আইডার ফুলের কথা
ছোটোমেয়ে আইডা বলল, “আহা, আমার ফুলগুলো সব শুকিয়ে গেছে, দেখেছ।” কৌচের উপর ওর পাশে একজন ছাত্র বসেছিল ; আইডা তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কালকে এত সুন্দর দেখতে ছিল আর এরই মধ্যে সব নুইয়ে পড়েছে ! এর কি কারণ বলতে পার ?” ছাত্রটিকে তার বড়ো পছন্দ ছিল, কেমন গল্প বলত সে, কেমন কাগজ কেটে কত কি সুন্দর-সুন্দর জিনিস বানিয়ে দিত, হরতনের মধ্যে ক্ষুদে-ক্ষুদে মেয়েরা নাচছে, কতরকম ফুল, উঁচু-উঁচু রাজবাড়ি, তার দরজা খোলা যায়, এই-সব। ছাত্রটি বলল, “ওমা, তাও জান না ? কাল যে তোমার ফুলরা সব নাচ-সভাতে গিয়েছিল, তাই এখন ক্লান্ত হয়ে মাথা ঝুলিয়ে রেখেছে।” শুনে আইডা অবাক । “সে কি ! ফুলরা আবার নাচে নাকি ?” “তা আর নাচে না ! যেই-না অন্ধকার নামে আর আমরা সবাই শুয়ে পড়ি, ফুলরা নেচেকুদে একাকার হয় ! প্রায় রোজ রাতে ওদের নাচ-সভা বসে ” আইডা জিজ্ঞাসা করল, “ছোটো ছেলেমেয়েরা ঐ নাচ-সভায় যেতে পারে না ?” ছাত্রটি বলল, “নিশ্চয়ই । ডেজি ফুলরা যায়, পাহাড়তলির লিলি ফুলরা যায়।” “সবচেয়ে সুন্দর ফুলরা কোথায় নাচে ?” “কেন, রাজার গ্রীষ্মাবাসের সামনে, মস্ত বাগানে যাও নি কখনো ? সেই যে-জায়গাটা ফুলে ফুলে ঠাসা ?” আইডা বলল, “আরে, কালই সেখানে মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম, কিন্তু গাছে তো একটাও পাতা ছিল না, কোথাও একটা ফুল দেখলাম না। সেগুলোর কি হল বল দিকিনি ? বসন্তের শেষে কত ফুল দেখেছিলাম।” ছাত্রটি বলল, “সব ফুল এখন রাজবাড়ির মধ্যে। যেই-না রাজা গ্রীষ্মের শেষে রাজবাড়ি ছেড়ে, সভাসদদের নিয়ে, শহরে চলে যান, অমনি ফুলরা সবাই বাগান ছেড়ে প্রাসাদে ঠাঁই নেয়। সেখানে তারা কি আমোদ-আহলাদে মেতে ওঠে, সে যদি একবার দেখতে ! সবচাইতে সুন্দর দুটি গোলাপ ফুল রাজা-রানী সেজে সিংহাসনে চড়ে বসে। লালমোরগ ফুলরা নিচু হয়ে তাদের কুর্নিশ করে, সারি দিয়ে সামনে বসে পড়ে। তার পর সবচাইতে সুন্দর ফুলরা নাচ শুরু করে। নীল ভায়োলেট ফুলরা শিক্ষানবীশ নাবিক সাজে, তাদের সঙ্গে নাচে সুন্দরী মেয়ে সেজে যত সব হায়াসিন্থ আর ক্রোকাস ফুল। টিউলিপ ফুলরা আর লম্বা-লম্বা কমলা রঙের লিলি ফুলরা মা-ঠাকুমা সেজে চারদিকে চোখ রাখে, যাতে সবাই সভ্যভব্য হয়ে চলে ।” আইডা আশ্চর্য হয়ে বলল, “কিন্তু রাজার প্রাসাদে কি ফুলরা-কখনো নাচের আসর করতে পারে ?” ছাত্রটি বলল, “আরে, কেউ কিছু জানতে পারলে তবে তো ! হয়তো রাতে একবার বুড়ো সরকারমশাই প্রকাণ্ড চাবির গোছা হাতে নিয়ে দেখে শুনে যান সব ঠিক আছে কি না, কিন্তু যেই-না চাবির গোছার ঝুনঝুন শব্দ তাদের কানে যায়, ফুলরাও অমনি নাচ থামিয়ে, জানলার লম্বা-লম্বা রেশমী পরদার পিছনে লুকিয়ে পড়ে। সরকারমশাই বলেন, ‘ফুলের গন্ধ পাচ্ছি যেন । কিন্তু ফুলটুল দেখতে পান না !” আইড়া তখন হাততালি দিয়ে বলে উঠল, “ভারি মজা তো ! আমি গেলে ফুলদের দেখতে পেতাম না ?” ছাত্রটি বলল, “তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পেতে । এর পরের বার রাজবাড়িতে বেড়াতে গেলে, জানলা দিয়ে একবারটি উঁকি মারলেই কিছু দেখতে পাবে। আমি আজ গেছিলাম, দেখলাম, কোঁচের উপর একটা লম্বা হলদে লিলি ফুল শুয়ে আছে। উনি কোনো সভাসদের স্ত্রী।” আইডা বলল, “সরকারি বাগিচার ফুলরাও ওখানে যেতে পারে নাকি ? অত দূর হাটতে পারে ওরা ?” “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ইচ্ছা করলেই ফুলরা উড়তে পারে। ঐ যে ফুলের মতো দেখতে লাল হলুদ সুন্দর প্রজাপতিরা, ওরা ফুল নয় তো কি ? বোটা থেকে লাফিয়ে উঠে, ছোটো-ছোটো পাখার মতো পাপড়ি নেড়ে, ওরা উড়ে বেড়ায়। ওরা যদি খুব লক্ষী হয়, তা হলে বোটার উপর চুপ করে বসে না থেকে, সারা দিন ওদের উড়ে বেড়াতে দেওয়া হয়, সেটাই হল ওদের পুরস্কার। তার পর পাপড়ির মধ্যে থেকে সত্যিকার ডান গজায়। অবিশ্যি এমনও হতে পারে যে সরকারি বাগিচার ফুলর খবরই পায় নি যে রাজবাড়িতে রোজ রাতে আমোদ-আহলাদ হয়। আমি হলপ করে বলতে পারি যে এর পর যেদিন তুমি সরকারি বাগানে বেড়াতে যাবে, একটি ফুলের কানে কানে যদি বলে আস যে রাজবাড়িতে রাতে নাচের আসর হবে, ফুল থেকে ফুলে খবরটা ছাড়িয়ে পড়বে আর রাতে সববাই সেখানে উড়ে গিয়ে হাজির হবে।
“ঠিক সেই সময় যদি বাগান দেখার ভার যাঁর উপরে সেই অধ্যাপকমশাই বাগানে এসে দেখেন যে ফুলরা কেউ নেই, তিনি ভেবেই পাবেন না তারা গেল কোথায় !” ছাত্রটির আজগুবি কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে আইডা বলল, “হ্যা, তাই বৈকি! বলি, ফুলের কানে কানে কি কথা বললাম, অন্য ফুলদের মধ্যে জানাজানি হবে কি করে ? ফুলরা তো কেউ কথা কইতে পারে না !” ছাত্রটি বলল, “তা পারে না মানছি, কিন্তু অঙ্গভঙ্গি করে মনের কথা প্রকাশ করতে তো পারে। এতটুকু বাতাস বইলে কেমন হেলেদুলে ওঠে দেখ নি ? ঐভাবে ওরা ওদের মনের কথা জানায়, ঠিক যেমন করে আমরা কথা বলি।” আইডা বলল, “আর অধ্যাপকমশাইও ওদের অঙ্গভঙ্গির মানে বুঝতে পারেন নাকি ?” “সে আর বলতে ! একদিন সকালে তিনি বাগানে এসে দেখেন কিনা লম্বা এক বিছুটিগাছ হাত-পা নেড়ে একটা সুন্দর লাল কার্ণেশন ফুলের সঙ্গে গল্পে মশগুল । বিছুটি বলল, “কি সুন্দর দেখতে তুমি । তোমাকে আমি কত ভালোবাসি।” কিন্তু এ-সব ব্যাপার অধ্যাপকমশাই আদৌ পছন্দ করেন না । তিনি বিছুটির পাতায়, পাতাগুলোই ওদের আঙল কিনা—জোরে একটা টোকা লাগালেন। লাগিয়েই সে কী জুলুনি, তার পর থেকে অধ্যাপক আর বিছুটির গায়ে আঙলটি তোলেন না।” আইডা হা-হা করে খানিকট হেসে বলল, “কি বোকা রে বাবা ”
সেদিন পরিদর্শকমশাই বেড়াতে এসেছিলেন, ওঁর কথা শুনলে আইডার ভারি বিরক্ত লাগে । মাঝখান থেকে তিনি নাক গলিয়ে ছাত্রটিকে বললেন, “আচ্ছা, এ-সবের মানে কি ? যত রাজ্যের বাজে কথা ছেলেপিলের মাথায় ঢোকাচ্ছ !” ছাত্রটির উপরে উনি হাড়ে চটা । যখনই তাকে পীচবোর্ডের ছবি কাটতে দেখতেন, তখনই বকবকি শুরু করে দিতেন। অথচ কি চমৎকার সব ছবি কাটত সে, একটা লোক ফাঁসিকাঠে ঝুলছে, হাতে একটা হরতন, অর্থাৎ কিনা লোকের মন চুরি করেছে, লম্বা নাকের ডগায় স্বামীটিকে বসিয়ে ডাইনী-বুড়ি বাটায় চেপে চলেছে, এমনি ধারা কত কি ! পরিদর্শকমশাই আজকের মতো সর্বদাই বলেন, “ছেলেপিলের মাথায় এ-সব বাজে ক পুরে দেবার মানেটা কি ? যত রাজ্যের গাঁজাখুরি গল্প ” এদিকে আইডার কিন্তু মনে হল ঐ ফুলদের কথাটি সত্যি ভারি আশ্চর্য ; দিনরাত ওর সেই কথাই মনে পড়তে লাগল।
ওর মনে কোনোই সন্দেহ রইল না যে ওর নিজের ফুলগুলোর মাথা নুইয়ে রাখার একমাত্র কারণ হল সারারাত নাচার পর ওরা বেজায় ক্লান্ত, কাজেই যে সুন্দর টেবিলের উপরে ওর খেলনা সাজানো থাকত, ফুলগুলোকেও সেখানে নিয়ে গেল। সেখানে ক্ষুদে একটা খেলার খাটে আইডার পুতুলটি ঘুমিয়েছিল। আইডা তাকে বলল, “এবার উঠতে হবে, সোফি, আজ রাতে খুশিমনে টেবিলের টানায় ঘুমোও দিকনি। ফুল বেচারিদের শরীর খারাপ, ওরা তোমার বিছানায় শুয়ে পড়ুক। কাল সকালে হয়তো দেখব ওরা সেরে উঠেছে।” এই বলে পুতুলটাকে সে খাট থেকে তুলে নিল, অবিশ্যি তাতে পুতুলট খুব একটা খুশি হল তা মনে হল না ।
তার পর পুতুলের খাটে আইডা বাসি ফুলদের শুইয়ে দিল । বলল, “চুপ করে শুয়ে থাক, আমি তোমাদের জন্য চা করে নিয়ে আসছি। তা হলে কাল তোমরা সেরে উঠবে।” এই বলে আইডা খাটের চারদিকের পরদাটা ভালো করে টেনে দিল, যাতে রোদ লেগে ফুলদের চোখ না ঝলসে যায়। সারা বিকেল ছাত্রটির ঐ গল্প ছাড়া মনে কোনো চিন্তা নেই। রাতে শুতে যাবার আগে সে একবার জানলার কাছে ছুটে গেল, পরদার বাইরে মায়ের টিউলিপ তার হায়াসিন্থ ফুলর দাঁড়িয়েছিল । আইাঁ তাদের বলল, “আমি ঠিক জানি আজ তোমরা নাচ-সভায় যাবে।” ফুলগুলো কিন্তু একটা পাতা পর্যন্ত নাড়ল না, যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ! রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে আইডা ভাবল রাজবাড়িতে ফুলদের নাচ দেখতে না জানি কি ভালোই লাগে। তার পর মমে মনে বলল, “আমার নিজের ফুলরাও গেল কি না কে জানে ’ এ-সব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাতে একবার ঘুম ভাঙল। এতক্ষণ সে কত কি স্বপ্ন দেখছিল, ছাত্রের কথা, ফুলদের কথা, পরিদর্শকমশাইয়ের কথা। পরিদর্শকমশাই বলেছিলেন ও-সব কথা সত্যি নয়, চালাকি । ঘরের মধ্যে চুপচাপ, রাতের বাতিটি টেবিলের উপর জুলছে, মা-বাবা দুজনেই ঘুমিয়ে। আইডা মনে মনে বলল, “আমার ফুলগুলো এখনো সোফির খাটে শুয়ে আছে কি না কে জানে। একবার দেখতে ইচ্ছা করছে। এই ভেবে সে মাথাটি তুলে, দরজার দিকে তাকাল। দরজাটি আধখোলা, আইডা দেখল ফুল, খেলনা সব যেমন ছিল তেমনি আছে। কান পেতে সে শুনতে লাগল ; তখন মনে হল কে যেন পিয়ানো বাজাচ্ছে, কিন্তু এমন মৃদু এমন মিষ্টি পিয়ানোর সুর সে কখনো শোনে নি। ভাবল, ‘এবার নিশ্চয় ফুলরা নাচছে। বেজায় দেখতে ইচ্ছা করছে ? কিন্তু মা-বাবা যদি জেগে যান, এই ভয়ে আর ওঠা হল না । আহা, এ-ঘরে যদি একবার আসত ওরা ? তবু ফুলরা এল না, পিয়ানো বেজেই চলল, কি মিষ্টি সে সুর। শেষটা আর সে থাকতে পারল না, নাচ দেখতেই হবে । আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে আইডা দরজার কাছে গেল । আহা, কি আশ্চর্য জিনিসই-না দেখল ! এখন আর রাতের বাতিটি জ্বলছে না, কিন্তু জানলা দিয়ে চাদের আলো ঘরের মেঝেতে পড়েছে, ঘর আলোয় আলো । হায়াসিন্থ রা আর টিউলিপর দুই সারি বেঁধে দাড়িয়েছে, জানলার সামনে ফুলের টবগুলো খালি পড়ে আছে। কি নাচই-না হল ! কতরকম নকশাকাটা নাচ, এ ওর পাতায় পাতায় ধরাধরি করে । পিয়ানোর সামনে বসে ছিল মস্ত একটা হলদে লিলি ফুল, আইডার কেমন মনে হচ্ছিল ওকে আগেও নিশ্চয় কোথায় যেন দেখেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছাত্রটি একবার বলেছিল, এই হলদে লিলি ফুল দেখতে ঠিক লরাদিদির মতো, তাই শুনে সবাই খুব হেসেছিল। এখন ওরও মনে হল কথাটা ঠিকই, হলদে লিলি সত্যিই লরাদিদির মতো দেখতে, পিয়ানো বাজাবার ধরনটিও অবিকল এক, সেই একইভাবে লম্বা হলদে মুখটা একবার এপাশে একবার ওপাশে ফেরাচ্ছে আর তালে তালে মাথাটি নাড়াচ্ছে। এবার একটা লম্বা নীল ক্রোকাস ফুল এগিয়ে এসে একলাফে আইডার খেলনা রাখার টেবিলে চড়ল। চড়েই, সোজা খাটের কাছে গিয়ে পরদা সরিয়ে দিল। রুগ্ন ফুলগুলো শুয়েই ছিল, কিন্তু অমনি তারা উঠে পড়ে, অন্য ফুলদের নমস্কার করল। ফুলরা ওদের নাচে যোগ দিতে ডাকল। রুগ্ন ফুলর নেমে এল । দেখে মনে হল তাদের রোগটোগ সেরে গেছে, মহা ফুর্তিতে সকলের সঙ্গে ওরাও নাচতে লাগল। হঠাৎ একটা জোরে শব্দ শোনা গেল, কি যেন টেবিলের উপর থেকে ধপ করে পড়ল। আইডা তাকিয়ে দেখে পরবের দিন সকালে বিছানার উপর যে লাঠিটা পেয়েছিল, তার এখন ফুলের দলে ভিড়বার শখ হয়েছে। লাঠিটা সত্যি বড়ো সুন্দর দেখতে, হাতলের কাছে একটা মোমের পুতুল বসানো, তার মাথায় খাসা এক টুপি পরানো, টুপির চারদিকে লাল নীল রেশমী ফিতে বাঁধা । ফুলদের মাঝখানে লাঠিও ধেইধেই নাচতে শুরু করে দিল, সবার সঙ্গে মিলে পরম আনন্দে ঠুকঠুক করে লাফাতে লাগল । হঠাৎ লাঠির হাতলের মোমের পুতুলটা ফুলে ফেঁপে প্রকাণ্ড লম্বী চওড়া একটা দৈত্যের মতো হয়ে গিয়ে, চীৎকার করে বলল, “এসব কথা ছেলেপিলেদের মাথায় ঢোকাবার মানেট কি ? যত রাজ্যের বাজে গাঁজাখুরি গল্প সব !” এবার আইডা তাকিয়ে দেখল দুফোঁটা জল যেমন অবিকল একরকম দেখতে হয়, তেমনি পুতুলটা আর পরিদর্শকমশাইও একেবারে হুবহু একরকম দেখতে, আর মাথার টুপিটা পর্যন্ত ! পুতুলের মুখটাও অবিকল পরিদর্শকের হলুদ-পানা খুঁতখুঁতে মুখের মতো দেখাচ্ছিল । তার পরেই কিন্তু লাঠির গায়ের কাগজের ফুলর পুতুলটার সরু সরু ঠ্যাঙে এমনি চিমটি কাটতে লাগল যে দেখতে দেখতে যে-কে সেই, পুতুল আবার আগেকার সেই ক্ষুদে আকারটি ধরল। ব্যাপারটা আইডার কাছে এমনি মজার ঠেকল যে সে না হেসে পারল না । নাচ-সভার লোকো কিন্তু কেউ অতটা লক্ষ্য করে নি, কারণ লাঠি তো সমানে নেচেই চলেছিল আর হাতলে বসা পরিদর্শক-মুখে পুতুলও, তার ইচ্ছা থাক বা নাই থাক, সমানে নাচতে বাধ্য হচ্ছিল । কখনো বেচার রোগ হচ্ছে, কখনো মোটা হচ্ছে, কখনো লম্বা হচ্ছে, কখনো বেঁটে হচ্ছে, যতক্ষণ না ফুলরা ওর হয়ে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, অগত্য লাঠি ওকে ছাড়ান দিল । এদিকে টেবিলের টানায় আইডার পুতুল শুয়ে ; সেখান থেকে খুব জোরে ঠকঠক করে শব্দ হতে লাগল। সোফি ছাড়া আর কে ! এবার সে দেরাজ থেকে মাথা বের করে বলল, ‘ওকি ! তোমরা নাচ করছ নাকি ? আমাকে কেউ বলে নি কেন ?” বাদাম-ভাঙার জাঁতি বলল, “নাচবে নাকি আমার সঙ্গে ?” সোফি তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বলল, “হুঁ ! নাচবার আর সঙ্গী পেলাম না, ওঁর সঙ্গে নাচতে হবে!” এই বলে সে টেবিলের উপর বসে পড়ল, ইচ্ছাটা ফুলরা কেউ যদি এসে তার সঙ্গে নাচতে বলে । কিন্তু তা কেউ বলল না। তখন সোফি হম্ম্ হম্ম্ করে বার দুই গলা সাফ করল, তবু কেউ এল না। এদিকে বাদাম-ভাঙার জাতি এক একাই নাচতে আরম্ভ করেছিল । ফুলরা কেউ এগুচ্ছে না দেখে, সোফি হঠাৎ ধপাস করে মাটিতে পড়ল আর অমনি একটা সোরগোল উঠল। ফুলরা সব ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “আহা, লাগল নাকি ?” ভাগ্যিস লাগে নি। তখন ফুলরা খুব ভালো ব্যবহার করতে লাগল, বিশেষ করে আইডার নিজের ফুলরা। এই ফাঁকে তারা নিজের বিছানা ছেড়ে দেওয়ার জন্য সোফিকে ধন্যবাদ জানাল ; বলল ঐ বিছানায় ওরা খুব আরামেই ঘুমিয়েছে । তার পর ওর সঙ্গে নাচবে বলে ফুলরা ওর হাত ধরল, বাকিরা চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়াল। সোফির আনন্দ দেখে কে ! সে বারবার ফুলদের বলতে লাগল নাচ ভাঙলে তারা যেন আবার সোফির বিছানাতেই শোয়, টেবিলের টানায় শুতে সোফির কোনোই অসুবিধ নেই । ফুলরা বলল, “তোমার দয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু অতক্ষণ তো আমরা বঁচিব না যে শোব | কালকের মধ্যে আমরা একেবারে মরে যাব । আইডাকে বোলো যেন তার পোষা ক্যানারি পাখির পাশে আমাদের কবর দেয় । তা হলে আগামী গ্রীষ্মে আমরা আবার ফুটব আর এ বছরের চাইতেও সুন্দর দেখতে হব।” সোফি ফুলদের চুমো খেয়ে আদর করে বলল, “না, না, তোমরা মরে গেলে চলবে না ।” ঠিক সেই সময় দরজা খুলে গেল আর এক দল ফুল নাচতে নাচতে ঘরে এল । আইডা ভেবেই পেল না রাজার বাগান ছাড়া আর কোথা থেকে এরা আসতে পারে । সবার আগে ঘরে ঢুকল দুটি চমৎকার গোলাপ ফুল, মাথায় তাদের সোনার মুকুট। তাদের পিছনে পিছনে কত রঙের কত সুগন্ধি ফুল এসে ঘরে ঢুকে, সবাইকে নমস্কার করতে লাগল।
ওরা আবার সঙ্গে করে বাজনদারের দল নিয়ে এসেছিল। এই বড়ো-বড়ো রঙিন পপি ফুল, পিওনি ফুল, মটরশুটির খোলার তৈরি বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে মুখ লাল করে ফেলল। তার উপর নীল সাদা মিহি ফুলের দল মহা ফুর্তির সঙ্গে ঘণ্টা বাজাতে লাগল। তার পর কতরকমের ফুল মিলে সে যে কতরকম নাচ দেখাল, ভায়োলেট, ডেজি, লিলি, আরো কত কি। তাদের নাচের সুললিত ভঙ্গি দেখলে চোখ জুড়োয়। অবশেষে ফুলরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল, তখন আইডাও গুটিগুটি আবার বিছানায় ঢুকে, এই সব চমৎকার জিনিসের স্বপ্ন দেখতে লাগল।
পরদিন সকালে উঠে, কাপড়-চোপড় পরেই আইডা টেবিলের কাছে গেল ; ফুলগুলো ঠিক আছে তো ? পুতুলের খাটের পরদা সরিয়ে দেখে, হ্যা, ঐ তো সব ফুলরা শুয়ে আছে, তবে কালকের চাইতে আরেকটু শুকনো দেখাচ্ছে। টেবিলের টানায় শুয়ে আছে, মনে হচ্ছে তার বেজায় ঘুম পাচ্ছে।
আইডা বলে ছোটো মেয়েটি তাকে বলল, “আমাকে কি বলার কথা ছিল, মনে নেই বুঝি ?” সোফি বোকার মতো ভাব করে শুয়ে রইল, মুখে টু শব্দটি নেই!
আইডা বলল, “তুমি মোটেই লক্ষী মেয়ে নও, ফুলরা তবু তোমাকে তাদের সঙ্গে নাচতে দিয়েছিল ” তার পর খেলনার মধ্যে থেকে ক্ষুদে ক্ষুদে পাখির ছবি আঁকা, ছোটো একট পীচবোর্ডের বাক্স বের করে, আইডা তার মধ্যে শুকনো ফুলগুলোকে রাখল। তার পর বলল, “এই বাক্সটিতে করে তোমাদের মাটি দেব। আমার মাসতুতো ভাইরা যখন দেখা করতে আসবে, তখন আমার সঙ্গে বাগানে নিয়ে তোমাদের পুঁতে দেব। তা হলে আসছে গ্রীষ্মকালে তোমরা আবার ফুটবে আর এ বছরের চাইতেও সুন্দর দেখতে হবে।”
ঐ মাসতুতো ভাইয়ের নাম ছিল জেনাস আর এসবেন। ওদের বাবা ওদের দুটো নতুন তীর ধনুক দিয়েছিলেন, সেগুলো আইডাকে দেখাবার জন্য নিয়ে এসেছিল। দেখা হলে পর আইডা ওদের বলল ফুলরা মরে গেছে ্রখেন তাদের বাগানে নিয়ে গিয়ে পুঁততে হবে। তীর ধনুক কাঁধে ঝুলিয়ে আগে আগে ভাইরা চলল, বাক্সটাতে মরা ফুলগুলো নিয়ে তাদের পিছনে পিছনে আইযা চলল। তারপর বাগানে একটা কবর খোঁড়া হল। আইডা আরেকবার ফুলগুলোকে চুুমু খেল, তারপর বাক্সটাকে গর্তে র মধ্যে নামিয়ে রাখল। বন্দুক, কামান তো আর ওদের ছিল না, কাজেই ফুলদের সম্মান দেখাবার জন্য জোনাস আর এসবেন কবরের উপর দিয়ে দুটি তীর ছুঁড়ল।