1 of 2

আঁধারপ্রিয়া

আঁধারপ্রিয়া

‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।’

একটি শীতের সন্ধ্যা, ১৯৭৪ সাল

সতেরো-আঠেরো বছরে মেয়েটি রাস্তা পার হচ্ছিল। পরনে গোলাপি-কালো নকশা ছাপা শাড়ি। গায়ে একটা বাদামি রঙের শাল অগোছালোভাবে জড়ানো। এখন কোনও কিছুই গুছিয়ে করার মতো মনের অবস্থা মেয়েটির নেই।

সেটা মেয়েটির হাঁটার ধরন লক্ষ করলেও বোঝা যায়।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে শীত যতই জাঁকিয়ে বসুক না কেন যানবাহনের বেহিসেবি সংখ্যার তাতে কোনও হেরফের হয় না। সুতরাং এদিক-ওদিক দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল নানান গাড়ি: প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি, বাস, ট্রাম, স্কুটার, মোটরবাইক। আর অসংখ্য মানুষ যে-যার ব্যস্ততায় ফাঁকফোকর পেয়েই একছুটে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথের বাঁ-দিকে পায়রার খোপের মতো ছোট-ছোট লটারির টিকিটের দোকান। ডানদিকে পাঁচমিশেলি ফলের দোকানে কেনাকাটার ভিড়। তার পাশেই জাগ্রত মা-কালীর মন্দিরে আরতি হচ্ছে, ঘণ্টাও বাজাচ্ছে কেউ-কেউ। ভক্তেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রণাম সেরে নিচ্ছে। কেউ মাথা ঠুকছে মন্দিরের দেওয়ালে। কারও মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে, তাই ভক্তি মেশানো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে দেবীকে। আর কেউ বা মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার আশায় কাতর প্রার্থনায় আকুল।

মেয়েটি আস্তিক। ওর বাড়িতে ঠাকুরের আসন আছে। সেখানে ওর মা সকাল-সন্ধে পুজো করেন। মেয়েটিও একই অভ্যাস পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে। দেবদেবীর ওপরে ওর ভক্তি আছে, আস্থাও। এই পথ ধরে ও বহুদিন বহুবার যাতায়াত করেছে, কিন্তু এই কালী মন্দিরে কখনও থমকে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানায়নি। ওর কাছে ওর বাড়ির দেবদেবীই ছিল সব।

কিন্তু আজ সকাল থেকেই ওর সমস্ত হিসেব গুলিয়ে গেছে। মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। মনের অবস্থাও এলোমেলো। তাই ও-দিকের ফুটপাথে কালী মন্দিরটা চোখে পড়ামাত্রই ও কোনওরকমে গাড়ি-ঘোড়া বাঁচিয়ে রাস্তা পার হল। ওর টানা-টানা চোখে নাম-না জানা আশঙ্কা। রাস্তার ধার ঘেঁষে বসেছিল কয়েকজন শাকসবজি বিক্রেতা। তাদের পাশ কাটিয়ে মেয়েটি চলে গেল ফুটপাথের ওপরে। মন্দিরের কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে গাঢ় চোখে অনুভব করল জাগ্রত মা কালীকে। মেয়েটির চোখ জলে ভিজে গেল। মনে পড়ে গেল মায়ের কথা, বাবার কথা, ছোট-ছোট দুটো ভাইয়ের কথা।

আর শুভদীপের কথা।

প্রতিমাকে প্রণাম জানিয়ে মেয়েটি অন্যান্য ভক্তের পাশ কাটিয়ে সরে এল মন্দিরের দেওয়ালের কাছে। তারপর বিষাদে আকুল হয়ে মাথা ঠুকতে লাগল, আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘মা, আমাকে রক্ষা করো। মা…মাগো…।’

মেয়েটির মনের একটি অংশ বলতে চাইছিল, ‘মাথা খুঁড়ে কোনও লাভ নেই। যা হওয়ার তা হবেই।’ কিন্তু ওর মনের অন্য আর-একটা অংশ চিৎকার করে বলছিল, ‘দেবতার লীলা দেবতাই জানে। তোর প্রার্থনায় যেন তিলমাত্রও অবিশ্বাস না থাকে।’

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি যেন ঘোর থেকে জেগে উঠল। শাল সরিয়ে বাঁ-হাত বের করে ঘড়ি দেখল: সাতটা পঁচিশ। শুভদীপ নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাড়ি ফিরে এসেছে। বাঁ-হাতের চেটো স্পষ্টভাবে চোখের সামনে মেলে ধরল মেয়েটি। শুভদীপের ফোন নম্বর লেখা রয়েছে সেখানে: ফোর সেভেন টু ফোর জিরো ওয়ান।

চোখের জল মুছে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে এল ও। হাঁটতে শুরু করল পাঁচমাথার মোড়ের দিকে। মোড়টা পেরিয়ে ও যাবে শ্যামবাজারের টেলিগ্রাফ অফিসে। সেখান থেকে ফোন করা যায়। যদি ওদের ফোন খারাপ থাকে তা হলে দুটো ওষুধের দোকান আছে কাছাকাছি—একটু বেশি পয়সা দিলে ওরা ফোন করতে দেয়।

মেয়েটির গায়ের রং মাজা। সরল, টানা-টানা, গভীর চোখ। গড়ন লম্বা ছিপছিপে। ভুরুর কাছটা যেন জোড়া, নাকে ছোট্ট সাদা চকচকে পাথর বসানো নাকছাবি। চিবুক তীব্র, সামান্য উদ্ধত। অথচ চোখের দৃষ্টি এখন অসহায়। খানিকটা যেন ভয় পেয়েছে।

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পার হওয়ার সময় নেতাজীর মূর্তির প্রায় পাশ ঘেঁষে চলে গেল মেয়েটি। রাস্তায় পথচারী যানবাহন ও যেন দেখেও দেখছিল না।

শীতের বাতাসে হালকা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছিল। একটু দূরের জিনিস ঠিকমতো ঠাহর করে দেখা যাচ্ছিল না। মেয়েটির নজর ঝাপসা হয়ে আসছিল বোধহয়। ও শালের খুঁট দিয়ে কয়েকবার চোখ মুছল।

টেলিগ্রাফ অফিসের দোতলায় উঠে একটা টেলিফোন বুথ খালি পেয়ে গেল মেয়েটি। চটপট বুথের ভেতরে ঢুকে গিয়ে অকূলপাথারে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো রিসিভারটাকে আঁকড়ে ধরল। না, ডায়াল টোন নেই। লিভারটা টেনে বেশ কয়েকবার খটখট করল ও। রিসিভার কানে চেপে শুনল। না, একটা অস্বাভাবিক গুঞ্জন কানে আসছে শুধু।

বেরিয়ে এসে পাশের বুথের ভাঙা দরজার কাছে দাঁড়াল মেয়েটি। একজন অবাঙালি ভদ্রলোক বেশ চেঁচিয়ে কথা বলছেন টেলিফোনে। মেয়েটি উসখুস করতে লাগল। পিছনের কাউন্টারের ওপাশ থেকে টেলিগ্রাফের টরে-টক্কা শুনতে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, মর্স কোডের সংকেত ওর মাথার ভেতরে বাজছে। এই ভদ্রলোকের টেলিফোন করা কখন শেষ হবে!

একটু পরে বুথ খালি হতেই মেয়েটি ঢুকে পড়ল বুথে। নম্বর ডায়াল করার সময় টের পেল ওর হাত কাঁপছে।

ও-প্রান্তে রিং বাজছিল। চারবারের পর টেলিফোন তুলল কেউ।

‘হ্যালো।’ বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠস্বর। বোধহয় শুভদীপের বাবা।

‘হ্যালো, শুভদীপ আছে?’

‘আপনি কে বলছেন?’ প্রশ্নের মধ্যে অপছন্দের সুর।

শুভদীপের বাবার সঙ্গে মেয়েটির এখনও আলাপ হয়নি। শুভর কাছে শুনেছে, ভদ্রলোক বেশ কড়া আর রাশভারি। ওঁর ব্যবসার পয়সাতেই শুভদীপদের যত বাবুয়ানি।

মেয়েটি ভয় পেয়ে গেল। এক মুহূর্ত কী ভেবে কাঁপা গলায় মিথ্যে বলল, ‘আমি ওর বন্ধু জয়ন্তর দিদি। জয়ন্ত ওকে একটা খবর দিতে বলেছে। ওর লাস্ট উইকের ক্লাস নোটটা যেন কাল ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে আসে। আর…’ আর কী বলা যায় এই মুহূর্তে!

ও-প্রান্তের রাশভারি গলা শোনা গেল, ‘দাঁড়াও, বুড়োকে দিচ্ছি, ওকে যা বলার বলো—’ ‘বুড়ো’ শুভদীপের ডাকনাথ।

কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ। শুধু পিছন থেকে টরে-টক্কা ভেসে আসছে। কী রকম দম বন্ধ করে ভ্যাপসা গরম লাগছে যেন।

‘হ্যালো—’

শুভদীপের গলা।

আঃ! মা কালী সত্যিই জাগ্রত।

‘শুভ…শুভ…খুব বিপদে পড়েছি…।’

গলা চিনতে পারল শুভ। সঙ্গে সঙ্গে ওর কণ্ঠস্বর কেমন যেন নির্বিকার কাঠ-কাঠ হয়ে গেল। বাবার সামনে কী করে সহজভাবে কথা বলবে ও! ও তো বলেই দিয়েছিল, ‘ফোন নাম্বার নিচ্ছ নাও, কিন্তু, জেনুইন ইমারজেন্সি না হলে ফোন কোরো না—অথচ…।

‘কেন, কী হয়েছে?’ শান্তভাবে প্রশ্নটা করল শুভ।

‘শুভ…শুভ…আজ সকাল থেকে খুব…বমি হচ্ছে। বারবার ওয়াক উঠছে।’ শেষ দিকে কেঁদে ফেলল মেয়েটি।

হাসল শুভ, বলল, ‘কাঁদছ কেন, বোকা মেয়ে! রেগল্যান ট্যাবলেট খেয়ে নাও, বমি-বমি ভাব এক্ষুনি কেটে যাবে। কোনও কারণে বোধহয় খাওয়াদাওয়ার গণ্ডগোল হয়েছে।’

মেয়েটি বুঝতে পারল, ও-প্রান্তে টেলিফোনের সামনে শুভদীপ এখন একা এবং নিরাপদ। কিন্তু শুভর কথায় ভরসা না পেয়ে ও তখনও কাঁদছিল। জড়ানো গলায় বলল, ‘না, না, সেসব নয়। অন্য ব্যাপার—ট্যাবলেট খেলেও কমবে না। তুমি বুঝতে পারছ না। সেই যে পুজোর সময় আমরা ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিলাম। তোমাকে তখন অত করে বারণ করলাম, তুমি শুনলে না। বললে, ভয়ের কিছু নেই…এখন কী সর্বনাশ হল বলো তো।’ কান্না আরও বেড়ে গেল।

‘আস্তে, আস্তে—’ চাপা গলায় বলে উঠল শুভ।

তা হলে কি ওর বাবা আবার ঢুকে পড়েছেন ঘরে? কিন্তু মেয়েটি তখন মরিয়া। একমাত্র শুভদীপই ওকে বাঁচাতে পারে এই পাগল-করা ঝড় থেকে। তাই ও জেদি গলায় বলল, ‘কাল আমি ছ-টার সময় তোমার জন্যে কফি হাউসে ওয়েট করব। তুমি আসবে কিন্তু। তারপর—।’

‘তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ।’ ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল শুভদীপ, ‘মাত্র একবারে এত কিছু হতে পারে না। নিশ্চয়ই তুমি হিসেবে কোনও গন্ডগোল করছ। আর তাতেই এত প্যানিকি হয়ে উঠেছ। যাকগে, কোত্থেকে ফোন করছ তুমি?’ শুভ জানে ওদের বাড়িতে ফোন নেই।

মেয়েটি বলল।

‘ও ব্বাবা! এই সামান্য ব্যাপারের জন্যে এই ঠান্ডার মধ্যে এতদূর চলে এসেছ। এরকম হিসেবের গোলমাল তোমার আগেও হয়েছে। ওসব বাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাড়ি যাও। ভালো করে খেয়ে-দেয়ে কষে ঘুম দাও—।’

‘কাল তুমি ছ’টার সময় আসছ তা হলে?’ মেয়েটি ভয় পাওয়া গলায় জিগ্যেস করল।

‘কাল ছ’টার সময় বোধহয় হবে না। কাল আমাদের বিজনেসের ব্যাপার নিয়ে বাবার সঙ্গে একটু বসতে হবে…।’

শুভদীপ যে পড়াশোনার ফাঁকে-ফাঁকে বাবার ব্যবসায় সময় দেয় সেটা মেয়েটি জানে। কিন্তু এখন এই জরুরি অবস্থায় ওর কি বিজনেস নিয়ে মাথা না ঘামালে চলছিল না!

‘শুভ, প্লিজ, এই অবস্থায় তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে আমি মরে যাব। যা হওয়ার তা হয়েছে। কিন্তু, তুমি পাশে না থাকলে আমি—।’

‘শোনো, এত আপসেট হওয়ার কিছু নেই। পরশু সন্ধেবেলা…অ্যাই, শোনো, কাল আমি বিডিজি-র ক্লাসটা করতে পারব না। ইন্ডিয়ান পলিটিক্স নিয়ে অনেকটা লাইব্রেরি ওয়ার্ক বাকি আছে। নোট করলে তোকে দেব, কপি করে নিস। এখন রাখছি। কাল এগোরোটায় ক্লাসে দেখা হবে।’ বলে টেলিফোন রেখে দিল শুভ।

মেয়েটি বুঝতে পারল, শেষ দিকটায় শুভ কাল্পনিক কোনও ক্লাসমেটের সঙ্গে কথা বলছিল। ওর এই অভিনয়ের একমাত্র কারণ হয়তো টেলিফোনের কাছাকাছি ওর বাবা এসে পড়েছেন। কিন্তু এই অবস্থায় অন্য সমস্যার কথা শুভ ভাবছে কেমন করে! মেয়েটি তো অন্য কোনও সমস্যার কথা আর ভাবতে পারছে না!

গা গুলিয়ে উঠল মেয়েটির। গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইল সবকিছু। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে ঢোক গিলল ও। রিসিভার রেখে দিয়ে আবার ডায়াল ঘোরাল।

বুথের বাইরে একজন তরুণ টেলিফোন করার জন্য অপেক্ষা করছিল। মেয়েটিকে দ্বিতীয়বার ডায়াল ঘোরাতে দেখেই হ্যাঁচকা টানে দরজাটা খুলে দিল সে। রুক্ষ গলায় বলল, ‘কী হল, দিদি। এখানে পরপর দুটো টেলিফোন করা যায় না। বাইরে আসুন, আমার হয়ে যাক, তারপর আপনি আবার করবেন—।’

মেয়েটি ঘুরে তাকাল ছেলেটির দিকে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি পাথর হয়ে গেল। ভাসানের সময় দুর্গা প্রতিমার মুখটা ঠিক এরকম দেখায়।

মেয়েটি কান্না-চাপা গলায় বলল, ‘প্লিজ, আমার ভীষণ জরুরি দরকার…।’

ঠিক আছে, ঠিক আছে, আপনি করে নিন। বলেছি বলে কিছু মাইন্ড করবেন না।’

আবার ফোন করল মেয়েটি।

ও-প্রান্তে সেই রাশভারী গলা।

মেয়েটি রিসিভার রেখে দিল।

আবার ডায়াল ঘোরাল। আবার সেই কণ্ঠস্বর।

তারপরও সেই একই ব্যাপার।

তারপরের চেষ্টায় ও-প্রান্তে কোনও রিং শোনা গেল না। বোধহয় শুভদীপের বাবা বিরক্ত হয়ে রিসিভার নামিয়ে রেখেছেন একপাশে।

একটা ঘোরের মধ্যে টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটি। এখন আর ফোন করার চেষ্টা করেও কোনও লাভ নেই। কিন্তু এখন কী করবে ও?

পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটি নানান কথা ভাবছিল।

সন্দেহটা ওর মনে মাথাচাড়া দিয়েছিল দিন সাতেক আগে থেকেই। মেয়েলি নিয়মটার গরমিল হতেই ওর ডায়মন্ডহারবারের ব্যাপারটা মনে পড়ে গিয়েছিল। তারপর যত দিন গেছে, ভয়টা ততই জমাট বেঁধেছে। অবশেষে কাল রাত থেকে ওয়াক উঠতে শুরু করেছে। রাতে ও দু-একবার বাথরুমে গিয়েছিল তার মধ্যে একবার বমির দমক চাপতে পারেনি। কিন্তু শুধু খানিকটা জল বেরিয়ে আসা ছাড়া আর কিছুই বেরোয়নি মুখ দিয়ে।

তারপর আজকের জঘন্য সকালটার শুরু। গা গুলোনো, মাথা ঝিমঝিম, সেইসঙ্গে ছোটখাটো আরও কত নানান উপসর্গ।

মা কয়েকবার স্নেহ মাখানো অবাক চোখে তাকিয়েছে, ডাক্তার দেখানোর কথা বলেছে, ওষুধ খাওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু মেয়েটি বিশেষ আমল দেয়নি। বরং আজ অনেক বেশি সময় ধরে ও প্রার্থনা করেছে ঠাকুরের আসনের সামনে। সেখানে অধিষ্ঠিত মা কালী, দেবী লক্ষ্মী, আর দেবাদিদেব মহাদেব। তাঁরা নিশ্চয়ই ওর প্রার্থনায় বিশেষ কান দেননি, কারণ শরীরের অস্বস্তি সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরও বেড়েছে।

ওর বাবা অতসব লক্ষ করেননি। সদাগরি অফিসের ম্যানেজারসাহেবের অতসব লক্ষ করার সময় কোথায়! সবসময় ধোপদুরস্ত পোশাকে ফিটফাট হয়ে রয়েছে। ঠোঁটে ঝুলছে সিগারেট। বাড়িতে তিনি সাধারণ সিগারেট খান। কিন্তু রাস্তায় বেরোলেই আঙুলের ফাঁকে থাকে দামি সিগারেট—অফিসেও তাই। অফিসের গাড়ি সকাল ন’টার সময় তাঁকে মোহনলাল স্ট্রিটের মুখ থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেই গাড়িতে অফিসের আরও দুজন হোমরাচোমরা যাতায়াত করেন।

বাড়িতে বাবা যখনই কোনও কথা বলেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে অফিস আর উন্নতি। মানুষটা শুধু প্রতিপত্তি আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেই গেল। মায়ের কাছে শুনেছে, একেবারে গরিব অবস্থা থেকে বাবা এই মাঝারি অবস্থায় পৌঁছেছেন। মাঝারি থেকে এখন পৌঁছতে চান অনেক উঁচুতে।

ছেলেমেয়েদের সুখদুঃখের খবর তিনি খুব কম নেন। আর যখনই নেন, সেটা একেবারে অফিসারের ঢঙে। কাজে-কর্মে ভুল হলে মাকে অধঃস্তন কর্মচারী ভেবে দিব্যি ধমক লাগান আর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট রেখে একমনে রেডিয়োর খবর শোনেন।

দেশের খবর নিয়ে কমবেশি মাথাব্যথা থাকলেও বাড়ির খবরে খুব একটা বোধহয় আগ্রহ ভদ্রলোকের ছিল না। তা না হলে সদ্য-যুবতী মেয়ের তাল-কেটে-যাওয়া রোজকার জীবন কেন তাঁর নজরে পড়বে না!

আজ সারাদিন মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে মেয়েটির। অথচ মা-কে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে ওর মনে শুধুই মায়ের স্মৃতি। কারণ ওর বাবা তখন গরিব থেকে মধ্যবিত্ত হওয়ার চেষ্টায় দিনরাত ব্যস্ত ছিলেন।

ছোট-ছোট ভাই দুটোকেও মেয়েটি খুব ভালোবাসে। বুবুর বয়েস আট, আর টুটুর বয়েস পাঁচ। ‘দিদি’ বলতে ওরা দুজনেই একেবারে আত্মহারা। অথচ আজ ভাই দুটোর সঙ্গেও হাসিখুশি ব্যবহার করতে পারেনি মেয়েটি।

একটিমাত্র দুশ্চিন্তা ওকে চোখের পলকে অন্য গ্রহের বাসিন্দা করে দিয়েছে। ওর সুখ-দুঃখ ব্যথা-বেদনা যেন ছোট্ট একটা ঘরে লুকিয়ে পড়েছে। আর সেই ঘরের জানলাগুলোও যেন বন্ধ করে দিয়েছে কেউ।

একটু আগে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করেছে, ‘কোথায় বেরোচ্ছিস, এখন, এই ঠান্ডার মধ্যে?’

‘একটা…একটা ফোন করব…।’

‘কাল সকালে করিস।’

‘না। খুব জরুরি ফোন—এখনই করা দরকার।’ দরজার কাছে ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

‘যা তা হলে। যা ভালো বুঝিস কর। এখন তুই বড় হয়ে গেছিস, নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছিস—’ মা অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলছিল।

মা-কে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল তখন।

‘আজ সকাল থেকে তোর কী হয়েছে!’ মা আলনার জামাকাপড় গুছোতে-গুছোতে আবার কথা বলছিল, ‘তোকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়—’

শুভদীপের কথা কাউকে বলেনি ও। বাবা তো জানেই না, মা-ও না। ইস, যদি মা-কে সব খুলে বলতে পারত।

মেয়েটি নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিয়েছে, ‘কেন, শুধু-শুধু চিন্তার কী আছে!’

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল: ‘দশ মাস দশ দিন তো পেটে ধরেছি, তাই…।’

দশ মাস দশ দিন!

কথাটা ধাক্কা মারল মেয়েটির বুকে। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই দশ দিন কেটে গেছে। তা হলে আর দশ মাস বাকি। মা যদি ব্যাপারটা এখন শোনে তা হলে কি হার্টফেল করবে? মায়ের তো আবার হাই ব্লাড প্রেসারের ধাত রয়েছে।

আর কথা বাড়ায়নি ও। থমথমে মুখে সদর দরজা খুলে নেমে এসেছে রাস্তায়।

এখন, বাড়ি ফেরার পথে, বারবার ওর মনে হচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তে ওর শরীরের ভেতরে আর একটা শরীর বেড়ে উঠছে।

মেয়েটির চিন্তা এলোমেলো দিশেহারাভাবে ছুটোছুটি করে শেষ পর্যন্ত পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ে মরছিল।

‘মা জননী, অন্ধকে কিছু সাহায্য করবেন—।’

চমকে উঠে মেয়েটি দেখল, ফুটপাথে একজন অন্ধ ভিখারি একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে ভিক্ষে করছে।

মেয়েটি পার্স থেকে একটা টাকা বের করে লোকটিকে দিল।

‘ভগবান আপনার ভালো করবেন…।’

মেয়েটি প্রায় চোখ বুজে সেই আশিস গ্রহণ করল। এখন ওর সবরকমের শুভেচ্ছা প্রয়োজন।

বাড়িতে ফেরার পর মেয়েটি ঠিক করল, কাল ও ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শুভদীপের সঙ্গে দেখা করবে। এই সমস্যাটা এমন কিছু বড় সমস্যা নয়। শুভদীপ নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। আর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সমাধান তো একটা আছেই: বিয়ে।

এই চিন্তাটাকে পাখির ছানার মতো বুকে আঁকড়ে ধরে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিল মেয়েটি। বারবার ওর গা গুলিয়ে উঠছিল, মাথা দপদপ করছিল। কিন্তু শুভদীপের সঙ্গে কাটানো ভালোবাসার মুহূর্তগুলোর কথা সিনেমার ছবির মতো পরপর ভেবে ও নিজেকে সামলে রাখছিল। কখনও-কখনও দু-এক কলি গান গেয়ে মনটা হালকা করতে চাইছিল।

কাল শুভদীপের সঙ্গে দেখা হলেই আর কোনও চিন্তা নেই। তারপর মা-কে সব কথা খুলে বলবে ও। মা-কে কষ্ট দিয়েছে ভেবে ও মনে-মনে কষ্ট পেল। কাল ও মা-কে গলা জড়িয়ে ধরে সব বলবে। বলবে, ‘মা, মাগো, আমিও তোমার মতো দশ মাস দশ দিন কষ্ট করতে শিখেছি।’

মনটা বোধহয় ওর শান্ত হয়ে আসছিল। কারণ, একসময় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটি। তবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ও আকুল হয়ে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীকে ডেকেছিল।

দেবতারা যে ওর আকুল প্রার্থনায় কান দেননি সেটা মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল এক সপ্তাহের মধ্যেই।

শুভদীপ ওর সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছিল।

একটি শীতের সন্ধ্যা, ১৯৯৪ সাল

ভদ্রমহিলা আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছিলেন। বেশ মোটামোটা কালোকোলো চেহারা। সিঁথির সিঁদুর বেশ চওড়া। যতটা চওড়া, স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক বোধহয় ঠিক ততটাই সরু। তাই আমার কাছে এসেছেন। সম্পর্ক জোড়া লাগানোর ঝাড়ফুঁক তুকতাক করতে।

বড়-বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু খোনা গলায় তিনি অনুনয় করে বললেন, ‘কিছু একটা আপনাকে করতেই হবে। অনেক আশা নিয়ে আমি এসেছি—।’

আমি মহিলাকে ভালো করে দেখলাম। তিনটি সন্তানের জননী। জননী হওয়ার জন্যে আলাদা কোনও যোগ্যতার দরকার হয় না। এ-ব্যাপারে পশু বা মানুষের কোনও তফাত নেই। শুধু জন্মসূত্রে শারীরিক কোনও গোলমাল না থাকলেই হল।

ভদ্রমহিলার স্বামী অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে বেড়ায়। কবে নাকি স্বামীর ব্যাগের মধ্যে একটা পারফিউম মাখানো রুমাল পেয়েছিলেন তিনি। তারপর দু-মাসের ব্যবধানে দুটো চিঠি। না, নির্দোষ চিঠি নয়, প্রেমপত্র।

এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তুমুল হয়ে গেছে, অথচ লাভ কিছুই হয়নি। ভদ্রমহিলার যা চেহারা দেখছি তাতে ওঁর পক্ষে স্বামীকে বশ করা বেশ মুশকিল। তার ওপর উনি ফ্রিজিড কি না কে জানে!

কিন্তু চেষ্টা আমাকে করতেই হবে। এই চেষ্টা করার জন্যেই সবাই আমাকে টাকা দেয়। আর সেই টাকাতেই আমার আর মায়ের দিন চলে যায়।

‘আপনার স্বামীর নাম কি?’ ওঁকে জিগ্যেস করলাম।

‘অতীশ। অতীশ নন্দী—’ উৎসাহ নিয়ে মহিলা বললেন।

আমি পাশের টেবিল থেকে বেশ মোটাসোটা একটা বই টেনে নিলাম। অতি ব্যবহারে বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর সেলাই ঢিলে হয়ে গেছে। পাতা ওলটাতে-ওলটাতে নির্দিষ্ট একটা জায়গা খুঁজে পেলাম: পতি বশীকরণ মন্ত্র। পাতার মার্জিনে আমারই লেখা নানান নোট।

সামনে রাখা একটা সাদা খাতা টেনে নিলাম। একটা ফরসা পৃষ্ঠা বের করে লিখতে শুরু করলাম:

মন্ত্র: ‘ওঁ নমো মহাযক্ষিণী পতিং মে বশ্যং কুরু-কুরু স্বাহা।’

মঙ্গলবার একটি গোটা সুপারি উক্ত মন্ত্রে ২১ বার অভিমন্ত্রিত করে মুখে রাখবে। স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, সুপারিটি মুখ থেকে বার করে দুধ, গঙ্গাজল দ্বারা ধুয়ে আবার সেই সুপারিটি উক্ত মন্ত্রে ২১ বার অভিমন্ত্রিত করে সেটা কুচিয়ে পান সেজে স্বামীকে খাওয়ালে পতি বশ হবে। তীব্র বশীকরণ প্রভাব পেতে হলে সুপারির সঙ্গে বাদুড়ের কানের সামান্য টুকরো এবং গোরোচনা মিশিয়ে পতিকে খাওয়াতে হবে। এ ছাড়া অভিমন্ত্রিত করার সময় নীচের যন্ত্রটি অষ্টগন্ধের সাহায্যে ভুর্জপত্রে অঙ্কন করে চোখ বুজে বাঁ-হাতের কনিষ্ঠা দ্বারা স্পর্শ করে রাখতে হবে। এই আচার পালন করলে সিদ্ধিলাভ অনিবার্য।

লেখা এবং যন্ত্রের ছবি আঁকা শেষ হলে কাগজটা ভদ্রমহিলার হাতে নিয়ে বললাম, ‘আপনার চেনাজানার মধ্যে অতীশ নামে আর কেউ নেই তো?’

ভদ্রমহিলা দ্রুত মাথা নেড়ে জানালেন, না, কেউ নেই।

আমি বললাম, ‘থাকলে মুশকিল হত। দুজন অতীশই আপনার টানে পাগল হত।’

ভদ্রমহিলা বিনয়ের হাসি হেসে বোধহয় ব্লাশ করলেন। গায়ের রঙ কালো বলে রক্তের টুকটুকে লাল উচ্ছ্বাস বোঝা গেল না।

কাগজের লেখা ইত্যাদি পড়া শেষ হলে তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘গোরোচনা জিনিসটা কী?’

‘গোরুর পিত্ত থেকে একরকম চকচকে হলদে জিনিস বেরোয়—সেটাই।’

‘কিন্তু এই গোরোচনা আর বাদুড়ের কানের টুকরো পাব কোত্থেকে? ওগুলো বাদ দিয়ে যদি…।’

ওঁকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। ওগুলো বাদ দিলে কাজ হবে না। আপনাকে নিউ মার্কেটের একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। ওখানে গিয়ে আমার নাম বললে সব পেয়ে যাবেন। তবে দোকানের নামটা আর কাউকে জানাবেন না—।’

ভদ্রমহিলা কৃতজ্ঞভাবে বারবার ঘাড় নাড়লেন। তারপর তাঁর হাতব্যাগ থেকে কয়েকটা একশো টাকার নোট বের করে জিগ্যেস করলেন, ‘কত দেব?’

আমি বই আর খাতা গুছিয়ে রাখতে-রাখতে বললাম, ‘দুশো—।’

এমন সময় মা দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। চেহারা এতই রোগা যে, গায়ের চাদরের একপাশ খসে পড়েছে। মুখে অসংখ্য ভাঁজ, চোখে চশমা, গাল ভাঙা, মাথার সব চুল সাদা ধবধবে।

আমাদের দুজনের সামনে দুটো কাপ সাজিয়ে দিতেই ভদ্রমহিলা হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, ‘এতসবের কী দরকার ছিল…।’

আমি বললাম, ‘আমার মা—।’

মহিলা দুশো টাকা আমার হাতে দিয়ে ব্যাগটা সরিয়ে রেখে আচমকা উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। মায়ের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঝপ করে একটা প্রণাম সেরে ফেললেন। মা লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে গেল।

আমি মজা পেলাম। ভদ্রমহিলা বোধহয় মা-কে বড়-ডাইনি ভেবেছেন, তাই এত ভক্তি।

মা কোনও কথা না বলে চলে গেল। বহু বছর ধরেই মা খুব কম কথা বলে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে ভদ্রমহিলা বিড়বিড় করে আমার দেওয়া কাগজটা পড়ছিলেন। বোধহয় এখন থেকেই মন্ত্র প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছেন।

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। শুধু মাঝে-মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার শব্দ।

ভদ্রমহিলা এখন বোধহয় এই মধ্যবিত্ত মলিন ঘরে বসে থাকতে অস্বস্তি পাচ্ছেন। কাজ মিটে গেলে কে-ইবা ডাইনির আস্তানায় বসে থাকতে চায়!

চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘একটা কথা জিগ্যেস করছি…কিছু মনে করবেন না…।’

আমি বললাম, ‘বলুন। আমার কাছে মন খুলে কথা না বললে কাজে নানান প্রবলেম হয়…।’

হাতের কাগজটা আমাকে দেখিয়ে তিনি অসহায় বালিকার গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘এসবে ঠিকঠাক কাজ হবে তো!’

‘আপনার কী মনে হয়?

তিনি বেশ লজ্জা পেয়ে বলে উঠলেন, ‘না, মানে, আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। আপনি তো আমার মনের অবস্থা বুঝতেই পারছেন…ওইসব জিনিস ঘাঁটতে হবে। আমার গা গুলিয়ে উঠছে…বমি পাচ্ছে…।’

‘আপনার কোনও চিন্তা নেই। একবার একটু কষ্ট করেই দেখুন না। আর একটা কথা: যেদিন পানটা সেজে স্বামীকে খাওয়াবেন, সেদিন উপোস করে থাকবেন। খেয়াল রাখবেন, আপনার হাজব্যান্ড যেন কিছু টের না পায়—।’

ভদ্রমহিলা ঘন-ঘন ঘাড় নেড়ে কৃতজ্ঞতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন। আমি ওঁকে দরজার কাছে এগিয়ে দেওয়ার সময় বললাম, ‘হাজব্যান্ডের সামনে একটু সেজেগুজে থাকবেন। একটু পারফিউম-টারফিউম মাখবেন।’

আচমকা এই হিতোপদেশে ভদ্রমহিলা একটু যেন অবাক হলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

‘নিয়মগুলো ঠিক-ঠিক মানবেন। কাজটার এফেক্ট কী হল ও-সপ্তাহে আমাকে ফোন করে জানাবেন।’

এই বশীকরণ মন্ত্রে যদি কাজ না হয় তা হলে ওঁর অতীশকে আর ধরে রাখা যাবে না। তখন বাদুড়ের কান কেন, ইয়েতির ‘ইয়ে’ পানে সেজে খাওয়ালেও কোনও কাজ হবে না।

ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। এখন আর কোনও ক্লায়েন্টের আসার কথা নেই। পাশের রান্নাঘর থেকে পাঁচফোড়নের গন্ধ নাকে আসছে। মা রান্না শুরু করে দিয়েছে।

চুপচাপ বসে আমি নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছিলাম। আর চার দেওয়ালে ঘেরা ছোট্ট ঘরটাকে দেখছিলাম। কুড়ি বছরে এই ঘরটা এতটুকু বদলায়নি। অথচ জীবন কত বদলে গেছে।

ঘরের দেওয়ালগুলো বিশ বছরে আরও জীর্ণ মলিন হয়েছে। একদিকের দেওয়াল নানানরকম তন্ত্র-মন্ত্র অলৌকিক আচারের বই আর কাগজপত্রে ঠাসা। আর একদিকের দেওয়ালে অনেকগুলো তাক। তাকে নানা জড়িবুটি, পশুপাখির লোম-পালক, হাড় আর নখ, রুদ্রাক্ষ, হরীতকী, শুকনো নিমপাতা, সাপের খোলস ইত্যাদি রয়েছে। ক্লায়েন্টদের দরকারে এগুলো ব্যবহার করতে হয় আমাকে।

তাকগুলোর ওপরে দেওয়ালে রক্ষাকালীর এক বিশাল মাপের ফটো টাঙানো। লোল জিহ্বা, করাল বদন, ছিন্দ মুণ্ডে সজ্জিতা দেবী। এই ফটোর প্রভাব আমার ওপরে যত না, তার চেয়ে ঢের বেশি আমার ক্লায়েন্টদের ওপরে। কারণ, দেবদেবীর ওপর ভক্তি আমার অনেকদিন আগেই ক্ষয়ে গেছে।

এখন আমার মা নিত্য দেবতার পুজো করে। আর আমি করি অপদেবতার পুজো।

মা কালীর উলটোদিকের দেওয়ালে আর-এক দেবতার ফটো: আমার পিতৃদেব। বছরে একদিন ধূপধুনো ফুলমালায় পুজো পেয়ে থাকেন। যদিও সবসময় উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু ফটোর মানুষ বলেই আমাকে দেখতে পান না। পেলে তাঁর ম্যানেজার-সুলভ গলায় নির্ঘাত ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘এসব কী হচ্ছে, লিলু! তোমাকে না কতদিন শিখিয়েছি, ভূত-প্রেত অবদেবতা বলে কিছু নেই!’

‘দেবতা বলেও তো কিছু নেই, বাবা!’ আমি হেসে আপনমনেই বলে উঠলাম।

এই বাড়িতে দেবতা একদিন ছিল। কিন্তু বিশ বছর আগে তাঁরা একটা আঠেরো বছরের অসহায় মেয়েকে একা ফেলে রেখে আকাশে চম্পট দিয়েছে।

বাবার ফটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আমার গা গুলিয়ে উঠছিল, বমি পাচ্ছিল অকারণে। পুরোনো সেই রাতটাকে আমি ফিরে পাচ্ছিলাম মনে-মনে।

অবস্থা যখন চরমে পৌঁছেছিল তখন ব্যাপারটা আর চেপে রাখতে পারিনি আমি। গা গুলিয়ে, মাথা ঘুরে, বমি হয়ে সে এক সাংঘাতিক অবস্থা!

মা আমাকে ধরে-ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় বারবার জিগ্যেস করছিল: ‘লিলু, কী হয়েছে বল! কী হয়েছে বল!’

আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শুভদীপের নির্লিপ্ত নির্বিকার গলা কানে বাজছিল: ‘ভয়ের কিছু নেই।’ আর ততই আমার ভয় বাড়ছিল।

মা-কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। মা আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে কী বুঝেছিল কে জানে! মায়ের চোখে জল এসে গিয়েছিল। চাপা ভর্ৎসনার গলায় বলেছিল, ‘লীলা, এ তুই কী করলি!’

আমার গা পাক দিয়ে উঠেছিল। ছুটে বাথরুমে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বমি করতে শুরু করলাম। মা তাড়াতাড়ি এসে বাথরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছিল, যাতে নাক-গলানে পড়শিরা আমার বমির শব্দ শুনতে না পায়।

সেদিন রাতে ঠাকুরের আসনের কাছে গলায় আঁচল দিয়ে বসে মা পাথরের মূর্তি হয়ে স্থির ভেজা চোখে তাকিয়ে ছিল দেবতার দিকে। এই বিশটা বছরে দেবতারা মা-কে কী দিতে পেরেছেন জানি না, তবে মা এখনও ঠাকুরের আসন ছাড়েনি, দেবতাদের ছাড়েনি, আর…আর আমাকেও ছাড়েনি।

চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে আমি বাবার গলা পেলাম। বাবা কাঁদছে।

রাত তখন অনেক। পাশের ঘর থেকে মা আর বাবার চাপা কথাবার্তা কানে আসছিল। হঠাৎই বাবা কেঁদে উঠল। ইনিয়েবিনিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল।

আমি অস্বস্তি আর যন্ত্রণার মধ্যেও হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ফিটফাট পোশাক পরা চব্বিশ ঘণ্টার ম্যানেজারসাহেব কাঁদছে! বাবাকে সেই প্রথম কাঁদতে শুনেছিলাম। মানুষটা ভেঙেচুরে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। অফিসে বাড়িতে যে সবসময় শৃঙ্খলা বজায় রাখে সে নিজেই বেসামাল বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল।

সে-রাতে আমার ভালো লেগেছিল। বাবা তা হলে আমাদের কথা ভাবে, আমার সুখ-দুঃখের কথা ভাবে!

কিন্তু তিনদিন পর বুঝেছিলাম, বাবা আমার সর্বনাশ নিয়ে ভেঙে পড়েনি। বাবা ভেঙে পড়েছে নিজের সর্বনাশের চিন্তায়। কারণ, আমার ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে দামি সিগারেট খাওয়া ম্যানেজারসাহেবের সামাজিক প্রতিষ্ঠার কী হাল হবে সেটা ভেবেই বাবা ভেঙে পড়েছিল। এই মানসিক চাপ মানুষটা নিতে পারেনি। তাই এক ছুটির দুপুরে সিলিং ফ্যানে মায়ের শাড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছিল।

বাবার গল্প সেখানেই শেষ হয়েছিল, কিন্তু আমার গল্প নয়।

স্বপ্নে দেখা স্লো-মোশান সিনেমার মতো আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে ছবির ফ্রেমের কোনা দিয়ে একটা সরু কালচে রক্তের ধারা ধীরে-ধীরে গড়িয়ে নামছিল।

পুরোনো স্মৃতি সত্যিই বড় নির্লজ্জ। যখন তখন ল্যাংটা হয়ে চোখের সামনে এসে নাচানাচি করে। যেমন এখন, এই অসময়ে, বিশ বছরের পুরোনো কথা মনে পড়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। স্মৃতিকণা নামের বিশ বছরের এই উদোম তরুণী শরীরে মোচড় দিয়ে ড্যাং-ড্যাং করে নাচতে থাকে। নাচতে-নাচতে ও কমলালেবুর খোসার রস ছুড়ে দেয় আমার চোখে। আমার চোখ জ্বালা করে, বুক জ্বালা করে।

হঠাৎ মায়ের গলা পেলাম, ‘কী রে, লিলু, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি!’

আমি চোখ মেলে তাকালাম। এই শীর্ণ জীর্ণ বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যায়। এঁর সহ্যের কোনও সীমা নেই।

একের পর এক মর্মান্তিক ঝড় বয়ে গেছে আমার মায়ের ওপর দিয়ে।

প্রথমে আমার ঘটনা।

তারপর বাবার স্বার্থপরের মতো আত্মহত্যা।

আর, অবশেষে, বুবু আর টুটুর আলাদা হয়ে যাওয়া।

বিয়ের পরই ওরা আলাদা হয়ে গেছে। দিদির সঙ্গে ওদের দূরত্ব আগেই অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর সেই দূরত্বের মাঝে কেউ যেন কংক্রিটের পাঁচিল তুলে দিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত আমি আর মা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রইলাম। একটা সময়ে প্রচুর টিউশানি করে টাকা রোজগার করতাম। তারপর কী করে কী হয়ে গেল, ঝাড়ফুঁক তুকতাকের দু-একটা বই হাতে এসে গেল। আর একইসঙ্গে তন্ত্রমন্ত্রের দিকে ঝোঁক গেল বেড়ে। গোয়াবাগানের এক ‘বাবা’র আশ্রমে আমি প্রায়ই যেতাম। ভদ্রলোকের নাম নৃপেন সাধুখাঁ। সংসারী তান্ত্রিক বলে নিজের পরিচয় দিতেন। সেখানে প্রায় বছর পাঁচেক তাঁর সাধন সঙ্গিনী হয়ে ছিলাম। শরীর বা মন নিয়ে শুচিবায়ুর ব্যাপারটা আর ছিল না। তাই বোধহয় ‘গুরু’কে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

‘তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দেব?’ মা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোর কি খুব ক্লান্ত লাগছে?’

আমি একটা হাই তুললাম। তাকে রাখা টেবিলঘড়ির দিকে তাকালাম: প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। মাকে বললাম, ‘ন-টা বাজলে খেতে দিয়ো। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব—।’

এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মা ফোন ধরে কথা বলে আমার দিকে রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর ফোন।’

আমি রিসিভার কানে চেপে ধরে ‘হ্যালো’ বললাম।

ও-প্রান্তে মিসেস খান্ডেলওয়াল কথা বললেন। আমার অনেকদিনের ক্লায়েন্ট। ওঁর বিশ্বাস, আমার মন্ত্রতন্ত্রের জন্যেই উনি মা হতে পেরেছেন।

প্রায় বছর ছয়েক হল আমার পসার বেড়েছে। ক্লায়েন্টরাই আমাকে সবকিছু দিয়েছে। এই টেলিফোনও ওদেরই দেওয়া। এসব আমি কখনও ভুলি না।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর যখন শুতে গেলাম, তখন হঠাৎই মনে হল, আর দিন কয়েক পর ১৮ ডিসেম্বর। বিশ বছর আগে ওই দিনটাতেই আমি শুভদীপকে টেলিফোন করতে বেরিয়ে শ্যামবাজার কালীবাড়ির দেওয়ালে মাথা খুঁড়েছিলাম—কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।

এশিয়াটিক সোসাইটিতে কয়েকটা বইয়ের খোঁজে গিয়েছিলাম।

মাঝে-মাঝে নিজের পড়াশোনার কাজে ওখানে যেতে হয় আমাকে। আজ দুটো বই কিনলাম ওদের সেলস কাউন্টার থেকে: ‘এ ক্রিটিক্যাল এডিশান অফ শ্রীকালচক্রতন্ত্ররাজ’ আর ‘তন্ত্রলোক’। তারপর ওদের পুঁথিঘরে পড়াশোনা সেরে বেরিয়ে এসেছি বিকেলের পার্কস্ট্রিটে।

সূর্য ডুবে গিয়ে এর মধ্যেই ছায়া নেমেছে। শীতের হাওয়া বেরিয়ে পড়েছে সান্ধ্য ভ্রমণে। সামনের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ একা-একা লাগছিল। মাঝে-মাঝে এই নিঃসঙ্গতার অসুখ আঁকড়ে ধরে আমাকে। আমার জানা এমন কোনও জড়িবুটি নেই যা এই অসুখ সারাতে পারে।

আমি জানি, আমি স্বাভাবিক নই। আমার বয়েসি যৌবন যাই-যাই কোনও মহিলা সারাদিন নানারকম স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। আর আমি! আমার যত ব্যস্ততা আমার পেশাকে ঘিরে। আমার কোনও বন্ধু নেই—ছেলে-বন্ধুও না, মেয়ে-বন্ধুও না। শুভদীপের ঘটনার পর আমার বিশ্বাসের জায়গাটায় বোধহয় কোনও গোলমাল হয়ে গিয়ে থাকবে। তাই অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলেও কাউকে আমি বিশ্বাসের আওতার মধ্যে নিয়ে এসে বন্ধু করতে পারিনি। শুধু আমি আর মা লতানে গাছের মতো পরস্পরকে জড়িয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছি।

শরীরের তাড়না আমি কখনও-কখনও টের পাই। তখন কামোত্তেজনা দমন যন্ত্র সামনে রেখে নিয়মমতো অভিমন্ত্রিত করে সে-তাড়নার উপশম করি। তবে সবসময় যন্ত্র বা মন্ত্রে কাজ হয় না।

যে-তন্ত্রমন্ত্রের ব্যবসা করে আমি বেঁচে আছি, তাতে কি আমি বিশ্বাস করি?

বহুদিন ধরে ভেবে উত্তর পেয়েছি ‘হ্যাঁ’। আমার বিশ্বাসে ইন্ধন জুগিয়েছে আমার অসংখ্য মক্কেল। আর, যে কখনও তোমার ক্ষতি করবে না, তাকে বিশ্বাস করতে ভয় কিসের! তন্ত্রচর্চা কখনও আমাকে নিরাশ করেনি।

ফুটপাথের কোণে দাঁড়িয়ে এসব নানান কথা ভাবছিলাম। অফিস ফেরত লোকজন অনবরত যাতায়াত করছে পাশ দিয়ে। হঠাৎই বিশ বছরের পুরোনো একটা ভূত দেখে আমি চমকে উঠলাম।

সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে লাফিয়ে পড়ল স্মৃতিকণা নামের মেয়েটা। আমাকে ঘিরে ফুটপাথের ওপরেই ড্যাং-ড্যাং করে নাচতে শুরু করল। ওর বুক ঊরু অশ্লীলভাবে নড়ছে। আর বিলোল কটাক্ষে আমাকে প্রতি মুহূর্তে শেষ করে দিচ্ছে।

ভূতটা আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। খানিকটা অবাক হয়ে দেখছিল আমাকে।

আমি প্রথমটায় ভেবেছি সন্ধের আলোছায়ায় ভুল দেখছি। কিন্তু না, ভূতটা এখনও মিলিয়ে যায়নি!

আমি অবাক হয়ে গেলাম। সবকিছু সেই একইরকম—চলার ছিরি, মুখের ছাঁদ, চুলের কায়দা, আর সর্বনাশা সেই দুটো চোখ।

স্মৃতিকণা পাগলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বাতাসে হাত-পা ছুড়ে নাচছিল। আমার মাথার ভেতরে মা অবাক চিৎকারে বলছিল, ‘লীলা, এ তুই কী করলি!’ আর বাবা কপাল চাপড়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছিল

ভূতটা আরও কাছে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল।

এবার আরও ভালো করে দেখলাম।

বয়েস হয়েছে, কপালের দুপাশের চুল ফিকে হয়ে এসেছে, কোমর একটু ভারী, প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটারে স্মার্ট সাজার চেষ্টা করেছে বটে, তবে উঁচিয়ে ওঠা ভুঁড়ির জন্যে একটু বোকাসোকা লাগছে।

কিন্তু চোখ দুটো পালটায়নি। সেই গভীর টলটলে চোখ। রোমান্টিক। এখনও—বিশ বছর পরেও। কেন যে এই চোখের গভীরে সেদিন বোকা মেয়ের মতো ঝাঁপ দিয়েছিলাম! কেন যে ওকে অতটা বিশ্বাস করেছিলাম! কিন্তু তখন যে আমাদের বয়েসটাই ছিল না ভেবে কাজ করার বয়েস।

না, ভূতটাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি।

‘আপনাকে যেন চেনা-চেনা লাগছে—’ ভূতটার গলার স্বরে এখনও সেই পুরোনো ম্যাজিক।

আমি বললাম, ‘শুভদীপ? শুভ?’

‘লীলা…শ্যামবাজার…লিলু…মানে…’ ও হাসল।

আমি উত্তরে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে তুললাম ঠোঁটে।

‘ওঃ, সেই টিপিক্যাল হাফ স্মাইল! বাব্বাঃ, কতদিন পর দেখা! পনেরো-ষোলো বছর হবে, কী বলো?’

আমি বললাম, ‘পনেরো নয়, কুড়ি…বিশ বছর…।’

বিশ বছর? নাকি বিষ বছর?

শুভদীপের স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়। আমার ‘টিপিক্যাল হাফ স্মাইল’-এর ব্যাপারটাও ও মনে রেখেছে! কিন্তু বিশ বছরটা ভুলে গেছে অনায়াসে।

ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার পর শুভ বলল, ‘লিলু, চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি—যদি অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকে। কত গল্প জমে আছে, জানো?’

আমি অবাক হয়ে শুনলাম আমি বলেছি, ‘চলো, কোনও আপত্তি নেই।’

রাস্তা দিয়ে কত গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। শুভকে আমি কেন এক ধাক্কায় কোনও গাড়ির তলায় ফেলে দিচ্ছি না! কেন খতম করে দিচ্ছি না ওর পৌরুষের আস্ফালন?

আমার একা-হয়ে যাওয়া মন বোধহয় এই মুহূর্তে কারও সঙ্গ চাইছিল। তাই ওর পাশাপাশি হেঁটে চললাম অনায়াসে। বাবার কান্না আর আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না।

ফুটপাথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে শুভ বলল, ‘লিলু, সত্যি, ভাবা যায় না! বিশ বছর পর হঠাৎ করে এরকম রাস্তায় দেখা…!’

আমি অল্প হেসে বললাম, ‘আমি আর সহজে অবাক হই না, শুভ। ভাবা যায় না এরকম অনেক কিছু আমি এই বিশ বছরে ভাবতে শিখেছি।’

শুভ একটু অবাক চোখে দেখল আমার দিকে। মজা করে বলল, ‘আমার লিলু অনেক পালটে গেছে।’

‘পালটাবেই তো। আঠেরো বছর আর আটতিরিশ বছরে অনেক তফাত।’

আমরা ‘টমি ক্যাট’ রেস্তরাঁয় গিয়ে বসলাম।

রেস্তরাঁর ভেতরটা আবছা অন্ধকার। মাঝে-মাঝে লাল-নীল স্পট জ্বলছে। চাপা ঝংকার তুলে হালকা মিউজিক বাজছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোট-ছোট বুকওয়ালা একটা রোগা মেয়ে মিহি গলায় হিন্দি গান গাইছে।

রেস্তরাঁর সাজগোজ মন্দ নয়। পালিশ করা কাঠের দেওয়াল। তার ওপরে পেতলের কারুকাজ। আর দেওয়ালের নানা জায়গায় রহস্যময় ছমছমে অয়েল পেইন্টিং ঝোলানো। দরজার কাছে রঙিন কাচের চুড়ির শিকল ঝুলিয়ে তৈরি চিক। তার জায়গায়-জায়গায় লাল-নীল-হলদে টুনি বাতি।

শুভদীপ মেনু কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘পছন্দসই অর্ডার দাও।’

আমি বললাম, ‘শুধু একটু স্ন্যাক্স নেব। যেমন, চিকেন স্যান্ডউইচ চলতে পারে। তার সঙ্গে কফি।’

শুভ পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে-ধরাতে বলল, ‘ব্যস, এই! ড্রিঙ্কস নেবে না?’

‘না। অভ্যেস নেই—’ একটু থেমে তারপর: ‘তবে তুমি নিতে পার। আই ওন্ট মাইন্ড।’

শুভ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমি একটু হুইস্কি নেব। ফর ওল্ড টাইমস সেক—।’

বেয়ারা অর্ডার নিয়ে চলে গেল।

বিশ বছর আগের মতো সুন্দর করে হেসে শুধু জিগ্যেস করল, ‘বলো, কেমন আছ। কী-কী করলে এই কুড়ি বছরে—।’

ওর কথার সহজ সুরে মনে হল, বিশ বছর নয়, ওর সঙ্গে বিশ ঘণ্টা পরে যেন আমার দেখা হল।

টেবিলের একপাশে কাচের গ্লাসে সাজানো পেপার ন্যাপকিনের নকশা দেখতে-দেখতে বললাম, ‘তেমন কিছুই করিনি। শুধু বুড়ি হয়েছি। কোনওরকমে দিন চলে যাচ্ছে…।’

‘কে বলেছে তুমি বুড়ি হয়েছ!’ কথাটা বলে শুভদীপ আমার সাজপোশাক দেখছিল। বারবার তাকাচ্ছিল আমার বুকের দিকে। বয়েস সেখানে ছাপ ফেলতে পারেনি। তা ছাড়া আমি তো জানি, ওর বরাবরই বুকের নেশা—তা সে ছোটই হোক, আর বড়ই হোক।

‘বিয়ে তো করোনি দেখছি—।’

ওর সিগারেটের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগছিল, আর বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, মানুষটা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে আর কপাল চাপড়ে কাঁদছে।

আমি হেসে বললাম, ‘শুধু বিয়ে কেন, অনেক কিছুই করা হয়ে ওঠেনি।’

আবার সিগারেট গভীর টান। তারপর: ‘বিয়ে না করার জন্যে নিশ্চয়ই আমার ঘাড়ে দোষ চাপাওনি!’

আমার বমি পাচ্ছিল, গা গুলিয়ে উঠছিল। বললাম, ‘ওটা ছাড়া আর কোনও টপিক নেই?’

শুভ হাসল—স্বস্তির হাসি। ও বোধহয় ভেবেছিল, আমি পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে ওর দায়দায়িত্ব নিয়ে চাপান-উতোর শুরু করব। সেই আশঙ্কা কেটে যেতেই ও অনেক সহজ হয়ে গেল।

‘এখন কোথায় থাকো? সেই শ্যামবাজারে?’

‘হ্যাঁ। একই বাড়িতে। থাকা বলতে আমি আর মা।’

‘মেসোমশাই?’

শুভদীপ আমাদের বাড়িতে কখনও যায়নি। শুধু আমার মুখে সকলের গল্প শুনেছিল। ওকে সংক্ষেপে সবার কথা বললাম। তবে বাবা যে আত্মহত্যা করেছে সেটা জানালাম না।

চিকেন স্যান্ডউইচ আর পটাটো চিপস চলে এল টেবিলে। সঙ্গে টমাটো সস।

শুভ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে স্যান্ডউইচে সস মাখাতে শুরু করল। দু-এক টুকরো চিপস দাঁতে কেটে স্যান্ডউইচ কামড় বসাল।

আমারও খিদে পেয়েছিল। তাই লোক-দেখানো লজ্জা না করে খেতে শুরু করলাম।

‘তুমি আর মাসিমা বাড়িতে একা থাকো!’ শুভ বেশ অবাক হয়ে বলল। কিন্তু ওর চোখে একটা লোভের ছায়া দেখতে পেলাম আমি। মনে হল, কয়েক মিনিট পরেই ও হয়তো আমার বাড়িতে আসার বায়না ধরবে।

আমি ওর কথায় হাসলাম, বললাম, ‘দুজন থাকলে আর একা কোথায়?’

‘তোমাদের চলে কী করে?’

আমি স্যান্ডউইচ চিবোতে-চিবোতে বললাম, ‘স্যান্ডউইচটা বেশ ভালো করেছে।’

‘তোমাদের চলে কী করে?’ শুভদীপ নাছোড়বান্দার মতো দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল।

আমি হেসে ওর দিকে তাকালাম, বললাম, ‘আমি স্যান্ডউইচ মাইনাস স্যান্ড। ওই করেই বেশ চলে যায়।’

শুভ চোখ কপালে তুলে জিগ্যেস করল, ‘তার মানে?’

‘আমি উইচ। সাদা কথায় যাকে ডাইনি বলে। তুকতাক ঝাড়ফুঁক নিয়ে আছি—।’

আমার কথায় ও এত জোরে হেসে উঠল যে, পাশের টেবিলের লোকজন প্রায় চমকে উঠল। কিন্তু ওর হাসি কিছুতেই আর থামতে চায় না।

হাসতে-হাসতে ওর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। কোনওরকমে বলল, ‘লিলু, দারুণ জোক করেছ। তোমাকে সেলাম।’

আমি কোনও কথা বললাম না। সত্যি কথা বলেছি, বিশ্বাস করা-না-করা ওর ব্যাপার। ওকে বিশ্বাস করিয়েই বা আমার কী লাভ!

‘এবার তোমার কথা বলো—।’ আমি ঠান্ডা গলায় বললাম।

শুভদীপের সাজপোশাক, হাতের হিরের আংটি ইত্যাদি জানিয়ে দিচ্ছিল ও বেশ আরামেই জীবন কাটাচ্ছে।

আমার তলপেটটা ব্যথা করছিল। চিনচিনে ব্যথা। এ-ব্যথা থেকে নিস্তার নেই। একটা সিনেমার রিল উলটোদিকে ঘোরাচ্ছিল কেউ। বিশ বছরের পথ পেরিয়ে গেল বিশ সেকেন্ডে। লীলা, এ তুই কী করলি! এ তুই কী করলি!

স্মৃতিকণা কোথা থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে টেবিলে। তারপর হাত-পা-বুক দুলিয়ে-দুলিয়ে ওর সে কী নৃত্য! ছাতা-পড়া পুরনো ঘা-টাকে ও যেন খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে দাগদগে করে তুলছিল।

আমি পলকের জন্যে চোখ বুজলাম। ওঃ! তোর এই হাহাকারী নাচ আর কত দেখব!

শুভদীপ ওর ব্যবসার কথা বলছিল। বাবার ব্যবসাকে কীভাবে কৃতিত্বের সঙ্গে ও ফুলিয়ে- ফাঁপিয়ে তুলেছে গর্ব করে সে-কথাই শোনাচ্ছিল। ওরা এখন প্রায় সাতাশ রকম কনুজিউমার প্রোডাক্ট তৈরি করে। বরানগরে ওদের বিশাল ফ্যাক্টরি। বাবা-মারা গেছেন চার বছর। এখন ও আর ওর ছোট ভাই সবকিছুর মালিক। মায়ের অংশটা ওরা দুজনেই দেখাশোনা করে। ওরা এখনও সেই যোধপুর পার্কের বাড়িতেই আছে। নতুন একটা বাড়ি তৈরি করেছে সল্টলেকে। সেটা লিজ দেওয়া আছে।

বোঝা গেল। আমার সামনে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে একজন সফল লম্পট।

আমি নির্লিপ্ত মুখে শুভর কথা শুনছিলাম। ও আমার কাছে ঝুঁকে এসে চাপা গলায় বলল, ‘লিলু, আমাদের প্রোডাক্টের লিস্টে অ্যাডাল্ট আইটেমও আছে।’

আমার কোনও প্রতিক্রিয়া হল না দেখে ও উদাস গলায় বলল, ‘আমাদের প্ল্যান্টে একটা অটোমেটিক পোরশান গন্ডগোল করছে। তাই কনসালট্যান্ট ফার্মকে খবর দিতে এদিকে এসেছিলাম। ভালোই হল তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’

কথা শেষ করে শুভ একটা ভিজিটিং কার্ড বের করল পকেট থেকে। সেটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘রেখে দাও—।’

চোখ বুলিয়ে দেখলাম, তাতে অফিস আর বাড়ি—দুটো ঠিকানাই আছে।

একবার মনে হল কার্ডটা ওর মুখে ছুড়ে মারি। কিন্তু ল্যাংটো মেয়েটা টেবিলের ওপরে নাচতে-নাচতেই যেন চোখ টিপল আমাকে। ইশারা করল। কার্ডটা আমি হাতব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।

হঠাৎই শুভদীপ জিগ্যেস করল, ‘এরপর তুমি কোথায় যাবে?’

বেয়ারা কফি দিয়ে গিয়েছিল। তাতে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘কোথায় আবার, বাড়ি! মা একা আছে।’

শুভ ওর হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিল। চুমুক দেওয়ার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল দু-এক পেগ ওর কাছে নেহাতই ট্রায়াল বল।

‘লিলু, একটা কথা বলব?’ শুভ সতর্ক চোখে আমাকে জরিপ করতে-করতে বলল, ‘আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে? আমি ভীষণ লোনলি…।’

আমি কফিতে আরামের চুমুক দিয়ে বললাম, ‘তাড়া কিসের! বিশ বছর পর আমাদের দেখা হল কি আবার বিশ বছরের ছাড়াছাড়ির জন্যে!’

‘লিলু, ইউ আর গ্রেট!’ শুভদীপ আবেগে যেন পা পিছলে পড়ল। ও বোধহয় আমার শরীরের তাপ-উত্তাপ টের পাচ্ছিল। হয়তো সেই তরঙ্গের কম্পাঙ্ক থেকে বিশ বছর আগে ডায়মন্ডহারবারের ব্যাপারটা জীবন্ত করে তুলতে চাইছিল মনে-মনে।

‘তোমাকে দেখে মনেই হয় না তোমার বয়েস তিরিশ পেরিয়েছে।’ শুভদীপ বোধহয় প্রশংসার মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

‘তোমাকে দেখেও ঠিক একইরকম মনে হয়। মনে হয় সেই বিশ বছর আগের শুভ।’ ছেনালি করে ওর ছেনালির শোধ দিলাম। কিন্তু শুভ বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝল না। কারণ মাথা ঝুঁকিয়ে ও ব্লাশ করল।

‘লিলু, কবে আবার দেখা হবে?’

আমি ওকে আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিলাম। বললাম, ‘কাল সন্ধে সাতটায় আমার বাড়ি এসো। আমি তোমার জন্যে ওয়েট করব—।’

শুভদীপ আমার হাত চেপে ধরল। গাঢ় গলায় বলল, ‘তোমার কাছে আমি অপরাধী হয়ে আছি। তুমি কখনও আমাকে ক্ষমা করবে ভাবিনি।’

হঠাৎ দেখি নাচুনী মেয়েটা আমাদের টেবিলের ওপর থেকে কোথায় মিলিয়ে গেছে। আর তখনই খেয়াল করলাম, রোগা ছোট-ছোট বুক মেয়েটা তখনও গান গাইছে: ‘মার দিয়া যায়, কে ছোড় দিয়া যায়। বোল তেরে সাথ কেয়া সলুক কিয়া যায়…।’

সত্যি, নিয়তির জবাব নেই! নইলে শুভদীপের সঙ্গে এতদিন পর এই অলৌকিক সাক্ষাৎ! এখন বুঝতে পারছি, রক্তের ঋণ সহজে শোধ হয় না। রক্তের ফোঁটা সহজে ধুয়ে ফেলা যায় না।

কফি শেষ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম: ‘কাল সাতটায় এসো কিন্তু।’

শুভও উঠে দাঁড়াল: ‘ছ-টা বেজে ষাট মিনিটে আমি পৌঁছে যাব।’

বাড়ি ফেরার পথে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, শুভদীপ কী চমৎকারভাবেই না দুটো প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। এক: ওর বিয়ের প্রসঙ্গ। দুই: বিশ বছর আগে ওর-আমার সন্তানের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তা ও জানতে চায়নি।

অনেক ভেবে দেখলাম, শুভদীপকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দেওয়াটা আমার অপদেবতাদের অভিপ্রায় নয়।

তা হলে কি আঠেরো বছরের একটা মেয়ের সঙ্গে অন্যায়ের জন্যে আটতিরিশ বছরের এক মহিলা প্রতিশোধ নেবে?

কাঁটায়-কাঁটায় সাতটার সময় শুভদীপ এল আমার বাড়িতে। পাজামা-পাঞ্জাবি-শাল পরে ও একেবারে ফুলবাবুটি সেজে এসেছে।

ও যখন আমাকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকল তখন ওর গা থেকে পারফিউমের গন্ধ পেলাম।

আমার হাসি পেয়ে গেল। লড়াইয়ের জন্যে ও দেখছি পুরোপুরি তৈরি হয়ে এসেছে!

মা-কে বলে রেখেছিলাম, সাতটার সময় আমার কাছে একজন দামি মক্কেল আসবে। আর কাজের বাচ্চা মেয়েটাকে দোকানে পাঠিয়ে মিষ্টি আনিয়ে রেখেছি। মা শুভদীপের সামনে সেগুলোই সাজিয়ে দিয়ে গেল। ও ‘এ কী, এতসবের কী দরকার ছিল’ বলে একটু সৌজন্য দেখাল।

খেতে-খেতেই শুভ ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিল। আর আমি তলপেটের সেই চিনচিনে ব্যথাটা টের পাচ্ছিলাম।

ও মা-কালীর ফটো দেখল, বাবার ফটো দেখল, কিন্তু কোনও কথা বলল না।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমিই প্রসঙ্গ তুললাম।

‘তোমার জীবনটা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।’ টেবিলে নখের আঁচড় টানতে-টানতে বললাম। তারপর মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে: ‘বিয়ে করেছ?’

ও অস্বস্তি পেয়ে নড়েচড়ে বসল। ওর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। কোনও কথা বলার আগে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে নিল।

‘আমার জীবনটা কোনও জীবন নয়, লিলু। শুধু অফিস-ফ্যাক্টরি-বাড়ি, অফিস-ফ্যাক্টরি-বাড়ি, এই করে দিন কাটছে। একটু থেমে ও বলল, ‘তবে কাল থেকে জীবনটা অন্যরকম লাগছে। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল: সত্যি, মানুষ ভাবে এক, আর ভগবান করে এক।’

বুঝতে পারলাম, বিশ বছরে শুভদীপ আরও চালাক হয়েছে। আরও সুন্দর করে মন-রাখা কথা বলতে শিখেছে। ওর ডায়ালগ শুনে আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে করছিল। কী সুন্দরভাবেই না ও আমার প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে গেল!

মা এসে চা দিয়ে গেল। খালি প্লেট-গ্লাসগুলো তুলে নিয়ে গেল যাওয়ার সময়।

আমি নির্লিপ্ত গলায় একই প্রশ্ন করলাম আবার, ‘বিয়ে করেছ?’

আজকের লিলু বিশ বছর আগেকার খুকি লীলারানি নয়।

তা সত্ত্বেও ও চুপ করে আছে দেখে ভর্ৎসনা করে বললাম, ‘ওঃ, কাম অন, শুভ! ছেলেমানুষি কোরো না। আমি না করলে কী হবে, সবাই বিয়ে করে।’

একটা সিগারেট ধরাল শুভদীপ। চায়ের কাপে কয়েকবার চুমুক দিল। তারপর উদাস চোখে মা-কালীর ফটোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সুস্মিতার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে বারো বছর। এই জানুয়ারিতে টুয়েলফথ অ্যানিভার্সারি। আমার কাছে ব্যাপারটা মৃত্যুবার্ষিকীর মতো।’

আমার হাসি পেয়ে গেল। বেচারা শুভদীপ আজ কত আশা নিয়েই না আমার বাড়িতে এসেছিল! বিশ বছর আগে পড়া আমার শরীরের ভূগোল বই ওর আজও মুখস্থ আছে কি না সেটা যাচাই করতে এসেছিল। অথচ কথাবার্তা কী অদ্ভুতভাবে ওর অপছন্দের পথে এগোচ্ছে।

আমি শুভর অভিনয়ে সায় দিয়ে সহানুভূতির অভিনয় করে বললাম, ‘কেন, সুস্মিতা কি তোমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলে না?’

‘ও আমাকে একটুও বোঝার চেষ্টা করে না। জানি, তুমি হয়তো ভাবছ এসব বলে তোমার সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু…’ হঠাৎই সিগারেট ফেলে দিয়ে আমার হাত চেপে ধরল শুভদীপ: ‘বিশ্বাস করো, লিলু, আমি ভীষণ একা—।’

শুভ আমার হাত কচলাতে লাগল।

আমার বিরক্ত লাগছিল, কিন্তু হাত ছাড়িয়ে নিলাম না। ওকে আমি একটু-আধটু আশকারা দিতে চাই। আমার পরিকল্পনার পক্ষে সেটা খুব জরুরি।

আমার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি চাপলাম। শুভর অভিনয়ে বুদ্ধির ছাপ আছে। তবে ওকে আমার খারাপ লাগছিল না। বোকা ভগবানের চেয়ে বুদ্ধিমান শয়তান অনেক ভালো।

ওর হাত ক্রমশ গরম হয়ে উঠছিল। ও আতুর চোখে আমাকে দেখছিল।

দেখার যথেষ্ট কারণ আছে। আজ আমি আমার আলমারির সবচেয়ে ফিনফিনে এবং দামি শাড়িটা পরেছি। আর আকাশি শাড়ির নীচে লো-কাট গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ। বাইরে শীত থাকলেও ঘরের ভেতরে সেরকম ঠান্ডা নেই। সুতরাং আমার শরীরের যতটুকু যেভাবে দেখা যায় সেভাবেই দেখছিল শুভদীপ।

আমি আচমকা জিগ্যেস করলাম, ‘তোমার ছেলেমেয়ে ক’টা?’

শুভ আমার হাতটা চট করে ছেড়ে দিল। আমাকে একপলক অদ্ভুত চোখে দেখে মাথা নাড়ল: ‘নেই।’

‘তোমার বিয়ে তা হলে সুখের হয়নি?’

‘এর পরেও ঠাট্টা করছ, লিলু!’

‘সুস্মিতাকে ডির্ভোসের কথা ভেবেছ?’

‘ভেবেছি, কিন্তু কোনও উপায় নেই। বাঁধা পড়ে গেছি। ওর বাবা আমাদের বিজনেসে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ঢেলেছে—।’

তাই বলি! আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা না পড়লে শুভকে কে আটকাতে পারে!

‘লিলু, তুমি সাহস দিলে আমি একবার চেষ্টা করতে পারি। তা হলে পুরোনো ভুলটা শোধরানো যায়। বিশ্বাস করো টাকা-পয়সার দিকে আমার আর কোনও টান নেই।’

কিন্তু মেয়েছেলের দিকে আছে। বুঝতে পারছিলাম, শুভর কথাগুলো আগাগোড়া মিথ্যে, পুরোটাই অভিনয়—কিন্তু তা সত্ত্বেও শুনতে খারাপ লাগছিল না।

তুমি সাহস দিলে আমি একবার চেষ্টা করতে পারি। চমৎকার!

আমার গুরু নৃপেন সাধুখাঁ যখন আমাকে কামনা করেছেন তখন স্পষ্ট বলেছেন, ‘লীলা, আমাদের মিলন প্রয়োজন।’

আমরা দুজনে মাঝরাতে মিলিত হওয়ার পর উত্তরে মুখ করে বসে কর্ণপিশাচিনী গুহ্যমন্ত্র সাধনা করেছি। ফলে মিলনটাকেও আমার খুব স্বাভাবিক স্বতঃফূর্ত বলে মনে হয়েছে। সেই গুরুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমি বট-যক্ষিণী চেটক, রতিরাজ চেটক, ষটকোণ বিশাংক যন্ত্র প্রয়োগ, বার্তালী মন্ত্র ইত্যাদি চর্চা করেছি। একসময় মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তিনিই আমার দেখা একমাত্র পুরুষ, যার মধ্যে পুরুষকার রয়েছে।

কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর সম্পর্কের পর তিনি একবস্ত্রে হিমালয়ের দিকে রওনা হয়ে যান। মনে পড়ে, সেদিন আমি হারানো ভালোবাসার জন্যে কেঁদেছিলাম।

খেয়াল করিনি শুভ কখন যেন আমার ঊরুতে হাত রেখেছে। শুনতে পেলাম ও বলছে, ‘লিলু, আমি বিয়ে করেছি শুনে তোমার খারাপ লাগছে?’

আমি বাবার ফটোর দিকে চোখ রেখে বললাম, ‘না, তা নয়।’

তারপর উঠে গিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলাম। মা জানে, তন্ত্র চর্চার জন্যে নির্জনতা দরকার। এখন ঘরে আমি আর শুভদীপ—ঘরের দুটো দরজাই নিশ্চিন্তে বন্ধ।

শুভ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের শালটা খুলে রেখে দিল চেয়ারে। তারপর দু-পা ফেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে একেবারে জাপটে ধরল।

আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘এখন না—পরে। কয়েকটা দরকারি কথা তোমার শোনা দরকার।’

শুভ আমার চোখে কী দেখল কে জানে। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ও শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল আবার। ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ‘শুধু-শুধু তা হলে দরজা দিতে গেলে কেন?’

আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। বললাম, ‘শরীরের লজ্জা আড়াল করতে দরজা দিইনি। দিয়েছি মনের লজ্জা আড়াল করতে। বোসো—।’

ও বসে পড়ল।

দাঁতে-দাঁতে চেপে আমি ঠিক করলাম, এইবার ওকে বলা দরকার। সত্যি কথার প্রয়োজন কখনও ফুরিয়ে যায় না।

‘শুভ, কুড়ি বছর মানে কত দিন জানো! সাত হাজার তিনশো দিন।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘আজ আমার সর্বনাশের প্রায় বিংশতিতম বার্ষিকী..।’

‘লিলু, প্লিজ, আমাকে আর অপমান কোরো না। জানি, আমার অন্যায়ের কোনও ক্ষমা নেই…আমি…।’

‘কথা না বলে চুপ করে শোনো।’

শুভদীপের মুখে একটা ভয়ের ছায়া পড়ল। ওর পারফিউমের গন্ধ মিশে যাচ্ছিল মলিন ঘরের প্রাচীন গন্ধের সঙ্গে। কেমন এক অদ্ভুত বাতাবরণ কখন যেন তৈরি হয়ে গেছে এই শীতের সন্ধ্যায়।

শুভ ঠিক বুঝতে পারছিল না কী করবে, কোনদিকে তাকাবে, হাত দুটো কোথায় রাখবে।

আমি স্বগতোক্তির মতো বলতে শুরু করলাম, ‘সর্বনাশ বলতে তোমার হাতে আমার মেয়েলি ব্যাপার খোওয়া যাওয়া নয়। এমন কি তুমি আমাকে বিয়ে না করে সরে পড়েছ, তাও নয়। ব্যাপারটা অন্য। বিশ বছর আগে আমার বয়েস ছিল সতেরো কি আঠেরো—কিশোরী আর যুবতীর মাঝামাঝি বয়েস একটা। বাড়িতে ঝগড়া করে আজকের মতোই শীতের এক সন্ধ্যায় শ্যামবাজারের টেলিগ্রাফ অফিস থেকে তোমার বাড়িতে আমি ফোন করেছিলাম। তুমি নানান পাশ কাটানো কথা বলেছিলে আমায়। বলেছিলে, আপসেট হওয়ার কিছু নেই। তারপর তোমার কোনও ক্লাসমেটের সঙ্গে কথা বলার ভান করেছিলে। তুমি যদি…।’

শুভদীপের চোয়াল কিছুটা ঝুলে পড়েছিল। ও বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি হাত তুলে ওকে বাধা দিলাম: ‘আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। নানান দুশ্চিন্তা মাথায় করে সেদিন আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। তুমি জানো না, কীভাবে আমার এক-একটা দিন, এক-একটা রাত কেটেছিল। বেশ কয়েকদিন সন্ধেবেলা আমি কফি-হাউসে গিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছি। তুমি আসোনি। শুভ, আমি কিন্তু তোমার বাড়িতে যেতে পারতাম। পারতাম ইউনিভার্সিটিতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। হয়তো হইচই হত, অনেক ঝামেলা হত—শেষ পর্যন্ত সমাধানও হয়তো একটা হত। কিন্তু আমার আত্মসম্মানে বেধেছিল। ফাঁপা আত্মমর্যাদা নিয়ে আমি শুধু অপেক্ষাই করে গেলাম মূর্খের মতো।’

শুভ তখনও মুখ সামান্য হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে। আর আমি একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কথা বলে যাচ্ছিলাম।

‘তুমি তো জানো, অ্যাবরশান তখন বেআইনি ছিল। ফলে অনভিজ্ঞ অপদার্থ একটা মেয়ে অসহায়ভাবে শূন্যে হাতড়াতে লাগল। লুকিয়ে-চুরিয়ে যে কিছু করব, তাও পেরে উঠলাম না। ভাবতে পারো, তখন আমি কী পাগলামিটাই না করেছি! যা দিয়ে পেরেছি চেষ্টা করেছি, নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছি। পেন, পেনসিল, স্কেল, অ্যালুমিনিয়ামের হ্যাঙার —ওঃ!’

স্মৃতিকণা নামের নির্লজ্জ মেয়েটা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে টেবিলের ওপরে। ওর বিশ বছরের যৌবন উথালপাথাল হয়ে মাতালের মতো ধেইধেই করে নাচছে।

‘লিলু, প্লিজ, আমি আর শুনতে পারছি না—’ শুভদীপ ভাঙা গলায় অনুনয় করে বলল, গলা দিয়ে উঠে আসা কাশির দমক কোনওরকমে সামলে নিল।

আমি কিন্তু থামলাম না। একে-একে সব ওকে বললাম। মায়ের কথা, বাবার কথা। বাবা যে পাশের ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন সে-কথাও বললাম।

‘…বাবা মারা যাওয়ার পর আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। ঠিক করলাম, বাচ্চাটাকে নষ্ট করব না। মায়ের সঙ্গে তুলকালাম ঝগড়াঝাঁটি করে চলে গেলাম বর্ধমানের এক দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে। দোকান থেকে সিঁদুর কিনে মাথায় লাগিয়ে মিথ্যে একটা বিয়ের গল্প ফেঁদে সেখানে থেকে গেলাম। সত্যি কথা বলতে কি, পিসির বাড়িতে আমি রাতদিনের ঝিয়ের কাজ করতাম। পিসির বড় ছেলে আমাকে নষ্ট চোখে দেখত। কী অপমানে, কী হেনস্থার মধ্যে যে ক’টা মাস সেখানে কাটিয়েছি তা শুধু আমিই জানি। বিশ বছরে সেই দিনগুলোর কথা আমি একটুও ভুলিনি। একটুও না। অথচ শেষ পর্যন্ত কী হল জানো?’

শুভ কেউটে সাপের মুখে বশ হওয়া কোলা ব্যাঙের মতো নিষ্পলকে আমার দিকে তাকিয়ে। ওর ঠোঁট সামান্য কাঁপছে। আমার গল্প শুনতে-শুনতে আমার ভেতরের গল্পটাও পড়ে ফেলতে চাইছে যেন।

আমার চোখ জ্বালা করছিল। গলায় কী একটা যেন আটকে গেছে। অনেক চেষ্টা করে আবার কথা বললাম আমি, ‘বাচ্চাটা মরে জন্মাল। জন্মের পর মৃত্যু নয়—মৃত্যুর পর জন্ম। আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। মরতে-মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। আর সেই সঙ্গে মা হওয়ার সাধে চিরদিনের মতো ইতি পড়ল, নটে গাছটি মুড়োল।’

শুভদীপ দু-হাতে মুখ ঢাকল। একটা যন্ত্রণার শব্দ বেরিয়ে এল ওর ঠোঁট চিরে। তারপর কোনওরকমে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, লিলু। এতসব আমি জানতাম না…আমি…।’

‘সত্যিই তো, জানবে কী করে! তুমি তো ‘আপসেট হওয়ার কিছু নেই। বলেই পালিয়েছিলে—।’

শুভ এবার কাঁদতে লাগল। ওর পাঞ্জাবি পরা পিঠটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল। তারই মধ্যে ও জড়িয়ে-জড়িয়ে বলল, ‘আমাকে শাস্তি দাও। আমার বাবা কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন তুমি জানো না। তা ছাড়া আমি তখনও পড়াশোনা নিয়ে…।’

ওর কান্নায় আমার মন নরম হতে দিলাম না। বিশ বছরে আমি অনেক কেঁদেছি। কেউ সে-কান্না শুনতে পায়নি।

‘শুভ, সেই টেলিফোন করা রাতের ব্যাপারটা নিয়ে পরে আমি অনেক ভেবেছি। সেদিন তোমার কাছ থেকে আমি বোধহয় শুধু ভরসা চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়াও। পরে কী হত সেটা পরে ভাবা যেত।’

আমার তলপেটে কেউ যেন বরফের ছুরি চালাল। গোপন যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে গেল আমার।

‘লিলু, আমি সেদিন ভুল করেছিলাম। সেদিন আমার খুব অন্যায় হয়েছিল। তুমি আমাকে শোধরানোর সুযোগ দাও…একটিবার…।’

আমি হাসলাম। আমার অভিযোগের উত্তরে শুভদীপ প্রতিবাদ করার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। আর শোধরানো! তার মানে বিয়ে? শুভদীপকে? কক্ষনো না। সুস্মিতার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। না, একটি বিশেষ অঙ্গ যে-জাতের একমাত্র মূলধন, সে-জাতের কোনও প্রাণীকে বিয়ে করার সাধ আমার নেই। তবে শরীরের চাহিদার ব্যাপারটা আলাদা।

অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। শুভদীপ রুমাল বের করে চোখ, গাল, কপাল মুছছিল বারবার। আর আমার চোখ জ্বালা করছিল, তলপেটে জ্বালা করছিল। স্মৃতিকণাকে আর টেবিলের ওপরে দেখতে পেলাম না।

আমি মনে-মনে ভাবছিলাম, সেই ঘটনার পর আমার মতো বিপন্ন অবস্থায় শুভ যদি কোনওদিন আমাকে ফোন করত! আমি হয়তো ওর মতোই এড়িয়ে যাওয়া কথাবার্তা বলতাম, তারপর ওকে ‘বর্ধমানের পিসির’ ভরসায় ছেড়ে দিতাম।

হঠাৎই খেয়াল করে দেখি শুভ কখন যেন আমার কাছে সরে এসে গায়ে-টায়ে হাত দিচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, অপরাধবোধের খোলস ছেড়ে ধূর্ত নারীখাদকটা আবার বেরিয়ে এসেছে বাইরে। শীতের রাত, ঘরের দুটো দরজাই বন্ধ—এ-সুযোগ ছাড়ার কোনও মানে হয় না।

আমি মনে-মনে হাসলাম। ‘বর্ধমানের পিসির’ চেয়েও বড় শাস্তি ওকে আমি দিতে চাই। কিন্তু ওর তো সংসার আছে! একটা বউ আছে। নিশ্চয়ই সে আমার চেয়ে কমবয়েসি কোনও ফুটফুটে মেয়ে।

শুভ তখন আমার গা ঘেঁষে বসে পড়েছে। ওর অভিসারী হাতের গন্তব্যের কোনও বাছবিচার আর নেই। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ও বিড়বিড় করে বলছিল, ‘সুস্মিতাকে আমি ছেড়ে দেব। নকল বিয়েতে আমার আর কোনও সাধ নেই। আমার লিলুকে আমি খুঁজে পেয়ে গেছি। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, তুমিই আমার শেষ ভালোবাসা। লিলু, লিলু…।’

লিলু, এ তুই কী করলি! লিলু, এ তুই কী করলি!

শুভদীপকে আমি আরও স্পষ্ট করে চিনতে পারছিলাম। বিশ বছরে ও বিশেষ শোধরায়নি।

ও আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল জোর করে। আমাকে জাপটে ধরে ওর একমাত্র মূলধন ঘষতে লাগল আমার শরীরে। আমার মুখে, গালে, ঠোঁটে, যেখানে সেখানে চুমু খেতে লাগল পাগলের মতো। আমার ডায়মন্ডহারবারের দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে অসহায় মেয়েটার টেলিফোনের কথাও।

যখন ও প্রায় চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছে, তখন ওকে থামালাম। ও স্টিম ইঞ্জিনের মতো ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস নিতে লাগল।

আমি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আজ নয়—পরে। ফোনে বলে দেব।’

শুভদীপ আকাঙ্ক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষের চোখে আমাকে দেখল। হাঁপাতে-হাঁপাতে জিগ্যেস করল, ‘কেন’?

আমি বললাম, ‘এটা আমার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলার ঘর। এটা তুকতাক-মারণ-উচাটন-বশীকরণের ঘর। এ-ঘরে আর সবকিছু আছে—শুধু ভালোবাসা নেই। আজ তুমি যাও—।’

শুভ যথেষ্ট আহত হল। কিন্তু আহত হলেও আমার কিছু করার ছিল না। নিজেকে তৈরি না করে ওর সঙ্গে কিছু করতে চাই না আমি।

‘লিলু, কাল আসব?’ ও আকুল গলায় জানতে চাইল।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘না, কাল নয়, পরশু। সময়টা পরে আমি বলে দেব।’

‘কাল নয় কেন?’ বাচ্চাদের মতো বায়না করল শুভ। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

ওর প্রশ্নের উত্তরে হাসলাম আমি। বললাম, ‘অপেক্ষার আনন্দ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করতে চাই না বলে—।’

বিশ বছর ধরে আমিও হয়তো অপেক্ষা করেছি। অপেক্ষার আনন্দ থেকে আমিও বঞ্চিত হতে চাই না।

অপ্রসন্ন মন নিয়ে শুভদীপ চলে গেল। আমি ওকে ‘টা-টা’ করে বিদায় জানালাম।

শুভদীপ চলে যাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত নানান বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। দেওয়ালের একেবারে নীচের তাক একটা প্রাচীন পুঁথির কপি বের করলাম। নেপালের দরবার পাঠাগারের একটি দুষ্প্রাপ্য অমূল্য পুঁথি ‘গুহ্যসূত্র’—এটা তারই কপি।

পুঁথির পাতা উলটে অনেকক্ষণ পড়াশোনা করলাম, কাগজে নোট নিলাম। তারপর বের করে নিলাম আরও দুটি বই: ‘গর্ভপ্রবেশ’ ও ‘সৃষ্টিশাস্ত্র’। সেগুলোর কয়েকটা বিশেষ পৃষ্ঠা খুঁটিয়ে পড়ার পর পেয়ে গেলাম আমার আকাঙ্ক্ষিত সমাধান: বন্ধ্যা নারীর নিশ্চিত গর্ভসঞ্চারের হদিস। একবার এক মক্কেলের জন্যে এই টোটকা কাজে লাগিয়েছিলাম। তাতে ফলও পাওয়া গিয়েছিল।

এবারে আমার নিজের পালা।

একটা সাদা কাগজে যাবতীয় তথ্য-আচার লিখে নিতে লাগলাম:

মন্ত্র: ‘ওঁ হং গং নং ষং ফং সং খং মহাকাল ভৈরবায় নমঃ’

দু-চামচ মধু, এক চামচ পোস্ত, পোয়াটাক দুধ, তিল পরিমাণ আফিম ও ধুতুরার দুটি বিচি গুঁড়ো করে ভালো করে মিশিয়ে একটি শুচি কাচপাত্রে রাখবে। দ্রব্যটিকে শুষ্ক করে একটি কাকের পালক ও একটি প্যাঁচার পালক দিয়ে তিনবার করে স্পর্শ করবে। তারপর দ্রব্যটিকে উপরোক্ত মন্ত্রে ১০৮ বার অভিমন্ত্রিত করবে। অভিমন্ত্রিত করার সময় নীচের যন্ত্রটি অষ্টগন্ধের সাহায্যে ভুর্জপত্রে অঙ্কন করে চোখ বুজে বাঁ-হাতের অনামিকা দ্বারা স্পর্শ করে রাখতে হবে। এই আচারের পর গর্ভকামী যুবতী দ্রব্যটি সেবন করবে এবং বীর্যবান পুরুষের সঙ্গে পূর্ণমিলনে লিপ্ত হবে। মিলনকালে মন্ত্রটি নিবিষ্টমনে জপ করবে। এই প্রকারে সিদ্ধিলাভ অবশ্যম্ভাবী।

বইগুলোতে এর পরেও লেখা ছিল পুত্রসন্তান লাভের জন্য কী-কী নিয়ম মানতে হবে, আর কন্যাসন্তানের জন্যেই বা কী নিয়ম। সেসব আমার কোনও দরকার নেই। কারণ, আমি চাই কিছু একটা হোক—তা সে ছেলে, মেয়ে বা হিজড়ে যা-ই হোক, আমার কাজ চলে যাবে।

শুভদীপ এরপর যেদিন আসবে, সেদিন আমাকে তৈরি থাকতে হবে আগে থেকেই। মা-কে আর কাজের মেয়েটাকে দেশবন্ধু পার্কে ভাগবত পাঠ শুনতে পাঠিয়ে দেব, যাতে বাড়ি খালি থাকে। তারপর আমি, শুভ, আর অশুভ—শুধু এই তিন শক্তির খেলা।

পরদিন সকাল শুভদীপ ফোন করল।

‘লিলু, কেমন আছ?’

‘ভালো। তুমি?’

‘তোমার ডাকের জন্যে অপেক্ষা করছি—।’

‘আমিও বিশ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি।’ হেসে ওকে বললাম।

‘আমিও। ডায়মন্ডহারবারের সেই দিনটার অ্যাকশন রিপ্লের জন্যে হন্যে হয়ে ওয়েট করছি।’ অন্যরকম ইঙ্গিত দিয়ে হাসল শুভ।

আমি হেসে বললাম, ‘অপেক্ষার আনন্দ টের পাচ্ছ?’

‘আনন্দ নয়, লিলু, যন্ত্রণা। আজ রাতে তোমার বাড়ি যাচ্ছি।’ জেদি গলায় বলল ও।

‘না, আজ নয়।’ ওর আশায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলাম আমি: ‘পরে বলব।’

এই কথা বলে টেলিফোন রেখে দিলাম।

সারাদিনে আমাকে মোট তিনবার ফোন করল ও। কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, ওর মাথা আর কাজ করছে না, শুধু শরীর কাজ করতে চাইছে।

আমি হাসলাম মনে-মনে। আপন মনেই বললাম, ‘ধৈর্য ধরো, বৎস, ধৈর্য ধরো।’

তারপর পরদিনও শুভদীপের ফোন এল। ফোন করেই ওর প্রথম প্রশ্ন, ‘কবে, লিলু?’

আমি হেসে বললাম, ‘আজ রাতে।’

ও আনন্দে একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। গদগদ গলায় বলল, ‘সোনামণি, আজ রাতে আর ছলনা কোরো না।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘তুমি ঠিক রাত আটটায় এসো।’ হেসে আরও বললাম, ‘বাড়ি ফিরতে তোমার রাত হতে পারে—।’

ও উৎসাহী গলায় বলল, ‘নো প্রবলেম। আমার সঙ্গে গাড়ি থাকবে।’

সেদিন সন্ধে থেকেই তৈরি হওয়ার কাজ শুরু করলাম। বেশ টের পাচ্ছিলাম, ভেতরে-ভেতরে একটা উত্তেজনা ধীরে-ধীরে জানান দিচ্ছে।

ঠিক আটটার সময় কলিংবেল বেজে উঠল।

সদর দরজা খুলতেই শুভদীপকে দেখতে পেলাম। আজও যথারীতি পাজামা, পাঞ্জাবি আর শাল, নাকে এল পারফিউম আর হুইস্কির গন্ধ।

‘লিলু, তোমার টানের কাছে তড়িৎ চুম্বকও হার মেনে যাবে।’ মজা করে বলল শুভদীপ।

বুঝতে পারছি, ওর দণ্ড চুম্বকের অবস্থা খুব খারাপ। তাই বললাম, ‘এসো, ভেতরে এসো—।’

‘ভেতরে ঢোকার জন্যে আমি ছটফট করছি—’ চোখ মটকে বলল ও। তারপর: ‘আমার কথাটার কিন্তু ডাবল মিনিং…।’

আমি হাসলাম। ওর জন্যে যে কী অপেক্ষা করে আছে তা যদি ও জানত! জানলে নির্ঘাত ও দৌড়ে পালাত এ-বাড়ির দরজা থেকে।

বাইরে ফুটপাথের লাইটপোস্টের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কালো কুকুর আকাশের দিকে মুখ তুলে মিহি সুরে কেঁদে উঠল। বোধহয় বেচারার শীত করছে।

আমি আবার ওকে ডাকলাম, ‘এসো—।’

আমাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় শুভর বাঁ-হাত যেন অসাবধানে ঘষে গেল আমার বুকে। আমার ঘাড়ের কাছে মুখ নামিয়ে ও জড়ানো গলায় বলল, ‘সুইট উইচ, আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ, লিলু।’

মনে পড়ে গেল, বিশ বছর আগে এক নির্বোধ অষ্টাদশী এই চারটে শব্দ শোনার জন্যে সমরখন্দ বোখারা দিয়ে দিতে পারত। দিতে পারত কেন, দিয়ে দিয়েছিল, আজ এই চারটে শব্দ চারটে লম্বা কালো শুঁয়োপোকার মতো আমার কানে কিলবিল করতে লাগল।

আমি সদর দরজা বন্ধ করে দিলাম।

শুভ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। বেপরোয়া আদর করতে লাগল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।

আমি কোনওরকমে ওকে ভেতরে শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলাম। নীচু গলায় বললাম, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই।’

শুভ এক ঝটকায় ওর শালটা ছুড়ে দিল একটা চেয়ারের ওপরে। পাঞ্জাবিটাও খুলে ফেলল মসৃণভাবে। ওর পরনে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা। শীতে গায়ে কাঁটা দিয়েছে।

ওর পাজামার দিকে লক্ষ করে বুঝলাম জ্বর বাড়ছে, থার্মোমিটারের পারা উঠছে।

বললাম, ‘তুমি একটুও পালটাওনি, শুভ…।’

‘আমি তোমার ক্রীতদাস, লিলু, তোমার দেখা পেয়ে অনেকগুলো পুরোনো ফুল ফুটে গেছে আমার পোড়ো বাগানে। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা, তুমিই আমার শেষ ভালোবাসা। সুস্মিতাকে কাটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আমি খুব সিরিয়াসলি ভাবছি।’

আমি তখন তৈরি করা ‘দ্রব্যটির’ কথা ভাবছিলাম। জিনিসটা বিছানার মাথার কাছে একটা টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম। আমি সেটার দিকে হাত বাড়াতেই শুভ আমাকে জড়িয়ে ধরল আবার। বলল, ‘আর্লি টু বেড…।’

আমি ওর বাঁধন ছাড়াতে-ছাড়াতে বললাম, ‘এক মিনিট, প্লিজ, একটা ছোট কাজ বাকি আছে।’

একটা কাচের বাড়িতে জিনিসটা রেখেছিলাম আমি। ঢাকা তুলে কাচের বাটিটা হাতে নিলাম। তারপর চোখ বুজে মন্ত্রপূত ডেলাটা মুখে পুরে নিলাম। কোনওরকমে চিবিয়ে সেটা গোগ্রাসে গিলতে চেষ্টা করলাম।

শুভ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘ওটা কী খাচ্ছ?’

আমি বললাম, ‘এটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এটা খেলে বাচ্চা হওয়ার ভয় থাকে না।’

‘লিলু, তুমি সত্যিই লাজবাব!’ উৎফুল্ল হয়ে বলল শুভ।

আমি বাটিটা রেখে দিয়ে টেবিল থেকে জলের জাগ তুলে নিলাম। ঢকঢক করে জল খেয়ে কোনওরকমে গিলে ফেললাম জিনিসটা। মুখের বিস্বাদ ভাবটা কিছুতেই পুরোপুরি গেল না।

শুভ আর দেরি করতে পারল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে শুরু করল। আমার বুকে মুখ ঘষতে-ঘষতে সেই চারটে শুঁয়োপোকা ছেড়ে দিল বারবার।

আমার তলপেটে চিনচিনে ব্যথাটা হঠাৎই শুরু হয়ে গেল। গা গুলিয়ে উঠতে লাগল। চোখের সামনে হাইস্পিড চলচ্চিত্র ঝিলিক মেরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আর একটা সতেরো-আঠেরোর মেয়ে উবু হয়ে বসে ওর শরীরের ভেতরকার শরীর নষ্ট করার চেষ্টা করছিল।

আমার শাড়ি-ব্লাউজ ইত্যাদি পেশাদার হাতে খুলে ফেলেছে শুভ। আমার নগ্ন শরীর দেখে ওর লালসাও যেন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়াল। ও বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আটতিরিশে এই ফিগার! লিলু, তুমি সত্যি, না স্বপ্ন?’

ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ থাকলেও আমার কেমন লজ্জা করছিল। তাই অনেক কসরত করে বেডসুইচ টিপে ঘরের আলোর নিভিয়ে দিলাম। শুভদীপের তীব্র শক্তি আমাকে কাত করে ফেলে দিল বিছানায়। ও নিজের বাকি পোশাক খুলে এলোমেলোভাবে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দিল।

এবং আমরা শুরু করলাম।

শুভ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। আমি ওকে চুমু খেলাম। ও পাগলের মতো আমাকে চটকাতে লাগল। আর বরাবর বলতে লাগল, ‘লিলু…লিলু…আমার লিলু…।’

বয়েস শুভদীপের আগ্রহ আর ক্ষমতাকে বিন্দুমাত্রও ভোঁতা করতে পারেনি। ওর তাড়াহুড়োয় আমার ব্যথা লাগছিল, কিন্তু সব সহ্য করলাম। ও ছন্দে নড়তে লাগল! আর আমি নিবিষ্ট মনে গুপ্ত মন্ত্র জপ করে চললাম।

বিড়বিড় করে আমার মন্ত্র আওড়ানো শুনে শুভদীপ একটু ভুল বুঝল। ও ভাবল, আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। তাই দ্বিগুণ উৎসাহে নিজের কেরামতির অহঙ্কারে আরও উদ্দাম হয়ে উঠল। খাটে ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ হতে লাগল।

একটু পরেই আমাকে আঁচড়েকামড়ে চিৎকার তুলে শুভদীপ খেলা শেষ করল। আমি কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে ওর চরম তৃপ্তির ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম ক্লান্ত শরীরে। শুভ কয়েকটা ভালোবাসার চুমু এঁকে দিল এখানে সেখানে। তারপর উঠে বাথরুমে গেলাম। একটু পরে ফিরে এসে শাড়ি-জামাকাপড় পরতে শুরু করলাম।

শুভ বিছানায় বসে সিগারেট টানছিল। আমাকে দেখে আবেগ মাখানো গলায় বলল, ‘লিলু, নতুন করে আবার শুরু করা যায় না?’

আমি বিশ বছরের পুরোনো বমির গন্ধ পেলাম। একমনে শাড়ির কুচি ঠিক করতে লাগলাম। ওর প্রশ্নের কোনও জবাব দিলাম না।

‘তোমাকে তো কতবার করে বলছি কুড়ি বছর আগে আমি…আমি ভুল করেছিলাম…অন্যায় করেছিলাম। কিছুতেই কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না, লিলু?’

আমি শুধু হাসলাম। সেই মুহূর্তে বিশ বছরের পুরোনো রক্তের গন্ধ পেলাম। মাংস চিরে যাওয়ার যন্ত্রণা টের পেলাম।

তৈরি হয়ে নিয়ে ঘরের টিউবলাইটটা জ্বেলে দিলাম।

শুভদীপের মুখ কেমন বিবর্ণ লাগছিল। ও বিছানা ছেড়ে উঠে চেয়ারে কাছে গেল। সিগারেটে শেষবারের মতো লম্বা টান দিয়ে ওটা ফেলার জায়গা খুঁজল। তারপর সেরকম কিছু খুঁজে না পেয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল। মেঝেতে ঘষে ওটা নেভাল। তারপর চেয়ার থেকে ওর শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘কাল কখন দেখা হচ্ছে?’

আমি কোনও জবাব না দিয়ে তাড়া দিলাম, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। মা এখুনি চলে আসবে।’

‘তোমার মায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে না?’

‘না। কারণ মা কে বলার মতো কোনও যোগ্য পরিচয় তোমার নেই। নাও, জলদি তৈরি হয়ে নাও।’

ও পোশাক পরে নিতে শুরু করল। তারপর আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল: ‘লিলু, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে আমি মরে যাব।’

আমি হেসে বললাম, ‘তাই? তা হলে ধরে নাও আর দেখা হবে না।’

শুভদীপ কয়েক মুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর রুক্ষভাবে বলল, ‘তা হলে আমাকে এভাবে ডাকলে কেন? শুলে কেন? নাকি তোমাকে শোওয়ার টাকা দিতে হবে?’

আমার হাসি পেল। পুরোনো জানোয়ারটা বিশ বছরের পথ ডিঙিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে।

ওর থুতনিতে হাত দিয়ে বাচ্চা ছেলেকে আদর করার মতো করে নেড়ে দিলাম। বললাম, ‘শুভ, লাখ টাকার প্রশ্ন করেছ তুমি। সত্যি, কেন যে তোমাকে আদর করে ডাকলাম, কেন যে শুলাম, তা যদি তুমি জানতে!’

আর কথা না বাড়িয়ে ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। যাওয়ার আগে ও নাছোড়বান্দার মতো বলল, ‘কাল তোমাকে ফোন করব—।’

আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। দরজার কাছের আঁধারি জায়গায় দাঁড়িয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলাম। আমি যা করেছি সেটা ঠিক, না ভুল? ন্যায় না অন্যায়?

বিশ বছর আগে ন্যায়-অন্যায়ের হিসেব কে কষেছিল?

আমার গা ঘিনঘিন করছিল। তাই গ্যাস-স্টোভে গরম জল চাপিয়ে দিলাম। এক্ষুনি স্নান করতে হবে।

সারাটা রাত আমি ঘুমোতে পারলাম না।

পাগলের মতো কাঁদলাম। খোলা জানলা দিয়ে শীতের রাত দেখলাম, আকাশের তারা দেখলাম। এলোমেলো গান গাইলাম। শুভকে যা-তা গালিগালাজ করলাম। বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক কষ্ট হতে লাগল। বারবার ভাবতে লাগলাম, যা করতে চলেছি তা উচিত হবে কি না।

ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে বাবার ঝুলন্ত মৃতদেহটা দুলতে লাগল। মায়ের বুকফাটা হাহাকার শুনতে পেলাম। আর শূন্য বয়েসে চলে যাওয়া খুদে দস্যিটা চিৎকার করে আমাকে চৌচির করে দিতে লাগল।

আমার চোখের জল জমাট বেঁধে বরফের কুচি হয়ে গেল। না, শুভদীপকে ক্ষমা করা যায় না।

এইভাবে দোলাচলের মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে গেল। তারপর আমি অনেকটা শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। শুভদীপ পরপর চারদিন আমাকে ফোন করেছিল, কিন্তু আমি ঠান্ডা গলায় ওকে একই কথা বলেছি। আর মনে করিয়ে দিয়েছি সুস্মিতার কথা। ও তাতে খেপে উঠেছে পাগলের মতো। তারপর থেকে আমাকে ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছে।

কিছুদিন পরেই বুঝলাম, ‘গুহ্যসূত্র’, ‘গর্ভপ্রবেশ’ ও ‘সৃষ্টিশাস্ত্র’-এর নির্দেশ ব্যর্থ হয়নি।

আরও দু-মাস যেতে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম।

আমার হিসেব অনুযায়ী চার মাস সতেরো দিন পর উপযুক্ত সময় এল। শরীরে সব ক’টা প্রয়োজনীয় লক্ষণই নজরে পড়ল আমার। তখনই কাজ শুরু করলাম। অসহ্য যন্ত্রণায় একটা গোটা রাত ছাগলের মতো ছটফট করলাম। ভীষণ জ্বর এল। রক্তপাতও হল। সকালবেলা রক্তমাখা কাপড় থেকে রক্তাক্ত সাতটা সুতো ছিঁড়ে নিলাম। সেগুলোকে পরিষ্কার একটা শিশিতে ছিপি এঁটে রেখে নিলাম। তারপর ব্যথা কমানোর দুটো ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে রইলাম বিছানায়।

আমার মধ্যে কিছু-কিছু পরিবর্তন মায়ের চোখ ধরা পড়েছিল। মায়ের চোখে নীরব প্রশ্ন থাকলেও মুখে কোনও নতুন কথা ছিল না। বিড়বিড় করে শুধু বলতে লাগল, ‘তুই সাবধানে থাকিস। নিজের যত্ন নিস।’

ন’-দশ দিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম। শরীরে, মনে, জোর ফিরে পেলাম। তখন কাশী মিত্তির ঘাটের শ্মশানে গিয়ে দু-চিমটে ছাই আর খানিকটা মাটি নিয়ে এলাম।

একদিন রাতে আমি পুতুলটা তৈরি করতে বসলাম।

মাটি আর ছাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম শিরীষের আঠা আর খানিকটা সিঁদুর। তারপর বেশ মনোযোগ দিয়ে পুতুলটা তৈরি করলাম। হাত-পা-মাথা…সব। চোখের জায়গায় দুটো লাল পুঁতি বসিয়ে দিলাম।

পুতুলটা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর রাতে স্নান সেরে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে উত্তরদিকে মুখ করে পদ্মাসনে বসলাম। পুতুলটা দু-হাতে ধরে একদৃষ্টে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হে অন্ধকারের রাজা, প্রেতসিদ্ধ সম্রাট, শক্তি দাও। এই জড় পদার্থে তোমার তীব্র ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করো, প্রাণ সঞ্চার করো। শত্রুকে নাশ করো, অনুগতকে রক্ষা করো।

সাদা সরষে, কালো মরিচ আর ঘি দিয়ে একটা মণ্ড তৈরি করে রেখেছিলাম। সেটাতে আগুন দিয়ে হোম শুরু করলাম। তারপর পাশে রাখা একটা রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে শত্রুনাশের মন্ত্র জপ করতে লাগলাম। পুতুলটা তখন আমার অন্য হাতে স্থির।

‘সর্ববাধা প্রশমনং ত্রৈলোক্যস্যাখিলেশ্বরী।

এবমেব ত্বয়া কার্য্যসম্পদ বৈরী বিনাশনম।।’

জপ শেষ হলে বাঁ-হাতের অনামিকার নখ দিয়ে পুতুলটার তলপেট লম্বালম্বিভাবে চিরে দিলাম। উঠে গিয়ে নিয়ে এলাম ছিপি আঁটা শিশিটা। একটা কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তমাখা সুতোগুলো বের করে নিলাম। ওগুলো গুঁজে দিলাম পুতুলটার তলপেটে। তারপর ভালো করে টিপে-টিপে চেরা জায়গাটা বন্ধ করে মসৃণ করে দিলাম। পুতুলটার তলপেটে আর কোনও ক্ষতচিহ্ন রইল না।

পরপর দু-দিন আমি উপোস করলাম। তৃতীয় দিনে আমার সরঞ্জামের তাক থেকে শালিঞ্চ গাছের শুকনো শেকড় বের করে নিলাম। সেটা গুঁড়ো করে আমার নগ্ন দেহে ছড়িয়ে দিলাম। সপ্তমুখী রুদ্রাক্ষের একটা ছোট্ট টুকরো জল দিয়ে গিলে ফেললাম। তারপর অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম। কারণ আজই সেই পবিত্র দিন। আজই শেষ হবে আমার কাজ।

সারাটা দিনে কতবার যে ঘড়ি দেখেছি মনে নেই! শেষে যখন রাত পৌনে বারোটা হল তখন ঘরের সব ক’টা জানলা খুলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

আজ শনিবার। পূর্ণিমার রাত। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ল অন্ধকার ঘরে, আমার নগ্ন দেহে, আর পুতুলটার ওপরে।

একটু পরে উঠে বসে একটা ছোট পিঁড়ি নিলাম। পুতুলটাকে তার ওপরে বসিয়ে তার তিন দিকে তিনটে মোমবাতি জ্বেলে দিলাম। তারপর একটা ছোট শিশি খুলে কয়েক ফোঁটা সুগন্ধি তেল ছিটিয়ে দিলাম পুতুলটার গায়ে। আর একটা ধূপকাঠি জ্বেলে দিলাম।

কপালে খানিকটা সিঁদুর আর কাজল মেখে আমি পুতুলটার সামনে ধ্যানস্থ হয়ে বসলাম। তারপর প্রার্থনা শুরু করলাম।

একটু পরেই আমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল। ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে কেউ যেন কাটাছেঁড়া করছে আমার ভেতরটা। নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করছে বারবার!

হে নিরাকার কৃষ্ণশক্তি! এসো, আমার মনস্কামনা পূর্ণ করো। রক্তের ঋণ শোধ হোক রক্ত দিয়ে। হে দেবী! তোমার ঘৃণা ও বিদ্বেষ থেকে আমাকে পরিত্রাণ করো। তোমার অনুগতকে আশীর্বাদ করো। শত্রুকে নাশ করো। হে নিরাকার অন্ধকারের রাজা! হে অন্ধকার তন্ত্রলোকের রানি! আমার মনোবাসনা পূর্ণ করো।

যন্ত্রণায় আমার তলপেট ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করলাম। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। কিন্তু আমার আকুল প্রার্থনা চলতেই লাগল। সেই সঙ্গে বিধি অনুযায়ী মন্ত্র উচ্চারণ।

সেই যন্ত্রণার মধ্যেই যেন দেখলাম, পুতুলটার হাত-পা নড়ে উঠল, কিলবিল করে উঠল।

হঠাৎই আমার শরীর এক বিচিত্র ক্লান্তি ও অবসাদে ছেয়ে গেল। ভীষণ ঘুম পেল আমার। আমি বিছানায় আবার শুয়ে পড়লাম। চাঁদের আলোয় আমার নগ্ন শরীর মাখামাখি হয়ে গেল।

তারপর ঘুমে আমার চোখ ঢুলে এল। সেই অবস্থাতেই দেখলাম, পুতুলটা যেন জীবন্ত হয়ে তীব্র লাল চোখে আমাকে দেখছে।

দিনের পর দিন যেতে লাগল। তলপেট ফুলে পুতুলটার রোগা-ভোগা চেহারা ক্রমে বেঢপ হয়ে উঠতে লাগল। একইসঙ্গে আমিও উলটোপালটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

স্বপ্নগুলো ধীরে-ধীরে দুঃস্বপ্নের চেহারা নিল। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে মন হাতড়ে শত চেষ্টাতেও সেগুলোকে আর খুঁজে পেলাম না। কোথা থেকে তিলতিল করে মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। অবাক হলেও সন্দেহটা মন থেকে ঠেলে সরাতে পারলাম না। ওটা ক্রমে গাঢ় হতে লাগল।

আমি কাজটা ঠিক করছি তো? সত্যিই কি রক্ত দিয়েই শোধ করতে হয় রক্তের ঋণ?

মনে পড়ছে, শুভদীপ কেঁদেছিল। আমার দু-হাত চেপে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল বারবার। ভুল শোধরাতে চেয়েছিল অনুনয়ের সুরে। সত্যিই কি বিশ বছর আগের ব্যাপারটা ওর আকস্মিক ভুল? কে জানে, বিশ বছরে ও হয়তো সত্যিই বদলে গেছে। মানুষ তো বদলায়। মানুষই তো বদলায়! আমিই হয়তো জেদের বশে একটা ভুল করতে চলেছি। নিষ্ঠুর ভুল। যে-ভুল একবার হয়ে গেলে আর শোধরানো যায় না।

সুতরাং চরম ভুল করে বসার আগে একবার খোঁজ করে দেখতেই হবে।

কার্ডে লেখা শুভদীপের ঠিকানা নিয়ে একদিন দুপুরে সোজা চলে গেলাম ওর যোধপুর পার্কের বাড়িতে।

বাড়িটা খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না।

ওর বাড়ি দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। বড়লোকের বাড়ি কাকে বলে!

তিনতলা বাড়ি, সঙ্গে ছোট একটুকরো বাগান। বাড়ির দেওয়ালের নানা জায়গায়-মার্বেল পাথরের ডিজাইন। ছাদে টিভি অ্যানটেনা আর হাওয়া-মোরগ।

আমার চোখে সানগ্লাস। মাথায় রঙিন ছাতা। পিচের রাস্তা দুপুরের রোদে জ্বলছে।

শুভ নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে নেই। অফিসে বা ফ্যাক্টরিতে গেছে। এই সুযোগে সুস্মিতার সঙ্গে একটু আলাপ করে নেওয়া যেতে পারে। তা হলেই বুঝতে পারব, শুভদীপ সত্যিই বদলে গেছে কি না।

বাড়ির কাছাকাছি গিলে লাল-সবুজ শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম। বছর পঁচিশ বয়েস। স্বাস্থ্য মন্দ নয়। রঙ কালোর দিকেই, তবে মুখ-চোখ ভালো।

মেয়েটির কানে রুপোর দুল, আর নাকে রুপোর নাকছাবি। শাড়ির আঁচল ডানকাঁধের ওপর দিয়ে পিঠে নেমেছে। দেখে কাজের লোক বলেই মনে হল।

ইশারা করে ডাকতেই মেয়েটি কাছে এল।

ওকে শুভদীপের কথা জিগ্যেস করলাম।

মেয়েটি হিন্দি মেশানো বাংলায় বলল যে, সাহেব বাড়ি নেই। ফ্যাক্টরিতে গেছে।

তখন আমি মেমসাহেবের কথা জিগ্যেস করলাম। বললাম, ‘আমি সুস্মিতাজীর দোস্ত। একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। শ্যামবাজারে থাকি—।’

মেয়েটির চোখে আচমকা জল এসে গেল। আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে নিয়ে বলল, ‘আপনি জানেন না, বড় মেমসাব খুদকুশি করেছে! এই তো করিব এক মাহিনা হল।’

আমি অবাক হয়ে গেলাম। খুদকুশি! আত্মহত্যা!

ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিলাম।

তারপর জিগ্যেস করলাম, ‘কেন, সুইসাইড করল কেন? এরকম ভালো স্বামী, যার এত পয়সা, শান-শওকত, সে কেন হঠৎ সুইসাইড করতে যাবে!’

তখন কাঁদতে-কাঁদতে মেয়েটি যা বলল তার সারাংশ এই:

সুস্মিতাজীর পতি মোটেই ভালো লোক নয়। বাড়িতে বসে সবসময় মদ খায়। উলটোপালটা আওরত ইয়ার-দোস্ত দিয়ে আসে। রোজ বিবির সঙ্গে হুজ্জুতি করত। অথচ বড় মেমসাহেবের পয়সাতেই তার এত বোলবোলা, দুটো বাড়ি, দুটো গাড়ি, ফ্যাক্টরি, অফিস—কী নেই! সুস্মিতাজীর মতো মালকিন হয় না— এত ভালো ছিল। লেকিন সবই তকদীর! অনেক সহ্য করেছিল, শেষ পর্যন্ত আর পারল না।

আমি ভেতরে-ভেতরে পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম। আর সেইসঙ্গে স্বস্তিও পাচ্ছিলাম। তা হলে ভুল আমার হয়নি!

ওকে জিগ্যেস করলাম, সুস্মিতাজী কীভাবে খুদকুশি করেছে।

মেয়েটি ভাঙা গলায় জানাল যে, বাথরুমে দরজা বন্ধ করে বড় মেমসাব তার হাত-পায়ের শিরা ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে। অনেক খুন বেরিয়েছিল। সাহেব তখন বাড়ি ছিল না। কোম্পানির কী একটা কাজে দিল্লি গিয়েছিল। চিৎকার চেঁচামেচি করে দরজা ভেঙে সবাই সুস্মিতাকে দেখতে পায়। থইথই রক্তের মধ্যে মেমসাব পড়ে ছিল।

ওঃ! সেই রক্ত! কিছুই তা হলে পালটায়নি! শুধু আমিই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু সুস্মিতার সুইসাইডের ব্যাপারটা শুভদীপ আমাকে ফোন করে জানাল না কেন! এটা তো ওর রাহুমুক্তির সুখবর! নাকি ওর কোনও মতলব ছিল? কয়েকমাস পর সব থিতিয়ে গেলে তারপর কি ও খবরটা আমাকে জানাবে? তারপর হ্যাংলার মতো আবার বলবে, ‘লিলু, নতুন করে সবকিছু আবার শুরু করা যায় না?’

না, সবকিছু আর শুরু করা যায় না। এখন শেষ করার সময়।

ওঃ! শুভ তা হলে সেই শুভই আছে! আগাপাস্তলা নিখুঁত জানোয়ার!

সুস্মিতার জন্যে আমার কান্না পেল। তলপেটে চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

মেয়েটিকে বললাম, ‘সাহেব বাড়ি ফিরলে এত সব কথা বলার দরকার নেই। শুধু বলবে, আমি খোঁজ করতে এসেছিলাম।’

‘আপনার নাম?’

‘বলবে শ্যামবাজারওয়ালি মেমসাব। তা হলেই তোমার সাহেব বুঝতে পারবেন।’

‘এখানে নওকরি করতে আমার আর মন লাগে না, দিদি…।’ মেয়েটি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল।

আমি ঠান্ডা সুরে জবাব দিলাম, ‘কে করতে বলেছে! ছেড়ে দাও চাকরি।’

শুভদীপের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পথে গনগনে রোদ্দুর আমার মাথায় যেন আগুন ধরিয়ে দিল। নাকে রক্তের আঁশটে গন্ধ পেলাম।

গন্ধটা বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমার নাকে লেগে রইল।

পরদিন সন্ধে নাগাদ শুভদীপকে ফোন করলাম আমি।

টেলিফোনে আমার গলা পেয়ে ও একেবারে উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

‘লিলু, কাল তুমি আমার বাড়িতে এসেছিলে?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ—।’

‘আমি ঠিকই আন্দাজ করেছি, তবে ভয়ে তোমাকে ফোন করিনি।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও আবার বলল, ‘লিলু, থ্যাঙ্ক গড যে তোমার রাগ পড়েছে। আমি হয়তো তোমাকে দু-এক সপ্তাহ পর ফোন করতাম।’

‘কেন, সুস্মিতা সুইসাইড করেছে এই খবরটা আরও থিতিয়ে গেলে তারপর আমাকে জানাতে?’ আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম।

‘ওঃ, লিলু! সবসময় তুমি এত মারমুখী হয়ে থাকো কেন বলো তো?’ গলায় সুর অন্তরঙ্গ করে ও বলল, ‘কবে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলো—খুব জরুরি কথাবার্তা আছে।’ কথা শেষ করার আগেই হেঁচকি তোলার মতো একটা শব্দ করল শুভ।

আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কী হল!’

‘ও কিছু নয়…।’ আবার সেই একইরকম শব্দ। তারপর: ‘কবে তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলো। অনেক জরুরি কথা আছে।’

‘আমারও তোমার সঙ্গে অনেক জরুরি কথা আছে। আজ রাত আটটার সময় তুমি আমার বাড়িতে আসবে?’

‘ন-না। তার চেয়ে বরং তুমি আমার বাড়িতে এসো।’ শুভদীপ কাহিল সুরে বলল, ‘আমার শরীর ভালো নেই।’

‘তোমারও তা হলে শরীর খারাপ হয়!’ আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, ‘আমার কথাটার ডাবল মিনিং আছে কিন্তু—।’

‘আঃ, লিলু, প্লিজ, ঠাট্টা কোরো না। আমার শরীরটা ভালো নেই। তুমি রাত আটটার চলে এসো। তুমি এলে কোনও প্রবলেম হবে না।’ দোতলার দক্ষিণ দিকটায় আমি থাকি।

আমি হাসলাম। বললাম, ‘প্রবলেম কী করে হবে! প্রবলেম তো সুইসাইড করেছে!’

হেঁচকি তোলার মতো শব্দ শোনা গেল আবার। শুভ বলল, লিলু, প্লিজ, রাত আটটায় এসো কিন্তু। এখন রাখছি—।’

রাত আটটায় ওর বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন প্রচণ্ড গুমোট কেটে গিয়ে বাতাস বইতে শুরু করেছে। ওদের বাগানের গাছের পাতা শব্দ করে এপাশ-ওপাশ দুলছে। আকাশে তারা ফুটেছে বটে, তবে চাঁদ খানিকটা মেঘে ঢাকা।

এক অচেনা বিষণ্ণতা ছেয়ে যাচ্ছিল আমার মনে। শুভদীপের ওপরে মনটা নরম হয়ে আসতে চাইছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল সুস্মিতার কথা, বিশ বছর আগেকার কথা, আর বেঢপ নগ্ন পুতুলটার কথা।

কলিংবেল বাজাতেই গতকালের শ্যামলা মেয়েটি দরজা খুলে দিল। আমাকে সানগ্লাস ছাড়া দেখেও ও সহজে চিনতে পারল। বলল, ‘বড়সাহেব দোতলার ঘরে আছে। সাহেবকে কাল বলেছি, আপনি এসেছিলেন।’

আমি হেসে ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম বাড়িতে। তারপর এগিয়ে গেলাম দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।

দক্ষিণ দিকের শেষ ঘরটায় শুভদীপ ছিল। বিছানায় কাত হয়ে বসে টিভি দেখছিল। আমাকে দেখেই রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে টিভি অফ করে দিল। সোজা হয়ে উঠে বসতে-বসতে ক্লিষ্ট হাসল। বলল, ‘আরে, এসো এসো…বোসো…।’

আমি টিভির প্লাগ পয়েন্টের সুইচটা অফ করে দিলাম। ঘরের ভেতরটায় একপলক চোখ বুলিয়ে নিলাম।

সর্বত্র বড়লোকী ছাপ। সবকিছুই সাজানো ফিটফাট।

আমি শুভদীপকে খুঁটিয়ে দেখলাম। প্রায় পাঁচ মাস পর ওকে আমি দেখছি। এর মধ্যে ও তেমন কিছু একটা পালটায়নি। অন্তত ওর বাইরেটা পালটায়নি।

কিন্তু ওর ভেতরটা যে পালটে যাচ্ছে সে-খবর আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!

আমি একটা শৌখিন মোড়া টেনে নিয়ে ওর বিছানার কাছে বসলাম। ওর মুখে ক্লান্তি শ্রান্তির পাণ্ডুর ছাপ।

‘শুভ, তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলার আছে—।’

শুভ হেসে বলল, ‘তোমার মাত্র কয়েকটা কথা বলার আছে? আর আমার তোমাকে অনেক কথা বলার আছে।’

কথা শেষ করেই ও হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করল। জোর করে ঢোক গিলে গলা দিয়ে উঠে আসা কোনও জিনিসকে রুখে দিল।

‘শুভ, আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো—।’

ও আমাকে প্রায় বাধা দিয়ে বলল, ‘ভাবতেই পারছি না, তুমি আমার বাড়িতে এসে আমার বেডরুমে বসে গল্প করছ!’

ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘আরও অনেক কিছুই তুমি ভাবতে পারবে না।’

হঠাৎই ও পেট খামচে ধরল। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। তারপর আমার দিকে একটু মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি ঘরে বসেই ওর বমি করার শব্দ শুনতে পেলাম।

একটু পরেই ও মুখ-টুখ ধুয়ে ফিরে এল। ক্লান্ত পা ফেলে বিছানায় গিয়ে বসল।

‘কী, তোমার শরীর খারাপ না কি?’

‘হ্যাঁ, কয়েক মাস ধরেই এরকম হঠাৎ-হঠাৎ পেট ব্যথা করছে, বমি পাচ্ছে, গা গুলোচ্ছে। একটু পরেই আবার সব ঠিকঠাক । কী যে হয়েছে কিছু বুঝতেই পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। বলছে, কিছু হয়নি। হয়তো নতুন টাইপের কোনও ভাইরাল ইনফেকশান। কয়েকটা ট্যাবলেট দিয়েছে, কিন্তু তাতে…।’

বুঝলাম, কাজ শুরু হয়েছে। আর কেউ এই শরীর খারাপের রহস্য বুঝতে পারবে না।

আমি নিষ্ঠুর হেসে বললাম, ‘ডাক্তার দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। তোমার কী হয়েছে আমি বলে দিচ্ছি।’

শুভ যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে অবাক চোখে আমাকে দেখল: ‘তুমি আমাকে ভালো করে দাও, লিলু।’

‘এখন ভগবানও তোমাকে ভালো করতে পারবে না। শোনো, শুভ, কাল আমি এ-বাড়িতে এসেছিলাম। সুস্মিতার কথা সব শুনেছি।’

‘কে বলেছে? আশা?’

‘আশা কি ভালোবাসা, কী নাম আমি জানি না—তবে তোমাদের কাজের মেয়েটিই সব বলেছে।’

শুভদীপ বিরক্ত হয়ে চাপা গলায় বলে উঠল, ‘সুস্মিতা নিজের দোষে মরেছে। ওর মাথার দোষ ছিল।’

‘হ্যাঁ, মাথার দোষ তো ছিলই, নইলে তোমার মতো পাবলিককে বিয়ে করে! যাকগে, এবার জরুরি কথাগুলো শোনো—।’

ওকে মন্ত্রতন্ত্রের ব্যাপারগুলো খুলে বললাম।

শুভদীপ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল: ‘লিলু, আমার কাছে উইচও যা, স্যান্ডউইচও তাই। তুমি ঠাট্টা করছ।’

‘না, একটুও ঠাট্টা করছি না। তোমাকে তো আগেও বলেছি, আমি কী করে দিন চালাই। আর আমার বাড়িতে গিয়ে তুমি তুকতাকের জিনিসপত্রও দেখেছ—।’

শুভ ওর তলপেটে হাত বোলাতে লাগল। একটা বালিশ কোলে টেনে নিয়ে আরাম করে বসতে চাইল।

ওকে বললাম, ‘শুয়ে পড়ো, তা হলে আরাম পাবে।’

ও কী ভেবে সত্যিই খাটের মাথার দিকটায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক ঠেলে।

তখন ওকে পুতুলটার কথা বললাম।

ও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

নিস্তব্ধতা আমাদের ডুবিয়ে দিল।

তারপর ও হঠাৎ উঠে বসে একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘তুকতাক, মারণ, উচাটন—তন্ত্রমন্ত্র! হুঁঃ! এসব বুজরুকি যারা বিশ্বাস করে তারাই ওতে ভয় পায়। আমি ওসবে বিশ্বাস করি না।’

আচমকা ওয়াক তুলল শুভদীপ। মুখ কুঁচকে গেল ওর। জোর করে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল।

‘কিন্তু আমি ওসবে বিশ্বাস করি, শুভ। আর অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস করাই। ক’-মাস ধরে তোমার গা-বমি, পেট ব্যথা, গা-ব্যথা, সব কি মিথ্যে? অবশ্য পুতুলটার কথা তখন তুমি জানতে না।’

‘ওসব কাকতালীয় ব্যাপার।’ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ও বলল।

আমি মোড়া থেকে উঠে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। ওর একটা হাত ধরলাম। নরম গলায় বললাম, ‘শুভ, আজ শুধু তোমাকে সত্যি কথাই বলব। আর ক’-দিন পরেই এসব তন্ত্রমন্ত্রে তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। কারণ, বাচ্চাটা তখন নড়বে-চড়বে, হাত-পা ছুড়বে—তুমি নিশ্চয়ই টের পাবে।’

এক ঝটকায় আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিল শুভ। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে গুঁজে দিল অ্যাশট্রেতে।

এমন সময় আশা আমার জন্যে জলখাবারের ট্রে নিয়ে এল। একটা টি-টেবিলে মিষ্টির প্লেট, চা-বিস্কুট ইত্যাদি সাজিয়ে দিয়ে ও চলে গেল।

ও চলে যেতেই শুভদীপ চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমার ওসব নোংরা কথা আমি শুনতে চাই না। আমার গা ঘিনঘিন করছে। তুমি চটপট এগুলো খেয়ে চলে যাও…প্লিজ…।’

আমি টেবিলের কাছে গিয়ে একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। সেটা খেতে-খেতে হাসলাম, বললাম, ‘বিশ বছর আগে আমিও ঠিক এইরকম হাত-পা ছোড়া নড়াচড়া টের পেয়েছিলাম। দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ, বাচ্চার বদলে…।’

‘তুমি এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরোও! এই মুহূর্তে।’ রাগে অন্ধ হয়ে চিৎকার করে উঠল শুভ। ও বিছানা থেকে নেমে এক পা এগিয়ে এল আমার দিকে।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘আর এগিয়ো না। আমাকে সুস্মিতা পাওনি। একটু বেচাল দেখলেই তোমার হাল আরও খারাপ করে ছাড়ব।’

বেশ বুঝতে পারছিলাম, শুভদীপের চোখ ওর দেখা লীলাকে আর একটুও চিনতে পারছিল না।

‘তুমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাও!’ হুমকি দিয়ে বলল ও।

‘হ্যাঁ, যাব। এ সময়ে তোমার বিশ্রাম দরকার।’

‘আউট! কোনও কথা আমি শুনতে চাই না! আউট!’ আঙুল তুলে ও দরজা দেখিয়ে দিল আমাকে।

আর-একটা মিষ্টি নিয়ে মুখে দিলাম আমি। আজ তো মিষ্টিমুখ করারই দিন!

লক্ষ করলাম, শুভর চুল এলোমেলো, দু-চোখে ভয়।

আমি দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। পুতুলটার সব কথা ওকে বলা দরকার।

‘একটা কথা তোমাকে এখনও বলিনি—।’

‘তুমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।’

‘চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই, শুভ। শোনো। পুতুলটা হচ্ছে অনেকটা অর্ধনারীশ্বর। ওটার ওপরের পোরশানটা মেয়ে, আর নীচের পোরশানটা ছেলে—।’

শুভ বিভ্রান্ত নজরে দেখতে লাগল আমাকে। আমার কথা ও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি।

‘পুতুলটার পক্ষে মা হওয়া কী কষ্টের এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। ঠিক একইরকম কষ্ট তোমারও হবে।’

শুভদীপ থম মেরে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যাপারটা এখনও ওর কাছে বোধহয় স্পষ্ট হয়নি। পরে বুঝবে। দশ মাস দশ দিন যখন পূর্ণ হবে।

ওকে একটা চুমু ছুড়ে দিয়ে বিদায় নিলাম।

ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমার পা কাঁপছিল, মাথা টলে যেতে চাইছিল।

জ্বালাধরা চোখ নিয়ে আমি স্মৃতিকণাকে দেখতে পেলাম। আমার পাশে-পাশে নাচতে-নাচতে চলেছে। তীব্র উল্লাসের নাচ।

শুনতে পেলাম, বাবা কপাল চাপড়ে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে।

মা জলভরা চোখে আমার সামনে এসে ভর্ৎসনার সুরে বলল, ‘লীলা, এ তুই কী করলি!’

আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, ‘বেশ করেছি! এতদিনে বিশ বছরের ঋণ শোধ হল।’

অন্ধকার পিচের রাস্তা থেকে তাপ উঠছিল। বাড়ি ফিরে আমাকে স্নান করতে হবে।

এমন সময় পেছন থেকে শুভদীপের বুক-ফাটা চিৎকার শুতে পেলাম—যন্ত্রণা আর আতঙ্কের চিৎকার। সে-চিৎকারে বুক কেঁপে ওঠে।

হঠাৎই মনে হল, চিৎকারটা বোধহয় আমার কল্পনা।

কারণ, এখনও তো দশ মাস দশ দিন হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *