১১
নানারকম বই, কাগজ আর ট্রফি সাজানো আছে আলমারিতে৷ তার মাঝখানে একটা টেবিল, কাচ ঢাকা৷ মাথার ওপর নানা রঙের কাচে ঢাকা মস্ত ঘুলঘুলি দিয়ে আলো এসে পড়েছে টেবিলের ওপর৷ রামধনু রং৷ টেবিলের একপ্রান্তে দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছেন এক মোটাসোটা ভদ্রলোক৷ মাথা ভরতি টাক৷ এক চোখে পরকলা৷ ফিতে ঝুলছে তার থেকে৷ ভদ্রলোকের হাতে একটা কাগজ৷ ষান্মাসিক পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড৷ গম্ভীরভাবে তিনি চেয়ে আছেন সেই রিপোর্ট কার্ডের দিকে৷ তিনি শেরবর্ন পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক৷ আর টেবিলের উলটোদিকে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর—অ্যালান টিউরিং৷ ষান্মাসিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে আজ৷ প্রধান শিক্ষকের ঘরে ডাক পড়েছে অ্যালানের৷ রিপোর্ট কার্ডের দিকে চোখ রেখে ভদ্রলোক গম্ভীর কণ্ঠে সেটা পাঠ করতে লাগলেন—‘জিওমেট্রিতে একশোতে একশো, অ্যালজেব্রাতে একশোতে একশো, জেনারেল সায়েন্সে একশোতে নিরানব্বই নম্বর, কিন্তু…৷’ এই বলে মুহূর্তের জন্য অ্যালানের দিকে তাকালেন তিনি৷ অ্যালানের মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত৷ হ্যাঁ, এ বিষয়গুলোতে ফুল মার্কস আশা করেছিল সে৷ রিপোর্ট কার্ডে চোখ রেখে আবার পড়তে শুরু করলেন ভদ্রলোক—‘লিটারেচারে একশোতে একচল্লিশ, গ্রামারে একশোতে উনত্রিশ, রোমান হিস্ট্রিতে একশোতে বিয়াল্লিশ…৷’
রিপোর্ট কার্ডটা আর পড়লেন না তিনি৷ সেটা টেবিলে নামিয়ে রেখে অ্যালানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন৷ এবার চোখ নামিয়ে নিল অ্যালান৷ ঘড়ির পেন্ডুলামের টিক টিক শব্দ ছাড়া আর-কোনো শব্দ নেই ঘরে৷ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে মুখ খুললেন প্রধান শিক্ষক৷ তিনি অ্যালানের উদ্দেশে বললেন, ‘এ কথা ঠিকই যে তুমি গণিত বিষয়ক পরীক্ষাগুলোতে সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করেছ৷ পরীক্ষকরা আমাকে এ কথাও জানিয়েছেন যে অঙ্কের কোশ্চেন পেপারের বিকল্প অঙ্কগুলোও প্রত্যেকটা নির্ভুলভাবে কষেছ তুমি৷ কিন্তু আসল বিষয়গুলোতে? গ্রামারে তো ফেল করেছ তুমি! কেন এমন হল?’
অ্যালান মাথা নীচু করে আমতা আমতা করে জবাব দিল, ‘আমার গণিত আর বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু ভালো লাগে না৷ বিশেষত গণিত৷’
জবাব শুনে প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘আমরা কিন্তু আসল শিক্ষা বলতে বুঝি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনকে৷ মানুষকে যা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে, মানুষ গড়ে তোলে৷ গণিতের প্রয়োজন মানুষের জীবনে ঠিক ততটুকুই, যা তার দৈনন্দিন প্রয়োজনে লাগে৷ অর্থাৎ পরিমাপ বা টাকাপয়সা লেনদেনের জন্য যতটুকু জানা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু জানাই যথেষ্ট৷’—এই বলে থামলেন তিনি৷
অ্যালান কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল৷ প্রধান শিক্ষক এরপর বললেন, ‘আমাদের এই বিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের মূল লক্ষ্য হল ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা৷ আগামী বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে তুমি যে ক্লাসে উঠবে, সেখানে আটশো নম্বরের মধ্যে অঙ্কের জন্য বরাদ্দ মাত্র একশো নম্বর৷ তাতে যদি তুমি ফুল মার্কসও পাও, কিন্তু আসল বিষয়গুলোতে কী করবে তুমি? সাহিত্য, ব্যাকরণ, ইতিহাস, দর্শন? তোমাকে তো সেসব বিষয়ে ভালো ফল করতে হবে? অন্তত পাশ মার্ক পেতে হবে৷ আসল বিষয়গুলোতে তো ভালো লাগে না বললে চলবে না৷’
এরপর তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার কথাগুলো তুমি মাথায় রেখো৷ দেখি বার্ষিক পরীক্ষায় তুমি কী করো৷ এবার তুমি যাও৷’—এই বলে অ্যালানের হাতে রিপোর্ট কার্ডটা ধরিয়ে দিলেন তিনি৷
হেডমাস্টারের রুম থেকে বেরোল অ্যালান৷ আজ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে বলে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে৷ প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে স্কুল৷ কিন্তু সেই পুরোনো বাড়িটার গাছের নীচে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে মরকম৷ অ্যালান ছুটল সেদিকে৷ গাছের নীচেই বসে ছিল মরকম৷ অ্যালান তার পাশে গিয়ে বসতেই মরকম প্রশ্ন করল—‘অ্যালজেব্রাতে কত?’
‘ফুল মার্কস৷’—জবাব দিল অ্যালান৷
‘আর জিওমেট্রি?’
‘ফুল মার্কস৷’—আবারও জবাব দিল অ্যালান৷
জবাব শুনে মরকম ‘ব্র্যাভো’ বলে অ্যালানের পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘কিন্তু তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন?’
মরকমের প্রশ্নের জবাবে অ্যালান হেডমাস্টারের রুমের ঘটনাটা বলার পর তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, গণিত কি ‘আসল বিষয়’ নয়? তিনি তো তাই বললেন৷ আরও অনেককেই তাই বলতে শুনেছি!’
মরকম প্রশ্ন শুনে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, ‘যাঁরা এ কথা বলেন তাঁরা ভুল বলেন৷ এই এত বড় পৃথিবী, এ তো গাণিতিক নিয়মেই ঘুরে চলেছে৷ এই যে সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা, সবই তো গাণিতিক নিয়মেই চলছে৷ এমনকি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, এ সবই নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম মেনেই চলে৷ আমাদের দেহকোশ বিভাজিত হয় গাণিতিক নিয়ম মেনেই, কোথাও একচুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই৷ সর্বত্রই তো শুধু অঙ্ক আর অঙ্ক৷ আসলে এসব ব্যাপার অনেকের মাথায় ঢোকে না৷ অঙ্ক বলতে তারা শুধু বোঝে পাউন্ড, গজ আর সুদের হিসাব৷ বিষয় হিসাবে সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাসের নিশ্চয়ই গুরুত্ব আছে৷ কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখবে যে, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাসেরও একটা নির্দিষ্ট বিজ্ঞান আছে, যা উচ্চতর গণিত শাখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷’—একটানা কথাগুলো বলে থামল মরকম৷
মরকমের কথা শুনে বেশ খুশি হল অ্যালান৷ তার মুখে এবার হাসি ফুটে উঠল৷
মরকম একটা চুরুট বার করে ধরাল৷ তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যে ধোঁয়া, এর আণবিক গঠনও কিন্তু গাণিতিক৷’
এ কথা বলার পর সে হঠাৎ বলল, ‘এই রে! কারা যেন এদিকে আসছে! চলো ওই সামনের ঘরটাতে গিয়ে ঢুকি৷ মনে হচ্ছে হেডমাস্টার!’
অ্যালানেরও মনে হল কারা যেন আসছে! গাছতলা থেকে উঠে একছুটে পরিত্যক্ত বাড়ির একটা ঘরে ঢুকে দরজা দিল তারা৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দরজাতে টোকা পড়তে শুরু করল৷ প্রথমে আস্তে, তারপর বেশ জোরে!
ঘুম ভেঙে গেল অ্যালানের৷ ভোর হয়ে গেছে৷ স্বপ্ন দেখছিলেন অ্যালান৷ গতকাল বইয়ের ভাঁজে শেরবর্ন স্কুলের সেই চিঠিটা পেয়েছিলেন বলেই হয়তো এ স্বপ্নটা দেখলেন তিনি৷ আড়মোড়া ভেঙে খাটে উঠে বসে অ্যালান কথাটা ভাবলেন৷ খাট থেকে নেমে জানলাটা খুললেন অ্যালান৷ ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ বাইরে সকাল শুরু হয়েছে৷ গাড়ি বোঝাই ফুল নিয়ে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করেছে ঘোড়ার গাড়িগুলো৷ সেদিকে তাকিয়ে অ্যালান ভাবলেন, সেই ম্যারাথন রেসের দিনের পর তাঁর আর বাইরে যাওয়া হয়নি৷ সকালবেলা একটু হেঁটে আসবেন তিনি৷ তারপর লাইব্রেরি রুমে কাজে বসবেন৷ গতকাল তিনি একটা জটিল অঙ্ক কষতে বসেছিলেন, সেটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে৷ সেটার সমাধান করতে হবে৷
ঘণ্টা বাজিয়ে পরিচারককে ডাকলেন তিনি৷ পরিচারককে দ্রুত প্রাতরাশের ব্যবস্থা করতে বলে তিনি ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলেন৷ এরপর আধঘণ্টার মধ্যেই তৈরি হয়ে প্রাতরাশ সাঙ্গ করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়লেন অ্যালান৷
নির্মল বাতাস, নতুন সূর্যের আলো, রাস্তার পাশের গাছগুলোতে পাখি ডাকছে৷ মাঝে মাঝে ছন্দোবদ্ধভাবে পা ফেলে ঘোড়াগুলো পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ফুলের গাড়ি নিয়ে৷ বাতাসে ফুলের সৌরভ৷ ফুলের মতো শিশুরা গুটি গুটি পায়ে বাবা- মা-র হাত ধরে মর্নিং স্কুলে যাচ্ছে৷ সব মিলিয়ে এক সুন্দর পরিবেশ৷ ধীর পায়ে হাঁটতে থাকলেন অ্যালান৷
‘মিস্টার অ্যালান?’ হঠাৎ কে যেন ডাকল তাঁর নাম ধরে!
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অ্যালান দেখলেন রাস্তার বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি৷ চালকের আসনে বসে আছে এক প্রৌঢ়, আর তার পিছনে কিছু ব্যাগ নিয়ে বসে আছে একটা বাচ্চা ছেলে৷ চালকের আসনে বসা লোকটাকে চিনতে পারলেন অ্যালান৷ এ সেই ফুলচাষি হেপবার্ন৷ যে তাকে ডেকে নিয়ে গেছিল ম্যারাথন রেসের অনুষ্ঠানে৷ অ্যালানকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে তাকে ডাক দিয়েছে লোকটা৷
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল লোকটা৷ আর তার সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটাও৷ অ্যালান রাস্তা পেরিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ করমর্দন করে সুপ্রভাত বিনিময়ের পর হেপবার্ন বলল, ‘এই আমার নাতি হেনরি৷ বারো বছর বয়স৷’
অ্যালান এবার বাচ্চা ছেলেটার উদ্দেশে বললেন, ‘হ্যালো৷’ সেও প্রত্যুত্তরে বলল, ‘হ্যালো৷’
হেপবার্ন এরপর বলল, ‘এর মধ্যে একদিন বিকেলে আপনার বাড়ি খুঁজে ওকে নিয়ে গেছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য৷ কিন্তু গেটম্যান কিছুতেই বাড়িতে ঢুকতে দিল না, আপনাকে ডেকেও দিল না৷ বলল সরকারি অনুমতি ছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা করা নাকি নিষেধ! তাই ফিরে চলে এলাম৷’
কথাটা শুনে অ্যালান মৃদু বিস্মিতভাবে বললেন, ‘তাই নাকি! কী দরকারে গেছিলেন?’
হেপবার্ন বলল, ‘সেদিন ম্যারাথন রেসে এই হেনরি ছিল কনিষ্ঠতম প্রতিযোগী৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও-ই প্রথম হয়৷ আপনার কথা শুনে ও একবার দেখতে চেয়েছিল আপনাকে৷ তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার জানার ছিল আপনার থেকে৷ ও একটা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে৷ আমাদের এক আত্মীয়ই ব্যবস্থাটা করেছেন৷ আপনি শহুরে, শিক্ষিত মানুষ, আপনার থেকে জানার ছিল স্কুলটা কেমন৷ যদিও এখন সে স্কুলে যাব বলেই গাড়ি ধরতে রওনা হয়েছি আমরা৷ ওখানে রেখে আসব হেনরিকে৷’
অ্যালান প্রশ্ন করলেন, ‘কোন স্কুল?’
জবাবে হেপবার্ন যা বলল তাতে চমকে উঠলেন অ্যালান৷ হেপবার্ন বলল, ‘জায়গাটা বেশ দূর এখান থেকে৷ ডরমেটের শেরবর্ন স্কুল৷ আপনি চেনেন?’
মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, চিনি৷ ভালো স্কুল৷ আমি নিজেও একসময় ওই স্কুলের ছাত্র ছিলাম৷’
কথাটা শুনে হেপবার্ন বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘ছাত্র ছিলেন! ব্যস, এবার তবে নিশ্চিন্ত হলাম৷ আমরা অশিক্ষিত ফুলচাষি৷ এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না৷ ভরসা পেলাম আপনার কথা শুনে৷ খেলার পাশাপাশি হেনরির পড়াশোনাতেও খুব উৎসাহ৷’
কথাটা শুনেই অ্যালান বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালেন৷ অ্যালান সে ইস্কুলে পড়েছেন শুনে আনন্দে উদ্ভাসিত বাচ্চা ছেলেটার মুখ৷ তার দাদু হয়তো তাকে বলেছে যে অ্যালান একজন বড় মানুষ৷ অ্যালান তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কী বিষয় ভালো লাগে?’
ছেলেটা জবাব দিল, ‘অঙ্ক, বিজ্ঞান৷’
একটা শিহরন খেলে গেল অ্যালানের মধ্যে৷ ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও এই বাচ্চা ছেলেটা যেন অ্যালানেরই শৈশবের প্রতিচ্ছবি! ম্যারাথন, অঙ্ক, শেরবর্ন স্কুল!
অ্যালান মনে মনে ছেলেটার উদ্দেশে বললেন, ‘কিন্তু আমার মতো অঙ্কশাস্ত্র যেন তোমার জীবনে অভিশাপ না হয়৷’
মনে মনে এ কথাগুলো বলে অ্যালান ছেলেটার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন, ‘নতুন স্কুলে আর ভবিষ্যৎ জীবনে সফল হও তুমি৷ মানুষের মতো মানুষ হও৷ তোমার জন্য যেন তোমার পিতা-মাতা, দাদু, প্রতিবেশী—সারা দেশের মানুষ গর্ববোধ করতে পারে৷’
ছেলেটা মুখে কিছু বলল না৷ শুধু তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা আপেল বের করে তা বাড়িয়ে দিল অ্যালানের দিকে৷ অ্যালানের প্রতি তার ভালোবাসার শ্রদ্ধার্ঘ্য৷
অ্যালান প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন সেটা নিতে৷ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবে বাচ্চা ছেলেটা৷ নিশ্চয়ই খিদে পাবে তার৷ ফলটা থাকলে তার সুবিধা হবে৷
হেপবার্ন সম্ভবত অ্যালানের মনের ভাব পাঠ করে বলল, ‘ও যখন দিতে চাইছে তখন নিন৷ নইলে ও কষ্ট পাবে, আমিও পাব৷ আপনার মতো বড় মানুষকে তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের কিছুই দেবার নেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছাড়া৷ দয়া করে নিন৷’
তার কথা শোনার পর আপেলটা নিলেন অ্যালান৷ খুশিতে, নিষ্পাপ ভালোবাসাতে ঝিলিক দিয়ে উঠল বাচ্চা ছেলেটার মুখ৷ অ্যালানের থেকে বিদায় নিয়ে এরপর গাড়িতে উঠে পড়ল তারা দুজন৷ অনেকটা পথ তাদের পাড়ি দিতে হবে শেরবর্ন স্কুলে পৌঁছোবার জন্য৷ গাড়িটা চলতে শুরু করার পর বাচ্চা ছেলেটা অনেক দূর পর্যন্ত পিছন ফিরে হাত নাড়তে লাগল অ্যালানের উদ্দেশে৷ হাত নাড়তে লাগলেন অ্যালানও৷ একসময় পথের বাঁকে অ্যালানের শৈশবকে নিয়ে হারিয়ে গেল সেই ঘোড়ার গাড়িটা৷ বাচ্চা ছেলেটার প্রতি একরাশ ভালোলাগা নিয়ে তার দেওয়া উপহার আপেলটা মুঠোয় ধরে হাঁটতে লাগলেন অ্যালান৷
কিন্তু কিছুটা এগোবার পরই পিছন থেকে আবারও একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন তিনি—‘স্যর, দাঁড়ান৷’ হাঁটা থামিয়ে পিছনে ফিরে অ্যালান দেখলেন তাঁর পরিচারক এগিয়ে আসছে৷ সে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াতেই অ্যালান তাকে মৃদু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
পরিচারক বললেন, ‘ডাক্তার এসেছেন৷ তিনি এখনই ফিরতে বলছেন আপনাকে৷’
কথাটা শুনে মৃদু বিস্মিত হলেন অ্যালান৷ ডাক্তারের তো আজ আসার কথা নয়! কী ব্যাপার? অ্যালান বললেন, ‘ঠিক আছে চলো৷’ পরিচারকের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন অ্যালান৷ ফেরার সময় একটা লোককে চোখে পড়ল অ্যালানের৷ গোবেচারার ভঙ্গিতে যে একটা ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে আছে৷ অ্যালানের দৃঢ় ধারণা হল লোকটা পুলিশের লোক৷ হয়তো এই সাতসকালেই অ্যালানকে অনুসরণ করছিল সে৷ অ্যালান বাড়ি থেকে বেরোলেই এরা কোথা থেকে তাঁর ওপর নজরদারি করার জন্য উদয় হয় কে জানে! পরিচারক বা গেটম্যান কি জানে এদের কথা? সেদিন গোলেমবাক বা গতকাল লুসি নামের সেই নারীকে কি তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেছে এরা? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে এগোলেন অ্যালান৷
বাড়িতে ঢুকে ড্রয়িংরুমেই সরকারি চিকিৎসককে বসে থাকতে দেখলেন অ্যালান৷ তিনি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার? পনেরো দিন তো হয়নি! আপনি এসেছেন?’
চিকিৎসক উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, আসতে হল৷ বেডরুমে চলুন৷’
অ্যালান চিকিৎসককে নিয়ে চললেন বেডরুমের দিকে৷ সে ঘরে ঢুকে অ্যালান খাটে বসে চিকিৎসকের উদ্দেশে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী?’
সরকারি চিকিৎসক তাঁর ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বার করতে করতে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ইনজেকশন দিতে এসেছি৷ আজ অন্য একটা ইনজেকশন৷ পনেরো দিন নয়, এবার থেকে আমি সাত দিন অন্তর অন্তর আসব৷ যতদিন না আপনি সুস্থতার দিকে এগোন৷’
কথাগুলো বলে একটা অ্যাম্পুল ভেঙে তার মধ্যেই ওষুধটা সিরিঞ্জে টেনে ডাক্তার বললেন, ‘কোট খুলুন৷ জামার হাতটা ওপরে তুলুন৷’
আজ যেন একটু বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে ডাক্তারকে৷ অ্যালান তাঁর কোটের পকেট থেকে প্রথমে আপেলটা বার করে কোটটা খুলে ফেললেন৷ তারপর জামার হাতাটা গুটিয়ে বাহু বাড়িয়ে দিলেন৷ ডাক্তার এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে৷ তুলোতে স্পিরিট মাখিয়ে বাহুর নির্দিষ্ট অংশটা মুছে অনেকটা যন্ত্রের মতো ইনজেকশনটা প্রবেশ করালেন তাঁর শরীরে৷
কাজ শেষ৷ ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন সরকারি চিকিৎসক৷ অ্যালান জানতে চাইলেন, ‘এই নতুন ইনজেকশন দিলে আমি কি আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হব?’
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখা যাক৷ আপনি তো চিকিৎসাতে কোনো সাড়াই দিচ্ছেন না! সুস্থ হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷’
অ্যালান কথাটা শুনে বললেন, ‘কোনো পরীক্ষা ছাড়াই কীভাবে বুঝলেন আমি সুস্থ হয়ে উঠছি না? বলেছিলেন তো ব্যাপারটা পরীক্ষা করবেন?’
ডাক্তার জবাব দিলেন, ‘সে পরীক্ষা করা হয়ে গেছে৷’
অ্যালান বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কখন? কীভাবে?’
দরজার বাইরে বেরোবার আগে মুহূর্তের জন্য থামলেন ডাক্তার৷ তারপর অ্যালানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আপনি সাড়া দিচ্ছেন না৷ আপনার আসক্তি এখনও পুরুষের প্রতি রয়ে গেছে৷ নারীর প্রতি আসক্তিহীনতাই প্রমাণ করছে মানসিক সুস্থতার দিকে এগোননি আপনি৷’—এ কথাগুলো বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন সরকারি চিকিৎসক৷
তাঁর কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যে গতদিনের ঘটনাটা স্পষ্ট হয়ে গেল অ্যালানের কাছে৷ লুসি নামের মেয়েটা সম্ভবত দেহপসারিণী গোত্রের কেউ হবে৷ কৌশলে তাকে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল নারীর প্রতি অ্যালানের যৌন আকর্ষণ তৈরি হয়েছে নাকি তা পরীক্ষা করার জন্য৷ সমকামিতার ভাবনা অ্যালানের মন থেকে মুছে গিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে কি না তা দেখার জন্য৷ গতকাল মেয়েটার আসার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ একটা সাজানো ঘটনা! গেটম্যান, পরিচারক, সবাই সরকারি নির্দেশে যুক্ত হয়েছিল এ ঘৃণ্য ঘটনার সঙ্গে! ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে কাঁপতে শুরু করলেন অ্যালান৷ প্রচণ্ড উত্তেজনার বশে, অথবা ইনজেকশনের প্রভাবে মাথার ভিতরটা কেমন যেন করতে লাগল তাঁর৷ সব যেন ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে মাথার ভিতর! কোনোরকমে উঠে গিয়ে তিনি দরজাটা বন্ধ করলেন৷ তারপর বিছানাতে এলিয়ে পড়লেন৷