পাঁচ
মিস্টার কাতসুতোশি কাতসুরাগি,
আপনার প্রিয় কন্যা এখন আমাদের কাছে রয়েছে। যদি তাকে নিরাপদে বাসায় ফিরিয়ে নিতে চান, তাহলে আমাদের কথামতো আপনাকে কাজ করতে হবে। প্রথমত, আমাদের জন্য নগদ…শত মিলিয়ন ইয়েন জোগাড় করবেন।
এটা না বললেও চলে, কোনোভাবেই আপনি বাদে কাউকে জানাতে পারবেন না। পুলিশ বা অন্য কারো সাহায্য চাইতে পারবেন না। যদি এটা মেনে না চলতে পারেন, তবে আপনার মেয়েকে নিরাপদে ফিরে পাওয়ার কথা ভুলে যেতে পারেন।
জানিয়ে রাখছি, আপনার কন্যার ‘এখন পর্যন্ত কোনো শারীরিক ক্ষতি করা হয়নি। তবে ওর অভদ্র আচরণ যতক্ষণ সীমার মধ্যে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্তই সেটা আমরা মানতে রাজি আছি। আশা করছি, খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন। সেটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
.
চেয়ারটা ঘুরিয়ে জুরির দিকে তাকালাম। “মুক্তিপণের পরিমাণ কেমন লাগছে?”
সে কম্পিউটারের স্ক্রিনে পুরোটা পড়ার পর বিছানায় গিয়ে বসলো, “আপনি তো এখানে শত মিলিয়ন ইয়েন চেয়েছেন।”
হাসলাম। “কেন, ঠিক আছে না? কে কিডন্যাপ হয়েছে সেটা দেখতে হবে না? বিশ্ববিখ্যাত নিসেই অটোমোবাইলস-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের কন্যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এর থেকে কম চাওয়া যায় না। খুদকুঁড়ার মতো টাকা নিয়ে তো লাভ নেই, তাই না?”
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এত টাকা পাপা দেবে না। হাজার হোক, আমি তার মিস্ট্রেসের মেয়ে।”
“কিন্তু কিডন্যাপাররা তো সেটা জানে না।”
চেয়ার ঘুরিয়ে কিবোর্ডে হাত দিলাম। ফাঁকা জায়গাটাতে ৩ লিখে দিলাম। তারমানে মুক্তিপণের পরিমাণ তিনশত মিলিয়ন ইয়েন।
“তিনশ মিলিয়ন ইয়েন? কেন?” জুরির চোখ কপালে উঠে গেল।
“কোনো কারণ নেই। যদি জানার আগ্রহ খুব বেশিই হয়, তবে ধরে নাও সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্যই চেয়েছি।” বিয়ারের ক্যানটার দিকে হাত বাড়ালাম। “তাদেরকে একটা ভুল ধারণা দিতে চাচ্ছি। তারা যেন টাকার পরিমাণ দেখে ভেবে নেয়, কিডন্যাপার তিনজন। আজকালকার যুগে হয়তো পরিমাণটা খুব একটা বেশি নয়, কিন্তু আরো বেশি চাইলে হয়তো তোমার বাবাও খুব দ্রুত ঐ পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করতে পারবে না।”
“তাই আপনি তিনশ মিলিয়ন ইয়েন চেয়েছেন। ওটা দুজনের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলে প্রত্যেকে দেড়শত মিলিয়ন ইয়েন করে পাবো।”
“আমার অত লাগবে না। দশভাগের একভাগ, মানে তিরিশ মিলিয়ন ইয়েন হলেই চলবে। টাকা দরকার তোমার, আমার নয়।”
“আপনার টাকার দরকার নেই?”
“আছে। কিন্তু এই খেলাটার প্রধান উদ্দেশ্য তো টাকা নয়।”
মাউস দিয়ে একটা জায়গায় ক্লিক করলাম। স্ক্রিনে একটা থ্রিডি ছবি ভেসে উঠল। ছবিটার ওপর শিরোনাম দেওয়া ছিল—”অটোমোবাইল পার্ক।”
“ওটা আবার কী?”
“কয়েক মাসের পরিশ্রমের ফসল। একটা গর্দভ যদি আমাকে বাধা না দিতো, তবে এই স্বপ্নের জগতটা আলোর মুখ দেখত।”
আবার ক্লিক করলাম। একটা ডিজিটাল দরজা খুলে গেল। ভেতরে অটোমোবাইল গাড়ির একটা জগত চোখের সামনে ধরা দিলো। যদি ডানদিকে যাওয়া যায়, তবে অটোমোবাইলের শুরুর দিকের অবস্থাগুলো দেখা যাবে। একে একে স্টিম ইঞ্জিন ব্যবহার করা গাড়ি থেকে শুরু করে ক্লাসিক গাড়িগুলোও দেখা যাবে। এরকম রত্নগুলোর সমাহার দেখে যে-কোনো গাড়িপাগল মানুষের জিভে জল আসতে বাধ্য।
“জাদুঘরের মতো লাগছে।”
“কেবল মিউজিয়ামই নয় এটা। ঐসব জায়গায় তো দেখেছই, সবক্ষেত্রে একটা সাবধানবাণী থাকে। এটা ধরবেন না, ওটা ধরবেন না।কিন্তু এই অটোমোবাইল পার্কে কোনোধরনের ওরকম সাবধানবাণী নেই। বরঞ্চ যে কেউ চাইলেই যে-কোনো গাড়ি চালিয়েও দেখতে পারবেন। হাত দিয়ে ইঞ্জিন ম্যানুয়ালি ঘোরানো গাড়ি থেকে শুরু করে টয়োটা ২০০০ জিটি সিরিজ আর এফওয়ান সিরিজের গাড়িও চালাতে পারবে দর্শনার্থীরা। লাইসেন্স না থাকলেও চলবে।”
“কীভাবে?”
“প্রত্যেকটা ভাগে অসংখ্য সিমুলেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ভার্চুয়ালি যে-কোনো গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা নেওয়া যাবে। এমনকি গাড়ির মডেলভেদে সেই ভার্চুয়াল পরিবেশটাও পালটে যাবে। ধরো, তুমি টয়োটা ২০০০ জিটি চালাতে চাইছো। তাহলে তোমাকে ভার্চুয়ালি পুরোনো শৌয়া যুগে (১৯২৬-১৯৮৯) নিয়ে যাবে।”
“শুনে ভালোই তো লাগছে।” জুরি মুগ্ধ গলায় বলল। ইশ, যদি তার পাপাও এরকম মুগ্ধ হতেন।
“অটোমোবাইল গাড়ির ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে হতে দর্শনার্থীরা বর্তমান যুগে প্রবেশ করবে। ঐ এলাকাটা পার হলেই নতুন গাড়িগুলোর কাছে যাওয়া যাবে। তবে তার আগে একটা বিশেষ এক্সিবিট রাখা হয়েছে। সেটাই হলো এই পার্কের মূল আকর্ষণ। নিসেই অটোমোবাইল নতুন গাড়িটা এখানে রাখা হবে। এখানে যে সিমুলেটরটা বসানো হবে, সেটাতে বসলে এই মডেলে সবার আগে বসার সুযোগ হবে তোমার। তবে এখানকার সিমুলেটরটা হবে অন্যগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ব্যবহার করলে মনে হবে যেন সত্যি সত্যিই কেউ গাড়িটা চালাচ্ছে। খোদ নিসেই অটোমোবাইলস-এর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ থেকে সেটা আনা হবে। গোটা গাড়িটার সব বৈশিষ্ট্য, দক্ষতা—সবই যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হবে। এটা থেকে বের হতে হতে তোমার মাথায় কেবল একটা জিনিসই ঘুরবে, কীভাবে অত টাকা লোন নেওয়া যায়!”
টানা কথা বলছিলাম দেখে জুরির দিকে লক্ষ করিনি। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে থেমে গেলাম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার মুক্তিপণের চিঠি লেখায় ফিরে গেলাম।
“আমি কথাটা বলে রাখছি। যদি তোমার গর্দভ, বুড়ো বাপ গণ্ডগোল না করত, তবে যা যা বললাম সব কিছুই বাস্তবায়িত হতো। নিসেই অটোমোবাইলস-এর নতুন গাড়িটা ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখত। এমনকি সাইবারপ্ল্যানের স্টকও বেড়ে যেত। মোটকথা, এটা বাস্তবায়িত হলে সবাই খুশি হতো।”
“তারমানে, আপনার পরিকল্পনাটা ভেস্তে দেওয়া হয়েছে বলেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এরকম কিডন্যাপিংয়ের মতো একটা মিশন হাতে নিয়েছেন?”
“যদি তুমি এটাকে ‘প্রতিশোধ’ বলো, তবে তোমার ভুল হচ্ছে। আমি তো শুরু থেকেই একটা কথা বলে আসছি। এটা একটা খেলা। আমি তোমার অপদার্থ বাপকে একটা ম্যাচ খেলার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। এখান থেকে বের হবে কে আসল খেলোয়াড়।”
“কিন্তু পাপা তো জানে না এটা একটা খেলা। ব্যাপারটা কি অন্যায্য না?”
“কোনোমতেই না। কাতসুতোশি কাতসুরাগি কোনোমতোই ব্যাপারটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইবেন না। তিনি তার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ফন্দি আটবেন, সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। অবশ্যই আমি যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেটা তিনি জানবেন না। কিন্তু এটা জেনে রেখো, তিনি এ খেলায় অংশ নেবেনই। তখনই আসল খেলা শুরু হবে।”
আবার চিঠিটা পড়ে দেখলাম।
শেষের দিকে ‘শারীরিক ক্ষতি’র যে বাক্যটা লিখেছিলাম, সেটার পেছনে একটা কারণ ছিল। একটু আগে যখন জুরি প্রশ্ন করেছিল কতিপয় কিডন্যাপাররা তাকে ধর্ষণ করবে কিনা, সেখান থেকেই কথাটা মাথায় এসেছে।
এরকম সুন্দরী একটা মেয়েকে ঘরে বন্দি করে রাখার সময় যে-কোনো কিডন্যাপারের মনে কু-চিন্তা চলে আসবে। আমার বানানো পরিকল্পনাটাতে দুজন কিডন্যাপার। তাই তাদের একজন কিংবা দুজনেরই এরকম ধর্ষণ করার মনোভাব জাগতে পারে। হয়তো তাকে পালানো থেকে বিরত রাখবার জন্য সেটা করতে পারে।
কিন্তু কেন জানি জুরিকে নিয়ে সেরকম কোনো কল্পনা করতে পারলাম না। অবশ্যই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু চললে সেটা করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যদি সেটার সাথে ঐ দৃশ্যকল্প কোনোভাবে জুড়ে যায়, তবে তাকে মিথ্যা বলতে হবে। সবশেষে (ধরে নিলাম, আমার পরিকল্পনা ইতোমধ্যে সফল হয়ে গেছে) যখন জুরি ফিরে যাবে, তখন সে পুলিশের দ্বারা নানা প্রশ্নের শিকার হবে। প্রত্যেকটা জিনিস তার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইবে। সহজ কথায়, তারা ঐ ঘৃণ্য জিনিসটা তার সাথে ঘটেছে কিনা, সেটাও জানতে চাইবে। এরকম একটা পরিস্থিতির শিকার মেয়ে কীভাবে সেটার উত্তর দেয়? এটাই কল্পনা করা শক্ত মনে হচ্ছে। যদি সে সাফসাফ জবাব না দিয়ে তিক্ত বেদনার দৃষ্টিতে টলটলে জলভরা চোখে তাদের দিকে তাকায়, তবে হয়তো ডিটেকটিভরা তাকে ছাড় দিতে পারে। কিন্তু জুরি আদৌ সেরকম অভিনয় করতে পারবে কিনা, সেটা নিয়েও চিন্তা হচ্ছে। অবশেষে ধরে নিলাম, সে অভিনয় করেও ডিটেকটিভদের মন থেকে প্রসঙ্গটা সরাতে পারবে না। তাদের নিচু চোখে দেখা কোনোমতেই ঠিক হবে না।
সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার পরিকল্পনায় কিডন্যাপাররা কেউই তাকে ধর্ষণ করবে না। কিন্তু তাহলে চিঠিতে কেন সেটার ইঙ্গিত করলো? হুমকিটার মধ্যেও খানিকটা জোর থাকতে হবে। তারপরেও এমন একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল যে, নিজেকে বাহবা না দিয়ে পারলাম না।
কিডন্যাপার দুজনের একজন হবে মহিলা। হয়তো তারা প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে। যখন জুরিকে কিডন্যাপ করা হলো, তখন মহিলাটাই গাড়ি চালাচ্ছিল। আর সেজন্যই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জুরিকে পুরুষটা ধর্ষণ করতে পারবে না।
গোটা বাক্যটা, মানে ‘আপনার কন্যার এখন পর্যন্ত কোনো শারীরিক ক্ষতি করা হয়নি’– এটা হয়তো ধর্ষণের দিকেই ইঙ্গিত করছে। একই সাথে দুষ্কৃতকারীরা যে এসব কাজে আগ্রহী না তাও কিন্তু তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে। পরে যখন জুরির মুখ থেকে ডিটেকটিভরা বের করবে যে, কিডন্যাপারদের একজন মহিলা ছিল, তখন গোটা জিনিসটা বুঝতে পেরে নিজেদের হাঁটুতে চাটি মেরে বসবে।
“এখন আমার পরবর্তী প্রশ্ন হলো— কীভাবে চিঠিটা পাঠানো যায়।” দুহাত ভাঁজ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। “তোমার পাপার ইমেইলটা জানা আছে?”
“না জানা নেই।” জুরি মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল। “তাহলে তার মোবাইল নম্বর জানা আছে?” হাত নাড়িয়ে সে জানালো, সেটাও জানা নেই। “তুমি কিছুই জানো না, তাই না?”
“একটা কাজ করে দেখতে পারেন। শিবুইয়াতে গিয়ে আমার বয়সি মেয়েদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, তারা তাদের বাবার ইমেইল বা ফোন নম্বর জানে কিনা। যদি দশজনের একজনও হ্যাঁ বলে বলে উত্তর দেয়, তাইলে আমি আপনার পায়ে চুমু দিতে রাজি আছি।”
হয়তো কথাটা সত্য/ভাবলাম। আসলে মোবাইল নম্বর সেভ করে রাখতে রাখতে আমাদের এ অভ্যাসটা দূর হয়ে যাচ্ছে। কথাটা কিন্তু আমার ক্ষেত্রেও সত্য। আরো একটা কথা মনে পড়লো। জুরি হয়তো তার পাপাকে কালেভদ্রে ফোন দেয়।
তবে তার মানে এই না যে, কাতসুতোশি কাতসুরাগির মতো মানুষের ইমেইল বা ফোন নম্বর জানা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। কোম্পানির যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সেগুলো পেয়ে যাবো। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাকে নিজের পরিচয়টাও দিতে হবে।
“শুধু ফোন দিলেই চলবে না?” জুরি জিজ্ঞেস করলো। “কিডন্যাপিং বিষয়ক সিনেমাগুলোতে তো সবসময়ই কিডন্যাপাররা ফোন দেয়, তাই না?”
“ফোন করলে আমরা বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবো। ধরেই নিলাম যে, আমাদের তারা ট্রেস করে বের করতে পারবে না। কিন্তু ফোনের মাধ্যমে তারা কিডন্যাপারের গলার স্বর, স্পিচ প্যাটার্ন, ব্যাকগ্রাউন্ডের শব্দ—সবই পেয়ে যাবে। সেগুলো পুলিশের হাতে গেলে তারা কেসটাতে অনেকখানি এগিয়ে যাবে। যদি শুরু থেকেই এরকম বড়োসড়ো ভুল করি, তবে আমাদের নিখুঁত অপরাধ করার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে।”
“কিন্তু প্রথমবারের মতো ফোন করছি আমরা। আমার তো মনে হয় না পুলিশ এত তাড়াতাড়ি হাজির হবে। আমাদের বাসার ফোনগুলোতে ভয়েস মেইল রাখার ব্যবস্থাও নেই।”
“তুমি নিখোঁজ হবার পর প্রায় বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমাদেরকে ধরেই নিতে হবে যে, তারা ইতোমধ্যে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছেন। পুলিশ সবরকম পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখে। যদি তোমার পরিবার খুবই সাধারণ হতো, তাহলে হয়তো এত ঘাঁটাঘাঁটি করতো না। ঢিলেঢালাভাবে কাজ করত। কিন্তু যে মেয়েটা নিখোঁজ হয়েছে, সে কাতসুতোশি কাতসুরাগির মেয়ে। এজন্য তারা শুরু থেকেই এটা যে ‘কিডন্যাপিং’ তা ধরে নেবে। এমনকি দলেবলে ফোনের কাছে বসে থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না।”
“তারা যে এরকম করতে পারে, ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।” জুরি মাথা বাঁকিয়ে বলে উঠল।
“হয়তো তারা এসবের কিছুই করেনি, হয়তো তারা করেছে। আশাবাদী কোনো মানুষ নই আমি। তাই ফিফটি-ফিফটি সুযোগ থাকলে সেই বাজিটা ধরি না।” কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকালাম। ভেবেছিলাম ইমেইল পাঠালেই আমার কাজ শেষ। কিন্তু না, এখন দেখছি সেটা করা যাবে না। “আমার মনে হয় তোমাদের বাসায় ফ্যাক্স মেশিন আছে, তাই না?”
“হুম, আছে। পাপার স্টাডি রুমে। আপনি কি এটা এখন ফ্যাক্স করবেন?”
“সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ উপায় বলে মনে হচ্ছে। সেখান থেকে আমাদের ব্যাপারে খুবই কম তথ্য বের করতে পারবে। আচ্ছা, এবার কীভাবে তাদের উত্তর পাওয়া যায় তা ভাবতে হবে। কোনো আইডিয়া?”
কথার কথা হিসেবে জুরিকে প্রশ্নটা করলাম। তার কাছ থেকে সেরকম কোনো পরিকল্পনা ঠিক আশা করছি না। কিন্তু সে আমাকে অবাক করে দিয়ে গম্ভীরমুখে চিন্তা করা শুরু করলো।
“আচ্ছা, দেখে মনে হচ্ছিল আপনি শুরুতে ইমেইল ব্যবহার করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু কোন ইমেইল অ্যাড্রেস ব্যবহারের কথা ভাবছিলেন? আপনারটা তো নিশ্চয়ই নয়।
“অবশ্যই না। কোনো গাধাই নিজের নামধাম আর ইমেইল অ্যাড্রেস ব্যবহার করে মুক্তিপণ চেয়ে মেইল পাঠাবে না। চেষ্টা-চরিত্র করলে অবশ্য সেটাকে খানিকটা পরিবর্তন করে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। কিন্তু আমি নতুন একটা অ্যাড্রেস ব্যবহার করার কথা ভাবছিলাম।”
“ঐ অ্যাড্রেস দিয়ে আপনাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না?”
“ঠিক তাই। আমি দুটা অপশন ভেবে রেখেছি। একটা হলো ফ্রি ইমেইল সার্ভিস।” যেমন ‘হটমেইল’ ব্যবহার করলে আমি নিজেকে গোপন রেখেও একটা একাউন্ট পেয়ে যাবো। এমনকি পুলিশেরও সেটা থেকে আমাকে খুঁজে বের করার কোনো প্রকার সুযোগ নেই।”
“আরেকটা?”
জুরির দিকে আঙুল তাক করলাম। “আরেকটা হলো তোমার অ্যাড্রেস ব্যবহার করা।”
“আমার?”
“তুমিও তো ইমেইল ব্যবহার করো, তাই না?”
“আমার ইমেইল অ্যাড্রেসটা মনে আছে। কিন্তু পাসওয়ার্ডটা ভুলে গেছি।”
“তাহলে নতুন করে একটা ইমেইল অ্যাড্রেস বানাও। বলেছিলে তোমার কাছে একটা ক্রেডিট কার্ড আছে। সেটা থাকলেই হবে। যে-কোনো মুহূর্তে একটা ইমেইল অ্যাড্রেস ঝট করে বানাতে পারবে।”
“আচ্ছা।” জুরির মুখ খানিকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। “একটা কথা বলার ছিল।”
“কী?”
“আমার কাছে আসলে কোনো কার্ড নেই। আমি মিথ্যা বলছিলাম। সামান্য কিছু পকেটমানি আছে। ব্যস।”
“অবশ্য আমি তাই আঁচ করছিলাম। মিথ্যা বলতে গেলে কেন?”
“আসলে আপনার সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চাচ্ছিলাম না। যদি সোজাসুজি আপনাকে কথাটা জানিয়ে দিতাম, তাহলে নিজের একটা দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যেত।” তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু সে থোড়াই কেয়ার করলো। “তাহলে আমাদের হাতে কেবল একটা উপায়ই রয়েছে। আমাদের একটা ফ্রি ইমেইল সার্ভিস ব্যবহার করতে হবে।”
“ওগুলো ব্যবহার করবেন?”
“কেন। কোনো সমস্যা?”
“না, মানে…আপনি কিন্তু চাইলে মুক্তিপণ চেয়ে যে মেইলটা পাঠাবেন, তার নিচে একটা ইমেইল লিখে দিলেও পারেন। ওটাতে শুধু লিখে দেবেন, যোগাযোগ করতে যেন তারা এই ইমেইলটা ব্যবহার করে।”
“ভুল বলোনি।” নাহ, মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে।
“তাহলে সেটা করতে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা নেই, কিন্তু এতে মজা পাওয়া যাবে না। কেবল ইমেইল ব্যবহার করে আমার প্রতিপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে পুরো খেলাটাই আমার কাছে পানসে হয়ে যাবে। আর ইমেইল অ্যাড্রেস পেলেই বা কী। আমরা পরবর্তীতে আরেকটা ইমেইল পাঠাতে চাইলে আরেকটা নতুন অ্যাড্রেস ব্যবহার করব। মোদ্দা কথা, প্রতিপক্ষকে আমাদের খুঁজে বের করার কোনো সুযোগই দেবো না।”
“বেশ সতর্ক মানুষ তো আপনি।”
“অবশ্যই। এরকম কাজের ক্ষেত্রে সতর্ক হতেই হবে। তোমার কি মনে হয়, আমরা এখানে ছেলে-খেলা করছি?”
রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালু করে দিলাম। চালু হতেই টিভির চওড়া পর্দায় একটা বাস্কেটবল ম্যাচ চলতে শুরু করলো। চ্যানেল পালটে ফেললাম। খেলার সংবাদের ফাঁকে নিসেই অটোমোবাইলস-এর একটা বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করলো। সিপিটি নামের একটা স্পোর্টসকারের বিজ্ঞাপন ছিল ওটা। একজন জনপ্রিয় সেলিব্রিটি নারী খুব স্বাভাবিকভাবে বিস্তীর্ণ একটা ঘাসের প্রান্তরে সেটা চালিয়ে দেখালেন। খুব ভালো করে বিজ্ঞাপনটা বানানো হয়নি। বোধহয় কাতসুতোশি কাতসুরাগিকে না দেখিয়েই বিজ্ঞাপনটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কম্পিউটারের দিকে ঘুরলাম। নেটের সাথে যুক্ত হয়ে সার্চ ইঞ্জিনে লিখলাম ‘সিপিটি।’ ইতোমধ্যে যে নিসেই-এর ভক্তরা সেটার জন্য একটা ওয়েবসাইট বানিয়ে ফেলেছে— সেটা দেখে একটুও আশ্চর্য হলাম না। সেটাতে ঢুকে সূচিপত্রটা ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। সাইটের নাম ছিল ‘সিপিটির মালিকদের ক্লাব’। স্ক্রিনে লাল রঙের সিপিটির একটা ছবি ভেসে উঠল। ছবিটা খুব ভালো করে তোলা হয়নি, দেখে বোঝাই যাচ্ছে এটা কোনো অদক্ষ ফটোগ্রাফারের কাজ। ছবিটা যে এই পেজের নির্মাতারই তোলা— তা সত্য হবার সম্ভাবনা অনেকখানি। “এমন একটা ওয়েবসাইট এটি, যেখানে সিপিটি গাড়ির ভক্তরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবে। নিজের ইচ্ছামতো ওয়েবসাইটটাতে ঘোরাফেরা করুন!”
সাইটটাতে বেশ কয়েকটা ওয়েবপেজ সংযুক্ত আছে— ‘সর্বশেষ খবর’, ‘মেইনটেনেন্স’, ‘সিপিটির ছবিসমূহ’ আর একটা ‘বুলেটিন বোর্ড’। কী চমৎকার একটা যুগে বসবাস করছি। ঘরে বসেই সব তথ্য পেয়ে যাচ্ছি। বুলেটিন বোর্ডে ক্লিক করলাম। সাথে সাথে নিচের তথ্যগুলো কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠলো—
তর সইছে না আর (ইউজারনেম : হামিংবার্ড)
সবাইকে অভিবাদন জানাই। এর আগেও বলেছি, অবশেষে আমার বাসায় সিপিটি আসতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, আমি হাইওয়েতে দূরন্ত ঘোড়ার মতো সিপিটি চালাচ্ছি। কদিন ধরেই চোখে ঘুমই আসছে না। প্রথম রাইড শেষে আমি এখানে দ্রুত আমার প্রতিক্রিয়া জানাবো। আশা করি, কোনোপ্রকার দুর্ঘটনার শিকার হবো না! (lol)
উদ্ভট আওয়াজ (ইউজারনেম : স্পার্কল প্রিন্সেস)
দুবছর ধরে সিপিটি চালাচ্ছি। কদিন ধরে থার্মোমিটারের উচ্চমাত্রা দেখে চিন্তা হচ্ছে। ওভারহিটিং হচ্ছে নাতো? আর কারো কি একই সমস্যা হয়েছে?
রিপ্লাই : উদ্ভট আওয়াজ (ইউজারনেম : স্ট্রিট রেসার সামুরাই)
@স্পার্কল প্রিন্সেস, আমারও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। যা বুঝতে পারলাম, সিপিটির বাইরের গঠনের কারণে রেডিয়েটরে প্রচুর চাপ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমারটা কখনও ওভারহিট হয়নি। যদি বেশি চিন্তা হয়, তবে সেটা পরীক্ষা করিয়ে আনতে পারেন (জানি বাজে একটা উপদেশ দিলাম!)
এই মানুষগুলো ইন্টারনেট নামের এই অসাধারণ খেলনাটা ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে মিষ্টি মিষ্টি করেই কথা চালাচ্ছে। কিন্তু এদের মতো অনেকেই আছে যারা বাস্তবে একই প্রোডাক্টের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছে। এদেরকে না ঘাটানোই ভালো।
ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস সেভ করে রেখে নেট সংযোগ বন্ধ করে দিলাম।
ডেস্কটপ খুঁজে আবার সেই মুক্তিপণের জন্য লেখা খসড়াটা বের করলাম। কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আবার তাতে লেখা শুরু করলাম :
যদি টাকা পাঠাতে রাজি হয়ে থাকেন, তবে নিজের লিংকটা ব্যবহার করে বুলেটিন বোর্ডে জুরির নাম ইউজারনেম হিসেবে ব্যবহার করে আপনার মতামত জানাতে পারবেন। আমাদের স্বীকৃতি পেলে আপনি বার্তাকারে একটা জবাব পেয়ে যাবেন।
সাইটের নাম- CPT Owners Club
লিংক- http://www…
.
“এবার কেমন হলো?” ঘাড় ঘুরিয়ে জুরিকে জিজ্ঞেস করলাম।
পুরোটা বেশ কয়েকবার পড়ার পর সে মাথা ঝাঁকালো। “ভালো হয়েছে। এখানে লেখা দেখলে কেউ সন্দেহ করবে না। আর তাদের সাথে যোগাযোগ করাটাও সহজ হবে।”
“আগেকার দিনের কিডন্যাপাররা পত্রিকার সাহায্য নিত। কোনো জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় ছাপাতো—’সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরে আসো।’ কিন্তু উত্তর পাওয়ার জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। ইন্টারনেট বুলেটিন ব্যবহারের সুবিধা হলো, সাথে সাথে সেখান থেকে তাদের মনের অবস্থা, সিদ্ধান্ত টের পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে বড়ো সুবিধা—জিনিসটা খুবই সস্তা, প্রায় বিনে পয়সাতেই করা যায়। যুগের ভালো পরিবর্তনই হয়েছে।”
প্রিন্টার চালু করে খসড়াটা প্রিন্ট করতে দিলাম।
“একটু দাঁড়ান।” জুরি আমার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল।
“কী হয়েছে?”
“এই চিঠিটার ব্যাপারে আমার একটা অনুরোধ রয়েছে।”
“সেটার ব্যাপারে অভিযোগ আছে নাকি, খুকি?”
“আপনি যে ‘আপনার প্রিয় কন্যা’ লিখেছেন, সেটা মুছে দিয়ে আমার নাম, মানে জুরি লিখে দেন।”
জিনিসটা আবার পড়ে দেখলাম। তারপর মাথা নেড়ে বললাম, “না, সেটা করা যাবে না। যদি ‘জুরি’ লিখে দেই, তবে কেমন জানি কাঠখোট্টা দেখাবে। কেন, ‘প্ৰিয় কন্যা’তে আপত্তি কোথায়?”
“আমি তাদের ‘প্রিয় কন্যা’ নই।” সে মাথা নিচু করে জবাব দিলো।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। “তাহলে ‘আপনার কন্যা’ লিখে দিই?”
সে মানলো না। “আমি জুরি। জুরি কাতসুরাগি। আমি তাদের কন্যা নই।”
“এত ঝামেলা…” মেয়েটার কথাবার্তা শুনে আমার মাথা ধরতে শুরু করেছিল। “আচ্ছা। তাহলে জুরি কাতসুরাগিই লিখে দিলাম। সম্মান দেখিয়ে ‘মিস’ও লিখবো না। মেনে নিতে পারবে? এটুকুই কেবল পরিবর্তন করতে পারব আমি
জুরি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো। “রাজি।”“
ঘাড় বাঁকিয়ে কিবোর্ডে আবার হাত দিলাম। ঝটপট বাক্যটা ঠিক করে নিলাম। ওর বয়সি মেয়েদের মনে যে কী খেলা করে, তা বুঝতে পারলে বড্ড ভালো হতো।
আবার চিঠিটা পড়লাম। কোনো বানান-টানান ভুল আছে কিনা দেখে নিয়ে প্রিন্ট করে নিলাম। কালির পরিমাণ পরীক্ষা করে সেটা জুরির হাতে তুলে দিলাম।
“ফ্যাক্সে আপনি এটাই পাঠাবেন? আপনার কম্পিউটারের ফ্যাক্স মডেম ব্যবহার করলে হতো না?’”
“এটা সতর্কতার জন্য করছি। ডকুমেন্ট আকারে পাঠালে তারা আমার কম্পিউটারের মডেলটা বের করে ফেলতে পারবে। আর তাছাড়া, এইটুকু কাগজ ফ্যাক্স করতে খুবই অল্প সময় লাগবে। আর কোনো ধরনের ঝামেলা হলে সাথে সাথে সংযোগ কেটে দেওয়া যাবে।”
একটা কাঁচি দিয়ে মার্জিনের ওপরের অংশটুকু সাবধানে কেটে দিলাম। তাহলে ট্রান্সমিশনে অল্প সময় লাগবে। এবার কাঁচি দিয়ে এলেমেলোভাবে গোটা কাগজটাকে আটভাগে কেটে নিলাম।
“এবার আবার কী করছেন?”
“দেখতে থাকো। জবাব পেয়ে যাবে।”
সেলোফোন টেপটা বের করলাম। সবগুলো কাগজের টুকরাকে উল্টেপালটে সাজিয়ে সেটাতে টেপ মেরে দিলাম। তারপর সেটা কম্পিউটারের পাশের ফ্যাক্সে প্রবেশ করিয়ে দিলাম।
“এখান থেকে ওটা পাঠাবেন?” জুরি অবাক স্বরে বলে উঠল। “পুলিশ ট্রেস করে ফেলবে না?
“যাতে না করতে পারে, সেজন্যই এরকম কাটাকুটি করে জোড়া লাগালাম। যদি পুলিশ কাতসুরাগিদের আবাসস্থলে ঘাপটি মেরে বসেও থাকে, তারা প্রথমদৃষ্টিতে কাগজটার লেখা বুঝতে পারবে না। কেটে ঠিকমতো জোড়া লাগানোর পরই তারা টের পাবে, এটা কিডন্যাপাররা পাঠিয়েছে। ততক্ষণে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে।” জুরির দিকে তাকালাম। “আমার ফোনের কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী ফোন নম্বরের শুরুতে যতক্ষণ না পর্যন্ত ১৮৬ লিখব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নম্বর অপরপক্ষ দেখতে পাবে না। এখন, তুমি নম্বরটা ডায়াল করবে। তোমাকেই এই ফ্যাক্সটা পাঠাতে হবে।”
“আমাকে পাঠাতে হবে কেন?”
“কারণ, আমি চাই তুমি যেন সজ্ঞানে আমার সাথে এই অপরাধে জড়িত থাকো। তুমি আমাকে বলেছ যে, আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে রাজি আছো। কিন্তু অপরাধটা নিজের হাতে করার পরে তোমার মনোভাব পালটেও যেতে পারে। হয়তো আমি চিঠিটা ফ্যাক্স করার পর তুমি বেঁকেও বসতে পারো।
ঐ যে ফ্যাক্সটা, দেখিয়ে দিলাম।
জুরি তার নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। সে এখন আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘাবড়ালাম না। আমিও চেয়ারে বসে তার দিকে পাল্টা তাকিয়ে রইলাম। হ্যাঁ, আমার এ কাজটায় ঝুঁকি আছে ঠিকই। কিন্তু নিশ্চয়তার জন্য এরকম ঝুঁকি নিতে রাজি আছি।
জুরি অবশেষে জোরেশোরে একটা শ্বাস ফেলল। “বেশ। কিন্তু তার আগে আমার একটা কাজ করতে হবে।”
“গোসল করে মাথা ঠান্ডা করতে হবে?”
“আমি আমার বাড়ি যেতে চাই।”
“বাহ।” আশাভঙ্গের স্বরে বললাম। “এতদূর আসার পর বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে? তাহলে কী আর করার।” ফ্যাক্সের যেখানে কাগজটা সেট করে রেখেছিলাম, সেখান থেকে কাগজটা তুলে নিলাম। ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবো।
“থামুন। আমি কথাটা ওভাবে বোঝাইনি। আমি বাড়ি ‘ফিরে’ যেতে চাই না। বরং বাইরে থেকে বাড়ির অবস্থাটা দেখে আসতে চাই।”
“একই কথা। তুমি এখন আফসোস করতে শুরু করেছো। এরকম করতে থাকলে খেলাটায় জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“আমি তো বললামই যে, ওরকম কিছু করতে চাচ্ছি না। আপনি কিছুই বোঝেননি।” অধৈর্য হয়ে জুরি হাত দুটো ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি এই খেলা থেকে পালাতে চাই না। আমি নিজেও ঐ পরিবারের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই। শুধু একটা ব্যাপার নিশ্চিত করতে চাচ্ছি যে, পাপা আদৌ বাসায় আছে কিনা। কারণ, উনি বাসায় না থাকলে ফ্যাক্স পাঠিয়ে কোনো লাভ হবে না। একটু আগে বললাম না যে, ফ্যাক্স মেশিনটা তার স্টাডিরুমে রাখা? তার অনুমতি ছাড়া কেউ ওটা ছুঁয়েও দেখার সাহস পায় না।”
“হুহ।” আবার কাগজটা ফ্যাক্স মেশিনে সেট করে দিলাম। “তার মানে এই না যে, তোমার বাবা কখনোই বাসায় আসে না। একসময় না একসময় ফ্যাক্সটা তার চোখে পড়বেই।”
“কিন্তু কখন? সেটা না জানা পর্যন্ত আমি স্থির হতে পারবো না। চোখে আমার বিন্দুমাত্র ঘুমও আসবে না।”
তর্জনীটা কানে ঢুকিয়ে চুলকাতে শুরু করলাম। তার এই অনুভূতিটা আমার কাছে খুব একটা অচেনা নয়। “কিন্তু বাইরে থেকে দেখলেও তো তুমি সেটা বুঝতে পারবে না।”
“গ্যারাজটা দেখতে পারলেই বুঝতে পারবো। পাপা বাসায় থাকলে গাড়িটাও সেখানেই থাকবে।”
“বুঝলাম।” তার কথার সাথে একমত হলাম। “ফ্যাক্সের সাথে কি ফোনের সংযোগ রয়েছে? নাকি…”
“আলাদা সংযোগ। আমাদের ফোন নম্বর থেকে একটু আলাদা।”
“ফ্যাক্স এলে কি সেটা বেজে ওঠে?”
জুরি মাথা ঝাঁকালো। “না। বাজার কথা নয়।”
“তাহলে মিস্টার কাতসুরাগি নিজের বাসাতে থাকলেও আগামীকাল সকালের আগে সেটা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ সময়ে তার ঘুমানোর কথা।”
“সেটাও পরীক্ষা করে দেখতে চাই। বাড়ি থেকে আমি পালিয়ে আসার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। আমি শুধু একটা জিনিস দেখতে চাই। আমি নিখোঁজ হবার কারণে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন হয়েছে, নাকি সবকিছু আগের মতোই চলছে?”
“যদি বাড়ির প্রত্যেকটা বাতি জ্বালানো থাকে, তারমানে সবাই তোমার জন্য চিন্তিত— এই তো? তারপর অবস্থা বুঝে কেটে পড়বে?” বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলাম।
“না, কখনোই না। তাই দেখতে চাচ্ছি। তাছাড়া দেখে এলে আমাদের পরিকল্পনার জন্য ভালো হবে। চিঠিটা ফ্যাক্স করার আগে বাড়ির অবস্থাটা দেখে এলে মন্দ হবে না।”
“যেমন?”
“ধরুন, আশেপাশে পুলিশ টহল দিচ্ছে কিনা তা জানা যাবে।”
হেসে ফেললাম। “তোমার ধারণা বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি পার্ক করা থাকবে?”
“যদি ডিটেকটিভরা ইতোমধ্যে বাড়িতে প্রবেশ করেই থাকে, তবে বাড়ির সবগুলো ঘরেই আলো জ্বলবে—এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”
“সেটা…” না, কথাটা সে ভুল বলেনি। “কিন্তু ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। আশেপাশে সন্দেহজনক গাড়ি পার্ক করতে দেখলে পুলিশ অবশ্যই কিছু একটা টের পেয়ে যাবে। আর ভুলে যেও না, তোমার বাড়ির আশেপাশের রাস্তায় অনেকগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা লাগানো আছে। যদি কোনো একটারও নজরে পড়ে যাই, তবে আমাদের গোটা পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে।”
“আমরা বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চলে যেতে পারি। তাহলে সন্দেহজনক মনে হবে না।”
বিরক্ত হয়ে দুহাত ভাঁজ করে তার দিকে তাকালাম। “আমি যদি না করে দিই?”
“তাহলে…” সে ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিলো, “তাহলে আর কী করার। আপনার মতোই সবকিছু চলবে। তবে তখন আমাকে দিয়ে জোর করেও ফ্যাক্সটা পাঠাতে পারবেন না।”
“ধরতে পেরেছি।”
উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম। পর্দাটা সরিয়ে রাতের শহরটার দিকে তাকালাম।
সে চাপ দিচ্ছে, নাকি আস্তে আস্তে সব মেনে নিচ্ছে? জুরি যদি সত্যি সত্যিই বাড়ি ফিরে যাবার কথা ভেবে থাকে, তবে আমার তৎক্ষণাৎ মিশনটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু জানালার কাচে তার প্রতিফলিত মুখটা দেখে বুঝলাম, সে বিন্দুমাত্র ভয় পায়নি। মেয়েটার মুখে শুরু থেকেই ‘থোড়াই কেয়ার করি’ ভঙ্গিটা ছিল। আর সে কারণেই এত দ্রুত সব সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম।
ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম। “আমাদের ছদ্মবেশ নিতে হবে।”
“ছদ্মবেশ?”
“গাড়িতে তোমাকে দেখার পরও যাতে কেউ চিনতে না পারে, সেটারই ব্যবস্থা করতে হবে।’
আমার কথাটা বুঝতে পেরে সে হেসে সম্মতির সুরে মাথা নাড়লো। চল্লিশ মিনিট পর জুরি আর আমি ট্যাক্সিতে উঠলাম। নিজের গাড়িটা আনলে ক্যামেরায় ধরা পড়ে যেতাম। তাই এই ব্যবস্থা।
ট্যাক্সিতে বসে আমরা স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে গেলাম। কথাবার্তার বিষয়বস্তু ছিল ফুটবল, টিভি শো, ইত্যাদি। আমাদের দেখে ঘুণাক্ষরেও কেউ সন্দেহ করবে না। ভাববে, সাধারণ কোনো প্রেমিক জুটি। ড্রাইভারও আমাদের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল না। জুরি একটা জিন্সের জ্যাকেটের ওপর সোয়েটার চাপিয়েছিল। দুটাই বেশ ঢোলা। কিন্তু আজকালকার তরুণ-তরুণীরা এর থেকে অদ্ভুতভাবে পোশাক-আশাক পরে ঘোরাফেরা করে। আমি নিজে একটা লেদারের জ্যাকেট পরে ছিলাম। আমাদের দেখে ড্রাইভার হয়তো ধরে নিয়েছে, আমরা বোকাসোকা এক জুটি, যারা কিনা রাতের গভীরে মৌজ করতে বেরিয়েছে।
ট্যাক্সিটা দেনেনচোফু এলাকায় ঢুকে পড়লো। জুরি আমার হয়ে ড্রাইভারকে গন্তব্যের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়েছিল। কাতসুরাগিদের ম্যানশনের কাছাকাছি আসতেই আমার হাতের তালু ঘামতে শুরু করলো।
অবশেষে ম্যানশনটা আমাদের হাতের ডানদিকে দেখতে পেলাম। কিন্তু ড্রাইভারকে তো আর গাড়ি আস্তে চালানোর কথা বলা যায় না। তাহলে সন্দেহ করতে পারে।
“এভাবেই সোজা চালাতে থাকুন প্লিজ।” জুরি ড্রাইভারকে নির্দেশনা দিল। সে সোয়েটারের হুডিটা মাথার ওপর দিয়ে নিল। জিন্সের জ্যাকেটটাও শক্ত করে ধরে চেষ্টা করলো সেটাতে মুখ ঢাকার
গতি না কমিয়েই ট্যাক্সিটা কাতসুরাগিদের ম্যানশনের সামনে দিয়ে চলে গেল। ঐ অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের চোখগুলো বাড়ির অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতে থাকলো।
বাড়ি পার হবার পর আমি আর জুরি চোখাচোখি করলাম। সে আলতোভাবে মাথা নাড়ল, আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম। গোটা ম্যানশনের সব আলো নেভানো।
সামনেই একজায়গায় ট্যাক্সি থামিয়ে দুজন নেমে পড়লাম। কিছুদূর হেঁটে আরেকটা ট্যাক্সি থামিয়ে সেটাতে করে পথ ধরলাম বাড়ির। ফেরার পথে দুজনেই চুপ ছিলাম।
বাসায় ঢোকার পর ফ্যাক্স মেশিনের সামনে গিয়ে দুজন মুখোমুখি বসলাম।
“যাই হোক, তোমার বাসার সব বাতি নেভানো ছিল।” অবশেষে নীরবতা ভাঙলাম। “গ্যারেজটা দেখেছিলে?”
“দেখতে ভুল না হলে আমি নিশ্চিত, পাপা বাসাতেই আছে।”
“তারমানে কাতসুতোশি কাতসুরাগি নিজের বাসাতেই অবস্থান করছেন। বাতি নেভানো, মানে ঘুমোচ্ছেন তিনি। আর কোনোধরনের পুলিশও নজরে পড়েনি আমাদের।” ফ্যাক্স মেশিনটার দিকে তাকালাম। “যদি মুক্তিপণের চিঠিটা পাঠাতেই হয়, তবে আমার মনে হয় এখনই পাঠালে সবচেয়ে ভালো হবে।”
“সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হয় না?”
“নতুন একটা দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যাও দেখা দেয়। তোমার নতুন করে কোনো চিন্তাও হতে পারে। তাই এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। এই সুযোগটা না নিলে খেলাটা শুরুর আগেই বন্ধ করে দিতে হবে।”
জুরি চিঠিটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। আমি দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকালাম। আর দশ মিনিট সময় দেবো ওকে। এর থেকে বেশি সময় দিলে সেটা কেবল নষ্ট হবে।
পাঁচমিনিট পর সে মুখ খুললো। “ঠিক আছে। আমি ওটা পাঠাচ্ছি।”
“মনে রেখো, আর কিন্তু ফিরে যেতে পারবে না।”
“আপনিও যেন পরে অনুশোচনা না করেন।”
“আরেকটা টোস্ট হয়ে যাক, কি বলো? ড্রিংক হাতে নতুন করে কাজের সূচনা করব আমরা।”
জুরি সমর্থন জানিয়ে ফ্যাক্স মেশিনের সামনে দাঁড়ালো। চিঠির কাগজটা ঠিকঠাক মতো সেট করা আছে কিনা আর মডেমের সংযোগ আছে কিনা দেখার পর সে নম্বরের বাটনগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল।