আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়ে

আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়ে

ব্যক্ত ধ্বনির নাম কথা। এই কথা দিয়েই গড়ে ওঠে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি। আর অব্যক্ত ধ্বনির নাম চিত্রশিল্প, অস্ফুট ধ্বনিই নৃত্যকলা এবং গান হচ্ছে স্কুটধ্বনি।

যে-ধ্বনি দিয়ে মানুষকে চটানো যায়, কাঁদানো যায়, হাসানো চলে এবং ভীত, চকিত, ত্রস্ত, স্তম্ভিত কিংবা আনন্দিত, অভিভূত, উত্তেজিত ও উৎসাহিত করা সম্ভব, সে-ধ্বনির–সে-কথার চেয়ে বড় শক্তি পৃথিবীতে কিছুই নেই। তাই বাক্যবলই শ্রেষ্ঠ বল।

ওহী কিংবা সূক্ত সবই এ বাক্য। কাজেই মানুষের জীবনে মুখ্য নিয়ন্ত্ৰী শক্তিই হচ্ছে কথা। ভাবতে গেলে মানুষ কথায় বাঁচে, কথায় মরে। এই তাৎপর্যেই বাকব্রহ্ম তত্ত্বের উদ্ভব।

সুচিত শব্দের সুবিন্যাসেই ভাব হয়ে উঠে বাঙময় মন্ত্র ও ইসম। তার সম্মোহনশক্তি অতুল্য। জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের অণুত অণুতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকে তার প্রভাব।

 সাহিত্য তাই বাকপটুতারই নামান্তর। একের ভাব-চিন্তাকে বহুর মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং বহুর প্রকাশোন্মুখ বদ্ধ ভাব-চিন্তাকে একের মধ্যে সংহত করে আবার সর্বহৃদয়ে সঞ্চারিত করে দেয়াই সাহিত্যিকের কাজ। চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পীর লক্ষ্যও তা-ই।

অতএব আঁকিয়ে, লিখিয়ে, বাজিয়ে, গাইয়ে-সবারই এক ব্ৰত এক অভীষ্ট–লোকহিতে লোকসেবা। এ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে যারা এক্ষেত্রে বিচরণ করেন, তাদের সৃষ্টি আবর্জনা এবং আবর্জনা মাত্রেই অসুন্দর ও অস্বাস্থ্যকর। এ ধরনের কলাকৈবল্যবাদী স্রষ্টা ও শিল্পী সবক্ষেত্রে গণশত্রু না হোন, গণবন্ধু যে নন তা বলাই বাহুল্য। অকাজের কাজে পণ্ডশ্রম তো আছেই, তাছাড়া তাদের ফুল-পাখি-প্রেম-প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক রচনা গণমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বলেই তা সুগতি ও প্রগতির অন্তরায়।

আপাতদৃষ্টে সাহিত্য-শিল্পাদি কলার দান দৃশ্য নয়, কিন্তু বাব্রহ্ম তত্ত্বে আস্থা রাখলে দেখতে পাব মূলত জীবনযাত্রীর জীবনের সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব প্রকট। মানুষের জীবনযাত্রার এ কেবল পাথেয় নয়, প্রেরণার উৎসও। বাজিয়েরা যেমন গাইয়ে-নাচিয়েদের তাল ঠুকে সুর তুলে সহায়তা করেন, শিল্পী-সাহিত্যিকরাও তেমনি চিন্তায় উদ্দীপনা, কর্মে প্রবর্তনা ও সগ্রামে অনুপ্রাণিত করেন। এ তাৎপর্যে তাঁরা মন্ত্রদাতা, চারণ কবি, বন্দী ও দিশারী। এখানে সাহিত্য-শিল্পের সংজ্ঞা অবশ্যই ব্যাপক করতে হবে। শিক্ষিত কিংবা লোকশিল্পীয় লিখিত কিংবা অলিখিত সব সৃষ্টিকেই এমনকি ছড়া ও স্লোগান, প্রাচীরলিপি ও প্রচারপত্র-ইস্তাহার ও ব্যঙ্গচিত্র সবকিছুকেই এক্ষেত্রে সাহিত্য-শিল্পের অন্তর্ভুক্ত ভাবতে হবে।

কেননা এগুলো মানুষের প্রয়োজন-প্রেরণাজাত চিন্তা ও আবেগের ফলপ্রসূ লেখা ও রেখাচিত্র। মন্ময় বাসনার এই তন্ময় প্রকাশ–ভালো-মন্দ-মাঝারি-ভেদ স্বীকার করেও–অবশ্যই সাহিত্য ও শিল্প। প্রেরণা-উৎসাহ-উত্তেজনা-উদ্দীপনা জাগানো লক্ষ্যে সৃষ্ট এসব লেখন ও অঙ্কন যদি একটি হৃদয়েও প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয় তা হলেই বলতে হবে প্রয়াস সার্থক। কেননা মানসজীবনের বিকাশ সাধনের এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজন মিটানোর সহায়ক হওয়াতেই সাহিত্য-শিল্পাদি কলার সার্থকতা ও সফলতা।

রণে যেমন রণবাদ্য, নৃত্যে-গীতে যেমন যন্ত্রসঙ্গীত, দুর্বহ বোঝা টানায় যেমন বোল, যৌথকর্মে যেমন গান, জাহাজে যেমন পাঞ্জেরী, নৌকায় যেমন হাল; মানুষের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে সাহিত্য-শিল্পাদি কলাও তেমনি দিশারী ও নিয়ন্তা।

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক, ধার্মিক কিংবা রাষ্ট্রিক আন্দোলন, বিপ্লব অথবা বিদ্রোহ জাগানোর জন্যে যেমন প্রেরণা-সঞ্চারী সাহিত্য ও শিল্পের প্রয়োজন তেমনি সে-সব সংগ্রাম চালু রাখার জন্যেও সাহিত্য-শিল্প আবশ্যিক। আবার সাহিত্য-শিল্প নতুন ভাব-চিন্তা কর্মের ফসলও। অতএব, সাহিত্য-শিল্পাদি কলা একাধারে বীজ ও ফল দুই-ই। জীবনে জাগরণ আনার জন্যে এবং জাগ্রত জীবনের চাহিদা পূরণের জন্যে সাহিত্য-শিল্পই মুখ্য অবলম্বন। গণজাগরণ যেমন সাহিত্য শিল্পের মাধ্যমেই সহজে সম্ভব, জাগ্রত জনতারও তেমনি সাহিত্যাদি কলাই শক্তির উৎস এবং কর্মোদ্যমের আকর। এসব কলা, বলতে গেলে, জীবনেরই উৎস ও অবলম্বন, শস্য ও স্বাক্ষর। অতএব জীবনের প্রয়োজনেই সাহিত্যাদি কলার এত আয়োজন।

আজকের দিনে আমাদের পরিবর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের প্রয়োজন পূরণ লক্ষ্যে আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়েদের ভাব-চিন্তা-কর্ম নিয়োজিত হওয়া আবশ্যিক। ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র, সামাজিক জীবনে সাম্য ও স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে সংস্কারমুক্তি ও গ্রহণশীলতা, আর্থিক জীবনে সমসুযোগ ও সুবিচার রাষ্ট্রিক জীবনে দায়িত্ব-চেতনা ও অধিকারবোধ প্রভৃতি কাম্যবস্তু লাভের সহায়ক হতে হবে আমাদের আঁকিয়ে-লিখিয়ে-গাইয়েদের সাধনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *