আঁতোয়ান সুকের ডায়েরি

আঁতোয়ান সুকের ডায়েরি

এতখানি বুড়িয়ে গেছে বাড়িটা অ্যাদ্দিনে? কীরকম, কীরকম শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেছে কি? ‘১৯’ লেখা নীল-সাদা এনামেলের সাইনটাই বা কোথায় গেল? ফ্ল্যাটের দরজার সামনের স্পেসটাতেও কেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজার গায়ে কলিং বেল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অরুণ অগত্যা ঠক ঠক করে আওয়াজ করল দরজায়। তারপর দরজা থেকে একটু পিছিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে।

কিন্তু কোথায় কে? দরজা খোলা দূরে থাক ভেতরে কোনো গলা বা নড়াচড়ার আওয়াজও নেই। ডরোথি কিন্তু ফোনে বলেছিল, আই উইল ওয়েট ফর ইউ ফ্রম সিক্স। আর এখন তো প্রায় সাড়ে ছটা।

অরুণ ফের এগিয়ে নক করল দু-বার। একটু থেমে আরও দু-বার, শেষের বারটা একটু ধাক্কার চালে। অমনি কোঁ কোঁ ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অরুণ দেখল কমলা রঙের সিল্কের শেডের হল ল্যাম্পের আলোয় মনোরম এক আলস্যের মধ্যে শুয়ে আছে ডরোথির বসার ঘর।

দু-পা ভেতরে ঢুকে অরুণ দেখল ঘরে কেউ নেই। এক মলিন, ধ্বস্ত চেহারা ঘরের। পোড়া সিগারেটের গন্ধে ম ম করছে। রেডিয়োগ্রামে একটা রেকর্ড চাপানো আছে সেই কবে থেকে কে জানে। সে রেকর্ডেও ধুলো পড়েছে। ডালাটা হাঁ করে খোলা।

অরুণের চোখ গেল কোণের ভেঙে পড়া রেকর্ডের তাকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে গুনগুনোতে লাগল ছেলেবেলার এই ঘরে বসেই শোনা সেই সব গান, সেই সব কণ্ঠ। ন্যাট কিং কোল, বিং ক্রসবি, ফ্রাঙ্ক সিনাট্রা, এলভিস প্রিসলে, পল অ্যাঙ্কা, জিম রিভস, প্যাট বুন…

সব রেকর্ডেই ধুলোর জামা, মেঝের লাল কার্পেটে ঝাঁট পড়েনি বহুকাল। অরুণ দেওয়ালে সুইচ খুঁজে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে একটা সোফায় বসল। কিন্তু বসার জায়গা করতে সোফা থেকে একটা এলপি ডিস্ক সরিয়ে পাশে রাখতে হল। ডিস্কটা তুলতে তার কভারে দেখল হাসি-হাসি মুখের ইভ মত; পাশে ঝাপসা হয়ে আসা কলমের আঁচড়—’টু ডিয়ারেস্ট ডর, উইথ আ কিস–টোনি।

কোনো তারিখ নেই বলে ভাবতে বসল ঠিক কবেকার উপহার হতে পারে রেকর্ডটা। মনের মধ্যে বছরগুলো কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। এটা..এটা কি তাহলে ডরোথিকে দেওয়া আঁতোয়ান সুকের শেষ উপহার?

ডিস্কটা বাজাবার একটা চাড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু অরুণের এই ধারণাও ছিল যে, ধূলিধূসর ওই রেডিয়োগ্রাম থেকে আর কোনোদিনও কোনো ধ্বনি ফুটবে না। রেকর্ডটা পাশের সাইডটেবিলে শোয়াতে গিয়ে ওর চোখ পড়ল পাঁচ-পাঁচটা লাল রেক্সিন বাঁধাই সুকের সেই ডায়েরি। যার জন্য অরুণের এই আসা, ডরোথির এই আমন্ত্রণ। ঈশ্বর জানেন কী হিরেমানিক আছে ওর মধ্যে, কিন্তু ছেলেবেলায় সুকের কলমে রোজ একটু একটু করে জিনিসটাকে ফলে উঠতে দেখেছে ও। সেদিন ফোনে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলেছিল ডরোথি—এটা শুধু টোনির একার কথা নয়। এতে আমরা সব্বাই—আমি, তুমি, লোরেন, মার্নি, রিটা, ডুলু, মাম্পু সবাই আছি। ইটস লাইক আ হিউজ লাভলেটার। সত্যি একটা প্রেমের চিঠি। তোমায় পড়তেই হবে এটা, অরু। আর তারপর, তুমি তো লেখক, একটা লাভ স্টোরি লিখো আমাদের নিয়ে।

অরুণ বলেছিল, কিন্তু সেই প্রেমের গল্পটা তো খুব করুণই হবে, ডরোথি।

হোক না।–ওপার থেকে গলা ভেসে এসেছিল মহিলার। সব সত্যিকারের প্রেমের গল্প চোখের জলে শেষ হয়। তুমি লেখক, তুমি জান না চোখের জল কত মিষ্টি হয় যদি সেভাবে কাঁদতে পার?

ঠিক আছে, আমি আসব বলে ফোন নামিয়ে রেখেছিল অরুণ। আর এখন সেই ডায়েরিগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ও ভাবতে বসল, সত্যিই তো! এইসব ডায়েরি ও কোন কাজে লাগাতে পারবে। কয়েকটা প্রবন্ধ? হারিয়ে যাওয়া অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের সমাজচিত্র? লেট-ফিফটিজ আর আর্লি-সিক্সটিজের একটু কলকাতা? হারিয়ে যাওয়া মিন্টো রো, মিন্টো লেন? নাকি অদ্ভুতচরিত্র অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পুরুষের মনের আগড়াম-বাগড়াম?

অরুণ আনমনে একদম ওপরের ডায়েরিটা তুলে নিয়ে, সে জায়গায় ইভ মত-র রেকর্ডটা রেখে ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগল। লম্বা-চওড়া ডায়েরির পাতায় সুকের হাতের লেখার স্মৃতি ওর একেবারে মুছে যায়নি, ওর মনে আছে সুকের বেশ মুশকিল হত পল্লির বাঙালিদের নামের বাংলা বানান লিখতে। একবার অরুণকেই জিজ্ঞেস করেছিল, অরু, হাউ ডু ইউ স্পেল ইয়োর নেম?

O-r-o-o-n অর O-r-u-n? অরুণ তখন বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিল, কোনোটাই না। ওটা A-r-u-n। আর যখন অরু লিখবে লিখো A-r-u, ক্লিয়ার?

কথাটা মনে পড়তে অরুণের একটু হাসি পেল। হঠাৎ পাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল— হাসছ? এনিথিং ফানি?

অরুণ চমকে উঠে ওপরে চাইতে দেখল আলো-আঁধারির মধ্যে একটা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ডরোথি। বলিরেখায় বলিরেখায় সুন্দর মুখটা কাহিল হয়ে আছে। কাঁচার সঙ্গে পাকা মিশে কেমন ধূসর একটা বর্ণ হয়েছে কোঁকড়া চুলে। গায়ের হালকা নীল গাউনটারও বয়স হয়েছে। পায়ের কার্পেট স্লিপারটার তো এখনই অবসর নেওয়া উচিত। শুধু এই বয়সেও এই চেহারাতেও ডরোথির সেই রুপোলি হাসি-সুকের ভাষায় ডর’স সিলভার স্মাইল এখনও যে-কে-সেই।

অরুণ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ডরোথি, তুমি আজও এত সুন্দর হাসতে পার? তারপর এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরে বলল, কত বছর হল বলো তো?

ডরোথি অরুণকে আপাদমস্তক নজর করে কীরকম স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করল, তুমিও কত বড়ো হয়ে গেলে অরু?

অরুণ একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে লাগল সেইসব দিনগুলোর কথা যখন এক তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের মতো এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটি মিন্টো রো দিয়ে হেঁটে যেত সারাপাড়াকে স্তব্ধ করে। ও রাস্তার মোড় বাঁকলে হয়তো ফের গুঞ্জন শুরু হত ওকে নিয়ে, কিন্তু যতক্ষণ ও দৃষ্টির মধ্যে ততক্ষণ মানুষ কীরকম নির্বাক।

সিঁড়ি, বারান্দা বা ছাদ থেকে ডরোথিকে দেখলে ওই বালকবয়সেও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যেত অরুণও। সেই দৃশ্য আজও ভোলার নয়। ভোলার নয় আঁতোয়ান সুকের শেষ চলে যাওয়ার দৃশ্যটাও। গ্রীষ্মের মাঝদুপুরে, কাঠফাটা রোদুরে একটা ট্যাক্সির ডিকিতে সুক এক এক করে দুটো সুটকেস তুলল; কী মনে করে রাস্তার এপ্রান্তে ওপ্রান্তে দু-বার চোখ চালাল, পকেট থেকে বার করে একটা চারমিনার ধরাল, তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটটার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল, শেষে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কী একটা বলে পিছনের সিটে গা এলিয়ে বসল।

আসলে ডরোথিকে দেখবে বলেই এই বিশ্রী গরমেও ছাদে এসে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ভাগ্যিস ওদের বাড়ির গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা লম্বা বেনেবাড়িটা, যার লম্বা ছায়াতে ওদের ছাদ এখন রোদ থেকে গা বাঁচাচ্ছে! একটা নিরাপদ দূরত্ব আর ছায়া থেকে সারাপাড়ার চেহারা দেখে দেখে লম্বা দুপুর কেটে যায় অরুর। মিসেস স্মিথ, মিসেস হোয়াইট ও মিসেস সালদানা-র কেক-প্যাটিজের পেল্লায় বাক্স নিয়ে ফেরিওয়ালা হাঁক দিলে ডরোথি গোটা একটা থালা হাতে বেরিয়ে আসে, কখনো-সখনো সঙ্গে সুকও। তখন ছাদ থেকে অরু হাঁক তোলে—আমিও আছি, ডর।

কেক-প্যাটিজ তো বটেই, ছাদে দাঁড়ানোর বড়ো টান ডরোথির নিজেরও। ওকে দেখেও চোখের আশ মেটে না। চন্দন বলছিল সেদিন, এ তেষ্টাটা তোর চোখের নয়, মনের। সেটা বুঝিস তুই?

সুকের ট্যাক্সি মৌলালির বাঁকে উধাও হতেই খালি পায়ে দুদ্দাড় করে রাস্তা অবধি ছুটে এল ডরোথি। একবার এধার, একবার ওধার চোখ চালিয়ে দেখল সব শুনশান। একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেলল বুঝি নীচের দিকে তাকিয়ে। তারপর সিমেন্টের থামটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল স্কুলের বাচ্চা মেয়েদের মতো।

বাচ্চা মেয়েদের মতোই একটা সূর্যমুখী হলুদ হাতকাটা গেঞ্জি ওর পরনে। স্কার্টের জায়গায় ছোট্ট নীল হাফপ্যান্ট। যে পোশাকে ওকে দেখলে পাড়ার বয়স্করা একটাই শব্দ উচ্চারণ করেন,

–অসভ্য!

তার ওপর খালি পা।

চাপা রঙের সুন্দরীটির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ওর মনে হল চন্দন কথাটা মিথ্যে বলেনি—ডরোথিকে দেখার তেষ্টাটা ওর চোখের নয়।

ঠিক তক্ষুনি চোখের জল মুছল ডরোথি।

ধড়াস করে উঠেছিল অরুর বুক, ডরোথি কাঁদছে?

কী এক নিশির টানে ছাদ থেকে নেমে গুটি গুটি বাড়ির গেট পেরিয়ে ওপারের বাড়ির থামে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ডরোথির পাশে গিয়ে দাঁড়াল অরু। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ডর?

হাত দিয়ে চোখ চাপা ছিল ডরোথির। সে হাত না সরিয়েই বলল, টোনি আমায় ছেড়ে চলে গেল।

ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য খুব বিজ্ঞের মতো বলেছিল অরু, সে তো কতবারই তোমায় ছেড়ে গেল আর ফিরে এল। এ নিয়ে ভাবছ কেন? আজ তো শনিবার, দেখো, সামনের শনিবারে ফিরে এল বলে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ থেকে হাত নামিয়ে ডরোথি বলল, মনে হয় না। এবার একটা ভয়ে দুরু দুরু কাঁপতে লাগল অরুর বুক আর ঠোঁট, কে.কে…কেন?

তখন হঠাৎ একটা বিকট কান্নায় ভেঙে পড়ে ডরোথি বাড়ির ভেতরে ছুটল মুখে শুধু একটাই কথা—আমি জানি না! আমি কিছু জানি না!

কীরকম বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে অরু, একবার ভাবল ভেতরে গিয়ে দুটো-একটা সান্ত্বনার কথা বলে ডরোথিকে, পরক্ষণেই মনে পড়ল কাকে নিয়ে যেন বেদম ঝামেলা সুক-ডরোথির মধ্যে হপ্তা দুয়েক আগে। অরু আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এল।

আজও ডরোথির পাড়া বেয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো সুকের সেই চলে যাওয়াটা ভর করে আছে অরুণের মনে। ওর মনে পড়ল বার বার চেষ্টা করেও ওদের শেষ ঝগড়া নিয়ে মুখ খোলাতে পারেনি ডরোথির।

যখনই অরুণ জিজ্ঞেস করেছে, হোয়াট রিয়েলি হ্যাপেনড, ডর? ডরোথি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছে, না, না, তুমি বড্ড বাচ্চা। তুমি কিসসু বুঝবে না।

শেষে ক্লাস নাইনে উঠে হোস্টেলে ভরতি হয়ে পড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে যেদিন, ডরোথি এল এক বাক্স চকোলেট নিয়ে। মা-র সামনে অরুণের হাতে চকোলেট তুলে দিয়ে বলল, তাহলে, অরু, তুমি সত্যিই বড়ো হয়ে গেলে?

অরুণ মিষ্টি করে বলেছিল, বলছ?

বড়ো বড়ো চোখ করে ডরোথি বলল, ইয়েস! অফ কোর্স!

তারপর ডরোথিকে বাড়ির গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, তাহলে টোনির চলে যাওয়া নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি?

একটু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ডরোথি, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো অরুণকে দেখেনি। সামনে, ওপারে নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে চোখ রেখে বলেছিল, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভালো করতে, অরু। আই রিয়েলি মিন ইট।

অরুণ আর কথা বাড়ায়নি। কিছুটা অভিমানে, কিছুটা হতাশায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বাড়ির গেটে। ডরোথি টরটর করে হিলতোলা জুতোর আওয়াজ তুলে ওপারের বাড়িতে চলে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে দেখল অরুকে, কিন্তু বাই! বাই!’ বলার মতো করে অরুর ডান হাতটা উঠল না।

ওর মনের চোখে ততক্ষণে ভাসছে আঁতোয়ান সুকের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভরদুপুরের দৃশ্যটা।

অরুণ বলল, আমি তো আজ সত্যিই বড়ো হয়ে গেছি, ডরোথি। আজ আমি সত্যিই তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি, টোনি চলে গেল কেন?

ডরোথি রেডিয়োগ্রামের পাশে রাখা একটা পুরোনো রুপোর কেস থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ধরল, আর কেসটা এগিয়ে দিল অরুণের দিকে। অরুণ একটা স্টিক বার করে ঠোঁটে তোলার আগে সিগারেটের ব্র্যাণ্ডটা দেখল। ও নামটা পড়ছে দেখে ডরোথির বেশ হাসি পেল, বলল—নিশ্চয়ই ভাবছ এই ভিখিরির দশায় আমি ‘সিনিয়র সার্ভিস অ্যাফোর্ড করছি কী করে? সত্যিই পারি না, তা ছাড়া ওই ব্র্যাণ্ডটা এখানে আসে না।

সিগারেটটা ধরিয়ে বসতে বসতে অরু বলল, কিন্তু এসেছে তো দেখছি। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল একটা বিশ্রী রকম কঠিন কথা বলা হয়ে গিয়েছে। কথাটা ঘোরাবার কথা ভাবছে যখন অন্য কিছু বলে ডরোথি এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হল ল্যাম্পের পাশের মোড়াটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, আমার শরীরের আর তেমন কিছু পড়ে নেই ঠিকই, কিন্তু কিছু অ্যাডমায়ারার্স তবু পড়ে আছে দেখি। ওদেরই একজন ডিকি। তুমি তো চিনতে ডিকিকে, তাই না?

অরুণ মাথা নাড়ল।-মিন্টো লেনের ডিকি? জাহাজের পার্সার?

ডরোথি বলল, এগজ্যাক্টলি! টোনি চলে যাওয়ার পর এতদিন ওরাই তো আমাকে সামলেছে। ও ট্রিপ করে ফিরলে আমার কিছুদিনের জন্য চারমিনারের হাত থেকে নিস্তার। তারপর কয়েক হপ্তা গেলে ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।

হঠাৎ কীরকম চিনচিন করে উঠল বুকটা অরুণের। বলল, তোমায় সামলেছে মানে? ওদের কী স্বার্থ?

যেটা সব পুরুষের! একটু খিলখিল করে হেসে নির্লজ্জের মতো বলল ডরোথি।

তার মানে…? প্রশ্নটা আটকে রইল গলার মধ্যে অরুণের।

ঠিক। ঠিকই। গত চব্বিশটা বছর তো আমি শুধু টোনির জন্য বৃথা অপেক্ষাই করিনি। কিছু বৃথা বেশ্যাবৃত্তিও করেছি। করিনি কি?

‘বৃথা বেশ্যাবৃত্তি’! টং করে কথাটা বাজল মগজে অরুণের। সামান্য নাক সিটকে বলল, বেশ্যাবৃত্তি…তাও বৃথা…?

ডরোথি ফের একটা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল।–বৃথা তো বটেই। আশপাশের অবস্থা দেখছ না? পয়সার জন্য পুরুষ ধরলে এই হাল হয়? টাইপিস্টের চাকরিটাও ছাড়লাম মাত্র দু-বছর আগে।

তাহলে পুরুষ নিতে কেন?কেমন এক অভিমানের সুরে জানতে চাইল অরুণ।

এবার একটা রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে ডরোথি বলল, কে জানে, হয়তো টোনিরই একটা কথাকে সত্যি করতে।

কী কথা? —অরুণ জিজ্ঞেস না করে পারল না। হা হা হি হি করে হেসে কুটোপুটি যাচ্ছে তখন ডরোথি। স্কুলের বালিকার মতো প্রায় ওর এই অদ্ভুত হাসি থামানোর জন্যই অরুণকে ফের জিজ্ঞেস করতে হল—এত হাসির কী হল? বলোই না কথাটা।

এত হাসির পর ধোঁয়া টানা ঠিক হবে না ভেবে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে দিল ডরোথি। কিছুটা মেজাজ তৈরির জন্যই দামি বিলিতি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল অরুণ। আমেজে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল ওর, শুনল ডরোথি বলছে—তুমি খুব ছোটো ছিলে ঠিকই, তবু তোমায় একবার বলেছিলাম না? অরুণ জানতে চাইল কী কথা?

—যে, টোনি বেহদ্দ পাগল আমার এই শরীরটার জন্যে।

–হু। মনে আছে।

—ভালোবাসা দেখানোর সময় মাঝে মাঝেই বলত টোনি, তোমার এই অপূর্ব শরীর শুধু একটা লোকের ভোগে থাকা ঠিক নয়। তোমার বেশ্যা হওয়া উচিত!

ডরোথি কথাটা শেষ করতেই ও আর অরুণ হো হো হি হি করে দমফাটা হাসিতে ভেঙে পড়ল। হাসির তোড় সামলাতে সামলাতে অরুণ কোনোমতে জিজ্ঞাসা করল, তা তুমি কী বলতে? ডরোথি ফের একটা সিগারেট ধরাবার উদ্যোগ করল; বলল—বলতাম ওহ, দ্যাটস ওয়াণ্ডারফুল! কাল থেকেই শুরু করি? তাতে টোনি বলত, কাল কেন? আজ থেকেই হতে পারে। যখন বলতাম আজ বললে একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। হঠাৎ করে কাকে ধরব এখন? তখন টোনির জবাব আসত, কেন, এই আমাকে দিয়ে! তোমার ফাস্ট কাস্টমার।

এতগুলো কথা বলে চুপ করে গিয়েছিল ডরোথি। হল ল্যাম্পের নিবু নিবু আলোয় এত রোমান্টিক একটা সংলাপ এমনভাবে থমকে যেতে অরুণের কৌতূহল যেন আরও তীব্র হল। ও জানতে চাইল, তাতে তুমি কী উত্তর দিতে ডর?

ডরোথি ওর সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলেছিল। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ওর ওই ফাস্ট কাস্টমার কথাটা আমার ভালো লাগত। তাই প্রতিবার আমি শেষ করতাম আর আমার শেষ খদ্দের! বলে।

কথাটা বলার সময় শূন্যে এক অদৃশ্য আঁতোয়ান সুককে জড়িয়ে ধরার ভান করল ডরোথি। অরুণের মনে হল কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়, সিনেমারই যেন এক নাটকীয় দৃশ্য দেখছে ও।

ঠিক তখন একটা ট্রে-তে করে এক পাঁইট রাম, দুটো গেলাস আর এক বোতল সোডা এনে রাখল সেন্টার টেবিলে এক তরুণী কাজের মেয়ে। কত বয়স হবে মেয়েটার? — ছাব্বিশ-আটাশ? তা যখন দরজায় এত এত নক করল অরুণ সাড়া দিতে পারল না?

ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্তিই হচ্ছিল অরুণের, যখন ডরোথি বলল, ও বিন্দিয়া, ও-ই আমার সব দেখাশোনা করে…

অরুণ রাগটা আর চাপতে পারল না—দেখাটা করে হয়তো, কিন্তু শোনাটা? আজ অতবার নক করে…

ওর কথার মধ্যে ডরোথি বলল, ও বোবা-কালা। ওর বর ওকে বিহার থেকে এনে ফেলে যাচ্ছিল রিপন স্ট্রিটের ব্রথেলে।

হঠাৎ ভয়ানক লজ্জিত বোধ করে আমরা আমতা করে অরুণ বলল, ত-ত-তো?

—ওর প্রথম খদ্দের জুটেছিল ডিকি। যে ওর কান্নাকাটি শুনে প্রথম রাতে ওকে তুলে এনে আমার এখানে ফেলে।

ওকে নিয়েই যে আলাপ চলছে তা বিন্দিয়ার বোঝার কথা নয়, ও দিব্যি একমনে মেমসাহেব আর সাহেবের ড্রিঙ্ক বানিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অরুণের অস্বস্তি কাটেনি, ও বিন্দিয়া প্রসঙ্গ থেকে কথা ঘোরাতে বলল, কিন্তু ডর, তুমি আজও এখনও বলোনি কেন টোনি চলে গেল।

এরপর এক অদ্ভুত নীরবতা ভর করল ঘরটাকে। সেই নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে একটু-আধটু ভাঙল গেলাস, বোতলের ঠোকাঠুকিতে যখন নতুন করে ড্রিঙ্ক সাজাল ডরোথি। এর মধ্যে বিন্দিয়া দু-প্লেট কাবাবও রেখে গেছে টেবিলে। সম্ভবত তৃতীয় পেগের শেষে কি চতুর্থ পেগের গোড়ায় ডরোথি জিজ্ঞেস করল, সেই যে তোমরা চলে গেলে তারপর আর শমির সঙ্গে দেখা হয়নি। কোথায় আছে ও? কেমন আছে?

শমি মানে শর্মিলা। অরুণের দিদি। খুব বন্ধু ছিল ডরোথির।

অরুণ বলল, ভালো আছে। জামশেদপুরে আছে। কর্তার চাকরি টাটায়।

—ও। ছেলেপুলে ক-টি?

—দুটি ছেলে। বড়োজন সবে ডাক্তারি পড়া শুরু করেছে, ছোটোজন সিনিয়র কেমব্রিজ দেবে বলে তৈরি হচ্ছে। ওরা পিঠোপিঠি।

—শমি সুখী তাহলে?

অরুণ এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে সোফাতে শরীরটা ভালোরকম এগিয়ে দিল। বলল, সুখ মাপার কি থার্মোমিটার আছে, ডর? যে জিভের তলায় কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রেখে বলে দেব কে কতটা সুখী কি অসুখী। তবে বাইরে থেকে দেখে যেটুকু যা বুঝি…ওয়েল শি সিমজ টু বি হ্যাপি।

ডরোথি ওর ড্রিঙ্কে একটা চুমুক দিয়ে বলল, গড ব্লেস! এটা শুনে বড্ড ভালো লাগল। ওর মতো মেয়ের জীবনে সুখী হওয়া উচিত। টোনির মতো পাগলের পাল্লায় পড়ে উচ্ছন্নে যাওয়া উচিত না।

একটা ফোর-ফর্টি ভোল্টের শক লাগল যেন অরুণের পায়ের পাতায়। ও তড়াক করে সোফায় সোজা হয়ে বসে আর্তনাদের সুরে বলল, হোয়-ট! হোেয়ট ডু ইউ মিন, ডর! দে ওয়্যার ইনভলভড? ওরা…ওরা জড়িয়ে পড়েছিল?

ডরোথি ফের সিগারেটে একটা টান দিতে দিতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। আরেকটু পর মুখে বলল, হ্যাঁ! ওই অবধি আমি সব সহ্য করেছি টোনির পাগলামি। কিন্তু শমির প্রেমপত্রগুলো যেদিন আবিষ্কার করলাম ওর অফিস ব্যাগে আর দুপুরবেলার ওই দৃশ্য চোখে পড়ল…না, না, ওই দৃশ্য আমি বর্ণনাও করব না… আমি মাছ কাটার বঁটি দেখিয়ে টোনিকে বলেছিলাম ঢের হয়েছে। এই মেয়েটার যদি কোনো ক্ষতি হতে দেখি তাহলে এই বঁটির কোপ পড়বে তোমার গলায়। তুমি দেখে নিয়ো। অরুণ আকাশ থেকে পড়েছে যেন। বলল, এসব ঘটল কখন? আমি তো বোজই আসতাম, আমারও চোখের আড়ালে?

ডরোথি বলল, আমি সব সময়েই একটা কথায় বিশ্বাস করেছি—সম্পর্ক, অ্যাফেয়ার, মাখামাখি, বদমায়েসি…এসব চোখে পড়ে। সত্যিকারের প্রেম, সত্যিকারের ভালোবাসা অদৃশ্য! ইনভিজিবল!

অরুণ জিজ্ঞেস করল, তার মানে…?

ডরোথি ঘাড় নাড়ল, টোনি সত্যিই শমির প্রেমে পড়েছিল, হয়তো জীবনে ওই প্রথম বার। আমি বুঝতে পারছিলাম। অতগুলো বছর ধরে ওকে দেখেছিলাম তো। যা খুশি করে বসতে পারত ও। হয়তো শমিকে নিয়ে পালিয়েই যেত। আমি চাইনি তোমার দিদিটার অত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাক। যেকোনো মূল্যেই সেটা রদ করতে চেয়েছিলাম। বলতে পারো নিজের জীবন ও সুখের মূল্যেই।

অরুণের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, জিজ্ঞেস করল, কেন, তোমাকে ভালবাসেনি টোনি?

–কে জানে! ভালো হয়তো বেসেছে। নিজের একান্ত নারীদের যেমন ভালোবেসে থাকে পুরুষরা। সেক্স, প্যাশন কিছুরই অভাব ছিল না। তবে কীরকম যেন শরীর-শরীর, সারাক্ষণ…

—আর শমির ক্ষেত্রে?

—ওহ! ও তো শমিকে পুজো করত। শমির চিঠিগুলো পড়ে বুঝেছিলাম ওর সেটা খুব ভালো লেগেছিল। মেয়েটাও একটু একটু পাগল হচ্ছিল।

হঠাৎ অরুণের মনে পড়ল ওর হোস্টেলে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে শমি সন্ধ্যে নামলে ছাদে একা একা ঘুরত। একদিন কী করছিস এখানে? জিজ্ঞেস করায় অরুণকে মুখ ঝামটা দিয়েছিল, তোর কী দরকার! যা, নীচে যা! সেই সন্ধ্যের সঙ্গে কোথায় যেন একটা সম্পর্ক আঁতোয়ান সুকের শিস দিতে দিতে রাতে বাড়ি ফেরা, প্রভূত রাম গিলে চিৎকার করে গান, তারপর একসময় ডরোথির সঙ্গে গালিগালাজ, মারপিট…

অরুণ কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ডরোথি, থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং। আজ আমি টোনির ডায়েরিগুলো নিয়ে যাব। আমায় সত্যিই পড়তে হবে সব কিছু। তারপর ভাবব কী করা যায়।

ঠোঁটের সিগারেট হাতে নিয়ে অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল ডরোথিও। দু-হাতে অরুণের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, পড়া শেষ হলে ফের এসো। বোলো কেমন লাগল। পারলে একটা গল্প লিখো টোনিকে নিয়ে। ইট মাস্ট হ্যাভ আ বিউটিফুল এণ্ডিং। খুব সুন্দর শেষ হতে হবে সে-গল্পের। তা সে যতই কষ্টের হোক।

কী মনে করে অরুণ বলল, গল্পই তো নিজে ঠিক করে শেষে কী হবে, তা কি আগে থেকে বলা যায়?

ডরোথি খুব বিষণ্ণ একটা হাসি মাখিয়ে রাখল মুখে, দরজা অবধি এগিয়ে দিল অরুণকে। দরজার ওপারে গিয়ে অরুণ কিছুটা যখন ঘুরে দাঁড়াল ‘বাই! বাই!’ বলবে বলে তখন কিছুটা আপনমনে ডরোথি বলল, গল্পের নায়িকাও জানবে না শেষ কোথায়?

উত্তরে অরুণ শুধু বলল ‘না’, তারপর বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

২.

সাত সাতটা দিন পড়ার টেবিলের সামনের বুক-র‍্যাকে দিব্যি শোভা পাচ্ছে আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিগুলো। অরুণ বোজ একবার মনে করে প্রথম খন্ডটা নামিয়ে পড়া শুরু করে। আর তা মনে হলেই কতকগুলো অদ্ভুত স্মৃতি ধেয়ে এসে অচিরে মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। ওর মনে পড়ে টকটকে লাল রঙের ডায়েরিগুলো কীরকম উন্মনা হয়ে বাড়ির গেটের ধাপিতে বসে বিড়বিড় করে পড়ত সুক। এক-আধবার অরুণকে দুটো-একটা শব্দের বানানও জিজ্ঞেস করেছে। শুনে কান থেকে কলম নামিয়ে বানানটা শুধরেও নিয়েছে। তারপর ফের ডুবে গেছে। নিজের লেখা ডায়েরি পড়ায়।

একবার চটে তিরিক্ষি অরুণের ওপর, কারণ ও বলেছে মেয়েদের শাড়িতে লাগানো হয় যে ব্রোচ তার বানান broach নয়, brooch। বলতে লাগল, কী পাগলের মতো বকবক করছ? তুমি বলতে চাও তোমাদের পারসি টিউটোরেস ডিনা মিস শাড়িতে যেটা লাগায় তার বানান brooch? নট broach? অরুণ হাতের মার্বেল গুনছিল, চোখ না তুলেই বলেছিল, এগজ্যাক্টলি! তখন ‘ধুত্তোর!’ বলে খাতাপত্তর গুটিয়ে বাড়ির ভেতরে হাঁটা লাগিয়েছিল সুক।

আরেক বার কীসব লিখছিল সুক একটা বেতের চেয়ারে বসে। চেয়ারটা গেটের ওই ধাপিটার পাশে রাখা। বিশেষ কোনো কৌতূহল থেকে নয়, এমনি এমনিই অরুণের চোখ চলে গিয়েছিল ওর ডায়েরির পাতায়, যেখানে আপনমনে কীসব লিখে চলেছিল সুক। অরুণের দৃষ্টি যে সেখানে লেপটে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য তার কারণ একটা শব্দ—Prostitute. নিতান্ত বালক, কিন্তু এই শব্দটা ওকে চিন্তায় ফেলার পক্ষে মোক্ষমই। অরুণ চোখে একটু কম দেখে। যদিও চশমা নিতে হয়নি। ও দূর থেকে কিছু পড়ার চেষ্টা করলে ভুরু কুঁচকে যায়। আড়চোখে সেটাই হয়তো দেখেছিল সুক, তাই ধমকে বলেছিল, চোখ ঘোরাও, দিস ইজ অ্যাডাল্ট স্টাফ।

কিন্তু ততক্ষণে যা পড়ার পড়া হয়ে গেছে অরুণের। আর ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া শুরু হয়েছে। সুক লিখেছে :

একদিন এক বেশ্যাকে সঙ্গে করে বাড়ি আনল বাবা, আর মার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছেন আমার স্ত্রী। সুন্দরী বেশ্যা বেশ অবাকই হয়ে প্রশ্ন করল, ওহ, তাই বুঝি! তোমার বউও আছে! তখন সাত বছরের আমার দিকে দেখিয়ে বাবা বলল, সঙ্গে একটি পুত্র। আমার প্রিয়তম আঁতোয়ান।

সুকের ধমকে একটু চমকেছিল অরুণ। তবে ঘাবড়ে যায়নি, কারণ ডায়েরির ওই শব্দটা ওকে এত ভাবিয়েছিল যে, তার একটা নিষ্পত্তির প্রয়োজন বোধ করছিল। ও হাতের গুলিগুলো পকেটে পুরে ফেলে বেশ স্পষ্ট করে জানতে চাইল, টোনি, তুমি সাত বছর বয়সেই জানতে পারছিলে যে বাবা যে-মেয়েটিকে তুলে এনেছে সে বেশ্যা? Prostitute শব্দটা তো আমি এই ক-দিন আগে জেনেছি। আর কে যে প্রস্টিটিউট তা কী করে জানব? জানা যায় কি?

সুক প্রথমে একটা গম্ভীর শব্দ করেছিল ‘হুম’! কিছুক্ষণ নীরব থেকে পরে বলেছিল, না, জানতাম না। প্রস্টিটিউট শব্দটার মানে জানতাম না। রাতে আমায় ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা-ই বলেছিল। বিছানায় ভারী কম্বলের তলায় শীতে নয়, রাগে কাঁপছিল মা। কাঁদছিলও। বলেছিল, অনেক সহ্য করেছি আঁতোয়ান, তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। আর পারছি না রে। যে-ছুঁড়িটাকে তোর বাপ তুলে এনেছে আজ, তুই জানিস ওটা কী? আ প্রস্টিটিউট! আ ব্লাডি হোর! যার মানে…

মাকে আর কষ্ট করে মানে বোঝাতে হয়নি। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে তুলে আনা মেয়েটার হইহই, চিৎকার, গান আর কত সব অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে। এরকম মেয়ে আসা আর এরকম শব্দটব্দ আমার কাছে নতুন নয়, কিন্তু সেই প্রথম আমি এদের মেলাতে শুরু করলাম মার কান্না আর প্রস্টিটিউট শব্দটার সঙ্গে। আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় মা নিজেই একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।

সুকের এই স্মৃতিটা মন থেকে মিলিয়ে যেতেই অরুণের মনে পড়ল ডরোথির মুখে শোনা একটা কথাও। সেই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে শোনা কথাটা আজও ভুলতে পারেনি অরুণ। পিজবোর্ড কেটে কেটে গঁদের আঠা দিয়ে এঁটে এঁটে বেশ একটা খেলনা এরোপ্লেন বানিয়ে ফেলেছিল সুক। তারপর তাতে রঙিন রঙিন কাগজ সেঁটে দিব্যি বাহারি করা হল সেটাকে। ছোট্ট ছোট্ট টিনের পাত দিয়ে প্লেনের নাকের ডগায় প্রপেলার বসানো হল। মোটা কলমে গা জুড়ে লেখা হল ‘টাইগার মথ। শেষে খেলার মার্বেল দিয়ে বানানো হলো তিন পিস চাকা। তখন খুব চেষ্টা চলল প্লেনটাকে মেঝেতে দৌড় করানোর।

বারে দশেকের চেষ্টাতেও প্লেন ছাড়ল না। ডরোথিদের বাড়ির সামনেকার ওই উঠোনটায় গোটা সকালই কাটছিল এইভাবে, হঠাৎ ডরোথির উদয়। বরের থেকে একটা সিগারেট চাইতে এসে ওই দৃশ্য দেখে বলে উঠল, সেই অচল প্লেন! এবার কার সর্বনাশ করবে?

কথাটা খুব মনে ধরেছিল অরুণের। সেদিন সন্ধেয় সুক রাম কিনতে বেরোতেই সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে জিজ্ঞেস করল ডরোথিকে, ডর, সকালে কী একটা বললে যেন অচল প্লেন নিয়ে? এনিথিং ইনটারেস্টিং?

ওহ ইয়েস! ওহ ইয়েস, অফকোর্স! বলে খুব একপ্রস্থ হেসে নিল ডরোথি। তারপর যোগ করল, ওরকম একটা অ্যাবানডানড প্লেনে আমায় প্রথম কিস করে এই রাস্কেলটা!

সুককে নিয়ে খুব সোহাগ করে কথা বললে ওকে রাস্কেল বলে উল্লেখ করে ডরোথি। তাই জিজ্ঞেস করল অরুণ, প্রথম চুমুটা খুব খারাপ লাগেনি নিশ্চয়ই? ডরোথি তখন ওর ওই পেটেন্ট হাহা হিহি হাসিটা হেসে বলেছিল, টোনির ওই ডায়েরিতে কোথাও লেখা আছে। আমি পড়েছি। পারলে পোড়ো কখনো, তবে বড় হয়ে। টোনির সবকিছুই তো খুব অ্যাডাল্ট ব্যাপার,?

আজ মনে হয় ওই অ্যাডাল্ট ব্যাপার দিয়েই শুরু করা যায়—এই ভেবে অরুণ সামনের তাক থেকে রেক্সিনে বাঁধানো পাঁচটা লাল ডায়েরির প্রথম খন্ডটা তুলে নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসল। কত কী যে পাগলটা লিখে গেছে এন্তার, রোমাঞ্চের শেষ নেই, কিন্তু কোথায় ডরোথি, তার নামগন্ধই কোথাও নেই! এর মধ্যে মায়ের পাশে শুয়ে সেই প্রস্টিটিউট কথাটা শোনাও এসে পড়ল, কিন্তু সেটা পরে পড়বে বলে পাতা উলটে গেল অরুণ। আর ওলটাতে ওলটাতে খেয়াল হল যে, ওর হাতে ধরা ডায়েরির খন্ডটায় সুক কলকাতাতেই এসে পৌঁছায়নি। গোয়া আর বম্বে করতে করতেই শেষ হয়ে গেছে।

অরুণ উঠে প্রথমটা জায়গামতন রেখে দ্বিতীয় খন্ডটা খুলতেই পুলকিত বিস্ময়ে অবশ হয়ে গেল। ডায়েরিটা শুরু হচ্ছে এভাবে—’ডরোথিকে পাচ্ছি, আমার জীবন শুরু হচ্ছে!’ অরুণ পড়তে শুরু করে দেখল এক অদ্ভুত রস, ছেনালি আর সরলতা মিশিয়ে সুক লিখে গেছে ডর বৃত্তান্তগুলো, যার কোথাও কোথাও কিছুটা স্বীকারোক্তির গন্ধও মিশে আছে। ডরোথিকে পাওয়ার প্রসঙ্গে যেমন লিখছে

আমি বাপু পোড় খাওয়া পার্টি, কোন মেয়ে উঠবে আর কোন মেয়ে বহুত হ্যাপা দেবে দিব্যি বুঝি। কলকাতায় এসেছি এই ছ-মাস, তার মধ্যে তিন তিনটে চিড়িয়া গেঁথেছি। ইভা, ট্রেসি, লাভলি। লাভলি খ্রিশ্চান নয়, কিন্তু এরই মধ্যে পালিয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য খেপেছে। কিন্তু আমার ভয় করছে ওদের কমিউনিটিকে, কোথাও কিছু ইধর-উধর হলে আমাকে পেঁদিয়ে লাশ করে দেবে। ইভা, ট্রেসিকে নিয়ে ভাবি না, দে আর ওনলি ফর দ্য গুড টাইমজ। আমারও তো গুড টাইমজ চাই, চার-পাঁচ পেগ রাম সেঁটে ট্যাক্সিতে চড়লেই তো আমার হাত দুটো কাজ শুরু করে দেয়। হাজার হোক, এয়ারক্রাফট মেন্টেন্যান্স মেকানিকের হাত তো। নাটবল্ট খুঁজতে বেশি সময় নেয় না; তার ওপর হাতের মধ্যে দুটো রক্তমাংসের বল এলে তার ফিলিং। ওহ ক্রাইস্ট, প্লেনের কোনো কলকবজাই তুলনায় আসতে পারে না। কিন্তু এখানেই একটা মস্ত বড়ো কিন্তু নেভিলদের ক্রিসমাস পার্টিতে আলাপের পর এগারো বার ডেট করা হল, কিন্তু একবারটিও মুখটা দুহাতে ধরে ঠোঁটে চুমু দেওয়া ঘটল না! হোয়াটস হ্যাপেনড টু ইউ, টোনি সুক? তোমার বম্বের সাঙ্গোপাঙ্গরা তো বিশ্বাস করবে না তুমি এগারো দিন ধরে ডেট করেও বিলকুল সুখা যাচ্ছ!

কাজেই সব মহৎ প্রেমের মতো এখানেও আমাকে একটা প্যাঁচ কষতে হয়েছে। আমি ফাঁদ পেতেছি ডরোথির জন্য। ওর খুব কৌতূহল প্লেন নিয়ে আমার কাজ কারবার বিষয়ে। সেদিন বেমালুম বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আগামী ফোর্টিন্থ ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিন, সেদিন তোমায় একটা স্পেশ্যাল ট্রিট দিতে চাই।

ও আকাশ থেকে পড়ে চোখ দুটো আলুর মতো গোল করে বলল, তু-তুমি ভ্যা-ভ্যা ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে জন্মেছ! ভ্যালেন্টাইন ডে-টা যে কী, আমি কিছুই জানি না। একটা লিয়েন পাওনা ছিল, সেটা শুক্কুরবার দেখে ওই তারিখটায় নিয়েছিলাম। ডরোথি অমন করছে। দেখে জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াটস সো গ্রেট অ্যাবাউট ভ্যালেন্টাইনজ ডে?

ডরোথি ফের অবাক হয়ে গেল—তুমি জানো না ওটা প্রেমিকদের দিন? তখন মোক্ষম চালটা চাললাম—তাতে আর কী লাভটা হল জীবনে? জন্মানোই সার হল, প্রেম কোথায়? ডরোথি তখন সেই অপূর্ব রূপোলি হাসিটা হেসে বলল, লায়ার! ড্যাম লায়ার! মিথুক কোথাকার। তখনই বুঝলাম আমার ফাঁদ পাতা কাজে এসেছে।

বাপরে! বলে একটা কাচের পেপারওয়েটে পাতাটা চাপা দিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে উঠল অরুণ। লেখার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার সুকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে ও। বানানের ছিরি, গ্রামারের গড়বড় আর সিন্ট্যাক্সের রকমসকম ভেদ করে অদ্ভুত একটা স্বাদ উতরে আসছে। কাহিনি শোনানোর কিছুটা চপল, কিছুটা উন্মাদ একটা পদ্ধতিও আছে লোকটার। সুকের জীবনের যতখানি যা চাক্ষুষ করেছিল অরুণ ও তার সঙ্গে মিলিয়ে পড়া শুরু করল ফের। ডায়েরির উত্তম পুরুষেরা কখন যেন কোথায় হারিয়ে গেল, যেভাবে হয়তো সুককে নিয়ে ওর উপন্যাসে লেখা যাবে সেভাবেই ডায়েরির মধ্যে কাহিনির খোঁজে ঢুকে পড়ল অরুণ। আস্তে আস্তে সেই ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে আঁতোয়ান সুক ও ডরোথি রবার্টের প্রথম মিলনের বৃত্তান্তে কুঁদ হয়ে গেল ও।

ডরোথির মনে ধরা ছিল একটা উড়োজাহাজ, আর সুকের মাথায় ভর করেছিল একটা অন্যরকম ওড়া। ট্যাক্সি থেকে শীতের সকালে অ্যারোড্রামে নেমে প্রথম যে কথাটা সুক ডরোথিকে বলেছিল তা হল—আজ তুমি উড়বে।

ডরোথি জিজ্ঞেস করেছিল, কী রকম? বিনা টিকিটে? বিনা প্লেনে?

সুক শুধু দুষ্টু হাসি হেসেছিল, চুপচাপ।

সুক মেন্টেন্যান্স মেকানিক ছিল দারভাঙা এয়ারলাইনের। প্রথমে সেই হ্যাঙ্গারে নিয়ে তুলল ডরোথিকে। দুটো ড্যাকোটা বিমানের মেরামতি, অয়লিং, ঝাড়পোঁছ হচ্ছে সেখানে। একটা ছোট্ট বাও করে সুক বলল, ডার্লিং, এই হল আমার অফিস। আর এরা আমার কলিগ।

বলতে বলতে দুটি যুবা প্লেনের ডানা থেকে নেমে ডরোথিকে বলল, হ্যালো ডরোথি!

ডরোথি, বলা বাহুল্য, বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল। আমার নাম পর্যন্ত জেনে গেছে এরা। গড নোজ আরও কত কী শুনেছে বন্ধুর কাছে।

বেশ চমকেছিল দুই সঙ্গী ড্যানিয়েল এবং আসরানিও। বাপরে, কী চিড়িয়া পাকড়াও করল টোনি! এ তো বিলকুল রুপোলি পর্দা থেকে নেমে আসা এভা গার্ডনার! শুধু গায়ের রংটা চাপা। তাতে চেহারার নখরা আরও বেড়েছে। আর… আর কী চাউনি, মাই গড! ওরা হাঁ করে গিলছিল ডরোথিকে।

শেষে সুক বলল, শালা, কী গিলছিস ওভাবে? একটু আমার দিকেও চা। আফটার অল শি ইজ মাই বার্ড!

এই বার্ড কথাটার প্রতিবাদ করল ডরোথি। বলল, আমি পাখি নই, আই অ্যাম আ…

ওকে কথা শেষ করতে দিল না সুক। ওকে, ওকে, তুমি পাখি নও, তুমি এরোপ্লেন। আমরা এখানে প্লেনকেও বার্ড বলি। নাউ লেটস গো, আমাদের নিজস্ব প্লেনে।

কিন্তু কোথায় সে প্লেন? একটার পর একটা হ্যাঙ্গার পেরিয়ে কোথায় কোন দুনিয়ার প্রান্তে একটা প্লেন দেখিয়ে সুক বলল, ওই আমাদের পাখি।

ডরোথি দেখল চাকায় ঘাস গজিয়ে যাওয়া এক কোন জমানার অ্যাবানডাণ্ড ড্যাকোটা সবুজ খেতের মধ্যে বসে আপনমনে শীতের রোদ পোহাচ্ছে। বলল, এর আর দেখার কী আছে টোনি?

মুচকি হেসে সুক বলল, শুধু খোলটা দেখলেই হবে? কেন, ভেতরটা? ডরোথি বলল, দেখতে চাই, কিন্তু ওর তো সিঁড়িও নেই। উঠব কী করে?

সুক মুখে কিছু বলল না, বেশ কিছুক্ষণ ডরোথির বলা নানা কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিল। শেষে প্লেনটার দরজার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, হ্যাঁ, এই তো সিঁড়ি। আমার দু-কাঁধে পা রাখো।

ডরোথি ওর পায়ের জুতো খুলে এক হাতে নিল, আর অন্য হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। ও সুকের কাঁধে পা রাখতে সুক উঠে দাঁড়িয়ে ওকে প্রায় ছুঁড়ে দিল প্লেনের মধ্যে। ডরোথি একটা বিড়ালছানার মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্লেনের ফ্লোরে। আর আড়চোখে দেখতে পেল ওর বন্ধুটি প্লেনের ডানার ওপর ভল্ট খেয়ে কীসব করে, এটা-ওটা ধরে ঠিক হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর ওপর।

কোনো নারীর ওপর আছড়ে পড়ার এরকম আনন্দ কখনো পাইনি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম খোলা আগুনের ওপর এক পতঙ্গের মতো পড়েছি আমি। এর আগে একবারও যাকে চুম্বন করিনি তার ব্লাউজ, ব্রা ছত্রভঙ্গ করে তার বুক দুটো নিয়ে এরকম মেতে উঠলাম কেন? ওর বুকের বৃন্ত দুটো দেখামাত্র মনে হল যেন শৃঙ্গ জয় করেছি। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের ঠোঁটে চুমু দেওয়ার আগে তার বুক চুষতে শুরু করলাম। ব্যতিক্রম শুধু মা, যার বুকই চুষেছি, ঠোঁটে ঠোঁট মেলাইনি। তবে…তবে…তবে তাই বা কী করে বলি? আমি কি ভুলে গেলাম…যাক সে কথা, তা তো যথাস্থানে আছে। এখন আমি ডরোথি রবার্টের একটা বুকের বোঁটায় ঠোঁট রেখে অন্য বুকের বোঁটায় আঙুল দিয়ে খেলছি।

যে-ডরোথিকে অ্যাদ্দিন বড় সংরক্ষণশীল মনে হয়েছিল, যাকে বাগে আনতে এত প্যাঁচ পয়জার কষতে হল, তার দিক থেকে প্রথম মুহূর্তের কিছু ‘উঁহুউঁহু!’ শব্দ ছাড়া বিশেষ প্রতিরোধ না পেয়ে যেমন মজা পাচ্ছিলাম তেমনি একটু একটু অবাকও হচ্ছিলাম। অবাক হওয়া আর মজা পাওয়া মিলেমিশে একটা ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে ঠেকল যখন ডরোথি ওর অপরূপ খোলা বুক দুটো নিয়ে ঠেলে উঠে ঠিক এক সদ্য ডেক-অফ করা টাইগার মথের মতো প্রায় উড়ে এল আমার ওপর। দু-হাত প্লেনের দুই ডানার মতো দু-ধারে ছড়ানো, মুখে একটা ইঞ্জিনের আওয়াজের মতো ‘গোঁ-ও-ও-ও’ ধ্বনি। আর আমার ওপর ল্যাণ্ড করার পর দিব্যি ঘোষণা—দিস ইজ আ প্লেন ক্র্যাশ!

ছাইচাপা আগুন বলতে যা বোঝায় ডরোথি দেখলাম ঠিক তাই। এভাবে তো বর্ণনা করা যায় কারও মনকে, স্বভাবকে, হয়তো প্রতিবাকে। এ ছাড়াও এই বাগধারাটা খুব লাগসই ভাবে বর্ণনা করে ডরোথির শরীরটাকে। পোশাক-আশাক যে নারীর সৌন্দর্যের এতখানি ঢেকে রাখতে পারে তা ডরোথিকে ক্রমাগত বিবস্ত্র না করলে জানতে পারতাম না। ওর গায়ের চাপা রংটার মধ্যেও একটা মাদকতা আছে, কিছুটা গাঢ় রেড ওয়াইনের মতো। রংটার নিজেরই একটা লাবণ্য আছে, প্লেনের জানালা দিয়ে রোদ্দুর এসে সেই রংটাকেই এখন সোনালি আভায় মুড়ে দিচ্ছে। ওর দুই বলিষ্ঠ বুকে মুখ ডুবিয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে হল। কিন্তু আমার ধারালো যন্ত্রটির কোনো ঘুম নেই, সে বাঘের মতো জেগে উঠে ডরোথির গোপন রহস্যভেদে ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমার বাঘ কিংবা টাইগার মথ প্লেন কখন যে হ্যাঙ্গার খুঁজে নিয়েছে জানি না, কিন্তু প্লেনের ‘গোঁ-ও-ও-ও’ ধ্বনিটা ছড়াতে শুরু করেছে ডরোথির সামান্য খোলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। ওর সারাশরীরের মতো সুন্দর মুখটাও ঘামে ভেসে যাচ্ছে। ওর চোখ দুটো আধবোজা, চুলগুলো মাটিতে ছড়ানো। একটু পর পর গোঙানির মতো আওয়াজ করে ও কিছু বলছে, কিন্তু আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না, আমারও ক্ষমতায় কুলোচ্ছে না ওকে জিজ্ঞেস করি, কেমন প্লেন দেখছ ডর?

ওই সকাল থেকেই সুক ডরোথি রবার্টসের ভ্যালেন্টাইন। অরুণ পাতা উলটে উলটে ক্রমশ একটাই জিনিসে এসে ধাক্কা খাচ্ছিল—এয়ারপোর্টের কাজ সেরে এয়ারলাইনের স্টাফ বাসে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে এসে কখন একটা গাছতলায় এসে দাঁড়াচ্ছে সুক, আর ব্ল্যাকউড অ্যাণ্ড হজ-এর টাইপিস্ট ডরোথি কখন এসে পৌঁছচ্ছে এবং সেখান থেকে কোথায় কোথায় গিয়ে ওরা কী-কী পাগলামি করছে। এই সমস্ত পাগলামির শেষ হয় কখনো সুকের ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে, কখনো ডরোথিদের বাড়ির প্রাচীন বিছানায়। এই বিছানায়—ডরোথির বক্তব্য

ওর বাবা ওর মায়ের কুমারীত্ব হরণ করেছিলেন। ডরোথি যখন পেটে এল ওঁরা চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সারাপাড়া হামলে পড়েছিল গির্জায়, কিন্তু বর এমিল রবার্টস হাজির হননি। সেদিন সকালেই প্র্যাক্টিসের সময় তাঁর প্রিয় ঘোড়া ক্যাপ্টেন-কুক-এর স্যাডেল থেকে ছিটকে পড়ে কোমায় চলে যান। অবিবাহিত মা মরিন ওয়েলচ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর মেয়ে মৃত পিতা এমিল রবার্টসের পদবিই বহন করবে।

অরুণের মনে পড়ল ডরোথি কথায় কথায় একদিন ওকে কী বলেছিল। বলেছিল, তুমি জান অরু, আমি জীবনে কোন জিনিস ভীষণ মিস করি? অরুণ যখন জিজ্ঞেস করেছিল, কী জিনিস, ডর? ও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, বাবার সঙ্গে একটা ছবি। কিন্তু ঈশ্বর সেটা হয়তো চাননি। বাবার মুখ কখনো দেখলাম না। আর ওঁর স্মৃতি বলতে আমাদের ম্যান্টেলপিসে বাবার জকি-বেশে একটা হাসিখুশি ছবি। বাবা সেদিন ক্যালকাটা ডার্বি জিতেছিল অ্যাফ্রিকান কুইন-এ সওয়ার হয়ে।

সুকের ডায়েরি পড়তে পড়তে একটা জিনিস ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছিল অরুণের কাছে। তা হল নির্মম সত্যকে খুব সহজভাবে মেনে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুকের, আর সেই নির্মম সত্যটাকে সরলভাবে লেখার। যেমন ডায়েরির দ্বিতীয় খন্ডেরই এক জায়গায় ও লিখছে :

আমি জানি ডরোথির মতো এত সংরক্ষণশীল মেয়েকে বিয়ে করার বিপদ আছে আমার। ও আর একশোটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েদের মতো নয়। অথচ আমিও বিয়ে করে আদ্যোপান্ত পালটে যাওয়ার ছেলে নই। মেয়ে ব্যাপারটার আমার রুচি আছে, মেয়েদের জয় করতে, চেখে দেখতে, বিছানায় ফেলে আমোদ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ডরোথি আমার বউ হলে আমি এসব ত্যাগ করব ভাবতেই পারি না। অথচ ডরোথিকে আমি চাই এবং বউ করেই। জানি এতে দু-দুটো জীবন নিয়ে খেলা করছি—ওর এবং আমার; কিন্তু আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি।

জায়গাটা পড়া হতে অরুণ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাত নেমেছে সারাশহর জুড়ে, দূরের অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে, যেসব আলো নেভেনি তাদের কীরকম জোনাকির মতো ঠেকছে। আকাশ জুড়ে একটা গাঢ় নীল অন্ধকার, আর তার এক কোণে একটা ভাঙা চাঁদ। যেরকম চাঁদকে আঁতোয়ান সুকের ওপরতলার ভাড়াটে সিরিল বলত ‘অ্যাংলো মুন’। ওই ছেলেবেলাতেই কথাটা শুনে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল অরুণ, এক সন্ধেয় সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সুককে, টোনি, অ্যাংলো চাঁদ বলে কি কিছু হয়?

কথাটা শোনামাত্র হো হো করে হেসে উঠেছিল সুক—নিশ্চয়ই সিরিলের কাছে শুনেছ কথাটা? রাইট? অরুণ মেনে নিয়েছিল—হ্যাঁ। তখন সুক বলল, এটা একটা মহৎ তত্ত্ব মহামান্য সিরিল ওয়াটসনের। অরুণ বলেছিল, তার মানে? আঁতোয়ান সুক একটা ফ্রেশ প্যাকেট ছিঁড়ে একটা ‘লাকি স্ট্রাইক’ ধরিয়ে বলেছিল, সিরিল বিশ্বাস করে এ পাড়ায় বাঙালি, পারসি, এমনকী বাঙালি খ্রিশ্চানদের থেকেও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরা সব কিছুতেই পুরোপুরি আলাদা। এতটাই আলাদা যে বাঙালিরা যে চাঁদ দেখে অ্যাংলোরা ঠিক সেই চাঁদ দেখে না। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের চাঁদও আলাদা—অন্তত সিরিল ওয়াটসন তাই বিশ্বাস করে। আর সেই চাঁদ হল অ্যাংলো চাঁদ।

এইসব ভাবতে ভাবতে অরুণ দূরের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কী ভেবে নিজের মনে হাসল। ওর মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা চাঁদ নয়, একটা অদ্ভুত সকালের কথা। যে সকালের একটা চরিত্র ডায়েরি লেখক আঁতোয়ান সুক।

৩.

একটা রবিবারের সকাল। বেশ চকচকে রোদের সকালও। রোদে কী একটা সোনালি আভা মিশেছে, যেমনটা মিশে থাকে শরতের আলোয়। তাহলে কি বর্ষা গিয়ে..? অতটা মনে পড়ে না অরুণের। শুধু মনে পড়ে পাড়ার ফটিক, সঞ্জীব, নীলু, ভুলু, ডোম্বল, ডম্বলরা দড়ির বারপোস্ট খাঁটিয়ে বল খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু আগে বেনেদের রোয়াকে বসে কেশবদা এক প্রস্ত গেয়ে গেছে মানবেন্দ্রর ‘বারে বারে কে যেন ডাকে’ গানটা। অরুণরা বায়না ধরেছিল, কেশবদা, ও আমার চন্দ্রমল্লিকা ধরো। কেশবদা এক টিপ নস্যি নাকে ঠুসে বলল, দূর! দূর! এই ভর সক্কালে কেউ রাতের গান গায়। বলে ধুতির কোঁচা সামলে উঠতে যাচ্ছিল, যখন কী আশ্চর্যের কারণে একটু একটু করে অন্ধকার ছড়াতে লাগল।

আর সবার মতো কেশবদাও আকাশের দিকে হাঁ করে চাইল, আর দেখল একটা জমাট অন্ধকার পাড়ার পশ্চিম কোণ থেকে মেট্রোপলিটান স্কুল পেরিয়ে পুবে মৌলালির দিকে ধেয়ে আসছে। এ আবার কী সূর্যগ্রহণ বাবা, ভাবল সবাই। কিন্তু ভাবনার আগে রাত ছুটছে, সোনালি রোদ গিলছে হাঘরে অন্ধকার। আর থেকে থেকে কীসব আছড়ে পড়ছে পিচের রাস্তায়, সিমেন্টের ফুটপাতে, রাস্তার এধার-ওধারের বাড়ির বারান্দায়। শেষে কোত্থেকে একটা শোর উঠল ‘পঙ্গপাল। পঙ্গপাল!

‘পঙ্গপাল’ শব্দটা অরুণ এক-আধবার স্কুলের ভূগোল-টুগোলের বইতে পেয়েছে, তবে সে বস্তুটি আখেরে কী দাঁড়াতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। আর পঙ্গপাল মানে যে আসন্ন রাত তা আর কল্পনায় আসবে কোত্থেকে! ও ঘাড় উঁচিয়ে পাড়ার আকাশ জুড়ে বেড়ে চলা অন্ধকার দেখতে থাকল।

ক্রমে পাড়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মিশমিশে কালো অন্ধকারে চাপা পড়ল, অরুণ শুনল কেশবদা বলছে, মানে মানে বাড়ি কাট বাপ। এ তো বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার!

সবার মতো অরুণও গুটি গুটি বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কানে আসছিল পথচারীদের নীচু গলায় কথাবার্তা আর চড়াৎ চড়াৎ আওয়াজ। হয়তো ওই পঙ্গপাল পড়ার আওয়াজ আর তার মধ্যে হঠাৎ ইংরেজিতে একজনের গলা, দিজ আর লোকাস্টস! দে আর গোয়িং টু ভ্যানিশ সুন।

কণ্ঠস্বরটা ভুল হওয়ার নয়, তবু অরুণ জিজ্ঞেস করল, ইজ ইট টোনিং সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর, অফ কোর্স! হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার, অরু কালেক্টস লোকাস্টস?

অরুণ বলল, কালেক্ট করব কী, চোখে তো কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। হঠাৎ সেই অন্ধকারে কোত্থেকে এসে আন্দাজে অরুণের একটা হাত ধরল সুক। বলল, ঘাবড়িয়ো না। এটা কয়েক মিনিটের ব্যাপার। লোকাস্ট চলে গেলেই সকাল আবার সকাল হয়ে যাবে।

অরুণ জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে এভাবে লোকাস্ট দেখেছ?

অন্ধকারেই সুকের জবাব এল, হ্যাঁ, ছোটোবেলায়।

অরুণ জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

সুক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আলো ফুটল পাড়ার পশ্চিমে। অরুণ আকাশের দিকে চেয়ে দেখল পঙ্গপাল বাহিনী ক্রমশ সরে যাচ্ছে পুবে, আর পশ্চিমে ক্রমশ আকাশ আর রোদ বেরিয়ে আসছে। রাস্তার দিকে চাইতে অরুণ দেখল শয়ে শয়ে মরা পঙ্গপাল পড়ে আছে। হঠাৎ একটা ওর গায়ে এসেও পড়ল, ও সেটা গা থেকে ঝাড়ার জন্য লাফ দিতে গোটা দুয়েক পড়ল সুকের গায়েও। সাহেব ওর পেটেন্ট করা বুলি ঝাড়ল, শিট! তারপর হাতের ক্যানভাস ব্যাগ দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটতে লাগল নিজের হাতে পিঠে পায়ে। আর মুখে ক্রমাগত ওই স্ল্যাং—শিট! বাস্টার্ড! ফাঁক অফ!!

আলো ফুটতে দেখা গেল একটা-দুটো নয়, বেশ ক-টা পঙ্গপাল পড়েছে সুকের জামায়, মাথায়, ব্যাগে। তখন অরুণও জুটল সাহেবের গা ঝাড়তে। সেই ঝেড়ে ফেলা পোকা যেই যেই পড়তে থাকল মাটিতে সুক ওর ভারী ক্যানভাস শুয়ে তাদের পিষতে থাকল। আর মুখে সমানে সেই খিস্তি—শিট! বাস্টার্ড!…

গোটা পাড়ার আলো যখন পরিষ্কার হয়ে গেল সুক যেন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। অরুণকে বলল, আজ রোববার, তোমার নিশ্চয়ই ছুটি। চলো, লেটস সেলিব্রেট!

অরুণ বুঝে পেল না কীসের সেলিব্রেশন। বলল, আজ কী? নিশ্চয়ই ডরোথির জন্মদিন নয়। ওর জন্মদিনটা আমি জানি।

ভেরি ক্লেভার! বলে অরুণের পিঠে একটা চাপড় দিল সুক। তারপর বলল, তাহলে আমারটাও জান নিশ্চয়ই।

অরুণ বলল, না। তবে এইটুকু জানি সেটা আজ নয়।

ব্রিলিয়ান্ট! বলল সুক। আসলে ডর চাইছে আমার চাকরিতে প্রমোশনটা সেলিব্রেশন করতে। কোয়ায়েটলি। নো হ্যাঙ্কি প্যাঙ্কি অর পার্টি থ্রোইং। আজ দুপুরে আমার গেস্ট শুধু তুমি।

আমি! শুধু আমি?—অরুণ বেশ তাজ্জব হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, জাস্ট ইউ। কারণ ডরোথি বলল তুমি নাকি কখনো পর্ক ভিন্দালু খাওনি। আজ ও ওটাই রাঁধছে আমাদের দুজনের জন্য। তুমি প্লিজ তোমার মাকে বলো আজ তুমি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করছ।

অমনি অরুণ বাড়ির দিকে ঘুরছিল মাকে বলবে বলে, সুক ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, দাঁড়াও! এখন না।

-কেন?

-তার আগে তুমি আমার সঙ্গে পর্ক, মশলা, জার্মান লোফ আর ওয়াইন শপিং-এ যাবে। রাজি?

অরুণ বিগলিত স্বরে বলেছিল, ওহ, অফ কোর্স!

তালতলা আর এন্টালি মার্কেট থেকে কেনা হল পোর্ক, হ্যাম, সসেজ, রুটি মাখন চিজ, চার রকমের ফল আর কিছু সবজি। তারপর হাঁটা শুরু হল শিয়ালদা-র দিকে। সেখানে লিকার শপ থেকে কেনা হল দু-বোতল রাম আর চার বোতল বিয়ার। কিন্তু ফের পাড়ার

মমাড়ে এসে সুক বলল, ডিয়র অরু, তুমি কি খুব বিরক্ত হবে যদি একটা কথা বলি?

অরুণ বলল, কথাটা না শুনে কী করে বুঝব বিরক্ত হব কি না? পানের দোকানের জগরুকে দিয়ে আমি জিনিসগুলো বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু ডরোথিকে বলো আমি মিন্টো লেনে ক্লাইভদের বাড়িতে যাচ্ছি। ও রান্না শুরু করে দিক, আমি ঠিক বারোটায় পৌঁছে যাচ্ছি।

অরুণ সুকের হাতে ঘড়িতে দেখল দশটা কুড়ি। জিজ্ঞেস করল, আর আমি? সুক বলল, ইউ বি দেয়ার অ্যাট টুয়েলভ থার্টি শার্প! অরুণ ‘ওকে’ বলে জগরুর সঙ্গে চলে গেল ডরোথির কাছে।

বেশ ভালোই চকচক করছিল ডরোথির চোখ দুটো জগরু যখন একে একে জিনিসগুলো নামাচ্ছে ওর সেন্টার টেবিলের ধারে। শেষ হতে ডরোথি ওকে দু-টাকা বকশিশ করে বিদেয় করে দিল। ডরোথি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সো? ফাইন পার্টি হবে আজ, কিন্তু টোনি কোথায়?

অরুণ তৈরিই ছিল, বলল—ক্লাইভদের বাড়ি গেছে। বলেছে ঠিক বারোটায় চলে আসবে। ডরোথি একটা চাপা আওয়াজ তুলল ‘হুম’। আর ওর সুন্দর মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। একটু পর স্বগতোক্তির মতো বলল, আবার ওই ছেমড়ি মাগিটার পাল্লায় পড়ল ইডিয়েটটা!

কিছু বুঝতে না পেরে অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, শেষে আমতা আমতা করে বলল, আমাকে ও সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছিল ডর।

চকিতে নিজেকে সামলে নিয়ে ডরোথি বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। তুমি নিশ্চয়ই এসো। পর্ক ভিন্দালু আমি তোমার কথা ভেবেই করতে চেয়েছি। প্লিজ কাম।

সুকদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাইরের সোনালি রোদে বেরিয়েও অরুণের কেন জানি না মনে হল পঙ্গপালের অন্ধকারটা যেন পাড়ার আকাশ ছেড়ে কখন ঢুকে পড়েছে এই অ্যাংলো দম্পতির ফ্ল্যাটে। ও এক ছুটে উলটো দিকে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে বলা শুরু করল, মা, মা, আজ দুপুরে আমার নেমন্তন্ন ডরোথিদের বাড়িতে।

মা অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী কথা! বাড়িতে মাংস হচ্ছে আর তুমি বাইরে খাবে?

অরুণ বলল, ওদের বাড়িতেও মাংস হচ্ছে, খুব স্টাইলের রান্না।

মা মুখ ভেটকে বললেন, ছাড় তো তোর স্টাইল, যত্তোসব শুয়োরের মাংস দিয়ে রান্না।

অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। খানিক পর নীচু স্বরে বলল, তাহলে কী?

মাও একটু নরম হয়েছে ততক্ষণ। বলল, ঠিক আছে যাও, নেমন্তন্ন করেছে যখন। তোমার মাংসটা ওবেলার জন্য তুলে রাখবখন।

অরুণ মনে মনে মাকে থ্যাংক ইউ বলে স্নান করতে চলে গেল। জীবনে প্রথম পর্ক ভিন্দালু খাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে।

স্নান সেরে, গায়ে পাউডার ছড়িয়ে, লম্বা কোঁকড়া চুলে সামান্য পমেড ঘষে, পপলিনের শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট চড়িয়ে কখন যে দিব্যি পৌঁছে গেছে ডরোথিদের বাসায় অরুণের সে খেয়ালও নেই। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল খাবারের মনোহরা গন্ধ চারদিকে মম’ করলেও ডরোথি সেই সকালের বাসি পোশাকেই বসে আছে ডাইনিং টেবিলের এক ধারে, গালে হাত আর চোখ দুটো বন্ধ। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল, সেটা ঠেলে বসার ঘরেও একটু থমকেছিল অরুণ। কোনো সাড়া শব্দ নেই দেখে খাবারের জায়গায় ঢুকে ওই দৃশ্য। অরুণ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, হোয়াট হ্যাপেণ্ড, ডর?

ডরোথি চোখ মেলে অরুণকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অরুণ দ্রুত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল, বলল—কাঁদছ কেন, বলো কী হয়েছে।

ডরোথি ওর মাথার ওপর রাখা অরুণের হাতটা দু-হাতে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, অরু, আমার ভয় করছে।

কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না অরুণ, জিজ্ঞেস করল, ভয়? কীসের ভয়? একটা থমথমে গলায় ডরোথি বলল, নিজেকে।

অরুণ তো আকাশ থেকে পড়েছে, নিজেকে! কেন?

—মনে হচ্ছে বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাই।

-কারণ?

–টোনি, ক্লাইভের ওই নির্লজ্জ বউটার সঙ্গে ফেঁসেছে।

–সে কে?

সিলভি।

অরুণের মাথায় কিছুতেই এল না এত ফাঁসাফাঁসির কথা উঠছে কেন। মোটে তো আধ ঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের দেরি। ও ডরোথিকে ঠাণ্ডা করার জন্য বলল, তুমি ওসব চিন্তা ছাড়ো। তুমি চান করে তৈরি হয়ে নাও, আমি টোনিকে ডেকে আনছি। আমার যেতে-আসতে পনেরো মিনিটও লাগবে না।

ক্লাইভদের বাড়ি যেতে যেতে কত অদ্ভুত দৃশ্য চোখে ভাসল অরুণের। ছাদের ঘরে ও পড়তে বসলেই কত নাচগান, হইহল্লার আওয়াজ ভেসে আসে ক্লাইভদের ফ্ল্যাট থেকে। মাঝে মাঝে চিলেকোঠার জানালা খুলে কিছু দৃশ্য দেখে অরুণ। হাতে মদের গেলাস নিয়ে নেচে চলেছে ক্লাইভ, সিলভি, জেমস, এস্থার, এডি, পার্সি, নোয়েল, রিচি, বেলিণ্ডা। এ এক মস্ত দল ওদের, যখনই দেখবে কীরকম পার্টির মেজাজে। বিশেষ করে সিলভির হাঁটাটাই তো নাচ। অরুণ শুনেছে ও নাকি ‘ইজায়াস’ বার-এ রোজ সন্ধেয় গান গাইতে যায়। আর ক্লাইভ যে কী করে সেও এক রহস্য। অত হ্যাণ্ডসাম, টিপটপ, ফুলবাবুটি অ্যাংলোদের মধ্যে আর কে আছে? সারাক্ষণ সিগারেট ফুকছে, শিস দিচ্ছে, মুখে বিলেত আমেরিকা ছাড়া কথা নেই। মেয়েদের নাকি চোখের মণি। সুককে পাওয়ার আগে ডরোথিরও নাকি ‘ক্রাশ ছিল ওর ওপর। তারপর হঠাৎ একদিন স্বর্গ থেকে সিলভিকে পেড়ে নিয়ে এল ক্লাইভ। এ সবই ডরোথির মুখে শোনা কথা। একেক সময় আপনমনে পাড়ার অ্যাংলোদের কীর্তিকলাপ শুনিয়ে যায় ডরোথি। আর অরুণ সেসব আরব্য রজনীর কাহিনির মতো গোগ্রাসে গেলে।

এখন মিন্টো লেনের ওই বাড়িটার দিকে যেতে যেতে আচমকা একটা ভাবনা এল অরুণের। আচ্ছা, সিলভি না হয় খুব সুন্দরী, দারুণ নাচে, গায়। তাবলে ক্লাইভের মতো অত হ্যাণ্ডস্যাম একটা বরকে ছেড়েও সুকের পাল্লায় পড়বে কেন? সুকের গায়ের রং সাহেবি ঠিক আছে। ওর চোখ জোড়া নীল—ঠিক আছে। ও এরোপ্লেনের মেন্টেন্যান্সে আছে—ঠিক আছে। সারাক্ষণ টাকায় টাকায় ওর পকেট ভারী থাকেনা, এইখানে এসে অরুণ একটু থমকে গেল। সিলভি তো টাকাপয়সা ভালোবাসেই, টাকা ওড়াতেও ভালোবাসে…তাই বলে টাকার জন্যে?…আর ডরোথির মতো বউ থাকতে সুক…? অরুণের সমস্ত ভাবনাচিন্তাগুলো কখন কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। ওর চটকা ভাঙতে ভাঙতে দেখল ও ক্লাইভ, সিলভিদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

নতুন করে কোনো ভাবনা আসার আগেই অরুণ বেল টিপে দিয়েছে। তারপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।

ফের বেল টিপল অরুণ; কিন্তু সাড়া নেই।

ফের বেল, ফের সেই নিস্তব্ধতা।

অথচ ও জানে সুক এখানে আছে। একটু একটু করে ওর মধ্যে ডরোথির ভয়, দুঃখ, রাগগুলো ছড়াতে লাগল। ও হয়তো সেই রাগেই হঠাৎ বিকট চেঁচিয়ে উঠল—টোনি! তার খানিক পর ফের—টোনি! শেষে মরিয়া হয়ে শেষবারের মতো—সিলভি! কোনো ডাকেই কোনো সাড়া না পেয়ে এবার মনে মনে, নিঃশব্দে অ্যাংলোদের প্রিয় গালটা উচ্চারণ করল–বাস্টার্ড! আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছেই নিজে লজ্জায় পড়ে গেল। ও মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল, কিন্তু ডরোথিদের বাড়ি গেল না। চুপি চুপি বাড়ি ফিরে চিলেকোঠায় ওর পড়ার ঘরে ফিরে বন্ধ জানলার একটা মাঝারি ফাটল দিয়ে চেয়ে রইল বাড়ির পিছনে সিলভিদের ফ্ল্যাটের দিকে।

কিছুই সত্যি দেখার নেই, সিলভিদের বসার ঘরটা এমনিই পড়ে আছে। না চলছে। রেডিয়োগ্রাম, না বসে কেউ কোনো সোফায়, না চলছে ফ্যানও। ঘরের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো যেটা অরুণদের বাড়ির দিকে খোলে তা হাট করে খোলা। তা থেকে লোহার স্পাইরাল সিঁড়িটা দিব্যি নেমে এসেছে একতলায়, কিন্তু সে সিঁড়িও অলসভাবে ঘুমিয়ে আছে, তার কোনো ধাপিতেই কোনো বেড়ালও শুয়ে নেই। অরুণ জানালার গর্ত থেকে চোখ সরিয়ে আনতে যাচ্ছিল যখন ওর নজর টানল একটা সামান্য জিনিস রেডিয়োগ্রামের ওপর রাখা সুকের প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স সিগারেটের পঞ্চাশের কৌটো। গোল টিন, আজ সকালেই সুকের হাতে দেখেছে ও। হাতে মোটা ক্যাশ এলেই এরকম রকমারি বিলিতি সিগারেটের আবির্ভাব হয় সুকের হাতে, বুক পকেটে, সাইডপকেটে। শুধু রনসনের সিগারেট লাইটারটা একই থাকে। সেই লাইটারটাও, অরুণ দেখল, দিব্যি শোভা পাচ্ছে সিগারেটের টিনের পাশে।

অরুণের গলার কাছটা কীরকম ব্যথা-ব্যথা করতে লাগল, ও চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে ছাদের উলটোদিকের আলসেতে গিয়ে দাঁড়াল। দেখতে চাইল ডরোথিদের বাড়ির কী দশা। দেখল সেখানেও সেই একই হাল, রোববারের দুপুরে নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। অরুণ। ভাবল ডরোথি নিশ্চয়ই চান সেরে সেজেগুঁজে গালে হাত দিয়ে বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। তাহলে ওর কি গিয়ে ওর সঙ্গে আহ্লাদের লাঞ্চটা সেরে ফেলা উচিত না? বিশেষ করে যে মধ্যাহ্নভোজে ওর পোর্ক ভিন্দালু পদে হাতে খড়ি হবে?

পর্ক ভিন্দালুর কথাটা মনে আসাতে বেশ একটা টান বোধ হল অরুণের। আর তার পরেই কীরকম একটা ভয়মিশ্রিত দ্বিধা। কী করে জানাবে মেয়েটাকে যে অত ডাকাডাকিতেও সাড়া দেয়নি সুক। কিংবা ছাদ থেকে ও দেখেছে সুকের সিগারেট আর লাইটার পড়ে আছে সিলভিদের গ্রামের ওপর। এই ভয় ও দ্বিধায় ওর খিদেটাও একটু একটু করে মরে এল, ও মা-র কাছে গিয়ে দুপুরের খাওয়ার কথা বলল না। ওর চিলেকোঠার ঘরটাকেই গোঁসাঘর করল, তার মেঝেতে মাদুরের ওপর শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ল।

ওর ঘুম ভাঙল দূর থেকে ভেসে আসা আবছা এক চিৎকারে—আগুন! আগুন!!

প্রথম প্রথম ওর মনে হয়েছিল স্বপ্নের মধ্যেই কিছু শুনেছে হয়তো। পরে প্যাট প্যাট করে বাইরে গোধূলির আকাশের দিকে চেয়ে স্পষ্ট শুনতে পেল ওই হল্লা। তখন ও ছুট্টে ছাদের ওপারে গিয়ে দেখল পাড়ার ছেলে, ছোকরা, বয়স্ক, সবাই নানা সাইজের বালতিতে জল নিয়ে ছুটছে ডরোথিদের বাড়ির ভেতর। মুহূর্তে বুকটা হিম হয়ে গেল অরুণের। ও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল ডরোথিদের বাড়ি যাবে বলে। তাড়াহুড়োতে বার দুয়েক হোঁচট খেল ছাদের সিঁড়িতে, শেষে পৌঁছোল যখন ওপারের বাড়িতে লীলা শেষ। সুকের দামি জামাকাপড়ের স্কুপে কেরোসিন ঢেলে দেশলাইয়ের আগুন লাগিয়ে গোটা বাড়িটাই পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল ডরোথি। আগুনের শিখা যখন সিলিং ছোঁয় তখনই অকুস্থলে হাজির নাটের গুরু আঁতোয়ান সুক। প্রথমে এক হ্যাঁচকা টানে বউকে ফ্ল্যাটের বাইরে ফেলে ইলেকট্রিকের লাইনটা অফ করে ও। তারপর বাথরুম থেকে জল এনে ঢালা শুরু করে। এক বিচ্ছিরি অগ্নিকান্ডের বিরুদ্ধে একা লড়ছিল ও, তাও বেশ কিছুক্ষণ। কার্পেট চাপা দিয়ে এক কোণের আগুন চাপতে গিয়ে হাতও পোড়াল। তখনই নাকি ডরোথি চিৎকার জুড়ে দেয় ফায়ার! ফায়ার!!

ডরোথির ‘ফায়ার! ফায়ার!!’ চিৎকার পড়শিদের মুখে ‘আগুন! আগুন!!’ হয়ে ছড়াতে লাগলে বালতি বালতি জল আসা শুরু হল। কেউ জানতেও চাইল না আগুন ধরল কীভাবে অ্যাংলোদের ঘরদোরে, এ আর নতুন কী! কিন্তু সাধের ফ্ল্যাট আগুনে পুড়ছে, জলে ভাসছে দেখে হাউ হাউ কান্না ধরল ডরোথি। ঠিক তক্ষুনি সেখানে ভিড়ের একজন হয়ে এসে দাঁড়াল অরুণ।

আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিতে ‘আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি’ কথাটায় এতগুলো ছবি ও ঘটনা এসে গিয়েছে অরুণের ভাবনায়। আপনমনে কটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছে কে। জানে। ফের একটা ধরাল ও, আর দেশলাইয়ের কাঠিটা বাইরে ছুঁড়তে গিয়ে খেয়াল করল আশপাশের আরও অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে। একটা থমথমে অন্ধকার রাত মুড়ে ফেলেছে শহরটাকে, একটা ভারী মেঘ ঢেকে দিয়েছে এক ফালি চাঁদকেও।

অথচ অরুণের চোখে ঘুম নেই। সুকের ডায়েরি ওর ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসেছে। সেখান থেকে ফের ওকে পড়া শুরু করতে হবে। ও ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ফের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এসে থেমে পড়ল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫-এ। পাতার মাথায়

সুকের নিজস্ব হেডলাইন ‘লোকাস্টস ব্রিংগ লাভ অ্যাণ্ড ফায়ার’। পঙ্গপাল নিয়ে এল প্রেম ও আগুন। সুক লিখেছে—

৪.

পঙ্গপালের ঢেউ বয়ে গেল মিন্টো রো-এর ওপর দিয়ে আজ। সাত সকালে ঘোর অন্ধকার, বাইবেলে যেমন দিনের বেলার অন্ধকারের কথা আছে এখানে ওখানে। ঠিক কোথায় বলতে পারব না। আমার তাতে অবিশ্যি অসুবিধে নেই, আমি তো একপ্রকার অন্ধকারেরই জীব। অন্ধকার আমার জন্য ভালো ব্যাপার-স্যাপার ঘটায়। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে। আজও তাই, যদিও শেষটা গোলমেলে হয়ে গেল।

আকাশটা যখন কালো হয়ে গেল আমি অরুর গলার শব্দ পেলাম। আমার ওকে আজ বড়োই দরকার ডরোথিকে সামলানোর জন্য। ডর পর্ক ভিন্দালু করতে চায় শুনে বললাম, অরুকে খেতে বলো আজ। ওকে তো ভিন্দালু খাওয়ানোর কথা আছে। ডর রাজি হতেই সুযোগটা এসে গেল। সিলভি কালই বলেছিল রোববার সকালে ক্লাইভ একদিনের জন্য খড়গপুর যাবে ওর অসুস্থ মাকে দেখতে। সো দিস ইজ আ গ্র্যাণ্ড চান্স, আমি বুঝে গেছিলাম। সিলভিকে কিস্যু বলিনি, তাহলে ও চিল্লামিল্লি করত। জানি ও আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু কোনো সুযোগ দেয়নি এতকাল। একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমার প্রিয়তমা ডরোথি ছাড়া এত ঝামেলায় কেউ ফেলেনি আমায়। অথচ সেক্সি এবং গ্ল্যামারাস সিলভি সম্পর্কে কী উদ্ভট ধারণা সবার। যেন তুড়ি দিলেই উঠে আসবে!

একটা বিশ্বাস আমার ছিলই—ক্লাইভটা বলতে গেলে কিছুই করে না, তাই ওদের ওখানে পয়সা লড়াবার সুযোগ আছে। দুটো রামের পাঁইট আর এক প্যাকেট প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স দিলে ছোকরাকে বাগে পাওয়া যায়। কিন্তু সিলভি? ওকে কিছুতেই বুঝতেই পারি না। কাজেই আজকের দিনটাকেই কাজে লাগাতে হবে। না হলে আর কবে হবে?

মনটা খচখচও করছে। প্রমোশন সেলিব্রেট করার জন্য পার্টি, অথচ ঠিক তক্ষুণি এই সুযোগ, যা হাতছাড়া করা পাপ আমার মতো পুরুষ মানুষের পক্ষে, তাই অরুকেই কাজে লাগাতে হল। বড্ড ভালো ছেলে, ভেরি ইনোসেন্ট। আজ কিস্তিমাত হলে ওকে কাল একটা পাইলট পেন কিনে গিফট করব। ও খুব পেন ভালোবাসে।

আমার বিশ্বাস অরুণ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। বেচারা জীবনে প্রথম পর্ক ভিন্দালু খাওয়ার স্বপ্নে মজে আছে। আমার কেনাকাটাগুলো খুব মন দিয়ে দেখছে। তবে ওকে কিছুতেই সিলভিদের বাড়ি অবধি নিয়ে যাওয়া যাবে না। ডরোথি ওকে ক্রস করে কী বার করে ফেলবে গড ওনলি নোজ।

জগরুর সঙ্গে অরুণকে বাড়ির দিকে পাঠিয়ে সিলভিদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি আমার প্যালপিটেশন বেড়েছে। মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের মোলাকাতে এটা আমার হয়, জানি। ঘড়ি দেখতেও সাহস হচ্ছে না, কে জানে বেল টিপতে হয়তো ব্যাটা ক্লাইভই স্বশরীরে বেরিয়ে এল! এই সব ফষ্টিনষ্টির খেলায় এ তো আকছারই হয়। সেদিক দিয়ে আমি পোড় খাওয়া পাবলিক। যদিও আমার সাকসেস রেটও কিছু খারাপ না, এও বলতে পারি। আসরানি তো আমাকে সোহাগ করে মাদারফাঁকার বলে; বলে এ ছেলে মাকেও ছাড়বে না। আমি মিটিমিটি হাসি, ভাবি এই বিশ্রী, সাংঘাতিক গালিটাও আমার জীবনে সত্যি হয়েছে। তা তো আগেই, জায়গামতো লিখেওছি। যাকগে সেসব পুরোনো কেচ্ছা। এই মুহূর্তে আমি সিলভিদের ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে ক্লাইভকে দেখবার আশঙ্কায় আছি। দরজা খুলল…

না, ক্লাইভ বেরিয়ে আসেনি; সিলভিও না। বেরোল সিলভিদের বুড়ি নোকরানি উসরা। মাগিটাকে আমার একদম পছন্দ নয়। সিঁড়িঙ্গি বুড়ি সারাক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে আছে। দশটা প্রশ্নের জবাব দেয় একটা। চোখে-মুখে সারাক্ষণ সব্বাইকে সন্দেহ। পার্সি বলে ক্লাইভ ওটাকে রেখেছে সিলভির ওপর নজরদারি করার জন্য। দরজা খুলে উসরা তাই কিছুক্ষণ আমাকে মাথা থেকে পা অবধি দেখল। তারপর একটিও কথা না বলে ফ্ল্যাটের দরজার খিল এঁটে বসার ঘরের ওপারের স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে টুকটুক করে নেমে গেল। আমি একটা খোলা খালি ফ্ল্যাটে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝলাম না বাড়ির মালগুলো গেল কোথায়। ক্লাইভ না হয় খড়গপুরে গেছে, কিন্তু সিলভি? বেলা এগারোটার পরও নিশ্চয়ই বিছানায় গড়াচ্ছে না!

আমি আমার টিন থেকে একটা প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স বার করে ধরিয়ে সিলভিদের সোফাটায় বসলাম। আরামসে কয়েকটা টান মারতে মগজটা খুলল। তাই তো! বেডরুমে একবার ঢু মারলে তো হয়। জাস্ট ইন কেস।

আমি অ্যাশট্রেতে সিগারেট নিভিয়ে, টিন আর লাইটার গ্রামের ওপর রেখে, আস্তে করে সিলভিদের বেডরুমের দরজাটা ঠেললাম। আর অমনি একটা ঘুরঘুট্টিB অন্ধকার এসে ধাক্কা মারল। কে বলবে এত বেলা বাইরে? শোবার ঘরের সব জানালার পর্দা পুরো পুরো টানা। নো নাইট বালব, নাথিং। আলো থেকে ঢুকে আমি চারগুণ বেশি অন্ধকার দেখতে থাকলাম। তাই খুব মৃদু গলায় ডাকলাম, সিলভি! কোনো উত্তর নেই।

আমি হাতড়ে হাতড়ে বিছানার ধারে গেলাম। ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সিলভি শুয়ে আছে কি না। শ্বাস-প্রশ্বাসের একটা হালকা আওয়াজ কানে এল। সেই শব্দটাকে লক্ষ করে হাত নিয়ে এদিক-ওদিক করতে সিলভির মুখের স্পর্শ পেলাম হাতে। আর সঙ্গে সঙ্গে সারাজগৎ উলটে গেল আমার। আকাশের চাঁদ এখন আমার হাতে, পৃথিবী উলটে গেল কি না তা দিয়ে আমার কী এল-গেল। ওর ঘোর অন্ধকারের মধ্যে গা থেকে সমস্ত কাপড়চোপড় খসিয়ে আমি কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আদম সেজে বিছানার ভেতর আমার ইভের সন্ধানে সেঁধিয়ে গেলাম। আমার তলপেটটা তখন ভিসুভিয়াসের জাগ্রত আগ্নেয়গিরি!

আমি ওর অপূর্ব বুক দুটোয় হাত বুলিয়ে জাগালাম সিলভিকে। কোনো নতুন বুকজোড়ায় হাত পড়লে মনে হয় যেন নতুন কোনো পাহাড়চুড়োয় উঠলাম। সেই শৃঙ্গজয়ের উল্লাসে আমি সিলভির নগ্ন দেহের ওপর চড়ে আমার ব্যারিটোন ভয়েসে ডাকতে লাগলাম, সিলভি! সিলভি মাই ডিয়ার!

সিলভি কোনো উত্তর দিল না, শুধু দু-হাতে কী এক অদ্ভুত শক্তিতে আমায় জড়িয়ে ধরে সারা মুখে অবিশ্রান্ত চুমু দিতে লাগল। এক-আধবার ঠোঁটে দারুণ কামড়ও দিল, কিন্তু আমি চট করে ছাড়িয়ে নিলাম। মেরুনিসার ঠোঁটের কামড় নিয়ে বাড়ি ফিরে কী কম ঝামেলায় পড়েছি! ডর, আমার প্রিয়তমা, ডর, সেবার জ্বলন্ত সিগারেট চেপে সেই জায়গাটায় বলেছিল, ফের এরকম ঠোঁট নিয়ে ফিরলে ঠোঁটটাই কুপিয়ে দেব।

সে যাকগে এখন সিলভি রীতিমতো বাঘিনি। অন্ধকারে দুটো আদিম জন্তুর মতো একে অন্যকে ছিঁড়ে খাচ্ছি। বালিশ ফেটে তুলো উড়ছে ঘরময়, আমরা কখনো বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো ছিটকে পড়ছি নীচের কার্পেটে। আর সবটাই জোড়ায় জোড়ায়। কীভাবে যে দুটো শরীর মিশে এক হয়ে গেছে সঙ্গমে জড়ানো সাপের মতো বুঝতেও পারছি না। আমি আবেগের বশে বেজায় চেঁচাচ্ছি, সিলভি কিন্তু চুপ! কে বলবে সন্ধ্যেবেলায় এই মেয়েই গান গেয়ে মাতিয়ে রাখে ইজায়াস বার।

এক সময় আমারও আওয়াজ থেমে গেল, আমার শরীর শান্ত হয়ে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল সিলভির ঘর সেই অন্ধকার, কিন্তু বিছানায় সিলভি নেই। আমি ওই অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে কাপড়চোপড়, জুতোমোজা পরলাম। তারপর দরজা ঠেলে বসার ঘরে পা রাখতেই সামনের সোফায় দেখলাম ব্রা আর প্যান্টি পরে সিগারেটে ফুক দিচ্ছে সিলভি নয়, ব্ৰেণ্ডা! ক্লাইভের বেস্ট ফ্রেণ্ড এডির বউ, যাকে ক্লাইভরা আড়ালে ডাকে ক্যালকাটাজ হিপেস্ট হোর! শহরের তারকা পতিতা। আবার তলে তলে সব্বাই-ই ওর সঙ্গে বিছানার যাবার তাল কষে। ব্ৰেণ্ডার বান্ধবীদের দিনে তিন ঘণ্টা নিট যায় স্বামীদের পাহারা দিতে, যখন ব্ৰেণ্ডা ধারেপাশে আছে। সেই ব্ৰেণ্ডা! সে কী করে এখানে এল, একেবারে সিলভির বিছানায়?

কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ব্ৰেণ্ডাই জিজ্ঞেস করল, কীরকম লাগল ব্যাপারটা টোনি?

কোনো উত্তর দেবার আগে ও-ই বলে দিল, সিলভি বলেছিল তুমি ওকে তাক করেছ আজকের জন্য, কারণ ক্লাইভ থাকছে না। ও তাই ক্লাইভকে সি-অফ করে আমাদের ফ্ল্যাটে চলে গেছে, আর আমি এখানে।

—আর তুমি এখানে মানে?

—সিলভি চায় না, তাই সিলভির হয়ে প্রক্সি দিলাম।

–প্রক্সি দিলে? তার মানে এই লাভমেকিং…

—হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম। পাইলটদের মাটিতে ফেলতে আমার ভালো লাগে।

–তাই? আর পাইলটরা পড়ে গেলে?

—তাদের ফের আমি ওড়াই।

–তাহলে আমিও উড়ব?

—শিওর! এরপর কারও প্রক্সি হিসেবে নয়, পরিষ্কার ব্ৰেণ্ডা হিসেবে। রাজি?

আমি কিছু বলার আগে ফের বলল ব্ৰেণ্ডা, কিছুটা যেন আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে—ডোন্ট ওরি! সিলভির পিছনে ছুটে কাজ নেই, ও তোমাকে চায় না।

জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সেটা নিশ্চিত জেনে গেছ?

ও বলল, হ্যাঁ।

—কীরকম?

–ও বলেছে আমাকে, টোনিকে আমি বিশেষ পাত্তাটাত্তা দিই না। ও ক্লিংগজ, শর্ট অ্যাফেয়ার্স, ছুটকো-ছাটকা প্রেমটেম বোঝে না। ও খুব লম্বা সফর পছন্দ করে ভালোবাসায়।

এই সময় আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, হোয়াট ননসেন্স! আমার অনেক ছুটকো-ছাটকা কেস আছে, ও কী মনে করে আমাকে, ইনোসেন্ট পাদ্রি? আমার একটাই লম্বা সফর ডরোথি। কিন্তু আমি প্রায়ই ওর বিশ্বাসে আঘাত দিই। আমার হ্যাবিট ওইটা।

একটা লম্বা রিং ছাড়তে ছাড়তে ব্ৰেণ্ডা বলল, তাই বলেছিলাম ওকে একবার টোনিকে। আমার হাতে ছেড়ে দ্যাখ, ওকে মানুষ করে দেব। তাই…।

সিগারেটের টিনটা ব্ৰেণ্ডাকে দিয়ে দিলাম, জিজ্ঞেস করলাম একটা ড্রিঙ্ক কিনবে না? ও মাথা নাড়তে একশোটা টাকাও দিলাম, তারপর বললাম, সিলভি এতক্ষণ কী করছে

তোমাদের ওখানে? ও বলল জানি না। নিশ্চয়ই বোরড হচ্ছে খুব। কেউ তো নেই।

-কেন, তোমার বর?

–ও জাহাজে? হয়তো কোনো পোর্টে পরিদের মাঝখানে।

—ও, বেশ চাল খেললে তোমরা তাহলে?

–নাও গেট লস্ট। ঢের হয়েছে। এখন ওকে ডেকে আনি। লাঞ্চও তো খাইনি কেউ। সিলভিদের ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে লজ্জায় শিস দিয়ে ফেললাম। লাঞ্চ খাইনি আমিও তো। সেই সঙ্গে ডর আর অরুও হয়তো…

আমি জোরে পা চালালাম বাড়ির দিকে এবং এসে ঢুকলাম এক আগুন থেকে আরেক আগুনে…

অ্যাদ্দুর এসে অরুণ কিছু অংশ টপকে গেল, অগ্নিকান্ডের যেসব বৃত্তান্ত ওর স্বচক্ষে দেখা। ওই দ্রুত টপকে যাওয়ার মধ্যেও টের পেল সুক যা বলে তাতে বানানো, ফলানো ব্যাপার কিছু নেই। অথচ একটা পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর যত আশ্চর্য কান্ড দেখা যায় ওর জীবনেই ঘটে। যেমন লিখছে—

আগুন নিভল বটে, কিন্তু আমার হাতের জায়গায় জায়গায় ঝলসে গেল। ক্যাম্বেল হসপিটালে গিয়ে ট্রিটমেন্ট হল। আমার ওপর তলার সিরিল আর মার্লিন আমাদের থাকতে বলল ওদের ফ্ল্যাটে। ওদের ওখানেই খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত দেড়টায় যখন ঘুমোবার জন্য লাইট নেভানো হল তখনও সকালের ব্যাপারটা নিয়ে ডরোথি একটাও কথা বলেনি। যেই পাশে এসে শুল অমনি প্রথম প্রশ্ন, সিলভিদের সঙ্গে কী করছিলে?

আমি অবাক স্বরে বললাম, সিলভিদের বাড়ি গেছলাম ঠিকই কিন্তু সিলভি ছিল না।

–তার মানে তাই, সিলভি ছিল না।

আশ্চর্য, সিলভির জায়গায় কে ছিল সেটা আর জিজ্ঞেসও করল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একবার সেই কান্নার মধ্যেই বলল, আমার গলার ক্রস ছুঁয়ে বলো সিলভি ছিল না!

আমি ক্রস ছুঁয়ে বললাম, না ছিল না।

আর ডরোথির কান্না থেমে গেল।

এরপর ও আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, আই লাভ ইউ, টোনি।

আমি বললাম, আই লাভ ইউ টু, ডর।

একই দিনে দুটো ভালোবাসা আমার পাওনা হল। একটা ডরোথির, যেটা নতুন করে, হাত পুড়িয়ে, পেলাম। আরেকটা সিলভির। সিলভি আমাকে এক রাতের খদ্দের মনে করেনি। বলেছে লম্বা সফরের প্রেমিক। এই বলাটাই তো ভালোবাসা।

আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ, সারাগায়ে ব্যথা, তবু গভীর রাতে আমি আর ডর প্রেম করলাম। আমি হাত বাঁধা কয়েদির মতো চিৎ হয়ে শুয়ে, ও আমার ওপরে ইংল্যাণ্ডের মেয়ে জকিদের মতো সওয়ার। আই হ্যাভ ফাউণ্ড লাভ!

এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়েরিটা বন্ধ করে, টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে অরুণ শুয়ে পড়ল। কাল দশটায় ফের অফিস, কখন ফিরবে জানে না, ফেরাটা তো সাংবাদিকদের রুটিনে লেখা থাকে না। তবু মনে হল ফেরার মুখে একবারটি ডরোথিদের বাড়ি ঘুরে এলে মন্দ হয় না। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে মাথার মধ্যে। বিশেষ করে একজনকে নিয়ে একটা প্রশ্ন : সিলভি।

হাজারো প্রশ্নের ওঠাপড়ার মধ্যে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।

৫.

এক বোতল অ্যারিস্টোক্র্যাট হুইস্কি আর দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস সিগারেট নিয়ে গিয়েছিল ডরোথির জন্য। ডরোথি সেই হুইস্কিই সার্ভ করছে দু-জনের জন্য। ইতিমধ্যে ওর বোবাকালা কাজের মেয়ে বিন্দিয়া এসে ক-প্লেট ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে দিয়ে গেছে টেবিলে। একটা প্যাকেট খুলে ডরোথির দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়েছে অরুণ। ডরোথি সিগারেট নিয়ে ওর হুইস্কির গেলাস তুলে বলল ‘চিয়ার্স!’

অরুণও ‘চিয়ার্স!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন এক স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে গেল ওর মনটা। ডরোথি সিগারেট ধরিয়ে হুট করে উঠে গিয়ে গ্রাম চালিয়ে দিয়ে বলল, ফর ওল্ড টাইমজ সেক। আর রেকর্ড থেকে ধ্বনি উছলে উঠে গোটা ঘরটাকে ভরিয়ে তুলল। সারাঘর জুড়ে ভাসতে লাগল ন্যাট কিং কোলের জলদগম্ভীর রোম্যান্টিক গলার ফ্যাসিনেশন’।

গ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাসে প্রথম চুমুকটা দিতে দিতে ডরোথি বলল, টোনির সবচেয়ে প্রিয় গান।

অরুণ গেলাসে সিপ দিয়ে বলল, আমারও।

ডরোথি বলল, তা কি আমি জানি না?

অরুণ হাসতে হাসতে বলল, সবই জান দেখি। শুধু জানলে না বেচারা টোনিটা কোথায় হারিয়ে গেল।

ডরোথি যেন কথাটা শুনেও শুনল না। নিজের সোফায় এসে বসতে বসতে বলল, গ্রামটার যা দশা হয়েছিল। তাই ইলেকট্রিশিয়ান যুগলবাবুকে দিয়ে সারিয়ে সাফ করে ফের চালু করলাম। চল্লিশ টাকা গচ্চা গেল ঠিকই, তবু তোমাকে এখন গান শোনাতে পারছি। মনে হয় এক যুগ পরে এ ঘরে গান বাজছে। কী জানি সত্যি কতদিন!

এরপর দু-জনে চুপ করে ডুবে রইল ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন-এ। গানটা শেষ হতে হুইস্কিতে দ্বিতীয় সিপ দিতে দিতে উঠে গিয়ে গ্রামটা বন্ধ করে দিল ডরোথি। আর ফিরে এসে সোফায় বসল, সো? কীরকম বুঝলে টোনির লেখাগুলো?

প্রায় আপনা আপনি অরুণের মুখ গলে বেরিয়ে এল, ফ্যাসিনেটিং!

ওর তারিফে চমকে গেছে ডরোথি—বলছ? রিয়্যালি!

অরুণ বলল, অ্যাবসোলিউটলি ফ্যাসিনেটিং!

ডরোথি সহসা বুঝে উঠতে পারল না এরপর কী বলবে। শেষে খুব দ্বিধার স্বরে জিজ্ঞেস করল, ওটা দিয়ে কিছু করা যাবে ভাবছ?

অরুণ, এবার খুব সপ্রতিভ, কেন না? তবে তুমি যা ভাবছিলে তা-ই হবে। আমি ওগুলো নিয়ে কোনো নিউজপেপার ফিচার করছি না। খুব আলাদা গোছের একটা লাভ স্টোরি লিখব।

সঙ্গে সঙ্গে ‘ওয়াও!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডরোথি আর কেঁদে ফেলল। হাতের গেলাস নামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, অরু এখন তো টোনি বলতে আমার কাছে ওই ডায়েরিগুলোই আর রেকর্ড। তুমি জানো টিবি-র লেট স্টেজে আমি এখন?

একটা ঠাণ্ডা হাওয়া সোঁ সোঁ করে বইতে লাগল অরুণের শিরদাঁড়া দিয়ে। মুখে শুধু বলতে পারল, কী বলছ কী, ডর?

ডরোথি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, একটা সিগারেটও আমার খাওয়া বারণ, জান?

-তাহলে খাচ্ছ কেন?

—কারণ আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এই যে তুমি বললে একটা লাভ স্টোরি লিখবে আমি সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করব। আই মিন ইট।

গলা ধরে এসেছিল অরুণের, তবু না বলে পারল না—কিন্তু আমি তো সেই প্রেমের গল্প লিখব বাংলায়, নট ইন ইংলিশ। তুমি কী করে পড়বে?

ডরোথি ফের হুইস্কিতে চুমুক সেরে বলল, কেন, তুমি এসে আমায় ট্রান্সলেট করে শুনিয়ে যাবে।

ফের এক প্রস্থ নিস্তব্ধতা ভর করল ঘরটায়। দু-জনে একটু একটু করে মদ আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেল। শেষে সন্ধের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়ে নীরবতা ভাঙল অরুণ। জিজ্ঞেস করল, আমার গল্প হতে গেলে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরও তোমায় দিতে হবে ডর? এগ্রিড?

—তাহলে বলো, টোনি কি সিলভির প্রেমে পড়েছিল?

প্রশ্নটায় ভালো রকম চমকে গেল ডরোথি। ফলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বেশ জড়তাভরা গলায় বলল, এর কোনো উত্তর হয় না, অরুণ। কখনো মনে হয় হ্যাঁ, কখনো মনে হয় না।

—কখনো হ্যাঁ মনে হয়?

—যখন ভাবি সিলভি যেদিন কলকাতা ছেড়ে পাকাঁপাকি ভাবে চলে গেল দিল্লির ইন্টারকনের ফ্লোর শো আর্টিস্ট হয়ে আর টোনিকে দেখতাম গুম মেরে বসে থাকতে।

-ওরা ফিজিক্যালি ইনভলভড ছিল মনে হয়?

–না, তা মনে হয় না।

–তাহলে ওই ইনফ্যাচুয়েশন, প্ৰেমান্ধতা কেন?

—কারণ ওর একটা বদ্ধ ধারণা জন্মেছিল সিলভি ওকে ভালোবাসে।

চকিতে অরুণের মনে পড়ল সেই পঙ্গপাল আক্রমণের দিনে ব্ৰেণ্ডার মুখে শোনা কথাটা। ও জিজ্ঞেস করল, সিলভি যে ওকে ভালোবাসে সেটা ওর মাথায় ঢুকল কেন?

ডরোথি বলল, আমার জন্য।

-তোমার জন্য! কেন?

—কারণ মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে যেটা ছেলেরা পারে না। নানা জায়গায়, নানা পার্টিতে দেখে আমি টের পেতাম যে, মেয়েটার ভেতর একটা সার্টেন রেসপেক্ট আছে টোনির জন্য। অন্যদের থেকে একটু আলাদা করে দেখত। যেটা আমার ভালো লাগত না, ভয় লাগত।

—আর সেটা টোনি বুঝত?

—হয়তো। নাহলে আমার সামনে সিলভির নাম নিতে গলা ভেঙে যেত কেন।

–বুঝলাম। আর?

—আরেকটা কথা কি জান? টোনি কোনোদিন ইজায়াস বার-এ সিলভির গান শুনতে যায়নি। কোনোদিন। একবার আমি খুব জোরাজুরি করেছিলাম, কিছুতেই রাজি হল না। উলটে ঢের বেশি পয়সা খরচা করে শেহরাজাড-এ স্যাণ্ডি হল্যাণ্ডের গান শোনাতে নিয়ে গেল।

–কারণ?

–কারণ ও যাকে মনে মনে অতখানি চায় সে সবার জন্য প্রেমের গান গাইছে সেটা সহ্য হবার নয়।

—অথচ তোমাকে বলত এত সুন্দর শরীর শুধু একজনের ভোগে লাগা উচিত নয়।

ডরোথি এবার ওর সেই হা হা হি হি রুপোলি হাসিতে ভেঙে পড়ল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, দ্যাট টোনি ওয়াজ সাম ক্যারেক্টার। আমি এখনও ওকে বুঝিনি সত্যি।

অরুণ চুপচাপ খানিকক্ষণ স্মোক করল। সিগারেটটা শেষ করে নিভিয়ে ফের চুমুক দিল ড্রিঙ্কে, তারপর জিজ্ঞেস করল, আর কখন তোমার মনে হয় সিলভির সঙ্গে টোনির সে অর্থে কোনো প্রেম ছিল না?

ডরোথি এবার খুব দ্রুত উত্তর দিল, যখন তোমার দিদি শমিকে লেখা ওর চিঠিগুলোর কথা ভাবি।

ঘরের মধ্যে বাজ পড়ল যেন বিনা মেঘে। শমিকে লেখা টোনির প্রেমপত্র ডরোথি পড়েছে? তাতে কী ছিল? সে-সব ও পেলই বা কী করে?

অরুণ এসবের কিছুই জানে না। বাড়িতে কখন যে কী ঘটে গেছে কোনো আঁচ পায়নি ওই কিশোর বয়সে। শুধু মনে আছে এক রাতে দিদিকে বেদম প্রহার মা আর কাকা মিলে। থেকে থেকে কাকার প্রবল হুঙ্কার—কনভেন্টে পড়ে এই উপকার হল! বিলিতি শিক্ষার এই নমুনা। দুর করে দোব বাড়ির থেকে অপদার্থ মেয়ে কোথাকার!

পাশের ঘরে ভয়ে কান্নায় একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল অরুণ। কেন যে হঠাৎ দিদিকে নিয়ে এত হল্লা বাড়িতে তা বোঝার ফুরসত মেলেনি। তবে তার পর থেকেই দিদির ওবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। আর তার ক-দিন পর এক ঘটনা ঘটল যার কোনো মানে মাথা বুঝে পায়নি অরুণ সে সময়, আজ যেন তার কিছু খোলস ছাড়ানো যাচ্ছে। পাড়ার মাস্তান জগুদা হঠাৎ এক বিকেলে কাজফেরত সুককে ধরে বেদম ঠ্যাঙাল রাস্তার মাঝখানে। চুলের মুঠি ধরে চড়, দু-চারটে রদ্দা, তারপর গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতর ফেলে দেওয়া। এই মারের সঙ্গে ইংরেজি বাংলা হিন্দি মিশিয়েও কত সব বকাঝকা চালাচ্ছিল জগুদা, যা বাড়ির ছাদ থেকে বিশেষ শুনতে পায়নি অরুণ। শোনার মধ্যে একটাই গাল—সোয়াইন।

তবে সেদিনও একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হয়েছিল অরুণ। যা নিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করেনি ডরোথিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টোনির মার খাওয়া দেখল ও, কিন্তু প্রতিবাদ করল না। যা একেবারেই ওর সঙ্গে মেলে না।

অরুণ জিজ্ঞেস করল শেষে, শমিকে লেখা টোনির চিঠি তুমি পেলে কোত্থেকে?

ডরোথি বলল, টোনি চলে যাবার অনেকদিন পর শমিই এসে দিয়ে গেল চিঠিগুলো। বলল, এগুলো তোমার কাছে থাক, আমি অনেক চেষ্টা করেও পোড়াতে পারিনি। জিজ্ঞেস করেছি তোমরা কি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে ভেবেছিলে? শমি বলল—হ্যাঁ। ও ভীষণ, ভীষণ চাইছিল একটা সন্তান, যা তুমি ওকে দিতে পারনি। বললাম, কোথায় যেতে? শমি বলল—খুব দূরে কোথাও, যাতে আমার মা, কাকা, ভাইবোনদের কাছে আমার কোনো খবর কখনো না পৌঁছায়। যাতে ওরা ধরে নিতে পারে আমি মৃত। সেদিন আমি আর শমি দু-জনে দু-জনকে ধরে খুব কেঁদেছি। যাবার আগে শমি বলল, ডর, তোমার বন্ধুত্বের সম্মান আমি রাখতে পারিনি, আমায় ক্ষমা করো। আমি বলেছি, শমি, তুমি একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ে। আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। টোনির হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর জন্যই ওকে ত্যাগ করেছি আমি।

অরুণের সব প্রশ্নই প্রায় শেষ হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে না এরপর কী আর জিজ্ঞাস্য থাকে। তবু জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের নিয়ে এই রোগের কথা কখনো জানতে চাওনি ওর কাছে? ডরোথি বলল, জানতে চাইনি আবার! শুধুই বলত, ইটস অল ইন দ্য ব্লাড। রক্তের দোষ।

-মানে।

-মানে বাবার থেকে পাওয়া।

—সেই বাবাকে নিয়ে জানতে চাওনি?

–বলত সব লেখা আছে, পরে পড়ে নিয়ো।

–পড়েছিলে?

—তখন দেয়নি। বলত দিস ইজ পার্সোনাল। আমাকে প্রমিস করিয়েছিল আমি কখনো ডায়েরি ছোঁব না। ছুঁইওনি।

—তাহলে যাবার সময় ফেলে গেল কেন?

—সেটাই ইন্টারেস্টিং। রাগারাগি করে অন্তত এক ডজন বার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেকবার সুটকেসে বাইবেল আর ডায়েরি সঙ্গে করে। শেষবার কিন্তু ডায়েরিটা ফেলেই গেল। ভেবেছিলাম ডায়েরির জন্যও যদি বা আসে। তবে…

কী মনে করে ডরোথির কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল অরুণ–পরে কবে পড়লে তাহলে?

উত্তর এল—শমির চিঠিগুলো পড়ার পর।

—তখন কী মনে হল?

—মনে হল কারও ডায়েরি নয়, যেন একটা উপন্যাসই পড়ছি। যে উপন্যাসে আমি নিজেও একটা চরিত্র।

—যেটুকু যা পড়েছি তাতে আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে।

–তাই না?

-আমি অবাক হয়ে গেছি ওর গল্প বলার ক্ষমতা দেখে।

—একেক সময় মনে হয় ও নিজের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে পেত।

–ও কবে শুরু করল এই ডায়েরি লেখা? মনে পড়ে?

—আমাদের আলাপের সময়ই দেখেছিলাম একটা খাতা ভরতি হয়ে আছে।

–এখন যখন ডায়েরিগুলো পড়া আছে কোন জায়গাগুলো তোমার সবচেয়ে পছন্দের?

—যে-জায়গাগুলো আমি কালো কালিতে কেটে তছনছ করেছি।

চমকে গিয়ে অরুণ বলল, সে কী! কোন জায়গা ওগুলো? আর কাটলেই বা কেন?

ডরোথি বলল, শমির সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ারের জায়গাগুলো। ডায়েরির আর কোনো জায়গারই তুলনা হয় না তার সঙ্গে। দোজ প্লেসেজ ওয়্যার অলমোস্ট ডিভাইন। তুমি দেখতে পাচ্ছ টোনি যেন পুজো করছে শমিকে…ওরশিপিং হার, লিটেরালি ওরশিপিং শমি। আমার এত ভাল লেগেছিল, তবু মানতে পারিনি। শমিকে লেখা চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেললাম। পরে ডায়েরির ওই শেষ খন্ডটাও পোড়াতে গেছলাম। পারিনি। তাই কালি বুলিয়ে কথাগুলো নষ্ট করে দিলাম।

ডরোথির কান্না শুরু হল। জল আসছিল অরুণের চোখেও। ও চোখের জল মোছার চেষ্টাও করল না। দু-জনে কোনো কথা বলল না বাকি সন্ধ্যে, নীরবে ধূমপান আর মদ্যপানে কেটে গেল সময়টা। ওঠার মুখে অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্রশ্ন গুছিয়ে তুলতে পারল অরুণ। আচ্ছা, ডর, সুকের কাহিনি তাহলে কি ওর চলে যাওয়া দিয়েই শেষ হবে? গল্পটা খুব কষ্টের হবে তাহলে।

ডরোথি একটা ছোট্ট রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে বলল, কেন, গল্পের নায়িকা আমাকে দিয়েই তো শেষ হতে পারে। নায়কের স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে নায়িকা… কিংবা মারা যাচ্ছে!

এনাফ! বলে ধমকে উঠল অরুণ। ওভাবে কথা বললে আমি আর আসব না। ডরোথি ছেনালির হাসি হেসে বলল, তা কী করে হয়? আমাকে তো গল্পটা অনুবাদ করে শুনিয়ে যেতে হবে।

অরুণ গম্ভীরভাবে বলল, হুম! কিন্তু গল্পের তো শেষ দেখতে পাচ্ছি না।

ডরোথি বলল, পাবে, পাবে। মন দিয়ে শুরু করো। না হয় আবার আসবে।

তাই তো মনে হচ্ছে—বলে এক ঢোঁকে গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল অরুণ। শমির ব্যাপারটা হেঁটে দিয়ে বিপদ করেছ দেখছি।

কার বিপদ?—জিজ্ঞেস করল ডরোথি। তোমার না আমার?

দু-জনেরই-সংক্ষেপে জবাব দিল অরুণ।

কিছু না বলে নীরবে হাসল ডরোথি। অরুণ চলে যাচ্ছে দেখেও উঠে এল না দরজা অবধি। অরুণ খিল নামিয়ে দরজা খুলে ফেলেছে দেখে হঠাৎ বলে উঠল, অরু তুমি তো খুব পন্ডিত ছেলে, আমি তো কিছুই জানি না। তবে স্কুলে পড়া লর্ড টেনিসনের একটা কবিতার লাইন খুব মনে পড়ে। বলব?

অরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই! বলো, আমি শুনছি।

ডরোথি চোখ বন্ধ করে লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল।

মনে আসতে একটু গলা ঝাড়ল, তারপর স্কুলের এলোকিউশন কন্টেস্টের প্রতিযোগীদের। মতো প্রবল অনুভূতি দিয়ে বলতে লাগল

Out flew the web and floated wide;
The mirror crack’d from side to side;
‘The curse is come upon me,’ cried
The Lady of Shalott.

ওর আবৃত্তি শেষ হলে অরুণ ‘ব্রাভো!’ বলে আস্তে আস্তে হাততালি দিল। তাতেও ডরোথি চোখ মেলল না।

অরুণ ইশারায় বিন্দিয়াকে দরজা বন্ধ করতে বলে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেল।

৬.

অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে, পোশাক বদলে, টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফের ডায়েরি নিয়ে বসল অরুণ। এবার প্রথম খন্ড। আর খুলেই এক মস্ত চমক…

প্রথম পাতাতেই বেশ বড়োসড়ো করে তারিখ লেখা—১লা এপ্রিল, ১৯৫-। তারপর হেডলাইনের মতো করে লেখা ‘অল ফুলজ ডে’। বোকাদের দিন। আর ডায়েরির প্রথম বাক্যটা আরও তাজ্জব-করা

তিন সপ্তাহ হল বাবা মারা গেছে, ফলে সংসারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় সম্পূর্ণ ছিন্ন হল। তবে বাবা বেঁচে থেকেও যে খুব একটা সম্পর্ক বর্তাচ্ছিল তাও না। যতদিন যাচ্ছিল বাবা ক্রমশ একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়ে যাচ্ছিল। তাও এই লোকটার জন্যই আমি বম্বে ছেড়ে বেরোতে পারছিলাম না। কোথাও যাবার কথা উঠলেই বলত, দ্যাখ টোনি, আমরা আর্মেনিয়ান, তার ওপর ইণ্ডিয়াতে ফরেনার। এই বম্বেই আমাদের যথেষ্ট, অন্য কোথাও গিয়ে ঠাঁই পাব না।

আমি বলতাম, তা কি মরতে বম্বে এলে? সাইপ্রাসই তো ভালো ছিল।

তখন বলত, বাপ রে! কতগুলো মেয়েছেলে জুটে গেছল বল তো! তার মধ্যে তোর মা একটি।

আমি চুপ মেরে যেতাম। নাইটক্লাবের ম্যানেজার আমার পিতৃদেবটি যে-হারে মেয়েদের পেট বাঁধিয়ে যাচ্ছিল তাতে রাস্তাঘাটে ফুটফুটে ছেলেপুলে দেখলেই ভাই বলে ডাকার বাসনা হত। বলতে নেই, বাবার অজস্র আয়ের অনেকটাই খসে যেত মেয়েদের বাঁধানো পেট খালাস করতে। আজ যাবার স্মরণে এই ডায়েরি শুরু করতে এইসব কথা মাথায় ভিড় করে এল।

তবে আমার বাবা, আউগুস্ত সুক, সত্তর বছর বয়সে সদ্যমৃত (ঈশ্বর তার সহায় হন), খুব পাপী লোক ছিল না কিন্তু। ওর দোষ জীবনটাকে বড় ভালোবাসত, আর জীবন বলতে বেচারি বুঝত ওয়াইন অ্যাণ্ড উওমেন। মদ আর মেয়ের পিপাসা বাপটার মিটল না জীবনের শেষ দিন অবধি। বড়ো হওয়ার পর একটাই কথা শুনে এসেছি ওর মুখেইটস বেটার টু ডাই দ্যান নট টু বি এবল টু স্কু। সঙ্গম করতে না পারার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।

গত বছর গ্রান্ট লেন থেকে একটা ছুকরিকে তুলে বাড়ি আনছি দেড়া দাম দিয়ে..ফ্ল্যাটের সামনে এসে ছুকরি বলল, তুমি কি পিম্প?

আমি খচে গেছলাম, কী বলতে চাও, আমি দালাল?

ও তখন আমতা আমতা শুরু করল, না, মানে এখানে একটা খ্যাপা বুড়ো থাকে না?

বললাম, তাই বুঝি?

—তিন চার মাস আগে আমায় নিয়ে এসেছিল এখানে। অনেক টাকাও দিল। কিন্তু আমার বডি নিয়ে যা ছিনিমিনি করল জন্মেও ভুলব না।

কেন জানি না, লজ্জার বদলে খুব গর্বই হল বাবার এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বললাম, বুড়োটা আজ নেই। জাহাজের পার্টিতে গেছে, কখন ফিরবে জানি না। তবে বুড়োটা আমার বাবা।

প্রচুর রাম খেলাম মেয়েটাকে নিয়ে, তারপর কী ঝোঁক চাপল কে জানে ফুর্তি করার সময় কেবলই জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, বুড়ো আর কী করেছে? বুড়ো কী করল?

বাবা যা যা করেছে ঠিক সেই সেই কান্ড ঘটিয়ে যেতে যেতে এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম। মেয়েটা বলল, বুড়ো এরপর আমার যোনিতে মাথা রেখে শীর্ষাসন করল। গুডনেস গ্রেশাস মি! সত্তর বছর বয়সের লোকটা এই সব করেছে! এই না হলে আমার বাপ!

আমি কাজকর্ম শেষ করে মাঝরাতে ছুকরিকে ভালো টাকা আর এক পাঁইট রাম দিয়ে বিদেয় করলাম। তারপর বাবার যৌবনকালের এক ছবির সামনে মদের গ্লাস তুলে টোস্ট করলাম—টু ইয়োর ইমটাল কক, ড্যাড! তোমার অবিনশ্বর লিঙ্গকে অভিবাদন, বাবা!

প্রচুর চাইনিজ এনেছিলাম সেদিন, কিন্তু খেলামটা কই? যা খাওয়ার মেয়েটাই খেয়েছিল। পরের পর রাম খেয়ে কখন যে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম জানি না, সকালে ঘুম ভাঙল লোকজনের ডাকাডাকিতে। দরজা খুলে দেখি বাবাকে সবাই চ্যাংদোলা করে আনছে। বুড়ো বেপ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল জাহাজে। পরে জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু নড়ার শক্তি নেই। বাবার বন্ধু ভিকিকে বললাম, আঙ্কল, ওকে বাড়ি আনলে কেন? ওকে তো হাসপাতালে ভরতি করা দরকার।

দেড় মাস পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হতে বাবা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল, আমিই আসতে দিইনি। ফাস্টলি, বুড়োর টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স কেয়ার দরকার। ওর হাতে ট্রেমর ধরেছে। সেকেণ্ডলি, বাড়ি ফিরলেই বুড়ো ফের রেণ্ডি খুঁজতে বেরুবে। বান্দ্রা চার্চের ওল্ড পিপলস হোমে রেখে আসার সময় খারাপ যে লাগেনি তা না। তবে ওর ভালোর জন্যই করতে হচ্ছিল।

আজ কিন্তু মনে হয় আমি বাবা আউগুস্ত সুককে বড়োরকম শাস্তিই দিচ্ছিলাম। আমি ওকে ওর যৌবন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম। না হলে বুড়ো হয়তো আরও অনেকদিন বাঁচত। কে জানে!

তবে ফি হপ্তায় যখনই গেছি বুড়োর একটাই অনুযোগ—এখানে সব কিছুই ভালো, টোনি। বাট নো ওয়ান কেয়ারস অ্যাবাউট মাই কক। আমার যন্তরটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

একবার তো হোমের ব্যালকনিতে বসে বাপটা কেঁদেই ফেলে—মাই লাভলি কক ইজ ডাইং, সন। ইটস ডাইং। ও খিদেও ভুলে যাচ্ছে।

তখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বাড়ি ফিরতে চাও, ড্যাড?

অনেক চিন্তা করে বাবা বলল, নো!

জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

খুব নিশ্চিন্ত স্বরে বাবা বলল, আই ডোন্ট থিঙ্ক আই ক্যান স্ক্র এনিমোর। আর ওই কম্মোটা করতে পারব না।

তখন বললাম অমন ভাবছ কেন ড্যাড? তোমাকে তো জানি, তাহলে তুমি বাঁচবেই না।

বাবা করুণভাবে মাথা নেড়ে বলল, ট্র। কিন্তু এটাই তো জীবন। তারপর একটু থেমে পড়ে বলল, কিংবা মৃত্যু।

আশ্চর্য, যেদিন ভোরবেলায় হোম থেকে বাবার মৃত্যুসংবাদ এল আমার বিশেষ একটা কান্না এল না। বরং মাথায় ভিড় করে এল সেই সব মেয়েদের মুখ যারা ভরিয়ে রেখেছে। আমার শৈশব, বাল্য, কৈশোর আর প্রথম যৌবনের স্মৃতি। যারা সবাই-ই বাবার সংগ্রহ, বাবার সুখের পাত্র, আদরের পাত্রী। যাদের সব্বাইকে বাবা আড়ালে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলত ‘হোল। গর্ত।

এমনকী আমার মাকেও। যে অবিশ্যি আমার সত্যিকারের মা নয়। আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি। ডিয়ার ড্যাড কিছু মনে কোরো না। আমি তোমায় তেমন কিছু ঘেন্না করি না, বরং পছন্দই করি। তবে আমার এই স্মৃতিকথা তোমার শোনা দরকার, হেভেন বা হেল যেখানেই থাকো না কেন। এই স্মৃতিগুলো তোমার প্রাপ্য। তোমার জন্যই এই ডায়েরি শুরু করেছি, আর লিখেও যাব। আমি যে কিছুই ভুলিনি।

তোমাকে ভেবেই আজ এপ্রিল ফুলজ ডে-তে খাতা খুললাম। শুধু তুমি আর আমি নই, আমরা সব পুরুষমানুষই খুব বোকা। আমাদের ভালোবাসা বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই। তোমার তো ছিলই না, ভয় হয় আমারও নেই। তোমার হয়তো মনেও নেই আমার জন্মদাত্রী মা রেবেকা স্পিরোজ সুক তোমার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ না পঞ্চম স্ত্রী। যদি চার্চে মন্ত্র পড়ে, আংটি বদল করে শপথ নেওয়াটাকে তুমি বিবাহ বলে মনে করো। মা অবিশ্যি সবসময় বলত, তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে চার্চে, আর তুই হচ্ছিস আমার একমাত্র লেজিটিমেট চাইল্ড। তোর বাবার অন্য বউগুলো হল … না থাকগে।

একটা ব্যাপারে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে চাই না—সাইপ্রাস ছেড়ে আসার জন্য। তুমি যতই কষ্ট দাও মাকে আমরা কিন্তু সব দুঃখ ভুলে যেতাম সকালে ঘন নীল সমুদ্রটার পাশে গিয়ে বসলে। খুব উত্তেজিত থাকলে আমরা ওই নীল জলে সাঁতার দিতাম অনেকক্ষণ। একেকটা বড়ো ঢেউ এসে শরীরের ওপর ভেঙে পড়লে মা চিৎকার করে উঠত–এসো, এসো! আমাকে ভাসাও! আরও জোরে মারো! এই যে আমি চিৎ হয়ে আছি।

এখন বুঝি সমুদ্রের ওই ঢেউ তখন তোমার কাজটা করত। তুমি যে সংসর্গ থেকে মাকে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলে সেই আহ্লাদগুলো মা কুড়িয়ে নিচ্ছিল জল থেকে। আর আমিও একটু একটু করে নিজেকে ভেবে নিতে শুরু করেছিলাম জলের সন্তান বলে।

বাবা, তুমি কি কখনো জানতে পেরেছিলে মা একটা গোটা বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে? আমিও পারিনি, তাই যখন ক্রিসস্তোমো ডে স্কুলে শেষবারের মতো মা বলল, তুমি খুব সাবধানে থেকো লক্ষ্মীটি। খবরদার একলা সমুদ্রে যাবে না। বাবার হাত ধরে যাবে। আমি বুঝতে পারিনি আমি মাকে শেষবারের মতো দেখছি। সেদিন গভীর সন্ধেয় সিরিকালিয়ন বিচে পাথরের ওপর মা-র ক্ষতবিক্ষত দেহটা খুঁজে পেয়ে তুমি যখন হাউ হাউ করে কাঁদছিলে আমার চোখ তখন কিন্তু শুকনো। আমার মনে হল মা এখন ঈশ্বরের কোলে, তুমি আর তাকে কষ্ট দিতে পারবে না।

আমি এসবের ছোট্ট ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়েছি সারাজীবন। শেষ প্রতিশোধ তোমাকে হোমে পাঠিয়ে, আমি জানতাম তুমি যৌনক্ষুধায় মারা যাবে। আমি কি মার যৌন ক্ষুধা দেখিনি? তখন বুঝিনি মা ওভাবে সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরতে চাইত কেন, তবু বুঝতাম সমুদ্রের ঢেউকে কোলে নিয়ে মা বালিয়াড়িতে বিছানা পাতছে।

তবে প্রথম প্রতিশোধটা কবে জান? তুমি কল্পনাতেও পারবে না। এথেলরেড রুবিনা সুককে তোমার মনে পড়ে? তোমার কত নম্বর স্ত্রী কে জানে! তোমার মাতৃহারা সন্তানের ভার যার ওপর ন্যস্ত করেছিলে। ওর স্তন ও পাছার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না।

ক্যাবারেতে গান গাওয়া গলা—অপূর্ব! যৌনকলায় ও-ই আমার প্রথম শিক্ষিকা। অত বড়ো শরীরে যৌনতার জাদুঘর বানিয়ে রেখেছিল আন্ট এথেল। ও চাইত আমি ওকে মা বলে ডাকি, আমি বলতাম—তা কেন? তাহলে তো সব মজা উবে যাবে।

আট থেকে চোদ্দ বছর অবধি আমার সেক্স টিচার ছিল তোমার তিন, চার কি পাঁচ নম্বর গিন্নি এথেলরেড রুবিনা সুক। তারও দাবি ছিল তুমি তাকে গির্জায় শপথ নিয়ে বিয়ে করেছ।

না, বাবা, আমার প্রতিশোধের ফর্দ এখনও শেষ হয়নি। আমার দ্বিতীয় মাকেও দেখেছি দিনে দিনে কীরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে তোমার থেকে। তোমার নাইটক্লাব যত ফুলে ফেঁপে উঠেছে খদ্দেরে আর টাকায় ততই তুমি সরে গেছ আমাদের জীবন থেকে। রাতই তোমার দিন ছিল, ভোর রাত ছিল তোমার ছুকরিদের নিয়ে ডেরায় ফেরার সময়। তুমি জানতেও পারতে না তোমার হিসাবরক্ষক ছেলেটি—মিখাইল ইগলেসিয়াস—কেমন টুকটুক করে বাড়ি এসে তোমার জায়গাটায় শুয়ে পড়ত। ঘণ্টা দুয়ক এথেলরেডের সঙ্গে খেলাধুলো করে বেশ ফিটফাট চেহারায় বেরিয়ে যেত। এসব কথা না বলার জন্য আমার ঘুষ কী ছিল জান? প্রথম প্রথম বাড়তি হাতখরচ। তারপর নতুন পোশাক-আশাক (ইগলেসিয়াসের মতোই স্টাইলিশ স্কার্ফ, কাফ লিঙ্ক, জুতো আমার পছন্দ ছিল), শেষে যৌনশিক্ষা। আমার সেই সব শিক্ষাদীক্ষার আমি সুনাম রেখেছিলাম—আমার যখন পনেরো বছর বয়স আর তুমি আঠেরো বছরের এক ছুকরিকে এনে ফেললে বাড়িতে আমার দ্বিতীয় মা এথেলরেড পরিষ্কার নির্দেশ দিল : টোনি, গো গেট হার। ধর শালিকে! আমি সময় নষ্ট করিনি, পনেরো বছর এক মাস বয়েসে স্টেফানি লুৰ্দেসকে দিব্যি বুজুকি মিউজিকের রেকর্ড চালিয়ে নাচে নামালাম, স্টেপিং মিলিয়ে কখনো হাত ধরছি, হাত ছাড়ছি, বুকে টেনে নিচ্ছি, জড়িয়ে ধরছি, ক্রমে গালে গাল রাখছি, চোখে চোখ, নাকে নাক, বুকে বুক, ঠোঁটে ঠোঁট…শেষে একসময় ওর সমস্ত কাপড় খুলে নিয়ে, নিজের সব পরিধান বিসর্জন দিয়ে ওর যোনিতে আমার লিঙ্গ। মিউজিক তখনও চলছে। আমরাও মিশে আছি এক অভিনব নাচে। শুনলাম স্টেফানি আমার কানে ফিসফিস করে বলছে, তুমি কি জানো তোমার বাবার সঙ্গে আমার আংটি বদল হয়েছে? এই দ্যাখো—বলে ওর এনগেজমেন্ট রিংটা দেখাল আমাকে। তাতে কী প্রমাণ হয় জান? ও জিজ্ঞেস করল। কী? আমি বললাম, দ্যাট আই অ্যাম আ মাদারফাঁকার।

বাবা, আমি বড়োই হয়েছি আমার চতুর্থ, পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ মা স্টেফানি লুৰ্দেস সুককে যৌনসঙ্গী করে। তুমি হয়তো এর কিছুই জাননি, জানলেও তোমার মনে হয় বড়ো একটা এসে যেত না। আমাকে পেয়েছিল বলে স্টেফানি আর তোমার অন্য বউ এথেলরেড আর ইগলেসিয়াসের কথা তোমার কানে তোলেনি। তবে এথেলরেড ভালোই চেষ্টা করেছে স্টেফানিকে বিষ খাইয়ে মারতে। পারেনি যে তা একান্তই আমার জন্য। আমার দ্বিতীয় মা টের পাচ্ছিল আমি স্টেফানির প্রেমে পড়েছি।

যাক, শেষপর্যন্ত কেউই মরেনি, কেউই তোমায় ছেড়েও যায়নি। বরং তুমিই সব্বাইবে ছেড়ে পালালে, সঙ্গে নিলে শুধু আমাকে। আমি বলেছিলাম এই সমুদ্র ছেড়ে যাব না। তাতে তুমি বললে, তাহলে সমুদ্রেই ডুবে মরতে হবে।

বললাম, কেন?

তুমি বললে, বিকজ আই হ্যাভ বার্নট অল মাই বোটস। আমার সব নৌকোই পুড়িয়ে ফেলেছি।

-কীরকম?

—আমার অ্যাকাউন্টে ইগলেসিয়াস আমার ব্যাবসার সব টাকা তছনছ করে, আমাকে লুঠ করে গ্রিসে পালিয়েছে, আমার চারদিকে এখন পাওনাদার, কারও কোনো পয়সা মেটায়নি লোকটা। আমার দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া গতি নেই।

তখন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ‘এথেলরেডকে বলছ না কেন?’ চট করে কথাটা সামলে নিলাম। ঠিক করলাম নিজেই গিয়ে জিজ্ঞেস করব। মা তো আকাশ থেকে পড়ল—এই সেদিনও আমার দুটো হিরের নেকলেস বন্ধক রাখবে বলে নিল! হায় রে, আমার মন্দ কপাল! মা হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে বসল। হিসাবরক্ষকের হিসেবি কাজ দেখে ওই বয়সেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।

তোমাকে বললাম, মা-দের কে দেখবে? তুমি একবার ওপরে আঙুল দেখিয়ে বোঝালে ঈশ্বর, তারপর প্যান্টের সাইডপকেটে থাবড়ে বোঝালে টাকা। আমি বললাম, ঈশ্বর যা করার তো করবেন, কিন্তু টাকাটা জোগাবে কে? তখন তুমি ক্লাবের ক্যাশবাক্স আমার সামনে ফেলে বললে, এর অর্ধেক টাকা তোমার আর আমার, বাকিটা দিয়ে গর্ত বোজাব।

মেয়েদের তাচ্ছিল্য করলে তুমি তাদের গর্ত বলতে। আমার ভালো লাগত না, তবু চুপ করে যেতাম। কিন্তু সেদিন পারিনি; বললাম, এই সব টাকা তোমার গর্তগুলোয় ফ্যালো। আমরা খালি হাতে দেশ ছাড়ব।

গর্তে যা ঢালার পরেও তুমি শেষ হাসি হেসেছিলে। বম্বেতে প্লেন থেকে নামার পরেও তোমার সুটকেস ভরতি মার্কিন ডলার। আমার আর জিজ্ঞেস করার রুচি ছিল না, তবে আন্দাজ করছিলাম ইগলেসিয়াসের সঙ্গে সাঁট করেই কান্ডটা তুমি ঘটিয়েছিলে। তোমাদের টার্গেট ছিল জর্জ এফেন্দি। নাইটক্লাবের মালিক। শরীরে তুর্কি এবং গ্রিক রক্ত। সারাজীবন গড়াগড়ি দিয়েছে হিরে জহরতের ওপর। তুমি আক্ষেপ করতে, শালা আমার শরীরের শেষ রক্তও নিঙড়ে নিচ্ছে, কিন্তু ভুলেও একটা বোনাস কখনো দিল না।

জানি না, এই ধারণাটা আমার ভুলও হতে পারে। খুব সম্ভবত ভুল, কারণ মা এথেলরেডের একটা চিঠি থেকে জেনেছিলাম যে, বছর দেড়েক পর ইগলেসিয়াস ফিরে গিয়েছিল সাইপ্রাসে মা-র কাছে। ওরা তখন সংসার বাঁধার পরিকল্পনা করছিল। আর স্টেফানি চলে গিয়েছিল বেইরুটে নাইটক্লাবে নাচিয়ে হয়ে। এসবই মা-র চিঠি থেকে জানা। তবে ইগলেসিয়াস ফিরে গেছে জেনে আমি তোমার এথেলরেডকে চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দিই। মা তার পরেও বেশ কটা চিঠি আমায় লিখেছিল, কিন্তু আমি সে সবের উত্তর দিইনি। আমার শেষ চিঠিতে লিখেছিলাম, তুমি বার বার কেন আমার ফিরে যেতে বল? বাবার মতো আমিও দেশে ফেরার নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি।

বাবা, আমার প্রতিশোধের কথাটাও বলে নিই? বম্বে এসে তুমি ফের এক রেস্তরাঁর ম্যানেজার হলে। আমায় বললে, টোনি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো। জাহাজে করে দেশবিদেশ ঘোরো। পারলে মাঝে মাঝে সাইপ্রাস হয়ে এসে আমায় গল্প শোনাও। উত্তরে আমি কী বলেছিলাম?—নো ড্যাড, সেটা হয় না, আমার সব নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি। উদবিগ্ন হয়ে তুমি কী বললে?—তাহলে তুমি কী করবে? আমার মতো রাতের পাখি হবে? আমি বললাম না। আমি আকাশের পাখি হব। তুমি ঠিক ধরতে পারোনি আমি কী বলতে চেয়েছিলাম। আমি তাই সহজ করে দিয়ে বললাম, আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যাব। তুমি খানিকটা গুম মেরে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করে বললে, বুঝলাম।

আসলে তুমি কিছুই বোঝনি। তুমি বুঝতেই পারনি এ আমার এক ছোট্ট প্রতিশোধ ছিল তোমার সারাজীবনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। তুমি চাইতে আমি সমুদ্রের জীবন নিই, কারণ সমুদ্রের হাওয়ার মধ্যেই আমরা মানুষ। অথচ ওই সমুদ্রই টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাকে, মা শেষবার বারণও করে গিয়েছিল একলা একলা জলে না যেতে। অথচ কার হাত ধরে আমি সমুদ্রে যাব বল? তুমি কি একবারও আমাকে হাতে ধরে জলে নেমেছিলে? শুধু বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে দূরে জাহাজ দেখিয়ে বলেছ—ওটা ইংলণ্ডেশ্বরীর জাহাজ! ওটা অ্যারিস্টটল ওনাসিসের জাহাজ! ওটা যুদ্ধের! ওটা মাল বহনের! ওটা প্রমোদতরণী!

কিন্তু আমি বেছে নিলাম উড়োজাহাজ। অনেকপরে চাকরিতে প্রথম মাইনে পেয়ে তোমায় কী উপহার এনে দিয়েছিলাম মনে আছে? একটা টাইপিন। তার বিশেষত্ব? সেটা একটা ছোট্ট সোনালি প্লেন! তারপর থেকে টাই পরলেই সে প্লেনটা তোমার বুকে শোভা পেত। আর তোমার কফিনে ছোট্ট কী একটা শুইয়ে রেখেছিলাম তোমার মাথার কাছে খেয়াল করেছ? ওটা একটা ছোট্ট জাহাজ, যার গায়ে আমি লিখে দিয়েছি একটা নাম—রেবেকা। মহিলাকে মনে পড়ে?

না, বাবা, আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই, এখন থেকে তোমাকে আরেকটু ভালোবাসার চেষ্টা করব। নানা শত্রুতা সত্ত্বেও আমরা তো বন্ধুই ছিলাম।

আমি জানি তুমি স্বর্গে নয়, নরকেই যেতে চাও। কারণ ওখানে ফুর্তি বেশি। কিন্তু তোমার পুত্র হিসেবে আমি চাই তুমি স্বর্গে যাও এবং যৌনতাবিহীন এক অনন্ত জীবনযাপন করো। কিন্তু তুমি যা জিনিস বাপ, তুমি ঠিক স্বর্গের দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে নরকে ফুটে যাবে। যেখানে হেলেন অফ ট্রয়, ক্লিওপেট্রা, মাতা হারি-রা তোমার অপেক্ষায়। আর ভয় নেই, কালে কালে আমিও নরকে তোমার সঙ্গী হব। ততদিন তুমি নরকে ফুর্তি করো, আর আমি মর্তে ততদিন সবরকম অবাস্তবতা সহ্য করে যাই।

অতএব বিদায়, প্রিয় আউগুস্তে সুক! মাতালদের মতো আর কান্না জুড়বে না; দ্যাখো আমার চোখ কত শুকনো।

চিঠির আকারে বাবাকে লেখা সুকের ডায়েরির প্রথম এন্ট্রি পড়েই বেশ চুপ মেরে রইল অরুণ। একটা সিগারেট ধরাল, দুটো টান দিয়ে বহুক্ষণ ভাবল—সুকের জীবনের যত জানছে ততই কেমন জটিল হয়ে উঠছে লোকটা। ওর নিজের দেখা ও জানা সুকের চরিত্রকে খুবই খন্ড, আংশিক, একপেশে মনে হচ্ছে। কাহিনি করে লিখতে গেলেও আরও আরও প্রেক্ষিতের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এক অ-অ্যাংলো প্রেক্ষিতের। কিন্তু কার হবে সেই প্রেক্ষিত? দুলালি? যে-মেয়েটিকে নিয়ে ইন্টালি সিনেমা হলে শাম্মী কাপুরের ‘দিল দেকে দেখো’ দেখতে গিয়েছিল বলে ডরোথি বারো দিনের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল? কিন্তু সে দুলালি কোথায় এখন? সে তো কবেই বিয়ে হয়ে আসামে। তাহলে সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়ে মাম্পু, যার পড়ার খাতা বাঁধিয়ে দিত সুক? কিন্তু মাম্পু কোথায়? তাদের গোটা পরিবারই তো কবে থেকে মিন্টো রো-ছাড়া! তাহলে… তাহলে… তাহলে কি দিদি শমি? ও কি রাজি হবে কিছু বলতে? জিজ্ঞেস করাটাও কি শোভন হবে? ওদের সুখী পরিবার…জামাইবাবু দীপেনদা খুব খোলামেলা, উদাস প্রকৃতির হলেও তার কি খারাপ লাগবে না?

নানা এলোমেলো প্রশ্নের মধ্যে ওর সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। অরুণ সেটা নিভিয়ে সুকের ডায়েরির অন্য পাতায় চলে গেল। কিন্তু খোঁচাটা ভেতরে থেকেই গেল। রাতের খাওয়ার সময় যখন টেবিল ছেড়ে উঠল তার মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে। শনিবার অফ ডে

-সেদিন ভোরে জামশেদপুরে রওনা হবে।

রাতের ঘুমের মধ্যে দিদি শর্মিলাকে স্বপ্ন দেখল অরুণ।

—দিদি তোকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করব, কিছু মনে করবি না তো?

–অদ্ভুত প্রশ্ন! হঠাৎ অ্যাদ্দিন পর কী এমন অদ্ভুত প্রশ্ন গজাল?

–আগে বল মাইণ্ড করবি না।

—মাইণ্ড করলে উত্তরই দেব না।

—দ্যাটস জাস্ট লাইক ইউ!

–আগে বল প্রশ্নটা কী?

—আঁতোয়ান সুক, মানে আমাদের টোনিকে নিয়ে।

–টোনিকে নিয়ে হঠাৎ?

—ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব ভাবছি।

–কী মনে করে?

—ওর সেই ডায়েরিগুলো পেয়েছি।

–অ! আর দে ইন্টারেস্টিং?

—কী বলছিস ইন্টারেস্টিং? দে আর ফ্যাসিনেটিং!

–তাই?

–তাই।

—তা আমি কী করব?

–বলবি, টোনি তোকে ভালোবাসত কি না।

–তাই তো মনে হয়।

—আর তুই?

—সার্টেনলি। তুই তো সত্যটাই জানতে চেয়েছিস।

—নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!

–তাহলে ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না কেন?

–কোথায় পালাতাম?

—যেখানে নিয়ে যেত ও?

—কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল জানিস?

—কোথায়?

–সাইপ্রাস।

—সব জায়গা ছেড়ে ফের সাইপ্রাস! সাইপ্রাস কেন?

–ও তখন ঠিক করেছিল ওখানে সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে আমাকে নিয়ে থাকবে।

-তুই চাইলি না কেন? তুই তো চিরটাকাল প্রবল রোমান্টিক।

–কারণ আমি ওকে খোয়াতে চাইনি।

–খোয়াবার কথা ভাবলি কেন? ওখানে ওর ওই সব নারীসঙ্গের কথা ভেবে?

–না। ওর মার কথা ভেবে। ওর একটা সুপ্ত বাসনা ছিল সমুদ্রে নেমে হারিয়ে যাওয়া।

—কিন্তু তুই থাকতে…?

—আমি থাকতে মানে কী? তুই জানিস ও কখনো আমাকে টাচ করেনি?

—অথচ অত পাগলের মতো ভালবাসত?

—প্রিসাইজালি সেই কারণেই তো আমিও পাগলি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বলেছিল, তোমাকে বিয়ে না করে ছোঁব না। আর বিয়ের দিন শুধু একটা আনুষ্ঠানিক চুম্বন দেব। আমাদের সত্যিকারের মিলন হবে সাইপ্রাসের সমুদ্র তটে ঢেউয়ের নীচে। আমি শিউরে উঠে বলেছি, সে কী কথা! আমি তো সাঁতারই জানি না। ও হাসতে হাসতে বলত তাতে কী? আমিও তো সাঁতার জানি না, শুধু জলকেই জানি।

—আর তার পরেও তুই ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না?

—তাতে কী লাভ হত? তোর উপন্যাস মাঝপথে শেষ হয়ে যেত।

–সে তো এমনিই মাঝপথে দাঁড়িয়ে।

—তার কারণ তুই এখনও ডরোথিকে বুঝে উঠতে পারিসনি।

–তার মানে?

–তার মানে তাই! টোনির চেয়ে কোনো অংশে কম রহস্যময় নয় ডরোথি। জগুদাকে দিয়ে টোনিকে মার খাওয়ানোর পিছনেও ডরোথি। আর তোকে প্রথম কে নষ্ট করেছে বল! সত্যি করে বল, আমি সব জানি।

—ড-ডু-ড-ডরোথি।

–কতদূর গিয়েছিলি ওর সঙ্গে বল! কাম আউট ছোটা ভাই।

—পুরোটা!

—তাহলে শোন, টোনিকে বেঁধে রাখার ওটাই ছিল ওর শেষ চাল। টোনিকে বলেওছিল তুমি শমিকে নিয়ে পালিয়ে গেলে আমিও অরুণকে নিয়ে চম্পট দেব। আর শমি আর ওর ফ্যামিলি কোনোদিন সেটা মেনে নিতে পারবে না। ওর ফ্যামিলির কথা ভেবে শমি গলায় দড়ি দেবে। তুই জানতিস এসব?

–না।

–তাহলে আরও শোন। এইসব ভেবেই কাকা গিয়ে তোর হোস্টেলের ব্যবস্থা করে এল। আমাকে রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, লক্ষ্মী মা, একবারটি বাড়ির সম্মানের কথা ভাববা! আমরা কাকে মুখ দেখাব তুই ওকাজ করলে? মা বলল, শমি, আমরা চিরকাল থাকব না, কিন্তু তুই বাড়ির সম্মান… …মার আর কথা জোগায়নি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, তবু বললাম, তোমরা কেঁদো না। আমি ও কাজ করব না, কথা দিলাম যখন এসব বলছি আমার চোখের সামনে কী দৃশ্য আসছে জানিস? শুধু তোর মুখ! তখন তোর কত বয়স বল?

–চোদ্দোর কিছুটা বেশি।

—আর তোকে নষ্ট করেছে ছাব্বিশ বছরের এক মেয়েছেলে।

–ওভাবে বলিস না প্লিজ! ও তো বলত আমি নাবালক, কিছুই বুঝি না।

–তাহলে নাবালকের সঙ্গে ওই ব্যবহার?

—ও তো এও বলল আমাকে যে তোকে বাঁচানোর জন্য টোনিকে ছেড়েছিল।

—আর তোকে বন্ধক রেখে!

–ওঃফ! তুই ফের সেই গাওনা ধরেছিস।

—ধরবই তো, টোনিকে আগলাবার জন্য ও সব কিছু করতে পারত। এই আমি বলে দিলাম। ও অসাধারণ গুণী মহিলা, কিন্তু টোনির ব্যাপারে শুধু অন্ধ বা পাগল নয়, একেবারে হিংস্র।

-তুই তো উপন্যাস লিখছিস, এগুলো একটু তলব কর। আর সত্যি বলব? নিজের। ভেতরটা ভালো করে খুঁড়ে দ্যাখ। কী তুই এখানে-ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছিস? সুকের ব্যাপারে সত্যিকারের কিছু লিখতে গেলে দুটোই তো চরিত্র—ডরোথি আর তুই!

সন্ধ্যেবেলায় শর্মিলাদের বাড়ির বাগানে দীপেনদার সঙ্গে হুইস্কি নিয়ে অনেক সময় কাটাল অরুণ। সুকের জটিল কাহিনির অনেক সূত্রই যেন ক্রমশ আলগা হয়ে আসছিল। দেশের রাজনীতি নিয়ে গল্প করতে করতে অনেক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অরুণ। তখন দীপেনদা বলতে থাকলেন, আরে কী নিয়ে এত ভাবছ তখন থেকে? অফিসের সমস্যা? নাকি পৃথার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করলে? পৃথা অরুণের স্ত্রী, সে এই সুক-ডরোথির বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গও জানে না। ও শুধু জানে বর একটা বড়োসড়ো লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

দীপেনদার প্রশ্ন সামাল দেওয়ার জন্য অরুণ বলল, ও কিছু নয়, একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি, থেকে থেকে ব্যাপারটা মাথায় ঘুরে আসছে।

দীপেনদা বললেন, তা গল্পের প্লট ভেবে বাস্তবকে ভুলে থাকা যায়? এই যে এমারজেন্সি ডেকে বসলেন মিসেস গান্ধী এও তো এক মস্ত প্লট। মানে চক্রান্ত। নয় কি?

দু-জনে এক প্রস্থ হাসির তোড়ে নতুন করে ড্রিঙ্ক ঢালল। অরুণের মনে পড়ল এক একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ—দাবা। শমির কথায় হঠাৎ করে ওর কাহিনির সাজানো দৃশ্যটাই তছনছ হয়ে গেল, খেলাটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে পুরোপুরি নিজের সঙ্গে। অরুণের মনে পড়ল সেই দুপুরবেলা যেদিন ডরোথি টোনির সঙ্গে ঝগড়া করে ওর হাত ধরে বেরিয়ে গেল ম্যাটিনি শোয়ে একটা হলিউডি ছবি দেখতে। হল খালি তবু ব্যালকনির একেবারে পিছনের সিট নিল। হলের আলো নিভতে ওর গায়ে হাত দিল। এক সময় গালে চুমু দিল, তারপর ঠোঁটে, তারপর ওর হাতটা নিজের বুকের ওপর রাখল, আর বলল, এটা তোমার, তুমি খেলতে পারো।

শমির ওখান থেকে ফিরে ছ-সপ্তাহ চলে গেল। প্রথম হপ্তা জুড়ে সুকের সবগুলো ডায়েরি পড়া হল অরুণের। বাকি পাঁচ হপ্তা ধরে লিখেই চলেছে, কিন্তু ওর উপন্যাস কোথাওই যাচ্ছিল না। অনেকগুলো প্রেক্ষিতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর দুটো সুন্দর রাস্তার মধ্যে পথ হারাচ্ছিল-মিন্টো রো আর মিন্টো লেন। বার বার মনে পড়েছিল দিদি শমির কথা; চরিত্র তো দুটোই-ডরোথি আর তুই!

ভাবলেই একটা শেলের মতো বিধছিল কথাটা। সত্যিই তো ডরোথিকে সেভাবে ঘাঁটিয়ে দেখেছে ও? কিংবা নিজেকে? নিজের ভেতরেই কুড়িটা বছর ধরে লুকিয়ে থেকে থেকে ডরোথির সঙ্গে সম্পর্কটা ওর কোথায় যে তলিয়ে গেছে। সেই ঘুমিয়ে থাকা সাপটাকেই খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে শমি। সিগমণ্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণে যাকে বলা হচ্ছে ইমার্জেন্স অফ দ্য রিপ্রেসড। দমিত অনুভূতির নবজাগরণ। অরুণ বুঝতেই পারছে না ওর লেখায় নিজের এই অদৃশ্য নাটক কীভাবে চিত্রিত করবে। নিজের প্রেক্ষিত নিয়ে মাথা ঘামালেই তো সেইসব ছবি সিনেমার রিলের মতো নিজেদের মেলে ধরছে। আর ছবি মানেই তো…।

প্লেন নিয়ে একটা ছবির বই দেখছিল অরুণ, হঠাৎ চোখ তুলে দেখল একটু দূরে পোশাক বদলাচ্ছে ডরোথি। ওকে ডাকল, অরুণ আমার ব্রার হুকটা একটু লাগিয়ে দিয়ে যাও প্লিজ! অরুণ কাঁপা কাঁপা হাতে হুকটা লাগাতে গিয়ে দেখল তড়াং করে ইলাস্টিকটা ছিটকে গেছে। ডরোথির বুক থেকে নেমে এসেছে ব্রেসিয়ারের কাপ দুটো। ডরোথি ঘুরে ব্রা-টা ফেলে দিল কার্পেটে আর ঘুরে দাঁড়াল অরুণের দিকে। বলল, ভালো করে দ্যাখো ও বলো কেমন লাগছে।

অরুণের হাত আপনা-আপনিই উঠে গেল ওই অপরূপ বুক দুটোয় আর মুখ দিয়ে শুধু একটাই কথা বেরুল—সুইট!

একটু থেমে ফের বলল, বিউটিফুল!

তারপর আরেকটু থেমে, আই লাভ ইউ, ডর!

তখন ডরোথিই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল।

অফিস থেকে ফেরার পথে ফের এক বোতল রাম, দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস আর নিজামের রোল নিয়ে ডরোথির ফ্ল্যাটে চলে এল অরুণ। পৃথা দু-দিনের জন্য মামাবাড়ি মিহিজামে গেছে। গল্পের সন্ধানে বেশি রাত অবধি ডরোথির সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে নেই। কাহিনির শেষ যে কোথায় হবে তার কোনো হদিশ এখনও করা গেল না। লাভস্টোরিটা বিয়োগান্তক হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু বিয়োগটা কোথায়, কীভাবে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া দরকার। নাহলে পুরো কাহিনিটাই এক অস্থিরমতি অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের অবিশ্রাম নারীবিলাস হিসেবে ঠেকবে। আর এই এতগুলো বছর একলা থেকে ডরোথি নিজেই বা কী করেছিল?

ডরোথির ফ্ল্যাটে এসে নক করে অন্ধকারে দাঁড়িয়েই অরুণ শুনতে পেল ডরোথি বসার ঘরে বসে কাশছে। বেশ ভালোই কাশি ধরেছে ওকে। অরুণ আবার নক না করে ঠেলা দিতে দরজাটা এক বিচিত্র আওয়াজ করে খুলে গেল। ও ভেতরে পা রাখতেই দেখল হল ল্যাম্পের মায়াবী আলো-আঁধারিতে ডরোথি সুকের উপহার করা ইভ মর্ত-র গানের রেকর্ডটা গ্রামে বসানোর উদ্যোগ করছে। অরুণকে দেখে একই সঙ্গে অবাক আর খুশি হয়ে বলল, তুমি? হাউ স্ট্রেঞ্জ! আজকেই তোমার কথা ভাবছিলাম।

–আমার কথা ভাবছিলে? কেন? লাভস্টোরি তো এখনও শেষ হয়নি।

—আসলে আমার একটা উকিল চাই, এ ব্যাটা বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাঙবে বলে জ্বালিয়ে মারছে।

অরুণ ওকে আশ্বস্ত করে বলল, ছাড়া তো! ভাঙব বললেই হল। সে আমি তোমাকে ভালো উকিল দিয়ে দেব।

ডরোথি নরম করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, ডিয়ার!

তারপর অরুণের হাতের জিনিসপত্তর দেখে বলল, আবার অত সবের কী দরকার ছিল? আমার এখানে রাম আর সিগারেটের অভাব রাখি না।

অরুণ কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলল, জাহাজি বন্ধু ডিকির দৌলতে তো?

ডরোথি বেশ আহতই হয়েছে। খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমি নিজেই চেয়ে নিয়েছি কাল এই অ্যানিভার্সারির জন্য।

অরুণ অবাক হয়ে গেল, কীসের বার্ষিকী? তোমার জন্মদিন? ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।

–টোনির বার্থ ডে?

ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।

-তাহলে তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?

-না, তাও না।

-তাহলে?

ডরোথি কীরকম একটা আবছা গর্বের সঙ্গে বলল, টোনির ফিরে আসার।

গোটা আকাশটাই যেন ভেঙে পড়েছে অরুণের মাথায়—হোয়াট ডু ইউ মিন, ডর? টোনি ফিরে এসেছিল।

ডরোথি খুব শান্ত আর বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল—হ্যাঁ।

থরথর করে কাঁপছিল অরুণের গলা যখন জিজ্ঞেস করল-কবে?

ডরোথির ফের সেই শান্ত, বিষণ্ণ জবাব—চলে যাওয়ার দু-বছর পরে। তখন তোমরা কেউ আর এখানে ছিলে না।

—পৃথিবীর আর কেউ সেটা জানল না?

–আমি জানতে দিইনি।

—কারণ?

–তাহলে ওকে নিয়ে যেত আমার কাছ থেকে ওরা।

—সে আবার কী! নিয়ে যেত কেন?

–ন্যাচারালি কবর দেওয়ার জন্যে।

কবর দেওয়ার জন্যে? কেন, ও কি মরে গেছিল নাকি?

—হ্যাঁ! এই আমার কোলে। ও ফিরে এসেছিল আমার কোলে মরবে বলে।

–কোত্থেকে এসেছিল?

—আমি জানি না।

–সত্যি কথা বলো, ডর। গল্পের জন্য আমার জানা দরকার। ডোন্ট হাইড।

—আমি সত্যিই জানি না, অরু।

–তাহলে কী জান তুমি?

—শুধু এটাই যে শেষবারের মতো শমি ওকে না বলেছিল। শমির তখন বিয়ে ঠিক হয়ে। গেছে। আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শমি বলেছে গো ব্যাক টু ডর!’

—তাতে ও তোমার কাছে ঘুরে এল?

-না, ও আসেনি। সাতদিন ওর মদের সঙ্গী ছিল ডিকি আর আসরানি। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আমাকে ডরোথির কাছে পৌঁছে দে। মাঝরাতে ওরা যখন ওকে রেখে গেল, ও মারাই যাচ্ছে। আমি নিজেই যা পারলাম যত্ন করলাম, কিন্তু ডাক্তার ডাকিনি।

-কেন ডাকলে না?

—কোনো লাভ ছিল না, ও চলেই যেত।

—তো কী করলে শেষ অবধি?

—আমি ওকে একটা খুব প্রাইভেট বেরিয়াল দিলাম। খুব নির্জন কবর।

—নির্জন কবর? কোথায়?

ডরোথি একটা ডিকির গিফট করা সিনিয়ার সার্ভিস সিগারেট ধরাল আর একটা অফার করল অরুণকে। তারপর ওর হাতটা ধরে বলল, এসো, দেখে যাও।

ডরোথির হাত ধরে অরুণ ওদের বসার ঘরের পেছনের ডাইনিং রুম পেরিয়ে স্টোর রুমের ভেতরে ঢুকল। তার এক ধারে একটা বন্ধ দরজা। কী একটা ড্রয়ার খুলে একটা লম্বা চাবির গোছা বার করল। তারপর মিটসেফের ওপর থেকে একটা চার ব্যাটারির টর্চ নিয়ে বলল, এসো অরু। বাল্যে, কৈশোরে কত কত বার এই বিশেষ দরজাটা দেখেছে অরুণ। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি ওটার ওপারে কী। একবার সুক আর মাম্পুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেও ওই দরজাটার পিছনে লুকোবার বাসনা হয়েছিল ওর। কিন্তু তখনও জানা হয়নি দরজাটা কীসের।

ডরোথি ইশারাতে বিন্দিয়াকে বলল বসার ঘরে যেতে আর দরজা খুলে অরুণকে বলল, সাবধানে নামো।

ডরোথির মস্ত টর্চের আলোয় অরুণ দেখল বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে একটা সেলারের মধ্যে। সাহেবরা বলবে সেলার, এদেশীয়রা গোপন কুঠুরি। সিঁড়ি দেখিয়ে নামতে নামতে ডরোথি বলল, মা-র কাছে শুনেছি একসময় এর ব্যবহার হত বন্দুক আর কার্তুজ রাখার জন্য।

অরুণের খুব ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে কার বন্দুক, কার কার্তুজ। কিন্তু তার আগেই ওর চোখ গেছে এক মস্ত লম্বাটে বাক্সের দিকে। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে চেস্ট। ডালা দেওয়া প্রকান্ড বাক্স। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোয় ডরোথি ওর গোছর একটা চাবি দিয়ে খুলে ফেলল বাক্সের তালাটা। তারপর নীচু স্বরে অরুণকে বলল, একটু হাত লাগাও।

দু-জনে মিলে ঠেলে ডালাটা তুলে ধরতে এক বিকট গন্ধে পা থেকে মাথা অবধি ঝাঁকিয়ে উঠল অরুণের। ও হাতের সিগারেটে লম্বা টান মেরে নাকের বোধটা মারার চেষ্টা করল। ডরোথি দিব্যি ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে বাক্সের কাপড়ের বাণ্ডিলগুলো সরাতে লাগল। বাক্সের মধ্যে কত যে সুগন্ধির বোতল ছড়ানো, যাদের সব গন্ধই জলাঞ্জলি হয়েছে শবের গন্ধ মারতে। একে একে ডরোথি সরাল ম্যাক্স ফ্যাক্টর, কোটি, পাট্টা, ইভনিং ইন প্যারিসের সব মহার্ঘ শিশি। শেষে এক বিবর্ণ গোলাপি চাদর টেনে তুলতে হুস করে ভেসে উঠল পচা, গলা এক দেহ যা বস্তুত কঙ্কালসর্বস্ব। ভয়ে শিউরে উঠেছিল অরুণ, কিন্তু ডরোথি সেই পূর্বের মতো শান্ত। বলল, বছরে বেশ কবার ওর বেশভূষা পালটে দিই। গলে পড়া শরীরের সবকিছু বার করে দিয়েছি। তবু এই গন্ধটা থেকে গেছে। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি। দ্যাখো, কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে টোনি!

অরুণ দেখল শুধু একটা কঙ্কালের চোখের শূন্য কোটরে ক্লান্ত অন্ধকার। না বলে পারল, এভাবে একটা বডিকে বাড়িতে পুষে ঠিক করোনি, ডর। কঙ্কালটা মুক্তি চাইছে।

ওর কথার নিষ্ঠুরতায় চমকে গিয়েছিল ডরোথি। ফের পরিপাটি করে বাক্সটা গুছিয়ে ভারী ডালাটা নামিয়ে রেখে বলল, এভাবে ওকে রেখে দিতে পেরেছিলাম বলেই তো তুমি তোমার গল্পের গ্র্যাণ্ড ফিনালি পেয়ে গেলে, তাই না? এরকম একটা ভয়াবহ সেটিং ছাড়া তুমি টোনির অবিশ্বাস্য জীবনের শেষ দেখাতে কীভাবে? একটা প্রেমের উপন্যাসের এরকম এক ভয়াবহ শেষ কি খুব খারাপ?

অরুণ এসব কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। জুতোয় মাড়িয়ে হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে চুপ করে উঠে এল বসার ঘরে। গ্রামে বসামো ইভ মত-র প্রেমের গানটা চালিয়ে দিয়ে এক পাত্র রাম নিয়ে বসল। একটা ড্রিঙ্ক বানিয়ে রাখল ডরোথির জন্য।

একটু পর ডরোথি দিব্যি সেই পুরোনো দিনের স্টাইলে সেজেগুঁজে, গায়ে অপূর্ব পারফিউম ছড়িয়ে এসে বসল। গান শুনতে শুনতে রাম খেল, স্মোক করল, এক ফাঁকে ন্যাট কিং কোলের ‘রেনড্রপস আর ফলিং অন মাই হেড’ চালিয়ে দিল, তারপর আরেক ফাঁকে এলভিসের ‘লাভ মি টেণ্ডার, লাভ মি ঠু’ চালিয়ে দিল, কিন্তু একটাও কথা উচ্চারণ করল না। কেমন যেন ভুলেই গেল যে ওর সামনে কেউ বসে আছে।

কত রাত অবধি গান, পান, ধূমপান চলল কিন্তু বহু চেষ্টাতেও অরুণ আর ওকে কথা বলায় ফেরাতে পারল না। অরুণ বুঝতে পারল ডরোথির চারপাশ ঘিরে তখন শুধু টোনি, টোনি আর টোনি। মদের প্রভাবে কখন এক সময় ডরোথির উলটো দিকের সোফায় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।

তখন গানও বন্ধ হয়ে গেছে, বিন্দিয়া এসে না খাওয়া রোলের প্লেট, মদের খালি গেলাস সব তুলে নিয়ে গেছে। এক দফা কাশির পর নিজের সোফায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে ডরোথি। বিন্দিয়া ঘরের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়েছে।

সকালের এক টুকরো রোদ এসে মুখে পড়তেই ধড়মড় করে জেগে উঠল অরুণ। হাতের ঘড়িতে দেখল আটটা। আরেক টুকেরা রোদ দেখল পড়েছে ডরোথির আজও সুন্দর মুখটায়। একবার ডাকবে মনে করল ওকে, পরমুহূর্তে ভাবল, না থাক। কী সুন্দর হাসি হাসি মুখে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো ভোর রাতের স্বপ্নে এসেছে টোনি। শিশুদের মতো দেয়ালা করছে যেন আশ্চর্য নারীটি।

কিছুদিন আগে টেনিসনের ‘দ্য লেডি অফ শ্যালট’ থেকে কী সুন্দর আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল। যেন নিজেরই বর্ণনায় ওই আবৃত্তি। তা শুনে অরুণ হাততালিও দিয়েছিল, কিন্তু ডরোথির কোনো সাড়া পায়নি। আজও ডরোথির সাড়ার অপেক্ষায় নেই ও, নিদ্রিত নায়িকার রোদে রাঙানো মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে কবিতার এক অন্য অংশ থেকে আবৃত্তি শুরু করল অরুণ

But Lancelot mused a little space;
He said, ‘She has a lovely face;
God in His mercy lend her grace,
The Lady of Shalott.’

ফ্ল্যাট থেকে দিনের আলোয় বেরিয়েই অরুণ ভেতরে ভেতরে টের পেল ওর উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু কে। সেটা সুক নয়, দিদি শমিও নয়, ও নিজেও নয়। কাহিনির কেন্দ্রে একটাই নায়ক কিংবা নায়িকা, আর সেটা ডরোথি রবার্টস সুক। ডরোথির সেই কাহিনি একই সঙ্গে প্রেমের এবং খুনের। শেষবারের মতো ফিরে আসা নায়ককে খুন ও গুম করে নিজের প্রেমকাহিনিকে এক অপূর্ব মাত্রা দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। আর এখন স্বপ্নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়ে শুয়ে শুয়ে হাসছে। মৌলালির মোড়ে এসে একটা ট্যাক্সি ধরল অরুণ; পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের কোণে জমা জল মুছল। লেখকদের এত সহজে নাকি কাঁদতে নেই, লেখার ক্ষতি হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *