অ-আ-ক-খুনের কাঁটা – ৫

পাঁচ

পয়লা নভেম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে একটা বিশ্রি দুর্ঘটনা ঘটল।

বেলা তখন আটটা। চিলে কোঠার ঘর থেকে নিচে নেমে দোতলার ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়ে মাস্টারমশাই হাঁকাড় পাড়লেন, বৌমা?

দোতলায় ওঁরা তিনজনে প্রাতরাশে বসেছিলেন। প্রমীলা এসে বললেন, মাস্টারমশাই? আসুন ভিতরে আসুন।

—না বৌমা, ভিতরে যাব না। তোমার সারা মেঝে নোংরা হয়ে যাবে। এমনিতেই এই দেখনা…হাতটা বিশ্রীভাবে কেটে গেল…ইয়ে, দাশু আছে? একটা ব্যান্ডেজ…

ডান হাতখানা তিনি বাড়িয়ে ধরলেন। ডান হাতের তালু দিয়ে টপ্ টপ্ করে রক্ত পড়ছে. ওঁর ধুতি, জামার আস্তিন রক্তে মাখামাখি!

—ঈস! কী-করে এমন হল!…ওগো…শিগগির এস…

ডক্টর দে চায়ের কাপটা নামিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলেন। দেখেই বললেন, মৌ! আমার ডাক্তারী ব্যাগটা—কুইক্

প্রাথমিক চিকিৎসা যা করার তৎক্ষণাৎ করা হল। হাতের তালুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা হল। ডক্টর দে ওঁকে জোর করে একটা খাটে শুইয়ে দিলেন। একটু গরম দুধও খাইয়ে দিলেন স-ব্র্যান্ডি। বললেন, এভাবে হাত কাটলেন কী করে?

—পেন্সিল ছুলতে গিয়ে।

—আপনি নিজে নিজে আর পেন্সিল কাটবেন না। মৌকে বলবেন, আর না হলে ঐ যে ঘোরানো পেন্সিল-কাটা কল পাওয়া যায় তাই দিয়ে কাটবেন।

মাস্টারমশাই হেসে বললেন, আর দাড়ি? শেভ করে দেবে কে? তুই?

ঠিকে ঝিকে প্রমীলা বললেন, তিনতলার ঘরটা মুছে দিয়ে আয় তো কুসমির মা। ঝি বাসন মাঝছিল, বললে, দেব মা, হাতটো অপ্সর হোক্ পহিলে।

প্রমীলার মনে হল হয়তো চিলে-কোঠার ঘরখানা খোলা রেখেই মাস্টারমশাই নিচে নেমে এসেছেন। সে ঘরের একটি ডুপলিকেট চাবি ওঁর কাছে বরাবরই থাকে। ঘরে আর কিছু না থাক একটা দামী টাইপ-রাইটার আছে। তাছাড়া রক্তারক্তি কাণ্ড কতটা হয়েছে দেখতে প্রমীলা নিজেই চাবিটা হাতে নিয়ে তিনতলায় উঠে গেলেন।

ঘরে ঢুকেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি!

সিঁড়ি থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের একটা ধারা শেষ হয়েছে ওঁর টেবিলে। সেখানে গিয়ে দেখলেন, মাস্টারমশায়ের ছড়ানো পাণ্ডুলিপির পাশেই টেবিলের উপর পড়ে আছে একটা বাঁধানো ফটো। চিনতে পারলেন সেটা। এটা বহুদিন আছে ওঘরে। মাস্টারমশায়ের নয়। একজন স্বনামধন্য পুরুষের। গুরুগিরি তাঁর ব্যবসা। অনেক শিষ্য আছে তাঁর। প্রতি বৎসর জন্মোৎসবে খবরের কাগজে তাঁর নাম, ফটো আর আশীর্বাণী ছাপা হয়। ভক্তদের খরচে। সম্প্রতি একটি নারীঘটিত ব্যাপারে ঐ প্রৌঢ় গুরুজীর নামে কিছু কেচ্ছা খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। বিধবার সম্পত্তি গ্রাস অথবা শ্লীলতাহানি, কী-যেন ব্যাপারটা! দাশরথী এঁর শিষ্য নন, গুণগ্রাহীও নন। তাঁর কোনও রুগী রোগমুক্ত হবার পর ফটোখানি ডাক্তারবাবুকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন, এটা শোবার ঘরে মাথার কাছে টাঙিয়ে রাখবেন ডাক্তারবাবু। ‘বাবা’র আশীর্বাদ তাহলে নিত্য পাবেন। ডক্টর দে স্নেহের দানটি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রীকে রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘শোবার ঘরে এঁকে রাখা যাবে না। মাথার দিকে রাখলে রোজ ঘুম ভেঙে শ্রীমুখখানি দেখতে পাব না, পায়ের দিকে রাখলে তা পাব—কিন্তু তাহলে ‘বাবা’র আশীর্বাদের বদলে হয়তো অভিশাপটাই জুটবে কপালে।’ প্রমীলা জানতেন, তাঁর স্বামী এসব গুরুবাদে বিশ্বাসী নন। ছবিখানি তাই দীর্ঘদিন চিলেকোঠার ঘরে হুক থেকে ঝুলছিল।

বর্তমানে দেখলেন, ফটোর কাচটা চুরমার হয়ে ঘরময় ছড়ানো। আর একটা পেন্সিল-কাটা ছুরি ছবিটার উপর এত জোরে মারা হয়েছে যে, ছবি ও ফ্রেম ভেদ করে ছুরির ফলাটা টেবিলে গেঁথে আছে!!

প্রমীলা ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিলেন। ছুরিটা সাবধানে উপড়ে নিলেন এবং একটি পুরানো খবরের কাগজে সব কিছু জড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে সন্তর্পণে নিচে নেমে এলেন। লুকিয়ে ফেললেন সব কিছু।

একটু পরে ঝি এসে ঘরটা ভিজে-ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দিয়ে গেল।

মৌ দুপুরে কলেজে বেরিয়ে যাবার পর আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা স্বামীকে জানালেন।

মাস্টারমশাই তখন তিনতলায় ঘুমাচ্ছেন। আজ আর বই ফিরি করতে বার হননি তিনি।

বিকেলে দাশরথী ওঁকে দেখতে এলেন। ওঁকে দেখে মাস্টারমশাই উঠে বসে বলেন, আয় দাশু। বোস্। আজ আর বের হইনি। কালও আমার ছুটি।

—দুপুরে ঘুমটা হয়েছিল?

—হ্যাঁ। তুই বোধহয় ঘুমের ওষুধ কিছু দিয়েছিলি। নয়? দুপুরে এত ঘুমাই না তো! ডাক্তারবাবু বুঝতে পেরেছেন—কী কারণে মাস্টারমশাই ঐ ছবিখানি পেড়ে তাকে ছুরি-বিদ্ধ করেছেন। গুরু মহারাজের কেচ্ছা-সংক্রান্ত সাময়িক পত্রিকাখানা পড়ে আছে খাটের উপর। তিনি বরং জানতে চাইলেন— কেন মাস্টারমশাই তখন অমন মিথ্যা কথাটা বললেন : পেন্সিল ছুলতে গিয়ে ওঁর হাত কেটেছে। কিন্তু সরাসরি সে প্রশ্নটা পেশ করলেন না। গল্পগুজবের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে বললেন, ঐ টাইপ-রাইটারটা কত দিয়ে কিনেছিলেন স্যার?

—কিনিনি তো। ওটা আমার এক ছাত্তর উপহার দিয়েছিল।

—ছাত্র? আমাদের ব্যাচের? কী নাম?

—না, তোদের ব্যাচের নয়! সেই যে ছেলেটাকে পরীক্ষার হলে গলা টিপে ধরেছিলুম।

—তাই নাকি? তার সঙ্গে তাহলে আপনার দেখা হয়েছিল? তবু নামটা মনে পড়ে না?

—দেখা তো হয়নি। একটা বেগানা লোক হঠাৎ একদিন ওটা আমাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল সেই ছেলেটির একটি চিঠি। সে সময় আমি বেকার! থাকতুম একটা ছাপাখানায়। এক গাড়োল অধ্যাপকের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় আমার চাকরি যায়। লোকটা অঙ্কের কিছু জানত না, বুঝলি? যে অঙ্ক পাঁচটা স্টেপে কষা যায়, তাকে….

বাধা দিয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, সে গল্প আপনি আগেও বলেছেন। টাইপ-রাইটারটার কথা বলুন।

—হ্যাঁ। টাইপ-রাইটার। তখন তো আমি বেকার! কী করব, কোথায় দু মুঠো অন্নসংস্থান হবে এই চিন্তা। এমন সময় একটা বেগানা লোক পৌঁছে দিয়ে গেল ঐ উপহারটা। আর একখানা চিঠি। দাঁড়া তোকে দেখাই…

কাগজপত্র অনেক ঘেঁটেও পত্রটি খুঁজে পেলেন না উনি। শেষে বললেন, তাহলে বোধহয় যত্ন করে রাখিনি। তবে চিঠির বক্তব্যটা আমার মনে আছে। হতভাগা লিখেছিল—”স্যার! আমার অপরাধেই আপনার চাকরি যায়! টুকছিলাম আমি, আর চাকরি খোয়ালেন আপনি! আমি এখন ভালোই রোজগার করি। শুনেছি আপনি বেকার। চাকরি জোগাড় করা আপনার পক্ষে শক্ত। কিন্তু আপনি তো ভালো টাইপ করতে পারতেন, স্যার! এক কাজ করুন—হাইকোর্টের কাছে অনেকে ফুটপাথে বসে টাইপ করে, নিশ্চয় দেখেছেন। দলিল দস্তাবেজ কপি করে। স্বাধীন ব্যবসা। চাকরি খোয়াবার ভয় নেই। এই সঙ্গে একটি টাইপ-রাইটার, কাগজ আর কার্বন পাঠিয়ে দিলাম। আবার আপনি নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ান। এটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার নামটা উচ্চারণ করতেও লজ্জা হয়। যদি আমার নাম ভুলে গিয়ে থাকেন তবে ভুলেই থাকুন। মনে আনবার চেষ্টা করবেন না। ইতি আপনার অযোগ্য সেই ছাত্র।” বুঝলি দাশু! চিঠি পড়া শেষ করে তাকিয়ে দেখি যে-লোকটা যন্ত্রটা নামিয়ে রেখেছে সে ইতিমধ্যে হাওয়া?… ছেলেটার মনটা ভালো ছিল, তাই না? ওর গলা টিপে ধরাটা আমার উচিত হয়নি।

ডাক্তারবাবু এবার প্রসঙ্গান্তরে চলে আসেন। দেওয়ালের একটা হুকের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ওখানে একটা ছবি ছিল না, মাস্টারমশাই?

শিবাজীপ্রতাপ অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাঁ, হুক আছে, ফ্রেমের অবস্থিতিজনিত কারণে দেওয়ালের রঙের সঙ্গে ঐ জায়গাটার একটা বর্ণপার্থক্যও নজরে পড়ে। দীর্ঘসময় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ঠিকই বলেছিস! ওখানে অনেকদিন ধরে একটা ছবি টাঙানো ছিল। কার ছবি বলতো?

দাশরথী স্বীকার করলেন না। বলেন, না, এমনিতেই মনে হল। দেওয়ালে কেমন একটা চৌকো দাগ হয়েছে না? অনেকদিন কোনও ছবি টাঙানো থাকলেই সচরাচর এমন দাগ হয়।

—য়ু আর পার্ফেক্টলি কারেক্ট মাই বয়! আশ্চর্য! কিছুতেই মনে পড়ছে না তো! অথচ এঘরে আমিই তো থাকি! আমার মনে পড়া উচিত! কার ছবি হতে পারে?

দাশরথী বুঝতে পারেন, ‘হত্যা’ মানে মুছে ফেলা। ছুরিটি গেঁথেই ওঁর মানসিক প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। তাই স্মৃতি থেকে ঐ অপ্রিয় লোকটার ছবিও মুছে ফেলেছেন। এককালে যেমন অঙ্ক কষা হয়ে গেলে ব্ল্যাকবোর্ড মুছে ফেলতেন।

তাই আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা অমুক ব্রহ্মচারীর কি?

—হতে পারে! আই ডোন্ট রিমেম্বার! তবে ভালোই হয়েছে, ছবিটা খোয়া গেছে। লোকটা ভালো ছিল না, বুঝলি দাশু? পরশু কাগজে কী লিখেছে দেখেছিস?

—না! কী?

আশ্চর্য! সংবাদপত্রে যেটুকু বার হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। শুধু সেই বিধবার নামটুকুই নয়, সাল-তারিখ, বিধবার সম্পত্তির আর্থিক মূল্য—সব কিছু! সে-রাত্রে প্রমীলা স্বামীকে বললেন, তুমি অন্য কিছু ব্যবস্থা কর বাপু! আমার ভয় করে! এ কেমন জাতের পাগল?

ডক্টর দে বলেন, কেমন জাতের পাগল তা তোমাকে কী করে বোঝাই বল? মস্তিষ্কের যে-অংশটা স্মৃতিকে ধরে রাখে তার কয়েকটা স্নায়ু জট পাকিয়ে গেছে ওঁর! আর উনি একটা মনগড়া দুনিয়া গড়তে চান—এ দুনিয়ার কোনও কোনও বস্তু বা প্রাণীর উপর প্রচণ্ড বিদ্বেষে…

—ও সব বড় বড় কথা থাক। আজ যে কাণ্ডটা হল, এর পর ওঁকে বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না। কোনও দিন হয়ত ছুরি নিয়ে মৌকেই…

দাশরথী কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে একটি সিগারেট ধরালেন। মাস্টারমশাইকে তিনি সত্যিই ভালোবাসেন। হারানো বাপের মতোই। কিন্তু প্রমীলা যে কথা বলছে সেটাও ভাববার। মাস্টারমশাই মাঝে মাঝে যে ধরনের আচরণ করেন তা সুস্থ মানুষের নয়। তাকে রীতিমতো ‘পাগলামী’ বলা চলে। উনি নিজে ডাক্তারমানুষ। যখন বাইরে যান তখন মৌ আর প্রমীলা এ বাড়িতে অরক্ষিত থাকে। স্বজ্ঞানে না হোক ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় যদি মাস্টারমশাই—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *