এগার
পরদিন সকালে রবি বোস এসে হাজির। বললে, এক এক সময় ইচ্ছে করে রিজাইন দিয়ে ঐ নরক থেকে বেরিয়ে আসি। পুলিসের চাকরি তারাই করে যারা গতজন্মে গোহত্যা, ব্রহ্মহত্যা করেছিল!
বাসু-সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, কেন হে! এমন ক্ষেপে গেলে কেন?
রবি বুঝিয়ে বলে তার অন্তর্দাহের ইতিকথা। গতকালই সন্ধ্যায় বাসু-সাহেবের ঐ চতুর্থ পত্রখানি তার হস্তগত হয়েছিল। এবার বাসু-সাহেব নিজে যাননি, রবিকে চিঠিখানি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ও তৎক্ষণাৎ গোয়েন্দা বিভাগে বরাট-সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এবং অনুরোধ করে-ঐ দিনই আবার একটা কনফারেন্সের ব্যবস্থা করতে। ডক্টর ব্যানার্জি, ডক্টর মিত্র এবং বাসু-সাহেবকে ঐ চতুর্থ পত্রটি বিশ্লেষণ করার সুযোগ দিতে। বরাট সরাসরি অস্বীকার করেন। বলেন, ও সব থিওরিটিক্যাল বিশেষজ্ঞের পর্যায় পার হয়ে গেছে। এখন শুধু অ্যাকশন! সে কাজ গোয়েন্দা বিভাগ যথারীতি করছে। ঐ তিনজন বিশেষজ্ঞকে নাকি ইতিপূর্বেই ফর্মাল ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। তারপর রবি স্বয়ং আই.জি. ক্রাইমের সঙ্গে লডন স্ট্রীটে গিয়ে দেখা করেছিল। তিনি বলেছেন, অফিশিয়ালি স্পিকিং–বরাট-এরই যা কিছু করণীয়। সে যেভাবে অগ্রসর হতে চায়, হোক। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাসু-সাহেবকে একটি ধন্যবাদপত্র পাঠিয়েছেন।
বাসু-সাহেব পত্রখানি নিয়ে পড়লেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, মিস্টার বরাটকে বলেছিলে যে, আমি ঐ সীজ করা জিনিসগুলো দেখতে চাই?
—বলেছিলাম। তাতে উনি বললেন, একটিমাত্র শর্তে উনি তা আপনাকে দেখতে দেবেন। যদি আপনি কথা দেন, লোকটা ধরা পড়লে আপনি তার ডিফেন্স কাউন্সেল হবেন না।
—অল রাইট। তখনই না হয় দেখব।
—তখনই মানে? কখন?
—যখন ডিফেন্স কাউন্সেল হিসাবে আদালতে দাঁড়াব। পিপল্স্ এক্সিবিট হিসাবে সবই ওরা আমাকে দেখাতে বাধ্য হবে।
—তার মানে আপনি ঐ লোকটার…
হ্যাঁ রবি। আমি চেষ্টা করব প্রমাণ করতে যে, সে সজ্ঞানে হত্যা করেনি! সে পাগল!
—আপনি তাই মনে করেন?
—আমি তাই মনে করি। মানসিক চিকিৎসালয়ের ডাক্তারের রিপোর্টটা দেখনি? ও ‘অস্মার’ রোগে ভুগছিল। ওর স্মৃতি মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। তখন যদি সে কাউকে…আর তাছাড়া বনানীর ‘লাভার’ হিসাবে ঐ বুড়োটাকে তুমিই কি কল্পনা করতে পারছ?
—না। কিন্তু ওর ঘরে ঐ টাইপ-রাইটার? আর পাতা-কাটা ঐ ‘সুকুমার রচনা সংগ্রহ’?
—ডাক্তার দাশরথী দের বয়স কত? তার ব্যাকগ্রাউন্ড কী? তুমি কি খোঁজ নিয়ে জেনেছ, ঐ অঙ্কের মাস্টার প্রাইভেট ট্যুইশানি করতেন কি না? ওঁর ঘরে কোনও কলেজের অল্পবয়সী ছেলে সন্ধ্যার পর এসে ওঁর প্রাইভেট ট্যুইশানির ক্লাস করত কিনা? এলে, সে টাইপ-রাইটিং জানে কি না? টাইপরাইটারটা ব্যবহার করত কি না?
—মাই গড! এ সব কথা তো—
—গুডবাই মাই ফ্রেন্ড! আজ তোমার ‘বস’-এর কাছে রিপোর্ট কর—আমার সহকারী হিসাবে আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। আই ফায়ার য়ু! তার মানে এই নয় যে, আমি তোমার উপর রাগ করেছি। প্রয়োজনে তোমাকে ডেকে পাঠাব। কিন্তু এরপর থেকে তুমি আর আমি ভিন্ন ক্যাম্পে। তোমার চাকরির নিরাপত্তাটাও তো আমাকে দেখতে হবে।
রবি বোস এগিয়ে এসে বাসু-সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
.
ডাক্তার দাশরথী দে বাড়ি ছিলেন না। রোগী দেখতে বেরিয়েছেন। প্রমীলা ওঁদের সাদরে বসতে দিলেন। প্রমীলা এবং মৌ দুজনেই বাসু-সাহেবকে ভালভাবে চেনেন—মানে ব্যক্তিগতভাবে নয়, তাঁর কীর্তিকাহিনীর জন্য। প্রমীলা বললেন, উনি বাড়িতে নেই তাতে কী হয়েছে? আপনি ঘরটা যদি দেখতে চান….
—ঘরটা তো দেখবই। তার আগে বলুন, কাগজে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে। তার বাইরে ওঁর সম্বন্ধে কী জানেন?…আচ্ছা, আমি বরং একে একে প্রশ্ন করে যাই—উনি কবে প্রথম আসেন, কী ভাবে? তার আগে কোথায় ছিলেন?
—এ বাড়িতে উনি এসেছেন বছরখানেক আগে। ওঁর ডিসপেনসারিতে একদিন এসেছিলেন একটা চাকরির খোঁজে। উনি চিনতে পারেন। সে সময় মাস্টরমশাই ছিলেন বেকার। কোথায় থাকতেন জানি না। তবে উনি একাধিক ডিসপেনসারিতে কম্পাউন্ডারের কাজ করেছেন। যদিও পাস-করা কম্পাউন্ডার নন। মাঝে কিছুদিন নাকি কোনও এক ছাপাখানায় প্রুফ-রিডারের কাজও করেছেন। তখন ঐ প্রেসেই থাকতেন। কোথাও বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। বারে বারে চাকরি খুইয়েছেন। হাইকোর্টের কাছে পথের ধারে বসে টাইপিংও করেছিলেন কিছুদিন—কিন্তু তাতে পেট চলে না। মাথা গোঁজার আশ্রয়ও তখন ছিল না।
—উনি বারে-বারে চাকরি খুইয়েছেন কেন? ওঁর পাগলামীর জন্যে?
—হয়তো তাই।
মৌ উপরপড়া হয়ে বললে, গল্পচ্ছলে মাস্টারমশাই আমাকে দুটি কেস-হিস্ট্রি বলেছিলেন। সে দুবার কেন তাঁর চাকরি যায়। একবার একটি ডিসপেনসারিতে ক্যাশ থেকে কিছু টাকা চুরি যায়। দোকানের সবাই বলেছিল, তারা টাকা নেয়নি; আর মাস্টারমশায়ের বক্তব্য ছিল আমার মনে নেই। দ্বিতীয়বার প্রেস-এর চাকরি খোওয়া যায় সম্পূর্ণ অন্য কারণে। একটি অঙ্কের বই ছাপা হচ্ছিল। উনি প্রুফ-রিডার। ধুম তর্ক বাধিয়েছিলেন লেখকের সঙ্গে। ওঁর মতে লেখকটি অঙ্কের কিছুই বুঝতেন না। যেভাবে তিনি পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কগুলি কষেছিলেন তার চেয়ে সহজ পদ্ধতিতে সেগুলি, নাকি কষা যায়। কষে নাকি দেখিয়েও দিয়েছিলেন। লেখক ছিলেন অঙ্কের একজন অধ্যাপক তর্কাতর্কির সময় তিনি নাকি ঐ অধ্যাপকের গলা টিপে ধরেন। ফলে চাকরি খোয়ান।
—উনি কি টাইপ-রাইটিং জানতেন?
হ্যাঁ। বেশ ভালই। আমি ওঁর কাছেই শিখেছিলাম।
—শিশু সাহিত্য পড়তেন? পড়তে ভালবাসতেন?
—যথেষ্ট। বরং বড়দের চেয়ে শিশু ও কিশোর সাহিত্যই বেশি করে পড়তেন।
বাসু হঠাৎ মৌ-এর দিকে ফিরে বললেন, তুমি এদুটি শব্দ কখনো শুনেছ? ‘ব্যাচারাথেরিয়াম্’ আর ‘চিল্লানোসরাস্’?
এমন অদ্ভুত প্রশ্নটা শুনে মৌ একটু থতমত খেয়ে যায়। সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ। সুকুমার রায়ের একটা হাসির গল্পের দুটি নাম। বইটিতে ছবিও আছে ঐ জীবের ‘চিল্লানোসরাস্ ব্যাচারাথেরিয়ামকে কামড়াতে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কামড়ালো না। হঠাৎ এ-কথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন?
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাসু বললেন, ঐ গল্পটা, বা ঐ জন্তু দুটোর নাম নিয়ে কখনো মাস্টারমশায়ের সঙ্গে তোমার কোনও আলোচনা হয়েছে? তোমার মনে পড়ে?
মৌ একটু ভেবে নিয়ে বললে, মনে পড়ে না। হঠাৎ ঐ জন্তু দুটো…
বাসু-সাহেব প্রমীলা দেবীকে বললেন, এবার চিলে-কোঠা ঘরটা দেখি।
ঘরটা উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। আলমারি হাট করে খোলা। বই বা টাইপ-রাইটার নেই। মাস্টারমশায়ের কাগজপত্র, জামাকাপড়, কলম-কলমদানি- পিনকুশান-পেপারওয়েট কিচ্ছু নেই। এ ঘরে এখন তল্লাসী করা নিরর্থক। ওঁরা নেমে আসছিলেন, হঠাৎ বাসু-সাহেব দেওয়ালের একটা অংশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ঐখানে দীর্ঘদিন একখানা ছবি টাঙানো ছিল, ফ্রেমে বাঁধানো। মাস্টারমশায়ের নিশ্চয়। সেটাই আপনারা খুলে পুলিসকে দিয়েছেন?
মা-মেয়ের দৃষ্টি বিনিময় হল। প্রমীলা জবাব দেবার আগেই মৌ বললে, না। আমাদের ফ্যামলি-অ্যালবাম থেকে খুলে মাস্টারমশায়ের ছবিখানি দেওয়া হয়েছে।
—আই সী! তাহলে ওখানে যে ফটোটা ছিল, সেটা…কার ফটো ছিল ওখানে? ফটো না ছবি?
মৌ-ই জবাব দিল। ফটোটা কার তা শুনে বাসু বলেন, আই সী! কাগজে ওঁর নামে যেসব কথা বেরিয়েছে তারপর ছবিখানা নামিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু সরিয়েছেন কে? আপনারা কেউ, না শিবাজীবাবু নিজেই?
—নামিয়েছিলেন মাস্টারমশাই। সরিয়ে রেখেছেন মা।
আই সী!
সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল। ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবু ফিরে এসেছেন। দ্বিতলে কুসমির মায়ের কাছে খবর পেয়ে উঠে এসেছেন চিলে-কোঠার ঘরে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বনানীর প্রেমিক হওয়ার সম্ভাবনা অল্প!
ওঁরা আবার ফিরে গিয়ে দ্বিতলের ঘরে বসলেন।
ডাক্তার-সাহেব আরও কিছু তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হলেন। বিশেষ করে মাস্টারমশায়ের বর্তমান নিয়োগ-কর্তা সম্বন্ধে। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে পণ্ডিচেরী থেকে একখানি চিঠি আসে ‘মাতৃসদন’ থেকে। কী এক মহারাজ শিবাজীবাবুকে পত্র লেখেন। পত্রটা, বস্তুত গোটা ফাইলটাই পুলিসে ‘সীজ’ করেছে। তবে প্রথম চিঠিখানির বয়ান ডাক্তারবাবুর স্পষ্ট মনে আছে। মহারাজ জানিয়েছিলেন, তাঁর এক ভক্ত—যিনি নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক—কিন্তু শিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তীর ছাত্র—মহারাজকে তাঁর মাস্টারমশায়ের আর্থিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য করতে অনুরোধ করেছেন। ‘মাতৃসদন’ ওঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। বিনিময়ে শিবাজীবাবুকেও মাতৃসদনের সেবা করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে ধর্মপুস্তক বিক্রয় করে আসতে হবে। সাড়ে চারশ টাকা মাস মাহিনায়। মাস্টারমশাই সাগ্রহে চাকরিটি গ্রহণ করেন। মাসে মাসে মানি-অর্ডারে টাকা আসত…
—মানি-অর্ডারে? চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট-এ নয়?
—না। বরাবর মনি-অর্ডারে টাকা আসতে দেখেছি। আর মাঝে মাঝে পোস্টাল পার্সেলে বই।
—মাতৃসদনের ঠিকানাটা দিন দেখি?
দেখা গেল, ওঁদের কাছে তা নেই। ঐ ফাইলেই সব কিছু ছিল। ডাক্তারবাবু ওদের লেটার-হেড প্যাডের চিঠি বহুবার দেখেছেন। অপ্রয়োজনবোধে ঠিকানা টুকে রাখেননি। ইতিমধ্যে চা-পানের পাট চুকেছে। বাসু-সাহেব গাত্রোত্থানের চেষ্টা করতেই ডাক্তারবাবু বললেন, একটা অনুরোধ করব স্যার?
—কী বলুন?
—মাস্টারমশাই দু-চার দিনের মধ্যে নিশ্চয় ধরা পড়বেন। আপনি কি তাঁর ডিফেন্সটা নিতে পারেন না? ব্যারিস্টার দেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি অবশ্য আমার নেই। কিন্তু ওঁর কয়েকজন ধনী ছাত্রকে আমি চিনি—মানে আমারই সব ক্লাস-ফ্রেন্ড। আমরা চাঁদা তুলে… বাসু বলেন, দেখুন ডক্টর দে, টাকার জন্য আটকাবে না, কিন্তু কেসটা আমি নেব কি না তা নির্ভর করছে সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ের উপর।
—জানি। শুনেছি আপনার কথা। আপনি নিজে যাকে মনে করেন ‘নির্দোষ’ তার কেসটি আপনি গ্রহণ করেন। যাকে মনে করেন দোষী, তাকে পরামর্শ দেন গিলটি প্লীড’ করতে। কিন্তু এ কেসটা যে সম্পূর্ণ অন্য রকম, বাসু-সাহেব। মাস্টারমশাই তো নিজেই জানেন না—তিনি ‘গিলটি’ না ‘নট গিলটি’।
বাসু বললেন, আগে তিনি ধরা পড়ুন। তবে আপনার অনুরোধটা আমার মনে থাকবে।
পরদিন সকালে বাসু-সাহেব চন্দননগরে একটা ফোন করে জানালেন যে, তিনি বিকেলে ওখানে আসবেন। টেলিফোন ধরেছিলেন বিকাশবাবু। তিনি আগ্রহ দেখালেন, বললেন, তাহলে মধ্যাহ্ন আহারটা এখানেই করে যাবেন, স্যার। বিকালের বদলে এবেলাই—
—না। কারণ আমার একটি লাঞ্চ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি গিয়ে পৌঁছাব বিকেল চারটে নাগাদ। মিস গাঙ্গুলীকে কি তখন পাওয়া যাবে?
—আমি খবর পাঠাচ্ছি।
—তোমার দিদি কেমন আছেন?
—দিন দিন খারাপের দিকে।
বাসু-সাহেব এবার রিভালভারটা সঙ্গে নিলেন কিনা সুজাতা জানে না; কিন্তু ওঁর ক্যামেরা, টেলি-ফটো লেন্স, বাইনোকুলার, কম্পাস ও মাপবার ফিতে যে নিয়েছেন তা টের পেল। এসব সরঞ্জামের কী প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করতে সাহসই হল না। ইতিমধ্যে কৌশিক আসানসোল থেকে যে ফটো তুলে এনেছে সেগুলোও সঙ্গে নিয়েছেন।
বিকাশ ওদের সাদরে নিয়ে গিয়ে বসালো বৈঠকখানায়। অনিতা গাঙ্গুলীও ছিল। বাসু ওঁর সব সরঞ্জাম টেবিলে সাজিয়ে রেখে প্রথমেই স্টাডি-রুমটার মাপজোক নিলেন। কত লম্বা; কত চওড়া, জানলাগুলি মেঝে থেকে কত উপরে। ওঁর নির্দেশ মতো সুজাতা একটা খাতায় মাপগুলি লিখে নিল। গেট থেকে সদর দরজার দূরত্বটা মাপতে গিয়ে প্রাণান্ত হল কৌশিকের। দারোয়ান আর বলাই সাহায্য করল ওকে। বাড়িটার একগাদা ফটো নিলেন। যে বেঞ্চিটার নিচে মৃতদেহটি আবিষ্কৃত হয়েছিল তারও বেশ কয়েকটি ফটো! বালিয়াড়ির উপর থেকে টেলিফোটো লেন্স লাগিয়ে দূর থেকে অনেকগুলি ফটো
কারও সাহস হল না প্রশ্ন করতে এসব কোন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে লাগবে। বারে বারে বাইনোকুলার দিয়ে গঙ্গার ওপারে কিছু খুঁজলেন তিনি। কম্পাস বার করে নির্ধারণ করলেন বাড়িটি ঠিক পূর্বমুখী নয়-সাত ডিগ্রি দক্ষিণপূর্ব দিকে সরে আছে।
এরপর অনিতা এসে বলল, আপনারা ভিতরে এসে বসুন। আফটারনুন টি রেডি।
ওঁরা ঘরে এসে বসলেন। বাসু বললে, চা নিশ্চয়ই খাব, কিন্তু এ যে হাই-টি!
এরপর কিছুক্ষণ শিবাজী চক্রবর্তীর বিষয়ে আলোচনা হল। কী অপরিসীম আশ্চর্য! লোকটা এখনো ধরা পড়লো না। পুলিস কোনও কর্মের নয়। বাসু খবরটা প্রকাশ করলেন—ইতিমধ্যে উনি চতুর্থ পত্রটি পেয়েছেন—D FOR DIGHA’!
বিকাশ এবং অনিতা দুজনেই আঁৎকে ওঠে। বিকাশ বলে, সর্বনাশ! তারিখটা?
—পঁচিশে ডিসেম্বর!
অনিতা বললে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান দিয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চয় ধরা পড়ে যাবেন।
বিকাশ বলল, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান ইচ্ছা করেই দিয়েছে। জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন চন্দননগরে ভীড় হয়, ঠিক তেমনি বড়দিনে ভীড় হয় দীঘাতে। ‘ডি’ নাম বা উপাধির কে-কে আসবে পুলিস তা কেমন করে জানবে? আপনি কবে চিঠিটা পেলেন? কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন নিশ্চয়। কবে ছাপা হবে?
বাসু বলেন, এনি ডে। আজ বের হয়নি, কাল পরশু বের হবে। তোমার দিদিকে কি খবরটা জানানো হয়েছে?
—না। ডাক্তার বলেছে ম্যাক্সিমাম এক মাস। কী দরকার?
—অসুখটা কী?
—ক্যানসার। ওঁকে বলা হয়েছে জামাইবাবু হঠাৎ বিশেষ কাজে দিল্লী যেতে বাধ্য হয়েছেন। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ফিরবেন।
বাসু-সাহেব অনিতার দিকে ফিরে বলেন, সেদিন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ডক্টর চ্যাটার্জির রিসার্চটা কী জাতের ছিল? তুমি বলেছিলে, তিনি একটি ‘রবীন্দ্র অভিধান’ রচনা করছিলেন। তার মানেটা কী?
অনিতা ওঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। এটা শেষ পর্যন্ত একটি অভিধানের রূপ নিত। প্রতিটি শব্দ রবীন্দ্রনাথ কোথায়, কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তার খতিয়ান।
—সেটা কী কাজে লাগবে?
—অনেক কাজে লাগতে পারে। ধরুন, আপনাকে প্রশ্ন করলাম, ‘করো করো অপাবৃত হে সূর্য আলোক আবরণ’—এই পংক্তিটা রবীন্দ্রনাথ কবে, কোথায় এবং ‘অপাবৃত’ শব্দের কী অর্থে ব্যবহার করেছেন। আপনি বলতে পারেন?
–না। কোথায়?
—আমার মুখস্ত নেই। কিন্তু অভিধান দেখে বলতে পারব। ‘আলোক’ ‘সূৰ্য’ কিম্বা ‘অপাবৃত’ এই তিনটে ‘এন্ট্রির’ যে কোনও একটাতে পাওয়া যেতে পারে। এইটে ‘অ’-ফাইল। এই দেখুন—
ফাইল থেকে দেখালো লেখা আছে : “অপাবৃত-অনাবৃত। তৎ ত্বং পূষপাবৃণু সত্যধর্ম্মায় দৃষ্টয়ে। ঈশ ১৫।। “করো করো অপাবৃত হে সূর্য আলোক আবরণ”। জন্মদিনে/১৩/১১ই মাঘ/১৩৪৭ উদয়ন/সকাল”।
—তার অর্থটা কী দাঁড়ালো?
—‘জন্মদিনে’ কবিতাগ্রন্থের তের নম্বর কবিতা। ১১ই মাঘ, ১৩৪৭ তারিখের সকালে ‘উদয়ন’-এ বসে কবি ঐ পংক্তিটি রচনা করেছিলেন। ‘অপাবৃত’ শব্দের অর্থ ‘অনাবৃত করা’। কবির ঐ পংক্তিটির মূল ভাবের উৎস হচ্ছে ঈশোপনিষদের পঞ্চদশ মন্ত্রটি, ‘তৎ ত্বং পৃষণ্ণপাবৃণু সত্যধর্ম্মায় দুষ্টয়ে।’
বাসু বললেন, দারুণ কাজ করেছিলেন তো ডক্টর চ্যাটার্জি! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি ঐ ‘অপাবৃত’ শব্দটা অন্য কোথাও ব্যবহার করেননি?
—হয়তো করেছেন। সেটা বোঝা যেত গ্রন্থটা সম্পূর্ণ হলে। কারণ উনি প্রতিদিনই ছোট ছোট কাগজে এইসব নোট লিখে দিতেন, আর আমরা সেগুলি বিভিন্ন ফাইলে অভিধানের রীতিতে পর পর গেঁথে রাখতাম। কম্পাইলেশন শেষ হলে বোঝা যেত ‘অপাবৃত’ শব্দটা কবি কতবার, কোথায় কোথায় কী অর্থে ব্যবহার করেছেন।
এই সময় একজন য়ুনিফর্মধারী নার্স এসে অনিতাকে জানালো, মিসেস চ্যাটার্জি তাকে ডাকছেন। ‘এক্সকুজ মি’ বলে অনিতা উঠে গেল দ্বিতলে। একটু পরেই ফিরে এসে বাসু-সাহেবকে বলল, দিদি টের পেয়েছেন যে, আপনি এসেছেন। শুক্লা ওঁকে জানিয়েছে।
—শুক্লা কে?
— এ।
মিসেস চ্যাটার্জির ডে-টাইম নার্স যুক্তকরে নমস্কার করল।
—উনি আপনার কীর্তি-কাহিনীর কথা জানেন। বস্তুত উনি আপনার একজন ‘ফ্যান’। আমাকে দিয়ে অনুরোধ করেছেন, যাবার আগে যেন আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করে যান। -তা আমার এখানকার কাজ তো মিটেছে। মাপজোক সবই নেওয়া হয়েছে। চল যাই—
বিকাশ বলে, কিন্তু স্টাডিরুমের মাপটা কোন্ কাজে লাগবে?
বাসু হেসে বললেন, ট্রেড-সিক্রেট কি কেউ জানিয়ে দেয়? চল, দোতলায় যাই।