দশ
তের তারিখ সকাল আটটা।
আজও ব্রেকফাস্ট-টেবিলে এসে কৌশিক দেখে চতুর্থ চেয়ারখানি শূন্যগর্ভ। বললে, কী ব্যপার? বাসুমামু এখনো ফেরেননি?
রানী দেবী টোস্টে জ্যাম মাখাচ্ছিলেন। বললেন, ফিরেছেন। ঘণ্টাখানেক আগে। স্টাডি-রুমে ঢুকেছেন
সুজাতা বলে, ডেকে আনি?
রানী বলেন, না থাক। আমিই যাচ্ছি—
—কেন? আপনি কেন আবার কষ্ট করবেন?
রানী তাঁর হুইলচেয়ারে ইতিমধ্যেই একটা পাক মেরেছেন। থমকে থেমে গিয়ে বলেন, তোমাদের মামুর ভাষায় ‘নাইন্টি-নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট চান্স’–চতুৰ্থ চিঠিখানা এসেছে।
কৌশিক চমকে ওঠে। বলে, মানে? আপনি কী করে জানলেন?
—আমি একে ব্যারিস্টারের বউ তার উপর গোয়েন্দার মামী। আমাকেও একটু-একটু ডিডাকশান করতে হয় কৌশিক। উনি সব বিষয়েই ওভার-পাঞ্চুয়াল। ঘড়ি ধরে সাড়ে ছয়টায় মর্নিং-ওয়াকে গেলেন, কিন্তু এক ঘণ্টা বেড়ালেন না। ফিরে এলেন সাতটায়। ঢুকে গেলেন স্টাডি-রুমে। সেখানে সচরাচর মিনিট পনের থাকেন। আজ আছেন এক ঘণ্টার উপর।
সুজাতা বলে, তাই যদি হয়, তবে আপনাকেই যে চাকা-দেওয়া গাড়িতে ডাকতে যেতে হবে তার মানেটা কী?
—বুঝলে না? স্কাউনড্রেলটা এবার আরও অবমাননাকর ভাষায় লিখেছে। মহাদেবের ত্রিনয়ন থেকে যখন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বার হয় তখন ত্রিনয়নী শিবানীই তাঁকে ঠাণ্ডা করতে পারেন।
সুজাতা ও কৌশিক বসল নিজ নিজ আসনে। রানী দেবী তাঁর হুইল চেয়ারে পাক মেরে চলে এলেন স্টাডি-রুমে। দ্বারপ্রান্ত থেকে বললেন, ব্রেকফাস্টে আসবে না?
বাসু-সাহেব সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, এগিয়ে এস। দেখ, তোমার কর্তার রাইভালটার খানদানি বদনখানা!
মেলে ধরলেন সংবাদপত্রটা।
প্রথম পাতায় শিবাজীপ্রতাপ চক্রবর্তীর একটি আলোকচিত্র। নিরীহ গোবেচারী ইস্কুলমাস্টার-মার্কা চেহারা। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী—যেটুকু সংগৃহীত হয়েছে এ পর্যন্ত—তা প্রথম পাতাতেই ছাপা হয়েছে :
হেমাঙ্গিনী বয়েজ স্কুলের থার্ড মাস্টার। অঙ্কের টীচার ছিলেন। বদমেজাজী। এ পর্যন্ত তিনবার তিনি মানুষ খুনের চেষ্টা করেছেন এ তথ্য প্রতিষ্ঠিত। তিনবারই গলা টিপে। পরে তাঁর চাকরি যায়। মানসিক চিকিৎসালয়ে বছর দুই ছিলেন। যে মানসিক চিকিৎসালয়ে বন্দী ছিলেন তার ডাক্তারের ইন্টারভ্যু নেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে বৃদ্ধ ‘মেগালোম্যানিয়াক্’! মনে করতেন তিনি ছত্রপতি শিবাজী অথবা চিতোরের রাণাপ্রতাপের সমপর্যায়ের এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। সমাজ-সংসার এটা বুঝতে পারছে না। এটাই তাঁর পাগলামি। ঐ সঙ্গে ছিল মৃগীরোগ ও ‘ক্রনিক অ্যামনেশিয়া’—দীর্ঘস্থায়ী ‘অস্মার রোগ’—অর্থাৎ মাঝে মাঝে বিশেষ সময়ের স্মৃতি লুপ্ত হয়ে যাওয়া। গোয়েন্দা বিভাগ ও আরক্ষা বিভাগের মতে সাম্প্রতিক কালের তিন তিনটি বীভৎস খুনের ইনিই হচ্ছেন নায়ক। প্রথমে আসানসোলের অধর আঢ্য, তারপর বর্ধমানের বনানী ব্যানার্জি এবং শেষে চন্দননগরের চন্দ্রচূড় চট্টোপাধ্যায়। ঐ তৃতীয় হত্যাকাণ্ডের পরেই আততায়ী নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁর পরিধানে ছিল…ইত্যাদি ইত্যাদি।
রানীর প্রত্যাবর্তনে দেরি হচ্ছে দেখে কৌশিক ও সুজাতাও গুটিগুটি এসে জুটেছে।
টোস্ট-ডিম-কফির কথা আর কারও মনেই রইল না। তিন-চারখানি কাগজ ওঁরা ভাগাভাগি করে পড়তে থাকেন।
রানী বলেন, তোমাদের বিশ্বাস হয়?
কৌশিক বললে, বলা কঠিন। লোকটা ব্যাগে করে বই ফিরি করত—আসানগোল ও চন্দননগরে হয়তো সে উপস্থিত ছিল। এছাড়া তো সবই খবরের কাগজের রিপোর্টারের আপ্তবাক্য।
হঠাৎ ঝঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। বাসু তুলে নিয়ে আত্মপরিচয় দিতেই ও প্রান্ত থেকে রবি বোস বলে, গুডমর্নিং স্যার। খবরের কাগজ দেখেছেন? আততায়ীর ছবি?
—দেখেছি। কিন্তু এভিডেন্স কোথায়? লোকটার একমাত্র অপরাধ তো দেখছি বই ফিরি করা।
—না স্যার। ক্লিয়ার কেস্! এভিডেন্স সূর্যোদয়ের মতো স্পষ্ট। এখনি আসছি আমি।
রবি বসুর কাছ থেকে বিস্তারিত অনেক কিছু জানা গেল। ঐ শিবাজীপ্রতাপ চক্কোত্তির পূর্ব-ইতিহাস। অনেকটাই অবশ্য এখনো কুয়াশা ঢাকা
গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ বিডন স্ট্রিট থানাতে এক ডাক্তার ভদ্রলোক আর তাঁর কন্যা মিসিং স্কোয়াডে একটা এজাহার দিতে আসেন। হারিয়েছেন একজন বুড়ো মানুষ, ওঁর বাড়ির তিনতলার চিলে-কোঠার ঘরে ভাড়া ছিলেন। একাই। তিনকুলে তাঁর কেউ নেই। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন চন্দননগর যান, তারপর থেকে নিখোঁজ। তাঁর বিবরণ এবং তিনি ফেরি করে বই বেচতেন শুনে থানা অফিসার সন্দিগ্ধ হন। লালবাজারে জানান আর রবিকেও টেলিফোন করেন, কারণ প্রতিটি থানায় জানানো হয়েছিল, রবি বোস ঐ ‘এ. বি. সি.―হত্যা’ রহস্যের ‘অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি’। রবি বারবার বাসু-সাহেবকে টেলিফোনে খবর দেবার চেষ্টা করে কিন্তু টেলিফোনে কিছুতেই লাইন পায় না। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টার বরাট বারবার তাগাদা দেওয়ায় তাকে যৌথ তদন্তে যেতে হয়।
ডাক্তার দাশরথীর কাছ থেকে ওঁর পূর্ব-ইতিহাস যা জানা গেছে তার বেশির ভাগই খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। বাড়তি খবর—যেটা প্রকাশ করা হয়নি, তা বৃদ্ধের এমপ্লয়ারের পরিচয়। পণ্ডিচেরীর একটি আশ্রম ওঁকে এই চাকরিটি দিয়েছিলেন। পার্সেলে বই আসত। মাসে মাসে মনি-অর্ডারে ওঁর মাহিনা আসত। রবি আর ইন্সপেক্টার বরাট ওঁর ঘরটা সার্চ করে। ওঁর ঘরের একটি আলমারিতে থরে থরে প্যাক করা বই ছিল। সবই ধর্ম বা ধর্ম সংক্রান্ত সাহিত্যপুস্তক। সর্বসমেত একশ তেরটি। তার ভিতর প্যাকেট না খোলা একটি বাণ্ডিলে পাওয়া গেছে একটি মারাত্মক এভিডেন্স। ‘সুকুমার সমগ্র’ রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ড। তার তিনশ-আশি নম্বর পৃষ্ঠা থেকে ব্লেড দিয়ে নিপুণভাবে দুখানি ছবি কেটে বার করা। কী ছবি ছিল জানা গেছে। অন্য একটি কপি দেখে। উপরের ছবিটি ‘ল্যাংড়াথেরিয়ামের’ এবং নিচে ‘ব্যাচারাথেরিয়াম’ আর ‘চিল্লানোসরাসের’ ছবি। শেষের ছবি দুটি ব্লেড দিয়ে যেভাবে কাটা তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সে দুটিই দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রে সরাসরি আঠা দিয়ে সাঁটা হয়েছিল। তৃতীয় ছবিটি ‘L’ অক্ষর দিয়ে। সেটা কেন কাটা হয়েছে বোঝা যায়নি। আরও একটি মারাত্মক এভিডেন্স। ওঁর টেবিলে ছিল দামী একটা টাইপ-রাইটার। বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা করে ইতিমধ্যেই নিঃসন্দেহ যে, ঐ যন্ত্রটি দিয়েই তিনখানি চিঠি টাইপ করা।
সব কিছু এভিডেন্স বাজেয়াপ্ত করে ইন্সপেক্টর বরাট নিয়ে যান। রবি প্রতিবাদ করেছিল। বলেছিল পি. কে. বাসু সাহেবকে না জানিয়ে ঐ সব বই, টাইপ-রাইটার, ওঁর কাপড়-জামা ইত্যাদি সরানো-নড়ানো উচিত নয়, কারণ আই. জি. ক্রাইম সাহেবের স্পষ্ট নির্দেশ আছে দুটি টীম সমান্তরালে কাজ করবে, একে অপরকে সাহায্য করবে।
তার জবাবে ইন্সপেক্টর বরাট বলেন, এখন পরিস্থিতিটা’ নাকি পাল্টে গেছে! বাসু-সাহেব সবই দেখতে পাবেন আদালতে। যখন পিপল্স্ এক্সিবিট হিসাবে সেগুলি দাখিল করা হবে।
বাসু প্রশ্ন করেন, ঐ বুড়োটাকে এখনো ধরা যায়নি?
—না। আজই তার ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে। আজ সন্ধ্যায় টিভিতেও দেখানো হবে। বিকৃতমস্তিষ্কের মানুষ। পকেটে টাকা-পয়সা বোধহয় সামান্যই আছে। আমার তো ধারণা ওকে ধরা এখন —
বাসু-সাহেব বলেন, ‘ছেলেখেলা!’
রবি হাসল। বলল, অনেকটা তাই স্যার! আমরা তো তাই আশা করছি… দুই কি তিন দিন!
.
বাস্তবে ব্যাপারটা হল উল্টো। একটার পর একটা বিশ্রি ঘটনা! মারাত্মক ও বেদনাদায়ক। রবি বোসের ঘোষণা অনুসারে তিন দিনের মধ্যে লোকটা আদৌ ধরা পড়ল না—কিন্তু সাতজন নিরীহ লোক গণধোলাইয়ের শিকার হল। তাদের অপরাধ—তাদের দেহাকৃতি এবং জীবিকা ঐ অজ্ঞাত আততায়ীর মতো। ঐ সাতজনের মধ্যে দুজন মারাই গেল। তাদের একজন ফিরি করত ধূপকাঠি, দ্বিতীয়জন বেচত না, কিনত—পুরনো খবরের কাগজ!
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বেতারে বিবৃতি দিলেন। দূরদর্শনে উপস্থিত হয়ে বিশেষ ঘোষণায় অতি-উৎসাহী জনগণকে অনুরোধ করলেন—যা করণীয় তা পুলিসকেই করতে দিন। সরকার জনগণের সহযোগিতা চান—নিশ্চয়ই চান— তবে সীমিত ক্ষেত্রে। সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়লে জনগণ যেন অনুগ্রহ করে থানায় খবর দেন। সরকার জনগণের কাছে আর কোনও সক্রিয় সাহায্য কামনা করছেন না।
এতে লাভবান হল কিছু সাময়িক পত্রিকা—যারা মুখরোচক স্টান্ট নিউজ ছাপাতে ওস্তাদ। পত্রিকার চিঠিপত্র-বিভাগের বৃকোদর অংশ দখল করল ‘এ. বি. সি… হত্যারহস্য’। কাগজ খুলে কেউ দেখতে চায় না জরুরী খবরগুলো: ভারত এশিয়াডে কত নিচে নামল, প্রধানমন্ত্রীকে কী জাতের সম্বর্ধনা করা হল অথবা পূর্তমন্ত্রী কোন মূর্তিকে কবে মাল্যভূষিত করলেন। সকলেই সর্বপ্রথমে জানতে চায়: লোকটা ধরা পড়েছে কি না।
.
এই যখন সারা দেশের অবস্থা তখনই ডাকযোগে এসে পৌঁছলো সেই দুঃসাহসী হত্যাবিলাসীর চতুর্থ প্রেমপত্র। এবারও খামের উপর ভুল ঠিকানা। পোস্টাল জোনটায় একটিমাত্র ভ্রান্তি; প্রথম সংখ্যাটা ‘সাত’-এর বদলে ‘এক’। অর্থাৎ পোস্টাল জোন: 100053। চিঠিখানা চন্দননগরের ডাকঘরের ছাপ নিয়ে চলে গিয়েছিল শ্রীনগর। সেখান থেকে পুনর্নির্দেশিত হয়ে বাসু-সাহেবের হাতে এসে পৌঁছালো ষোলো তারিখে। একই রকম খাম, কাগজ, একপিঠে আঁক-কষা, অপর পিঠে-না, এবার দুটি ছবি। দুইটি একরঙা লাইন ব্লক। অন্য কোনও বই থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা:
D-FOR DIPLODOCUSAIH NAMAH!
পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল্যাংড়াথেরিয়ামেষু,
মহাশয়, কী মর্মবিদারক দৃশ্য! বিশালকায় ব্যারিস্টার ল্যাংড়াথেরিয়ামকে একজন সামান্য মানুষ—যাহাকে কেহই চেনে না, যাহার ক্ষমতাকে কেহই স্বীকৃতি দেয় না—গলায় দড়ি দিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছে!
অহেতুক জীবহত্যা করিতেছেন কেন? সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিয়া নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করাই বাঞ্ছনীয় নহে কি? আপনার দম্ভ কি এতই আকাশচুম্বী? ঈশ্বর আপনাকে সুমতি দিন, এই কামনা।
D FOR DIGHA!
তাং : পঁচিশে ডিসেম্বর।
ইতি—D.E.F.