আকবরের আমল
আজ ৩৪০ বৎসর হইল দিল্লীর সম্রাট আকবর বাদশা মারা গেছেন। তার ত্রিশ বছর আগে তিনি বাঙ্গলাদেশ জয় করেন। তাঁরই প্রতাপে সমস্ত উত্তর-ভারত এক রাজার অধীনে আসে; অর্থাৎ সেই দক্ষিণে সমুদ্রকূলে জগন্নাথপুরী হইতে সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমানায় কাশ্মীরে অমরনাথ পর্যন্ত সব হিন্দু তীর্থগুলি এক দেশের অংশ, এক শাসনের অধীন হইয়া গেল; গৌড়ের আদিনা মসজিদ হইতে আরম্ভ করিয়া দিল্লীর নিজামুদ্দীন আউলিয়া আর আজমীরের মৈনুদ্দীন চিশতির দরগা পর্য্যন্ত সব মুসলমান পীরস্থান এক রাজ্যের মধ্যে আসিল। এই বাদশা আমাদের দেশের কি করিয়া গেলেন, তাঁহার রাজ্যে লোকদের অবস্থা কেমন ছিল, তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইত যদি আমরা সেই যুগে জন্মিতাম। আজ কল্পনা করিলাম যে, আমি তাঁহারই রাজ্যের একজন বাঙ্গালী প্রজা ছিলাম। বাঙ্গলায় আমরা যে দিল্লীর বাদশার প্রজা, তিনি পরম ন্যায়পরায়ণ রাজা, দুষ্টের দমন, দুর্ব্বলের রক্ষা, গুণী জ্ঞানীর আদর করেন, যেমন পূৰ্ব্বে কখনও হয় নাই। এই কথা অনেকের মুখে শুনিয়া আমার বড় ইচ্ছা হইল যে একবার তাঁহাকে দর্শন করিব। তাঁহার রাজধানী ইন্দ্রের অমরাপুরীর মতো সুন্দর তাহা দেখিয়া চক্ষু সার্থক করিব। আর সেই সঙ্গে বৈষ্ণবদের মহাতীর্থ মথুরা-বৃন্দাবনের যাত্রাটাও সারিয়া আসিয়া একাধারে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ লাভ করিব। এই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বৈকুণ্ঠে গিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহার ভক্ত গোঁসাইরা বৃন্দাবনে মঠ ও মন্দির স্থাপন করিয়া শাস্ত্রগ্রন্থ লেখেন, বাঙ্গালী বৈষ্ণব ধর্ম শিখান, এসব খবর তীর্থযাত্রীরা ফিরিবার সময় আমাদের গ্রামে বলিয়া গিয়াছে। তাহারা আরও বলিয়াছে যে, এখন এই সুদূর তীর্থযাত্রা অতি সহজ ও নিরাপদ হইয়াছে, কারণ আকবর বাদশা এমন ন্যায়পরায়ণ, নিরপেক্ষ, প্রজারঞ্জক রাজা, যে তিনি যৌবনে শাসনভার নিজ হাতে পাইবামাত্র শুধু হিন্দুদের উপর যে মাথা গুণতি জিজিয়া কর এবং প্রত্যেক তীর্থে প্রবেশের সময় যে ট্যাক্স আদায় করা হইত, তাহা উঠাইয়া দিলেন, যাহাতে সব ধর্মের প্রজারা সমানভাবে ভাই ভাই হইয়া একত্ৰ নিৰ্ব্বিবাদে বাস করিতে পারে। এজন্য তাঁহার বহু লক্ষ টাকার রাজ-আয় ত্যাগ করিতে হইল, তাঁহার মহা-প্রাণ সেজন্য একটুও ইতস্ততঃ করিল না। আরও শুনিলাম যে মথুরা, প্রয়াগ, কাশী অঞ্চলে রব উঠিয়াছে যে আকবর বাদশা কি হিন্দু, কি জৈন, কি জুরুথাস্ত্রীয়, কি খ্রিস্টান, কি শিয়া, কি সুন্নী, কি দাদুপন্থী, সব ধর্মের পণ্ডিতদের ডাকিয়া আনিয়া তাঁহাদের কাছে নিজ নিজ ধর্মের সার-শিক্ষা ও পুণ্যকাহিনী সযত্নে শুনেন এবং তাঁহাদের অর্থ দক্ষিণা দেন।
আমার এই ইচ্ছা পুরাইবার সুযোগ হইল সেই বৎসর দুর্গাপূজার পর একদল বৈষ্ণবযাত্রী বৃন্দাবন যাইতেছে শুনিয়া আমি আমার বাড়ী সাতগাঁ হইতে তাহাদের সঙ্গ লইলাম। এই যাত্রার আগে আমার দিদিমা ভয় দেখাইয়াছিলেন যে ষাট বৎসর আগে তাঁহার শ্বশুর কাশী দর্শন করিতে গিয়া পথে কষ্টে ও বিপদে মারা যান; তাঁহাকে কত ছোট ছোট স্বাধীন নবাবের রাজ্য পার হইতে হয়, প্রত্যেক রাজ্যের সীমানায় বিলম্ব, অত্যাচার ও টাকা আদায়; পথগুলি চোর-ডাকাতে ভরা, প্রায় প্রদেশেই কোন রক্ষক বা বিচারক পাওয়া যায় না; প্রত্যেক রাজ্যেই এক এক ভিন্ন মুদ্রার চলন, টাকার উপর বাটা কাটিয়া তাহার অৰ্দ্ধেক মূল্য কমাইয়া দেয়। আর আমার এই বৃন্দাবনযাত্রা আশ্চর্য্য নিরাপদে ও সহজে শেষ হইল। সাতগাঁ হইতে ব্রজধাম পৰ্য্যন্ত পাঁচশ ক্রোশ পথ সমস্ত এক রাজার দেশ, তাহার সব প্রদেশেই ঠিক একরকম রাজ্যশাসন-প্রণালী, এক মুদ্রা, এক সরকারী ভাষা চলিতেছে। প্রত্যেক প্রদেশের রাজধানীতে একজন সুবাদার শাসনকাজে সদা নিযুক্ত, আর প্রদেশটিকে মাপসই ছোট ছোট ভাগ করিয়া, তাহার মধ্যে এক এক জন ফৌজদারকে শান্তি রক্ষার ভার দেওয়া, এক একজন কাজীকে বিচারের কাজে এবং বড় শহরে এক একজন কোটওয়ালকে পুলিসের কর্ম্মে রাখা হইয়াছে। একছত্র সাম্রাজ্য, সর্বত্র এক ছাঁচে ঢালা শাসনপ্রণালী, কোন গোলমাল, কোন বিলম্ব হইতে পারে না। পথে চুরিডাকাতির সংবাদ পাইলেই ফৌজদার সদর হইতে সৈন্য লইয়া তাহার দমন ও চোরাইমাল উদ্ধারের জন্য ছুটিত।
আর সর্বত্রই বাদশার গোয়েন্দা পত্র-লেখক নিযুক্ত আছে, তাহারা রীতিমত মাসে মাসে গোপন পত্র লিখিয়া তাঁহাকে জানাইতেছে যে, কোন্ সরকারী কর্মচারী ঘুষ লইল, অবিচার করিল, অথবা কোন বড় ঘটনা সরকারী রিপোর্টে না দিয়া লুকাইয়া রাখিল।
সর্বত্র দেখিলাম যে পথ দিয়া বদলী রাজকর্ম্মচারী ও সৈন্য, এক মহকুমা হইতে অন্য মহকুমায় যাইতেছে, সুবাদারের সরকারী কাগজপত্র ও বাদশাহী গোয়েন্দাদের গোপনীয় পত্র লইয়া দুজন বা জুড়ী হরকরা এবং গরুর গাড়ীতে, টাটু ঘোড়ার উপর বা বলদের পিঠে মাল বোঝাই করিয়া দলে দলে বণিকেরা, দূর স্থানে যাইতেছে। এই একছত্র রাজত্বের ফলে এই প্রকাণ্ড মহাদেশময় শান্তি ও নিরাপদ, পথে সহজে আনাগোনা, বাণিজ্য ও সভ্যতার বিস্তার চলিতেছে; এটি আগে সম্ভব ছিল না। পথের দুদিকে নির্ভয়ে বিনা বাধায় চাষবাস, কেনা-বেচা, কারিগরদের শিল্পদ্রব্য তৈয়ারী, পড়াশুনা চলিতেছে। কত সুন্দর মসজিদ ও সমাধি গড়িয়া উঠিতেছে, কারণ অরাজকতা দূর হওয়ায় লোকের হাতে টাকা হইয়াছে। কত ভিন্ন ভিন্ন জাতির লোক নির্বিবাদে ভারতের এক দিক হইতে অপর দিকে যাইতেছে, নিজ নিজ কাজ করিতেছে।
এইরূপ নিরাপদে, সহজে এবং অল্প খরচে সেই দীর্ঘ পথ হাঁটিয়া, পথে কাশি, প্রয়াগ সারিয়া, বৃন্দাবনে পৌঁছিলাম। সেখানে কি শান্তি, কি উৎসাহ, কি ধর্মচর্চা! গোকুলে বল্লভাচার্য্যের মঠ, খুব বর্দ্ধিষ্ণু, রাজপুত্ররাজাদের ও গুজরাতী বণিকদের দানে পুষ্ট। বাদশার মা হামিদা বানু বেগম এক ফর্মান্ দিয়াছেন যাহার বলে ঐ গোকুলের বৈষ্ণবদের সব গরু বিনা বাধায় বিনা গাউচরাই টেক্সে বাদশাহী খাসমহলে চরিতে পারিতেছে। কত ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ হইতে যাত্রীরা এখানে একত্র হইয়া জন্মাষ্টমীর উৎসবে যে দৃশ্য সৃষ্টি করিল, তাহা জীবনে ভুলিব না। তখন বুঝিলাম যে আমি কোণঠাসা বাঙ্গালী নই; এই ভারতব্যাপি জনসমুদ্রের মধ্যে আমিও ঠিক অন্যের থেকে অভিন্ন একটি জলবিন্দু।
যে বাদশা ভূভারতকে এত একত্রিত, এত বলশালী, এত ধনী, এত শান্তি, জ্ঞান ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ করিয়াছেন, তাঁহাকে একবার দর্শন না করিয়া দেশে ফিরিতে মন চাহিল না। এই দর্শনলাভের ইচ্ছা পূর্ণ করিবার একটি সুযোগও ঘটিল। আমাদের সাতগাঁয়ে এক কাজীর অনাথ পুত্র আমার সমবয়সী ও খেলার সাথী ছিল। ভ্রমণকারী আউলিয়া ফকিরদের কাছে আগ্রা প্রদেশের বিখ্যাত সুফী ধর্মগুরুদের বিবরণ এবং দু-চারটা বাণী শুনিয়া, তাহার বড় আকাঙ্ক্ষা হয় যে সে আগ্রা গিয়া ভাল করিয়া আরবী পারসী ভাষা শিখিবে এবং ঐসব মহাপুরুষের চরণে বসিয়া তাঁহাদের শিষ্য হইয়া জন্ম সার্থক করিবে। সাতগাঁ হইতে সেও আমাদের সঙ্গ লইল। তাহার সাহায্য পাওয়ায় সমস্ত পথে বিদেশী রাজকর্মচারীদের সঙ্গে আমাদের যাত্রীদলের কথাবার্তা অতি সহজে চলিল আমি তাহার নিকট চলনসই উর্দুভাষা শিখিয়া লইলাম। বৃন্দাবন-মথুরায় কয়েক মাস কাটাইবার পর আমি আগ্রায় আসিলাম এবং একটি মুসলমানী মঠ (খাকা)-তে এই বন্ধুকে খুঁজিয়া বাহির করিলাম। এই রাজধানীতে সে আমার পাণ্ডা হইল।
কিন্তু আমার মতো দীনহীনজন কি করিয়া সম্রাটের দর্শন পাইবে? তাহার একটি পন্থা এই বন্ধুর সাহায্যে বাহির হইল, সেটা এইরূপে–এই ক’বছর হইল শেখ মুবারক নামে এক পরম ধার্মিক ও মহাপণ্ডিত সুফী মারা গিয়াছেন। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁহাকে ভক্তি করিত; সেজন্য ঈর্ষাপরবশ গোঁড়া কাজীর দল তাঁহাকে ধর্মভ্রষ্ট রাফিজী বলিয়া মিথ্যা অপবাদ দিয়া মারিয়া ফেলিতে চাহে। কিন্তু বাদশা তাহাতে বলেন, “আচ্ছা তাহাকে আমার সম্মুখে আন, আমি তাহার কথাবার্তা শুনিবার পর উচিত বিচার করিব।” শেখ মুবারককে দরবারে আনিবার পর তাঁহার সরল সাত্ত্বিক ভাব, ধর্মশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান এবং অকপট ঈশ্বরভক্তি দেখিয়া, আকবর মুগ্ধ হইলেন এবং তাঁহাকে নিজ শিক্ষক করিয়া লইলেন; কাজীদের মক্কায় নির্ব্বাসন করা হইল! এই সাধুর দ্বিতীয় পুত্র মহাপণ্ডিত ও অতুলনীয় সুলেখক, আবুল ফজল এখন বাদশাহের সবচেয়ে বেশী বিশ্বস্ত অমাত্য ও বন্ধু–যদিও তাঁহাকে দেওয়ান উজীর বক্সি প্রভৃতি কোন উচ্চ পদ দেওয়া হয় নাই, কিন্তু তাঁহার মতে বাদশা চলেন। বর্তমানে বাদশার আদেশে আবুল ফজল এই সাম্রাজ্যের একখানা বড় ইতিহাস এবং সমস্ত দেশের বর্ণনা ও শাসনযন্ত্রের বিবরণ লিখিতে ব্যস্ত আছেন। এজন্য নানা প্রদেশ হইতে স্থানীয় সংবাদ লওয়া তাঁহার আবশ্যক হইয়াছে। আমি বাঙালী এবং শিক্ষিত কায়স্থ একথা শুনিয়া তিনি আমাকে ডাকিয়া আমার কাছে বাঙলা দেশের সব খবর এবং আমাদের ধর্মসম্প্রদায়গুলির বিবরণ জানিতে চাহিলেন। আমি হিন্দুস্থানী ও সংস্কৃত মিশান ভাষায় বলিতাম, আর তিনি তাহা পারসিক ভাষায় সংক্ষেপে লিখিয়া লইতেন। তাঁহার বড় ভাই ফৈজী চমৎকার সংস্কৃত শিখিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি এখন আর এ জগতে নাই।
আমার বিবৃতি শেষ হইবার পরও আমি প্রত্যহ আবুল ফজলের বৈঠকে যাইতাম এবং তিনি বন্ধুবান্ধব ও আগত ভদ্রলোকের সঙ্গে যে গল্প করিতেন তাহা মুগ্ধ হইয়া শুনিতাম। এইরূপে বাদশা আকবরের চরিত্র ও কীর্তিকলাপের যেন একটি জীবন্ত ছবি পাইলাম। তাঁহার কাছে শুনিলাম যে বাদশা শুধু সত্য খুঁজিয়া বেড়ান, কোন ধর্ম্মের বাহ্য আচার-ব্যবহারের দিকে না তাকাইয়া, উহার অন্তরে কি নীতিশিক্ষা আছে তাহা জানিতে চেষ্টা করেন। অনেক দিন ফতেপুর-সিকরির রাজপ্রাসাদের এক কোণে একটা ছোট ভাঙ্গা ঘরের সামনে একখানা চ্যাপটা পাথরের উপর নিরিবিলি বসিয়া তিনি ধ্যান করিতেন, গভীর চিন্তায় মগ্ন, তাহার চিবুক ঝুলিয়া বুকের উপর পড়িতেছে। তার পর ওই শহরে ইবাদৎ-খানা নামে একটি বাড়ী তৈয়ারী করিলেন, তাহার এক ধারে নিজে আসন লইতেন, আর সামনের আঙিনায় ডান ও বা হাতের বারান্দায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের প্রচারকগণ নিজ নিজ ধর্ম্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা করিতেন। প্রথম প্রথম এই গৃহে শুধু ইস্লামের পণ্ডিতগণ আলোচনা করিতে পাইতেন, কিন্তু তাহাদের বাহাত্তর সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া এবং মোল্লাগণের ব্যক্তিগত অহঙ্কার ও স্বার্থপরতার ফলে তাঁহাদের মধ্যে এত গালাগালি আরম্ভ হইল যে
আকবর সত্যের চিহ্ন হারাইলেন! তখন তিনি হিন্দু জৈন জুরুথাস্ত্রীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি নানা ধর্ম্মের শিক্ষকদের ডাকিয়া তাঁহাদের ধর্ম্মব্যাখ্যা ও নীতি-উপদেশ মনোযোগ দিয়া শুনিতেন এবং ঐসব সাধুদের সম্মান করিতেন। একদিন আবুল ফজলের চাকরদের দলে মিশিয়া আগ্রা দুর্গে গিয়া রাজদর্শনের সৌভাগ্য আমার হইল।
এইসব আলোচনার শেষ ফল দাঁড়াইল যে আকবর বুঝিলেন যে- সব ধর্মেই কিছু-না-কিছু সত্য লুকান আছে। যদি লোকে প্রত্যেক ধর্মের বাহ্য রীতিনীতি ছাড়িয়া দিয়া তাহার ভিতরকার সাত্ত্বিক ভাব ও চির সত্যটুকু শিক্ষা করে, তবে আর ধর্মে ধর্মে লড়াই কাটাকাটি বাধে না; সব মানুষ উদারচেতা হয়, সৎভাবে নিজ জীবন যাপন করিবার পন্থা ও প্রবৃত্তি লাভ করে। এইজন্য আকবর গোঁড়ামি ও ধর্ম্মান্ধতা উচ্ছেদ করিতে খাড়া হইলেন। তাঁহার রাজনীতি হইল সুহ্-ই-কুল্ বা সকলের সহিত শান্তি, এখন যাহাকে বলা হয় universal toleration, অর্থাৎ সব ধর্ম্মের পালন। কি আশ্চর্য্য তাঁহার ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা! নিরক্ষর আকবর নিজ নিভৃত সাধনার ফলে এই মন্ত্র আবিষ্কার করিলেন। তাঁহার বিশাল রাজ্যের সব প্রজাকে তাহাদের ধর্ম্মের দিকে না তাকাইয়া, আইনের বিচারে, রাজনৈতিক অধিকারে, রাজকার্য্যে, এবং নিজ নিজ ধৰ্ম্মপালনে ঠিক সমান অধিকার দিলেন। বর্তমান যুগে তুরস্কদেশকে যিনি নূতন (প্রাণ দিয়াছেন সেই কমালপাশা আতাতুর্ক, যে রাজনীতি তুরস্কে) চালাইয়াছেন আকবর ৩২৫ বৎসর পূর্ব্বে ভারতে তাহাই প্রচলিত করিতে চেষ্টা করেন; অর্থাৎ গভর্ণমেন্টকে ধৰ্ম্ম হইতে পৃথক করিতে হইবে, সমস্ত রাষ্ট্রবাসিগণ ধর্ম্ম নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করিবে। সতের-শ উননব্বই সনের ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের পর ইউরোপে যে নব্যযুগ আরম্ভ হইয়াছে তাহার মূল মন্ত্রটিও এই। সুতরাং আকবর একজন অতুলনীয় অদ্বিতীয় নেশন-স্রষ্টা ছিলেন। বর্তমানের চক্ষে তাঁহাকে এইরূপ দেখা যায়।
আবুল ফজল বলিলেন যে আকবর এই উদার ধর্ম্মনীতি ও সমদর্শিতার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হইয়া দক্ষ হিন্দুদের উচ্চ উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করিলেন, সব সম্প্রদায়ের সাধুদের দক্ষিণা ও সম্মান দিলেন; তিনি এখন একটি মাত্র ধর্ম্মের সেনাপতি অথবা আমির্-উল্-মুমনীন রহিলেন না, জাতীয় রাজা national king হইয়া উঠিলেন। ইস্লামের ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের উপাধির মধ্যে একটি রর্-উল্-আলমীন অর্থাৎ সমস্ত বিশ্বের প্রভু, শুধু আরবীয় দেবদূতের শিষ্যদেরই প্রভু এরূপ বলা হয় নাই।
আকবরের আজ্ঞায় আবুল ফজল কাশ্মীরের এক মন্দিরের প্রস্তর ফলকের জন্য যে লিপি রচনা করেন, তাহাতে লেখা ছিল, “এই মন্দির স্থাপিত হইয়াছে হিন্দুস্থানের সমস্ত একেশ্বরবাদীদের হৃদয় একত্র বাঁধিবার জন্য”, এবং লিপির পারসী কথাগুলির ইংরাজী অনুবাদ এই মতো
O God! in every temple I see people that seek Thee, and in every language
I hear spoken, people praise Thee!
Polytheism and Islam feel after Thee,
Each religion says, ‘Thou art one, without equal.’
… Sometimes I frequent the Christian cloister, and some
times the mosque,
But it is Thou whom I seek from temple to temple.
এই জন্যই আকবরের আজ্ঞায় আবুল ফজল তাঁহার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড ভরিয়া হিন্দুদের শাস্ত্র, দর্শন, জ্যোতিষ, বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা, আচার-ব্যবহার, এবং দণ্ডনীতির বিস্তৃত বিবরণ পারসিক ভাষায় লিখিয়া গিয়াছেন, এবং তাহার ভূমিকায় বলিয়াছেন যে পরস্পরের ধর্ম্ম ও সাহিত্যের সহিত পরিচিত হইলে আর ধর্ম্মে ধর্ম্মে বিবাদ থাকিবে না-একেশ্বরবাদী মুসলিমগণও এই বিবরণ হইতে বুঝিতে পারিবে যে হিন্দুরাও প্রকৃতপক্ষে এক ঈশ্বরকেই ধ্যান করে। এই মহান ঐক্য সাধন করিবার উদ্দেশ্যে আকবর অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের পারসিক অনুবাদ করান, এবং তাঁহার দরবারে তাঁহার উৎসাহে ভারতীয় ও মধ্য-এশিয়ার চিত্রকলার সম্মিলনে এক অতি সুন্দর নবীন চিত্র-পদ্ধতি গড়িয়া উঠে, যাহার জন্য অনেক হিন্দু ও মুসলমান চিত্রকর বিখ্যাত হইয়াছে।
আল্লাহু আকবর এই বাক্যের অর্থ, আল্লা বা নিরাকার পরমব্রহ্মই সবচেয়ে বড়, তিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য; আর যত দেবদেবী যেমন পৌত্তলিক আরবরা ইস্লাম ধর্ম্ম গ্রহণের আগে আল্ লাট, আল্ উজজা, আল্-মনাৎ ইত্যাদি যে সব মূর্তি পূজা করিত, (কোরান, ৫৩ সুরা, ১৯-২৩ শ্লোক) তাহারা সকলেই আল্লার নীচে। ব্রহ্মের এই সর্ব্বশ্রেষ্ঠতা ঘোষণা করাকে আরবি ভাষায় বলে “তীর্”–এটা ভক্ত মুসলমানদের একটা কর্ত্তব্য, যেমন ভক্ত হিন্দুরা বলে, “জয় দয়াময় হরি”। আকবর সমাজে আল্লাহু আকবর এই সম্ভাষণটি চালাইতে চাহিলেন। আর অমনি গোঁড়া পুরাতন দলের প্ররোচনায় আগ্রা দিল্লীর সাধারণ মুসলমানগণ ক্ষেপিয়া উঠিল। তাহারা বলিতে লাগিল যে আকবর নিজেকে ঈশ্বর বানাইতে চাহেন এবং এই বাক্যটির অর্থ হইতেছে “আকবর খোদ্ আল্লা হ্যায়”-আকবর ঈশ্বরের অবতার। অথচ আকবরের ভক্ত হিন্দুরা তাঁহাকে কখনও ঈশ্বর বলে নাই, তাঁহাকে “জগদ্গুরু” অর্থাৎ সকলেরই ধৰ্ম্মশিক্ষক এই উপাধি দিয়াছিল। এই মূর্খ অপবাদের জন্য আবুল ফজল বড় দুঃখ করিয়াছেন; তাঁহার আকবরনামা গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তাহা এখনও পড়া যায়।
স্বার্থপর শত্রুগণ আকবরের তীরকে বিষফল বলিয়া বর্ণনা করিল, সুহ্-ই-কুল বা মৈত্রী মহামন্ত্রের প্রবর্তক কাফের হিন্দু হইয়াছেন এই ঘোষণা করিয়া অজ্ঞ সৈন্যদের আকবরের বিরুদ্ধে ধর্ম্মযুদ্ধে উত্তেজিত করা হইল, সেই অবসরে আফগান সীমানা ভেদ করিয়া শত্রুগণ আবার আমাদের দেশ আক্রমণ করিল। কিন্তু সেই সত্যসন্ধানী মহাপুরুষের বিরুদ্ধে কেহই দাঁড়াইতে পারিল না।
আকবর বাদশার শেষ বয়সে রাজ্য ও ধন, সুখ ও সভ্যতা, কল্পনাতীত বৃদ্ধি পাইল বটে, কিন্তু তিনি নিজে ক্রমেই গভীরতর বিষাদ ও হতাশায় মগ্ন হইয়া পড়িলেন, কারণ তিনি দিব্যচক্ষে দেখিতে পাইলেন যে তাঁহার এই নব রাজনীতি, সমাজ-সংস্কার, দেশের ও দশের মিলন চেষ্টা, সব নষ্ট হইয়া যাইবে, উপযুক্ত উত্তরাধিকারী ও দক্ষ সৎ শিক্ষিত কর্ম্মচারী মন্ডলের অভাবে। এ দেশে জনশিক্ষা, ছাপাখানা বা সংবাদপত্র কিছুই তাঁহার মৃত্যুর দুই শত বৎসর পর পর্য্যন্তও জন্মিল না। অর্থাৎ আকবরের চেষ্টার পরও, ভারতে ক্রমোন্নতির বীজ অঙ্কুরিত হইল না। ভারত পিছাইতে থাকিল, কারণ ইউরোপ বর্ষে বর্ষে নূতন জ্ঞানে নূতন শিল্পে উন্নতি লাভ করিতে লাগিল। ভারতের যে বিদেশীর হস্তে পরাধীনতা ইহাই তাহার কারণ।
আকবর শব্দটি একটি আরবী বিশেষণ ইহার মানে মহত্তম, সবচেয়ে বড়, যেমন আল্লাহু আকবর অর্থাৎ নিরাকার পরমেশ্বর বা আল্লা সব সাকার দেবদেবীর উপরে এবং তিনিই এক মাত্র উপাস্য।
আকবর বাদশা নিজে ভারতবর্ষের জন্য যাহা করিয়া গিয়াছেন তাহা ভাবিলে মনে হয় যে তাঁহার বাপের দেওয়া নামটি সার্থক, তিনি সত্যই আমাদের রাজাদের মধ্যে মহত্তম, সবচেয়ে বড় সব চেয়ে ভাল ছিলেন।*
[প্রবাসী, ভাগ ৪৪, খণ্ড ২, সংখ্যা ৬, চৈত্র, ১৩৫১।]
* অল ইন্ডিয়া রেডিও কলিকাতা ষ্টেশনে প্রদত্ত বক্তৃতা।