১. আওরঙ্গজেবের পরিচিতি
অবিস্মরণীয় আওরঙ্গজেব
আমি এসেছি অচেনা মানুষ হিসেবে, চলেও যাব অচেনা মানুষের মতো ।
–মৃত্যুর প্রাক্কালে আওরঙ্গজেবের লেখা চিঠি
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালে ৮৮ বছরের পরিণত বয়সে যখন জীবনের পেছন দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন তিনি ব্যর্থতাই দেখতে পেয়েছিলেন।
মৃত্যুশয্যা থেকে আওরঙ্গজেব ছেলেদের কাছে বেশ কিছু মর্মভেদী চিঠি লিখেছিলেন। এসব লেখায় তার অধার্মিকতার জন্য আল্লাহ তাকে শাস্তি দিতে পারেন, এমনসহ নানা ভয়ানক শঙ্কা প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সর্বোপরি, বাদশাহ হিসেবে তার ভুলগুলো নিয়ে আর্তনাদই করেছেন বেশি। সবচেয়ে ছোট ছেলে কাম বকশের কাছে লেখা চিঠিতে তার মৃত্যুর পর অফিসার ও সেনাবাহিনীর প্রতি খারাপ আচরণ করা হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় ছেলে আযম শাহের কাছে অনেক গভীর সংশয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন : ‘শাসন করা ও জনগণকে রক্ষার গুণ আমার মধ্যে একেবারেই ছিল না। আমার মূল্যবান জীবনটা বৃথাই গেল। খোদা এখানেই আছেন, কিন্তু আমার নিষ্প্রভ চোখ তার উজ্জ্বল দীপ্ত দেখতে পারছে না।’
আওরঙ্গজেব ১৫ কোটির বেশি লোকের ওপর ৪৯ বছর শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেছিলেন, মানব ইতিহাসে তিনিই প্রথমবারের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ এলাকাকে একটি একক রাজকীয় শাসনের অধীনে এনেছিলেন। আইনগত বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে তিনি স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন, সব ধরনের লোক ও ধর্মীয় গ্রুপের সদস্য তার কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছে বলে তার সুখ্যাতি রয়েছে। খুবই সম্ভব যে তিনি ছিলেন তার আমলের সবচেয়ে ধনী লোক, তার কোষাগার ছিল পরিপূর্ণ। তাতে ছিল উপচে পড়া হীরা, মানিক, মুক্তা, স্বর্ণ। এমনকি জৌলুষপূর্ণ কোহিনূর হীরাও ছিল তার কাছে। তবে এসব অর্জনও শেষ দিনগুলোতে নিজের রাজনৈতিক অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে তার উৎকণ্ঠা প্রশমিত করতে পারেনি ।
আযম শাহ ও কাম বকশ- উভয়ের কাছে আওরঙ্গজেব তার ধর্মীয় ত্রুটিগুলোর কথাও স্বীকার করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে তাকে শিগগিরই কঠিন ঐশী বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে। নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম হিসেবে চিন্তা করেছেন যে এই জীবন ও পরকালে তিনি ‘আল্লাহর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন।’ তিনি বোঝাহীনভাবে এই দুনিয়ায় এলেও পাপের বোঝা নিয়ে পরকালে যাচ্ছেন বলে ধারণা তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল । আযমকে তিনি শেষ যে চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে স্মৃতিকাতরতা, দীর্ঘ অলঙ্কৃত বাক্যে তিনবার বিদায়সম্ভাষণ করেছিলেন : ‘বিদায়, বিদায়, বিদায় ।
—
আওরঙ্গজেব তিন শতাধিক বছর আগে, ১৭০৭ সালের শীতকালে, এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাকে সমাহিত করা হয় মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদের সাধারণ, ছাদ ও প্রাচীরহীন একটি খোলা কবরে। দিল্লিতে হুমায়ূনের লাল বেলেপাথরের বিশাল সমাধিসৌধ বা আগ্রায় শাহ জাহানের জাঁকজমকপূর্ণ তাজ মহলে অপরিমিত ব্যয়ে নির্মিত বিশ্রামাগারের বিপরীতে আওরঙ্গজেবের কবরটি তাকে স্মরণ করার মতো কোনো তাগিদ সৃষ্টি করেনি। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছানুযায়ী একটি সুফি দরগার মধ্যে সমতল ও চিহ্নহীন স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। কয়েক শ’ বছরের ব্যাপ্তিতে এতে মার্বেলের মেঝ হয়েছে, মার্বেলের রেলিং লাগানো হয়েছে, শনাক্তকারী ফলকও সংযোজন করা হয়েছে। অবশ্য, এসব অলঙ্করণ সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের সমাধির সাদামাটা অবস্থা তার পূর্বসূরীদের সমাধিস্থল ও জাগতিক কীর্তিগাঁথা জোরালোভাবে প্রকাশকারী পাথরের ব্লকগুলোর প্রবল বিপরীত কথাই জানায় ।
আওরঙ্গজেব হয়তো বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুনিয়া তাকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। একুশ শতকের ভারত ও পাকিস্তানের জনসাধারণের স্মৃতিতে তিনি স্পন্দমান একটি চরিত্র। ভারতে লোকজন তার আমল নিয়ে উত্তপ্তভাবে বিতর্কে নিয়োজিত হয়, প্রায়ই হিন্দুদের প্রতি জঘন্য নির্যাতন করার জন্য তার নিন্দা করে। আওরঙ্গজেব নিজের কৃতকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বর্তমান ভারতের অনেকেই সংশয়হীনভাবে মনে করে যে তিনি ছিলেন উগ্র গোঁড়া, তরবারির জোরে শাসন করতেন, পেছনে রেখে গেছেন হিন্দু অশ্রুধারা। আধুনিক ভারতের অবয়ব থেকে আওরঙ্গজেবকে মুছে ফেলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রয়াসগুলো (দিল্লিতে আওরঙ্গজেব সড়কের নাম পরিবর্তন করা এমনই একটি কাজ) এই সম্রাট ও ভারতের ইসলামি অতীতবিষয়ক বিতর্কে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। কাছের পাকিস্তানে আওরঙ্গজেব স্রেফ কিছুটা ভালো অবস্থায় আছেন। সেখানে অনেকে ভারতীয় ধারার আলোকে মনে করে যে আওরঙ্গজেব সুস্পষ্টভাবে গোঁড়া ছিলেন। তবে অন্যরা তাকে অতীত কালের মুসলিম সত্যনিষ্ঠ শাসকদের একজন মনে করে। এসব আধুনিক ধারণায় ইতিহাসের বক্তব্য থাকে খুবই সামান্য ।
আরো ভালোভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য ও নিন্দাবাদ একুশ শতকের দক্ষিণ এশিয়াকে ছেয়ে ফেলায় লোকটি নিজে একটি হেঁয়ালি হিসেবেই রয়ে গেছেন।
—
আওরঙ্গজেব ছিলেন বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক । উপমহাদেশের বাইরের দুনিয়ায় বর্তমানে খুব কমই মোগলদের কথা স্মরণ করা হয়, কিন্তু তাদের আমলে তারা ছিলেন তীব্র মোহিনী শক্তিসম্পন্ন, সম্ভ্রম জাগানিয়া। ১৬০০ সাল নাগাদ মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল পুরো ইউরোপের চেয়ে বেশি, সারা পৃথিবীতে মোগলদের সম্পদের কোনো তুলনা ছিল না। এক রক্তাক্ত উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসেন ১৬৫৮ সালে ৷ এই লড়াইয়ে তার দুই ভাই মারা যান, একজন বার্মায় পালিয়ে যান এবং তার পিতা কারারুদ্ধ হন। আওরঙ্গজেব নিজের নাম রাখেন ‘বিশ্বজয়ী’ (আলমগীর), তার ৪৯ বছরের রাজত্বকালে একটার পর একটা রাজ্য দখল করে নামকরণকে যথার্থ প্রতিপন্ন করেছেন ।
জীবদ্দশাতেও আওরঙ্গজেব জগতব্যাপী কল্পনামানসে ধরা পড়ে ছিলেন। ১৬৭৫ সালে ওই সময়ের ইংল্যান্ডের রাজকবি জন ড্রাইডেন বিদ্যমান মোগল সার্বভৌমত্ব নিয়ে বীরোচিত ট্রাজেডি আওরেঙ্গ-জেব লিখেছিলেন । আর ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা ভারত সফর করেছেন ক্রমবর্ধমান হারে, তাদের অনেকেই খ্যাতিমান আওরঙ্গজেব আলমগীরের সাথে সাক্ষাত প্রার্থনা করেছেন। ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ ও ফরাসি বণিকেরা উপমহাদেশের পকেটগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করত, মোগলদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করার প্রয়াস চালাত । অবশ্য মোগলদের দৃষ্টিতে ইউরোপিয়ানরা ছিল চুনো পুঁটি। পূর্বসূরিদের মতো আওরঙ্গজেবের মনেও দৃঢ় বিশ্বাস গেঁথে ছিল যে তিনি বিশ্ব ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর একটি পরিচালনা করছেন। এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (আধুনিক ভারতের প্রায় সমান) এবং এর সম্পদ, সমৃদ্ধি ও ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য ছিল সম্মানের পাত্র।
গত কয়েক দশক ধরে অন্যান্য মোগল শাসক ইতিহাসবিদদের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আওরঙ্গজেব শিকার হয়েছেন অবহেলার। এ সম্রাটের জীবনকে তুলে ধরার কাজটি, তার সম্পর্কে আমরা বিস্ময়করভাবেই কম জানি, কোনোভাবেই সহজ নয়। আওরঙ্গজেব ছিলেন জটিল শাসক। ক্ষমতা, ন্যায়বিচার, ধর্মপ্রীতি ও মোগল সাম্রাজ্যের দায়ভারসহ নানা সাঙ্ঘর্ষিক আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার সমাবেশে গড়ে ওঠেছিল তার জীবন। যেকোনো পরিস্থিতিতেই এ ধরনের লোক হবেন দুরূহ ঐতিহাসিক বিষয়। তার সময় ও আমাদের নিজেদের সময়ের মধ্যকার সাংস্কৃতিক জ্ঞানের বিপুল পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনা করা হলে তা যে কত কঠিন হতে পারে, তা বোঝাই যাচ্ছে ।
বর্তমান সময়ে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে এমন উত্তপ্ত ও ফুটন্ত ইতিহাসও আওরঙ্গজেব। অবশ্য, আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ভাষ্যগুলোতে বাস্তব অস্তিত্বের চেয়ে বানোয়াট কাহিনীই রয়েছে বেশি। আওরঙ্গজেবকে ঘিরে থাকা কল্পকথার ধূম্রজাল ভেদ করতে পারলে আমরা সম্ভবত সপ্তদশ শতকের ভারতের এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটিকে আবিষ্কার করতে পারব। বর্তমান ছাড়া অতীতে যাওয়ার অন্য কোনো পথ না থাকায় আমি প্রথমে আমাদের সময়ে কল্পিত আওরঙ্গজেবের দিকেই নজর ফেরাব। আমি তারপর দুইভাবে তথা তার সময়ের ফসল হিসেবে এবং যে যুগে তিনি বাস করেছিলেন ওই কালকে অবয়ব দানকারী সম্রাট হিসেবে তাকে বিশ্লেষণ করব ।
খলনায়ক আওরঙ্গজেবের কল্পকথা
তথাকথিত ‘গ্র্যান্ড মোগলদের’ শেষ ব্যক্তি আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে ঘোরাতে। তা করতে গিয়ে তিনি ঘড়িটি বন্ধ করে ফেলেন, এটি ভেঙ্গে যায় ।
–জওহেরলাল নেহরু
আওরঙ্গজেবের জন্য ২০১৫ সালটি ছিল খারাপ। প্রায় পুরো বছর ধরেই এই মোগল সম্রাটের নামে থাকা দিল্লির একটি প্রধান রাস্তার নাম বদল করা নিয়ে বিতর্ক চলে । স্থানীয় একটি শিখ গ্রুপ প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করে। নাম বদলের যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ‘ভারতের অসহিষ্ণু অমানবিক নৃশংস অপরাধের অন্যতম স্বৈরাচারী উৎপীড়নকারী শাসক।’ হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য সাথে সাথে এই স্রোতে যোগ দিয়ে তাদের ভাষায় দিল্লির ইতিহাসের অন্যতম বেদনাদায়ক অধ্যায়টিকে নিশ্চিহ্ন করার কিংবা অন্তত নগরীর রাস্তা থেকে এই উৎপীড়ক শাসকের নাম মুছে ফেলার আহ্বান জানান। নয়া দিল্লির কর্মকর্তারা এই দাবির কাছে নতি স্বীকার করে ২০১৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম সড়ক নামে নতুন নামকরণ করেন। এক সপ্তাহ পর রাতের অন্ধকারে নগরকর্মীরা চুপি চুপি রাস্তার সাইনগুলো থেকে আওরঙ্গজেবের নাম মুছে ফেলে।
অবশ্য এ ধরনের প্রয়াসের ফলে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সমাজ-বিস্তৃত স্মৃতিবিলোপ না ঘটে বরং জনসাধারণের মনে আবার তাকে জাগিয়ে তোলে । এর মাত্র এক মাস পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে শিব সেনার এক এমপির একটি টেপ প্রকাশিত হয়। এতে তাকে এক সরকারি কর্মকর্তার প্রতি আওরঙ্গজেব কি আওলাদ (আওরঙ্গজেবের বংশধর) এবং আরো কিছু গালিগালাজ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। ভারতীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা এ ধরনের বাক্য বাবর কি আওলাদ (বাবরের বংশধর) পরিভাষার প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগ দিয়ে এর ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবরের স্থানে আওরঙ্গজেব হলো কেন?
—
বিভেদকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অত্যাচারী মুসলিম বিজয়ী হিসেবে বাবর ও আওরঙ্গজেব অনেক দিক থেকে বিনিময়যোগ্য। এই দিক থেকে আওরঙ্গজেব ভারতের অতীতের ধিক্কারজনক ঘটনাবলীর সাথে জড়িত ‘গোঁড়া মুসলিমদের’ পুরো শ্রেণির প্রতিনিধি এবং এ কারণে ভারতের বর্তমান সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত। আওরঙ্গজেবকে সবচেয়ে ধার্মিক মোগল বাদশাহ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করাটাও কাকতালীয় বিষয় নয়। এ কারণে আওরঙ্গজেব অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ের উদ্দীপ্ত মুসলিম সমগ্রের (যারা তাদের ধার্মিকতা দিয়ে ভারতীয় সমাজে হুমকি সৃষ্টি করেছিল) আদর্শ প্রতিনিধিত্বকারী। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতি একটি একক, সমতল অবস্থানে মিশে যায়, যেখানে অন্য ধর্মীয় গ্রুপগুলোর জন্য শ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে সামান্যই ।
ভারতের তীব্র সমালোচিত শাসকদের মধ্যেও আওরঙ্গজেবের বিশেষ, অনাকাঙ্ক্ষিত স্থান রয়েছে। এমনকি যারা বিজেপি ও সমমনা হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলোর ভাবাবেগের সাথে একমত নয়, এমন সাধারণ অভিমতেও নির্মম ইসলামি উৎপীড়ক (যাদের কাছে ভারতের সবকিছু, বিশেষ করে হিন্দু মাত্রই ঘৃণিত) হিসেবে আওরঙ্গজেবকে বিদ্রূপ করা হয়ে থাকে। সীমান্তের ওপাড়ে পাকিস্তানেও অনেকে বদ আওরঙ্গজেবের ভাষ্যটি অনুমোদন করে, এমনকি তাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী মনে করা হয়। পাকিস্তানি নাট্যকার শহিদ নাদিমের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন : ‘আওরঙ্গজেব যখন [তার ভাই] দারাশিকোর ওপর বিজয়ী হলেন, তখনই [ভারতবর্ষ) বিভক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল।’ অনেক লোক অনুমোদন না করলে এ ধরনের কষ্টকল্পিত অভিমত ফালতু হিসেবে পরিগণিত হতো।
এই পাকিস্তানি নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গির নজির পাওয়া যায় আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জওহের লাল নেহরুর রচনাবলীতে। জওহের লাল নেহরু কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের অনুরাগী ছিলেন না। ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ডিসকোভারি অব ইন্ডিয়ায় নেহরু বিস্তারিতভাবে আওরঙ্গজেবের অন্তর্নিহিত খুঁতগুলো তুলে ধরেন, ‘গোঁড়া ও কঠোর বিশুদ্ধবাদী’ হিসেবে তার নিন্দা করেন । তিনি ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে চালানো ও মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসকারী বিপজ্জনক পূর্বানুবৃত্তিকারী হিসেবে ষষ্ট মোগল সম্রাটের সমালোচনা করেছেন । সম্ভবত নেহরুর সবচেয়ে কঠিন আঘাত ছিল আওরঙ্গজেবের মুসলিম পরিচিতির ওপর। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে আওরঙ্গজেব বাড়াবাড়ি রকমের মুসলিম হওয়ায় সফল ভারতীয় রাজা হতে পারেননিঃ ‘আওরঙ্গজেব যখন [আগেকার মোগল শাসকদের সমন্বয়বাদের] বিরোধিতা ও একে দমন করা শুরু করেন এবং ভারতীয় শাসক হিসেবে নয়, বরং মুসলিম হিসেবেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন, তখন মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। নেহরুর মতে, ইসলামের প্রতি আওরঙ্গজেবের দৃঢ়ভাবে অনুরক্ত থাকাটাই তার ভারতবর্ষ শাসন করার সক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল।
