আঁদ্রে জিদ

আঁদ্রে জিদ

দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে প্যারিস যায়, এবং প্যারিসের ধনীদরিদ্র সকলেরই কামনা, কী করে গ্রামাঞ্চলে একখানা কুটিরাবাস নির্মাণ করা যায়। প্যারিসের ফ্ল্যাটখানাও থাকবে এবং সেখানে মাঝে-মধ্যে আসবেন থিয়েটার অপেরা দেখবার জন্য, বন্ধুজনের (বান্ধবী তো নিশ্চয়ই) সঙ্গে মিলিত হবার জন্য।

খাঁটি স্ট্যাটিস্টিক্স দেওয়া কঠিন– বক্তিগতভাবে বলতে পারি, যে ক-জন মহৎ ফরাসি লেখক আমার প্রিয় তাদের প্রায় সকলেই জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন মফস্বলে। যারা নিতান্তই কোনও না কোনও কারণে পেরে ওঠেননি– যেমন আলফাস দোদে– তাঁরা সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গ্রামাঞ্চলে, কোনও সখার বাড়িতে।

প্রভাঁসের যে জায়গাটিতে দোদে বারবার গেছেন সেখানে দিন পাঁচেক কাটানোর পর এক অপরা বসে আছি, যে ইটিতে উঠেছিলুম (এসব ই এমনই গাইয়া যে এগুলো না হোটেল, না ডাক-বাঙলো, না সরাই, না চটি– সবকটিরই অল্প-বিস্তর সুবিধে-অসুবিধে দুই-ই এগুলোতে পাবেন। তারই জানালার কাছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। ঢেউখেলানো উঁচু-নিচুর টক্করে ভর্তি জনপদ ধরিত্রীর দূরত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দেয় আপন দৃষ্টি যে কত দূরান্তে যেতে পারে সে সম্বন্ধে মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং আশ্চর্য, সমুদ্র যদ্যপি দিগন্ত বিস্তৃত তার পারে বসে মানুষের এ অভিজ্ঞতা হয় না।

ইনকিপার, পত্র (Patron), মালিক– যে নামে খুশি ডাকুন–কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি প্রসন্ন বদনে বললুম এ বাঁ, আল– এ শব্দগুলোর মানে অভিধানে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, যেমন এই যে, হেঁ হেঁ বেশ বেশ– শব্দগুলো নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মানে ধরে কিন্তু আসলে এগুলো ফারসি ভাষাতে যাকে বলে তাকিয়া-ই-কালাস অর্থাৎ কথার তাকিয়া অর্থাৎ যার উপর ভর করে কথাবার্তা আরাম পায়– জমে ওঠে।

তার পর বললুম, বসবে না? একটা কিছু খাও।

বলল, এ বাঁ, আমি আপনাকে দেরাজ (ডিসএরেঞ্জ শব্দার্থে অর্থাৎ ডিসটার্ব বা বদার) করছি না তো?

আমি প্রসন্নতর বদনে বললন, পা দ্য তু– বিলকুল না!

বলল, মসিয়ো, আমি আদৌ নোজি না। বিশেষত যখন দেখতে পাচ্ছি, আপনি যখন আপন মনে, মনের সুখে আছেন। ও লা লা–কাল সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডাটি যা জমেছিল। আর আপনি যা হাসাতে পারেন

একদম গুল। হাসাতে পারার মতো তেমন কোনও স্টা আমার নেই। আসলে ব্যাপারখানা হয়েছিল এই যে, আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কতকগুলি গল্প, গোপালভাড় ইত্যাদি আমি তাদের শুনিয়েছিলুম আপন ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে। তাদের কাছে লেগেছে এপাতা (ভয়ঙ্কর মজাদার) এবং অরিজিনাল। অবশ্য এসব গল্প যখন প্যারিস-লন্ডনেই পৌঁছয়নি তখন প্রভাঁসের পা-বর্জিত অজপাড়াগায়ে যে অরিজিনাল মনে হবে তাতে আর বিচিত্র কী? গোপালের দু-একটি রিসৃকে (risky আদিরসাত্মক) গল্প বলতেও ছাড়িনি, এবং তখন গাঁয়ের পাদ্রি সাহেবই এবং তিনিই ছিলেন আসরের চক্রবর্তী সবচেয়ে বেশি চোখের ঠার মেরে আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

বললেন, মসিয়ো, আমাদের গ্রামে কজন বিদেশি এসেছে সে আমি এক আঙুলে বলতে পারি- তা-ও তারা পাশের দেশ স্পেন বা ইতালির বাউণ্ডুলে– আর আপনি তো এসেছেন কোথায় সেই সুদূর লাদ (L Inde) থেকে। এখানে আপনি কী মধু পেলেন, বলুন তো!

আমি বললুম, তুমি তো বলেছিলে, তুমি কখনও প্যারিস ত দেখোনি। তোমাকে বোঝানো হবে শক্ত। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি, এটা অনেকটা রুচির কথা। আপন দেশেও আমি গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে, বাস করতে ভালোবাসি। তা ছাড়া এটা কবি মিসালের দেশ।… আচ্ছা, অন্য লোক আসে না এখানে মিসত্রালের জন্মভূমি দেখতে?

বেশ গর্বভরে বলল, নিশ্চয়ই, মসিয়য়া, তবে তারা সবাই ফরাসি–

তার পর কী যেন মনে পড়ে যাওয়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে এবারে সে উৎসাহভরে বলল, ও লা লা। সে এক কাণ্ড!

দুই লেখকের লড়াই। সে হল গিয়ে ১৯৪৪-এর শেষের দিকের কথা। মার্কিনিংরেজ নরমাদিতে নেমে প্রায় সমস্ত ফ্রান্স দখল করে ফেলেছে, ওই সময় কী কারণে, কী করে যেন দুই লেখক–হ্যাঁ খাঁটি ফরাসি–এসে উঠেছেন আমার এখানে। আর এই ঘরেই, আমরা কাল যেখানে দুপুররাত অবধি কত আনন্দে হইহুল্লোড় করলুম, এসে বসেছেন, সেই দুই লেখক; কিন্তু তাঁরা তাঁদের চতুর্দিকে যে আবহাওয়া নির্মাণ করলেন সেটি ঠিক তার উল্টো। অ্যাব্বড়া বড়া গেরেমভারি হাঁড়িপানা গম্ভীর একজোড়া মুখ দেখে আমার গাইয়া খদ্দেররা তো আশ্রয় নিল ঘরের অন্য কোণে।

ওঁরা গুরুগম্ভীর আলোচনা করে যাচ্ছেন নিজেদের ভিতর– আমরা ওদিকে কান দিইনি। কিছুক্ষণ পরে তাদের গলা চড়তে লাগল, তার পর আরম্ভ হল রীতিমতো ঝগড়া। তার পর আরম্ভ হল আমাদের ওই পাহাড়ি বকরিতে করিতে যেরকম লড়াই হয়।(১) তার পর বলদে বলদে। অবশ্য আমাদের বলদ প্রতিবেশী স্প্যানিশদের বলদের তুলনায় তেমন কিছু না।(২)

কী নিয়ে ঝগড়া, মসিয়য়া? জান কী নিয়ে–ঘুড়ি নিয়ে? তা হলেও তো বাঁচতুম। সে তো হর-হামেশাই হচ্ছে। এ ঝগড়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস নিয়ে। বলি :

ওই সময় অর্থাৎ তখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি, অবশ্য হিটলারের পরাজয় সম্বন্ধে তখন সবাই নিঃসন্দেহ– এক ফরাসি লেখক লিখেছেন, এই যে আমরা, ফরাসিরা পাত্রি(স্বদেশ), পাত্রি, লিবেরতে লিবেরতে বলে চেঁচাই তার মূল্য কতটুকু? তিনি নাকি, তার পর লিখেছেন, ফরাসি চাষা যদি তার গম দু পয়সা বেশি দামে বিক্রি করতে পারে তবে সে থোড়াই পরোয়া করে দেকার্ত আপন জাতভাই ফরাসি না দুশমন জরমন।

এই নিয়ে লেগেছে তুলকালাম ঝগড়া! এক লেখক বলছেন, যারা ফরাসি জাতের দেশপ্রেম নিয়ে এরকম বিদ্রূপ করে তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত। অন্য লেখক বলছেন, কথাটা টক হলেও হক। এবং যে ফরাসি লেখক একথা বলেছেন তিনি তো জর্মন বা তাদের দোস্ত পেতাঁর সহযোগিতা করতে রাজি হননি। তাঁর সততা সম্বন্ধে যারা সন্দেহ করে তাদের হওয়া উচিত ফাঁসি। তখন প্রথম জন বললেন, আজ যদি আমাদের ক্লেমাসে বেঁচে থাকতেন তবে ওই যে ব্যাটা ফরাসির দেশপ্রেম নিয়ে মশকরা করেছে তাকে তার নোংরা বন্দুকটা দিয়ে পরিষ্কারটা দিয়ে নয়, যেটা দিয়ে তিনি বুনো শূয়ার মারেন– গুলি করে মারতেন।

এতক্ষণ মালিক ভায়া যে গম্ভীর সুরে কথা বলছিলেন, তার থেকে আমার মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং ক্রেমাসেই লিগ অব নেশনসে প্রতিবেদন পাঠ করছেন।

এবারে হঠাৎ হেসে উঠে বলল, তার পর যা হল, মসিয়য়া, সে সত্যি যাকে বলে কু দ্য তেয়াৎর(৩)-নাটকীয় ব্যাপার–ইতোমধ্যেই যে আমাদের পাদ্রি সাহেব কখন এখানে এসে এক কোণে দাঁড়িয়ে এঁদের তর্কাতর্কি শুনছিলেন সেটা আমি লক্ষই করিনি।

তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, মেসিয়ো, আমি আপনাদের দোজ করতে চাই নে; সামান্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আপন পথে চলে যাব। আপনারা শহুরে সজ্জন শুনেছি, আপনারা বঁ দিয়োর (ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আমার শুধু বক্তব্য, আপনাদের একজন বলছিলেন, আজ ক্লেমাসে বেঁচে থাকলে তিনি নাকি কাকে যেন গুলি করে মারতেন। এ-ভভাওয়ালা, মেসিয়ো– আজই সন্ধ্যায় এই কাগজখানা আমার কাছে এসেছে আমাদের কলোনি ট্যুনিস থেকে। তাতে প্রকাশিত হয়েছে একখানি চিঠি। ইটি লিখেছেন মসিয়ো ক্রেমাসের ভ্রাতুস্পুত্রী তার বয়স, এখন চুরাশি। তিনি লিখেছেন–শের মসিয়ো জিদ, আমি আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বহু বছর বাস করেছি। আমি বলতে পারি, আজ তিনি বেঁচে থাকলে আপনার পক্ষ নিতেন। তাঁকে কতবার বলতে শুনেছি, জমি! জমি!! শুধু জমি!! আর টাকা। ব্যস, মাত্র এ দুটো বই আমাদের চাষিরা চেনে!

পাদ্রি সায়েব বললেন, তা সে যাক! কিন্তু এটা কী বঁ দিয়োর মিরাকল নয় যে, আজই আমি এ কাগজখানা পাব, আজই আপনারা এ আলোচনা তুলবেন, আজই আমি সেই পত্রিকাটি পকেটে করে আজই এখানে আসব এবং আপনাদের দ্বন্দ্বের সমাধান করে দেব!…ও রভোয়া মসিয়ো! কাল রোববার গির্জেয় দেখা হবে।

কাহিনীটি শেষ করে মালিক মিটমিটিয়ে হেসে বলল, এই যে বিরাট ফ্রান্সভূমি– এদেশের কারও বিশ্বাস, প্রভাঁসের লোক বড় সরল, বিশ্বাসী, ধর্মপ্রাণ আর কারও-বা বিশ্বাস তারা কুসংস্কার কুণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।… আপনার কী মনে হয়? আপনি তো এসেছেন ধর্মের দেশ LInde থেকে।

আমি তার মিটমিটে হাসি থেকে তারই বিশ্বাস কোন দিকে বুঝতে পারলুম না।(৪)

———–

১. প্রভাঁসের বকরি সম্বন্ধে লিখেছেন দোদে– Le Chevre de M. Seguin.

২. এ-ও পাঠক পাবেন পুস্তকে।

৩. Coup detat, cout de palais তুলনীয়। আজকাল পৃথিবীর সর্বত্র নানারকম কু (অনেক সময়ই কিন্তু সেগুলো শিব্রামীয় সু!) হচ্ছে বলে এটা উল্লেখ করলুম।

৪. আঁদ্রে জি-এর ডাইরি, Journal 1939-42, 1942-42, Appendice, 200ff.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *