আকাশচুম্বী

আকাশচুম্বী

সন্ধের পর থেকেই একটু একটু বৃষ্টি পড়ছে, ও এমন কিছু না। লোডশেডিং হয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে, তাতেই বা কী আসে যায়। কলকাতার রাস্তার সঙ্গে এখন গ্রামের রাস্তার কোনো তফাত নেই। ওদের দুজনের হাঁটতে একটুও অসুবিধে হয় না।

গড়িয়াহাটের মোড় পেরিয়ে ওরা এগিয়ে গেল গোলপার্কের দিকে। চতুর্দিকে এত মানুষের ভিড়, তার মধ্যে ওরা আলাদা। ওরা নিজেদের নিয়েই মশগুল।

মেয়েটি পরে আছে একটা ফুলছাপ শাড়ি। ওর নাম মুন্নি। ছেলেটি মালকোঁচা মারা ধুতির ওপর পরেছে একটা নীল হাফশার্ট। ওর নাম জাদু।

দুজনেরই তেজি চামড়া, শরীরের কোথাও এক ছিটে চর্বি নেই, কোথাও কোথাও একটু-আধটু ধুলোবালি লেগে আছে অবশ্য।

মুন্নি বলল, আজ রাতে ভাত খাব।

জাদু বলল, রুটি খাবি না? ও দোকানে তো ভাত পাওয়া যায় না।

মুন্নি তবু আদুরে গলায় বলল, অন্য দোকানে খাব। আজ রুটি খেতে ইচ্ছে করছে না।

তারপর ফিক করে হেসে বলল, আজ আমি খাবারের পয়সা দেব।

সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ওপর লেকের এককোণে পর পর কয়েকটা দোকানের মাঝখানে একটা হোটেল। ওখানেই রোজ সন্ধেবেলা ওরা খেতে আসে। রুটি, ডাল-তড়কা, সবজি, ডিমের ঝোল, কিমা, কারি। গরম গরম সেঁকে দেয় রুটি, পেঁয়াজ, লঙ্কা যত ইচ্ছে চাও দেবে।

রাস্তার উলটো দিকেই একটা চিনে রেস্তোরাঁ। সেখানের চেয়ে এই হোটেলের ভিড় অনেক বেশি।

আজ মুন্নি আর জাদু সেদিকে গেল না।

ওরা ঢাকুরিয়া ব্রিজ পার হয়ে বাস ডিপোর পিছনটায় আর-একটা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারের মধ্যে এখানে জ্বলছে একটা হ্যাজাক বাতি। কয়েকখানা বেঞ্চি পাতা। পেঁয়াজ মেশানো মুসুরির ডালের গন্ধে ম ম করছে বাতাস।

মুন্নি আর জাদু ভেতরে ঢুকতে দ্বিধা করছে খানিকটা, একটা বাচ্চা বেয়ারা বলল, আসুন, বসুন, এই তো জায়গা আছে!

ওরা দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। কোনো কারণ নেই, এমনিই।

ভাত ডাল আর ঢেঁড়সের তরকারি নিল প্রথমে। সেই খাওয়া শেষ হতে না হতেই বাচ্চা বেয়ারাটা কানের কাছে চেঁচাতে লাগল, আর কী নেবেন। পারশে মাছ, ট্যাংরা মাছ, মটন কারি, ফাউল কারি…

মুন্নি বলল, আজ মাংস খাব!

জাদুর তাতে কোনো আপত্তি নেই। আজ দুজনের কাছেই অনেক টাকা। এক প্লেট মাংসের সঙ্গে দু-বার ঝোল চেয়ে নিয়ে আরও অনেকটা ভাত। শহুরে সরু চালের ভাত, ঠিক যেন পেট ভরতেই চায় না।

হোটেল থেকে বেরিয়ে মুন্নি আবার আবদার জানাল, পান খাব!

জাদু পানের দোকানে গিয়ে চার খিলি পান নিয়ে ফেলল। মিঠা পাতা, সুপারি, জরদা, ইলাইচ। পাঁচ টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করল না সে।

তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় ঘুরল অনেকক্ষণ।

এক সময় বৃষ্টি বেশ ঝেঁপে এল, ওরা দাঁড়াল একটা গাড়ি বারান্দার তলায়। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

শহরের রাস্তায় ছাতা না থাকলেও চলে। বারান্দার পর বারান্দা, আর দোকানের ঝাঁপের তলা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়।

বাড়ি। প্রকাণ্ড বাড়ি।

একতলায় অনেকে শুয়ে আছে ঘেঁষাঘেঁষি করে, কুণ্ডলী পাকিয়ে। বৃষ্টির আমেজে ঘুমিয়ে পড়েছে এর মধ্যে।

ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল দোতলা।

মুন্নি বলল, আরও ওপরে চল!

একেবারে ধবধবে নতুন বাড়ি। গতকালই দেয়ালগুলোতে সাদা রঙের পোঁচ পড়েছে, চুন আর এলার গন্ধ। জানলার গ্রিলে রং। হাত দিলে এখনও লেগে যেতে পারে।

দরজা লাগানো হচ্ছে আজ থেকে। এখনও সব ঘর বন্ধ হয়নি।

মুন্নি বলল, আরও ওপরে যাব।

জাদু বলল, আরও ওপরে গিয়ে কী হবে? এখানেই থেকে যাবি!

মুন্নি সুর করে বলল, না, না, আরও আরও ওপরে যাব।

জাদু মুন্নির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ইস একেবারে ভিজে গেছিস!

মুন্নি খিলখিল করে হেসে বলল, তুই বুঝি ভিজিসনি!

জাদু নিজের জামাটা খুলে ফেলল। মুন্নির দিকে তাকাল। মুন্নি তো এভাবে শাড়ি খুলে ফেলতে পারে না। সে পরে শাড়ি বদলাবে। এখন তার ওপরে ওঠার নেশা লেগেছে।

ছ-তলার ওপরে উঠে এসে জাদু বলল, থেকে গেছি। আর উঠতে হবে না। এই ঘরটা কী ভালো দ্যাখ! সব দিকে জানালা।

ঘরটায় ঢুকে পরিদর্শন করে দেখল মুন্নি। অন্ধকার বটে। কিন্তু দেয়ালের নতুন সাদা রং থেকে যেন কিছুটা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

সঙ্গে একটা মস্ত বারান্দা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ মজা লাগল মুন্নির। একটা নারকেল গাছের মাথা অনেক নীচে। গ্রামে থাকার সময় মুন্নি দেখেছে, নারকেল গাছের মাথা সবসময় বাড়ি ছাড়িয়ে যায়! এখানে নারকেল গাছটা পাল্লায় হেরে গেছে।

চিক করে একটু থুতু ফেলল মুন্নি। কোথায় হারিয়ে গেল সেই থুতু।

তারপর সে বলল, চল, ওপরে চল।

জাদু বলল, আবার? এই ঘরটা তোর পছন্দ হল না?

মুন্নি হেসে হেসে মাথা দোলাতে লাগল। কত ঘর, একশো, দুশো, এর মধ্যে যে-কোনো ঘরেই ইচ্ছে করলে ওরা থাকতে পারে। রাজা বাদশাদেরও এত ঘর থাকে না।

সে বলল, চল না। চল না।

সাত তলা, আট তলা, ন তলা…। দশ তলায় এসে মুন্নির পা ব্যথা হয়ে গেছে। সিঁড়ির রেলিং ধরে সে দম নিচ্ছে।

জাদু এখানেও থামবে না। ওপরেই যখন উঠেছে, তখন একেবারে ওপরে উঠে যাবে না কেন?

সে মুন্নির হাত ধরে টেনে বলল, আয়।

মুন্নি বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, একটু শ্বাস নিই!

টপ করে জাদু পাঁজাকোলা করে তুলে নিল মুন্নিকে।

মুন্নি হাত-পা ছুড়ে বলতে লাগল, আরে আরে, ছাড়, ছাড়, পড়ে যাব। তুইও তো থেকে গেছিস!

কে শোনে কার কথা। মুন্নিকে কোলে নিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল জাদু।

ওপরে এসে একটা গোটানো মাদুরের মতন মুন্নিকে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল সে।

জাদুও খুব হাঁপিয়ে গেছে। বুকটা উঠছে আর নামছে তার।

এগারো তলা। এটাই সবচেয়ে উঁচু। সারা বাড়িতে আলো নেই, কিন্তু এখানে আকাশের আলো আছে। ভিজে শাড়িতে মুন্নির হিলহিলে শরীরটা স্পষ্ট।

জাদু বলল, এখানে থাকব। সকলের মাথার ওপরে। কোন ঘরটায় শুবি বেছে নে।

পর পর অনেকগুলো ঘর। যে-কোনো ঘর ওদের শয়নকক্ষ হতে পারে। মুন্নি আগেই একটা বেছে রেখেছে মনে মনে। দক্ষিণ দিকের কোণের ঘর।

তিন দিক খোলা এই ঘর। এখান থেকে গোটা শহরটাকেই পায়ের তলায় মনে হয়। দূরের দিগন্তকে মনে হয় সমুদ্র।

জাদু দেয়ালে হাত বোলাতে লাগল খুব মায়ার সঙ্গে। মুন্নি মাথায় করে ইট বয়ে এনেছে, সে সিমেন্ট গেঁথেছে। কত মসৃণ হয়েছে দেয়াল। এ ঘর তার সৃষ্টি। তাদের দুজনের।

কাল থেকে সব ঘরে দরজা বসে যাবে। দরজার সঙ্গে তালা। তখন সব ঘর বন্ধ হয়ে যাবে।

কাল থেকে ইলেকট্রিক মিস্তিরি, কলের মিস্তিরিরা কাজ করবে। জাদু মুন্নিদের কাজ শেষ। ওরা চলে যাবে।

আজ রাত পর্যন্ত এই সব ঘরের ওপর ওদের অধিকার আছে। এই শহরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘরখানিতে ওরা শুয়ে থাকবে পাশাপাশি। ওদের নিজের হাতে গড়া ঘর। না ঘুমিয়ে ওরা জেগে জেগে গল্প করবে সারারাত।

দুজনেই দেওয়ালে হাত বুলোচ্ছে। তারিফ করছে মসৃণতার।

জাদু জিজ্ঞেস করল, ভিজে শাড়িটা খুলবি না? এখানে তো আর কেউ নেই। শরমের কী আছে?

মুন্নি ভ্রূভঙ্গি করে বলল, না, খুলব না।

দুজনে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। বাবু-বিবিদের মতন পরস্পরের গলা জড়িয়ে ধরল। গালে ঠেকাল গাল।

মুন্নি হাসতে হাসতে বলল, আমাদের বাড়ি।

জাদু মুন্নিকে আরও জোরে টেনে বলল, আমাদের বাড়ি।

তারপর দুজনেই হাসতে লাগল পাগলাটে গলায়।

একটু পরে রেলিং-এ অনেকখানি ঝুঁকে মুন্নি তার জিভটা বার করল। নীচের দিকে অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে শহর। মুন্নি দেখছে ওপরের দিকে। জাদু জিজ্ঞেস করল, ও কী করছিস?

মুন্নি বলল, দ্যাখ দ্যাখ, আকাশ কত কাছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে, না?

জাদু হাত তুলে বলল, কই, ছোঁয়া যাচ্ছে না!

মুন্নি বলল, দূর বোকা, তুই কিছু বুঝিস না। দ্যাখ না, মেঘ নীচু হয়ে আসছে। বৃষ্টি নামবে। একটু মেঘ খেয়ে দ্যাখ না। জিভে লাগছে।

জাদুও জিভ বার করে দিল।

তারপর দুজনে মহা উল্লাসে মেঘ খেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *