আকাশবাণী
ক্লাবের বারান্দায় আমরা কয়েকজন নীরবে বসিয়া ধূমপান করিতেছিলাম। ফাল্গুন মাসের অপরূপ একটি গোধূলি যেন বাতাসে গোরোচনার স্নিগ্ধ শীকর-কণা ছড়াইতেছিল। এমন সন্ধ্যায় বরদার মুখেও ভূতের গল্প বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, সে গুন গুন করিয়া একটি প্রেমের গান ভাঁজিতেছিল। ‘যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি’।
এমন সময় সুধাংশু আসিয়া দেখা দিল। সুধাংশু আমাদের বন্ধু হইলেও এতদিন ক্লাবের সভ্য ছিল না, সম্প্রতি হইয়াছে। সম্ভবত বরদার সঙ্গে ভূত-প্রেত লইয়া তর্ক করিবার মতলব লইয়াই সে ক্লাবে ঢুকিয়াছে। প্রেতযোনি সম্বন্ধে এতবড় নাস্তিক বড় একটা দেখা যায় না; বরদার সঙ্গে চোখাচোখি হইলেই তাহার মুখ লড়ায়ে মেড়ার মতো যুযুৎসু ভাব ধারণ করিত। তারপর দু’জনের মধ্যে যে তর্ক আরম্ভ হইত তাহার তুলনা খুঁজিতে হইলে রামায়ণ মহাভারতের শরণাপন্ন হইতে হয়। কিন্তু আজ লক্ষ্য করিলাম, সুধাংশুর সে তেজ নাই, মুখখানা কেমন যেন ফ্যাকাসে। মনের মধ্যে সে যেন বড় রকম ধাক্কা খাইয়াছে।
অমূল্য জিজ্ঞাসা করিল, ‘হে সুধাংশু, কেন পাংশু বদন তোমার?’
সুধাংশু উত্তর দিল না, সোজা বরদার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। তদ্গতভাবে কিছুক্ষণ তাহার মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া গাঢ় স্বরে কহিল, ‘ভাই বরদা, পায়ের ধুলো দাও।’ বলিয়া তাহার পায়ে হাত ঠেকাইয়া মাথায় স্পর্শ করিল।
আমরা সকলে হাঁ করিয়া রহিলাম; এমন কাণ্ড জীবনে দেখি নাই। বরদাও ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গিয়াছিল; সুধাংশুর হাত ধরিয়া পাশের চেয়ারে বসাইতেই সে বলিয়া উঠিল, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কালকের ঘটনার পর আর আমার প্রেতযযানিতে অবিশ্বাস নেই।’
অতঃপর ‘কালকের ঘটনা’ শুনিবার জন্য আমরা তাহাকে ঘিরিয়া বসিলাম। কিছুক্ষণ উন্মনাভাবে আকাশের পানে তাকাইয়া থাকিয়া সুধাংশু আরম্ভ করিল—
মাসখানেক হল আমাদের পাড়ায় একটি নতুন বাঙালী ভদ্রলোক এসেছেন—প্রিয়তোষবাবু। ওই যে বাড়িখানা আগে মাইনর স্কুল ছিল, সেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন। বাড়ির চারধারে পাঁচিল-ঘেরা ফাঁকা জমি; হল্দে রঙের বাড়িখানা। দেখেছ বোধহয়।
প্রথম দিনই প্রিয়তোষবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। পাড়ায় নতুন বাঙালী এসেছেন, তাই সাদর সম্ভাষণ করবার জন্যে নিজে উপযাচক হয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলুম। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের একটি সৌখীন গোছের ভদ্রলোক; প্রথমদিন এসেই মিস্ত্রী ডাকিয়ে বাড়ির মাথার ওপর রেডিওর এরিয়েল বসাচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে মামুলি দু’চারটে কথা হ’ল। কাজকর্ম কিছু করেন না; পয়সা আছে। পুত্ৰকলত্রও কেউ নেই—বছর দশেক আগে পত্নীবিয়োগ হয়েছে। তারপর থেকে খেয়ালমত এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। এর আগে বছর দেড়েক গয়ায় ছিলেন। সেখানে আর মন টিক্ল না তাই চলে এসেছেন।
ভদ্রলোক একলা থাকেন, অথচ এত বড় বাড়ি নিয়ে কি করবেন, এই ভেবে তখন একটু আশ্চর্য মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রথম আলাপেই তো ওকথা জিজ্ঞাসা করা যায় না। তিনি যেসব আসবাবপত্র সঙ্গে এনেছিলেন তাও বেশ দামী আর সৌখীন। দেখলুম লোকটি বিপত্নীক এবং বয়স্থ হলে কি হয়, প্রাণটা বেশ তাজা রেখেছেন।
তারপর আরও বার দুই তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলুম। তাঁর চরিত্রে দু’একটি ছোটখাটো অসঙ্গতি চোখে পড়েছিল। তিনি সৌখীন লোক, কিন্তু স্বপাক আহার করেন; একটিমাত্র শুকো চাকর রেখেছেন, সে দিনের বেলায় কাজকর্ম সেরে বাড়ি চলে যায়। তাঁর বাড়িতে মেয়েমানুষের পাট নেই, অথচ বসবার ঘরটি ছবির মতো সাজিয়ে রেখেছেন। পুরুষমানুষ যে এত গোছালো হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আরও লক্ষ্য করলুম, লোকটি যে পরিমাণে অমায়িক সে পরিমাণে মিশুক নয়। কথা ভারি মিষ্টি, কিন্তু কম কথা বলেন। কথা বলতে বলতে বা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। তাছাড়া আমি তিনবার তাঁর বাড়িতে গেলুম, তিনি একবারও তার পাল্টা দিলেন না। একটু বিরক্তি বোধ হল; সন্দেহ হল, তিনি হয়তো মনে করেন তাঁকে বড়লোক মনে করে আমি তাঁর মোসাহেবি করবার চেষ্টা করছি। যাওয়া বন্ধ করে দিলুম। তারপর পথেঘাটে মাঝে মাঝে দেখা হত, এই পর্যন্ত।
এইভাবে হপ্তা তিনেক কেটে গেল। প্রিয়তোষবাবুর সম্বন্ধে মনটা যখন প্রায় নির্লিপ্ত হয়ে এসেছে এমন সময় তাঁর নামে কয়েকটা কথা কানে এল। এসব খবর মেয়েদের কানেই আগে পৌঁছোয়; আমার স্ত্রী খবরটা দিলেন। প্রিয়তোষবাবু নাকি সুবিধের লোক নন, রাত্রি দশটার পর তাঁর বাড়িতে মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ শোনা যায়। পাড়ার কেউ কেউ শুনেছে।
এমন কিছু অসম্ভব কথা নয়, মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। প্রিয়তোষবাবুকে যেটুকু দেখেছিলুম তাতে তাঁকে লম্পট দুশ্চরিত্র বলে মনে হয়নি। তবু, কিছুই বলা যায় না। যাদের সারা জীবন ধরে দেখছি তাদেরই চিনতে পারলুম না, আর প্রিয়তোষবাবুর চরিত্র এক নজরে চিনে নেব এত অহঙ্কার আমার নেই।
তা ছাড়া, সত্যি হোক আর মিথ্যে হোক, এ বিষয়ে করবার কিছু নেই; করবার মধ্যে বৈঠকখানায় বসে মুখরোচক জল্পনা করতে পারি। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল।
কাল সকালবেলা পাড়ার ছোকরা দলের চাঁই ভূতো আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। ভূতো ডাকাবুকো ছেলে, মনের মধ্যে মারপ্যাঁচ নেই; মেজাজ কড়া। সে এসেই প্রিয়তোষবাবুর কথা তুললে, ‘শুনেছেন বোধহয়?’
দেখলুম ভূতোর মন এখনও আমাদের মতো নির্লিপ্ত জল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠেনি। কুণ্ঠিতভাবে স্বীকার করতে হল, ‘কিছু কিছু শুনেছি বৈকি।’
ভূতো টেবিলের ওপর কীল মেরে বললে, ‘এ রকম লোক পাড়ায় রাখা যেতে পারে না। ছেলেরা বলছে, একদিন ধরে দু’ঘা দেওয়া যাক, তাহলেই পালাবে।’
ভূতো আর তার দল বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু মনে মনে তাদের বাহুবলকে সম্ভ্রম করি। তবু ক্ষীণ আপত্তি করে বললুম, ‘শুধু কানাঘুষোর ওপর এতটা বাড়াবাড়ি করা কি ঠিক হবে? বরং কথাটা সত্যি কিনা ভালভাবে যাচাই করে যা হয় করা উচিত।’
ভুতো বললে, ‘বেশ তো, আপনিই যাচাই করুন।’
অতঃপর ভূতোর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হল রাত্রে গিয়ে প্রিয়তোষবাবুর বাড়িতে আড়ি পাতা। কাজটা মোটেই রুচিকর মনে হল না; কিন্তু একটা লোককে উত্তম-মধ্যম দেবার আগে তার অপরাধ সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া ভাল।
রাত্রি সাড়ে দশটার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে রবার-সোল্ জুতো পায়ে দিয়ে বেরুলুম। স্ত্রীকে বলে গেলুম, ‘ফিরতে হয়তো দেরি হবে। ঘুমিও না। দিল্লী থেকে ‘ফিল্মি গান’ দিচ্ছে, রেডিওতে তাই শোন।’
প্রিয়তোষবাবুর ফটকের সামনে ভূতোর সঙ্গে দেখা হল। ভূতোটা এমন গোঁয়ার, জুতো পরে এসেছে যার আওয়াজ দেড় মাইল দূর থেকে শোনা যায়। তাকে বললুম, ‘ও জুতো পরে তোমার ভেতরে যাওয়া চলবে না। শিকার ভড়্কে যাবে।’
সে বললে, ‘বেশ, আমি বাইরে পাহারায় রইলুম।’
রাস্তা তখন নির্জন হয়ে গেছে। প্রিয়তোষবাবুর বাড়ি অন্ধকার। ফটক পার হয়ে পা টিপে টিপে চললুম। বাড়ির সামনাসামনি এসে সদর দরজার মাথার ওপর খিলেনের কাচের ভিতর দিয়ে একটু আলো চোখে পড়ল।
ঘরের দরজা জানলা সবই বন্ধ, কিন্তু ভেতর থেকে একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন আসছে—যেন কারা খাটো গলায় কথা কইছে। আমার বুকের মধ্যে একবার দুড়দুড় করে উঠল—কারণ, পরের বাড়িতে গিয়ে চোরের মতো আড়ি পাতার অভ্যেস কোনকালে নেই। যদি ধরা পড়ি তাহলে কী বলব, তার একটা খসড়া মনে মনে মক্শ করে রেখেছিলুম; কিন্তু স্নায়ুর কম্পন তাতে থামল না। যাহোক, অপ্রীতিকর কর্তব্য যখন করতেই হবে তখন দ্বিধা করে লাভ নেই।
বাড়ির সামনে এক ফালি খোলা বারান্দা, তারপরই বৈঠকখানা ঘর। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে বৈঠকখানার বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছিল—ফাল্গুন রাতের হাওয়া—ঠাণ্ডা আর মোলায়েম। এমন কিছু বুড়ো হইনি। মনে হল, এমন রাত্রে কোনও প্রণয়ীর ঘরে গুপ্তচরবৃত্তি করা একটা অপরাধ, তা হোক না সে অবৈধ প্রণয়! কিন্তু সে যাক, ওটা মনের ক্ষণিক দুর্বলতা মাত্র।
ঘরের মধ্যে দু’জন লোক কথা কইছে; বেশ সহজ গলাতেই কথা কইছে। একজনের গলা চিনতে কষ্ট হল না, নিঃসংশয়ে প্রিয়তোষবাবুর গলা। অন্য গলাটি—হ্যাঁ, স্ত্রীলোকেরই বটে। মিষ্টি ভরা গলা—কিন্তু ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়; এস্রাজের তারের আওয়াজের মতো তাতে একটা ধাতব ঝঙ্কার আছে।
কান পেতে শুনতে লাগলুম। গলার আওয়াজ বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কথাগুলো ঠিক ধরতে পারছি না। একবার মনে হল প্রিয়তোষবাবু কবিতা আবৃত্তি করছেন—‘তুমি সকল সোহাগ সয়েছিলে সখি—’…..তারপর কিছুক্ষণ কথাবার্তা অস্পষ্ট হয়ে গেল। দোরের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শোনবার চেষ্টা করলুম…কথাবার্তার সুর বদলে গেছে—মান-অভিমানের পালা চলছে। মনে হল যেন মেয়েলি গলা বলছে…‘যাও, তোমার সঙ্গে আর কথা কইব না…আর আস্বোও না…কেন তুমি—?’
আমার মনের মধ্যে শুধু বিস্ময়ই নয়, আতঙ্কও জমা হয়ে উঠছিল। কারণ, মেয়েলি গলাটি কেবল বাঙালী মেয়ের গলাই নয়, শিক্ষিত মার্জিত বাঙালী মহিলার গলা! মনে মনে ঘেমে উঠছিলুম আর ভাবছিলুম—কে হতে পারে?
হঠাৎ ঘরের মধ্যে সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় দশ সেকেন্ড আর কোনও শব্দ নেই। তারপর একটি সুমিষ্ট ব্যঙ্গ-হাসি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠ্ল।
হাসি থামলে স্পষ্ট স্ত্রীকণ্ঠ শুনতে পেলুম—‘একটি ভদ্রলোক দোরের কাছে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছেন। যাও, আদর করে ঘরে এনে বসাও।’
চমকে উঠলুম। পালাব কিনা ভাবছি, এমন সময় প্রিয়তোষবাবু দরজা খুলে দাঁড়ালেন। ঘরের মধ্যে আলো ছিল, মৃদুশক্তির একটা নীল বাল্ব জ্বলছিল; দেখলুম প্রিয়তোষবাবুর মুখে বিরক্তি এবং ক্ষোভ মাখানো রয়েছে বটে, কিন্তু অবৈধ প্রণয়ে ধরা পড়ার লজ্জা সেখানে লেশমাত্র নেই। তিনি বললেন, ‘আসুন।’
একরকম অসাড়ভাবেই ঘরে ঢুকলুম। ঘরের মধ্যে কিন্তু আর কেউ নেই; মেয়েলি গলার অধিকারিণী কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেবল ঘরের একপাশে রেডিও সেটের ভেতর থেকে আলো বেরুচ্ছে; যেন প্রিয়তোষবাবু এতক্ষণ বসে রেডিও শুনছিলেন, যন্ত্রটা বন্ধ না করেই দরজা খুলতে এসেছেন।
প্রিয়তোষবাবু যদি আমার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতেন তাহলে আমিও একটু জোর পেতুম কিন্তু এতই ভদ্রভাবে আমাকৈ রেডিওর কাছে নিয়ে গিয়ে বসালেন যে, আমার মুখে আর কথা যোগালো না। তিনি নিজের মুখের ওপর দিয়ে একবার হাত চালিয়ে ধীরভাবে প্রশ্ন করলেন, কিছু দরকার আছে কি?’
আমি উত্তর দেবার আগেই সেই ব্যঙ্গহাসি আমার কানের কাছে আবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। আমি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, আওয়াজটা আসছে রেডিওর ভেতর থেকে! তারপরই কথা শুনতে পেলুম, বিদ্রূপভরা তীক্ষ কণ্ঠের কথা—‘দরকার কাছে বৈকি; তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ তাই চুরি করে শুনতে এসেছেন!’
সভয়ে রেডিওর কাছ থেকে সরে এলুম। মাথার চুল বোধহয় খাড়া হয়ে উঠেছিল, গায়েও কাঁটা দিয়েছিল। বিহ্বলভাবে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এ কি? কে কথা কইছে, প্রিয়তোষবাবু?’
প্রিয়তোষবাবু একবার চোখ তুলে আমার পানে চাইলেন, তারপর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমার স্ত্রী।’
‘আপনার স্ত্রী! কিন্তু—’
রেডিওর মধ্য থেকে গঞ্জনাভরা কঠিন স্বর বেরিয়ে এল, ‘কিন্তু তিনি মারা গেছেন—এই না? তাতে আপনার কী? আপনি কেন আমার স্বামীকে বিরক্ত করতে এসেছেন? যান বাড়ি যান। কী রকম ভদ্রলোক আপনি? আমার স্বামীর চরিত্র তদারক করবার কী অধিকার আছে আপনার? উনি আপনাদের পাড়ায় এসে আছেন, আপনাদের পাড়া পবিত্র হয়ে গেছে জানেন তা?’ তারপর হঠাৎ এই তপ্ত ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর উদ্বেগে যেন গলে গেল—‘ওগো যাও, এবার শুয়ে পড় গিয়ে—নইলে শরীর খারাপ হবে। অনেক রাত হয়েছে।’
প্রিয়তোষবাবু উঠে দাঁড়ালেন। আমার মাথার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল, নেহাৎ গ্রাম্য লোকের মতো বললুম, ‘কিন্তু কিছু যে বুঝতে পারছি না! রেডিওর ভেতর থেকে—?’
ক্লান্ত স্বরে প্রিয়তোষবাবু বললেন, ‘রেডিওতে আমার স্ত্রী রোজ এই সময় আমার সঙ্গে কথা কন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এমনি হয়ে আসছে। আমার জীবনের এই একমাত্র সম্বল। উনিই সংসার চালান, উনিই সব কিছু করেন—আমি শুধু ওঁর কথা মতো কাজ করে যাই।’
বিস্ময়ের ঘোরে মনটা তখনও অর্ধ-মুর্ছিত হয়ে ছিল; বললুম, ‘কিন্তু এ কি করে সম্ভব হয়—?’
রেডিও থেকে অধীর উত্তর এল, ‘আপনি সে বুঝবেন না—বোঝবার বৃথা চেষ্টাও করবেন না। তার চেয়ে বাড়ি যান—আপনার স্ত্রীর বুকের ব্যামো আছে না? ভাল চান তো শিগ্গির বাড়ি যান, নইলে হয়তো আর দেখতে পাবেন না।’
শেষের দিকে কথাগুলো ভয়ঙ্কর গম্ভীর হয়ে উঠল।
সেই যে সাধু ভাষায় বলে বেত্রাহত কুক্কুর, ঠিক সেইভাবে প্রিয়তোষবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িমুখো দৌড়োতে আরম্ভ করলুম। পথে ভূতো বোধহয় সঙ্গ নিয়েছিল, কিন্তু সেটা জাগ্রত চেতনার কথা নয়—আবছায়া একটা অনুভূতি মাত্র।
বাড়ি পৌঁছে দেখি, বসবার ঘরে রেডিওটা খোলা রয়েছে, কিন্তু তার ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ বেরুচ্ছে না। আর মেঝের ওপর মাদুর পেতে স্ত্রী পড়ে আছেন। তাঁর দু’চোখ বন্ধ; একটা হাত এমন অস্বাভাবিকভাবে ছড়ানো রয়েছে যে, মনে হয়—
মনের অবস্থা বুঝতেই পারছ। প্রায় তাঁর ঘাড়ের ওপর আছড়ে পড়লুম। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, ‘অ্যাঁ—এলে! আমার একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল—’
রেডিওর মধ্য থেকে তরল কৌতুকের হাসি এস্রাজের ধাতব মূৰ্ছনার মতো বেরিয়ে এল। তারপর সেই গলার আওয়াজ,—‘কেমন জব্দ! আর যাবেন পরের হাঁড়িতে কাঠি দিতে?…স্বামী-স্ত্রীর কথা চুরি করে শুনতে গিয়েছিলেন, তাই একটু ভয় দেখালুম। আর কখনও এমন কাজ করবেন না…’
৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৩