তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৬/২ – আঁধারে কে – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০
এক
‘খবরটা শুনেছ?’ ডানা প্রশ্ন করল কিশোর, রবিন আর মুসাকে। ওরা চার বন্ধু ওক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে, স্কুলের ঘণ্টা পড়ার অপেক্ষা করছে।
‘কী খবর?’ প্রশ্ন করল কিশোর। চিড়িয়াখানার ওরা কি মত পাল্টেছে? বাঁদরের বদলে খাঁচায় তোমাকে রাখবে ঠিক করেছে?’
কিশোরের দিকে জ্বলন্ত চোখে চাইল ডানা।
‘না,’ বলল ও। ‘তোমরা মনে হয় জানো না, আমরা নতুন একজন টিচার পাচ্ছি।’
হাততালি দিয়ে উঠল কিশোর।
‘দারুণ খবর! তারমানে আমরা মিসেস হকিন্সের হাত থেকে বাঁচছি!’
মিসেস হকিন্স ওদের ফোর্থ গ্রেডের টিচার। ভয়ানক কড়া। এক হানাবাড়িতে থাকেন তিনি। কথা বলেন বিজাতীয় উচ্চারণে। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েদের ধারণা ভদ্রমহিলা ভ্যাম্পায়ার।
‘দাঁড়াও,’ বলে কিশোরের বাহু চেপে ধরল মুসা। ‘এত খুশি হয়ো না। আমরা একজন স্টুডেণ্ট টিচার পাচ্ছি। মিসেস হকিন্স ঠিকই বহাল থাকছেন। ‘
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল কিশোর।
‘এভাবে আমাকে হতাশ করলে?
ওর পিঠ চাপড়ে দিল রবিন।
‘আমি শিয়োর এই স্টুডেণ্ট টিচার নরম ধরনের মানুষ হবেন।’
‘সন্দেহ আছে,’ বলল কিশোর। ‘মিসেস হকিন্সের যে কোন স্টুডেণ্ট টিচারই আজব কিসিমের হতে বাধ্য।’
ঘণ্টা বাজলে আর তর্ক করার সুযোগ পেল না রবিন। ওরা চারজন ক্লাসরুমের উদ্দেশে চলল। কিশোর ওর ডেস্কের ভিতরে একটা পেন্সিল রাখল। মুখ যখন তুলল তখন চোখে পড়ল শুধু কালো আর কালো।
কিশোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি শুধু লম্বা নয়। তার বিশাল কাঁধ যেন তিনটে স্কুল ডেস্কের সমান চওড়া। গলাটা এতটাই মোটা শার্টের বোতাম লাগানো যায়নি। লোকটির পরনে কালো শার্ট, কালো টাই আর কালো প্যান্ট। এক কান থেকে ঝুলছে কালো এক দুল। লোকটি কিশোরের দিকে এক ঝলক নজর বুলিয়ে ভ্রূ কুঁচকাল।
‘হাই,’ ককিয়ে উঠে বলল কিশোর।
‘কোন কথা নয়,’ গর্জে উঠল লোকটি। ‘আমি মিস্টার বগি, তোমাদের নতুন স্টুডেণ্ট টিচার। কোন ইয়ার্কি চলবে না। বই বের করে পড়তে শুরু করো। কালকে রিপোর্ট দিতে হবে।’
ডেস্ক থেকে একটা বই তুলে নিল কিশোর। বইয়ের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখল মি. বগি কামরাময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওদের নিয়মিত টিচার মিসেস হকিন্সের দেখা নেই। ক্লাসরুমের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে নিঃশব্দে পড়ে চলেছে।
‘অ্যাই,’ রবিনের উদ্দেশে বলল কিশোর। ‘এই লোকের ব্যাপারটা কী বলো তো?’
রবিন শ্রাগ করল।
‘চুপ করো,’ সতর্ক করল।
কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিশোরের ডেস্কের পাশে এসে ওর দিকে মোটা এক আঙুল তাক করলেন মি. বগি।
‘সাবধান,’ বললেন তিনি। ‘পড়া না করলে খবর আছে।’
মি. বগির শরীরে মাংসপেশীগুলো কিলবিল করে উঠলে ঢোক গিলল কিশোর। কিন্তু দমল না ও। স্টুডেন্ট টিচাররা তো আর সত্যিকারের টিচার নন। ডেস্কে রাখা বইটার দিকে চকিতে চাইল কিশোর। এরোপ্লেন নিয়ে লেখা ওটা। এ বিষয়ে পড়ার আগ্রহ নেই কিশোরের, কিন্তু কাগজের বিমান বানালে মন্দ হয় না।
কিশোর ফট করে বইটা বন্ধ করে নোটবই থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ল। এবার ভাঁজ করতে লাগল। ও কাগজ ভাঁজ করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল, লক্ষই করল না মি. বগি ওর দিকে চেয়ে রয়েছেন। ভ্রূ কুঁচকে উঠছে তাঁর।
দুই
‘কী হয়েছে তোমার?’ পরদিন সকালে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল ডানা।
কিশোর পা টেনে টেনে চলেছে। ওক গাছের নীচে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল বন্ধুরা। বন্ধুদের কাছে পৌঁছে, বইয়ের ব্যাগটা ধপ করে ফেলে দিয়ে দু’চোখ ঘষে নিল কিশোর।
‘মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমোওনি,’ বলল মুসা। হাই তুলল কিশোর।
‘হ্যাঁ,’ স্বীকার করল।
‘কেন?’ রবিনের জিজ্ঞাসা। ‘হোমওয়র্ক করেছ বুঝি?’ মাথা নাড়ল কিশোর।
‘বুক রিপোর্ট লিখেছ?’ মুসার প্রশ্ন।
‘কীসের বুক রিপোর্ট?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
‘মিস্টার বগি যেটার কথা আমাদের বলেছিলেন,’ রবিন বলল। ‘হোমওয়র্ক করার জন্যে নয়, অন্য কোন কারণে সারা রাত জেগে
ছিল কিশোর,’ বলল ডানা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘কারণটা হলো আমার বিছানার নীচে সারা রাত ধুপ-ধুপ শব্দ হয়েছে।’
মুচকি হাসল মুসা।
‘দানব-টানব হয়তো।’
‘কিংবা বগিম্যান,’ হেসে বলল ডানা। চোখ ঘুরাল কিশোর।
‘বগিম্যান বলে কিছু নেই।’
‘অত শিয়োর হয়ো না,’ বলল রবিন।
‘আমি হচ্ছি, কারণ আমার বিছানার নীচে উঁকি দিয়েছিলাম, ‘ জানাল কিশোর।
ডানার চোখজোড়া বিস্ফারিত। বিছানার নীচে তাকাতে ভয় পায় ও। ওর ধারণা কিছু একটা পাল্টা চেয়ে থাকবে।
‘কী পেলে?’ প্রশ্ন করল।
‘বাঘাকে!’ বলল কিশোর। বাঘা ওর পোষা কুকুর।
‘বাঘা তোমার বিছানার নীচে গেল কী করে?’ মুসা জানতে চাইল।
মাথা নাড়ল কিশোর।
‘জানি না। সারা রাত মেঝেতে লেজ আছড়েছে। একটুও ঘুমোতে দেয়নি।’
কিশোরের কাঁধ চাপড়ে দিল মুসা।
‘আমার কাছে কিছু খবর আছে। শুনলে চাঙা হয়ে উঠবে তুমি,’ বলল। এবার পাঁচটা সবুজ কাগজ দোলাল কিশোরের নাকের নীচে
‘কী এগুলো?’ বলে কিশোর হাত বাড়াল।
মুসা সাঁৎ করে সরিয়ে নিল ওগুলো। এসময় জুলি হেঁটে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে।
‘টিকেট। গ্রীন হিলস বম্বার টিকেট!’ বলল মুসা।
‘বাবা বলেছে গ্রীন হিলস ফুটবল দলটা এতটাই শক্তিশালী যে তাদের পেশাদার ফুটবলে নামা উচিত,’ বলল জুলি। ‘সব খেলার টিকেট আছে বাবার কাছে।’
‘আমার বাবা এই উইকএণ্ডের টিকেট পেয়েছে,’ সগর্বে বলল মুসা। ‘আমাকে বলেছে আমি তিনজন প্রিয় বন্ধুকে সাথে নিয়ে যেতে পারি।’
‘সাবাস!’ উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর। ‘আমাদের এখন বাকি সপ্তাহটা পার করতে হবে।’
‘মিস্টার বগির হাত থেকেও বেঁচে থাকতে হবে,’ যোগ করল ডানা।
‘মিস্টার বগিকে আমি ভয় পাই না,’ বলল কিশোর
‘না, কিন্তু বিছানার তলায় বাঘা ঢুকলে পাও,’ বলল মুসা।
ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল কিশোর।
‘সাবধান,’ বলল রবিন। ‘মিস্টার বগি বলেছে ঠিকমত হোমওয়র্ক না করলে খবর আছে।’
‘আমি হোমওয়র্ক করিনি,’ জানাল কিশোর।
‘আমিও, বলল জুলি। ‘তবে এ নিয়ে ভয় পাচ্ছি না। কারণ মিস্টার বগি তো স্রেফ একজন স্টুডেণ্ট টিচার।’
‘তা হতে পারে,’ বলল নথি। ‘কিন্তু আমার মন বলছে তাঁর ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকা উচিত।’
তিন
‘গো, বম্বার্স।’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। রবিন, মুসা আর ডানাও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল। ক’জন ফুটবল খেলোয়াড় দর্শকদের উদ্দেশে হাত নাড়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। শনিবারের খেলা শুরু হতে চলেছে। গ্রীন হিলস বম্বারদের ঠিক পিছনে রিচার্সে বসে চার বন্ধু। কালো ইউনিফর্মে দারুণ দেখাচ্ছে দলটিকে। এমনকী তাদের কালো হেলমেটও বিকেলের রোদ পড়ে ঝিকোচ্ছে।
‘মনে হচ্ছে আমি দলের সাথে বসে আছি,’ বলল ডানা। ‘ওদের প্রতিটা মুভ দেখতে পাব আমরা।’
‘এই সিটগুলো দারুণ!’ রবিন বলল মুসাকে।
‘এমনকী জুলির সিটের চাইতেও,’ হেসে বলল কিশোর। জুলি
বসেছে কিশোরের ঠিক পিছনে।
‘শুনে ফেলেছি,’ বলল জুলি।
কিশোর ঘুরে বসে জুলির উদ্দেশে নিষ্পাপ হাসল।
‘আসতে যে পেরেছি এই বেশি,’ বলল জুলি। ‘বাবা আমার রুম পরিষ্কার করছে।’
‘কী ব্যাপার বলো তো?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘কাল রাতের ঘটনা,’ বলল জুলি। ‘হোমওয়র্ক করার কথা, কিন্তু তার বদলে ডায়েরি লিখছিলাম। হঠাৎ আমার বিছানার তলা থেকে ধুপ-ধুপ শব্দ আসতে লাগল।’
‘ঠিক এমনটাই ঘটেছিল কিশোরের বেলাতেও,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রবিন। দর্শকরা হৈ-হৈ করতে আরম্ভ করলে ওর কথাগুলো বন্ধুদের কান পর্যন্ত পৌছল না।
‘আর তারপর,’ চেঁচামেচি সামলে কথার খেই ধরল জুলি, ‘হুশ করে একটা শব্দ, আর পরমুহূর্তে চারদিকে ফোয়ারার মত পানি ছিটাতে লাগল। বাবা বলেছে পানির পাইপ নাকি ভেঙেছে।’
‘শশশ!’ বলল মুসা। ‘খেলা শুরু হয়ে গেছে। খেলা দেখতে দাও। সাবাস, গ্রীন হিলস বম্বার্স!’
বম্বারদের রানিং ব্যাক ফুটবল হাতে ছুটে গেল মাঠ ধরে। অন্য দলের খেলোয়াড়দের দেখে মনে হলো তারা গতিজড়তায় ভুগছে। রানিং ব্যাক গোললাইন অতিক্রম করার পর, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল।
‘কী দৌড়টাই না দৌড়াল,’ বলল রবিন। ‘ইস, বড় হয়ে আমি যদি এরকম খেলতে পারতাম!’
‘এরকম স্পীড খুব কমই দেখা যায়,’ বলল মুসা।
চার বন্ধু বম্বারদের রানিং ব্যাককে জগ করে সাইডলাইনে আসতে দেখল, পানি পানের জন্য। পানির বোতল তুলে নিয়ে হেলমেট খুলল সে।
এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রূ কুঁচকে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের দিকে চাইল।
‘খাইছে,’ ককিয়ে উঠল মুসা। ‘দেখো কে ওটা!’
চার
‘গ্রীন হিলস বম্বারের স্টার প্লেয়ার কেন টিচার হতে চাইবে?’ প্রশ্ন করল রবিন।
‘এ তো জানা কথা,’ বলল কিশোর। ‘উনি পাগল। তা না হলে কেউ টিচার হয়ে সারা জীবন স্কুলে কাটাতে চায়?’
ডানা আলতো চাপড় মারল কিশোরের বাহুতে।
‘মিস্টার বগি পাগল নন,’ বলল ও। ওঁর দিনের বেলায় একটা কাজ দরকার তাই। রাগবি প্লেয়াররা বেশি টাকা কামাতে পারে না কিনা।’
‘পেশাদার হলে পারে,’ বলল জুলি।
মুসা কালো জার্সি পরা খেলোয়াড়দের দিকে আঙুল তাক করল। ‘ওঁর পেশাদার প্লেয়ার হওয়া উচিত,’ বলল ও। ওঁর যোগ্যতা আছে সেটা উনি নিজেও জানেন।’
গ্রীন হিলস বম্বাররা মাঠে সারি বেঁধে দাঁড়াচ্ছে। বিশালদেহী এক লোক মি. বগির পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘লেটস গো!’
গ্রীন হিলস বম্বাররা তৈরি। চওড়া কাঁধের বম্বারদের পাশে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে।
‘ওদের উচিত চাট্টিবাট্টি গোল করে চলে যাওয়া, বলল কিশোর। ‘বম্বাররা ওদেরকে গোহারা হারাবে।’
‘খেলার কথা আগে থেকে বলা যায় না,’ বলল মুসা।
‘খেলা শুরুর আগেই এই খেলা শেষ হয়ে গেছে,’ গর্বের সুরে বলল কিশোর। ‘এ শহরে হয়তো তেমন কিছু নেই, কিন্তু আমাদের এ বছরের দলটা তুখোড় হয়েছে। এতদিনে আমরা ভাল কিছু একটা পেতে চলেছি।’
মি. বগি একটা ফাম্বল সামলে ওঠার পর গ্রীন হিলস স্ট্যাণ্ডের সবাই উল্লাসধ্বনি করে উঠল
‘মিস্টার বগি স্টুডেণ্ট টিচার হিসেবে হয়তো আজব,’ শোরগোল থেমে গেলে বলল মুসা। কিন্তু তিনি রাগবি প্লেয়ার হিসেবে অসাধারণ।’
‘আজব না বলে অদ্ভুতুড়ে বলা যেতে পারে। তাঁর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় হোমওয়র্ক না করলে মাথা চিবিয়ে খাবেন।’ বলল ডানা।
‘উনি খুব স্বাভাবিক হবেনই বা কীভাবে?’ বলল রবিন। ‘ওঁকে মিসেস হকিন্সের সঙ্গে ওঠ-বস করতে হয়। মিসেস হকিন্সকে তো কিছুতেই স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় না।’
বন্ধুরা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল। ওদের সবার ধারণা মিসেস হকিন্সের সবুজ লকেটটা তাঁকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। টিচারকে ভীষণ ভয় পায় ওরা।
‘আমরা শেষ,’ ব্যথিত কণ্ঠে বলল জুলি।
‘সে তো স্কুলে,’ বলল কিশোর। ‘এটা ফুটবল মাঠ। স্কুল হাজার বছর দূরে।’
‘পরশু দিন,’ মনে করিয়ে দিল ডানা। ‘তবে হোমওয়র্ক করলে ভয়ের কিছু নেই।’
‘হোমওয়র্ক করার সময় কোথায়?’ জনতা হর্ষধ্বনি করলে তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। মি. বগি বম্বারদের এণ্ড জোনের উদ্দেশে ছুটছেন। লাইন পেরিয়ে টাচডাউন করলেন তিনি।
‘সাবাস!’ চিৎকার ছাড়ল উৎফুল্ল কিশোর। লক্ষই করল না মি. বগি সোজা ওর দিকে চেয়ে রয়েছেন।
পাঁচ
মুসা ওর ফুটবলটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে মারল। সোমবার সকাল। হোঁতকা ম্যাকনামারার সঙ্গে হেঁটে খেলার মাঠ পেরোচ্ছিল কিশোর। রবিন আর ডানা ওক গাছের নীচে অপেক্ষা করছিল মুসার সঙ্গে। ফুটবলটা উড়ে এল সোজা কিশোরের উদ্দেশে।
‘হেডস আপ!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। কিশোরের বুকের উপর পড়েছে ফুটবলটা। কিশোর টলে উঠে বসে পড়ল মাটিতে। মুসার ফুটবল গড়িয়ে গেল ম্যাকনামারার পাশ দিয়ে।
‘আমি এতটাই ফাস্ট, কিশোর আমাকে দেখতে পর্যন্ত পায়নি, ‘ ওক গাছের নীচ থেকে সোল্লাসে বলে উঠল মুসা। ‘গ্রীন হিলস বম্বার্স, আমাকে দলে নাও!’
‘তুমি যতটা ভাবছ ততটা ফাস্ট নও,’ খেঁকিয়ে উঠল কিশোর।
‘হ্যাঁচ্চো!’ ম্যাকনামারা হাঁচি দিয়ে কিশোরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াল।
প্যান্টের পিছনটা ঝেড়ে নিল কিশোর।
‘ঘুম-ঘুম না লাগলে ঠিকই ধরে ফেলতাম,’ বলল ও।
‘এত ক্লান্তি কীসের তোমার?’ প্রশ্ন করল রবিন। ‘আমরা তো হোমওয়র্ক আর বিশ্রাম করার জন্যে পুরো দু’দিন পেয়েছি।’
‘আমি গ্রীন হিলস বম্বারদের খেলা দেখেছি,’ বলল কিশোর।
‘আমিও,’ স্বীকার করল ম্যাকনামারা। আবারও হাঁচি দিল।
‘আর একটুও ঘুমোতে পারিনি, কারণ বাতি নিভালেই এমন শব্দ হয় যেন বিছানার নীচে পার্টি হচ্ছে,’ বলল কিশোর।
‘বাঘা কি এখনও তোমার খাটের তলায় ঘুমোচ্ছে?’ রবিন প্রশ্ন করল।
‘না, কিন্তু এখনও শব্দ হচ্ছে,’ বলল কিশোর।
‘শব্দটা শুনলে কি মনে হয় কেউ দেয়ালে নখ আঁচড়াচ্ছে?’ ম্যাকনামারা জিজ্ঞেস করল। মুখের চেহারা মড়ার মতন ফ্যাকাসে।
‘দুপ-দুপ শব্দে কি মনে হয় কেউ মেঝেতে মাথা ঠুকছে?’
‘ঠাণ্ডাটা তোমার মাথায় উঠে গেছে,’ ম্যাকনামারাকে বলল মুসা। ‘ফলে মাথা গেছে গুবলেট হয়ে।’
রবিন আর ডানা হেসে উঠলেও, কিশোরের মুখে হাসির লেশমাত্র নেই।
‘ঠাট্টা করছ না তো? শব্দটা তোমার নিজের তৈরি নয় তো?’ প্রশ্ন করল কিশোর।
ম্যাকনামারা পিছিয়ে গেল যতক্ষণ না ওক গাছে কাঁধ ঠেকে।
‘প্রশ্নই ওঠে না, জানাল।
‘তা হলে আমি কী শব্দ শুনেছি তা তুমি জানলে কীভাবে?’ জবাব চাইল কিশোর।
‘কারণ, আমারও মনে হয়েছে আমার বিছানার তলায় কিছু একটা আছে,’ বলল ম্যাকনামারা।
মুসা জোরে হেসে উঠল
‘তোমার বিছানার নীচে যা জঞ্জাল, কোন কিছু ঢুকবে কীভাবে?’ ম্যাকনামারার অগোছাল ঘরটি সম্পর্কে সবারই জানা আছে।
‘মাও একথাই বলেছিল,’ স্বীকার করল ম্যাকনামারা। ‘আমাকে বাধ্য করেছে বিছানার তলা পরিষ্কার করতে। প্রচুর ধুলো বেরিয়েছে। এ ছাড়াও অন্য জিনিস।’
‘হারানো খেলনা?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল ম্যাকনামারা।
‘কিছু পুরানো জিনিস পাওয়া গেছে। বেশির ভাগই আমার। তবে সবগুলো নয়।’
‘তার মানে?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।
‘ওখানে বিস্কুটের গুঁড়ো আর একটা সোডা ক্যানও ছিল, ফিসফিস করে বলল ম্যাকনামারা।
ম্যাকনামারার পেটে খোঁচা মারল কিশোর।
‘রাতের বেলা তুমি বেশি স্ন্যাক্স খাচ্ছ,’ বলল।
‘ওই বিস্কুটগুলো আমার না,’ ম্যাকনামারা বলল। ‘আমার মনে হয় কেউ—কিংবা কিছু একটা আমার বিছানার নীচে থাকছে!’
হেসে ফেলল ডানা আর মুসা।
‘খাইছে, বিছানার তলায় দানব?’ বলল মুসা।
‘মুসা ঠিকই বলেছে,’ বলল রবিন। ‘তুমি সারাক্ষণই কিছু না কিছু খাচ্ছ। মনে হয় ভুলেই গেছ বিস্কুটগুলো কখন রুমে নিয়ে গেছ।’
‘হতে পারে,’ বলল ম্যাকনামারা, ব্যাকপ্যাকের ভিতরে হাত ভরে দিল। ‘কিন্তু এটার কী ব্যাখ্যা দেবে তোমরা?’
ছয়
‘খাইছে!’ মুসা এমনভাবে ফিসফিস করে উঠল যেন বারাক ওবামাকে স্বচোখে দেখেছে। ‘এটা পেলে কোথায়?’ ম্যাকনামারার হাত থেকে বলটা নিয়ে চামড়ায় লেখা স্বাক্ষরটা পড়ল। ‘গ্রীন হিলস বম্বারদের কোচ সাইন করেছেন এটায়।
‘তুমি এটা পেলে কোথায়?’ ডানার প্রশ্ন।
‘বলেছি তো, খাটের তলায়,’ জানাল ম্যাকনামারা।
‘তুমি ওখানে না রাখলে কে রাখল?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল। খিলখিল করে হেসে উঠল ডানা।
‘হয়তো বগিম্যান রেখেছে।’
মুসা হেসে উঠল আর কিশোর চোখ ঘুরাল। কিন্তু রবিন ডানার বাহু আঁকড়ে ধরল। ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে ও।
‘কী ব্যাপার?’ ডানা জানতে চাইল।
রবিনের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে।
‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।’
রবিনের নাকের সামনে আঙুল নাচাল কিশোর।
‘তোমাকে না কতবার বলেছি বেশি বেশি আইডিয়া আসা বিপজ্জনক!’ বলল ও।
‘স্টুডেণ্ট টিচারের চাইতে বেশি বিপজ্জনক নয়,’ বলল রবিন।
‘ম্যাকনামারার বিছানার তলায় বিস্কুটের গুঁড়ো আর ফুটবল পাওয়া গেলে তার সাথে মিস্টার বগির কী সম্পর্ক?’ মুসা প্রশ্ন করল।
রবিন ঢোক গিলে মাঠের চারধারে নজর বুলিয়ে নিল।
‘কারণ,’ শেষমেশ বলল ও, ‘মিস্টার বগিই বগিম্যান!’
কিশোর হেসে উঠে রবিনের পিঠে চাপড় মারল।
‘শেষ পর্যন্ত ছেলে ভুলানো গল্প নিয়ে এসেছ!’
‘ছেলে ভুলানো নয়,’ রবিন বলল। ‘বগিম্যান গ্রীন হিলসে এসেছে, এবং সে একজন গ্রীন হিলস বম্বার।’
‘আর আমি বর্ষসেরা সুপারবল প্লেয়ার,’ বলে হেসে ফেলল মুসা। ‘গ্রীন হিলসে বগিম্যানের কী কাজ?’ ডানার প্রশ্ন।
‘জানি না,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। বগিম্যান বিছানার তলায় লুকিয়ে থাকে, আর ভয়ঙ্কর সব শব্দ করে ছেলে-মেয়েদের জাগিয়ে রাখে। মিস্টার বগি আমাদের টিচার হয়ে আসার পর থেকে কিশোরের বেলাতে এমনটাই ঘটে চলেছে।’
‘উনি কিশোরকে বলেছিলেন পড়া না করলে খবর আছে,’ বলল ডানা।
‘সেটা যে কোন টিচারই বলতে পারেন,’ বলল মুসা। ‘তাতে কিছু প্রমাণ হয় না।’
‘কিন্তু এতে হয়।’ রবিন মুসার হাতে ধরা গ্রীন হিলস বম্বারদের ফুটবলটা ইশারায় দেখাল। যখনই খাটের তলায় বগিম্যানের খোঁজ করা হয়, সে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু এবারে বগিম্যান ম্যাকনামারার বিছানার নীচে একটা বল ফেলে গেছে।’
‘তুমি কি বলতে চাইছ বগিম্যান আমার বিছানার নীচে থাকে?’ ককিয়ে উঠল ম্যাকনামারা।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘তবে ভয় পেয়ো না, যেহেতু বিছানার তলা পরিষ্কার করেছ ও এখন সম্ভবত তোমার ক্লজিটে আস্তানা গাড়বে।’
ম্যাকনামারাকে দেখে মনে হলো এখুনি মূর্ছা যাবে বুঝি। ‘রবিনের কথায় কান দিয়ো না,’ বলল মুসা। ‘বগিম্যান কখনও ফুটবল খেলে না।’
‘মুসা ঠিক বলেছে,’ বলল কিশোর। এবার মুসার হাত থেকে গ্রীন হিলস বম্বার ফুটবলটা কেড়ে নিল। ‘কিন্তু আমরা খেলি!’
বলটা বগলের নীচে গুঁজে দৌড় দিল ও। ওকে ধাওয়া করল মুসা। ডানা, রবিন আর ম্যাকনামারাও যোগ দিল। গোটা খেলার মাঠে কিশোরকে তাড়া করে বেড়াল ওরা।
মুসা ছিল কিশোরের একদম কাছে। কিশোরকে ট্যাকল করতে হাত বাড়িয়েও সুযোগ পেল না।
কিশোর ওক গাছের পাশ কাটানোর জন্য দৌড়ে যেতেই লম্বা কালো এক ছায়া আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। কিশোর থামতে চেষ্টা করল, কিন্তু জুতোর ফিতেয় পা বেধে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মুখ তুলে চাইছে তো চাইছেই, শেষমেশ মি. বগির সঙ্গে চোখাচোখি হলো।
‘সাবধান,’ মি. বগি বললেন। ‘নইলে খবর আছে!’
সাত
‘আমি ভেবেছিলাম মিস্টার বগি কিশোরকে না জানি কী বলবেন, ‘ স্কুলের পরে বলল মুসা। ‘কিন্তু উনি শুধু ছুটির পরে ওকে দিয়ে হোমওয়র্ক করিয়ে নিচ্ছেন।
‘ম্যাকনামারাকে দিয়েও,’ বলল ডানা। মুসা, রবিন আর ডানা ওক গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘বুঝতে পারছি না মিস্টার বগি আজ সকালে কীভাবে আমাদের পাকড়াও করলেন,’ বলল ডানা।
‘বগিম্যান যে কোনখানে নিঃশব্দে হাজির হতে পারে,’ মৃদু কণ্ঠে বলল নথি।
‘তুমি কি সত্যিই বগিম্যানে বিশ্বাস কর নাকি?’ প্রশ্ন করল মুসা। ‘মিস্টার বগি কড়া ধাঁচের স্টুডেণ্ট টিচার কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি মোটেই মানুষের বিছানার নীচে থাকেন না।’
‘হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেন তিনি,’ বলল ডানা। ‘বেখাপ্পা সব জায়গায়।’
‘যেমন কিশোর আর ম্যাকনামারার বিছানার তলায়,’ শেষ করল রবিন।
‘আর তোমার কল্পনায়,’ রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল মুসা।
‘ঠাট্টা করছ করো,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু আমি হলে মিস্টার বগির হোমওয়র্ক ঠিকঠাক মত করতাম।’
‘বিছানার তলার দানবের সাথে হোমওয়র্কের কী সম্পর্ক?’ মুসার প্রশ্ন।
‘ভেবে দেখো, কিশোর আর ম্যাকনামারা হোমওয়র্ক করেনি। এমনকী করার চেষ্টাও করেনি,’ বলল রবিন।
‘তাতে কী? জুলিও তো হোমওয়র্ক করেনি,’ বলল মুসা।
‘আহহহ!’ হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল ডানা। ‘রবিনের কথাই ঠিক মিস্টার বগিই বগিম্যান!’
কোমরে দু’হাত রাখল মুসা।
‘শেষ পর্যন্ত তুমিও?’ বলল ও।
মুসার বাহু চেপে ধরল ডানা।
‘কেন বুঝতে পারছ না?’ প্রশ্ন করল। ‘জুলি, কিশোর আর ম্যাকনামারা বিছানার নীচে অদ্ভুত শব্দ শুনেছে, এবং মিস্টার বগি বলেছিলেন হোমওয়র্ক না করলে ওদের খবর আছে!’
‘মিস্টার বগি বোঝাতে চেয়েছিলেন ওদেরকে ছুটির পর থাকতে বাধ্য করবেন। তাই বলেছিলেন ওদের খবর আছে,’ ব্যাখ্যা করে বলল মুসা।
‘তুমি যখন এতটাই শিয়োর তখন প্রমাণ করছ না কেন?’ জানতে চাইল রবিন।
মুসা জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
‘আমি রবিনের বিছানার নীচে রাত কাটাতে পারব না,’ বলল ও। ‘কাটালে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখব।’
‘কাটাতে হবে না,’ বলল রবিন। ‘তুমি শুধু কথা দাও হোমওয়র্ক করবে না।’
‘কিন্তু ওর তো তা হলে সমস্যা হবে,’ বলল ডানা।
‘মিস্টার বগি যে বগিম্যান নন তা প্রমাণ করার এটাই একমাত্র উপায়,’ বলল রবিন। ‘তা যদি উনি না হন, মুসা আরামে ঘুমোবে। কিন্তু উনি যদি বগিম্যান হন, তা হলে সারা রাত বিছানার নীচে শব্দ শুনবে।’
‘আমি বগিম্যান-টগিম্যান মানি না,’ খেঁকিয়ে উঠল মুসা।
‘তা হলে আমি যা বলছি করবে?’ রবিনের জিজ্ঞাসা।
মুসা জবাব দেয়ার আগেই সবুজ এক ভ্যান বাঁক ঘুরে ব্রেক কষে দাঁড়াল। মুসা ওর বাবার ভ্যান দেখামাত্র দৌড়ে গিয়ে জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ল।
‘ইয়াহু!’ একটু পরে, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে বন্ধুদের কাছে দৌড়ে ফিরে এল ও। ‘বাবা আমাদের জন্যে আরও গ্রীন হিলস বম্বার টিকেট নিয়ে এসেছে। আমরা আজ রাতে খেলা দেখতে যাচ্ছি! আমরা এমনকী খেলার আগে লকার রুমও ঘুরে দেখতে পারব!’
রবিনের মুখের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
‘কী হলো?’ মুসা জবাব চাইল।
‘আমরা খেলা দেখতে গেলে, আস্তে আস্তে বলল রবিন, ‘হোমওয়র্ক করার সময় পাব না। এর মানে একটাই। বগিম্যান আমাদেরকে বাগে পাবে!’
আট
‘ওরা ন্যাংটো নাকি?’ প্রশ্ন করল ডানা। চোখে হাত চাপা দিয়ে কিশোর, মুসা, রবিন আর মি. আমানকে অনুসরণ করে গ্রীন হিলস বম্বারদের লকার রুমে ঢুকল।
মুসা ডানার হাত সরিয়ে দিল চোখের উপর থেকে।
‘ধুর বোকা,’ বলল। ‘খেলা এখুনি শুরু হবে। সবাই পোশাক পরে রেডি।’
লকার রুমে শোল্ডার প্যাড আর কালো ইউনিফর্ম পরা বিশালদেহী লোকজন গিজগিজ করছে। অতিকায় সব অ্যান্টইটারের মাঝখানে নিজেকে ছোট্ট এক পিঁপড়ে মনে হচ্ছে ডানার। গ্রীন হিলস বম্বারদের কোচ মি. আমানের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে হাত ঝাঁকিয়ে দিলেন।
‘আসুন,’ কোচ বললেন। দলের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই।’
কোচ ঘুরে ঘুরে কজন বিশালদেহী খেলোয়াড়ের সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওরা যখন মি. বগির সামনে থেমে দাঁড়াল, ঢোক গিলল ডানা। মি. বগির গালে কালো রং, ভ্রূ কোঁচকানো।
‘তোমরা এখানে কী করছ?’ মি. বগি জিজ্ঞেস করলেন। হেসে উঠলেন কোচ।
‘এরা শহরের সেরা দলের খেলা দেখতে এসেছে,’ মি. বগিকে বললেন।
‘ওদের এখানে না এসে হোমওয়র্ক করা দরকার ছিল,’ মি. বগি ঘাউ করে উঠে বিশাল এক মুঠো দিয়ে ঘুষি বসালেন অন্য হাতের তালুতে।
মি. আমান মুসার কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
‘মুসা সব সময় হোমওয়র্ক করে রাখে,’ সগর্বে বললেন মি. বগিকে।
মি. বগি মি. আমানের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকিয়ে ডানা, কিশোর, মুসা আর রবিনের দিকে চাইলেন।
‘হোমওয়র্ক করে রেখো, নইলে কিন্তু ধরব,’ সতর্ক করলেন। কালো হেলমেটটা তুলে নিয়ে মাথায় বসালেন। এখন কেবল তাঁর কালো, কুতকুতে চোখজোড়া দেখা যাচ্ছে ফেস মাস্কের আড়াল থেকে।
মুসা ভান করল ভয় পায়নি।
‘গুড লাক,’ ককিয়ে উঠে বলল।
‘চলো,’ গলা ছাড়লেন কোচ। ‘মাঠে চলো।’
লকার রুম থেকে যেন একদল মোষের মত ক্ষুর দাপিয়ে বেরিয়ে এল গ্রীন হিলস বম্বাররা। তিন বন্ধু, ডানা আর মি. আমান দলকে অনুসরণ করলেন। ছেলে-মেয়েরা রিচার্সে বসার পর মি. আমান পপকর্ন আনতে গেলেন।
‘মিস্টার বগির কথা শুনলে?’ বন্ধুদের প্রশ্ন করল রবিন।
‘হোমওয়র্ক না করলে ধরবেন বলেছেন,’ নাকি সুরে বলল ডানা। ‘আমি, বাবা, বাসায় গিয়ে এখুনি হোমওয়র্ক নিয়ে বসতে চাই।’
‘বোকার মত কথা বোলো না। উনি আমাদেরকে স্রেফ ভয় দেখিয়েছেন,’ বলল কিশোর।
‘তাতে কাজও হচ্ছে,’ বলল ডানা।
রবিন মাঠে জড় হওয়া গ্রীন হিলস বম্বার ফুটবল দলটাকে আঙুল- ইশারায় দেখাল।
‘ভয় পাওয়ার কারণ আছে। বগিম্যান আমাদের পিছে লেগেছে,‘ বলল ও।
‘ধুত্তোরি, মিস্টার বগি মোটেই বগিম্যান নন এবং আমি তা প্রমাণ করে দেখাব,’ বলল কিশোর। ‘এসো।’ কিশোর লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।
‘কোথায় যাচ্ছে ও?’ মুসা জানতে চাইল।
‘নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে,’ বলল ডানা।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘ওকে আমাদের ঝামেলা থেকে বাঁচানো দরকার,’ বলল। ‘সম্ভব নয়। এখুনি খেলা শুরু হবে,’ বলল মুসা।
‘বেশিক্ষণ লাগবে না,’ বলল রবিন। ওরা তিনজন লাফিয়ে উঠে কিশোরের পিছু ধাওয়া করল। কিশোর ‘প্রাইভেট’ লেখা এক দরজা দিয়ে ঢুকছে এসময় ওকে দেখতে পেল মুসা, রবিন আর ডানা।
‘ওটা লকার রুমের দরজা,’ বলল ডানা। ‘কিশোরের ওখানে ঢোকা ঠিক হয়নি।’
‘ওর বড় ধরনের বিপদে পড়ার আগেই ওকে থামাতে হবে, বলল মুসা। দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল তিনজন। ওদের পিছনে দরজাটা লেগে গেল সশব্দে। কালিগোলা আঁধার গ্রাস করল সবাইকে।
‘কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না,’ শিউরে উঠে বলল ডানা।
ও ও ও ও ও হ হ হ হ হ!’
জোরাল এক গোঙানির শব্দ কানে এল ওদের।
‘ও ও ও ও ও হ হ হ হ হ!‘
‘খাইছে, কীসের শব্দ?’ প্রশ্ন করল মুসা।
‘জানি না,’ বলল রবিন, পিছনে দরজার হাতল খুঁজছে পাগলের মত। ‘তবে যাই হোক, এদিকে কাছিয়ে আসছে!’
নয়
‘আউচ!’ বলে উঠে লকার রুমের বাতিগুলো জ্বেলে দিল কিশোর।
‘কী হয়েছে তোমার?’ মুসার প্রশ্ন।
কিশোর মেঝেতে বসে পায়ের পাতা ডলতে লাগল।
‘পায়ে ব্যথা পেয়েছি,’ বলল।
ডানা হেসে ফেলল খিলখিল করে।
‘তার মানে তুমি গোঙাচ্ছিলে?’
‘তা হলে কে? বগিম্যান?’ পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
জবাব না দিয়ে লকার রুমের চারধারে নজর বুলিয়ে নিল মুসা, রবিন আর ডানা।
‘তুমি এখানে কী করতে এসেছ?’ কিশোরকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
‘প্রমাণ করতে যে মিস্টার বগি সম্পর্কে তোমাদের ধারণা ভুল, ‘ বলল কিশোর।
‘কী ধরনের প্রমাণ?’ মুসা জানতে চাইল।
ধূসর ধাতব এক লকারের কাছে চলে এল কিশোর।
‘এখনও শিয়োর না, বলল। ‘তবে দেখলেই জেনে যাব।’ লকারটা খুলে ভিতরে চোখ রাখল ও। ‘মোজার দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছু নেই।’ লকারটা দড়াম করে লাগিয়ে দিল।
ডানা বুকের উপর আড়াআড়ি দু’হাত রাখল।
‘অন্যের লকারে উঁকি দেয়া ঠিক নয়,’ বলল।
‘বগিম্যান সত্যিই আছে কিনা জানতে চাও না?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।
‘তা চাই,’ আস্তে করে বলল ডানা।
‘তা হলে এখানেই খুঁজে দেখতে হবে,’ বলে এক লকারের সামনে দাঁড়াল কিশোর। লকারটায় লেবেল সাঁটা: বি. বগি।
‘আমি দেখি,’ বলে লকারের হাতল ধরে টানল মুসা। ‘আহহহহ!’ বিশাল এক দেহ ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আর্তনাদ ছাড়ল ও। ‘খাইছে, বাঁচাও! বগিম্যান!’ ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।
কিশোর মুসার উপর থেকে অবয়বটা সরিয়ে নিতেই গড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল ও।
‘এই তোমার বগিম্যান,’ বলল কিশোর। হেসে উঠে কালো এক ইউনিফর্ম তুলে ধরল। শোল্ডার প্যাড নিয়ে এক রাগবি জার্সি এবং উপরে এক হেলমেট।
‘তুমি না বলে বগিম্যানে বিশ্বাস করো না,’ মুসাকে বলল রবিন। ‘করি না-ই তো,’ মিথ্যে বলল মুসা। ‘কিন্তু ওভাবে একটা ইউনিফর্ম গায়ের ওপর পড়লে সবাই ভয় পাবে।’
‘অনেক হয়েছে,’ বলল ডানা। মুসাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। ‘রবিন বগিম্যানের কথা বলে আমাদেরকে ভয় দেখিয়েছে আর লোকে হোমওয়র্ক না করলে আমাদের দেখে নেবে বলে শাসাচ্ছে। এই ভুতুড়ে লকার রুম থেকে বেরিয়ে সবাই খেলা দেখতে চলো।’
‘চলো,’ বলে দরজার দিকে পা বাড়াল কিশোর। কিন্তু অতদূর পৌছতে পারল না। প্রকাণ্ড এক থাবা ওর কাঁধ চেপে ধরল।
দশ
কিশোরের কী হলো দেখার জন্য অপেক্ষা করল না ডানা। ঝেড়ে দৌড় দিল।
‘আহ!’ সরাসরি খেলার মাঠের দিকে খোলে এমন এক দরজা খুলে চেঁচিয়ে উঠল ও। টলতে টলতে গ্রীন হিলস বম্বারদের চিয়ারলিডারদের মধ্যে পড়ে গেল। ওরা তখন কালো পম-পম নেড়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।
‘গেট ডাউন, বুগি-উগি-উগি!’ চিয়ারলিডাররা মন্ত্রোচ্চারণের মত করে বলছে। এক চিয়ারলিডার ডানার মুখের সামনে পম-পম নাড়ল।
ডানা যখন আসন খুঁজে পেল মুখের চেহারা টকটকে লাল তার। স্ট্যাণ্ডের দর্শকদের কেউ কেউ ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে জানতে চাইল চিয়ারলিডিং কেমন লাগল।
‘এত অপ্রস্তুত আর কখনও হইনি,’ জানাল ডানা।
মুসা, রবিন আর কিশোর ওর পাশে এসে বসল। মুসা এক হাতে ডানার কাঁধ জড়িয়ে ধরল।
‘ভেবো না। কালকেই কেউ আর এ ঘটনা মনে রাখবে না,‘ বলল।
‘তুমি দৌড় দিলে কেন?’ রবিন প্রশ্ন করল ডানাকে। ‘বগিম্যান ধরবে ভেবে?’
ঢোক গিলল ডানা।
‘কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।’
‘কোচ এসে আমাদেরকে বললেন লকার রুমে না থাকতে, তাই চলে এসেছি আমরা,’ ব্যাখ্যা করল মুসা।
‘বলতে চাইছ মিস্টার বগি তোমাকে ধরেননি?’ কিশোরকে জিজ্ঞেস করল ডানা।
‘না,’ কিশোর জানাল। ‘কিন্তু উনি টাচডাউন করতে যাচ্ছেন।’ মাঠের দিকে তর্জনী নির্দেশ করল ও। খেলা শুরু হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই বল এসে গেছে মি. বগির হাতে। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে দৌড়তে দেখছে। তাঁর দৌড় যেন থামবেই না। অন্য দল তাঁকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারল না। মি. বগি চল্লিশ গজ লাইনে দৌড়ে গেলেন, তারপর ত্রিশ।
চিয়ারলিডাররা চেঁচাচ্ছে, ‘বুগি-উগি-উগি!’
মি. বগি যখন বিশগজ লাইন পেরিয়ে গেলেন, ডানার পিছন থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘বগির দৌড় দেখো!’
আরেকজন চেঁচাল, ‘বুগি-উগি, বগিম্যান!
মি. বগি পাঁচ গজী লাইন পেরনোর পর, চিয়ারলিডাররা আর জনতা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল
‘বুগি-উগি করো, বগি!
মি. বগি টাচডাউনের জন্য দৌড়ে গেলে উন্মাদ হয়ে উঠল দর্শকরা।
‘বুগি-উগি!’ গর্জে উঠল তারা।
‘দেখলে?’ মি. আমান বললেন, ছেলে-মেয়েদের পাশে একগাদা পপকর্ন আর সোডা নিয়ে বসলেন। ‘অন্য কাউকে এরকম দৌড়তে দেখেছ?’
রবিন এক প্যাকেট পপকর্ন ও একটা ড্রিঙ্ক নিল।
‘ধন্যবাদ, আঙ্কল,’ বলল মি. আমানকে। কিশোরের দিকে এক প্যাকেট পপকর্ন বাড়িয়ে দিল। ‘আমি একজনকে এরকম দৌড়তে দেখেছি,’ ফিসফিস করে কিশোরকে বলল।
‘কোথায়?’ কিশোরের জিজ্ঞাসা।
‘দুঃস্বপ্নে,’ জবাব দিল নথি 1
কিশোর এক মুঠো পপকর্ন ছুঁড়ে দিল রবিনের দিকে।
‘তুমি এখনও বগিম্যানকে নিয়ে পড়ে আছ?’
‘আমি একাই মিস্টার বগিকে বগিম্যান ভাবছি না,’ রবিন বলল কিশোরকে। ‘দর্শকরা কী বলছে শোনো।’
মি. বগি গোলপোস্টের পাশে খানিকটা নাচ জুড়ে দিতেই হৈ-হৈ করে উঠল চিয়ারলিডার আর দর্শকরা। দর্শকদের স্লোগান শুনে গলায় পপকর্ন আটকাল কিশোরের।
‘গেট দেম, বগিম্যান! গেট দেম, বগিম্যান!’
রবিন কিশোরের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল।
‘দেখলে,’ বলল ও, ‘এমনকী দর্শকরাও জানে মিস্টার বগি যে বগিম্যান!’
এগারো
‘আমি কাজটা করেছি,’ পরদিন সকালে ওক গাছের নীচে বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বলল মুসা। ‘কিংবা বলা উচিত করিনি।’
‘কী বলছ উল্টোপাল্টা?’ কিশোর প্রশ্ন করল।
মুসা চারপাশে নজর বুলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ শুনছে না। ‘আমি হোমওয়র্ক করিনি,’ শেষমেশ জানাল।
‘তাতে কী?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর। মুসা বড়াই করছে কেন বুঝতে পারছে না ও।
ডানার চোখজোড়া বিস্ফারিত।
‘কিন্তু মুসা তো সব সময় হোমওয়র্ক করে!
দাঁত বের করে হাসল মুসা।
‘এবার নয়। আমি প্রমাণ করতে চাই কিছুই ঘটবে না।’
‘যাতে প্রমাণ হয় মিস্টার বগি বগিম্যান নয়?’ ডানার জিজ্ঞাসা।
‘জানতাম,’ বলল কিশোর। ‘তুমি প্রমাণ করেছ মিস্টার বগি স্রেফ একজন স্টুডেণ্ট টিচার। খারাপ কোন কিছুই ঘটেনি।
‘হয়েছে কী,’ বলে চোখ ঘষল মুসা। ‘তা ঠিক নয়। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।’
‘বিছানার নীচে শব্দ শুনেছ?’ রবিনের প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল মুসা।
‘না। আমি শুনেছি অদ্ভুত বীপ-বীপ শব্দ। ‘
‘শুনে মনে হচ্ছে ভিনগ্রহবাসী,’ বলল কিশোর। ‘বগিম্যান নয়।’
‘ওটা ছিল আমাদের স্মোক অ্যালার্মের শব্দ,’ ব্যাখ্যা দিল মুসা। ‘ওটা রয়েছে লিভিং রুমে, আমার বেডরুমের ঠিক নীচে। নতুন ব্যাটারি লাগবে।’
রবিন একটা আঙুল তাক করল মুসার উদ্দেশে।
‘এসব ঘটেছে কারণ তুমি হোমওয়র্ক করনি,’ বলল ও। ‘মিস্টার বগি স্মোক অ্যালার্ম গুবলেট করে দিয়ে তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন।’
‘আমার ভয় করছে,’ বলল ডানা। ‘মিস্টার বগি আমাদের সবাইকে একে একে ধরবেন। আমাদের খবর আছে!’
‘এত ভয় কীসের? হোমওয়র্ক করলেই তো তুমি নিরাপদ,’ বলল, রবিন।
ডানা শিউরে উঠে সোয়েটারটা টেনেটুনে ভালভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল।
‘আমি চাই না কারও ভাগ্যে খারাপ কিছু ঘটুক। নিজেদের বাঁচানোর কি কোনই পথ নেই আমাদের?’ বলল ও।
‘এটা নিয়েই ভাবছি,’ বলল রবিন। ‘সবাই জানে বগিম্যান রাতের আঁধারে মানুষকে ভয় দেখাতে চায়।’
‘তো?’ মুসা বলল।
‘আমরা যদি সবাই লাইট জ্বেলে ঘুমাই?’ বাতলে দিল রবিন। ‘তা হলে হয়তো বগিম্যানের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।’
‘চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী,’ সায় জানিয়ে বলল মুসা। ‘আমি জুলি আর ম্যাকনামারাকে বলব।’
‘কিন্তু আজকে কী হবে?’ ডানা জিজ্ঞেস করল। ‘আমার তো ভয় করছে।’
‘ভয় পেয়ো না,’ অভয় দিল মুসা। আজকে সারাদিন মিসেস হকিন্স থাকবেন। মিস্টার বগি কাউকেই ধরতে পারবেন না।’
‘এখানটাতেই ভুল করছ তুমি,’ বলল রবিন। এসময় স্কুল বসার ঘণ্টা বাজল। ‘আজকে মিস্টার বগির একাই পড়ানোর কথা। মিসেস হকিন্স আমাদের বাঁচাতে আসবেন না!’
‘আমরা আশা করছি ভ্যাম্পায়ার টিচার আমাদেরকে বগিম্যানের হাত থেকে বাঁচাবেন! ভালই বলেছ!’ বাঁকা হেসে বলল কিশোর।
‘বগিম্যান টিচার হয়ে আসার পর থেকে আমাদের সাবধান আর সতর্ক থাকা উচিত,’ বলল রবিন।
কিশোর হেসে উঠল।
ছেলে-মেয়েরা স্কুল বিল্ডিঙের দিকে পা বাড়াল।
‘দেখো আমি কী করি, বলল কিশোর। ‘আমি চিরতরে প্রমাণ করে দেব মিস্টার বগি বগিম্যান নন!’
বারো
ডানা রবিনের বাহু চেপে ধরল।
‘ও কী করবে?’ ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
রবিনের মুখের চেহারা দেখে মনে হলো এইমাত্র প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছে।
‘কিশোরকে যদ্দূর চিনি ও মিস্টার বগি যে বগিম্যান নন সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে।’
‘ও না আবার ঝামেলা পাকায়,’ আশঙ্কা প্রকাশ করল মুসা। ‘ওকে ঠেকাতে হবে,’ বলল ডানা। ‘নইলে বগিম্যান আজ রাতে ওকে ধরবে।’
‘বগিম্যানের কথা বাদ দাও,’ বলল মুসা। ‘কিশোরকে না ঠেকালে স্কুলের সব টিচার ওকে ধরবে!’
রবিন, মুসা আর ডানা ক্লাসে ঢোকার সময় দেখতে পেল ওরা দেরি করে এসেছে। কিশোর ইতোমধ্যে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
প্রতিটা ডেস্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পেন্সিলগুলো টোকা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে ও। সারির শেষ প্রান্তে পৌঁছে, ক্লাসের সামনের দিকে চাইল। মি. বগি এসবের কিছুই দেখতে পাননি। বোর্ডে ম্যাথ প্রবলেম লিখতে ব্যস্ত তিনি।
‘এগুলো প্র্যাকটিস, করলে,’ বললেন তিনি, ‘কালকের টেস্টে তোমরা ভাল গ্রেড পাবে।’
কিশোর এ কথায় কান দিল না। আরেক সারিতে ঢুকে সহপাঠীদের কাগজ ঠেলে ফেলে দিল মেঝেতে।
‘কী করছ!’ খেঁকিয়ে উঠল জুলি। এবার হাত দোলাল। ‘মিস্টার বগি,’ গলা ছেড়ে ডাকল। ‘কিশোর আমাকে ডিস্টার্ব করছে।’
মি. বগি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিশোরের দিকে চাইলেন। গোটা ক্লাসরুম নিস্তব্ধ।
‘কিশোর ওর সিটে না যাওয়া পর্যন্ত ওর ওপর নজর রাখব আমি, ‘ গর্জে উঠলেন।
কিশোর বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি। প্রমাণ করতে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ মি. বগি বগিম্যান নন। চোখ বুজল ও, যাতে কিছু দেখতে না পায়। এবার সামনে দু’হাত নাড়তে শুরু করল।
‘আমার ডেস্ক খুঁজে পাচ্ছি না!’ চেঁচিয়ে উঠল।
রবিন, মুসা আর ডানা ক্লাসরুমের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তিনজনই কিশোরের কথা ভেবে আতঙ্কিত।
মি. বগি এক পা এগোলেন, এবার আরেক পা। থপ-থপ করে ভারী পা ফেলে কিশোরের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালেন।
চোখ মেলল কিশোর। সরাসরি মি. বগির চোখে চোখে চাইতে হলো ওকে।
‘বসে পড়ো। এখুনি,’ ঘাউ করে উঠলেন মি. বগি।
কিশোর মাথা ঝাঁকিয়ে ঝটপট চেয়ার খুঁজে নিলে চেপে রাখা দমটা ছাড়ল মুসা।
‘কিশোরের মনে হয় শিক্ষা হয়েছে,’ ফিসফিস করে রবিন আর ডানার উদ্দেশে বলল।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘ওর বগিম্যানের সাথে লাগতে যাওয়া ঠিক হয়নি।’
ওরা তিনজন ঝটপট যার যার সিটে গিয়ে বসে ম্যাথ প্রবলেম টুকতে লাগল। প্রতিটা সমস্যার সমাধান করার পর কিশোরের দিকে চোরা চাউনি হানল রবিন। দেখে মনে হলো কিশোর ওর পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে। ডেস্কে মাথা নুইয়ে মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক কষছে ও।
রবিনের প্রায় সবকটা অঙ্ক করা হয়ে গেছে, এসময় একটা কাগজের প্লেন ঠোকর খেল ওর গালে।
ও মুখ তুলে চেয়ে দেখল, কিশোরের ছোঁড়া এক কাগজের গোলা উড়ে গিয়ে মুসার মাথায় পড়ল।
‘ফিল্ড গোল!’ হেসে উঠে আরেকটা গোলা ছুঁড়ে দিল কিশোর। ওটা সোজা গিয়ে পড়ল মি. বগির খোলা অঙ্ক বইয়ের মাঝখানে।
‘টাচডাউন!’ বলল কিশোর। এবার উঠে দাঁড়িয়ে নিজস্ব বুগি-উগি টাচডাউন নাচ জুড়ে দিল
‘বসে পড়ো, নইলে বগিম্যান ধরবে!’ হিসিয়ে উঠল রবিন।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মি. বগি দুপ-দাপ করে গিয়ে সব কটা বাতির সুইচ অফ করে দিলেন। সূচীভেদ্য অন্ধকারে ঢাকা পড়ল গোটা ক্লাসরুম।
তেরো
পরদিন সকাল। ঠাণ্ডা বাতাসে খটাখট বাড়ি খাচ্ছে ওক গাছের ডাল- পালা। ডানা শিউরে উঠে জ্যাকেটের যিপার টেনে লাগাল।
‘ওরা এখনও আসছে না কেন?’ বলল ডানা। ও আর মুসা রবিন আর কিশোরের জন্য অপেক্ষা করছে।
চোখ ঘুরাল মুসা।
‘মিস্টার বগি যদি সত্যিকারের বগিম্যান হত তা হলে কালকে কিশোরকে আস্ত গিলে খেত।’
‘সুযোগ পেল কোথায়?’ মনে করিয়ে দিল ডানা। ‘বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়ার পরই তো মিসেস হকিন্স এসে গেলেন।
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
‘তা ঠিক।’
‘কাজেই মিস্টার বগিকে কিশোরকে ধরার জন্যে গত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে,’ বলল ডানা। তারপর হয়তো রবিনকেও ধরেছে।’
‘তা নয়,’ বলল মুসা, খেলার মাঠের ওপারে আঙুল তাক করল। কিশোর আর রবিন এদিকে দৌড়ে আসছে।
‘কী ব্যাপার? বগিম্যান তোমাদেরকে ধরেছিল?’ ব্যগ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল ডানা।
দাঁত বের করে হাসল কিশোর।
‘আমি রাতে মড়ার মতন ঘুমিয়েছি,’ জানাল।
‘তা তো ঘুমোবেই,’ দায়সারা কণ্ঠে বলল নথি।
‘খাইছে! তো তুমি শেষমেশ বগিম্যানে বিশ্বাস করা বাদ দিয়েছ?’ মুসা প্রশ্ন করল রবিনকে।
রবিন বন্ধুদের সামনে একটা খবরের কাগজ ঝাঁকাল।
‘বগিম্যান গ্রীন হিলস ছেড়েছে।’ এবার শিরোনাম দেখাল।
‘ ‘বব বগি সেই লোক’ ’ ডানা, মুসা আর কিশোর একসঙ্গে পড়ল।
ঢোক গিলল ডানা।
‘তারমানে রবিন ঠিকই ভেবেছিল! খবরের কাগজ বলছে উনি বগিম্যান ছিলেন।’
‘না, তা বলছে না, বোকা কোথাকার,’ বলল কিশোর। ‘পুরোটা পড়ো।’
কাগজে একটা আঙুল দাবাল ও।
‘এতে বলছে বগি সেই লোক যিনি গ্রীন হিলস বম্বারদের জিতিয়ে দিয়েছেন-এবং দলকে পেশাদার লিগে টেনে নিয়ে গেছেন।’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘গ্রীন হিলস বম্বাররা গত রাতে শহর ছেড়েছে,’ জানাল। ‘আবার যদি উনি ফিরে আসেন?’ ডানার প্রশ্ন।
‘আসতে পারেন। গ্রীন হিলস সিটি বগিম্যান বোল গেমের জন্যে!’ বলল কিশোর।
‘তারমানে মিস্টার বগি আর আমাদের ক্লাস নেবেন না?’ ডানা জিজ্ঞেস করল।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘ওঁকে অন্য কোথাও স্টুডেণ্ট টিচিং শেষ করতে হবে।’
কিশোর খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে নিজস্ব বুগি-উগি টাচডাউন নাচ নেচে নিল।
‘যাক, বাবা, ওঁর হাত থেকে বাঁচা গেছে!’
এসময় ঘণ্টা বাজল।
‘তারপরও আমাদেরকে ম্যাথ টেস্ট দিতে হবে,’ বলল রবিন।
কিশোরের নাচ থেমে গেল।
‘কী টেস্ট?’ জিজ্ঞেস করল ও।
চোখ ঘুরাল ডানা।
‘মিস্টার বগি যে টেস্টটার জন্যে আমাদের প্র্যাকটিস করিয়েছেন,’ কিশোরকে জানাল।
কিশোরের নাকের সামনে আঙুল নাচাল মুসা।
‘তুমি দুষ্টামি করছিলে বলে প্র্যাকটিস করনি। তুমি টেস্টের জন্যে রেডি নও।’
খিলখিল করে হেসে উঠল ডানা।
‘দেখা যাচ্ছে বগিম্যান শেষমেশ কিশোরকে ঠিকই ধরেছে!’
***
তিন গোয়েন্দা সিরিজ সবসময়ই সেরা
আরো নতুন নতুন বই চাই তিন গোয়েন্দা সিরিজের।