আকাশ পাতাল – ৫

আমি অত্যন্ত চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম একি অতুলদা? একি চেহারা হয়েছে আপনার?

অতুলদা বিমর্ষভাবে হাসলেন শুধু। আমি ফের প্রশ্ন করলুম আপনার কোন কঠিন অসুখবিসুখ হয়েছিল নাকি।

–নারে, আমার কিছু হয়নি। বল্লবীর অসুখটাই—

অতুলদার সমস্ত চুল পেকে গেছে রাতারাতি, চোখদুটো কোটরগত, মুখে একজন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, পরাভূত মানুষের ছবি।

অবাক না-হয়ে উপায় নেই। মাসছয়েক আগেও অতুলদাকে দেখেছি, কী সুন্দর দীপ্ত ও তেজস্বী চেহারা। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতন সাবলীল, চকচকে কালো ঢেউ খেলানো মাথার চুল। আগে মার্চেন্ট নেভিতে যখন কাজ করতেন, তাঁর ধপধপে সাদা পোশাক ও নীল বর্ডার দেওয়া টুপি পরিহিত মূর্তি এখনও চোখের সামনে ভাসে। বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশের বেশি বয়েস নয় অতুলদার হঠাৎ এই কয়েকমাসে তাঁর এই বিস্ময়কর রূপান্তর —কল্পনাই করা যায়না।

অতুলদা ছিলেন আমাদের ছেলেবেলার হীরো। খেলাধুলো, পড়াশুনো সবদিকেই চৌকোশ, হো-হো করে হাসতেন, রেডিওতে যে-কোন গান শুনলেই গলা মিলিয়ে গাইবার চেষ্টা করতেন, সবসময় প্রাণবন্ত। সমস্ত ছেলেমেয়ের সঙ্গেই ছিল তাঁর আন্তরিক ব্যবহার–তবু কোন্ ফাঁকে তিনি শান্তাদির সঙ্গে প্রেম করে ফেললেন—আমরা বুঝতেই পারনি, শান্তাদির সঙ্গে যখন ওঁর বিয়ে হল—সবাই একবাক্যে বলেছিল, এমন আদর্শ দম্পতি সচরাচর দেখা যায়না। মেরিন এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে অতুলদা একটা ইটালিয়ান জাহাজ কম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন, বছরে তিন-চারমাস মাঝসমুদ্রে কিংবা দূর-দূরদেশের বন্দরে কাটিয়ে আসতেন। ফিরে আসার পর অতুলদার শরীরে আমরা কল্পনায় বিদেশের সৌরভ পেতাম।

শুধু রোমান্টিক দিকটাই নয়। অতুলদার ন্যায়-অন্যায় ও আদর্শবোধ ছিল অত্যন্ত তীব্র। যেটাকে তিনি অন্যায় কিংবা যুক্তিহীন মনে করতেন, সেটা তিনি অন্য কারুর কথায় কিংবা অনুরোধেও মেনে নিতেন না। আদর্শজ্ঞান তো অনেকেরই থাকে—কিন্তু জীবনে ক’জন আর তা মেনে চলতে পারে? অনেকসময়ই গুরুজন, আত্মীয়স্বজনের যুক্তিহীন অনুরোধে অনেককিছুই ঢোক গিলে সহ্য করে যেতে হয়। অতুলদাকে ঐজন্য আমরা আরও বেশি শ্রদ্ধা করতাম।

অতুলদা প্রথম চমকপ্রদ কাজ করেছিলেন তাঁর বাবার মৃত্যুর পর। ওঁর বাবার যখন হঠাৎ স্ট্রোক হল, অতুলদা পাগলের মতন ছোটাছুটি করেছিলেন, কলকাতার সবচেয়ে বড় স্পেশালিস্টকে জোর করে ধরে এনেছিলেন মাঝরাত্রে, শেষরাত্রে ধর্মতলা থেকে ওষুধ এনেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর বাবা মারা গেলেন। মৃত্যুর পর, অতুলদা আড়ালে কেঁদেছিলেন কি না আমরা দেখিনি, কিন্তু অতুলদা অশৌচ পালনে অস্বীকার করলেন, মাথা ন্যাড়া হলেননা, এমনকী শ্রাদ্ধ করতেও রাজি হলেননা। তাঁর আত্মীয়স্বজন, শ্বশুর-শাশুড়ি এসে অনুনয়-বিনয়, ভৎসনা, তিরস্কার কতকিছু করলেন কিন্তু অতুলদা অটল। তিনি বলেছিলেন, আমার বাবাকে আমি বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছি, তা যখন পারিনি—তখন এসব অবান্তর জিনিশ নিয়ে আমি সময় নষ্ট করতে চাইনা। আমি এসব বিশ্বাস করিনা, আমি পরলোক মানিনা, শুধু-শুধু কতকগুলো সামাজিক সংস্কার আর ভড়ং-এর জন্য আমি টাকা খরচ করতেও রাজি নই, কষ্ট সহ্য করতেও রাজি নই। আমার মা যদি বেঁচে থাকতেন, তাঁকে খুশি করার জন্য না হয় আমি এসব করতাম কিন্তু তিনিও বেঁচে নেই—শুধু-শুধু কতকগুলো বামুনকে আমি ডেকে এনে খাওয়াবই-বা কেন, আর ন্যাড়ামাথায় অফিসে যাবই-বা কেন?

পরলোকে অনেকেই বিশ্বাস করেনা, অনেকেই আজকাল ঠাকুর-দেবতা মানেনা কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বিদ্রোহ সত্ত্বেও এখনো প্রায় সব হিন্দু পরিবারেই এসব উপরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। ক’জন দৃঢ়তা বজায় রাখতে পারে? অতুলদা পেরেছিলেন। পণ নিয়ে বিয়ে হচ্ছে শুনলে তিনি সে বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে যেতেননা পর্যন্ত।

জাহাজে চাকরি ছেড়ে অতুলদা এক্সপোর্টের একটা এজেন্সি খুলেছিলেন—অল্পদিনেই তাতে বেশ সমৃদ্ধি ঘটল। ইদানীং কাজে খুব ব্যস্ত থাকতেন—কিন্তু মাঝে—মাঝে যখনই দেখা হয়েছে, অতুলদা সেইরকম হাসিখুশি উচ্ছল মানুষ, নিছক কেজো ব্যবসায়ী হননি। জরুরি কাজ ফেলেও আড্ডায় মশগুল হয়ে যেতে দেখেছি। ছ’মাস আগেও দেখেছি তাঁর ঈর্ষণীয় সুন্দর স্বাস্থ্য। হঠাৎ এর মধ্যে এই বদল?

জিজ্ঞেস করলাম, বল্লরী কেমন আছে এখন? ওর কী যেন অসুখ হয়েছে শুনেছিলাম, দেখতে যেতে পারিনি—

অতুলদা ক্লান্তভাবে বললেন যাস একদিন, তাড়াতাড়ির মধ্যে। ও আর বেশিদিন বাঁচবেনা।

—বাঁচবেনা? কী হয়েছে?

বল্লরী অতুলদার একমাত্র মেয়ে। এখন পনেরো-ষোলো বছর বয়স। অমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে আমি আর কোথাও দেখিনি! নিখুঁত সৌন্দর্য একেই বলা যায়। শুধু ফর্শা নয়, তার শরীরে একটা গোলাপি আভা, একরাশ কালো চুল প্রায় কোমর পর্যন্ত, চঞ্চল সরল দুই চোখ, যে-কোন সময় ওর ঠোঁট দেখলেই মনে হয়—যেন এইমাত্র হাসি শেষ করল। বল্লরীর শুধু একটা খুঁত ছিল, তার অতিরিক্ত ঘাম হত। শীতকালেও কুলকুল করে ঘামতে দেখেছি তাকে। সেটার আমরা কোন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু শুনলাম, বল্লরীর সাংঘাতিক অসুখ এখন।

এখন বল্লরীর অসম্ভব ঘাম হয়, সবসময় টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ে, এই বয়েসেই তার ব্লাডপ্রেসার দারুণ এরাটিক। কখনো আশি, কখনো আড়াইশো। তাছাড়া আজকাল আবার সারাদিন তিন-চারবার তার হাত-পা কাঁপতে থাকে মৃগী রোগীর মতন, একটু বাদেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আরো সাংঘাতিক, মাসচারেক আগে থেকে বল্লরীর কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে গেছে, এখন সে একেবারে বোবা, একটি শব্দও বার করতে পারেনা। অমন সুন্দর মেয়েটির এই নিদারুণ রোগের কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম, অতুলদা ধীরস্বরে সব বলে যেতে লাগলেন।

বল্লরীর এই অদ্ভুত অসুখ বছরখানেক আগে থেকেই ধরা পড়েছিল। এদেশের কোন ডাক্তার এর চিকিৎসা খুঁজে পাননি। সারা ভারতবর্ষে যেখানে যত স্পেশালিস্ট আছে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অতুলদা। কেউ আশা দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কার কাছে শুনলেন, রাশিয়াতে এই রোগের চিকিৎসা হয় সর্বস্ব বিক্রি করেও অতুলদা রাশিয়ায় গিয়ে বল্লরীর চিকিৎসা করাতে রাজি ছিলেন, ভারত সরকারের অনুমতিও পেয়েছিলেন, কিন্তু রুশ ডাক্তারদের চিঠিপত্র লিখে রোগের বিবরণ জানাবার পর তাঁরা জানিয়েছেন এ রোগের কথা তাঁরা জানেন বটে, এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে—কিন্তু এর কোন ওষুধ তাঁদেরও জানা নেই। তাঁরা বল্লরীকে বাঁচাতে পারবেননা—ষোলো থেকে আঠারো মাসের মধ্যে সে মারা যাবে। তাঁরাই আগে বলেছিলেন, বল্লরীর কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যাবে, অজ্ঞান হওয়া আরো বাড়বে—ক্রমশ এক-একটা প্রত্যঙ্গ অক্ষম হয়ে যাবে—রুশ ডাক্তারেরা যা উপসর্গ বলেছেন, তা একটার পর একটা ঠিক মিলে যাচ্ছে। বল্লরী বাঁচবেনা।

কিন্তু অতুলদা শুধু এতেই ভেঙে পড়েননি। তাঁর পরাজয় অন্য জায়গায়। অপমানিত, লাঞ্ছিত মানুষের মতন শুকনো হেসে অতুলদা বললেন, এই দ্যাখ! জামার হাতা গুটিয়ে তিনি দেখালেন, তাঁর বাহুতে বাঁধা নানান সাইজের একগাদা কবচ আর তাবিজ। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলামনা।

বল্লরীর নিয়তি অতুলদা শান্তভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। তার শেষ দিন ক’টি যতদূর সম্ভব আনন্দ ও শান্তিতে কাটাতে পারে—তিনি সেই চেষ্টা করছিলেন, এমন সময় অতুলদার শ্বশুর কোথা থেকে এক সন্ন্যাসীকে ধরে আনলেন। সন্ন্যাসী নাকি যাগযজ্ঞ করে বল্লরীকে সারিয়ে তুলতে পারবে। অতুলদা তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি ওসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করেননা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা যে-রুগীকে জবাব দিয়েছে সে সেরে উঠবে ধুলোর ধোঁয়ায়। অনেক অনুনয়-বিনয় কাকুতি-মিনতির পর অতুলদা শুধু এইটুকু রাজি হয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেমতন যাগযজ্ঞ যা খুশি করতে পারেন, কিন্তু বল্লরীকে কোন কষ্ট দেওয়া চলবেনা আর অতুলদা নিজে সেই সময়ে বাড়ি থাকবেননা। .

কিন্তু জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর শর্ত অন্যরকম। তাঁর যজ্ঞে মেয়ের বাবাকেই প্রধান অংশ নিতে হবে, হোম করতে হবে, হাতে তাবিজ ধারণ করতে হবে এবং একদিন তারকেশ্বরে গিয়ে হত্যে দিয়ে থাকতে হবে। এসব শুনে অতুলদা রাগে জ্বলে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা ওসবে বিশ্বাস করে—তাদের এসবে ফল ফলতেও পারে—কিন্তু আমি ওসব মানিনা; মানিনা। আমি কিছুতেই পারবনা।। অতুলদার মামাশ্বশুর, সন্ন্যাসীকে জোগাড় করার কৃতিত্ব যার—তিনি বললেন, কিন্তু বাবা, যদি মেয়েটা এতে কোনক্রমে বেঁচেই যায়, তাহলে তোমার নিজের একটু কষ্ট হলেও—

সেই সময় অতুলদার চোখ পড়েছিল দরজার দিকে। বল্লরী এসে দাঁড়িয়েছে নীরবে ডাগর চোখদুটি মেলে আছে। কথা বলতে পারেনা বল্লরী—কিন্তু এখনো সব শুনতে পারে, বুঝতে পারে। শান্তাদি বিছানার ওপর পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। শান্তাদির আর কোনরকম মনের জোর নেই, এখন তিনি যে-কোন ভরসার খড়-কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চান। হঠাৎ অতুলদার মনে হয়েছিল -এখন এই সন্ন্যাসীর বুজরুকিতে যদি তিনি রাজি না হন—তাহলে শান্তাদি হয়তো সারা জীবন এই দুঃখ পুষে রাখবেন যে—অতুলদা যদি যাগযজ্ঞ করতেন—তাহলে, বাঁচতে পারত। এমনকী বল্লরীও হয়তো মৃত্যুর আগে শেষ দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময় ভেবে যাবে—তার বাবা তাকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করেনি। সবাই ভাববে মেয়ের জীবনের চেয়েও অতুলের নিজের গোঁয়ার্তুমিটাই বড়! শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন অতুলদা, আজীবন নাস্তিক হয়েও দুদিন ধরে যজ্ঞ করেছেন, হাতে পরেছেন তাবিজ এমনকী তারকেশ্বরেও গিয়েছিলেন।

কিছুই সুফল হয়নি, রুশ ডাক্তারদের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী বল্লরীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ দিকে যাচ্ছে। বল্লরী বাঁচবেনা, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের আদর্শেরও মৃত্যু হওয়ায় অতুলদা ভেঙে পড়েছেন। তিনি এখন অন্তরে দগ্ধ; পরাজিত মানুষ, হ্যাজাক বাতির ম্যান্টলের মতন, আকৃতি বজায় রাখলেও আসলে পোড়া ছাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *