আওকিগাহারা
পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে রহস্যময়, সবচেয়ে দুর্গম জায়গা কোথায়? এর উত্তর গুগল কিম্বা উইকিপিডিয়ায় পাবেন না৷ আমিও দীর্ঘদিন এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি৷ কিছুদিন আগে, হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত ব্যাপার শুনলাম৷
জাপানে নাকি একটা জঙ্গল আছে৷ ইংরেজিতে নাম, Sea of Trees; জাপানিজে—আওকিগাহারা৷ এখানে নাকি প্রতিবছর কমপক্ষে প্রায় একশো মানুষ, গাছের ডাল থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করে৷ দিন-দিন এই সংখ্যাটা এমন বাড়ছে, যে জঙ্গল জুড়ে পুলিশি প্রহরা বসেছে; লাগানো হয়েছে সি-সি-টিভি ক্যামেরা৷ তাও, কোনও ফল হয়নি৷ গতবছরে ২৫৭ জন মানুষ এখানে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন৷
ভয়ঙ্কর, রহস্যময়, দুর্গম—অবশ্যই৷ কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর, আওকিগাহারা নয়৷ চলুন, গল্প শুরু করা যাক৷ যদি গল্পটা মন দিয়ে পড়েন—শেষে উত্তর, নিশ্চয় পাবেন৷
একটা আকাসিয়া গাছের নীচে শরীর এলিয়ে আমি বসে পড়লাম৷ চারপাশে যতদূর দেখা যায় শুধু খয়েরি আর সবুজ রং—এই ঘন সবুজ অন্ধকার ছাড়া এ জীবনে আর কিছু হয়তো দেখতে পাব না৷ উপরে তাকিয়ে আকাশের একটা ছোট অংশও দেখতে পেলাম না৷ একটু পরে জঙ্গল জুড়ে অন্ধকার নামবে৷ আমি হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম—সাড়ে পাঁচটা বাজে৷ সামনে সার বাঁধা দৈত্যর মতো দাঁড়িয়ে আছে একটা জেমন্সুগি গাছ৷ তার সারা গা জুড়ে সাপের মতো লতানো গাছের ঝাঁক উঠেছে, প্রথমে কাণ্ডে, তারপর ডালপালার প্রায় সবটাই ঢাকা পড়েছে সর্পিল গাছের চাদরে৷ আমার ঠিক সামনের গাছটার একটা নীচু ডাল থেকে ঝুলছে আমার দুই সঙ্গীর মৃতদেহ৷ না, দড়ি নয়! এ জঙ্গলে আমরা দড়ি নিয়ে ঢুকিনি৷ গাছেরই শক্ত দুটো গুল্মলতা কেটে নিয়ে আত্মহত্যা করেছে তারা৷ আমার চোখের সামনে তাদের নিষ্প্রাণ শরীর দুটো হাওয়ার স্রোতে একবার ডানদিকে ফিরছে একবার বাঁদিকে৷ শরীরে একটু জোর পেতে আমি পকেট থেকে একটা ছুরি বের করলাম৷ এ জঙ্গলে ঢোকার আগে এইটাই ছিল আমাদের নেওয়া একমাত্র অস্ত্র৷ কোনও পশুজন্তু সামনে পড়লে আত্মরক্ষার একমাত্র হাতিয়ার৷ কিন্তু আওকিগাহারার জঙ্গলে পশুপাখি প্রায় নেই৷ এখানে মৃত্যু আসে… সন্ধে নামার আগে খানিকটা সময় আছে, গল্পটা প্রথম থেকে বলা যাক৷
জাপানের রাজধানী টোকিও শহর থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ফুজিয়ামা৷ পাহাড়টা উচ্চতায় বেশ খানিকটা বড় হওয়ার জন্য চূড়ার কাছটা সারা বছরই বরফে ঢেকে থাকে৷ আস্তে-আস্তে নীচের দিকে নেমে এলে বরফ শেষ হয়ে হাল্কা গাছপালার আভাস চোখে পড়ে৷ সেই গাছের মিছিল ঘন হতে-হতে একদম নীচে নেমে এসে তৈরি করে চিরহরিৎ বৃক্ষের এক দুর্ভেদ্য রহস্যময় জঙ্গল— আওকিগাহারা৷ মাউন্ট ফুজিয়ামার কোল ঘেঁষে ৩৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে মৃত্যুময় বিভীষিকা৷ এই জঙ্গলে গাছপালা এত ঘন আর দুর্ভেদ্য যে ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালে বাইরের হাওয়া পর্যন্ত গায়ে এসে লাগে না৷ এখানে পাখির ডাক শুনতে পাওয়া সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়ার মতোই ভাগ্যের ব্যাপার৷ আমরা জঙ্গলে ঢোকার আগে আমাদের ট্রাভেল গাইড গাকুশি বলেছিল এ জঙ্গলের কয়েকটা জায়গাতে দুপুরবেলাতেও ঘন রাতের মতো নিকষ অন্ধকার জমে থাকে৷ ব্যাপারটা প্রথমে আমাদের বিশ্বাস হয়নি, পরে জঙ্গলে পথ চলতে-চলতে বুঝেছি এ আদিম অরণ্যের কিছু জায়গায় এখনও সূর্যের প্রথম আলো স্পর্শ করেনি৷
গাকুশি গাড়ি করে আমাদের সাথেই এসেছিল, কিন্তু সে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে চাইল না৷ স্থানীয় লোকেরা সাধারণত এদিকটা এড়িয়ে চলে; বাচ্চাদেরও আসতে দেওয়া হয় না৷ তবে জঙ্গলের বাইরের দিকটার ট্যুরিস্ট স্পট বলে নামডাক আছে৷ আমরা অবশ্য সেটা ছাড়িয়ে বেশ কিছটা ভিতরে যাব৷ অগত্যা গাকুশিকে রওনা হতে বলে আমরা জঙ্গলের দিকে এগোলাম৷ এখানে হারিয়ে যাবার ভয় তেমন নেই, মাত্র ৩৫ বর্গকিলোমিটারের জঙ্গল৷ সোজা হাঁটতে থাকলে কোথাও না কোথাও পৌঁছাব৷ পিঠের ব্যাগগুলোকে কাঁধে নিয়ে আমরা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে এলাম৷ সামনেই একটা পায়ে চলার পথ৷ তার দু-পাশে সবুজ লতাগুলোর ঝাঁক ক্রমশ গভীর হয়েছে৷ নীচে তাকালে নানারকম জিনিস চোখে পড়ে—খয়েরি হয়ে ঝরে যাওয়া পাতা, গাছের শুকনো ডাল, ট্যুরিস্টদের ফেলে যাওয়া খাবারের প্যাকেট, ছেঁড়া জামাকাপড়…
লাভা জমে তৈরি হয়েছে বলে এখানকার মাটি লাল৷ তার বেশিরভাগটাই ঢেকে আছে খসখসে পাতার চাদরে৷
‘এই তাহলে সুইসাইড ফরেস্ট?’ নিশি আমার পাশে হাঁটতে-হাঁটতে বলল৷
‘এখনও শুরু হয়নি৷ এটা যাকে বলে প্রিলিউড৷’ আমি চারপাশে তাকিয়ে উত্তর দিলাম৷
আমাদের থেকে বেশ কিছুটা পিছনে হাঁটছিল রিনা, নিশি তার দিকে ফিরে বলল, ‘বুঝলি রি, একটা দড়ি-টড়ি গোছের আনলে হত, ঝুলে পড়ার জন্য আদর্শ জায়গা৷’
নিশি পায়ের নীচে আসা একটা বিয়ারের ক্যানকে লাথি মেরে বলল, ‘ধুর, এত সুন্দর জঙ্গলে লোকে সুইসাইড করতে আসে কেন কে জানে৷’
একটা কারণ লোকে বলে বটে৷’ আমি বললাম৷
‘কী কারণ?’ নিশি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল৷
‘ধীরে বন্ধু, আগে ভিতরে গিয়ে পথ হারিয়ে নাজেহাল হই, তবে তো জমবে ভূতের গল্প৷’
খানিকটা চলার পর দু-পাশের গাছপালা আরও গভীর হয়ে এল, এখন আর বাইরের পৃথিবীটাকে দেখাই যাচ্ছে না৷ উপরে তাকালে নীল আকাশের খানিকটা দেখা যায়, একটু পরে সেটাও গাছের ডালপালায় ঢেকে যাবে৷ আমাদের সামনে পায়ে চলা রাস্তা শেষ হয়ে গিয়ে আসল জঙ্গল শুরু হয়েছে৷ সাধারণ ট্যুরিস্টদের বেশি এগোতে দেওয়া হয় না, একটা গাছের গুঁড়ির উপরে টিনের বোর্ডে ইংরেজিতে ভিতরে ঢুকতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে, আমি একটু এগিয়ে বোর্ডটার ওপাশে পা রেখে বললাম ‘‘abandon all hope ye who enters here.’’৷
রিনা ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে তা লেন্সবন্দি করতে লাগল, নিশি পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘জঙ্গলটা কী চুপচাপ লক্ষ করেছিস?’
রিনা হঠাৎ ক্যামেরা থেকে মুখ তুলে বলল, ‘সামনে কিছু একটা আছে, খালি চোখে দেখতে পাবি না, জুমিং করলে বুঝতে পারবি৷’
আমি তার হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে জুমের ফোকাসটা ঠিক করে দেখলাম সত্যি গাছপালার ফাঁক দিয়ে কিছু একটা যেন চোখে পড়ছে—একটা নীলচে কাপড়৷ বোধহয় কোনও অভিযাত্রী দলের ক্যাম্প৷ তবে বেশ খানিকটা দূরে৷
রিনা বলল, ‘লোকজন চোখে পড়ল?’
‘নাহ, তবে ট্যুরিস্ট যে নয় তা বুঝতে পারছি, ট্যুরিস্ট স্পট ওই সাইন বোর্ডটার আগে পর্যন্ত৷’
আমরা গাছগাছালির জাল ভেদ করে এগোতে লাগলাম; গভীর জঙ্গলের ভিতরে ঢোকার সাথে-সাথে বাতাসটাও যেন ক্রমাগত ভারী হয়ে উঠছে৷ কীরকম একটা বুনো গন্ধ, পায়ের তলায় খসখসে পাতার চাদরও পুরু হয়েছে, ট্যুরিস্টদের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রও আর সেরকম চোখে পড়ছে না৷ হঠাৎ কী একটা দেখতে পেয়ে নিশি দাঁড়িয়ে গেল৷ আমাদের পাশেই গাছের গা জড়িয়ে একটা বেগুনি ফিতে বাঁধা; ফিতের আর একটা প্রান্ত সোজা সামনে পথ ধরে এগিয়ে গেছে৷ আমি বললাম, ‘ওটা মার্কিং৷ এ জঙ্গলে ফেরার রাস্তা বের করা প্রায় অসম্ভব, তাই ওই ব্যবস্থা৷ ওটা ধরে হাঁটতে থাক, শেষে কিছু না কিছু পাবি৷’
‘আমরা তো মার্ক করলাম না৷’ রিনা বলল৷
নিশি পকেট থেকে জিপিএসটা বের করে তাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমরা প্রফেশনাল হাইকার, এইসব দেশি পদ্ধতি আমাদের জন্য না৷’
‘এ জঙ্গলের কোর এরিয়াতে যারা ঢোকে তাদের ফেরার উদ্দেশ্য সাধারণত থাকে না, তবু তাদের মধ্যে কারও-কারও সংশয় থাকলে সে ফেরার একমাত্র রাস্তা হিসেবে ওই ফিতের পথ ধরেই ফিরতে পারে, ওই দেখ…’
কথাটা বলে আমি ডান পাশের গাছের ঠিক নীচের অংশটা দেখালাম৷ সেখানে আর একটা বড়সড় সাবধানবাণী ঝোলানো আছে, তাতে জাপানি আর ইংরেজিতে যে বক্তব্য বলা আছে তার মর্মার্থ এই— আত্মহনন একটি ভয়ানক পাপ৷ এর শিকার হয় আপনার বাড়ির লোক ও প্রিয়জনেরা৷ দয়া করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আর কয়েকবার ভেবে দেখুন৷ নীচে একটা ফোন নং৷
‘এতে লাভ হয়েছে কিছু?’ নিশি জিজ্ঞেস করল৷
‘সম্ভবত না৷ আগের বছর সরকারি হিসেবে ২৫৭ জন এখানে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে, ভেবে দেখ, প্রতি তিনদিনে দু-জন এখানে আসে গাছে ঝুলতে৷’ আমি বললাম৷
আমরা সামনে এসে পড়েছিলাম৷ ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম দূর থেকে যে নীল কাপড়টা চোখে পড়েছিল সেটা আসলে একটা তাঁবুর অংশ, ফিতেটাও তাঁবুর কাছে এসেই শেষ হয়েছে৷ তার সামনে পোড়া কাঠের চিহ্ন দেখলাম৷ লোকজন কাউকে চোখে পড়ল না অথচ কিছুক্ষণ আগেও যে এখানে লোকজন ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়৷ নিশি বলল, ‘লোকটা কি সুইসাইড করতে গেছে নাকি?’
‘অথবা করে ফেলেছে৷’ আমি বললাম৷
রিনা ভয়ে-ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাল৷ বললাম, ‘চারপাশে খুঁজে দেখ তোরা, ঝুলন্ত বডিফডি পাস কি না৷ আমি এইখানটাতেই বসি৷’
রিনা ভয়-ভয় মুখে বলল, ‘অদ্ভুত জঙ্গল বটে! এসে থেকে একটা জীবজন্তুর ডাক শুনতে পেলাম না খুঁজতে যাচ্ছি কিনা ঝুলন্ত ডেড বডি! ওসবে আমি নেই৷ নিশি, তুই যা৷ আর হ্যাঁ, ক্যামেরাটা রেখে যা বাবা৷’
নিশি ব্যাগ আর ক্যামেরা রেখে চলে গেল৷ আমি তাঁবুটার ভিতরে ডঁzকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম৷ নাঃ, এর ভিতরে একটু আগেও মানুষ ছিল৷ খাবার-দাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ পড়ে আছে; কোণের দিকে কয়েকটা ছেঁড়া সাদা পাতাও চোখে পড়ল৷ সেগুলো আমি হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম৷ তাঁবুর ভিতরে আলো সেরকম নেই৷ মাথা নীচু করে কাগজগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম—বোধহয় ফাঁকা৷ ভিতরে আর কিছু নেই দেখে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ বেরোতেই থমকে দাঁড়ালাম৷ তাঁবুর ঠিক বাইরেটাতেই বসে ছিল রিনা, হাতে কী একটা যেন ধরে এক মনে সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ একটা এক হাত লম্বা দড়ি, ডগার দিকটায় ফাঁস লাগানো, যেন ফাঁসি হওয়ার পর আসামির গলা থেকে খুলে নেওয়া একটা ফাঁস৷ আমি তার কাঁধে একটা ধাক্কা দিয়ে বললাম ‘কোথায় পেলি এটা?’
সে হঠাৎ আমার দিকে চমকে তাকিয়ে বলল, ‘এ… এই তো… সামনেই পড়েছিল৷ অদ্ভুত না?’
‘হুম এখানে এসব জিনিস পড়ে থাকাটা আশ্চর্যের নয়…’ আমি তার পাশে বসে পড়লাম৷ ব্যাগ থেকে একটা প্রণ-সুসি বের করতে-করতে বললাম ‘জাপানের আদি পুরাণ অনুযায়ী যে ফাঁসির দড়ি একবার কোনও মানুষের গলার স্বাদ পেয়েছে সে নাকি নরখাদক বাঘের মতো ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে, আরও মানুষকে টেনে আনে গলায় পরার জন্য৷ ওটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করিস না৷’
রিনা ভয়ে-ভয়ে সেটা একপাশে রেখে দিল৷ জানি না কেন হঠাৎ আমার মনে হচ্ছে, ফাঁস লাগানো দড়িটার প্রতি তার কেমন যেন একটা আগ্রহ জন্মেছে৷ বিশেষ করে আমি দেখার আগে সে যেভাবে সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল, কেমন যেন সম্মোহিত মনে হচ্ছিল৷ আমি একটুকরো সুসি তার দিকে এগিয়ে দিলাম৷ সে খেতে-খেতে বলল, ‘আচ্ছা যদি আগ্নেয়গিরিটা হঠাৎ জেগে ওঠে?’
‘উঠতেই পারে, তবে তিনশো বছর ধরে যখন ঘুমিয়ে আছে তখন তোকে আমাকে হঠাৎ ওয়েলকাম করার ইচ্ছা জাগবে বলে তো মনে হয় না৷ এদিকে দেখ৷’
আমি তাঁবুর ভিতরে পাওয়া কাগজগুলো তার হাতে দিলাম৷ প্রথমে উলটে-পালটে কিছুই চোখে পড়ল না, সাদা পাতা৷ যেন কেউ একটা নোটবুক থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা কাগজের উলটো দিকে ছোট-ছোট অক্ষরে কী যেন একটা লেখা আছে৷ আমি সেটা চোখের সামনে নিয়ে এসে ভালো করে লক্ষ করে বুঝলাম, ভাষা ইংরেজি নয়, সম্ভবত জাপানি৷ রিনা অল্প জাপানি জানে৷ জায়গাটা তাকে দেখিয়ে বললাম, ‘দেখ তো কী লেখা আছে৷’
লেখাটা পড়ে তার মুখ কীরকম যেন শুকিয়ে গেল৷
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল রে?’
‘একটাই ওয়ার্ড লেখা আছে ‘সাতসুজিন্সা’৷’ সে থমথমে মুখে বলল৷
‘তার মানে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
‘মানে কিলার—খুনি৷’
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে নিশি ফিরে এল; তার চোখে-মুখে উদ্বিগ্ন ভাব নেই দেখে বুঝলাম বডি পায়নি৷ আমাদের সামনে বসে জামার ধুলো ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল, ‘ডেড, লিভিং কোনও বডিই চোখে পড়ল না৷ লোকটা মনে হয় বেরিয়ে গেছে৷’
‘তাঁবুটা এখানে ফেলে?’ রিনা বলল৷
‘একটা সাদা কাগজে খুনি লিখে?’ আমি তার হাতে কাগজটা দিলাম৷
নিশি কাগজটা দেখে বলল, ‘খুন! মানে ব্যাপারটা আর আত্মহত্যায় থেমে থাকছে না?’
‘তোর হাতে অতটা কাটল কী করে?’ রিনার দৃষ্টি নিশির হাতের দিকে স্থির৷ তার হাতে কব্জির খানিকটা উপরে বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে কেটে গেছে৷ দু-এক ফোঁটা রক্তের ধারা নেমে আসছে সেখান থেকে৷
নিশি এমন ভাবে হাতের দিকে তাকাল যেন এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি৷ এবার ভালো করে দেখে বলল, ‘এ বাবা! দেখিইনি এতক্ষণ৷ কোনও গাছে লেগে কেটেছে মনে হয়…’
আমি ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ডেড বের করে তার হাতে লাগিয়ে দিলাম৷ কাটা জায়গাটা ভালো করে দেখে কেমন যেন খটকা লাগল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোনও গাছে কেটেছে?’
‘কাঁটা গাছ-টাছ আছে ভিতরে অনেক, কী জানি কিসে কাটল!’
‘হুম…’ আমি একটু দূরে সরে এসে বসলাম৷
রিনা বলল, ‘আচ্ছা দড়িটা যদি লোকটাই নিয়ে এসে থাকে তো সেই দড়িটা ফেলে গেল কেন?’
‘ব্যাপারটা সন্দেহজনক, একটা লোক সুইসাইড ডেস্টিনেসনে এল, তাঁবু খাটাল, খাওয়া-দাওয়া করল, এমনকি ফাঁসের দড়ি অবধি বানাল, তারপর একটা ছেঁড়া কাগজে খুনি লিখে উধাও হয়ে গেল!’
‘এখন কথা হচ্ছে এই খুনিটা কে?’
‘আর খুনটাই বা কে হয়েছে? কোনও বডি তো নেই…’ রিনা বলল৷
যেখানে আমরা বসে আছি তার চারপাশে খানিকটা গাছপালা পাতলা হয়ে এসেছে৷ সরু-সরু গাছগুলোর উপর পুরু শ্যাওলার পরত জমেছে৷ তারপর পিছনের দিকটা খাড়া হয়ে নীচের দিকে নেমে গেছে, সেদিকটা আরও অন্ধকার হয়ে আছে৷ মনে হয় সোজা হাঁটতে থাকলে এ জঙ্গল শেষ হবে না, ঘন গাছপালা যেন দেওয়ালের মতো ঢেকে রয়েছে চারদিক৷ কোথাও জীবজন্তু এমনকি পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে না৷ সমস্ত পৃথিবীটা জুড়েই বোধহয় এই জঙ্গল৷ মনে হয়, আদিম মানুষের পথ পেরিয়ে সৃষ্টির প্রথম ভোরে এসে দাঁড়িয়েছি৷
দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি৷ নিশি হঠাৎ বলল, ‘কী একটা ভূতের গল্প আছে বলছিলি, এ পরিবেশে জমবে ভালো, কী বল?’
‘ভূত নয় মিথ৷ লোকে বলে৷ তবে জাপানিরা ভূত নিয়ে অবসেসড বলতে পারিস৷ দুনিয়ায় এমন কী জিনিস নেই যা নিয়ে একটা জাপানি ভূতের ছবি হয়নি! পরিত্যক্ত কুয়ো, আয়না, চুল, লিফট, জ্যামিতির নকশা, খবরের কাগজ এমনকি হালে দেখলাম ওয়েবক্যাম নিয়েও একটা সিনেমা বানিয়েছে৷’
‘সে যাই হোক, দেখতে কিন্তু ভয় লাগে৷’ রিনা বলল৷
নিশি এতক্ষণ কোনও মন্তব্য করেনি, এবার সে বিরক্ত হয়ে উঠল৷ ‘সিনেমার কথা বাদ দে, তোর ওই মিথটাই বল৷’
‘আচ্ছা শোন,’ আমি আরাম করে বসে একটা সিগারেট ধরালাম, পায়ের জুতোটা আলগা করতে-করতে বললাম, ‘১৮৩৩ সালে জাপানে দুর্ভিক্ষ হল, খাবার-দাবার প্রায় পাওয়া যায় না, এমনকি খাবার জলটুকুও মারামারি করে জোগাড় করতে হয়৷ দুর্ভিক্ষে মারা পড়তে লাগল শয়ে-শয়ে মানুষ, কচি বুড়ো কেউ বাদ গেল না৷ তো এখানে আশপাশের গ্রামের লোকজন এই সময় একটা ভয়ানক কাজ করল—বাড়ির বয়স্ক, অথর্ব লোকজনদের রেখে যেতে লাগল এই জঙ্গলে৷ তাতে গ্রামের খাবার-দাবারের কষ্ট খানিকটা কমল বটে; কিন্তু রুগ্ন মানুষগুলো এই গভীর পৈশাচিক জঙ্গলে অনাহারে তৃষ্ণায় অযত্নে মারা যেতে লাগল; মরার আগে কারও মুখও দেখতে পেল না৷ মৃত্যুর পর তাদের দেহগুলোও সৎকার হল না৷ পশু-পাখিও নেই৷ দীর্ঘদিন ধরে একটু-একটু করে পচত তাদের শরীর, গাছপালার তলায় বসে বা শুয়ে থাকা অনেক কঙ্কাল পাওয়া গেছে৷ কিছু- কিছু কঙ্কাল নাকি জঙ্গলের ভিতরে এখনও আছে৷ জাপানি মিথ অনুযায়ী কোথাও মানুষের নির্মম অসহায় মৃত্যু হলে সেই জায়গাটা জুড়ে একটা অভিশাপ জন্মায়, যাকে বলে—নরই৷ এ জঙ্গলটাও সেই মৃত আত্মাদের অভিশাপ৷ সেটাই হয়তো টেনে আনে মানুষকে, দূরদূরান্ত থেকে৷’
আমি আবার দুই সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাদের মুখে ভয়ের স্পষ্ট চিহ্ন৷ হেসে বললাম, ‘খাওয়া-দাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করা যাক, না হলে অনাহারে তো আমাদেরই কঙ্কাল হতে হবে৷ নিশি, ভাই ছুরিটা দে৷ প্যাকেটটা কাটতে হবে৷’
নিশি কোমরের খাপে গাঁথা ছুরিটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল৷ সেটা হাতে নিয়ে আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম, ছুরির ডগায় হাল্কা হয়ে যাওয়া এক বিন্দু রক্তের দাগ, সেটা আঙুলে লাগিয়ে আমি বুঝলাম রক্ত বেশিক্ষণ আগের নয়৷
খানিকক্ষণ বাদে আমরা ক্যাম্পটা ছেড়ে উঠে পড়লাম৷ জাপানি ভদ্রলোক তো আর ফিরবে বলে মনে হয় না৷ ঘড়িতে চারটে বাজে৷ একটু ঘুরে ফিরে ফেরার পথ ধরতে হবে৷ খানিকটা এগোতে আরও কতগুলো সতর্কবাণী চোখে পড়ল৷ “Life is precious– think again.” তারপর আবার সার বাঁধা গাছপালা৷ পথ প্রায় নেই বললেই চলে৷ কোথাও লাফিয়ে কোথাও ঝুঁকে পার হতে হচ্ছে৷ দু-একটা গাছে দড়িও ঝুলতে দেখলাম, তার চারপাশে ছেঁড়া জামাকাপড় ছড়িয়ে আছে৷ বুঝলাম বডি নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
‘ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং৷’ বেশ কিছুক্ষণ হল লক্ষ করেছি রিনার হাবভাবে কেমন পরিবর্তন এসেছে৷ জঙ্গলটা যেন কৌতূহলী করে তুলেছে তাকে৷
‘কারওর মৃত্যু-দেশের সাক্ষী হওয়াটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার’৷ নিশি সামনে-সামনে ঝোপঝাড় ফাঁকা করতে-করতে বলল, ‘এই দড়িগুলো থেকেই কোনও একসময় হয়তোএকটা বডি ঝুলছিল৷’
‘বডি নাও ঝুলতে পারে, অনেক সময় ঝুলন্ত দড়ি দেখে লোকে ভয় পেয়ে আর এগোয় না৷’
“Thus the currents turn awry
And lose the name of action.
তবে এই ব্যাপারে আওকিগাহারার সুখ্যাতি আছে৷ খুব বেশি লোকজনকে ফেরায়নি, যাদের মনে অর্ধসংশয় থাকে তাদের দৃঢ়চেতা করে উপরে পাঠায়৷’
‘নিশি, তোর কি সত্যি মনে হয় ব্যাপারটা ভৌতিক?’ রিনা জিজ্ঞেস করল৷
‘নাঃ৷ তবে জঙ্গলটা কেমন যেন বিষণ্ণ, একটাও পাখির ডাক শোনা যায় না, গাছপালাও যেন প্রাণহীন, মনে হয় দরজা-জানলাহীন একটা বন্ধ ঘরে কেউ আটকে রেখে গেছে৷ সুইসাইডটা আইসোলেসন ছাড়া তো সম্ভব নয়৷’
আমি হঠাৎ একটা হাত বাড়িয়ে নিশিকে থামিয়ে দিলাম৷ সে আমার দিকে ফিরতে বললাম, ‘আচ্ছা তোরা একটা প্রশ্নের উত্তর জানিস?’
‘কী প্রশ্ন?’ রিনা জিজ্ঞেস করল৷
‘পৃথিবীতে সব থেকে বেশি আইসোলেটেড আর রহস্যময় জায়গা কোথায় আছে?’
‘বারমুডা ট্রাঙ্গেল?’ নিশি বলল৷
‘লকনেস? যেখানে এখনও আলো পৌঁছায়নি৷’
আমি মাথা নাড়ালাম, ‘ধুর, একটাও হয়নি৷ সবথেকে রহস্যময় আর দুর্গম জায়গা হল মানুষের মন৷ কী যে সেখানে আছে, কী নেই, তা কেউ জানে না৷ মনের রহস্য তাবড় তাবড় গোয়েন্দা ভেদ করতে পারেনি৷’
নিশি সবে সামনে ঘুরতে যাচ্ছে, এমন সময় আমাদের প্রায় চমকে দিয়ে ঠিক ডান দিক থেকে খুব ক্ষীণ একটা চিৎকার ভেসে এল৷ যেন সামনেই কাউকে গলা টিপে খুন করা হচ্ছে৷ শান্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে তীক্ষ্ণ আকস্মিক চিৎকারটা বাজ পড়ার মতো শোনাল৷ আমরা প্রায় আঁতকে উঠে চিৎকার করে সরে এলাম সেদিক থেকে৷ আওয়াজটা কিন্তু একবার হয়েই থেমে গেছে৷ আমি আমার দুই সঙ্গীর থমথমে মুখের দিকে তাকালাম৷ আর্তনাদটা কিসের থেকে হতে পারে তা আমরা তিনজনেই জানি৷ হয়তো আর একটু এগোলেই গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত একটা দেহ দেখতে পাব৷ তাড়াতাড়ি গেলে এখনও বাঁচানো যেতে পারে৷ আমরা তিনজনেই দ্রুত পা চালালাম৷ এ জঙ্গলের ভিতর দৌড়ানো অসম্ভব৷ না দেখে হাঁটতে গিয়ে আমার পা মচকে গেল৷ তাও আমি দাঁড়ালাম না, গাছপালার স্তর ভেদ করে এগোতে লাগলাম৷ আমার সামনে নিশি আর রিনাও উদভ্রান্তের মতো পা চালাচ্ছে৷ বেশ খানিকটা এগিয়েও কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না৷ আওয়াজটাও এর মধ্যে আর শুনতে পাইনি৷ ব্যাপারটা আমার অদ্ভুত লাগল৷ যে মানুষ গলায় দড়ি দিচ্ছে, সে মাত্র একবার চিৎকার করতে যাবে কেন?
রিনা চারপাশটা একবার ভালো করে দেখতে দেখতে বলল, ‘আওয়াজটা ঠিক শুনেছিলাম তো রে?’
‘কী জানি, ভুলও হতে পারে৷ এরকম জঙ্গলে আওয়াজ শুনতে ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক৷’
‘তোরা কি পাগল হয়েছিস?’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, ‘আমি পরিষ্কার শুনেছি৷’
‘হাওয়ার শব্দও হতে পারে৷ রিফ্লেক্ট হয়ে ওরকম শোনায়৷’
ওরা ব্যাপারটাকে সেরকম গুরুত্ব দিচ্ছে না৷ যেন ফাঁকা জায়গা ছেড়ে এই গভীর বনের ভিতর আসা গেছে সেটাই বড় কথা৷ ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছি আমরা৷ রাস্তা খেয়াল করা হয়নি৷ আগের তাঁবুর কাছে ফিরতে গেলে GPS ছাড়া উপায় নেই৷ আমি নিশির দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘অনেক হয়েছে৷ দে এবার GPSটা৷’
নিশি ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজে বলল, ‘এমা সেটা তো আমার কাছে নেই! তোর কাছেই তো ছিল?’
কথাটা শুনে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল৷ হিংস্র জন্তুর মতো চিৎকার করে উঠলাম, ‘জেনে শুনে ন্যাকামি মারছিস? তুই রেখেছিলি ব্যাগে৷ এখন কী হবে? ওটা না হলে ফিরব কী করে?’
‘কেন? পিছনদিকে হাঁটলে ফেরা যাবে না?’ রিনা বলল৷
‘এটা কি বাড়ির বাগানে হাঁটছিস যে পিছনে হাঁটলেই পৌঁছে যাবি? কোনটা কোনদিক বুঝবি কী করে?’
‘চেষ্টা তো করে দেখাই যায়৷ এ জায়গাটাও কিন্তু খারাপ নয়৷’
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম৷ পাগল হয়ে গেছে, ওরা দু-জন পাগল হয়ে গেছে৷ ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছে না কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের৷ এখানে রাস্তা না চিনে এক পা এগোনোও বিপজ্জনক৷ রাস্তা তো হারিয়েছি, এবার দিকও হারিয়ে ফেলব৷ রিনা ক্যামেরা নিয়ে চারদিকের ছবি তুলছে৷ দেখেই আমার গাটা জ্বলে উঠল৷
‘তোদের মরার ইচ্ছা হয়েছে আমাকে আগে বললেই পারতিস৷ দড়ির ব্যবস্থা করে দিতাম৷’
‘ওমা দড়ি কী হবে রে? চারপাশে এত লতানে গাছ, শক্ত দেখে দুটো জোগাড় করে নিলেই হল৷’
আমার এবার কেমন যেন খটকা লাগল৷ এসব কি বলছে এরা? এই গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে কি পাগল হয়ে গেছে সবাই? আমার মাথাটাও কেমন যেন করছে৷ বিকট পাহাড়ের মতো লম্বা গাছপালা ধীরে-ধীরে এগিয়ে এসে যেন পিষে মেরে ফেলতে চাইছে আমাদের৷ কিন্তু ওদের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই কেন? নিশি ছুরি দিয়ে একটা গাছের লতা কাটার চেষ্টা করছে আর রিনা ক্যামেরাটা মাটির দিকে তাক করে কিসের যেন ছবি তুলছে৷ আমি আর কিছু না বলে তার পাশে গিয়ে বসলাম, ‘তোদের কি শরীর খারাপ লাগছে? আমার কাছে জল আছে কিন্তু৷ খাবি?’
রিনা মাথা নেড়ে না বলল৷ নিশি হঠাৎ একটা গাছের ডালের খানিকটা কেটে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, এসব ফলে বিষ-টিষ থাকে নাকি?’
‘তা আমি কী জানি, তোকে কে খেতে বলেছে?’
‘খেয়ে দেখি৷ কী বল?’
‘খা৷’
আমার আর কাউকে বাধা দিতে ইচ্ছা করল না৷ ওরা যে কী করছে তা ওরা নিজেরাও জানে না৷ হঠাৎ চোখে পড়ল খানিকটা দূরে একটা গাছের ডালে আগের মতোই ফিতে বাধা আছে৷ তবে রংটা বেগুনি নয়—নীল৷ আমি উঠে ধীরে-ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম৷ সেটা ধরে এগোলে কিছু তো অন্তত পাওয়া যাবে৷ ফিতেটার কাছে এসে দেখলাম সেটা বেশ পুরনো, কাপড়টা তুলোর মতো আলগা হয়ে আছে৷ সেটা ধরে আমি এগোতে লাগলাম৷ খানিকটা এগোতে মনে হল কোথা থেকে যেন ঠান্ডা হাওয়া আসছে৷ গাছের পাতাগুলো অল্প-অল্প নড়ে উঠছে৷ দুটো আকাসিয়া গাছের মাঝখান দিয়ে ঢুকে ফিতেটা শেষ হয়ে গেছে৷ সেখানে পা রেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম, খানিকটা ফাঁকা জায়গা৷ সেখানে দিব্যি একটা ক্যাম্প করা যায়৷ নীচু হয়ে মাটির উপর বসে পড়লাম৷ নাঃ! চারপাশে কেউ নেই৷ বেশ কিছুকাল আগে হয়তো কেউ এখানে এসে সুইসাইড করেছিল৷ কিন্তু কোন গাছটায়? আমার ঠিক চোখে পড়ল না৷ আমার হঠাৎ সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে৷ ওই দুটো গাছের ফাঁক দিয়ে জায়গাটা দেখে কিছু যেন মনে পড়ছে আমার৷ সবটা খুব অস্পষ্ট, চারপাশটা কি পালটে যাচ্ছে? গাছগুলো একটু-একটু করে আরও লম্বা আর ঘন হয়ে যাচ্ছে৷ আমি এক ঝটকায় পিছনে সরে এলাম৷ খুনি, এই সমস্ত জঙ্গলটাই একটা আস্ত খুনি৷ কিন্তু আমার ধরা দিলে চলবে না, এই খুনে আওকিগাহারার কাছে ধরা দিলে চলবে না৷ আমাকে পালাতে হবে, নিশি আর রিনা…রিনা… গোল্লায় যাক… মরুক গে! যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে ঝঞ্চাটাটা৷ আমি পিছন ফিরে দৌড়াতে লাগলাম৷ মাটির নীচের গর্তে পড়ে বিশ্রীভাবে ছড়ে গেল পা-টা৷ মুখে এগিয়ে আসা গাছপালার ডালের ঝাপটা লাগছে৷ তাও আমি গতি কমালাম না৷ আমাকে বাঁচতে হবে৷ পালাতে হবে এই আদিম মহাজাগতিক অরণ্যের মৃত্যুগ্রাস থেকে৷
আর একটু এগোতেই কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ নাঃ, আর পালানোর দরকার নেই৷ অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছি৷ আমি তো এখানে পালাতে আসিনি৷ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম৷ আমার ঠিক সামনেই গাছের ডাল থেকে ঝুলছে আমার দুই সঙ্গীর মৃতদেহ৷ না মৃতদেহ নয়, রক্ত মাংসহীন, অস্থিসার— কঙ্কাল৷ দীর্ঘ দু-বছর ধরে ঠিক ওইভাবে ওইখানে ঝুলে আসছে নিশি আর রিনার ক্ষয়িত গলিত শরীর৷ এখন শুধু কঙ্কাল৷
দু-বছর আগের সব কথা আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে৷ তিনজনেই এসেছিলাম আমরা৷ তারপর কী হয়েছিল জানি না—আমি দল থেকে আলাদা হয়ে গেছিলাম৷ ওদের আর খুঁজে পাইনি, GPSটা ছিল আমার কাছে, পাগলের মতো সমস্ত জঙ্গল ধরে ছুটে বেরিয়ে চিৎকার করে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিলাম একটা গাছের তলায়৷ ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ তারপর একসময় উঠে পালিয়েছিলাম বাইরে৷ আমার দুই বন্ধুকে ফেলে৷ তার মধ্যে হয়তো ওরা দু-জন হারিয়ে গেছে আরও গভীর জঙ্গলের ভিতর৷ বেরনোর রাস্তা ওদের জানা নেই৷ এই জঙ্গল বেরনোর পথ দেখায় না৷ ভয় অনাহার নিঃসঙ্গতায় ততক্ষণ পিষে মারতে থাকে যতক্ষণ না মানুষ গলায় তুলে নেয় দড়ি৷
দু-বছর খুনের বোঝা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি শহরের আনাচে- কানাচে৷ ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি আমার পাপ৷ আমার বন্ধুদের মৃত্যুর অন্ধকারে ফেলে পালিয়ে আসার কথা৷ আর পারলাম না, না আর পারব না৷ তাই এবার আটঘাট বেঁধেই এসেছিলাম৷ ওদের কাছেই ফিরে যাব আমি, একই ভাবে, একই জঙ্গলে৷ আমি ঝুলন্ত কঙ্কাল দুটোর দিকে তাকিয়ে হাসলাম৷ খানিকটা দূরে পড়ে আছে ধুলোয় ঢেকে যাওয়া ক্যামেরাটা৷ সেটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম, আমার ব্যাগে নতুন ব্যাটারি ছিল, লাগিয়ে দিতেই তাতে পুরনো ছবি ফুটে উঠল—আমার দুই বন্ধুর ভগ্নপ্রায় অসুস্থ শরীর, হাড়গুলো বেরিয়ে এসেছে পাঁজর ঠেলে৷ উন্মাদের মতো গাছের ছালবাকল ছাড়িয়ে খাচ্ছে তারা, ছবিগুলো কি আমার জন্যই তুলেছিল? কে তুলেছিল? ঝুলন্ত শরীরের ছবি, গলিত বিকৃত শরীর, সব ইতিহাস যেন কেউ বন্দি করে রেখেছে কেউ আমার জন্য…
ক্যামেরাটা রেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম৷ ওদের মুখ দুটো খুব মনে পড়ছে৷ এখন আর সেগুলো রক্ত মাংসের নয়—হাড়ের৷ হাওয়ায় ধীরে-ধীরে দুলে কঙ্কালগুলো যেন জঙ্গলের চারপাশে নজর রাখছে৷ তাদের ঠিক সামনেই গাছে হেলান দিয়ে বসে আছি আমি—সাতসুজিন্সা৷
পকেট থেকে ছুরি বের করে উঠে দাঁড়ালাম৷ কাছেই একটা গিট বাঁধা দড়ি পড়ে আছে৷ আঃ! আমার কাজের জন্য আদর্শ৷ সমস্ত আওকিগাহারা ফরেস্ট যেন উন্মুখ হয়ে কিসের প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷ আমি ফাঁসটাকে গাছের ডালের সাথে ভালো করে বাঁধলাম৷ ফাঁসের ভিতর থেকে নিশি আর রিনার ঝুলন্ত কঙ্কাল দুটো দেখা যাচ্ছে৷ জঙ্গলের প্রতিটা গাছ যেন কিসের এক অদ্ভুত উত্তেজনায় মেতে উঠেছে৷ হাওয়া নেই, অথচ মাথা দোলাচ্ছে গাছগুলো৷ আমি ফাঁসটা গলায় পরে পা দুটো মাটি থেকে তুলে নিলাম৷ আমার চোখের সামনে অন্তহীন সবুজ রং মুছে গিয়ে অন্ধকার নামল৷ আকাসিয়া গাছের উঁচু ডালে তিনটে দেহ স্থির হয়ে ঝুলতে লাগল….