আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা – ৩

              চিঠি তিনটে পড়ার পর দুজনেই চুপচাপ বসেছিলাম কিছুক্ষণ । দুজনেই জানতে পারছিলাম কে কি ভাবছে। আমিই প্রথমে কথা বলা আরম্ভ করলাম।  

              আমি : তোর বাংলা হাতের লেখা খুব স্পষ্ট, স্ট্যাণ্ডার্ড টেন থেকেই রবীন্দ্রনাথের মতন হাতের লেখা রপ্ত করে ফেলেছিস।

               তুই : হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ ; আসল প্রসঙ্গে এসো, কনটেন্টে, বিষয়ে, হ্যান্ডরাইটিঙের প্রশংসা করে পাশ কাটিয়ে বেরোতে চাইছ কেন, টেক্সট ডিকন্সট্রাক্ট করো, সম্পর্ক, রিলেশানসিপ, রক্তের খেলা ।

               আমি : ডিকন্সট্রাক্ট আবার কি করব, জানি তো, তুই কোল্ড ব্লাডেড রিভেঞ্জ নেবার ফাঁদ পাতছিলিস, আমি তো তোর ভালোর জন্যই সবকিছু করেছি, আর নেতিস্মর লিখে জানিয়ে দিয়েছিস তুই কি বলতে চাস , ওয়ার্ডটা শুনিনি আগে ।

              তুই :নেতিস্মর শব্দটা আঁস্তাকুড়ে পেয়েছিলুম, ইউ লায়ার লাভার, লুকিয়ে রিমোট কনট্রোল করে গেছ, আর এখন অ্যালিবাই খাড়া করছ, ইউ আর এ কাওয়ার্ড।

              আমি : বলে নে, বলে নে, মেটা তোর ঝাল, আমি ছাড়া কার কাছেই বা পুষে রাখা ক্রোধ, ক্ষোভ, আক্রোশ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা রিলিজ করতিস ।    

              তুই আহত হলি আমার কথায়, কাঁদতে আরম্ভ করলি, ফুঁপিয়ে, সামলে নিলি, তারপর বললি, আমাকে ফেলে যাওয়া হয়েছিল কলকাতার এক আঁস্তাকুড়ে, আমি দিল্লির এনজিওর হাতে গেলুম কেমন করে গো, তুমি তো আমাকে দিল্লির সংস্হা থেকেই সেলেক্ট করেছিলে ?

                আমি : ওঃ, বেশিরভাগ এনজিও বিদেশ থেকে ডলার-ইউরোর ধান্দায় যতো পারে আনওয়ান্টেড বেবিদের নিজেদের আওতায় আনতে চায় ; বিদেশীরা অ্যাডপ্ট করার জন্য ওদের কাছে আসে বা ওদের ফাণ্ডিং করে, বাচ্চাদের পড়াশুনা করাবার জন্য, স্বাস্হ্যের জন্য । দিল্লির এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড  চালায় একজন অবসরপ্রাপ্ত আই এ এসের স্ত্রী। ওরা অ্যাবানডণ্ড চিলড্রেনদের সংবাদের দিকে লক্ষ্য রাখে , তোর সংবাদ কাগজে পড়ার পর ওদের প্রতিনিধি কলকাতা পুলিসের সঙ্গে কথা বলে দিল্লি এনেছিল ।

                তুই : তুমি মাঝখান থেকে কি করে উদয় হলে ? তুমি স্পনসর করলেই বা কেন ? তুমি তো ব্যাচেলার ছিলে, ফ্যামিলি লাইফ শুরু করোনি, নেহাতই কাঁচা অভিজ্ঞতা তখন ।

                আমি : আমার কাছে চিঠি এসেছিল একটি গার্ল চাইল্ডকে স্পনসর করার জন্য । জানি না কে আমার ঠিকানা ওদের দিয়েছিল । আমি কিছু একটা ভালো কাজ করতে চাইছিলাম, চাকরিতে ঢুকেই তো চারিদিকে দেখছিলাম রাজনীতিকদের জোচ্চুরি আর লোকঠকানো, আমার কলিগরাও এই ধান্দায় প্রথম থেকেই ফেঁসে যাচ্ছিল, যেচে ফেঁসে যাচ্ছিল, যারা বিয়ে করেনি তারা মোটা ডাউরি হাঁকছিল, সে এক বিরাট নরক, আমি সেখানে এক টুকরো স্বর্গ গড়তে চাইছিলাম, আর ব্যাস, পেয়ে গেলাম তোকে। জগদীশও পড়েছে গিয়ে ওই নরকে, তাই জন্যেই ও হরিয়ানা ছেড়ে যেতে চায় না ; মন্ত্রিদের তেল দাও, তাদের কথামতো চলো আর আনলিমিটেড কালোটাকা রোজগার করো।

                তুই : ভাগ্যিস দিয়েছিল ; নয়তো বাচ্চাগুলো কোথায় যাচ্ছে, তাদের শেষপর্যন্ত কি হচ্ছে, তার ফলো আপ হয় না। আমিও পড়তুম কোনো বাজে ফ্যামিলির খপ্পরে ।

                আমি : হ্যাঁ, তুইও তো নিজেই যেচে আমার খপ্পরে পড়তে এলি । নীতি আমার ঠাকুমার নাম, তাই আমি ওই নামটা বেছেছিলাম, কিন্তু রেজিস্ট্রেশানের ক্লার্কটা গোলমাল করে একটা ই বাদ দিয়ে তোকে করে দিলে নেতি।

               তুই : স্বর্গে সামান্য নরকের নুন-মিষ্টি থাকা দরকার, নয়তো বিস্বাদ লাগতো, তোমার আমার দুজনের রসায়নই। আমি নেতি আর তুমি ইতি, ব্যাস, প্লাস-মাইনাসের যোগফল যা হয়, কী বলো ।

               আমি : ইতি বলিস বা ইটি বলিস, যা ইচ্ছে হয় বলিস । ওগো, হ্যাঁগাও বলতে পারিস ।

               তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, দ্যাট ইজ এ গুড ওয়ান । না, তুমি আমার ড্যাডি, আমি তোমার বেবি এলেকট্রা, ড্যাডি বলেই ডাকব ।

##

              এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

              যেন এমন, যেমন অমন, যেন তেমন নয় ।

##

               তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, আরে, ফোটো দ্যাখো দ্যাখো, তুমি কোলে নিয়ে আমার গালে চুমো খাচ্ছ ? তখনই চুমো খেয়ে নিয়েছিলে তাহলে ?

               আমি : খেয়েছিলাম, অনেক চুমো খেয়েছিলাম, গালে, পেটে । পেটে ফুঁ দিয়ে হাসিয়েছিলাম , কত হাসতিস খিলখিল,  আমি তোর ন্যাপিও চেঞ্জ করেছি কয়েকদিন ।

              তুই : ওঃ, সব জায়গায় হাত দেয়া হয়ে গেছে ; তাই মনে হচ্ছিল, হাতটা, ঠোঁটটা যেন চেনা-চেনা লাগছে। এখন আরেকবার পেটে ফুঁদিয়ে হাসাতে পারতে ।

              আমি : তুই অ্যাস্ট্রনট হতে চাইছিলি, স্পেস সাইন্টিস্ট হতে চাইছিলি, বাচ্চা নিয়ে কি করে সামলাবি?

              তুই : সব ব্যাপার ইনডিয়ান পার্সপেক্টিভে ভাবো কেন ? যারা অ্যাস্ট্রনট তাদের কি ওয়াইফ বা হাজব্যাণ্ড বা বেবিজ নেই ? আমার ইনটারভিউটা পড়ে বলছ, বুঝেছি । কয়েকটা রিসার্চ পেপার পাবলিশ করেছি, পিয়ার অ্যাপ্রুভড, আরও কিছু করতে হবে।

              আমি : তুই স্নান করে নিয়েছিস ?

              তুই : পাগল নাকি ! প্রেম করব বলে প্ল্যান করে তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলুম, পাউডার পারফিউম মেখে নিয়েছিলুম, লিপ্সটিক লাগিয়ে নিয়েছিলুম, ব্যুরোক্র্যাট বিশ্বামিত্রের চেস্টিটি বেল্টের তালা খোলার পণ করে বসেছিলুম । চলো তোমাকে চান করিয়ে দিই । তুমি আমার ডায়াপার চেঞ্জ করতে, আমি তোমার গায়ের ময়লা ঘষেমেজে তুলি । তোমার পিঠে যথেষ্ট ময়লা জমে আছে, নাকের দুপাশে ব্ল্যাকহেড ফুটে উঠেছে, তোমার পাও বেশ নোংরা ।

              আমি : চল, ওই ঘরের বাথরুমে চল, ওটা বড়ো । স্ক্রাবার আছে । ভাগ্যিস তুই আমেরিকান মেয়েদের মতন গায়ে ট্যাটু করাসনি ; আমার একেবারে ভালো লাগে না কারোর গায়ে উল্কি আঁকা দেখলে ।

              তুই : ধ্যুৎ, ট্যাটু আবার কি করাব ! তামাটে চামড়ায় কেউ ট্যাটু করায় না ।

              আমি : তামাটে নয়, তোর ত্বক হল উজ্জ্বল ।

              তুই : থ্যাংকস ফর দি মিথ্যেকথা । চুলটুল না কামিয়ে তুমি কিন্তু রিয়্যাল হিম্যান । আজকাল বুকে বগলে কুঁচকিতে পুরুষরাও চুল রাখছে না; পুরুষের গা থেকে পুরুষ হরমোনের দুর্গন্ধ না বেরোলে আকর্ষণ গড়ে ওঠে না, মনে হয় ডলফিন ।

              ঘরে ঢুকে, দেখলুম তোর বাক্স খুলে বিছানার ওপর পোশাক টুকিটাকি ছড়িয়ে রেখেছিস, জিগ্যেস করলি, দেয়ালে ওটা কার ফোটো গো ?

             বললুম, চিন্তা করিসনি, ওটা আমার মায়ের ।

             তুই : কোনে রাখা গিটারটা ?

             আমি : ওটা আমার, কলেজে বাজাতাম ।

             তুই : দারুণ হবে, তুমি গিটার বাজাবে আর আমি গাইব, আমার পেনডিং সঙ্গীত সেরিমনি ।

             আমি : গিটার বাজালে আর গান গাইলে পাশের বাংলোয় ‌ভাণ্ডারির মেয়েরা শুনতে পাবে,  আর ওরা দেখতে আসবে, যে আজ অচানক প্রধান সাহেবকো হো কেয়া গয়া, এক লড়কি গা রহি হ্যায় অওর গিটার বজা রহি হ্যায়, কৌন হ্যায় ইয়ে লড়কি ? আমার বাংলোয় তরুণী কেউ তো কখনও আসেনি ।

              তুই : তাহলে নেক্সট হলিডেতে কোথাও বাইরে চলো, দূরে, ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিও আর আমি গান গাইব ।

              আমি : মার্কিন গান ? এদিকে ধানের খেত পাবি না, পাবি কালো টাকায় কেনা ফার্মল্যাণ্ড ।

              তুই : না, না, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারি, আমেরিকায় বাঙালিদের অনুষ্ঠানে গাই ।

              আমি : বারবার আমেরিকা বলছিস, শহরের নাম বলছিস না তো ? কোন রাজ্যের কোন শহর,  কোন রাস্তা, অ্যাঁ?

              তুই : হুঁ হুঁ, আমি যেমন তোমাকে লোকেট করার জন্য খেটে মরেছি, আমি চাই আমি চলে যাবার পর তুমিও সেরকম মরো, তোমার তো লোকবল আছে, কানেকশান আছে, সরকারি যন্ত্র আছে, চেষ্টা চালিও ; আমার ডিসপোজালে কিছুই ছিল না মিস্টার আগামেমনন, কিছুই ছিল না, কাঠের ঘোড়ায় লুকোনো সৈন্যসামন্তও নয়, জাস্ট একা, বুঝেছ, জাস্ট একা । আর আরশুলাকে ঠিক ধরে ফেলেছে টিকটিকি । খুঁজো, আমাকে খুঁজো ।

              আমি : কেনই বা খুঁজব তোকে ?

              তুই : যেদিন যাব সেদিন বলব । রিভেঞ্জ, রিভেঞ্জ, প্রতিশোধ হল সবচেয়ে সুন্দর শিল্প ; প্রত্যেক মাসে আমি রক্ত ঝরাই, কেন ? প্রতিশোধ হল নলেন গুড়ের সন্দেশ ।

##

              এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

              যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।  

##

              আমি :আচ্ছা, বাথরুমে চল আপাতত । আমি কিন্তু শর্টস পরে নিচ্ছি, বেশ এমব্যারাসড ফিল করছি এভাবে, অভ্যাস নেই তো ।

              তুই : তুমি যাও, আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি । আমারও অভ্যাস নেই, তো তাতে কি । যা-যা করলুম, তার কি অভ্যাস ছিল নাকি, করলুম তো, বিন্দাস, তোমার জন্য ।

              আমি শাওয়ারের তলায় টুলের ওপর বসেছিলাম, তুই হাঁটুগেড়ে আমার সামনে বসলি, নেকেড, শাওয়ারের তলায়, একটা আঙটি হাতের তালুতে রেখে বললি, আমি নেতিস্মর আঁস্তাকুড়বাসিনী, আজ দ্বিপ্রহরের এই ঝরণাতলায়, তোমায় প্রোপোজ করছি, তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে ?

             বলে, আমার উত্তরের অপেক্ষা করলি না, বাঁহাতখানা নিয়ে অনামিকায় পরাবার চেষ্টা করলি আঙটিটা, ঢুকল না, তর্জনীতে ঢুকল, বললি, ভালো হল, ওয়েডিং ফিংগারের চেয়ে ডিজিটাল ফিংগার উপযুক্ত, ডিজিটাল ফিংগার ছাড়া প্রেম হয় না, অর্জুনের ডিজিটাল ফিংগার ছিল সবচেয়ে ইমপরট্যান্ট ; অতগুলো মহাকাব্যিক প্রেমিকাকে হ্যাণ্ডল করা সহজ ব্যাপার ছিল না ।

              উঠে দাঁড়িয়ে, বললি, কি কোলে তুলে নিলে না, ছোটোবেলায় তো নিয়েছিলে, নাকে নাক, গালে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলে ।

              ডিবেতে দেখলাম তনিষ্ক লেখা ।        

             পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে জিগ্যেস করলাম, কখন কিনলি, যখন এসেছিলি তখন তো দোকান খোলার টাইম হয়নি ।

             গলা জড়িয়ে ধরলি, আমি তোর নাকে নাক গালে ঠোঁট ঠেকাতে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, হাসতে হাসতে বললি, আমি পরশু এসেছি, হোটেলে উঠেছিলুম, তোমার লোকেশান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য রিকনাইসান্স ভিজিট করে গেছি, গেটে দেখে গেছি প্রভঞ্জন প্রধানের নাম ।

               ডিটেকটিভ এজেন্সি বাপির, আই মিন আঙ্কলবাপির, আর আন্টিমায়ের অ্যাকাউন্ট ট্রেইল করার সময়ে, তোমার অ্যাকাউন্টও ট্রেইল করেছিল, আর সেখান থেকে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডকে আজও যে টাকা পাঠিয়ে চলেছ তা জানিয়েছিল আমায়; আমি কালকে এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড-এর পরিচালক মিসেস সোমপ্রীত কৌরের সঙ্গে দেখা করেছি, পরিচয় দিয়েছি, কিন্তু ওনারা তোমার সঙ্গে হওয়া কনট্র্যাক্ট আর আঙ্কলবাপির এফিডেভিট দেখতে দিলেন না, সিক্রেট ডকুমেন্ট ।

               ফোটো দেখালেন, ফাইলে, তোমার কোলে, যে ফোটোর কপি রয়েছে তোমার আলমারিতে, প্রায় সেইরকম কয়েকটা ফোটো, নাকে নাক, গালে ঠোঁট । অ্যাকাউন্ট ট্রেইল না করলে তোমার পরিচয়, বাড়ি, এনজিওর ঠিকানা পেতুম না । সরি ফর দি ইনট্রুজান । তুমি আমার লাইফে ঢুকেছ, আমি তোমার লাইফে ঢুকলুম, শোধবোধ । ওকে ?

              ওরকম হাসিসনি, হাসলে তোর বুক দুলে দুলে উঠছে, আর আমি ডিস্টার্বড ফিল করছি, ওদের বাড়িতে থাকার ফলে তোর বুক-পাছাও হয়ে গেছে জাঠনিদের মতন, নিয়ন্ত্রণহীন ।

              থ্যাংকস ফর দি কমপ্লিমেন্ট ড্যাড ।

              আঙটিটা দামি, হিরের, কত ক্যারাট রে ? কিন্তু আমার কাছে তোকে দেবার মতন আঙটি তো নেই, কিনে দেবো, কি বল ?

              না, না, ধ্যুৎ,ওসব করতে হবে না, আমরা এনগেজমেন্ট করছি না, ইউ আর মাই ফ্যাসিস্ট ড্যাডি, দি রিমোট কনট্রোলার, ওই আসনেই থাকো ।

               নামিয়ে দিলাম তোকে শাওয়ারের তলায় ।

               হঠাৎ জিগ্যেস করলি, এর আগে চুমো খেয়েছ কাউকে ?

               বেফাঁস বলে ফেললুম, হ্যাঁ । স্মৃতির চোট খেয়ে কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকত ভেসে উঠেছিল।

               তোর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, কথাটা শুনে চকিতে বদলে গেল অভিব্যক্তি, এক বর্ণনাতীত ক্রোধ ফুটে উঠল, কোমরে দুহাত দিয়ে, নেকেড, তুই জিগ্যেস করলি, কে সে ?

               টের পেলাম, মারাত্মক ভুল  করে ফেলেছি, যৌনসম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা কত যে জরুরি ।

               এসে পর্যন্ত তোর এই রূপ যে লুকিয়ে রেখেছিস, জানতে দিসনি, রগের পাশে উঁচু হয়ে উঠেছে শিরা ।

               কাছে এসে, বাঁহাত দিয়ে আমার বুকে ঠেলা মেরে বললি, কে সে, অ্যাঁ, কে সে ?

               আমি দ্রুত কি উত্তর দেব ভাবছি, ডান হাত দিয়ে বুকে ঠেলা মারলি, বললি, কে মেয়েটি ?

               আবার বাঁহাতে ঠেলা মারলি, আমি দেয়ালে পিঠ, দ্রুত একটা উত্তর খুজছি, মগজকে বলছি, দাও দাও, তাড়াতাড়ি যোগাও মনের মতন উত্তর । তোর ঠেলাও উপভোগ করছি, দেয়ালটা আরেকটু পেছনে হলে আরও কি-কি বলতিস জানতে পারতাম ।

               তুই, আরও ক্রুদ্ধ, আবার বুকে ঠেলা মেরে বললি, আর কি-কি করেছ ?

               নাম কি ?

               অপেক্ষা করতে পারোনি ?

               আমি তো বড়ো হচ্ছিলুমই, না কি, অ্যাঁ ? হলেইবা বয়সের ডিফারেন্স !

               তিন তিনটে চিঠি লিখেছিলুম, পড়লে তো, তবে ?

               এত তাড়া কিসের ছিল ?

               তোমার জন্যই যে আমি তা কি জানতে না ?

               তোমার নামের মেহেন্দি লাগিয়েছি কেন দুহাতের চেটোয় ?

               দ্যাখোনি লাভ ব্যাঙ্গলস পরে এসেছিলুম ?

               তোমার কাছে এলুমই বা কেন, অ্যাঁ ?

               হোয়াই আই ওয়াজ সিইং ইউ উইদাউট সিইং ইউ ফর মোর দ্যান টু ডিকেডস, বলো, বলো?

               বলো, বলো, বলো, বলো,বলো, চুপ করে থেকো না, কি কথা নেই কেন ?

               প্রথম রক্ত আর প্রথম স্পার্মের বেবি চেয়েছিলুম আমি, জানতে না ? সেক্স নয়, বেবি, তোমার বাচ্চা চেয়েছিলুম, উইদাউট ব্লেমিশ, জানতে না ?

##

               এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

               যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

               অন্ধকারে, অন্ধকারে, অন্ধকারে, কেননা তোর দেহ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় ।

               বানভাসি, বানভাসি, ভাসিয়ে নিয়ে সাগরে, কূলকিনারাহীন ।

##

              তোর অভিব্যক্তির ভেতর যে বার্তা আবিষ্কার করলুম, তা হল, আমি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারি ভেবে তুই সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেছিস, যেন  কখনও কেউ তোকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, আর তাদের কারাগারের কথা চিন্তা করলেই মগজে ছড়িয়ে পড়ছে উষ্মা ।

               আমার মুখের কাছে তোর ঠোঁট হুইস্কির গন্ধের কাছাকাছি নিয়ে এলি, একটা উত্তর আপনা থেকে বেরোলো, দুর্গন্ধের স্মৃতি থেকে, প্রথম চুমুতে ছিল ইনটারপ্রেটার-ট্রানস্লেটারের হাঁ-মুখের দুর্গন্ধ, ক্যাণ্ডললাইট শুয়োর খাবার পরিণাম, বললাম, হ্যাঁ, আমি একটা ছোট্ট মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম, বহুকাল আগে তাকে কোলে তুলে, নাকে নাক ঠেকিয়াছিলাম, নাভিতে ফুঁ দিয়ে কাতকুতু দিয়েছিলাম ।

              আশ্চর্য, যত দ্রুত রেগে গিয়েছিলি, তত দ্রুত তোর উগ্রতা প্রশমিত হয়ে গেল; ফিরে এলি দ্যুতিময়তায় ।

               হাত ধরে শাওয়ারের তলায় টেনে নিয়ে গিয়ে বললি, সরি, তোমার ওপর আর কারো অধিকার, তা আংশিক হলেও, আমি মোটেই বরদাস্ত করব না, যথেষ্ট নিষেধ মাথা পেতে নিয়েছি, আর নয় । 

              শান্ত গলায় বললি, জানো কি সাইক্লোনের নাম মেয়েদের নামে হয় ? ক্যাটরিনা, লায়লা, নিলম, হেলেন, নিশা ? আমার নামে আছে তোমার দেয়া সুপার সাইক্লোন ।

               টুলের ওপরে গিয়ে বসলাম ; মগজে তখন ভাবনার জেলি তৈরি হয়ে চলেছে, তাহলে কি আমি হেরে গেলাম, তোর সামনে কখনও না গিয়ে তোর ওপরে উল্টে এক কুইন্টালের বাটখারা চাপিয়ে দিয়েছি, যা তুই জীবনে মাথার ওপর থেকে সরাতে পারবি না ? তোকে বড়ো করে তুলে নিজস্ব নারী হিসাবে পেতে চাই বলেই কি এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম, আমার একজন তরতাজা মানস-ক্রীতদাসীর প্রয়োজন মেটাবার জন্য ?

               মুষড়ে পড়লাম ।

               তুই বুঝতে পারলি না কেন মুষড়ে পড়েছি, কিন্তু ভাবলি যে তোর কথায় আর বুকে থাবড়ানিতে  অপমানিত আহত হয়ে বাকরুদ্ধ ।

               ক্রোধ নয়, তুই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলি, বজ্রপাত ঘটিয়ে দিলি, এটাই বোধহয় আমাকে টুকরো-টুকরো করে খেয়ে ফেলার আগাম ইশারা । আমাকে বাদ দিলেই যেন তোর সামনে কালো গহ্বর, যেন ওই গহ্বরে তোকে কেউ ঠেলে দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরোবার জন্য আমার হাত আঁকড়ে ধরেছিস ।

               বললুম না যে তুই অকারণে ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলি । বললুম ঠিকই করেছিস, ক্রোধ ধরে রাখলে ভেতরটা পচতে আরম্ভ করে, দেখেছিস তো অ্যানিমাল প্ল্যানেটে, বাঘিনীর ক্রোধে তার থাবা থেকে নখগুলো বেরিয়ে আসে, শিকারকে ধরার সময়ে আসে, খাবার আয়োজন করার সময়ে আসে । গোরিলারা নিজেদের বুক থাবড়ায়, তুই আমার বুক থাবড়ালি ।

                 প্রায়শ্চিত্ত করার বা পারস্পরিক দায়মোচনের তরল কন্ঠস্বরে, তুই বললি, ডিয়ার সিলভার-ব্যাক আলফা মেল, এসো, তোমার পায়ের নোংরা ঘষে তুলি, নখে আর পায়ের আঙুলে এতো নোংরা, কখনও কি সাবান লাগাও না ? এত রোজগার করো, স্পাতে গিয়ে পেডিকিওর করালেই তো পারো, কতো স্পা চোখে পড়ল কালকে, এক্সক্লুসিভলি পুরুষদের জন্যে । আমার জন্য তো অনেক কিছু করেছ, এবার না হয় নিজের জন্য করলে

              শাওয়ারের তলায় আমাকে জড়িয়ে ধরে তুই আবার কবিতাটার আরেক স্তবক আরম্ভ করলি, বললি, লিসন ইউ লাভিং বাস্টার্ড:

               There’s a stake in your fat black heart

               And the villagers never liked you

              They are dancing and stamping at you.

              They always knew it was you

              Daddy, daddy, you bastard, I’m through.

             #

              সাবান মাখাবার সময়ে তুই চেঁচিয়ে উঠলি, ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, আইডিয়া ।

              আমি জিগ্যেস করলাম, কী, শুনি ? জারজপুরুষ হিসাবে আমার নামকরণ ?

              তুই বললি, ধ্যুৎ, আরে নাঃ , চলো, আমার জন্মস্হান সেই আঁস্তাকুড়টা দেখে আসি, ফোটো তুলে নেব, আমি ওখানে বসব, তুমি ফোটো তুলে নিও, যদি নোংরা না হয় তাহলে শুয়ে পড়ব, আর শুয়ে থাকার ফোটো তুলে নিও  ।

              দাঁড়িয়ে ফোটো সম্ভব, বসে বা শুয়ে সম্ভব কি না জানি না ; কর্পোরেশানের গাড়ি জঞ্জাল তুলে নিয়ে যাবার পর হয়ত বসতে পারবি ।

              নোংরা তো কি হয়েছে, শুয়ে ছিলুম এককালে, কতক্ষণ শুয়েছিলুম কেউ কি জানে ? ফোটো তুলতে তো কয়েক মিনিট ।

              আটপৌরে পোশাক আছে কি তোর ? শাড়ি-ব্লাউজ, চুড়িদার ? আঁস্তাকুড়ে বসতে বা শুতে হলে মার্কিন পোশাক তো চলবে না ।

              স্ট্রেঞ্জ, না ? আমেরিকায় বহু আফ্রিকান-আমেরিকান গারবেজ ডাম্প থেকে খাবার তুলে খায়, তারা কেউ-কেউ রাতে ড্রাগ ফুঁকে শুয়েও থাকে গার্বেজ ডাম্পে । দেখেছ তো হলিউডের ফিল্মে ?

              যাক, সে তুলনায় আমাদের আঁস্তাকুড় বেশি ডেভেলাপড, অনেকের রুজি-রুটির ব্যবস্হা হয়, বাতিল জিনিস  কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ।

              যাই, দেখি গিয়ে, কবে যাবে ?

              ঠিক আছে, চল যাওয়া যাক, সেই কতকাল আগে গিয়েছিলাম, দেখে আসি আরেকবার ।

              তুই বললি, আবদারের কন্ঠে, এই প্রথম তোর কন্ঠে ড্যাডের প্রতি মেয়ের কন্ঠস্বর শুনলুম, বললি, চলো না তোমার গ্রামেও একটা ট্রিপ মারি, তোমাদের জমিজমা আছে তো সেখানে ? কোথায় তোমাদের গ্রাম, একটু কানট্রিসাইড ঘুরে নেবো, তোমার জ্ঞাতিদের সঙ্গে তোমার বউয়ের পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে ।

              আমার বাবা স্কুল টিচার ছিলেন, হুগলি জেলার আরামবাগে, মাধবপুর গ্রামে জমিজমা ছিল । সম্পত্তি নিয়ে কখনও ভাবনা-চিন্তা করেননি বাবা-কাকারা ; অনেক জমি ছিল, সবই বেদখল হয়ে গেছে, বাবা রাজনীতি করতেন না, হাতছাড়া জমিজমা আর ফেরত পাননি । কাকারা বাবার আগেই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কোথায় ওনারা থাকেন, খুড়তুতো ভাইবোনরা কে কোথায়, তাও জানি না ।

              আমি আইএএস হবার পর মা-বাবাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছি প্রতিটি পোস্টিঙে; আমরা আর ওমুখো হইনি কখনও ।

              তুই বললি, তোমার বাবা অমন সাধাসিধে মানুষ ছিলেন বলে তুমি এরকম নিষ্ক্রিয় টাইপের হয়েছ, প্রিহিসটরিক মরালিটির মানুষ, বর্তমান ভারতবর্ষের অনুপযুক্ত । আন্টিমা বলেন যে একটা ফ্ল্যাটও কিনে রাখতে পারোনি প্রভঞ্জন প্রধান, এমনই ফুলিশ।

              আমি তোকে জিগ্যেস করলাম, কি করে সন্দেহ করলি যে তোর জীবনের আড়ালে আমি আছি ? আর আমি তোকে সাড্ডল্য সুন্দরী করে তুলছি একদিন তোকে পাবো বলে ? আমার ডারলিং ডটার গ্রোইং আপ ফর মি !

                তুই বললি, ক্লুটা পেয়েছিলি  কবিতার লাইন থেকে, “আই টক টু গড বাট দি স্কাই ইজ এম্পটি।” তারপর আমার গা তোয়ালে দিয়ে পুঁছতে-পুঁছতে বললি, আমি লেগহর্ন মুর্গি তো, তুমি একদিন যে খাবে আমাকে তা জানতুম ।

               আর তুই ?

               রয়াল বেঙ্গল টাইগ্রেস, টুঁটি ধরে ঝুলিয়ে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে খাবার পরিকল্পনা চালিয়ে গেছি, ঘ্র্যাঁওওওওও । কাল অফিস যাবার সময়ে সরোজিনি নগর মার্কেটে ড্রপ করে দিও, কটা দরকারি জামাকাপড় কিনে নেবো ।

              সরোজিনি নগর মার্কেটে পৌঁছে তোর নজরে পড়ল এক প্রৌঢ় দম্পতি, বললি, পাল্কি ফ্যামিলি, চেনো না বোধহয় । ওনাদের মুখের ভেতর সদাসর্বদা পাঁকের ল্যাণ্ডস্লাইড চলতে থাকে, সাবধান না হলেই ডুববে সেই পাঁকে ।

              পাল্কি ?

              মিস্টার পাল আর মিসেস পাল, এত গুলগল্প ঝাড়েন যে ওনাদের আরিয়ান নাম দিয়েছে পাল্কি, লিপিকা-কিরণশঙ্কর থেকে খামচে তোলা ; দুজনেই বুদ্ধি আর কল্পনায় দেউলিয়া । ওই যে এদিকেই আসছেন, তুমি চেনো না, কাচ তুলে দাও, কাচ তুলে দাও, শিগগির, শিগগির, দেখে ফেললেই কেলেঙ্কারি ।

               গেছেন ওনারা, তোর ভয় পাবার কারণ বুঝতে পারলাম না, আমি যখন তোকে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছি, তখন যার যা ইচ্ছা হয় বলুক, কিচ্ছু এসে যায় না ।

               ও তুমি বুঝবে না, ওনারা আমাকে তোমার সঙ্গে দেখে ফেললে ভিষণ বিপদ হতো ।

               এখন যা, কি-কি কিনবি কিনে নে । তুই ওই গাছটার তলায় দাড়িয়ে থাকিস, আমার ড্রাইভার আমাকে পৌঁছে তোকে পিক আপ করে নেবে । তোদের বাড়ি যেতে চাস তো গুড়গাঁও হয়ে আয়, বৈদেহী আছে; জগদীশ-অমরিন্দর তো চণ্ডীগড়ে । নয়তো কলকাতা থেকে ফিরে তারপর যাস ।

             যাবো’খন, তাড়া নেই, তোমার সঙ্গে তো তিনমাস কাটাবো, তোমার বিছানার চাদর থেকে মেমেন্টোটা কেটে রেখে নিয়ে চাদরটা  তোমার আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছি, তোমার সংরক্ষণের মেমেন্টো হিসাবে ; একটা নীল ফুলফুল বেডশিট বিছিয়ে দিয়েছি, রাতে আকাশে বিচরণ করব ।

##

             স্পর্শের মর্মার্থ, মর্মার্থের রসায়ণ, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন ।

             চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস ।

##

              এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

              যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

##

              রাত দুটো নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল । উঠে, তোর দেহের পাশে বসে, নাইটল্যাম্পের ফিকে নীল আলোয়, দেখছি , চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছিস, নেকেড । আমি তো পায়জামা বা শর্টস না পরে ঘুমোতে পারি না ।

              তোর ভুরু দেখছি, সরু করিয়েছিস । ভ্রুযুগল, ভ্রুযুগল ।

              তোর দুজোড়া ঘুমন্ত চোখ দেখছি, আইলাইনার বোধহয় স্মাজফ্রি, রয়েছে এখনও, পাতার তলায় ।

              তোর চোখের পাতা দেখছি । সত্যিকার পক্ষ্ম, পক্ষ্ম, পক্ষ্ম । চাপা দিয়ে রেখেছিস, স্বপ্ন, স্বপ্ন ।

              তোর নাকের পাটা দেখছি, নাকছাবির দাগ রয়েছে, পরতিস হয়তো শখ করে ।

              তোর কান দেখছি, মাকড়ি খুলে রেখে দিয়েছিস ।

              তোর ঠোঁট দেখছি, স্নানের পর আর লিপ্সটিক লাগাসনি । ওষ্ঠ, অধর, ওষ্ঠ, অধর ।

              তোর কোঁকড়া চুল দেখছি, আঁচড়াসনি মনে হল ।

              তোর গলা দেখছি, বেশ লম্বা, ঢ্যাঙাদের গলা বোধহয় এরকমই হয় ।

              তোর বুক দেখছি, শ্বাস নিচ্ছিস, আলতো উঠছে-নামছে ।

              তোর শরীরের গন্ধ নিলাম ঝুঁকে, শোবার আগে পারফিউম মেখেছিস ।

              দেখছি, মানুষীর মাংসল নির্যাস, নীলতিমিরে আচ্ছন্ন প্রতিমা, সেই কবেকার শিশু,  যাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করছি, চিন্তা করা বন্ধ করে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দখলে, উদ্বেল হয়ে উঠছি । প্রেম করার সময়ে এভাবে চোখ বন্ধ রাখিস না কেন যাতে তোকে ভালোভাবে দেখে নিতে পারি, তখন তো হাসিস, কবিতার লাইন বলিস, গানের কলি গেয়ে উঠিস, মাংসের সঙ্গে মাংসের সম্পর্ককে চরমে নিয়ে যাবার নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছিস নাকি ?

              বাস্তবকে অবাস্তব করে দিচ্ছিস, তোর জাদুতে আবিষ্ট হই । ঘুমও প্রেমের স্ফূরণ ঘটিয়ে দিল, ঘুমন্ত শরীরও ভালোবাসার জ্যোতি বিকিরণ করতে পারে । কত কিছু জানা ছিল না, তুই এলি, জানতে পারছি ।

##

               ইচ্ছে হল তোর গলা টিপে ধরি, মেরে ফেলি তোকে, যাতে তুই আমাকে ছেড়ে চলে না যাস ।

               তোর দেহের দিকে হাত নামালাম, গলায় নয়, বগলের পাশ দিয়ে দুহাতে তুলে নিলাম তোর ঘুমন্ত শরীর, ঘুমের ঘোরে বললি, আই লাভ ইউ ব্রো-প্রো, আমি অন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছি না, আমি রক্তমাংসের জেনুইন প্রেমিকা ।

              অনেকসময়ে তোকে প্রশ্ন করলে কেন চুপ করে থাকিস, তক্ষুনি উত্তর দিস না, কিসের ইঙ্গিত দিস অমন করে, নাকি নিজের মস্তিষ্কে কোনো উত্তর গড়ে ওঠে না ।

              স্বপ্ন দেখছিস, দ্যাখ, দেখে নে স্বপ্নসংকটের স্বপ্ন, ঘুম ভাঙাবো না ।

              আলতো শুইয়ে দিলাম তোকে ।

তিন

               তোর আবদার ছিল আমরা ফার্স্ট ক্লাস এসির একটা ক্যুপে রিজার্ভ করে ট্রেনের চাকার তালে-তালে প্রেম করতে করতে যাই, তাতা ধিন না, তাতা ধিন না, দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিদিম ব্রিজের ওপর দিয়ে, প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ ।

                তা সম্ভব ছিল না, আমার পক্ষে অতদিন ছুটি কাটানো অসম্ভব, জানাজানি হলে ঘুষখোর অফিসাররা টানাহেঁচড়া করবে ; তারা ওৎ পেতে আছে বহুকাল যাবত ।

                আমি আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দুটো এয়ার টিকিট কাটলাম, মিস্টার প্রভঞ্জন প্রধান, মিসেস নেতি প্রধান, দমদমের, ভোরের ফ্লাইট । 

                আট নম্বর রোতে সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে তুই বললি, ড্যাড, প্লেনটা যদি ক্রাশ করার মতো হয়, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরব, তুমিও তক্ষুনি জড়িয়ে ধোরো আমায় ।

                ছি ছি, কি বলছ গো, যাত্রা আরম্ভ হবে, এখন ওসব কি অলুক্ষুনে কথা । পেছন ফিরে দেখলাম, রিমলেস  বৃদ্ধা । আমি পেছন ফিরেছি দেখে বললেন, আপনার মেয়েকে যথাযথ শিক্ষাদীক্ষা দেননি, এতগুলো মানুষ, আপনার মেয়ে চাইছেন সবাই এক সঙ্গে মরি ।

               উনি আমার মেয়ে নন, স্ত্রী ।

              পেছন থেকে ফিসফিসগুলো ভেসে আসতে লাগল ।

              ফাঁসিয়েছে মালদার আসামী।

              না, তেমন বুড়ো নয় লোকটা, বেশ স্মার্ট, পঁয়তাল্লিশ হবে মনে হয় ।

               মেয়েটা তো তার অর্ধেক, দেখছিস না, তাও আধুনিকা, খাঁজ দেখা যাচ্ছে ।

              বাপের সঙ্গে বেরোলেও মেয়েরা খাঁজ দেখায়, খাঁজ তো আর বাপকে দেখাচ্ছে না, পাবলিককে দেখাচ্ছে; নতুন কি এতে ?

              আমি তো বলব লোকটা টাকার টোপ দেখিয়েছিল, মেয়েটা তো কম স্মার্ট নয়, সুশ্রী ।

              ম্যাট্রিমোনিয়াল ডট কমে দিয়েছিল হয়ত, সেখান থেকে খুঁটে তুলেছে রে ।

             দুটোই ডিভোর্সি হবে বোধহয় ।

             ঘাটে-ঘাটে জল খেতে গিয়ে নদীকূলে পরিচয় ।

             মেয়েটা ভাবছে ক্র্যাশ হলে ও বেঁচে যাবে আর আমরা সবাই থেঁতলে ছড়িয়ে থাকব সর্ষের খেতে ।

             হ্যাঁ, গায়ে পড়া টাইপের, হাই-হ্যালো করেছে, ক্যান্ডললাইট ডিনার খেয়েছে, ডিসকোয় নেচেছে, আর ব্যাস, আঙটি বদল আর লেংটি দখল ।

              আমি পেছন ফিরে বলতে চাইছিলাম, না সেসব কিছুই হয়নি, নেতি আমার হাত চেপে বলল, দাও না বলতে, এনজয় করছি, আলোচনার পাত্রী হয়ে উঠেছি, ল্যাজটা না হয় খানিক মোটা হল, বাজেট এয়ারলাইন্সে চাপার এটাই প্লাস পয়েন্ট ; অন্য এয়ারলাইন্সে গেলে বিজনেস ক্লাসে সবাই মুখ গোমড়া করে দার্শনিক সেজে থাকে, বাঞ্চ অফ ওল্ড হ্যাগার্ডস, যেন আইনস্টাইনের পেট থেকে জন্মেছে ।

              ফিসফিস বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল, পেছন ফিরে বললাম, আমি সাতচল্লিশ আর উনি চব্বিশ, প্রেম করে বিয়ে করেছি । উনি আমেরিকা থেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য এসেছেন ।

              তা উনি আপনাকে ড্যাড বলছিলেন যে, একজনের যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন ।

              উত্তরটা তুইই দিলি, আমেরিকায় এই কিছুকাল আগে অব্দি হাজব্যাণ্ড আর প্রেমিককে মেয়েরা বেবি বলে ডাকত, এখন বেবি পুরোনো হয়ে গেছে, ড্যাডি বলে ডাকা হয়, আদর করে ডাকতে হলে ব্যাড ড্যাড, শোনেননি সেই গানটা, ব্যাড ড্যাড, ডোন্ট ফিল স্যাড, ইউ আর এ ল্যাড, লে মি ওন ইওর প্যাড, স্নুপি বিচের গাওয়া ?

##

               এলোচুলে ঢাকা রাজকন্যার মুকুটের ঝিলিক থেকে গানের টুকরো ।

               কিছুটা অপরিচিত থাকার আহ্লাদ ।

##

               এয়ারপোর্টের কাছের হোটেলে বাক্স-ব্যাগ রেখে তোকে পাশে বসিয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারের দিকে চললাম, হোটেলের নির্ধারিত গাড়িতে । তুই চুড়িদার পরে নিয়েছিস ;  বাচ্চাদের মতো চারিদিকে মাথা ঘুরছে তোর । গাড়ির ভেতর থেকে স্মার্টফোনে ছবি তুলছিস, ডাবের ঠেলা, মিনিবাস, রাজনৈতিক দলের ছেঁড়া পোস্টার, মোড়ের হিজড়ে, রাস্তা পেরোনো অলস ভিড়, যা  তোকে অবাক করছিল, তারই ।

              একটাও আঁস্তাকুড় দেখলুম না এখনও, বললি ।

             সমবেদনার মুচকি ঠোঁটে খেলিয়ে, ড্রাইভার বলল, আঁস্তাকুড়ের ফোটো তুলবেন নাকি, দিদি । একটু অপেক্ষা করুন, সকাল এদেশে কুঁড়ে-স্বভাবের, সূর্য একটু জোর পাক গায়েগতরে, দেখতে পাবেন ।

             তুই উত্তর দেয়া দরকার মনে করলি না , ঘাড় নাড়াটা সন্মতিসূচক কিনা বুঝতে পারলাম না।

             আচমকা উচ্ছ্বসিত, বললি, এটা আমার দেশ, ওই বউটা কি বাচ্চা-ফেলে দেয়া মা, আরে ওই লোকটা আমার মতন ঢ্যাঙা, ও নিশ্চয়ই ফেলে দেয়া বাচ্চার বাবা, নাঃ, রাসকেলটা  বুড়ো হয়ে গিয়ে থাকবে, কিংবা নরকে গিয়ে গরম তেলে ঝলসে মরছে । কে জানে, মুসলমানও হতে পারে, মুসলমানরা বেশ লম্বা-চওড়া হয়, তা যদি হয় তাহলে জাহান্নমে অপেক্ষা করছে কয়ামতের জন্য ।

             বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলি, যতই যাই হোক, আঁস্তাকুড়ে জন্মে থাকি বা না থাকি,  এটা আমার মাতৃভূমি, আই লাভ ইট।

             তোকে চিমটি কাটতে হল, ড্রাইভার তো আমেরিকা বা গুড়গাঁওয়ের নয়, যে বাংলা বুঝতে পারবে না!

             তোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, মাতৃভূমি মানুষকে মূর্খ করে তোলে, আবেগের গাধা বানায় ; মাতৃভূমির প্রেমে পড়ে রাশিয়ানরা কার্ল মার্কসকে বদনাম করে দিলে । শুনেছিস তো মার্কসের নাম ।

            শুনেছি, শুনেছি, দাড়িগোঁপ ছিল, তোর কন্ঠস্বরে অন্য চিন্তাকে বিপথগামী করে দেবার অভিযোগ ।

            ড্রাইভার শুনছিল তোর কথা, বলল, দিদি, মাতৃভূমি আর নেই, এখন যে দল সরকার চালায় সেই দলকে ভালোবাসতে হয় । দেশটাকে তো সবাই মিলে  আঁস্তাকুড় বানিয়ে ফেলেছে । যে লোক নেতা হয়, সে মনে করে সে-ই বুঝি সরকার, তার হুকুম সবাইকে মানতে হবে, নইলেই কেলেঙ্কারি, খুনোখুনি, মাটির তলায় হাড়পাঁজর, ছেলেপুলে কাঁখে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে ।

            তুই বললি, কী যে বলছেন, সরকার আর মাতৃভূমি তো এক নয় ।

            এখন লোকে মাতৃভূমির জন্য জান দেয় না গো দিদি, দলের জন্য দেয়, শহিদ হয়, যারা মরে আর যারা মারে, সবাই তা দলের জন্য করে, মাতৃভূমির জন্য নয়, বলল ড্রাইভার , নিজের মাকেই বুড়ো বয়সে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দ্যায়, আর আপনি মাতৃভূমির কথা বলছেন । এই তো সেদিন পড়লুম,  মাকে খুন করে তার সম্পত্তি হাতিয়েছে চার ছেলে ষড়যন্ত্র করে, মুখে অ্যাসিড ঢেলে তারপর পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল, যাতে পুলিশ চিনতে না পারে ।

            যাক, ড্রাইভারটা অন্তত তোকে চুপ করিয়ে দিতে পারল, নয়তো কি-কি বকে যেতিস মাথামুণ্ডু ।

            নাঃ, তুই দমবার নয়, আবার আরম্ভ করলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ওরা সব প্যারানয়েড, বুঝলেন, পশ্চিমবাংলা হল আমার আর আপনার, আমাদের, আমি নলেন গুড়ের সন্দেশ ভালোবাসি, পাটালি গুড়, পাটি সাপটা, জামদানি শাড়ি, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাপা ইলিশ, ট্যাংরা মাছের ঝোল, শিষপালঙের চচ্চড়ি, চালতার অম্বল, আমার চাষি-ড্যাডিকে ভালোবাসি, এইগুলোতে কি পশ্চিমবাংলা নেই ?

          এবার ড্রাইভার যা বলল, তাতে তুই একেবারে চুপ করে গেলি, জিগ্যেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?

           তুই বললি, আমেরিকা, আর সামনের আয়নায় দেখতে পেলি ড্রাইভারের ঠোঁটে মৃদু শ্লেষের হাসি ।

           হঠাৎ বলে উঠলি, আচ্ছা, জোনাকি কোথায় দেখতে পাবো ? আমি আজ অব্দি জোনাকি দেখিনি ।

           ড্রাইভার এবারে তোকে বিপদে ফেলল ওর অনুসন্ধিৎসা প্রয়োগ করে, দিদি, কোথায় জন্মেছেন, পশ্চিমবাংলায় কোথায়, যে জোনাকি দেখতে চাইছেন ?

          আঁস্তাকুড়ে, বললি তুই ।

          ড্রাইভার ভাবল ঠাট্টা করছিস, আমাকে জিগ্যেস করল, স্যার কোথাকার লোক আপনারা, আপনার মেয়ে এখনও পশ্চিমবাংলা দেখেননি ?

          উনি আমার মেয়ে নন, আমার স্ত্রী, বললুম, তারপর যোগ করলুম, তুমি আমাদের যেখানে নিয়ে যাচ্ছ, বাঁশদ্রোণী বাজার, সেই বাজারের বাইরে জঞ্জাল ফেলার যে আঁস্তাকুড় আছে, সেখানে এনাকে ফেলে গিয়েছিলেন এনার বাবা কিংবা মা, তখন এনার কয়েকদিন মাত্র বয়স, তারপর স্হানীয় ক্লাব, যাদবপুর থানা, হাসপাতাল, স্হানীয় এনজিও  হয়ে ইনি দিল্লির জনসেবামূলক এক সংস্হায় পৌঁছোন, একটি বাঙালি পরিবারে পড়াশুনা করে আমেরিকায় বড়ো চাকরি করছেন ; ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় দিল্লিতে ।

          দিদি, আপনাকে দেখে বাংলা ফিলিমের  নায়িকা মনে হয়েছিল, এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে ঘটনাটা সত্যি ।

          তুই বললি, গ্রেট, সিনেমা হলে বসে বাংলা ফিল্ম জীবনে দেখিনি, একটা ফিল্মও দেখব ড্যাড । হিরোরা কি বলিউডের মতন মারামারি করে ? নাচে ? ঝিনচাক ঝিনচাক ? আইটেম ডান্স হয় ? বিড়ি জালাইলে ? ঝাণ্ডুবাম ? বেবি ডল ম্যায় সোনে দি হয় ?

          ড্রাইভার বলল, সব শিল্প পশ্চিমবাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে ।

          শিল্প আবার চলে যাবে কেন, কোটি-কোটি টাকায় আজকাল বাঙালি শিল্পীদের পেইনটিং বিক্রি হচ্ছে ; যারা আর্টিস্ট নয় তাদের পেইনটিংও অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে, পশ্চিমবাংলার আর্ট জগদ্বিখ্যাত ।

          আর্টের কথা বলছে না, বলছে কলকারখানার কথা, ইনডাসট্রির কথা । আমি বললুম ।

           ইনডাসট্রিকে আর্ট মনে করা ভুল, মনে হবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলকারখানা বসিয়ে গেছেন ।

          তাই করলেই ভালো হতো দিদি, ড্রাইভার বলল ।

           তুই বললি, এখন তো তাই মনে হয় ; শান্তিনিকেতনে যাবার কথা ভাবি , এবার হবে না ।  রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করব ।

          রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগে মারা গেছেন, বললাম আমি ।

           মারা গেলেই বা, মারা গেলেই তো আর মানুষ মরে যায় না, আমি শান্তিনিকেতনে গেলে রবীন্দ্রনাথের অবশ্যই দেখা পাবো ; জোড়াসাঁকোয় গিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সবাই কে কেমন আছেন খোঁজ নেবো। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব আর স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে দেখা করব । সুভাষচন্দ্র বসু তো বাড়ি ফেরেননি, নয়তো ওনার সঙ্গেও দেখা করতুম । লোকে বোধগয়ায় যায় কেন ? গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে কথা বলবে বলে, ওওওওউউউম মণিপদ্মে হুমমমমমম ।

          তুই ইনকরিজিবল, বললাম গলার স্বর নামিয়ে ।

##

          এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয় ।

          যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয় ।

##

           বাঁশদ্রোণী বাজারের কাছে পৌঁছে ড্রাইভার বলল, এখানে পার্কিং নেই, আপনারা যা কেনাকাটা বা দরকারি কাজ সেরে আমায় ফোন করে দেবেন, এসে যাবো, দেখি কোথায় গাড়ি পার্ক করা যায় ।

          গাড়ি থেকে নামলি, সামনেই সেই জঞ্জালের ভ্যাট বা আঁস্তাকুড়, তুই একেবারে কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস, তোর মায়ের স্মৃতি টিকে আছে কিনা, হয়তো সেকথাই ভাবছিস, কিংবা কি করে এরকম নোংরা জায়গায় পড়ে থেকেও বেঁচে রইলি ।

            আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দূরে, যাতে তুই নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারিস, বোঝাপড়া করতে পারিস । ফোটো তুলছিস না কেন, বলেছিলিস ফোটো তুলবি, মনে করিয়ে দেব কিনা ভাবছিলাম, তখনই তুই আঁস্তাকুড়ের ভেতরে ঢুকে পচা সবজি, ছাই, মাছের আঁশপোঁটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লি, নানা ভঙ্গীতে একের পর এক সেলফি তুলতে লাগলি, আর লোক জড়ো করে ফেললি ; আমি দৌড়োলাম তোর দিকে, পরিস্হিতি সামলাবার জন্য ।

           হাত ধরে তোকে টেনে তুলতে যাব, তুই বললি, আমি চিৎ হয়ে, পাশ ফিরে, নানা পোজে শুচ্ছি, তুমি ফোটো তুলে নাও তো ।

          তুই পোজ দিতে লাগলি, আমি ক্লিক করতে লাগলুম । হলুদ রঙের কুর্তার ওপর সবুজ ফুল, সবুজ চুড়িদার, ওড়না নেই ।

           যখন উঠে দাঁড়ালি, ঠাকুমার ঝুলি বইয়ের গাছপাতা-চরিত্র, তোর পোশাকে  ডাস্টবিনের নোংরা জঞ্জাল জেঁকে বসেছে, মাছের আঁশ ঝরছে ।

           দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে বললি, এই দ্যাখো, জঞ্জালমাতা হয়ে গেছি, বিশ্বসুন্দরী প্যাজেন্টে চললুম ।

           কোনো প্রতিযোগীতা আছে কি ম্যাডাম, আঁস্তাকুড়ে সেলফি নেবার ? জানতে চাইল এক পথচারী ।

           অনেক ভালো সেলফি উঠত, আপনার কাছে যদি সেলফি স্টিক থাকত, বলল একজন যুবতী, থলে থেকে লাউ, পালং শাকের আঁটি, সজনে ডাঁটা  বেরিয়ে রয়েছে ।

           আরেকজন জানতে চাইল, কিসের বিজ্ঞাপনের মডেলিং করছেন ম্যাম, হার্বাল প্রডাক্টের ? দেখিনি তো আগে  আপনাকে টিভিতে বা কাগজে ।

           চব্বিশ বছর আগে ওনার মা বা বাবা ওনাকে এই আঁস্তাকুড়ে ফেলে চলে গিয়েছিলেন, বললাম আমি, অগত্যা  ।

           ভিড়ের মেজাজ বোঝা বেশ কঠিন, কখন কোন দিকে মোড় নেবে বলা যায় না । তোর বাহু ধরে একটু এগিয়ে ড্রাইভারটাকে ফোনে ডাকলাম । তোকে বললাম, কি করলি কি, এখন এগুলো পালটাবি কি করে?  ইনফেকশান হয়ে যাবে ।

           হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তুই বললি, কিছুই হবে না, দেখে নিও, আমি জঞ্জালপ্রুফ, লাথিপ্রুফ, ঘেন্নাপ্রুফ, গলাধাক্কাপ্রুফ, নয়তো বাঁচতুম না, তখনই মরে যেতুম । তোমার কি মনে হয় জীবনে ধাক্কা খাইনি ? শুনলে তোমার মাথায় রক্ত উঠে যাবে ।

           একটি লোক আমাদের পেছু নিয়েছিল, বলল, স্যার, আমাদের দোকানে ওনার মাপের চুড়িদার আছে, পোশাক পালটাবার ঘরও আছে ।

           দারুণ তো, বলে লোকটার সঙ্গী হলি তুই, আমি পেছন-পেছন, ড্রাইভারকে বললাম, এক্ষুনি আসতে হবে না, একটু পরে এসো ।

           লাল রঙের কুর্তা কিনলি, তাতে কালো ডোরা লম্বালম্বি, চুড়িদারও লাল । তোকে ঘিরে থাকা ভিড়ে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে তোর মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়েছিল, তুই তাকে নোংরা পোশাকের প্যাকেটটা দিয়ে বললি, খোকাবাবু, এটা ওই আঁস্তাকুড়ে ফেলে এসো তো ।

           ছেলেটি বলল, আমার নাম খোকাবাবু নয় ।

           তুই বললি, আচ্ছা নবীনকিশোর, ফেলে এসোতো এটা ।

           ছেলেটি : আপনি কি করে জানলেন আমার নাম নবীনকিশোর ?

           তুই : তোমার গোল মুখ দেখে ; যাদের মুখ গোল হয়, তাদের নাম সাধারণত নবীনকিশোর হয় ।

            বৃদ্ধ কেশিয়ার টাকা গুণতে-গুণতে বলল,  শুনলাম আপনাকে আঁস্তাকুড়ে পাওয়া গিয়েছিল, আমি জানি ব্যাপারটা, অষ্টম সন্তানকে ত্যাগ করার ঘটনা, হইচই হয়েছিল বেশ । শান্তনুর বাচ্চাদের গঙ্গাদেবী জলে ভাসিয়ে দিতেন, গল্প শুনেছেন তো ? শেষে অষ্টম সন্তানকে ভাসাতে গেলে শান্তনু বাধা দিয়েছিলেন, সেই অষ্টম সন্তান ছিলেন মহাভারতের ভীষ্ম ; কত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল ওনাকে, বিয়ে করতে পারেননি, সংসার করতে পারেননি ।

             তুই আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ভাগ্য ভালো যে জোর করে দখল করে নিয়েছি পছন্দের লোকটাকে।               গেঞ্জি কিনছিল এক প্রৌঢ়, বলল, ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টম তিথিতে মথুরার রাজপরিবারে বাসুদেব আর দেবকীর অষ্টম পুত্র হয়ে জন্মেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, জানেন কি ?

            তুই বললি, গল্পটা জানি, অষ্টম গর্ভের কথা জানতুম না, জানা ছিল না, শ্রীকৃষ্ণের চেয়ে যেমন বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন ওনার প্রেমিকা রাধা, তেমনি আমার আর আমার শ্রীকৃষ্ণের বয়সের পার্থক্য ; আমি ওনার এলেকট্রারাধা । আমার দিকে তাকিয়ে তোর উক্তি, কি ঠিক বলেছি না, ড্যাড ?

             বৃদ্ধ বলল, আমরা শুনেছিলাম সেই বাচ্চাকে কোনো বিদেশি কোল নিয়েছে । নিচের তলায় যান, মাছের বাজারে, অনন্ত নামে একজন মাছ বিক্রি করে, ওর কুটুমের গ্রামের ঘটনা, অবশ্য অনন্ত তখন ছোটো ছিল, গ্রামের এবং পরিবারের তো হালহদিশ দিতে পারবে ।

          শুনেই তুই দৌড়োলি নিচে, মাছের বাজারে, ঢুকেই চেঁচালি, অনন্ত, অনন্ত কে, আপনাদের মধ্যে কার নাম অনন্ত ?

           আঁশবঁটিতে ধড় থেকে তিন কেজি রুইয়ের মুড়ো আলাদা করছিল, লুঙ্গি-পরা মাঝবয়সী মাছবিক্রেতা, সে বলল, আমিই অনন্ত, বলুন, কবেকার অর্ডার, যত ওজনের চাইবেন এনে দেবো, বিয়ের সিজন, দিন পাঁচেক আগে অর্ডার দিতে হবে ।

            আমাদের পেছনে যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের একজন বলল, উনি তোমার কুটুমের গ্রামে যাবেন, তোমার কোন এক জ্ঞাতি তার অষ্টম মেয়েকে ফেলে গিয়েছিল বাজারের জঞ্জাল ফেলার জায়গায়, সেই যে কত থানা-পুলিশ কাগজ-কিচাইন হয়েছিল, তারপর যাদের বাচ্চা তারা ধরা পড়ার পর বললে যে, না, তাদের নয়, মনে নেই ? কত কচাল করেছিল লোকেরা । উনি বলছেন যে উনিই সেই বাচ্চা ।

            লুঙ্গিতে হাত পুঁছে উঠে দাঁড়াল চশমা-পরা তেলালো টেরিকাটা অনন্ত, যেন মাছেদের নিশিডাক দিয়ে জালে তুলতে চলেছে । বাকরহিত বলতে যা বোঝায় । বসল, কাৎ করে রাখল মেগাসাইজ বঁটি । বলল, আজকে হবে না দিদি, আজকে আমার ছেলে আসতে পারেনি, আপনি কালকে ভোরবেলা আসুন, ভোর-ভোর না বেরোলে  ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে আপনাদের, দিনকাল ভালো নয় জানেনই তো । গ্রামর নাম লক্ষ্মীপুর, ঈশ্বরপুরের কাছে, জীবনপুরে যাবার পথে, রাজপুর-সোনারপুর বা বারুইপুর হয়ে যেতে হবে । আজকে আপনি ক্লাবে হয়ে আসুন বরং, ওনারাই আপনাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন ।

           তুই : ঈশ্বরপুর, জীবনপুর, লক্ষ্মীপুর, বাঃ, পারফেক্ট নাম, গডলি-গডলি । ঠিক এই কথাই রইল তাহলে, কাল সকাল সাতটায় এসে যাবো, গাড়ি ভাড়া নিয়েই আসব, আমার বরের সঙ্গে ।

           অনন্ত : বিয়েও হয়ে গেছে আপনার ? বর পক্ষ ব্যাপারটা জানে ?

           তুই : ওই তো আমার সুপুরুষ বর দাঁড়িয়ে আছেন ।

           অনন্ত : বড়লোক বর পেয়েছেন দিদি, কি ভাগ্যি আপনার । গিয়ে আপনার বোনেদের দেখবেন, দু-বেলা খেতে পায় না, সবায়ের অ্যাণ্ডাগ্যাণ্ডা  ছেলে-মেয়ে ।

           তুই : বোন ? কতগুলো বোন ? জিগ্যেস করে আমার দিকে ফিরে জয়ের হাসি খেলালি ঠোঁটে ।

           অনন্ত : আপনি অষ্টম গর্ভের সন্তান তো, আপনার আগে আরো সাত বোন, সবাই হয়তো বেঁচেবর্তে নেই, কারা আছে কারা নেই বিশেষ জানি না গো, ছেলেপুলেরা থাকবে । দশ-বারো বছর হয়ে গেল ওমুখো হইনি । ছেলে হয়েছিল ওদের,  আপনার পর, শুনেছি, সেই ছেলে বিয়োতে গিয়ে আপনার মা মরে গিসলো । কি করবে বলুন, খাওয়াতে পারে না, বাচ্চা বিইয়ে চলেছে, গেল শেষে সগগে ।

            তুই : বিইয়ে চলেছে, শুনতে কতো ভালো লাগে, তাই না ? অষ্টম গর্ভ ? এইটথ চাইল্ড ! হুউউউশ ওয়ান, হুউউউশ টু, হুউউউশ থ্রি, হুউউউশ ফোর, এই করে আটবার । ঈশ্বরপুরের মেয়ে, যেতেই হবে, আপনি রেডি থাকবেন, আমরা সাতটায় পোঁছোচ্ছি।

             বিশাল ভেটকি কেটে খদ্দেরের জন্য ফিলে বানাচ্ছিল যে, সে বলল, কিন্তু ক্লাব তো এখুন তৃণমূল নিয়ে নিয়েচে ।

             শিঙিমাগুর বিক্রেতা : আরে ঘেঁচুবাবু সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে চলে গেচেন, ফুটানিবাবুও ওনার পেচন পেচন গেচেন, ভালোবাবু তো তৃণমূলের কি একটা পুরস্কারও পেলেন, ওনার হ্যাদানে ফোটো আছে ক্লাবঘরে, দুহাতে সেই কেঠো তকতিখানা ধরে আচেন, মুচকি হাসিতে গুটকা-দেঁতো ফোকলা ঢেকে ।

             ভেটকি : তখুন তো অ্যামবুলেন্স পায়নি ওঁয়ারা, চাঁদুচৈতনের বউ রিকশায় চেপে আপনাকে কোলে করে থানায় নিয়ে গিসলো ।

             রুই : চাঁদুচৈতনকে পাবো কি ক্লাবঘরে ?

            শিঙি : না ওনারা দুজনেই গত হয়েছেন ।

             তুই : ক্লাবটা কোথায় ?

            কুচোমাছ বিক্রেতা : অ্যাই বদনা মাছ বাচা বন্ধ রেখে এনাদের নিয়ে যা তো ক্লাবঘরে, ক্যারাম খেলছে বোধহয় ঘেঁচুবাবুর ছেলেরা । তোকে মাছ ছাড়াবার ভরতুকি দিয়ে দেবেন দিদি ।

            তুই : কত দূরে ?

            কুচো : ওই তো রাস্তায় বেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই বাঁদিকে ।

            তুই : এটা কি মাছ ?

             অনন্ত : ফলুই ।

            তুই : ওউ-ওউ-ওউ-ওউ, কত্তো রকমের মাছ, কত টাটকা, পাবদা, পারসে, খয়রা, বাটা, গুড়জাওলি, কাজরি, আহা, মনে হচ্ছে কাঁচাই খেয়ে নিই । বাসি মাছ খেয়ে বোর হয়ে গেছি । যে মাছে কাঁটা থাকে না, সে মাছে বোধহয় স্বাদ হয় না ; কাঁটাহীন ইলিশ কি ভাবা যায় ?

            অনন্ত : যা বলেছেন, এদেশে একবার আসে হেঁটে কাঁটার দল, তারা গিয়ে আসে ওপরে কাঁটার দল ।

            তুই : মানে ?

            অনন্ত : মানে ওই ওপরে কাঁটা হেঁটে কাঁটা, এদেশে থাকলে টের পেতেন ।

            নবীনকিশোর ছুটতে ছুটতে এসে জানাল, ক্লাবঘর বন্ধ, তালা দেয়া, ঘেঁচুকাকু আর ফুটানিকাকু দুজনেই কলেজ ইউনিয়ানের নির্বাচন সামলাতে গেছেন ।

            তুই : ধ্যুৎ, এই বয়সে কলেজে পড়েন নাকি তাঁরা ?

            নবীনকিশোর : দিদি, ঘেঁচুকাকু-ফুটানিকাকুকে বাদ দিয়ে এই এলাকায় কোনো ছাত্রের ইয়ে ঝরে না আর কোনো ছাত্রির উয়ো পড়ে না ।

           অনন্তর দিকে তাকিয়ে বললি, সেই কথাই রইল, কাল সকাল সাতটা ।

            আমার দিকে তাকিয়ে বললি, ইয়ে ঝরার পর কিন্তু উয়ো পড়া বন্ধ হয়ে যায় ; ড্যাড, অবসিনিটি ব্যাপারটা জেনারেশান গ্যাপের সঠিক মেজারমেন্ট করে ।

           আমাদের বয়সের পার্থক্যকে টিটকিরি মারলি কিনা বুঝতে পারলাম না, বললাম, জানি, ওসব কুকথা শুনে-শুনেই এখান-ওখানের চুল পাকিয়েছি ।

            তুই কাপড়ের দোকানটায় গিয়ে আবার ঢুকলি, বললি, শুনলুম আমার সাত বোন আছে, তাদের ছেলেপুলে আছে, কতজন তা তো জানি না, আপনি গ্রামে পরা যায় এমন কুড়িটা শাড়ি প্যাক করে দিন, আর আমার মাপের যেকোনো রঙের ব্লাউজ দিন, গ্রামে পরা যায় এমন ।

            দেখলিও না ব্লাউজ আর শাড়িগুলো, দাম যা চাইল মিটিয়ে দিলি । আমি দিতে পারতাম, কিন্তু তোর তো মুখের আগল নেই, বেফাঁস কি বলে ফেলবি, পকেটে হাত ঢুকিয়েও বের করে নিলাম ।

            বাজার থেকে বেরিয়ে দেখলাম আঁস্তাকুড় ঘিরে ভিড় ; একজন করে তার ভেতর ঢুকে জঞ্জালের ওপর শুয়ে সেলফি তুলছে, আরেকজন দ্রুত ঢুকতে চাইছে, বেশ ঠেলাঠেলি, বুম হাতে একজন সাংবাদিকা আর কাঁধে ক্যামেরা তার আধাযুবক সঙ্গী । জঞ্জালের ওপর শুয়ে যে প্রৌঢ়া সেলফি নিচ্ছে, তাকে জিগ্যেস করল, কেমন লাগছে আপনার ?

            সে বলল, ওঃ অসাধারণ অভিজ্ঞতা, কি যে ভালো লাগল, দারুণ দারুণ !

            তোর বাহু ধরে ছুটলাম গাড়ির দিকে ।

##

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *