আইডেন্টিটি
অটোটা সিগন্যালে আটকে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটার পেটের পাইপ থেকে নরকের সমস্ত বিষ কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাসে মিশছে। নাকে রুমাল চেপেও দৃশ্যটা হজম করতে পারল না তনুশ্রী। অটোর ভিতর দিকে মুখ ফেরাল। ফেরাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল একজন আধো-চেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভদ্রলোক হাসলেন ওর দিকে তাকিয়ে, চিনতে পারছেন, আমি কিংশুক!
হ্যাঁ পারছি, আবার পারছিও না। কোথায় আলাপ হয়েছিল বলুন তো?
আপনাদের অফিসে। অনিরুদ্ধদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, কিংশুক বলল।
ও, আচ্ছা। কিন্তু আমি আর ওই চ্যানেলে কাজ করি না, তনুশ্রী গম্ভীর হয়ে গেল।
সরি, আমি জানতাম না! কিংশুক অপ্রস্তুত।
না না, ইটস ওকে, তনুশ্রী হাসল, আপনি এখনও সেই খবরের কাগজে আছেন? ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিংশুক কী কাজ করত।
খবরের কাগজ তো নয়, ট্যাবলয়েড, কিংশুক একটু নরম গলায় বলল।
ও হ্যাঁ, তাই তো, বলতে বলতেই একটা ফোন এল তনুশ্রীর মোবাইলে, ও সেটাতে হাবিজাবি কয়েকটা কথা বলেই রেখে দিল। কিংশুককে বলল, আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল জানেন। আমি পরের স্টপে নেমে যাব, আপনার নম্বরটা একটু দেবেন?
নিশ্চয়ই।
তনুশ্রী নেমে যাওয়ার পর কিংশুক আকাশ-পাতাল ভাবতে শুরু করল। তনুশ্রীরও চাকরি গিয়েছে চ্যানেল থেকে? আশ্চর্য! কই অনিরুদ্ধ তো তাকে এই কথাটা জানায়নি! অবশ্য অনিরুদ্ধর সঙ্গে কিংশুকের কথাবার্তার মধ্যে তনুশ্রীর প্রসঙ্গ ওঠেওনি ইদানীং। আগে আগে তনুশ্রীকে দেখিয়ে অনিরুদ্ধ বলত, কী স্কিন দেখেছিস মাইরি! একদম মোম-পালিশ। মৈনাক পাল পেলেই সলতেয় আগুন ধরিয়ে দেবে।
কিংশুকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হত, প্রমিত ব্যানার্জি পেলে দেবে না? কিন্তু করত না। সেই সময়টা ও অনিরুদ্ধর চ্যানেলে চাকরি খুঁজতে গিয়েছে আর অনিরুদ্ধ প্রমিত ব্যানার্জির খোচর।
সময়ে কী-ই না বদলায়। সেই অনিরুদ্ধর চাকরি গেল। প্রমিত ব্যানার্জির বদান্যতাতেই। ফোকটে মাল খেয়ে অনিরুদ্ধ কত কাঁদল, কত খিস্তি করল প্রমিত ব্যানার্জিকে! একবার বলল, সই জাল করেনি, আবার বলল যদি করেও থাকে সেটা কী এমন অপরাধ? সব বলল, শুধু তনুশ্রীর যে চাকরি নেই, সেই কথাটা বলল না। কিন্তু তনুশ্রী ওকে কী বলবে?
দিন তিনেকের মাথায় সত্যিই তনুশ্রীর ফোন এল এবং তার পরদিনই একটা ছাপোষা রেস্তরাঁয় তনুশ্রীর মুখোমুখি বসে কিংশুক টের পেল যে-কোনও আকর্ষণের পিছনেই থাকে শরীর।
আপনি জানেন, কেন আমার চাকরি গেল ওই চ্যানেল থেকে? তনুশ্রী কিংশুকের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল।
না, জানি না। ইনফ্যাক্ট জানতে চাই-ও না, কিংশুক বিব্রত গলায় বলল।
না, আপনাকে জানতে হবে…
তনুশ্রী ওর হাতের আঙুল দিয়ে কিংশুকের আঙুলগুলো ছুঁল।
আবারও সেই বিদ্যুৎ! কিংশুক অসহায় মুখ তুলে বলল, বলুন।
আপনি জানেন, আমাদের চ্যানেলে খোলাখুলি দ্বিচারিতা চলত? একদল লোক মাইনে পাচ্ছে না, আর একদল লোক নিজের কানেকশন খাটিয়ে মাসের প্রথমে দিব্যি নিজের চেকটি তুলে নিচ্ছে। আমি মাইনে পাচ্ছিলাম না, কারণ আমি যার আন্ডারে ছিলাম সে পাওয়ারফুল এবং সে আমার সঙ্গে শুতে চাইছিল।
কিংশুক একটু চমকে গিয়ে বলল, খোলাখুলি?
ওই আর কী! বলছিল তুমি কত সেক্সি, তোমাকে দেখলেই আমার ভিতরে একটা ব্লাস্ট ফার্নেস জ্বলে ওঠে, আমি কি তোমার স্পর্শ পেতে পারি না সোনা?
আপনি চুপচাপ শুনছিলেন?
শুনছিলাম এবং অ্যাভয়েড করছিলাম। অ্যাভয়েডই করতাম, যদি না ওই অনিরুদ্ধ এসে আমার মাথাটা খেত।
অনিরুদ্ধদা? অনিরুদ্ধদা কী বলল আপনাকে?
অনিরুদ্ধ আবার দাদা! ঠোঁট বেকাল তনুশ্রী। তারপর বলল, আমি ওকে মৈনাক পাল আমাকে কী বলে না বলে তার কোনও হদিশ দিতে চাইনি। কিন্তু আমি কেন প্রাইম টাইমে খবর পড়ার অ্যাসাইনমেন্ট পাচ্ছি না, তাই নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে করতে ও আমাকে এমন একটা প্ল্যান দিল যে আমি ভিজে গেলাম। তা ছাড়া প্রমিত ব্যানার্জিকে ধরে আমার বাবার চিকিৎসার জন্য পঁচিশ হাজার টাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বলাতে আমি খুব কৃতজ্ঞ হয়ে পড়লাম ওর ওপর।
কী হয়েছে আপনার বাবার?
সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল, সেখান থেকে প্যারালিসিস। বিছানাতেই পড়ে আছে, শুধু নীচের ঠোঁট আর বাঁ হাতটা নাড়তে পারে একটু। অনিরুদ্ধ তখন আমাকে পঁচিশ হাজার অ্যাডভান্সের কথা বলে হাজার পনেরো মতো পাইয়ে দিয়েছিল আর আমিও ওর কথামতো মৈনাক পালকে কেস দিলাম।
কীভাবে?
মৈনাকের কাছে গিয়ে নরম করে বললাম, আমি কেন চান্স পাচ্ছি না। মৈনাক কোনও কথা না বলে আমার কোমরে পিঠে হাত বোলাতে শুরু করল। ড্রাঙ্ক ছিল বোধহয়, কথা বলতে আরম্ভ করল। ভাটের কথা। বলতে বলতে যেই না আমি কী দিলে ও আমাকে কী দেবে, সেই টপিকে এসেছে, আমি মোবাইলে রেকর্ড করতে শুরু করলাম। সেই পুরো রেকর্ডিংটা পরদিন প্রমিত ব্যানার্জির সামনে ফেলে দিলাম।
অনিরুদ্ধ ছিল না সামনে?
থাকবে না কেন, ওই তো আমাকে প্রমিত ব্যানার্জির কাছে নিয়ে গেল। তারপর গোটা অফিসে চাউর করল ব্যাপারটা। হইহই পড়ে গেল একেবারে। মৈনাক পাল যার রিক্রুট ছিল, সেই বিশাল শ্রীবাস্তব কলকাতায় এসে এনকোয়ারি শুরু করলেন। আমাকে ডাকা হল দু’বার, আমি গেলাম। চাকরি থেকে স্যাক করা হল মৈনাক পালকে।
ওর সব রাগ গিয়ে পড়ল আপনার ওপর?
না, মৈনাক পাল তো বম্বে চলে গেল। কিন্তু আমার বাঁশ হল যে, আমি ব্র্যান্ডেড হয়ে গেলাম।
কার কাছে?
দেখুন, এখানে মুখে যে যাই বলুক, সিনেমা-টিভির লাইনে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট নিয়ে খোলাখুলি নালিশ জানিয়েছে যে-মেয়ে, তাকে পাঁচজন একটু সমঝে চলে।
মানে অ্যাভয়েড করে। তাই তো? কিংশুক হাসল।
এগজ্যাক্টলি। আমি যে আসলে আমার প্রাপ্য এক্সপোজার চাইছিলাম, প্রতিবাদ করে কঁসির রানি লক্ষ্মীবাই হতে চাইছিলাম না, সেই ব্যাপারটাই আড়ালে চলে গেল। তার সুযোগ নিল প্রমিত ব্যানার্জি। ও এবার আমাকে ওর ঘরে ঢোকাতে চাইল।
কিন্তু ও তো জানত, আপনি মৈনাক পালের কী হাল করেছেন!
সেজন্যই তো ও শিয়োর ছিল যে, আমি ওর ক্ষেত্রে উচ্চবাচ্য করব না। কারণ ওই ঘটনার পর থেকে আমি তো গোটা অফিসেই প্রমিত ব্যানার্জির লোক বলে চিহ্নিত হয়ে গেছিলাম। ইনফ্যাক্ট অনিরুদ্ধই ছড়িয়েছিল যে, আমি প্রমিতের লোক বলেই মৈনাক পাল আমাকে টরচার করছে। এবার আমি যার লোক, তার বিরুদ্ধেই যদি আমি অভিযোগ করতে যাই, লোকে হাসবে না!
আপনি চুপ করে রইলেন?
ভেসে থাকার চেষ্টা করলাম, যতটা পারলাম। কিন্তু বুঝতেই পারছিলাম প্রমিত ব্যানার্জির কাছে টোটাল সারেন্ডার না করলে ওখানে টিকে থাকা যাবে না।
করলেন?
মৈনাক পালের কাছেই করতে পারতাম, যদি সারেন্ডার করার হত!
চাকরি ছাড়লেন?
ছাড়তে পারতাম না, যদি মৃদুলদা হেল্প না করত।
বিষম খেল কিংশুক, মৃদুল ঘোষ?
হ্যাঁ, তনুশ্রীর গলায় রাজ্যের বিষণ্ণতা। সেই কোন ছোটবেলায় আমি টুকটাক কাজ করেছিলাম মৃদুলদার সঙ্গে। তখন থেকেই আমাকে ছোট বোনের মতো ভালবাসত মৃদুলদা। আমার অবস্থা জেনে ও-ই আমাকে মডেলিং-এ ব্রেকটা দিল।
মডেলিং-এ? কিংশুকের গলায় বিস্ময়।
হ্যাঁ, প্রথমে একটা গ্যাস ওভেনের কাজ। পরে শাড়ি, হাওয়াই চপ্পল। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুটোতেই কাজ করতাম এবং টাচউড কাজ দেখেই কাজ আসছিল। কিন্তু মৃদুলদা আনফরচুনেটলি…
আপনার সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছিল মৃদুলদার? কিংশুক একটা বিস্ময়ের ঘোর থেকে উঠে এসে বলল।
রোজই তো হত।
যেদিন মৃদুলদা মারা গেল সেদিন হয়েছিল?
কেন বলুন তো? চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল তনুশ্রী।
না, এমনিই। বাই দ্য ওয়ে আপনি এখন কী করছেন? মানে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন কেন? কিংশুক পরিষ্কার জিজ্ঞেস করল।
তনুশ্রী বোঝাতে শুরু করল ওর কাজ। ও অনেক কষ্ট করে একটা পাবলিক রিলেশনস এজেন্সি খুলেছে। সেই এজেন্সি একদিন বড় হবে, ওর আশা।
কিংশুক কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। ওদের সামনে চাউমিন গরম থেকে ঠান্ডা হচ্ছিল। কিংশুক শুধু টের পাচ্ছিল মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, দু’চোখে ঘন কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দেওয়া একটা মেয়ের ফুঁ দিলেই উথলে ওঠা শরীর, তার উলটোদিকে সদ্য তিরিশ ছাড়ানো পুরুষের শরীরে জাগিয়ে তুলেছে ঈপ্সা, যে-ঈপ্সা যে-কোনও মূল্যে গ্রাস করতে চায় ঈপ্সিতকে। গ্রাস করতে চাইছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃদুলদার প্রসঙ্গ এল। ট্রেনের নীচে নিমেষে বডি হয়ে যাওয়া মৃদুলদাই যেন কিংশুককে মনে পড়িয়ে দিল ও এড়িয়ে না গিয়ে তনুশ্রীর সঙ্গে যার টানে দেখা করতে এসেছে তা কতটা নশ্বর!
তনুশ্রী বলছিল ওরা কীভাবে প্রোমোট করে এক-একজন মানুষ কিংবা সংস্থাকে। ধরা যাক, কোনও একজন গায়িকা নিজের গান শোনাতে চাইছেন খ্যাতনামা কোনও সংগীত পরিচালককে। এবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই গায়িকার ইমেল এবং তার সঙ্গে তার গানের অ্যাটাচড ফাইল চলে গেল সেই সংগীত পরিচালকের কম্পিউটার ঠিকানায়। কিন্তু এখানে যেহেতু এভাবে এখনও কাজ হয় না, তাই কিংশুকের সাহায্য চাই তনুশ্রীর। ওর এজেন্সি যাদের প্রোমোট করবে, কিংশুক যদি তাদের বিষয়ে মাঝে মধ্যে ওর ট্যাবলয়েডে একটু লেখে তা হলে তনুশ্রীর কাজটা সহজ হয়। এটা যে প্রকারান্তরে একজন সাংবাদিককে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা, তনুশ্রীর মাথায় সেটা কোনওভাবে কাজ করছিল না বলেই কিংশুকের মনে হচ্ছিল। ও ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে ওকে বোঝাচ্ছিল একটা আর্ট গ্যালারির এগজিবিশন কভার করতে গিয়ে কিংশুক যদি ওর ক্লায়েন্ট কোনও আর্টিস্টকে একটু বেশি কভারেজ দেয়, তা হলে তার ছবি বেশি বিক্রি হওয়ার একটা চান্স থাকবে। আর সেটা বাস্তবায়িত হলে তনুশ্রীর এজেন্সি একটা মোটা কমিশন পাবে, যার একটা ভাগ ও নিশ্চয়ই কিংশুককে দেবে।
রেস্তরাঁ থেকে বেরোনোর সময় ও তনুশ্রীকে বলল, আমার মনে থাকবে। আমার পক্ষে যখন যেটুকু সম্ভব আমি নিশ্চয়ই করব।
তনুশ্রী ওর হাতটা নিজের দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। নেক্সট ট্রিটটা কিন্তু আমি দেব।
আমাদের আবার দেখা হচ্ছে তা হলে?
নিশ্চয়ই। আমরা পরস্পরের বন্ধু হলাম তো নাকি? তনুশ্রী খুব আন্তরিক গলায় বলল। তারপর গলা একটু নামিয়ে বলল, আমাকে একটা ব্যাপারে একটু হেল্প করবে তুমি?
কোনও ভূমিকা ছাড়াই ‘তুমি’ ডাক শুনে একটু চমকে গেল কিংশুক। তাও স্বাভাবিক গলাতেই বলল, বলুন। নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।
তনুশ্রী বলল, আমি না এজেন্সি শুরু করার সময় মৃদুলদার থেকে কুড়ি হাজার টাকা লোন নিয়েছিলাম, মানে মৃদুলা নিজের থেকেই দিয়েছিল।
তো? কিংশুক ওর দিকে সোজাসুজি তাকাল।
না, মানে মৃদুলদা তো আর নেই, এখন আমি যদি কোনওদিন টাকাটা ফেরত দিতে পারি তা হলে কাকে দেব?
এই কথাটা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন তনুশ্রী? কিংশুকও ‘তুমি’ করে বলল ওকে।
তুমি যে বললে তুমি মৃদুলদার কত ক্লোজ ছিলে…
কিংশুক দু’দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, উফ মৃদুলদার ব্যাপারে আমি এত কথা কেন যে বলি…
কী বলছ? তনুশ্রী জিজ্ঞেস করল।
কিংশুক গলায় একটু মিষ্টতা এনে বলল, শোনো তনুশ্রী, তুমি যদি এই কথাটা আমাকে এটা দেখানোর জন্য বলে থাকো যে তুমি কত সৎ, তা হলে আমি চেষ্টাচরিত্র করে তোমাকে মৃদুলদার এক দিদির ঠিকানা জোগাড় করে দেব। আর যদি সাজেশন চাওয়ার জন্য বলল, তা হলে বলব মৃদুলদা দিয়েছিল, তুমি কাজে লাগিয়েছ। ব্যস। ব্যাপারটা ভুলে যাও।
তনুশ্রী একটু আহত গলায় বলল, আমি কিছু দেখানোর জন্য বা প্রমাণ করার জন্য বলিনি। আমি সত্যিই ভীষণ কৃতজ্ঞ মৃদুলদার কাছে। যেখানে প্রত্যেকটা সম্পর্কই হরেদরে একটা ব্যাবসা, সেখানে মৃদুলদা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে মানুষকে ভালবাসতে জানত।
মৃদুলদা সম্পর্কে আমাকে অত জ্ঞান দিয়ো না তনুশ্রী, ওকে ছোট থেকে চিনি।
তনুশ্রী হাসল, চিনতেই পারো কিন্তু একটা মেয়ে যেভাবে চেনে, সেভাবে তো চেনো না। মৃদুলদা সেই বিরল প্রজাতির পুরুষ ছিল, অন্ধকারে যাদের চোখ জ্বলে উঠত না।
কথাটা যেন ধাক্কা মারল কিংশুককে। ও খপ করে দুটো হাত চেপে ধরল তনুশ্রীর, আমাকে কীরকম পুরুষ বলে মনে হয় তনুশ্রী? অন্ধকারে আমার চোখ জ্বলে, না জ্বলে না?
তনুশ্রী হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, আমি জানি না কিংশুক।
কিংশুক ওর আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল, তোমার ডাকে যে দুম করে চলে এলাম, তোমার কথা যে এতক্ষণ ধরে শুনলাম তার একটা কারণ তো তোমার চেহারা, তোমার সেক্স অ্যাপিল।
তনুশ্রী মাথা নিচু করে বলল, তাতে তো দোষের কিছু নেই।
আছে তনুশ্রী। মৃদুলদা যদি স্ট্যান্ডার্ড হয়, তা হলে আছে। মুখে বলছি বন্ধুত্ব কিন্তু ভিতর-ভিতর তার মধ্যে অন্য আকর্ষণ কাজ করছে, এটা কি দ্বিচারিতা নয়?
না। আমি জানি, আমাকে দেখলে লোকের ভাল লাগে। সেই ভাল লাগাটা তো আমারও ভাল লাগে। যদি না লাগত তা হলে তো আমি উলোঝুলো হয়ে থাকতাম। সাজগোজ করতাম না, তনুশ্রী আস্তে-আস্তে বলল।
কিছু মনে কোরো না, একটা কথা বলছি, তোমরা যারা মডেলিং কিংবা অভিনয় করো, তাদের কাছে তো শরীরটা একটা ক্যাপিটাল।
যারা খেলাধুলো করে তাদেরও। যারা রাত জেগে পড়াশোনা করে, তাদেরও। যারা তোমার মতো কাগজে লেখে, তাদেরও। শরীর শুধু ক্যাপিটাল নয়, আইডেন্টিটি কার্ড। হাজার ভালবাসলেও মৃদুলদাকে আমরা আর দেখতে পাব?
পাব না ঠিকই। কিন্তু মৃদুলদার স্মৃতি আমার শারীরিক অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে, আমার নার্ভগুলো দপদপ করে, আমি ঘুমোতে পারি না রাতে।
তুমি যোগাসন করো কিংশুক। আমারও তো কত প্রবলেম! কিন্তু আমি জানি রাতে আমাকে সাত ঘণ্টা ঘুমোতে হবেই, তনুশ্রী সিরিয়াস গলায় বলল।
কিংশুক হো-হো করে হেসে ফেলল যোগাসনের কথা শুনে। ওর ভিতরে একটা রিলিফ কাজ করতে শুরু করল। সেই ছোট্ট খাঁচা, যেখানে শরীর আর মন দু’জনেই এ ওর পিছনে শুধু দৌড়োয়, খুলে গেল দুম করে। সেই খুলে যাওয়ার ধাক্কায়ই হয়তো হঠাৎ বাজ পড়ল কাছে-দূরে। বৃষ্টি শুরু হল হুড়মুড়িয়ে। ছাতাবিহীন কিংশুক আর তনুশ্রী ছুটে গিয়ে একটা গাড়ি-বারান্দায় আশ্রয় নিল। মুহুর্মুহু বাজ পড়ছিল। তনুশ্রী আরও একটু সরে এসে কিংশুকের কাঁধে মাথা রাখল।