৩
ভ্রমণকাহিনী পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। গল্প-উপন্যাস পড়ে প্রায় নিরাশ হতে হয়, কিন্তু ভ্রমণকাহিনীতে সে সম্ভাবনা নেই, লেখাটা ভালো হোক বা না—হোক—কিছুক্ষণের জন্য তো সেই বর্ণিত জায়গাটায় মনে-মনে ঘুরে আসা যায়।
আমার নিজেরও ইচ্ছে করে একটা ভ্রমণকাহিনী লিখে ফেলি। কিন্তু কোন্ জায়গার কথা লিখব, কোন দুর্গম পাহাড়ে কিংবা অচেনা জনপদে তো যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি এই পৃথিবীর কত রহস্য, কত মনোহারিণী শোভা আমার চোখের আড়ালেই রয়ে গেল। বছরের পর বছর কলকাতা শহরেই বন্দি হয়ে আছি। কিন্তু ভ্রমণকাহিনী লেখার খুবই সাধ আমার। তাই ঠিক করলুম, কলকাতা শহরের একখানা ভ্রমণকাহিনী নিয়েই হাতেখড়ি করা যাক।
এক নাতিশীতোষ্ণ অপরাহ্ণে, খাঁটি পরিব্রাজকের মতন সঙ্গে কিছু মালপত্র না-নিয়ে পকেটে সামান্য কিছু টাকাকড়ি, আমি কলকাতার পাইকপাড়া অঞ্চলে একটি নীলরঙা দোতলা বাসে উঠে বসলাম। বাসটি সেখান থেকেই ছাড়ে, সুতরাং বেশ ফাঁকা ছিল, দোতলার জানালার পাশে একটি বহু আকাঙ্ক্ষিত আসন পাওয়া গেল। সেইদিনই যে ভ্রমণ করার খুব একটা ইচ্ছে আমার ছিল, তা নয়, জীবনে অনেক মহৎকার্যের মতন আমার সেই অপরাহ্ণভ্রমণও আকস্মিক। আমার উদ্দেশ্য ছিল শিয়ালদহ নামক অঞ্চলে নেমে কোন একটি কর্তব্য সমাপন, কিন্তু তা বদলে গেল কার্যকারণবশত। সূত্রপাত হল এইভাবে যে, বাস ছাড়ার আগেই বিড়িতে শেষ টান দিতে-দিতে কণ্ডাক্টর মহোদয় টিকিটগুচ্ছে আঙুল চালিয়ে আমার নাকের সামনে এনে এক প্রকার উৎকট শব্দ করতে লাগলেন। আমি তখন পথের সৌন্দর্য নিরীক্ষণে ব্যস্ত ছিলাম। সেই শব্দে চমকিত হয়ে প্রশ্ন করলুম, কী? তিনি বললেন টিকিট! আমি আমার পকেট থেকে সযত্নে রক্ষিত পাঁচ টাকার নোটটি এগিয়ে দিলাম। কণ্ডাক্টর সেদিকে পলকের মাত্র চাহনি দিয়ে বিরক্তমিশ্রিত স্বরে বললেন, পাঁচ টাকা? নেমে যান!
আমি হতবাক।
আমার বরাবরই কলকাতা শহরে বাসের ভাড়ার ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। ধরা যাক একশো মাইল দূর থেকে কেউ ট্রেনে চেপে কলকাতা শহরে আসতে চায়। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলে ভাড়া তিন টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছ’টাকা, প্ৰথম শ্ৰেণীতে প্রায় বারো টাকা দিতে হবে। একই দূরত্ব, একই ট্রেন, শুধু আসনের আরাম অনুযায়ী বিভিন্ন দাম। অথচ কলকাতায় শ্যামবাজার থেকে বালিগঞ্জগামী বাসে যারা হাতল ধরে ঝুলছে, যারা ভিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে, যারা অস্থায়ী মহিলা আসনে বসে সদা কম্পিত, যারা জানালার পাশে নিশ্চিত আরামের আশ্রয় পেয়েছে—সকলেরই টিকিটের ভাড়া এক হয় কী প্রকারে? সুতরাং আমার মনে হল, কর্তৃপক্ষের বুঝি এতদিনে চেতনা ফিরেছে। দোতলায় জানালার ধারের আসনকে এয়ারকণ্ডিশনড় কামরার মর্যাদা দিয়ে ভাড়া বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি সভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কত ভাড়া? কণ্ডাক্টরটি পুনশ্চ বিরক্তিভরে বললেন, বললুম তো খুচরো নেই। নেমে যান! নেমে যান!
শাস্ত্রে আছে, যেসব মানুষের শরীর অত্যধিক রোমশ হয়, যাদের বর্ষাকালে জন্ম, যাদের শরীর রোগা নয় আবার খুব স্থুলও নয়, যাদের চোখ বড় কিন্তু নাক ছোট, যারা দ্রুত স্নান সারে কিন্তু খাবার খেতে দেরি করে, যারা দিনে ঘুমোয় কিন্তু অধিক রাত্রি পর্যন্ত জেগে থাকে, সেইসব মানুষ অত্যন্ত গোঁয়ার প্রকৃতির হয়। আমার সঙ্গে এর প্রত্যেকটার মিল থাকা সত্ত্বেও—আমি গোঁয়ার গোবিন্দ হিসেবে তেমন পরিচিত নই। কিন্তু এক নিরুপদ্রব বিকেলবেলা নিশ্চিন্তভাবে বাসের জানালায় বসেছি, এমন সময় আমার সঙ্গে ভালো করে কথা না-বলেই ‘নেমে যান’ বলায় চড়াৎ করে আমার মেজাজ সপ্তমে উঠল। একবার বললেও হয়তো অতটা মনে করতামনা, কিন্তু পরপর দুবার নেমে যান নেমে যান আমার কানে অতিশয় রুক্ষ শোনাল। তখন আমি স্থিরভাবে বললুম আমি নেমে যাবনা, আমি এখানেই বসে থাকব। এই বাস যতদূর যায় ততদূর যাব তার মধ্যেও যদি আপনার খুচরো না হয়—তবে এই বাস যতবার আজ যাতায়াত করবে—আমি এখানেই বসে থাকব—যদি তাতে পাঁচ টাকার পুরো ভাড়া হয়!
অতএব এরপর আমার যাত্রার আর কোন উদ্দেশ্য রইলনা, আমি ভ্রমণকারীর মতন নিরাসক্তভাবে বসে রইলাম। অন্যদিন কাজের জন্য বাসে চাপতে হয়, তখন তাড়া থাকে কতক্ষণে পৌঁছুব। আজ সেরকম কিছু নেই বলেই—অনেককিছু চোখে পড়তে লাগল।
পাইকপাড়ার রাজা-রানীদের স্মৃতিমণ্ডিত রাস্তা ধরে বাস ছুটছিল, অচিরে তা দুবার ডানদিকে বেঁকে বেলগাছিয়ায় এসে পৌঁছুল। বেলগাছিয়ার রাস্তাটুকু অতিশয় অভিনব। এখানে বাস কিছুক্ষণ ঘোড়ার চাল অনুসরণ করে। প্রতি কদমে বাসটি লাফিয়ে উঠছে ও ডানদিকে-বাঁদিকে হেলছে—সেই অনুযায়ী যাত্রীরাও! একেবারে সামনের আসনে কয়েকটি শিশু ছিল তারা আনন্দে খলখল করতে লাগল। আমার মনে পড়ল, অতিশৈশবে দার্জিলিং গিয়ে বাবার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠে চেপে আমারও এইপ্রকার আনন্দ হয়েছিল। যেসব বাচ্চারা আজকাল দার্জিলিং যেতে পায়না— তাদের আনন্দের জন্যই বোধহয় বেলগাছিয়ার রাস্তায় এই বন্দোবস্ত। তারপরেই বাসের নৃত্য থামল, জলের সরসর শব্দ কানে এল। তাকিয়ে দেখি ব্রিজের পাদদেশ সম্পূর্ণ জলমগ্ন। গত পূজার পর আর একদিনও বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে পড়েনা —কিন্তু বেলগাছিয়া ব্রিজের কাছে কোমর জল, বাস তার মধ্যে সাঁতার কাটতে লাগল। কলকাতার বাসগুলি সত্যিই বাঘের বাচ্চা—জল-স্থলের কোন বাধাই তারা মানেনা, মনে হয় শূন্যপথেও তারা যাতায়াতে পারঙ্গম। এক মহিলা সেই কোমর জলে রিকশা চেপে আসছিলেন, রিকশা থেকেই তিনি বাসের পাদানিতে লাফ দিয়ে পড়লেন।
বাস ব্রিজের ওপর উঠল, এবার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব। ব্রিজটি বেশ উঁচু, দূরে অনেক নিচে শ্যামবাজারের গমগম জনতা। ব্রিজের দুপাশে বহু আঁকিবুকি কাটা রেললাইন—দিগন্তবিস্তৃত শূন্যতা—মেদুর সন্ধ্যা তার ওপর ঝুঁকে আসছে। ডানধারে পার্শ্বনাথের ঠাণ্ডা ছিমছাম মন্দির, ভিতরে জলাশয়, তার আশেপাশে সুবেশ নরনারী। বাঁদিকে একটি শিবমন্দিরের শুধু চূড়াটুকু উঠে আছে, তার ওপর প্রাইভেট বাসের কণ্ডাকটররা কী কারণে যেন পয়সা ছুঁড়ে দেয়। বাস এখানে একবার শরীর ঝাড়া দিল, যেন শহরতলি ছেড়ে শহরে ঢুকবার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছে। শ্যামবাজারে এসে থামা মাত্র একটা বিশাল ভিড় বাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শ্যামবাজার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত সার্কুলার রোডের একটি বিশেষত্ব আছে —এতদিন চোখে পড়েনি। সার্কুলার রোডের বাঁপাশে প্রায়শই বস্তি, কিন্তু ডানপাশে সবই প্রায় পাকাবাড়ি। সার্কুলার রোডের মতন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এত বস্তি কেন, বস্তির বদলে ব্যারাকবাড়ি তুলে দিলে অনেক স্থান সঙ্কুলান হত—এসব কথা তুলছিনা। একটা রাস্তার একদিকে বেশি বস্তি, অন্যদিকে বেশি পাকা-বাড়ি—এর কারণ কী? তখন মনে হল, হয়তো কলকাতার প্রাচীন কালের চিহ্ন এখানে এখনও রয়ে গেছে। সার্কুলার রোড তো খাল-ভরাট-রাস্তা। বর্গির হাঙ্গামার ভয়ে যে খাল কাটা হয়েছিল—সেটাকেই পরে বুজিয়ে রাস্তা হয়েছে। অর্থাৎ এই রাস্তাটির ডানদিকে ছিল কলকাতা শহর বাঁদিকে গ্রাম—বাঁদিকের বস্তিগুলোয় এখনো বোধহয় সেই গ্রামের চিহ্ন রয়ে গেছে।
শিয়ালদহে এসেও আমার মন কেমন করলনা। বিবাগী ভ্রমণে বেরিয়েছি -আজ আর কর্তব্য-কর্ম থাক। ইতিমধ্যে পুরানো যাত্রীরা অধিকাংশ নেমে গিয়ে নতুন যাত্রীদল উঠেছে। এক-এক এলাকার যাত্রীদের পোশাকেও কিছু-কিছু সূক্ষ্ম তফাৎ আছে—কিন্তু সে প্রসঙ্গ থাক। মৌলালি থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই দৃশ্য আমূল বদলে গেল। এ এক নতুন কলকাতা। ঝকঝকে পরিষ্কার দুপাশের বাড়িগুলি নতুন, জানালার পরদায় হরেক শোভা। বারান্দায় রেলিং ধরে ঝোঁকা মেয়েরা স্বাস্থ্যবতী, পুরুষদের পা-য় হরিণের চামড়ার চপ্পল। পথও দুভাগ করা, মাঝখানে সবুজ ঘাসের নর-চারণ ক্ষেত্রং। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আলেকজাণ্ডার যখন দিগ্বিজয়ে বেরন, তখন তাঁর গুরু অ্যারিস্টটল নাকি বলেছিলেন, পৃথিবীর যত জায়গাতেই যাও, মানুষের মতন এত আশ্চর্য জিনিশ আর কিছুই দেখবেনা। সুতরাং বাসের জানালায় বসে আমি যে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যই দেখছিলাম, তা নয়, দোতলার প্রত্যেক যাত্রীর ওঠা-নামা এবং ধরন-ধারণও লক্ষ করছিলাম। তাছাড়া আজকালকার ভ্রমণকাহিনীতে একটি সুন্দরী নায়িকা এবং দুটো-একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা না-থাকলে জমেনা। আমার এ ভ্রমণকাহিনীতেও তার অভাব নেই, যথাসময়ে বলছি।
বাস তখন ভিড়ে ভর্তি অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েদের দুটি আসনই ভর্তি, তাছাড়াও দু-একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমি বসেছি অনেক দূরে, সেখান থেকে হঠাৎ শিভারি দেখাবার অবকাশ নেই। আমার পাশে আগাগোড়া বসে আছে একজন হিন্দুস্থানী, তার প্রতি আমার রাগের উদ্রেক হবার কোনই কারণ নেই, কিন্তু তার কাঁধে একখানি ময়লা গামছা। আমার বারবার তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, এই ভর সন্ধ্যাবেলা তুমি কী বাসে চেপে কোথাও স্নান করতে যাচ্ছ? তা যদি না হয় তবে ঐ মহামূল্য গামছাখানা বাড়িতে রেখে এলে কী তুলসী দাসের রামায়ণ অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমার সামনের সীটের দুজন প্রৌঢ় অত্যন্ত নিস্পৃহ গলায় পঞ্চাশ হাজার কিংবা ষাট হাজার টাকার কী একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছেন! পিছনের সীটে দুজন যুবক ভারতের ক্রিকেটভাগ্য নিয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত। একেবারে সামনের সীটে বসা এক ভদ্রলোক একেবারে পিছনের সীটে-বসা একজন চেনা লোককে দেখে চিৎকার করে সারা বাস শুনিয়ে ঘোঁতনদার বিয়ের দিন কী কাণ্ড হল সেই গল্প শুরু করলেন। বাস সি আই টি রোড ছেড়ে বাঁদিকে বেঁকল।
বণ্ডেল রোড, চার নম্বর গেট এইসব নামগুলো কেমন যেন অচেনা। এতকাল কলকাতা শহরে আছি, অথচ চার নম্বর গেটের পাশে থাকি—একথা কারুকে বলতে শুনিনি। অথচ, কণ্ডাক্টর চার নম্বর গেট, চার নম্বর গেট বলে চেঁচাচ্ছে—অমনি একদল লোক হুড়মুড় নেমে যাচ্ছে, একদল লোক উঠছে। এখানেও তো কম লোক থাকেনা। আমার ইচ্ছে হল, একদিন পায়ে হেঁটে এ রাস্তা দিয়ে ঘুরব। এখানে রাস্তাটা খুব ছোট, দুটো বাস পাশাপাশি এলে সরু হয়ে কাৎ হয়ে যেতে হয়। উগ্র কাচা চামড়ার গন্ধ। পাশে রেললাইন। ছোট-ছোট খাপরার ঘরে গরু-ছাগল আর মানুষ একসঙ্গে রয়েছে। রাস্তায় কয়েকটি উলঙ্গ ছেলে। বড় শহরের এইরকমই বৈশিষ্ট্য ‘বড়’র পিরীতি বালির বাঁধ ক্ষণেক হাতে দড়ি খনেক চাঁদ’। এইমাত্র ছিল সি আই টি রোড়ের চমৎকার রাস্তা, সাজানো বাড়ি-ঘর— মাঝখানে চামড়ার হঠাৎ গন্ধ আর বস্তি আর আবর্জনা—আমার একটুপরেই বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে মর্ত্যের স্বর্গ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে বাস হাজরা রোডে পড়ল।
এখানে হঠাৎ বাস প্রায় খালি। মনে হয় বাসে চড়ার মানুষ এসব রাস্তায় খুব কম থাকে। এখন দোতলা বাসের জানালার ধারে-ধারে একজন-একজন বসে আছে। পাশের সীটগুলো প্রায় ফাঁকা। আমার পাশের লোকটিও কখন যেন নেমে গেছে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, হঠাৎ উগ্র সেন্টের গন্ধ নাকে লাগল।
‘আপনি একটু উঠে অন্য সীটে বসবেন?’
চমকে উঠলাম। কণ্ডাকটর নয়, এক তরুণী, হালকা নীল-রঙা নাইলন জর্জেট পরা, কানে দুটি মুক্তোর দুল। মেয়েটিকে সুন্দরীই বলতে পারতাম, কিন্তু ঐ বিশ্রী সেন্টের গন্ধ সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছিল। মেয়েটির পিছনে বাচ্চাছেলে কোলে নিয়ে একটি পুরুষ, পুরুষটিকে দেখলেই বোঝা যায়—কোন এক গোধূলি লগ্নে তিনি তাঁর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে দাসখত লিখে দিয়েছেন। ব্যাপারটা বোঝা গেল, বাসের প্রায় সবকটা আসনই একটা-একটা খালি, ওঁরা পাশাপাশি বসতে চান। মেয়েটি ব্যগ্র গলায় আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি একটু উঠে অন্য সীটে বসবেন’?
আমি মেয়েদের অন্ধ স্তাবক। কিন্তু এটুকু জানি মেয়েদের আর যত গুণই থাক—সামগ্রিকভাবে অধিকাংশ মেয়েরই ভদ্রতাবোধ তেমন প্রবল নয়। ট্রামে—বাসে হিলতোলা জুতোয় পুরুষদের পা মাড়িয়ে দিয়ে মেয়েরা অক্লেশে ভ্রূক্ষেপহীন থাকে, লেডিস সীটে বসে থাকা পুরুষদের তুলে দিয়ে তাদের প্রতি একটু সামান্য কৃতজ্ঞতার হাসি বিলোতেও তারা কার্পণ্য করে। এমনকী এইধরনের স্বার্থপর অনুরোধও তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। এইজন্যই পুরুষটি সলজ্জ মুখে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাইহোক, মেয়েদের দেখে তড়াক করে আসন ছেড়ে দিতে আমার বেশ ভালোই লাগে, তাতে মনের মধ্যে একধরনের সুড়সুড়ি বোধ করি। কিন্তু এক্ষেত্রে ঐ বিশ্রী সেন্টের গন্ধের জন্য মেয়েটিকে আমি গোড়া থেকেই অপছন্দ করেছিলাম। আমি বিলাতপ্রেমিক নই, কিন্তু দিশি সেন্টের গন্ধের চেয়ে ঘামের গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ, কাচা চামড়ার গন্ধ, পেট্রোল পোড়ার গন্ধ এসব স্বাভাবিক গন্ধও আমার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু মেয়েটির অনুরোধ তো প্রত্যাখ্যান করা যায়না। সেইজন্য শীতকালের পুকুরে স্নান করতে নামার সময় যেরকম আলস্য লাগে—সেইরকম ভঙ্গিতে আমি চটিতে পা গলাতে-গলাতে বললুম, উঠতে হবে? আচ্ছা—
মেয়েটি বোধহয় আমার ভঙ্গি দেখে অপমানিত বোধ করল। আমার কথার উত্তর না-দিয়ে মেয়েটি সামনের সীটের আরেকজন পুরুষের পাশে বসে পড়ে স্বামীকে বলল, তুমি ওখানেই বসো—একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়না…পুরুষটি লাজুক মুখে আমার পাশে বসলেন। আমি হাসি চেপে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ চুপচাপ
একটু পরেই মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল, ঐ তো ট্যাক্সি যাচ্ছে, ডাকোনা, ট্যাক্সি! ট্যাক্সি!
রাস্তা দিয়ে আলো জ্বালিয়ে একটা ট্যাক্সি যাচ্ছিল, পুরুষ ও নারীটি বাসের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সমস্বরে চেঁচাতে লাগল সেটার উদ্দেশ্যে। ট্যাক্সিটা হঠাৎ থেমে পড়ল এবং দোতলা বাস তার পিছনে একটা ঢু মারল। সঙ্গে-সঙ্গে কেঁপে উঠল জগৎসংসার, ঝন ঝন ঝন আমার কপাল ঠুকে গেল সামনের সীটে, মেয়েটি হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। বাসসুদ্ধু লোক চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাকসিডেন্ট! অ্যাকসিডেন্ট!
সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তার ভিড়, দুপদাপ করে আমরা সবাই বাস থেকে নেমে পড়লাম। সেই মেয়েটির হাত ধরে পুরুষটি পিছনদিকে দ্রুত পালাল। আমার ভ্রমণপর্বেরও সেইখানেই শেষ।
ভ্রমণের অশেষ উপকারিতা। সেদিন আমি ভ্রমণ করব এই মনস্থ করাতেই শেষপর্যন্ত আমার বাসের ভাড়া লাগেনি।