তিন
গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা এটা নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। বাসুসাহেবের পত্র এবং অধরবাবুর পঞ্চত্ব এ দুটি ‘প্রাপ্তি’ যোগ নিঃসম্পর্কিত। ‘কে’ খুন করেছে সেটা বোঝা না যাবার একটিই হেতু :
অধরবাবুর জীবনে এমন একটা অনুদ্ঘাটিত অধ্যায় আছে, যার কথা এখনো জানা যায়নি। হয়তো জানতেন অধরবাবু এবং আততায়ী। একোয়ারি? সে তো রুটিনমাফিক হচ্ছেই। খবরটা এত নগণ্য যে, দুদিন পরে দু-একটি সংবাদপত্রে ভিতরের পাতায় ‘অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি কর্তৃক আসানসোলে দোকানদার নিহত’ সংবাদটা যে ছাপা হয়েছিল তা সুনীল, কার্তিক এবং বাসু-পরিবারের কজনের বাইরে হয়তো কারও নজরেই পড়েনি।
কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল যখন বাসুসাহেব দ্বিতীয় একখানা পত্র নিয়ে এসে হাজার হলেন পুলিসের কাছে।
অ-অ-ক-খুনের কাঁটা একই জাতের খাম, একই জাতের কাগজে, সম্ভবত একই টাইপ-রাইটারে ছাপা কাগজটার পিছন দিকে জ্যামিতির একটা প্রতিপাদ্য প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কাগজটা লম্বালম্বিভাবে ছিঁড়ে ফেলায় অঙ্কটা বোঝা যাচ্ছে না। পরপৃষ্ঠায় একটা ছাপা-ছবি অন্য কোনও বই থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা। জীবটা অদ্ভুতদর্শন। এবার রঙিন ছবি নয়।
একরঙা। তার তলায় লেখা :
‘B’ FOR BECHARATHERIUMAIH NAMAH!
“শ্রীযুক্ত বাবু পি. কে. বাসু. বার-অ্যাট-লয়েষু,
“বেচারা মহাশয়,
“পঞ্চবিংশতিটি সুযোগ বাকি থাকিতেই এতটা মুষড়াইয়া পড়িলেন কেন?” “গাড্ডু কে না মারে?”
“ট্রাই-ট্রাই-ট্রাই এগেন : ‘B’ FOR BURDWAN! তাং : এ মাসের সাতাশে। ইতি
গুণমুগ্ধ B-C-D”
এস. এস. ওয়ান, অর্থাৎ স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট বার্ডওয়ান রেঞ্জ বললেন, দেখা যাচ্ছে, আপনার অনুমানই ঠিক। অধরবাবুর খুন আর আপনার ঐ রহস্যজনক পত্র সম্পর্ক-বিযুক্ত নয়। লোকটা আবার হুমকি দিয়েছে। আজ বাইশ তারিখ। পুরো পাঁচদিন সময় আছে। রাস্কেলটাকে এবার ধরতেই হবে! যেমন করে হোক!
—কিন্তু কী স্টেপ নিতে চাইছেন আপনারা?
—সমস্ত ব্যাপারটা খবরের কাগজে ছাপিয়ে দিয়ে। ‘B’ অক্ষর দিয়ে যাদের নাম এবং বর্ধমানে থাকে, তারা যাতে সাবধান হতে পারে।
—নাম না উপাধি?
—ও ইয়েস্। অধর আঢ্যির নাম উপাধি দুটোই ছিল ‘এ’ দিয়ে।
আই. বি. ক্রাইম বললেন, কিন্তু তাতে কি আমরা রাস্কেলটার ফাঁদেই পা দিচ্ছি না? আমার ধারণা লোকটা ‘মেগ্যালোম্যানিয়াক’—অর্থাৎ তার মস্তিষ্কবিকৃতির অবচেতনে আছে একটা আকাশজোড়া ‘হামবড়াই’ ভাব! বাসুসাহেবের উপর সে টেক্কা দিতে চাইছে। সে পাবলিসিটি চাইছে। মানে ‘নটোরিটি’। কাগজে সব কথা জানিয়ে দিলে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। সে যা চায়,—বাসুসাহেবের চেয়ে বেশি নাম—তা সে ‘বিখ্যাতই হোক বা ‘কুখ্যাত ই–তাই সে পেয়ে যাবে।
সি. আই. ডি. সিনিয়ার ইন্সপেক্টার বরাট বলেন, আপনি কী বলেন বাসুসাহেব?
বাসু বললেন, এ ক্ষেত্রে আমি একজন পার্টি। আমার কিছু বলা শোভন হবে না। লোকটা আমাকেই ‘চ্যালেঞ্জ থ্রো’ করেছে। যদি আমি বলি—”খবরের কাগজে সব ছাপা উচিত নয়’ তাহলে কেউ মনে করতে পারেন ‘ব্যাচারা-থেরিয়াম’ মুখ লুকাতে চাইছে। তাই আমার পরামর্শ—আজ সন্ধ্যায় একটা কনফারেন্স ডাকুন। দু-একজন ধুরন্ধর ক্রিমিনলজি এক্সপার্ট এবং মনস্তত্ত্ববিদ, আমরা কজন তো আছিই আর ও. সি. বর্ধমানকে একটা ফোন করে অ্যাটেন্ড করতে বলুন। আপনারা সবাই মিলে স্থির করুন—কী কী স্টেপ আমরা নেব, খবরের কাগজে সব কিছু ছাপিয়ে দেব কিনা।
আই. জি. ক্রাইম বললেন, যুক্তিপূর্ণ কথা। তাই করুন। বিকাল পাঁচটায় আপনার অসুবিধা হবে না তো বাসুসাহেব?
—না। আসানসোলের কেসটার আর কোনও ক্লু পাওয়া গেল?
—হ্যাঁ, একটা মাইনর ব্লু। ঐ আনকোরা ‘গীতা’ বইখানা কোথা থেকে এল। রবি আরও ইন্টেন্সিভ এন্কোয়ারি করে জেনেছে—একজন ফেরিওয়ালা সন্ধ্যা নাগাদ ঐ পাড়ায় কিছু বই বিক্রি করতে এসেছিল। অধরবাবুর দোকানের পরের দোকানদার তার কাছে কী একটা ধর্মপুস্তক কিনেছিলেন। একটা বুড়ো মতো লোক, ঝোলায় করে বই ফিরি করছিল। টেন-পার্সেন্ট কমিশনে সে বাড়ি-বাড়ি বই বিক্রি করে। সম্ভবত অধরবাবু তার কাছেই বইটা কেনেন।
—বুড়ো মতন লোক? কী রকম দেখতে কিছু বলেছে? লম্বা না বেঁটে, দাড়ি-গোঁফ … বাধা দিয়ে আই. জি. সাহেব বলেন, দ্যাটস্ ইম্মেটিরিয়াল। ফেরিওয়ালা বই বেচতে এসেছিল সন্ধ্যায়। অথচ সুনীল তার বাবাকে রাত দশটা পর্যন্ত জীবিত দেখেছে।
বাসু গম্ভীর হয়ে বলেন, তা বটে! তবু আজ সন্ধ্যায় কি রবি বসুকেও আনানো যায় না?
আই. জি. সাহেব শ্রাগ্ করলেন। বলেন, যাবে না কেন? একটা ফোন করলেই সে চলে আসতে পারবে। এখন তো সকাল সাড়ে দশটা। কিন্তু তার কি কোনও প্রয়োজন আছে ব্যারিস্টার সাহেব?
—আছে! আরও একটা অন্যায় অনুরোধ করব, দেখুন যদি মঞ্জুর করা সম্ভবপর হয়। –বলুন?
—আপনারা মেনে নিয়েছেন ‘আসানসোল’ আর ‘বর্ধমান’ দুটো বিচ্ছিন্ন কেস নয়। দুটো খুন একই আততায়ীর হাতের কাজ—
ইন্সপেক্টার বরাট বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আপনার ডিডাকশানটা একটু প্রিম্যাচিওর হয়ে যাচ্ছে না বাসুসাহেব? ‘বর্ধমানে’ কোনও খুন হয়নি। হবেই, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই।
বাসু একটু বিরক্ত হয়ে বলেন, অল রাইট—চক্রধরপুর, চিনসুরা বা চাকদার কেসের পর না হয় সে বিষয়ে আলোচনা করব—
আই. জি. সাহেব বরাটের দিকে একটা ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলেন, না না, ব্যাপারটা এখন অত্যন্ত সিরিয়াস। একজন ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়্যাক’ সমাজে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও সে বাসুসাহেবকে চিঠি লিখছে—কিন্তু চ্যালেঞ্জটা আমাদের সকলের প্রতিই প্রযোজ্য। আসানসোলের কেসটাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি। এবার আমি সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে চাই। বলুন, বাসুসাহেব, কী যেন বলছিলেন?
—আমি বলতে চাই, লোকটা কে জানি না, উদ্দেশ্য কী তাও জানি না; কিন্তু তার কর্মপদ্ধতি সে পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করেছে। ‘এ. বি. সি.’ করে সে ক্রমাগত খুন করে যাবে। আসানসোলে সে আমাদের বেইজ্জৎ করেছে। বর্ধমানে করতে যাচ্ছে সাতাশ তারিখে। এর পর ‘চুঁচুড়া’ ‘চাকদহ’ ‘চন্দ্রকোণা রোড’ কোনও একটা জায়গা সে বেছে নেবে। প্রত্যেকটি এলাকা ভিন্ন ভিন্ন ও. সি-র এক্তিয়ারে। আপনারা কি মনে করেন না একজন বিচক্ষণ ‘অফিসার-অন-স্পেশাল-ডিউটি’ নিয়োগ করে প্রতিটি কেকে লিংক-আপ করা উচিত? না হলে প্রতিটি থানা অফিসার খণ্ড খণ্ড চিত্রই শুধু পাবে। আততায়ীকে ধরা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
—য়ু আর পার্ফেক্টলি কারেক্ট। একজন সিনিয়ার ইন্সপেক্টরকে আমরা O.S.D. করে দেব। সে আপনার সঙ্গে অ্যাটাচ্ড্ থাকবে। ইন্ ফ্যাক্ট—আপনার নির্দেশেই সে কাজ করবে। আমি আপনাকে পূর্ণ তত্ত্বটা দিতে চাই ব্যারিস্টারসাহেব!
ইন্সপেক্টার বরাট আর এস. এস. ওয়ান-এর দৃষ্টি বিনিময় হল। আই. জি. ক্রাইম যে আরক্ষাবিভাগের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না এটা স্পষ্টই বোঝা গেল। ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি আই. জি.-রও। তাই ইন্সপেক্টার বরাটের দিকে ফিরে বললেন, আপনার সি. আই. ডি. সমান্তরালে কাজ করে যাবে। আমি তাতে কোনও হস্তক্ষেপ করছি না। কিন্তু অজ্ঞাত আততায়ী যেহেতু বাসুসাহেবকেই বারে বারে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখছে তাই তাঁকে আমি এ সুযোগটা দিতে চাই। আমি আশা করব, আপনারা সমান্তরালে তদন্তের বার্তা বিনিময় করে পরস্পরকে অবহিত করবেন। কোনওক্রমেই যেন রাসেলটা ‘B’ পার হয়ে ‘C’-তে না পৌঁছাতে পারে। এখন বলুন ব্যারিস্টারসাহেব, আপনি কি এ তদন্তের জন্য অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে বিশেষ কাউকে পেতে চান? আপনি এদের অনেককেই চেনেন
—তা চিনি। আমি খুশি হব যদি আসানসোল সদর থানায় নেক্সট-ম্যানকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে রবিকে আপনারা মুক্তি দেন। মাসখানেকের জন্য রবি বোসকে আমার সঙ্গে অ্যাটাচ করে দিন। ছোক্রা ভারি কাজের এবং বুদ্ধিমান!
—তাই হবে, আমি ব্যবস্থা করছি। সে আজ সন্ধ্যার মিটিঙে আসবে। থানার চার্জ নেক্সট-ইন-কমান্ডকে সাময়িকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে।
— থ্যাঙ্কু!
.
একুশ তারিখ, সকাল।
ডাক্তার দে তিনতলায় উঠে এসে দেখলেন মাস্টারমশাই টেবিলে বসে একমনে কী যেন টাইপ করছেন। দরজা খোলাই ছিল। ডাক্তার দে ঘরে প্রবেশ করে ওঁর খাটে বসলেন। তবু বৃদ্ধের হুঁস হল না। দাশরথী ঝুঁকে পড়ে দেখলেন—মাস্টারমশায়ের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাসংখ্যা একশ বাহান্ন।
একটু গলা খাঁকারি দিলেন তিনি।
—কে? ও তুই? দাশু? কখন এলি?
—একটু আগে। আপনার লেখা কতদূর হল?
—আর্যভট্ট চ্যাপটারটা শেষ হয়ে এল।
দাশরথী জানেন, এ পাণ্ডুলিপি কোনও দিনই ছাপা হবে না। আজ ছয় মাস ধরে তিনি লিখছেন, কাটাকুটি করছেন, আর কপি করছেন। অজ্ঞাত লেখকের “স্টাড্ িঅফ্ ম্যাথমেটিক্স ইন অ্যানসেন্ট (এনশেন্ট?) ইন্ডিয়া” কোনও প্রকাশকই কোনওকালে ছাপবে না। তা জেনেও মাস্টারমশাইকে উৎসাহ দিয়ে যান : ‘অকুপেশনাল থেরাপি!’ মনোমত কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পারলেই ওঁর মানসিক ভারসাম্য আবার কেন্দ্রচ্যুত হয়ে যাবে না।
বললেন, আমি বলি কি স্যার, আপনি ক্যানভাসারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের জন্য ঐ লেখাটা নিয়ে পড়ুন। মাসে-মাসে ঐ কটা টাকার জন্য…
—ঐ কটা নয়, দাশু! সাড়ে চার শ! বইটা ছাপতে খরচও তো আছে।
—সে দায়িত্ব আমাদের। আপনার ছাত্রদের। আপনি তা নিয়ে কেন ভাবছেন?
বৃদ্ধ হাসলেন। বললেন, এসব কথা তুমি আগেও বলেছ দাশু। দুটো কারণে আমি চাকরিটা ছাড়ছি না। এক নম্বর, এতে বাধ্যতামূলকভাবে আমি অ্যাকটিভ্ থাকছি। আমি যে রকম গেঁতো, চাকরি ছাড়লে দিনরাত বসে বসে লিখব। তার মানেই অজীর্ণ, ব্লাডপ্রেসার…
—কেন? সপ্তাহে তিনদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরী যাবেন! রেফারেন্সও তো দরকার…
—তা দরকার। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটা কী জানিস দাশু? জীবনভর অঙ্কই শুধু কষে গেলাম। ভগবানের নাম তো কোনওদিন নিইনি! পারানির কড়ি গুনে দেব কী দিয়ে? আসলে কাজটা তো ভালো—বাড়ি-বাড়ি ভালো ভালো বই ফিরি করে আসা! কথামৃত, গীতা, রামায়ণ; বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ এঁদের লেখা বই!
—এরপর আর কথা নেই। দেখি, হাতটা দিন। আজ আপনার ইজেকশান নেবার দিন।
বৃদ্ধ বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন, কী ওষুধ রে ওটা?
—নাম শুনে কী বুঝবেন? ‘অ্যানাটেন্সল ডিকোনায়েড’।
—এ ইন্জেকশনে কী হয়?
ডাক্তার দে হেসে বলেন, ‘অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন/ইহলোকে সুখী, অন্তে বৈকুণ্ঠে গমন।’
অট্টহাস্য করে ওঠেন বৃদ্ধ। বলেন, না। আমি তো এক্কেবারে ভালো হয়ে গেছি। মাস-তিনেকের মধ্যে একবারও ‘এপিলেকটিক ফিট’ হয়নি। কারও গলা টিপেও ধরিনি!
—স্মৃতিশক্তি?
—না। সে জটিলতাটা আছে। পিথাগোরাস থিওরেম বল, বাইনোমিয়াল থিওরেম বল, নাইন-পয়েন্ট সার্কেলের প্রুফটা বল—গড়গড় করে বলে যাব। কিন্তু যদি বলিস—কাল বিকালে কোথায় ছিলেন, কী করেছিলেন, হয়তো কিছুতেই মনে করতে পারব না। ও মাসে মৌ ওদের কলেজ সোশালে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। হিসাব মতো আমি নাকি বৌমার সঙ্গে তিন ঘণ্টা নাচ-গান-অভিনয় দেখেছি। কিন্তু পরদিন সকালে সব, স–ব ব্ল্যাঙ্ক! মৌ অনেক হিন্টস্ দিল—কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না—পূর্বরাত্রের সন্ধ্যাটা আমার কেমন ভাবে কেটেছে।
—হুম্। কিন্তু তাহলে আশ্রমের নির্দেশমত আপনি কী করে বাড়ি-বাড়ি বই ফিরি করেন?
—এই যে, ডায়েরি দেখে দেখে। এই দ্যাখ না, কাল যাব শ্রীরামপুর, পরশু অফ, চব্বিশে রাসবিহারী অ্যাভিন্যুতে ‘প্রিয়া’ সিনেমা থেকে গড়িয়াহাটের মোড় পর্যন্ত প্রত্যেকটি বাঁ-দিকের দোকান, পঁচিশে ছুটি, ছাব্বিশে বর্ধমান—ফিরব আঠাশে সকালে…সব ডায়েরিতে লেখা আছে।
—আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনার সেদিনের সেই ঘটনাটা মনে পড়ে?
—কোনটা রে?
—সেই যে ‘পরীক্ষার হল’-এ একটি ছেলেকে টুক্তে দেখে আপনি ক্ষেপে গিয়ে তার গলা টিপে ধরেছিলেন?
মাস্টারমশাই অনেকক্ষণ নিজের রগ টিপে বসে রইলেন। বললেন, ছেলেটার নাম মনে পড়ে না! চেহারাটাও নয়!
—আমাদের আগের ব্যাচের ছেলে?
—কী জানি! মনে নেই, কী জানিস দাশু। আসলে ঘটনাটা আমার একটুও মনে পড়ে না। এমনকি সেই পূজা-প্যাণ্ডেলে যে ছেলেটা বেলেল্লাপনা করছিল তার গলা টিপে ধরার কথাও নয়। তবে বারে বারে শুনে শুনে একটা মনগড়া ছবি আমি তৈরি করে নিয়েছি। আমার মনের পটে যে ছবি তাতে পরীক্ষার ‘হল’-এ যে টুকছিল তার মাথায় শিং ছিল, পূজা-প্যাণ্ডেলের মূর্তিটা সরস্বতীর আর বজ্জাত ছেলেটার ল্যাজ ছিল! অথচ ঘটনাটা ঘটে দুর্গা-পূজা প্যান্ডেলে। সুতরাং স্বীকার করতেই হবে—সত্যি ঘটনাগুলো আমার একদম মনে নেই।
যাক। ওসব কথা জোর করে মনে আনবার চেষ্টা করবেন না। এখন তো আপনি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। না হলে কেউ পারে অমন একখানা গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখতে?
মাস্টারমশাই উত্তরটায় সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষ খুন করবার জন্য আমার হাত এমনভাবে নিশপিশ করে কেন বল তো?
—মাঝে মাঝে তো নয়, এমন ঘটনা আপনার জীবনে মাত্র তিনবার ঘটেছে।
—আসল দোষটা কার জানিস? আমার বাবার!
—আপনার বাবার?
—হ্যাঁ নামকরণ করাটা। শিবাজী, রাণা প্রতাপের সঙ্গে আমার নামটা যুক্ত করে তিনি আমাকে একটা বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি করতে চেয়েছিলেন। আর আমি হলাম গিয়ে নগণ্য থার্ড মাস্টার! হয় তো সেই ব্যর্থতাই এভাবে তির্যক প্রকাশ পায়!
—ওসব চিন্তা একদম করবেন না স্যার!
—বলছিস?
লডন স্ট্রিটে আই. জি. ক্রাইমের ঘরে বসেছে একটা গোপন মন্ত্রণা সভা।
বাইশ তারিখ সন্ধ্যা পাঁচটায়।
সকাল বেলা যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে আরও কজন যোগ দিয়েছেন। আসানসোল থেকে রবি, বর্ধমান থানার ও. সি. আবদুল মহম্মদ, একজন রিটায়ার্ড ক্রিমিনোলজির এক্সপার্ট ডঃ ব্যানার্জি এবং ডক্টর পলাশ মিত্র, প্রখ্যাত মানসিক চিকিৎসাবিদ। রাঁচী উন্মাদ আশ্রম থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন বছর তিনেক।
ডঃ ব্যানার্জি পত্র দুটি পরীক্ষা করে দেখেছেন। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তিনি একমত। পত্র দুটি একটা টাইপ-রাইটারে ছাপা এবং সম্ভবত একই ব্যক্তির ড্রাফট। তাঁর ধারণা লোকটা পাগলাটে—পাগল কিনা বলা কঠিন। তবে সে জীবনে ব্যর্থ। প্রতিষ্ঠা চায়। দ্বিতীয় খুনটা সে কাকে করতে যাচ্ছে তা না জানা পর্যন্ত তার সম্বন্ধে আর কিছু বলা সম্ভব নয়।
ডক্টর পলাশ মিত্রর সুচিন্তিত অভিমত : লোকটা ‘মেগালোম্যানিয়াক্’–অৰ্থাৎ মনে করে যে, সে এক দুর্লভ প্রতিভা। তার যা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল তা সে পায়নি। এই পথেই সে বিখ্যাত বা কুখ্যাত হতে চায়। তার পড়াশুনার রেঞ্জটা ভালো। ইংরাজী জ্ঞান টনটনে, টাইপিঙের হাত খুব ভালো। কৌতুকবোধ প্রখর। ‘পাগল’ বলতে সচরাচর আমরা যা বুঝি তার আকৃতি মোটেই সে রকম নয়। পথেঘাটে দেখলে, বা আধঘণ্টা তার সঙ্গে খোশ গল্প করলেও হয়তো বোঝা যাবে না যে, সে পাগল। আরও বললেন, এ জাতীয় হত্যাবিলাসী বা ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক’রা দু জাতের হয়ে থাকে। প্রথম জাতের হত্যাবিলাসীরা বিশেষ এক জাতের মানুষকে খুন করে যায়—ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, ব্যবসায়ী, বিপরীত-লিঙ্গের মানুষ, স্কুল-টিচার ইত্যাদি। মনঃসমীক্ষণ করে দেখা গেছে তার পিছনে একটা-না-একটা অতীত ইতিহাস থাকে, ঐ জগতের মানুষের কাছ থেকে অতীতে আঘাত পাওয়া। দ্বিতীয় জাতের হত্যাবিলাসী নির্বিচারে তার পথের বাধা সরিয়ে যায়। কোনও দোকানদারের সঙ্গে কোনও জিনিসের দর কষাকষি করতে করতে হয়তো তার গলা টিপে ধরে…
ইন্সপেক্টর বরাট বলেন, কিন্তু অধরবাবুকে কোনও একটা ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল- —যে অস্ত্রটা আততায়ী লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। সুতরাং এটা পূর্বপরিকল্পিতভাবে…
ডক্টর মিত্র বাধা দিয়ে বলেন, আমি অ্যাকাডেমিক ভাবে ব্যাপারটা বলছি, স্পেসিফিক এ কেসটার কথা নয়। মানে, ‘হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকে’র মানসিক বিকৃতিটা কী জাতের হয়।
—ঠিক আছে, আপনি বলুন।
—বলার বিশেষ কিছু নেই। ‘ব্লু’ বলতে ঐ দুখানি চিঠি। দ্বিতীয় খুনটা…আই মীন খুনের চেষ্টাটা হলে হয়তো পাগলটার চেহারা আর একটু স্পষ্ট হয়ে যাবে।
বাসু বলেন, আমার মনে একটাই প্রশ্ন! আপনি যে দু-জাতের হত্যাবিলাসীর কথা বললেন, আমাদের পাগলটা তো তাদের কোনও দলেই পড়ছে না! বিশেষ এক জাতের মানুষকে যে সরিয়ে দিতে চায়, অথবা নিজের পথের বাধা সরিয়ে দেবার জন্য যে খুন করে, সে কি সে কথা এভাবে সকৌতুকে চিঠি লিখে ঘোষণা করতে পারে?
—আমি এমন কোনো কেস জানি না।
সারা রাত বেচারির ভালো করে ঘুম হয়নি। বার বার উঠেছে, জল খেয়েছে আর বাথরুমে গেছে। অথচ পাশের খাটে কৌশিক ভোঁস ভোঁস করে মোষের মতো ঘুমিয়েছে, টেরও পায়নি। অবশ্য দোষ তার নিজেরই—ভাবে সুজাতা। লাইব্রেরী থেকে একটা বিশ্রী বই নিয়ে এসে সন্ধ্যারাতে পড়তে শুরু করেছিল। বিশ্রী বই মানে মনস্তত্ত্ব আর অপরাধ বিজ্ঞানের এক জগাখিচুড়ি গবেষণামূলক ইংরাজি বই। হত্যাবিলাসীদের মানসিকতা, কর্মপদ্ধতি, কেস-হিস্ট্রি এবং কীভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ‘জ্যাক-দ্য-রীপার’ এর উপরেই বেয়াল্লিশ পাতা। এককালে লোকটা নাকি লন্ডনে মহা আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। ক্রমাগত সে মানুষ খুন করে যেত। হত্যাতেই তার আনন্দ। বাছবিচার নেই! কী বলবে? লোকটা পাগল? কিন্তু পাগল কি ঐ রকম সোয়ানা হয়? সমস্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কয়েক বছর ধরে হিম্শিম্ খেয়েছে তার হদিশ পেতে। আর একটি অদ্ভুত কেস। এ ছোকরা আমেরিকান—তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল : জ্যাক-দ্য-রীপারের হত্যাসংখ্যাকে অতিক্রম করা। বুড়ো-বাচ্চা, পুরুষ-স্ত্রী কোনও বাছবিচার নেই। জ্যান্ত মানুষ হলেই হল। মায় জানলা দিয়ে ঢুকে হাসপাতালের বেডে ঘুমন্ত রোগীকে হত্যা করে এসেছে! যে রোগীকে সে জানে না, চেনে না, অন্ধকারে বুঝতেও পারেনি সে পুরুষ না স্ত্রীলোক। উদ্দেশ্য? বাঃ! রেকর্ড বেড়ে গেল না?
গ্রন্থকার এজাতীয় হত্যাবিলাসীদের মনোবিকলনের বিশ্লেষণ করেছেন। সাত-আটটি কেস-হিস্ট্রি পড়ে সুজাতার মনে হল ওদের এই অজ্ঞাত হত্যাবিলাসীকে কোনও গ্রুপেই ফেলা যাচ্ছে না। সে যেন পরিচিত প্যাটার্নের নয়—সে অনন্য। প্রথম কথা, যে কটা কেস্ হিস্ট্রি পড়ল তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আততায়ী সযত্নে নিজের পরিচয় গোপন করেছে—সন্তর্পণে সব ব্লু মুছে দিয়ে গেছে। এ লোকটা তা করেনি। আসানসোলে দোকানের সান-মাইকা-টপ্ কাউন্টারে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি, এমনকি দোকানীরও নয়—তার একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত হত্যাকারী স্থানত্যাগের আগে রুমাল দিয়ে টেবিলটা মুছে দিয়ে গিয়েছিল। এই যার মানসিকতা সে কেন একই টাইপরাইটারে দু দুবার চিঠি লিখবে? সে কি জানে না যে, প্রতিটি টাইপরাইটারের ছাপা ফিঙ্গার-প্রিন্টের মতো সনাক্ত করা যায়—বিশেষজ্ঞের চোখে? তার মানে কি লোকটার দ্বৈতসত্তা? ডক্টর জ্যাকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড? এক সময়ে সে নিতান্ত ছেলেমানুষ, সুকুমার রায়ের বই থেকে ‘ব্যাচারাথেরিয়াম্’-এর ছবি কেটে চিঠিতে সাঁটছে নিতান্ত কৌতুকবশে, অন্য সময়ে আস্তিনের মধ্যে লোহার ডাণ্ডা নিয়ে গভীর রাত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে কোনও একজন জ্যান্ত মানুষের সন্ধানে? না! তাও তো নয়! যার বাসস্থান, নাম/উপাধির আদ্য অক্ষর মিলে যাবে! কী করে সে খুঁজে বার করছে এমন অদ্ভুত কাকতালীয় যোগাযোগ? ওর মনে পড়ে গেল এক বান্ধবীর কথা—চুঁচুড়ার চন্দনা চ্যাটার্জির কথা। শিউরে উঠল সুজাতা! চন্দনার হাসিখুশি মুখটা মনে পড়ে গেল। বর্ধমানের পরে কি চুঁচুড়া?
ঠিক তখনি মনে হল সন্তর্পণে কে যেন দরজায় নক্ করছে। ব্রাশ করে উঠল বুকের ভিতর! পরক্ষণেই মনে হল—এটা বর্ধমান নয়, নিউ আলিপুর; তার নামের আদ্যক্ষর বা উপাধি ‘B’ দিয়ে নয়! তবে কি ভুল শুনেছে? দরজায় কেউ ঠক্ঠক্ করেনি? এ ওর অবচেতনের প্রতিক্রিয়া?
নাঃ! আবার কে যেন ঠক্ঠক্ করল। সুজাতা বের্ড-সুইচটা জ্বালে। টেবিল ঘড়িটার দিকে নজর পড়ে। রাত সাড়ে চারটে। নাইটি পরে শুয়েছিল সে। চাদরটা জড়িয়ে নিল গায়ে। কৌশিক এখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। উঠে এসে দরজা খুলে দিল। প্যাসেজে আলোটা জ্বলছে। দাঁড়িয়ে আছেন বাসুমামু। পরনে গাউন, মুখে পাইপ। বললেন, কৌশিকের ঘুম ভাঙেনি?
—না। কী হয়েছে মামু?
—যা আশঙ্কা করা গেছিল! তুমি মুখে-চোখে জল দিয়ে নিচে নেমে এস। কৌশিককে ডাকার দরকার নেই!—সিঁড়ির দিকে ফিরে গেলেন বাসুসাহেব।
‘যা আশঙ্কা করা গেছিল’! অর্থাৎ বর্ধমানে এক হতভাগ্য কাল গভীর রাত্রে…সে যখন জ্যাক-দ্য-রীপারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড পড়ছিল? মৃত লোকটা কে?…পুরুষ? স্ত্রীলোক? আবার দোকানদার? এত-এত পুলিসের সতর্কতা সত্ত্বেও?
একটু পরে নিচে নেমে এসে দেখল বাসুসাহেব টে-ল্যাম্পের আলোয় কী একখানা চিঠি লিখছেন। সুজাতা নিঃশব্দে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। বাসুসাহেব লক্ষ করলেন। কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না। চিঠিখানা শেষ করে খামে ভরলেন, উপরে ঠিকানা লিখলেন। খামটা বন্ধ করলেন না। কাগজচাপার তলায় রেখে ঘুরে বসলেন সুজাতার মুখোমুখি। বললেন, বনানী ব্যানার্জি। বয়স সাতাশ-আটাশ। অবিবাহিতা। সুন্দরী। সময় রাত বারোটা থেকে দুটো। শ্বাসরোধ করে হত্যা। মার্ডারার কোনও ব্লু রেখে যায়নি!
—এত তাড়াতাড়ি আপনি খবর পেলেন কেমন করে?
—আধঘণ্টা আগে বর্ধমান থেকে রবি ট্রাঙ্ককল করেছিল।
—কিন্তু রবিবাবুই বা রাত ভোর হবার আগে কেমন করে জানলেন—কোন্ বাড়ির, কোন্ রুদ্ধদ্বার ঘরে একটা কুমারী মেয়েকে গলা টিপে মারা হয়েছে?
—না! মৃতদেহটা পাওয়া গেছে বর্ধমান স্টেশনে, টু ফিটিন আপ বার্ডওয়ান লোকালের ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে! শোন সুজাতা, আমি সকাল ছটা দশ-এর বর্ধমান-লোকালে ওখানে যাচ্ছি। এবার একাই। তোমাদের দুজনের কাজ এখানে, মানে কলকাতায়। এই চিঠিখানা ধর। মৃদুলকে আর্লি-আওয়ার্সে ধরবে। চিঠিখানা পড়লেই বুঝবে কী করতে হবে। সংক্ষপে বনানীর পরিচয়টা দিই। খুব কিছু বিস্তারিত আমি জানি না। ইন্ ফ্যাক্ট, রবিও এখনো জানতে পারেনি। যেটুকু জানা গেছে তা এই :
বনানী ব্যানার্জির বাড়ি বর্ধমানে, কানাইনাটশাল পাড়ায়। ওরা দু বোন, বাবা-মা জীবিত। বাবা রিটায়ার্ড রেলকর্মী! গার্ড, টিকিট-চেকার অথবা ডি. এস. অফিসের কেরানি ছিলেন। ছোট বোনটা কলেজে পড়ে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্ভবত বি. এ.। তার নাম জানি না। বনানী বড় বোন। ভালো অভিনয় করত। কলকাতার একটি গ্রুপ-থিয়েটারে—’কুশীলব’-এ হিরোয়িনের পার্ট। সাধারণত সপ্তাহে দুদিন—শনি রবি। প্রতি শুক্রবার কলকাতায় আসে, সোমবার ফিরে যায়। ও দুটো রাত ও কলকাতায় থাকে মাসির বাড়ি, এক নম্বর ডোভার লেনে। সচরাচর বনানী সোমবার সকাল বা দুপুরের লোকাল ট্রেনে বর্ধমানে ফিরে যায়। কাল ওর কী দুর্মতি হয়েছে–মেইন-লাইনের টু-ফিটিন আপ লোকালটা ধরে গিয়েছিল। সেটা বর্ধমানে পৌঁছায় রাত পৌনে দুটোয়। ওর ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টে ও একাই ছিল। গাড়ি ইয়ার্ডে নিয়ে যাবার আগে একজন যাত্রীর নজরে পড়ে।
সুজাতা বললে, এ তো অবিশ্বাস্য! রাত দুটোর সময় একটা অবিবাহিতা মেয়ে কেমন করে সাহস পায় একা একা বর্ধমান স্টেশান থেকে কানাইনাটশাল রিকশা করে যাবার? দ্বিতীয়ত আপনি যা বলছেন তাতে তো ফার্স্টক্লাসে ওর যাবার কথা নয়। বাপ রিটায়ার্ড কেরানি, নিজে কতই বা রোজগার করে?…
—তাই জানতেই যাচ্ছি। আজ সন্ধ্যাতেই ফিরে আসব। রানু ঘুমোচ্ছে, তাকে ডাকিনি। ঘুমোক। তোমরা সারাদিনে দেখ, এ দিককার কতটুকু খবর জানা যায়। মানে ‘কুশীলব’-এর। মৃদুল ছোকরা জার্নালিস্ট। বুদ্ধিমান, করিৎকর্মা। প্রেস কার্ড আছে। এ টিপ্টা পেয়ে ও খুশিই হবে। হয়তো পরের সংখ্যা ‘সাপ্তাহিকে’ মৃদুল একটা ঝাঁঝালো রিপোর্ট ঝাড়বে : ‘বর্ধমানে ব্যর্থপ্রেমী বনানী ব্যানার্জির বিদায়!’ তোমরা দুজন মৃদুলের সঙ্গে থাকবে। সন্দেহজনক সব কজনের ফটো নেবে…
—সন্দেহজনক মানে?
—ঐ বয়সের একটি অভিনেত্রীর, যে একা-একা অতরাত্রে ট্রেন-ট্রাভ্ করে, তার একটা রোমান্টিক অজ্ঞাত অধ্যায় থাকবার সম্ভাবনা। আর আমার তো বিশ্বাস – নাইন্টি-নাইন-পার্সন্ট চান্স বনানী একা যাচ্ছিল না, তার কোনও পুরুষ সঙ্গী ছিল। যে লোকটা কেটে পড়েছে। সম্ভবত সেই আততায়ী।
—হ্যাঁ, তা হতে পারে বটে!
—সে-ক্ষেত্রে লোকটা ‘কুশীলব’-এর কোন কুশীলব হওয়াই সম্ভব। এবার বুঝলে? ‘সন্দেহজনক’ শব্দটার অর্থ?
সুজাতা সলজ্জে ঘাড় নাড়ে।
—ও হ্যাঁ। ঐ সঙ্গে ডোভার লেনেও একবার ঢুঁ মেরো। ওর মেসোর নাম এস. রায়!
বাসুসাহেব বাথরুমে ঢুকে গেলেন। এখনো তাঁর প্রাতঃকৃত্যাদি সারা হয়নি। সুজাতা চট করে রান্নাঘরে চলে যায়। মামুর জন্য ঝপট্ করে একটা ব্রেকফাস্ট বানাতে।