আওরঙ্গজেব বিপজ্জনকভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি খারাপ সম্রাট ছিলেন- এমন ধারণা কেবল নেহরুই পোষণ করতেন, তা নয়। নেহরুর সমসাময়িক আরো অনেকেই এ ধরনের মতবাদ সমর্থন করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন বিশ শতকে আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনাকারী যদুনাথ সরকার। ব্রিটিশ উপনিবেশিক চিন্তাবিদেরা আরো অনেক আগে থেকেই মোগলদেরকে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছিলেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে ছিল মোগলরা কামুক, উৎপীড়ক ও মুসলিম। আলেকজান্ডার ডো ১৭৭২ সালেই মোগল শাসন সম্পর্কে এক আলোচনায় মন্তব্য করেছিলেন যে ‘মোহাম্মদের ধর্ম অদ্ভূতভাবে স্বৈরতন্ত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়, এবং প্রাচ্যের এ ধরনের সরকারের টিকে থাকার কারণগুলোর সাথেই তা সম্পর্কিত।’ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য ব্রিটিশদের কাছে সমস্যাটির এই সমাধান যে প্রয়োজনীয় ছিল, তা স্পষ্ট। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা উপনিবেশিক যুক্তির শেষ ধাপটি প্রত্যাখ্যান করলেও অনেকেই কোনো বাছবিচার না করেই প্রথম অংশটি গ্রহণ করে নেন। পাঠ্যবই ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এসব ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কয়েকটি প্রজন্ম ধরে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উগ্রবাদে তাড়িত উৎপীড়ক শাসক ছিলেন, এমন উপনিবেশিক ধারণা গলধঃকরণ করে তা বমনও করছে।
—
কয়েক শ’ বছর ধরে একেবারে হালকা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে অনেক ভাষ্যকার দুষ্ট, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের কল্পকথা প্রচার করেছেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এখনো লোকরঞ্জক স্মৃতিতে বিরাজ করছে। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে রয়েছে তিনি লাখ লাখ হিন্দুকে হত্যা করেছেন, হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করেছেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা এসব ‘তথ্য’ ঐতিহাসিক প্রমাণে না টিকলেও কোনো কোনো পণ্ডিত, সাধারণত খারাপ উদ্দেশ্যে, এ ধরনের আষাঢ়ে গল্পের একটি কথিত ভিত্তি প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য, আরো বেশি দেখা যায় আওরঙ্গজেবকে নিয়ে আগে উল্লেখ করা সমালোচনাগুলো টিকিয়ে রাখার নির্লজ্জ লক্ষ্য হাসিলের জন্য সুবিধাজনক কিছু নির্বাচিত ঘটনার পক্ষপাতপূর্ণ ব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমালোচকেরা সুর তোলেন যে আওরঙ্গজেব অমুক অমুক মন্দির ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তারা এ কথা স্বীকার করেন না যে তিনি অনেক হিন্দু মন্দির রক্ষা করার জন্য অসংখ্য আদেশ জারি করেছেন, ব্রাহ্মণদের বৃত্তি ও ভূমি মঞ্জুর করেছেন। তারা হলি উদযাপনে তার কড়াকড়ি আরোপের নিন্দা করেন একথা উল্লেখ ছাড়াই যে তিনি মোহাররম ও ঈদের অনুষ্ঠানও কাট-ছাঁট করেছেন। তারা বেমালুম চেপে যান যে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের সাথে পরামর্শ করতেন, আগের যেকোনো মোগল শাসকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি সংখ্যক হিন্দুকে তার প্রশাসনে নিয়োগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসন-সংশ্লিষ্ট অনেক কম উল্লেখ করা তবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর সাথে এই শাসককে নিয়ে ধর্মভিত্তিক ঘৃণায় চালিত কাল্পনিক চরিত্রকে সমন্বিত করার কাজটি আমরা করতে পারি না।
