আট
মেট্রোপলিটন এলাকায় থাকলে আসলে গাড়ি কেনার প্রয়োজন পড়ে না। অনেক সময় ডেটিংয়ে গেলেও নিজের গাড়ি নেই না। খাওয়া-দাওয়ার সময় পান করা থেকে বিরত রাখতে পারি না নিজেকে, এটাও একটা কারণ। আরো একটা কারণ হলো, আমার গাড়িটা ছিল একটা এমআর-এস। গাড়িটা চালাতে মজা পেতে হলে সেটার ছাদের অংশ খুলে দিয়ে বাতাসের ঝাপটাকে উপভোগ করতে হবে।
ইয়োকোসুকাতে চুপেচাপে একটা ট্রিপ মেরে আসতে হলে কোনোভাবেই ট্যাক্সি নেওয়া যাবে না। জুরিকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে আমার বিল্ডিংয়ের পার্কিং লট থেকে বের হলাম। স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির ছাদটা খুলিনি। টোকিওর বাইরের বাতাস বেশ বিশুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আজকের সন্ধ্যায় ছাদটা খুলে দিতে রাজি নই আমি।
“এরকম গাড়ি আপনার ভালো লাগে?” গাড়ি চলতে শুরু করতেই জুরি জিজ্ঞেস করে বসলো।
“প্রশ্নটা বুঝলাম না।”
“এটা একটা দুইসিটের স্পোর্টস কার।”
“সেটাতে খারাপ কিসের?”
“খারাপ বলছি না।”
“আসলে আমার গাড়িতে দুইয়ের অধিক পরিমাণ মানুষকে বসানোর কোনো ইচ্ছা নেই। ছেলেদের সাথে করে গাড়ি চালানোর কোনো শখ নেই। আর একবারে একজন করে মেয়েকে গাড়িতে চড়ানোটাই পছন্দ আমার।”
“আপনার জিনিসপত্র কোথায় রাখেন?”
“তোমার সিটের পেছনে জিনিসপত্র রাখার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে।”
“কিন্তু মাঝেমধ্যে তো আপনাকে অনেক জিনিসপত্র সরাতে হয়, তাই না? “বাহন হিসেবে ব্যবহারের জন্যই গাড়িটা কিনেছিলাম। ট্রাকের কাজ করার জন্য তো কিনিনি।”
জুরি কথাটার উত্তর দিলো না। সে হয়তো উত্তর শুনে বিরক্ত হয়ে ঘাড় বাঁকিয়েছে। কিন্তু তার দিকে আমার নজর ছিল না।
“সিডি চালাতে পারবো?” সে জিজ্ঞেস করলো।
“তোমার ইচ্ছা।”
ঠিকই ভেবেছিলাম। গানের ব্যাপারেও তার মন-মানসিকতা বেশ নিচু। “এগুলো আবার কী ধরনের গান? নামই শুনিনি কখনো।”
“একজন জ্যাজ পিয়ানোবাদক বাখ-এর একটা এরেঞ্জমেন্ট শোনাচ্ছে।”
“হু।” তার মুখচোখ দেখে মনে হলো, সেটা তার পছন্দ হয়নি। তবে সে স্টেরিওটা বন্ধ করলো না।
এমআর-এস এর কোনো ক্লাচ নেই। রূপালি লিভারটা শক্ত করে ধরে গিয়ার পালটে গাড়ির গতি বাড়ালাম।
জুরি ঠিকই বলেছিল। একঘণ্টার মধ্যেই আমরা মেট্রোপলিটন এক্সপ্রেসওয়ে পার হয়ে ইয়োকোহামা-ইয়োকোসুকা-এর রাস্তায় উঠে পড়লাম। ইয়োকোসুকার ইন্টারচেঞ্জ পার হয়ে আমরা পথ ধরলাম হোঞ্চো ইয়ামানাকার। কয়েক মিনিট পরেই উপস্থিত হলাম শিয়োইররি স্টেশনের সামনে।
“সোজা ঐ রেঁস্তোরার পার্কিং লটে চলে যান।”
জুরির কথামতো ওখানেই গাড়িটা পার্ক করলাম।
“এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি একাই যাবো।”
“খুব কাছেই নাকি?”
“একটু হাঁটতে হবে। তবে এর থেকে বেশি কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। এরকম চকমকে গাড়ি নিয়ে বাড়ির সামনে গেলে সবার মনে থাকবে।”
সে ঠিকই বলেছে। তাকে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে দিলাম যাতে সমস্যা হলে ফোন করতে পারে। সে রাস্তা পার হয়ে একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লো।
রেঁস্তোরাটাতে বিস্বাদ কফি খেতে খেতে সামনে কীভাবে আগাবো সে ব্যাপারে চিন্তা করতে লাগলাম। জুরির এই ভুল করে মেসেজ রেখে দেওয়াটা আমার হিসাবের বাইরে ছিল। তবে সাবধানে সেটা মুছে দিতে পারলে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাতে কোনো সমস্যাই হবে না।
এখন ঐ বিশাল পরিমাণের টাকা সরানোটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা বলে মনে হচ্ছে। ঐ পরিমাণ টাকার ওজন খুবই বেশি হবে, বহন করতেও সমস্যা হবে। বহন করতে গেলে বোধহয় আমাদের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু একটা গাড়িকে খুব সহজেই খুঁজে বের করা যায়। আসলে টাকা হাতে নিয়ে এভাবে পালিয়ে যাবার প্রক্রিয়াটাই আমার কাছে আদিম বলে মনে হয়।
তবে সেই টাকাকে যদি অন্য কিছুতে রূপান্তর করে আমাদের দিতে বলি, তাহলে পরে খুব সহজেই সেটাকে টাকায় রূপান্তর করে নেওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে হীরার কথাই ধরা যাক। তাহলে ওটা বহন করতে কোনো সমস্যাই হবে না। তবে একসাথে সবগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাহলে লোকে সন্দেহ করতে পারে। এর থেকে একে একে সেগুলোকে বিক্রি করলেই বরং ভালো হবে। এক মিলিয়ন ইয়েনের মূল্যের সমান সংখ্যক হীরা নিয়ে প্রত্যেকবার বের হবো। তাহলে তিনশত বার বের হতে…
মাথা ঝাঁকালাম। না, ওটাও সম্ভব নয়। এক-দুবার নাহয় যাওয়া যায়, কিন্তু এতবার? একই সাথে দুটো দোকানে গিয়ে হীরা বিক্রি করলেও তো প্রায় দেড়শবার যাওয়া লাগবে। তাছাড়া প্রত্যেকটা অলংকারের দোকানের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক তো অবশ্যই রয়েছে। তাদের কেউ ফাঁস করলেই সবাই জেনে যাবে। আমার প্রতি সন্দেহটাও বেড়ে যাবে। দেখা যাবে, পরেরবার আমাকে অ্যামবুশ করার জন্য ডিটেকটিভরা দোকানে ওঁত পেতে রয়েছে।
তাহলে ব্যাংকে সম্পূর্ণ টাকাটা ট্রান্সফার করে নিলেই হবে। তবে সেজন্য নকল নাম দিয়ে আমার একটা অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। ওটা অবশ্য শক্ত কোনো কাজ নয়। ইন্টারনেটে খুঁজলেই এরকম নকল নামধারী প্রচুর অ্যাকাউন্ট পাওয়া যাবে। তবে টাকা ওঠানোটাই আমার কাছে ঝামেলা মনে হচ্ছে। ব্যাংকে তো আর যেতে পারবো না, তাই হয়তো এটিএম মেশিনই ব্যবহার করতে হবে। একদিনে অবশ্য বেশি করে টাকা তোলা যাবে না। তাই একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকলেও সম্পূর্ণ টাকাটা তুলতে বেশ কয়েকদিন লেগে যাবে। আর তাছাড়া পুলিশ হয়তো ঐ অ্যাকাউন্টগুলোর ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দেবে, এমনকি আমাকে ধরার জন্য সাহায্যও চাইতে পারে। কদিন পর তাদের বিছানো জালে ধরাও পড়ে যেতে পারি। সিকিউরিটি ক্যামেরাতে আমার ছবিটাও থেকে যাবে—সেটাও একটা বড়ো সমস্যা।
যখন এটিএম বুথ ব্যবহারের অসুবিধাগুলো ভাবছিলাম, তখনই রেজিস্টারের ফোনটা বেজে উঠল। একজন যুবক ওয়েটার ফোনটা তুলে কানে ধরলো।
তাকে দেখে বেশ অবাক মনে হলো। সে কর্ডলেস ফোনটা কানে চেপেই বেরিয়ে গেল বাইরে। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে সে আবার ফিরে এসে কাউন্টারের পেছনে চলে গেল।
কিছু সময় পর একজন মোটাসোটা ব্যক্তি (দেখে মনে হচ্ছে এ জায়গার ম্যানেজার) বেরিয়ে এলো। তারপর পূর্বের সেই ওয়েটারকে সঙ্গে করে ছুটলো বাইরে। তারা দুজন ফিরে আসতেই তাদের মুখে একটা হতবুদ্ধি ভাব লক্ষ করলাম।
কিছুক্ষণ শলা-পরামর্শ করে দুজনে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেক কাস্টোমারের টেবিলে যাওয়া শুরু করলো। একটু পরই যুবক ওয়েটার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“মাফ করবেন, স্যার।” সে নম্রভাবে মুখ খুললো।
“হ্যাঁ বলুন।”
“আপনি কি আজ গাড়ি করে এখানে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, এসেছি।”
“আপনার গাড়ি কোনটা?”
“একটা এমআর-এস টাইপের গাড়ি ওটা।”
“এম…” গাড়িটা কোন ধরনের তা সে বুঝতে পারেনি।
“একটা নেভি স্পোর্টস কার। কনভার্টেবল হুড়ওয়ালা একটা গাড়ি।”
ওয়েটার মুখভঙ্গি পালটে গেল। “মানে, শিনাগাওয়ার রেজিস্ট্রেশন প্লেটওয়ালা…?”
“হ্যাঁ, ওটাই।” মনে হচ্ছে কোনো খারাপ কিছু ঘটেছে। হৃৎপিণ্ড জোরে জোরে লাফাতে শুরু করেছে। “কিছু হয়েছে নাকি?”
“আসলে কারা জানি ওটা স্প্রে পেইন্ট করে রেখে গেছে…”
ওয়েটারের কথা শেষ হবার আগেই আমি দৌড়ে বের হলাম।
গাড়িটাকে লাল রঙে মাখামাখি করে ফেলেছে একেবারে। এমনকি একটা হেডলাইট সেই রং থেকে নিস্তার পায়নি, পুরোপুরি ঢেকে গেছে।
“কোন গর্দভ এটা করেছে?”
হেডলাইটটাকে দেখে একটা রক্তাক্ত চোখ বলে মনে হচ্ছিল। ওয়েটার ভেতর থেকে দৌড়ে হাতে কি যেন নিয়ে এসে আমার সামনে উপস্থিত হলো। “স্যার, আপাতত আপনার জন্য এটা নিয়ে এসেছি।”
বেঞ্জিনের বোতল আর একটা টাওয়েল নিয়ে এসেছে সে। তাকে ধন্যবাদ জানাতেও মন চাইলো না। কিন্তু সেটা নিয়ে লাইটটা পরিষ্কার করা শুরু করলাম। টের পেলাম, এই রং মাখামাখি ঘটনা খুব বেশিক্ষণ আগে ঘটেনি। তাই কাচের ওপর লেগে থাকা রংটা খুব সহজে উঠে গেল। তবে কোটিংয়ে লেগে থাকা রংটা ঘষার সাহস পেলাম না। সৌভাগক্রমে গাড়ির বড়ির খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
“আসলে স্যার…” মোটা ম্যানেজারটা কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। “পার্কিং লটে কিছু ঘটলে সেটার ক্ষতিপূরণ রেঁস্তোরা দিতে পারবে না।”
“সেটা আমার জানা আছে। আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও ভাবছি না।” টাওয়েল আর বেঞ্জিনের বোতলটা ওয়েটারকে ফিরিয়ে দিলাম। “ধন্যবাদ।”
“আপনি কি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করবেন?” ওয়েটার শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করলো।
“নাহ, এত গণ্ডগোল করার ইচ্ছা হচ্ছে না।” এই মুহূর্তে পুলিশ ডাকার কথা ভাবাও যাবে না। “সমস্যা নেই। আপনারা রেঁস্তোরায় চলে যান।” আশেপাশে তাকালাম, কিন্তু কাউকে চোখে পড়লো না। স্বাভাবিক। ঘটনা ঘটানোর পর কালপ্রিট কোনোমতেই পার্কিং লটে থাকবে না।
“আগে কখনো এরকম ঘটেনি।” মোটা ম্যানেজার ঘামতে ঘামতে অযুহাত দেবার চেষ্টা করলো। আমি অবশ্য তার উত্তর দিলাম না।
আবার রেঁস্তোরার ভেতর ঢুকে পড়লাম। তবে আর বসে থেকে কফি খেতে মন চাচ্ছে না। তাই বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে জুরির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু লাল রঙের ছোপগুলোর কারণে গা চিড়বিড় করে জ্বলতে লাগল। গাড়িটা আগের মতোই এমআর-এস ছিল, কিন্তু এই রঙের কারণে গাড়িটার প্রতি ভালোবাসা অনেকাংশে কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
দশ মিনিট পর জুরি ফিরে এলো। সে রেঁস্তোরায় ঢুকতে যাচ্ছিল, তাই হর্ন বাজিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম।
সে ঢোকার পর যখন তাকে স্প্রে পেইন্টের দুর্ঘটনার কথা বললাম, সে খুবই অবাক হলো। বের হয়ে গাড়ির অবস্থাটা দেখলো।
“কী জঘন্য ব্যাপার-স্যাপার। মোটরসাইকেল গ্যাং-এর কেউ করেনি তো এসব?” সে আমার পাশে বসে বলল।
“আজকালকার যুগে গ্যাংয়ের সদস্যরা এত বড়ো ভুল কখনোই করবে না। বোধহয় এখানকার স্থানীয় গ্রেড স্কুল কিংবা মিডল স্কুলের ছেলেপিলেদের কাজ এটা।”
“হতে পারে।”
“যাকগে। তোমার কী অবস্থা? কাজটা ঠিকভাবে করতে পেরেছ তো?”
“একেবারে নিখুঁতভাবে করে এসেছি।” জুরি হাত দিয়ে একটা ওকে সাইন করে দেখালো। “চাবিটা যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিল। তাই ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি। আর আন্সারিং মেশিন থেকে মেসেজটা মোছাও অনেক সোজা একটা ব্যাপার ছিল।”
“কেউ তোমাকে দেখেনি তো?”
“আপনার কি মনে হয় আমি এরকম বড়ো কোনো ভুল করব?”
“বলা তো যায় না। এই তো, আন্সারিং মেশিনের ভুলটা কিন্তু তুমি মনের অজান্তেই করে ফেলেছিলে। ওটা কিন্তু আমার চোখে অনেক বড়োসড়ো একটা ভুল।”
“জিনিসটা মাথায় ছিল, তাই সব ঠিকঠাক মতোই ভুলটা সংশোধন করার চেষ্টা করেছি।”
“আর সেটা করার জন্য আমাদেরকে ইয়োকোসুকা পর্যন্ত আসতে হয়েছে।” গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলাম।
পার্কিং লট থেকে বের হয়ে যে রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা, সেদিকে না গিয়ে তার উলটো দিকে যাওয়া শুরু করলাম।
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“চুপচাপ দেখতে থাকো।”
আগে একবার ইয়োকোসুকা এসেছিলাম। পূর্বের সেই স্মৃতিগুলো কাজে লাগিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে শুরু করলাম। পূর্বে ব্যবহার করা রাস্তাগুলো সবসময় আমার আবছা আবছা হলেও মনে থাকে বলে সবার কাছে দাবি করতাম।
হাইওয়ে থেকে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। সে রাস্তাটা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। আশেপাশে খুবই কম বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, ধীরে ধীরে বনের আধিক্য ততটাই বেড়ে যাচ্ছে। অবশেষে রাস্তার কোণে সবুজ আলোয় আলোকিত একটা বিল্ডিং চোখে পড়ল। পার্কিং লটের সাইন দেখে গাড়ির গতি কমাতে শুরু করলাম।
“দাঁড়ান, আপনি কী করতে চাচ্ছেন?” জুরির গলার স্বর তীক্ষ্ম হয়ে গেছে। “চুপ করে থাকো।”
“আমি চুপ থাকতে পারবো না। আপনি আমাকে আগে বলেননি যে, এরকম জায়গায় আমাকে যেতে হবে।”
জুরির কথা অগ্রাহ্য করে রাস্তার পাশে পার্কিং করলাম, হ্যান্ডব্রেক লাগিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম।
“চলো, ভেতরে যাওয়া যাক।”
“কোথায়?”
“কোথায় আবার? ঐ যে, ঝকমকে বিল্ডিংটাতে।”
কিন্তু জুরি নিজের সিটবেল্টটা খোলার চেষ্টাও করলো না। সে শক্ত হয়ে মুখ পাথরের মতো করে বসে থাকলো।
“তুমি পাগলামি করছো কিন্তু।” অট্টহাস্য দিলাম। “এতদিন ধরে আমার বাসায় থাকছো, সেটাতে তোমার কোনো সমস্যা হয়নি। আজ আমার সাথে একটা লাভ হোটেলে ঢুকতে এত ভয় পাচ্ছো কেন?”
“কিন্তু…এ জায়গাটা…”
“এ জায়গাটায় মানুষ কেবল একটা কাজের জন্যই আসে?”
জুরি জবাব দিলো না। আমি আবার হো হো করে হেসে দিলাম।
“ভুল বুঝো না। আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। সেজন্যই একটা প্রাইভেট রুমের ব্যবস্থা করেছি।”
“কী কাজ?”
“কেন, আমাদের খেলার সম্পর্কিত কাজ। তুমি কি ভেবেছ আমরা এতদূর এসেছি কেবল একটা আন্সারিং মেশিনের মেসেজ মোছার জন্য?”
অবশেষে তার মুখভঙ্গি আবার স্বাভাবিক হলো। এরপরেও তার চিবুক দেখে বুঝলাম, মনের সন্দেহ এখনো দূর হয়নি। আমাকে সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। “তাহলে পার্কিং লটে কেন গাড়িটা রাখলেন না?”
“এরকম হোটেলের সিকিউরিটি ক্যামেরাগুলো সবকিছুর ওপর বেশ তীক্ষ্ম নজর রাখে। আমাদের গাড়ির প্লেট নম্বরও তারা দেখে ফেলতে পারে। সেজন্যই সতর্কতার খাতিরে এখানে পার্ক করলাম।”
“হুম।” সে কিছুটা অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আপনি এসব জায়গা তো বেশ ভালোভাবেই চেনেন দেখছি।”
“অতীতে এরকম হোটেলের মতো অনেক হোটেলের হয়ে তাদের কাজ করে দিয়েছি, তাদের নানা শলা-পরামর্শ দিয়েছি।”
দুজনে একসাথে হেঁটে হেঁটে ক্যামেরার প্রতি সাবধান থেকে হোটেলে ঢুকলাম। যে রুমটা ভাড়া করেছিলাম, সেটা অশোভনীয়, অশ্লীলভাবে সাজানো হয়েছিল। ভেতরে ঢুকেই সবকিছুর আগে জানালাটা খুলে দিলাম। পাহাড়ের এত কাছাকাছি চলে এসেছি, অথচ সাগরটাকেও খুব কাছে মনে হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ করে জাহাজের হর্নের শব্দ কানে আসছে।
“আপনি এখানে কী করবেন?”
একটু পরেই বুঝতে পারবে। আপাতত ঐ সুন্দর সোফাটাতে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ো।”
কিন্তু জুরি সোফায় গিয়ে বসলো না। সে চাদর ঢাকা বিছানাটার ওপর গিয়ে বসলো। কৌতূহলী দৃষ্টিতে ঘরটার সবকিছু দেখতে লাগল। এরকম জায়গায় সে কখনো আসেনি নাকি যে হোটেলে ঢুকেছিল সেটা এর থেকে আলাদা—কোনটা যে হতে পারে তা বলতে পারলাম না।
সোফায় বসে নোটবুকটা বের করে হাতে নিলাম। একটা বলপয়েন্ট কলম দিয়ে সেটাতে লেখা শুরু করলাম।
“কী লিখছেন?”
“একটু অপেক্ষা করো।”
বিছানায় কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে সেটাতে আরাম করে বসে সে টেবিলের ওপর থেকে রিমোটটা তুলে নিয়ে টিভি অন করলো। কয়েকটা চ্যানেল পাল্টানোর পর টিভির পর্দায় একটা ভিডিয়ো চলা শুরু করলো। একজন পুরুষ অভিনেতা একজন যুবতি নারীর সাথে শারীরিক আনন্দ-উল্লাসে মত্ত হয়ে আছে। অবশ্য বিশেষ বিশেষ অংশগুলো ব্লার করে দেওয়া হয়েছিল।
জুরি তাড়াতাড়ি করে টিভি অফ করে দিলো। সেটা দেখে হেসে ফেললাম।
“তুমি অনেক নিষ্পাপ দেখছি।”
“আমি ওটা বন্ধ করে দিয়েছি কারণ ওটা বাজে লাগছিল। আপনি যদি দেখতে চান, তবে এক্ষুনি চালিয়ে দিচ্ছি।”
“নাহ, ধন্যবাদ। আমি আপাতত কাজে ব্যস্ত আছি।”
“তাই নাকি।” জুরি পা নাড়াতে নাড়াতে বলল, “পুরুষরা খুবই উদ্ভট একটা প্রাণী। এরকম জিনিস দেখে কীভাবে তারা আনন্দ পায়?”
“অনেক মহিলারাও কিন্তু ‘এসব’ দেখার ভক্ত।”
“তবে পুরুষদের সমান সংখ্যক তো আর নয়। বিশেষ করে, বুড়োরা একদম হদ্দ বোকা। তাদের নিজেদেরই পকেট খালি থাকে, অথচ তারা একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সাথে ডেটিং করার জন্য হাজার হাজার ইয়েন খরচ করতে দ্বিধাবোধ করে না। ওদের মাথায় বোধহয় কোনো সমস্যা রয়েছে। তারা কি কোনোভাবেই বুঝতে পারে না যে, মেয়েগুলো তাদের হৃদয় নিয়ে খেলছে?”
““খেলছে’ শুনলে কেমন জানি শিকারি প্রাণীর কথা মনে হয়।” আমার হাত থেমে গেল। নোটবুক থেকে মাথা তুলে বললাম, “তুমি কি একদম নিশ্চিত যে, ঐ বুড়ো মানুষরা একদমই বোকা? ওরা না বুঝেই মেয়েগুলোর ফাঁদে পা দিয়েছে?”
“আমি কি ভুল বলেছি নাকি?”
“শোনো। এই বুড়োরা অনেক কষ্টের জগতে বাস করে। টাকাপয়সার মূল্য তাদের ভালোমতোই জানা আছে। তারমানে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, তারা জেনে-বুঝেই হাজার হাজার ইয়েন খরচ করছে। টাকাটা ব্যয় করা তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে বলেই সেটা তারা করছে।”
“কিন্তু…”
“যদি তোমার কাছে মনে হয় যে, সেক্সের জন্য অত টাকাপয়সা খরচ করা বোকামির লক্ষণ, তুমি ভুল জানো। এই তো, এক জেনারেশন আগে একজন অ্যামেচার হাইস্কুলের মেয়ের সাথে সেক্স করার স্বপ্ন হাজার হাজার ইয়েন খরচ করলেও পূরণ করা সম্ভব হতো না। আজকাল কেবল দশহাজারের মতো খরচ করলেই তারা সেটা পেয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে এটা অনেকটা স্বপ্ন পূরণের মতো। সেই স্বপ্নটা তারা আগের তুলনায় অনেক কম খরচ করে পূরণ করতে পারছে। তাই সুযোগটা না নেওয়াই বরং বোকামির লক্ষণ। ঐ বুড়োগুলো বরং মনে মনে ভাবে, ‘এই কচি মেয়েরা কয়েক সহস্র, না, কয়েক মিলিয়ন ইয়েনের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে। কী বোকা ওরা!” মেয়েগুলো কেবল তাদের শরীরই বিক্রি করছে না, তারা তাদের আত্মাটাকেও সেই সাথে বিক্রি করে দিচ্ছে।”
“তারা নিজের হৃদয়টা তো আর বিক্রি করছে না। ঐ পেশার সাথে জড়িত মেয়েরা বলে যে, তারা কেবল শরীরটাকেই বিক্রি করে।”
“তারা নিজেদের মনকে বুঝ দেবার জন্য এ কথাটা বলে। ঠিক আছে। ধরলাম যে, তারা কোনো বুড়োকে নিজেদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে দেয় না। কিন্তু তাতে কী? তোমার কি মনে হয় ঐ বুড়োদের তাতে যায়-আসে? যখন তারা ঐ মেয়েদের শরীরটাকে উপভোগ করে, তখন তাদের মনে একটাই কথা ঘোরাফেরা করে, ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি মেয়েটা আমার সাথে এ কাজ করতে গিয়ে ঘেন্নায় মরে যাচ্ছে। তাতে আমার কী? আমি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি ওকে।’ সহজ কথায় তারা ভাবে যে, টাকা দিয়ে তারা মেয়েটার মনের অনুভূতিকেও অগ্রাহ্য করার অনুমতিও পেয়ে গেছে। তাহলে এতে কি আত্মার অবমূল্যায়ন ঘটলো না?”
বোধহয় মেশিনগানের মতো একটানা বকবক করছিলাম দেখে কিংবা আমার বলা একটা কথাও বুঝতে না পেরে সে মাথা আলতো করে নাড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
“এ জগতে টাকার চেয়েও অনেক দামি জিনিস রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, ‘মানুষের হৃদয়’ আর ‘সময়’ এরকম দুটো অমূল্য জিনিস। তুমি যত ইচ্ছা টাকা খরচ করলেও আরেকজনের হৃদয়কে টলাতে পারবে না। আর সময়কে টাকা দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই আমি এ দুটোর ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে।” নোটবুক থেকে একটা কাগজ বের করে তার হাতে দিলাম। “যাকগে, অনেকক্ষণ বকবক হলো। এবার কাজে ফেরা যাক। একটু আগেই তো বলেছি যে, সময় টাকার থেকেও অমূল্য।”
“এটা কী?”
“পড়লেই বুঝতে পারবে।”
জুরি পুরোটা পড়ার পর ধীরে ধীরে মাথা তুললো। তার গাল আবার খানিকটা শক্ত হয়ে গেছে। “আমরা এখান থেকে তাদের ফোন করব? আমাকেই ফোনটা করতে হবে?”
“একদম ঠিক। তাদের বোঝাতে হবে যে, তুমি নিরাপদ আছো। তাই তুমি ফোন করলেই তারা খুশি হয়ে যাবে।”
“এখান থেকে কেন?”
“দুটো কারণে। প্রথমত, তারা নম্বরটা ট্রেস করবেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে সমুদ্রের ঐ জাহাজগুলো। আমার জানা নেই তারা কী ধরনের রেকর্ডার ব্যবহার করছে, তবে কোনোভাবে জাহাজের হর্নের শব্দ শুনতে পেলেই কেল্লা ফতে। তারা যদি আন্দাজ করতে পারে যে ওটা জাহাজের হুইসলের শব্দ, তাহলে ওরা ধরে নেবে আমরা সমুদ্রের আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছি। এমনকি হুইসলের শব্দটা যে ইয়োকোসুকা থেকে এসেছে, সেটাও বের করে ফেলতে পারে।”
“মোদ্দা কথা আপনি চাচ্ছেন তারা যাতে ভুল পথে এগোয়।”
“ঠিক ধরেছ।”
বিছানার পাশের ফোনটাতে কয়েকটা বাটন টিপে ফোন দিলাম। খুব দ্রুত আমার ফোন তারস্বরে বাজতে শুরু করলো। মোবাইলের স্ক্রিনটা দেখে হোটেলের টেলিফোন কেটে দিলাম।
“এবার কী করলেন?”
“পরীক্ষা করে দেখলাম, হোটেলের ফোন নম্বরটাতে কোনো ধরনের আইডি আছে কিনা। কোনো সমস্যা নেই। আমরা ফোন দিতে পারব।” বলে ফোনটা তার দিকে ঠেলে দিলাম।
সে হাত ভাঁজ করে সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো। “পাপা বাদে অন্য কেউও কিন্তু ফোন ধরতে পারে।”
“আমি মোটামুটি নিশ্চিত তিনিই ফোন ধরবেন। তবে অন্য কেউ হলে তাকে ডেকে দিতে বলবে। ওরকম পরিস্থিতিতে পড়লে কেবল দশ সেকেন্ডের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর ফোনটা রেখে দেবে।”
“পাপা অনেক প্রশ্ন করতে পারে।”
“সেটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের হাতে খুচরা আলাপের সময় নেই। বলে দেবে যে, তুমি উত্তর দিতে পারছো না। আর কাগজে যা যা লেখা আছে সব গড়গড় করে বলে দেবে।”
“বুঝতে পেরেছি।” জুরি চোখ বন্ধ করে নিল। “সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।” চোখ খুলে বলে উঠল।
হাত দিয়ে ফোনটা তাকে দেখিয়ে দিলাম। জুরি ঢোঁক গিলল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে রিসিভারের দিকে হাত বাড়ালো।
কাঁপা কাঁপা হাতে সে ফোনের বাটনগুলোতে চাপ দিল। স্বাভাবিক কারণেই আমার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড লাফালাফি করছিল। সব ঠিকঠাক মতো করেছি কিনা, তা বারবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম।
জুরির কানে লাগানো রিসিভার থেকে রিং হবার শব্দ শুনতে পেলাম। তিনবার রিং হওয়ার সাথে সাথে কেউ ফোনটা ধরলো। একটা গলা শোনা গেল। তবে ওটা কার গলা তা দূর থেকে বুঝতে পারছিলাম না।
“পাপা? হ্যাঁ, আমি বলছি। আমার গলার স্বর চিনতে পারছো না? আমি জুরি।” সে আমার লিখে দেওয়া নোটের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল।
দূরে থেকেও আমি ফোনের অপর পাশ থেকে যে অজস্র প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে আসছে তা টের পাচ্ছিলাম। জুরি জোরেশোরে একটা শ্বাস টেনে নিল।
“আমাকে মাফ করো। বেশি কথা বলার মতো সময় নেই আমার হাতে। তুমি তো বুঝতে পারছো, তাই না? কারণ, আমি তো এখানে একলা নই… না, সেটার উত্তর দিতে পারবো না। শুধু মনোযোগ দিয়ে শোনো। সময় নেই একদম।”
ঘড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ইতোমধ্যে পনেরো সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে।
“আমি ঠিক আছি। তাই চিন্তা করো না। তারা আমাকে বলেছে যে, টাকাটা পেলেই তারা আমাকে ছেড়ে দেবে…ইশ, সময় শেষ হয়ে গেছে। মাফ করে দিও পাপা।”
কল বাটনের ওপর আঙুল দিয়ে বসে থাকলাম। দুসেকেন্ড পর সৌভাগ্যক্রমে দূর থেকে জাহাজের হুইসলের শব্দ ভেসে এলো। সাথে সাথে বাটনে চাপ দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।
“শেষ!” হাত মুঠি করে দাঁড়িয়ে গেলাম। জানালাটা বন্ধ করে তাকালাম জুরির দিকে। “ভাগ্য আমাদের সাথে ছিল। একেবারে ঠিক সময়ে হুইসলের শব্দ পেয়েছি।”
কিন্তু জুরিকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলো না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর খুব ঠান্ডা লাগছে।
“কী হয়েছে?” তার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম।
তার গোটা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। যখনই প্রশ্নটা করলাম, সে আমাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
“আর ফিরে যেতে পারব না আমি।” সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো। তার গাল আমার বুকে চেপে ধরে রাখলো।
“ভয় লাগছে?”
জুরি উত্তর দিলো না। আমি স্থিরভাবে বসে থেকে তার শরীরের কম্পন টের পেলাম।
“খুবই স্বাভাবিক।” শান্ত গলায় বললাম। “আমরা যা করছি, তা একদম অস্বাভাবিক একটা কাজ। সাধারণ মানুষ কখনই এরকম কাজ করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু কাজটার বিনিময়ে আমরা যা পাচ্ছি, তাও কিন্তু কম নয়।”
জুরি আলতো মাথা নেড়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। তার চোখজোড়া অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে আছে।
হঠাৎ করে বুকের ভেতর অনেকগুলো অজানা অনুভূতি ঝড় তুলতে শুরু করলো। একটা নির্দিষ্ট তাড়না টের পাচ্ছি। অচেনা একটা অনুভূতি, না অচেনা নয়, অচেনা বলে অগ্রাহ্য করা একটা অনুভূতি আমার হৃদয়টাকে কাঁপাতে শুরু করলো।
জুরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। মাথার ভেতর অনেকগুলো চিন্তা খেলে গেল। এগুলোর অধিকাংশই ছিল নিজের স্বার্থ উদ্ধার নিয়ে। মেয়েটার সাথে এখানে বিছানায় যাওয়াটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার হবে না। বরং সেটা করলে আমাদের পরিকল্পনা মতো আগানো আরো সোজা হবে। কথাটা কিন্তু মন্দ ভাবিনি।
কিন্তু না, ধীরে ধীরে হাত দুটো আলগা করে দিয়ে তার থেকে কিছুটা সরে বসলাম। না, এখন এসব করা চলবে না। আমি এখন জীবনের সেরা খেলাগুলোর একটা খেলছি।
“আপাতত এখান থেকে চলে যাওয়া যাক। মনে হয় না তারা ফোনটা ট্রেস করতে পারবে, তবে সাবধানতার মার নেই। এরকম জায়গা থেকে যত দ্রুত চলে যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল।”
জুরি নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।
গাড়ির কাছে ফিরে এলাম আমরা। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি যখন চালাতে শুরু করব, ঠিক তখন জুরি বলে উঠল, “একমিনিট দাঁড়ান।” ব্রেকে শক্ত করে চাপ দিলাম।
“আমার একটা অনুরোধ আছে।” সে বলতে থাকলো।
“কী অনুরোধ?”
“কাছাকাছি একটা জায়গায় আমার যেতে ইচ্ছা করছে।”
“তোমার কি আরো কাজ করা বাকি আছে?”
“না, কাজ নয়। একটা জায়গায় যেতে মন চাচ্ছে। অনেক ছোটো থাকতে আমার মা আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি আসলে শান্ত হতে পারছি না। প্লিজ, ওখানে গেলে বোধহয়…”
জুরিকে হাত দুটো একসাথে মুঠো করে বসে থাকতে দেখে খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলাম। মেয়েটা যে এরকম আবেগপূর্ণ হতে পারে, তা কল্পনাতেও আসেনি।
“জায়গাটা কি বেশি দূরে?”
“মনে হয় না খুব বেশি দূরে।”
“কিন্তু এখান থেকে ঝটপট সরে যাওয়াটাই কি ভালো হতো না?”
“সমস্যা হবে না। এখান থেকে বেশ ভালোই দূরে জায়গাটা। তবে গাড়িতে করে যেতে সময় লাগবে না।
“বুঝতে পেরেছি।” ব্রেক প্যাডেল থেকে পা সরিয়ে নিলাম। গাড়ি আস্তে আস্তে চলা শুরু করলো। “কীভাবে যেতে হবে সেটা জানা আছে?”
“হ্যাঁ, মোটামুটি জানা আছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। “চলো তাহলে। পথটা তোমাকে বলে দিতে হবে।”
“আচ্ছা। প্রথমে মূল রাস্তায় চলে যান।”
“ঠিক আছে।” স্টিয়ারিং হুইলটা চক্রাকারে ঘুরিয়ে এক্সিলারেটরে চাপ দিলাম।
জুরির কথামতো হাইওয়ে ধরে চলতে থাকলাম। শীঘ্রই উপকূলের রাস্তায় উঠে পড়লাম। রাস্তার বামপাশে সমুদ্র, ডানপাশে সারি সারি উঁচু টিলা। কিছুক্ষণ পর জুরি আমাকে ডানদিকে মোড় নিতে বলল। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে সেদিকে মোড় নিলাম। লক্ষ করলাম, রাস্তা কিছুটা সরু হয়ে গেছে।
“বেশ উঁচুতে উঠছি আমরা। তুমি নিশ্চিত যে, এটাই সঠিক রাস্তা?”
“হুম।” জুরি আত্মবিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলো।
আশেপাশের বাড়িগুলোর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বাইরের পরিবেশ বাধা দেওয়ার মতো কোনো প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়ছে না। ফলে প্রত্যেকটা দিকই দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমরা একটা টিলার ওপর উঠেছি। সামনে কেবল সমতল রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
“এখানেই থেমে যান।”
জুরি বলামাত্র ব্রেক কষলাম। আশপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে ছিল। রাস্তার কোনো দিক থেকেই কোনো গাড়ি চলাচল করছিল না। তা সত্ত্বেও আমি রাস্তার পাশে গাড়িটা পার্ক করলাম।
“শুনুন।” সে আমার দিকে তাকালো। “আপনি কি এটা খুলে দেবেন?” সে গাড়ির ছাদের দিকে ইঙ্গিত করলো।
“এখানে?”
“এখানে এসেছি বলেই খুলতে বলছি।”
কিছুটা দ্বিধাবোধ করতে লাগলাম, তবে তা কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর হুড খোলার সুইচ টিপে দিলাম। ধীরে ধীরে ছাদটা খুলে গেল। একটা শীতল বাতাস আমার গালে টোকা দিয়ে গেল। বাতাসটার মধ্যে ঘাস আর মাটির সোঁদা গন্ধ মিশে ছিল।
“দেখেছেন? কী অপূর্ব জায়গা!” জুরি ওপরে তাকিয়ে তর্জনী দিয়ে সেটা দেখার জন্য ইঙ্গিত করলো।
উফফ, বোকার মতো খাবি খেয়ে বসলাম। রাতের আকাশটা এতই অপূর্ব লাগছিল যে, খাবি খেতে বাধ্য হলাম। সীমাহীন, কুচকুচে কালো রঙের আকাশটাতে অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছিল। তারা আকাশের একদম নিখুঁত জায়গায় অবস্থান করছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, এই অপরূপ পরিবেশটার মধ্যে আমার হৃদয়টাকে হারিয়ে ফেলব। “আমি জানি এটা খুবই অপূর্ব লাগছে, কিন্তু…
জুরি আমাকে থামিয়ে দিল। “প্লিজ আবার বলে বসবেন না যে, এইরকম দৃশ্য প্লানেটেরিয়ামে গেলেই দেখা যায়।”
হাসিটা আটকে রাখতে পারলাম না। তখনো আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছি। “আমি তারার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। আজকে সেজন্য অনুশোচনা হচ্ছে।”
“আমি কেবল ওরিয়ন চিনি। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না।” জুরি হাত দুটো প্রসারিত করে ওপরে উঠিয়ে দিয়ে জোরে একটা শ্বাস টেনে নিল। “অসাধারণ লাগছে। মনেই হচ্ছে না যে, আমরা এখন জাপানেই আছি।”
আমি নতুন দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালাম। আশেপাশের টিলা আর উপত্যকা সবই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সামনে মনে হচ্ছে বিশাল একটা মাঠ প্রসারিত হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে।
“কোনদিকে সমুদ্র বুঝতেই পারছি না।” মুখ ফসকে বলে বসলাম। আশ্চর্য, এ কথাটা জেনে আমার তো লাভ নেই, তারপরেও কেন প্রশ্নটা করছি?
“ঐ যে ওটা, ওটা আর হ্যাঁ, ঐদিকেও সমুদ্র।” জুরি আঙুল দিয়ে তিনটা দিক দেখিয়ে দিল। “আমরা এখন মিউরা পেনিনসুলার একেবারে অগ্রভাগে অবস্থান করছি।”
মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলাম। রাস্তা ধরে আসতে আসতেই সেটা আমার বোধগম্য হয়ে গিয়েছিল।
“কী, এখন একটু ভালো বোধ হচ্ছে?” জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, অনেক ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।” জুরি আমার দিকে তাকিয়ে প্রাঞ্জলভাবে হাসলো। দ্রুত দুবার চোখের পলক ফেলে সে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“এবার আবার কী হলো?”
“আপনি ওখানে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, তাই না?”
এক মুহূর্তের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। তার থেকে চোখ সরিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। “তুমিই তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।”
“না, আমি সেটা বোঝাতে চাইনি…” কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে আবার বলল, “আমি কি বলতে চাইছি, তা আপনি বুঝতে পেরেছেন।’”
উত্তর দিলাম না। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে আঙুলগুলো নাড়াতে লাগলাম। “আপনি থেমে গিয়েছিলেন কেন? ওখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমাদের জন্য বিপদ হতে পারে— এইজন্য? তার মানে সময় থাকলে আপনি আমাকে আরো কাছে টেনে নিতেন?” সে ফিসফিস করে বলল।
এই প্রশ্নগুলো যে আসতে পারে, তা কল্পনাতেও ভাবিনি। “তাহলে আমি তোমাকে প্রশ্ন করছি।” আমি ওর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলাম। “তুমি কেন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে? হ্যাঁ, বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে তুমি ভয় পেতেই পারো। কিন্তু আমি তো তোমার কাছে একজন সহযোগী বাদে কিছুই হওয়ার কথা না।” সে মাথা নিচু করে ফেলল। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে আমার দিকে সোজাসুজি তাকালো। “কারণ, আমি আপনাকে বিশ্বাস করা শুরু করেছি। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র আপনার ওপর আমি আস্থা রাখতে পারবো।”
তার আন্তরিকতা মাখা চোখজোড়া আমাকে হতবুদ্ধি করে ফেলল। লাভ হোটেলে যে অজানা অনুভূতিগুলো গজাতে শুরু করেছিল, সেগুলো আবার হৃদপিণ্ডে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে।
“স্টকহোম সিন্ড্রোম,” বললাম।
তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো সে বোঝাতে চাইছে, কী? এখন পর্যন্ত তাকে এরকম বাচ্চাদের মতো মুখ করতে দেখিনি।
“যখন একজন টেররিস্ট আর তার জিম্মিতে থাকা মানুষ খুবই দীর্ঘ সময় একসাথে থাকে, তাদের মধ্যে নাকি একধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অনুভূতি জেগে ওঠে। দুজনেই চায়, দ্রুত এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে তাদের যেন মুক্তি ঘটে। এটা মনের একটা বিশেষ অবস্থা। বন্ড একটা মুভিতেও এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিল।”
“আমি তো কারো হাতে জিম্মি নই। আর আপনিও কোনো টেররিস্ট নন।”
“ঐ একই কথা। তোমাকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিবশত একটা নির্দিষ্ট স্থানে আইসোলেট থাকতে হচ্ছে। সবই নাটক হলেও আমরা দুজনেই কিন্তু মনে মনে চাচ্ছি সবকিছু যাতে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। আর সেটাই হলো পূর্বে বলা টেররিস্ট আর জিম্মির মধ্যেকার সেই সম্পর্ক।”
জুরি মাথা নাড়লো। “না, ওটার সাথে আমাদের পরিস্থিতির পার্থক্য আছে।”
“কী পার্থক্য?”
“টেররিস্ট আর তার জিম্মির মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে, সেটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই না? সেটাকে অস্বাভাবিকও বলা যায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা সত্য নয়।”
জিহ্বাটা ভিজিয়ে আলতোভাবে মাথা নাড়লাম। “অবশ্যই, আমাদের একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতার প্রয়োজন রয়েছে।”
“ঠিক। তাই আমি আপনার সাথে আমার সেই ‘নির্ভরশীলতা’ অনুভব করতে চাই।”
জুরির চোখজোড়া যেন আমাকে সম্মোহিত করে ফেলল। আমার চোখ দুটোকে যেন তার ওপর থেকে সরাতেই দিচ্ছিল না।
আর নিজেকে ব্রেক কষে থামাতে মন চাচ্ছিল না। এখন ওসব অতিরিক্ত বলে মনে হচ্ছে।
আমি বাম হাত দিয়ে তার মুখটা কাছে এনে চুম্বন করলাম। আমাদের ঠোঁট দুটোর মিলনের ঠিক আগ মুহূর্তে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
জিনিসটা আসলে আপনা-আপনি হয়ে যায়, বুঝলেন? অনেকটা নদীর স্রোতের মতো। চুম্বনের সময় আপনার জিহ্বাটা ঠিক একইভাবে সঙ্গিনীর মুখের ভেতরে প্রবেশ করে। যদি সে কোনো ধরনের বাধা না দেয়, তবে আপনি তার স্তনজোড়া ধরতে চাইবেন। আর সেটা হওয়া শুরু করলে আপনাআপনি আপনার হাত তার আন্ডারওয়্যারের ভেতরে চলে যাবে।
হ্যাঁ, আমিও মনে মনে কিছুটা পরিবর্তন চাচ্ছিলাম, কিন্তু আগে সে সুযোগটা হয়নি। এরকম কথাবার্তা বললে অবশ্য তার এই শারীরিক তাড়না কিছুটা কমে যাবে। তার ঠোঁটে ডুবে যেতে যেতে ভাবলাম, জিনিসটা সিনড্রোমের মধ্যেই পড়ে যাচ্ছে। বাসায় ফোন দিয়ে পাপার সাথে কথা বলার কারণে জুরির মনটা অস্থির হয়ে গেছে। আর তাই সে অস্থিরতাটা দূর করার জন্য তার পাশে থাকা একমাত্র মানুষটাকে কাছে পেতে চাইছে।
তাহলে আমার মনে এসব অনুভূতি কেন খেলা করছে? আমি কি মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম? না, এতটা বোকা নই আমি। না, মেয়েটার প্রতি আমার আলাদা করে কোনো আগ্রহ নেই। আর সেটার সাথে আমাদের একসাথে থাকার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। আসলে যে জিনিসটা আমি ভেতরে অনুভব করছিলাম, সেটা হলো একটা জৈবিক তাড়না। সে যুবতি মেয়ে বলেই সেই তাড়নাটা বোধ করছিলাম। আমি জানি, এই তাড়না পূরণ করা বোকামি হবে, তাই নিজেকে সামলে রাখছিলাম। আমার আচরণে সেটা প্রকাশ পেতে দেইনি। একদম শেষে গিয়েও সেটা তার কাছে প্রকাশ করতে চাই না।
তবে ঘটনা এভাবে মোড় নেওয়ায় আমি কিন্তু অখুশি নই। আমার মনেও একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করছে। সেটাকে দূর করতে হবে। তাছাড়া এতবড়ো একটা খেলা খেলতে হলে একে অপরের প্রতি একটা দৃঢ় আস্থা থাকা দরকার। আর একটা পুরুষ আর মহিলার মধ্যে সেরকম আস্থা স্থাপন করতে হলে শারীরিকভাবেই সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হয়। আসলে সেটা মনের বিভ্রান্তিও হতে পারে। যে অনুভূতিগুলো আমাদের মধ্যে কাজ করছিল সেগুলো স্থায়ীও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। স্টকহোম সিন্ড্রোম ঠিক এরকমই একটা মানসিক অবস্থা।
যখন জুরি কোথা থেকে যেন একটা কনডম বের করে আনলো, তখন চূড়ান্তভাবে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। সে বোধহয় লাভ হোটেল থেকে ওটা তুলে এনেছিল। তারমানে, সে এটা ঘটার অপেক্ষা করছিল। তখন ভাবতে বাধ্য হলাম, ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা।
গাড়ির ছোট্ট জায়গার মধ্যেই আমরা একে অপরের সাথে মিলিত হলাম, একে অপরকে উত্তেজিত করে তুললাম। আমার কাছে মনে হলো, জুরি যৌনকর্মে বেশ দক্ষ। কীভাবে সেটাকে উপভোগ করতে হয়, সেটাও তার জানা ছিল।
মিলন শেষ হবার কিছুক্ষণ পর জঞ্জালগুলো ফেলার কথা বলে সে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ফিরে না আসায় আমিও প্যান্ট পরে গাড়ি থেকে বের হলাম।
একটু দূরেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আমি তাকে পেছন থেকে ডাকলাম। “কী করছো?”
“না, কিছু না। প্রকৃতিটা উপভোগ করছিলাম।”
সে যেদিকে তাকিয়ে আছে, সেদিকে তাকালাম। আবছা আবছাভাবে সমুদ্রটা দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে একটু নিচে নামাতেই হেসে ফেললাম।
“কী হয়েছে?”
“ঐ যে দেখো। একটা জিজো মূর্তি (জাপানিজ মিথ অনুযায়ী এমন একটা দিব্যশক্তি, যে পিতামাতার আগে মারা যাওয়া শিশুকিশোরদের আত্মাকে কু-শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে)।”
সেও ছোটোখাটো পাথরের তৈরি বৌদ্ধমূর্তিটা আর সেটার জন্য বানানো ছোট্ট ঘরটা দেখতে পেল। “ঠিকই বলেছ। আমি লক্ষই করিনি।”
“আর তুমি কিনা একটু আগে বলছিলে যে, এ জায়গাটাকে জাপান বলে মনেই হচ্ছে না।”
“হ্যাঁ।” জুরির চোখদুটো ঝকমক করছিল। সে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, “ঠান্ডা লাগছে। চল বাড়ি ফিরে যাই।”
“ঠিক আছে।” আমিও তার কথায় সায় দিয়ে আরেকবার তাকে চুম্বন করলাম। এটাও লক্ষ করলাম সে আমাকে তুমিকরে সম্বোধন করতে শুরু করেছে।