আকাশ পাতাল – ১১

১১

শুনেছিলাম তিনি ঠনঠনে কালীবাড়ির কাছেই কোথাও থাকেন। ঠিক বাড়ির নম্বরটা জানিনা বাড়ি নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে।

বছর তিনেক আগে এক দুপুরবেলা আমি ট্রাম থেকে ঠনঠনের সামনে নেমে পড়েছিলাম। একটু ভয় ভয় করছিল, কী জানি কেমন লোক, আমি বিরক্ত করতে এসেছি বলে যদি ধমকে ওঠেন। যাইহোক আজ দেখা না-করে আর ফিরছিনা।

কালীবাড়ির রকে একজন লোক বসে আছে, এমন চেহারা যে বয়স বোঝার কোন উপায় নেই। লোকটির মুখে কাচা-পাকা মুড়ি-মিছরি ধরনের দাড়ি কিন্তু মাথার চুল কুচকুচে কালো। আমি একটুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এ পাড়ায় শিবরাম চক্রবর্তী কোথায় থাকেন বলতে পারেন?

লোকটি প্রথমেই আমার সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করল। হয়তো আমার লেখা উচিত ছিল, ‘করলেন’ কিন্তু লোকটির ব্যবহার এমন যাচ্ছেতাই যে এসব লোককে কিছুতেই আপনি বলা যায়না। ওরকম কুটিলভাবে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখার দরকারটা কী? লোকটির গলার আওয়াজ কাক ডাকার মতন, জিজ্ঞেস করল, কে থাকে? কী নাম?

আমি সম্ভ্রমপূর্ণ গলায় পুনরায় বললুম, আজ্ঞে, শিবরাম চক্রবর্তী। দয়া করে যদি—

দয়া করে যদি—

—বাড়ির নম্বর কত?

— আজ্ঞে বাড়ির ঠিকানাটা ঠিক জানিনা সেইজন্যই তো—

—বাড়ির ঠিকানাটা জানো না, কলকাতা শহরে লোক খুঁজতে এসেছ? কে পাঠিয়েছে তোমায়?

—কেউ না, উনি বিখ্যাত লোক, তাই আমি ভেবেছিলাম—

লোকটি হঠাৎ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বিখ্যাত লোক এ পাড়ায়?

তারপর সে ঠোঁটদুটি পুরো ফাঁক করল। অর্থাৎ হাসি। বলল, এ পাড়ায় বিখ্যাত লোক দুজনই আছে, আমি আর কাশীরাম ভট্টাচার্যি। আমায় তো চেনোই দেখছি, কাশীরাম ভট্টচার্যির নাম শুনেছ? প্রখ্যাত জ্যোতিষী সম্পর্কে আমার আপন ভগ্নিপোত, তুমি বোধহয় তাকেই—

আমি বললুম, আমি নাম শুনিনি বটে, কিন্তু উনি নিশ্চয়ই খুব বিখ্যাত। তবে আমি খুঁজছি শিবরাম চক্রবর্তীকে।

—তবে যে বললে বিখ্যাত লোককে খুঁজছ? সে লোকটা কিসে বিখ্যাত?

—উনি একজন লেখক। আমাদের শ্রদ্ধেয়—

—লেখক! কী লেখে?

প্রধানত হাসির গল্পই লেখেন। তাছাড়া আগে—

—হাসির গল্প? চালাকি পেয়েছ?

লোকটি এবার বেশ ক্রুদ্ধ। সোজা হয়ে বসে বলল, হাসির গল্প আবার লেখার কী আছে হে! ওসব মানুষে লেখে? লেখে লোকে ধম্মোকৰ্ম্ম, সদা সত্য কথা, কী করে স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হয়—এইসব নিয়ে। তুমি এসেছ হাসির গপ্পো চালাতে? আমার সঙ্গে ফাজলামি-এয়ার্কি?

ইতিমধ্যে তিন-চারজন কৌতূহলী লোক জমে গেছে! একজন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? পকেটমার না জুতোচোর? আজকাল কালীবাড়িতে এমন জুতোচোরের উপদ্রব হয়েছে। আরেকজন বলল, পকেটমার না তো?

মূল লোকটি খেঁকিয়ে উঠে বলল, ছোকরাকে দেখছি তখন থেকে এখানে ঘুরঘুর করছে। বাবুরাম চক্কোবর্ত্তী না কাকে খোঁজার ছুতো।

আমি ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে বললুম, বাবুরাম না শিবরাম।

–ও নামে কেউ এ পাড়ায় থাকে? আপনারাই বলুন! আমি তিরিশ বছর এ পাড়ায় আছি, আমি জানিনা!

জনতা বলল, ঐ তো কাশীরামবাবু আসছেন, ওকেই জিজ্ঞেস করুননা!

বেশ টের পেলাম, লোকে আমায় ঘিরে ধরেছে! দৌড়ে পালাতে গেলে হিতে—বিপরীত হবার সম্ভাবনা। কাশীরামবাবুর চেহারা রোগা-চিমশে ধরনের, কপালে ফোটা-তিলক। দেখে আরো ভয় হল। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, খুব বেশি রোগা লোকেরা কিছুতেই সরল কথা বোঝেনা। সবসময়েই তাদের জেরা করার টেণ্ডেন্সি। ইনিও এসে শুনে সাহাস্যে বললেন, আগে বলো তো বাপু, এ পাড়ার সেই লোকটির সঙ্গে তোমার কী দরকার?

সর্বনাশ, একথা আগে তো একবারও ভাবিনি। দরকার তো কিছু নেই? আমি আমতা-আমতা করে বললুম, না, মানে, শুধু একবার চোখের দেখা দেখতে—

জনতা গর্জন করে উঠল, অ্যাঁ, দেখতে? শুধু দেখতে? একজন জলজ্যান্ত মানুষকে শুধু চোখের দেখা দেখতে? স্পাই! স্পাই!

কাশীরামবাবুই দয়ালুভাবে বললেন, আহা-হা, আগেই মারধোর শুরু কোরো না! আগে দেখা যাক, সত্যিই ও নামের কোন লোক এ পাড়ায় থাকে কি না! যদি এখান থেকে তিন মাইলের মধ্যেও কোথাও সে থাকে, আমি গুণে বলে দেব!

ফতুয়ার পকেট থেকে খড়ি বার করে তিনি মাটিতে আঁকিবুকি কাটতে লাগলেন। গোটাকয়েক চৌখুপি আর ঢ্যাড়া। চক্রবর্তী তাহলে তোমার হল গিয়ে অমুখ গোত্র, নামের প্রথমে যদি তালব্য শ থাকে—। আমি তখন দরজা-জানালা—বন্ধ-ঘরের মধ্যে বেড়ালের মতন আটকে পড়েছি। ভাবছি এবার আঁচড়ানো—কামড়ানো শুরু করব কি না। নাকি কেঁদে-কেঁদে মাটিতে গড়াগড়ি দেব!

খানিক বাদে চোখ খুলে কাশীরাম জ্যোতিষার্ণব বললেন, তেমনি হাসি-হাসি মুখ, নাঃ ও নামে কোন লোক থাকতে পারেনা। সর্বৈব বাজে কথা। এ পাড়ায় কেন, কোথাও নেই!

আমি বললুম তাহলে মন্টুর মাস্টার কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে—এগুলো কে লিখেছে? নাকি আপনি বলতে চান, এরকম কোন বইও নেই?

এমন সময় একটি শৌখিন চেহারার যুবা, ফর্শা, সুদর্শন, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, ধপধপে আদ্দির পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম—ভিড়ের মধ্য থেকে এসে আলতোভাবে আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলল আহা, ওকে ছেড়ে দিন! ও আমাকে খুঁজছে!

আমার চেয়েও কাশীরামের বিস্ময় বেশি। হাঁ করে তাকিয়ে বললেন, আপনিই? তা চক্রবর্তী আপনার উপাধি না খেতাব? রাঢ়ী না বারেন্দ্র? খড়দা মেল না ফুলেল মেল? ওঃ! তাই বলুন, এইজন্য আমার গণনা একটুর জন্যে মেলেনি!

বলেই কাশীরাম ভিড়ের মধ্যে সুট করে মিশে গেলেন। যুবকটি আমার হাত ধরে ফাঁকায় নিয়ে এসে সস্নেহে বললেন, এবার বলো!—আমার বুকের ধড়ফড় তখনো কমেনি। ঢোক গিলে বললাম, আপনার এত বয়স কম? আমি ভেবেছিলাম একেবারে অন্যরকম।

যুবকটি বললেন,

অন্যরকম অন্যবেশি
বুঝলে বেশির কম, কমবয়সী?

অথবা বলতে পারো, বয়সের ভয়েস কখনো বেশি Boyish কখনো বায়সের মতন Raw. কখনো ভঁইসের মতন…

আমি বললুম, সত্যিই যদি আপনার কম বয়েস হয়, তবে আমাকে ‘তুমি বলবেন না। আমিও রোজ-রোজ দাড়ি কামাই।

–রোজ রেজারে দাড়ি কামাও, না দাড়ি কামিয়ে রোজের রুজি রোজগার করো, তোমার চেহারাখানা তো দেখলে মনে হয়, চেয়ারহারা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামানোই…

একটু আস্তে-আস্তে বললুম, না, আমি লিখে নিই। অত তাড়াতাড়ি বলছেন একটু মাঝে-মাঝে দাড়ি-কমাও না বসালে—

—বেশ-বেশ শিখে গেছো দেখছি। তোমারও হবে। চালিয়ে যাও। পেছন থেকে রুক্ষ গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, এই পল্টু! পল্টু! একঝলক তাকিয়ে দেখি একজন বেঁটে-কালো-গুণ্ডা চেহারার লোক আমাদেরই দিকে তাকিয়ে ডাকছেন। যুবক শিবরাম চক্রবর্তীর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। আমার নাম যে পল্টু নয়, সে ই অন্তত আমি ভালোরকমই জানি। আবার পল্টু, পল্টু ডাক শুনে আমি ওঁকে বললুম, আপনাকে ডাকছেন বোধহয়। আপনার ডাকনাম পল্টু বুঝি?

হ্যাঁ।

—তাহলে আপনি শিবরাম নন্ শিবরামের ডাকনাম কখনো পল্টু হতে পারেনা!

পিছন থেকে সেই লোকটি এসে বলল, ও বুঝি তোমায় বলেছে, ও শিবরাম। ব্যাটা মহাজোচ্চোর! শিবরাম হচ্ছি আসলে আমি, আমার নাম শিবরাম সেন— একথা বলেই লোকটার কী হাসি।

আমি বললুম, কিন্তু আমি তো শিবরাম চক্রবর্তীকে খুঁজছি। সেন তো না! ঐ হোল। আমিই আস্তে-আস্তে চক্রবর্তী হয়ে উঠব। শুনবে? আমি মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের বাড়ির তক্তায় শুয়ে শুক্তো খাই। স্ত্রীকে দিয়ে জামাটা ইস্তিরি করিয়ে নিয়ে মিস্তিরি খুঁজতে যাচ্ছিলুম এমন সময় চটির সঙ্গে চটাচটি হয়ে—

প্রাগুক্ত যুবক বললেন, ধুৎ! বাজে! সব মুখস্ত। কেন ছেলেটাকে শুধু-শুধু ঠকাচ্ছ? আমার মতন বানান নিয়ে বানানোর ক্ষমতা আছে তোমার? এসো না কমপিটিশন হয়ে যাক!

-কমপিটিশনে কে জজ হবে?

–কেন, এই ছেলেটি!

—উঃ, যদি কারুকে কম পিটি কারুকে বেশি পিটি করে?

আচ্ছা, ঐ তো বড়দা আসছেন, বড়দাকে জাজ করা যাক।

একজন সৌম্য চেহারার, প্রৌঢ় আসছিলেন। বিশাল দেহ, মাথাভর্তি চকচকে টাক, সোনার চশমা, গরদের পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি। মনে হয় কোন রিটায়ার করা জমিদার বিকেলের ভ্রমণে বেরিয়েছেন। লোকদুটো ওঁর কাছে গিয়ে বললে, বড়দা, আপনি বিচার করে বলুন তো আমাদের মধ্যে কে সত্যিকারের শিবরাম?

প্রশান্ত হাস্যে সেই প্রৌঢ় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে দেখে খুশি হলাম। পাঠকদের দেখা পাওয়াই তো আমাদের সৌভাগ্য। এই দুটোর কোন কথায় কান দিওনা। ওরা হচ্ছে রামশিব, আমিই হচ্ছি আসল শিবরাম। শিবরামের Soul! আর কারুর কথায় বিশ্বাস, কোরো না, আমার কোন ব্রাঞ্চঅফিস নেই!

লোকদুটো বলল, বড়দা, এ কী হচ্ছে? এ আপনার অন্যায়!

রহস্যময়ভাবে প্রৌঢ় বললেন, আমিই যে আসল শিবরাম, তোরা এতদিন জানতে পেরেছিলি? অবশ্য, এখন আমি প্রমাণ দিতে গেলে তোদের কাছে হেরেও যেতে পারি। জানিস তো, বার্নার্ড শ-এর মতো গদ্য কে লিখতে পারে, এই নিয়ে ‘একবার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। স্বয়ং বার্নার্ড শ-ও তাতে ছদ্মনামে লেখা পাঠিয়ে পেয়েছিলেন মোটে তৃতীয় পুরস্কার। তেমনি তোদের কাছে আমি হেরে গেলেও—

যুবাটি বলল, আপনার চালের ব্যবসা, আপনি লাকি ম্যান তা বলে চালাকি করছেন এখানে? আপনি যদি শিবরাম চক্রবর্তী হন তো, আপনার চুল কোথায়? শৈল চক্রবর্তীর সব ছবিতে আছে, কপালের পাশে একগোছা চুল এসে পড়েছে, এই দেখুন না, আমার মতন—

প্রৌঢ় হঠাৎ চুপসে গিয়ে বললেন, ওসব আগেকার ছবি। আগে যখন আমার চুল ছিল—

-বাজে কথা! কুড়ি বছর ধরে আপনাকে দেখছি এইরকম গোল আলুর মতন মাথা, জম্মো থেকে আপনার টাকালু!

এরপর সেই তিনজন লোক শিবরামত্ব নিয়ে মহা ঝগড়া আরম্ভ করে দিল। আমি কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর দৌড়ে চলন্ত ট্রামে উঠে পড়লাম।

শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে তারপরও আমার কোনদিন দেখা হয়নি! দেখা হবেওনা জানি। আমার ধারণা শিবরাম চক্রবর্তী নামে বোধহয় কোন লোক নেই। শিবরাম চক্রবর্তী আসলে অনেকগুলো লোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *