১২
এসেছি কেঁদে যাই যেন হেসে
বহুকাল আগে একটি গল্প পড়েছিলাম। আজকাল পাঠ্যপুস্তকে তেমন গল্পের আর সন্ধান পাওয়া যায় না। এখানকার স্কুল বালকরা অনেক বিজ্ঞ। তাদের মগজে দুধের দাঁত পড়ার আগেই গভীর জ্ঞান কংক্রিট মিকশ্চারের মতো ঠেসেঠুসে একটি ঢালাই তৈরি করার চেষ্টা চলে। ইনটেলেকচুয়াল ভাস্কর্য।
সেই গল্পটি ছিল এইরকম। একটি রাজত্বে যে—কোনো একজন মানুষকে রাজা করা হত। ধরো আর সিংহাসনে বসিয়ে দাও, রাজমুকুট পরিয়ে। তা একদিন এক পথিককে ধরে এনে বলা হল, আজ থেকে তুমি হলে এই রাজত্বের রাজা। সে তো অবাক। পথ থেকে একেবারে সিংহাসনে! বেশ মজা তো! পথিক জিজ্ঞেস করলে, তা কতদিনের জন্য আমাকে রাজা করা হবে। যতদিন বাঁচব ততদিন? না, একদিনের রাজা?
না, নিয়ম হল, তুমি একদিনের জন্যে নয়, এক বছরের জন্যে রাজা হয়ে থাকবে।
তারপর তোমাকে এক দ্বীপে নির্বাসিত করা হবে।
পথিকের পালিয়ে যাবারও উপায় নেই। ধরা পড়ে গেছে। অগত্যা সিংহাসনে রাজা হয়ে বসতেই হল।
রাজা একদিন পরিচারককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে যে দ্বীপে নির্বাসিত করা হবে তুমি সেই দ্বীপটা জানো?
হ্যাঁ, মহারাজ জানি।
আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?
দ্বীপ খুব দূরে নয়। একদিন রাতে সেই পরিচারকের সঙ্গে নৌকো করে গিয়ে রাজা চুপি চুপি দ্বীপটি দেখে এলেন। নির্জন একটি ভূখণ্ড। বেঁচে থাকার কোনো আয়োজনই সেখানে নেই। রাজা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একবছর পরে মৃত্যু সুনিশ্চিত। প্রকৃতি নিরস্ত্র মানুষকে ক্ষমা করে না। খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই, পানীয় নেই।
মানুষটি কিন্তু দমে গেল না। এক বছরের রাজা রোজ রাতে সবার অলক্ষ্যে সেই দ্বীপে যেতে লাগলেন। সময় থাকতে থাকতেই শুরু করে দিলেন বেঁচে থাকার আয়োজন। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল বাসস্থান। তৈরি হল খাদ্যসম্ভারের মজুত ভাণ্ডার। পানীয়ের আধার।
এদিকে বছর ঘুরে গেল। শেষ হয়ে গেল রাজত্বকাল। সিংহাসনচ্যুত রাজা চলেছেন নির্বাসনে। কোমরে দড়ি। চারপাশে প্রহরী। সকলে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এযাবৎ যত রাজা নির্বাসনে গেছেন, সকলেই গেছেন কাঁদতে কাঁদতে, ইনি চলেছেন মহানন্দে, প্রফুল্লবদনে।
কৌতূহলী একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ভয় করছে না। সামনেই তো আপনার মৃত্যু!
উত্তরে মৃদু হেসে রাজা বললেন, সময় থাকতেই আমি যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
আমরা ক’জন ভবিষ্যতের ভাবনা তেমন করে ভাবি! আর ভাবলেই বা কী করতে পারি। প্রাচ্যচিন্তায় ভবিষ্যতের ভাবনা আছে। পাশ্চাত্যচিন্তায় ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের আদর্শ হল পশ্চিম। বর্তমানই হল সব। কালকের কথা যারা ভাবে তাঁরা দুর্বল। গেঁয়ো। জিও পিও। ইংরেজ সঞ্চয়ের ধার ধারে না। আজ রাজার মতো বাঁচো। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।
কোকিলকে ডেকে কাক বললে, ভাই খুব তো কুহু কুহু করে কালোয়াতি করছ। একটা বাসাটাসা বানাও না। কোকিল বললে, ওসব আমার স্বভাবে নেই, ধাতে সইবে না। আমার ডিম আছে, তোমার বাসা আছে। আমি পাড়ব, আর বোকা তুমি তা দিয়ে মরবে। কোকিলের জন্যে কাক আছে মানুষের জন্যে কে আছে?
অর্থের চেয়ে বড় সম্পর্ক। জনৈক নাস্তিক পণ্ডিত বলেছিলেন, ঈশ্বর, ভাগ্যে এসব আমি মানি না। তবে জেনে রাখো, তুমি আর তোমার জগৎ মুখোমুখি। জগতের সামনে নিজেকে হাজির করার ওপর নির্ভর করছে তোমার ভাগ্য। নিজেকে ঘৃণিত করলে তুমি ঘৃণিত, নিজেকে ভালোবাসার পাত্র করতে পারলে সকলের স্নেহধন্য। কারুর মৃত্যুতে পাড়া ভেঙে পড়ে, কেউ মরলে কাঁধ দেবার লোক জোটে না। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে—অ্যাজ ইউ সো, সো উইল ইউ রিপ? যেমন বীজ ছড়াবে ফসলও উঠবে তেমন। মেয়েলি প্রবাদ, দুনিয়া হল আয়নায় মুখ দেখা।
তিব্বতীয় এক সাধুর জীবনের ঘটনা মনে পড়ছে। গুরুর নির্দেশে সাধু ছিলেন দীর্ঘ নির্জন সাধনায়। নির্জন খুপরিতে বসে বছরের পর বছর ধ্যান করতে করতে তিনি অলৌকিক দৃশ্য দেখতে শুরু করলেন। একটি মাত্র দৃশ্য। সেটি হল একটি মাকড়সা। ধ্যানে বসলেই তার আবির্ভাব। প্রথম আবির্ভাব ছিল ক্ষুদ্র। দিনে দিনে তা বড়ো আকারে দেখা দিতে শুরু করল। শেষে তার আকার দাঁড়াল সাধুর আকারের মতো। শুধু তাই নয় মাকড়সাটি সাধুকে ভয় দেখাতে শুরু করল। সাধু ছুটলেন গুরুর কাছে, কী করব গুরুজি?
গুরু বললেন, এরপর যেদিন মাকড়সাটা আসবে, তুমি তার পেটে একটা ঢ্যারা আঁকবে, হাতে নেবে একটা ছুরি, তারপর বেশ ভালো করে ঢ্যারার মাঝখানটা লক্ষ্য করে ফ্যাঁস করে বসিয়ে দেবে ছুরি।
পরের দিন সাধু প্রস্তুত হয়েই ধ্যানে বসলেন। যথারীতি সেই ভয়ংকর বিশাল মাকড়সার আবির্ভাব। সাধু সঙ্গে সঙ্গে পেটে ঢ্যারা আঁকলেন। তারপর বেশ দেখেশুনে ছুরি চালাতে গিয়ে কী মনে করে নীচের দিকে তাকিয়ে অবাক। এ কি ঢ্যারাটি যে তাঁর নিজেরই পেটে আঁকা। ছুরি বসাতে হলে যে নিজের পেটেই বসাতে হয়। তাহলে মানুষের ভেতর কোনটা আর বাইরেটাই বা কী? মানুষের ভেতর এইভাবেই অসতর্ক মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে এসে ভয় দেখাতে থাকে। বাইরেটাকে মারতে হলে ভেতরটাকেই মারতে হয়।
আমাদের ঘৃণা, আমাদের অহংকার আমাদের নিজেকেই ঘৃণিত করে তোলে। নিঃসঙ্গ করে দেয়। দুজন মাননীয় মানুষ। দুই বন্ধু। একজন আর একজনকে বলছেন, তোমার ভাই সুখের সংসার। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, পুত্রবধূ, সকলকে নিয়ে কেমন সুখে আছ। রাতে বাড়ি ফিরে একসঙ্গে বসে টিভি দেখছ। একই টেবিলে বসে একসঙ্গে হই হই করে খানা খাচ্ছ। সকালে পুত্রবধূ অফিসে আসার আগে হাতে টিফিন কৌটো এগিয়ে দিচ্ছে। তোমাকে দেখে আমার হিংসে হয়। আমার বাড়ি নয় তো, আতঙ্ক। ঢুকতেই ভয় করে। সুইট হোম নয় বিটার হোম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। যখন দেখি এবার রাস্তায় ঘুরলে পুলিশে ধরবে তখনই বাড়িমুখো হই। সুখী ভদ্রলোক তাঁর দুঃখী বন্ধুকে বললেন, একটি মাত্র কথাই বললেন, আমার সুখ আমি নিজের চেষ্টায় অর্জন করেছি ভাই। তুমি সংসারের জন্যে কী করেছ যে সংসার তোমাকে সুখী করবে? ভদ্রলোক নিরুত্তর। অতীতে প্রসারিত দৃষ্টি। অসংখ্য ভুলে ভরা জীবন।
বিশাল এক ব্যক্তি ছিলেন আমার প্রতিবেশী। বিরাট চাকরি। ঝকঝকে গাড়ি। সুন্দর বাড়ি। রোজ রাতে প্রচণ্ড মদ্যপান করে ফিরতেন। ছেলেরা চ্যাংদোলা করে বাপকে গাড়ি থেকে খালাস করে দোতলার বিছানায় নিয়ে গিয়ে ধপাস করে মালের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিত। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে তেড়েফুঁড়ে খাড়া হবার চেষ্টা করলেই ছেলেরা ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করে দিত। ভদ্রলোকের রাত কাটত আর্তনাদে। সারারাত যন্ত্রণায় আক্ষেপ, বাবারে, মারে। অবসর নেবার পর বছরখানেক বেঁচে ছিলেন অসংলগ্ন এক সংসারে বিদেশির মতো। দোষ কার? রামপ্রসাদ থাকলে বলতেন, দোষ কারো নয় গো মা/আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।
এই যে মায়ের সঙ্গে বউয়ের তিক্ত সম্পর্ক, শেষে ছেলের বউ নিয়ে পৃথক হয়ে যাওয়া, এ কি খুব সুখের! কেন এমন হয়! এ ঘটনা শিক্ষিতের সমাজেই বেশি ঘটে। ছেলেরা যত সহজে মেয়েদের বশ্যতা স্বীকার করে মেয়েরা কি তত সহজে করে! বিয়ের পরও মেয়েদের বাপের বাড়ির আকর্ষণ কমে না। আমার বাবা, আমার মা, আমার ভাই। বাপের বাড়ির টানটাই বেশি। ছেলে এদিকে বউ বউ করে নিজের গর্ভধারিণীকে গাদায় ফেলে দিলে। এক বৃদ্ধা আক্ষেপ করে বললেন, মা হল মাগি, আর বউ হল মা। হায় কলি! জনৈক রসিকপ্রবীণ বলেছিলেন, যেদিন দেখবে বালক গৃহভৃত্য চুলে আলবোট কেটে শিস দিয়ে ঘুরছে সেদিন বুঝবে তার হয়ে গেছে। আর যেদিন শুনবে তোমার ছেলে শ্বশুরমশাইকে তোমার সামনে বাবা, বাবা করছে, সেদিন থেকে তাকে খরচের খাতায় লিখে রাখবে। কলির শেষপাদে যা হবে তার বর্ণনায় এই লক্ষণই আছে, পুরুষ স্ত্রীর বশীভূত হবে। প্রকাশ্যস্থানে নারীপুরুষ মদ্যপানে বেঁহুশ হবে। সমস্ত খাদ্যবস্তু তার স্বাদ হারাবে। ঋতুর কোনো ঠিক থাকবে না। গুণীর কোনো কদর থাকবে না। মাস্তানে দেশ ভরে যাবে। কথায় আছে কাঠ খেলে আংরা দাস্ত হবে।
আবার একটি গল্প মনে পড়ছে। এক যুবক এক যুবতীর প্রেমে পাগল। বিয়ে করতে চায়। মেয়েটির একটি মাত্র শর্ত, তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি, যদি তুমি তোমার মায়ের হৃদয়টি কেটে এনে আমাকে উপহার দিতে পারো। ছেলেটি বাড়ি ফিরে এসে নিদ্রিত মায়ের হৃৎপিণ্ডটি ছুরি চালিয়ে বের করে আনল। কোনো বাধা পেল না। কী আনন্দ! প্রেমিকা এখন তার হাতের মুঠোয়। সেই রাতেই মাঠময়দান ভেঙে যুবক ছুটল প্রেমিকার কাছে তার প্রার্থিত উপহার নিয়ে। অন্ধকার রাত। এবড়োখেবড়ো জমি। হোঁচট খেয়ে যুবক ছিটকে পড়ল। মায়ের হৃৎপিণ্ডটি হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। অন্ধকারে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যুবকটি শুনল, মায়ের কণ্ঠস্বরে কাটা হৃৎপিণ্ডটি বলছে, বাবা খুব লাগেনি তো!
মানুষ থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে সমাজ, সমাজ থেকে জাতি, জাতি থেকে জাতিপুঞ্জ। আমাদের রক্তে ঢুকে আছে সমাজবদ্ধতা, জাতিবদ্ধতার বীজ। অস্বীকার করলেই আমরা একক। নিঃসঙ্গতায় সুখ নেই। আমার অতীত তৈরি করছে আমার বর্তমান। সারা জীবন সকলকে বলেছি তফাত যাও, এখন কাছে এসো বললে কে আসবে! অতীতে নিজের সেবাই করেছি, এখন কে আমার সেবা করবে! অতীতে নিজের অহংকারের বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন ছিলাম, এখন কে আমায় সঙ্গ দেবে! হেট বিগেটস হেট, লাভ বিগেটস লাভ। অসংলগ্ন সংসারের আর্তনাদ চারপাশে। ক্লিন্ন পারস্পরিক সম্পর্ক। পাড়ায় পাড়া নেই। সংসারে সংসার নেই। প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান নেই। সুখ বস্তুটিই উধাও। ঐশ্বর্য আছে। কেতা আছে। আর আছে বিলিতি কায়দার ওলড—এজ হোম। আর আছে করুণ সুর—হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল/পার করো আমারে।।