আকাশকুসুম
০১.
বটুক মিত্তির ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, আরে জয়ন্তবাবু যে! নমস্কার। নমস্কার।
প্রতি-নমস্কার করে বললুম, কেমন আছেন মিত্তিরমশাই?
আছি এইমাত্র। বলে বটুক মিত্তির সোফায় বসলেন। হাতের ছড়িটা পাশে ঠেস দিয়ে রেখে টুপি খুলে বললেন, বেরিয়েছি ভোর ছটায়। মর্নিং ওয়াক করে ফেরার সময় হঠাৎ খেয়াল হলো একবার কর্নেলসায়েবকে দেখা দিয়ে আসি।
কর্নেল চুরুট টানতে টানতে কয়েক শিট টাইপ করা কাগজে চোখ বুলোচ্ছিলেন। বললেন, জয়ন্ত জানে কি না জানি না, মিত্তিরমশাইয়ের এই হঠাৎ খেয়াল ব্যাপারটা কত গুরুত্বপূর্ণ।
বটুকবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন আপনি। আমার এই এক বদ অভ্যাস। অন্যায় দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়।
কর্নেল হাসলেন। তা আপনার টুপি খোলা দেখেই বুঝেছি। গত কদিন বৃষ্টির পর আজ শীতটা বেশ জমে উঠেছে। তো আগে কফি খান। তারপর কথা হবে। বলে তিনি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী। শীগগির কফি।
বটুক মিত্তিরের সঙ্গে আমার পরিচয় কর্নেলের বাড়িতেই। ভদ্রলোক একসময় শেয়ার বাজারে দালালি করতেন। সেই সূত্রে টাকা কামিয়েছিলেন প্রচুর। তারপর কিছুকাল স্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচার কারবারে নেমেছিলেন এবং প্রোমোটারও হয়েছিলেন। শেষে মস্তানদের জুলুমে সে-কাজ ছেড়ে কোন কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটিং এজেন্ট হন। এই পর্যন্ত আমার জানা। এখনও সেই কারবারে আছেন কি না জানি না। তবে ভদ্রলোক সদালাপী। মন খুলে কথা বলেন। ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে খুব সচেতন হয়ে উঠেছেন। অবশ্য এটা ওঁর নিজের কথা।
দেখলুম, মেঝের দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি হাঁটু দোলাচ্ছেন। বললুম, কোথায় অন্যায় দেখলেন মিত্তিরমশাই?
বটুকবাবু দৃষ্টি মেঝের দিকে রেখেই আস্তে বললেন, আজকাল এমন অবস্থা, হয়েছে, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়, তা ঠিকঠিক বুঝতে মাথা গুলিয়ে যায়। বলে হঠাৎ তিনি মুখ তুললেন। আচ্ছা জয়ন্তবাবু! আপনাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার ইভনিং এডিশন বেরোয় না?
খুব বড় ঘটনা হলে তবেই বেরোয়।
মিত্তিরমশাই আস্তে বললেন, এটাও বড় ঘটনা বৈকি। এখনও কেউ জানে না। হয়তো কেউ আর জানতেও পারবে না। কিন্তু আমি মনে করি, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া সবচেয়ে বড় পাপ।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে বটুকবাবুকে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, আগে কফি খান মিত্তিরমশাই! ব্রেন চাঙ্গা করে নিন।
বটুক মিত্তির অন্যমনস্কভাবে কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলুম, আপনার সেই ডিস্ট্রিবিউটিং এজেন্সির কারবার কেমন চলছে।
বটুকবাবু বললেন, মোটামুটি ভালোই চলছিল। জানি না এবার কী অবস্থা হবে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কেন? আপনার খুঁটি তো শক্ত। ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির দেশেবিদেশে সুনাম আছে। জয়ন্ত সাংবাদিক হয়েও সংবাদ সম্পর্কে নিরাসক্ত। সম্প্রতি কাগজে দেখলুম, কোম্পানি আকাশকুসুম নামে একরকম তেল বাজারে ছাড়ছে। সেই তেলে নাকি টাকে চুল গজানোর সম্ভাবনা শতকরা ৯৯ ভাগ। আপনাকে দেখেই ভাবছিলুম, এক শিশি আকাশকুসুম চাইব। আপনি কোম্পানির একজন বড় ডিস্ট্রিবিউটর। কিন্তু আপনি হঠাৎ খেয়াল আর অন্যায়ের কথা তুলে আমার টাকে চুল গজাবার সম্ভাবনা জিরো করে দিলেন।
বটুক মিত্তির কর্নেলের রসিকতায় কান দিচ্ছেন না, তা ওঁর গম্ভীর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম। বললুম, মিত্তিরমশাই! আমি অবশ্য কর্নেলের মতো জোক করছি না। অন্যায় সংক্রান্ত বড় খবরটা শুনতে আগ্রহী। যদি খবরটা সত্যি বড়–মানে, চমকপ্রদ হয়, এডিটরকে ইভনিং এডিশন বের করার জন্য বলব। দৈনিক সত্যসেবক হিড়িক ফেলে দেবে। বিশেষ করে আপনি যখন বলছেন, এখনও কেউ জানে না। এবং ভবিষ্যতেও কারও জানার সম্ভাবনা কম।
বটুকবাবু কফি শেষ করে জোরে শ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, কর্নেলসায়েব! আপনি ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির প্রকৃত মালিক এবং ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বি কে সেনকে কি চেনেন?
কর্নেল বললেন, নাম শুনেছি।
বটুক মিত্তির চাপা গলায় বললেন, আজ ভোর ছটায় মর্নিং ওয়াকে বেরুতে যাচ্ছি, তখন আমার মিসেস খবরটা জানিয়ে আমাকে বেরুতে নিষেধ করল। প্রথমে বিশ্বাস করিনি। শেষে বিশ্বাস করতে হলো। আমার বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে সেনসায়েবের বাড়ি। প্রায় তিনি একর জমির ওপর দিশি-বিদিশি গাছপালার ভেতর বিলিতি ধাঁচের বাড়ি। আমার দোতলার ছাদ থেকে বাড়িটা গাছপালার আড়ালে আবছা দেখা যায় মাত্র। ফুলবাগান, টেনিস লন, সুইমিং পুল। সবুজ ঘাসে ঢাকা একটুকরো জমির ওপর সেনসায়েব আর মিসেস সেন বেতের চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকেন দেখেছি। কিন্তু তা-ও গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে। গত একবছরে মাত্র বার দুই সেনসায়েবের ডাকে ওঁর বাড়িতে ঢুকেছি। গেটের ডানপাশে একটা আলাদা বাংলা ধাঁচের একতলা বাড়ি আছে। বাইরের লোকের সঙ্গে সেখানেই কথা বলেন সেনসায়েব। কোটি-কোটি টাকার মালিক।
কর্নেল আর একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, কিন্তু ঘটনাটা কী? মানে– আপনি যেটা অন্যায় বলছেন!
কণ্ঠস্বর আরও খাদে নামিয়ে বটুকবাবু আমার দিকে ঘুরে বললেন, আগে ডিটেলস শুনুন। তারপর ডিসিশন নেবেন জয়ন্তবাবু। প্লিজ! যেন আমি বিপদে না পড়ি।
ঠিক আছে। আপনি বলুন।
মিসেস সেনের জন্য আমার মিসেস একজন বিশ্বাসী কাজের মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছিল।
কর্নেল বললেন, মিসেস সেনের সঙ্গে আপনার মিসেসের আলাপ আছে তা হলে?
আলাপ হয়েছিল একটা পার্টিতে। সেনসায়েবের মেয়ে থাকে আমেরিকায়। সে বিয়ে করেছিল এক সায়েবকে। তারপর বরকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। অগত্যা সেনসায়েব–বিশেষ করে মিসেস সেনের উদ্যোগেই হোটেল কন্টিনেন্টালে পার্টি দিয়ে জামাইবরণ করা হয়। এটা মাস তিনেক আগের কথা। আমার মিসেসের এই এক গুণ সহজে ভাব জমিয়ে নিতে পারে। যাইহোক, পরে একদিন টেলিফোনে মিসেস সেন ওকে বলেন, তার একজন বিশ্বাসী কাজের মেয়ে দরকার। একজন ছিল। সেই মেয়েটি দেশের বাড়ি গিয়ে আর ফেরেনি। তো–
আপনার মিসেস বিশ্বাসী কাজের মেয়ে জুটিয়ে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করে তারই সহোদরা বোন।
বুঝলুম। এবার বলুন ঘটনাটা কী?
বটুক মিত্তির এবার ফিসফিস করে বললেন, গতকাল সন্ধ্যায় সেনসায়েব অফিস থেকে সোজা ওঁদের গুড ইভনিং ক্লাবে গিয়েছিলেন। নিজেই ড্রাইভ করেন উনি। রাত বারোটা বেজে গেল। তবু সেনসায়েব ফিরছেন না দেখে মিসেস সেন উদ্বিগ্ন হয়ে ক্লাবে ফোন করেন। ক্লাবের ম্যানেজার বলেন, সায়েব রাত দশটা নাগাদ বেরিয়ে গেছেন। মিসেস সেন কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সওয়া বারোটায় সেনসায়েবের গাড়ি এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু গাড়িতে সেনসায়েব ছিলেন না। একটা লোক–তার মাথায় টুপি, নাকের তলা অবধি মাফলার জড়ানো,–সে গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ানের হাতে একটা খাম গুঁজে দিয়ে বলে, মেমসায়েবকে দিয়ো। হিন্দিতে কথাটা বলে সে উধাও হয়ে যায়।
কর্নেল বললেন, তারপর?
বটুকবাবু বললেন, ঘটনা হলো সেনসায়েবকে কারা কিডন্যাপ করেছে। মুক্তিপণ দাবি করেছে ক্যাশ এক কোটি টাকা। সময় দিয়েছে আজ রাত দশটা। কিডন্যাপিং কেসে যা-যা হয়, তা-ই। পুলিশকে জানালে সেনসায়েবকে ওরা মেরে ফেলবে। তাই মিসেস সেন ঠিক করেছেন, টাকা দেবেন। এক কোটি তার কাছে কিছুই না।
কোথায় কীভাবে টাকা দিতে হবে?
ছন্দা–মানে মিসেস সেনের এই বিশ্বাসী কাজের মেয়ে, আমাদের কাজের মেয়ে নন্দার ছোট বোন–আড়াল থেকে এর বেশি কিছু শুনতে পায়নি। মিসেস সেন তাদের বাড়ির কেয়ারটেকার নরেন ব্যানার্জিকে অত রাতে ঘুম থেকে উঠিয়ে যা সব আলোচনা করেছেন, ছন্দা তা ওত পেতে শুনেছে। বাকি রাত তার ঘুম হয়নি। পিছনদিকের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সেই দরজা খুলে বেরিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে। দিদিকে ডেকেছে। নন্দা থাকে নিচের তলার একটা ঘরে। তার ওপাশে একটা কানাগলি। নন্দা জানালা খুলেছে। দিদিকে সব বলে ছন্দা ফিরে গেছে সেনসায়েবের বাড়িতে। বলে হাসবার চেষ্টা করলেন বটুক মিত্তির। বুঝুন। কেমন বিশ্বাসী মেয়ে!
কর্নেল বললেন, তারপর নন্দা কথাগুলো আপনার মিসেসের কানে তুলেছে?
হ্যাঁ। তবে ভাগ্যিস আমার মিসেস তখনই মিসেস সেনকে ফোন করে সিমপ্যাথি জানিয়ে ফেলেনি। এ বুদ্ধিটা সুলতার আছ। আমাকে সে দিব্যি দিয়ে নিযেধ করেছে। কিন্তু এত বড় ঘটনা তার ওপর কর্নেলসায়েবের মতো মানুষ যখন আছেন, তখন ঠিক করলুম সুলতার দিব্যির দাম দেব না। কেন দেব? এ তো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই না? বলুন আপনি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, হু। তা আমাকে কী করতে বলছেন আপনি?
কিডন্যাপারদের খুঁজে বের করে নিজে গুলি করে মারুন। বটুক মিত্তির উত্তেজিতভাবে বললেন। আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। কত শত্রুকে গুলি করে মেরেছেন। এই কিডন্যাপাররা দেশের শত্রু। সমাজের শত্রু। এরা দেশের ইন্ডাস্ট্রি, বিজনেস–সব কিছু তছনছ করে ফেলতে চায়। ভাবুন কর্নেলসায়েব। সেনসায়েবের না হয় টাকা আছে। গোপনে মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু এতে কিডন্যাপারদের লোভ বেড়ে উঠবে না? না–আপনি প্লিজ পুলিশকে কিছু জানাবেন না। পুলিশকে আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া পুলিশ কিডন্যাপারদের কাছে বখরা পেয়ে চুপ করে যে যাবে না, তার গ্যারান্টি আছে? বলবেন, পুলিশের মধ্যে সৎ লোকও আছে। হা–আছে। কিন্তু তারা সৎ কাজে পা বাড়ালে পায়ে-পায়ে বাধা আসবে। এমন কি প্রাণে মারা পড়াও বিচিত্র নয়।
কর্নেল চোখ খুলে একটু হেসে বললেন, আপনি আমাকে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে বলছেন?
বলছি। কারণ কোথায় আইন? কে তোয়াক্কা করছে আইনের?
মিত্তিরমশাই! আপনি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এ বয়েসে উত্তেজনা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।
বটুক মিত্তির এবার আমার দিকে ঘুরে আমাকে তাতিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললেন, জয়ন্তবাবু! আপনি আপনাদের এডিটরকে বলে কাগজের ইভনিং এডিশন বের করার ব্যবস্থা করুন। হিড়িক পড়ে যাবে। কিডন্যাপাররা ভয় পাবে।
বললুম, তা হলে পুলিশ তো ব্যাপারটা জেনে যাবে। অথচ আপনি পুলিশকে কিছু জানাতে নিষেধ করেছেন।
বটুকবাবু বললেন, বুঝলেন না? এমন সাংঘাতিক ঘটনা খবরের কাগজে বেরুলে জনসাধারণ জেনে যাবে আর মুখে মুখে রটেও যাবে। তাতে হবে কি, লোকেদের চোখ এড়িয়ে কিডন্যাপাররা কিছু করতে পারবে না। গণধোলাইয়ের ভয়ে সেনসায়েবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। এদিকে আপনাদের কাগজ বেরুনোর আগে কর্নেলসায়েব তার কাজ শুরু করে দেবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কর্নেলসায়েব ততক্ষণে কিডন্যাপারদের ডেরা খুঁজে পাবেন। তারপর
কর্নেল হাসলেন। ঠিক আছে মিত্তিরমশাই! আপনি যখন এমন একটা সাংঘাতিক খবর দিলেন, তখন আমার পক্ষ থেকে যথাসাধ্য করব। কিন্তু আপনি এ নিয়ে আর চিন্তাভাবনা করবেন না। অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না। মুখটি বুজে থাকুন।
বটুক মিত্তির উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ফোন নাম্বার তো আপনি জানেন। দরকার হলে যোগাযোগ করবেন। আর সেনসায়েবের ফোন নাম্বারটা লিখে নিন। এটা ওঁর প্রাইভেট নাম্বার।
কর্নেল একটা ছোট্ট প্যাড আর কলম দিয়ে বললেন, মিসেস সেনের পুরো নাম কী?
রুচিরা সেন।
বটুকবাবু ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে গম্ভীরমুখে বেরিয়ে গেলেন!…
কর্নেল আবার সেই টাইপ করা কাগজে মনোনিবেশ করেছেন দেখে বললুম, আমার ধারণা, আপনি মিত্তিরমশাইয়ের অমন সাংঘাতিক খবরটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না।
কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না।
এবার একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললুম, তা হলে আমি আমাদের নিউজ ব্যুরোর চিফ সত্যদার সঙ্গে একটু পরামর্শ করি। সত্যদা বললে এডিটর না করতে পারবেন না। দুর্দান্ত একখানা স্কুপ নিউজ।
বলে টেলিফোনের কাছে যেতেই কর্নেল বললেন, তার আগে তুমি বরং সেনসায়েবের এই নাম্বারে ফোন করো। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, সেনসায়েবের সঙ্গে কথা বলতে চাও। খুব জরুরি কথা। কিন্তু একটা শর্ত। কখনও মিত্তিরমশাইয়ের দেওয়া খবর নিয়ে কোনও কথা বলবে না। সাবধান জয়ন্ত!
অগত্যা সেনসায়েবের নাম্বারে ডায়াল করলুম। এনগেজড় টোন। মিনিট তিনেক পরে আবার ডায়াল করলুম। আবার এনগেজড় টোন। বিরক্ত হয়ে রিসিভার রেখে দিলুম।
কর্নেল বললেন, আবার চেষ্টা করো। পেয়ে যাবে। মিত্তিরমশাই খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন বটে, কিন্তু এ সব সিরিয়াস ব্যাপারে ওঁর বুদ্ধিসুদ্ধির কোনও গোলমাল ঘটবে বলে মনে হয় না। নাম্বারটা উনি নিজের হাতেই যখন লিখেছেন, তখন ওটা রাইট নাম্বার।
এবার রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া এল মহিলাকণ্ঠে। ইয়া?
আমি মি. বি কে সেনের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
আপনি কে বলছেন?
আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার
মিঃ সেন বাইরে গেছেন।
কলকাতার বাইরে?
হ্যাঁ। কিছু বলার থাকলে আপনি আমাকে বলতে পারেন।
কথাটা ব্যক্তিগত। আপনি কি মিসেস সেন বলছেন?
হ্যাঁ। তবে কথাটা কী ধরনের ব্যক্তিগত, জানতে পারি?
মিঃ সেন আমাকে চেনেন। উনি আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন যোগাড় করে দিতে বলেছিলেন–
বলুন। আমি নোট করে রাখছি। মিঃ সেন ফিরে এল জানাব।
কবে ফিরবেন উনি?
রুক্ষ স্বরে মিসেস সেন বললেন, আমার সময়ের দাম আছে। আপনি অকারণ সময় নষ্ট করছেন।
জাস্ট আ মিনিট প্লিজ। ওরিয়েন্ট কেমিক্যালের আকাশকুসুম তেলের সোল ডিস্ট্রিবিউটিং এজেন্সি
হ্যাঁ বলুন।
মানে–ইয়ে–তারা অর্ডার সাপ্লাইয়ে কোনও কারচুপি করছেন না।
আপনি বললেন সাংবাদিক।
হ্যাঁ। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নাম শুনেছেন নিশ্চয়?
আমাদের কোম্পানির নিজস্ব মার্কেটিং রিসার্চ ব্যুরো আছে। প্রয়োজনে কোম্পানি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নেয়। মিঃ সেন আপনাকে এ দায়িত্ব দিলেন কেন? কে আপনি?
কী আশ্চর্য! ম্যাডাম, আপনি ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানেন না। তা ছাড়া সাংবাদিকরাও অনেক সময় গোয়েন্দাগিরি করে।
মিসেস সেনের রুক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। থামুন। আমি বুঝেছি আপনি কে। বারবার আমাকে এভাবে আপনারা বিরক্ত করছেন কেন?
ওহ ম্যাডাম। আপনারা মানে কী বুঝতে পারছি না।
পারছেন। নিন। আপনার আসল কথাটা মিঃ সেনের পি. এ. বরুণ রায়কে বলুন।
উত্তেজনা চেপে কর্নেলের দিকে তাকালাম। উনি টাইপকরা কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন। দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট।
একটু পরে পুরুষকণ্ঠে সাড়া এল। দেখুন মশাই, বাঘ কোনও শিকার করলে গন্ধ পেয়ে আনাচে-কানাচে দু-একটা ফেউ ঘুরঘুর করে। বাঘকে জানিয়ে দিলে কী হবে বুঝতে পারছেন?
আহা! আমার কথাটা শুনুন।
শুনছি না। যথাস্থানে জানিয়ে দিচ্ছি।
লাইন কেটে গেল। হাসতে হাসতে রিসিভার রেখে সোফায় বসে পড়লুম। বললুম, ওহ্ কর্নেল! কী মজার নাটকে ঢুকে পড়েছিলুম ভাবতে পারবেন না!
কর্নেল কাগজগুলো গুছিয়ে একটা বড় খামে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, কিছুটা উপভোগ করেছি। আমার টেলিফোনটা জাপানি। খুব সেন্সিটিভ?
শেষে সেনসায়েবের পি. এ. বরুণ রায় ফোন ধরেছিল।
হুঁ। কানে এল, বাঘ ফেউ ইত্যাদি কিছু বলছিল।
বরুণ রায়ের কথাগুলো কর্নেলকে বললুম।
কর্নেল বললেন, ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে। একাধিক লোকে যেভাবে হোক জানতে পেরেছে। সম্ভবত তারা মিসেস সেনকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।
কী ভাবে?
কিডন্যাপারদের সঙ্গে মিসেস সেন গোপনে যে রফা করেছেন, তা পুলিশের কাছে জানিয়ে দেবার ভয় দেখাচ্ছে। তাতে পুলিশ এই কেসে নাক গলাতে আসবে এবং সেনসায়েবকে মুক্তি পাওয়াটা অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। এমন কি তার জীবনের ঝুঁকি এসে যাবে। এই অবস্থায় তথাকথিত ফেউরা মিসেস সেনের কাছে টাকাকড়ি দাবি করতেই পারে।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম, সর্বনাশ! আমি যে আমার পরিচয় দিয়ে ফেলেছি।
কর্নেল হাসলেন। তুমি যে ফেউ নও, তা প্রমাণের জন্য তোমার প্রেসকার্ড নিয়ে মিসেস সেনের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে পারো।
আপনিই আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছেন।
কর্নেল এবার তার প্রখ্যাত অট্টহাসি হেসে বললেন, ডার্লিং! কেন যে তুমি খবরের কাগজের রিপোর্টার হয়েছিলে বুঝি না! তোমার কাছে সরকারের দেওয়া প্রেসকার্ড আছে। তোমার সাত খুন মাফ। উঠে পড়ো। এখনই চলে যাও।
হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। সত্যি যেতে বলছেন? কিন্তু আমি যে ঠিকানা জানি না।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো! আমি তোমার সঙ্গী হব। তবে আমি ঢুকব মিত্তিরমশাইয়ের বাড়িতে। তারপর দুজনে কোথায় কীভাবে মিলিত হব, সেটা যেতে যেতে ঠিক করা যাবে। এক মিনিট। আমি পোশাক বদলে আসি।
একটু পরে কর্নেল সেজেগুজে বেরিয়ে এলেন। বাইনোকুলার আর ক্যামেরা যথারীতি গলা থেকে ঝোলানো। তবে পিঠে সেই কিটব্যাগটা নেই।
বেরুনোর আগে তিনি বটুক মিত্তিরকে ফোনে তার যাওয়ার খবর জানিয়ে এলেন।…
কর্নেলের নির্দেশ অনুসারে ড্রাইভ করছিলুম। বেকবাগানের মোড় পেরিয়ে ডাইনে একটা আঁকা-বাঁকা গলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে এগোচ্ছিলুম। কলকাতায়। এমন গোলোকধাঁধা আছে, জানা ছিল না। কিছুক্ষণ পরে তেমনই আঁকা বাঁকা, কিন্তু অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় পৌঁছে চন্দ্রকলার মতো একটা জায়গায় কর্নেল গাড়ি থামাতে বললেন। আমি এখানে নেমে যাচ্ছি। ওই বাঁকের বাঁদিকে সেনসায়েবের বাড়ির গেট দেখতে পাবে। আমি হেঁটে গিয়ে উল্টোদিকে বটুক মিত্তিরের বাড়িতে ঢুকব। আমি তোমার আগে বেরুব না। লক্ষ্য রাখব। তুমি এখানে এসে অপেক্ষা করবে।
শীতটা জাঁকিয়ে পড়েছে এবার। তবু মনে হচ্ছিল যেন ঘামছি। কর্নেল নেমেই হাঁটতে শুরু করেছেন। পাশ দিয়ে যাবার সময় চাপাস্বরে বললেন, প্রেসমার্কা গাড়ি তোমার। দুর্ভাবনার কারণ নেই।
বাঁকের মুখে পৌঁছে দেখি, বাঁদিকে চওড়া গেট এবং তারপর উঁচু পাঁচিল গোলাকারে বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের মুখে একটা গলি। গলি থেকে একটার পর একটা গাড়ি বেরিয়ে আসছে। অভিজাত বিত্তবানদের পাড়া এটা, তা আগেই বুঝতে পেরেছিলুম।
গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে একবার হর্ন বাজালুম। উর্দিপরা দুজন দারোয়ান দুধারে টুলে বসে ছিল। একজন উঠে এসে বলল, বোলিয়ে সাব!
গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তার হাতে আমার একটা নেমকার্ড দিয়ে বললুম, মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এই কার্ডটা তার কাছে পাঠিয়ে দাও।
লোকটা তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। সে টুলে বসে থেকেই বলল, দেখা হবে না সাব। উনহির তবিয়ত আচ্ছা না আছে।
বললুম, আমি নিউজপেপারের লোক। আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কার্ডটা তার কাছে পাঠিয়ে দাও।
এইসময় স্মার্ট চেহারার জিনস-জ্যাকেট পরা এক বলিষ্ঠ গড়নের যুবক ডানদিক থেকে বেরিয়ে এল। দারোয়ান তাকে কার্ডটা দিল। সে কার্ডটা দেখে প্রথমে আমাকে, তারপর আমার প্রেসস্টিকার আঁটা গাড়ির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাল। বললুম, কিছুক্ষণ আগে আমিই মিসেস সেনকে ফোন করেছিলুম। এই দেখুন আমার প্রেসকার্ড।
সে প্রেসকার্ডে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, সরি মিঃ চৌধুরি! ম্যাডামের শরীর ঠিক নেই। যা বলার আপনি আমাকে বলতে পারেন।
একটু হেসে বললুম, আপনিই কি মিঃ সেনের পি. এ. বরুণ রায়?
হ্যাঁ।
আপনি আমাকে টেলিফোনে কী সব অদ্ভুত কথা বলছিলেন, তাই সশরীরে চলে আসতে হলো।
বরুণ হাসবার চেষ্টা করে বলল, এক্সট্রিমলি সরি মিঃ চৌধুরি। আপনি নিউজপেপারের লোক। ভালোই বোঝেন দেশে কী অবস্থা চলেছে। যাইহোক, যা বলেছি, তার জন্য ক্ষমা চাইছি। আপনি আসতে পারেন। আমি ব্যস্ত ম্যাডামকে নিয়ে। বলেই সে চলে গেল।…
.
০২.
সেনসায়েবের পি. এ., বরুণ রায়ের এই আচরণে মনে মনে খাপ্পা হয়ে উঠেছিলুম। তাকে স্মার্ট না বলে ওভারস্মার্ট বলা চলে। কিন্তু কী আর করা যাবে? মাথা ঠাণ্ডা রেখে দারোয়ানদ্বয়ের উদ্দেশে বললুম, সেনসায়েব আমাকে চেনেন। তিনি কি বাড়িতে আছেন?
একজন দারোয়ান বলল, সাব বাড়িতে নেই। বাইরে গেছেন।
কবে ফিরবেন জানো?
মালুম নেই।
দ্বিতীয় দারোয়ান মেজাজ দেখিয়ে বলল, আভি গেটকি সামনেসে গাড়ি হটাইয়ে।
এরা দুজনেই কাঠখোট্টা যাকে বলে। ভাব জমানো যাবে না এদের সঙ্গে। অগত্যা গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে সামনে গলির মুখে গিয়ে গাড়ি ঘোরালুম। তারপর কর্নেলের নির্ধারিত জায়গায় অপেক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলুম। সেনসায়েবের বাড়ির গেটের কাছে ফিরে এসেছি, সেইসময় উল্টোদিকের বাড়ির গেটে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বটুক মিত্তিরকে দেখতে পেলুম। তিনি দুহাত নেড়ে থামতে বলে এগিয়ে এলেন। একটু গলা চড়িয়ে বললেন, আরে জয়ন্তবাবু যে! নমস্কার! নমস্কার! এদিকে? কোথায় গিয়েছিলেন? আসুন! আসুন! একবার আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়ে যান।
বলেই তিনি তাঁর বাড়ির গেট খুলে দিলেন। বুঝলুম, কর্নেলের নির্দেশ পালন করছেন মিত্তিরমশাই। গেটে গাড়ি ঢুকিয়ে ডানদিকে লম্বালম্বি একটা প্যাসেজে দাঁড় করালুম। এই প্যাসেজের শেষপ্রান্তে তার গাড়ির গ্যারাজ। বাঁদিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি।
বটুকবাবু চাপা গলায় এবং সহাস্যে বললেন, আমি আর কর্নেলসায়েব লক্ষ্য রেখেছিলুম। জানতুম, আপনাকে গেট থেকেই বিদায় দেবে। ওই যে উঁটিয়াল ছোকরাকে দেখলেন, মহা ধুরন্ধর। সেনসায়েবের পি এ বরুণ।
দোতলার একটা ঘরে ঢুকে দেখি, কর্নেল জানালার পর্দার ফাঁকে বাইনোকুলার ঢুকিয়ে সেনসায়েবের বাড়িতে কিছু দেখছেন। বটুকবাবু আমাকে বসতে বলে বেরিয়ে গেলেন।
ঘরে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলুম, এটা এ বাড়ির গেস্টরুম। মোটামুটি আধুনিক আসবাবে সাজানো-গোছানো। অন্তত মিনিট দুই পরে কর্নেল জানালা থেকে সরে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। একটু হেসে বললেন, তোমাকে পাত্তা না দিক, বরুণ রায় তোমার সঠিক পরিচয় পেয়েছে, এই যথেষ্ট। তবে বাইনোকুলারে ওর মুখের রেখা দেখে বুঝতে পারছিলুম, খবরের কাগজের লোকের আবির্ভাবে একটু সন্দিগ্ধ হয়েছে। তুমি লক্ষ্য করেছ কি না জানি না, চলে যাবার সময় বরুণ দারোয়ানদের দিকে চোখের ভাষায় নির্দেশ দিয়ে গেল, স্পিকটি নট।
বললুম, আপনার বাইনোকুলারে আরও বিশেষ কিছু ধরা পড়ল?
একে গাছপালার আড়াল, তার ওপর বাংলোপ্যাটার্ন গেস্টহাউসের আড়াল। তবে সুইমিং পুল আর টেনিস লনের কিছুটা দেখতে পাচ্ছিলুম। সেখানে অবশ্য নির্জনতা ছাড়া কিছু দেখলুম না।
বটুকবাবু এলেন। মুখে দুষ্টুমির হাসি। সোফায় বসে হাঁটু দোলাতে দোলাতে বললেন, জয়ন্তবাবুকে কর্নেলসায়েব কি কথাটা বলেছেন?
কর্নেল বললেন, না। আপনিই বলুন।
বটুক মিত্তির চাপা গলায় বললেন, আমি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলুম। সেইসময় মিসেস সেন আমার মিসেসকে টেলিফোন করেছিলেন। আমার সঙ্গে উনি কথা বলতে চান। আমি ফিরে এসেই সুলতার কাছে কথাটা শুনে মিসেস সেনকে ফোন করলুম। উনি বললেন, একটা জরুরি কথা আছে। বেলা তিনটেয় আমি যেন ওঁর সঙ্গে দেখা করি।
বললুম, তাহলে মিসেস সেন আপনার সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে চান।
তা ছাড়া আর কী? এক কোটি টাকা বলে কথা। টাকা দিয়েও যে মিঃ সেন অক্ষত শরীরে মুক্তি পাবেন, তার তো কোনও গ্যারান্টি নেই। দুবৃত্তদের মতিগতি বোঝা কঠিন। এমনও হতে পারে, টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। যাই হোক, এই সুযোগে জেনে নেব ঠিক কখন কোথায় কীভাবে কার কাছে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। তারপর কর্নেলসায়েবকে জানিয়ে দেব।
কর্নেল বললেন, নন্দা তার বোনকে ডাকতে গিয়ে এত দেরি করছে কেন?
বুঝতে পারছি না। বলে দিয়েছি, ওর মা অসুস্থ। দেশের বাড়ি থেকে খবর এসেছে।
বললুম, নন্দা কোন পথে সেনসায়েবের বাড়িতে ঢুকল? ওকে তো গেটে দেখতে পাইনি।
বটুকবাবু বললেন, পেছনের দিকে একটা দরজা আছে। মালী, ড্রাইভার আর সারভ্যান্টদের ঘরদোর আছে ওদিকটায়। তারপর সেনসায়েবের বাড়িটা প্রোটেক্টেড এরিয়া। নিচু পাঁচিলে রেলিং বসানো। সেখানেও ছোট্ট একটা গেট আছে। বেলের সুইচ টিপলে ভেতর থেকে কেউ এসে গেট খোলে। তবে দিনে ওই গেটটা অনেকসময় খোলাই থাকে।
এইসময় একটা মধ্যবয়সী রোগা লোক ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বটুকবাবু বললেন, চা খান জয়ন্তবাবু। কর্নেলসায়েব! কফির বদলে চা খান। আমার বাড়িতে কফি চলে না। বাইরে থেকে কফি আনাতে সাহস পাইনি। কী আজেবাজে কফি দেবে। কর্নেলসায়েবের রুচি হবে না খেতে।
লোকটা চলে যাচ্ছিল। বটুকবাবু তাকে ডাকলেন, ফটিক! একবার গলি ঘুরে সেনসায়েবের বাড়ির খিড়কির দোরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আয় তো, নন্দা ওর বোনকে ডাকতে গিয়ে দেরি করছে কেন। নন্দাকে বলবি গিন্নিমা ডাকছেন।
ফটিক বলল, আমাকে ঢুকতে দেবে না।
ধুর বোকা আহাম্মক কোথাকার। ওই দরজা খোলাই থাকে। না থাকলে কড়া নাড়বি। যে দরজা খুলবে, তাকে বলবি নদাকে ডেকে দাও। গিন্নিমা ডাকছেন।
ফটিক গোমড়ামুখে বেরিয়ে গেল। বুঝলুম, ও বাড়িতে যেতে তার প্রচণ্ড অনিচ্ছা আছে–তা সে যে কোনও কারণেই হোক।
ভেতরের দিকের দরজার পর্দা সরিয়ে এক ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন। বটুকবাবুকে তিনি বললেন, তোমার ফোন।
বটুকবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। ইনিই সেই কর্নেলসায়েব। আর ইনি জয়ন্ত চৌধুরি। সাংবাদিক। কর্নেলসায়েব। আমার মিসেস সুলতা! তুমি আলাপ করো। আমি আসছি।
বটুকবাবুর স্ত্রী সুলতা নমস্কার করে একটু তফাতে বসলেন। মুখে অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য। বটুকবাবু ফোন ধরতে গেলেন। সুলতা চাপা গলায় বললেন, কর্নেলসায়েবের অনেক গল্প শুনেছি। মুখোমুখি একবার দেখবার ইচ্ছে হতো। এতদিনে সে-ইচ্ছে পূর্ণ হলো।
কর্নেল হাসলেন। মিত্তিরমশাই আমাকে সেনসায়েবের ঘটনাটা বলেছেন। তবু আপনার মুখে একবার শুনতে চাই। কারণ আমার ধারণা, আপনি আপনার স্বামীর মতো খেয়ালি নন। বিশেষ করে মহিলারা সবরকম চমকপ্রদ ঘটনার চুলচেরা বিচার ঠাণ্ডা মাথায় করতে পারেন। এটাই আমার অভিজ্ঞতা।
সুলতা আস্তে বললেন, এমন কিছু ঘটবে, তা গত সপ্তাহেই টের পেয়েছিলুম।
উনি থেমে গেলে কর্নেল বললেন, বলুন মিসেস মিত্র।
সুলতা একটু ইতস্তত করার পর বললেন, সেনসায়েবের প্রথম স্ত্রীর নাম রমলা। রুচিরা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। রমলার সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছিল।
কতদিন আগে?
সুলতা মনে মনে হিসেব করে বললেন, এ বছর বিশ-একুশ আগে। তখন সদ্য আমি এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছি।
তো এমন কিছু ঘটবে কীভাবে টের পেয়েছিলেন বলুন।
বলছি। রমলা ছিল বাগবাজারে আমাদের পাড়ারই মেয়ে। তাই আগে থেকে আমার সঙ্গে চেনাজানা ছিল। ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরও রমলা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। শেষে রমলার আবার বিয়ে হয়েছিল। সেই ভদ্রলোক একজন নামকরা পলিটিক্যাল লিডার। তাকে চিনতে পারবেন। অপূর্ব চন্দ্র।
হ্যাঁ, নাম শুনেছি।
আমি না বলে পারলুম না। কর্নেল। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অপূর্ব চন্দ্রের আরেকটা নাম আছে। লালুবাবু। লালুবাবুর কীর্তিকলাপ–
কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, আঃ। মিসেস মিত্রের কথার মধ্যে তুমি ফোড়ন কেটো না। বলুন মিসেস মিত্র। গত সপ্তাহে কী করে টের পেলেন এমন কিছু ঘটবে।
সুলতা বললেন, রমলার বাবার জুয়েলারি ব্যবসা ছিল। তখনকার বাজারদরে ত্রিশ লাখ টাকার গহনায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। ডিভোর্সের মামলার সময় রমলা তার কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। কারণ তার বাবা তখন মারা গেছেন। সুলতা আস্তে শ্বাস ছেড়ে চাপা গলায় ফের বললেন, গত সপ্তাহে মানে, মঙ্গলবার দুপুরে রমলা হঠাৎ আমাকে টেলিফোন করেছিল। একথা সেকথার পর হঠাৎ জোক করে বলল, কাগজে পড়েছে ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল আকাশকুসুম নামে তেল তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে। আমাদের ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সি সেই তেল বিক্রি করছে কি না। আমি হাসতে হাসতে বললুম, তোমার মাথায় না তোমার কর্তার মাথায় টাক গজিয়েছে? রমলা বলল, টাক কার মাথায় গজিয়েছে শিগগির দেখতে পাবে। রমলার এই কথাটা হঠাৎ কেমন বেসুরো ঠেকেছিল।
এই সময় বটুকবাবু ফিরে এসে বললেন, আজ ছুটির দিনে কোথাও বেরুব না ভাবছিলুম। কিন্তু না বেরিয়ে উপায় নেই। ত্রিপুরা থেকে একজন এজেন্ট এসেছেন। সুলতা, তুমি কর্নেলসায়েবদের সঙ্গে কথা বলো। আমি বেরুচ্ছি। বর্মনসায়েব হোটেল কন্টিনেন্টালে অপেক্ষা করছেন।
সুলতা বললেন, খেয়ে যাও। রান্না হয়ে গেছে।
ফিরে এসে খাব! কর্নেলবাবু। জয়ন্তবাবু। অপরাধ নেবেন না। যথাসময়ে যোগাযোগ করব। বলে ব্যস্তভাবে বটুক মিত্তির বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।
বললুম, আমার গাড়ি না সরালে আপনি গাড়ি বের করবেন কীভাবে?
বটুকবাবু হকচকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আপনি প্লিজ আসুন। আপনার গাড়িটা একটু পিছিয়ে সামনেকার লন ঘেঁষে রাখলে আমি বেরিয়ে যেতে পারব।
এতক্ষণে লক্ষ্য করলুম, বটুকবাবু পোশাক বদলেছেন এবং হাতে একটা ব্রিফকেস ঝুলছে। নিচে গিয়ে আমার গাড়ি পিছিয়ে সামনেকার লন ঘেঁষে দাঁড় করালুম। বটুকবাবু গেট খুলে দিয়ে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি বের করলেন। সেই সময় ফটিক এসে গেল। বটুকবাবুকে সে চাপাস্বরে কিছু বলে একপাশে দাঁড়াল। তারপর বটুকবাবুর গাড়ি বেরিয়ে গেলে সে গেট বন্ধ করল। আমি গাড়ি থেকে নেমে তাকে জিজ্ঞেস করলুম, কী হলো ফটিক? নন্দার দেখা পেলে?
ফটিক বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার! নন্দা এখনই আসবে বলল।
দোতলায় সেই ঘরে ঢুকে দেখলুম, কর্নেল সুলতা দেবীর সঙ্গে কথা বলছেন। ফটিক গিয়ে নন্দার খবর দিয়ে বারান্দা হয়ে কোথায় উধাও হলো। সুলতা পূর্ববৎ চাপাস্বরে বললেন, অপূর্ব চন্দ্র সেনসায়েবের কোম্পানিতে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে নাক গলানোর চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু ইউনিয়নের লিডার ওঁর বিরোধী পলিটিক্যাল পার্টির লোক। তাই সুবিধে করতে পারেননি।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, বিরোধী পার্টির সেই নেতা কে জানেন?
সুহাস ভৌমিক।
আবার বলে উঠলুম, সুহাস ভৌমিককে আমি চিনি। বন্যার রিলিফ নিয়ে কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এখনও সেই মামলা চলছে।
সুলতা হাসলেন। কাগজের লোকেরা অনেক কেলেঙ্কারির খবর রাখেন। রমলার বর সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন?
আড়চোখে দেখে নিলুম, কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছেন। বললুম, শোনা কথা। লালুবাবুর সঙ্গে নাকি একটা মাফিয়া দলের সম্পর্ক আছে। হাওড়া-লিলুয়া এলাকা জুড়ে লোহার স্ক্র্যাপ বিক্রি তার হুকুম ছাড়া করা যায় না।
সুলতা আবার গম্ভীর হলেন। বললেন, রমলা বেচারার ত্রিশ লাখ টাকার গহনার দাম এখনকার বাজারে এক কোটি টাকা। রমলা বরের সাহায্যে তা আদায় করতে পারলে আমি খুশি হব।
এতক্ষণে একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল ভেতরের দরজা দিয়ে। বলল, গিন্নিমা। ছন্দাকে মেমসায়েব আমার সঙ্গে দেখা করতে দিল না। আমাকে ঢুকতে দেয়নি। মালীবউকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলুম। মালীবউ এসে বলল, মেমসায়েবের শরীর খারাপ। ছন্দা এখন যেতে পারবে না।
সুলতা বললেন, হ্যাঁ রে নন্দা, ছন্দা যে অত ভোরে তোর কাছে এসেছিল, তা মেমসায়েব টের পাননি তো?
নন্দা বাঁকা মুখে বলল, কে জানে। নরেনবাবু বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে খেঁকিয়ে উঠেছিল। কে রে ওটা? বলেই ছোটেলালকে হুকুম দিল, এদিকে যেন বাইরের কোনও লোক না ঢোকে। ছোটেলাল আমাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল।
হুঁ। একটা কিছু আঁচ করেছে নরেন ব্যানার্জি। ওকে সদরগেটে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলুম। নন্দা! এই সায়েবকে বল ছন্দা তোকে ভোরবেলা এসে কী বলেছিল।
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, বলো নন্দা!
নন্দা চাপাস্বরে এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ মিশিয়ে যা-সব বলল, তা বটুকবাবুর মুখে শুনেছিলুম। তার কথা শেষ হলে সুলতা বললেন, নরেনবাবু চিঠিটা মেমসায়েবকে পড়ে শুনিয়েছেন–একথাটা বাদ দিলি যে?
নন্দা বলল, হ্যাঁ। তা না হলে ছন্দা জানবে কেমন করে? মেমসায়েব বলেছিল, হাতের লেখা আমি পড়তে পারছি না। তাই নরেনবাবু পড়ে শুনিয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিল, কোথায় টাকা দিতে হবে পরে ফোন করে জানাবে।
কর্নেল নন্দার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, তোমার বোনের মনে হচ্ছে আড়ি পেতে কথা শোনার অভ্যাস আছে?
নন্দা হাসবার চেষ্টা করে বলল, তা একটু আছে। বলে সে সুলতার দিকে তাকাল। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি।
সুলতা গম্ভীরমুখে বললেন, কর্নেল সায়েবের কাছে লুকবো না। এখন আর লুকোনোর মতো অবস্থা নেই। ছন্দাকে আমি বলে রেখেছিলুম, সেনসায়েবের সঙ্গে তার স্ত্রীর কেমন বনিবনা হয়েছে, কোনও সময় ঝগড়া-ঝাটি হচ্ছে কি না, আড়ি পেতে শুনে যেন আমাকে জানায়। যদি জিজ্ঞেস করেন কেন, তার উত্তর স্পষ্ট করে দেব। সেনসায়েবের ক্যারেক্টার ভাল নয়। এর বেশি কিছু বলছি না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। নিজে বুঝে নিন।
নন্দা কাঁদো-কঁদো মুখে বলল, আমার ভয় হচ্ছে গিন্নিমা। ছন্দার যদি কোনও বিপদ হয়?
আমি আছি। ভাবিস নে। নিজের কাজে যা।
নন্দা চলে গেল। তারপর কর্নেল বললেন, নন্দার সিঁথিতে সিঁদুর দেখলুম। ওর স্বামী কোথায় থাকে?
ফটিকের সঙ্গে নন্দার বিয়ে দিয়েছি।
কর্নেল হাসলেন। ভালো করেছেন। আচ্ছা! এবার আমরা উঠি। আমার এই কার্ডটা রাখুন। দরকার হলে ফোন করবেন।
বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সুলতা কার্ডটা নিয়ে বাঁকা মুখে বললেন, আমার কর্তামশাই সেনসায়েবের চামচা। কিছু বললে পরে ধুয়ো গায়, ব্যবসার খাতিরে মানিয়ে চলতে হয়। আমার কিন্তু স্পষ্ট কথা কর্নেলসায়েব! যদি রমলার বর সেনসায়েবকে কিডন্যাপ করে টাকা আদায় করে এবং আপনি তা জানতে পারেন, তা হলে প্লিজ এ ব্যাপারে আর নাক গলাবেন না। সেনসায়েবের একটা শিক্ষা হোক।
কর্নেল হাসলেন। তার মানে, লালুবাবু এই ঘটনায় জড়িত না থাকলে তবেই আমি কিডন্যাপারদের ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করব?
ঠিক। সুলতা শক্ত মুখে বললেন, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমার কর্তা একেবারে মহাপুরুষ। ওঁকে পাত্তা দেবেন না।
কিন্তু মিসেস সেন ওঁকে বিকেল তিনটেয় ডেকেছেন।
ও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভুলবেন না। আপনি আমাকে কার্ড দিলেন। আমার ওপর আপনি নির্ভর করে দেখতে পারেন। দেখবেন, আমি আপনাকে যত ক্ল দিতে পারব, আমার কর্তা তা পারবে না। ও বড্ড বেশি ভালোমানুষ বলেই তো এখনও সেনসায়েবের লেজ ধরে আছে। অন্য কেউ হলে এতদিনে নিজেই বড় কোম্পানির মালিক হতে পারত।…
কিছুক্ষণ পরে রাস্তায় যেতে যেতে কর্নেল একটু হেসে বললেন, কী বুঝলে জয়ন্ত?
বললুম, একটু খটকা বেধেছে।
কী বিষয়ে?
মিসেস মিত্তিরের যেন সেনসায়েবের ওপর বড্ড বেশি রাগ।
সেটা রমলার কারণে হতে পারে।
আমার মনে হচ্ছে, ওটা উপলক্ষ। ভেতরে যেন আরও কিছু আছে।
আর কী কারণ থাকতে পারে বলে তোমার ধারণা?
একটু ভেবে নিয়ে বললুম, মিসেস মিত্তির কেমন টোনে কথাটা বলছিলেন, সেনসায়েবের চরিত্র ভালো নয়।
কর্নেল হাসলেন। মিসেস মিত্তিরকে সুন্দরী বলা চলে না। একটু পুরুষালি হাবভাবও স্পষ্ট!
আহা! আমি তা বলিনি। আমার পয়েন্টটা হলো, ছন্দাকে উনি কেন সেনসায়েবের বাড়িতে আড়ি পাতার কাজে লাগিয়েছেন। কেন–এটাই মোক্ষম প্রশ্ন।
তার জবাব তো মিসেস মিত্তির নিজেই দিয়েছেন। সেনদম্পতির সম্পর্কে ওঁর কৌতূহল আছে।
কেন এই কৌতূহল?
হুঁ। এতক্ষণে তুমি সঠিক লাইনে এসেছ। যাইহোক, এখন আর এসব কথা নয়। বলে কর্নেল চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলেন।…
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিয়ে সহাস্যে বলল, হালদারমশাই দুবার ফোন করেছিলেন। তারপর একটু আগে এসে পড়েছেন।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলুম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ সোফায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। চোখ বন্ধ। কাছে গিয়ে আস্তে ডাকলুম, হালদারমশাই।
অমনি গোয়েন্দাপ্রবর তড়াক করে উঠে সিধে হলেন। বললেন, ঘুম পাইছিল।
কর্নেল বললেন, কোথাও মক্কেলের জন্য রাত্রি জাগতে হয়েছিল বুঝি।
কে কে হালদার হাসলেন। ঠিক ধরেছেন কর্নেলস্যার! কাইল রাত্তিরে খুব ধকল গেছে। মর্নিংয়ে আপনার লগে কনসাল্ট করতে আইব ভাবছিলাম। ক্লায়েন্ট আবার ফোনে ডাকল। তেনার রিকোয়েস্টে একসঙ্গে লাঞ্চ খাইতে হইল। তবে তার আগে দুইবার আপনারে ফোন করছিলাম। যষ্ঠী কইল, বাবামশাই ফেরেন নাই। শ্যাষে লাঞ্চ খাইয়াই আইয়া পড়লাম।
কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। ক্যামেরা আর বাইনোকুলারও রাখলেন। তারপর হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী।
ষষ্ঠীচরণ ভেতরের দরজার পর্দা তুলে উঁকি দিল। বলল, আবার এখন কফি খাবেন বাবামশাই? ছোটদিনের বেলা। গরম-গরম খেয়ে নেওয়া ভালো। কী বলেন দাদাবাবু?
বললুম, ঠিক বলেছিস।
কর্নেল ষষ্ঠীর দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, বড্ড বেশি কথা বলার অভ্যাস হয়েছে। শোন! তোর দাদাবাবুও খাবেন।
ষষ্ঠী বলল, সেটা কি বলতে হবে বাবামশাই! সব রেডি।
বাঃ! শোন! আমরা ঠিক একটায় খাব।
বলে কর্নেল হালদারমশাইয়ের দিকে ঘুরলেন। মনে হচ্ছে জব্বর কেস পেয়েছেন হালদারমশাই। মক্কেলের সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছেন। হোটেলের গন্ধ পাচ্ছি। বড় হোটেল। হোটেল কন্টিনেন্টাল নয় তো?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ সহাস্যে বললেন, আপনি হইলেন গিয়া এক্কেরে অন্তর্যামী। আপনার চক্ষু চারদিকে।
মক্কেল কি ত্রিপুরার কোনও মিঃ বর্মন।
অ্যাঁ? হালদারমশাইয়ের চোখ গুলি গুলি হয়ে উঠল। গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপতে থাকল। এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার প্রচণ্ড উত্তেজিত হলেই তার চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। যেন শিকারি চিতা!
কিন্তু আমি অবাক হয়ে বললুম, কর্নেল! নিশ্চয় এর কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড আছে–আমাকে যা আজ একবারও বলেননি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। তুমিও একটু তৎপর হলে আন্দাজে এই চিলটা ছুঁড়তে পারতে!
কী করে পারতুম?
তোমার চোখে পড়া উচিত ছিল, মিত্তিরমশাই ফোন পেয়েই হোটেল কন্টিনেন্টালে ওঁর ত্রিপুরার এজেন্ট জনৈক বর্মনসায়েবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বিভ্রান্তভাবে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তুমিই স্মরণ করিয়ে দিলে, নিচের প্যাসেজে তোমার গাড়ি আছে। কাজেই গ্যারাজ থেকে ওঁর গাড়ি বের করা যাবে না।
চমকে উঠে বললুম, হ্যাঁ। আমি কথাটা বলায় উনি কেমন যেন হকচকিয়ে উঠেছিলেন। এখন মনে পড়ছে ব্যাপারটা। কিন্তু সেই বর্মনসায়েবই যে হালদারমশাইয়ের মক্কেল, এটা অনুমানের বাইরে পড়ে। আপনি নিশ্চয়–
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, হালদারমশাই প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বা রুমাল বের করতে গিয়ে একটা জিনিস নিজের অজ্ঞাতসারে সোফায় ফেলেছেন। লক্ষ্য করো, গলাবন্ধ সোয়েটার পরেছেন উনি। কাজেই জিনিসটা প্যান্টের পকেটে তাড়াহুড়ো করে ঢোকানোই স্বাভাবিক।
বলে কর্নেল ইজিচেয়ার থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে হালদারমশাইয়ের উরুর পাশ থেকে একটা নেমকার্ড কুড়িয়ে দিলেন। ডিটেকটিভদ্রলোক বললেন, কী কাণ্ড!
দেখলুম, কার্ডে বোল্ড টাইপে ছাপা আছে বর্মন ট্রেডিং এজেন্সি। আগরতলা। অমনি হালদারমশাইকে চার্জ করলুম। কেসটা কী বলুন তো?
হালদারমশাই বললেন, কাইল বর্মনসায়েব গণেশ অ্যাভেনিউতে আমার অফিসে দেখা করছিলেন। ওনার ভগ্নীপতি বিগ ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট বি কে সেন। স্যানসায়েবেরে ফলো করতে কইলেন! রাত্তির দশটায় স্যানসায়েব নাকি একজন স্ত্রীলোকের লগে ফুর্তিফার্তি করেন। বর্মনসায়েব সেই স্ত্রীলোকের ঠিকানা চান। বর্মনসায়েব একটা প্রাইভেট কারের ব্যবস্থা করছিলেন। লেকের ধারে গুড ইভনিং ক্লাব দেখাইয়া দিছিলেন। তারপর
এই সময় টেলিফোন বেজে উঠে বাধা দিল।..
.
০৩.
কর্নেলও আমার মতো বিরক্ত হয়েছিলেন। বললেন, ফোনটা ধরো জয়ন্ত। কেউ আমাকে চাইলে বলবে, আমি বাইরে গেছি। বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফোন করতে বলবে। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছিল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কেউ কর্কশ কণ্ঠস্বরে বলল, এই ব্যাটা বুড়ো। আকাশকুসুমে নাক গলাতে এসো না। টাকে চুল গজাবে কি, টাক ফুটো হয়ে যাবে।
তারপরই লাইন কেটে গেল। কর্নেল হাসলেন। আকাশকুসুম! বাঃ! ভালো।
বললুম, কোন বজ্জাত কী বলে শাসাল আপনাকে শুনতে পেলেন?
পরিষ্কার। সকালে বলেছিলুম না? আমার এই নতুন জাপানি টেলিফোনটা খুব সেন্সিটিভ। কাছাকাছি থাকলে সব কথা স্পষ্ট শোনা যায়!
হারদারমশাই উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে বললেন, কী কইল? কী কইল?
পরে শুনবেন। আপনি তো জানেন উড়ো ফোনে আমাকে লোকেরা বরাবর শাসায়। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। এবার আপনার কেসের কথা বলুন।
গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেলের দিকে এক মুহূর্ত সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, স্যানসায়েবের–মিঃ বি কে সেনের গাড়ির নম্বর আগেই বর্মনসায়েব আমারে দিছিলেন। সাদা মারুতি গাড়ি। বর্মনসায়েব ট্যাক্সিতে গেলেন। আমি ক্লাবের গেটের কাছাকাছি ওয়েট করছিলাম। আমারে বর্মনসায়েব যে গাড়ি দিছিলেন, তার ড্রাইভারের নাম মুন্না। জুয়েল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মারুতি সুজুকি গাড়ি। সুপারফাইন। মুন্না বর্মনসায়েবেরে চেনে। তারেও বর্মনসায়েব কইয়া দিচ্ছিলেন, আমারে য্যান কোঅপারেট করে। তো মুন্নাও খুব আলাপি। এদিকে মশার কামড়ে অস্থির। ফঁক পাইয়া ঢুকছে আর কী! সময় কাটে না। আমাগো সামনে-পিছনে গাড়ির সার! হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, দশটায় স্যানসায়েবের গাড়ি বারাইতে দ্যাখলাম। মুন্না রেডি ছিল। ফলো করল। স্যানসায়েব নিজে ড্রাইভ করছিলেন। গাড়ি ফলো করতে করতে গিয়া পড়লাম নিউ আলিপুরে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ির সামনে বা পেছনে আর কেউ ছিল কি না লক্ষ্য করেছিলেন।
না। জানালার কাঁচ বন্ধ। শুধু স্যানসায়েবের কাছে কাঁচ এটুখানি নামানো ছিল।
তারপর?
একটা বাড়ির সামনে ওনার গাড়ি থামল। উনি বারাইয়া সেই বাড়িতে ঢুকলেন। ছোট্ট গেট খোলা ছিল। ভাবলাম, অতবড় গাড়ি ঢুকবে না বলে স্যানসায়েব গাড়ি বাইরে রাখলেন। একটু দূরে গাড়ি রাখতে কইলাম মুন্নারে। তারপর আমি বাড়িটার কাছে গেলাম। সেইসময় একটা লোক বাড়ি থেকে আইয়া স্যানসায়েবের গাড়িতে ঢুকল। তারপর জোরে উধাও হইয়া গেল। তখন কী আর করি কন? মুন্নারে কইলাম, চলো। হোটেলে যাই। বর্মনসায়েবের লগে দেখা করা দরকার।
বুঝলাম। বর্মনসায়েব কী বললেন?
উনি সেই বাড়ির অ্যাড্রেস জিগাইলেন। বাড়ির নাম্বার গেটে একটুকরো ফলকে লেখা ছিল। নামও লেখা ছিল। মুন্দ্রাভবন।
খুব ধকল গেছে গত রাত্রে। কর্নেল জ্যাকেট খুলে বললেন, তারপর আজ বর্মনসায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?
করছিলাম। উনি কইলেন, আজ বারোটায় লাঞ্চে আমার ইনভেটিশেন। ওইসময় আমারে বাকি টাকা পেমেন্ট করবেন। পাঁচশো অ্যাডভান্স করছিলেন। বাকি পাঁচশো দিলেন। কিন্তু সবটাই আমার কাছে মিসটিরিয়াস। কিছু বোঝা যায় না। বর্মনসায়েবও আর য্যান পাত্তা দিতে চান না। শুধু কইলেন, থ্যাঙ্কস্ ফর দা জব। পরে দরকার হইলে খবর দেবেন।
আজ আপনি যখন হোটেলে ছিলেন, তখন কাকেও কি বর্মনসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে দেখেছেন?
হালদারমশাই হাই তুলে বললেন, রিসেপশন হইতে ওনারে ফোন করছিল। কী কইল জানি না। বর্মনসায়েব কইলেন, ওনারে লাউঞ্জে ওয়েট করতে কন।
বললুম, তার মানে বটুকবাবু।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ চমকে উঠে বললেন, বটুকবাবু? হু ইজ হি?
কর্নেল বললেন, পরে শুনবেন। আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা খেয়ে আসি।..
ডাইনিং রুমে খেতে বসে বললুম, ঘটনাটা স্পষ্ট হলো এবার। ছন্দার কথা টায়েটোয়ে মিলে যাচ্ছে। মুন্দ্রাভবনের গেট থেকে যে লোকটা সেনসায়েবের গাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল এবং মুক্তিপণের চিঠি দিয়েছিল, তাকে হালদারমশাই দেখেছেন। দ্বিতীয় ঘটনা হলো, বর্মনসায়েবের ফোন পেয়ে বটুকবাবু উদ্ভান্তের মতো বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। কেন?
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! তোমার এই বদ অভ্যাস কিছুতেই গেল না। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।
অগত্যা চুপচাপ খাওয়াতে মন দিলুম। কিন্তু মনের ভেতর আর একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটু আগে যে লোকটা উড়ো ফোনে হুমকি দিল তার টাইম ফ্যাক্টর লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, সে আমাদের অজ্ঞাতসারে ফলো করে এসেছিল এবং এই পাড়ারই কোনও বুথ থেকে ফোন ব্যবহার করেছে। হ্যাঁ, আমার এই পয়েন্ট নির্ভুল। সে ঠিক সময়ে ফোন করেছে। তার মানে, আমাদের বাড়ি ফেরা সে লক্ষ্য করেছে। আন্দাজে ফোন করেনি। তা করলে ষষ্ঠী ফোন। ধরত এবং আমাদের জানাত।
চুপচাপ খাচ্ছিলুম বটে, কিন্তু ভাবতে চমক লাগছিল, একজন দুবৃত্ত আমাদের অজ্ঞাতসারে অনুসরণ করে এসেছে। ইচ্ছে করলে সে গুলি ছুঁড়ে কর্নেল বা আমাকে–ওঃ!
কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার? আর্তনাদ করছ কেন? ষষ্ঠী তো রান্নায় একেবারে ঝাল দেয় না।
বললুম, নাঃ। ঝাল নয়! যে লোকটা তখন উড়ো ফোনে হুমকি দিল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে আমাদের ফলো করে আসছিল। ভাগ্যিস গুলি চালায়নি।
কর্নেল হাসলেন। এইজন্যই তোমাকে প্রায়ই বলি, তুমি বোঝো সবই। তবে দেরিতে বোঝো। তোমার গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে সবুজ মারুতিটা চোখে পড়া উচিত ছিল। যাইহোক, গাড়িটার নাম্বার আমি মুখস্থ করে নিয়েছি। হালদারমশাইয়ের, এক আত্মীয় মোটর ভেহিকেলস ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন, সে তো তুমি জানো। কাজেই গাড়িটার মালিকের নাম-ঠিকানা জানা কঠিন কাজ নয়। অবশ্য ভুয়ো নাম-ঠিকানায় আজকাল গাড়ির রেজিস্ট্রেশনও করানো নতুন কিছু নয়।
ড্রয়িংরুমে ফিরে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, মিসেস মিত্র? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। আপনার কর্তা কি বাড়ি ফিরেছেন?… আচ্ছা। আমি একটা কথা জানতে চাইছি আপনার কাছে। …মানে মিসেস রুচিরা সেনের বাবার বাড়ি কোথায় জানেন?… আচ্ছা! মিসেস সেনের কোনও ভাই বা দাদা…ও! তাই মিঃ মিত্র ফোন পেয়েই বেরিয়ে গেলেন!… শুধু বর্মন নয়, দেববর্মন। হিতেশ্বর দেববর্মন।… একটা কথা। উনি বোনের বাড়ি ওঠেন না কেন? হোটেলে কি বরাবরই ওঠেন?… বলেন কী! সেনসায়েব শ্যালকের ওপর অসন্তুষ্ট?… তা হলে মিঃ মিত্রের ওপর সেনসায়েবের মনে মনে ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা। ভগ্নীপতির কারখানার তৈরি জিনিস হিতেশ্বর দেববর্মন আপনাদের ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সির মাধ্যমে কেনেন। …ত্রিপুরা, আসাম, মণিপুর–সারা পূর্বাঞ্চলে ওরিয়েন্ট কেমিক্যালের তৈরি পণ্যের রাজার খুব ভালো। আপনি ঠিক বলেছেন। পূর্বাঞ্চলে সেনসায়েবের কোনও ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সি নেই?… বুঝেছি। মিঃ দেববর্মনের দাপট আছে। …পলিটিক্যাল সার্কেলেও…হ্যাঁ, হ্যাঁ। ব্যাকগ্রাউন্ডটা পরিষ্কার হলো। রাখছি ম্যাডাম! ধন্যবাদ।
রিসিভার রেখে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন।
হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলেন। তিনি নস্যির কৌটো বের করে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর রুমালে নাক মুছে ফিক করে হাসলেন।
বললুম, কী ব্যাপার হালদারমশাই?
গোয়েন্দাপ্রবর চাপা গলায় বললেন, অল ক্লিয়ার জয়ন্তবাবু! কর্নেলস্যার যার মুড়া ধরছেন, আমি তার ল্যাজ ধরছিলাম।
কর্নেল চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ল্যাজটা আবার ধরতে হবে হালদারমশাই। না–মিঃ দেববর্মন আর আপনার ক্লায়েন্ট নন। মনে করুন, আমিই আপনার ক্লায়েন্ট।
কী যেন কন কর্নেলস্যার! হালদারমশাই সহাস্যে বললেন। আপনি কইলে আগুনে ঝাঁপ দিতে রেডি আছি।
নিউ আলিপুরে মুন্দ্রাভবন বাড়িটা কি খুব বড়?
না। পুরানো এল প্যাটার্ন বাড়ি। লনে জঙ্গল গজাইয়া আছে।
রাস্তার নাম লক্ষ্য করেছিলেন।
না। অত রাত্তিরে নাম খুঁজব ক্যামনে? লোকজন নেই। বাড়ির উল্টাদিকে ব্যাবাক জঙ্গল।
বুঝেছি। হর্টিকালচার সোসাইটির বাগান। বলে চোখ খুলে কর্নেল সিধে হয়ে বসলেন। লাঞ্চের পর আমার কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। আপনিও এক পেয়ালা কফি খেয়ে ব্রেন চাঙ্গা করুন। দেড়টা বেজে গেছে। আপনি এক কাজ করুন।
উত্তেজিত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, কন।
আপনি তো ছদ্মবেশ ধরতে পটু। আমি বলি কী, টিপিক্যাল পাগলা ভবঘুরে সেজে মুন্দ্রাভবনের গেট চোখে পড়ে, এমন কোনও জায়গায় বসে থাকবেন। মাথার চুল, ঘোঁফদাড়ি, চামড়ার রঙ ইত্যাদি ভবঘুরে পাগলাদের কেমনটি হয়, নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন।
ব্যস! ব্যস! আর কইতে হবে না কর্নেলস্যার। ফায়ার আর্মস সঙ্গে রাখব তো?
রাখবেন। আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সির লাইসেন্সও সঙ্গে রাখবেন। অন্তত রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত আপনাকে থাকতে হবে। শীতের রাত্রে শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালবেন। সত্যিকার ভবঘুরে বা রাস্তার ছেলেদের যাদের স্ট্রিট আৰ্চিন বলা হয়, তাদেরও আড্ডায় পেতে পারেন। আপনার লক্ষ্য থাকবে শুধু মুন্দ্রাভবনের গেটের দিকে। কিন্তু সাবধান। যা কিছু ঘটুক, আগ বাড়িয়ে নাক গলাতে যাবেন না।
তারপর? তারপর?
প্রয়োজনে এগারোটা পর্যন্তও আপনাকে থাকতে হবে। অর্থাৎ, আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে আপনি ওখান থেকে উঠে পড়বেন। কোনও নির্জন জায়গায় পোশাক বদলে নিয়ে ট্যাক্সি করে সোজা আমার এখানে চলে আসবেন। ভেবে দেখুন। অসুবিধে হবে না তো?
গোয়েন্দামশাই হাত নেড়ে বললেন, কর্নেলস্যার! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি, ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার হইয়া এমন সব কাম করছি, ভাবতে পারবেন না। এ তো সি আই ডি-র কনস্টেবলদের কাম। তারপর যখন আমারে স্পেশাল ব্রাঞ্চে বদলি করল,
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে আনার ফলে প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মুখ বন্ধ করলেন।
কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, আপনি সন্ধ্যা ছটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বেন। তারপর ওখানে গিয়ে ছদ্মবেশ ধরার জায়গা পেয়ে যাবেন। এলাকাটা সন্ধ্যার পরই নির্জন হয়ে যায়।
হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে দ্রুত কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলেন। তারপর আরেক টিপ নস্যি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যথারীতি যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
বললুম, কাজটা কি ঠিক হলো? হালদারমশাইয়ের স্বভাব তো জানেন। যেমন হঠকারী আর খেয়ালি, তেমনি একরোখা মানুষ। কিছু ঘটতে দেখলে ওঁর মাথার ঠিক থাকে না।
কর্নেল আস্তে বললেন, ওঁর ওই কাজটা কি তুমি পারবে?
হাসি পেল ওঁর কথায়। বললুম, তা পারব না। অর্থাৎ ভবঘুরে পাগলা সাজা আমার কর্ম নয়। তবে সাংবাদিকরাও গোয়েন্দাগিরি করে। অবশ্য সাংবাদিকদের গোয়েন্দাগিরির কলাকৌশল অন্যরকম।
কর্নেল কফি শেষ করে নিভিয়ে রাখা চুরুট ধরিয়ে আবার হেলান দিলেন এবং চোখ বন্ধ করলেন। মনে হলো, পুরো কেসটা মনে মনে অঙ্কের মতো সাজাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পরে বললুম, একটা ব্যাপার এখন স্পষ্ট যে, হিতেশ্বর দেববর্মন তাঁর ভগ্নীপতি বি কে সেনকে কিডন্যাপ করেননি।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। হঠাৎ চোখ খুলে মিটিমিটি হেসে বললেন, আচ্ছা জয়ন্ত, তুমি তো জানো, আমি এ যাবৎ কখনও ছদ্মবেশ ধরিনি। এখন ধরো, দৈবাৎ প্রয়োজনে ছদ্মবেশ ধরতে হলে কেমন ছদ্মবেশ আমার পক্ষে উপযুক্ত?
কেন? গোঁফ-দাড়ি কেটে মাথায় পরচুলো পরলেই—
সর্বনাশ ডার্লিং! অমন অলক্ষুণে কথা বোলো না।
ছদ্মবেশ ধরেননি বললেন। কিন্তু সেবার লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে একটা মসজিদের সামনে আলখেল্লা পরে ফকিরের বেশ ধরেছিলেন যে?
ও হ্যাঁ! সরি ডার্লিং! সেই একবার। আসলে বয়স হচ্ছে। স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে।
কর্নেল! আপনি কিন্তু শিখ সর্দারজির ছদ্মবেশ সহজে ধরতে পারেন।
বাঃ। ঠিক বলেছ। গোঁফদাড়ি অক্ষত রেখে এই ছদ্মবেশ ধরা যায়।
কিন্তু আপনি কি সত্যি ছদ্মবেশে কোথাও যেতে চান?
কর্নেল হাসলেন। নাঃ। কথাটা হঠাৎ মাথায় এল। বলে তিনি পা দুটো ছড়িয়ে হেলান দিলেন আগের মতো। তারপর বললেন, তুমি ডিভানে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতে পারো। মিত্তিরমশাই যতক্ষণ না ফোন করছেন, ততক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে।
ডিভানে শুয়ে পড়লুম। দুপুরে খাওয়ার পর ভাতঘুম না দিলে আমার। কেমন অস্বস্তি হয়।
তারপর সত্যিই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঘুম ভাঙল ষষ্ঠীচরণের ডাকে। দাদাবাবু! উঠে পড়ুন। চা এনেছি।
ষষ্ঠী জানে, ঘুম ভাঙার পর আমি চা খেতে ভালোবাসি। তখনই সটান উঠে পড়লুম। তারপর দেখলুম, কখন বটুক মিত্তির এসেছেন এবং কর্নেলের সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছেন।
বটুকবাবু সহাস্যে বললেন, ঘুমোচ্ছেন দেখে জাগাইনি। কর্নেলসায়েবও বললেন, কঁচা ঘুম ভাঙালে নাকি আপনি চটে যান।
বললুম, আপনি কতক্ষণ?
মিনিট দশেক আগে এসেছি। বলে বটুক মিত্তির কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। তো যা বলছিলুম। মিসেস সেন আমাকে ব্রিফকেস খুলে টাকা দেখালেন।
হাজার টাকার একশোখানা নোটের বান্ডিল। থাকে-থাকে সাজানো একশোটা বান্ডিল। এক কোটি ক্যাশ টাকা। দেখে তো আমার চক্ষুস্থির। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো, কাকেও দেবার জন্য যেন স্বয়ং সেনসায়েবই এই টাকা তৈরি রেখেছিলেন। যাইহোক, মিসেস সেন আমাকে পীড়াপীড়ি করে বললেন, এই ব্রিফকেসটা আমাকেই পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে ছাড়া উনি আর কাকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেয়ারটেকার ব্যানার্জিবাবু, কিংবা সেনসায়েবের পি এ বরুণ রায়, কাকেও তিনি বলেননি, কে টাকাটা পৌঁছে দেবে। মিসেস সেন খুব বুদ্ধিমতী। বললেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি যেন ঠিক ওই রকম একটা ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ওঁর সঙ্গে আবার দেখা করতে যাই। ফেরার সময় আমার ব্রিফকেস রেখে ওঁরটা নিয়ে বেরিয়ে আসি। তারপর রাত দশটা নাগাদ নিউ আলিপুরে হর্টিকালচার সোসাইটির উল্টোদিকে মুন্দ্রাভবনের সামনে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢুকতে হবে। কেউ অপেক্ষা করবে। সে জিজ্ঞেস করবে, এ কে? আমাকে বলতে হবে ও কে। তারপর তাকে ব্রিফকেস দিয়ে গাড়িতে বসে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। সেনসায়েবকে ওরা তখনই ছেড়ে দেবে। তাঁকে নিয়ে আমাকে ফিরতে হবে।
কর্নেল মন নিয়ে শুনছিলেন। বললেন, সেনসায়েব যদি ওই বাড়িতে বন্দী অবস্থায় থাকেন, পুলিশ নিয়ে হামলা করলে তো ওরা–
বটুক মিত্তির তার কথার ওপর বললেন, প্রাণে মেরে দেবে সেনসায়েবকে। তারপর পুলিশ তাদের ধরুক কিংবা মারুক, ওরা গ্রাহ্য করবে না। মিসেস সেন বললেন, টেলিফোনে যে লোকটা এ সব কথা বলেছে, তার গলার স্বর কর্কশ। ভাঙাভাঙা বাংলা বলছিল। আমি তো আমার মিসেসের কাছে কিছু গোপন করি না। সুলতা বলল, সেনসায়েবের ডিভোর্সড ওয়াইফ রমলার স্বামী নাকি পলিটিক্যাল লিডার। তার হাতে একটা মাফিয়া গ্যাং আছে। জয়ন্তবাবু নাকি সুলতাকে সেই গ্যাঙের কথা বলেছেন।
বললুম, হ্যাঁ। লালুবাবুর গ্যাঙের লোকেরা বেশির ভাগই অবাঙালি।
আমার মিসেসের অঙ্ক মিলে যাচ্ছে। রমলা তার গহনার দাম আদায় করতে চায়। কিন্তু আমি তো ভরসা পাচ্ছি না। একা অত নগদ টাকা নিয়ে কীভাবে যাব? সুলতা বলল, তুমি এখনই কর্নেলসায়েবের সঙ্গে পরামর্শ করে এস। তিনি নিশ্চয় তোমাকে গার্ড দেবেন।
কর্নেল বললেন, কী করা যায় দেখছি। এবার বলুন, হোটেল কন্টিনেন্টালে বর্মনসায়েবের সঙ্গে কী কথা হলো?যবটুক মিত্তির আস্তে বললেন, কারবারি কথা।
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিত্তিরমশাই। আমি যেভাবে হোক জানতে পেরেছি, আপনার বর্মনসায়েব অর্থাৎ হিতেশ্বর দেববর্মনেরই সহোদর ভগ্নী মিসেস রুচিরা সেন। সেনসায়েব কোনও কারণে তার শ্যালককে পছন্দ করেন না। তাই ইস্টার্ন রিজিয়নে ওরিয়েন্ট কেমিক্যালের তৈরি পণ্যের বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও শ্যালককে ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সির দায়িত্ব দেননি। অগত্যা হিতেশ্বর দেববর্মন আপনার মাধ্যমে ওঁদের জিনিস কেনেন। এতে নাকি সেনসায়েব আপনার প্রতি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ। তাই না?
বটুক মিত্তির হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনার কাছে কিছু গোপন থাকে না। আপনার কীর্তিকলাপ জানি বলেই তো ঘটনাটা সাতসকালে আপনাকে জানাতে এসেছিলুম।
তা হলে প্লিজ মিত্তিরমশাই, বৰ্মনসায়েবের সঙ্গে কী কথা হয়েছে, খুলে বলুন।
বটুকবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বর্মনসায়েব প্রথমেই বললেন, তাঁর বোন রুচিরা সিধেসাদা বোকা টাইপের মেয়ে। আগরতলায় আমাদের বাড়িতে রুচিরার সঙ্গে বি কে সেনের আলাপ হয়। বাড়ির অমতে সে সেনকে বিয়ে করে। গোপনে সেনের সঙ্গে কলকাতা চলে আসে। বর্মনসায়েবের হাতে নাকি খবর আছে, গুড ইভনিং ক্লাবে রুচিরা যেদিন যায় না, সেদিন বি কে সেন একজন সিনেমা অ্যাকট্রেসের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে। কখনও তার সঙ্গে রাত কাটিয়ে আসে। রুচিরা জিজ্ঞেস করলে বলে, কোম্পানির কাজে হঠাৎ বাইরে যেতে হয়েছিল।
তা হলে এতদিন আপনি জানতেন না রুচিরা সেন বর্মনসায়েবের বোন?
বটুকবাবু মাথা নেড়ে বলেন, বিশ্বাস করুন, ওঁদের সম্পর্কের কথা জানতুম না। আজই বর্মনসায়েবের মুখে শুনে অবাক হয়ে গেছি।
শেষ পর্যন্ত বর্মনসায়েব আপনাকে কী বললেন?
বর্মনসায়েব আমাকে বললেন, সেই সিনেমা অ্যাকট্রেসের বাড়ির খোঁজ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বোন মনে আঘাত পাবে বলে এ বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি। আমিও যেন তাকে ঘুণাক্ষরে কথাটা না জানাই। তিনি নিজেই সেই সিনেমা অ্যাকট্রেসকে থ্রেটন করবেন।
মিত্তিরমশাই! বর্মনসায়েব শুধু এসব কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছিলেন বলে বিশ্বাস হচ্ছে না।
বটুক মিত্তির কাঁচুমাচু মুখে বললেন, বিশ্বাস করুন। এর বাইরে নিছক কারবারি কথা ছাড়া আর কোনও কথা হয়নি। ওঁর সঙ্গে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কারবারি কথাটাও কি বলতে আপত্তি আছে?
মোটেই না। আমার কাছে বর্মনসায়েব তিন পেটি করে আকাশকুসুম তেলের সাপ্লাই নেন। এক পেটিতে থাকে এক হাজার বোতল। পেটিগুলো ওরিয়েন্ট কেমিক্যালের ডানকুনির কারখানা থেকে আমার গোডাউনে আসে। নানা জায়গায় আমি সাপ্লাই করি কমিশন বেসিসে। আমার গোডাউন আছে। তিলজলা এরিয়ায়। তো বর্মনসায়েব একটা অদ্ভুত কথা বললেন। যেসব পেটিতে রেডক্রশ মার্কা দেওয়া থাকে, সেগুলোর নাকি একটু বেশি দাম। সেগুলো হাই কোয়ালিটি মাল। এ সপ্তাহে সেই রেডক্রশ মার্কা যতগুলো পেটি আসবে, সবই তিনি চান। তার জন্য আমাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে যাবেন। কিন্তু ব্যাপারটা হলো, কোনও পেটিতে রেডক্রশ মার্কা দেওয়া থাকে কি না আমি মোটেও জানি না। আমার সেলস ম্যানেজার বা অন্য কর্মচারীদের জানার কথা। তাই বর্মনসায়েবের কাছে খোঁজ নিয়ে রেডক্রশ মার্কা পেটিই পাঠাব। বর্মনসায়েব মঙ্গলবার সকালের ফ্লাইটে আগরতলা ফিরবেন। যাবার আগে আমাকে অ্যাডভান্স করে যাবেন।
আপনি মাল পাঠান কীভাবে?
জয় মা তারা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ট্রাকে। এই কোম্পানির ট্রাকে আরও অনেক ট্রেডিং এজেন্সির মালও ইস্টার্ন রিজিয়নে পাঠানো হয়। সবার মাল ইন্সিওর করা থাকে অবশ্য।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনার তিলজলার গোডাউনে কি আকাশকুসুম তেলের পেটি মজুত আছে?
না। প্রথম দফায় শখানেক পেটি এসেছিল। এখন আর স্টক নেই। আগামী সপ্তাহে আবার আসার কথা আছে। বাজারে খুব ডিম্যান্ড। এবার দুশো পেটির অর্ডার দিয়ে রেখেছি।
কর্নেল আবার ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, মিত্তিরমশাই। নিরাপদে সেনসাহেবকে মুক্ত করে আনা সবচেয়ে জরুরি কাজ। আপনি হোটেল কন্টিনেন্টালে হিতেশ্বর দেববর্মনকে এখনই টেলিফোনে বলুন আপনি সেনসায়েবের কাছে কৌশলে জেনে নিয়েছেন, সেই সিনেমা অ্যাকট্রেস মুন্দ্রাভবনে নেই। ক্যামাক স্ট্রিট এরিয়ার একজন সিনেমা পরিচালকের সঙ্গে তিনি বেরিয়ে গেছেন। খুব জোর দিয়ে বলুন কথাটা।
বটুকবাবু টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়েছেন, সেই সময় আমি বললুম, বর্মনসায়েব কি বোনকে ফোন করেন না?
বটুক মিত্তির ডায়াল করতে করতে বললেন, না। বললুম না বোন বাড়ির অমতে সেনসায়েবের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিলেন। তবে দেখুন, আফটার অল সহোদর বোন। তাই তার ভাল-মন্দর ব্যাপারটা বর্মনসায়েবকে চিন্তা করতে হয়। …হ্যালো! আমি বি মিত্র বলছি।… মিস চান্দ্রেয়ী নাকি? শুনুন। প্লিজ পুট মি টু স্যুইট নাম্বার সিক্স ও টু। ইয়েস। মিঃ দেববর্মন। …রিং হচ্ছে সাড়া পাচ্ছি না। বলে বটুকবাবু কর্নেলের দিকে তাকালেন। রিসেপশনিস্ট বলল, মিঃ বর্মনকে বেরোতে দেখেনি। কি বোর্ডে ওঁর স্যুইটের চাবি নেই। তার মানে, হোটেলেই আছেন। ..কী ব্যাপার? রিং হয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কুইক মিত্তিরমশাই। চলুন। আমরা হোটেল কন্টিনেন্টালে যাই।…
.
০৪.
হোটেল কন্টিনেন্টালের পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে আমরা লাউঞ্জে ঢুকলাম। বিশাল লাউঞ্জে পুরোটা লাল কার্পেট বিছানো আছে। নানা দেশের নর-নারী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে চাপাস্বরে কথা বলছে। শেষপ্রান্তে বার। সেখানে উঁচু টুলে বসে কয়েকজন সায়েব-মেমসায়েব শরীর গরম করছে।
রিসেপশনে এক সুন্দরী যুবতী বটুক মিত্তিরকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল, মিঃ মিটার! আর য়ু রিয়্যালি অ্যাংশাস ফর ইয়োর ফ্রেন্ড অ্যাট সিক্স ও টু? আই অ্যাম সিওর, হি ইজ ড্রাংক্।
বটুকবাবু বললেন, হাউ আর য়ু সো সিওর মিস চান্দ্রেয়ী?
মিস চান্দ্রেয়ী ভিজিটারস বুক খুলে একটা পাতা দেখিয়ে বলল, সার পি রায় অব থ্রি ও বি পি অ্যাভেনিউ কেম টু মি মিঃ দেববর্মন অ্যাট টু-টেন ওক্লক টুডে। আফটার সামটাইম আই নোটিণ্ড দি ওয়েটার স্যামুয়েল ফ্রম দা বার ইজ গোয়িং টু সার্ভ হুইস্কি অ্যাট সিক্স ও টু।
মিঃ দেববর্মনের স্যুইটে যাচ্ছে, কেমন করে বুঝলেন?
যুবতী চোখ নাচিয়ে হাসল। ও! আই নো দ্যাট ওয়েল! স্যামুয়েল ইজ আ জলি ফেলা, ইউ নো! হি–
কর্নেল এইসময় তাঁর একটা নেমকার্ড বের করে তাকে দিলেন। আই ওয়ান্ট টু মিট দা ম্যানেজার মিঃ ব্রিজেশ কুমার। প্লিজ সেন্ড ইট টু হিম।
মিস চান্দ্রেয়ী কার্ডে চোখ বুলিয়ে কর্নেলকে দেখে নিয়ে পাশের এক যুবককে বলল, রাকেশ! দিস জেন্টলম্যান ওয়ান্ট টু মিট দা ম্যানেজার।
রাকেশ কার্ড নিয়ে চলে গেল। আমি বটুকবাবুকে জিজ্ঞেস করলুম, এই হোটেলে দেখছি বড্ড কড়াকড়ি। কোনও বোর্ডারের সঙ্গে দেখা করতে হলে নাম-ঠিকানা লিখে দিতে হয়।
বটুকবাবু বললেন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল তো। দেশবিদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিরা এখানে ওঠেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য এই ব্যবস্থা। শুনেছি, একবার কী একটা মিসহ্যাপ হয়েছিল নাকি। তারপর থেকে কড়াকড়ি।
স্যুট-টাই পরা কেতাদুরস্ত স্মার্ট চেহারার একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক রিসেপশনের শেষপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে কর্নেলের করমর্দন করে বললেন, হ্যালো কর্নেল সরকার। আই থিংক, ইউ হ্যাভন স্মেল্ট আ ডেড র্যাট হিয়ার এগেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ইউ আর রাইট মিঃ ব্রিজেশ কুমার।
ও মাই গড! মুহূর্তে ম্যানেজারের মুখ পাংশু হয়ে গেল। হু ইজ দা ভিকটিম দিস টাইম?
আই অ্যাম নট কোয়াইট সিওর। বাট লেট আস গো অ্যান্ড চেক দ্য সুইট নাম্বার সিক্স ও টু।
ব্রিজেশ কুমার তখনই ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন। মিস চান্দ্রেয়ী বটুকবাবু ও আমাকে ভিজিটরস বুকে নামধাম লিখতে অনুরোধ করল। কোন স্যুইটে কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, তা-ও লিখতে হলো।
ততক্ষণ কর্নেল ও ম্যানেজার লিফটে উঠে গেছেন। তাই একটু অপেক্ষা করতে হলো। বটুকবাবুর মুখ আতঙ্কে যেন রক্তশূন্য দেখাচ্ছে। একটু পরে লিফট নেমে এল। আমরা সিক্সথ ফ্লোরে উঠে গেলুম। দেখলুম, দুজন সিকিউরিটি গার্ড ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে ৬০২ নম্বর স্যুইটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা। গার্ডরা বাধা দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু আমরা ঢুকে গেলুম।
প্রথমেই কাশ্মীরি নকশাদার কাঠে পার্টিশন করা ছোট একটা ঘর। সোফাসেট আছে। সেন্টার টেবিলে একটা হুইস্কির বোতল এবং দুটো খালি গ্লাস চোখে পড়ল। এক প্লেট অর্ধভুক্ত স্ন্যাক্সও আছে। পাশের পর্দা তুলে বেডরুমে ঢুকে দেখলুম, বিছানায় কাত হয়ে এক ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। তার দুটো চোখ রক্তাক্ত এবং চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কানের কাছে চাপচাপ রক্ত। রক্ত গড়িয়ে পড়েছে গাল ও গলা বেয়ে বিছানার চাদরে। টাটকা রক্ত। বীভৎস দৃশ্য। মাথা ঘুরে উঠেছিল আমার!
বটুকবাবু উঁকি মেরে দেখে দুহাতে মুখ ঢেকে পিছিয়ে গেলেন। কর্নেলের সঙ্গগুণে বা সঙ্গদোষে এ যাবৎ অনেক খুনখারাপি দেখেছি। কিন্তু এমন বীভৎস খুন কখনও দেখিনি। রক্তাক্ত চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্য মৃতদেহের মুখ পৈশাচিক ভয়ঙ্করতার নিদর্শন হয়ে উঠেছে।
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, জয়ন্ত! বর্মনসায়েবকে সম্ভবত মদের সঙ্গে কোনও ড্রাগ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। তাই উনি বিছানায় শুয়ে পড়তে বাধ্য হন। তখন খুনী ওঁর কানের পাশে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি করে। তোমার মনে পড়তে পারে, হংকংয়ের এক ব্যবসায়ী মিঃ রঙ্গনাথন এই হোটেলের ১২৭ নম্বর স্যুইটে খুন হয়েছিলেন। তুমি অবশ্য তখন দিল্লিতে ছিলে।
বললুম, হ্যাঁ। আপনি সবিস্তারে বলেছিলেন। তার ভিত্তিতে একটা ধারাবাহিক রিপোর্টাজ লিখেছিলুম।
ব্রিজেশ কুমার পকেট থেকে কর্ডলেস ফোন বের করে চাপাস্বরে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
কর্নেল বললেন, মিঃ কুমার। আপনি নিচে গিয়ে অপেক্ষা করুন। পুলিশ অফিসারদের নিয়ে আসবেন।
ম্যানেজার বাংলা বোঝেন। বললেন, আপনি থাকুন। আমি যাই। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল এবার ঘরের মেঝে এবং বিছানা পরীক্ষা করে সাবধানে বালিশ একটু তুলে দেখে চাপাস্বরে বললেন, আশ্চর্য! বর্মনসায়েবের বালিশের তলায় একটা ফায়ার আর্মস রাখা আছে। এটা সম্ভবত উইপন নয়। খুনী সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারে গুলি করেছে। তা না হলে বাইরে সিকিউরিটি গার্ডরা গুলির শব্দ শুনতে পেত।
বর্মনসায়েবের প্যান্টের বাঁদিকের পকেট দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল সাবধানে হাত ভরে একটা রুমাল বের করলেন। তারপর পকেটের ভেতরে হাতড়ে ভাজ করা কিছুটা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া কাগজ বের করে পকেটস্থ করলেন। মৃতদেহ ডাইনে কাত হয়ে থাকায় বুকপকেট পরীক্ষা করার অসুবিধা ছিল না। কর্নেল মৃতদেহের বাঁ হাত সাবধানে একটু তুলে বুকপকেট পরীক্ষা করলেন। একটা খুদে নোটবই বের করে পাতা উল্টে দেখে আবার পকেটে পুরে দিলেন। তারপর পার্টিশন করা ছোট্ট বসার ঘরে এলেন। বটুকবাবু সোফায় বসে ছিলেন। কর্নেল সেন্টার টেবিল এবং মেঝে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হলেন।
আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলুম না। বটুকবাবুর পাশে বসলাম। বটুকবাবু ভাঙা গলায় বললেন, পুলিশ আমাকে নিয়ে টানাটানি করলেই বিপদ। আমার হাতে আজ রাত্তিরে একটা বড় কাজের দায়িত্ব।
বললুম, আপনাকে নিয়ে টানাটানির কারণ দেখছি না। আপনার সঙ্গে মিঃ দেববর্মনের কারবারি সম্পর্ক ছিল মাত্র। তা ছাড়া আপনি চলে যাওয়ার পর জনৈক পি রায় এসেছিল এ ঘরে। ভিজিটরস বুক তার প্রমাণ দেবে। মিস চান্দ্রেয়ী এবং বারের ওয়েটার স্যামুয়েল সাক্ষী দেবে।
বটুকবাবু চাপাস্বরে কর্নেলকে বললেন, একটা কথা।
কর্নেল তাঁর অন্যপাশে বসে চুরুট ধরাচ্ছিলেন। বললেন, কী কথা?
ভিজিটরস বুকে হাতের লেখাটা যেন চেনা মনে হচ্ছিল।
পুলিশকে এ কথা আগ বাড়িয়ে যেন বলবেন না। চেপে থাকুন।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে আবার উঠলেন। আবার বেডরুমে ঢুকে গেলেন। বুদ্ধিমান ম্যানেজার যাবার সময় দরজা বন্ধ করে গিয়েছিলেন, যাতে বাইরের আর কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম। বাইরে থেকে চাবি ছাড়া দরজা খোলা যায় না। কিন্তু ভেতর থেকে হাতল ঘুরিয়ে খোলা যায়।
একটু পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, মিঃ দেববর্মনের স্যুটকেস আর ব্রিফকেসের তালা ভেঙে কিছু খুঁজেছে খুনী। এমনও হতে পারে, এই কাজটা খুনী ইচ্ছে করেই করেছে, যাতে পুলিশকে মিসলিড করা যায়। যেন টাকাকড়ি বা দামি কিছু হাতাবার জন্য খুন করেছে। তবে আমি এ বিষয়ে সিওর নই।
বটুকবাবু বললেন, ব্রিফকেস থেকে টাকা বের করে বর্মনসায়েব আমাকে অ্যাডভান্স পাঁচ হাজার টাকা পেমেন্ট করেছেন। তাছাড়া আমার বকেয়া পাওনা ছিল দুহাজার টাকা। তা-ও পেমেন্ট করেছেন। আমি আমার এজেন্সির ছাপানো রিসিটবই এনেছিলুম। রিসিট দিয়েছি। রেভেনিউ স্ট্যাম্পে সই করে রবারস্ট্যাম্পের ছাপ মেরে দিয়েছি।
কর্নেল বললেন, আপনার রিসিট ওঁর প্যান্টের বাঁ পকেটে রুমালের তলায় ছিল। ওটা আমার কাছে আপাতত থাক।
বটুক মিত্তির কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। বললেন না। দরজা খোলার শব্দ হচ্ছিল। দরজা খুলে প্রথমে ম্যানেজার, তারপর দুজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন। একজন অফিসার কর্নেলকে দেখেই একটু হেসে বললেন, দেন ইট ইজ আ বিগ গেম। কর্নেলসায়েব মরা ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছিলেন শুনলুম। আমাকে একটু হিন্ট দিয়ে এলেও পারতেন।
কর্নেল উঠে গেলেন তার সঙ্গে। তাপস! তোমাকে হিন্ট দেবার আগে সিওর হবার দরকার ছিল।
পার্ক স্ট্রিট থানার ওসি তাপস ব্যানার্জি আমারও পরিচিত। আমি পর্দা সরিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলুম। ওসি মৃতদেহ দেখেই বললেন, হ্যাঁ। মদ খাইয়ে আদর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই খুনী তার কাজ করেছে। সম্ভবত তার ফায়ার আর্মসে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। মৃগেনবাবু! আপনি বাইরে করিডরে যান। কনস্টেবলদের বলুন, ভিড় জমতে যেন না দেয়।
মৃগেনবাবু বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল ওসিকে টেবিলে রাখা স্যুটকেস এবং ব্রিফকেসের কাছে নিয়ে গেলেন। দুজনে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলার পর মৃতদেহের কাছে এলেন। কর্নেল বললেন, সব কিছু আজ ইট ওয়াজ আছে। আমি নাক গলাইনি। কারণ ডেডবডির যা পজিশন, বিছানা পরীক্ষা করতে হলে আগে ডেডবডি সরাতে হবে।
একটু পরে অ্যামবুল্যান্সের স্ট্রেচার নিয়ে কয়েকজন লোক এল। একজন ডাক্তার এবং একজন ফোটোগ্রাফার এলেন। ডাক্তার বডি পরীক্ষা করে বললেন, স্টোনডেড। আপাতদৃষ্টে একঘণ্টা থেকে দুঘণ্টার মধ্যে মার্ডার করা হয়েছে।
ফোটোগ্রাফার বিভিন্ন দিক থেকে মৃতদেহের ছবি তুললেন। তারপর বডি স্ট্রেচারে তুলে অ্যামবুল্যান্সের লোকেরা বেরিয়ে গেলে ওসি প্রথমে বালিশ তুলে দেখে বললেন, ফায়ার আর্মস! মার্ডার উইপন হওয়া সম্ভব। মিঃ দেববর্মনের ফায়ার আর্মর্স হতেও পারে। নিশ্চয় লাইসেন্স আছে।
বললুম, কর্নেল! আমি আর বটুকবাবু লাউঞ্জে গিয়ে বসছি।
কর্নেল ওসিকে বটুক মিত্তিরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওসি বললেন, পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে। নিচে গিয়ে অপেক্ষা করুন।
লাউঞ্জে এখন অন্য চিত্র। অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কথা বলছেন। লাউঞ্জের একখানে খালি আসন পেয়ে আমরা দুজনে বসলুম। হোটেলের দরজায় পুলিশ। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে পুলিশভ্যান এবং আরও কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবলকে দেখতে পেলুম। অ্যামবুল্যান্সটা সদ্য বেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝলুম, পাঁচতারা বড় হোটেল এবং আন্তর্জাতিক হোটেল বলেই এত পুলিশের আড়ম্বর। লালবাজার হেডকোয়ার্টারের একটা জিপ এসে ঢুকল। তারপর একদঙ্গল অফিসার হন্তদন্ত লাউঞ্জে ঢুকে লিফটের কাছে চলে গেলেন।
বটুকবাবু বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। তা লক্ষ্য করে বললুম, চিন্তা করবেন না। এখনও ছটা বাজেনি। কর্নেল এলেই আপনি চলে যাবেন। গাড়ি নিয়ে এসেছেন যখন, তখন শর্টকাটে বাড়ি পৌঁছুতে আধঘণ্টার বেশি লাগবে না।
বটুকবাবু আমার কানের কাছে মুখ এনে চাপাস্বরে বললেন, বর্মনসায়েবকে খুনের একটা মোটিভ মাথায় আসছে। এই মোটিভের দুটো পয়েন্ট আছে। প্রথমটা হলো, সেনসায়েবের সঙ্গে কোনো সিনেমা অ্যাকট্রেসের অবৈধ প্রণয়। ধরুন, এমন হতে পারে, সেনসায়েব টের পেয়েছিলেন বর্মনসায়েব তার বোনের স্বার্থে সেই মেয়েটির ওপর হামলা করবেন। তাই সেনসায়েব কিডন্যান্ড হওয়ার আগেই বর্মনসায়েবকে ভাড়াটে খুনী দিয়ে খতম করার প্ল্যান করে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় পয়েন্ট হলো, ইস্টার্ন রিজিয়নে ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির মালের প্রচুর ডিম্যান্ড। অথচ বর্মনসায়েবের দাপটে সেনসায়েব ওদিকে সরাসরি কোনও ডিসট্রিবিউশন এজেন্সি খুলতে পারছেন না। এটা কিন্তু ওপেন সিক্রেট। বুঝলেন?
বললুম, তা হলে সেনসায়েবই ভাড়াটে খুনী দিয়ে বর্মনসায়েব কলকাতা এলেই খুন করার প্ল্যান করে রেখেছিলেন।
কিন্তু এ সব কথা পুলিশকে কি বলা উচিত হবে?
না। অকারণ এতে নিজেকে জড়াবেন না। বরং সময়মতো কর্নেলকে বলবেন।
আর একটা কথা। ভিজিটরস বুকে পি রায়ের নামধাম দেখলুম। হাতের লেখাটা কেন যেন চেনা মনে হলো।
কর্নেলকে বললে ওই পাতার একটা জেরক্স কপি যোগাড় করে দেবেন। পুলিশ আপত্তি করবে না।..
মিনিট কুড়ি পরে কর্নেলকে দেখতে পেলুম। তার সঙ্গে একদঙ্গল পুলিশ অফিসার। লালবাজারের ওসি–হোমিসাইড নবারুণ রুদ্র আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, বাঘের পেছনে যথারীতি ফেউ। সাবধান জয়ন্তবাবু। লালবাজার হেডকোয়ার্টারে ফিরে রাত আটটা নাগাদ সাংবাদিকদের ব্রিফিং করব। তার আগে প্লিজ স্পিকটি নট হয়ে থাকবেন যেন।
বললুম, আজ রবিবার আমার অফ-ডে মিঃ রুদ্র।
কর্নেলের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিট থানার ওসি তাপস ব্যানার্জি এসে বটুকবাবুকে ডেকে একান্তে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কর্নেল ও বটুকবাবু ফিরে এলেন। কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত! আমরা কেটে পড়ি। বটুকবাবুরও কাজ আছে। পুলিশের কাজ পুলিশ করুক।
বললুম, বটুকবাবুর চোখে ভিজিটরস বুকে লেখা—
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বটুকবাবু বলেছেন ওসি-কে। ওই পাতার একটা জেরক্স কপি আমার কাছে পুলিশ পাঠাবে। বলে বটুকবাবুর কাঁধে হাত রেখে আস্তে বললেন, সাবধান! মিসেস সেনকে এই ঘটনা যেন জানাবেন না।
পার্কিং জোনে গিয়ে বটুকবাবু নিজের গাড়িতে চেপে পালিয়ে যাওয়ার মতো উধাও হলেন। গাড়িতে যেতে যেতে বললুম, পি রায় যে খুনী এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।
কর্নেল হাসলেন। শুনলে অবাক হবে, বারের ওয়েটার স্যামুয়েল দেখেছিল, বর্মনসায়েবের গেস্ট নেমে লাউঞ্জে এসেছিল। লাউঞ্জে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। সে চলে যাবার সময় সেই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে যায়।
পুলিশ পি রায়ের দেওয়া ঠিকানায় খোঁজ নেবে নিশ্চয়?
নেবে। তবে আমার ধারণা, ঠিকানাটা ভুয়ো।
এবার আমি বটুকবাবুর সেই কথাগুলো বললুম। কর্নেল মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বললেন, বটুকবাবুর পাটিগণিতের অঙ্কটা ঠিকই আছে। তবে তোমাকে বহুবার বলেছি, ন্যায়শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্ব বলে একটা টার্ম আছে। হোয়াট অ্যাপিয়ারস, ইজ নট রিয়্যাল। কাজেই ঝটপট সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়।…
ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কফি খেতে খেতে কর্নেল আপন মনে হেসে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার?
পুলিশকে ধাঁধায় ফেলেছেন আমাদের হালদারমশাই। ভিজিটরস বুকে তার নামধাম লেখা আছে। তার খোঁজে পুলিশ এতক্ষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সত্যিই তো! হিতেশ্বর দেববর্মন কেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করেছিলেন? পুলিশের দৃঢ় বিশ্বাস, হালদারমশাই এই কেসে খুনের মোটিভসংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।
এতক্ষণ হালদারমশাই সম্ভবত নিউ আলিপুরের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন।
কর্নেল চুপচাপ কফি খাওয়ার পর চুরুট ধরালেন। তারপর বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা দুমড়ে যাওয়া সেই কাগজটা বের করলেন, যেটা মৃত বর্মনসায়েবের প্যান্টের পকেট থেকে তিনি হাতিয়েছিলেন। ফিকে হলুদ রঙের কাগজটা খুলে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে তিনি পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। যথারীতি আতসকাঁচের সাহায্য নিলেন। তারপর উল্টোদিকটা টেনে সমান করে কী দেখতে থাকলেন।
বললুম, ওটা তো বটুকবাবুর দেওয়া মানিরিসিট।
হ্যাঁ। কিন্তু উল্টোপিঠে একটা ফোন নাম্বার লেখা আছে দেখছি। বলে তিনি টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।
একটু পরে সাড়া পেয়ে বললেন, হ্যালো! আপনি কে বলছেন?… কাকে চাই? বলছি। আগে শুনুন, আগরতলার মিঃ হিতেশ্বর দেববর্মন এই নাম্বারটা আমাকে দিয়েছেন। …আচ্ছা, ধরছি।… নমস্কার ম্যাডাম। আগরতলা থেকে মিঃ হিতেশ্বর দেববর্মন এসেছিলেন। হোটেল কন্টিনেন্টালে ৬০২ নাম্বার সুইটে ছিলেন উনি। এইমাত্র খবর পেলুম, উনি খুন হয়ে গেছেন। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো! রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন, কথাটা শোনামাত্র ভদ্রমহিলা টেলিফোন সশব্দে রেখে দিলেন।
জিজ্ঞেস করলুম, মহিলাটি কে?
কর্নেল হাসলেন। তা কেমন করে জানব?
বলে তিনি আবার রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, জয়শ্রী স্টুডিয়ো? …ম্যানেজার গোপালবাবু আছেন নাকি? …প্লিজ তাকে একটু ডেকে দিন। বলুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কথা বললেন।
বললুম, মহিলাটি সেনসায়েবের প্রেমিকা সেই অভিনেত্রী। তাই না?
কর্নেল বললেন, জানি না। …হ্যালো! গোপালবাবু? …না, না। তেমন কিছু না। আপনার সাহায্য চাই একটা ব্যাপারে। আগে এই ফোন নাম্বারটা লিখে নিন। কর্নেল নাম্বারটা দুবার আওড়ে বললেন, আমি জানতে চাই, এই। নাম্বারটা কোনও ফিল্মস্টারের কি না। …হ্যাঁ। প্রাইভেট নাম্বার হওয়াই সম্ভব। …ঠিক আছে। আপনি খুঁজে পেলে রিং ব্যাক করবেন। রাখছি।
বললুম, এক্সচেঞ্জ নাম্বারটা কোন এরিয়ার?
নিউ আলিপুর।
চমকে উঠে বললুম, তা হলে নাম্বারটা অবশ্যই মুন্দ্রাভবনের।
দেখা যাক। বলে কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন।
আচ্ছা কর্নেল?
হুঁ।
বর্মনসায়েবের প্যান্টের পকেটে নাম্বারটা লেখা থাকবে, তা কি আপনি জানতেন?
উহুঁ।
তা হলে প্যান্টের পকেটে খুঁজতে গেলেন কি নিছক খেয়ালে?
হুঁ।
ওই কাগজটা বের করা মাত্র নিশ্চয় ফোন নাম্বারটা চোখে পড়েছিল?
হুঁ।
পুলিশ নিশ্চয় প্যান্টের অন্য পকেট সার্চ করেছে?
হুঁ।
সন্দেহজনক কিছু পেয়েছে?
উঁহু।
বিরক্ত হয়ে বললুম, খালি হুঁ আর উঁহু! এত ভাববার কী আছে? সেনসায়েব আর সেই ফিল্ম অ্যাকট্রেস চক্রান্ত করে রেখেছিলেন, বর্মনসায়েব এলেই তাকে খতম করা হবে। এতে আপনার অবভাসতত্ত্ব-উত্ত্ব কিছু নেই।
টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল যেন ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গিতে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। হ্যালো! …বলুন গোপালবাবু! …কুন্তলা চৌধুরি? সিওর? …ঠিকানা? এক মিনিট। লিখে নিচ্ছি। …কর্নেল একটা কাগজে ঠিকানা লিখে নিয়ে বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ গোপালবাবু! …না। প্লিজ চেপে থাকুন। সময়মতো জানাব। …হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলুন। …অনিন্দ্য বসুরায়। নতুন প্রোডিউসার– _ নাকি? …মাই গুডনেস! কথাটা আগে বলবেন তো। …আবার ধন্যবাদ। রাখছি।
রিসিভার রেখে কর্নেল আবার হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন করলে আবার হু-উঁহুর পাল্লায় পড়ব ভেবে চুপ করে থাকলুম।
ষষ্ঠীচরণ কাপপ্লেট নিতে এসেছিল। তাকে বললুম, ষষ্ঠী! অনেকদিন সিগারেট খাইনি। আজ একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে! তুমি অন্তত দুটো ফিল্টা উইলস এনে দাও। এখন দাম কত জানি না। তুমি পাঁচ টাকার নোটটা নিয়ে যাও।
ষষ্ঠীচরণ উধাও হয়ে গেল। কর্নেলের এই তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজাতে ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। তাই ষষ্ঠী বেরুলে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে যায়।
মিনিট পাঁচের মধ্যে ষষ্ঠী সিগারেট এনে দিল। খুচরো ফেরত নিলুম না। সে ধ্যানমগ্ন কর্নেলের পাশের টেবিল থেকে লাইটারটা আমাকে দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল।
সিগারেট ধরিয়ে সোফার কোনায় হেলান দিলুম। এতক্ষণে কর্নেল নড়ে বসলেন। চোখ খুলে বললেন, সিগারেট খাচ্ছ? বাঃ! ভালো। মার্কিন কালচারের এই ধূমপানবিরোধী ব্যাপারটা আসলে একটা লাইফস্টাইল। পোস্টমডার্নিস্ট স্টাইল বলা চলে। আমি এখনও পিছিয়ে থাকতে চাই।
বলে তিনি আমার কাছ থেকে লাইটার ফেরত নিয়ে নিভে যাওয়া চুরুটটি ধরালেন। বললেন, অবশ্য তুমি উত্তেজনার উপশম ঘটাতে সিগারেটের দ্বারস্থ হয়েছ। উত্তেজনা নার্ভকে বিগড়ে দেয়।
বললুম, বিগড়ে দিয়েছে বৈকি। আপনার ধ্যানস্থ অবস্থায় হু-উঁহু শব্দ যে অন্যের কাছে কী বিরক্তিকর, তা যদি আপনি জানতেন।
কর্নেল হাসলেন। আমি তোমার প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছি।
ঠিক আছে। জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবু কুন্তলা চৌধুরির নাম বললেন। উনিই বর্মনসায়েব কথিত সেই অভিনেত্রী? এবং তার প্রযোজক জনৈক অনিন্দ্য বসুরায়। হুঁ দিয়ে যেতে পারেন।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, কুন্তলা চৌধুরির বাড়ি নিউ আলিপুরে হলেও মুন্দ্রাভবন নয়। আর তার স্বামীর নাম অনিন্দ্য বসুরায়। নববিবাহিত দম্পতি। কুন্তলা প্রেম করে বিয়ে করেছে। কুন্তলার বাড়িতে অনিন্দ্য বসুরায় এখন বাস করছে।
তা হলে কুন্তলা কি সেনসায়েবের মিস্ট্রেস নয়?
এখনও জানি না। বলে কর্নেল আবার টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল ১ করলেন। সাড়া পেয়ে খুব ভরাট গলায় বললেন, আমি ফিল্ম অ্যাকট্রেস কুন্তলা। চৌধুরির সঙ্গে কথা বলতে চাই। …আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বাই এনি চান্স, আপনি কি মিঃ অনিন্দ্য বসুরায় বলছেন? …নমস্কার। আপনার মিসেস বেরিয়ে গেছেন? কখন ফিরবেন তা কি বলে গেছেন?… ঠিক আছে। আত্মীয়স্বজনের অসুখ-বিসুখের সময় …হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাইরের লোককে এড়িয়ে থাকতে চায়। জয়ন্ত! প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। চলো! বেরিয়ে পড়া যাক।
কোথায় যাবেন?
হালদারমশাইয়ের অবস্থা দেখে মুন্দ্রাভবনের সামনে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরব। তারপর কোথায় যাব, প্রশ্ন কোরো না। কারণ আমিও জানি না কী ঘটতে পারে।
ইশ! আগে জানলে আমার ফায়ার আর্মস সঙ্গে নিয়ে আসতুম।
দরকার হবে না। আমরা কোথাও যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না।
কর্নেল! যদি হঠাৎ কেউ হামলা করে?
কর্নেল হাসলেন। আমার রিভলবারের টিপ অব্যর্থ বলে বিশ্বাস আছে। কম বয়সে মিলিটারিতে ঢুকেছিলুম। ওই বয়সে যা শেখা হয়ে যায়, তা আজীবন অবচেতনায় থেকে যায়। অবশ্য নিয়মিত অভ্যাস রাখাও দরকার। অভ্যাস বজায় রাখতে আমি ছাদের বাগানে টয় পিস্তলে পটকা পুরে কাক তাড়াই।
বলে কর্নেল ভেতরের ঘরে গেলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পোশাক বদলে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু এ কী চেহারা! দিনে ছদ্মবেশ ধরার কথা বলছিলেন। এখন দেখি, একেবারে সর্দারজি হয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে কাকন। চেন-আঁটা জ্যাকেটের ওপর দিয়ে বেল্টবাঁধা কৃপাণ ঝুলছে কোমরের কাছে। চোখে নিকেল ফ্রেমের চশমা। সম্ভবত পাঞ্জাবি ভাষায় আমাকে কিছু বললেন। কথাগুলো না বুঝলেও উচ্চারণের কেঁক এবং সুর শিখ সর্দারজিদের মুখে কতবার শুনেছি।
কর্নেলের নির্দেশ অনুসারে গাড়ি চালাচ্ছিলুম। শীতের রাতে কলকাতা কেমন যেন নিঝুম হয়ে যায়। নিউ আলিপুর থেকে বাঁক নিতে নিতে হর্টিকালচার সোসাইটির কাছে পৌঁছে দেখলুম, আগুনের কুণ্ড জ্বেলে ভবঘুরে পাগল সেজে বসে আছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার। তিনটে বাচ্চা তার সামনে বসে পাঁউরুটির টুকরো চিবুচ্ছে। সম্ভবত শিখ সর্দারজিকে দেখেই উনি আমার গাড়ির দিকে মনোনিবেশ করলেন না। কর্নেল আস্তে বললেন, এই হলো মুন্দ্রাভবন। বাড়িতে আলো নেই।
বাড়িটার পরই একটা সংকীর্ণ গলি দেখতে পেলুম। তারপর একটা বাড়ির গেট। বড় বাড়ি। সেনসায়েবের বাড়ির মতো বিশাল জায়গা জুড়ে ফুলবাগান, গাছপালা, সুন্দর লন। কর্নেল বললেন, কুন্তলা চৌধুরির বাড়ি। সামনের মোড়ে গাড়ি ঘোরাও।
তাঁর নির্দেশে গাড়ি ঘুরিয়ে একই পথে আসছিলুম! মুন্দ্রাভবনের কাছে এসে দেখলুম, একটা কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি গেটের কাছে থামল। তারপর দুটো লোক বাড়িতে ঢুকল। গাড়িটাও আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এবার কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি হালদারমশাইয়ের কাছাকাছি নিয়ে গেলুম। হালদারমশাই পাগলামি শুরু করার আগেই কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! এখানে থাকার দরকার নেই। গাড়িটা একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড় করাচ্ছি। চলে আসুন।
একটা গাছের তলায় গাড়ি থামাতেই গোয়েন্দাপ্রবর এসে গেলেন। বললেন, কী কাণ্ড!…
.
০৫.
হালদারমশাই গাড়ির ব্যাকসিটে উঠে বসলেন। কর্নেল বললেন, কুইক জয়ন্ত! কালো অ্যাম্বাসাডারটাকে ধরতে হবে। নাম্বার আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
রাস্তায় গাড়ির ভিড় কম। যথাসাধ্য দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলুম। হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার শিখ সর্দারজি সাজছেন ক্যান এটু বুঝাইয়া কন!
কর্নেল বললেন, বাড়ি ফিরে বলব। আপনি বলুন, মুন্দ্রাভবনে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করেছেন কি না?
কিছুক্ষণ আগে দোতলার একটা ঘরে আলো দেখছিলাম। জানালা বন্ধ। তবু আলো জ্বাললে বোঝা যায়। মিনিট পনেরো বাদে আলো নিভে গেল। তারপর আপনাদের গাড়ি দেখছিলাম। কিন্তু সর্দারজি বইয়া আছেন। তাই গাড়ির নাম্বার দেখি নাই। বলে খিক খিক করে হাসলেন হালদারমশাই!
কর্নেল বললেন, আলো জ্বলে ওঠা ছাড়া আর বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি?
কয়জন পোলাপান আমার কাছে ছিল। দ্যাখছেন তো? হ্যাঁ।
অগো কইছিলাম, মুন্দ্রাভবনের ভেতরে ঢুকতে পারলে পাউরুটি পাবি। শুধু ঢুকলে হইব না, কেউ আছে বা কী করতাছে, আমারে কবি। গেট খোলা আছে। একজন গিয়া ঢুকছিল। আইয়া কইল, বাড়িতে জঙ্গল। কেউ নাই। একটু পরে আরেক পোলা আইল। তারে পাউরুটি দিয়া জিগাইলাম, ওই বাড়িতে কে থাকে জানিস? সে কইল, ওটা গুদামঘর। সে দ্যাখছে, ওখানে ট্রাকে মাল বোঝাই হয়।
বললুম, আমারও ধারণা বাড়িটা গোডাউন।
মোড়ে ট্রাফিকজ্যাম! কর্নেল বললেন, ওই সেই কালো অ্যাম্বাসাডার। জয়ন্ত, তোমার গাড়িটা যেভাবে পারো, ওই গাড়িটার কাছে নিয়ে যাও।
আমার গাড়ির সামনে দুটো রিকশা আর একটা খালি ঠেলাগাড়ি ছিল। কর্নেল নেমে গিয়ে পাঞ্জাবি-বাংলা মেশানো কথায় তাদের একটু সাইড দিতে বললেন। ঠেলাওয়ালা ঠেলা পিছিয়ে আনল। রিকশা দুটো একটু ডানদিকে সরে গেল। এবার কালো অ্যাম্বাসাডারের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেলুম। লক্ষ্য করলুম, পেছনের দিকের জানালা ওঠানো আছে। সেটা স্বাভাবিক। প্রচণ্ড শীতে সব গাড়ির জানাল ওঠানো।
ট্রাফিক সিগন্যাল পেয়ে কালো গাড়িকে অনুসরণ করলুম। গাড়িটা ট্রামলাইন ধরে উত্তরে এগিয়ে রেলব্রিজ পেরিয়ে ভাইনে লেকের দিকে ঘুরল। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়াম পেরিয়ে আবার গাড়িটা ডাইনে ঘুরে লেকব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকে নিচু রাস্তায় এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, গাড়িটা একটা গেটের ভেতর ঢুকে গেল। কর্নেল বললেন, গুড ইভনিং ক্লাবের কোনও মেম্বারের গাড়ি।
গেটের কাছে গিয়ে দেখলুম, আলোকিত সাইনবোর্ডে গুড ইভনিং ক্লাব শব্দগুলো নানা রঙে জ্বলে উঠছে পালাক্রমে।
কর্নেল বললেন, ব্যাক করে গাড়ি ঘোরাও। এই যথেষ্ট। আমরা বাড়ি ফিরব।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন, কাইল রাত্তিরে এইখানে স্যানসায়েবের জন্য ওয়েট করছিলাম।…
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে রাত নটা বেজে গেল। হালদারমশাই ইতিমধ্যে গাড়ির ভেতর বসে পোশাক বদলেছেন। কিন্তু হাত-মুখ-চুলের অবস্থা নোংরা। বাথরুমে তিনি চেহারা বদলাতে ঢুকলেন। কর্নেল ভেতরে গিয়ে শিখ সর্দারজির ছদ্মবেশ ছেড়ে এলেন। ষষ্ঠীচরণ হাসি চেপে তখনই কফি দিয়ে গেল।
বাথরুম থেকে হালদারমশাই তার কালো কিটব্যাগ নিয়ে স্বাভাবিক চেহারায় বেরিয়ে এলেন। আমি তাকে তার ক্লায়েন্ট খুন হওয়ার খবর দিতে উসখুস করছিলুম। কর্নেল তা টের পেয়ে বললেন, এখন কোনও কথা নয়। কফি। শীতের রাতে কফির চেয়ে আরামদায়ক আর কিছু নেই। হালদারমশাই। কফি খান। তারপর কথা হবে।
কফি খাওয়ার সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, বলুন মিসেস মিত্র!… না, না। আপনার উদ্বেগের কিছু নেই। মিঃ মিত্র… হ্যাঁ। ওঁকে আপনি সুপরামর্শই দিয়েছেন। ঘুরপথে যাওয়াই ভালো।…হ্যাঁ। মিঃ মিত্র ঠিকই বলেছেন। আমারও তাই ধারণা … ঠিক আছে। মিঃ মিত্র ফিরে এসে যেন আমাকে রিং করেন।… না, না। কোনও বিপদ হবে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিন। রাখছি।
কফি খাওয়ার পর ঘড়ি দেখে নিয়ে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন, ওসি মিঃ ব্যানার্জি আছেন?… আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। …হ্যালো! ..তাপস! ভূপেন বোস অ্যাভেনিউয়ের পি রায় সম্পর্কে জানতে চাই। …তাহলে আমার অনুমান ঠিক ছিল। ভুয়ো ঠিকানা। যাক গে। আমি তোমাকে একটা নাম দিয়েছিলুম। তার ব্যাকগ্রাউন্ড কিছু জানা গেছে?… মাই গুডনেস! হোজাই? সে তো অসম-মণিপুর সীমান্তে! …বুঝেছি। শক্তিমান গার্জেন ধরেছিল। দেখ তাপস, আমার মনে হচ্ছে ইস্টার্ন রিজিয়নে সে সেনসায়েবকে পা রাখার জায়গা দেবার লোভ দেখিয়েছিল। .হ্যাঁ, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুল। ঠিক! ঠিকই বলেছি। …না। তাড়াহুড়োর কারণ নেই। হোটেল কন্টিনেন্টালের রিসেপশনিস্ট, চান্দ্রেয়ী আর বারের ওয়েটার স্যামুয়েল ওকে নিশ্চয় আইডেন্টিফাই করতে পারবে। আজ রাত্রিটা কোনও অ্যাকশন নয়। …বেশ তো! ওয়াচডগ পাঠিয়েছ। তুমি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছ। রাখছি। উইশ য়ু গুড লাক।…
রিসিভার রেখে কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। বললেন, কর্নেলস্যার! কিছু বুঝতে পারছি না।
কর্নেল একটু পরে চোখ খুলে বললেন, হালদারমশাই! শুনে দুঃখ পাবেন, আপনার ক্লায়েন্ট হিতেশ্বর দেববর্মন নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য হোটেল কন্টিনেন্টালে খুন হয়েছেন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ সোজা হয়ে বসে বললেন, খুন? মার্ডার? বর্মনসায়েব? ও মাই গড! কখন?
বেলা দুটো দশ মিনিট থেকে তিনটে বা সওয়া তিনটের মধ্যে। দেববর্মন সম্ভবত নিজেই তার খুনীকে ডেকে হুইস্কি খাইয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। খুনী হুইস্কিতে তার অজ্ঞাতসারে কোনও ড্রাগ মিশিয়ে দিয়েছিল। তার ফলে দেববর্মন সম্ভবত অসুস্থ বোধ করেন। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়েন। খুনী তাঁকে। সম্ভবত বিছানায় ওই অবস্থায় শুতে সাহায্য করেছিল। তারপর সে দেববর্মনের। বাঁ কানের পাশে সাইলেন্সর লাগানো রিভলভার দিয়ে গুলি করে মেরে চলে। যায়। একটা গুলিই যথেষ্ট ছিল।
হালদারমশাই দুহাত মুখের দুপাশে রেখে মুখ নিচু করে বসে রইলেন। কোনও কথা বললেন না।
ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, এ ব্যাপারে আপনার তো কোনও দায়িত্ব ছিল না হালদারমশাই! মিঃ দেববর্মন আপনার ফি মিটিয়ে দিয়ে আপনাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
কর্নেল বললেন, আপনি দেববর্মনকে বাঁচাতে পারতেন না। কারণ–ওই যে বললুম, তিনি নিজেই খুনীকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। খুনীর সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক বা বোঝাপড়া ছিল বিশেষ একটা ব্যাপারে।
হালদারমশাই বললেন, কী ব্যাপারে আপনি তা জানতে পেরেছেন?
হ্যাঁ। আকাশকুসুম তেলের ব্যাপারে।
মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না কর্নেলস্যার!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আশা করি, কালকের মধ্যে সব বুঝতে পারবেন। এ মুহূর্তে আমার কাছেও ব্যাপারটা তত স্পষ্ট নয়। নিছক অনুমান। যাইহোক, আপনি বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। আগামীকাল সকাল নটার মধ্যে অবশ্যই আসবেন। আপনার এই কেসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ দেববর্মনসায়েবের কথায় আপনি গুড ইভনিং ক্লাব থেকে সেনসায়েবকে ফলো করেছিলেন। জুয়েল ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মুন্নাকে পুলিশ জেরা করে ছেড়ে দিয়েছে। মুন্না আপনার কথা বলেছে। তা ছাড়া হোটেল কন্টিনেন্টালে ভিজিটরস বুকে আপনার সই আছে। বুঝলেন তো?
হঃ। বলে বিষণ্ণ মুখে উঠে দাঁড়ালেন হালদারমশাই। তারপর যথারীতি যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
বললুম, একটা কথা বুঝতে পারছি না কর্নেল!
কী কথা?
কথা মানে–আপনার হঠাৎ মুদ্রাভবন এলাকায় শিখ সর্দারজি সেজে ঘুরে আসা এবং হালদারমশাইকে হঠাৎ তুলে আনা।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল হালদারমশাই ওখানে অক্ষত শরীরে আছেন কি না তা দেখতে যাওয়া। জয়ন্ত! দেববর্মন খুনীকে যেভাবে আপ্যায়ন করেছিলেন, তাতে বোঝা যায়, খুনী তার অন্তরঙ্গ লোক। মদের নেশায় মানুষ মন খুলে কথাবার্তা বলতে ভালবাসে। দৈবাৎ যদি তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের সাহায্য নেওয়ার কথা খুনীকে বলে থাকেন, খুনী তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে এবং যেহেতু হালদারমশাই মুন্দ্রাভবনে সেনসায়েবকে ঢুকতে দেখেছেন এবং বেরুতে দেখেননি, সেই কারণে খুনীর অস্বস্তি বেড়ে যাবে।
কেন অস্বস্তি হবে?
এটা আমার অঙ্ক। সেনসায়েব কিডন্যাপড হওয়ার পিছনে খুনীও জড়িত। তাই খুনী হালদারমশাইয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। দেববর্মনকে হালদারমশাই রীতি অনুসারে তার নেমকার্ড দিয়েছিলেন, এটা নিশ্চিত। হোটেলে তন্নতন্ন সার্চ করে হালদারমশাইয়ের কোনও কার্ড পাইনি। কাজেই ধরে নিয়েছিলুম, খুনীকে দেববর্মন সেই কার্ড দিয়েছিলেন কিংবা খুনী সেটা হাতিয়েছিল। যাইহোক, হালদারমশাইকে ওখানে পাঠিয়ে তাই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলুম না। একে তো উনি হঠকারী আর খেয়ালি মানুষ। তার ওপর মুন্দ্রাভবনের কাছাকাছি হঠাৎ এক ভবঘুরে পাগলের আবির্ভাব। খুনীর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু দেখা গেল হালদারমশাই অক্ষত ছিলেন এবং কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি।
হ্যাঁ। যে-কোনও কারণেই হোক, খুনী তাকে আবিষ্কার করতে যায়নি। কিন্তু ঝুঁকিটা ছিল। তাই আমি তাকে আগে-ভাগে সরিয়ে আনা ঠিক মনে করেছিলুম। আর মুদ্রাভবন এলাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মুন্দ্রাভবন এবং কুন্তলা চৌধুরির বাড়ির অবস্থান দেখে আসা। সর্দারজি সেজে না গেলে আমার একটু ঝুঁকি ছিল। প্রতিপক্ষ আমাকে দেখেছে। সেই সবুজ মারুতির কথা ভুলে গেছ তুমি। গাড়িটা আমাদের অনুসরণ করে এসেছিল। অবশ্য প্রেসমার্কা তোমার গাড়ি সে লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু মুন্দ্রাভবন এলাকায় আলোছায়ার মধ্যে প্রেস স্টিকার চোখে না পড়ারই কথা। ওই রাস্তার দুধারে গাছের সার। কাজেই মুন্দ্রাভবন পেরিয়ে কুন্তলা চৌধুরির বাড়ি যাতায়াতে অনায়াসে ঝুঁকি নেওয়া যায়। হা–খোলামেলা রাস্তা হলে শুধু হালদারমশাইকে তুলে নিয়েই চলে আসতুম।
কর্নেল ঘড়ি দেখে চোখ বুজে হেলান দিলেন। বললুম, কর্নেল! হালদারমশাইকে রাস্তার ছেলেরা বলেছে, মুন্দ্রাভবন একটা গোডাউন।
হ্যাঁ। কথাটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাড়িটা কোন কোম্পানির গোডাউন এটা জানা উচিত।
কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ।…
ষষ্ঠীচরণ আরেক দফা কফি দিয়ে গেল, তখন রাত দশটা বাজে। বটুকবাবুর কথা ভেবে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। শেষ পর্যন্ত সেনসায়েব মুক্তি পেলেন কি না জানার জন্য মন অস্থির।
কফি খাওয়ার পর চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন, তোমার মুখে অস্থিরতার ছাপ পড়েছে জয়ন্ত! আমার মনও অবশ্য অস্থির। মিসেস সুলতা মিত্রকে রিং করে দেখি।
কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া এলে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… না? আমাকে চিনতে পারছ তো? তোমার গিন্নিমা কোথায়? তাকে ডাকো। হা–একটা কথা। তোমার বোন ছন্দার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?… ঠিক আছে। গিন্নিমাকে ডেকে দাও। কর্নেল রিসিভারের মাউথপিসে হাত চেপে বললেন, বিকেলে না আবার গিয়েছিল। ছন্দার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারপর মাউথপিস থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে কর্নেল বললেন, মিসেস মিত্র! আপনার কর্তামশাই… বেরিয়ে গেছেন? ..হ্যাঁ, আমিও উদ্বিগ্ন। তবে আমার ধারণা, কোনও ঝামেলা হবে না।… মিঃ মিত্রের মুখে হোটেল কন্টিনেন্টালের ঘটনা কি শুনেছেন?… হ্যাঁ। আমারও খারাপ লাগছে। আপনি মিসেস সেনকে ঘটনাটা জানাননি তো? ..বাঃ! আপনি বুদ্ধিমতী। পুলিশ আগামীকাল যাতে মিসেস সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমি তার ব্যবস্থা করব। অবশ্য আগরতলায় খবর পাঠিয়েছে পুলিশ। …হা! আমারও তাই ধারণা। মিসেস সেনের সঙ্গে তার বাপের বাড়ির লোকেদের যোগাযোগ বন্ধ। দেখুন, এবার কী হয়। যাইহোক, আপনার কর্তা ফিরলেই যেন আমাকে রিং করেন। ছাড়ছি।
কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, শীতের রাত্তির। গরম গরম খেয়ে নিলে হতো বাবামশাই। বেটাইম হয়ে গেল। ঘড়ি দেখুন।
কর্নেল বললেন, আজ একটু দেরি হবে যষ্ঠী।
দাদাবাবুর জন্যও রান্না করেছি।
বললুম, না যষ্ঠী! আমি বাড়ি ফিরব।
কর্নেল বললেন, তোমার বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে কেউ বসে নেই। যাবার সময় পার্কসার্কাস এরিয়ার হোটেল থেকেই তো রাতের খাবার নিয়ে যাবে। হা–মোগলাই খাদ্য মুখরোচক। কিন্তু নাটকের প্রথম অঙ্কের শেষ দৃশ্য মিস করলে পস্তাবে।..
রাত দশটা চল্লিশে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। বলছি। আপনার খবর বলুন মিত্তিরমশাই! …বাঃ! কিডন্যাপাররা কথা রেখেছে। …হা। চেহারায় কষ্টের ছাপ তো পড়বেই। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার বন্দিত্ব! …হ্যাঁ। সকালে মর্নিং ওয়াক সেরেই আসবেন। মুখে ডিটেলস শুনব। গুড নাইট।
বললুম, সেনসায়েবকে ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। এ কে। তার উত্তরে ও কে। মুন্দ্রাভবনের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার, তা তো দেখে এসেছ। একটা লোক ব্রিফকেস নিয়ে যাওয়ার দশ মিনিট পরে সেনসায়েব বেরিয়ে আসেন। ভীষণ বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। শরীর দুর্বল। ফেরার পথে কোনও ঝামেলা হয়নি। সেনসায়েবের জন্য গেটের কাছে মিসেস সেন আর সেনসায়েবের পি এ বরুণ রায় অপেক্ষা করছিলেন।
মাত্র একদিনেই এত সব নাটকীয় ঘটনার চাপে আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল। মাঝে মাঝে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে রাত কাটাতে হয়। তাই আমার একসেট পোশাক এখানে থাকে। খাওয়ার পর আমি কর্নেলের সঙ্গে ড্রয়িং রুমে না গিয়ে শুয়ে পড়েছিলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি।
ষষ্ঠীচরণ বেডটি হাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, আটটা বাজে দাদাবাবু? বললুম, তোমার বাবামশাই কি উঠেছেন?
কখন! সেই ভোরবেলায় উঠে হাঁটাহাঁটি করে এসে এখন ছাদের বাগানে গাছপালার সেবাযত্ন করছেন। বলে ষষ্ঠী চলে গেল।
চা খেয়ে বাথরুম সেরে বেরিয়ে এলুম। ষষ্ঠী কিচেন থেকে উঁকি দিয়ে বলল, দাদাবাবু! আপনার দাড়ি কামানোর জন্য বাবামশাই সেপটিরেজার, বেরাশ আর কী যেন এনে রেখেছেন। দেখতে পাননি?
আবার বাথরুমে ঢুকলুম। একেবারে বিলিতি ব্যবস্থা। নামী কোম্পানির ফোম পর্যন্ত চোখের সামনে সাজানো আছে। রবিবার দাড়ি কাটি না। তাই গোঁফদাড়ি বেশ জমে উঠেছে। গরম জলের ব্যবস্থাও আছে। তাই সানন্দে গোঁফদাড়ি কামিয়ে লোশন মেখে ফিটফাট হওয়া গেল। নাইটড্রেস ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ছাদে উঠতে যাচ্ছি, কর্নেলকে নামতে দেখলুম। পরনে গার্ডেনিংয়ের পোশাক। দুহাতে গ্লাভস। সহাস্যে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত! আমি নিশ্চিত, তোমার সুনিদ্রা হয়েছে।
বললুম, মর্নিং বস্! সুনিদ্রা কী বুঝি না। তবে গত রাতে স্বপ্ন দেখিনি।
কর্নেল হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকলেন। ষষ্ঠী আমাদের পাশ কাটিয়ে ছাদে চলে গেল। তারপর এক হাতে কয়েকটা ইংরেজি-বাংলা খবরের কাগজ, অন্য হাতে কফির জগ নিয়ে ফিরে এল। তার হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলুম।
আমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় সেকেন্ড লিড করেছে : হোটেল কন্টিনেন্টালে ব্যবসায়ী খুন। পুলিশসূত্রের খবর। ভাষার স্টাইল দেখে বুঝতে পারলুম, অশোক হাজরার লেখা। ওর সঙ্গে লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের যোগাযোগ আছে। ওর মামা পুলিশের এক বড়কর্তা। তাই পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি লেখায় স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। খুনী আগরতলার ব্যবসায়ী হিতেশ্বর দেববর্মনের পরিচিত। কোনও দামী চোরাই মাল বেচতে কলকাতা এসেছিলেন মিঃ দেববর্মন। তা ধনরত্ন বা কোনও প্রত্নদ্রব্যও হতে পারে। খুনীর সাহায্যে সম্ভবত তা বিক্রির পরিকল্পনা ছিল। খুনী তাকে মেরে তা হাতিয়ে নিয়েছে। ইত্যাদি।
প্রথম শ্রেণীর একটা ইংরেজি দৈনিকে ভেতরের পাতায় মেট্রোপলিটন শিরোনামে একটা লাইন দশেকের খবর বেরিয়েছে। অন্যান্য কাগজে চোখ বুলোনোর সময় কর্নেল এসে গেলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, বি কে সেনের সঙ্গে হিতেশ্বর দেববর্মনের সম্পর্কের কথা পুলিশ সাংবাদিকদের জানায়নি। সেনসায়েবের স্ত্রী স্বামীকে অক্ষত শরীরে ফিরে পেয়ে সম্ভবত খবরের কাগজের দিকে মন দিতে পারেননি। তবে তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক খুনের যে মোটিভ উল্লেখ করেছে, তাতে যুক্তি আছে।
বললুম, পুলিশের যুক্তি।
কর্নেল হাসলেন। তোমার যুক্তিটা অনুমান করতে পেরেছি, যেহেতু তুমি জানো দেববর্মনের ভগ্নীপতি সেনসায়েব কিডন্যাপড হয়েছিলেন এবং এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এদিকে বটুকবাবুর যুক্তিও তুমি শুনেছ। অতএব সেনসায়েব আগেই চক্রান্ত করে রেখেছিলেন। তাঁর ভাড়াটে খুনী জানত না তিনি হঠাৎ কিডন্যাপারদের পাল্লায় পড়েছিলেন। এবার সে বাকি টাকা চাইতে যাবে এবং পাবেও বটে। এই তো?
এগজ্যাক্টলি। আমার এবং বটুকবাবুর যুক্তি খুব মজবুত।
ষষ্ঠীচরণ কফি এবং স্ন্যাক্স রেখে গেল। স্ন্যাক্স চিবুতে চিবুতে কর্নেল বললেন, তা যদি হয়, তা হলে ইস্টার্ন রিজিয়নে কোথাও শিগগির সেনসায়েব ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সি খুলে ফেলবেন।
সিওর। বলেই আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। কর্নেল! বটুকবাবু কাল বলছিলেন, এক কোটি নগদ টাকা যেভাবে ব্রিফকেসে সাজানো ছিল, তা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল যেন স্বয়ং সেনসায়েবই কোনও উদ্দেশ্যে তৈরি রেখেছিলেন।
হ্যাঁ। বটুকবাবু কথাটা বলেছিলেন বটে।
উত্তেজনা চেপে বললুম, তা হলে এমন কি হতে পারে না যে, সেনসায়েব নিজেই প্ল্যান করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন এবং টাকাটা এইভাবে কৌশলে তার প্রেমিকা কুন্তলা চৌধুরিকে দিয়েছেন।
কর্নেল হাসলেন। সেনসায়েব নিজের টাকা সরাসরি কুন্তলাকে দিতে পারতেন। কিডন্যাপড় হওয়ার ছল করার তো দরকার ছিল না। তা ছাড়া তিনি কিডন্যাপড় হওয়ার পর টেলিফোনে মিসেস সেনকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশকে যেন জানানো না হয়। তা হলে ওরা তাকে মেরে ফেলবে।
আমি নিজের থিয়োরির পক্ষে যুক্তি খুঁজতে শুরু করলুম। একটু পরে বললুম, সেনসায়েব যখন ফোন করেছিলেন, তখন কিডন্যাপাররা তার দিকে অস্ত্র বাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজেই তাঁর ওই কথা না বলে উপায় ছিল না। আপনি এই কথাই তো বলছেন?
হ্যাঁ। ঠিক ধরেছ।
একটু ইতস্তত করে বললুম, তা হলেও মিসেস সেন যদি খুব গোপনে পুলিশকে জানাতেন, আমার মনে হয়, সত্যিকার ঘটনা জানা যেত। মিসেস যেন ভুল করেছেন। এদিকে বটুকবাবু আপনাকে যখন ঘটনাটা জানালেন, তখন আপনি কেন চুপচাপ থাকলেন বুঝতে পারছি না। আপনি একাই একশো।
না জয়ন্ত! তুমি দেখেছ আমাকে শেষাবধি পুলিশেরই সাহায্য নিতে হয়। আমি তো অরণ্যদেব নই।
কর্নেল আবার হেসে উঠলেন। বললুম, বেশ তো! আপনি গোপন পুলিশ নিয়ে ওত পেতে থাকতেন এবং সময়মতো হানা দিতেন। হাতেনাতে ধরা পড়ত কিডন্যাপাররা।
কর্নেল বললেন, তুমি সাংবাদিক হয়েও আজকালকার কিডন্যাপারদের কলাকৌশলের খবর রাখে না। কিডন্যাপাররা মাফিয়া গ্যাং। তারা যেখানে টাকা নেবে, সেখানে রাস্তার ছেলে স্ট্রিট আৰ্চিন বা মুখগবেট কোন ভবঘুরের সাহায্য নেয়! টাকার ব্যাগ বা ব্রিফকেস তাদের মারফত হাতানোর ব্যবস্থা করে আড়ালে ওত পেতে থাকে। মুক্তিপণের টাকা দেওয়ার পর পুলিশ যদি সেই ভবঘুরে বা রাস্তার ছেলেটাকে পাকড়াও করে, তা দেখামাত্র মাফিয়ারা উধাও হয়ে যায়। তাই শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীরা অপহৃত হলে প্রাণে বাঁচার জন্য পুলিশের সাহায্য নেন না। মুক্তিপণ মিটিয়ে অক্ষত শরীরে বাড়ি ফিরতে চান। মাফিয়ারা টাকা পেলে খুনখারাপি করবে কেন? তারা তো শুধু টাকার জন্য কিডন্যাপ করে।
এইসময় ডোরবেল বাজল। তারপর বটুক মিত্তির এলেন। ছড়ি পাশে রেখে সোফায় বসে তিনি হাঁটু দোলাতে দোলাতে বললেন, সেনসায়েবের হাবভাব একেবারে বদলে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টার ধকল গেছে, তা ঠিক। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কিছুক্ষণ ছিলুম। যেন ভুল বকছেন। বিড়বিড় করে বলছিলেন, কোম্পানি তুলে দেব। কাকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। এইসব কথা। শেষে ওঁদের ফ্যামিলি ডাক্তার এলেন। শরীর খারাপ বলে খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেডেটিভ ওষুধ দিলেন। বললেন, স্ট্রোক নয়। কোনও কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তারই অ্যাকসিডেন্টাল রিঅ্যাকশন।
টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। মর্নিং অরিজিৎ! খবর বলো। …আঁ! বলো কী? রাতের ট্রেনে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুটিংয়ে গেছে? কোথায়?… বাড়ির লোকের জানা উচিত ছিল। …গোয়া যাবার কথা ছিল? ড্যাম লাই। …হ্যাঁ। আমি বলছি। …আচ্ছা শোনো! পাশের বাড়ি মুন্দ্রাভবন সার্চ করা হয়েছে? …ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির গোডাউন? ..এক মিনিট। তুমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডি সিকে মেসেজ পাঠাও। আমি ব্রেকফাস্ট করেই ওখানে যাচ্ছি। …উইশ ইউ গুড লাক ডার্লিং।
রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন, ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়িকে গত রাত্রে কুন্তলার বাড়িতে হানা দিয়ে ওদের জেরা করার জন্য অ্যারেস্ট করতে বলেছিলুম। ওদের পাওয়া যায়নি।
আবার ডোরবেল বাজল এবং প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার সবেগে ঘরে ঢুকলেন।…
.
০৬.
কর্নেল বটুক মিত্তিরের সঙ্গে হালদারমশাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর হিতেশ্বর দেববর্মন এই প্রাইভেট ডিটেকটিভকে কী কাজে লাগিয়েছিলেন, তাও সংক্ষেপে জানালেন। বটুকবাবু অবাক হয়ে বললেন, এ যে দেখছি বেজায় জটিল ধাঁধা। বর্মনসায়েব কীভাবে জানলেন, সেনসায়েবের সঙ্গে এক ফিল্ম অ্যাকট্রেসের অবৈধ সম্পর্ক আছে?
কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, বর্মনসায়েব তার কোনও কলকাতাবাসী বন্ধুর সঙ্গে গুড ইভনিং ক্লাবে কোনও সময়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই বন্ধু হয়তো তাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এতে বর্মনসায়েবের স্বার্থ কী? বোনের সঙ্গে তো তার কোনও যোগাযোগ ছিল বলে মনে হয় না।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, এ প্রশ্নের জবাব ফিল্মস্টার কুন্তলা চৌধুরিকে জেরা করলে জানা যেত। কিন্তু এইমাত্র লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ি আমাকে জানাল, কুন্তলা চৌধুরি আর তার স্বামী অনিন্দ্য বসুরায় রাতের ট্রেনে কোথায় ফিল্মের শুটিং করতে গেছে। বাড়িতে দুজন সারভ্যান্ট, একজন মালী আর দারোয়ান ছিল। পুলিশ পাড়ার কাউন্সিলার এবং একজন অ্যাডভোকেটকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এনে তাদের সামনে তালা ভেঙে সব ঘর সার্চ করেছে।
হালদারমশাই কথা বলার জন্য ছটফট করছিলেন। এবার বললেন, রাস্তার পোলারা আমারে কইছিল, পাড়ায় একজন ফিমকরা মাইয়া থাকে। অরা তার বাড়ি দেখাইয়া দিছিল।
বললুম, আপনি কাল রাত্রে এ কথাটা কিন্তু আমাদের বলেননি।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, বলব কী! ক্লায়েন্ট খুন হইছে শুনিয়্যাই আমার মাথা খারাপ!
বটুকবাবু নড়ে বসলেন আবার। আমারও কাল থেকে মাথার ঠিক নেই। বর্মনসায়েবের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অপূর্ব চন্দ্রের আলাপ ছিল। তার ডাক নাম লালুবাবু। গত মাসে কলকাতা এসে বর্মনসায়েব আমাকে বলেছিলেন লালুবাবুর সঙ্গে তিনি গুড ইভনিং ক্লাবে গিয়েছিলেন। লালুবাবু ক্লাবের ভাইস চেয়ারম্যান।
কর্নেল বললেন, স্বাভাবিক। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সম্পর্ক তো থাকার কথা।
ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুরে জিভ কেটে বলল, ওই যাঃ! আমার যেন আজকাল কী হয়েছে। কাল রাত্তিরে বাবামশাইরা বেরুলেন, তখন পার্ক স্ট্রিট থানার একজন পুলিশ একটা খাম দিয়ে গেল। একেবারে খেয়াল নেই।
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকাতেই ষষ্ঠীচরণ উধাও হয়ে গেল। তারপর একটা লম্বা খাম এনে কর্নেলের হাতে দিয়ে আবার জিভ কেটে হন্তদন্ত চলে গেল।
কর্নেল খাম থেকে এক শিট কাগজ বের করে বললেন, হোটেল কন্টিনেন্টালের ভিজিটার্স বুকের এক পাতা জেরক্স কপি। এই দেখুন মিত্তিরমশাই। আপনার জন্যই এটা পাঠাতে বলেছিলুম। কারণ আপনি বলেছিলেন, পি রায়ের হাতের লেখা চেনা মনে হচ্ছে।
বটুকবাবু কাগজটা হাতে নিয়ে ধ্যানমগ্ন হলেন।
আমি বললুম, কর্নেল। তা হলে আপনি ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়িকে এই কেসের পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়ে দিয়েছেন?
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, আমার পক্ষে ওই খানাতল্লাশি সম্ভব ছিল না। একমাত্র পুলিশই এ কাজটা পারে। তুমি তো জানো, আমি শখের গোয়েন্দা নই। আমার কোনও অলৌকিক ক্ষমতাও নেই। বড় জোর আমি অঙ্ক কষে টের পাই সত্য জিনিসটা কোথায় কীভাবে খুঁজে বের করা যাবে।
বটুকবাবু এবার মুখ তুলে বললেন, এই কাগজটা যদি আমাকে নিয়ে যেতে দেন, তা হলে আমার অফিসে গিয়ে মিলিয়ে দেখতে পারি। পি হরফের তলায়। একটা খোঁচা। রায়টা ইংরেজিতে আর এ ওয়াই। পি এবং আর এই দুটো হরফ আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। নিয়ে যান।
বটুক মিত্তির খামসুদ্ধ নিয়ে সোয়েটারের ভেতর হাত ঢুকিয়ে শার্টের পকেটে ভরলেন। তারপর কফি শেষ করে বললেন, একটা প্রশ্নের জবাব সেনসায়েব দেননি। অথচ আমার মনে সেটা খোঁচা দিচ্ছে। এদিকে খোঁচাটা আরও ধারালো করে দিলেন মিঃ হালদার।
হালদারমশাই বললেন, কী? কী?
মুন্দ্রাভবন নাকি সেনসায়েবের গোডাউন–এটা এইমাত্র শুনলাম। আমি একেবারে জানতুম না। কিন্তু অতবড় একটা বাড়ির ভেতর জঙ্গল গজিয়ে আছে। পোড়ো বাড়ি বলেই মনে হয়েছে। বাড়িটার মালিক কে এবং সত্যি যদি ওটা গোডাউন হয়, অমন অবস্থা কেন? সেনসায়েবকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, আপনাকে কিডন্যাপাররা ২৪ ঘণ্টা বন্দী করে রেখেছিল। অতবড় এল প্যাটার্ন দোতলা বাড়ি। সেখানে মানুষ বাস করে না? আরও কিছু প্রশ্ন করেছিলুম। সেনসায়েব শুধু বললেন, ছেড়ে দিন। সেনসায়েব কেন চেপে থাকতে চান? উনি তেজী মানুষ। সাহসীও বটে। অথচ পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে থাকতে চান। সেনসায়েবের হাবভাব খুব মিসটিরিয়াস। ছিলেন বাঘ। ফিরে এলেন বেড়াল হয়ে।
বলে বটুকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন, হাতের লেখা চিনতে পারলে ফোনে জানাবেন। আর একটা কথা। কলকাতায় ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির আর সব গোডাউন কোথায় জানেন নিশ্চয়?
হাজরা রোডের একটা গলির ভেতর বড় গোডাউন আছে। বেহালায় একটা আছে শুনেছি। তবে তিলজলায় আমার গোডাউনে কোম্পানির মাল আসে ডিরেক্ট ডানকুনির কারখানা থেকে।
কর্নেল বললেন, আপনি ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির এই গোডাউন দুটোর ঠিকানা যোগাড় করতে পারবেন না?
বটুকবাবু ছড়িতে ভর দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললেন, এই ব্যাপারটা আমার অদ্ভুত লাগে। সেনসায়েবের কলকাতার গোডাউন থেকে মাল ডেলিভারি নিতে ক্যারিং কস্ট কম পড়ে। অথচ ওঁর অফিসের সেলস একজিকিউটিভ প্রবীর গুহ আমার এ প্রস্তাবে কান করেননি। ওঁর কথা হলো, ক্যারিং কস্ট বেশি লাগলেও খাঁটি মালের গ্যারান্টি থাকছে। কমিশনে পুষিয়ে দিচ্ছি। অর্থাৎ কোম্পানির তৈরি মালের নাকি গ্রেড আছে। সোজা কথা, এক নম্বরি-দুনম্বরি ব্যাপার আছে। যাইহোক, কর্নেলসায়েবের জন্য একটু গোয়েন্দাগিরি না হয় করব।
বলে মুচকি হেসে বটুক মিত্তির বেরিয়ে গেলেন।
হালদারমশাই কান করে কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, আমার ক্লায়েন্ট খুন হওয়ার সাথে স্যানসায়েবের কোম্পানির গোডাউনের কোনও সম্পর্ক আছে কর্নেলস্যার?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, আছে বলে আমার ধারণা।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ দ্রুত একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, চিন্তা করবেন না। স্যানসায়েবের অফিসের ঠিকানা আমারে দ্যান। হ্যাডঅফিস তো?
কর্নেল তার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের কাছে গেলেন। একটা দেরাজ খুলে খবরের কাগজের একটা কাটিং এনে একটু হেসে বললেন, এটা সেনসায়েবের কোম্পানির উদ্ভাবিত তেল আকাশকুসুমের বিজ্ঞাপন। এই তেল ব্যবহার করলে টাকে নাকি চুল গজায়! মানুষের এই এক আশ্চর্য দুর্বলতা হালদারমশাই! আমি বরাবর আমার টাকের জন্য গর্ব করি বটে, হঠাৎ এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখলে আগ্রহও জাগে। তাই বিজ্ঞাপনের কাটিংটা রেখে দিয়েছিলুম। তবে আকাশকুসুম কেনার ব্যাপারে একটু ভয়ও ছিল। একবার আমার বন্ধু এমনি টাকগজানো তেল মেখে মাথায় ঘা গজিয়ে খুব ভুগেছিলেন।
হালদারমশাই গম্ভীরমুখে বললেন, আকাশকুসুম কথাটার মানে কী য্যান জয়ন্তবাবু?
বললুম, যা অসম্ভব বা অবাস্তব।
হালদারমশাই খাপ্পা হয়ে বললেন, বদমাইসি! তারপর বিজ্ঞাপন থেকে ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির কলকাতা হেডঅফিসের ঠিকানা তার খুদে নোটবইয়ে টুকে নিলেন।..
ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। পার্কস্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গিতে পৌঁছে। গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, আমি আপনাগো কামে লাগতে পারি। আমারে মুন্দ্রাভবনে লইয়া চলেন কর্নেলস্যার।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, বেশ তো! চলুন।
মুন্দ্রাভবনের সামনে পুলিশের একটা বেতারভ্যান এবং জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা গাড়ি থেকে নামতেই গেটের কাছে যে পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়েছিলেন, কর্নেলকে নমস্কার করে এগিয়ে এলেন। বললেন, আমি ডি সি এস বি গৌতম দত্ত। মিঃ লাহিড়ি আমাকে আপনার আসবার কথা জানিয়েছেন। চলুন। ভেতরে গিয়ে দেখবেন।
কর্নেল হালদারমশাই এবং আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। একসময় গেটটা গাড়ি ঢোকানোর মতো চওড়া ছিল। এখন দুপাশে গরাদ দিয়ে পথ সংকীর্ণ করা হয়েছে। ভেতরে একফালি পথের দুধারে উঁচু-নিচু জঙ্গল। বাউন্ডারি ওয়ালে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া লোহার অ্যাঙ্কেলে সারবদ্ধ এবং টানটান হয়ে আছে। দেখলুম, মাল বয়ে আনার জন্য ঠেলাগাড়ি ব্যবহার করা হয়। চারটে ঠেলাগাড়ি একটার ওপর একটা–এইভাবে রাখা আছে। বাঁদিকে দুটো পূর্বমুখী ঘর, তারপর মধ্যিখানে কোনায় দোতলায় ওঠার সিঁড়ি এবং তার পাশে তিনটে ঘর দক্ষিণমুখী। গৌতম দত্ত বললেন, সেনসায়েবের অফিস থেকে চারজন এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কর্নেলসায়েব কি কথা বলবেন?
কর্নেল বললেন, আপাতত নয়। আমি দোতলাটা দেখতে আগ্রহী।
হালদারমশাই সিঁড়িতে ওঠার সময় ফিসফিস করে আমাকে বললেন, দোতলায় একটা ঘরে আলো দেখছিলাম।
বললুম, চলুন। দেখিয়ে দেবেন।
দোতলায় উঠে বাঁদিকে ঘুরেই একটা ঘর। সেই ঘরের দরজায় হ্যান্ডকাফ আঁটা ছিল। গৌতমবাবু বললেন, নিচের তলায় পাঁচটা ঘরের মধ্যে তিনটেতে কোম্পানির মাল ভর্তি। সব প্লাইউড বক্স। লোহার পাত দিয়ে আঁটা। কয়েকটা পেটি র্যান্ডম দেখে নিয়ে খুলতে বলেছি। হেয়ার অয়েল, স্নো, ক্রিম, লিপস্টিক ইত্যাদি নানারকমের প্রসাধন। সাবান, শ্যাম্পুর আলাদা-আলাদা পেটি আছে। সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। একটা ঘরে দুজন দারোয়ান থাকে। একটা ঘরে তারা। রান্না করে। কিন্তু দোতলার এই ঘরটা সন্দেহজনক।
বলে তিনি হ্যান্ডকাফ খুললেন। ভেতরে ঢুকে অবাক হলুম। মেঝেয় পুরু কার্পেট। সুন্দর সব শিল্পদ্রব্য সাজানো। একপাশে ডাবলবেড খাট। একটা আলমারিতে অজস্র প্রসাধন থরেবিথরে সাজানো। ড্রেসিং টেবিলটাও দেখার মতো। গৌতমবাবু সুইচ টিপে আলো জ্বালতেই একটুকরো স্বর্গ ঝলমলিয়ে উঠল।
হালদারমশাই আমার পাঁজরে একটু খুঁচিয়ে দিলেন। অর্থাৎ এই ঘরে উনি আলো দেখতে পেয়েছিলেন।
ঘরটা এয়ারকন্ডিশনড। অ্যাটাচড় বাথ আছে। পাশের ঘরে এ ঘর থেকে ঢোকা যায়। কর্নেল পর্দা তুলে দেখে বললেন, কিচেন-কাম-ডাইনিং। বাঃ! সেনসায়েব তা হলে মাঝেমাঝে এখানে এসে থাকেন।
গৌতমবাবু বললেন, দেয়ালে ফিল্ম হিরোইনদের কাটআউটগুলো লক্ষ্য করেছেন?
হ্যাঁ। বলে কর্নেল খাটের পাশে নিচু টেবিলে রাখা বিদেশি টেলিফোনের পাশে একটা ল্যামিনেটেড রঙিন ছবির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। লাস্যময়ী এক সুন্দরীর অর্ধনগ্ন ছবি। বললেন, আমার ধারণা ইনিই ফিল্মস্টার কুন্তলা চৌধুরি।
গৌতমবাবু হাসলেন। দ্যাটস রাইট। আপনি কি আজকালকার বাংলা ফিল্ম দেখেন?
কর্নেল বললেন, নাঃ!
তাহলে এই উঠতি হিরোইনকে কী করে চিনলেন?
কর্নেল হাত বাড়িয়ে বিছানার মাথার দিকের বেডকভার তুললেন। তারপর পকেট থেকে আতস কাঁচ বের করে কী সব দেখতে দেখতে একটা লম্বা চুল টেনে তুললেন। গৌতমবাবু! এই হিরোইনের চুল!
গৌতম দত্ত মুচকি হেসে বললেন, আপনার গোঁফদাড়ি সাদা। কিন্তু মন আমার চেয়েও তরুণ। এবার আপনাকে সন্দেহজনক ব্যাপারটা দেখাই। এ ঘরের সব কিছু অ্যাজ ইট ইজ রাখা আছে।
বলে তিনি বেডকভারের সামনের দিক তুলে খাটের তলায় তর্জনী নির্দেশ করলেন। কর্নেল হাঁটু ভাজ করে উঁকি দিলেন। হালদারমশাইও দেরি করলেন না। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।
কর্নেল একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফায়ার আর্মসটা ইচ্ছে করেই ওখানে রেখেছে কেউ। গতকাল রাত এগারোটায় লালবাজারের ওসি হোমিসাইড আমাকে জানিয়েছেন, হোটেল কন্টিনেন্টালে মিঃ দেববর্মনকে খুন করা হয়েছে। তাঁরই লাইসেন্স রিভলভারের একটা গুলিতে। পয়েন্ট থার্টি টু ক্যালিবার। সাইলেন্সরটা খুলে নিয়ে গেছে খুনী। আর এই বিছানার তলায় যে রিভলভারটা পড়ে আছে, আমার ধারণা এটা পয়েন্ট টোয়েন্টি টু ক্যালিবার।
গৌতমবাবু হাসলেন। আই নো দ্যাট ওয়েল কর্নেলসায়েব। আপনি আসছেন শুনে ওটা সিজ করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা যথেষ্ট সন্দেহজনক। মিঃ দেববর্মনের খুনী এ ঘরে ঢুকল কী করে? আমি ওটা দেখার পরই সেনসায়েবকে রিং করেছিলুম এই টেলিফোনে। আজ তিনি অনেকটা সুস্থ। বললেন, তার একটা লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস আছে। তবে তিনি শনিবার অফিস থেকে সোজা ক্লাবে যান এবং ক্লাব থেকে এখানে বিশ্রাম নিতে আসেন। তাই অস্ত্রটা বাড়িতে থেকে গেছে!
গৌতমবাবু রুমাল বের করে খাটের তলা থেকে খুদে উজ্জ্বল আগ্নেয়াস্ত্রটি টেনে আনলেন। রুমালে জড়ানো অবস্থায় প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, আর কিছু দেখতে চান?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। নিচের তলায় একটা ঘর থাকা সম্ভব, সেটার দরজা দিয়ে পেছনের গলিতে নামা যায়।
আছে। আসুন। দেখাচ্ছি।
নিচে দক্ষিণমুখী ঘরগুলোর মধ্যে শেষ ঘরটা ছোট্ট অফিস। ভেতরের দরজা খুলে দিল একজন সাদা পোশাকের পুলিশ। আমরা সংকীর্ণ একটা কানাগলিতে পৌঁছলুম। তার সামনাসামনি কুন্তলা চৌধুরির বাড়িতে ঢোকার একটা ছোট্ট দরজা।
গৌতম দত্ত মুচকি হেসে চাপাস্বরে বললেন, অভিসারিকার যাতায়াতের পথ।
কর্নেল বললেন, সেনসায়েব কি বলেছেন, কেউ তাকে কিডন্যাপ করেনি?
কিডন্যাপ? না তো! উনি বললেন, প্রায়ই এ বাড়িতে উনি রাত কাটাতে আসেন, যে-রাত্রে তিনি একটু ড্রাংক হয়ে যান। তার স্ত্রী নাকি মদের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না।
এই সময় গৌতমবাবুর হাতে মোবাইল ফোন পি পি করে উঠল। তিনি একটু সরে গিয়ে চাপাস্বরে কার সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। সেই সময় দেখলুম, কর্নেল গলিতে ড্রেনপাইপের কাছে হেঁট হয়ে কিছু কুড়িয়ে নিয়ে। পকেটে প্রলেন।
গৌতমবাবু বললেন, কমিশনার সায়েব শুনেছেন আপনি এখানে আছেন। একটু কথা বলতে চান।
কর্নেল ফোন নিয়ে বললেন, মর্নিং মিঃ আচার্য।… ত্রিপুরার হোম সেক্রেটারি যখন ইন্টারেস্টেড, তখন আপনাদের একটু নড়াচড়া স্বাভাবিক। ও নো নো মিঃ আচার্য! কিছুক্ষণ আগে আমার স্নেহভাজন সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্তকে বলছিলুম, আমি অরণ্যদেব নই। …আসল কাজ তো আপনারাই করবেন। …হ্যাঁ, একটা ফায়ার আর্মস পাওয়া গেছে। আঙুলের ছাপ আছে কি না পরীক্ষা করা দরকার। …থ্যাঙ্কস মিঃ আচার্য। ছাড়ি।
কর্নেল গলিপথে হাঁটতে থাকলেন। তারপর রাস্তায় পৌঁছে কুন্তলা চৌধুরির বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলাকে পেলে জেরা করে জানা যেত, শনিবার থেকে রবিবার–শনিবার রাত দশটা থেকে রবিবার দশটা–এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে সেনসায়েবের সঙ্গে এ বাড়িতে দেখা করতে এসেছিল কি না। বাই দা বাই, এই গোডাউনের দারোয়ান দুজন কী বলেছে?
গৌতম দত্ত বললেন, শীতের রাত্রি বলে তারা সকাল-সকাল খেয়ে দরজা জানালা এঁটে ঘরে বসে ছিল। রবিবার অর্থাৎ গতকাল সক্কালে গয়ানাথ তার বালবাচ্চাকে দেখতে হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে গিয়েছিল। ফিরে আসে সন্ধ্যার আগে। লছমন তখন রুটি তৈরি করছিল। জেরার চাপে ওরা স্বীকার করেছে, দুজনেরই গাঁজা টানার অভ্যাস আছে।
কর্নেল বললেন, আমি জয়ন্তের গাড়িতে গতরাত্রে এই এলাকায় চক্কর দিয়ে গেছি। তখন রাত আটটা পনেরো–একটা কালো অ্যাম্বাসাডার দুটো লোককে মুন্দ্রাভবনে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। লোকদুটো গাছের ছায়ায় নেমে গেটে ঢোকার সময় আবছা দেখেছি, মোটাসোটা গড়ন, দুজনেরই মাথা থেকে মাফলার জড়ানো। শুধু নাকটুকু অস্পষ্টভাবে দেখেছি। গাড়িটা আমরা ফলো করেছিলুম। লেকের ধারে গুড ইভনিং ক্লাবে ঢুকে যেতে দেখলুম। নাম্বার– কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুদে নোটবই বের করে বললেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এই কাজটা খুব শিগগির পারবে। গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা চাই।
গৌতমবাবু তার নোটবুকে নাম্বার টুকে নিয়ে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বললেন। তারপর পা বাড়িয়ে বললেন, আপনি কি সেনসায়েবের কর্মচারীদের কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?
কোম্পানির অফিসার বা একজিকিউটিভ র্যাংকের কেউ এসেছেন কি?
স্টোর সেকশনের একজন এসেছেন।
তাকে ডেকে পাঠান। বাইরে দাঁড়িয়ে দুচারটে প্রশ্ন করে চলে যাব।
আমরা গেটের সামনে এসে দাঁড়ালুম। একটু পরে লম্বা রোগা এক ভদ্রলোক এসে নমস্কার করলেন। পরনে ঢিলে প্যান্ট আর সোয়েটার। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোম্পানির স্টোর সেকশনে কী পোস্টে আছেন?
ভদ্রলোক কঁচুমাচু মুখে হেসে বললেন, পোস্ট বলতে স্যার আসলে হেড ক্লার্ক। কোন গোডাউনে কত মাল আসছে, কত মাল চালান যাচ্ছে, কাগজপত্র দেখে তার হিসেব রাখতে হয়।
আপনার নাম?
আজ্ঞে আদিত্য ঘোষ।
আপনাকে কি কোম্পানির সব গোডাউন দেখাশোনা করতে হয়?
স্যার। প্রত্যেক গোডাউনে স্টোরকিপার আছে। এই বাড়িটা মাস ছয়েকের জন্য কোম্পানি ভাড়া নিয়েছে। ছেড়ে দিলে মালিকের প্রমোটার এখানে বাড়ি তুলবে। এটা অস্থায়ী গোডাউন বলে স্টোরকিপার রাখা হয়নি। এখানে এখন যে স্টক দেখলেন, আজ-কাল-পরশুর মধ্যে সব বাইরে নানা জায়গায় চালান যাবে। তাই দুজন দারোয়ান থাকে। সেলস সেকশন থেকে অফিসাররা এসে মাল চালানের ব্যবস্থা করেন। কাল ছুটির দিন ছিল। আজ পুলিশ যদি অনুমতি দেয়, সেলসের অফিসাররা এসে স্টক মিলিয়ে কত পেটি মাল কোথায় যাবে, তা ঠিক করে দেবেন।
কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, শুনেছি ক্রশমার্ক দেওয়া পেটির গ্রেড নাম্বার এ। এসব নাকি বেস্ট কোয়ালিটির মাল?
আদিত্যবাবুর মুখে চমক খেলে গেল। ক্রশমার্ক?
হ্যাঁ। লাল ক্রশমার্ক।
আমি তো এরকম মার্কের কথা শুনিনি স্যার! তবে গ্রেডের কথা বললেন। হ্যাঁ–এ বি সি গ্রেড আছে। এ গ্রেড বিদেশে রফতানি হয়। আরব ওয়ার্ল্ড যায়।
এখানে পুলিশ সার্চ করবে শুনে কোনও অফিসার ব্যাংক বা একজিকিউটিভ র্যাংকের কেউ আসেননি কেন?
তা জানি না স্যার। সেলস একজিকিউটিভ আমাকে আর স্টোর সেকশনের কর্মচারীদের আসতে বললেন। চাবি নিয়ে আমরা এসেছি। সব ঘর খুলে দেখিয়েছি।
সেনসায়েব মাঝে মাঝে এ বাড়িতে থাকতেন। আপনি জানতেন একথা?
না স্যার। আমি চুনোপুঁটি। মালিক আমাকে চেনেন না। আমিও
বুঝেছি। কোম্পানি তো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। মিসেস সেন এবং সেনসায়েকের আত্মীয়স্বজন কি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার?
আমি এ সব ব্যাপারে কিছুই জানি না স্যার। আদিত্যবাবু একটু ইতস্তত করে ফের বললেন, ম্যানেজিং বোর্ড আছে। মিটিং হয়। তাদের কাউকে আমি চিনি না।
আপনাদের ডানকুনির কারখানায় কখনও গেছেন আপনি?
না স্যার।
আপনাদের আর দুটো গোডাউন কোথায়? ঠিকানা দিতে পারেন?
আদিত্যবাবু কাকুতিমিনতি করে বললেন, আমি চুনোপুঁটি স্যার। দেখবেন যেন আমার কোনও ক্ষতি না হয়। একটা বড় ফ্যামিলির বোঝা আমার কাঁধে।
আপনার চিন্তার কারণ নেই। আপনি ঠিকানা দুটো বলুন।
কর্নেল তার খুদে নোটবই বের করলেন। আদিত্যবাবু চাপা গলায় হাজরা রোড এবং বেহালার গোডাউনের ঠিকানা জানিয়ে দিলেন।
গৌতম দত্ত এসে বললেন, কিছু মিলল কর্নেলসায়েব?
নাঃ। দুটো গোডাউনের ঠিকানা নিলুম।
ডি সি এস বি একটু অবাক হয়ে বললেন, সেখানেও কি সেনসায়েবের এমনি সুরম্য বেডরুম এবং প্রেমিকার আশা করছেন?
কর্নেল হাসলেন। না। রেডক্রশের খোঁজ করে বেড়াচ্ছি।
আপনার হেঁয়ালি সম্পর্কে প্রচুর গুজব শুনেছি।
হেঁয়ালি নয়। আমি টুপি খুললেই বিশাল টাক দেখতে পাবেন। তাই আমি এই কোম্পানির উদ্ভাবিত রেডক্রশ মার্কা অর্থাৎ এ গ্রেডের আকাশকুসুম তেল সম্পর্কে আগ্রহী।
আকাশকুসুম তেল? একটা পেটি খুলে এক হাজার শিশি লাল রঙের তেল দেখেছি এই গোডাউনে। তবে রেডক্রশ মার্কা নয়।
চলি মিঃ দত্ত। পরে দেখা হবে। ধন্যবাদ। বলে কর্নেল আমার গাড়ির কাছে গেলেন।
.
০৭.
ফেরার পথে থিয়েটার রোডে একটা গলির মোড়ে কর্নেল আমায় গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। তারপর একা নামলেন। হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার! আমি সঙ্গে যাব কি?
কর্নেল বললেন, না। আপনারা অপেক্ষা করুন। এই গলির ভেতর বটুকবাবুর ডিসট্রিবিউটিং এজেন্সির অফিস। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করে শিগগির ফিরে আসছি।
হালদারমশাই সেনসায়েবের সঙ্গে এক ফিল্মস্টারের অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে চাপাস্বরে তার থিয়োরি আওড়াতে শুরু করলেন। তার সিদ্ধান্ত হলো, কুন্তলা চৌধুরি সেনসায়েবকে গুণ্ডা দিয়ে আটকে রেখে টাকা আদায় করেছে। ওই টাকায় কুন্তলা আর তার স্বামী অনিন্দ্য বসুরায় হিন্দি ফিল্ম তৈরি করবে বলে বোম্বাইয়ে পাড়ি জমিয়েছে। এদিকে তার ক্লায়েন্ট মিঃ দেববর্মন ব্যাপারটা কোনও সূত্রে টের পেয়েছিলেন। তাই কুন্তলা তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে খুন করিয়েছে। খুনী ফিল্মলাইনেই ঘোরাফেরা করে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। সম্ভবত খুনীর কাছ থেকেই বর্মনসায়েব তার ভগ্নীপতির অবৈধ প্রণয় এবং এক কোটি টাকা আদায়ের চক্রান্ত টের পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন না, খুনী কুন্তলার হাতের পুতুল।
প্রায় আধঘণ্টা পরে কর্নেল ফিরে এলেন। বললেন, গাড়ি ঘোরাও জয়ন্ত! লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
হালদারমশাই লালবাজারের নাম শুনলেই বিরক্ত হন। বরাবর দেখে আসছি, উনি নিজে একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হয়েও পুলিশ সম্পর্কে ওঁর ধারণা খারাপ। বলেন, মশয়! পুলিশ ছিল ব্রিটিশযুগে। এখনকার পুলিশ পুলিশ নাকি? আসলে পুলিশ মহলে ওঁকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টাতামাসা করেন এবং কেউ পাত্তা দিতে চান না। কোনও কেসেই পুলিশ প্রাইভেট ডিটেকটিভের নাক গলানো পছন্দ করে না।
কর্নেলের মুখে লালবাজার শুনেই গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, কর্নেলস্যার! বরং আমারে স্যানসায়েবের গোডাউন দুটোর অ্যাড্রেস দ্যান। আমি নজর রাখব দুই জায়গায়। কিছু সন্দেহজনক দেখলেই আপনারে রিপোর্ট করব।
কর্নেল একটু হেসে ওঁকে ঠিকানা দুটো দিলেন। গোয়েন্দাপ্রবর গাড়ি থেকে নেমে উধাও হয়ে গেলেন। আমি কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি মুন্দ্রাভবনের পাশের গলিতে কী কুড়িয়ে নিলেন?
কর্নেল বললেন, চেপে যাও!…
লালবাজারে সাউথ ব্লকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ি কর্নেলের অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, আপনি একটু দেরিতে ফোন করলে মালবাবুর হেফাজতে চলে যেত জিনিসগুলো। এস আই নরেশবাবু এখনই এসে পড়বেন। ততক্ষণ কফি খান। বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। জয়ন্তবাবু কি সত্যসেবক পত্রিকায় আগরতলার ব্যবসায়ী খুনের খবর লিখেছেন?
বললুম, না মিঃ লাহিড়ি! আমাকে গতকাল সকাল থেকে কর্নেল কিডন্যাপ করে রেখেছেন।
অরিজিৎ লাহিড়ি হাসলেন। সেই বটে! কঁচা হাতের লেখা খবর। বিশ্বস্ত সূত্র-টুত্র উল্লেখ করে পুলিশের ভার্সান মিলিয়ে কন্ট্রাডিকশনে ভরতি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্তের লেখার সময় এখনও আসেনি। যতণ না প্রকৃত খুনী ধরা পড়ছে এবং তোমাকে একটু আভাস দেওয়া উচিত অরিজিৎ–এ কেসের সবচেয়ে সাংঘাতিক অংশ এখনও আড়ালে থেকে গেছে।
মিঃ লাহিড়ি ভুরু কুঁচকে বললেন, সবচেয়ে সাংঘাতিক অংশ! প্লিজ বস! একটু হিন্ট দিন।
আকাশকুসুম!
আকাশকুসুম? সেটা কী?
টাকে চুল গজানোর তেল। ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির উদ্ভাবিত বিজ্ঞাপন দেখনি?
ডি সি ডি ডি হাসতে হাসতে বললেন, সত্যি বস! আপনার কথা ডি-কোড করার সাধ্য নেই। এস বি-র গৌতমবাবু একটু আগে ফোন করেছিলেন। আপনি ওঁকেও আকাশকুসুম নিয়ে গোলকধাঁধায় ঢুকিয়েছেন।
ইত্যবসরে কফি আর স্ন্যাক্স এল। লক্ষ্য করলুম, অনবরত টেলিফোন। বাজছে, মিঃ লাহিড়ি চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছেন। বিশাল টেবিলের এধারে বসে ওঁর কথাবার্তা বোঝা কঠিন।
নরেশ ভদ্র এলেন। সঙ্গে একজন সাদা পোশাকের কনস্টেবল। তার দুহাতে ব্রিফকেস এবং সুটকেস। সে ও দুটো নিচে রেখে চলে গেল। নরেশ ভদ্রের অভ্যাস হালদারমশাইয়ের মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলা। কর্নেলকে নমস্কার করে বসলেন। বললেন, কর্নেলসায়েব সবখানে মরা ইঁদুরের গন্ধ পান। আগরতলার বিজনেসম্যান ভদ্রলোকের বোঁচকার ভিতরে আমরা তন্নতন্ন খুঁজছি। মরা ইঁদুর দেখি নাই।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, মরা ইঁদুর ছিল। খুনী তা খুঁজে বের করে নিয়ে গেছে। কিন্তু গন্ধটা থাকা সম্ভব। প্লিজ! আগে ব্রিফকেসটা দিন!
নরেশবাবু দেববর্মনের ব্রিফকেসটা টেবিলে এনে রাখলেন। কর্নেল তার ভেতর থেকে দুটো ফাইল আর টাইপ করা কয়েকটি কাগজ বের করলেন। লক্ষ্য করলুম, সবই ব্যবসাসংক্রান্ত কাগজ। পাতা উল্টে দেখার পর কর্নেল ব্রিফকেসটা খালি করে তলার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন। তারপর জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে আতস কাঁচ বের করে তলা পরীক্ষা করতে করতে বললেন, ভেতরটা সিল্কের ব্রাউন কাপড়ে সেলাই করা। তার তলায় পিসবোর্ড। কিন্তু এই দেখুন, তলার সামনের দিকটায় খুব সরু একই রঙের লম্বা জিপ। জিপের ডগাটা চোখে পড়ে না সহজে। বলে তিনি জিপ টেনে তলার পিসবোর্ডের নিচে হাত ভরলেন। তারপর ভাঁজ করা দুটো কাগজ বের করে খুললেন।
নরেশ ভদ্র বললেন, কী আশ্চর্য! তলার পিসবোর্ডের নিচে চিঠি লুকাইয়া রাখছিলেন ভদ্রলোক!
মিঃ লাহিড়ি অবাক হয়ে বললেন, আমিও তন্নতন্ন চেক করেছিলুম। তলায় যথারীতি শক্ত বোর্ড। জিপটা এমনভাবে তৈরি, চোখে পড়ার কথা নয়।
কর্নেল বললেন, মিঃ দেববর্মন এত সাবধানী লোক হয়েও কেন ফাঁদে পা দিলেন, বোঝা যায় না। অরিজিৎ। চিঠি দুটো ছোট্ট এবং হাতে লেখা। তলায় নাম সই সেই পি রায়ের। পড়ে দেখ।
নরেশ ভদ্র বললেন, দেববর্মনসায়েব হুইস্কি দিয়া খুনিরে আপ্যায়ন করছিলেন। কিন্তু খুনী সম্ভবত নিজের হাতে গেলাস ধোওয়ার ছলে ওনার গেলাসের তলায় ড্রাগ রাখছিল। দেববর্মনসায়েব সাবধানী মানুষ বটে, কিন্তু একচক্ষু হরিণ। তারে পি রায় মার্ডার করব, তা ক্যামনে জানবেন?
মিঃ লাহিড়ি চিঠি দুটোতে চোখ বুলিয়ে নরেশবাবুকে দিলেন। বললেন, কর্নেল একটু আগে আকাশকুসুম বলছিলেন। পি রায় রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুমের পেটি গোপনে দেববর্মনসায়েবকে সাপ্লাই করবে লিখেছে। প্রথম চিঠিটা গতমাসের। দ্বিতীয়টা গতসপ্তাহের। এটাতে ওঁকে পি রায় কলকাতা আসতে বলেছিল। মালের দর ঠিক করে অ্যাডভান্স পেমেন্টের কথা লিখেছিল। কিন্তু মিঃ দেববর্মনের পার্সে ক্যাশ টাকা আর কয়েন মিলিয়ে পাঁচশো টাকার মতো পাওয়া গেছে। তার মানে, আরও টাকা ছিল। খুনী তা হাতিয়েছে।
কর্নেল বললেন, অরিজিৎ! চিঠি দুটোর জেরক্স কপি আমার দরকার।
অরিজিৎ লাহিড়ি বললেন, নরশেবাবু! আপনি নিজে জেরক্স কপির ব্যবস্থা করুন।
নরেশ ভদ্র বেরিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, মিঃ দেববর্মনের আত্মীয়স্বজন এসেছেন কি?
হ্যাঁ। মর্নিংয়ে ওঁর বডির ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। ওঁর কাকা আর শ্যালক এসেছিলেন। চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার। ওঁর কাকা ত্রিপুরা গভর্নমেন্টের মিনিস্টার। অভিজাত পরিবার। আমাদের হোম সেক্রেটারি খুব চাপ দিচ্ছেন। কাজেই আমরা খুব বিব্রত। যাইহোক, ফিল্মস্টার মহিলা আর তার স্বামী ট্রেনে না প্লেনে কেটে পড়েছেন, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, স্টুডিয়ো মহলে আমার সোর্স আছে। দেখা যাক।
অরিজিৎ হাসলেন। সোর্স তো আমাদেরও আছে। কিন্তু সে শুধু এইটুকু। জানে, কুন্তলার স্বামী অনিন্দ্য বসুরায় নিজেই একজন প্রোডিউসার। সে বম্বের ডাইরেক্টর এবং হিরো-টিরো নিয়ে একটা বড় বাজেটের ছবি করছে।
কর্নেল আস্তে বললেন, সেনসায়েবের এক কোটি ক্যাশ টাকা আদায় করেছে কুন্তলা চৌধুরি।
আপনি যা-ই বলুন বস! সেনসায়েব কিডন্যাপড হননি। টাকাটা প্রেমিকাকে দিয়েছেন এবং সম্ভবত স্ত্রীর ভয়ে কিডন্যাপিং কেস সাজিয়েছেন।
আমি উৎসাহে বললুম, আমার থিয়োরিও তাই মিঃ লাহিড়ি। কর্নেল তা মানতে রাজি নন।
কর্নেল বললেন, ডার্লিং! তোমাদের থিয়োরিতে গণ্ডগোল আছে। সেনসায়েব তাঁর প্রেমিকাকে টাকা দিতে চাইলে এমনিতেই দিতে পারতেন। স্ত্রীর অজ্ঞাতসারে টাকা দেওয়ায় বাধা ছিল না।
অরিজিৎ বললেন, কিন্তু গৌতমবাবুর রিপোর্টে মুন্দ্রাভবনে তাঁকে বন্দী করে রাখার কোনও প্রমাণ মেলেনি। আপনি নিজেও তো দেখে এলেন। তাছাড়া গৌতমবাবু সেনসায়েবকে রিং করে জানতে চেয়েছিলেন, তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কি না। উনি কিডন্যাপ করার কথা অস্বীকার করেছেন।
সেটা ওঁর পক্ষে পুলিশকে না বলা স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিই তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। কিডন্যাপের পদ্ধতিটা আমি অনুমান করেছি। উনি অন্যদিনের মতো বাইরে গাড়ি রেখে দোতলায় তার ঘরে ঢুকেছিলেন। তারপর তাকে বন্দিদশায় থাকতে হয়েছিল। ভয়ে কুঁ শব্দটি করতে পারেননি।
ডি সি ডি ডি হাসলেন। এটা আপনার থিয়োরি হতে পারে। কিন্তু ভিত্তিটা কী?
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে তোবড়ানো কালো রবারের দুটো জিনিস বের করে ময়লা ঝেড়ে বললেন, দুটো মুখোশ।
বলে একটা মুখোশ তিনি পরলেন। কালো কদাকার পৈশাচিক মুখ। শুধু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য এবং চোখে দেখার জন্য ফুটো করা আছে।
দেখামাত্র বললুম, মুন্দ্রাভবন আর কুন্তলা চৌধুরির বাড়ির মাঝখানের কানাগলিতে ড্রেনপাইপের পাশে আপনি তা হলে এই মুখোশ দুটোই কুড়িয়েছিলেন? গৌতমবাবু অন্যদিকে ঘুরে মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছিলেন। হালদারমশাই রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।
অরিজিৎ ভ্রূ কুঁচকে বললেন, মুখোশ দুটো কি সেনসায়েবকে কিডন্যাপ করার প্রমাণ?
কর্নেল হাসলেন। একজ্যাক্টলি। টাকা নিয়ে যাবার সময় কুন্তলার দুই অনুচর মুখোশ দুটো খুলে ফেলে গিয়েছিল।
মুন্দ্রাভবনের নিচের তলায় দুজন দারোয়ান থাকে।
শীতের রাতে গাঁজা খেয়ে তারা দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ডাইনিং রুমে হুইস্কির বোতল আর তিনটে গ্লাস দেখেছি। গৌতমবাবুকে বলে আসা উচিত ছিল গ্লাসগুলো পরীক্ষার জন্য ফোরেন্সিক ল্যাবে পাঠাতে। আমার ধারণা, সেনসায়েবের দুর্বলতার কারণ, তাঁকে হুইস্কিতে ড্রাগ মিশিয়ে দেববর্মনের মতোই বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল।
অরিজিৎ লাহিড়ি মোবাইল টেলিফোনে চাপাস্বরে গৌতমবাবুকে নির্দেশ দিলেন।
কর্নেল বললেন, মুখোশ দুটো আপাতত আমার কাছে থাক। হুইস্কির বোতল আর তিনটে গ্লাস দেখে সে মুহূর্তে আমি ভেবেছিলুম কুন্তলা তার স্বামী অনিন্দ্য এবং সেনসায়েব হয়তো মদ্যপান করেছিলেন। পরে মুখোশ পরে দুই বজ্জাত ঘরে ঢোকে এবং কুন্তলা-অনিন্দ্যকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এই ভয় দেখানোটা সাজানো ব্যাপার। কিন্তু পথে আসতে আসতে মনে হলো কুন্তলা আর তার স্বামী হুইস্কিতে ড্রাগ মিশিয়ে সেনসায়েবকে অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় শুইয়ে দেয়। পাহারায় রেখে যায় মুখোশপরা দুই দুবৃত্তকে। আজ সেনসায়েবের কোম্পানির কলকাতার ডিসট্রিবিউটর বটুক মিত্তির বলেছিলেন, সেনসায়েব ছিলেন বাঘ। ফিরেছেন বেড়াল হয়ে। কী সব ভুল বকছিলেন গতরাত্রে। তাঁর নাকি কাকেও বিশ্বাস হয় না আর। সবাই বিশ্বাসঘাতক।
তার মানে কি এই যে, সেনসায়েব মুখোশপরা লোক দুটোকে চিনতে পেরেছিলেন?
সম্ভবত তা-ই।
তা হলে তাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
কর্নেল নড়ে বসলেন। হ্যাঁ। এটাই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। উনি তাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন। অরিজিৎ! এ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে একটাই। সেনসায়েব তাহলে বিপদে পড়তে পারেন। ব্ল্যাকমেলের আশঙ্কা আছে ওঁর।
আপনার থিয়োরি অবশ্য প্রায়ই বদলে যায় দেখেছি।
যেতে পারে। হ্যাঁ বদলে যায়। নতুন তথ্য হাতে এলে আমি থিয়োরি শুধরে নিই।
কিন্তু ব্ল্যাকমেলের পয়েন্টটা কী?
সম্ভবত আকাশকুসুম।
অরিজিৎ লাহিড়ি হেসে উঠলেন। নরেশ ভদ্র চিঠি দুটোর জেরক্স কপি নিয়ে এলেন। কর্নেল তা পকেটস্থ করে বললেন, উঠি অরিজিৎ। নরেশবাবু! আপনাদের কাজ আপনারা চালিয়ে যান।
নরেশ ভদ্র মুচকি হেসে বললেন, ট্রাম্পকার্ড আমরা কেউ কারেও দেখামু না।…
ইলিয়ট রোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল বললেন, আর কফি খাব না। জয়ন্ত! আগে স্নান করে নাও। আমিও আজ স্নান করব। গতকাল ছিল আমার স্নানের দিন। সুযোগ পাইনি।
কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে একদিন, অন্যসময় দুদিন স্নান করেন। রোজ স্নান না করে থাকতে পারেন কী ভাবে–এই প্রশ্নে ওঁর সুনির্দিষ্ট উত্তর হলো : সামরিক জীবনের অভ্যাস। ফ্রন্টলাইনে থাকার সময় এক-দেড়মাস পরে একদিন দৈবাৎ স্নানের সুযোগ পেয়েছেন। তার চেয়ে বড় কথা, হয় বনজঙ্গলে গেরিলা–লড়াই কিংবা বেশিরভাগ সময় যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে কাটিয়ে নাকি তার কতকগুলো সৃষ্টিছাড়া অভ্যাস জন্মে গেছে।
স্নানাহারের পর ড্রয়িংরুমে কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। আমি ডিভানে শুয়ে ভাতঘুমে গড়িয়ে পড়লুম।
চোখ বুজে শুয়ে থেকে শুনলুম, কর্নেল– টেলিফোনে কথা বলছেন। গোপালবাবু! এখন সবই আপনার ভরসা… হ্যাঁ, আমি বাড়িতেই আছি। অন্তত চারটের আগে বেরুচ্ছি না। আপনি উড়োপাখির ছায়ার পিছনে দৌড়ুতে থাকুন।… আসল লোক? বাঃ! তা হলে তাঁর শরণাপন্ন হোন। ছাড়ছি।
জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবুর কাছে কর্নেল কুন্তলা ও অনিন্দ্যর খবর চাইছেন। মনে মনে হাসলুম, তারা অত বোকা নয়। এতক্ষণে বোম্বে পৌঁছে জনারণ্যে উধাও হয়ে গেছে।…
ষষ্ঠীচরণের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। উঠে বসে বললুম, কর্নেল কি ছাদের বাগানে?
ষষ্ঠী একগাল হেসে বলল, কটা বাজছে দেখুন। সন্ধে হয়ে গেছে। বাবামশাই বেইরেছেন। বলে গেছেন, দাদাবাবুকে বলিস যেন চলে না যায়। সাতটায় আপনাকে নিয়ে বেরুবেন।
ঘড়ি দেখলুম, পাঁচটা বেজে গেছে। চা খাওয়া শেষ করে বাথরুমে গেলুম। তারপর প্যান্টশার্ট-জ্যাকেট পরে এলুম। ঘরে এখন শীতের উপদ্রব। সোফার সেন্টার টেবিলে কয়েকটা বিদেশি বিজ্ঞান পত্রিকা পড়ে ছিল। সবে পাতা উল্টেছি, ডোরবেল বাজল। ভাবলুম, কর্নেল ফিরলেন।
কিন্তু কর্নেলের বদলে হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে বললেন, কর্নেলস্যার কই গেলেন জয়ন্তবাবু?
বললুম, বসুন হালদারমশাই! কর্নেল কখন বেরিয়েছেন জানি না। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ষষ্ঠী বলল, উনি আমাকে থাকতে বলেছেন। সাতটায় কোথায় বেরুবেন আবার।
ষষ্ঠী ভেতরের পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বলল, হালদারমশাই চা না কফি খাবেন?
গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, কফি খাব ষষ্ঠী। নার্ভ চাঙ্গা করব। ব্র্যান ব্যাবাক গণ্ডগোল হইয়া গেছে।
বললুম, কী ব্যাপার হালদারমশাই?
হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, বেহালায় স্যানসায়েবের কোম্পানির গোডাউন একটা বাগানবাড়ি কইলেই ঠিক হয়। আমি থাকতে থাকতে দুই ট্রাক মাল আসল। তার লগে-লগে আইয়া পড়ল একটা সবুজ মারুতি কার। এক ভদ্রলোক–পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বৎসর বয়স হইব–মারুতি থেকে নামলেন। আমি ছিলাম উল্টোদিকে একটা পানের দোকানে। কানে আইল, ভদ্রলোক কারে কইতাছেন, রেডক্রশ মার্কাগুলি তিন নম্বরে রাখবা। গাড়ির নাম্বার আনছি।
বলে গোয়েন্দাপ্রবর খুদে নোটবই বের করে নাম্বার আওড়ালেন। এই সময় মনে পড়ে গেল, কাল একটা সবুজ মারুতি আমারে ফলো করছিল। বললুম, ভাল করেছেন। কিন্তু গাড়িটার নাম্বার নিলেন কেন?
হাজরা রোডের গোডাউন বন্ধ ছিল। তাই বাড়ি গিছলাম। কাইল রাত্তিরে চুলের অবস্থা তো দ্যাখছেন। স্নানের দরকার ছিল। বাথরুম থেকে বারাইছি, কর্নেল ফোন করলেন। একটা সবুজ মারুতির নাম্বার দিলেন। মোটর ভেহিকেলসে আমার ভাগনা কাম করে। তার সাহায্যে মালিকের নাম-ঠিকানা যোগাড় করতে কইলেন। তো নাম্বার এক্কেরে মিলছে। তখনই ভাগনারে ফোন করছিলাম।
ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কফি খেতে খেতে হালদারমশাই টেলিফোন করলেন। হ। আমি কইতাছি… এক মিনিট। লিখিয়া লই। কও। …প্রবীর গুহ। অ্যাড্রেস… ছয় বাই ওয়ান ঘোষপাড়া লেন। কলিকাতা-১৩। কোন এরিয়া?… ধর্মতলা। ঠিক আছে। সইত্য। এক মিনিট। ব্ল্যাক অ্যাম্বাসাডারের নাম্বার দিছিলাম। বাঃ কও। অপূর্ব চন্দ্র। নব্বই কইলা? ..হ। নব্বই এ বিডন স্ট্রিট… দ্যাটস অল সইত্য। চিনি। রাখলুম।
বললুম, কালো অ্যাম্বাসাডারের মালিক অপূর্ব চন্দ্র। মানে ট্রেড ইউনিয়ন লিডার লালুবাবু?
আপনি চেনেন ওনারে?
চিনি। কিন্তু ওঁর গাড়ি থেকে মুন্দ্রাভবনে দুজন লোককে কাল রাতে নামিয়ে দিয়ে এল–এটা তো অদ্ভুত ব্যাপার। মিসেস মিত্তির তা হলে ঠিকই বলেছিলেন।
হালদারমশাই বললেন, কী কইছিলেন উনি?
সেনসায়েবের প্রথম স্ত্রী রমলাসংক্রান্ত ঘটনাটা জানিয়ে দিলুম হালদারমশাইকে। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, কর্নেল ক্ষুব্ধ হবেন না তো? নিজের হাতের তাস উনি সহজে কাকেও দেখাতে চান না। এমন কি আমাকেও না।
আমার কথা শুনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, জয়ন্তবাবু! খুব বড় চক্রান্ত! এক কোটি টাকার ভাগবণ্টন হইয়া গেছে। উদ্ধারের আশা বৃথা। কিন্তু স্যানসায়েবেরে কিডন্যাপের সাথে বর্মনসায়েবকে খুন করার কী সম্পর্ক?
সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।
গোয়েন্দাপ্রবর সিধে হয়ে বসে গোঁফে তা দিতে থাকলেন। আমিও দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টায় অঙ্ক কষতে শুরু করলুম।
কর্নেল ফিরলেন সওয়া ছটায়। হালদারমশাইকে দেখে তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনি সেনসায়েবের বেহালার গোডাউনের আশেপাশে ছিলেন শুনলুম। না–না। ভড়কে যাবার কারণ নেই। স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সাদা পোশাকে মোতায়েন ছিল। গৌতমবাবুর কাছে খবর পেয়েছি।
গোয়েন্দাপ্রবর তার নোটবই খুলে বললেন, সবুজ মারুতি আর ব্ল্যাক অ্যাম্বাসাডারের মালিকের নাম-ঠিকানা আমার ভাগনা সইত্যর লগে যোগাড় করছি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, আলিপুরে ভবানীভবনে বসে নামধাম পেয়ে গেছি। তবে আপনার খবরকে আমি বেশি গুরুত্ব দিই। সবুজ মারুতি সম্প্রতি কিনেছে ওরিয়েন্ট কেমিক্যাল কোম্পানির সেলস একজিকিউটিভ প্রবীর গুহ। সে কাল রবিবার সারাদিন সেনসায়েবের বাড়িতে ছিল। সেনসায়েব ফেরার পর বাড়ি যায়। বেহালা গোডাউন থেকে ফেরার পথে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভবানীভবনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার সামনে তাকে জেরা করা হচ্ছিল।
হালদারমশাই হতাশ ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আমি বললুম, আপনি জেরা করেননি–কেন সে আমাদের ফলো করেছিল?
কর্নেল হাসলেন। নির্দোষ উত্তর পেয়েছি। সেনসায়েব কিডন্যাপ হওয়ার কথা গোপন রাখা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে আমরা কেন বটুকবাবুর বাড়িতে গেছি এবং জয়ন্তই বা কেন সেনসায়েবের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে বিশেষ করে প্রেসমার্কা আমাদের গাড়ি। তাই সে ফলো করেছিল। জানতে চেয়েছিল, আমাদের কী পরিচয়। হ্যাঁ–পরিচয় সে পেয়েছে। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একজন খেয়ালি বুড়ো মানুষ। পাখি প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাস নিয়ে মাথা ঘামায়। আর জয়ন্ত চৌধুরি সাংবাদিক। কাজেই প্রবীর গুহ আর আমাদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এবার অবশ্য ঘামাবে।
হালদারমশাই বলার আগেই আমি বললুম, কালো অ্যাম্বাসাডারের মালিক–
তোমার পরিচিত লালুবাবু। তিনি ভি আই পি! অতএব গৌতমবাবুর সঙ্গে তাঁর বাড়ি গিয়েছিলুম। তার বক্তব্য, তিনি ক্লাবে ঢোকেন সন্ধ্যা ছটায়। বেরিয়ে আসেন রাত দশটায়। কাজেই তার ড্রাইভার ইসমাইলকে তিনি জেরা শুরু করলেন। ইসমাইল কবুল করল, তার গলতি হয়েছে। সিনেমা প্রোডিউসার অনিন্দ্য বসুরায়কে সে চেনে। সেই বাবুজি ক্লাব থেকে বেরিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে বলেন, তিনি আজ গাড়ি আনেননি। ট্যাক্সি করে এসেছেন। তার সঙ্গে এক জওয়ান লড়কা ছিল। ইসমাইলের মালুম, সায়েবের সে বডিগার্ড। তাদের দুজনকে সে মুন্দ্রাভবনের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে। তবে ইসমাইলের অবাক লেগেছিল। সায়েব আর তার বডিগার্ড একটা পোড়ো শুনসান বাড়িতে কেন ঢুকে গেলেন, সে বুঝতে পারেনি। এদিকে লালুবাবু বললেন, হ্যাঁ। তিনি অনিন্দ্যবাবুকে চেনেন। তাকে দেখেছিলেন ক্লাবে।
ষষ্ঠীচরণ কফি আর স্ন্যাক্স এনেছিল ইতিমধ্যে। কর্নেল কফিতে মন দিলেন। আমি আর হালদারমশাইও কফি খেতে থাকলুম। হালদারমশাইয়ের পোটাটো চিপস আর চানাচুর খাওয়ার ভঙ্গি দেখে বুঝলাম, তিনি ক্ষুধার্ত।
কফি খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, বটুকবাবুর অফিস হয়ে আলিপুর ভবানীভবনে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে অরিজিতের সাহায্যে পুলিশ কমিশনার আচার্যসায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলুম। মিঃ আচার্য সেনসায়েবকে রিং করে রাত আটটায় আমাদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছেন। আমার প্রোগ্রাম ছিল সাতটায় বেরিয়ে জয়শ্রী স্টুডিয়োতে গোপালবাবুর কাছে। যাব। ওঁকে জানিয়ে দিয়েছি, আজ সন্ধ্যায় আর যাচ্ছি না। কাল জানিয়ে দেব, কখন জয়শ্রীতে যাব।
হালদারমশাই বললেন, রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুম কী?
কর্নেল হাসলেন। মুন্দ্রাভবনে ওরিয়েন্টাল কেমিক্যাল কোম্পানির স্টোর সেকশনের আদিত্যবাবু বলছিলেন, রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুমের কথা তিনি জানেন না। এ বি সি এই তিনটি গ্রেডের মাল আছে। এ গ্রেডের মাল যায় আরবমুলুকে। ওদিকে বটুকবাবুর মুখে শুনেছি হিতেশ্বর দেববর্মন তাঁকে রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুম পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। এখন কথা হলো, রেডক্রশ একটা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতীক। তা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে না। কাজেই আমার ধারণা আকাশকুসুম তেলের পেটিতে আঁকা রেডক্রশ ওই রেডক্রশ নয়। সম্ভবত ওই ধরনের কোনও চিহ্ন। ঠিক রেডক্রশ বলতে আমাদের চোখে যা ভেসে ওঠে, তা নয়।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, …কে ব্রাদার? আমার টাকের প্রতি তোমার সুনজর কেন?… আহা, এই বুড়ো মানুষকে বুড়ো বলতেই পারো। কিন্তু…শোনো ব্রাদার। এক্সচেঞ্জে পুলিশ আড়ি পেতে রেখেছে। এক্ষুণি ধরা পড়ে যাবে।… হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
কর্নেল রিসিভার রাখলেন। আমি ও হালদারমশাই একসঙ্গে বলে উঠলুম, থ্রেটনিং?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, বুঝি না। লোকেদের আমার টাকের ওপর কেন এত রাগ?
গোয়েন্দাপ্রবর গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার টাকের নিচে যে কোটি টাকার ব্র্যান।
এমন মুহূর্তেও ব্র্যান শুনে আমি হাসি আটকাতে পারলুম না। অথচ আমার মনে তখন চাপা আতঙ্ক।…
.
০৮.
কর্নেলের বাড়ির লনে পার্কিং জোন থেকে আমার গাড়ি সরিয়ে আনার সময় সেই আতঙ্ক আমাকে পেয়ে বসেছিল। তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। শুধু ভাবছি কোনও আততায়ী আড়াল থেকে গুলি ছুঁড়লেই হলো; তার তো অবাধ সুযোগ। কিন্তু রাস্তায় নেমে লক্ষ্য করলুম, পুলিশের এক লাল জিপ আমাদের সামনে এসে গেল। রিয়ারভিউ মিররে পিছনে একটা পুলিশভ্যানও দেখতে পেলুম। বুঝতে পারলুম, উড়ো ফোনের হুমকি শোনার আগে কর্নেল পুলিশ এসকর্টের ব্যবস্থা করেই বাড়ি ফিরেছিলেন।
আটটার আগেই আমরা সেনসায়েবের বাড়ির গেটে পৌঁছে গেলুম, সেখানে আর একটা পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে আছে দেখলুম। পুলিশের লাল জিপ আগে গেটের ভেতর ঢুকল। তার পেছনে আমাদের গাড়ি। বিলিতি স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি বাংলোর সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা নেমে গেলুম।
বারান্দায় এক ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা করে ঘরে ঢোকালেন। লাল জিপ থেকে দুজন পুলিশ অফিসার এবং চারজন সশস্ত্র কনস্টেবল নেমে বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রশস্ত ঘরে আধুনিক আসবাব সাজানো এবং মেঝে কার্পেটে ঢাকা। আমরা একটা সোফায় বসলুম। একটু পরে বাইরে গাড়ির শব্দ শুনলুম। ঘরে ঢুকলেন ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি। তারপর এলেন বটুক মিত্তির। তিনি এসে তাড়া দিলেন, নরেন! গেস্টদের জন্য চা-কফির ব্যবস্থা করো শিগগির।
সেই ভদ্রলোক বললেন, সব রেডি মিত্তিরমশাই।
বুঝলুম ইনিই কেয়ারটেকার নরেনবাবু। উর্দিপরা দুজন পরিচারক পাশের ঘর থেকে ট্রেতে পটভর্তি চা-কফি, প্লেটভর্তি স্ন্যাক্স আর দামি কাপপ্লেট ইত্যাদি আমাদের সামনের টেবিলে রেখে গেল। ইতিমধ্যে আরও দুজন পুলিশ অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ডিটেকটিভ সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ভদ্র ঘরে ঢুকলেন।
তারপর ভেতর দিকের দরজা দিয়ে সেনসায়েবের পি এ বরুণ রায় ঢুকে নমস্কার করে বলল, এখনই মিঃ সেন আসছেন। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
মিনিট পাঁচেক পরে দুজন ভদ্রলোকের কাঁধে হাত রেখে লম্বা, ফর্সা এবং সুদর্শন বি কে সেন ঘরে ঢুকে সবাইকে নমস্কার করলেন। তাকে দেখামাত্র আমার চিনতে দেরি হয়নি। কারণ তার ওইভাবে অন্যের সাহায্যে ঘরে ঢোকার দৃশ্য কল্পনা করেই রেখেছিলুম। তার চেহারা ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক। কিন্তু চোখের তলায় কালচে ছোপ। তাকে দুর্বল দেখাচ্ছিল।
আমাদের সামনাসামনি তিনি বসার পর ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি প্রথমে কর্নেল পরে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। বাদ পড়লেন শুধু হালদারমশাই। কিন্তু কী আর করা যাবে। লক্ষ্য করলুম, তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে সেনসায়েবকে দেখছেন।
কর্নেল বললেন, আপনার শারীরিক অবস্থার কথা জানি মিঃ সেন। তা সত্ত্বেও আপনার মুখোমুখি হওয়ার খুব প্রয়োজন ছিল। আপনি দেশের একজন খ্যাতনামা শিল্পপতি। প্রতিষ্ঠান চালাতে আপনাকে অন্যদের প্রতি নির্ভর করতে হয়। কাজেই আপনার অজ্ঞাতসারে যদি কিছু ঘটে, সেজন্য আপনাকে দায়ী করা যায় না।
সেনসায়েব আস্তে বললেন, আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
প্লিজ মিঃ সেন। সবই বুঝতে পারবেন। শুধু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাইছি।
বলুন।
আগরতলার মিঃ হিতেশ্বর দেববর্মন আপনার শ্যালক ছিলেন?
হ্যাঁ। শুনলুম, কেউ তাকে হোটেল কন্টিনেন্টালে মার্ডার করেছে। ফ্র্যাংকলি বলছি, মাঝে মাঝে আমার নিজেরই ইচ্ছে হতো, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিই। ইস্টার্ন রিজিয়নে আমার কোম্পানির কোনও ডিস্ট্রিবিউটর পাইনি তারই জন্য। বটুকবাবুর কাছ থেকে সে গোপনে আমার কোম্পানির প্রডাক্ট কিনত। বটুকবাবুকে আমি নিষেধ করেছিলুম। হিতেশ্বরের কাকা একজন মিনিস্টার। শিল্পমন্ত্রী। তাই হিতেশ্বর ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল।
কর্নেল বললেন, কথা বলতে আপনার কষ্ট হচ্ছে মিঃ সেন। তাছাড়া এ সব তথ্য আমাদের হাতে আছে। আপনি শুধু সংক্ষেপে উত্তর দিলেই চলবে।
হু। বলুন।
আকাশকুসুম তেল আপনার কোম্পানির নতুন প্রডাক্ট।
হ্যাঁ। ডানকুনিতে আমার কারখানা আছে। ল্যাব আছে। বাছাই করা একদল কেমিস্ট আছে। তাদের যৌথ উদ্ভাবনা।
আপনি কি জানেন আকাশকুসুম তেলের গ্রেডেশন আছে?
তেলের কোয়ালিটি এক। গ্রেডেশন করা হয়েছে তেলের আধার নিয়ে। সাধারণ কাঁচের বোতল সি গ্রেড। বি গ্রেড হাই কোয়ালিটির প্লাস্টিক
আকাশকুসুমের কোনও আধারে কি রেডক্রশ মার্কা লেবেল আছে?
সেনসায়েব একটু উত্তেজিত ভাবে বললেন, রেডক্রশ? অ্যাবসার্ড। রেডক্রশ মার্ক ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। ইন্ডিয়ান রেডক্রশ সোসাইটির সঙ্গে আমি যুক্ত। রেডক্রশ আমি নিজের কোম্পানির প্রডাক্টে ব্যবহার করতে পারি না। দ্যাট ইজ অ্যাবসোলিউটলি ইললিগ্যাল, ইউ নো।
ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি বললেন, আপনার বেহালার গোডাউন থেকে কিছুক্ষণ আগে কিছুটা রেডক্রশের মতো লাল ক্রশ আঁকা তিনটে পেটি আমরা আটক করেছি। তাতে বিদেশি ফায়ার আর্মসের পার্টস ভর্তি ছিল।
হোয়াট?
হ্যাঁ মিঃ সেন। আপনার চিফ সেলস একজিকিউটিভ প্রবীর গুহকে আমরা হাতেনাতে ধরে ফেলেছি। তিনি ওই পেটিগুলো ইস্টার্ন রিজিওনে একটা ট্রেডিং এজেন্সির নামে পাঠাচ্ছিলেন। হি ইজ অ্যারেস্টেড।
সেনসায়েব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। বটুকবাবু বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ!
কর্নেল বললেন, আপনার শ্যালক মিঃ দেববর্মন বটুকবাবুকে রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুম তেলের কয়েকটা পেটি তাঁকে সাপ্লাইয়ের অনুরোধ করেছিলেন। তাই না বটুকবাবু?
বটুকবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি তো শুনে অবাক। এতক্ষণে বুঝলুম, ওঃ! কী সাংঘাতিক!
মিঃ দেববর্মন ইস্টার্ন রিজিয়নে প্রভাবশালী বিজনেসম্যান। কোনও বিশ্বস্তসূত্রে তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল, ওই বিশেষ পেটিতে আগ্নেয়াস্ত্রের পার্টস জঙ্গিদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। জঙ্গিরা সমরাস্ত্র চড়া দামে কেনে, এটা জানা কথা। তারা এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে নানাভাবে কোটি কোটি টাকা আদায় করে, এ-ও জানা কথা। কিন্তু মিঃ দেববর্মন তার ভগ্নীপতিকে বিপদে ফেলার জন্য হোক, কিংবা নিজে অস্ত্রপাচারের কারবারের স্বার্থেই হোক, কলকাতার জনৈক পি রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
সেনসায়েব উত্তেজিতভাবে বললেন, আমার কোম্পানিতে এ সব সাংঘাতিক ব্যাপার চলেছে, অথচ আমি জানি না! বরুণ!
তার পি এ বরুণ বলল, স্যার?
গত মাসে আমার কোম্পানির নামে জাল প্রডাক্ট কারা বাজারে ছেড়েছে, তা জানার জন্য তোমাকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, কোনও প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাহায্য নেবে।
নিয়েছিলুম তো স্যার। জালিয়াত চক্র ধরাও পড়েছিল।
কিন্তু সো-কল্ড রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুম তেলের পেটিতে কী সাংঘাতিক কারবার চালানো হচ্ছে, তুমি টের পাওনি?
না স্যার!
ওয়ার্থলেস! আমি তোমাকে স্যাক করতে বাধ্য হচ্ছি। গেট আউট ইউ ফুল।
বরুণ বেরুতে যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, এক মিনিট বরুণবাবু। আপনি কি মিঃ দেববর্মনকে চিনতেন?
বরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমার সঙ্গে উনি কন্ট্যাক্ট করেছিলেন। আমি পাত্তা দিইনি।
শনিবার মর্নিংয়ে মিঃ দেববর্মন হোটেল কন্টিনেন্টালে এসে আপনাকে আপনার বাড়িতে টেলিফোন করেছিলেন। হোটেল কন্টিনেন্টালে বোর্ডারদের কলচার্জ বুকে তার প্রমাণ আছে। আপনার বাড়ির ফোন নাম্বার বলছি। কর্নেল তার খুদে নোটবই বের করে নাম্বারটা আওড়ালেন।
বরুণ স্মার্ট ভঙ্গিতে বলল, বললুম তো! হি অলয়েজ ট্রায়েড টু কন্ট্যাক্ট মি।
ফোন পেয়ে আপনি সকাল সাড়ে নটায় হোটেল কন্টিনেন্টালে তাকে মিট করেন। ভিজিটরস বুকে এর প্রমাণ আছে। আপনি পি রায় নাম লিখেছিলেন।
অ্যাবসার্ড। ড্যাম লাই।
কর্নেল পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করে বললেন, মিঃ দেববর্মনের ব্রিফকেসের তলায় গোপনে এই চিঠি দুটো রাখা ছিল। দেখুন তো, হাতের লেখা চিনতে পারেন কি না।
বরুণ চিঠি দুটো নিতে চেষ্টা করল। কর্নেল বললেন, পড়ে দেখুন! এই হাতের লেখা কার?
আমার নয়। সাম পি রায় সই করেছে।
বটুকবাবু তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তার হাতের ব্যাগ থেকে কয়েকটা টাইপকরা চিঠির পাশে এবং তলায় হাতে লেখা নোট দেখিয়ে বললেন, বরুণ! পি রায়ের লেখা আর তোমার লেখা হুবহু এক। পি রায় মানে তুমি। বি রায়। ইজ ইকোয়াল টু পি রায়।
কর্নেল গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, বরুণ রায়! হিতেশ্বর দেববর্মনকে হুইস্কির সঙ্গে ড্রাগ মিশিয়ে খাইয়ে তুমি তারই রিভলভারে তাকে খুন করেছ। অরিজিৎ! অ্যারেস্ট হিম।
বরুণ ভেতরের দরজার দিকে পালাতে যাচ্ছিল। সেই দরজার পর্দা তুলে দুজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকে তাকে ধরে ফেললেন এবং হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। বরুণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলল, এটা চক্রান্ত। মিঃ সেন। আপনার ফ্যাক্টরির ট্রেড ইউনিয়ন লিডার সুহাস ভৌমিকের চক্রান্ত। সে আপনাকেও ফাসাতে চায়।
ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ি বললেন, এতক্ষণ ডানকুনি ফ্যাক্টরিতে পুলিশ-সার্চ চলেছে। আশা করি, আজ রাত্রেই সুহাস ভৌমিককে অ্যারেস্ট করা হবে।
বরুণ দমে গেল না। বাঁকা হেসে বলল, হিতেশ্বর দেববর্মনকে আমি যে খুন করেছি, তার প্রমাণ দিতে পারবেন?
অবশ্যই। কাল রবিবার হোটেল কন্টিনেন্টালের ভিজিটরস বুকে বেলা দুটো দশ মিনিটে পি রায় নামে আবার আপনি ৬০২ নাম্বার স্যুইটে মিঃ দেববর্মনকে দেখা করার জন্য সই করেছিলেন। রিসেপশনিস্ট মিস চান্দ্রেয়ী এবং বারের ওয়েটার স্যামুয়েল আপনাকে আইডেন্টিফাই করেছে আপনার ফোটো দেখে। আপনার ফোটো আমরা পেয়েছি বটুকবাবুর কাছে। যথাসময়ে পি টি প্যারেডে ওরা আপনাকে শনাক্ত করবে।
বটুকবাবু অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, মিঃ সেনের মেয়ের বিয়ের পর পার্টিতে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছিলে। সেই পার্টির ফোটো এক কপি করে আমাকে তুমিই ফোটোগ্রাফারের কাছ থেকে যোগাড় করে নিতে বলেছিলে। মনে পড়ছে? বারো কপি ফোটো আমার কাছে আছে। তার মধ্যে তোমার ফোটো আছে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তোলা ফোটোগ্রাফটা খুব স্পষ্ট। সেটা আমি কর্নেলসায়েবকে আজ দিয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন, বরুণ রায়! মিঃ দেববর্মন রেডক্রশ মার্কা আকাশকুসুমের পেটিতে কী পাচার করা হয়, তা জানতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর চিরতরে মুখ বন্ধ করার দরকার ছিল তোমার। হা–তোমারই। কারণ তুমি বাঙালি হলেও অসমের হোজাই শহরে তোমার বাড়ি। ছাত্রজীবনে জঙ্গিগুপে তুমি জড়িত ছিলে। তাই তোমাকে পুলিশের তাড়া খেয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। মিসেস রুচিরা সেনের তুমি সহপাঠী ছিলে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটিতে। মিসেস সেন তোমাকে তার স্বামীর পি এ পদে চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন।
এই সময় আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। পর্দা তুলে এক সুন্দরী মহিলা ঢুকে বরুণের দিকে তর্জনী তুলে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ইউ ডার্টি ডগ! ট্রেচারার! তুমিই আমার হাজব্যান্ডের পেছনে একজন ফিল্ম অ্যাকট্রেসকে লাগিয়ে রেখেছিলে। আমার হাজব্যান্ডকে আমি দোষ দেব না। শি ইজ আ হোর। এমন গায়েপড়া। মেয়েকে কোনও পুরুষমানুষই এড়িয়ে চলতে পারে না। তোমার ফিল্মে নামা এবং হিরো হওয়ার অ্যাম্বিশন আমাকে কতবার বলেছ। এমন কি আমার হাজব্যান্ডকে যেন আমি ফিল্ম প্রোডিউস করার পরামর্শ দিই, এমন কথাও বলেছ। অ্যান্ড ইউ ট্র্যাপড় মাই ফুলিশ হাজব্যান্ড অ্যান্ড কিডন্যাপড হিম।
সেনসায়েব হাত তুলে স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শনিবার রাত্রে ক্লাবে আমি একটু ড্রাংক হয়ে পড়েছিলুম। তাই বাড়ি ফিরিনি। বরুণকে মুলাভবনে পৌঁছে দিতে বলেছিলুম। আমি ওকে আমার গাড়ি এ বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে দোতলায় আমার ঘরে ঢুকেছিলুম। একটু পরে কুন্তলা আর তার স্বামী অনিন্দ্য এল। আবার ড্রিঙ্কের আসর বসল। তারপর কী হয়েছিল আমার মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরল, শরীর দুর্বল। দুটো মুখোশপরা লোক ফায়ার আর্মস আর ভোজালি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল।
কর্নেল বললেন, সব আমরা জানি। আপনি এখন বিশ্রাম করুন গিয়ে। মিসেস সেন! আপনার স্বামীকে নিয়ে যান। আপাতত আমাদের কাজ শেষ। তবে এই দেখুন সেই মুখোশ।
সেনসায়েব বললেন, হ্যাঁ। চিনতে পারছি।
ফেরার পথে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম, সবই বোঝা গেল। কিন্তু মিঃ দেববর্মন কেন হালদারমশাইকে হায়ার করে মুন্দ্রাভবনে শনিবার রাত্রে গোয়েন্দাগিরি করতে পাঠিয়েছিলেন।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! জয়ন্তের কিছু মনে থাকে না। তাই না?
হালদারমশাই বললেন, ক্যান? কইছিলাম না? বর্মনসায়েব সেই ফিল্ম অ্যাকট্রেসের ঠিকানা যোগাড় করতে কইছিলেন। সেনসায়েব নাকি সে স্ত্রীলোকের সাথে ফুর্তিফার্তি করেন। রবিবার যখন বর্মনসায়েবেরে মিট করলাম, উনি লাঞ্চ খাওয়াইয়া আমার বাকি ফি পেমেন্ট করলেন। আর য্যান উনি ব্যাপারটা পাত্তা দিতে চাইলেন না। তাই কর্নেলসায়েবেরে কইলাম না? দিস ইজ ভেরি মিসটিরিয়াস!
বললুম, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। তবে আমার প্রশ্ন, বুর্মনসায়েবের এই আচরণ সত্যিই রহস্যজনক।
কর্নেল বললেন, মৃতেরা কথা বলে না। তবে এটা মোটেই রহস্যজনক নয়। শালা-ভগ্নীপতির মধ্যে শত্রুতা ছিল। কুন্তলা চৌধুরির ঠিকানা যোগাড় করে সম্ভবত বোনকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতেন। কিংবা নিজেই কুন্তলার সঙ্গে সেনসায়েবের সম্পর্কের কথা তুলে সেসায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতেন। কাজেই এটাতে কোনও রহস্য নেই। শত্রুতা থাকলে প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য জেদ চাপে মাথায়।
বরুণ বর্মনসায়েবকে খুন করে হোটেলের লাউঞ্জ থেকে একজনকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। লোকটাকে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে সে বর্মনসায়েবের স্যুইটে গিয়েছিল। এই লোকটার পরিচয় পেয়েছেন?
তার পরিচয় বরুণের কাছ থেকে পুলিশ বের করে নেবে। এই লোকটা বরুণের সঙ্গে গিয়েছিল মাত্র। তার সঙ্গে মূল কেসের সম্পর্ক নেই।
কিন্তু শনিবার রাতে সেনসায়েবকে মুদ্রাভবনে বরুণ পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর তার মারুতি কন্টেসা গাড়ি একজন অচেনা লোক সেনসায়েবের বাড়ির গেটে পৌঁছে দেয়। সেনসায়েবকে কিডন্যাপ করা হয়েছে বলে এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে লেখা চিঠিটা সেই অচেনা ড্রাইভারই পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়ে। কে সে?
আমি অন্তর্যামী নই ডার্লিং! কর্নেল হেসে উঠলেন। এই কেসের মূল আসামি বরুণ। তার বিরুদ্ধে দুটো চার্জ। সেনসায়েবকে অপহরণের চক্রান্তে সে জড়িত ছিল। কুন্তলা চৌধুরিকে সে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। দ্বিতীয় চার্জ আরও সাংঘাতিক। নরহত্যা! দেববর্মনের মুখ বন্ধ না করলে হয়তো তিনি তার বোনের মাধ্যমে সেনসায়েবকে অস্ত্রপাচারের কারবার জানিয়ে দেবেন, এই আতঙ্কের দরুন বরুণ দেববর্মনকে খুন করেছিল। ক্লিয়ার?
বললুম হ্যাঁ। কিন্তু০০
কিন্তু-টিন্তু আর নয় জয়ন্ত। শনিবার সকালে দেববর্মন হোটেল কন্টিনেন্টালে পৌঁছে বরুণকে টেলিফোন করেন। ভিজিটরস বুক খুঁজে তথ্য পাওয়া গেছে, সকাল নটা তিরিশে বরুণ ওঁর সঙ্গে ৬০২ নাম্বার স্যুইটে দেখা করে। তারই দুটো চিঠিতে প্রমাণ পাওয়া গেছে, দেববর্মনের সঙ্গে চুরম বোঝাপড়ার জন্য সে তৈরি ছিল। শনিবার সকালে সে দেববর্মনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এমন কিছু আঁচ করেছিল, যাতে সে সিদ্ধান্ত নেয়, সেনসায়েবের শ্যালকের মুখ বন্ধ করতেই হবে। কিন্তু এ কাজের জন্য তার অনুচরদের সঙ্গে পরামর্শের দরকার ছিল। নরহত্যার ঝুঁকি নিতে হলে তার পৃষ্ঠরক্ষার প্রয়োজন থাকা স্বাভাবিক। সে ডানকুনি কারখানার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সুহাস ভৌমিক, সেলস একজিকিউটিভ প্রবীর গুহ, অনিন্দ্য বসুরায় এবং অস্ত্রপাচার চক্রের আরও কিছু লোকের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। তারপর একজনকে সঙ্গে এনে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে সে দুটো দশে হিতেশ্বর দেববর্মনের সুইটে যায়। আমার সামনে এই চিত্রটা স্পষ্ট। অপেক্ষা করো। এই চিত্র তুমিও নিজের চোখে দেখতে পাবে।..
.
ইলিয়ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এক দফা কফি খাওয়ার পর কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।… হ্যাঁ জানি আপনি এখন বাড়িতে আছেন।… বলুন। …আপনি সিওর? মানে আপনার সোর্স–সেই আসল লোক… ঠিক আছে। বলুন। …এয়ারপোর্ট হোটেল? সুইট নাম্বার ৪১? ফর্টি ওয়ান?… থার্ড ফ্লোর? ..ফ্লাইট নাম্বার সেভেন ফোর টু। রিপোর্টিং টাইম ফোর থার্টি ও ক্লক। …ট্রাভেল এজেন্টের নাম? …হ্যাঁ। লাকি ট্রাভেল এজেন্সি। …ঠিক আছে। এই যথেষ্ট! ধন্যবাদ গোপালবাবু। উইশ ইউ গুড লাক! এগেন থ্যাঙ্কস।
ফোন রেখে কর্নেল তার খুদে নোটবইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললুম, জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবু?
হালদারমশাই গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। উত্তেজনায় গোঁফ তিরতির করে কাঁপছিল। তিনি বললেন, আই অ্যাম রেডি কর্নেলস্যার। এয়ারপোর্ট হোটেল মানে দমদম তো? চলেন।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, এই শীতের রাত্রে আর বেরিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বড় কথা, আমরা আইনত কাকেও গ্রেফতার করতে পারি না।
বললুম অনিন্দ্য বসুরায় আর কুন্তলা চৌধুরি বোম্বে পালায়নি এখনও?
আজকাল প্লেনে সিট পাওয়া তত সোজা নয়, জয়ন্ত! ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হয়। কনফার্মড় টিকিট পাওয়া অনিশ্চিত! ট্রাভেল এজেন্টরা অবশ্য কখনও-সখনও ম্যানেজ করে দেয়।
বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে আস্তেসুস্থে। ডায়াল করলেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি… না, না। আমার কৃতিত্ব নয় মিঃ আচার্য। থ্যাঙ্কস্। প্লিজ লিন। কুন্তলা চৌধুরি… হ্যাঁ, ফিল্মস্টার। তার স্বামী প্রোডিউসার অনিন্দ্য বসুরায়ের সঙ্গে মর্নিং ফ্লাইটে বোম্বে যাচ্ছে। …না। এখনও যেতে পারেনি। এয়ারপোর্ট হোটেল। স্যুইট নাম্বার ফর্টি ওয়ান। ..হ্যাঁ। এখনই। …না মিঃ আচার্য। স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডি সি গৌতম দত্তকে মেসেজ দিন। এয়ারপোর্ট পুলিশ ব্যাকগ্রাউন্ড জানে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেনসায়েবের এক কোটি টাকা ওদের লাগেজ সার্চ করলে পাওয়া যাবে। .না। বরুণ রায় অ্যান্ড পার্টি বখরা পায়নি। মানে, বখরার সময় পায়নি। …গুড নাইট মিঃ আচার্য।.
.
সেই রাত্রে কর্নেলের ড্রয়িংরুমে বসে বিস্তারিত রোমহর্ষক স্টোরি লিখে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে হাজির হয়েছিলুম। নাইট এডিটর স্টোরি পেয়েই প্রথমে চিফ অব দ্য নিউজব্যুরো–আমাদের প্রিয় সত্যদাকে টেলিফোনে জানালেন। সত্যদা জানালেন চিফ এডিটরকে। রাত সাড়ে বারোটায় চিফ এডিটর বাড়ি থেকে অফিসে ছুটে এলেন। রাত তিনটের মধ্যে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা আরও এক লাখ কপি বেশি ছাপা হয়ে গেল। একটা অ্যাডভান্স কপি নিয়ে সল্টলেকে বাড়ি পৌঁছুলুম ভোর চারটে নাগাদ।
আট কলম হেডিং বেরিয়েছিল পয়েন্ট সেভেনটি টু হরফে। আন্তর্জাতিক অস্ত্রপাচার চক্র ধৃত। মাথায় চিফ এডিটরের নির্দেশে লাল কালিতে ছাপা ছত্রিশ পয়েন্ট হরফে : ‘আকাশকুসুম রহস্য : প্রথম পর্ব’।
হালদারমশাই এ-রাত্রে কর্নেলের অতিথি ছিলেন।
সকাল দশটায় টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। রিসিভার তুলে যথারীতি বলেছিলুম, রং নাম্বার।
রাইট নাম্বার ডার্লিং।
কর্নেল! দৈনিক সত্যসেবক দেখেছেন? এক্সক্লুসিভ স্টোরি। আর কোনও কাগজ খবর পায়নি।
চলে এস জয়ন্ত। আকাশকুসুম রহস্যের দ্বিতীয় পর্বের মালমশলা পেয়ে যাবে।
প্রথম পর্বে সংক্ষিপ্ত স্টোরি আছে দ্বিতীয় পর্বে গোড়া থেকে শুরু করব।
সেইজন্যই বলছি চলে এস। চক্রের নিচের তলার লোকেরা ধরা পড়েছে। আর শোনো, বটুকবাবু এক হাঁড়ি উৎকৃষ্ট রাবড়ি নিয়ে তোমার অপেক্ষা করছেন।…