আকবরের জীবনী
পুত্রে পিতার গুণ বর্তে, সৰ্ব্বদৃষ্টান্তে ইতিহাস এ কথা সপ্রমাণ করে না। বাবরশাহ যে সকল গুণে অলঙ্কৃত ছিলেন, উপযুক্ত হইলেও হুমায়ুন সে সকল গুণের সম্পূর্ণ উত্তরাধিকারী হন নাই। বাবর যে সকল রাজ্য জয় করিয়া যান, হুমায়ুন সুশৃখলাপ তাহার ব্যবস্থা করিতে পারেন নাই। সন্ধিবিগ্রহে-মিত্রলাভে হুমায়ুনের দক্ষতা কিছু কম ছিল; শত্রুও অনেক হইয়াছিল। ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে সেরখা শূর নামক একজন বীরপুরুষ কনোজ নগরে হুমায়ুনকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। পরবৎসর জানুয়ারী মাসে হুমায়ুন সিন্ধুনদকূলে রোরী নামক স্থানে আশ্রয় প্রাপ্ত হন। সঙ্গে কেবল কতিপয় সুহৃদৃমাত্র ছিল, রাজ্যসম্পদ সমস্ত হারাইয়া বাদশাহ হুমায়ুন ভিখারীর ন্যায় পরগৃহে বাস করিতে থাকেন।
সিন্ধুপ্রদেশে সাদ্ধ দুই বৎসর অতীত হয়। ঐ প্রদেশ অধিকার করিবার অভিলাষে হুমায়ুন অনেক প্রকার প্রয়াস পাইয়াছিলেন, সমস্তই বিফল হইয়া যায়। ১৫৪২ অব্দের অক্টোবর মাসের পঞ্চদশ দিবসে তাহার একটী পুত্রসন্তান জন্মে। সেই পুত্রের নাম জালাল উদ্দীন মহম্মদ আকবর। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই আকবর শাহ সৰ্বগুণাক্তৃত মোগল-সম্রাট অভিধানে অভিহিত। অতএব এই বিষয়ের কিঞ্চিৎ বাহুল্যবৰ্ণন আবশ্যক।
হুমায়ুনের ভ্রাতা হিন্দন যে সকল উপায় নির্দেশ করিয়াছিলেন, হুমায়ুন তাহাতে উপেক্ষা করিয়া বরং ভাতার প্রতি অবিশ্বাস করেন। তাহার পর সিন্ধুর বিংশতি মাইল দূরবর্তী পাওর নগরে উভয় ভ্রাতায় যখন সাক্ষাৎ হয়, তৎকালে হিন্দন আপন পারিষদ্বর্গে পরিবেষ্টিত হইয়া রাজসম্মানে ভ্রাতার অভ্যর্থনা করিতে প্রস্তুত ছিলেন। এক মাতার গর্ভে উভয়ের জন্ম হয় নাই। হিন্দনের জননী হুমায়ুনের অভ্যর্থনার সময় রাজপুরীর সমস্ত মহিলাকে আমন্ত্রণ করেন, সেই সকল মহিলার মধ্যে হামিদা নামিকা একটী সুন্দরী যুবতীর প্রতি হুমায়ুনের দৃষ্টি নিপতিত হয়। কেবল দৃষ্টিমাত্র নহে, অনুরাগের সঞ্চার বলিলেও কল্পনার কথা বলা হয় না। হামিদার পিতা হিন্দনের উপদেষ্টা গুরু। হামিদাকে দর্শন করিয়া হুমায়ুন আগ্রহ সহকারে জানিতে চাহেন যে, যুবতীর বিবাহ হইয়াছে কি না? সে প্রশ্নে তিনি এই উত্তর প্রাপ্ত হন যে, সম্বন্ধ হইতেছে, কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত কোন প্রকার বৈবাহিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় নাই। হুমায়ুন কহিলেন, “তবে আমি ঐ কন্যাকে বিবাহ করিব।”
হিন্দন আপত্তি করিলেন। তিনি কহিলেন, “হঠাৎ যদি এ বিষয়ে এ প্রকার কতসংকল্প হওয়া যায়, তাহা হইলে উভয় ভ্রাতার আর মিলন থাকিবে না।” এই উপলক্ষে যথার্থই উভয় ভ্রাতার বিরোধ উপস্থিত হয়, কিন্তু হিন্দনের জননী ঐ বিবাহের পক্ষপাতিনী হইয়া উভয় ভ্রাতার পুনর্মিলন সংস্থাপন করেন। যেদিন পুনর্মিলন হয়, তাহার পরদিবস হামিদাবিবির সহিত হুমায়ুনের শুভ-পরিণয় সুসম্পন্ন হইয়া যায়। হামিদার বয়ঃক্রম তখন পূর্ণ চতুর্দশ বৎসর। বিবাহের অল্পদিন পরে নবদম্পতি বক্করের সম্মুখস্থিত শিবিরে উপস্থিত হন।
তখনও হুমায়ুনের যুদ্ধের আয়োজন চলিতেছিল। কল্পনার অপরিপক্বতা নিবন্ধন সঙ্কল্পিত বিষয়ে তিনি পূর্ণমনোরথ হইতে পারেন নাই। ১৫৪২ অব্দের বসন্তকালে যুবতী পত্নীকে লইয়া তিনি মারোয়ারের মরুভূমিতে পলায়ন করেন। আগষ্ট মাসে তাহারা যশল্পীর-রাজ্যে উপস্থিত হন। যশল্পীরের অধিপতি তাহাদিগকে আশ্রয় দানে অসম্মত হওয়াতে তথা হইতে তাড়িত হইয়া তাঁহারা বহুকষ্টে মরুভূমি পার হইয়া ক্ষুধায় পিপাসায় কাতর হইয়া ২২-এ আগষ্ট তারিখে অমরকোট-দুর্গে উপস্থিত হন। অমরকোটের রাণা পরমসমাদরে তাহাদিগকে অভ্যর্থনা করেন। সেই স্থানে ১৫ই অক্টোবর রবিবার হামিদাবেগম একটী পুত্রসন্তান প্রসব করেন। সেই পুত্রই ভাগ্যধর আকবর।
পুত্রের জন্মের চারিদিন পূর্বে একটী প্রদেশ জয় করিবার অভিলাষে হুমায়ুন অমরকোট হইতে স্থানান্তরে গিয়াছিলেন, তথায় এই শুভসংবাদ প্রাপ্ত হন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া আমীরগণকে আমন্ত্রণ করিয়া আকবরের পিতা পরমানন্দ প্রকাশ করেন। আমীরেরাও মঙ্গলাচরণ করিয়া আনন্দিত হন। সেই সময় তেজকেরা-পলবকিয়াত-গ্রন্থের প্রণেতা জৌহরকে আহ্বান করিয়া হুমায়ুন জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহার হস্তে কি কি বস্তু সমর্পিত আছে। জৌহর উত্তর করিলেন, দুইশত সারুফী (খোরাসানী স্বর্ণমুদ্রা), একটী রজতনিৰ্মিত রিষ্টলেট আর একটী মৃগনাভির আধার। কিন্তু সেই সকল স্বর্ণমুদ্রা আর রিষ্টলেটটী পূৰ্বাধিকারিগণকে প্রত্যাপিত করা হইয়াছে। হুমায়ুন তখন মৃগনাভির আধারটী আনয়ন করিতে বলেন। আনীত হইলে একখানি চীনের বাসনের উপর উহা ভাঙিয়া পুত্রের জন্মোৎসবের উপঢৌকন স্বরূপ আপন পারিষদবর্গকে সেই মৃগনাভিগুলি বণ্টন করিয়া দেন। জৌহর বলেন, জগতের সমস্ত জনপদে সেই সকল মৃগনাভি পরিব্যাপ্ত হওয়াতে সর্বস্থল সুগন্ধে আমোদিত হইয়াছিল।
পুত্রজননে অতিশীঘ্র পিতার সৌভাগ্য সমুদিত হয় নাই। ১৫৪৪ অব্দের জুলাই মাসে হুমায়ুন সিন্ধুপ্রদেশ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হন। সঙ্গে থাকেন বেগম, শিশুপুত্র আর কতিপয় অনুচরমাত্র। কান্দাহারে যাত্রা করিবার অভিলাষ। শালনামক স্থানে উপস্থিত হইয়া হুমায়ুন শুনিলেন, তাঁহার ভ্রাতা আজুকারী বহুতর সৈন্যসামন্ত লইয়া যুদ্ধসজ্জা করিয়া আছেন। অবিলম্বেই যুদ্ধসংঘটন অনিবাৰ্য সে বিরোধে দম্পতি প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু পুত্রটি কোথায় থাকিবে? সবেমাত্র একবৎসর বয়স; অশ্বারোহণে শীঘ শীঘ্র পরিভ্রমণে অক্ষম। বিশেষত সে সময় ঋতুবিপর্যয়ে নিতান্ত দুর্দিন। হুমায়ুন মনে করিলেন, পিতৃতুল্য পিতৃব্য কদাচ এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর সহিত যুদ্ধ করিবেন না, অতএব শিশুটীকে শিবিরে রাখিয়া পতি-পত্নীতে তথা হইতে বহির্গত হইলেন। যে সকল রমণী শিশুর লালন-পালনে নিযুক্ত ছিল, তাহারা শিবিরেই রহিল; আসবাবপত্রও তাহাদের জিম্মায় রহিল।
হুমায়ুন এবং হামিদা অশ্বারোহণে নিরাপদে পারস্য-সীমাভাগে উপনীত হইলেন। তাঁহারা যাত্রা করিবামাত্র আজকারী মির্জা তাহাদের শিবিরে পৌঁছিলেন। দেখিলেন, ভ্রাতা পলায়ন করিয়াছেন। তখন সস্নেহে শিশুটীকে ক্রোড়ে লইয়া তিনি কান্দাহারে গমন করিলেন। আজুকারী মির্জা তৎকালে কান্দাহারের গবর্ণর। আকবরকে লইয়া তিনি আপন পত্নীর ক্রোড়ে অৰ্পণ করিলেন। অমরকোটের শিবিরে যে সকল ধাত্রী ছিল, তাহারাও সেই স্থানে রহিল। ১৫৪৪ অব্দের শেষ পর্যন্ত আকবর সেইরূপে আপন পিতৃব্যপত্নীর স্নেহ-যত্নে পালিত হইলেন। ১৫৪৪ অব্দের প্রারম্ভে অবস্থার পরিবর্তন। হুমায়ুন সেই সময় শাহতামাস্পের সাহায্যে সৈন্য প্রাপ্ত হইয়া পশ্চিম আফগানস্থান জয় করিয়া মরুভূমিপারে কান্দাহারাভিমুখে যাত্রা করিলেন। পাছে তিনি কান্দাহারে উপস্থিত হইয়া পুত্রটীকে গ্রহণ করেন, সেই ভয়ে কামারণ শীঘ্র শীঘ্র এই আদেশ পাঠাইলেন যে, বালককে অবিলম্বে কান্দাহার হইতে কাবুলে প্রেরণ করা হউক। যাহাদের প্রতি আদেশ হইল, তাহারা কান্দাহারে উপস্থিত হইলে আজকারী মির্জার মন্ত্রীবর্গ একত্র হইয়া এই তর্ক উপস্থিত করিলেন যে, কামারণের আদেশপালন করা উচিত কিনা? কেহ কেহ স্থির করিলেন, হুমায়ুনের এখন শুভগ্রহ; এ সময় তাহার সহিত বিবাদ না করিয়া সন্ধি করাই সুপরামর্শ। তাঁহারা পরামর্শ দিলেন, উপযুক্ত সম্ভ্রম সম্ভ্রান্তজনগণসহ রাজপ্রহরী সমভিব্যাহারে শিশু আকবরকে তাঁহার পিতার নিকট প্রেরণ করা কর্তব্য। কেহ কেহ কহিলেন, তাহা করিলেও হুমায়ুনের ক্রোধানল নির্বাপিত হইবে না : আজকারী নিজে দারুণ বিশ্বাসঘাতকের কাৰ্য্য করিয়াছেন, প্রতিফল না দিয়া হুমায়ুন শীঘ্র নিরস্ত হইবেন, এমন বিশ্বাস হয় না। অতএব এ অবস্থায় কামারণের বশীভূত হইয়া চলাই উচিত। তাহার প্রীতি সাধনই এখন বাঞ্ছনীয়।
শেষোক্তশ্রেণীর পরামর্শই উত্তম বলিয়া বিবেচিত হইল। দারুণ শীত, পথ দুৰ্গম, সেই পথ অতিবাহন করিয়া শিশু আকবরকে এবং তাঁহার ভগ্নী বক্সীবানু বেগমকে কান্দাহার হইতে কাবুলে লইয়া যাওয়া হইল। তাহারা নিরাপদে কাবুলে পৌঁছিলেন। কামারণ শিশুকে প্রাপ্ত হইয়া বাবরশাহের মাননীয়া ভাগনী খ-জাদা-বেগমের হস্তে সমৰ্পণ করিলেন। হুমায়ুনের নিয়োজিত ধাত্রীগণ খা-জাদাবেগমের স্নেহপাত্রী হইয়া শিশুর লালনপালনে নিযুক্ত থাকিল। বেগম নিজেও আকবরের প্রতি মাতৃস্নেহ প্রদর্শন করিতে লাগিলেন।
এ সুখ-শান্তি অধিকদিন স্থায়ী হইল না। ১৫৪৫ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে হুমায়ুন কান্দাহার-রাজ্য অবরোধ করিলেন। কামারণ বিপদে পড়িলেন। হুমায়ুনকে অপদস্থ করিবার চেষ্টা কামারণের অন্তরে নিরন্তর প্রদীপ্ত ছিল। তিনি ভাবিয়াছিলেন, আকবরকে হস্তগত রাখিয়া হুমায়ুনকে পরাভূত করিবেন, অতএব বাবরের ভাগ্নীর ক্রোড় হইতে আকবরকে প্রতিগ্রহণ পূর্বক আপন বিশ্বাসী কুচকিলান নামক এক ব্যক্তির হস্তে অর্পণ করিলেন। যে সময়ের কথা, সে সময় অতি শীঘ শীঘই সকল ঘটনার পরিবর্তন হইত। সন্ধিবিগ্রহের আর এক অবস্থা ফিরিয়া দাঁড়াইল। কান্দাহার জয় করিয়া হুমায়ুন একদল সৈন্য লইয়া কাবুল আক্রমণে যাত্রা করিলেন। নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাবুল সহরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া অগ্রে যুদ্ধ চাহিলেন। বিনা যুদ্ধে তথাকার সৈন্যগণ তাহার বশীভূত হইল। এক সপ্তাহের মধ্যেই কাবুলে হুমায়ুনের প্রতিপত্তি লাভ। কামারণ উজুনীতে পলায়ন করিলেন। ভাগ্যবান্ পিতা হুমায়ুন অতঃপর কাবুল-সহরে আপন পুত্রকে পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া পরমানন্দনীরে অভিষিক্ত হইলেন। হামিদাবেগম তখন তাহার সঙ্গে ছিলেন না। পরবৎসরের বসন্তকালে তিনি কাবুলে আসিয়া পুত্রকে ক্রোড়ে লইলেন। কামারণের নিয়োজিত কুঁচকিলানের কর্ম গেল। পূৰ্ব্বপ্রতিপালক আবৃতক খ সেই পদ পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন। অতক খাঁর প্রকৃত নাম সমসুদ্দীন মহম্মদ। ১৫৪০ অব্দে সেরশাহের সহিত কনোজে যে যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে এই সমসুদ্দীন বিশেষ সাহসিকতা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক হুমায়ুনের প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন।
আকবর সেখানে পরমসুখে রহিলেন। শীতকাল আসিয়া উপস্থিত হইল। হুমায়ুন ইতিমধ্যে বদন-রাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন। তপ্রদেশের কিল্লাজাফর স্থানে শীতকাল অতিবাহিত করা তাহার ইচ্ছা হইল। পথে তাঁহার সঙ্কটাপন্ন পীড়া ক্রমশঃ এতদূর কঠিন হইয়া দাঁড়াইল যে, বাঁচিবার আশা রহিল না; কিন্তু তিনি বাঁচিলেন। ক্রমাগত দুইমাস শয্যাগত থাকিয়া আরোগ্যলাভ করিলেন। তাঁহার পারিষদবর্গের মধ্যে কতকগুলি লোক নিশ্চয় ভাবিয়াছিলেন, এ যাত্রা তাহার জীবনরক্ষা হইবে না। অতএব তাহাকে পতিত অবস্থায় ত্যাগ করিয়া তাহারা তাহার ভ্রাতৃগণের দরবারে গিয়া মিলিবেন। কামারণের বড় সুবিধা হইল। সেই অবসরে তাহার শ্বশুর বহুতর সৈন্য প্রেরণ করিলেন, সেই সকল সৈন্যের সাহায্যে কামারণ কাবুল অধিকার করিয়া শিশু আকবরকেও পুনৰ্ব্বার হস্তগত করিলেন। প্রথম সতর্কতা অবতক খাঁকে পদচ্যুত করা। তাঁহাকে পদচ্যুত করিয়া কামারণ নিজের একজন বিশ্বাসী ভূত্যকে তৎপদে প্রতিষ্ঠিত করিলেন।
আরোগ্য লাভ করিয়া শাহ হুমায়ুন এই সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। অচিরে রাজধানী অধিকার করা তাহার সঙ্কল্প হইল। অচিরেই যুদ্ধযাত্রা করিলেন। সহরতলীতে কামারণের একদল সুশিক্ষিত দক্ষ সেনাকে পরাজয় করিয়া বিজয়ী বীরপুরুষ কো-আকাবেলনামক স্থানে শিবিরস্থাপন করিলেন। সেই স্থানের সম্মুখেই নগর। তথা হইতে তোপ দাগিয়া নগর ভগ্ন করা আরম্ভ হইল। তোপাগ্নি কয়েকদিন পর্যন্ত নির্বাপিত হইল না। ধূ ধূ করিয়া নগর জ্বলিতে লাগিল শীঘ্র নির্বাপিত না হইলে সমস্তই ধ্বংস হইয়া যায়, এই লক্ষণ দর্শন করিয়া কামারণ দুষ্টবুদ্ধিপ্রভাবে বিজয়ী ভ্রাতাকে বলিয়া পাঠাইলেন, শীঘ্র যদি অগ্নিনির্বাণের ব্যবস্থা না করেন, তাহা হইলে যে স্থানে মহাগ্নি প্রজ্বলিত, সেই সর্বোচ্চস্থানে আকবরকে তিনি বসাইয়া দিবেন। গ্রন্থকার আবুল ফজেল আকবরনামা গ্রন্থে লিখিয়াছেন, কামারণ সত্য সত্যই শিশু আকবরকে জ্বলন্ত অনলসমীপে বসাইয়া দিয়াছিলেন। অপারপর গ্রন্থকারেরা কিন্তু উহা সত্য বলিয়া স্বীকার করেন না। কামারণের নৃশংসবাক্য শ্রবণ করিয়া হুমায়ুন তৎকালে তোপদাগা বন্ধ করিবার আদেশ দেন। নগরবেষ্টন বন্ধ রহিল না। ১৫৪৭ অব্দের ২৮ এপ্রিল তারিখে রণজয়ী হইয়া তিনি নগরপ্রবেশ করিলেন। ২৭ এপ্রিল রজনীতে কামারণ তথা হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন।
পলায়নস্থান বদন। হুমায়ুন সসৈন্যে কামারণের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। আর এক দুর্দৈব উপস্থিত। তাহার দরবারের কতিপয় প্রধান লোক বিদ্রোহী হইয়া কামারণের পক্ষে যোগ দিলেন।
উপর্যুপরি কয়েকটী যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, হুমায়ুন অবশেষে উত্তররাজ্যের সুবন্দোবস্তকরণার্থ সমরসংকল্প করিলেন। সংকল্প সিদ্ধ হইল। আকবরকে এবং তাঁহার জননীকে সমভিব্যাহারে লইয়া ১৫৪৮ অব্দের জুন মাসে তিনি কাবুল হইতে উত্তরাভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। গুলবাহার রাজ্যে উপস্থিত হইয়া সপুত্র বেগমকে পুনরায় কাবুলে প্রেরণপূর্বক স্বয়ং তালিকানপ্রদেশে যাত্রা করিলেন। তথায় ঘোরতর যুদ্ধ হইল। সেই যুদ্ধে কামারণ আত্মসমর্পণে বাধ্য হইলেন। অনন্তর উত্তররাজ্যের সুব্যবস্থা করিয়া হুমায়ুন পুনরায় কাবুলে ফিরিয়া আসিলেন।
আবার নূতনরাজ্যের উপর তাহার লোভ পড়িল। বাহীকরাজ্য অধিকার করিবার আশায় ১৫৪৯ অব্দের বসন্তকালে তিনি কাবুল হইতে তপ্রদেশে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। বাত্নীকরাজ্যটী (বালা) পশ্চিমকুণ্ডরাজ্যের অন্তর্গত। তথায় যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া হুমায়ুন কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না; উজবেকেরা তাঁহাকে হটাইয়া দিল, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া কাবুলে প্রত্যাগত হইলেন এবং ১৫৫০ অব্দের শীতকালটা তথায় নিরুপদ্রবে অতিবাহন করিলেন।
ইহার পর এক আশ্চর্য্য-ঘটনা হইল। কামারণ আত্মসমর্পণ করিয়াও মনে মনে ভ্রাতার বৈরসাধনে কৃতসংকল্প ছিলেন। বাহীকের রণাভিযানে তিনি ভ্রাতৃপক্ষে মিলিত হন নাই, বিফলযত্ন হইয়া হুমায়ুনের প্রত্যাগমনের উহাই প্রকৃত কারণ। অন্তরের আগুন অন্তরে কিছুদিন চাপিয়া রাখিয়া কামারণ পুনর্বার প্রকাশ্য বিদ্রোহী হইয়া উঠিলেন। অসস নদের কূলে তিনি এক ভীষণ সমরানল প্রজ্বালন করেন, সেই যুদ্ধের অবসানে কামারণ আবার ভ্রাতার বশীভূত হইবেন, এইরূপ অঙ্গীকার করিলেন। শিশু আকবরের হস্তে কাবুলের শাসনভার অর্পণ করিয়া তিনি (কামারণ) গোপনে গোপনে হুমায়ুনকে ধরিবার চেষ্টায় রহিলেন। আকবরের বয়ঃক্রম তখন আটবৎসর মাত্র। মহম্মদ কাসিমা কারলাস তৎকালে তাহার শিক্ষকস্বরূপ ছিলেন, রাজকার্যের তত্ত্বাবধান সেই কাসিমখাই করিতে লাগিলেন। হুমায়ুন সে সময়ে কিপচাক অরণ্যের উত্তরপ্রান্তে অসাবধানে অবস্থান করিতেছিলেন, কামারণ সেইখানে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করেন। আত্মরক্ষায় নিরুপায় হইয়া হুমায়ুন অগত্যা তথা হইতে পলায়নকরণে বাধ্য হন। পলায়নকালে তিনি গুরুতর আঘাত পাইয়াও নিরাপদে সার্টানপাস-গিরিশিখরে উপনীত হইয়াছিলেন। তথায় তাহার অন্য কোন প্রকার ভয় রহিল না।
এই অবসরে কামারণ কাবুলে যুদ্ধযাত্রা করিয়া কাবুলসহর অবরোধ করেন। শিশু আকবর তৃতীয়বার আপন পিতৃব্যের হস্তে বন্দী হন। হুমায়ুন অতি সহজে এ ক্ষতি সহ্য করিতে পারেন নাই, সৈন্যসামন্ত একত্র করিয়া কষ্টে পর্বতমালা পার হইয়া পুনরায় তিনি কাবুলে যুদ্ধযাত্রা করেন। সুটারগননামক স্থানে পৌঁছিয়া তিনি দেখিলেন, তাঁহার প্রতিরোধের নিমিত্ত কামারণের সৈন্যগণ তথায় সসজ্জ হইয়া রহিয়াছে। দিনকতক সেই স্থানে অপেক্ষা করিতে হইল। ধূর্ত কামারণ বৃথা আশ্বাস প্রদান করিয়া সন্ধির প্রস্তাব করিলেন। সমস্তই চাতুরী। ক্রমে ক্রমে ইহা বুঝিতে পারিয়া হুমায়ুন অবশেষে যুদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করিলেন।
যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সেই যুদ্ধে হুমায়ুন জয়ী হইলেন; কামারণ পলায়ন করিলেন। শিশু আকবর তখনও কামারণের অধীনে ছিল। পালায়নসময়ে কামারণ বুঝি আকবরকে লইয়া গিয়াছেন, অকস্মাৎ হুমায়ুনের মনে সেই ভয় উদিত হইল। কিন্তু সে ভয়ের কোন কারণ ছিল না। নগরপ্রবেশের অগ্রে তাহার শিবিরে আকবর উপস্থিত হইলেন। হাসানআই তকালে আক্বরের রক্ষকের স্বরূপ সঙ্গে আসিলেন। হুমায়ুনের পূর্ব আশঙ্কা দূর হইল। পরদিন তিনি নগরপ্রবেশ করেন।
বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল হইয়া আকবরের পিতা আপন পারিষদবর্গকে প্রচুর উপহার ও পুরস্কার প্রদান করিলেন; আকবরকেও বঞ্চিত করিলেন না। আকবরকে তিনি চার্শ্বপ্রদেশ জায়গীর দিলেন এবং হাজী মহম্মদখা সিস্তানীকে তাঁহার মন্ত্রীরূপে নির্বাচন করিলেন। বালকের বিদ্যাশিক্ষার তত্ত্বাবধানভারও তাহার উপর অর্পিত হইল।
হুমায়ুনের কষ্টবিপত্তির যে সকল কারণ উপস্থিত হইয়াছিল, এই বিজয়ের পরবৎসরে তাহা একে একে দূর হইতে লাগিল। এই শুভসময়েও কামারণ পুনর্বার বিদ্রোহী হইয়া ভ্রাতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিলেন। কিন্তু তাহাতে তাহার নিজেরই দর্প চূর্ণ হইয়া গেল। সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইয়া ১৫৫৩ অব্দের আগস্টমাসে তিনি আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হইলেন। তাহার প্রতি মক্কায় নির্বাসনের দণ্ডাজ্ঞা প্রদত্ত হইল। চারি বৎসর পরে মক্কাতীর্থে কামারণ প্রাণত্যাগ করিলেন।
হুমায়ুনের আর এক ভ্রাতা হিন্দনমির্জা ইহার ১৮ মাস পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হইয়াছিলেন। অপর ভ্রাতা আজকারীমির্জা বিশ্বাসঘাতকের শিরোমণি। ১৫৮১ অব্দে তাঁহাকেও মক্কাধামে নির্বাসিত করা হয়। ১৫৫৮ অব্দে তথায় তাহার মৃত্যু হইয়াছে।
বিদ্রোহী ভ্রাতৃদ্বয়ের উৎপাত হইতে বিমুক্ত হইয়া বাদশাহ হুমায়ুন কাশ্মীর জয় করিবার সঙ্কল্প করিলেন; কিন্তু তাহার অমাত্যবর্গ এবং অনুচরবর্গ সেই সঙ্কল্পে এতদূর বিরোধী হইলেন যে, অগত্যা অনিচ্ছাপূর্বক হুমায়ুনকে সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিতে হইল। সিন্ধুনদ পার হইয়া তিনি আপন মনে সান্তনা প্রাপ্ত হইয়া শান্তিলাভ করিলেন।
সিন্ধুর পরপার্শ্ববর্তী বিতস্তা নদীর মধ্যবর্তী প্রদেশে শিবিরস্থাপন করিয়া সর্বপ্রথমে তিনি পেশোয়ারের দুর্গসংস্কারের অনুমতি দিলেন। তখন তাহার অন্তরে ভারতবর্ষবিজয়ের বাসনা অত্যন্ত বলবতী ছিল। দুৰ্গসংস্কারকাৰ্য ১৫৫৪ অব্দে সমাপ্ত হইল। তদনন্তর তিনি কাবুলে ফিরিয়া গেলেন। সেই বৎসরে শীতকালে এবং বসন্তকালের প্রথমে হিন্দুস্থানের এক রাজা মহা বিপদগ্রস্ত হন। সেই উপলক্ষে হুমায়ুন আপন পূর্বসঙ্কল্প সিদ্ধকরণের উত্তম অবসর বিবেচনা করেন।
সেরখা শূর কনোজের যুদ্ধে ১৫৪০ অব্দে হুমায়ুনকে পরাজয় করিয়াছিলেন। তদবধি তিনি বাবরশাহের বিজিত রাজ্যসমূহ অধিকার করিয়া আরও কয়েকটী রাজ্য স্বাধিকারভুক্ত করেন। সেখাশূর দক্ষলোক ছিলেন বটে, কিন্তু সন্ধি ও একতা-বিধানে হুমায়ুন অপেক্ষা তিনি অধিক বিজ্ঞ ছিলেন না। বাস্তবিক তাহারা উভয়েই ঐ দুই বিষয়ে উদাহীন থাকিতেন। স্থানে স্থানে শিবির সংস্থাপন করিয়া রাজ্যশাসন করা হইত। প্রত্যেক প্রদেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন। ক্ষমতাবান্ মনুষ্যমাত্রেরই প্রশংসাকারী ও নিন্দাকারী উভয়দল বিদ্যমান থাকে। সেরখারও তাহাই ছিল। কেহ কেহ তাঁহার সুখ্যাতি করিতেন, পররাজ্যলোলুপ দস্যু বলিয়া কেহ কেহ তাহার নিন্দাবাদও করিত। সাধারণমতে দোষে গুণে তিনি এক প্রকার ভাললোক বলিয়া বিবেচিত হইতেন। কলিঞ্জর-দুর্গ আক্রমণের সময় তিনি সাংঘাতিকরূপে আহত হন। সেই আঘাতে ১৫৫৪ খৃঃ অব্দে তাহার মৃত্যু হয়।
সেরখার দ্বিতীয় পুত্র সেলিমশাহ নূর উত্তরাধিকারী হন। তাঁহার দ্বিতীয় আখ্যা সুলতান ইসলাম। তিনি ৭/৮ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। কিন্তু একদিনও সুখে থাকিতে পারেন নাই। তাহার অধীনস্থ ওমরাহবর্গ প্রায়ই তদৃবিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়া প্রদেশমধ্যে অশান্তি উৎপাদন করিতেন। তন্নিবন্ধন তাহাকে সৰ্ব্বদাই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকিতে হইত। একটী শিশু পুত্র রাখিয়া সুলতান ইসলাম লোকলীলা সংবরণ করেন। সুতরাং রাজ্যের প্রধান প্রধান অমাত্যগণ সকলপ্রকার রাজকার্যে কর্তৃত্ব করিতে থাকেন। শিশু রাজকুমার তিনদিনমাত্র সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। তাহার পরেই কুচক্রী লোকেরা তাহার প্রাণবিনাশ করে। তাহার এক মাতুল সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। তাহার উপাধি হয়, সুলতান মহম্মদ শাহ আদেল। তিনি মূর্খ ছিলেন। তাঁহার হিতাহিতবিবেচনা ছিল না, ব্যবস্থার স্থিরতা ছিল না। ব্যবহারে তিনি যারপর নাই নৃশংস ছিলেন। লাম্পট্যদোষের নিমিত্ত সর্বত্র তাহার কুখ্যাতি প্রচারিত হইয়াছিল। হিমুনামে একজন হিন্দুসন্তান তাঁহার মন্ত্রীরূপে নিযুক্ত হন। পূর্বে তিনি একজন দোকানদার ছিলেন। কিন্তু প্রতিভাভাবে হিমু রাজকার্যে এতদূর সুদক্ষ হইয়া উঠেন যে, রাজার সমস্ত ক্ষমতা তাঁহার হস্তে সমর্পিত হয়।
কিছুদিন পরে ইব্রাহিম খা নামক একব্যক্তি বিয়ানাতে রাজদ্রোহী হইয়া আগ্রা ও দিল্লী অধিকার করেন এবং আপনাকে সুলতান বলিয়া ঘোষণা দেন। শতদ্রু নদের উত্তরপশ্চিম প্রদেশের শাসনকর্তা আহম্মদ খা সেই সময় পঞ্জাব আক্রমণ করিয়া সেকেন্দার শাহ উপাধিধারণপূর্বক আপনাকে রাজা বলিয়া ঘোষণা করেন। সুজা খা নামক আর এক ব্যক্তি মালবরাজ্য আক্রমণ করিয়া সুলতান হইবার দাবী করেন। সেকেন্দর এবং সুজা উভয়েই পূর্বপ্রদেশসমূহের অধিকার লইয়া প্রতিযোগিতা করিতে থাকেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধ হয়! সেকেন্দর শাহ প্রবল হইয়া উঠেন। আগরা হইতে বিংশতি মাইল দূরবর্তী কারানামক স্থানে ইব্রাহিমখাকে পরাজয় করিয়া সেকেন্দর শাহ দিল্লী অধিকার করিয়া লন। জৌনপুর এবং বেহার দখল করিবার অভিলাষে তিনি সৈন্য-সজ্জা করিতেছিলেন, এমন সময় সংবাদ পাইলেন, কাবুল হইতে তাহাকে ভয়প্রদর্শন করা হইতেছে। বাদশাহ হুমায়ুন তাহাকে দমন করিবার নিমিত্ত যুদ্ধযাত্রা করিবেন।
১৫৫৪ অব্দের নবেম্বরমাসে হুমায়ুন শাহ কাবুল হইতে সিন্ধুকূলে যুদ্ধযাত্রা করেন। অল্পমাত্র সৈন্য সঙ্গে ছিল, পথে পথে সৈন্যসংখ্যা বর্ধিত হয়। শিশু আকবর পিতার সঙ্গে আসিয়াছিলেন; ১৫৫৫ অব্দের জানুয়ারীমাসের দ্বিতীয়দিবসে সিন্ধুনদ পার হইয়া হুমায়ুন রাওলপিঞ্জীতে উপনীত হন তথা হইতে ইরাবতী নদীর অপরপারস্থ কারানয়ে যাত্রা করেন। তথায় তাহার সৈন্যগণকে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করিয়া দেন। দক্ষসেনাপতি বাইরামখাঁকে জলন্ধরে প্রেরণ করেন; স্বয়ং লাহোরে যান। সেই স্থান হইতে তাঁহার প্রিয়সুহৃৎ আবদুলমালিকে দ্বিপালপুররাজ্য অধিকার করিতে পাঠান।
বাইরামখাঁ শতদ্রুকূলের মাহিবারানগরে সেকেন্দরশাহের সেনাপতিগণকে পরাজয় করিয়া সরহিন্দ নগরে গমন করেন। সেইখানে তাঁহাকে নিপাত করিবার অভিপ্রায়ে সেকন্দর শাহ বহুসৈন্য লইয়া শীঘ্র শীঘ্র তথায় উপস্থিত হন। বাইরামখাঁ এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া হুমায়ুনের নিকট সাহায্য চাহিয়া পাঠান। হুমায়ুন প্রথমে আকবরকে প্রেরণ করিয়া কয়েকদিন পরে স্বয়ং সরহিন্দে আসিয়া উপস্থিত হন। তাঁহারা আসিয়া পৌঁছিবার অগ্রে সেকেন্দর উপস্থিত হইয়াছিলেন কিন্তু যুদ্ধ করিবেন কি না, তাহা ভাবিয়া ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। বিলম্ব হওয়াতেই তাহার আশা ফুরাইল। হুমায়ুন আসিয়া পৌঁছিবামাত্র মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইল। হুমায়ুন জয়ী হইলেন। সেকেন্দর শাহ সিবালিক প্রদেশে পলায়ন করিলেন। বিজয়ী সৈন্যগণ সমভিব্যাহারে বিজয়ী হুমায়ুন দিল্লীযাত্রা করিলেন। ২৩এ জুলাই তারিখে দিল্লী অধিকার করিয়া তিনি একদল সৈন্য বোহিলখণ্ডে আর একদল আগরায় পাঠাইয়া দিলেন। ইতিপূর্বে পঞ্জাব অধিকার নিমিত্ত আবদুলমালিককে তিনি প্রেরণ করিয়াছিলেন, ইহা বর্ণিত আছে।
তখনও পর্যন্ত হুমায়ুনের সর্বকষ্টের অবসান হয় নাই। মহম্মদ শা-আদেলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি হিমু বঙ্গদেশের সিংহাসনারূঢ় সেরকে পরাভব করিয়া দিল্লীযাত্রার উদ্যোগ করিতেছিলেন, সেকেন্দশাহও সরহিন্দে পরাজিত হইয়া পঞ্জাবে আপন বিক্ৰম প্ৰকাশ করিতেছিলেন। দুইদিকে দুই বৈরী। এ সঙ্কটে কি করা কর্তব্য, ইহা বিবেচনা করিয়া হুমায়ুন স্বয়ং দিল্লীতেই অবস্থান করিবেন, এইরূপ স্থির করিলেন এবং বাইরামখাঁর সহিত আকবরকে পঞ্জাবে পাঠাইয়া দিলেন।
শিশু আকবর কি করিলেন, অগ্রে আমরা তাহাই দেখিব। ১৫৫৬ অব্দের জানুয়ারী মাসের প্রথমে তিনি সরহিন্দ নগরে পৌঁছিলেন। আবদুলমালিক ইত্যগ্রে তথায় গিয়া তথাকার প্রধানলোক দিগকে দুর্ব্যবহারে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিলেন। তাহারা আকবরের নিকটে আসিয়া সেই কথা জানাইলেন। আকবর তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া শতদ্রু পার হইয়া সুলতানপুরে যাত্রা করিলেন। তথা হইতে সেকেন্দর শাহের অনুসরণে হরিয়াণাতে যাত্রা করিলেন।
যেদিন প্রাতঃকালে হরিয়ানাতে আকবর, সেইদিন হঠাৎ সেই স্থানে সংবাদ গেল, বাদশাহ হুমায়ুন মহাসঙ্কটে নিপতিত। আকবর সেই সংবাদে ব্যথিতচিত্ত হইয়া অন্যকাৰ্য্য বন্ধ রাখিয়া কালানগরে গমন করিলেন। তথায় একখানি পত্র তাহার হস্তগত হইল। সেই পত্রে তিনি দেখিলেন, হুমায়ুনের আদেশে লিখিত হইয়াছে, তিনি শীঘ্রই আরোগ্যলাভ করিবেন। সংবাদ কেবল আশামূলকমাত্র। কিয়ৎক্ষণ পরে আর একখানি পত্র লইয়া আর একজন বার্তাবহ পৌঁছিল। আকবর সেই পত্র পাঠ করিয়া দেখিলেন, সম্রাটের মৃত্যু হইয়াছে। আকবর পিতৃশোকে আকুল হইলেন। সমভিব্যাহারী অমাত্যেরা সেইদিনেই আকবরকে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিলেন।
অপঘাতে হুমায়ুনের প্রাণান্ত হয়। দিল্লীপ্রাসাদস্থ পুস্তকাগারের ছাদে উঠিবার সিঁড়ির সর্বোচ্চ সোপান হইতে পতিত হইয়া চারিদিন তিনি অজ্ঞান থাকেন, চতুর্থরজনীতেই প্রাণপক্ষী উড়িয়া যায়। ১৫৫৬ অব্দের ২৪ এ জানুয়ারী তারিখে তাহার জীবনলীলা সমাপ্ত। এই দৃঢ়ভাগ্য বাদশাহের ৪৮ বৎসরমাত্র বয়ঃক্রম হইয়াছিল।
উত্তরাধিকারী হইলেন একটী বালক। এত বড় বিশালরাজ্যের অধীশ্বর হইয়া সেই বালকটী কিরূপে রাজক্ষমতা পরিচালন করিলেন, তাহা অবশ্যই জানিবার বিষয় বটে। আকবরের বয়স তখন এয়োদশবর্ষ চারিমাস মাত্র। সেই বয়সে তিনি সত্য সত্যই পঞ্জাব অধিকার করেন। তাঁহার অনুচরবর্গ সরহিন্দু, দিল্লী এবং সম্ভবতঃ আগরা দখল করিয়া রাখেন। রাজ্যমধ্যে অশান্তি ছিল না, কিন্তু দুটী প্রতিকূলবাৰ্তা শ্রবণ করিয়া আকবর কিছু বিচলিত হইলেন। মহম্মদ শা-আদেলের সেনাপতি হিমু দুই যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া জয়োৎসাহে আগরা আক্রমণে আসিতেছেন। তাঁহার সমভিব্যাহারে পঞ্চাশ হাজার সেনা এবং পাঁচ শত রণহস্তী আছে। দ্বিতীয় সংবাদ–কাবুলে হুমায়ুন যে প্রতিনিধি নিযুক্ত রাখিয়া আসিয়াছিলেন, সেই রাজপ্রতিনিধি হঠাৎ বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছেন।
দিল্লীর রাজপাটে একটী বালক সম্রাট, শীঘ্র শীঘ্র এই বার্তা প্রকাশিত হইলে পাছে বিপক্ষপক্ষ মাতিয়া উঠে, সেই আতঙ্কে রাজদরবারের প্রবীণ অমাত্য দিল্লীর শাসনকর্তা টার্ডি বেগখা উত্তম কৌশলে সপ্তদশ দিবস সম্রাটের মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখিয়াছিলেন। তদনন্তর ১০ই ফেব্রুয়ারী দিবসে তিনি বুধবর্গসহ প্রধান মসজীদে গমনপূর্বক নবীনসম্রাটের সিদ্ধি প্রার্থনা করেন। তাহার পর মণি-মণ্ডিত রাজমুকুটাদি অভিষেকসামগ্রীসহ রাজপুরীর কর্মচারিবর্গকে, রাজরক্ষীবর্গকে এবং কামারণের একটী পুত্রকে পঞ্জাবে আকবরের সমীপে প্রেরণ করেন। পাঠানের হিন্দু সেনাপতি হিমু আগরা আক্রমণ করিয়া দিল্লী আক্রমণে আসিবেন, এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন, টার্ডি বেগখা তজ্জন্য দিল্লীর নিরাপদ-উদ্যোগে ব্যাপৃত হইলেন।
আকবর যখন পিতার মৃত্যুসংবাদ প্রাপ্ত হন, তখন কাবুলের বিদ্রোহের সমাচার শ্রবণ করেন নাই, হিমু আসিয়া দিল্লী আক্রমণ করিবেন, তাহাও তিনি জানিতেন না। তিনি কেবল একজন শক্রর অস্তিত্ব পরিজ্ঞাত ছিলেন। সেই শত্রু সেকেন্দর শাহ। তাহার সহিত যুদ্ধ করিবার আশু প্রয়োজন হইল। সেকেন্দর তখন সদলে ধীরে ধীরে কাশ্মীরাভিমুখে প্রতিগমন করিতেছিলেন। অতএব বাইরামখাঁ কাৰ্য্যক্ষেত্রে আকবরকে পরামর্শ দিলেন, অগ্রে পঞ্জাবরাজ্য নিরাপদ করাই কৰ্ত্তব্য। সেই সঙ্কল্প সিদ্ধকরণোদ্দেশে সেকেন্দরের পশ্চাদ্ধাবন আবশ্যক।
সেই পরামর্শই অবধারিত হইল। আকবর সসৈন্যে কালানদ হইতে বাহির হইয়া সেকেন্দর শাহের অনুধাবন করিলেন। সেকেন্দর পলায়ন করিয়া সিবালিক পর্বতশ্রেণীর নিম্নপ্রদেশে মানকট দুর্গে আশ্রয় লইলেন। মানকট-দুর্গ অতিশয় দৃঢ়, বিশেষতঃ কাবুলে এবং হিন্দুস্থানে বিদ্রোহসূচনা, এরূপ অবস্থায় তথায় আর বিলম্ব না করিয়া আকবর সেই দুর্গপরিবেষ্টনার্থ একদল সৈন্য রাখিয়া জলন্ধরে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন।
যথার্থই দুঃসময়। কেবল কাবুলে বিদ্রোহে নহে, পাঠান-সেনাপতি হিমু সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া বিনা রক্তপাতে আগরা অধিকার পূর্বক দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করিতেছেন। একদিন পরে সংবাদ আসিল, পরাক্রান্ত হিমু দিল্লীর নিকটে মোগলসৈন্যগণকে পরাজয় করিয়া রাজধানী অধিকার করিয়াছেন। পরাজিত সৈন্যের অবশিষ্ট লোকগুলিকে লইয়া টার্ডি বেগ সরহিন্দ অভিমুখে পলায়ন করিয়াছেন।
যেখানে পরামর্শদাতা অধিক, সেখানে প্রায়ই সুবিবেচনার অভাব হয়। আকবর যখন শুনিলেন, হিমু আগরা এবং দিল্লী অধিকার করিয়া রহিয়াছেন, তখন কি করা কৰ্ত্তব্য, সমরসচিবগণকে তদ্বিষয়ে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। একজন ব্যতীত সকলে একবাক্যে পরামর্শ দিলেন, কাবুলে গমন করাই উচিত। সেই পার্বতীয় রাজ্য নিশ্চয় তিনি উদ্ধার করিতে পারিবেন, তাহার পর সুসময় উপস্থিত হইলে পুনরায় ভারতবর্ষ আক্রমণ করিতে আসিবেন। এই প্রস্তাবে সরগমখা দৃঢ় প্রতিবাদ করিলেন। তিনি কহিলেন, বিলম্বে শতদ্রু পার হইয়া সরহিন্দনগরে টার্ডি বেগের সহিত মিলিত হইয়া তথা হইতে হিমুকে আক্রমণার্থ যাত্রা করা কর্তব্য। দিল্লী দুইবার অধিকার হইল, দুইবারই হস্তভ্রষ্ট হইয়া গেল। পুনরায় ইহা অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। দিল্লীই প্রকৃত প্রশস্তক্ষেত্র। কাবুল নহে, দিল্লী যাহার অধিকারে থাকে, অতি সহজেই কাবুল তাহার আয়ত্ত হয়। আকবর সেই পরামর্শেই অনুমোদন করিয়া শতদ্রু পার হইবার আদেশ প্রদান করিলেন।
অক্টোবর মাসে আকবর জলন্ধর হইতে শ পার হইয়া সরহিন্দু নগরে উপনীত হইলেন, তথায় টার্ডি বেগের সহিত তাহার মিলন হইল। দিল্লীতে যাহারা হিমুর নিকট পরাজিত হইয়াছিলেন, সেই সকল বীরপুরুষও তথায় উপস্থিত ছিলেন, আকবরকে প্রাপ্ত হইয়া তাহারা উৎসাহিত হইলেন। আকবরের মনেও জয়াশা সমুদিত হইল।
টার্ডি বেগ তুর্কিদেশীয় সম্ভ্রান্তলোক। ভ্রাতৃগণের সহিত হুমায়ুনের যখন বিরোধ হয়, এই টার্ডি বেগ সেই সময় হুমায়ুনের বিস্তর সহায়তা করিয়াছিলেন, তাহাতেই সম্রাটের সহিত তাঁহার বিশেষ বন্ধুত্ব হয়। হুমায়ুনের মৃত্যু হইলে টার্ডি বেগ প্রকৃত রাজভক্তি দেখাইয়া বিনা যুদ্ধে আকবরকে সিংহাসনে বসাইয়াছেন। কামারণের এক পুত্র তখন দিল্লীতে ছিলেন, রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার লইয়া তিনিও কোনপ্রকার গোলযোগ করেন নাই। হিমুর সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া টার্ডি বেগ অবিলম্বে দিল্লী পরিত্যাগ করাতে অপরাপর ওমরাওয়েরা তাহাকে ভীরু বলিয়াছিলেন; কিন্তু একটী বিষয়ে প্রম হইলে তাহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হয় না। সরহিন্দনগরে আসিয়া তিনি বরং আকবরের বিশেষ উপকার করিয়াছেন; অনেকগুলি সৈন্য তিনি একত্র করিয়াছেন।
বাইরাম খা চিরদিন টার্ডি বেগের হিংসা করেন। ধর্মভেদ নিবন্ধন সেই হিংসা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছিল। বাইরাম খা তাহাকে আপন শিবিরে আমন্ত্রণ করিয়া গোপনে তাঁহার প্রাণবিনাশ করেন। সেই নিষ্ঠুরকার্যে আকবর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।
সেনাপতি হিমু আপন ইচ্ছায় রাজা উপাধি লইয়া দিল্লীসহরে আনন্দ-কৌতুকে অবস্থান করিতেছেন, আরও অধিকসংখ্যক সৈন্যসংগ্রহেরও ত্রুটি হইতেছে না। যখন তিনি শুনিলেন, আকবর সরহিন্দনগরে উপস্থিত হইয়াছেন, তখন অস্ত্রধারী সৈন্যগণকে পাণীপথে প্রেরণ করিরেন। দিল্লী হইতে ৫৩ মাইল উত্তরে পানীপথ। তিনি নিজেও অবিলম্বে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য লইয়া পানীপথে যাইবেন, এরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। আকবরও সরহিন্দ হইতে পানীপথে যাইতেছিলেন; স্বয়ং যাত্রা করিবার অগ্রে সেনাপতি আলী কুলিখা সাহেবানীর অধীনে দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। আলীকুলি অশ্বারোহণে পানীপথ পৰ্য্যন্ত গিয়াছিলেন। তথায় দেখিলেন, হিমুর সেনাদলের বহুতর কামান অরক্ষিত অবস্থায় আছে। তিনি সেই সকল কামান অচিরেই হস্তগত করিয়া লইলেন, সেই কাৰ্য্যের পুরস্কারস্বরূপ তিনি খাজাহান উপাধি প্রাপ্ত হন। তদবধি ইতিহাসে তাহার ঐ উপাধি ঘোষিত হইয়া আসিতেছে। কামানগুলি শত্রু-হস্তে যাওয়াতে হিমু অতিশয় ক্ষুব্ধ হইলেন। তুর্কী হইতে তিনি ঐ সকল কামান আনাইয়াছিলেন। সেগুলি গেল, তথাপি তিনি কালবিলম্ব না করিয়া পানীপথক্ষেত্রে গমন করিতে লাগিলেন।
১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে ৫ই নবেম্বর প্রাতঃকালে আকবর এবং বাইরাম পানীপথ-যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করিতেছিলেন, পথে তাহারা দেখিলেন, হিমুর সৈন্যগণ তাহাদের দিকে ধাবিত হইতেছে। বিপক্ষের সৈন্যসজ্জা দর্শন করিয়া ভবিষ্যজ্ঞানপ্রভাবে আকবরের মনে হইল, ত্রিশ বৎসর পূর্বে তাঁহার পিতামহ বাবরশাহ এইরূপে এই ক্ষেত্রে লোদীবংশ ধ্বংস করিয়া ভারতরাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন। তিনি এক্ষণে একজন বৈরীর বাহিনীসমক্ষে উপস্থিত হইয়াছেন। এই বৈরী শূরবংশের সহিত বৈবাহিকসম্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া মোগলসৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে ব্যর্থ। শূর-সেনাপতি সেরশাহ ইত্যগ্রে সম্রাট হুমায়ুনকে হিন্দুস্থান হইতে বিতাড়িত করিয়াছিলেন। বর্তমান যুদ্ধের ফল কি হইবে? আকবর জানিতেন, খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে এই যুদ্ধই তাহার ভাগ্যপরীক্ষার চূড়ান্ত সাক্ষীস্বরূপ হইবে। এই যুদ্ধে ভারতবর্ষলাভ হইবে, দুই শত বৎসরের অধিককাল এই রাজ্যভোগ হইবে, তাহার পর উকলপ্রদেশ হইতে আর একদল আক্রমণকারী দর্শন দিবে, আবার পানীপথক্ষেত্রে এক যুদ্ধ হইবে। সেই যুদ্ধে এই পরাক্রম হতবীৰ্য্য হইয়া পড়িবে, আটলান্টিক মহাসাগরের গর্ভস্থ এক দ্বীপবাসী বিদেশীলোক পুনরায় হিন্দুস্থান অধিকার করিবে, ভবিষ্যজ্ঞানে জ্ঞানী হইলেও, আকবর এ সকল তত্ত্ব পূর্বে জানিতে পারেন নাই।
সেনাপতি হিমু আপন সৈন্যগণকে তিনভাগে বিভক্ত করিয়াছিলেন। প্রথম বিভাগে অগ্রগামী পাঁচশত রণহস্তী। এক একজন মাননীয় সেনাপতি সেই সকল হস্তীর নায়ক। আপন প্রিয়তম গজপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া বীরবর হিমু স্বয়ং নেতৃত্ব করিতেছিলেন। মোগলসৈন্যগণকে দেখিবামাত্র তিনি বেগে ধাবিত হইয়া সেনাদলের বামপার্শ্ব ভেদ করিলেন, সৈন্যদল বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল; কিন্তু তাহার অনুগামী বীরেরা পদাতিসৈন্য লইয়া তাহার সহায়তা করিতে পারিলেন না; সুতরাং হিমু অগ্রসর হইয়া বাইরামখাঁর রক্ষিত সেনাদলের মধ্যস্থলে গিয়া পড়িলেন। বাইরাম খা ইতিপূর্বে তাহার দল তীরন্দাজগণকে উপদেশ দিয়া রাখিয়াছিলেন যে, গজাররাহী বিপক্ষেরা সম্মুখবর্তী হইলেই যেন তাহাদের মুখে শরনিক্ষেপ করা হয়। তীরন্দাজেরা হিমুর মুখে শরনিক্ষেপ করিতে লাগিল। একটা শর তাঁহার নেত্র বিদারণ করিয়া ফেলিল, হস্তীর হাওদার উপর হিমু অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন।
সেনাপতির পতনে সেনাদল আতঙ্কে হতবুদ্ধি হইয়া গেল; সুতরাং যুদ্ধও তকালে বন্ধ রহিল। কেবল বন্ধ থাকা নহে, বাইরামখাঁর সৈন্যগণ সেই অবকাশে বিপক্ষসৈন্যকে পরাভব করিয়া আকবরের পক্ষে জয়ঘোষণা করিল।
ইতিহাসে দৃষ্ট হয়, যে হস্তীপৃষ্ঠে হিমু আরোহণ করিয়াছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সেই মাহুত কাটা পড়ে।* প্রাকৃতিক বুদ্ধিবশে চালকশূন্য হস্তী তখন অচেতন হিমুকে লইয়া এক অরণ্যমধ্যে ছুটিয়া প্রবেশ করে। বাইরামখাঁর দূরসম্পৰ্কীয় একজন আমীর শাহকুলী মহরম-ই-বাহার সেই পলায়িত হস্তীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইয়া সেই অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করেন। হস্তীপৃষ্ঠে কে আছে, শাহকুলী তাহা জানিতেন না। হস্তীর নিকটবর্তী হইয়া তিনি তাহার পাশরঞ্জু ধারণ পূর্বক দেখিলেন, নেত্রযন্ত্রণায় অচেতন সেনাপতি হিমু। তৎক্ষণাৎ তিনি হিমুকে বন্দী করিয়া বাইরামার নিকটে আনয়ন করিলেন। বাইরাম সেই বন্দীকে শিশু সম্রাট আকবরের নিকট লইয়া গেলেন।
[* আবুল ফজেল বলেন, “মাহুত কাটা পড়ে নাই, সে ব্যক্তি প্রাণভয়ে প্রভুকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছিল।”]
ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসলেখকেরা বলেন, বন্দীকে দেখাইয়া বাইরামখাঁ আপন প্রভুকে বলিয়াছিলেন, “এই তোমার প্রথম যুদ্ধ। এই কাফেরের মস্তকে তোমার তরবারি পরীক্ষা কর। ইহা তোমার পক্ষে মহা গৌরবের কাৰ্য্য হইবে।”
আকবর উত্তর করিলেন, “এই বন্দী এক্ষণে মৃতবৎ; ইহার অঙ্গে আমি কিরূপে অস্ত্রপ্রহার করিব? যদি ইহার শক্তি থাকিত, তাহা হইলে সম্মুখযুদ্ধে আমি তরবারি পরীক্ষা করিতে পারিতাম।”
মরণাপন্ন হিমুর শিরচ্ছেদনে সম্রাট আকবর এইরূপে অস্বীকার করাতে বাইরাম স্বয়ং এক তীক্ষ্ণধার তরবারি লইয়া স্বহস্তে সেই বন্দীর মস্তকচ্ছেদন করিলেন। হিমুকে বিনাশ করিয়া বাইরাম খার উৎসাহবুদ্ধি হইল। পাঠান-সৈন্যগণ পরাজিত হইয়া, সেনাপতি লইয়া, সেনাপতি হারাইয়া দিল্লীতে পলায়ন করিতেছিল, বাইরামখাঁ আপন অশ্বারোহী সৈন্যগণকে তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিতে অনুমতি দিলেন–বলিয়া দিলেন, পলাতকেরা যেন পথের কোন স্থানে তিলমাত্র বিশ্রাম করিতে না পায়। সৈন্যগণ তাহাই করিল। অবিশ্রান্ত তিপ্পান্ন মাইল গমন করিয়া মোগলসৈন্যগণ পরদিন প্রাতঃকালে দিল্লীসহরে প্রবেশ করিল। হিমুর পতনে বালক আকবর আপাততঃ নিষ্কণ্টক হইলেন। ভারতবর্ষে তৎকালে তাহার তাদৃশ ভয়ঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেহই ছিল না। ত্রিশ বৎসর পূর্বে তাঁহার পিতামহ দিল্লী জয় করিয়া যেরূপ গৌরবান্বিত হইয়াছিলেন, তিনিও চতুর্দশ বৎসর বয়ঃক্রমে দিল্লী রাজধানীতে সেইরূপ গৌরবের অধিকারী হইলেন।
বাবরের সময়ে, হুমায়ুনের সময়ে ভারতবর্ষের অনেক রাজ্য সর্বপ্রকারে স্বাধীন ছিল। আকবরের অভিষেকসময়েও রাজপুতানায় কয়েকটী রাজ্য স্বাধীনগৌরবে উজ্জ্বল হইয়াছিল। জয়পুরের রাজা বাবরের সময়ে মোগলের প্রতি যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতেন। প্রদেশীয় এক একজন রাজা মোগলদরবারে কর দিতেন। জয়পুর অপেক্ষা যোধপুরের গৌরব তখন অনেক উচ্চ ছিল। সেরশাই যৎকালে হুমায়ুনের সহিত নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহে প্রবৃত্ত যোধপুরের রাজা মালদেব সিংহ তৎকালে তাঁহাকে পদে পদে বিপদগ্রস্ত করিয়াছিলেন। অপর কোন প্রতিপক্ষ সে সময় সেরশাহকে সেরূপে ব্যতিব্যস্ত করিতে পারে নাই। মোগলপক্ষে মালদেব সিংহের পক্ষপাতিত্ব ছিল, তথাপি কিন্তু সেরশাহতাড়িত পলাতক হুমায়ুনকে তিনি স্বরাজ্যে আশ্রয়দান করেন নাই। আকবর যখন দিল্লীর সিংহাসনে অভিষিক্ত হইলেন, মালদেবসিংহ তখন যোধপুরে স্বাধীন, সৰ্বাংশে কাৰ্য্যতৎপর এবং রাজপুতনার সমস্ত রাজা অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাশালী ছিলেন। যশশ্মীর, বিকানীর এবৎ মরুপ্রান্তরস্থ আরও কয়েকটী রাজ্য, সিন্ধুরাজ্য ও মূলতানরাজ্যও স্বাধীনতার বঞ্চিত ছিল না।
মুসলমানরাজত্বে প্রজারা বশীভূত ছিল বটে, কিন্তু পরস্পরের একতা ছিল না। রাজা, সুলতান অথবা সম্রাট, যাহার যে আখ্যাই হউক, তিনি কেবল ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা আমীরগণের উপর প্রভুত্ব করিতেন; প্রজাদের উপর তাহার আধিপত্য চলিত না। রাজা কেবল আপন দরবারেই রাজক্ষমতা পরিচালন করিতেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যগণকে কর্তব্যকাৰ্য্যে নিযুক্ত করিতেন। প্রদেশীয় অন্তরাজ্যসমূহ এক একজন প্রতিনিধির শাসনে স্বাধীন হইয়া থাকিত।
মুসলমানরাজত্বে হিন্দু প্রজাগণ অসুখী ছিলেন না। হিন্দু অধিবাসীর সংখ্যা সমগ্র অধিবাসীর সপ্ত অষ্টমাংশ। তাঁহারা স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্মানুষ্ঠান করিতে পারিতেন। যদিও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপর “জিজিয়া” নামে এক প্রকার মাথাগণতী কর অবধারিত ছিল, কিন্তু প্রজারা তাহা নিতান্ত কষ্টকর মনে করিতেন না। উপযুক্ত হিন্দুস্থানেরা রাজসরকারে বিশেষ সমসূচক উচ্চ উচ্চ পদ প্রাপ্ত হইতেন।
বাবর এবং হুমায়ুন রাজ্যশাসনে স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, ইহা অবশ্য স্বীকার্য। একজন রাজা যে সকল আইন প্রবর্তন করিতেন, তাহার উত্তরাধিকারী তাহা রদ করিয়া দিতেন। রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেহ কোন কাৰ্য্য করিতে পারিত না। কেবল বিদ্রোহ উপস্থিত হইলে, বিদ্রোহীরা যদি সঙ্কল্পে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিত, তবেই রাজারা কিছু শান্তভাব ধারণ করিতেন; অপর কিছুতেই তাহাদের স্বেচ্ছাচারিত বন্ধ হইত না। কিন্তু যে রাজা সুবিজ্ঞ, সুবিচারক, তাহার রাজ্যে অকারণ বিদ্রোহীরা কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিত না। সুবিচারবিতরণে যে রাজা সৰ্ব্বদা প্রজাপুঞ্জকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিতেন তাঁহার রাজ্যমধ্যে বিদ্রোহ সংঘটিত হইত না।
পানীপথের দ্বিতীয়যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া বালক আকবর অপরাপর রাজ্যাধিকারে মনোনিবেশ করিলেন। সমস্ত প্রদেশের অবস্থা যাহাতে সুন্দররূপে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, দেশীয়লোকের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা না হয়, বালক সম্রাট তদ্বিষয়ে মনোযোগী হইলেন। বাবরশাহ একদিনও এ চেষ্টা করেন। নাই। হুমায়ুন উহা অসম্ভব ভাবিতেন। তাহারা যাহা করিতেন তাহাতে কেবল যুদ্ধবিগ্রহই রাজনীতির মধ্যে গণনীয় ছিল। মূল শিথিল রাখিয়া চূড়ায় শোভা বৃদ্ধি করিতে গেলে একটা ঝটিকাতেই সমভূমি হইয়া যায়।
আকবর বালক হইলেও মূল দৃঢ় করিতে শিক্ষা করিয়াছিলেন। পানীপথ যুদ্ধে তাঁহার ভারতবর্ষলাভ বিষয়কার্যে তাহার বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভ। তাঁহার পিতা তাঁহার সহিত রাজকাৰ্য্যসম্বন্ধীয় পরামর্শ করিতেন। সুদক্ষ সেনাপতি বাইরামখাঁ তাঁহাকে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দিয়াছেন। চতুর্দশবর্ষীয় বালক একটী সাম্রাজ্যের অধিনায়ক হইলেন, ইহা সামান্য কথা নহে। ছয়মাসকাল তিনি স্বয়ং পঞ্জাবরাজ্য শাসন করিয়াছেন। চতুর্দশবর্ষীয় আকবর রাজ্যশাসনকর্তা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রণজয়ী। রাজাতে যে সকল গুণ থাকা আবশ্যক, আকবর তাহা অর্জন করিতেছেন। সংকটসময়ে কি করিতে হয়, তাহা তিনি বুঝিয়াছেন; কোন কোন ক্ষেত্রে দয়া করিতে হয়, তাহাও তিনি জানিয়াছেন। বাইরামখাঁর অনুরোধে হিমুর মস্তকছেদন করিতে অস্বীকার করিয়া তিনি একটী উত্তম দয়ার পরিচয় দিয়াছেন। অন্যান্য রাজগুণ শিক্ষা করিবার এখন প্রকৃত অবসর।
আকবরের গঠন অতি সুন্দর ছিল। আজানুলম্বিত বাহু, বিশাল বক্ষ এবং বৃহৎ নেত্র। তাঁহার শরীরে বিলক্ষণ বল ছিল। নাসিকার বামভাগে মটরের ন্যায় একটী আঁচিল, তাহাতে তাঁহাকে অতি সুন্দর দেখাইত। মুখশ্রী দেখিয়া যাহারা ভাগ্য অবধারণ করেন, তাহারা বলিতেন, ঐরূপ আঁচিল প্রচুর বিভবের এবং বর্ধিত সৌভাগ্যের অগ্রবর্তী লক্ষণ। তাঁহার প্রকৃতি কোমল এবং উগ্র; স্বর গম্ভীর; বাকপটুতা অসাধারণ; তিনি অতিশয় ক্লান্তিসহিষ্ণু, অশ্বারোহণে কৌতুকী, ভ্রমণে আমোদী এবং শিকারে স্থিরলক্ষ্য। যেরূপ ব্যায়ামে শরীর সবল হয়, তাহাতেও তিনি অভ্যস্ত হইয়াছিলেন।
সংগ্রামে আকবর প্রস্তুত ছিলেন। রাজ্যের মঙ্গল এবং সাধারণের মঙ্গলের নিমিত্ত তিনি যুদ্ধ করিতেন; কিন্তু যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তাহার আনন্দ হইত না। রাজ্যশাসনের সুব্যবস্থাই রাজ্যরক্ষার দৃঢ়ভিত্তি, ইহা তিনি বলিতেন। যুদ্ধ কেবল তাঁহার পক্ষে প্রয়োজনীয় পাপ ভিন্ন আর কিছুই নহে। শাসনপ্রণালীর পূর্ণতাসাধনার্থ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া তাঁহার অভ্যাস ছিল; অপর কোন কারণে তিনি একটীও যুদ্ধঘোষণা করেন নাই। নরশোণিতপাতে তাঁহার ইচ্ছা ছিল না। স্নেহ, মমতা, বন্ধুবৎসলতা তাঁহার স্বভাবের অলঙ্কারস্বরূপ ছিল। কেহ অপরাধ করিলে, প্রতিহিংসাসাধন না করিয়া ক্ষমা করিতেই তিনি ভালবাসিতেন। পরের সুখ দেখিলে, তিনি সুখী হইতেন। মহত্ত্বের যতগুলি লক্ষণ, আকবরের তাহা সমস্তই বিদ্যমান ছিল।
সৰ্ব্বকালেই মানবজাতির অনিষ্টসাধক কতকগুলি কাৰ্য্য আছে। এ কালেও তদ্দারা অনিষ্ট সাধিত হইতেছে। ধর্মের অনুষ্ঠান, নীতিবিধান, বিচারবিতরণ, এই তিন বিষয়ে মনুষ্য প্রায়ই বিবেচনা-পরিশূন্য হয়। আকবরের সে দোষ ছিল না। কুসংস্কারবর্জিত ঔদার্য তাঁহার নিত্যভূষণ ছিল। মুসলমানের ঔরসে জন্ম, মুসলমানপদ্ধতিতে লালিত, পালিত, শিক্ষিত; কিন্তু বৌদ্ধ, ব্রাহ্ম, হিন্দু, পাসী এবং খৃষ্টানের সহিত সমভাবে, সমসংস্কারে তিনি ধৰ্ম্মালাপ করিতেন। কেহ কেহ এই বলিয়া তাঁহার স্বভাবে দোষ দেন যে, অধিকবয়সে তিনি বিদ্বান মৌলবীগণকে দেখিতে পারিতেন না, রাজসভা হইতে তাহাদিগকে অপসৃত করিয়া দিতেন। এ অপবাদ ঠিক নহে। তিনি কুসংস্কার ঘৃণা করিতেন। যে সকল অধ্যাপক কুসংস্কারে অভ্যস্ত, আপন বিশ্বাসের বিরুদ্ধবাদে যাহারা ক্রোধান্ধ, তাহাদিগকে তিনি ভালবাসিতেন না। যাহারা আত্মমতে অন্ধ হইয়া অপরের সহিত বিবাদ বাধাইতেন, তাহাদিগকে তিনি রাজসভায় আসিতে নিষেধ করিয়াছিলেন।
বাইরামখাঁ তাঁহার শিক্ষক। কিন্তু আকবর যে কি পদার্থ, বাইরামখাঁ তাহা অগ্নে জানিতেন না। যদি জানিতেন তাহা হইলে টার্ডি বেগকে গোপনে হত্যা করিতেন না, বন্দী হিমুর শিরচ্ছেদনেও অনুমতি করিতেন না। শেষকালে তিনি বুঝিলেন, তাঁহার ন্যায় অপরাপর আমীরওমরাও বুঝিলেন, আকবর তাহাদের জ্ঞানশিক্ষার্থী ছাত্র নহেন, আকবর তাঁহাদের প্রভু; আকবর যাহা আদেশ করেন, সৰ্ব্বতোভাবেই তাহা তাহাদের পালন করা কর্তব্য।
পানীপথ-যুদ্ধে জয়লাভের পর একমাস আকবর দিল্লীতে রহিলেন। হিমুর অধীনস্থ বিচ্ছিন্ন সেনাগণ অনেক ধন-দৌলত লইয়া পলায়ন করিতেছিল, তাহাদিগের অনুসরণার্থ এবং সেই সকল ধনরত্ন অধিকারকরণার্থ দিল্লী হইতে তিনি একদল সৈন্য মেওয়াটে প্রেরণ করিলেন। সেই দলের সেনাপতি পীর মহম্মদ খাঁ। পলায়িত পাঠানসৈন্যের সহিত মোগলসৈন্যের একটী ক্ষুদ্ৰযুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পীর মহম্মদ জয়ী হইয়া প্রভুর প্রিয়পাত্র হন। তদনন্তর আকবর স্বয়ং আগরায় যুদ্ধযাত্রা করিয়া আগরা অধিকার করিলেন।
শতদ্রুত দক্ষিণে যে সকল রাজ্য আকবর জয় করেন, পঞ্জাব নিরাপদ না হওয়া পৰ্য্যন্ত তাহা বিশৃঙ্খল ছিল। সেকন্দর শূর তখনও তাঁহার জাতশত্রু। ১৫৫৭ অব্দের মার্চ মাসে আকবর সংবাদ পাইলেন, যে সকল সৈন্য তিনি পঞ্জাবে রাখিয়া আসিয়াছিলেন, লাহোরের চল্লিশ মাইল দূরে সেকেন্দর শূর তাহাদিগকে পরাজয় করিয়াছেন। আরও তিনি মহাযুদ্ধ বাধাইবেন, এরূপ সম্ভাবনা। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তিনি সরাসরি লাহোরে যাত্রা করিলেন;–দেখিলেন, লাহোর নিরাপদ। সম্রাট তথা হইতে জলন্ধরে যাত্রা করিলেন। সেকন্দর শূর জলন্ধরেই শিবিরস্থাপন করিয়াছিলেন। আকবর আসিয়াছেন শুনিয়া তিনি তথ্য হইতে সিবালিক পৰ্ব্বতশ্রেণীতে পলায়ন করিয়া মানকট দুর্গে আশ্রয় লইলেন। আকবরের সৈন্যগণ মানকট দুর্গ পরিবেষ্টন করিল।
মানকট-দুর্গ ক্রমাগত ছয়মাস অবরুদ্ধ, অনাহারে এবং নানা কষ্টে দুৰ্বল হইয়া সেকেন্দর তাঁহার কতিপয় পারিষদকে সন্ধিপ্রার্থনায় আকবরের নিকট পাঠাইলেন। দয়াপরবশ হইয়া আকবর এই রূপ আদেশ দিলেন যে, সেকেন্দর স্বয়ং বঙ্গদেশে চলিয়া যাইতে পারেন; তাঁহার পুত্র দিল্লীতে প্রতিভূস্বরূপ থাকিবেন। অঙ্গীকার এই থাকিল যে, সেকেন্দর আর কখনও সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবেন না।
সেকেন্দর তাহাই স্বীকার করিলেন। মানকট দুর্গ আকবরের হইল। আকবর লাহোর ফিরিয়া আসিলেন। চারিমাস চতুর্দশদিবস লাহোরে অবস্থান করিয়া তিনি দিল্লীতে আগমন করিলেন। পরে জলন্ধরে কয়েকদিন বিশ্রাম করা হয়। সেই স্থানে হুমায়ুনের এক পিতৃব্যকন্যার সহিত বাইরাম খার বিবাহ হইয়া যায়। হুমায়ূন জীবিত অবস্থায় এই বিবাহের সম্বন্ধ করিয়া গিয়াছিলেন। পিত ইচ্ছা-পরিপূর্ণনার্থ আকবর তাহাতেই অনুমোদন করিলেন।
১৫৫৮ অব্দের মার্চমাসের পঞ্চদশদিবসে আকবর পুনরায় দিল্লীতে আসিলেন। বিষয়কৰ্ম্মের ভার, শিক্ষকতার ভার, অভিভাবকের ভার, সমস্তই তখনও বাইরামখাঁর হস্তে। আরও দুই বৎসর বাইরাম খা সেই সকল কর্তব্যকর্ম নিৰ্বাহ করিলেন। যাহার অধীনে শিক্ষালাভ করিয়া যাহারা অভিভাবকতায় প্রতিপালিত হইয়া রাজকার্যে দক্ষতা জন্মিয়াছে, তাদৃশক্ষমতাপন্ন সেনাপতির অধীনতা পরিত্যাগ করা একটী বালকের পক্ষে নিতান্ত সহজ ছিল না। যদিও বাইরাম খার কোন কোন কাৰ্য্য আকবরের অপ্রীতিকর হইয়াছিল, তথাপি বাইরাম আঁকে তিনি শীঘ্র শীঘ্র অবসরদান করিতে সঙ্কুচিত হইলেন। বাইরামের দুর্ব্যবহারে রাজদরবারের অনেকগুলি বিজ্ঞ বিজ্ঞ অমাত্য বিদূরিত হইয়াছিলেন। আকবর তাঁহাদিগকে ভালবাসিতেন, অকারণে বাইরাম তাঁহাদিগকে শত্রুজ্ঞান করিয়া তাহাদের প্রতি শত্রুতাচরণ করেন। সেই উপলক্ষে বাইরামের প্রতি আকবরের বিরাগ জন্মিতে থাকে। প্রথমে অঙ্কুর, তাহার পর পল্লব, তাহার পর বৃক্ষে পরিণতি। রাজবিরাগ ক্রমশই পরিবর্ধিত। প্রাকৃতিক প্রতিভাপ্রভাবে বর্ষে বর্ষে আকবর রাজকার্যে বহুল অভিজ্ঞতা অর্জন করিতেছেন, বাইরাম তাহা বুঝিতে পারেন নাই। তখনও তিনি আকবরকে সেই বালকছাত্র মনে করিতেন। তখনও তিনি ভাবিতেন, বালকের জন্য রাজ্যজয় করিয়া দিয়াছি, বালকের জন্য রাজ্যশাসন করিতেছি, অতএব আমিই সর্বেসর্বা। স্বেচ্ছাচার বাধা না পাইলেই ক্রমে ক্রমে সীমা ছাপাইয়া উঠে। বাইরামের স্বেচ্ছাচার সীমা ছাপাইয়া উঠিল।
দরবারের পারিষদবর্গ আন্তরিক রাজভক্তি-প্রদর্শনে অনুরাগী; কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই বাইরামের উৎপীড়নে অসন্তুষ্ট; বাইরামের প্রতি অনেকেরই ঘৃণা। কেননা, বাইরাম তাহাদের অকারণ অনিষ্ট করিয়াছেন। সম্রাটের নিকটে যে অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইবার আশা, বাইরামের মধ্যবর্তিতায় সে অনুগ্রহলাভে নিশ্চয়ই তাহাদিগকে বঞ্চিত থাকিতে হয়। অমাত্যপক্ষে ত এইরূপ, এতদ্ব্যতীত ধাত্রীমাতার অনুরোধও রাজকর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। তাহার ধাত্রী পুনঃপুনঃ তাহাকে বলিতে লাগিলেন, “রাজকাৰ্য্য তুমি স্বহস্তে গ্রহণ কর।”
এই ধাত্রী জন্মকাল হইতে অভিষেকের পর পর্যন্ত আকবরের লালনপালন করিয়াছেন। আকবর তাঁহার অনুরোধ এড়াইতে পারিলেন না। তখন আকবরের বয়ঃক্রম অষ্টাদশবর্ষ। পানীপথযুদ্ধের পর চারি বৎসরকাল তিনি রাজকার্য্যের আলোচনায় অধিকপরিমাণে যোগ্যতা লাভ করিয়াছেন। বাইরামের নিষ্ঠুরতা ও পক্ষপাতিতা দেখিয়া দেখিয়া তাহার মহৎ অন্তঃকরণ ক্রমশই ব্যথিত হইতেছিল; কিন্তু মহৎ অন্তঃকরণের সমস্ত শিক্ষাই মহত্ত্বর অনুগামী। শিশুকাল হইতে শিক্ষাদান করিয়া যৌবনকাল পর্যন্ত যিনি মন্ত্রীত্ব করিতেছেন, কি করিয়া তাঁহাকে হঠাৎ পদচ্যুত করা হয়, ইহাই আকবর ভাবেন। বাইরামের চরিত্র তিনি বিশেষরূপে পৰ্যালোচনা করিয়াছেন। তাহার সহিত অল্পমাত্রই অমিলন হইলেই সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছেদ ঘটিবে, ইহা নিশ্চয়ই। আকবর মনে করিলেন, বাইরামের হস্তে কোন প্রকার ক্ষমতা না রাখিলেই তিনি নিশ্চিত হইতে পারেন। কতক ক্ষমতা কমাইয়া দিলে বাইরাম তুষ্ট থাকিবেন না, তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমতালাভ করিতে অভিলাষী, নতুবা অল্প ক্ষমতা পাইলে কদাচ তিনি প্রিয়চিকীর্ষ থাকিবেন না।
১৫০৭ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে রাজকাৰ্য্যসম্বন্ধে নানা প্রকার নূতন নূতন ঘটনা হইল। আকবর সেই সময়ে স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। মন্ত্রীকে এই সঙ্কল্প জানাইবার নিমিত্ত তিনি আগরা হইতে দিল্লীতে আগমন করিলেন। বাইরাম খাঁ রাজদরবারের যে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী আমীরকে ঘৃণা করিতেন। কি প্রণালীতে তাহাকে দমন করিতে হয়, অনেকবার তাহার নূতন নূতন দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন। তাহার অবলম্বিত প্রণালীর নাম ছোরা অথবা তলোয়ার। পবিত্র-হৃদয় নবীনসম্রাট সেই নিষ্ঠুর প্রণালীকে মহা অপরাধসূচক মনে করিতেন। তাহার জননী এবং ধাত্রী পরামর্শ দিতেন, বাইরামকে সসম্ভ্রমে মক্কায় পাঠাইয়া দেওয়া হউক, বাইরামও সর্বদা সাধারণসমক্ষে বলিয়া বেড়াইতেন, দুৰ্ব্বহ রাজ্যভার অপরের হস্তে অৰ্পণ করিয়া মুক্তিবাসনায় তীর্থবাস করিতে পারিলে তিনি কৃতার্থ হন। দিল্লীতে উপস্থিত হইয়া সম্রাট আকবর এই মর্মে এক ঘোষণাজারী করিলেন যে, স্বরাজ্যের শাসনভার তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন, এখন অবধি তাঁহার নিজের অনুমতি বিনা কাহাকেও অপরের কোন অনুমতিপালন করিতে হইবে না। সেই ঘোষণাপত্রের একখণ্ড প্রতিলিপি বাইরাম খার নিকটে প্রেরিত হইল। সেই সঙ্গে একখানি পত্র গেল। তাহাতে লেখা রহিল, আপনার দক্ষতায় এবং সাধুতায় আমি পরম সন্তুষ্ট আছি; আমি ইচ্ছাপূর্বক তন্নিমিত্ত আপনার হস্তে সমস্ত রাজভার সমর্পণ পূর্বক নিশ্চিন্ত ছিলাম। এক্ষণে আমি স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ করিলাম, আপনি এখন আপনার অভিলাষিত মুক্তিকামনায় মক্কাতীর্থে যাত্রা করিতে পারেন। ভারতবর্ষের পরগণা হইতে আপনার নিয়মিত ব্যয়নিৰ্বাহাৰ্থ আপনাকে একটী উপযুক্ত জায়গীর প্রদান করা হইবে। সেই জায়গীরের উপস্বত্বের টাকা আপনার মোক্তারেরা নিয়মিতরূপে আপনার নিকট পাঠাইয়া দিবেন।
এই পত্র প্রাপ্ত হইবার অগ্রে আকবরের স্থিরসঙ্কল্প বাইরাম খার শ্রবণগোচর হইয়াছিল। তন্নিমিত্ত পশ্চিম উপকূলে যাইবার অভিপ্রায়ে তিনি আগরা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। মনে মনে কিন্তু তাহার ক্রোধ জন্মিয়াছিল। যাহাতে রাজ্যের অপকার হয়, তাহাই তিনি করিবেন, এইরূপ মনস্থ করিয়াছিলেন। বিয়ানাতে পৌঁছিয়া তিনি তত্ৰত্য কতিপয় বন্দী আমীরকে কারামুক্ত করিয়া দিলেন। সেই সকল আমীর রাজবিদ্রোহে আকৃষ্টচিত্ত। বিয়ানাতেই বাইরাম আকবরের পত্র প্রাপ্ত হন। বিয়ানা হইতে জনকতক অনুগত আমীরকে সানুচর সঙ্গে লইয়া তিনি রাজপুতানার অন্তর্গত নাগরপ্রদেশে যাত্রা করেন। নাগরে পৌঁছিয়া সম্রাটের ইচ্ছায় বশীভূত হইবার নির্দেশনস্বরূপ তিনি আপন পতাকা, দামামা, রাজপতক এবং আমীরী সম্ভ্রমের অপরাপর আসবাব একজন অনুচরের দ্বারা সম্রাটের নিকট পাঠাইয়া দেন। আকবর বুঝিয়াছিলেন, ঐরূপে অপসৃত করিয়া দিলে বাইরাম নিশ্চয়ই পঞ্জাবীগণকে পাঞ্জাবে বিদ্রোহাগ্নি জ্বালিবার কুমন্ত্রণা দিবেন, ইহা জানিয়াই তিনি সসৈন্যে পাঞ্জাবে যাত্রা করিয়াছিলেন। যকালে বাইরাম ঐ সকল সমচিহ্ন প্রত্যার্পণ করেন, সম্রাট তকালে রোটক-প্রদেশের ঝঝর-নগরে অবস্থান করিতেছিলেন। বাইরাম-প্রেরিত পতাকা-দামাদানি তাঁহার হস্তগত হয়। পূর্বে একজন আমীর বাইরাম খার বিশ্বাসভাজন প্রিয়পাত্র ছিলেন। শেষকালে বাইরাম তাহার উপর বক্র হন। বাইরাম ত্যক্ত রাজ্যসম্ভব-চিহ্নাদি তাহাকেই অৰ্পণ করিয়া সম্রাট তাহাকে রাজপুতানায় পাঠাইলেন। মক্কায় যাইবার জন্য বাইরামকে জাহাজে তুলিয়া দিবার ভার তাহার প্রতিই অর্পিত হইল। সেই বন্দোবস্তে বাইরাম খাঁ এককালে মাহাক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। নাগর হইতে বিকানীরে গমন করিয়া তিনি আপন পরিবারবর্গকে আপন দত্তকপুত্রের হস্তে সমর্পণপূর্বক রাজবিদ্রোহী হইলেন। মোগলসম্রাটের বিশ্বাসভাজন প্রধান কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রজ্বলিত করার কতদূর প্রভেদ, বাইরামের তাহা জানা ছিল না। দিপালপুরে পৌঁছিয়া তিনি শুনিলেন, তাঁহার দত্তকপুত্ৰ পূৰ্ববিশ্বাস ভঙ্গ করিয়া তাহার বিরুদ্ধাচারী হইয়াছেন। তখন কি হয়, জলঙ্কর দুয়ারে বিদ্রোহ উৎপাদনাৰ্থ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া শীঘ্র শীঘ্র তিনি জলন্ধরাভিমুখে ধাবিত হইলেন। সীমাভাগে পৌঁছিবামাত্র পাঞ্জাবের শাসনকর্তা আজ খার সৈন্যের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। সুখের সাক্ষাৎ নহে, সেই স্থানেই যুদ্ধ বাধিল। বাইরাম খা সেই যুদ্ধে পরাজিত হইয়া লুধিয়ানার পশ্চিম ৩০ মাইল দূরস্থ শতদ্রুতীরবর্তী দিনবারা-রাজ্যে পলায়ন করিলেন। আকবর ইহা অবগত হইয়া পশ্চাদ্ধাবনপূর্বক তাহাকে ধরিলেন। নিরুপায় হইয়া বাইরাম তখন সম্রাটের দয়াভিক্ষা করিলেন। সময়ে বাইরাম খা অনেক উপকার করিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিয়া সম্রাট তাহাকে ক্ষমা করিলেন এবং অনেকগুলি টাকা প্রদান করিয়া তাহাকে মক্কার পথে তুলিয়া দিলেন। বাইরাম নিরাপদে গুজরাটে পৌঁছিলেন। তথাকার গবর্ণর তাহাকে সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। বাইরামের ভারতপরিত্যাগের আয়োজন হইতেছিল, এমন সময়ে একজন লোহাগী পাঠান তাঁহাকে খুন করিয়া ফেলিল। এক যুদ্ধে সেই পাঠানের পিতাকে বাইরাম নিহত করিয়াছিলেন, তাহারই এই প্রতিশোধ। “আল্লা-হহা আকবর”–ঈশ্বর করুণাময়! চরমে এই বাক্য উচ্চারণ করিয়া বাইরাম খা প্রাণত্যাগ করিলেন। আকবর তাহার পুত্রকে রাজকার্যে নিযুক্ত করিয়া লইলেন।
১৫০৭ খৃষ্টব্দের নবেম্বরমাসের নবমদিবসে আকবর পুনর্বার দিল্লীতে ফিরিয়া আসিলেন। তথায় কয়েকদিন বিশ্রাম করিয়া আগরায় যাত্রা করিলেন। বিজয়, একতা এবং প্রদেশসমূহের সামঞ্জস্যবিধানে তাহার যে অভিলাষ হইয়াছিল, সেই অবসরে তিনি সেই মহষ্কাৰ্যসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। সেই সময় হইতেই মন্ট্রিবিরহিত রাজ্যশাসনে তাঁহার একাকী প্রভুত্ব করা আরম্ভ।
আকবরের আধিপত্য তখন পশ্চিমে পঞ্জাব এবং উত্তরপশ্চিম প্রদেশ। ইহার অন্তর্গত গোয়ালিয়র এবং অজমীর; পূর্বদিকে লক্ষৌ এবং অযোধ্যার অবশিষ্ট প্রদেশ। ইহার অন্তর্গত জৌনপুর পর্যন্ত। এলাহাবাদ, বারাণসী, চুনার, বঙ্গদেশ এবং বেহারপ্রদেশ তখনও পর্যন্ত পাঠান-প্রতিনিধি শূরবংশীয় রাজগণের অধীনে ছিল। ভারতের দাক্ষিণাত্যপ্রদেশ এবং পশ্চিম ভারতবর্ষের অধিকাংশ স্থান তখন আকবরশাহের আধিকৃত রাজ্যসীমার বহির্ভূত।
পানীপথের যুদ্ধের সময় হইতে গণনা করিলে এই সময় পর্যন্ত আকবরের রাজত্বকাল ছয় বৎসর। আকবর যখন বাইরাম খাঁর পরমর্শানুসারে কাৰ্য্য করিতেন তখন অবধি তাহার মনে ছিল, রাজা-প্রজা সুখসম্মিলনে একজন প্রধান সম্রাটের বশীভূত থাকিয়া সম্রাটকে জাতিসাধারণ অধিপতি বলিয়া স্বীকার করেন, এরূপ বিধান করিতে পারিলে, প্রকৃতপক্ষে ভারতশাসনের সুশৃঙ্খলা হয়। পূর্ণাংশে এই শৃঙ্খলাবন্ধন করা বহুকষ্টসাধ্য। চারিশত বৎসর মুসলমানেরা ভারতের স্থানে স্থানে রাজত্ব করিতেছেন, কিন্তু কেহই এ পর্যন্ত সর্বজাতির এক তা-সচেষ্ট হন নাই।
মোগলের পূর্বে যাহারা যাহারা কিছুদিন হিন্দুস্থানে রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাঁহাদের বংশধরেরা রাজা হইবার লোভে বঙ্গদেশ হইতে গুজরাট পর্যন্ত সর্বস্থান একক উপনিবেশ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রত্যেকেই হিংসা করিয়া বলিতেন, মোগল কতদিন? অল্পদিনমাত্র মোগলরাজা এদেশে উচ্চক্ষমতা ধারণ করিয়া বিলোপ প্রাপ্ত হইবে। ভাগ্য প্রসন্ন হইলে, তাহাদেরই মধ্যে কেহ না কেহ মোগলকে দূর করিয়া সিংহাসনে অধিরোহণ করিবেন অথবা সম্ভবতঃ কোন নৃতন বিজেতা আসিয়া মোগলকে তাড়াইয়া দিবে। অতি সহজে হুমায়ুন বিতাড়িত হইয়াছিলেন। সেই কথা স্মরণ করিয়া রাজ্যলোভিদিগের মোগলরাজ্যের অস্থায়িত্বে একপ্রকার অটলবিশ্বাস দাঁড়াইয়াছিল। কনোজে পরাজিত হইয়া হুমায়ুন হিন্দুস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন; ত্রয়োদশবৎসর রাজত্বের কিছুমাত্র নিদর্শন রাখিয়া যাইতে পারেন নাই।
আকবর ঐ প্রকার জনরব কর্ণগোচর করিয়াছিলেন। যাহাতে লোকের মন হইতে ঐ সংস্কার দূরীভূত হয়, তদ্বিষয়ে তিনি বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য জয় করিয়া তিনি আপন রাজ্যভুক্ত করেন। যে সকল রাজ্য জয় করা হইবে, তত্রত্য প্রজাপুঞ্জের শান্তিস্বত্ত্ব নিরাপদে রক্ষা করা, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রকৃতিপুঞ্জের স্ব স্ব ধর্মানুষ্ঠানে স্বাধীনতা প্রদান করা এবং প্রজাগণ যাহাতে তাহাকে রক্ষাকর্তা পিতার ন্যায় সম্মান করে, কাৰ্য্যদ্বারা তাহার সদুপায়বিধান করা, যুবা আকবরের আন্তরিক সঙ্কল্প হইল। নিরপেক্ষভাবে, একব্যবস্থানুসারে একপ্রকার বিচারবিতরণে সর্বশ্রেণীর সন্তোষবিধান করা তাঁহার রাজনীতির প্রধান অঙ্গ হইল। গোড়া মুসলমানেরা তাঁহার এই অপরাধ রটনা করিয়াছিল যে, আকবর আপনাকে জগদীশ্বরের তুল্য শক্তিমান মনে করেন। যে কারণে এই অপবাদ রটিত হইয়াছিল, আকবর তাহাও বুঝিয়াছিলেন। ভারতের ন্যায় দেশে তাদৃশসময়ে তিনি রাজদণ্ড ধারণ করিয়া সর্বজাতিকে একসূত্রে বদ্ধ, সমদ্বর্শিতা প্রদর্শন, সুবিচারবিতরণ, সমান অধিকারপ্রদান এবং সকলের প্রতি সমান দয়াপ্রকাশ করিয়া পৃথিবীতে স্বর্গীয়দূতের ন্যায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা পরিচালন করিতেছিলেন; অজ্ঞানলোকেরা ইহাতেই তাঁহাকে অপরাধী মনে করিত।
ভারতবর্ষকে একচ্ছত্র করা আকবরের প্রধান উদ্দেশ্য। প্রজাগণের দৈহিক ও মানসিক মঙ্গলসাধন করা তাহার সঙ্কল্প ছিল। ষষ্ঠবার্ষিক রাজত্বকালে একবৎসরের খাস আমলে তিনি মালবরাজ্য পুনরাধিকার করিয়া লইলেন। তদনন্তর তাঁহার সেনাপতিগণ কর্মনাশা পার হইয়া জৌনপুর আক্রমণ করিতে যাত্রা করিলেন। আকবর স্বয়ং কালপীর পথ দিয়া যমুনা পার হইয়া প্রয়াগের নিকটস্থ গঙ্গার দক্ষিণ-কূলবর্তী কারা-নগর পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। তাহার সেনাপতিগণ জৌনপুর অধিকার করিয়া তথায় তাহার সহিত মিলিলেন। অনন্তর তিনি আগরায় প্রত্যাগমন করিলেন। সেই বৎসরের শেষভাগে যোধপুর-রাজ্যের অন্তর্গত মার্টা নগর তাঁহার অধিকারভুক্ত হইল। সেই সমৃদ্ধিশালী নগর যোধপুরসহরের ছিয়াত্তর মাইল উত্তরপূর্বদিকে অবস্থিত। তাহার নিকটেই অজুমীর। নূতন যুদ্ধের পূর্বে আকবর অজমীর ছিলেন। তথা হইতেই যুদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করেন। রাজপুত সৈন্যগণ সবিশেষ বীরত্বে সেই নগর রক্ষা করিয়াছিল। পরবৎসর বসন্তকালে তাহারা এই অঙ্গীকারে বাধ্যতা স্বীকার করিল যে, সৈন্যগণ সশস্ত্র অশ্বারোহণে নগর হইতে বাহির হইয়া যাইবে। তাহাদের সম্পত্তি ও আসবাবপত্র কিছুই সঙ্গে লইয়া যাইতে পারিবে না।
১৫৬২ খৃষ্টাব্দে মার্টা-বিজয়ের পর মালবস্থ মোগলসেনাপতিগণ পশ্চিমাভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করিয়া তপতীনদীতীরস্থ বিজয়গড় এবং বরহানপুর নগর জয় করিলেন। তাহার ফল এই যে, উক্ত উভয় নগরের শাসনকর্তারা মালবের বিতাড়িত পাঠান-শাসনকৰ্ত্তার সহিত যোগে, প্রদেশস্থ জমীদারগণের সাহায্য, মহাবিক্রমে মোগলসৈন্যগণকে আক্রমণ করিলেন। সেই যুদ্ধে মোগলসৈন্য সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হইল। মালবরাজ্য কিছুদিনের জন্য আকবরের অধিকারচ্যুত হইয়া গেল কিন্তু বৎসর শেষ হইতে না হইতেই আর এক যুদ্ধে আকবর তাহা পুনরধিকার করিলেন।
মালবের পদচ্যুত পাঠানশাসনকৰ্ত্তা কিছুদিন বিফলে পৰ্যটন করিয়া পরিশেষে আকবরের দয়া-প্রার্থী হইলেন। আকবর তাহাকে একসহস্র সৈন্যের সেনাপতি নিযুক্ত করিলেন। অল্পদিন পরেই দুই সহস্ৰ সৈন্যের সেনাপতিত্ব প্রাপ্ত হইলেন। নবসম্রাটের অধীনে চাকরী করিতে করিতেই সেই পাঠান-সেনাপতির মৃত্যু হইল।
পাঠকমহাশয় বিবেচনা করিবেন, আকবর শাহ শত্রুপক্ষকে বশীভূত করিবার কেমন সুন্দর উপায় জানিতেন। সমাদরে কর্ম দিয়া, সদ্ব্যবহার করিয়া মানসম্ভ্রমের পদে মৰ্য্যাদা প্রদান করিয়া তিনি বিপক্ষের মনস্তুষ্টিসাধন করিতেন। শত্রু অধঃপাতে যাউক, নিদানসমুদ্রে ভাসুক, এমন ইচ্ছা আকবর কখনই করিতেন না। যাহারা পরাজিত হইত, সর্বদা তাহাদের প্রতি তিনি সদয় ব্যবহার করিতেন; নিজশক্তির সহিত তাহাদের শক্তি মিশাইয়া লইতেন। পরাজিত শত্রু তাহার শক্তি অতিক্রম করিয়া স্বতন্ত্রস্থানে শক্তিমান হইয়া উঠুক, এমন অবসর তিনি কদাচ দিতেন না। প্রথমে যাহারা বিরুদ্ধচারী হইয়া বিদ্রোহ উপস্থিত করিত তাহারা বুঝিত, সম্রাট জয়ী হইয়াই হউক, অথবা ইচ্ছাবশে সম্রাটের অধীনস্বীকার করিয়াই হউক কোন গতিকেই কাহাকেও ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইবে না। পরাজিত হইলেও পদমৰ্য্যাদালাভ, বশীভূত থাকিলেও পদমৰ্য্যাদালাভ, ক্রমশ বরং সেই মৰ্য্যাদার বৃদ্ধি ভিন্ন কোন ক্রমে হ্রাস হইবার সম্ভাবনা থাকে না।
আকবরের অষ্টমবার্ষিক রাজত্ববর্ষের বসন্তকালে এক শোকাবহ ঘটনা হইল। তাঁহার শিশুকালের ধাত্রী এবং যৌবনের পরামর্শদাত্রী সেই গুণবতী মহিলা সম্রাটের আদরের পাত্রী ছিলেন। বাইরাম খাঁকে বিদায় করা সম্বন্ধে আকবর তাঁহার পরামর্শানুসারেই অনেক কাৰ্য্য করিয়াছেন। প্রাসাদে তাহার প্রচুর সম্পত্তি ছিল। সম্রাট তাঁহার সন্তানগণকে প্রচুর বিত্তদান করিয়াছেন, সম্ভ্রমের পদেও নিযুক্ত করিয়াছেন। সেই ধাত্রীর জ্যেষ্ঠপুত্র ঈর্ষানলে জ্বলিয়া উঠিয়া প্রকাশ্য কাৰ্যালয় মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রাণবিনাশ করিল। ঈর্ষার কারণ এই যে, সে যাহাদিগকে তাহার নিজের অপেক্ষা অযোগ্য মনে করিত, মন্ত্রী তাহাদিগকে তাহাপেক্ষা উচ্চবেতনে উচ্চপদে নিযুক্ত করিতেন। ঈর্ষার সহিত অভিমান মিলিত হইয়া ধাত্রীপুত্রকে নৃশংসকাৰ্য্য করাইল। তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, সম্রাট তাহাকে এবং তাহার পরিবারবর্গকে ভালবাসেন, এ কার্যের জন্য হয়তো রুষ্ট হইবেন না। সেই বিশ্বাসে মন্ত্রীহত্যা করিয়া রাজান্তঃপুরের দ্বারদেশে গিয়া দাঁড়াইল।
তাদৃশ নিষ্ঠুরকাৰ্য্যকারী নরাধমের উপর আকবরের দয়া ছিল না। বৃত্তান্ত অবগত হইয়া তিনি সেই পাপাত্মা গুপ্তহত্তাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিবার দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করিলেন। দেহটা অবশেষে উচ্চপ্রাচীর হইতে নিম্নতরস্থ গড়খাই-গহ্বরে বিনিক্ষিপ্ত হইল। যাহারা ঐ ধাত্রীপুত্রকে মন্ত্রীহত্যা করিতে মন্ত্রণা দিয়াছিল, দণ্ডের ভীষণতা দেখিয়া তাহারা যমুনাপারে পলায়ন করিল। রাজপুরুষেরা দিনকতক পরে তাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়াছিল। অপরাধের লঘুত্ব বিবেচনা করিয়া সম্রাট তাহাদিগকে ক্ষমা করিলেন। পুত্রশোকে না হউক, পুত্রের তাদৃশ দুঞ্জিয়ার অনুতাপে অবসন্ন হইয়া প্রবীণা ধাত্রী চল্লিশদিন পরে দেহত্যাগ করিলেন।
কিছুদিন পূর্বে পঞ্জাবের একাংশে একটা গোলযোগ বাধিয়াছিল। গামার নামে তথায় এক জাতি আছে, তাহারা সর্বদাই দৌরাত্ম্য করিয়া বেড়ায়। তাহারা এবং তাহাদের সর্দারেরা মোগলরাজ্যেশ্বরকে মানিতে চাহে না। যে স্থানে তাহাদের বাস, সেই স্থানটা ছাড়িয়া দিতে সম্রাট তাহাদিগকে আদেশ করিয়াছিলেন, সে আদেশ তাহারা উপহাসে উড়াইয়া দেয়। সেই প্রদেশে একজন শাসনকৰ্ত্তা রাখিবার ব্যবস্থা হইয়াছিল, গামারেরা সেই শাসনকর্তাকে অগ্রাহ্য করিল। স্থানটা রাওলপিণ্ডী-প্রদেশের উত্তরপূর্বাংশে সংস্থাপিত। দুরন্তলোকেরা রাজাজ্ঞা অমান্য করাতে আকবর পরিশেষে তথায় একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। সেনাগণ কয়েকদিবস ঘোরতর যুদ্ধ করিয়া অবশেষে তথায় শান্তিস্থাপন করিল। গামার-সর্দার বন্দী হইয়া বন্দীদশাতেই প্রাণত্যাগ করিল।
সেই সময়ে কাবুলেও এক বিদ্রোহ হইয়া উঠে। আকবর সেখানেও সৈন্য পাঠাইয়া শান্তিস্থাপন করেন। অচিরকালমধ্যে হুমায়ুনের একজন প্রিয়পাত্র আবুলমায়ালী বিদ্রোহী হইয়া উঠে। যে ব্যক্তি ইতিমধ্যে মক্কায় গিয়াছিল, তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া, মদগর্বে স্ফীত হইয়া, মোগল-সম্রাটের অপকারসাধনে প্রবৃত্ত হয়। আর একজন বিদ্রোহী আমীর তাহার সঙ্গে যোগ দিয়াছিল। নারনল নামক স্থানের নিকটে তাহারা একদল রাজকীয়সৈন্যকে আক্রমণ করিয়া সকলকেই বিনাশ করে। আবুলমায়ালীকে ধরিবার নিমিত্ত আকবর সৈন্য প্রেরণ করেন। আবুলমায়ালী ভয় পাইয়া কাবুলে পলায়ন করে। তথা হইতে অনুতাপপূর্ণ এক পত্র লিখিয়া সম্রাটের নিকট পাঠায়। তাহাতে কোন ফল হয় না। পরবৎসরের প্রারম্ভে আবুলমায়ালী বন্দী হইয়া বদকসানে প্রেরিত হয়। রাজাদেশে তথায় ফাসী হইয়া যায়।
১৫৬৪ অব্দের বসন্তকালে পৰ্য্যন্ত আকবর আর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন নাই। এলাহাবাদের পূর্বপ্রদেশসমূহে মোগলাধিকারবিস্তারার্থ বহুদিনাবধি তাহার বাসনা ছিল, এতদিন তাহাও সিদ্ধ হয় নাই। চুনার তত্ত্বালে ঐ সকল পূর্বরাজ্যের দ্বারস্বরূপ ছিল। আদেল রাজত্বের একজন গোলাম তখন চুনারের শাসনকর্তা। আকবরের একজন সেনাপতি ভয়প্রদর্শন করাতে চুনার-দুর্গ পরিত্যাগ করিবার অঙ্গীকারে গোলাম তখন সম্রাটকে এক পত্র লেখে। সম্রাট সে দুর্গ দখলের জন্য দুইজন আমীরকে তথায় প্রেরণ করেন। গোলাম তাহাদিগকে দুর্গ ছাড়িয়া দেয়। চুনার অধিকৃত হইলে, নরসিংহপুর-প্রদেশ অধিকার সুবিধা হইল। একটী রাণী তখন নরসিংহপুরে রাজত্ব করিতেন। চৌরগড়ে তাহার দুর্গ ছিল। একজন মোগল-সেনাপতি তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। রাণীর পরাজয় হইল। নরসিংহপুর এবং হোসেঙ্গাবাদের কতকাংশ মোগলরাজ্যের অন্তর্নিবিষ্ট হইল।
সেই বৎসর গ্রীষ্মকালে মৃগয়াব্যপদেশে সম্রাট আকবর মধ্যপ্রদেশে যাত্রা করেন। পথে বর্ষাকাল আরম্ভ হয়। অতিকষ্টে বারিপূর্ণ নদনদী পার হইয়া আকবর শাহ নারবার নগরে উপস্থিত হন। সে নগরের তখন মহাসমৃদ্ধি, পরিধি প্রায় বিংশতি মাইল। সেই নগরের নিকটে কিছুদিন পরিভ্রমণ করিয়া সম্রাট তথা হইতে মালবাভিমুখে যাত্রা করেন। রাবা এবং সারঙ্গপুরের মধ্য দিয়া তিনি সুপ্রসিদ্ধ মানগরে গমন করিলেন। তথায় তিনি একজন উজবেগা আমীরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়াছিলেন। আকবর তাঁহার প্রতি অসন্তুষ্ট, ইহা জানিতে পারিয়া সেই শাসনকর্তা নগর পরিত্যাগ পূর্বক আপন অনুচরবর্গের সহিত পালায়নে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার অনুসরণার্থ আকবর একদল সৈন্য পাঠালেন। সেনাগণ গুজরাটের প্রান্তভাগে তাহাকে ধরিয়া তাহার অশ্ব, গজ এবং নারীগণকে কাড়িয়া লইল।
মান্দুতে সম্রাট আকবর মহাসমাদর প্রাপ্ত হইলেন। নিকটবর্তী প্রদেশের জমীদারেরা দলে দলে আসিয়া তাহাকে সেলাম দিতে লাগিলেন। খাদেশের রাজা প্রচুর উপটৌকনসহ দূত প্রেরণা করিলেন। আকবর সেই রাজদূতকে যথোচিত সমাদরে অভ্যর্থনা করিতে ত্রুটি করিলেন না। তৎকালে এক প্রথা ছিল, রাজসম্মানের জন্য প্রদেশীয় রাজারা এক একটী কন্যা পাঠাইতেন। প্রগুক্ত দূতকে আকবর যখন বিদায় দেন, তৎকালে খান্দেশের রাজার নামে একখানি পত্র লিখিয়া সেই দূতের হস্তে প্রেরণ করিলেন। পত্রে লেখা ছিল, সম্রাটের সেবা করিবার উপযুক্ত দেখিয়া আপনার একটী কন্যাকে মানগরে পাঠাইয়া দিবেন। খাদেশের রাজা মোবারক শাহ সেই পত্র পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন, উপযুক্ত সঙ্গিনী ও মূল্যবান অলঙ্কারাদি স্ত্রীধনসহ আপনার কন্যাকে সম্রাট সমীপে প্রেরণ করিলেন।
কিছুদিন মানগরে অবস্থান করিয়া সম্রাট স্বচ্ছন্দে উজ্জয়িনী, সারঙ্গপুর, সিপ্রী, মারবার এবং গোয়ালিয়ররাজ্য দর্শন পূর্বক আগরায় ফিরিয়া আসিলেন। শীতকালে অনেকদিন তিনি গোযোগলিয়র-প্রদেশে মৃগয়া করিয়াছেন।
রক্তপ্রস্তরনির্মিত বিচিত্র দুর্গ আগরার একটী দেখিবার সামগ্রী। ইউরোপ হইতে যে সকল ভদ্রলোক ভারতভ্রমণে আসিয়াছেন, তাহারা প্রায় সকলেই সেই দুর্গ দর্শন করিয়া ভূয়োভূয়ো প্রশংসা করিয়াছেন। পূর্বে সেই স্থানে ভগ্নপ্রায় কদাকার ইষ্টকনিৰ্মিত একটী ক্ষুদ্র দুর্গ ছিল। আকবর শাহ রাজ্যাভিষিক্ত হইবার পর সেই দুর্গ ভাঙ্গিয়া বিশালরাজ্যের সম্রাটের গৌরবানুরূপ সুন্দরদুর্গ নির্মাণে অভিলাষী হন। ১৫৬৫ অব্দে বসন্তকালে সেই দুর্গ নির্মাণের অনুমতি প্রদত্ত হয়। তিন হাজারী সেনাপতি কাসিম খাঁ সেই দুর্গের স্থপতিকাৰ্য্য ব্যবস্থা করিয়া দেন। দুর্গটি নির্মাণ করিয়া ষাট বৎসর লাগিয়াছিল। ব্যয় পঁয়ত্রিশলক্ষ টাকা।
বৎসরশেষ হইবার পূর্বে আর একটা গোলযোগ উপস্থিত হয়। রাজদরবারে অনেকগুলি উজুবেগী আমীর ছিলেন। মান্দুপ্রদেশের উজুবেগী শাসনকর্তা বিদ্রোহী হওয়াতে সম্রাট তাহার যেরূপ দণ্ড দিয়াছেন, তাহা স্মরণ করিয়া দরবারের উজবেগী পারিষদেরা ভাবিলেন, উজবেবংশীয়গণকে সম্রাট কুনয়নে দর্শন করেন; অতএব সম্রাটকে কিছু শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। তিন চারিজন উজবেগী এইরূপ পরামর্শ করিয়া শরৎকালে জৌনপুরে বিদ্রোহ বাধাইলেন; তথাকার গবর্ণরকেও আপনাদের দলে মিশাইয়া লইলেন।
মারবার-প্রদেশে আকবর তখন হস্তী শীকার করিতেছিলেন; সেইখানেই ঐ বিদ্রোহসমাচার পৌঁছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি একজন দক্ষ সেনাপতিকে সসৈন্যে জৌনপুরে প্রেরণ করিলেন। দশ-দিন পরে নিজেও বহুসৈন্য লইয়া কনৌজে উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে একজন বিদ্রোহী দলপতি তাহার শরণাপন্ন হইল। দশদিন তিনি কনৌজে রহিলেন। অতিবৃষ্টিতে নদীতে বন্যা আসিয়াছিল। জলহাস হইলে বাহির হইবেন, এইরূপ অভিপ্রায়। তথায় তিনি শুনিলেন, বিদ্রোহী-সর্দার লক্ষ্ণৌ নগরে চলিয়া গিয়াছে। তখন আর কালবিলম্ব না করিয়া তুরায়-লক্ষৌ-অভিমুখে যাত্রা করিলেন। চব্বিশ ঘণ্টাকাল অবিশ্রান্ত অশ্বারোহণে গমন করিয়া দ্বিতীয়দিবসের প্রাতঃকালে তিনি নগরসমীপে পৌঁছিলেন। আকবর আসিতেছেন, এই সংবাদ পাইয়া বিদ্রোহীরা দ্রুত অশ্বধাবনে তথা হইতে পলায়ন করিল। এত দ্রুত অশ্ব ছুটাইল যে, সম্রাটের অশ্ব তাহাদিগকে ধরিতে পারিল না।
বিদ্রোহী-দলপতি জৌনপুরে পৌঁছিয়া সঙ্গীদের সহিত মিলিত হইয়া একসঙ্গে জৌনপুর ত্যাগ করিল। ঘর্ঘরা নদী পার হইয়া ছাপরায় আসিয়া তাঁবু গাড়িল। তথা হইতে বঙ্গেশ্বরের সাহায্য চাহিয়া পত্র লিখিয়া লোক পাঠাইল।
সম্রাটের একজন সেনাপতি বিনা রক্তপাতে বিবাদ মিটাইবার ইচ্ছায় বিদ্রোহিদিগের সম্মুখীন হইলেন। আর একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেনাপতি নির্বাচিত সৈন্য লইয়া রাজপুতানা হইতে যাত্রা করিলেন। শান্তিপ্রিয় সেনাপতি ধীরবিক্রমে সন্ধির বন্দোবস্ত করিতেছেন, এমন সময়ে সেই উগ্ৰ সেনাপতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি কহিলেন, “সন্ধির কথা কেবল ছলনামাত্র; যুদ্ধ কর।” যুদ্ধ বাধিল। রাজকীয় সৈন্যগণ পরাজিত হইয়া দলবদ্ধ হইবার জন্য পরদিন সেরগড়ে পলায়ন করিল।
এই যুদ্ধ হইবার পূর্বে বিদ্রোহিদিগের সহিত সন্ধি করাই সম্রাটের অভিপ্রেত ছিল। মোগল সৈন্য পরাজিত হইয়াছেন তাহা শ্রবণ করিয়াও তিনি সন্ধির বাসনা পরিত্যাগ করিলেন না। তিনি কহিলেন, “বিদ্রোহিগণের সব অপরাধ ক্ষমা করা হইয়াছে, আর বিবাদে প্রয়োজন নাই। আমীরেরা আগরায় আসুন।” এইরূপ উপদেশ দিয়া তিনি চুনারে আসিলেন। তথাকার দুর্গ নিরাপদ করিয়া মির্জাপুরের অরণ্যে হস্তী শীকার করিবেন, এইরূপ ইচ্ছা করিলেন। বিদ্রোহীরা ক্ষমা পাইয়াছে, অস্ত্রত্যাগ করিতে হইবে না, সম্রাটের এইরূপ অনুজ্ঞা ছিল; কিন্তু বিদ্রোহীরা একবার জয়ী হইয়া গর্বিত হইয়া উঠিয়াছে, পুনরায় নূতনপরাক্রমে প্রবল হইয়া উঠিল। আকবর ক্ষমা-গুণের বশবর্তী হইয়া বিদ্রোহিগণকে আপন দরবারে পুনরাহ্বান করিলেন। বিবাদের শেষ হইয়া গেল। সেই বৎসর মোগল-সেনাপতিগণ বেহারের নোটাস-দুর্গ অধিকার করিয়া লইলেন। উড়িষ্যার রাজার নিকটে যে সকল দূত প্রেরিত হইয়াছিল, তাহারা তথা হইতে বিপুল উপহারসামগ্রী লইয়া ফিরিয়া আসিল।
১৫৬৬ অব্দের বসন্তকালে সম্রাট আগরায় ফিরিয়া আসিলেন। রাজ্যমধ্যে শান্তি বিরাজ করিতেছে, সেই আনন্দে তিনি নিশাকালে গোলা-খেলা আরম্ভ করিলেন। এই গোলা-খেলাকে ইংরাজেরা এখন পোলো (polo) বলেন। এই ক্রীড়া হিন্দুস্থান হইতে ইউরোপখণ্ডে নীত হইয়াছেন। এখন সমস্ত সভ্যজগতে উহার প্রচলন। দিনমানেই ক্রীড়া হয়। অন্ধকাররাত্রে খেলিবার জন্য আকবর এক নূতন উপায় আবিষ্কার করিলেন। পলাশকাষ্ঠের গোলা নির্মাণ করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দেন। পলাশকাষ্ঠ লঘুভার এবং পলাশের অগ্নি বহুক্ষণস্থায়ী তাহাতেই খেলিবার সুবিধা হইত। সে সময়ে আকবরের তুল্য ঐ খেলায় আর কাহারও নৈপুণ্য ছিল না।
আমোদে আবার বাধা পড়িল। কাবুলে এবং লাহোরে আবার বিদ্রোহানল জ্বলিয়াছে, এই সংবাদ আসিয়া পৌঁছিল। সম্রাট ত্বরান্বিত হইয়া বৎসরের শেষে শ-অভিমুখে যাত্রা করিলেন। দশদিনে দিল্লীতে পৌঁছিলেন, তথা হইতে সরহিলে গেলেন, তৎপর পরম উৎসাহে লাহোরে গিয়া উপস্থিত হইলেন; তথা হইতে সরহিন্দে গেলেন, তৎপর পরম উৎসাহে লাহোরে গিয়া উপস্থিত হইলেন; তথা হইতে বিদ্রোহিগণকে সিন্দুপারে তাড়াইয়া দিবার জন্য সেনাপতিগণকে প্রেরণ করিলেন। সেনাপতিগণ রাজাজ্ঞা পালন করিয়া প্রত্যাগত হইলেন। কাবুলের বিদ্রোহও সে সময় থামিয়া গিয়াছিল। দুই স্থান শান্ত হইল, কিন্তু আবার জৌনপুরে বিদ্রোহ-বহি জ্বলিল।
১৫৬৬ অব্দের অবসান। বিদ্রোহের উপর বিদ্রোহ। সম্রাট ব্যতিব্যস্ত। রাজ্যের সুবন্দোবস্ত করিবার কল্পনা পূর্ণাংশে সুসিদ্ধ করিতে তিনি সমর্থ হইয়া উঠিতেছেন না। তাঁহার রাজত্বকালের একাদশবর্ষ। এ সময়ে যদি কোন বিশেষ দুর্ঘটনা হয়, তাহা হইলে পুনরায় উত্তরাধিকারগ্রহণের জন্য তরবারির সাহায্য লইতে হইবে, ইহা নিশ্চয়।
বিদ্রোহের শান্তি হইল। ১৫৬৭ অব্দের প্রথম তিনমাস সম্রাট লাহোরেই রহিলেন। মৃগয়া এবং তদনুরূপ অন্যান্য আমোদে-প্রমোদে তাহার কালাতিপাত হইতে লাগিল। উজবেগী আমীরগণকে তিনি ক্ষমা করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার অনুপস্থিতিকালে আগরায় তাহার পুনৰ্ব্বার বক্রভাব ধারণ করিলেন। ২২ মার্চ তারিখে সম্রাট লাহোর পরিত্যাগ করিয়া আগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। থানেশ্বরে উপস্থিত হইয়া তিনি দেখিলেন, হিন্দুসম্প্রদায়ের দুই শ্রেণী উপাসক ধনলোভে দাঙ্গা বাধাইয়াছেন। একপক্ষে যোগী একপক্ষে সন্ন্যাসী। ভক্তিমান যাত্রিগণ থানেশ্বর-শিব মন্দিরে বহুপরিমিত স্বর্ণ, রত্ন, অলঙ্কার উৎসর্গ করিয়া দিয়াছেন, যোগীরা তাহা লইবেন, কিংবা সন্ন্যাসীরা তাহা পাইবেন, সেই সূত্রেই বিবাদ। সম্রাট সেই বিবাদের সামঞ্জস্য করিয়া দিলেন।
দিল্লীতে আর এক কাণ্ড। তথাকার একজন রাজবন্দী গবর্ণরকে বিমোহিত করিয়া পলায়ন করিয়াছে। সম্রাট কোপাবিষ্ট হইবেন, এই সন্দেহে গবর্ণর দিল্লী হইতে পলায়ন করিয়া রাজবিদ্রোহ হইয়াছেন। অতএব সম্রাটের শীঘ্র শীঘ্ৰ দিল্লীতে উপস্থিত প্রয়োজন হইল।
সম্রাট যখন আগরায় পৌঁছিলেন, তখনও অশুভসংবাদ। কনোজের নিকটবর্তীপ্রদেশে বিদ্রোহপ্রবল। আকবর বুঝিলেন, আমীরদলের অনেকগুলি পারিষদকে আর বিশ্বাস করা যায় না, সুতরাং তিনি ভোজপুরে যাত্রা করিয়া তথা হইতে রায়বেরিলীতে উপস্থিত হইলেন। তথায় শুনিলেন, বিদ্রোহীরা গঙ্গাপার হইয়া কালপী অভীমুখে যাইতেছে। অতিবৃষ্টিতে বন্যা আসিয়াছিল সম্রাট তখন কারাপ্রদেশে বহসৈন্য প্রেরণ করিয়া একদল নির্বাচিত সেনা সমভিব্যবহারে মাণিকপুরে চলিলেন। প্রতাপগড় এবং এলাহাবাদের মধ্যে মাণিকপুর। সেই স্থানে তিনি হস্তী আরোহণ করিয়া নদীপার হইলেন। মাণিকপুরে বিদ্রোহিগণকে ধরিয়া সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিলেন যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধের পরে প্রধান প্রধান বিদ্রোহিগণের প্রাণবিনাশ করা হইল। রণক্ষেত্র হইতে বিজয়ী আকবর প্রয়াগযাত্রা করিলেন। অনন্তর বারাণসী ও জৌনপুর দর্শন করিয়া আরায় ফিরিলেন।
পূর্বরাজ্য নিরাপদ মনে করিয়া সম্রাট তখন রাজপুতনার প্রতি মনোযোগ প্রদান করিলেন। রাজপুতনার প্রাচীন রাজগণের মধ্যে মেবারের রাণা উদয়সিংহ প্রধান। তাহার চরিত্রে দুর্বলতা এবং স্বেচ্ছাচারিতাই অধিক ছিল! তাহার প্রধানদুর্গ সুপ্রসিদ্ধ চিতোর। আলা-উদ্দীন খিলজী ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে সেই দুর্গ ভেদ করেন, অথচ পুনরায় চিতোরদুর্গ দুর্ভেদ্য বলিয়া বিঘোষিত হয়। উচ্চ পাহাড়ের উপর নদীকূলে সেই দুর্গ বিনির্মিত। দুর্গের বহিঃপ্রকারও পাহাড়ের ন্যায় দৃষ্ট হয়। সাতসহস্র সুশিক্ষিত রাজপুতসেনা সেই দুর্গ রক্ষা করে। একজন রাজভক্ত সুদক্ষ কাপ্তেন সেই দুর্গের সেনাপতি। প্রচুর ভোজ্যদ্রব্য এবং পানীয়জল সর্বক্ষণ দুর্গমধ্যে সঞ্চিত থাকে। বিপক্ষপক্ষ বহুদিন অবরোধ করিয়া রাখিলেও পানাহারের জন্য দুর্গবাসী সেনাগণের কিছুমাত্র কষ্ট হয় না।
সম্রাট স্বয়ং সেই দুর্গসমীপে উপবেশন করিলেন। নিকটবর্তী স্থানসমূহ জয় করিবার জন্য তিনি একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। রাণা জয়াশা পরিত্যাগ করিয়া তৎকালে বনমধ্যে পলায়ন করিয়াছিলেন। আকবর যদি দুর্গাবরোধে অধিক বিক্রম প্রকাশ করেন, রাজপুতেরা অধিক বিক্রম দেখাইতে শৈথিল্য করিবেন না। দুর্গরক্ষকেরা যেরূপ সাহসে ও একাগ্রচিত্তে আত্মরক্ষা করিতেছে, আকবর তাহা দর্শন করিয়া চমকিত হইতেছেন। তিনি কোথাও কখনও তাদৃশ পরাক্রান্ত যোদ্ধা দর্শন করেন নাই। রক্ষকবর্গের যতই বিক্রম বাড়িতে লাগিল, আকবরের গৰ্ব্ব এবং সংকল্প ততই প্রবল হইয়া উঠিল। পরিশেষে তিনি শুনিলেন, দুর্গে প্রবেশ করিবার উপায় হইতে পারে; অতএব মার্চ মাসের একরাত্রে তিনি যুদ্ধ করিবার আদেশ প্রদান করিলেন। স্বয়ং যে স্থানে উপবিষ্ট থাকিয়া দুর্গ দর্শন ও সামরিক উপদেশ প্রদান করিতে পারেন, এমন একটী নিভৃতস্থান মনোনীত করিয়া লইলেন। বন্দুক হস্তে তথায় বসিয়া তিনি দেখিলেন, রাজপুতবীরেরা দলে দলে প্রবেশমুখে একত্র হইতেছে, বীরসেনাপতি সৈন্যগণকে উৎসাহ দান করিতেছেন। আকবর যেখানে বাসিয়াছিলেন, সে স্থান হইতে দুর্গমুখ অধিকদূর ছিল না, কেবল নদীমাত্র ব্যবধান।
মশালের আলোতে আকবর অতিসহজেই রাজপুতসেনাপতিকে চিনিলেন। বন্দুকের গুলী ততদূর যাইতে পারে, ইহাও তিনি বুঝিলেন, বন্দুক ছাড়িলেন। সেনাপতির বক্ষে গুলী লাগিল, সেনাপতির প্রাণ গেল। রাজপুতসেনারা তখন আর সমসাহসে যুদ্ধ করিতে পারিল না। কিছুক্ষণ পরে তাহারা আবার সাজিয়া আসিল বটে, অসীমসাহসে যুদ্ধও করিল বটে, কিন্তু যাহা গেল, তাহা আর উদ্ধার করিতে পারিল না। উষাকালে চিতোর দুর্গ আকবরের অধিকারে আসিল। দুর্গ অবোধ করিবার অগ্রে আকবরশাহ ধৰ্ম্মত এক অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, জয়লাভের পর সেই অঙ্গীকার অনুসারে অজমীর-পাহাড়ের উপর এক পবিত্র মজীদে পদব্রজে গমন করিলেন। সেই মজীদটী ভারতের প্রথম মুসলমান পেগম্বর মৈনুদ্দীন চিষ্টির সংস্থাপিত। সেই মসজীদে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া, কৃতজ্ঞতা জানাইয়া, রণজয়ী সম্রাট পরিতোষলাভ করিলেন। দশদিন তিনি অজমীরে রহিলেন, তথা হইতে আগরায় প্রত্যাগমন করিলেন।
বসন্তকাল এবং বর্ষাকাল আগরায় অতিবাহিত হইল। অনন্তর জয়পুরের সুদৃঢ় রত্নদুর্গ জয় করিতে সম্রাট কৃতসঙ্কল্প হইলেন। সেনাভিঘানের আয়োজন হইতেছিল, এমন সময়ে গুজরাটের বিদ্রোহ এবং মধ্যভারতের যুদ্ধসংঘটন-সংবাদ আসিয়া পৌঁছিল। সম্রাট সুতরাং পূর্বসঙ্কল্প ত্যাগ করিয়া সেই স্থানে গমন করিলেন।
১৫৬৯ অব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে রাম্বর-আক্রমণে যাত্রা। সেই দুর্গ অধিকার করিয়া সম্রাট আর একবার অজমীরের মসজীদ দর্শনে গমন করিলেন। এক সপ্তাহ তথায় থাকিয়া আগরায় ফিরিয়া আসিলেন।
এই বৎসর আকবরশাহ ফতেপুরসিকরিনগর পত্তন করেন। সেই নগর এইক্ষণে মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে। আকবরের দুটী যমজপুত্র হইয়াছিল। একটীও বাঁচিয়া রহিল না। একজন উপাখ্যানলেখক বলেন, সেখ সেলিচিষ্টি নামক একজন পেগম্বর সিকুরিতে থাকিতেন। তিনি অঙ্গীকার করিলেন, এইবার বাদশাহের যে পুত্র হইবে, সেটী বাঁচিয়া থাকিবে। সিদ্ধপুরুষের বাক্যে সম্রাটের বিশ্বাস জন্মিল। রত্নাম্বর হইতে প্রত্যাগত হইয়া তিনি কয়েকবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। প্রত্যেকবারে কখনও দশদিন, কখনও বিংশতি দিন সিরিতে থাকেন। কাজে কাজেই তথায় একটী প্রাসাদ নির্মাণ করা হইল। সেই সিদ্ধপুরুষও সেই সময়ে রাজপ্রাসাদের নিকটে একটী নূতন ধৰ্ম্মশালা এবং একটী উৎকৃষ্ট মসজীদ নির্মাণ করাইলেন। রাজসভার পারিষদবর্গ তদ্দর্শনে আপনাদের বাসের নিমিত্ত তথায় উত্তম উত্তম গৃহ নির্মাণ করাইতে লাগিলেন।
সিকরিতে যখন প্রাসাদ নির্মিত হয়, সেই সময়ে সম্রাটের একটী বেগম গর্ভবতী হইলেন। আকবর সেই গর্ভবতী মহিলাকে গুরু মহাপুরুষের আবাসে লইয়া গেলেন; তাহার পরেই গুজরাটজম। এই সৌভাগ্যনিবন্ধন নূতন নগরের নামের পূর্বে ফতেপুর (বিজয়নগর) যোগ করিয়া দেওয়া হইল। তদবধি সেই নগরী ফতেপুর-সিরি নামে বিখ্যাত। দশমাস গর্ভ পূর্ণ হইলে সেই সিদ্ধপুরুষের আবাসে রাজমহিষী একটী পুত্রসন্তান প্রসব করিলেন। সেই পুত্রের নাম সেলিম। পরিশেষে ইতিহাসে সেই সেলিম আঁহাগীর নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন। সেলিমের জননী মোধপুরের কন্যা।
সেলিমের জন্মের পর আকবরশাহ ফতেপুর-সিকরিতে স্থায়ীনিবাস নির্মাণ করাইলেন। তাহার চতুর্দিকে প্রস্তরের গড়বন্দী করিলেন। আরও কয়েকটী উত্তম উত্তম অট্টালিকাও সেই সময় নিৰ্ম্মিত হইল। তাহার পর পুনরায় পদব্রজে অজুমীরের পাহাড়ে সেই মসজিদে ভজনা করিয়া সম্রাট দিল্লীতে আগমন করিলেন।
পরবৎসরের প্রারম্ভে আকবর রাজপুতানা আক্রমণে যাত্রা করিয়া যোধপুরের অন্তর্গত নাগরে শিবিরস্থাপন করিলেন। লাহোরের রাজপুত এবং বিকানীরের রাজা ও রাজপুত্র রাজশিবিরে আসিয়া সম্রাটকে অভ্যর্থনা করিলেন। সেই উপলক্ষে বিকানীরের রাজকন্যার সহিত আকবরের বিবাহ হইল। কিছুদিন নাগরে থাকিয়া মৃগয়াপ্রিয় সম্রাট বহুসংখ্যক বন্যগর্দভ শীকার করিলেন। তাহার পর পাঞ্জাবের দিপালপুরে যাত্রা। দিপালপুরে এক দরবার হয়। সেই দরবারের পর নূতন বৎসরের জানুয়ারী মাসে তিনি লাহোর গমন করেন। পঞ্জাবরাজ্যের সুশৃঙখলাবিধান করিয়া তিনি আবার ফতেপুর সিকরিতে ফিরিয়া আইসেন।
গুজরাটবিজয়ের প্রতি সেই সময় সম্রাটের অধিক মনোযোগ হইল। সুরাট, বরোচ, একেরা, আমেদাবাদ, বরদারাজ্যের কিয়দংশ, মহীকান্তা, বেরাকান্তা, পাঁচমহা, পালানপুর, রাধাপুর, বালিগঞ্জ, কাম্বে, খাদেশ এবং কাটিবার সে সময়ে গুজরাটের অন্তর্গত ছিল। সেই সময়ে রাজ্যে তৎকালে কোন নির্দিষ্ট অধিপতি ছিল না। প্রায়ই সর্বদা শাসনকৰ্ত্তাদিগের মধ্যে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হইত, গুজরাটে অরাজকতা দাঁড়াইয়াছিল। সম্রাট আকবর সেই অরাজকতা দূর করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলেন।
১৫৭২ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ফতেপুর-সিরি হইতে সম্রাট স্বয়ং সেনাপতি হইয়া যুদ্ধযাত্ৰা করিলেন। অক্টোবরমাসের পঞ্চদশ দিবসে তিনি অজমীরে পৌঁছিলেন। তথা হইতে দশ সহস্র অশ্বারোহী ও বহুসংখ্যক পদাতিকে পথনির্ণয়ার্থ প্রেরণ করিলেন। অনন্তর নাগরে পৌঁছিয়া রাজধানী হইতে সংবাদ পাইলেন, তাঁহার আর একটী পুত্র হইয়াছে। সেই পুত্রের নাম কুমার দানিয়াল। চতুর্দশ দিবস নাগরে থাকিয়া সম্রাট পুনরায় সসৈন্য যাত্রা করিয়া নবেম্বরমাসে সরস্বতী-তীরবর্তী পাটল নগরে পৌঁছিলেন। ডিসেম্বর মাসে আমেদাবাদে উপস্থিত হইলেন। যে ব্যক্তি তখন আপনাকে গুজরাটের রাজা বলিয়া দৌরাত্ম করিত, আমেদাবাদ নগরে সেই ব্যক্তি সম্রাট আকবরের অধীনতা স্বীকার করিল। আমেদাবাদ তখন গুজরাট রাজ্যের প্রধান নগর। সেই স্থানে আকবর শাহ পশ্চিমভারতের অধীশ্বর বলিয়া স্বীকৃত ও বিঘোষিত হইলেন।
সমস্তই স্থির হইল; কিন্তু যাহারা ইতিপূর্বে এক একটী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন, তাঁহারা কেহই আপনস্বত্ব পরিত্যাগে সম্মত হইলেন না। তাহাদের মধ্যে গণনীয় ব্রোচ, বরদা এবং সুরাটের শাসনকর্তা। সম্রাট তাহাদিগকে এক এক নিয়মে বদ্ধ করিয়া সন্তুষ্ট রাখিলেন। তথাকার সুবন্দোবস্ত করিয়া তিনি কাম্বে প্রদেশে যাত্রা করিলেন। পাঁচ দিনে তথায় পৌঁছিলেন। ইতিহাস-লেখকেরা বলেন, আকবর সেই স্থানে প্রথম সমুদ্র দর্শন করেন। এক সপ্তাহ তথায় অবস্থান করিয়া বাদশাহ বরদারাজ্যে যাত্রা করিলেন। বরদারও সুশৃঙ্খলা-বিধান করা হইল! রাজধানী হইল আমেদাবাদ। আগরা হইতে যে সকল আমীর সম্রাটের সহগামী হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে একজন আমেদাবাদের শাসনকৰ্ত্তা হইলেন। বরদা হইতে ব্রোচ এবং সুরাটে একদল সৈন্য প্রেরিত হইল। অচিরেই সংবাদ আসিল, ব্রোচের তদানীন্তন শাসনকর্তা একজন মোগল প্রতিনিধিকে হত্যা করিয়াছে। এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আকবর সেই হত্যাকারীর অনুসরণে যাত্রা করিলেন। একটী ক্ষুদ্ৰনদীর পরপারে সারসা নগরে সেই হত্যাকারীর শিবির সন্নিবেশিত ছিল; দ্বিতীয়রজনীতে সম্রাট সেই শিবির দেখিতে পাইলেন।
সম্রাটের সঙ্গে তখন চল্লিশজন অশ্বারোহী ছিল। এত অল্প সৈন্য লইয়া যুদ্ধ করিতে যাওয়া তিনি অপরামর্শ ভাবিলেন। তাহার পর ৬০ জন অশ্বারোহী রাত্রিকালে আসিয়া জুটিল। সৰ্ব্বশুদ্ধ একশত হইল। আকবর তাহাদিগকে লইয়া নদী পার হইয়া বিদ্রোহীর সহিত যুদ্ধ করিতে গেলেন। বিপক্ষসৈন্যের সংখ্যা এক সহস্র। বিদ্রোহী দলপতি নগরমধ্যে যুদ্ধ করিতে দিবার অবসর না দিয়া সৈন্য সহ প্রশস্তক্ষেত্রে বাহির হইলেন। সম্রাট নিমেষমাত্রে নগরাধিকার করিয়া শত্রুগণের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। সেই প্রদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনপথ, দুই ধারে কাঁটার বেড়া। আকবরের অশ্বারোহিগণ কিছু গোলে পড়িল। তিনজন সারি সারি দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিতে পারে, এরূপ সঙ্কীর্ণ স্থান। দুইধারে বিপক্ষপুঞ্জ। সম্রাট অগ্রগামী। তাহার দক্ষিণপার্শ্বে রাজপুতবীর জয়পুরের রাজা ভগবাদাস; বামপার্শ্বে রাজার ভ্রাতুস্পুত্র মানসিংহ। ভগবান্দাসের ভাগিনীকে আকবর বিবাহ করিয়াছিলেন। মানসিংহ জয়পুর-রাজ্যের উত্তরাধিকারী হইবেন, এইরূপ অবধারিত ছিল। মানসিংহ মহাবীর। আকবর, ভগবানদাস এবং মানসিংহ তিনজনেই সেই সঙ্কীর্ণক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত। শত্রুপক্ষ তাহাদিগকে হটাইবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কণ্টকপথ অতিক্রম করিতে পারিল না। রাজা ভগবাদাস সুতীক্ষ্ণ বর্ষাঘাতে বিপক্ষ দলপতিকে নিপাত করিলেন। আকবর এবং মানসিংহ আর দুইজনকে বধ করিলেন। বিপক্ষসৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল; জয়ী হইতে পারিবে না, ইহা তাহারা নিশ্চয় বুঝিল। দলবলসহ সর্দারেরা পলাইয়া গেল। ব্রোচরাজ্য আকবরের অধিকৃত হইল।
বাকী এখন সৌরাষ্ট্র। জাহাগীর এবং শাহজাহীর সময়ে ইংরাজ-বণিকেরা সেই সৌরাষ্ট্র-নগর উত্তমরূপে জানিতেন। আকবর তখন সেই সৌরাষ্ট্রজয়বাসনায় অগ্রসর হইলেন। একমাস সপ্তদশ দিবসে সৌরাষ্ট্র তাহার অধিকৃত হইল। আরও কয়েকমাস সৌরাষ্ট্রে অবস্থান করিয়া ১৫১৭ অব্দের জুনমাসের চতুর্থদিবসে আকবরশাহ আগরায় ফিরিয়া আসিলেন।
সম্রাট যখন সুরাটে যুদ্ধ করেন, সেই সময়ে ব্রোচের পলায়িত শাসনকর্তা আর একজন বিদ্রোহী আমীরের সহিত যোগ করিয়া নানাস্থানে লুঠপাট আরম্ভ করিয়াছিলেন। রাজপুতানা হইতে পঞ্জাবে উপস্থিত হইয়া তাহারা পানীপথ, শোণপথ এবং কর্ণাল লুঠ করেন। পঞ্জাবে রাজকীয় সৈন্যের সহিত সেই দলপতির যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজয়, তাহার পর পলায়ন। সুলতানের নিকটে একদল ধীবর তাহাকে ধরিয়া সাংঘাতিক আঘাত করে। সেই স্থানে তিনি বন্দী হন। ধীবরগণের আঘাতের ফলে বন্দী অবস্থায় তাহার মৃত্যু হয়।
গুজরাট অধিকার করিয়া আকবর নিশ্চিন্ত হইবেন ভাবিয়াছিলেন, কিন্তু তাহা হইল না। পূর্বে যাঁহারা সেখানে রাজত্ব করিতেন, তাহারা সৈন্য সংগ্রহ করিয়া দেশ লুঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। এ সংবাদে আকবর অধিকদিন আগরায় থাকিতে পারিলেন না, অগ্রে একদল সৈন্য পাঠাইয়া সেপটেম্বরমাসে স্বয়ং এক দ্রুতগামী অশ্বারোহণ পূর্বক গুজরাট-যাত্ৰা করিলেন। একবারও বিশ্রাম না করিয়া ৭০ মাইল পথ দুইদিনে অতিক্রম করিলেন। তৃতীয়দিবস প্রাতঃকালে অজুমীরে পৌঁছিলেন, সেই মহাপুরুষের সমাধিমন্দিরে প্রার্থনা করিলেন; সন্ধ্যার সময়ে পুনরায় অশ্বারোহণে যাত্রা করিয়া পালিনগরে অগ্রে প্রেরিত সৈন্যগণের সহিত মিলিত হইলেন।
আগরা হইতে সম্রাট বাহির হইয়াছেন, বিদ্রোহীরা এ সংবাদ অগ্রে পায় নাই। আকবর যখন আমেদাবাদের নিকটে তাহাদিগের শিবির আক্রমণ করেন, তখন তাহারা আপন আপন শিবিরে সুখে নিদ্রা যাইতেছিল। নিদ্রিত বৈরিকে আক্রমণ করিতে নাই; অতএব সম্রাট সেই সময় বাদ্যকরগণকে রণভেরী বাজাইবার আদেশ প্রদান করিলেন। ভেরী নিনাদিত হইল। বিদ্রোহীদল জাগিয়া উঠিল। মহাযুদ্ধ বাধিল। বিপক্ষগণ সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া গেল। তাহাদের দলপতি আহত হইয়া বন্দী হইলেন।
একঘন্টা পরে আরও পাঁচ হাজার সৈন্য সম্মুখবর্তী হইল। তাহাদের সেনাপতি একজন বিদ্রোহী। আকবর তাহাদিগকেও পরাজিত করিলেন। সেনাপতি নিহত হইল। বিদ্রোহীদিগের দুই সহস্র সৈন্য রণশায়ী হইল।
আকবর পাঁচদিন আমেদাবাদে বিশ্রাম করিয়া পরাক্রান্ত বীরগণকে পুরস্কার দিলেন এবং রাজ্য যাহাতে চিরদিন নিরাপদে থাকে, তাহার ব্যবস্থা করিলেন। তথা হইতে যাত্রা করিয়া নানাস্থান পরিদর্শনপূর্বক তিনি ফতেপুর-সিরিতে পৌঁছিলেন। পথে জয়পুরের নিকটবর্তী একগ্রামে রাজা তোড়লমলের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। গুজরাটের রাজস্ব আদায়ের কিরূপ প্রণালী করিলে ভাল হয়, রাজা তোড়লমলের সহিত তিনি তদ্বিষয়ের পরামর্শ করিয়া আইসেন।
সমগ্ৰভারতের অধীশ্বর হওয়া আকবরের বাসনা। অষ্টাদশ বৎসরে প্রায় তিনি এ বাসনা পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছেন। উত্তরপশ্চিমপ্রদেশে, মধ্যপ্রদেশে, পশ্চিমভারত, পঞ্জাব এবং কাবুল তাহার অধিকারভুক্ত হইয়াছে। পূৰ্ব্বদিগ বিভাগে কর্মনাশানদীর তীর পর্যন্ত তিনি অধিকার করিয়া লইয়াছেন। কৰ্মনাশাপারে বঙ্গ এবং বেহার! ঐ দুই রাজ্যে এ পর্যন্ত স্বাধীন আছে। তথায় যুদ্ধবিগ্রহ উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। রাজত্বকালের ঊনবিংশবর্ষে বঙ্গদেশ এবং বঙ্গের করদমহল অধিকার করিয়া লইতে সম্রাটের ইচ্ছা হইয়াছে।
আকবর যুদ্ধ করেন, কিন্তু যুদ্ধে তাঁহার আন্তরিক অনুরক্তি নাই। প্রকৃতিপুঞ্জের সুখস্বচ্ছতাই তাহার প্রধান লক্ষ্য। পূৰ্ব্বে পূৰ্ব্বে খোরা সানীরা এবং অসভ্য পাঠানেরা যে প্রকার লোভে ভারতবর্ষ আক্রমণ করিয়াছিল, সে প্রকার লোভের দাস আকবর নহেন, সে পদ্ধতিও তাঁহার অবলম্বনীয় ছিল না। রাজ্যরক্ষার জন্য, প্রজার মঙ্গলের জন্য, যেখানে যুদ্ধ না করিলেই নয়, কেবল সেইখানেই তিনি যুদ্ধ করিতেন। যুদ্ধের সময়ে ভূস্বামিগণের এবং কৃষকগণের যাহাতে কিছু ক্ষতি না হয়, তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। উচ্ছল সেনাগণ উপদ্রব করে, ইহা তিনি জানিতেন। অতএব কোন যুদ্ধের প্রাক্কালে যেখানে সেনানিবাসে ছাউনী করা আবশ্যক বুঝিতেন, উপযুক্ত পরিদর্শক নিযুক্ত করিয়া সেই স্থলের প্রকৃত অবস্থা ভালরূপে পরীক্ষা করাইতেন। নিকটবর্তী চাষের জমী এবং ক্ষেত্রের শস্য নষ্ট না হয়, তাদৃশ্য স্থানেই ছাউনী নিবেশিত হইত। ছাউনী স্থাপিত হইলে, তথায় আরদালী নিযুক্ত রাখিতেন; পার্শ্ববর্তী শস্যক্ষেত্রসমূহ তাহারা রক্ষা করিত। যুদ্ধান্তে ছাউনী উঠাইয়া লইলে, পুনরায় পূর্বোক্ত পরিদর্শকেরা সেই সকল স্থান তদন্ত করিতেন। ছাউনী থাকাতে প্রজালোকের যদি কোন ক্ষতি হইয়া থাকে, এমন প্রকাশ পাইত, তাহা হইলে সম্রাট সেই সকল ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতেন। মহৎ মহৎ গুণের মধ্যে প্রজারঞ্জনগুণ আকবরের প্রধান ভূষণ, ইহা পূৰ্ব্বেও উক্ত হইয়াছে, এ স্থানেও ব্যক্ত হইল। এক্ষণে বঙ্গ-বেহারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। বঙ্গ-বেহারের পাঠানরাজা মোগলের পুনর্বিজয়কালে কাগজপত্রে মোগলের প্রাধান্য স্বীকার করিতেন তাহা কেবল কাগজপত্রেই লেখা থাকিত, কাজে কিছুই হইত না। পাঠানরাজা মোগল-সিংহাসনে কর প্রদান করিতেন না, মোগলকে-ভক্তিও করিতেন না। আকবর যখন দ্বিতীয়বার গুজরাটে যুদ্ধ করেন, সেই সময়ে সেই পাঠানরাজের মৃত্যু হয়। তাঁহার মন্ত্রীবর্গ তাঁহার পুত্রকে হত্যা করেন। রাজার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দায়ূদ খাঁ সিংহাসন প্রাপ্ত হন। দায়ুদ কিন্তু কেবল আমোদ ভালবাসিতেন। তাঁহার অভিষেকের পর লোদীবংশীয় একজন আমীর বিদ্রোহী হইয়া সাহাবাদ-প্রদেশের রোটসোড় দুর্গে সৈন্য সংগ্রহ করেন। যুদ্ধ ঘটে নাই, সন্ধি হইয়া যায়, দায়ূদ খ সেই সন্ধি ভঙ্গ করিয়া লোদীবংশীয় আমীরের প্রাণবধ করেন। জৌনপুরের মোগল গবর্ণর এই সংবাদ পাইয়া কৰ্মনাশা নদী পার হইয়া পাটনায় উপস্থিত হন। দায়ূদ খাঁ তখন পাটনায় ছিলেন। যুদ্ধ বাধিবার উপক্রম হয়। কিন্তু আকবর সংবাদ পাঠান, তিনি স্বয়ং উপস্থিত না হইলে যুদ্ধ করা যেন না হয়। অজুমীর হইতে এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া একদল সৈন্য সমভিব্যাহারে জলপথে তিনি এলাহাবাদে উপস্থিত হন। তথায় বিলম্ব না করিয়া জলপথেই কাশীতে যান। কাশীতে তিনদিন বাস হয়। তথা হইতে পুনরায় নৌকারোহণে গোমতীগঙ্গা সঙ্গমে উপস্থিত হন। সেখানে কোন সংবাদ না পাইয়া গোমতী পার হইয়া জৌনপুরে যান। তথায় সংবাদ পান; শীঘ্র তাহার কাৰ্য্যক্ষেত্রে উপস্থিতি প্রয়োজন। পরিবারগুলিকে জৌনপুরে রাখিয়া আকবর চৌসায় আসিয়া পৌঁছেন। এই চৌসায় সেরখা পাঠান হুমায়ুনকে পরাজয় করিয়াছিলেন। চৌসায় সংবাদ আসিল, বিপক্ষেরা পাটনা হইতে আসিয়া মোগল-সৈন্যগণকে আক্রমণ করিয়াছে। আকবর তৎক্ষণাৎ নৌকারোহণে যাত্রা করিয়া সপ্তমদিবসে পাটনার নিকট উপস্থিত হন।
পরদিন তিনি এক সামরিক সভা করেন। তাহাতে স্থির হয়, অগ্রে দুর্গ আক্রমণ না করিয়া পাটনার সম্মুখবর্তী হাজিপুর সহর দখল করা হউক। তাহাই হইল। দায়ূদ খাঁ ভয় পাইলেন। সেই রাত্রেই পাটনা পরিত্যাগ করিয়া পুপুপারে পলায়ন করিলেন। রণজয়ী আকবর সগৌরবে পরদিন প্রাতঃকালে পাটনা সহরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু দায়ুদখাকে গ্রেপ্তার না করিলে নিরাপদ হইতে পারেন না, ইহা ভাবিয়া একজন সেনাপতিকে তথায় রাখিয়া স্বয়ং একদল সুশিক্ষিত অশ্বারোহীসহ দায়ুদের অনুসরণে ধাবিত হইলেন। সুশিক্ষিত অশ্ব সন্তরণে পুনপুন্ নদ পার হইয়া প্রভুকে পরপারে লইয়া গেল। আকবর সেখানে দায়ুদের অনুচরগণকে ধরিলেন এবং দুইশত পঁয়ষট্টিটা হস্তী লুটিয়া লইলেন! দরিয়াপুরে পৌঁছিয়া দুইজন সেনাপতিকে দায়ুদখার অনুসরণে প্রেরণ করিলেন। দায়ুদ পলায়ন করিলেন। সেনাপতিরা তাঁহার উদ্দেশ না পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন।
পাটনা-বিজয়ে বেহার-প্রদেশ আকবরের অধীন হইল। তাহার পর, দায়ূদ খাঁর বাধ্যতাস্বীকারে বঙ্গরাজ্যও মোগল-রাজ্যভুক্ত হইল; সর্বত্রই তাঁহার সুশাসনে প্রজাগণ পরিতুষ্ট। রাজ্যপরিভ্রমণে আকবর দেখিলেন, রাজ্যের অধিকাংশ স্থান পতিত রহিয়াছে; চাষ হয় না, জমী ভাল নহে অথবা কৃষকেরা অলস, এই দুই কারণও নহে; রাজ্যমধ্যে ভূমির কর এত অধিকপরিমাণে অবধারিত হইয়াছে যে, গরীব প্রজারা তাহা প্রদান করিতে পারে না, সুতরাং চাষ করিতে ক্ষান্ত আছে। ইহা কেবল শাসনপ্রনালীর দোষ। আকবর বিবেচনা করিলেন, সেই সেই জমীতে চাষ করিলে প্রথম বৎসর যাহা উৎপন্ন হইবে, রাজা-প্রজায় তাহা ভাগ করিয়া লইবেন। ঐরূপ নিয়ম করিলে প্রজার সুবিধা হইতে পারে। শেষে হিসাব করা হইল, সমস্ত পতিতভূমি আবাদ হইলে এক কোটি তঙ্কা উৎপন্ন হইতে পারে। এক কোটী তঙ্কার মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। একজন উপযুক্ত কর্মচারীকে তকার্যে নিযুক্ত করা হইল; কল্পনামত সুফলও লাভ হইল।
ঊনবিংশবার্ষিক রাজত্ব সুখশান্তিতে অতিবাহিত হইল। বিন্ধ্যাচলের উত্তরবর্তী সমস্ত আৰ্যবও আকবরের অধীন হইল। সেই বৎসর পশ্চিমভারতে মহাদুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। শস্যের মূল্য অসম্ভব বাড়িয়া উঠে। গাভীগণ এবং অশ্বগণ বৃক্ষের ত্বক ভক্ষণ করিয়া প্রাণধারণ করিতে লাগিল। দুর্ভিক্ষ হইলেই মড়ক হয়, বহুপ্রাণী প্রাণত্যাগ করিল। সেই দুর্ভিক্ষ ও মড়ক ছয়মাস ছিল।
১৫৭৫ অব্দে উড়িষ্যাবিজয়। উড়িষ্যার অন্তর্গত কটকে দায়ুদখা ধরা পড়িয়া অধীনতা স্বীকার করেন। সম্রাট তাঁহাকে উড়িষ্যার গবর্ণর করিয়া রাখেন। দায়ুদ কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন না; পুনরায় তিনি বিদ্রোহী হইলেন। দুই বৎসর পরে একজন মোগল-সেনাপতি তাহাকে বন্ধন করিয়া রণক্ষেত্রে তাহার শিরচ্ছেদন করেন।
এই বৎসরের একটা প্রধান ঘটনা ফতেপুর-সিরিতে এক ইবাইতখানা-নিৰ্মাণ। ইহার বাঙ্গলা অর্থ পণ্ডিতগণের অভ্যর্থনাগৃহ। ইমারত নির্মিত হইলে প্রতি শুক্রবার রজনীতে এবং প্রত্যেক পৰ্বাহরজনীতে সম্রাট স্বয়ং তথায় গমন করিয়া সমস্ত রজনী পণ্ডিতগণের সহিত প্রিয়সম্ভাষণ করিতেন। পণ্ডিতেরা যোগ্যতানুসারে পুরস্কার প্রাপ্ত হইতেন।
১৫৭৬ অব্দে কোন বিশেষ ঘটনা হয় নাই; কিন্তু ১৫৭৭ অব্দে উড়িষ্যার বিদ্রোহ, দায়ুদের পরাজয় ও মৃত্যু। আকবরশাহ রাজপুত রাজকন্যাগণকে বিবাহ করিয়াছেন, মিবারের রাজা উদয়সিংহ একাকী তাহার বিরোধী। তাহার মতে রাজপুতেরা পবিত্র দেববংশে উৎপন্ন, মুসলমানের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ করিলে বংশে কলঙ্ক হয়; অতএব তিনি আকবরের প্রাধান্য স্বীকার করিতে চাহিলেন না। ১৫৬৮ অব্দে তাঁহার রাজত্ব গেল, তিনি বনবাসী হইলেন। ১৫৭২ অব্দে তাঁহার মৃত্যু হইল।
রাণা উদয়সিংহের পুত্র রাণা প্রতাপসিংহ মোগলের অধীনতা-স্বীকারে পিতার ন্যায় অসম্মত রহিলেন। রাজ্য নাই, অর্থ নাই, বাসস্থান নাই, এইরূপ নিরূপায় অবস্থায় তিনি আরাবলী পৰ্ব্বতের এক শিখরে আশ্রয় লইয়া দিনযাপন করিতেছিলেন, আকবরের সৈন্যগণ সে স্থান লইতেও তাহাকে নির্বাসিত করিল।
১৫৮০ অব্দ ইতিহাসপ্রমাণে অতিসুখময়। মোগলরাজ্যের সর্বত্রই শান্তি-সৌভাগ্য বিরাজিত, কেবল মিবারের শাসনকর্তা এক একবার মস্তকসঞ্চালন করিতেন; মোগল সৈন্যরা তাহাকে দমন করিতে যাইত, তদ্ভিন্ন রাজ্যের আর কুত্রাপি যুদ্ধাস্ত্রের ঝঙ্কারধ্বনি শ্রবণগোচর হইত না।
স্থানে স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া আকবরশাহ অন্তর্ভূত অনেক তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইয়াছিলেন। পাঠানের সময় হইতে রাজ্যমধ্যে রাস্তার মাশুল আদায় হইত; যে সকল প্রজা মুসলমান নহে, তাহাদের নিকট হইতে মাথাপন্তী (জিজিয়া) কর আদায় হইত। হুমায়ুনের সময় পর্যন্ত তাহা অবাধে চলিয়া আসিতেছিল। সদাশয় আকবর রাজ্যের সর্বত্র ঐ দুই কর উঠাইয়া দিলেন। জিজিয়া-করের নিন্দা করিয়া তিনি বলিলেন, এরূপ পক্ষপাত রাজধৰ্ম্মের কলঙ্ক। প্রজারা যে যে ধর্মের উপাসক, স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে সেই ধর্মের উপাসনা করিবে। ধর্ম ভিন্ন বলিয়া তাহাদের উপর-উৎপীড়ক করস্থাপন অতিশয় ঘৃণার কথা।
১৮৮২ অব্দে আকবর সসৈন্য পঞ্জাবযাত্রা করিলেন। তাঁহার এক ভ্রাতা মহম্মদ হাকিম মির্জা কাবুল হইতে আসিয়া পঞ্জাবে বিদ্রোহ বাধাইয়াছিলেন। আকবর পানীপথে পৌঁছিবার অগ্রে হাকিম মির্জা লাহোরের নিকটে উপস্থিত হন। সম্রাট আসিয়াছেন, এই সংবাদ পাইয়া বিদ্রোহী সহোদর কাবুলে পলায়ন করেন। কাবুল তখন হাকিম মির্জার দখলে ছিল। আকবর পেশোয়ারে গমন করিয়া কাবুল উদ্ধারার্থ একদল সৈন্যসহ আপন পুত্র মুরাদকে কাবুলে পাঠাইলেন। মুরাদ কাবুলে পৌঁছিয়া পিতৃব্যকে পরাজয় করিলেন, আকবর নিজেও তিনদিন পরে কাবুলে পৌঁছিয়াছিলেন। তিন সপ্তাহ তথায় বাস করিয়া ভ্রাতৃগণকে ক্ষমা করিয়া এক ভ্রাতাকে তথাকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া আসিলেন।
রাজা মানসিংহ আকবরের সেনাপতি হইয়া পঞ্জাবের শাসনকর্তা হইয়াছিলেন। সেই বংশের একটী কন্যাকে আকবর আপন পুত্রবধূ করেন। কুমার সেলিমের সহিত ফতেপুর সিকরিতে সেই রাজকন্যার বিবাহ হয়। মুসলমানের সহিত হিন্দুকন্যার বিবাহ অনেকেই দোষাবহ ভাবিতেন, পক্ষান্তরে অনেকেই একতা-বিধানের সূত্র বলিয়া এইরূপ বিবাহে অনুমোদন করিতেন।
আকবরের একত্রিংশবার্ষিক রাজত্বকালে কাবুলে তাহার এক সহোদরের মৃত্যু হয়। উজ্ববেকেরা সেই সময়ে বদন আক্রমণ করে; কাবুল আক্রমণ করিতেও উদ্যত স্বয়ং তথায় যাইবেন, এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া সম্রাট নির্বাচিত সৈন্যসহ রাওলপিণ্ডীতে যাত্রা করিলেন। ইতিপূর্বে আটকে একটী নূতন দুর্গ নির্মিত হইয়াছিল। তথায় গমন করিয়া তিনি কাশ্মীর জয় করিবার নিমিত্ত রাজা ভগবান্দাসের অধীনে একদল সৈন্য তথায় প্রেরণ করিলেন। আর একজন সেনাপতি বেলুচিস্তানে, তৃতীয় সেনাপতি সোয়াটে প্রেরিত হইলেন। সোয়াটের যুদ্ধই গুরুতর হইয়া উঠিল। আকবর তখন রাজা বীরবলকে সেনাপতি করিয়া সোয়াটে পাঠাইলেন। আট হাজার মোগলসৈন্য সেই যুদ্ধে মারা গেল। রাজা বীরবলও রণক্ষেত্রে নিহত হইলেন। মোগলসৈন্যের এমন পরাজয় আর কখনও হয় নাই। প্রতিশোধবাসনায় সম্রাট অবশেষে রাজা হোড়লমল এবং রাজা মানসিংহকে সেইস্থানে প্রেরণ করিলেন। তাহারা খাইবারপাশে পৌঁছিয়া বিদ্রোহীগণকে ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া দিলেন।
কাশীরজয়ের অনেকটা সুবিধা হইয়াছিল, কিন্তু তথাকার মুসলমান শাসনকর্তা করদার করিবেন, অঙ্গীকার করাতে সন্ধি স্থাপিত হইল। সেনাপতিরা ফিরিয়া আসিলে আকবর তাহাদিগকে সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন না; কিন্তু তাহার ক্রোধ অধিকক্ষণ থাকিত না, পরিশেষে ক্ষমা করিলেন।
বেলুচিস্তানের যুদ্ধে মোগলের জয়লাভ হইল। রাজা মানসিংহ কাবুলের শাসনকর্তা হইলেন। ইহার পরেই কাশ্মীরে দ্বিতীয় অভিযান। ১৫৮৭ অব্দের গ্রীষ্মকালে শ্রীনগরের শাসনকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাধিল; মোগলসৈন্যে সুবিধা পাইয়া শ্রীনগর অধিকার করিল।
কাবুলীরা মানসিংহের প্রতি সন্তুষ্ট হইল না। তাহারা আকবরের নিকটে আবেদন করিল, এখানে রাজপুত শাসনকৰ্ত্তা থাকা আমাদের সুবিধাজনক নহে; সুতরাং রাজা মানসিংহকে বঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া একজন মুসলমানকে কাবুলের শাসনভার দিলেন।
১৮৮৯ অব্দে সম্রাট স্বয়ং একবার কাবুলে গেলেন। তথায় সংবাদ পৌঁছিল, ১০ই নবেম্বর তারিখে রাজা তোড়লমলের পরলোকপ্রাপ্তি হইয়াছে; সেইদিন জয়পুরের রাজা ভগবানদাসেরও মৃত্যু হইয়াছে। কাবুল, গুজরাট এবং জৌনপুরের নূতন বন্দোবস্ত করিয়া সম্রাট হিন্দুস্থানে ফিরিয়া আসলেন।
দুই বৎসর আকবর লাহোরেই প্রধান বাসস্থান স্থির করিলেন। সিন্ধুর যুদ্ধে জয়লাভ হইল। একদল সৈন্য ভীমরবে প্রেরিত হইল। আকবর স্বয়ং তৎকালে চন্দ্রাভাগাতীরে মৃগয়া করিতেছিলেন, যুদ্ধ ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছে শুনিয়া তিনিও ভীমরবে যাত্রা করিলেন। তাঁহার সেনাপতি বহুবাধা অতিক্রম করিয়া বিপক্ষ-সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। যুদ্ধে জয় হয় হয়, কিন্তু বিদ্রোহী-সর্দারের সৈন্যগণ প্রতিশোধ লইবার বাসনায় একদিন রাত্রিকালে সেই সেনাপতিকে কাটিয়া তাহার কাটামুণ্ড আকবরের নিকটে পাঠাইয়া দেয়। সেনাপতির মৃত্যুতেই সেই যুদ্ধের অবসান। আকবর শ্রীনগর হইয়া লাহোরে প্রত্যাবৃত্ত হন।
সেই সময় বঙ্গদেশ হইতে সংবাদ যায়, রাজা মানসিংহ উড়িষ্যাপ্রদেশ নির্বিবাদে মোগলরাজ্যভুক্ত করিয়াছেন। সেই গৌরবের নিদর্শনস্বরূপ তিনি তৎপ্রদেশের একশত বিংশতিটা হস্তী সম্রাটের উপহারস্বরূপ লাহোরে পাঠাইয়া দেন।
ক্রমাগত আটবৎসর দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধ। সে সকল যুদ্ধে মোগলের বিজয়। দৌলতাবাদ, খেররা, নাসির, আসিরগড় এবং আহামেদনগর অধিকৃত হয়।
দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধের পর তিনটী ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। প্রথম,–আবুলফজেলের দাক্ষিণাত্যে গমন, তৎপরে সম্রাটের যুদ্ধযাত্রা। দ্বিতীয়,অতিরিক্ত সুরাপানে রাজপুত্র মুরাদের মৃত্যু। তৃতীয়,–কুমার সেলিমের কুমন্ত্রণায় আবুল ফজেলের প্রাণবধ।
আকবর চতুর্দশবর্ষকাল লাহোরে দরবার করেন। ৫৯৮ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের গোলযোগে তাহাকে তথায় গমন করিতে হয়। তাহার গমনে আমেদনগর এবং আসিরগড় বশীভূত হয়। কুমার দানিয়ালকে খাদেশ এবং বেহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া ১৬০১ অব্দের বসন্তকালে সম্রাট আগরায় ফিরিয়া আসিলেন।
কুমার সেলিম পিতা বর্তমানে রাজা হইবার বাসনা করিয়াছিলেন। সম্রাট যখন দাক্ষিণাত্যে যান, সেলিম সেই সময়ে লোভোনুত্ত হইয়া সৈন্যসামন্তসহ আগরায় গমন করেন। দুর্গপ্রবেশের চেষ্টায় রাজভক্ত দুর্গরক্ষক দুর্গের ফটক বন্ধ করিয়া দেন। সেলিম হতমান হইয়া অতিশীঘ্র এলাহাবাদে গমন করেন; তথাকার দুর্গ অধিকার করিয়া লন; অযোধ্যা এবং বেহার বেষ্টন করিয়া স্বয়ং রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। আকবরের দাক্ষিণাত্য হইতে ফিরিয়া আসিবার ইহাই প্রধান কারণ।
সম্রাট আগরায় উপস্থিত হইয়া সেলিমকে এই মর্মে এক পত্র লিখিলেন যে, “অবাধ্যতা পরিত্যাগ করিয়া তুমি যদি বশীভূত থাক, তাহা হইলে তোমার প্রতি আমার স্নেহ চিরদিন অক্ষুণ্ণ থাকিবে। আর তুমি অবাধ্য হইও না।”
সেলিম সেই পত্র প্রাপ্ত হইয়া বাধ্যতা স্বীকারপূর্বক বিনম্রভাবে প্রত্যুত্তর লিখিলেন, কিন্তু তাহার কথার সহিত কাৰ্য্যের মিলন হইল না। তিনি শুনিলেন, অধিকাংশ রাজসৈন্য তখনও দাক্ষিণাত্যে আছে। সেই সাহসে সৈন্য সংগ্রহ করিতে করিতে তিনি ইটোয়ায় যাত্রা করিলেন। পথে পিতার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, এইরূপ প্রত্যাশা।
আকবর পূর্বেই তাহা বুঝিতে পারিলেন। পুত্রকে তিনি লিখিলেন, “দুটী পন্থা তোমাকে আমি নির্দেশ করিতেছি; হয় তুমি অল্প অনুচর লইয়া আগরায় আইস, নতুবা এলাহাবাদে ফিরিয়া যাও।” এলাহাবাদে ফিরিয়া যাওয়াই সেলিমের অভিপ্রেত হইল। বঙ্গ এবং উড়িষ্যার জায়গীর তিনি প্রাপ্ত হইবেন, এইরূপ আশা থাকাতে পিতার আদেশ তিনি অমান্য করিলেন না। বাস্তবিক ঐ দুটী প্রদেশ তিনি জায়গীরস্বরূপ প্রাপ্ত হইলেন।
সেলিম পিতৃদ্রোহী ছিলেন, তাহা জানিয়াও আকবর তাহাকে ক্ষমা করিলেন; কিন্তু সেলিমের মন্ত্রণায় আবুলফজলের প্রাণ গিয়াছে, আকবর তাহা জানিতেন না; অথচ প্রিয়বন্ধুর শোচনীয় পতনে তাহার হৃদয়ে বিষম আঘাত লাগিল। তিনি শুনিয়াছিলেন, অৰ্দ্দার রাজাই আবুলফজলকে খুন করিয়াছেন। অতএব সেই রাজার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করিলেন। অপরাধী রাজা বনমধ্যে পলাইয়া গেলেন। আকবর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিনের মধ্যে কেহই তাহাকে ধরিতে পারে নাই।
পিতাপুত্রে সম্মিলন হইল। মিবারের গোলযোগদমনার্থ সম্রাট পুনৰ্ব্বার সেলিমকে রাজপুতানায় পাঠাইলেন। গোলযোগ আর কিছুই নহে, রাণা প্রতাপসিংহ মোগলের অধীনতা স্বীকার করিতে চাহেন না। ১৫৭৬ অব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে পরাজিত প্রতাপসিংহ বনবাসী হইয়াছিলেন। রাজসৈন্য তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছিল। প্রতাপসিংহ নিরূপায় হইয়া সঙ্কল্প করেন, মিবারে আর যাইবেন না, পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব লইয়া সিন্ধুকূলে নূতন নিবাসস্থাপন করিবেন। সিন্ধুকূলে যাত্রা করিবার উদ্যম, সেই অবকাশে তাঁহার চিরভক্ত মন্ত্রী এমন একটী উপায় করিয়া দিলেন যে, মোগলের সহিত যুদ্ধ করিতে তাহার আর সঙ্কট বিবেচনা হইল না। প্রতাপসিংহ তাহাতেই সম্মত হইয়া পুনর্মুদ্ধে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।
তিনসহস্র সৈন্যের অধিনায়ক হইয়া শাহজাদা সেলিম মিবারে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। রাণা প্রতাপসিংহ নির্ভয়ে মোগলসেনার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রতাপের জয়লাভ হইল। চিতোর-দুর্গ ব্যতীত তিনি সমগ্র মিবাররাজ্য অধিকার করিয়া লইলেন। দুর্গটী হারাইয়া প্রতাপসিংহ উদয়পুরনামে আর একটী রাজ্য সংস্থাপনপূর্বক তথায় একটী নূতন দুর্গ নির্মাণ করাইলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র অমরসিংহ উদয়পুরের রাজা হইলেন। পূর্ণ-সাহসবিক্রমে এই অমরসিংহ পুনঃপুনঃ মোগলসৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিয়া রণজয়ী হইয়াছিলেন।
১৬০৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সেইরূপ চলিল। রাণা প্রতাপের সহিত অপমানিত হইয়া কুমার সেলিম এলাহাবাদে চলিয়া আসিলেন। তথায় মদিরা ও বারাঙ্গনা-প্রমোদে তাহার দিন যাইতে লাগিল।
সম্রাটের এক পুত্র মুরাদ অত্যন্ত মাতাল হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন। আর এক পুত্র দানিয়ালও সেই রোগে মারা গেলেন। বহুশ্রমে পরিশ্রান্ত হইয়া এবং পুত্রশোকে কাতর হইয়া আকবর শাহ সঙ্কটাপন্ন পীড়াগ্রস্ত হইলেন। সে যাত্রা তাহার জীবনের আশা রহিল না। মন্ত্রিবর্গ উত্তরাধিকারী নির্বাচনে মনোনিবেশ করিলেন। কেহ কেহ সেলিমের পক্ষপাতী হইলেন, কিন্তু অধিকাংশই সেলিমের পুত্র খসরুকে সিংহাসনারূঢ় করিবার জন্য পরামর্শ করিতে লাগিলেন। দুইজন প্রধানলোক খসরুর অনুকূলপক্ষ হইলেন। রাজা মানসিংহ একে খসরুর পিতার শ্বশুর কুমার খসরুও যোধপুরের রাজকন্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন; অতএব মানসিংহ তাহার প্রধান অভিভাবক–মুরুব্বি। খসরু যাহাতে রাজা হন মানসিংহ তদ্বিষয়ে বিশেষ পরামর্শ দিয়াছিলেন। আকবর কিন্তু সেলিমকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করিলেন। সেলিম তখন নিকটে ছিলেন না, সংবাদ পাঠাইয়া এলাহাবাদ হইতে তাঁহাকে আনয়ন করা হইল। পিতৃপদতলে সেলিম বসিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। সাদরে সম্রাট তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। সেই স্থানে তাঁহাকে রাজপরিচ্ছেদ সজ্জিত করিয়া মস্তকে উষ্ণীষ এবং হস্তে তরবারি প্রদানের নিমিত্ত অমাত্যবর্গের প্রতি অনুমতি হইল। কুমার সেলিম পিতৃসমক্ষে সেইদিন রাজচ্ছত্রদণ্ড গ্রহণ করিলেন। খসরুকে বঙ্গদেশের শাসনভার প্রদান করিবার ব্যবস্থা করা হইল।
সেলিমকে সস্নেহ-সমাদর করিয়া পীড়িত সম্রাট তৎকালে দরবারের সমস্ত আমীর ও অমাত্যগণকে নিকটে আহ্বান করিলেন, সেলিমের সহিত তাহাদের যে মনোবাদ ছিল, তাহা বিস্মৃত হইয়া সদ্ভাব-সম্মিলনে রাজ্যশাসন করুন, সকলকেই তিনি এই অনুরোধ করিলেন। আমীর এবং সেনাপতিগণ যুদ্ধক্ষেত্রে ও রাজকার্যে বিশেষপরিশ্রম সহকারে সহায়তা করিয়াছেন, সম্রাট তজ্জন্য তাহাদিগকে ধন্যবাদ দিয়া অবশেষে কহিলেন, “ভ্রমক্রমে যদি আমি কখনও আপনাদের কাহারও প্রতি কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করিয়া থাকি, আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন।” অন্তঃপুরের মহিলাকুলের রক্ষণভার সেলিমের হস্তে অৰ্পণ করিয়া সেলিমকে তিনি কহিলেন, “পুরাতন বন্ধু ও আত্মীয়গণের প্রতি সৰ্ব্বদা সদয় ব্যবহার করিও। কাহারও অমৰ্য্যাদা করিও না।” এই শেষকথা বলিয়া অবসন্ন সম্রাট মস্তক অবনত করিলেন। শেষনিশ্বাস বহির্গত হইল। সেইদিন সেইস্থানে মোগলকুলের সমুজ্জ্বল দীপ নির্বাপিত হইয়া গেল! ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবরমাসের পঞ্চদশ-দিবসে আকবরশাহ সংসারলীলা সংবরণ করিলেন। রাজত্বকাল ঊনপঞ্চাশ বৎসর। বয়ক্রম তেষট্টি বৎসর একদিন।
এইরূপ রাজা ছিলেন, শাহ জালালুদ্দীন মহম্মদ আকবর। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ভারতে মোগলসাম্রাজ্যসংস্থাপনে প্রধান আদিপুরুষ। কিঞ্চিন সমগ্ৰভারত তিনি একচ্ছত্র করিয়াছিলেন। রাজগণ কেহ কেহ আকবরের শান্তিমূলক সন্ধি-প্রভাবে বাধ্যতা স্বীকার করেন। শান্তিকুশল আকবরের নিরপেক্ষশাসনে সমস্ত প্রজা সমভাবে সুখে ছিল।
বিদ্যার গৌরব এবং ধর্মবিষয়ে স্বাধীনতাদান, আকবরের প্রকৃতির মূল্যবান অলঙ্কারস্বরূপ ছিল। সৰ্বশ্রেণীর পণ্ডিতগণকে তিনি যথোচিত সমাদর করিতেন। সমবেত পণ্ডিতগণের সহিত শাস্ত্রালাপ করিয়া তিনি সুখী হইতেন। তাঁহার নিকটে বিদ্বানলোকের যথেষ্ট সমাদর ছিল; কিন্তু ভণ্ডপণ্ডিত ও ভণ্ডধার্মিকগণকে তিনি ঘৃণা করিতেন। সেক মোবারিকের পুত্র সেক ফৈজি এবং আবুলফজেল তাহার পরম প্রিয়পাত্র ছিলেন।
ধর্মসম্বন্ধে নিরপেক্ষতা আকবরচরিত্রে বিশেষ প্রশংসনীয় ছিল। কোন ধর্মাবলম্বীর উপাসনা-প্রণালীতে তিনি বিদ্বেষভাব প্রকাশ করিতেন না। পূর্বতন মুসলমানরাজগণ হিন্দুগণকে অতিশয় ঘৃণা করিতেন; অনেকেই অস্ত্রবল প্রকাশ করিয়া এবং প্রাণদণ্ডের ভয় দেখাইয়া অনেক হিন্দুসন্তানকে মুসলমান করিয়াছিলেন। অপর ধর্মাবলম্বীগণকে অবিশ্বাসী কাফের বলিয়া সর্বদা উৎপীড়ন করিতেন। সম্রাট আকবর তন্নিবন্ধন আক্ষেপ প্রকাশ করিয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, সৰ্ব্বজাতীয় ধর্মশাস্ত্রেই ঈশ্বরজ্ঞান এবং পবিত্র ধৰ্ম্মনীতি দেখিতে পাওয়া যায়। তবে কেবল মুসলমানধর্মের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করা কি প্রকারে ন্যায়ানুগত হইতে পারে? একটী ধৰ্ম্ম সত্য আর সমস্তই অসত্য, ইহা কেহই সপ্রমাণ করিতে পারেন না। অক্ষর দেখিয়া এবং মুখের কথা শ্রবণ করিয়া মুসলমানধৰ্ম্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করা ভ্রান্তিমাত্র। অপর ধর্মাবলম্বীগণকে নাস্তিক বলা অসঙ্গত। সর্বধৰ্ম্মের সার সংগ্রহ করিয়া আকবর একখানি ধর্মগ্রন্থ সঙ্কলন করিয়াছিলেন, তদনুসারে তিনি কাৰ্য্য করিতেন। সংসারের প্রাচীন ইতিহাসে যে সকল জ্ঞানগর্ভ গাথা বর্ণিত আছে, তাহার কিছুই আকবরের অপরিজ্ঞাত ছিল না। কারণ, সমস্ত ইতিহাস ও সমস্ত ধর্মগ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা হইতে পারস্যভাষায় অনুবাদ করাইয়া তিনি পাঠ করিতেন এবং পাঠ করিয়া শ্রবণ করাইবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিত নিযুক্ত ছিল। প্রতিদিন তাহারা যে পুস্তকের যত পৃষ্ঠা পাঠ করিতেন, আকবর সেই স্থানে স্বহস্তে চিহ্ন দিয়া রাখিতেন। পঠিত পত্রসংখ্যানুসারে পাঠকেরা স্বর্ণরজতাদি পুরস্কার প্রাপ্ত হইতেন। আকবরের আদেশে আমাদের রামায়ণ-মহাভারতও পারস্যভাষায় অনুবাদিত হইয়াছিল।
হিন্দুজাতিকে আকবর অধিক ভালবাসিতেন। পাঠানেরা হিন্দুর প্রতি বিষম দৌরাত্ম্য করিয়া গিয়াছেন, আকবর তৎপরিবর্তে হিন্দুকে সুখে রাখিবার প্রয়াস পাইতেন। তীর্থযাত্রায় হিন্দুর অত্যন্ত অনুরাগ, তীর্থের সংখ্যাও অধিক, প্রতি-বৎসর লক্ষ লক্ষ যাত্রী নানা তীর্থদর্শনে গমন করেন, পূর্বের মুসলমান রাজারা তাহা কুসংস্কারমূলক–অনর্থক বলিয়া তীর্থযাত্রিগণের উপর এক প্রকার দুর্বহ করভার স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহাতে রাজ্যের অনেক টাকা রাজস্ব বাড়িয়াছিল; সদয়-হৃদয় আকবর সেই তীর্থকর উঠাইয়া দিয়াছিলেন। এটীও হিন্দুর প্রতি এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। পাসীদিগের সূৰ্য্য-উপাসনায় আকবরশাহ যথেষ্ট অনুরাগ প্রকাশ করিতেন। গোঁড়া মুসলমানেরা তজ্জন্য আকবরকে গোপনে নাস্তিক বলিয়া নিন্দা করিতেন। কেবল হিন্দু ও পাসরি কথা নহে, সৰ্ব্বধর্মাবলম্বীর ধর্মশাস্ত্রের সারমর্ম অবগত হইবার জন্য আকবরের বিশেষ আগ্রহ ছিল। পর্তুগীজদিগের ধর্মের ভাব কিরূপ, তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে কবিবর ফৈজিকে তিনি নিউটেক্টমেন্টের প্রকৃত পারস্য অনুবাদ প্রস্তুত করিতে অনুমতি দেন। পর্তুগীজেরা তখন গোয়ানগরে কুঠী নিৰ্মাণ করিয়া বাণিজ্য করিতেছিলেন, তথাকার একজন মিশনারী পাদ্রী বড়কো একোয়া ভিভাকে আগরায় নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠান হয়।
একরাত্রে পাদ্রী বড়লকো আকবরের ইবাদতখানায় দর্শন দেন, সেই রাত্রে তথায় ব্রাহ্মণ, জৈন, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান, য়িহুদী এবং পার্সী প্রভৃতিশ্রেণীর মহামহা পণ্ডিতগণ আপন আপন ধৰ্ম্মের শ্রেষ্ঠত্বপ্রতিপাদন করিয়া দীর্ঘ দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। পরস্পর বিস্তর বাগ্বিতণ্ডা হয়। প্রতিপক্ষ-ধৰ্ম্মশাস্ত্রের দোষ দেখাইয়া তাহারা অনেক বিরুদ্ধকথা বলেন, কিন্তু কেহই স্ব স্ব মতের সত্যতা সপ্রমাণ করিতে পারেন না। মুসলমানেরাই খৃষ্টীয়শাস্ত্রের অধিক দোষাদোষণ করিয়াছিলেন। পাদ্রী তাহাতে এই উত্তর দেন, “এই সকল লোক আমাদের ধর্মশাস্ত্রকে মিথ্যা বলিতেছেন। কোরাণ যদি যথার্থই ঈশ্বরের বাক্য হয়, ইহাতেই যদি ইহাদের বিশ্বাস থাকে, তবে এইখানে একটী অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করা হউক, আমি আমার ধর্মশাস্ত্র হস্তে সেই কুণ্ডে ভ্রমণ করি এবং মুসলমানও আপনার কোরাণ-হস্তে কুণ্ডমধ্যে ভ্রমণ করুন্ কোনটী সত্য, সেই অগ্নিপরীক্ষায় তাহা সপ্রমাণ হইবে।” পাদ্রী-সাহেবের সেই প্রস্তাবে মুসলমানেরা কেবল ক্রোধান্ধ হইলেন, যথেচ্ছ কটুক্তি করিলেন, আর কিছুই করিতে পারিলেন না। আকবর তাহাতে যৎপরোনাস্তি অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন।
আকবরের আরও কতকগুলি কার্যের বিষয় ইতিহাসে বর্ণিত আছে। হিন্দুসতীর সহমরণপ্রথা তিনি ভালবাসিতেন না। যে সকল সতী ইচ্ছাপূৰ্ব্বক জ্বলন্ত-চিতারোহণে অভিলাষিণী না হইতেন, কেহ বলপূর্বক তাহাদিগকে চিতায় দগ্ধ করিলে দণ্ডণীয় হইবে, তিনি এইরূপ ব্যবস্থা করেন; বাল্যবিবাহ রহিত করিতেও প্রয়াস পান। হিন্দুর মনস্তুষ্টির জন্য রাজ্যমধ্যে তিনি গাভী-হত্যা নিষেধ করিয়াছিলেন। মুসলমানশাস্ত্রে শুকরমাংস এবং মদিরা নিষিদ্ধ; কিন্তু আকবরশাহ শুকরমাংসে দোষ দেন নাই; পরিমিত মদিরাপানেরও ব্যবস্থা দিয়াছিলেন।
আকবরের আহারে সবিশেষ পবিত্রতা ছিল। তিনি মাংস ভালবাসিতেন না, ফল ভালবাসিতেন। ইরাণতুরাণ হইতে সকল বৃক্ষের চারা আনাইয়া আগরায় এবং ফতেপুর সিরিতে রোপণ করাইয়াছিলেন। কাবুল, কান্দাহার, সমরকন্দ এবং কাশ্মীর হইতে উত্তম উত্তম ফল আনাইয়া ব্যবহার করিতেন। অপরাপর আহাৰ্য্যসম্বন্ধেও আকবরের রুচি-অরুচির পরিচয় পাওয়া যায়। গীতবাদ্যে তাহার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল; নিজেও তিনি সঙ্গীতবিদ্যায় সুপণ্ডিত ছিলেন।
এখন তাহার পুস্তকাগারের কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। বহুতর গ্রন্থকারকে তিনি উৎসাহ দিতেন, পুস্তকাগারে বহুতর গ্রন্থ সংগৃহীত হইয়াছিল। পদ্যগ্রন্থ, পদ্যকাব্য, হিন্দী, পারস্য, গ্রীক, কাশ্মীরী, আরবী, সমস্তই স্বতন্ত্র রক্ষিত হইত। আকবর একখানি গ্রন্থ আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতেন। পণ্ডিতেরা প্রত্যহ পুস্তকাগারে আগমন করিয়া বাদশাহকে নূতন নূতন পাঠ শ্রবণ করাইতেন। ইহা ব্যতীত শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রে ও শিল্পবিজ্ঞানের চর্চার তার যথেষ্ট উৎসাহদান ছিল।
এতাদৃশ গুণবান্ সম্রাট ১৬০৫ খৃষ্টাব্দের অক্টোবরমাসে ইহসংসার পরিত্যাগ করিলেন। জাহাগীর উপাধি লাভ করিয়া কুমার সেলিম দিল্লীর সিংহাসনে অভিষিক্ত হইলেন।