আওরংজীব ও মন্দিরধ্বংস ঐতিহাসিক সত্য কি?
সম্রাট আওরংজীবের মৃত্যুর পর তাঁহার প্রিয় মুশী এবং শিষ্য ইনাএউল্লা খাঁ (তখন দেওয়ান) মুহম্মদ সাকী মুস্তাদ খাঁকে ঐ পাদিশার রাজত্বের ইতিহাস লিখিতে অনুরোধ করেন। কারণ তাঁহার মতে মুস্তাদ খাঁই ‘অর্থজ্ঞানসম্পন্ন এবং আলমগীরের গুণবর্ণনা করিবার উপযুক্ত ক্ষমতাশালী (মাসির-ই-আলমগীরী, মূল ফার্সী ৬৮ পৃ.)। তখন রাজসরকারের কাগজপত্র দেখিয়া এবং আওরংজীবের দরবারে দীর্ঘকাল কর্ম্ম করিবার সময়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও ঘটনাজ্ঞান অবলম্বন করিয়া মুস্তাদ খাঁ ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে মাসির-ই-আলমীরী নামে এক ফার্সী ইতিহাস লিখিলেন। ঐ পাদিশার শেষ ৪০ বৎসর রাজ্যকালের ইহাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং এক মাত্র প্রামাণিক ইতিহাস।
এই গ্রন্থ হইতে আওরংজীব কর্তৃক হিন্দু-মন্দিরবিনাশ করা সম্বন্ধে এইসব সত্যসংবাদ পাওয়া যায়:-
(১) “৯ই এপ্রিল ১৬৬৯-পাদিশা সকল প্রদেশের শাসনকর্তাদিগকে আজ্ঞা করিয়া পাঠাইলেন যে বিধর্মীদিগের শিক্ষাগৃহ এবং মন্দির ধ্বংস করিতে হইবে এবং তাহাদের শিক্ষা এবং ধর্ম্মক্রিয়াকাণ্ড বলের সহিত বন্ধ করিতে হইবে।” (৮১ পৃ.)
(২) “২রা সেপ্টেম্বর– রাজসভায় সংবাদ আসিল যে সম্রাটের আজ্ঞানুসারে তাঁহার কর্ম্মচারীগণ কাশীতে বিশ্বনাথের মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে।” ( ৮৮ পৃ.)
(৩) “জানুয়ারী ১৬৭০-রমজান মাসে ধর্ম্মাত্মা পাদিশা মথুরার ‘কেশোরায়ের ডেরা’ নামক মন্দির ধ্বংস করিতে আজ্ঞা দিলেন। তাঁহার কর্মচারীগণ অতি অল্পসময়েই এই আজ্ঞা পালন করিল। প্রচুর ব্যয়ে উহার ভিত্তির উপর একটি প্রকাণ্ড মজিদ গড়া হইল। ঐ মন্দির বুন্দেলা-রাজ বীরসিংহদের ৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন।… উহার ছোট ও বড় এবং নানা-মণিখচিত সব দেবমূৰ্ত্তিগুলি আগ্রায় আনিয়া জহান্ আরার মজিদের সিঁড়ির নীচে পুঁতিয়া রাখা হইল, যেন সর্ব্বদাই পদদলিত হইতে পারে।” (৯৫ পৃ.)
“২২শে ফেব্রুয়ারি ১৬৮০-আজ সম্রাট চিতোরদুর্গ দর্শন করিতে গেলেন, এবং তাঁহার আজ্ঞায় স্থানের ৬৩টি মন্দির ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল” (১৮৯ পৃ.)। এই গ্রন্থের আরও অনেক স্থলে মন্দির ধ্বংসের তারিখ ও বিবরণ দেওয়া আছে, যথা ৮৪, ১৭১, ১৭৩, ১৭৫, ১৮৬, ১৮৮, ১৮৯, ৩৯৬ পৃষ্ঠা।
ইনাএউল্লা কর্তৃক সংগৃহীত বাদশাহের এক চিঠিতে তিনি লিখিতেছেন:- ‘আমার রাজ্যকালের প্রারম্ভে সোমনাথ মন্দির ভাঙ্গিয়া তথায় মূর্তিপূজা বন্ধ করিয়া দিই।… যদি পৌত্তলিকগণ সেখানে আবার পূজা আরম্ভ করিয়া থাকে তবে মন্দিরটি এমন করিয়া ভাঙ্গিয়া দিবে যে তাহার চিহ্ন মাত্র বিদ্যমান থাকিবে না’ (আকাম, রামপুর হস্তলিপির ১০ ক পৃ.)।
আর এক পত্রে সম্রাট লিখিতেছেন:– “এই দেশের (অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের) বাড়ীগুলি বড় শক্ত, শুধু পাথর ও লোহা দিয়া তৈয়ারী।… একজন গোঁড়া (মুসলমান) দারোগা নিযুক্ত করিবে যে অবসর মত তাহাদের ভাঙ্গিয়া ভিত্তি পৰ্য্যন্ত খুঁড়িয়া তুলিয়া ফেলিতে পারে।” (কালিমাৎ, ইণ্ডিয়া অফিস হস্তলিপি ৩৫ ক পৃ.)।
হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা সম্বন্ধে অন্যান্য আজ্ঞা এবং বিবরণ আমার History of Aurangzib, Vol iii, Ch. 34-এর ৫ পরিশিষ্টে দেওয়া হইয়াছে।
কাশীতে রক্ষিত আওরংজীবের যে ফর্ম্মানটি একজন ইংরেজের অনুবাদসহ শ্রীযুক্ত সেন ১৯১১ সালের এশিয়াটিক সোসাইটির জর্নালে প্রথম প্রকাশিত করেন, তাহার অনুবাদে তারিখটি ভুল করিয়া ১৬৫৩ দেওয়া হইয়াছে, তখন আওরংজীব দাক্ষিণাত্যের সুবাদার মাত্র ছিলেন, উত্তরভারতে তাহার কোন অধিকার ছিল না। উহার ফটো হইতে স্পষ্ট পড়িতে পারা যায় যে উহার তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯। আমার নিকট দুই পৃষ্ঠেরই ফটো আছে, তাহাতে লিখিত আছে যে কুমার মুহম্মদ সুলতানের অনুরোধে এই ফর্ম্মান দেওয়া হইল। তারিখটি ভাবিবার বিষয়; উহার কিছু পূর্ব্বেই পরাজিত শূজা বারাণসী হইতে ৪ লক্ষ টাকা লুঠের ভয় দেখাইয়া গ্রহণ করিয়া বিহার ও বঙ্গে পলাইয়া গিয়াছেন। তাঁহার পশ্চাদ্ধাবনে এই সময়ে মুহম্মদ সুলতান কাশীতে উপস্থিত। তাঁহাকে ধরিয়া কয়েকজন ব্রাহ্মণ সেবাইত এই ফৰ্ম্মান লাভ করে। ইহাতে স্থানীয় ব্রাহ্মণদিগকে নিজ নিজ কৰ্ম্ম (অর্থাৎ পাণ্ডাগিরি বা সেবাইতগিরি) হইতে সরাইয়া না দিতে এবং অপর হিন্দুদিগকে ত্যক্ত না করিতে আজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে। যদিও এই ফর্ম্মানের একস্থলে আছে-”আমাদের ধর্মগ্রন্থের আদেশ যে পুরাতন মন্দির ভগ্ন করা উচিত নহে, কিন্তু নূতন মন্দির গঠিত করিতে দিবে না”,-তথাপি ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে আওরংজীব কর্তৃক রাজ্যময় জারি করা এক আদেশপত্রে আমরা এই আজ্ঞা পাই: “গত দশ বারো বৎসরের মধ্যে নির্ম্মিত মন্দিরগুলি সব ভাঙ্গিবে, এবং পুরাতন মন্দির মেরামত করিতে দিবে না।” (মুরক্কাৎ-ই-হসন, রামপুর হস্তলিপি।)
[প্রবাসী, ভাগ ২১, খণ্ড ১, সংখ্যা ৬, আশ্বিন, ১৩২৮।।