আই হ্যাভ আ ড্রিম…

আই হ্যাভ আ ড্রিম…

‘আটলান্টা যাচ্ছ?’ শুনেই তুলি বলল, ‘কেন? মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়ি দেখতে?’ তুলির বর ঝিমা বলে, ‘মার্টিন লুথার কিংয়ের খুব সুন্দর একটা মিউজিয়ামও আছে ওখানে?’

-’তোরা দেখেছিস?

মাথা নাড়ে দুজনেই। দেখেনি। জানে। তা আটলান্টায় আর চট করে কে যাচ্ছে। হ্যাঁ সে গিয়েছিল বটে মানুষজন আটলান্টায় সে-বছর, যে-বছর অলিম্পিকের খেলাধুলো হয়েছিল আটলান্টার স্টেডিয়ামে। দাদাভাই তখন কলকাতা থেকে গিয়েছিল, বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কেউকেটা তো দাদা! দাদা বলে দিয়েছে, ‘অলিম্পিকের স্টেডিয়ামটা দেখে আসবি, অলিম্পিক পার্কটাও দেখে আসবি, যেখানে বোমা ফেটেছিল।’ আমার ননদ বায়োকেমিস্ট, বুড়ুমা বলল, ‘আটলান্টায় অসামান্য ডিজিজ কন্ট্রোল সেন্টার আছে শুনেছি, আমেরিকার বৃহত্তম, পারলে দেখে এসো।’

এমোরি ইউনিভার্সিটিতে আমার এক বন্ধু একদা পড়াতেন। অনেকবার যেতে আমন্ত্ৰণ জানিয়েছেন। কম্প্যারেটিভ লিটারেচারের এবং ইংরিজির অধ্যাপিকা ছিলেন তিনি, জাপানে আমরা একসঙ্গে বেড়িয়েছিলাম একবার—আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড় তিনি—গায়ত্ৰী স্পিভাকেরও খুব বন্ধু ছিলেন। কিন্তু আমার এমোরি ইউনিভার্সিটি দেখতে যাবার আগেই তিনি ক্যান্সারের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

আমার আটলান্টা বিষয়ে উৎসাহের অন্য একটা কারণ ছিল।

যে বছর আমি ম্যাকডাওয়েল আর্টিস্টস কলোনিতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম, সেই বছর ওখানে একটি পিয়ানিস্টের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়েছিল, অ্যালভিন সিংগলটন। অ্যালভিন আটলান্টার ছেলে। কালো ছেলে। অসাধারণ বাজায়, গাইতেও পারে ভালো, যদিও গাইতে চায় না। অ্যালভিনের ঠিকানাতে দুটো ‘পীচট্টি’ ছিল। পীচ-ট্রি ড্রাইভ, পীচ-ট্রি অ্যাভেনিউ।

—তোমাদের ওখানে বুঝি খুব পীচফল হয়? আর পীচমঞ্জরী তো অপূর্ব—-আটলান্টা নিশ্চয় আমাকে যেতেই হবে—পীচ খেতে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’

অ্যালভিন সঙ্গে সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ‘পীচ সর্বত্রই খেতে পারবে—গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার দিন চলে গেছে—পীচফল খেতে আটলান্টা যাওয়া অনর্থক, তবে জর্জিয়া তো সাউথ? আটলান্টাকে সেন্টার করে ঘুরে ঘুরে সাউথটা বেড়িয়ে আসতে পার। এই যে দেখছ ইস্ট কোস্ট, এই নিউইয়র্ক, বস্টন, ওয়াশিংটন—এদের থেকে অনেক আলাদা। আবার, ওয়েস্ট কোস্টের থেকেও। তোমার লস এঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকো, চেনা জায়গা তো? দেখবে সাউথ কত আলাদা। তবে বড় শহর তো সর্বত্রই এক। আটলান্টা বিরাট না হলেও বড় শহরই—শহরটা কিছু ইন্টারেস্টিং নয়—তবে হ্যাঁ, মার্টিন লুথার কিংয়ের শহর তো?’ বলেই হাসি-হাসি মুখে অ্যালভিন গেয়ে উঠেছিল, ‘উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে! ও ডিপ ইন মাই হার্ট আই ডু বিলিভ—’।

তখন থেকেই খুব ইচ্ছে অ্যালভিনের শহরে, মার্টিন লুথার কিংয়ের শহরে একবার যেতেই হবে। দাদাভাই বললে, ‘জানিস তো, ওই অলিম্পিক্সের পরে আটলান্টার এয়ারপোর্ট এখন বিশ্বের ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট? সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বিশাল, সবচেয়ে কমপ্লিকেটেড এয়ারপোর্ট?

—’যাঃ। কেনেডি, ল্যাক্স, নারিতা, হিথরো, ফ্রাঙ্কফুর্ট—‘

—হ্যাঁ, সবগুলোই বিশাল, এবং সবগুলোই কমপ্লিকেটেড, আটলান্টা আরও বেশি।

—’বাপ্ রে। তবে আর গিয়ে কাজ নেই।

—’তা কেন? সুন্দর ডিরেকশন দেওয়া আছে। তুই কি মুখ্যু? আর তোর তো বন্ধুই তোকে নেমন্তন্ন করেছে—এয়ারপোর্টে নিতে আসবে নিশ্চয়ই।’

.

দেখি। যাই কিনা। বস্টনে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে একটা লিটেরারি সেমিনার হচ্ছে। (হ্যাঁ, সাহিত্যসভা বলছে না তাকে কেউ। বলা হচ্ছে ‘লিটেরারি সেমিনার’) তিনজন বক্তা, কেতকী কুশারী ডাইসন, উইলিয়াম রাদিচে, এবং আমি। প্রথমদিনে, যেদিন সম্মেলনের উদ্বোধন সেদিন মূল মঞ্চে আমরা তিনজন স্বরচিত কবিতা পাঠ করব। আর দ্বিতীয়দিনে আমাদের আলোচনাসভা বসবে। বিষয়বস্তু স্থির করে দেওয়া হয়েছে,–’বিদেশে বঙ্গ সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রচার, বিশেষত দ্বিতীয় প্রজন্মের বঙ্গ সন্তানদের মধ্যে।’

বঙ্গ সম্মেলন এক বিপুল হট্টমেলা। গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে, নাটক হচ্ছে, এগুলোই ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’, মূল আকর্ষণ হয়তো দোকানপাট। শাড়ি। গয়না। খাবারদাবার। সামান্য দুটি ক্যাসেটের দোকান, চমৎকার সম্ভার নিয়ে এবং দুটি মাত্র বইয়ের দোকান অল্পস্বল্প বই নিয়ে মিনমিন করছে। আমাদের সেমিনারের ঘরে অবশ্য শ্রোতা আঁটছিল না, দরজার বাইরেও মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। বিষয়বস্তুর তুলনায় আলোচনার হলঘরটি ছোট ছিল।

এবারের বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে আটলান্টা থেকে প্রচুর বাঙালি এসেছেন, কেননা তাঁরা আটঘাট বেঁধে কাজে নামতে চান, সামনের বছর তো আটলান্টাতে হচ্ছে এই বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন। তাদের মধ্যে আমার প্রাক্তন ছাত্রী, তার স্বামীও আছে। ওরা এসে প্রণাম করল, এবং বলল, আমাকে টিকিট পাঠিয়েছে শিবানী আর উজ্জয়ন্ত। শিবানী, যার ডাকনাম মালা, যাদবপুরে আমাদের সহকর্মী ছিল উইমেন্স স্টাডিজে; কিন্তু সম্পর্কটা প্রায় ছাত্রীর মতোই। বয়েসটাও তেমনই।

আমি বস্টনে আসছি সেই খবর সে হঠাৎই পেয়েছে ইন্টারনেটে। পেয়েই আমাকে ই-মেইলে নিমন্ত্রণ—’আমার কাছে আসতেই হবে!’ আমি বলছি, ‘দেখি, দেখি।’ মালা বলছে, ‘দেখি-টেখি নয়। আমি টিকিট পাঠাচ্ছি। মেলা শেষ হলেই আটলান্টায় চলে আসবে।’

ই-মেইলে কুলল না, শেষে অস্থির হয়ে ফোন।—আসছ তো? আমাদের এক বন্ধুর হাতে টিকিট দিচ্ছি। ওরা ৯ই ভোরবেলার ফ্লাইটে বস্টন থেকে আটলান্টা আসছে। তোমাকেও ওই ফ্লাইটে বুক করে দিচ্ছি, ওদের সঙ্গে চলে আসবে, নো প্রবলেম। আমরা তো থাকবই।’

বঙ্গ সম্মেলন শেষ হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঘটছে লোওয়েল বলে ছোট একটা মফস্বল শহরে। কাছাকাছি বড় শহর বস্টন। সেখান থেকে নিত্য যাতায়াত সহজ নয়, আমরা নিমন্ত্রিতরা সকলে লোওয়েল-এ দু-তিনটি হোটেলে আছি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রমণা চক্রবর্তী, মোহন সিং আমরা আছি স্টে-ব্রিজ হোটেলে। ঊষা উন্মুপ, শর্মিলা ঠাকুর ইত্যাদি ম্যারিয়টে। আমাদের বন্ধুবান্ধবরা, মণিদা-করবী ইত্যাদি অনেকেই ডাল-ট্রি-তে। আমার ছাত্রী ইন্দ্রাণীও সেখানে। যেদিন মেলা ভাঙছে, শেষ মুহূর্তে ছুটতে ছুটতে কেউ এসে একটা খাম আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন–তাতে আমার টিকিট আছে এই খবরসমেত। মালার বন্ধুদের সঙ্গে দেখাই হল না ঠিকমতো—ভিড়ের মধ্যে আলাপ হয়েছে কিনা মনেই করতে পারলাম না–হয়নি নিশ্চয়ই, তাহলে তো তখনই খামটা দিতেন। পরদিন ভোর ৬টায় প্লেন।

তুলি বলল ‘টিকিটটা দেখে নাও একবার। ঠিক কটায় প্লেন, ফ্লাইট নম্বর কত?’ তুলিই কিনা পৌঁছে দেওয়ার ভার নিয়েছে। ঝিমা গাড়ি চালায় না।

তুলিকে দেখলে মনে হবে ক্লাস টুয়েলভের বাচ্চা মেয়ে। কিন্তু তিনি ডক্টরেট সেরে টাফ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করেন। পুজোর সময় থেকে তো চলে আসছেন এম আই টিতে অধ্যাপনা করতে। বরের সঙ্গে। ইংরিজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী তুলি, তার স্বামী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এম আই টিতে অর্থনীতির ডাকসাইটে, বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক। দুজনেই চল্লিশের নীচে। ঝিমা আমাদের বন্ধুপুত্র। দুজনেই সন্তানতুল্য। দুজনকে নিয়েই আমার বুকে ভয়ে-ধুকপুক-অহংকার। আমাদের এক নাতিও আছে, ‘সাশা’ তাঁর নাম। টিকিট দেখতে গিয়ে আমি তো হতবাক। এটা কার টিকিট?

এ তো মালবিকা বোসের আটলান্টার রিটার্ন টিকিট। এতে তো আমাকে প্লেনে চড়তে দেবে না? আজকাল প্লেনের টিকিটটাই শুধু দেখে না। ইন্টারনাল ফ্লাইটেও আইডেন্টিটি দেখাতে হয়, ছবিসমেত, যার সঙ্গে বুকিং ক্লার্ক তোমার শ্রীমুখচ্ছবিখানি মিলিয়ে নেবেন। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্কুল-কলেজের আই ডি, একটা কিছু চাই। এ টিকিটটা এখানে এল কোত্থেকে? এ তো আচ্ছা ঝামেলা হল? এই মালবিকা বোসটা কে? মালার বান্ধবী, যিনি আমাকে টিকিটটা পাঠিয়েছেন লোক মারফত, তাঁর নাম নীতাদি। আমার যাত্রাসঙ্গী হবেন তিনিই। নীতাদিকে যোগাযোগ করার পন্থা জানি না। তিনি কোন হোটেলে তাও শুনিনি। হয়তো আটলান্টা থেকে আগত আমার ছাত্রী ইন্দ্রাণী আর তিনি একই হোটেলে। অতএব ডাবল-ট্রিতে ফোন করি, রাত দশটার সময়ে। ইন্দ্রাণীরা নেই। তারা ফেরেনি।

হঠাৎ মাথায় এল, মালবিকা বোস?

—মালবিকা বোস নামে কেউ আছেন?’ উত্তর হল,–’আছেন, কিন্তু তিনিও ঘরে নেই। ধড়ে প্রাণ এল আমার।

—এই ফোন নম্বরটা রাখুন। যতরাত্রিই হোক, মালবিকা বোস যেন এখানে ফোন করেন। ওঁদের একটা ইমার্জেন্সি আছে। বলবেন।’ এবার একটা বিহিত হবে।

.

মালবিকা বোসের ফোন এল। বহু রাত্রে।

—’আপনারা ফোন করতে বলেছেন? এই নম্বরে?’ গলায় কিঞ্চিৎ বিরক্তি?

—‘আজ্ঞে, আপনি নীতাদিকে চেনেন কি? তিনি আটলান্টা থেকে এসেছেন।’

-’আমিই নীতা বোস। ‘

–’বাঃ’, আমি তো ফোনেই নেচে উঠেছি

—তাহলে তো খুবই আহ্লাদের কথা! নীতাদি আপনার কাছে কি আমার আটলান্টা যাত্রার টিকিটটা আছে?’

—সেটা আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যতদূর জানি আপনি তা পেয়েও গেছেন। পাননি?’

—’পেয়েছি যেটা, সেটা তো ভুল টিকিট। ওটা আমার টিকিট নয়।’

-’আমি খুব দুঃখিত। অই ওয়াজ ওনলি দি ক্যারিয়ার—আমি দূতমাত্র। কেবল বয়ে এনে আপনাকে পৌঁছে দেওয়াটুকুই আমার কাজ ছিল। ভুল টিকিট হলে সে দায়িত্ব আমার নয়। ‘

–’কিন্তু আপনি যাবেন কেমন করে?

–’তার মানে?’

—’আপনার টিকিট তো আমার কাছে। আপনার নামই তো মালবিকা বোস?’

—‘মানে?’

-’মানে আপনি আপনার টিকিটটাই আমাকে প্রেরণ করেছেন। আজকাল তো ওভাবে ট্রাভেল করা যায় না।’

–’কান্ট বি!’

—আপনি ব্যাগ খুলে দেখুন, হয়তো আমার টিকিটটা আপনার কাছে আছে। এখনই রাত বারোটা—আপনারা ৪টের সময় লোওয়েল থেকে রওনা হবেন। ৬টায় প্লেন। টিকিটটা এয়ারপোর্টেই অদলবদল করে নিতে হবে। যদি আমারটা থেকে থাকে আপনার কাছে। নইলে এ বাড়ি থেকে আপনার টিকিটটা তুলে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে। লাস্ট মোমেন্টে ওটা পাঠালেন তো, তাই এছাড়া উপায় নেই।

মহিলা চেক করে দেখলেন, হ্যাঁ ওঁর ব্যাগে আমারই টিকিট রয়েছে। যাক! বাঁচা গেল। তুলির সঙ্গে ওঁদের কথা হয়ে গেল, এয়ারপোর্টে, একেবারে চেকিং কাউন্টারে দেখা হবে, সেখানে একসঙ্গে যাত্রা। মহিলা এখন খুব লজ্জিত।

—কিন্তু এটা কী করে হয়? আমারটা পাঠিয়ে দিলাম? আপনারটা রইল? ছি ছি!’

–’হয়, হয়। আমার বেলায় হয়। আমার বেলায় সদা সর্বদা কিছু না কিছু গড়বড় হবেই।’ অত সহজেই যদি জীবনযাত্রা সম্ভব হত, তবে তো আমি অন্য জীবনে বাঁচতুম। ঝিমা-তুলি তো হেসেই গড়াগড়ি। নবনীতা মাসি যেখানে যায় গল্প তৈরি হয়ে যায়। যাই হোক সমস্যার তো সমাধান হয়েছে। কাল রাত থাকতে তুলি আমাকে নিয়ে লোগান এয়ারপোর্টে রওনা হবে। খুব যত্ন করেই মালবিকা ও সুজয় বোস আটলান্টা অবধি নিয়ে গেলেন। আমার চেয়েও ভুলো মানুষ পেয়ে আমি তো মহা আনন্দিত। যাক! আমি তবে একা নই? এয়ারপোর্টে মালা, উজ্জয়ন্ত এবং জিৎ (ওদের বাচ্চা ছেলে) এসেছিল। মেয়ে, মিমি, ইস্কুলে। প্লেন থেকে নেমেই সোজা দরজার সামনে দেখা—তাদের সঙ্গে প্রথমে একটা ট্রেনে চড়তে হল। সেই ট্রেনে করে যেতে হবে ব্যাগেজ ক্লেইমের জায়গায়। ট্রেনে কী ভিড়! এরকম ট্রেনের ব্যবস্থা ফ্রাঙ্কফুর্টেও আছে, এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে হয়। এটা তা নয়। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে স্কিপসহোল্ড—আমস্টারডাম এয়ারপোর্ট, সব টার্মিনালগুলো একই ছাদের তলায়! লস অ্যাঞ্জেলেস, টোকিও, নিউইয়র্ক, লন্ডন, সবই বিশাল, বিভিন্ন এয়ারলাইনের জন্য বিভিন্ন টার্মিনালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আটলান্টার ব্যাপারটা অত গুছিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, ‘বিশ্বের ব্যস্ততম’ এয়ারপোর্টটুকু শুনেই তো হাঁ, কেন রে বাবা? এত ব্যস্ততা কীসের? এখানে কী হয়? মোটেই এমন কিছু আহামরি শহর নয় যে এত লোকজন আসবে-যাবে। তবে? আমার এসব মাথায় ঢোকে না, ‘ঢোকাতে চেষ্টাও করলুম না। মালা, উজ্জয়ন্ত, জিৎকে দেখে মহানন্দে ভাসতে ভাসতে চললুম ওদের সুন্দর মফস্বলে, সাবার্ব। শহর নয়, গ্রামও নয়। বনাঞ্চলের প্রান্তে, অপূর্ব, সত্যি সত্যি ছবির মতো জায়গাতে ওদের বাড়ি। বাড়িটা সাজিয়েছেও ছবির মতো রং মিলিয়ে। উঠোন থেকে অরণ্যের শুরু। শান্ত, নির্জন। পাতা ঝরার শব্দ শোনা যায়।

.

প্রথমেই তো যেতে চাই মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়ি। আর মিউজিয়াম। আটলান্টার অধিবাসীরা অতটা উৎসাহী নয়, যেমন কলকাতাবাসীরা কজনে আর যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর বাড়িটা চোখে দেখতে? অনেক বেশি লোকে শান্তিনিকেতন দেখে এসেছে, জোড়াসাঁকো দেখেছে হাতে গোনা কজন।

দাদাভাইয়ের বলে দেওয়া ‘মিলেনিয়াম ডোম’, ‘অলিম্পিক পার্ক’ সেই সবও দেখতে হবে, এবং এমোরি ইউনিভার্সিটিও। উজ্জয়ন্ত সেখানেই অর্থনীতি পড়াচ্ছেন। তাছাড়া ডিজিজ কন্ট্রোল রিসার্চ ইনস্টিটিউটটাও দেখে যাওয়ার ইচ্ছে। জগৎ জুড়ে যত রোগবালাই সবকিছু নিয়েই তাদের কাজ। গুটিবসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়া থেকে ক্যান্সার, এইডস পর্যন্ত সবকিছুরই আধুনিকতম গবেষণাগার এখানে। অতি সাবধানে কাজ করতে হয়। কে কোন্ রোগজীবাণু চুরি করে নিয়ে কোন দুষ্কর্মে সেটা ব্যবহার করবে কে জানে! পৃথিবীতে এখন তো দুর্নীতিগ্রস্ত বিপথযাত্রী মানুষের অভাব নেই।

আমি ষাটের দশকের ছাত্রী। এই যুক্তরাষ্ট্রে তখন প্রবল উথালপাথাল। একদিকে কোল্ড ওয়ার, অন্যদিকে ফ্লাওয়ার চিলড্রেনদের শান্তির ডাক, একদিকে উত্তাল ভিয়েতনাম, আর দেশের ভেতরে মার্কিন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের মুভমেন্ট চলছে। ছাত্রছাত্রীরা দলবদ্ধ হচ্ছে অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে। সামাজিক, সরকারি, আইনি অসাম্য যে মার্কিন জাতীয় আদর্শের বিরোধী, স্বদেশকে সেটা খেয়াল করিয়ে দিচ্ছেন অসামান্য উদাত্ত, নির্ভীক বাগ্মিতায় এক যুবক–এক কৃষ্ণাঙ্গ পাদ্রী, মার্টিন লুথার কিং। সারা আমেরিকা জুড়ে সাড়া পড়ে গেছে।

—’মিলেনিয়াম ডোম দেখতে যাবে? দেখবার মতো’-

—’ওই সঙ্গেই অলিম্পিক পার্কও—কাছেই…’

—’দারুণ মেক্সিকান রেস্তোরাঁ আছে ওখানে…’

—’একটা শিল্পীদের পাড়া আছে—’

কিন্তু আমি তো সবার আগে যেতে চাই আমার তীর্থভ্রমণে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বাড়ি। কিন্তু উপায় কী আছে? কটাই বা দিন হাতে? আটলান্টাতে যে এত বাঙালি কে ভেবেছিল? প্রতিদিনই এখানে-ওখানে নিমন্ত্রণ। যত্ন-আত্তি। আর আটলান্টাতে সবকিছুই একঘণ্টার রাস্তা।

আমি যেখানে আছি সেখান থেকে অনেকখানি দূর মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়ি—মালারা চেনে না, জয় চেনে। জয়কে তুলে নিতে হবে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার সময়মতো যেতে যেতেই অনেক দেরি হয়ে গেল। শুরুতেই লাঞ্চ টাইম।

সেই শিল্পীদের পাড়ায় গিয়ে মেক্সিকান ফ্যান্সি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ।

পাড়াটি দ্রষ্টব্য, সত্যিই। আমেরিকার এই রক্ষণশীল দক্ষিণ-অঞ্চলে এমন বিচিত্রদর্শন ‘শিল্পী’ মানুষেরা চলাফেরা করছেন, এটা দেখবার জিনিস। নিউইয়র্কে, কিংবা সানফ্রান্সিসকোয় কেউ এঁদের দিকে ফিরেও তাকাত না। সেখানে এঁদের ছড়াছড়ি। আমার কেবল অস্থির লাগছে, আসল জায়গায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই সবই ভালো, লাঞ্চটা তো অসামান্য—পরিবেশটিও সামান্য নয়—কিন্তু আমাদের গন্তব্য তো আলাদা। অন্তত আমার।

খেয়েদেয়ে দিবানিদ্রা নিতে পারলেই ভালো হত, আমরা চললুম ম্যাপ দেখে দেখে মার্টিন লুথার কিংকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। এটুকুই। আর তো কিছুই না।

বার দুয়েক সামনে দিয়ে ঘুরে যেতে হল, রাস্তার এমনই কায়দা। অবশেষে পার্কিং লটটি পাওয়া গেল, যেখানে গাড়ি রেখে মার্টিন লুথার কিংকে প্রণাম করতে যাবে লোকে। গাড়ি রাখার পরেও দীর্ঘ পদযাত্রা। তা, তীর্থ করতে একটু একটু কৃচ্ছ্রসাধন লাগে। সেই সময় লক্ষ করলুম, অন্য অন্য যাঁরা যাচ্ছেন, গাড়ি রেখে, তাঁরা সকলেই কালো মানুষ। আজ ছুটির দিন নয়, সপ্তাহের মাঝখানে বেশি ভিড় হবে না, হয়তো ট্যুরিস্টরাই শুধু আসবে, এমনই ভেবেছিলুম। তা, এঁরা যদি ট্যুরিস্ট হন এঁরা সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনি ট্যুরিস্ট। তাঁরা সংখ্যায় একমুঠো!

–’না না, সব এখানকারই লোক হবে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছে দেখছ না?’

—’স্কুল ছুটি তো, ছোটদের নিয়ে আফটার লাঞ্চ বেরিয়ে পড়েছে—’

–’আমাদের মতো।’

আমরা অবশ্য ছোটদের আনিনি, জিৎ আর মিমি বাড়িতে আছে। ওরা বেড়াতে ভালোবাসে না, বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। অত্যন্ত মিষ্টি স্বভাব দুজনেরই। খুব লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে দুটি, মালা-উজ্জয়ন্তর। তবে এলে ভালো হত, দেখত। একটা বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে চেনা পরিচয় হত। জিৎ খুব ছোট্ট, ও বুঝবে না, কিন্তু মিমি বুঝবে।

-’পরে ওদের নিয়ে এস। আমেরিকাতে বড় হচ্ছে তো, মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে চেনা হলে, আমেরিকাকে চিনবে। আমেরিকার সামাজিক ইতিহাস বদলে দিয়েছেন ঊনচল্লিশ বছরের নিহত এই যুবকটি। স্বামী বিবেকানন্দরও ঊনচল্লিশ বছরই আয়ু ছিল।

.

পৌঁছলাম যেখানে সেটি মার্টিন লুথার কিংয়ের বাড়ি নয়। যাদুঘর।

এই আটলান্টাতেই তাঁর জন্ম-কর্ম, মৃত্যু যদিও মেমফিসে। সমাধির স্মৃতিসৌধও এই আটলান্টায়। আমি তো সব কিছুই দেখব বলে ব্যাকুল। মেমফিসে তাঁকে হত্যা করা হয়, 8 এপ্রিল, ১৯৬৮-কিন্তু আটলান্টায় এনে কবর দেওয়া হয় একবছর পরে, এপ্রিল ১৯৬৯-এ। দেখতে হবে সব।

—কিন্তু আমার কপালে ছিল না।

আমাদের ওই যাদুঘর দেখতেই মুগ্ধতায় এতটা সময় বেরিয়ে গেল যে না হল তাঁর জন্মগৃহটি দেখতে যাওয়া, না তাঁর কবরে গিয়ে একটু ফুল দিয়ে আসা। যেহেতু আজই সন্ধ্যাবেলায় বঙ্গ সম্মিলনের মানুষদের সঙ্গে মিলিত হবার কথা ইন্দ্রাণীদের বাড়িতে—তাঁরা আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসছেন—ওসব জায়গায় যেতে গেলে আরও দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই পৌঁছনোর কথা সাতটা সাড়ে সাতটায়, আমরা নটার আগে গিয়ে পৌঁছতে পারব না। যেতেই দেড় দুঘণ্টা। অতএব নো জোড়াসাঁকো। নো নিমতলা-অর্থাৎ কিংয়ের জন্মগৃহ ও দেখা হল না, তাঁর সমাধিসৌধও দেখা হল না, শুধু শুকনো মিউজিয়াম দেখেই তুষ্ট হয়ে ফিরতে হল। মন কি ভরে?

.

মিউজিয়ামের প্রবেশপথেই দাঁড়িয়ে আছেন কিংয়ের গুরুদেব, যাঁর কাছে তিনি রাজনীতিক্ষেত্রে অহিংসা প্রয়োগের বাণী পেয়েছিলেন। হাতে লাঠি, গায়ে চাদর, পায়ে চটি, ডাণ্ডি মার্চের খাটোধুতি পরা অতি দীর্ঘ সেই মানুষটি।

যিশুখ্রিস্টের পরেই মার্টিন লুথার কিংয়ের গুরু ছিলেন গান্ধিজি। আহা—তিনি রোদ্দুর মাথায় করে খাড়া, অথচ তাঁর দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। একমাত্র আমরাই তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম, মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম। এদেশে তাঁর মূর্তির যত্ন-আত্তি হয় ঢের বেশি। পাখিদের আদরের চিহ্ন লেগে নেই অঙ্গে।

মিউজিয়াম তো বাড়ি নয়। বাড়িতে যেতে পারলে যে রোমাঞ্চটা হত, ফুল হাতে করে সমাধিস্থলে গিয়ে প্রণাম করতে পারলে যে তৃপ্তিটুকু হত, মিউজিয়ামে তা হয় না। কিন্তু আমি তো ষাটের দশকের মার্কিন মুলুকের ছাত্ররাজনীতির অন্ধিসন্ধি জানি, একবার মিউজিয়ামে ঢুকে পড়বার পরে, আমার অবস্থা হল পুরনোদিনের স্মৃতিচারণের মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন

এই তো সেই ছবি—সেই বিখ্যাত মার্চ অন ওয়াশিংটন–লিঙ্কন সেন্টারে ২,০০,000 মানুষ জড়ো হয়েছিল যে দীর্ঘ পদযাত্রার অন্তে—যেখানে তিনি তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন—’আই হ্যাভ আ ড্রিম!’

‘কাজ’ ও ‘স্বাধীনতা’র দাবিতে সেই সভা। আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা তো সকলেই অনেক অল্পবয়সী। মার্টিন লুথার কিং তাঁদের কাছে স্মৃতি নন, ইতিহাস মাত্র। অনেকগুলি নামের মধ্যে একটি।

আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। ওই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ছাত্রজীবনের অনেকখানি, আমার গড়ে ওঠা। গান্ধিজির প্রতি তেমন কিছু ভালোবাসা ছিল না স্বদেশে থাকতে। পরে ঘৃণার, হিংসার চেহারা আরও স্পষ্ট হবার পরে তাঁর মূল্য বুঝেছি। কিংয়ের গান্ধিভক্তি আমাকে প্রথমে অবাক, তারপরে মুগ্ধ করেছিল। একলব্যের মতোই তিনি নিজে নিজে গান্ধির বাণীতে নিজের দিকনির্দেশ খুঁজে নিয়েছিলেন সুদূর মার্কিন মুলুকে বসে। শুধু বইপত্তরে তৃপ্ত হননি, সস্ত্রীক ছুটে এসেছিলেন ভারতবর্ষে, নেহরুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, নেহরুর সাহায্যে আলাপ-পরিচয় করেছিলেন কয়েকজন গান্ধিবাদী মানুষের সঙ্গে, আলোচনা করেছিলেন প্রাণভরে। অহিংসার নীতিতে দৃঢ়তর বিশ্বাস নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ষাটের দশকের যুদ্ধবাজ আমেরিকায়। শুধু বর্ণবৈষম্যই নয়, সবরকমের অসাম্যের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে, হিংসার বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ ছিল।

.

আমি তখন ছাত্রী ওই দেশে, বার্কলিতে ফ্রি স্পিচ মুভমেন্টে সামিল হয়েছি। ইংল্যান্ডে সি এন ডি (কমিটি ফর নিউক্লিয়ার ডিজআর্মামেন্ট) যার চালনায় বার্ট্রান্ড রাসেল, তাঁর সঙ্গেও লন্ডন থেকে দীর্ঘপথ অলডারমাস্টন মার্চে শান্তির পদযাত্রায় অংশ নিয়েছি। যুদ্ধ বিরোধিতার অন্যতম স্লোগান ছিল, ‘উই শ্যল ওভারকাম সাম ডে’–যে গান মার্টিন লুথার কিংয়েরও, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের গান।

.

ছাত্রাবস্থায় আমার অন্যতম আদর্শ মানুষ ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁর যাবতীয় কীর্তির সময়ে আমি সেই দেশে উপস্থিত ছিলাম, দেখেছি নোবেল শান্তি পুরস্কারের উত্তেজনা। ছিলাম তাঁর মৃত্যুর সময়ে টেলিভিশনের দৃশ্য-সাক্ষী। ওয়াশিংটনে ২,০০,০০০ মানুষের সেই পদযাত্রায় মার্কিন দেশের সব কটি সিভিল লিবার্টিজ সমিতি যোগ দিয়েছিল। সমস্ত অঞ্চল থেকে মানুষ এসেছিলেন, কালো এবং সাদা, যাঁরাই সাম্য এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। মার্টিন লুথার কিং তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ভাষণ ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ সেই সভাতেই দিয়েছিলেন। এখানে তাঁর সেই ভাষণও শোনানো হচ্ছে।

মার্টিন লুথার, এক প্রাতঃস্মরণীয় মানুষের নামে তাঁর নামকরণ—১৬ শতকের জার্মানিতে লুথার তাঁর গির্জার বন্ধ তোরণে ১৫টি ঘোষণা লিখে এঁটে দিয়েছিলেন—ক্যাথলিক চার্চের রীতি দুর্নীতি বিষয়ে তাঁর আপত্তি ও সমালোচনা—শত শত মানুষ সেদিন মেলায় বেড়াতে চার্চে এসে ওই ১৫টি ঘোষণা পড়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরেছিল। ইউরোপের ভাগ্য বদলে গিয়েছিল তারপরে। শুরু হয়েছিল ক্রিশ্চানিটির নবীন শাখা, প্রতিবাদী শাখা, প্রোটেস্টান্টিজম। প্রশস্ত করে দিয়েছিল রেনেসাঁসের পথ, নাড়িয়ে দিয়েছিল মানুষের অন্ধবিশ্বাসের শেকল, যুক্তির রাজ্যে পা রাখতে ভয় পায়নি ইউরোপের সাধারণ মানুষ।

মার্টিন লুথারের নামের মানরক্ষা করেছেন বটে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

মার্কিন দেশের মানুষদের মধ্যে নতুন করে জাগ্রত করেছেন যুক্তি, বিবেক, সাহস। প্রতিবাদের শক্তি, উচিত অনুচিতের ধারণা, মানবতাবোধের এই গোড়ার কথাগুলি নতুন করে শুনিয়েছেন।

মাত্র ২৬ বছর বয়েসে মন্টগোমারি শহরে কালো মানুষদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাস-বয়কটের বিদ্রোহী কাজে। তখনও বাসের সামনের দিকের সিটে কালো মানুষদের বসবার অধিকার ছিল না, তাদের উঠতে হত পিছনের দরজা দিয়ে। বসতে হত পিছনের আসনে। শ্রীমতী রোজা পার্কস, এক কৃষ্ণাঙ্গী, প্রথম এতে আপত্তি জানান। এরই স্মৃতিতে পিট সিগারের সেই প্রসিদ্ধ গান : ইফ ইউ মিস মি, অ্যাট দ্য ব্যাক অব দ্য বাস/ইফ ইউ ক্যান ফাইন্ড মি নো হোয়্যার/লুক ফর মি অ্যাট দ্য ফ্রন্ট অব দ্য বাস/আই উইল বি সিটিং রাইট দেয়ার’—এই বাস-বয়কটের সময়কারই কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদ-গীতি। ওই সময়েই জাতীয় নেতার পর্যায়ে উঠে পড়েন ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, এবং আমৃত্যু, অর্থাৎ ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সেই আসন থেকে তিনি সরেননি।

১৯৬৪তে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। কেননা শুধু বর্ণবিদ্বেষই নয়, তাঁর লড়াই ছিল আরও বিস্তৃত, ধনী-দুঃখীর লড়াই, যুদ্ধ ও শান্তির লড়াই। সকল প্রকার অসাম্য তাঁকে কষ্ট দিত। যিশুর শিষ্য হয়ে তিনি তা সহ্য করতে রাজি ছিলেন না। এবং প্রকাশ্যেই সেকথা বলতেন। সবরকমের অসাম্যের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়তে হবে, শুধুই সাদা-কালো নয়, ধনী-দরিদ্রের এই ফারাক না কমালে ব্যক্তির স্বাধীনতা আসবে না।

কিন্তু কিং সরকারকে খেপিয়ে দিলেন। ভিয়েতনাম বিরোধী কথাবার্তা বলছিলেন তো বটেই, এবারে মুখ খুললেন ধনী দরিদ্রের অসাম্যের বিষয়ে। তাঁকে কমিউনিস্ট দরদী বলে গ্রেপ্তার করার কথা ভাবা হল। ইতিমধ্যে তো FBI-এর সভাপতি হুভার তাঁর ঘরের ফোন ট্যাপ করানোর বন্দোবস্ত রেখেছেন। এবং তাঁকে ‘বিশাল মিথ্যুক’ বলে গাল পেড়েছেন, যেহেতু মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন যে FBI অসহায়কে যথেষ্ট সহায়তা দেয় না। নিরাপত্তা দেয় না। তাঁর কথা যে মিথ্যা ছিল না, কতদূর সত্য ছিল, তারই প্রমাণ মিলল যেদিন মেমফিসের মোটেলের বারান্দায় বেড়ানোর সময়ে একজন সাদার্ন বন্দুকবাজ মৌলবাদী তাঁকে হত্যা করল। ঠিক তার আগের রাতেই, মেমফিসে বিশাল মিটিং হয়েছিল, বেতারে ‘ঝড়ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা’ ঘোষিত থাকা সত্ত্বেও প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল তাঁর ভাষণ শুনতে।

সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পর্বত শিখরে আরোহণ করেছি—আমি সামনেই আমাদের পবিত্র প্রার্থিত ভূমি দেখতে পাচ্ছি—আর দেরি নেই। আমার মনে সংশয় নেই, ভয় নেই। হয়তো আমি আপনাদের সঙ্গে একসঙ্গে সেই মুক্তাঞ্চলে পৌঁছুতে পারব না, কিন্তু পৌঁছে একদিন আমরা যাবই। আমার মনে কোনও মানুষকে আর ভয় নেই—কেননা ঈশ্বরের মুখ আমি দেখেছি’—প্রায় দৈববাণীর মতো সেই শেষ ভাষণ। পরদিনই ঘাতকের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়।

.

মার্টিন লুথার কিং বারবার নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন তাঁর অহিংসার নীতি, সত্যাগ্রহের নীতি, নির্ভীক, নিরস্ত্র মানুষের অহংকৃত প্রতিবাদের নীতি গান্ধিজির কাছে শেখা। মৃত্যুও হল তাঁরই মতো, ঘাতকের হাতে। গান্ধির মৃত্যুর সময়ে কিংয়ের বয়স ছিল উনিশ।

১৯৫১ সালে যখন তিনি ত্রিশ বছরের যুবক, কিং এসেছিলেন ভারতবর্ষে। গান্ধির ভারতবর্ষে। তাঁর গভীর খ্রিস্ট বিশ্বাসের সঙ্গে সহজেই মিশে গিয়েছিল গান্ধির শান্তির দর্শন।

কিংয়ের একটি বইয়ের মলাটে একবার দেখেছিলাম, বক্তৃতারত কিং, দেওয়ালে গান্ধিজির হাসিমুখের মস্ত বড় ছবি। দেখে মনে হয়েছিল এই তো, আমাদেরই নিজের লোক।

এরকম মনে হয়েছিল আরেকবারও—সেদিন কিন্তু খুব অবাক হয়েছিলাম কেননা খবরটা আগে থেকে জানা ছিল না। নবজাত ইজরায়েলের সর্বজনপ্রিয় নেতা, গুরুই বলা যায় তাকে—বেন গুরিয়ন-এর বসতবাড়ি দেখতে গিয়ে এমনই অবাক হয়েছিলাম। তাঁর শোবার ঘরে, খাটের পাশে দেওয়ালে কেবল একটাই ছবি আছে। গান্ধিজির মুখ।

স্বদেশে যখন আমরা গান্ধিজির সমালোচনা করি, তখন জানতেও পারি না, বিদেশের আদর্শবাদী নেতাদের ওপর তাঁর নীতির প্রভাব কতটা।

মার্টিন লুথার কিং যাদুঘরটিতে প্রধানত আছে তাঁর জীবনের ইতিহাস এবং দক্ষিণাঞ্চলের কালো মানুষদের অত্যাচার ও মুক্তির কাহিনী।

এই তো, এই তো মেমফিসের পদযাত্রা। একজন নেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার পরেও যে-যাত্রা স্তব্ধ হয়নি, গন্তব্যে পৌঁছেছিল।

ওই তো ওখানে বাস-বয়কটের ছবি, ওই যে ওইখানে বাস-ডিপোতে গিয়ে কিংয়ের দলবদ্ধ প্রতিবাদ, বক্তৃতা!

কালো মানুষদের প্রতিবাদের একটা জরুরি ভাষাই হল গান। সেই ক্রীতদাসত্বের দিন থেকে চলে আসছে গানের মধ্য দিয়ে কথা বলার অভ্যাস। এই মিউজিয়মেও বিভিন্ন অংশে প্রতিবাদী গান বাজছে, বিশেষত যেখানে সাদা এবং কালো মানুষদের একসঙ্গে পদযাত্রা দেখানো হয়েছে কয়েক সারি প্রমাণ সাইজের মূর্তি বানিয়ে—যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষরাও সামিল হয়েছেন সেই দীর্ঘ যাত্রায়—সেখানে বাজছে হাততালি দিয়ে দিয়ে সেই গান : উই শ্যাল ওভারকাম! আমার স্বভাব অনুযায়ী আমিও তালি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেই স্থির শোভাযাত্রার সঙ্গে, মনে মনে সামিল তো ছিলামই সেই ওয়াশিংটন পদযাত্রার। আজ যেন পা মেলাতে পারলুম। আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমার অনুতে অনুতে গভীর শিহরণ লাগল, গলা মেলালুম, আপনিই ছন্দে ছন্দে হাতে তালি বেজে উঠল—‘উই শ্যাল ওভারকাম’।

জয় আর উজ্জয়ন্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা মিউজিয়ামের গোলকধাঁধায় ঘুরছি, ওরা ঢোকেনি সব ঘরে। বোরড হয়ে গেলেন কোথায় দুই অধ্যাপক মশাই? কাছাকাছি কোনও কাফেটেরিয়া আছে? কফি? বিয়ার? নেই। তবে?

ওদের খুঁজে পাওয়া গেল কাছেই। মিউজিয়ামের ছোট অডিটোরিয়ামে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। একের পর এক ডকুমেন্টরি দেখছে। শুনছে বিভিন্ন জনসভায় কিংয়ের ব্যাকুল, হৃদয়-কাড়া আবেদন, মনুষ্যত্বের কাছে,—সাহসের জন্য, বিশ্বাসের জন্য, প্রেমের জন্য, সাম্যের জন্য। যিশুর এবং গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রেরিত সেই আবেদনে সাড়া দেবে কি তাদের একদা নকশাল-অনুপ্রেরিত চিত্ত?

এবার গাড়িতে উঠতেই হচ্ছে।

নাঃ, হবে না সমাধিস্থলে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান। হবে না জন্মস্থানে প্রণাম রাখা। এসব কৃত্য মনে মনেই সেরে নিতে হবে। বাড়ির পথে নয়, ইন্দ্রাণীদের পার্টির পথে যাত্রা এখন। জয় পথে নেমে যাবে। মনপ্রাণ ভরে আছে।

আটলান্টাতে আজই শেষ দিন।

কাল ফেরত রওনা হচ্ছি নিউইয়র্ক।

—পথেই দেখিয়ে দেব মিলেনিয়াম ডোম, আর অলিম্পিক পার্ক—’ উজ্জয়ন্ত অভয় দিল গাড়ি চালাতে চালাতে। তারপর স্বর পাল্টে গেল। ‘নবনীতাদি, থ্যাংক ইউ! আজ যা দেখলাম না, মনে থাকবে। সত্যি, আশ্চর্য মানুষ ছিলেন কিং। আমরা তো অন্য জেনারেশন। উনি যা নিয়ে ফাইট করেছিলেন, তাঁর অনেকটাই জেতা হয়ে গিয়েছে এখন এদেশে—বর্ণবৈষম্যের চেহারা এখন অমন প্রকট নেই—খুব তলায় তলায় স্রোত বইছে অবশ্য এখনও—কিন্তু কী অসাধারণ সব স্পিচ! কী অসামান্য স্পিরিট! আমাদের দিনকাল পাল্টে গেছে, এমন স্পিরিটই আর দেখা যায় না। আদর্শবাদই নেই! শুনেছিলে, কী বলল একটা স্পিচে?—’উই মাস্ট লার্ন টু বি ডেনজারাসলি আনসেলফিশ’–কী অসাধারণ বাক্য-ভাবতে পার? টু বি ডেনজারাসলি আনসেলফিশ’-এত চমৎকার করে বলা—’

যাক। আমি খুশি। আমার দলে আরেকজনকে পাওয়া গেছে। কিং ভক্তদের দলে লোক বাড়ল। দুজন। মালা, উজ্জয়ন্ত। এরা তো কিংয়েরই আপন দেশের লোক, আটলান্টা শহরেরই বাসিন্দে।

—’বাচ্চাদের একদিন নিয়ে যেও, সেদিন ওদের বাড়িটা, সমাধিটাও দেখিও।’

–’আবার তুমি এস, তখন আমরা সবাই মিলে এসে বাকিটা দেখে যাব—‘ বলল মালা। এই তো ফিরেছি আটলান্টা থেকে। মাস খানেক? তারপরেই এগারোই সেপ্টেম্বর। হিম হয়ে টেলিভিশনে দেখছি নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের উড়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন। এই সেদিনই তো নিউ জার্সি থেকে ‘পাথ’ রেলওয়েতে করে এসে নামলুম ওদেরই গর্ভস্থ স্টেশনে! কিছু ধর্মোম্মাদ, নির্বিবেকী মানুষের হিংসা কীভাবে ধ্বংস করে মানব সভ্যতাকে—কত সহস্র নিরীহ প্রাণ অযথা বিনষ্ট করল নির্দ্বিধায়।

কিন্তু আরও ভয় পেলুম যখন শুনলুম সুস্থ মস্তিষ্ক মার্কিন প্রশাসন কীভাবে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চললেন, আর সমগ্র বিশ্ব তাতে সাড়া দিয়ে অবিকল শুনডি-হুনডির মতো ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ বলে নেচে উঠল। এর ফল কী?

আজ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যদি বেঁচে থাকতেন, তাঁর বয়স হত মাত্র বাহাত্তর, তাঁর কণ্ঠস্বর নিশ্চয় ধ্বনিত হত আমেরিকার আকাশ বাতাসে। তাঁর অতি অল্প বয়সে, মাত্র আঠাশ বছর বয়সে মন্টগোমারির চার্চে (১৯৫৭) দেওয়া একটি ভাষণ আমার মনে পড়ছে।

—’কেন আমরা আমাদের শত্রুদের ভালোবাসব।’

—’যিশুর ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে এই শিক্ষাই—যে ঘৃণার বদলে ঘৃণা দিলে, পৃথিবীতে শুধু ঘৃণার পরিমাণটাই বেড়ে চলে, শুধু হিংসার পরিমাণই বেড়ে যায়। তুমি আমাকে মারলে, আমি তোমাকে মারলুম, আবার তুমি আমাকে মারলে, আবার আমি তোমাকে মারলুম। …এমনই করে তো অনন্তকাল চলতে থাকবে, তাতে হানাহানি থামতে পারে না। কোথাও কারুর যদি এতটুকু বোধবুদ্ধি থাকে, এবং তিনিই বলবান, শুধু বলবান ব্যক্তিই এই হানাহানির শেকল ছিঁড়ে, ঘৃণার শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন। ঘৃণার স্বভাবই এই যে হিংসার বাঁধন সে কাটতে পারে না, নিজেই বন্দী হয়ে পড়ে আর জগতে কেবলই অশুভের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

হ্যাঁ আজ তীব্রভাবে প্রয়োজন হয়েছে আরও একবার কথাগুলি স্মরণ করবার। ‘পর্বতশীর্ষে উঠে’ তিনি কি সত্যিই দর্শন পেয়েছিলেন সেই স্বপ্নের, সেই ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’-র? কবে আসবে তাঁর সেই প্রতীক্ষিত শান্তির, প্রেমের অহিংসার শুভমুহূর্তটি?

আমরা দিন গুনব।

উই শ্যাল ওভারকাম, সাম ডে!

প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ অক্টোবর ২০০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *