আওরংজীবের পরিবারবর্গ
অন্য সকল মুঘল বাদশাহগণের ন্যায়, আওরংজীবও নিজ পুত্রগণকে লইয়া অসুখী ছিলেন। সর্ব্বদাই তাঁহার মনে মনে আশঙ্কা হইত, বুঝি বা কারারুদ্ধ বৃদ্ধ শাজাহানের অভিশাপই ফলিয়া যায়– নিজ পিতার প্রতি যেরূপ আচরণ করিয়াছিলেন, পুত্রগণের হস্তেও ঠিক সেইরূপ আচরণই তিনি প্রাপ্ত হন। এই কর্ম্মফলকে ব্যর্থ করিবার জন্য জীবনের শেষদিন অবধি তিনি সাবহিত ছিলেন। পুত্রগণের দৈনন্দিন কার্য্যকলাপ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তিনি স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত করিয়া দিয়াছিলেন, রাজবেতনভোগী গুপ্তচরবৃন্দ তাহাদের পরিচারকের কর্ম্মে সর্ব্বদা নিযুক্ত থাকিত। এবং কোনও পুত্র তাঁহার অনভিমত কার্য্য করিলে, উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বল্পমাত্রও পরিচয় দিলে অথবা কিঞ্চিৎমাত্রও রাজক্ষমতা অপহরণের আয়োজন করিলে তৎক্ষণাৎ তাহাদিগের লাঞ্ছনাবিধান করিতেন।
আওরংজীবের জ্যেষ্ঠপুত্র মুহম্মদ সুলতান। শাজাহানের রাজ্যের উত্তরাধিকারী হইবার জন্য সূজার সহিত যখন তাঁহার যুদ্ধ হইতেছিল, সেই সময় (৮ই জুন ১৬৫৯) মুহম্মদ সুলতান পিতৃপক্ষ ত্যাগ করিয়া গিয়া সূজার সহিত যোগদান করেন। কিন্তু কয়েকমাস পরে তিনি আবার পৈত্রিক সৈন্যদলে প্রত্যাগমন করিয়া রাজাজ্ঞায় গোয়ালিয়রে কারারুদ্ধ হন। মাঝে মাঝে পুত্রের প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কনের জন্য বাদশাহ তথায় চিত্রকরগণকে প্রেরণ করিতেন- নতুবা পুত্রের স্বাস্থ্যসংবাদ লইবার আর কি উপায় ছিল! দ্বাদশবর্ষ এইভাবে কারাবাসের পর ভাগ্যদেবী আবার বুঝি এই হতভাগ্যের উপর প্রসন্ন হইলেন! ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তাঁহাকে দিল্লী মধ্যস্থ সলিমগড় দুর্গে স্থানান্তরিত করা হইল এবং তিনি বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎলাভের অনুমতি পাইলেন। ইহার গূঢ় কারণটি কি? আমাদের অনুমান হয়, দ্বিতীয় পুত্র মুহম্মদ মুয়াজ্জম্কে খর্ব্ব করিবার জন্যই বাদশাহের এই কৌশল। এতদিন লোকে ভাবিত-মুয়াজ্জম্ই ভবিষ্যতে পিতৃসিংহাসন লাভ করিবেন কিন্তু তাঁহার আচরণে আওরংজীব অসন্তুষ্ট ছিলেন; তাই জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রতি এ অনুগ্রহ। মুহম্মদ সুলতানের উপর রাজপ্রসাদ অজস্র বর্ষিত হইতে লাগিল; তাঁহার অন্তঃপুর নব নব সুন্দরীগণে পূর্ণ হইয়া উঠিল; ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুরাদের কন্যা দোস্তদার বানুর সহিত, তিন বৎসর পরে পার্ব্বত্যরাজ্য কিস্তায়রের রাজকন্যা বাইভূত দেবীর সহিত এবং পরবর্তী আগস্ট মাসে দৌলতাবাদী মহলের এক ভ্রাতুষ্পুত্রীর সহিত– ক্রমান্বয়ে এই তিন কন্যার সহিত তাঁহার বিবাহ হইল।– সকলেই মনে করিল মুহম্মদ সুলতান এইবার স্বাধীনতা পাইবেন এবং সাম্রাজ্যাধিকারী বলিয়া গণ্য হইবেন। কিন্তু ৩৭ বৎসর বয়ঃক্রমকালে অকালমৃত্যু আসিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিয়া ফেলিল (৩রা ডিসেম্বর ১৬৭৬)।
মুহম্মদ সুলতানের বন্দী হইবার পরে মুহম্মদ মুয়াজ্জম্ তাঁহার পিতার দক্ষিণ পার্শ্বে সম্মানের স্থান গ্রহণ করিলেন। ইনিই পরে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাহাদুর শাহ্ নামে তাঁহার পিতার সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে যখন তাঁহার বয়ঃক্রম মাত্র ২০ বৎসর তখন তিনি দাক্ষিণাত্যের শাসকর্তারূপে প্রেরিত হন। তিনি তথায় ১০ বৎসর কাল অবস্থান করিয়াছিলেন, মধ্যে মধ্যে উত্তর ভারতে পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেন এবং পারস্যরাজের ভারতাক্রমণ আশঙ্কায় সম্রাট-সৈন্য পঞ্জাবে প্রেরিত হইলে তিনি অগ্রবর্তী সৈন্যের সেনাপতিরূপে তথায় একবার প্রেরিত হইয়াছিলেন (১৬৬৬ খ্রিঃ)। কিন্তু ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমভাগে তিনি বাদশাহের সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে পতিত হইলেন। রাজকীয় ইতিহাসে কেবল উল্লিখিত হইয়াছে, “সম্রাট সংবাদ পাইলেন রাজকুমার তোষামোদকারীদিগের উত্তেজনায় স্বাধীনভাবে কার্য্য করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। সম্রাটের সদুপদেশপূর্ণ পত্রে কোন ফল হইল না। রাজকুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাঁহাকে কর্তব্যের পথে ফিরাইবার জন্য তাঁহার জননী নবাব বাইকে সম্রাট দক্ষিণাত্যে প্রেরণ করিলেন। তাঁহার পক্ষ হইতে ভর্ৎসনাপূর্ণ পত্র দিবার জন্য রাজসভা হইতে জনৈক ওম্রাহ্ও প্রেরিত হইয়াছিলেন। কিন্তু অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইল। রাজকুমারের চরিত্র রাজভক্তি-পূর্ণ। রাজকুমার দুঃখ ও অনুতাপ প্রকাশ করিয়া বিনয় সহকারে পত্রের উত্তর প্রদান করিলে সম্রাটের অনুগ্রহ পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন।” কিন্তু তথাপি তাঁহার বিরুদ্ধে সন্দেহ অপনীত হইল না। যাহা হউক, তিনি শিবাজীকে দমন করিতে সম্পূর্ণরূপে অসমর্থ হইলেন এবং তাঁহার অবাধ্য সেনানী দিলির খাঁর সহিত অবিরত বিবাদের জন্য দাক্ষিণাত্যের শাসনকাৰ্য্য অসম্ভব হইয়া উঠিল। সেইজন্য তিনি ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ঐ পদ হইতে অপসারিত হইলেন। ঠিক এই সময়ে মুহম্মদ সুলতানকে পুনরায় অনুগ্রহ প্রদর্শন করায় সম্ভবত: আওরংজীবের এই উদ্দেশ্য ছিল যে, মুয়াজ্জম্ দেখুন যে, সম্রাটের তাঁহার অবাধ্য পুত্রকে ইচ্ছামত ত্যাগ করিতে পারেন।
তিন বৎসর পরে মুয়াজ্জম্ শাহ্আলম উপাধি পাইয়া (২৫ই অক্টোবর ১৬৭৬ খ্রিঃ) আফগানিস্তানে প্রধান সেনাপতিরূপে প্রেরিত হইয়াছিলেন। তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া (২০শে জানুয়ারী ১৬৭৮ খ্রি:) তিনি কয়েক মাস রাজসভায় প্রভাব ও ক্ষমতা ভোগ করিয়াছিলেন; তৎপরে দেড় বৎসরের জন্য দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা হইয়াছিলেন (১৬৭৮: সেপ্টেম্বর–১৬৮০ মার্চ) কিন্তু তিনি ‘বৃহৎ সৈন্যদল লইয়াও শিবাজী বা বিজয়পুর রাজের বিরুদ্ধে কিছুই করিয়া উঠিতে পারেন নাই।’ রাজপুত-যুদ্ধে তিনি উত্তর মেবারে একদল সৈন্যের সেনাপতিরূপে কার্য্য করিয়াছিলেন এবং বিদ্রোহী আকবরের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু সফলতা লাভ করিতে পারেন নাই! সম্রাট দাক্ষিণাত্যে গমন করিলে শাহ্ আলম তাঁহার অনুগমন করেন এবং কোঙ্কন প্রদেশে একদল সৈন্য লইয়া গিয়া (১৬৮৩ সেপ্টেম্বর-১৬৮৪ মে) অত্যন্ত বিপন্ন হইয়া পড়েন।
গোলকুণ্ডার অবরোধকালে শত্রুপক্ষের সহিত শাহ্ আলমের পত্র ব্যবহার পথিমধ্যে বাদশাহের হস্তগত হওয়ায় বুঝিতে পারা যায় যে, তিনি কুশাহের লোকজনদিগকে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য উৎসাহিত করিতেন। তাঁহাদিগের প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করিতেন এবং অবরোধ কার্য্যে শৈথিল্য করিয়াছেন। এরূপ সন্দেহও হইয়াছিল যে তিনি হায়দারাবাদের লুণ্ঠিত দ্রব্যের সমস্তই রাজভাণ্ডারে প্রদান না করিয়া অধিকাংশ আত্মসাৎ করিয়াছেন। সেই জন্য ২০শে ফেব্রুয়ারী ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বীয় পুত্রগণের সহিত ধৃত ও বন্দী হন। সম্রাটের আদেশে খোঁজারা তাঁহার প্রিয়পত্নী নুরুন্নিসাকে অপমানিত করিয়া তাঁহারও স্বাধীনতা হরণ করে। নুরুন্নিসার সমস্ত সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত হইল এবং তাঁহার প্রধান কর্ম্মচারী যাহাতে নিজ প্রভুর রাজ-বিদ্বেষের উদাহরণ ও প্রভুপত্নীর এরূপ কার্য্যের সহিত সম্পর্ক থাকা সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন, তজ্জন্য তাঁহাকে যন্ত্রণা দেওয়া হইতে লাগিল।
শাহ্ আলমের বন্দীত্বের কঠোরতা অল্পে অল্পে হ্রাস করিয়া ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মে তারিখে একেবারে মুক্তি প্রদান করা হইল এবং তিনি প্রথমে মুলতান ও পরে আফগানিস্তানে শাসকর্তারূপে প্রেরিত হইলেন। তিনি কখনই সাহসী বা দৃপ্ত ছিলেন না। এই কারাবাসের ফলে তাঁহার সমস্ত তেজ নষ্ট হইল। তাঁহার দশা নিতান্ত ভীরুর ন্যায় হইল। বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পাইল। তিনি কপটতা করিয়া পিতাকে প্রতারণা করিতে লাগিলেন এবং অন্তঃপুরের আমোদ প্রমোদে মনের তৃপ্তি অন্বেষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এখন তাঁহার পৌত্রপৌত্রী হইয়াছিল, তথাপি বাদশাহ তাঁহাকে ভীরুতার অপবাদ দিয়া উপহাস করিতে ক্ষান্ত হইতেন না।
শাহ্ আলম অপদস্থ হওয়ায় মুহম্মদ আজমের সুযোগ উপস্থিত হইল। মাতৃকুল হইতে তাঁহার শরীরে পারস্য-রাজশোণিত প্রবাহিত আছে বলিয়া এই রাজকুমার সর্ব্বদা গর্ব্ব অনুভব করিতেন কারণ তাঁহার মাতা সফভি বংশের এক কনিষ্ঠ শাখা হইতে উদ্ভুত। ইহার অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতা অত্যন্ত অধিক ছিল। এমন ভয়ানক পিতার সমক্ষেও তাঁহার বাক্যে বা ক্রোধের সময়ে কার্য্যে কোনরূপ সংযম থাকিত না। তিনি ক্রুদ্ধ হইলে কুস্তিগিরের ন্যায় জামার আস্তিন গুটাইতেন। আওরংজীব তাঁহার প্রতি তাঁহার পত্নী (দারাশুকোর কন্যা) জাহাঞ্জেব বানুর প্রতি এবং ইঁহাদের পুত্র, পিতামহের বৃদ্ধ বয়সের প্রিয়পাত্র, সাহসী ও সুদক্ষ সেনাপতি বিদার বতের প্রতি যে অনুগ্রহ ও স্নেহ প্রদর্শন করিতেন, তাহাতে রাজকুমারের গর্ব্ব অধিকতর বর্দ্ধিত হইতে লাগিল।
কথিত আছে যে, ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদের তদানীন্তন শাসনকৰ্ত্তা মীর খাঁ রাজপুত্র মুহম্মদ আজম শাহের ‘কার্য্যে সহানুভূতি দেখাইয়া তাঁহাকে স্বাধীনতার জন্য ষড়যন্ত্রে উৎসাহিত করিয়াছিলেন। সম্রাট এই সংবাদে বলিয়া উঠিলেন, “এই নীচ চড়ুইপাখীটির উর্দ্ধে ভ্রমণকারী বাজপক্ষীর শক্তি নাই।” কিন্তু পাছে সামান্য উৎপাতও করে, সম্রাট এই আশঙ্কায় মীর খাঁকে পদচ্যুত করিয়া তাহার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিলেন।’ (১৬৭১ খ্রি: আগস্ট) রাজকীয় বিবরণে এই ঘটনার কোন উল্লেখ নাই। কেবল উল্লিখিত হইয়াছে যে, রাজপুত্র প্রতিনিধি দ্বারা যে সম্ভল প্রদেশ শাসন করিতেন তাহার ফৌজদারী পদ হইতে তাঁহাকে অপসারিত করা হয় (অক্টোবর ১৬৭০ খ্রি:)। কিন্তু দণ্ডপ্রদানের উদ্দেশ্যে এরূপ করা হইয়াছিল অথবা কর্ম্মচরীগণের পদ পরিবর্তনের জন্য এরূপ হইয়াছিল, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। আজম ‘বন্দীরূপে প্রাসাদে পূর্ণ একবৎসর আবদ্ধ ছিলেন ও তিনি মদ্যপান করিতে পান নাই’-মানুষীর এই কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নহে। আর যদিও ইহা সত্য হয় তথাপি এ দণ্ড কোন অভিপ্রেত বিদ্রোহের শাস্তি স্বরূপ হইতে পারে না কারণ ১৬৬৯ খ্রি: জানুয়ারী মাসে দারার কন্যার সহিত বিবাহের পূর্ব্বে এ কারাদণ্ড প্রদত্ত হইয়াছিল, এরূপ মানুষী লিখিয়াছেন।
আওরংজীবের পুত্রগণের মধ্যে একমাত্র মুহম্মদ আজমই কারাদণ্ড ভোগ করেন নাই। পরন্তু তিনি আজীবন সম্রাটের বিশেষ অনুগ্রহভাজন হইয়াছিলেন। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্যে অত্যল্প সময়ে বাঙ্গলা হইতে আজমীরে পৌঁছিয়া, পুনরায় ১৬৮৩ খৃষ্টাব্দের বর্ষাকালে পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হইয়া (১৬৮৫ খ্রি:) বিজাপুর অবরোধ কালে দুর্ভিক্ষ ও বিপদ সত্ত্বেও সৈন্যগণকে উত্তেজক বক্তৃতা প্রদান করিয়া তিনি আওরংজীবের হৃদয় অধিকার করিয়া লইয়াছিলেন। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে আজম সাংঘাতিক পীড়িত হইয়া পড়েন। আওরংজীব স্বয়ং তাঁহার শুশ্রূষা করিয়াছিলেন। তিনি সম্রাটের অত্যধিক প্রিয়পাত্র হইয়া উঠেন বহু প্রদেশে শাসনকর্তার পদ পূর্ণ করিবার পরে মুহম্মদ আজম শাহি আলিজা’ উপাধিতে ভূষিত হইলেন এবং দাক্ষিণাত্যে শাহ্ আলমের ন্যায় একদল সৈন্যের স্বাধীন কর্তৃত্ব প্রাপ্ত হইলেন। শাহ্ আলমের বন্দীত্বকালে প্রকাশ্য উপাসনার স্থানে ও দরবারগৃহে আজম সম্রাটের দক্ষিণ পার্শ্বে উত্তরাধিকারীর স্থান গ্রহণ করিতেন।
১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে ঈদুলফিতর পর্ব্ব দিবসে শাহ্ আলম মুক্তিলাভ করিলে যখন সম্রাট পুত্রগণ সমভিব্যাহারে বিজাপুরের প্রধান মসজিদে উপাসনা করিতে গেলেন তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে স্থান লইয়া অদ্ভুত বিবাদ আরম্ভ হইল। রাজকীয় ইতিহাসে ইহার এইরূপ বিবরণ লিখিত আছে:
‘জ্যেষ্ঠপুত্র সর্ব্বদাই সম্রাটের দক্ষিণপার্শ্বে উপবেশন করেন, তজ্জন্য শাহ্ আলম অপদস্থ হইলে আজম সেই সম্মানের স্থান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এক্ষণে শাহ্ আলম সম্রাটকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঈদের দিনে আমার ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে সম্রাটের কি আজ্ঞা হয়?” আওরংজীব উত্তর করিলেন, “আমার অনুচরগণের পূর্ব্বেই তুমি ঈদ্গায় (ঈদের সময় নমাজ পড়িবার স্থানে) গিয়া আমার দক্ষিণ পার্শ্বে স্থান গ্রহণ করিবে।” শাহ্ আলম তাহাই করিলেন। ম্রাটের অনুচরগণ সোপানে আরোহণ করিবামাত্র শাহ্ আলম অগ্রসর হইয়া সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার পদচুম্বন করিলেন। সম্রাট তাঁহার সহিত করকম্পন করিয়া তাঁহার বামকর স্বীয় দক্ষিণ হস্তে ধারণ পূর্ব্বক মসজিদে প্রবেশ করিলেন। এইরূপে জ্যেষ্ঠ রাজকুমার সম্রাটের দক্ষিণ পার্শ্বে অত্যন্ত নিকটে উপবেশন করিলেন শাহি আলিজা (অর্থাৎ আজম) পশ্চাতে আসিয়া সম্রাটের সম্মুখে ভূমির উপরে স্বীয় তরবারি স্থাপন করিলেন এবং তিনি স্বয়ং যাহাতে সম্রাটের দক্ষিণ পার্শ্বে উপবেশন করিতে পারেন তজ্জন্য স্থানত্যাগ করিবার ইঙ্গিত স্বরূপ জ্যেষ্ঠভ্রাতার বাহুস্পর্শ করিলেন। সম্রাটের দৃষ্টি এই ব্যাপারে পতিত হইলে তিনি দক্ষিণ হস্তে আলিজার পরিচ্ছদপ্রাপ্ত ধারণ করিয়া তাহাকে নিজের বাম পার্শ্বে আকর্ষণ করিলেন। উপাসনা সাঙ্গ হইলে যখন সম্রাটের উপাধি ঘোষণা করিবার নিমিত্ত খাতিব বেদীর উপর আরোহণ করিল তখন সম্রাট আলিজাকে হস্তে ধারণ করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক দ্বিতীয় দ্বারপথে বহির্গত হইলেন এবং জ্যেষ্ঠ রাজকুমারকে নিজ পুত্রগণ সঙ্গে তৃতীয় দ্বার পথে নিষ্ক্রান্ত হইবার জন্য ইঙ্গিত করিলেন।” দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ভ্রাতার সশস্ত্র অনুচরগণের মধ্যে বিবাদ নিবারণের জন্যই এই সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছিল।
খাফি খাঁ এ সম্বন্ধে এক কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন যে, ১৬৯২ কিম্বা ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ্ আলমকে মুক্তি প্রদান করা হইবে সম্রাটের এইরূপ সংকল্পের বিষয় অবগত হইয়া, আজম প্রকাশ্যে ক্রোধ ও নৈরাশ্য প্রদর্শন করিয়াছিলেন। তৎক্ষণাৎ রাজশিবিরে জনরব রটিয়া গেল যে রাজকুমার তাঁহার পিতাকে আক্রমণ করিয়া স্বয়ং স্বাধীনতা অবলম্বন করিবেন; আর আজমের সৈন্যদলের মধ্যে কতকগুলি নির্ব্বোধ লোকের বিশ্বাস জন্মিল যে সম্রাটও মনে মনে আজমের বিরুদ্ধে শত্রুভাব পোষণ করিতেছেন। কিন্তু আওরংজীব এক কৌশল অবলম্বন করিলেন। আজম ও তাহার পুত্রগণকে নির্জ্জনস্থানে সাক্ষাতের জন্য আহ্বান করিয়া, ভান করিতে লাগিলেন যেন নিজেকে তিনি আজমের হস্তে সম্পূর্ণরূপে অর্পণ করিয়াছেন। পুত্রকে বিদায় দিবার সময় ইঙ্গিতে তাহাকে জানাইলেন, তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতার যে শাস্তি হইয়াছিল, আজম যে সে শাস্তি হইতে অব্যহতি পাইল, ইহাই তাহার পরম সৌভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করা উচিত। ইতিমধ্যে আজমের পত্নী ও অন্তঃপুরিকাগণ ভাবিয়াছিলেন যে নিশ্চয়ই সম্রাট কর্তৃক কৌশলে তিনি কারারুদ্ধ হইয়াছেন। তাঁহার আশা ত্যাগ করিয়া অন্তঃপুরে তাই ক্রন্দনের রোল উঠিয়াছিল। আজমের পক্ষে এই শিক্ষাই যথেষ্ট। ইহার পর হইতে পিতৃপ্রেরিত যে পত্রের বিষয় তাঁহার রাজসভার প্রতিনিধি পূৰ্ব্বাহ্নে তাঁহাকে অবগত করায় নাই এরূপ পত্র খুলিবার পূর্ব্বে তিনি ভয়ে ম্লান হইতেন ও তাঁহার হস্ত কম্পিত হইত। তিনি কখনই বিদ্রোহী হন নাই। ঈশ্বরদাস বলেন, তিনি দিলির খাঁর সহিত আজম রাজবিদ্বেষের ষড়যন্ত্র করিতেছেন সম্রাটের এই মিথ্যা সন্দেহ প্রকাশে ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে আজম যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন এমন কি পুত্রের এই মনোবেদনা দূর করিবার জন্য সম্রাট তাহাকে অনেক করিয়া সান্ত্বনা প্রদান করিয়াছিলেন।
আওরংজীবের প্রিয়পুত্র মুহম্মদ আকবরই প্রকাশ্যে তাঁহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। এই রাজপুত্র যখন এক মাসের শিশু, তখনই তাঁহার জননী দিলরবানুর মৃত্যু হইয়াছিল; সেইজন্য স্বভাবতই রাজকুমার তাঁহার পিতা ও সমস্ত রাজপরিবার কর্তৃক অত্যধিক আদরে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। বিশেষতঃ তাঁহার জ্যেষ্ঠা সহোদরা জেব্উন্নিসা তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন এবং ভবিষ্যতে কখনও উত্তরাধিকারিত্ব লইয়া সম্রাটের পুত্রগণের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হইলে তিনি আকবরের পক্ষাবলম্বন করিবেন বলিয়া প্রস্তুত ছিলেন। মুহম্মদ আকবরের পঞ্চদশ বর্ষ বয়ঃক্রম পূর্ণ হইবার পূর্ব্বে দারাশুকোর পৌত্রীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয় এবং চারিবৎসর পরে তিনি প্রথমে শাসনকর্তার পদ প্রাপ্ত হন। ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে রাজপুত যুদ্ধে অগ্রগামী সৈন্যদলের কর্তৃত্ব লইয়া সম্রাটের সহিত তিনি সেই দেশে গমন করিয়াছিলেন এবং পর বৎসরে একটি সম্পূর্ণ সৈন্যদল তাঁহার কর্তৃত্বাধীনে ছিল। তৎপরে অসৎ পরামর্শদাতাদিগের মন্ত্রণায় আপনাকে সম্রাট বলিয়া ঘোষণা করিলেন, মুসলমান ধর্ম্মলঙ্ঘনকারী বলিয়া পিতাকে রাজ্যচ্যুত করিবার আদেশ প্রচার করিলেন এবং তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য অগ্রসর হইলেন (জানুয়ারী ১৬৮১ খ্রিঃ)। কিন্তু তাঁহার চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইল এবং এই হতভাগ্য রাজকুমার সিংহাসনের দাবি ছাড়িয়া মারাঠারাজ শম্ভুজীর শরণাপন্ন হইবার জন্য পলায়ন করিলেন। অবশেষে বহু কষ্টভোগ করিবার পর পারস্য রাজসভায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহার ভ্রাতৃগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য পারস্যরাজ সৈন্য ও অর্থ দিতে চাহিলেন কিন্তু তাঁহার পিতা আওরংজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। আকবর আর কি করিবেন? তিনি পারস্যরাজ্যের পূর্ব্বপ্রান্তে অবস্থান করিয়া পিতার আশু মরণ কামনা করিতে করিতে নিজের হৃদয়খানিই অবসন্ন করিতে লাগিলেন। আওরংজীব ইহা শ্রবণ করিয়া ঈষদ্ধাস্য পূৰ্ব্বক কহিলেন, “আচ্ছা দেখা যাউক কাহার অগ্রে মরণ হয়।” তৎপরে নিম্নলিখিত চৌপদী আবৃত্তি করিলেন!-
কুম্ভকারের সেই কথা আমি নাহি পারি ভুলিবারে,
গড়ি ভঙ্গুর চীনার পেয়ালা কহিয়াছিল সে তারে–
‘নাহি জানি আমি, নিয়তির ছোঁড়া ঢেলা লাগি
তোমার আমার মাঝে কেবা যাবে আগে ভাঙ্গি।’
কার্য্যত নিজ জন্মদাতার পূর্ব্বেই আকবরের মৃত্যু হয়। কিন্তু যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি তাঁহার পিতার ও আফগানিস্তানের শাসনকর্তা তাঁহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা শাহ্ আলমের ভয়ের কারণ হইয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া আওরংজীব বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “আঃ বাঁচিলাম, ভারতবর্ষের প্রধান শান্তিভঙ্গকারী গেল।”
দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির অধঃপতনের পূর্ব্বে আওরংজীবের কনিষ্ঠপুত্র মুহম্মদ কামবখস (জন্ম ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৬৬৭ খ্রিঃ) ভারতের ইতিহাসে কোনো কার্য্যই করেন নাই। কিন্তু তিনিও তাঁহার দুর্ব্যবহারের জন্য কিছুকাল আবদ্ধাবস্থায় ছিলেন (ডিসেম্বর ১৬৯৮-জুন ১৬৯৯)।
সম্রাটের জ্যেষ্ঠা কন্যা জেব্উন্নিসা একজন প্রতিভাশালিনী কবি ছিলেন এবং সাহিত্যিকদিগকে উৎসাহ দিতেন। তিনি অন্তঃপুরে পারসীক শিক্ষয়িত্রীগণ কর্তৃক শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি কোরান কণ্ঠ করিয়াছিলেন এবং ‘মফী’ (অর্থাৎ গুপ্তব্যক্তি) এই ছদ্মনামে একখণ্ড কবিতাপুস্তক লিখিয়াছিলেন। তাঁহার পিতার রাজসভার জনৈক ওমরাহ্ আকিল খাঁর সহিত তাঁহার অবৈধ প্রণয় ছিল এইরূপ একটা কলঙ্ককর কাহিনী ঊনবিংশ শতাব্দীর উর্দুলেখকগণের কল্পনাবলে উদ্ভাবিত হইয়াছিল। কিন্তু এই সকল লেখকের কাহিনী প্রধান প্রধান বিষয়ে প্রকৃত ইতিহাসের সহিত অসঙ্গত।’
জেব্উন্নিসা তাঁহার কনিষ্ঠ সহোদর মুহম্মদ আকবরের পক্ষাবলম্বিনী ছিলেন এবং তাঁহার বিদ্রোহের পূর্ব্বক্ষণে গোপনে তাঁহার সহিত পত্রব্যবহার করিতেন। বিদ্রোহ বিফল হইলে আকবরের পরিত্যক্ত শিবির যখন সম্রাট সৈন্যের অধিকারে আসিল, জেব্উন্নিসার লিখিত পত্রগুলিও ধরা পড়িল। আকবর পলায়ন করিয়া শাস্তি হইতে নিষ্কৃতি পাইল বলিয়া পিতার সমস্ত ক্রোধ জেব্উন্নিসার শিরে পতিত হইল। তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি ও বাৎসরিক ৪ লক্ষ টাকার বৃত্তি বাজেয়াপ্ত হইল এবং তিনি চিরজীবনের জন্য সলিমগড়ে বন্দিনী হইলেন (১৬৮১-১৭০২ খ্রি:)। সম্রাট স্বয়ং যখন সমাধির প্রান্তে উপস্থিত প্রায় তখন দিল্লীতে কন্যার মৃত্যুসংবাদে অশ্রুপাত করিয়া তাঁহার আত্মার কল্যাণ-কামনায় দরিদ্রদিগকে ভিক্ষাদান করিতে আদেশ দিলেন।
আওরংজীবের আর এক কন্যা শাহজাদী জিনতুন্নিসা চির কৌমার্য্য অবলম্বন করিয়াছিলেন। কথিত আছে তিনি পিতার নিকট যৌতুক চাহিয়া লইয়া সেই টাকা দিয়া দিল্লীতে একটি সুন্দর মসজিদ নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। বহুদিন যাবৎ ইহা ‘কুমারী মসজিদ’ নামে পরিচিত ছিল। তিনি তাঁহার পিতার সেবা শুশ্রূষা কাৰ্য্যে আপনাকে নিয়োজিত করিলেন। রাজত্বের শেষার্দ্ধে সম্রাট যখন দাক্ষিণাত্যে অবস্থিতি করিতেছিলেন, তিনিই সে সময়ে রাজান্তঃপুরের কর্ত্রী ছিলেন। তিনি পিতৃসেবায় জাহানারা অপেক্ষা অল্প যশস্বিনী হইলেও তাঁহার অপেক্ষা অধিকতর সুখী ছিলেন I
শাহ্তাদীগণ আমরণ কুমারী থাকিবেন, ইহার মুঘল রাজরীতি ছিল। কোন মুসলমান ফকিরের অনুরোধে এবং মুসলমান ধর্ম্ম-প্রবর্ত্তকের দৃষ্টান্তে আওরংজীব রীতি পরিহার করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহার দুই কন্যা মিন্নিসা ও জুব্দতুন্নিসার বিবাহ দিয়াছিলেন। অপর এক কন্যা (বন্নিসা) বোধ হয় সুযোগ্য পাত্র পাইবার পূর্ব্বেই দ্বাবিংশবর্ষ বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
সম্রাটের জ্যেষ্ঠা ভগিনী জাহানারা দারাশুকোর পক্ষাবলম্বিনী এবং শাহজাহানের ন্যায্য অধিকারের সহায়ক ছিলেন। তিনি ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে আওরংজীব ও মুরাদকে ভ্রাতায় ভ্রাতায় যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করিবার জন্য বহু চেষ্টা করিয়াছিলেন। স্বয়ং তাঁহাদের আগ্রার জয়স্কন্ধাবারে সন্ধির প্রস্তাব সহ উপস্থিত হইয়াছিলেন, এবং এরূপ প্রস্তাব গ্রহণে তাঁহারা অস্বীকৃত হইলে, অস্বাভাবিক ব্যবহারের জন্য তাঁহাদিগকে কঠোর তিরস্কার করিয়াছিলেন। অবশেষে বিজেতার পক্ষাবলম্বন করিয়া স্বাধীনতা ও অর্থলাভ অপেক্ষা পিতার চিরজীবনের বন্দীত্বের অংশভাগী হওয়াই তিনি শ্রেয়স্কর মনে করিলেন। কিন্তু পরে, লোভীর যাহা স্বপ্নেরও অগোচর, স্বীয় সাধুচরিত্রের গুণে তিনি সেই পুরস্কারও লাভ করিয়াছিলেন। তিনি অন্ধকারময় দীর্ঘ কারাজীবনের মধ্যে আওরংজীবকে ক্ষমা করিবার জন্য তিন এই তিনবার শাহজাহানকে মিনতি করিয়াছিলেন।ক্রুদ্ধ পিতা দুইবার অস্বীকার করেন। কিন্তু অবশেষে জাহানারার দয়ার জয় হইল এবং শাহজাহান মৃত্যুর কিয়ৎকাল পূর্ব্বে আওরংজীব রাজা ও পিতার প্রতি যে অসদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন তাহার জন্য তাঁহাকে ক্ষমা পত্র লিখিয়া দেন।
শাজাহানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে (ফেব্রুয়ারী ১৬৬৬ খ্রি:) আওরং জীব আগ্রায় গমন করিয়া পুনঃ পুনঃ জাহানারার সহিত সাক্ষাৎ করেন, তাঁহার প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করেন এবং অবশেষে তাঁহাকে সাম্রাজ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহিলার গৌরব প্রদান করিয়াছিলেন। সমস্ত ওমরাহ্ দিগকে আদেশ দেওয়া হইল যে তাঁহারা আগ্রাদুর্গে তাঁহার মহলে যাইয়া বাহির হইতে তাঁহাকে সালাম করিবেন ও নজর দিবেন এবং খোঁজারা অন্তপুরে লুক্কাইত রাজভগিনীর নিকট ঐ অভিব- াদন ও নজর উপস্থিত করিবে। পরবর্ত্তী অভিষেকবাসরে (২৭শে মার্চ) জাহান- ারা এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (১৪ লক্ষ টাকা) নজর পাইয়াছিলেন এবং তাঁহার বাস- রিক বৃত্তি বর্দ্ধিত করিয়া ১৭ লক্ষ টাকা করা হইয়াছিল। এইরূপ সম্মান তাঁহাকে আজীবন প্রদর্শিত হইয়াছিল। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি আগ্রা পরিত্যাগ করিয়া দিল্লীতে গেলে আলি মদনের বৃহৎ অট্টালিকা তাঁহার সহিত দীর্ঘকাল কথোপকথন করিতেন। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে উচ্চ রাজকর্মচারী দানিশমন্দ খাঁকে আদেশ দেন যে তিনি যেন জাহানারার দেউড়িতে দণ্ডায়মান হইয়া তাঁহাকে বলিয়া পাঠান, “আপনি যে আজ্ঞা করিবেন তাহা প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত আমি উপস্থিত আছি।” তাঁহার এই গৃহেই তাঁহার বিশেষ স্নেহভাজন এবং পালিতা কন্যা (দারার পিতৃমাতৃহীন সন্তান ) জাহাজেব বানুর সহিত আওরংজীবের তৃতীয় পুত্র মুহম্মদ আজমের ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে অত্যন্ত ধুমধামের সহিত বিবাহ হয়। মুরাদের কন্যাগণও এই গৃহে আশ্রয় পাইয়াছিল ও জাহানারাই তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয়। আর হতভাগ্য সুলেমান শুকোর কন্যা সালিমা বানু, সম্রাটের অপর এক ভগিনী গৌহরারা বেগম কর্তৃক প্রতিপালিতা হন এবং কালক্রমে মুহম্মদ আকবরের সহিত তাঁহার বিবাহ হয়।
বস্তুত মুঘলদিগের সময়ে নূরজাহান ও মুমতাজ মহল ব্যতিরেকে অন্য কোন বাদশাহপত্নী রাজ্যমধ্যে প্রধান মহিলারূপে পরিগণিত হইতেন না। বাদশাহদিগের জননী বা ভগিনীই রাজ্যের মহিলাদিগের মধ্যে প্রধান স্থান অধিকার করিতেন। ভারতীয় রীতিতে পত্নী গৃহিণী না হইয়া বিধবা জননী বা অন্য কোন প্রবীণ আত্মীয়াই গৃহের কর্ত্রী হইয়া থাকেন। অন্তঃপুরের সাধারণ কার্য্যের তত্ত্বাবধান, পরিবারের বিবাহ ও অন্যান্য পর্ব্বানুষ্ঠান ও রাজধানীর মহিলা-সমাজের উপর প্রভাব-বিস্তার-রূপ কার্য্য হইতে সম্রাজ্ঞী স্বাভাবিক লজ্জাবশতঃ নিবৃত্ত থাকিতেন। কিন্তু তাঁহার স্বামীর মৃত্যু হইবামাত্র তিনি বিধবার মর্য্যাদা ও রাণীমাতার প্রভাব প্রাপ্ত হইতেন। কোন অল্পবয়স্কা সুন্দরী প্রতিযোগিনী আসিয়া তাঁহাকে স্বামীর প্রদত্ত মর্য্যাদা কিম্বা সম্মান ও প্রভাবের পদ হইতে বঞ্চিত করিবেন এ ভয় আর তখন থাকিত না। সামাজিক শিষ্টাচার বশত সম্রাটও তাঁহার পত্নীকে, স্বীয় জননী ভগিনী কিম্বা পিতৃস্বসার উপরে সম্মানের স্থান দিতে পারিতেন না। এই জন্য দিল্লীর প্রাসাদের মহিলাসমাজে মৃত বাদশাহের পত্নী কিম্বা প্রবীণা কুমারীগণই কর্ত্রী হইতেন।
শাহজাহান সিংহাসনারোহণ করিলে তাঁহার পরম শত্রু ও প্রতিযোগী শারিয়ারের সহায়ক বলিয়া নূরজাহানকে সামান্য অবস্থায় কালযাপন করিতে বাধ্য হইতে হইল। সম্রাটপত্নী মুমতাজ মহল কেবল চারিবৎ-সরকাল রাজসিংহাসনের অংশভাগিনী হইয়া জীবিত ছিলেন। তৎপরে জ্যেষ্ঠা শাহজাদী জাহানারা ২৭ বৎসরকাল তাঁহার পিতার গৃহস্থালীর তত্ত্বাবধান করিয়াছিলেন। তিনি বেগম সাহেব বা পাদশাহ্ বেগম নামে অভিহিত হইতেন। শাজাহানের কারাবাসের সময় তাঁহার শুশ্রূষাকারিণীরূপে তিনি ৮ বৎসরকাল নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু শাহজাহানের মৃত্যু হইলে তিনি যখন নিৰ্জ্জনতা ত্যাগ করিয়া বাহির হইলেন তখন আওরংজীব তাঁহাকে রাজগৃহের প্রধান মহিলার পদ পুনঃপ্রদান করিলেন। ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁহার মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত তিনি এই সম্মান ভোগ করিয়াছিলেন। যখন অন্য কেহই সাহস করিত না তখন তিনিই বয়স ও পদমর্যাদার গুণে আওরংজীবকে অপ্রিয় কিন্তু সৎ উপদেশ প্রদান করিতেন। তাঁহার মৃত্যুতে সম্রাট তিন দিবসকাল বিলাপ করিয়া আদেশ দিলেন যে, ভবিষ্যতে রাজকীয় বিবরণে তাঁহার নাম ‘সাহিবৎ উজ্জমানি’ (যুগরাণী) বলিয়া উল্লিখিত হইবে।
তাঁহার কনিষ্ঠা ভগিনী রৌশনারা বেগম সিংহাসন লইয়া যুদ্ধের সময়ে আওরংজীবের যথার্থই সহায়ক ছিলেন এবং আগ্রার অন্তঃপুরে থাকিয়া আওরংজীবের প্রতিদ্বন্দ্বিগণকে পরাভূত করিবার জন্য অব্যর্থ ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন। আওরংজীবের বিজয়ের দিন যথার্থই রৌশনারার আনন্দ প্রকাশের দিন হইল। তাঁহার অভিষেক দিবসে (জুন ১৬৫৯) রৌশনারা ৫ লক্ষ মুদ্রা উপহার পাইলেন। এত অধিক অর্থ আওরংজীব তাঁহার কোন কন্যাকেই প্রদান করেন নাই। তাঁহাদের পিতার মৃত্যু হইলে রাজগৃহে তাঁহার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর পুনরাগমন পর্য্যন্ত তিনি ভ্রাতার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার সন্তান ও পত্নীগণের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন। তৎপরে রৌশনারা সম্বন্ধে আমরা কিছুইজানিতে পারি না। সম্ভবত তিনি সামান্য অবস্থায় ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে ৫৬ বৎসর বয়সে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
আওরংজীবের পীড়ার সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় (মে ১৬৬২) যাহাতে একদল ওমরাহকে শিশু রাজকুমার আজমের সিংহাসনারোহণের পক্ষাবলম্বী করিতে পারেন তজ্জন্য তিনি তাঁহার নিকট রক্ষিত রাজকীয় পাঞ্জার (মুদ্রার) অপব্যবহার করিয়াছিলেন। তাহাতে জনসাধারণও আশঙ্কিত হইয়াছিল। ইতোমধ্যে দিল্লীনগরীর বিশৃঙ্খল অবস্থা ভয়ানক হইয়া উঠিল। এই সকল গোলমালের মূলকারণ রৌশনারা বেগম। স্বীয় দলের এক খোঁজা ব্যতিরেকে তিনি অন্য কাহাকেও পীড়িত আওরংজীবকে দেখিতে দিতেন না।’ আওরংজীব আরোগ্যলাভ করিলে, ‘সুলতান আজমকে সাহায্য করিবার জন্য স্বপক্ষ অবলম্বন করিতে রাজপ্রতিনিধি, শাসনকর্তা ও সেনাপতিদিগকে রৌশনারা পত্র লিখিয়াছিলেন এবং সেসব পত্র রাজকীয় মুদ্রায় মুদ্রাঙ্কিত করিয়াছিলেন জানিতে পারিয়া আওরংজীব রৌশনারার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হন। তিনি তাঁহার ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হওয়ায় রৌশনারা ভ্রাতৃস্নেহ হারাইলেন।
“রৌশনারার ভ্রষ্টাচারে আওরংজীব ক্রুদ্ধ হইয়া বিষ প্রয়োগে তাহার মৃত্যু ঘটান এবং তিনি ‘পিপার ন্যায় ফুলিয়া’ প্রাণত্যাগ করেন,”-প্রাসাদের একজন সঙ্কর জাতীয়া পর্তুগীজ বাঁদীর সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া মানুসী কর্তৃক বর্ণিত এই কলঙ্ককর জনরবের প্রকৃত ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। ইহা সম্ভবত এই ইটালীবাসী যুবকের আশু প্রত্যয়ের উদাহরণ। রৌশনারা রাজকীয় ইতিহাসে সচ্চরিত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন,- ‘তাঁহার মহৎ ও প্রশংসনীয় গুণ ছিল এবং তিনি সম্রাটকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। (তাঁহার মৃত্যুতে) সম্রাট তাঁহার আত্মার সদ্গতির নিমিত্ত দরিদ্রের মধ্যে বহু অর্থ বিতরণ করেন এবং তাঁহার দাসদাসীদের সহিত সদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন।’
ইতিহাসে আওরংজীবের অপর ভগিনীদিগের কোন প্রভাব লক্ষিত হয় না। তাঁহারা প্রাসাদে বসিয়া শান্তভাবে বৃত্তিভোগ করিতেন মাত্র।
আওরংজীব স্বীয় পরিবার ও তাঁহার হতভাগ্য ভ্রাতৃপরিবারের মধ্যে অনেকগুলি বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদ সুলতান শুজার কন্যা গুরুখ্ বানুকে এবং ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে মুরাদ বশের কন্যা দপ্তদার বানুকে বিবাহ করেন। তাঁহার অপর পুত্রদিগের মধ্যে মুহম্মদ আজম ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে দারার কন্যা জাহাঞ্জেব বানুকে এবং মুহম্মদ আকবর ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে সুলেমান শুকোর কন্যা সালিমা বানুকে বিবাহ করেন। সম্রাটের দুই কন্যা মিরুন্নিসা ও জুব্দতুন্নিসা যথাক্রমে মুরাদের পুত্র ইজাদ বখ্শ ও দারার পুত্র সিপি শুকোর সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (১৬৭২ ও ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দ) আওরংজীবের রাজত্বের শেষভাগে পলায়িত আকবরের দুই কন্যা শাহ্ আলমের দুই পুত্রের সহিত বিবাহিত হন (১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে)। এইরূপে দেখিতে পাওয়া যায় আওরংজীব হইতে তৃতীয় পুরুষে আওরং জীবের শোণিত তাঁহার মৃত ভ্রাতৃগণের শোণিতের সহিত জটিলভাবে মিশ্রিত হইয়া গেল।
[মানসী ও মর্ম্মবাণী, ৮ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, ৩য় সংখ্যা, বৈশাখ, ১৩23/
১। মডার্ণ রিভিউ, জানুয়ারি ১৯১৬, ৩৩-৩৬ পৃষ্ঠায় এই বিষয় আলোচনা করিয়া সাক্ষ্যদ্বারা আমি ইহার ভ্রম দেখাইয়া দিয়াছি।-যদুনাথ সরকার।