১৩
আমি এখন জীবনের সেই সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে জন্ম এবং মৃত্যু সমান দূর বলে মনে হয়। অথবা মৃত্যুকে মনে হয় খুবই কাছে, মৃত্যু তো জন্মের পর থেকেই খুব বিশ্বস্তভাবে কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। যাই হোক, এই সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আমি একটি সমস্যায় খুবই পীড়িত বোধ করি, একটি ছেলে কোনদিন থেকে হঠাৎ একজন লোক হয়ে যায়? চঞ্চল লঘুমতি ছেলেটিকে কবে থেকে পৃথিবী বলবে, ঐ লোকটা—
এই প্রথম শীতের মেদুর অপরাহ্নে যখন পথ দিয়ে একা হেঁটে যাই, মন অস্থির হয় নানাকারণে। কোনদিকে যাব, মনে পড়েনা। আমি কোন জায়গা থেকে আসছি, না কোন জায়গায় যাচ্ছি, বুঝতে পারিনা। অর্থাৎ পিছন থেকে কোন মানুষ আমাকে এইমুহূর্তে দেখলে বলবেন, আপনি ঐদিকে যাচ্ছিলেন দেখলাম। আবার সামনে থেকে কেউ এই একই মুহূর্তে আমাকে দেখে বলবেন, আপনি এইদিকেই তো আসছিলেন…। জীবন এখন এইরকম।
এই ভারী সন্ধেবেলা একা হাঁটতে-হাঁটতে আমি অলস নয়নে পৃথিবীর আটদিকে তাকিয়ে দেখি। যদি কোন চেনামুখ চোখে পড়ে। না, কারুকে দেখিনা, এইসময় কেউ তো একা থাকেনা, যে অপর একটি একলা মানুষকে চিনতে পারবে! কারুকে না পেয়ে, আমি নিজের সঙ্গেই দেখা করার চেষ্টা করি। কিন্তু নিজের সঙ্গে দেখা করা খুব কঠিন, অধিকাংশ সময়েই শুনতে হয়, উনি বাড়িতে নেই, বেরিয়ে গেছেন। কিংবা রূঢ়ভাবে, এখন খুব ব্যস্ত, দেখা হবেনা। বস্তুত, নিজেকে আমি কোনদিনই দেখিনি, কোনদিনই নিজের নাম ধরে ডাকিনি। আমি কী করে জানব, আমি ক্রমশ ছেলে থেকে লোক হয়ে যাচ্ছি কি না! ভবিষ্যৎ তো জানিনা, নিজের কথা ভাবলেই মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা, তেঁতুলের আচার, ঘুড়ি-মাঞ্জা, শিবরাম-হেমন্দ্রকুমারঘটিত উত্তেজনা, একমাইল পথ বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে কোন এক কিশোরী মেয়ের সামনে দুরু দুরু বুকে দাঁড়ানো, ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে একটি চশমা-পরা যুবতীকে কিছুই বলতে না-পারার লজ্জা। আর কিছুই মনে পড়েনা। এসব কী কোন ছেলেমানুষী কাজ, না, কোন লোকের উচিত ব্যবহার, বুঝিনা। পথের লোক আমাকে দেখে কী বলছে, ঐ ছেলেটা, না, ঐ লোকটা? ও আসছে, না, ও যাচ্ছে?
লোক হবার কী কী চিহ্ন আমি খোঁজার চেষ্টা করি। বয়েসের কথা ভেবে কোন সুবিধে হবেনা, কারণ আমি আমার ছোটভাইয়ের চেয়ে বয়েসে বড়, কিন্তু আমার দাদার চেয়ে নিশ্চয়ই বয়েসে ছোট। আমার জুলপিতে দু’-তিনটে পাকা চুল। এই কী লোক হবার চিহ্ন? কিন্তু অমুকবাবু আমার চেয়ে অন্তত আঠারো বছরের জ্যেষ্ঠ, কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডলের প্রতিটি কেশ-রোম ভ্রমরকৃষ্ণ। একটিও আধ—সাদা পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু অমুকবাবু যদি লোক না হন, তবে পৃথিবীটাই ছেলেমানুষীতে ভরা বলতে হবে। অপরপক্ষে, আমার সেজো পিসিমার ছোট ছেলে (সংক্ষেপে, আমার পিসতুতো ভাই বলাই উচিত ছিল বোধহয়)—যার বয়েস আমার চেয়ে অন্তত দেড়যুগ কম, তার মাথার অধিকাংশ চুলই পাকা—লিভার না কিডনি না হৃদয়ঘটিত কী দোষে যেন, সেও নিশ্চয়ই এই পক্ককেশ গুণে লোক হয়ে ওঠেনি। ক্রিকেটের বল লোফালুফি করতে করতে সে এখনো পিসেমশাইয়ের ভাতের থালায় ফেলে দিয়ে খাওয়া নষ্ট করে—এটাকে নিশ্চয়ই ভদ্রলোকোচিত কাজ বলা যায়না।
তুমি-আপনি সম্বোধন থেকেও কিছুই বোঝা যায়না। যেমন কোন অপরিচিত ভদ্রলোক যদি প্রথম আলাপেই আমাকে তুমি বলে কথা বলেন, আমি বিরক্ত হয়ে উঠি,—আবার, কোন অচেনা ছেলে বা মেয়ে যদি প্রথমেই এসে আমাকে অমুকদা বলে ডাকে, তাহলেও রাগে আমার গা জ্বলে যায়। এও সেই, যাচ্ছি না আসছি—সেই সমস্যা! মেয়েরাও ঠিক কবে থেকে একটি মেয়ে থেকে হঠাৎ মহিলা হয়ে ওঠেন, তাও বোধহয় একটা সমস্যা। ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার দিনই কী সেই সীমান্ত? কিন্তু, এ সম্পর্কে আমার কিছু জানার কথা নয়!
তবে কী অভিজ্ঞতাই একটি ছেলেকে লোক করে তোলে? জীবনের কোন—কোন্ ঘটনাকে ঠিক অভিজ্ঞতা বলে আমি বুঝতে পারিনা। জীবনে যা কিছু ঘটে সবই কী অভিজ্ঞতা, নাকি কোন-কোন বিশেষ ঘটনা? আমি বেছে নিতে পারিনা। এক হিসেবে জীবনের সব ঘটনাই মূল্যবান, আবার সব ঘটনাই অর্থহীন। জীবনের কোন-কোন্ ঘটনাকে অভিজ্ঞতা বলে, তা-ই যদি বুঝতে পারতাম, তাহলে আর জীবন এত দুর্বোধ্য কেন?
নিজেকে দেখতে পাইনা, তাহলে ছেলেবেলা থেকেই যারা আমার বন্ধু তাদের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। তারা কী সবাই লোক হয়ে গেছে? এক বন্ধু বিদেশ থেকে ফরাসি বউ নিয়ে এসেছে, এক বন্ধু বিদেশে গিয়ে থেকেই গেল, আর ফিরবেনা। চম্পাহাটিতে জমি কিনে কলোনি বানাচ্ছে এক বন্ধু। মানুষ খুন করে আর-একজনের যাবজ্জীবন জেল হয়ে গেল। একজন তার সদ্য জন্মানো মেয়ের গল্প করে সবসময়, আর-একজন তার সদ্য কেনা মোটরগাড়ির। একজন দুহাজার টাকা মাইনের চাকরি পেয়েছে, আর-একজন আজন্ম রেকার, কেউ ঠিকসময় খায় ঠিকসময় বাড়ি ফেরে, কেউ কখনো ফেরে কখনো ফেরেনা—অখাদ্য-কুখাদ্য খায়, কেউ ছেলেবেলার হাসিখুশি মুখ এখন দুঃখিত করেছে, কেউ শৈশবের নির্বোধ জড় খোলশ থেকে বেরিয়ে এসে হতে পেরেছে সরকারি অফিসার। যে-মেয়েটিকে ভাবতাম রোগা হতে-হতে একদিন বাতাসে উড়ে যাবে, সে এখন স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হয়ে, হেডমিস্ট্রেস সুলভ বিশাল বপু। (খুন করে যে যাবজ্জীবন জেল খেটেছে, তার কথা এমন সহজভাবে উল্লেখ করা আমার উচিত হয়নি। আমি এত নির্লিপ্ত নই। সেই সবচেয়ে আশ্চর্য? প্রত্যেক লোকেরই এমন বন্ধু থাকেনা। কলেজের গোড়া থেকে কুশলের সঙ্গে একসঙ্গে পড়তাম। সে ছিল একটু রাগী বা একগুঁয়ে, যাকে বলা যায় আদর্শবান। তার মনের জোর ও ক্রোধ দেখে আমরা ভাবতাম, কুশল একদিন সত্যিই বড় হবে—আমরা সবাই কে কোথায় হারিয়ে যাব, মিশে যাব জনতায়, কিন্তু কুশল আমাদের সকলকে ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। কলেজের শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই কুশল ফিরে গেল কলকাতা থেকে ৩০ মাইল দূরে নিজের গ্রামে, সেখানে হাস-মুরগি প্রতিপালন এবং সমাজসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুর কাছে কুশল প্ৰায় আসত ওর গ্রামের নানারকম খবর ছাপাতে। কুশলের নাম আলাদাভাবে দুবার কাগজে বেরিয়েছিল। মাঝরাত্রে দুটো চোরকে তাড়া করে প্রাণ বিপন্ন করে কুশল তাদের ধরেছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সভা করে কুশলকে তার অসমসাহসিকতার জন্য সাধুবাদ জানান এবং গ্রাম রক্ষার জন্য কুশলের নামে একটি বন্দুকের লাইসেন্স মঞ্জুর করেন। সেই প্রথমবার। আবার। সেই কুশলই পাশের বাড়ির একটি ছেলের সঙ্গে ঝগড়া করতে-করতে হঠাৎ রাগের মাথায় বন্দুক দিয়ে তাকে গুলি করে। আদালতে দোষ স্বীকার করেছিল বলে, তার ফাঁসী হয়নি, যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। কোথায় কোন্ অন্ধকার জেলের ঘরে কুশল বসে আছে, তার সেই নির্ভীক মুখ এখন কুঁচকে গেছে কিনা কে জানে! তার কথা আমার মনে আনা ঠিক হয়নি!
আমার মনে হচ্ছে, এই যেসব মিশ্রিত স্বভাব বন্ধুবান্ধব, এদের ক্রিয়াকলাপের উল্লেখ করলে মনে হয়, এরা প্রত্যেকেই লোক। এসব ছেলেমানুষের কাণ্ড নয়। কিন্তু যখনই মুখ মনে করি যে-কোন একজনের, কিছুতেই সেই মুখের মধ্যে লোক—লোক ভাব খুঁজে পাইনা। সেদিন একটি আটবছরের ছেলে আমাকে ‘কাকাবাবু’ ডাকছে শুনে আঁতকে উঠেছিলাম প্রায়। কী সর্বনাশের কথা! যে-ছেলেটি ডাকছে, পাশে দাঁড়ানো তার পিতৃদেব আমারই আবাল্যের বন্ধু। কিছুতেই আমার চেয়ে বয়েস বেশি হতে পারেনা। তাহলে, আমার এই বন্ধু নিশ্চয়ই লোক হয়ে গেছে। কারণ, ছেলের বাবা, কখনো নিজেও ছেলে হতে পারেনা। লোকেরই ছেলে হয়, কোন ছেলের ছেলে হওয়া একটি অভূতপূর্ব ঘটনা! হুঁ, এতক্ষণে বুঝলাম, বিয়ে করলেই একটা ছেলে হঠাৎ একটা লোক হয়ে যায়!
নাঃ, এতেও কিন্তু সমস্যা মিটলনা। আবার ভেবে দেখলাম, ঐ আট বছরের ছেলেটির পিতা সমেত অন্যান্য বিবাহিত বন্ধুদের সম্বন্ধে যখন আড়ালে আলোচনা বা নিন্দে করি (বলা বাহুল্য, আড়ালে হলে নিন্দেই বেশি)—তখন তো কখনো বলিনা, আমার বন্ধু অমুক লোকটা…, বরং বলি, অমুক ছেলেটা একটা হাড়হারামজাদা…ইত্যাদি। ছেলেবেলা থেকেই যাকে ছেলে বলে ভেবে আসছি, তাকে কোনদিনই হঠাৎ লোক বলতে পারবনা। তাহলে কী, এইরকমই চলবে চিরকাল? শৈশব থেকে একই সঙ্গে পাশাপাশি বাড়িতে পঞ্চাশ-ষাট-বছর ধরে আছেন, এমন দুই বৃদ্ধ কী পরস্পরের সম্বন্ধে আড়ালে উল্লেখ করেন ছেলেটা বলে? এক পক্ককেশ বৃদ্ধ, তাঁর অপর সমবয়সী বন্ধু সম্পর্কে কী বলেন, আমার বন্ধু ঐ ছেলেটা ভারী…। এই দৃশ্যটা ভেবে আমি নিজেই একা-একা খুক্-খুক করে হাসতে থাকি? এতো ভারী গোলমেলে ব্যাপার দেখছি। হঠাৎ এ সমস্যায় কেন জড়িয়ে পড়লাম?
এরকমভাবে একা-একা হাঁটতে-হাঁটতে আমি বহুদূর চলে যাই। সন্ধে অনেক গাঢ় হয়ে এসেছে, মনে হয় যেন আমি পৃথিবীর আটদিকই ঘুরে এলাম। এখন আমি বাকি দুদিক—অর্থাৎ উপরে বা নিচেও ঘুরে আসা যায় কিনা যখন ভাবছি, সেইসময়েই একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। মুখ তুলে দেখি, আমারই এক বন্ধু। সে বলে, কী রে, কোথায় যাচ্ছিস? আমি তো তোর ওখানেই আসছিলাম।
আমি অপ্রসন্ন মুখে বললুম, আমি আবার যাচ্ছি কোথায়? আমিই তো এদিকটায় আসছিলাম, তুই যেতে-যেতে ধাক্কা দিলি!
সে অবাক হয়ে বলল, সে কী! তুই-ই তো আনমনে এদিকে কোথায় যেন যাচ্ছিলি, আমিই বরং হন্তদন্ত হয়ে আসছি তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য!
আমি মুখ কালো করে বললুম মোটেই না, আমিই আসছি, তুই যাচ্ছিস। বন্ধুটি আমার কাধ ধরে ঝাঁকিয়ে হো-হো করে হেসে বলল, তোর হয়েছে কী আজ? আচ্ছা, এখন তো আমরা কেউই আসছি বা যাচ্ছিনা। এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
আমি নিশ্বাস ফেলে বললুম, সেই ভালো, আয় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি মাঝপথে। অনেকক্ষণ—অন্তত যতক্ষণ পারা যায়।