৮
গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরলাম। গলির মুখে দেখি, পাশের এক ফালি জমিতে এক ঝাঁক শিউলি ফুল ঝরে আছে। দেখেই মনে হল, শরৎকাল আসার আর দেরি নেই। অন্ধকার রাত, ওই ফালি জমি যেন এক টুকরো আকাশ, ফুটফুটে নক্ষত্রের মতো এক রাশ শিউলি। আমি রিকশাওলাকে বিদায় দিয়ে ওখানেই নেমে পড়লাম। কুড়িয়ে দু-হাতের মুঠোয় তুলে নিলাম অনেকগুলি। ঘ্রাণ নিলাম। এরা শরতের অগ্রদূতী, পূর্ণ শরতের নয়, কেননা, বোঁটা এখনো সবুজ, জাফরানি রং ধরেনি।
মাঝরাত্রে বাড়ি ফেরার পথে, দ্রুত না বাড়ি ফিরে, আমি শিউলিতলায় দাঁড়িয়ে আছি, কীরকম যেন লজ্জা করতে লাগল। এ যেন বেশি-বেশি কবিত্ব। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, কেউ কোথাও আমাকে দেখছেনা, কেউ কোথাও জেগে নেই। তবু ভালো। কবিত্ব জিনিশটা আজকাল সর্বসমক্ষে আর আস্বাদ করা যায়না, ফোড়ার মতো লুকিয়ে রাখতে হয় ব্যাণ্ডেজের নিচে! প্রতিদিন সারাদিন আমিও আর সব আধুনিক মানুষের মতো কবিত্বহীন, স্পষ্ট সপ্রতিভ নৈর্ব্যক্তিক, একজন মানুষের দুঃখের কথা, শুনলে তৎক্ষণাৎ অভিভূত না-হয়ে, সামগ্রিক মানুষের দুঃখদুর্দশার বিষয়ে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় মেতে উঠতে পারি। কিন্তু এখন আমি একা, আমাকে কেউ দেখছেনা—সুতরাং শিউলিফুল হাতে নিয়ে দাঁড়ালে আমার আধুনিকতা নষ্ট হবেনা। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
শহরতলির সম্পূর্ণ নিঃশব্দ মধ্যরাতে সেই শিউলিফুল দর্শনে অকস্মাৎ আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। আমি শুনতে পেয়েছিলাম, কোথায় যেন একটা সরু রিনরিন শব্দ হচ্ছে। শিউলিফুল তৎক্ষণাৎ আমাকে ফিরিয়ে দিল বাল্যকাল, আমার জন্মস্থানের কথা মনে পড়ল।
রেলে খুলনা পর্যন্ত, তারপর স্টিমার। তখন আমরা স্টিমারকেই জাহাজ ভাবতাম—ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রায়ই মনে হত, নদী পেরিয়ে একদিন এ জাহাজ পথ ভুলে সমুদ্রে চলে যাবে। বর্ষার দিনে পদ্মাকেই মনে হত সমুদ্র —চোখদুটিকে দূরবীনের মতো সরু করে একটি বালক দূরে তাকিয়ে থাকত প্রাণপণে। ওপার দেখা যাবে কী দেখা যাবে না? হে ভগবান, যেন ওপার দেখা না-যায়—তাহলেই সমুদ্র আবার নদী হয়ে যাবে। বাবার পাশে বসে একজন পুরুতশ্রেণীর লোক ভ্যান-ভ্যান করছে—মাস্টারমশাই বেশি করে প্যালড্রিন এনেছেন তো? গ্রামের চারটি মানুষের উবগার হবে। ওসব কুইনিন টুইনিন কিছু না প্যালুড্রিন যা বেরিয়েছে—ম্যালেরিয়ার গুষ্টির পিণ্ডি করে ছাড়বে এবার। একেবারে মোক্ষম। কম্পাউণ্ডার বিষ্ণু আবার তাক বুঝে দেড়া দাম নেয়। বামুনের ছেলে—চামারের মতো ব্যবহার। আমি তো এক গ্রোস। স্টিমার থামবে মাদারিপুর, ভোরবেলা। আগের সারাদিন খাওয়া হয়নি—ফলমূল আর রুটি—তরকারি ছাড়া, কিন্তু ভাত ছাড়া আবার খাওয়া নাকি। একটিমাত্র হোটেল খুলেছে তখন খেসারির ডাল, বেগুন ভাজা আর ইলিশ মাছ—বাবা খেতে-খেতে আমাকে ধমকে বললেন, ইস দেখো, নতুন জামাটায় ঝোল লাগিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে বলবিনা—কোন দোকানে খেয়েছি। এটা কায়স্থদের হোটেল!—মাদারিপুর থেকে আবার নৌকো।
শিউলিফুল হাতে নিয়েই কেন মনে পড়ল বাল্যকালও জন্মস্থান? প্ৰত্যেক বছর পুজোর সময় যেতাম, তাই আমার জন্মস্থান শিউলিফুল-চিহ্নিত। প্রত্যেকবার নৌকো থেকে নেমেই দেখেছি, দরদালানের পাশে দু-তিনটি মেয়ে শিউলিতলায় ফুল কুড়িয়ে কোচড়ে তুলছে। আমাদের নৌকো দেখেই উৎসুক ডাগর আঁখি মেলে তাকাত। আমি কলকাতাফেরৎ বালক, সুতরাং বিলেতফেরতের ভঙ্গিতে কিছুটা অহঙ্কারময় গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলতাম, কিরে?—প্রথম দিনটা অন্তত, কলকাতার ছেলেমেয়েদের মতো চেনবসানো হলদে তুলোট গেঞ্জি পরে গর্বভরে সেই গাম্ভীর্য বজায় রাখবার চেষ্টা করতাম প্রাণপণে।
কতদিন যাইনি আর, পনেরো-ষোলোবছর, আর হয়তো কোনদিন যাবওনা, ইহজীবনে হয়তো আর আমার জন্মস্থান দেখার সুযোগই হবেনা। আজকাল আর মনেও পড়েনা। মনে পড়লেই তো ক্রোধ আর অভিমান আর দুঃখ। কে আর হৃদয় খুঁড়ে ওসব জাগাতে চায়? তার বদলে ভিয়েতনামের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা ভালো। বার্লিনের দেওয়াল নিয়ে প্রচুর তর্কাতর্কি করা যায়। আমার ব্যক্তিগত দুঃখ আমারই গোপনে থাকে। জন্মস্থান নিয়ে কথা বলতে গেলেই লোকে বলবে, ওসব খেলো কবিত্ব! আজকের মানুষ যখন বিশ্বনাগরিক হতে চলেছে—। তাহলে ব্যক্তিগত দুঃখের নামই কবিত্ব?
নিঃশব্দ রাত্রির শিউলিফুল আমার জগৎ ঢাকের শব্দে ভরিয়ে দিল। আমি শুনতে পাচ্ছি অবিরাম ঢাকের শব্দ, আর কয়েকটি ছাগলের চিৎকার। চক্রধরের নৌকো ঘাটে বাঁধা, তাই দেখতে আমি পায়ের নতুন জুতোর ফোস্কার কথা ভুলে ছুটে গেছি। প্রতিমা দো-মেটে হয়ে গেছে, এবার মুখ বসানো হবে। চক্রধরকে মনে হত ম্যাজিসিয়ান, ওর নৌকোয় হাজারটা নারকোলের খোলে হাজাররকম রং। আর সবার বাড়ির ঠাকুরের ছাঁচের মুখ, শুধু আমাদের বাড়িতেই চক্রধর প্রত্যেকটি মুখ নিজের হাতে মাটি টিপে-টিপে আমাদের চোখের সামনে বানাত। কী অহংকার ছিল চক্রধরের, মূর্তির মুখ বসাবার সময় সে এমন প্রকাশ্যে বিড়ি খেত যে গ্রাহ্যই করতনা কর্তাবাবুরা কাছাকাছি আছেন কি না! আমরা প্রত্যেকেই ভাবতাম—দেবীর মুখ শুধু আমারই দিকে আলাদাভাবে তাকিয়ে আছেন। আমি ডানদিকে গেলেও তাঁর চোখ আমার দিকে ফেরানো আমি বাঁদিকে গেলেও। চক্রধরের গড়া মূর্তি দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলেছিলেন, পিটি, ইউ ইমার্স দিস্ ওয়ার্ক অব আর্ট!— আরেকবার আমার কলেজে-পড়া মামাদের অনুরোধে বানানো হয়েছিল মিলিটারি—হাতে রাইফেল, আর কার্তিকের মুখখানা হয়েছিল অবিকল সুভাষ বোসের মতন, সেবার সেই ম্যাজিস্ট্রেটই খবর পেয়ে এসে মূর্তি ভেঙে ফেলার হুকুম দিয়েছিলেন। রাতারাতি নতুন মূর্তি গড়া হল, আমার দাদুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন বলেই, সেবার সিডিসনের অভিযোগে কারুকে গ্রেপ্তার করেননি। একমাস আগে থেকে চারটে কালো পাঁঠা কিনে রাখা হয়েছে। অষ্টমীর দিন দুটো আর সপ্তমী ও নবমীতে একটা করে বলি হবে। আমাদের ওপর ছিল ওদের তদারকির ভার। আমরা ঘাস খাওয়াবার নাম করে মাঠে নিয়ে গিয়ে ওদের সঙ্গে ছুটোছুটি করতাম। ঠাকুরদার বন্ধু বুড়ো নাসিরউদ্দিন মিঞা হেসে বলতেন, পোলাপানের কাণ্ড! ছাগলের যেন চোট না-লাগে। মায়ের পুজোয় নিখুঁত পাঁঠা লাগে কিন্তু!—ছাগলগুলোর এমন বেয়াড়া স্বভাব, ঘাসের বদলে ধানপাতা খেতেই ওদের লোভ বেশি। কথায়-কথায় ওরা ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ত। কচি-নধর ধানপাতায় কী ধার! আমি একবার ধানগাছ ধরে টান দিতেই ব্লেডের মতো ধানপাতায় আমার বুড়ো আঙুলটা কেটে এত ফাঁক হয়ে গেল যে, সাতদিন ন্যাকড়া বেঁধে রাখতে হল। সেবার পুজোর বলির পাঁঠা নিখুঁতই ছিল, কিন্তু আমি খুঁত ছিলাম!
অমন ধারালো ধানপাতা খেতে ওদের একটুও কষ্ট হতনা দেখে আমার ক্ষীণভাবে মনে হত, রামদার কোপ যখন ওদের গলায় পড়ে—তখনো ওদের কষ্ট হয়না! ঢাক-ঢোল-কাঁসির প্রবল আওয়াজের মধ্যে ডুবে যেত ওদের চিৎকার। একবার রক্ত ছিটকে লেগেছিল প্রতিমার পায়। তখনো আমি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি পড়িনি এবং শরীরে প্রথম রিপু জাগ্রত হয়নি—তাই ওসব দৃশ্যের নিষ্ঠুরতা স্পর্শ করতনা, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বলি দেখতাম। আমাদের মধ্যে শুধু একজন, পাশের বাড়ির একটি মেয়ে, শেফালি, ও দৃশ্য সহ্য করতে পারতনা। পুজোর দিন সকালে নতুন শাড়ি-আলতা-পরা পায়ে আনন্দে ছুটোছুটি করত শেফালি। সবসময় আমার পাশে-পাশে থাকত। বলিদানের সময়ের একটু আগে থেকেই ও গম্ভীর ও শান্ত হয়ে উঠত আস্তে-আস্তে। তারপর পাঁঠাটাকে স্নান করাবার সময় থেকেই শেফালি অদৃশ্য হয়ে যেত। লুকিয়ে থাকতো কোন্ গোপন ঘরে। শেফালির এই দুর্বলতা নিয়ে হাসাহাসি করত অনেকে। কী আশ্চর্য, আমিও এ নিয়ে ঠাট্টা করেছি শেফালিকে। শেফালি সবার বিদ্রুপের মধ্যে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকত—ওর একরাশ কোঁকড়া চুলের মধ্যে প্রস্ফুটিত কচি বিষণ্ণ মুখখানি আজও আমার মনে পড়ে। জগন্নাথ মামা ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও রুক্ষ ধরণের মানুষ, তাঁর রসিকতাজ্ঞান ছিল বিকট। তিনি একবার জোর করে শেফালিকে হিড়হিড় করে টেনে এনেছিলেন বলিদানের সময়। শেফালি অজ্ঞান হয়ে যায়। সেদিন থেকে ও মহাপ্রসাদ বা অন্য সময়ের পাঁঠার মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। তারপর থেকে ও বলির সময়ে চলে যেত—বাঁশবাগানের আড়ালে যেখানে ছিল আমাদের বাড়ির ছোট বাথরুম ও বড় বাথরুম। সেখান থেকে আর কেউ ওকে ধরে আনতে পারতনা। সেই তখন থেকেই শেফালির এমন কোমল মন ছিল যে, কালীপুজোর সময় কুকুরের লেজে ফুলঝুরি বেঁধে আমাদের খেলা ও একেবারে সহ্য করতে পারতনা, ছুটে এসে আমাদের বাধা দিতে চেয়েছে, আঁচড়ে-খিমচে অস্থির করেছে আমাদের।
একি, শিউলিফুল আমাকে মনে পড়াল শেফালির কথা? সেইজন্যই সরু রিনরিন শব্দে আমার বুক মুচড়ে উঠেছিল! কী ভুল করেছি রিকশা থেকে নেমে এসে শিউলিতলায় একা দাঁড়িয়ে! শেফালিকে আমি কিছুদিন আগে দেখেছি হাবড়ার উদ্বাস্তু কলোনিতে। না, না, আমি দেখিনি। তার কথা আমি আর কিছু বলতে পারবনা— অসম্ভব আমার পক্ষে! না, ওসব কথা আর আমি মনে করতে চাইনা।