তবে কোনোভাবেই কেউ বলবে না যে আওরঙ্গজেব ত্রুটিহীন ছিলেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক, সার্বজনীন মূল্যবোধ ও মানবাধিকার মানদণ্ড পূরণ করতে না-পারা আওরঙ্গজেবের অনেক পদক্ষেপ খুঁজে বের করা কঠিন নয়। রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের প্রাক-আধুনিক বিশ্বে শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও অন্য সবকিছুই ওই সময় ও তিনি যে স্থানে বাস করেছিলেন তার সাথে শর্তসাপেক্ষ। আওরঙ্গজেবের সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় সোলায়মান। কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না যে এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বর্তমান সময়ের রীতিনীতি অনুযায়ী ‘সুশাসক’ ছিলেন। কারণ অতীতকে বর্তমানের মানদণ্ডের সাথে তুলনা করার কোনো মানে হয় না । ঐতিহাসিক সমীক্ষার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু ।
ইতিহাসবিদেরা বিশেষ সময় ও স্থানের ফসল হিসেবে তাদের নিজস্ব অবস্থার আলোকে ওই ব্যক্তিদের উপলব্ধি করতে চান, তাদের কর্মপন্থা ও প্রভাবের ব্যাখ্যা করেন। যাদের নিয়ে আমরা সমীক্ষা চালাচ্ছি, তাদেরকে অপরাধ মুক্ত করার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই এবং তাদেরকে পছন্দ করার কোনো দরকারও নেই আমাদের। তবে আমরা অভিমত প্রকাশ করা থেকে যথেষ্ট সময় বিরত থাকার চেষ্টা করেছি এ কারণে যে যাতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে থাকা কল্পকথা আড়ালে ম্লান হয়ে যায় এবং আরো বোধগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য কথা বলার অবকাশ সৃষ্টি হয় ।
মানুষ আওরঙ্গজেবকে ফিরে পাওয়া
সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তির স্থিতিশীলতা নির্ভর করে ন্যায়বিচারের (আদালত) ওপর।
–শাসকদের সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ বাণী, আওরঙ্গজেবের সমর্থিত
হিন্দুস্তানের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব তার জীবনকে বিন্যস্ত করেছিলেন কিছু প্রধান আদর্শ ও বদ্ধমূল ধারণার আলোকে। তিনি হতে চেয়েছিলেন ন্যায়পরায়ণ রাজা, ভালো মুসলিম, মোগল সংস্কৃতি ও প্রথা রক্ষাকারী। আওরঙ্গজেব একইসাথে একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রেরও প্রধান ছিলেন, প্রায়ই সহিংসতা প্রয়োগ করে উপমহাদেশ ও এর অধিবাসীদের ওপর রাজকীয় কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করার প্রয়াস চালাতেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যটি সর্বোপরি ন্যায়বিচারসহ এসব সার মূল্যবোধ অনুসরণে তার চেষ্টা, এবং রূঢ় ক্ষমতা কব্জা করার জন্য যেসব আদর্শ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন, সেইসব উদাহরণ কেন্দ্র করে প্রণীত 1
ন্যায়বিচার সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য বৃহত্তর ইসলামি ঐতিহ্যের রঙে গভীরভাবে রঞ্জিত, এর বেশির ভাগের সাথে ধর্মতত্ত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই । ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত প্রাক-আধুনিক ‘ইসলামি’ আদর্শ ব্যাপকভাবেই ইসলাম পূর্ববর্তী পারস্য ও গ্রিক দর্শন থেকে গৃহীত। এই ভাষ্যে জিহাদ ও জিজিয়ার (যথাক্রমে ধর্মযুদ্ধ ও ব্যক্তির ওপর আরোপিত কর) মতো বিভেদকারী ধারণাগুলো আখলাক ও আদবের (যথাক্রমে রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিক মূল্যবোধ) মতো আদর্শগত ধারণার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় পূর্বসূরীদের মাধ্যমেও প্রভাবিত হয়েছিলেন, নিজেকে পূর্ববর্তী মোগল রাজাদের অনুকরণে গড়ে তুলেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ন্যায়বিচার-সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের আদর্শ বর্তমান সময়ে সাধারণভাবে গৃহীত আদর্শের সাথে মেলে না। কিন্তু তা খুব বড় বিষয় নয়। সমসাময়িক মানদণ্ডে আওরঙ্গজেবকে বিচার করার বদলে আমি চেয়েছি তার জীবন ও শাসন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভাষ্য নির্মাণ করতে এবং কয়েক শ’ বছর ধরে আমাদের মেনে নেওয়া ভুল তথ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকা এই ব্যক্তি ও রাজাকে উদ্ধার করতে।
ন্যায়বিচার, ধর্মানুরাগ ও মোগল রাষ্ট্রের প্রতি আওরঙ্গজেবের ভক্তি ফারসি ইতিহাস গ্রন্থরাজি, বাদশাহর চিঠিপত্র ও সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকজুড়ে থাকা অন্য প্রাথমিক দলিল-দস্তাবেজগুলোতে বারবার উল্লেখ করা বিষয়। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যের মূল কাঠামো এসেছে এসব ফারসি রচনাবলীর সমালোচনামূলক পাঠ থেকে। এছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, ও অন্যান্য ভাষায় (আরো জানার জন্য এই বইয়ের শেষ দিকে থাকা জীবনীমূলক প্রবন্ধ ও পুনশ্চ : মধ্য যুগের ফারসি সাহিত্য পাঠ নিয়ে নোট অধ্যায় দেখুন) গবেষণাও রয়েছে। আওরঙ্গজেবের আদর্শগুলো- বিশেষ করে তার ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ ও যথার্থ ইসলামি আচরণবিষয়ক ধারণাগুলো- বর্তমানে এগুলো সাধারণভাবে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা থেকে অনেক ভিন্ন। তবে তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন কিনা তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং আমি জানতে চাই, আওরঙ্গজেব ন্যায়পরায়ণ শাসক বলতে কী বুঝতেন এবং তা কিভাবে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তার বিশ্ব-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা গড়ে দিয়েছিল ।
বোধগম্যভাবেই আওরঙ্গজেব তার নিজস্ব পরিভাষাতেই একটি প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ, তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা করার চেষ্টা হয়েছে সামান্যই। এই বই মধ্য যুগের ভারতবর্ষে আওরঙ্গজেবের প্রভাব এবং ইন্দো মুসলিম ইতিহাসের মধ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আরো ভালোভাবে বুঝতে আমাদের সহায়তা করবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জোরালো বাস্তব ঐতিহাসিক বক্তব্য বর্তমানের (যা আওরঙ্গজেবকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা তিনি কখনোই ছিলেন না) আবেগকে প্রশমিত করতে পারে। এটিও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক যে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বর্তমান বিকৃতির মধ্যে আমার সুপারিশ করা মধ্যবর্তী ভূমিকার ভিত্তি চিন্তাশীল ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। এর বিপরীতে, আগেকার চিন্তাবিদেরা আওরঙ্গবের উত্তপ্ত লোকরঞ্জক ভাবমূর্তি প্রশমিত করতে দুটি ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু রক্ষণাত্মক হওয়ায় উভয়টিই ব্যর্থ
হয়েছে।
—
প্রথম ব্যর্থ কৌশলে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মীয় স্বৈরশাসক, আবার সেইসাথে প্রধানত আকবর ও দারাশিকোর মতো ‘প্রচলিত মতবাদবিরুদ্ধ মুসলিম’ মোগল ব্যক্তিত্বদের চেয়ে ভিন্ন। এই যুক্তিতে বলা হয়, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের তুলনায় আকবর ও দারা অনেক বেশি হিন্দু ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করেছিলেন। আর এভাবেই তারা উপমহাদেশের গ্রহণযোগ্য শাসক হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ‘ভারতীয়তে’ পরিণত হয়েছিলেন। এই চিন্তাধারায় আওরঙ্গজেবকে পুনঃবিবেচনা বা পুনঃমূল্যায়ন করা হয় না। এর বদলে তৃতীয় মোগল সম্রাট ও আওরঙ্গজেবের দাদার বাবা আকবরের নির্মিত কথিত সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধ্বংস করা ও আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শুকোহর কাছ থেকে মোগল রাজমুকুট ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে কলঙ্কিত করা হয়। অবশ্য, মনে করা হয় যে ইতিহাসের মহা পথ-পরিক্রমায় আদর্শমূলক ভারতীয় মুসলিমদের সমন্বয়বাদী উত্তরাধিকারে ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেছে আওরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িকতাবাদ । এই চিন্তাধারা এমনকি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক প্রচারক ভি ডি সাভারকারের মতো লোকজনও লালন করেন। দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদল নিয়ে বিতর্কের সময় এই যুক্তি অনুসরণ করেই সেটির নতুন নাম দারা শুকোহ রোড রাখার প্রস্তাবও এসেছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আওরঙ্গজেবের মতো আকবর ও দারা শুকোহ উভয়েই তাদের নিয়ে লোকরঞ্জক খ্যাতিতে যা বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সাথে ভারসাম্য করার জন্য আকবর ও দারাকে সামনে আনতে গিয়ে এসব লোক সম্পর্কে নতুন কিছু শিখতে আমরা ব্যর্থ হই, তাদের মুসলমানিত্ব অনুযায়ী মোগল বাদশাহদের মান নির্ণয় করার কাজে নিজেদের শৃঙ্খলিত করে ফেলি। এই তুলনা করতে গিয়ে আমরা এই ধারণা পোষণ করে বিরাট ভুল করে বসি যে ভারতবর্ষের ইতিহাস, তথা ইন্দো-মুসলিম অতীতের সবকিছুই ধর্মবিষয়ক। আওরঙ্গজেব মুসলিম ছিলেন। তবে তার আধুনিক অনুসারীরা বা সমর্থকেরা তাকে যে ধরনের মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে, তেমন ছিলেন না তিনি। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবকে তার বিশ্বাসের মধ্যে খর্ব করা যায় না। অতীতের কাছে সৎ থাকার জন্য আমাদের যুবরাজ ও সম্রাট হিসেবে তার পূর্ণতর ছবিটি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
—
আক্রমণে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে আমরা খুবই কঠোরভাবে আওরঙ্গজেবকে বিচার করছি। সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে ঘৃণ্য মুসলিম বদমাসটি আসলে ততটা জঘন্য ছিলেন না?
এই যুক্তির ভিত্তি নিহিত রয়েছে আওরঙ্গজেবের আমল সম্পর্কে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা সংশোধন এবং মোটামুটিভাবে সঠিক হলেও যেসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলো উপস্থাপনের ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লোকরঞ্জক বিশ্বাসের বিপরীতে আওরঙ্গজেব কখনো বড় মাত্রার এমন কোনো ধর্মান্তর কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেননি যাতে অমুসলিমদেরকে ইসলাম বা তরবারির কোনো একটিকে গ্রহণ করে নিতে হয়েছিল। আওরঙ্গজেব কখনোই হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেননি (খুব সম্ভবত সংখ্যাটি কয়েক ডজনে সীমিত থাকতে পারে)। তিনি হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যার মতো জঘন্য কোনো কাজ করেননি। বস্তুত, তিনি তার সরকারের সর্বোচ্চ অবস্থানে হিন্দুদের বসিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মীয় গ্রুপগুলোর স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছিলেন, এমনকি ব্রাহ্মণদের হয়রানি বন্ধ করার জন্য স্বধর্মী মুসলিমদের নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তিনি তার সব প্রজার জন্য নিরাপদ রাস্তা ও মৌলিক আইন-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন।
সব ঘটনার সঠিক বিবরণ দেওয়া ইতিহাসবিদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়, এবং এটুকু সত্য : আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সমসাময়িক খ্যাতির তুলনায় অন্যের প্রতি অনেক কম অকল্যাণকামী। তবে আওরঙ্গজেব পুরোপুরি জঘন্য ব্যক্তি ছিলেন না, কেবল এমন কথার ফুলঝুড়ি দিয়েই আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লোকরঞ্জক নিন্দাগুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে পারব না। আরো সমস্যার বিষয় হলো, আমরা ভারতবর্ষের জটিল অতীত সম্পর্কে ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হই। আওরঙ্গজেব কি একুশ শতকের স্পর্শকাতরতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলেন? এমন প্রশ্নের চেয়ে উপনিবেশ-পূর্ব ভারতবর্ষে অর্ধশত বর্ষ শাসনকারী ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেওয়া লোকটি সম্পর্কে অনেক বেশি কথা বলার আছে। আমাদেরকে অবশ্যই তাড়াহুড়া করে আওরঙ্গজেবের বিচার করার প্রবল, আধুনিক প্রবৃত্তি দমন করে বরং এই প্রভাবশালী বাদশাহর কর্ম ও আদর্শগুলোকে প্রথমে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
আমাদের প্রয়োজন আওরঙ্গজেব সম্পর্কে নতুন ভাষ্য। আমি এখানে এ ধরনের একটি বক্তব্যই উপস্থাপন করছি।
—
আমার ভাষ্যে আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসনকাল সম্পর্কে বর্তমানে স্বল্প পরিচিত অনেক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করে এর মাধ্যমে বিভ্রান্তির শিকার এক বাদশাহ-সম্পর্কে অতি-প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করেছে। এতে আওরঙ্গজেবের কথিত ‘সবচেয়ে খারাপ’ বিষয়গুলো তথা তার মন্দির অবমাননা, কূটিল রাজনৈতিক বুদ্ধি, সহিংস পন্থা, কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নির্যাতন করার মতো অভিযোগের জবাব দেওয়া হলেও এগুলোতেই বইটি সীমাবদ্ধ নয়। যদি কেবল আওরঙ্গজেব সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সন্দেহজনক দাবিগুলো মোকাবিলা করা হয়, তবে তা হবে একটি ফাঁকা কাজ। কারণ এটি ইতিহাসের মূল নির্দেশিকা তথা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের তাদের নিজস্ব পরিভাষার ভিত্তিতে উপলব্ধি করার কাজটি বাস্তবায়ন করা হবে না ।
এই পার্থক্যের- রক্ষণাত্মকভাবে চিন্তা করা বনাম ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা করা- একটি ভালো উদাহরণ হলো হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ। লোকরঞ্জক ধারণায় আওরঙ্গজেবকে সব হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ও সবভাবে তাদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন বলে কল্পনা করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ইতিহাসবিদ বিজ্ঞচিতভাবে বলতে পারেন যে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হিন্দুদের সাথে আচরণ করেছিলেন। মোগল রাষ্ট্র ও বিশেষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতো এবং এতে অনেক সময় স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ও থাকত। কিন্তু অনেক হিন্দুই আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে সহিষ্ণুতা ও সুরক্ষা লাভ করেছিল। আওরঙ্গজেবের শাসন নিয়ে চিন্তা করার সময় নির্ভুল হলেও এ ঐতিহাসিক সংশোধনটি হিন্দুদের ব্যাপারে সাধারণ কোনো ধারা গ্রহণ ফলপ্রসূ পথ কিনা সেই মৌলিক প্রশ্নটি বিবেচনা করতে পারেনি।
বাস্তবে আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হিন্দুদের ব্যাপারে সার্বজনীন কোনো এজেন্ডা অনুসরণ করেননি। ওই আমলে ‘হিন্দুরা’ সাধারণত নিজেদের ওই পরিভাষায় পরিচিত করত না, তারা বরং আঞ্চলিক, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী পরিচয়ে (যেমন রাজপুত, মারাঠা, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব ইত্যাদি) পরিচিত করত। অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, ‘হিন্দু’ শব্দটি সংস্কৃত নয়, বরং ফারসি। আর এ শব্দটি ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে সাধারণভাবে স্ব-উল্লেখে ব্যবহৃত হয়েছিল । মোগলরাও ‘হিন্দুদের’ বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিত। উদাহরণ হিসেবে মোহাব্বত খানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ১৬৭০-এর দশকে অল্প সময়ের জন্য দাক্ষিণাত্যে মোগল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি মারাঠাদের (তারা দৃশ্যত এই ঘটনায় ‘হিন্দু’ হিসেবে বিবেচিত হয়নি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় মোগল আভিজাত্যের মধ্যে ‘রাজপুত ও হিন্দুদের’ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আওরঙ্গজেবের আমলে একটি ব্লক হিসেবে মোগল-হিন্দু সম্পর্ককে মূল্যায়ন করার বদলে আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তথা বিশেষ গ্রুপ ও পদক্ষেপকে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করব। এর ফলে পাঠকেরা এখানে হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ নিয়ে আলাদা কোনো অংশের দেখা পাবে না, বরং মোগল রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়োজিত হিন্দু অভিজাত, ব্রাহ্মণ নেতা এবং সশস্ত্র মারাঠা বিরোধিতারীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দেখতে পাবে!
আমাদের সময়ের সীমাবদ্ধকরণ, সাম্প্রদায়িক পরিভাষার ঊর্ধ্বে আমরা যদি ওঠতে পারি, এবং এর বদলে সপ্তদশ শতকের মোগল বিশ্বকে পুনরুদ্ধারের প্রবল প্রয়াস চালাই, তবে আওরঙ্গজেবের এক চমকপ্রদ ছবির আবির্ভাব ঘটবে। এই আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতবর্ষের সম্রাট। তিনি সারা জীবন সাধনা করেছেন মোগল সাম্রাজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারিত করার, রাজনৈতিক শক্তি লাভ করার এবং ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজস্ব ধারণার আলোকে শাসন করার ।
—
আওরঙ্গজেবের জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্যের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা একমত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬১৮ সালের শরতে। ১৬৫৮ সালে ৩৯ বছর বয়সে তার প্রথম রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। তিনি ১৬৮১ সালে পুরো রাজদরবার নিয়ে দাক্ষিণাত্য অভিযানে বের হয়েছিলেন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৬০-এর কোঠার মাঝামাঝিতে। এরপর তিনি বিজাপুর, গোলকোন্ডা ও এমনকি তামিল নাড়ুর অংশবিশেষও জয় করেছিলেন। তিনি ৮৮ বছর বয়সে ১৭০৭ সালে পরলোকগমন করেন । তবে আমরা তথ্যগুলোকে কিভাবে একসাথে করে সাজাব, তার আলোকে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আকর্ষণীয় সবকিছু বের হয়ে আসে। অন্য কথায় বলা যায়, আর এই ভাষ্যই আসল জিনিস ।
আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্য একইসাথে সম্রাট হিসেবে তার জীবনে গভীরতা ও ব্যাপকতা অনুসন্ধান করেছে। এগুলো কিছুটা কালক্রমানুনিকভাবে ও কিছুটা বিষয়ভিত্তিক সাজানো হয়েছে। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের জীবনকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা মোগল রাজত্ব, নৈতিক আচরণ, রাজনীতি সম্পর্কে তার ধারণা গঠনকারী প্রধান শক্তিগুলো উপলব্ধি করতে পারি, সময়ের পরিক্রমায় এসব শক্তি কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তাও দেখতে পাই। সিংহাসনে থাকাকালীন কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আরো গভীর মূল্যায়ন ও তার ঐতিহাসিক নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারি ।
আমি আওরঙ্গজেবের জীবনের প্রথম চার দশক তথা তার তারুণ্য আমল দিয়ে শুরু করব। এ সময়ই তিনি বিশেষ করে ভাইদের বিরুদ্ধে আসন্ন উত্তরাধিকার লড়াইয়ে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। দুই বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর আওরঙ্গজেব সিংহাসন নিশ্চিত করেন, অল্প সময়ের মধ্যেই তার নিজের প্রয়োজনের (তার প্রায় ৫০ বছরের শাসনকালে প্রকাশিত প্রকল্প) সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতাসীন সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনের তিনটি বিষয় তার শাসন কৌশল ও ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত ধারণা পেতে আমাদের সহায়তা করে। এগুলো হচ্ছে : সাম্রাজ্যিক আমলাতন্ত্র, একজন নৈতিক নেতা হিসেবে আওরঙ্গজেবের নিজেকে মূল্যায়ন এবং হিন্দু ও জৈন মন্দির সম্পর্কে তার নীতি। এগুলো আওরঙ্গজেবের শাসনকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং স্বল্প জানা ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসে। সর্বোপরি, এসব অধ্যায় প্রায়ই একটিমাত্র চশমা দিয়ে দিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত একজন বাদশাহ-সম্পর্কে ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করে। আমি এর পর আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ দিকের বর্ণনা দেব। এসবের মধ্যে রয়েছে দাক্ষিণাত্যে তার শেষ দশকগুলোর সংগ্রাম ও মৃত্যু। অষ্টাদশ শতকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তাকে যেসব কারণে অভিযুক্ত করা হয়, সেগুলোর ওপরও আমি আলোকপাত করব।
ব্যাপক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আমি প্রস্তাব করছি যে আমরা রাজপুরুষ হিসেবে আওরঙ্গজেবকে (তিনি রাজপরিবারের গতিশীলতার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। এটি তার প্রথম দিকের জীবন গড়ে দিয়েছিল এবং পরে তাকে এমন এক ভারতবর্ষীয় সম্রাটে পরিণত করেছিল, যিনি ভূখণ্ড, রাজনৈতিক শক্তি ও বিশেষভাবে ন্যায়বিচারের প্রতি ক্ষুধিত ছিলেন) সফলভাবে দেখতে পাব!