আকাশ পাতাল – ১৫

১৫

সকালবেলা কোকিলের ডাকে আমার ঘুম ভাঙে এবং রাত্রে ঝিল্লিরব আমায় ঘুম পাড়ায়। এই লাইনটা পড়েই পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমার মতন অকবিও শেষপর্যন্ত কাচা কবিত্ব করতে শুরু করেছে। কিংবা আমি বোধহয় গজদন্তমিনারে বাস করছি। কিন্তু ঘটনাটা সত্যিই।

নোংরা শহরতলীর যে ফ্ল্যাটবাড়িতে আমি থাকি—তার চারপাশে অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে অযত্নে বর্ধিত অনেকগুলো আম, নিম, বেল, নারকেল ইত্যাদি গাছ রয়েছে। আর সেই গাছে-গাছে অসংখ্য পাখি। পাখির মধ্যে অবশ্য কাকই বেশি আর যেখানে কাকের বাসা—তার কাছাকাছি কোকিলও থাকবে। এছাড়া শালিক আর ছাতারে আর চড়ুইয়ের পাল, মাঝে-মাঝে উড়ন্ত টিয়ার ঝাঁক, ক্বচিৎ কখনো ইটুকুটুম, দোয়েল, বুলবুলি, মুনিয়া আর দুর্গা টুনটুনিও দেখতে পাই। পাখির ডাক না-শুনে আমার একটি মুহূর্তও কাটার উপায় নেই।

কিন্তু পাখিরা বিষম অকৃতজ্ঞ। তাঁদের দয়ামায়া কিছুই নেই, আমি লক্ষ করেছি।

যেমন কাকের কথাই ধরা যাক। কাক কেউ পছন্দ করেনা। বনফুলের উপন্যাসের করালী ছাড়া আর কেউ কোনদিন কাক ভালোবেসেছে—এমন কখনো দেখিনি, শুনিনি। কাক অলক্ষ্মী, অশুভ। নির্জন দুপুরবেলা কাকের ডাক শুনলে গা ছমছম করে, মনে হয় পৃথিবীর কোথাও সেই মুহূর্তে মহাবিপদ ঘটে যাচ্ছে। তবু কাকেদের ওপর আমার মায়া পড়েছিল।

আজকাল ভাত কেউ ফেলে দেয়না, মাছও যেটুকু বাজার থেকে আসে— রান্নার পর তা প্রায় কাঁটাশুদ্ধুই চিবিয়ে খাওয়া হয়। তাহলে কাকেরা খাবে কী? এই নিয়ে মাঝখানে আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বাগানে গোটা তিরিশেক কাক আছে—তাদের বাঁচিয়ে রাখা তো দরকার। জীব দিয়েছেন যিনি, তিনি আজকাল আর আহার জুটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেননা। কাকেদের জন্য চিন্তা করেও আমি কোন সুরাহা করতে পারছিলামনা। কিন্তু আকস্মিক সুযোগ এসে গেল। মাঝখানে কিছুদিন কলকাতা থেকে পাঁউরুটি উধাও হয়ে গেল। তখন সকালবেলা জলখাবারের জন্যও বরাদ্দ হল হাতে-গড়া রুটি। দুপুরে রুটি, রাত্রিরে রুটি আবার সকালের জলখাবারেও রুটি—ভূতপূর্ব বাঙালের পক্ষে এতখানি সহ্য করা সম্ভব নয়। আমি সকালবেলার জলখাবারের রুটিগুলো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে কাকদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিতে লাগলাম। তিরিশটা কাক তাদের আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগোষ্ঠী সবাইকে ডেকে এনে জড়ো করল—সেই দৃশ্য দেখবার মতন, শূন্যে একটুকরো রুটি ছুঁড়ে দিই, আর শূন্যপথেই সেটা লুফে নেবার জন্য একপাল কাক ঝটাপটি করে শেষ পর্যন্ত যে-পায়-তার চোখে-ঠোঁটে কী গর্ব। সবগুলোর মধ্যে একটা কাক ভারী চালাক আর সবচেয়ে শক্তিশালী—বেশিরভাগ টুকরো সে একাই পায় —দু-একটা আবার অন্যদের বিলিয়ে দেয়।

সকালবেলা কাক-ভোজন করিয়ে বেশ মজা পাচ্ছিলাম—কিন্তু ক্রমশ ঐ কাকগুলো আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলল। গাছ ছেড়ে ওরা বারান্দার রেলিং—এ বসা শুরু করল, ক্রমশ বারান্দা ছেড়ে ঘরে। আমাকে মানুষসমাজের সবচেয়ে বোকা লোক মনে করে ওরা আমার ঘরবারান্দা সবকিছু নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল। আমার খাটের নিচে, আলমারির মাথায় সব জায়গায় ওদের উপদ্রব। যে—কোন খাবারে ওরা মুখ দেবে, দুধের ঢাকনা উল্টে ফেলে তাতে ঠোঁট ডোবাবে, এমন কী খোলাসুদ্ধ আস্ত ডিমও মুখে করে নিয়ে যায়। অসহ্য হওয়ায় শেষপর্যন্ত আমি গুলতি কিনলাম। সবাই বললে, খর্বদার, কাক মেরো না, একটা কাক মারলে বাকিরা তোমার চুল খুবলে নেবে, চোখ অন্ধ করে দেবে। কাকেদের ওপর আমার মহাক্রোধ জেগেছিল। আমি ইঁদুর-মারা-বিষ মেশানো খাবার ছড়িয়ে তিনটে কাককে মারলাম—তাতে ওরা বুঝতেও পারলনা কে ওদের হত্যাকারী—আর জাল দিয়ে বারান্দা থেকে শুরু করে ঘরের সবক’টা জানলা ঘিরে দিয়েছি।

তারপর কোকিল। কোকিল মানুষের কাছাকাছি আসেনা। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙল কোকিলের ডাক শুনে! আমগাছটার ঘন পাতার আড়াল থেকে একটা কোকিল বাহার রাগে কুহুতান ধরেছে! মনটা খুঁশি হয়ে গেল। আমি সেই নরম আলোময় ভোরবেলায় স্নিগ্ধ বাতাস মুখে মেখে জানলা দিয়ে তাকালাম। আমগাছের ডগায় সেই কোকিলটাকে দেখা গেল, আমি তার উদ্দেশ্যে বললুম, বাঃ বেশ চমৎকার। আর-একখানা গান করো তো হে! সে আবার কুহুরব তুলল, আর সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাঁচার কোকিলটাও ডেকে উঠল। পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকরা দুমাস আগে এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন ঐ কোকিলটা—সেটা কেমন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকত, কোনদিন একটু সাড়া-শব্দ করেনি—এই প্রথম তার ডাক শুনলাম। বনের পাখি আর খাঁচার পাখি এক সুরে ডাকছে—এই ব্যাপারটায় আমার কীরকম যেন একধরনের সেণ্টিমেণ্টাল কষ্ট হল। আমি পাশের ফ্ল্যাটের লোকদের অনেক অনুরোধ করে সেই কোকিলটার মুক্তি দেওয়ালাম। তারপর থেকে শুরু হল দুই কোকিলের পাল্লা দিয়ে ডাকাডাকি সেই আমগাছের মাথায়। কখনো উড়ে যায়, আবার ফের এসে বসে। প্রথম-প্রথম আমাদের খুব মজা লাগত। বাড়িতে লোকজন বেড়াতে এলে আমরা তাঁদের সেই খাঁচার কোকিল আর বনের কোকিলের কাহিনী বলে সেই কোকিলের ডাক শোনাতাম। তারপর ক্রমশ কান ঝালাপালা হয়ে এল। সকাল—দুপুর-সন্ধে জুড়ে অনবরত কোকিলের ডাক শুনতে কারুর ভালো লাগেনা। নানান সময় নানারকম মুড থাকে—সব সময় চোখ বুজে কোকিলের দিকে কান ফেরানো যায়না! পুরুষ কোকিল কুহু স্বরে ডাকেনা, তাদের রংও কালো হয়না। সুতরাং ঐ দুটিই মেয়ে কোকিল ওদের অত ভাব কিসের? ওরা যেন পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ডেকে গলা ফাটাতে লাগল। আমি একদিন জানলা দিয়ে মুখ বার করে ওদের বললাম, গান যে ঠিক সময়ে থামাতে জানেনা—সে মোটেই ভালো গাইয়ে নয়। এবার বাপু গান থামাও। ওরা কথা শুনলনা। বসন্তকাল ফুরিয়ে প্রখর গ্রীষ্ম তখন সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর কোকিলের ডাক এমনকী তারপর বর্ষাকাল, সেসময় কোকিলের ডাকার কথা কোন শাস্ত্রে লেখা নেই। একটা সুন্দর শ্লোক পড়েছিলাম ছেলেবেলায়—বর্ষাকালে কোকিল ডাকে না কেন? কারণ, বর্ষাকালে ব্যাঙেরা সমস্বরে ডাকতে শুরু করে—তখন কোকিলের চুপ করে থাকাই উচিত। ‘মূর্খেরা যখন বক্তা বুদ্ধিমানের পক্ষে তখন নীরব থাকাই যেন শ্রেয়।’ কিন্তু ঐ কোকিলদুটো সেই শ্লোকের কথা জানেনা—একেবারে গোমুখ্যু যাকে বলে -সারা বছর ধরে ডেকে-ডেকে আমাকে কোকিলের ডাক সম্পর্কে বীতস্পৃহ করে তুলল।

শালিকঘটিত ব্যাপারটা অন্যরকম। শালিকগুলিকে দেখতে বেশ সুন্দর, বুদ্ধিমানও খুব। আমাদের বাগানের শালিকগুলোর ভয়ডর নেই, নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়—মাঝে-মাঝে দল বেঁধে কাকদের সঙ্গে ঝগড়া করে, গাছে বিড়াল উঠলে তাদের ল্যাজে ঠোক্কর মেরে তাড়ায়। শালিকগুলোর মধ্যে দুটি শালিক আমার খুব প্রিয়। একটি শালিকের মাথায় কালো রঙের ছোপটি এমন, যেন মনে হয় খুব কায়দায় চুল আঁচড়ানো। আমি ওর নাম দিয়েছি শালিক উত্তমকুমার। আর—একটির চোখদুটো খুব টানাটানা— আমি ওর নাম সুচিত্রা সেন কিংবা সুপ্রিয়া চৌধুরী রাখব এখনো ঠিক করতে পারিনি। বারান্দা জাল দিয়ে ঘেরা সত্ত্বেও ওরা ঘুলঘুলির কাচ দিয়ে বাথরুমের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের মধ্যে এসে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ওদের উপদ্রব বেশি নয় বলে আমি অপছন্দ করিনি।

একদিন দেখলাম, বাগানে কতকগুলো বাচ্ছা ছেলে একটা শালিকের পায়ে দড়ি বেঁধে খেলছে। আমি চমকে উঠলাম, আরেঃ এতো সেই উত্তমকুমার। আহা, অমন শৌখিন পাখিটার এই দৃশ্য! ছেলেগুলো আম পাড়তে গাছে উঠেছিল— ..সেখানে শালিকের বাসা দেখে ভাঙতে যায়, তখন এই উত্তমকুমার শালিক এসেছিল ওদের ঠোকরাতে। সুতরাং ছেলেরা ওকে ধরে ফেলে পায়ে দড়ি বেঁধে ঘোরাচ্ছে। আমি ছেলেগুলোর কান মুলে দিয়ে হাত থেকে দড়িটা কেড়ে নিয়ে শালিকটাকে মুক্তি দিলাম। শালিকটা পিড়িং করে ডানার শব্দ করে উড়ে গেল। অন্য একঝাঁক শালিক সমস্বরে কোচাটু পিসাটু বলে আমায় কৃতজ্ঞতা জানাল।

এর ফলাফল কিন্তু করুণ। একদিন আমাদের দোতলার বাথরুমে একটা সাপের খোলস দেখতে পাওয়া গেল। বাড়িসুদ্ধ সবাই আঁতকে উঠলাম। দোতলায় সাপ! খোলস ছেড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে কোথায় লুকিয়ে আছে? বাড়ির সকলে চিন্তায় অস্থির, অবিলম্বে এ বাড়ি বদলাতে হবে। তাহলে সব ঝামেলা আমারই। আবার বাড়ি খোঁজ মালপত্তর টানা! সুতরাং আমি তন্ন-তন্ন করে সাপ খুঁজতে লাগলাম। বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে রহস্যটা পরিষ্কার হল। চৌবাচ্চার জলে আর-এক টুকরো সাপের খোলস। বাথরুমের ঘুলঘুলিতে একজোড়া শালিক এসে বাসা বাঁধছে— সেই উত্তমকুমার তার সুচিত্রা বা সুপ্রিয়া! নানান নোংরা জিনিশ-নারকেল দড়ি, ঝাঁটার কাঠি, ময়লা কাগজ ইত্যাদি মুখে করে আনছে শালিকদুটো বাসা বাঁধবার জন্য। সাপের খোলসও ওরাই এনেছিল—সেটাই উড়ে পড়েছে। উপকারের প্রতিদান! ক্রমশ বিচিত্র সব নোংরা পদার্থ বাথরুমে উড়ে পড়তে লাগল—কখনো জলের মধ্যে, কখনো আমার মাথায়। বাড়িতে শালিক পাখির বাসা— অসম্ভব, আমি উপকার করেছি কিনা তাই আমার ওপর যা খুশি অত্যাচার করা যায়। কিন্তু স্নানের জলে সাপের খোলস কে সহ্য করবে? আমি প্রথমে হাততালি দিয়ে হুস্-হুস্ শব্দ করে ওদের ওড়াবার চেষ্টা করলাম। যাবে না। তারপর ঝুলঝাড়া দিয়ে ওদের তাড়া করলাম—কিন্তু এমনই আবদার তখন-তখন উড়ে যাচ্ছে—কিন্তু একটু বাদেই আবার ফিরে আসছে। শেষপর্যন্ত যখন একটা থ্যাৎলানো ইঁদুর ওরা মুখে করে এনে জলে ফেলল—তখন আমার ধৈর্যচুতি হল। সন্ধেবেলা ওরা ঘুলঘুলিতে এসে আশ্রয় নেবার পর, আমি মই লাগিয়ে চুপি-চুপি উঠে ক্যাক করে ওদের ধরে ফেললাম এবং সঙ্গে-সঙ্গে—

শালিকের রোস্ট বেশ সুস্বাদু। মাংসটায় একটু ছিবড়ে হয়। কিন্তু চিলি সস দিয়ে মাখিয়ে নিলে চমৎকার। এখনো জিভে লেগে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *