নয়
বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত তিনটে বেজে গেল। এক রাতের মধ্যে আমরা গাড়ি চালিয়ে ইয়োকোসুকাতে গেছি, জুরিকে দিয়ে একটা ফোন করিয়েছি, বোনাস হিসেবে গাড়িতে সেক্স করার সুযোগও মিলেছে। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে (লাগাটাই স্বাভাবিক), কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, একটুও ঘুম পাচ্ছে না। ভাগ্যিস আগামীকাল শনিবার, কাজে যেতে হবে না। যতদিন ঐ অটোমোবাইল পার্কটার পেছনে পরিশ্রম করেছি, ততদিন ছুটির দিনগুলো আমার কাছে আলাদা কিছু মনেই হয়নি। আর আজকাল আমার হাতে কাজ নেই বললেই চলে।
কম্পিউটারটা চালু করে সিপিটির ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। বুলেটিন বোর্ডে একটা নতুন পোস্ট চোখে পড়ছে।
পণ্যটার মান যাচাই করে নিয়েছি (ইউজার নেম-জুলি)
সবাইকে আবার অভিবাদন। আমি জুলি বলছি।
ধন্যবাদ @ম্যানিয়াককে সুন্দর কিছু উপদেশ দেবার জন্য। একটু আগেই গাড়ির মান পরীক্ষা করে দেখেছি। কোনো ধরনের সমস্যা পাইনি।
অবশেষে চুক্তির পালা এসেছে। কিন্তু টাকাটা এখনো জোগাড় করতে পারিনি, তাই ঝামেলায় পড়ে গেছি। আগামীকাল ব্যাংক বন্ধ বিধায় টাকা জোগাড় করতে খানিকটা সময় লাগবে। তাছাড়া, কীভাবে টাকাটা দেবো, তাও বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারলাম, ম্যানিয়াক নামের একজন ইউজার পোস্টটার গূঢ় অর্থ বুঝতে না পেরে তাকে নানান উপদেশ দিয়েছে। যেই হোক না কেন, এত রাতে ‘জুলি’কে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে পোস্ট দিতে দেখে নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত হয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।
“মিস্টার কাতসুরাগি বসে বসে এইরকম পোস্ট দিচ্ছেন, দৃশ্যটা কল্পনা করতেই হাসি পাচ্ছে।” বলেই মনে হলো, এগুলো বোধহয় কোনো ডিটেকটিভ করে দিচ্ছে।
“তার মানে আমি ঠিক আছি বলে তিনি টাকা দিতে রাজি হয়েছেন?” জুরি পেছন থেকে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে বলল।
“সেই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।”
“কিন্তু…”
“তিনি বলছেন যে, টাকা জোগাড় করতে তার বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। মানে তারা এখনো সময় বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যই তারা টাকা কীভাবে আদান-প্রদান করা হবে, সে বিষয়ে জানতে ইচ্ছুক। মোদ্দা কথা, তারা চাচ্ছে আমরা যাতে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিই। সেটা থেকেই তারা আমাদের জব্দ করতে চায়।”
“আগে টাকা তারা জোগাড় করুক, তারপরে তাদেরকে আদানপ্রদানের পদ্ধতি বলা যাবে— কি, ঠিক বলেছি না?”
“হুম, আমারও একই কথা।” কম্পিউটার থেকে উঠে পড়ে লিভিংরুমে গেলাম। জুরি আমাকে অনুসরণ করলো।
লিভিংরুমের সোফাতে বসে চিন্তা-ভাবনা করা শুরু করলাম। আমার প্রতিপক্ষ কী করছে, কী করতে পারে—মনে মনে এসব নিয়েই ভাবছিলাম। আমরা একটা পদক্ষেপ নেব, আর তারা সেটার সুযোগ নেবার জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকবে—ওরা কি এই পরিকল্পনা ধরেই আগাচ্ছে?
“আচ্ছা।” জুরি আমার পাশে বসলো। “টাকাটা আমরা কীভাবে পাবো? কোনো উপায় মাথায় এসেছে?”
“হুম…” অনিশ্চিত গলায় উত্তর দিলাম। যদি আমি বলি যে, “না, এখনো কোনো উপায় পাইনি’, সে কী ধরনের মুখ করবে? এরকম পর্যায়ে এসে তার আস্থা ভঙ্গ করা চলবে না।
আমি ধরে নিয়েছি যে, দিনশেষে সবই ঠিকঠাক মতো হয়ে যাবে। পুলিশকে বোকা বানানো খুব একটা কঠিন নয়। তারা সবসময় বলে যে, কিডন্যাপিং করে কেউ পার পায় না। তবে আমার ধারণা, কথাটা সত্য না। তারা অসফল কেসগুলো ধামাচাপা দিয়ে দেয়। কেবলমাত্র জনগণের সামনে নিজেদের মুখ রক্ষা করার জন্য পুলিশ এসব লুকিয়ে থাকে। যেসব কিডন্যাপার ধরা পড়ে, তাদের ব্যাপারে গোটা বিশ্বকে মিডিয়ার মাধ্যমে জানানোর ব্যবস্থা করা হয়। ফলে একজন অকাট মূর্খও ধরে নেয় যে, কিডন্যাপিং খুবই বোকামির একটা কাজ। আর এই বোকামি করতে গেলে তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়বেই। পৃথিবীতে চালাক মানুষ থাকবে না, তা কি হয়? আবার ভিক্টিমের পরিবারও অনেক সময় সবকিছু ধামাচাপা দিতে চায়। তারা তাদের সন্তানকে পেয়েই খুশি। প্রেস আর মিডিয়ার সামনে বকবক করে কিডন্যাপারের রাগ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।
“উপায়টা আমাকে বলবেন না?”
সে আবার আমাকে আপনিকরে বলা শুরু করেছে।
“সময় হলেই বলব।”
“আপনি আমাকে অশান্ত অবস্থা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন? আমি ভয় পেতে পারি—সেটা ভাবছেন? আমি অতটা ভীতু নই।”
“না, সেটা মাথাতেই আসেনি…” হাসিমুখে জবাব দিলাম। ঐ মুহূর্তেই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। অশান্ত…হুম, খারাপ না আইডিয়াটা।
মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে দুই বিয়ার ক্যান বের করে সোফাতে ফিরে এলাম। জুরির সামনে একটা রাখলাম।
“আপনি হাসছেন কেন এভাবে? কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে।” জুরি অভিযোগ করলো।
“মজার একটা চিন্তা মাথায় এসেছে। ঐ মানুষগুলোকে অশান্তিতে ফেলে দেবো।”
“মানে?”
“আমি তাদেরকে বলে দেবো, কীভাবে আমরা টাকা আদানপ্রদান করবো।”
জুরি বিয়ারের ক্যান খুলতে যাচ্ছিল, আমার কথাটা শোনার পর সে স্থির হয়ে গেল। “আপনার কি মনে হয়, কাজটা ঠিক হবে?”
“দেখে নিও। সবকিছু ফাঁস করবো না।”
কম্পিউটারের সামনে ফিরে গেলাম। ইন্টারনেট সংযোগ করে পূর্বে ঠিক করে রাখা একটা ফ্রি ইমেইল সার্ভিস সাইটে ঢুকলাম। আগেই একটা অ্যাকাউন্ট বানিয়ে রেখেছি। নামধাম আর অ্যাড্রেস সবই ভুয়া।
নতুন মেইল উইন্ডো খুললাম। তারপর নোটবুক খুলে দেখে দেখে সেখানে অ্যাড্রেসটা টাইপ করলাম। জুলি নামধারী যে পোস্ট করছে, তার অ্যাড্রেস ছিল ওটা।
“তাহলে,” কিবোর্ডে হাত দিলাম। জোরে একটা শ্বাস টেনে নিলাম। “শুরু করা যাক।”
আমরা যে আপনাদের মেসেজটা পেয়েছি, সে ব্যাপারে আপনাদের নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। জুরি কাতসুরাগি যে নিরাপদে আছে, তা আপনারা বুঝতে পেরেছেন দেখে আনন্দিত হলাম। এখন আমাদের দ্রুত কাজে চলে যেতে হবে। যদি বেশি সময় নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দুপক্ষেরই ক্ষতি। আমাদেরকে ঝটপট কাজ সারতে হবে।
প্রথমত, আমরা চাই আপনারা যত দ্রুত সম্ভব তিনশ মিলিয়ন ইয়েন জোগাড় করুন। সেগুলো সব যেন পুরোনো দশ হাজার ইয়েনের নোট হয়। পুরো টাকাটা দুভাগ করে একটা ক্যাডি ব্যাগে ভরবেন, আরেকটা অন্য কোনো ব্যাগে।
এরপর একটা মোবাইলের ব্যবস্থা করবেন। সাধারণ যে-কোনো ফোন হলেই চলবে।
সব কাজ শেষ হলে আমাদের সাথে আগের মতো একই উপায়েই যোগাযোগ করবেন। সেখানে আপনাদের ফোন নম্বরটাও যোগ করে দেবেন। হয়তো পাবলিক প্লেসে সোজাসুজি নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়, তাই আশা করি কিছুটা রেখেঢেকে দেবেন। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আপনাদের ওপর
আমরা প্রার্থনা করছি, যাতে সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়। জুরি কাতসুরাগির মুক্তি এটার ওপরই নির্ভর করছে।
আপনাদের একটা কথা আগেই জানিয়ে রাখছি, যাতে পরে কোনো সমস্যা না নয়। সেটা হলো, এই ইমেইল এড্রেসে মেইল পাঠিয়ে লাভ নেই। আমরা আর এই অ্যাড্রেস ব্যবহার করবো না। কেবল এই কাজের জন্যই এটা খোলা হয়েছিল।
বেশ কয়েকবার সেটা পড়ার পর আমি সোজা হয়ে বসে সেন্ড বাটনে ক্লিক করলাম। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় সেটা যে পৌঁছে গেছে, তা দেখাতে লাগল। সাথে সাথে অ্যাকাউন্ট থেকে লগ আউট করলাম।
জুরি পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে পুরোটা পড়ে ফেলেছিল। মুগ্ধ গলায় সে বলল, “ক্যাডি ব্যাগ আর একটা সাধারণ ব্যাগ। বাহ, ঠিকই তো। এরকম ব্যাগ বয়ে বেড়ানো খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।”
“আশা করি আমাদের প্রতিপক্ষও তাই ভাববে।”
আড়চোখে জুরির দিকে তাকালাম। সে বিদ্রূপাত্মকভাবে মাথা বাঁকিয়ে বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিচ্ছে।
তারা কখন আমার ইমেইলটা টের পাবে? হয়তো শীঘ্রই। নিয়মিত তাদের ইমেইল চেক করার কথা। বোধহয় এই মুহূর্তেই গোটা কাতসুরাগি ম্যানশনে হট্টগোল লেগে গেছে।
খুব মন চাচ্ছিল সিপিটি মালিকদের ওয়েবসাইটটাতে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু সেটা করব না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। বারবার চেক করতে গেলে শেষমেষ আমিই উৎকণ্ঠায় পড়ে যাবো। সেটাতে বরং ক্ষতিই হবে। যাই হোক, এখন বোধহয় প্রতিপক্ষ কী করা যায়, তা নিয়ে মিটিংয়ে বসেছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে কম্পিউটারটাও বন্ধ করে দিলাম।
ফ্যানের শব্দ একসময় কমে যাওয়ায় গোটা ঘরটা আশ্চর্যরকমভাবে নীরব হয়ে গেল। আমার কানে কেবল জুরির শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ আসছিল।
“অবশেষে টাকাটা আমরা পেতে যাচ্ছি।” তার বুকটা সে আশায় স্ফীত হলো। “আমাকে এখনো পুরোটা বলবে না?”
“ধীরে ধীরে সবই জানবে।” হাসিমুখে উত্তর দিলাম। তাকে সবকিছু খুলে বলতে মন চাইছিল। কিন্তু না, তার সব জানার প্রয়োজন নেই। “আজকের মতো ঘুমিয়ে যাও।”
জুরিকে বিছানায় ঘুমাতে বলে আমি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। তাকে ব্যাপারটাতে একটু মন খারাপ করতে দেখলাম, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
সত্যি বলতে কী, এখন তার সাথে শোয়ার জন্য আক্ষেপ হচ্ছে। কেন এরকম লাগছে আমার কাছে? ব্যাপারটা যে আমার বানানো খেলার পরিকল্পনাতে ছিল না— সেজন্য? নাকি আমি আমার মূল্যবান ‘পণ্য’টাকে কলুষিত করে ফেলেছি— সেজন্য অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে?
না, সেগুলোর একটাও নয়।
আমার ভেতরে একটা অ্যালার্ম তারস্বরে বেজে আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিল, এখন তো আর করা কাজটাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না, তাই না?
এসব আজেবাজে চিন্তার কারণে ভালোমতো ঘুম হলো না। খানিকটা ঘোরের মতো অবস্থায় কাটিয়ে প্রতিদিনকার মতো একই সময়ে উঠে পড়লাম। বাথরুমে হাতমুখ ধুয়ে অভ্যাসবশত কম্পিউটারটা চালু করলাম।
সিপিটি মালিকদের ওয়েবসাইটে ঢোকার আগে ইমেইল চেক করে নিলাম। বুলেটিন বোর্ডে দেওয়া পোস্টটা দেখে প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
প্রস্তুত (ইউজারনেম- জুলি)
শুভ সকাল। আমি জুলি বলছি। টাকাটা অবশেষে জোগাড় করতে পেরেছি। এর মাধ্যমে আমি আমার প্রিয় গাড়িটা অবশেষে হাতে পাবো বলে আশা করছি। খালি তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেই সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
যাই হোক, আজকালকার দিনে আমরা আমাদের পছন্দমতো রেজিস্ট্রেশন প্লেট নম্বর বেছে নিতে পারব, তাই না?
এগুলোর যে-কোনো একটা হলেই আমি খুশি হবো
৩XXX কিংবা ৮Xxx
কদিন হলো গলফ খেলা শুরু করেছি। তাই কবে যে গাড়ির ট্রাংকে গলফ ব্যাগ রেখে ড্রাইভ করে সেখানে যেতে পারবো, তর সইছে না।