২
এই সংসার, শূন্য এক ছায়াবাজি
পুতুলের পুতুল খেলা। পৃথিবী এক তাজ্জব জায়গা। কোথা থেকে আসা কোথায় ভেসে যাওয়া! সংসারী জানে না। বিজ্ঞানী জানে না। প্রকৃত সাধক হয়তো রহস্যের সন্ধান জানেন। কিছু বলতে চান না। মুচকি হাসেন। জীবনের পাতা উলটে যাও। দেখো না কি পাও! শেষ অধ্যায়ে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে যেতে পার কি না দেখো না! হয়তো মনে হতে পারে, প্রবাস থেকে স্ব—বাসে চলেছি। আশেপাশে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে তাদের দেখে মনে হতে পারে। তোমরা কারা? কাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেলুম প্রবাসজীবন! স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, পরিজন, সদ্যসমাপ্ত নতুন বাড়ি, প্রিয় ঝুল বারান্দা, মাধবীলতা, কেয়ারি বাগান, আরাম কেদারা, ক্যাশ সার্টিফিকেট, ব্যাংকের পাশ বই, মেয়ে—জামাই সব পড়ে রইল। রথ চলেছে আলোর কণা ছড়িয়ে, দূর থেকে দূরে। সংসার বিদেশ ছেড়ে মন চলেছে নিজ নিকেতনে। বিদেশির বেশে অকারণে আর ঘুরতে হবে না।
কুছ নাহী কা নাঁর ধরি ভরসা সব সংসার।
সাচ ঝুঠ সমঝৈ নহী না কুছ কিয়া বিচার।।
কিছু না, সবই শূন্য। সেই শূন্য নিয়ে যত লড়ালড়ি। ন্যাজ তুলে দেখার অবসর হল না, এঁড়ে না, বকনা! সত্য মিথ্যার হদিশ মিলল না। বিচার! তাও করা হল না। হেগে, মুতে, চিৎকার, চেঁচামেচি করে, মাগের দাসত্ব করে, সংসারের খিদমত খেটে, নাটের গুরু অক্কা পেলেন। যাবার সময় কণ্ঠে ঘড়ঘড়ানির শব্দ। চারপাশ থেকে নানা প্রশ্ন, কী কষ্ট হচ্ছে তোমার? কিছু বলবে? কী দেখছ অমন করে? যার ছুঁচ—ফোটানো কথায় একদিন সবাই জ্বলত, যার জ্ঞানের প্লাবন একদা সংসার ভাসিয়ে নিয়ে যেত, সে আজ বাক্যহারা। অসহায় দুটি হাত কাকে যেন ধরতে চাইছে! চোখ কপালে উঠে গেল। জিভ ঝুলে গেল। ইংরেজ হলে কায়দা করে বলতেন, হি হ্যাজ কিকড দি বাকেট। জীবনপাত্র উলটে দিয়ে দেনাপাওনার মানুষটি সরে পড়েছে। আর হাঁচবে না, কাশবে না, ঢেউ করে ঢেঁকুর তুলবে না। ডালে নুন কম হয়েছে বলে কারুর শ্রাদ্ধ করবে না। লালসার হাতে দেহ চটকাবে না। আর জ্বলবে না, জ্বালাবে না। ফানুসে বায়ু ঢুকে যে নাচানাচির নাম ছিল মানুষ, সেই মানুষ দাঁত ছিরকুটে পড়ে আছে। আর ঘণ্টাখানেক পরেই ফুলতে থাকবে। দুর্গন্ধ ছড়াবে। সারা রাত যাকে ধরে হামলাহামলি চলত, যার অঙ্গে বেনারসী জড়িয়েছিল, গলায় দুলিয়েছিল চন্দ্রহার, যৌবনের সেই পাগল করা পাগলি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলবে, মালটিকে এবার বিদায় করো। সংসারে টাটকা সবজিরই কদর। হাজা, মজা জিনিস অচল। মৃত কর্তার চেয়ে রজনীগন্ধার শুকনো মালাভূষিত কর্তার ছবিই ভালো। রামপ্রসাদ সার বুঝেছিলেন :
দু’চারদিনের জন্য ভবে
কর্তা বলে সবাই মানে,
সেই কর্তারে দেবে ফেলে
কালাকালের কর্তা এসে।।
ঈশ্বর যদি প্রশ্ন করেন, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র সঙ্গে করে কী নিয়ে এলে?’
‘প্রভু পাঠিয়েছিলে উলঙ্গ, ফিরেও এলাম উলঙ্গ।’
‘কেন বৎস, তোমার সেই তালতলার জমি! বিধবার সম্পত্তি ধোকা দিয়ে নিয়েছিলে, সেই ভূখণ্ডটি ফেলে এলে? বাঁ হাতের রোজগার ব্যাংকের ফিকসড ডিপোজিট সেটিও রয়ে গেল, আইদার আর সারভইভার হয়ে!’
‘হ্যাঁ প্রভু। ছেলে এখন ওড়াবে। গৃহিণীর গতর বাড়বে। মুখে জর্দাপান ঠুসে পুত্রবধূর পেছনে লাগাতার লাগবে। লাগতে লাগতে একদিন ঝ্যাঁটা খাবে, তখন ধরা ধরা গলায় বলবে, থাকতো সে, তাহলে কি আর এমন হতচ্ছেদ্যা করতে পারতিস তোরা? প্যানপ্যানে অশ্রু বিসর্জন। পরক্ষণেই নিজ মূর্তি ধারণ।’
‘তা, এই ষাট—সত্তর বছর ধরে কি করলে মানিক। কী করে এলে? কী রেখে এলে?’
‘তা হলে জগতের দিনপঞ্জিটা শুনুন। প্রথম কয়েক বছর ন্যাজে—গোবরে হয়ে পড়ে রইলুম অয়েলক্লথে। কখনও হাসি, কখনও কাঁদি, কখনও দেয়ালা করি। সরষের তেল ডলে কখনও রোদে ফেলে রাখে চিংড়ি পোড়া হবার জন্যে। কখনও ছায়ায়। একদিন আদো আদো বুলি ফুটল। দুধের দাঁত উঠল। সবাই বলতে লাগল, আহা ঈশ্বর বিরাজ করছেন ভেতরে। শিশু মানেই ভগবান। যেই দেখে সেই কোলে তুলে নিয়ে হামি খায়। আবার অসাবধানে কাপড় ভিজিয়ে দিলে শিশু ভগবানটিকে মাটিতে থেবড়ে বসিয়ে দেয়। মাঝরাতে ককিয়ে উঠলে পিতা বিরক্ত হয়ে বলেন বাঁদরটা সব আনন্দের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লে গা। জননীর স্তন—বৃন্ত ঠোঁটের ডগায়। তখনও চুপ না করলে মধ্যরাতে ভগবানকে প্রহার। রোদন। রোদনান্তে নিদ্রা।
অতঃপর ছেলে চড়কো হল। ঈশ্বর বেরিয়ে চলে গেলেন। মানুষের পেটাই কারখানায় শুরু হল মানুষ ঢালাই। আদো বুলি আর নেই। দুধের দাঁত ঝরে গেছে। চোখের নীলে শয়তানের ছায়া। অধিকারবোধ প্রবল। স্বার্থের আঁচ গনগনে। ‘আমি’র জাগরণ। আমার জামা, আমার প্যান্ট, আমার পেনসিল, আমার বল, আমার বাবা, আমার মা। শিশুর বিশাল জগৎ ছোটো হতে হতে, একটা পাড়া, চারটে দেয়াল, একটি পদবি, এক ধরনের অর্থনীতি, বিশেষ এক ধরনের শিক্ষা। অমুকচন্দ্র তমুক। পিতার নাম। ঠিকানা। একটি পোস্টাপিস। নম্বর আঁটা কয়েদি।
পরীক্ষার পর পরীক্ষা। ঈশ্বর তখন পরীক্ষার্থী। গোল্লা পেলে ছাইগাদা। লেটার পেলে সিংহাসন। ঘন ঘন একই বাক্য শ্রবণ, বাপের বয়েস বাড়ছে, তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। জীবিকার শৃঙ্খলটি গলায় ঝুলিয়ে সংসারের হাল ধরো। বাপের হোটেলে আর কতকাল? দাদা থাকলে বউদির গঞ্জনা। পিতার প্রয়াণে বোনের বিবাহের ঝক্কি। ভড়ভড়িয়ে সংসারে ডুবে যাওয়া!
ঈশ্বরের এবার প্রজনন বাসনা। চুল ফিরিয়ে, টেরি বাগিয়ে মানবীর সন্ধান। প্রেমে আঁখি ঢুলু ঢুলু। লেপ্টে লেপ্টে বেড়ান। ফিরে তাকালে হৃদয়ে বিদ্যুৎচমক। না তাকালে চিরনিদ্রার বড়ি খোঁজা। অতঃপর পথ পরিষ্কার হলে ঘাটে ঘাট মিলবে। ঈশ্বরীর পিতা চাহিদা মেলাবেন, ছেলেটি কেমন? বংশ পরিচয়? চাকরি? পাকা না কাঁচা? মাইনে? ভাড়া বাড়ি, না নিজের বাড়ি? আর ভাই বোন আছে? কচলাকচলি চলতেই থাকবে। সব হিসেব মিললে একটি অর্ধাঙ্গিনী এসে পূর্ণাঙ্গ করবে।
তারপর ঈশ্বরের সরিষাফুল দর্শন। কত ধানে কত চাল, সে হিসেব তখন। সংসারের চাকায় ঈশ্বর ঘুরছেন। রোজই প্রায় এক রুটিন। ঘুম থেকে ওঠো। একটু আগে আর একটু পরে। ছোট বাজার। হলাহলি, গলাগলি, ঈশ্বরে ঈশ্বরে ঠোকাঠুকি, এক ঈশ্বর পকেট খালি করে আর এক ঈশ্বরের পকেট ভরে। কম ওজনের বাটখারা, কারচুপির দাঁড়িপাল্লা, পোকাধরা বেগুন, রং করা পটল। এক ছ্যাঁচড়ের সঙ্গে আর এক ছ্যাঁচড়ের মোলাকাত।
খড়খড়ে দাড়িতে ভোঁতা ব্লেডে জয় মা বলে এক টান। এক ঘটি জল মাথায় ঢেলেই রেশনের পিণ্ড গলাধঃকরণ। তারপর ধস্তাধস্তি করে বিধ্বস্ত অবস্থায় কর্মস্থলে গমন। সেখানে পরস্পর পরস্পরের ন্যাজ ধরে টানাটানি। কে উঠল, কে পড়ল তাই নিয়ে জ্বলে পুড়ে মরা। এ একবার বড় কর্তার কান ভারি করে আসে তো, ও একবার। সকলেরই ওপরে ওঠার জন্যে হাঁচড়—পাঁচড়। ডি—এ, টি—এর হিসেব। ইনসিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইনকাম ট্যাকস, প্রোফেস্যানাল ট্যাকস। পৃথিবী তিন কিসিমের পলিটিকসে জেরবার—পার্টি পলিটিকস, অফিস পলিটিকস আর ফ্যামিলি পলিটিকস। ঝাণ্ডা, লাল বাতি, স্লোগান, মিছিল। সর্বত্র গেল গেল অবস্থা। কখন কার ঘাড়ে কোপ পড়বে জানা নেই। জীবিকাচ্যুত হলেই হল। এরই মাঝে মঙ্গেশকার গান গাইছেন, হোটেলে ক্যাবারে নর্তকী পেট দেখাচ্ছেন, তেতাল্লিশ টাকার রেকর্ড কুড়ি টাকায় বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে, বাল গোপালের ননী পাড়ার ধরনে মানুষের ঘাড়ে মানুষ, তার ঘাড়ে মানুষ চেপে রেকর্ডের কোণা ধরে খামচাখামচি, আঁচড়া আঁচড়ি। এরই মাঝে দোল, দুর্গোৎসব বিয়ে, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন, শখের থিয়েটার, বিদেশ ভ্রমণ। ওদিকে ওঁত পেতে বসে আছে, ক্যানসার, করোনারি থ্রম্বোসিস, জনডিস, হেপাটাইসিস। কেউ জল খেয়ে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় কালো হয়ে ফেটে যাচ্ছে, কেউ মাল খেয়ে সিরোসিসে টেঁসে যাচ্ছে। কেউ টাকা ওড়াবার রাস্তা পাচ্ছে না, আবার কারুর দু’বেলা হাঁড়ি চড়ছে না। কেউ সারাদিন গাছতলায় বসে প্রেম করছে, কেউ উকিল খুঁজছে বউকে তালাক দেবার জন্যে। একদিকে ঝাড়ফুঁক চলছে, আর একদিকে স্ক্যানারে মানুষের ভেতরের কলকব্জা পরীক্ষা হচ্ছে। সাধু না খেয়ে মরছে, চোরে বিরিয়ানি সাঁটাচ্ছে। চৌকিদারে চোরে হাত মেলাচ্ছে, প্রজাদের ঘরে সিঁদ পড়ছে। এর নাম, পৃথিবী। মানুষ একবার লাল হচ্ছে, একবার সাদা হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা উলটে রাস্তা খুঁজছে, ডিকটেটারশিপ, সোস্যালিজম, ডেমক্রেসি, কমিউনিজম—কোথায়, কীসে, কীভাবে সুখের স্বপ্ন বাস্তব হবে। কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। ধীরে ধীরে জীবন বুড়িয়ে আসে। চুল পড়ে যায়, চোখে চালসে। বুকে তোমার অস্তিত্ব ধরা পড়ে না। ডাক্তারের স্টেথো একটি জিনিসই খুঁজে পায়, ব্রংকাইটিসের কফ। ই সি জি নেচে নেচে জানিয়ে দেয় হৃদয়বৃত্তি বড় হয়নি, বড় হয়েছে হৃদয়, খুব সাবধান। শিশু ঈশ্বর, ক্রমে পাকা মানুষ। দাও, দাও, আরও খাবো খাবো করে ঘুরছে। আদো বুলি উধাও। জননীর কোলে আর ধরে না। দেহ আকারে বেড়ে গেছে, পবিত্রতা হারিয়েছে। স্ত্রীর কোলের কাছে কুকুর—কুণ্ডলী। দামড়ার মুখে শিশুর জগৎ ভোলানোর হাসি আর নেই। বাক্যে বিষ ঝরছে। চিন্তায় অন্যের সর্বনাশ ঘুরছে। হাপর অনবরতই আমি আমি করছে আর, অহংকারের ফুলকি উড়ছে চারপাশে। এই তোমার পৃথিবী প্রভু।’
‘এর মাঝে আমার কথা কি মনে পড়েছে?’
‘মনে পড়েনি বললে ভুল হবে। মানুষ তোমাকে মেরেই ফেলেছে। জ্ঞানীরা বলেন—দুর্বলের ঈশ্বর, সবলের বাহুবল। তুমি তো প্রভু নোবেল প্রাইজ পাওনি! তোমাকে কে স্বীকার করবে। যে কবি লিখলেন, তাই তোমার আনন্দ আমার ‘পর/তুমি তাই এসেছ নীচে—/নোবেল না পাওয়া পর্যন্ত দেশের মানুষ তাঁকে চিনতে পারেনি। তুমি আছ, ইংরেজ বিজ্ঞানীর লেবরেটারিতে প্রমাণিত না হলে, তুমি নেই। তবু মনে পড়েছে। মাঘের রাতে বড়ো ছেলেটি যেদিন মারা গেল, সেদিন মধ্যরাতে তাকে চিতায় চাপাবার পর তোমাকে মনে পড়েছিল। তারাভরা আকাশের দিকে লকলকিয়ে উঠছে আগুনের জিভ। একটি মানুষের প্রথম সন্তান পুড়ে ছাই হচ্ছে। জননীর আর্ত চিৎকারে রাত কাঁপছে, সেই সময় গঙ্গার নিশ্ছিদ্র অমা—অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল—হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনও খানে। মনে পড়েছিল সেদিন—যেদিন ডাক্তার এসে বললেন, আমার সন্দেহই ঠিক, আপনার লিভারে ক্যানসার হয়েছে। হেসে নাও। দুদিন বই তো নয়। কার যে কখন সন্ধ্যা হয়।’