অ্যা কিডন্যাপিং – ২১

একুশ

জুরি, বিড়বিড় করলাম।

“তোমাকে তো এখন চিহারু বলে ডাকতে হবে, তাই না? অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।”

“টিভিটা বন্ধ করে দাও।” সে আমার সামনের আর্মচেয়ারটায় গিয়ে বসলো।

আমি রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিলাম। নিঃস্তব্ধতার মধ্যে দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। কেন জানি এই নীরবতাটা আমার কাছে অত্যাচার বলে ঠেকতে লাগল। জুরি, না, চিহারুর মুখটা শক্ত হয়ে আছে। সে আমার দিকে সোজাসুজি তাকাচ্ছিল না।

“তুমি পাপাকে ইমেইল করেছ, তাই না?”

“আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু তুমি আসবে তা ভাবতেও পারিনি।” জবাব দিলাম। তারপর একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানার জন্য তাকে প্রশ্ন করলাম, “ভেতরে ঢুকলে কীভাবে?”

সে তার ছোট্ট ব্যাগটা থেকে একটা চাবি বের করে আনলো। দেখতে আমার চাবিটার মতোই লাগছে।

“চাবিটা তো ডুপ্লিকেট করা যায় না বলেছিল,” বললাম।

“এটা ডুপ্লিকেট না। তুমি আমাকে ধার দিয়েছিলে।”

হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার খুললো। যে কোণে চাবিটা রাখি, সেখানে উঁকি দিয়ে দেখলাম। “কিন্তু চাবিটা তো এখানেই রয়েছে।”

চিহারু মুচকি হাসলো। “ওটা নকল।”

“নকল?”

আমি ড্রয়ারে রাখা চাবিটা বের করে আসল চাবিটার সাথে মিলিয়ে দেখলাম। দুটো .একই লাগছিল, কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ করতেই ভিন্নতাগুলো বেরিয়ে পড়লো।

“তারমানে তুমি আসল চাবিটা সরিয়ে ফেলেছিলে।”

“এরকম চাবি সবজায়গায় খুঁজে পাওয়া যায়।”

“তুমি কীভাবে পেয়েছিলে?”

“আমি ঘরে বসেই পেয়ে গিয়েছিলাম। পাপা কাছাকাছি এসে দিয়ে গিয়েছিল।”

“পাপা? হু, বুঝতে পেরেছি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গোটা শরীরটা অবশ অবশ লাগছে। “তার মানে সবকিছু তোমারই সাজানো ছিল।”

“সবকিছু না। কিডন্যাপিং গেমটা তো তোমারই পরিকল্পনা ছিল, তাই না?”

“আর সেটাতে তোমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।”

“আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। বিশাল একটা ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য আমার হাতে কেবল এই একটাই পথ বাকি ছিল।”

“বিশাল ঝামেলা।” জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। মনে মনে অবশ্য ততটা উৎফুল্ল ছিলাম না। “সেটা কী, তা আন্দাজ করতে পারি?”

সে আমার দিকে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালো। কাজটা করার সময়েও বোধহয় তার চোখদুটো এরকমই ছিল।

তার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, “তুমিই জুরিকে খুন করেছ, তাই না?”

চিহারু চমকে গেল না। সে বোধহয় আমার উত্তর কী হতে পারে তা আগেই আঁচ করতে পেরেছে। ইমেইলটা পাঠানোর পর বাপ আর মেয়ে দুজনেই নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছে যে, আমি সত্যটা জেনে ফেলেছি।

“সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি,” সে এমন স্বাভাবিকভাবে উত্তরটা দিলো যেন সে একটা ছোট্ট ভুল করে সেটা স্বীকার করছে।

“সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার সেটা করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আবেগের বশে করো কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে করো, সে মারা গিয়েছিল। তা না হলে…” আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিলাম। “তা না হলে তুমি সে রাতে বাড়ি থেকে পালাতে না।”

“ঠিক।” চিহারু দুইহাত তুলে দুদিকে প্রসারিত করলো। “আহ, এখন খুব শান্তি লাগছে। তোমার কাছে জুরি সেজে থাকার গোটা সময়টা আমার সবকিছু খুলে বলার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিল। তোমার মুখের চমকিত ভাবটা দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিল।”

“তার মানে ঐ অংশটা সত্য ছিল।”

“কোন অংশটা?”

“তুমি বলেছিলে চিহারুর সাথে কসমেটিক্স নিয়ে ঝগড়া করে তুমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে। তুমি ঠিকই ঝগড়া করেছিলে। খালি ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। চিহারু, যে কিনা সবসময় জুরিকে ঘেন্না করতো, সে জুরিকে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল—কি, ঠিক বলেছি না?”

তার মুখটা গোমড়া হয়ে গেল। সে আমার থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিল। লক্ষ করলাম, তার নাকটা দেখতে পুরোটাই কাতসুতশি কাতসুরাগির মতো। ছবিতে জুরির নাকটা তাদের থেকে একটু কম চ্যাপ্টা আর সুগঠিত ছিল।

“তাকে কী দিয়ে আঘাত করেছিলে?”

“কাঁচি।”

“কাঁচি?”

সে মুখের ওপর থেকে চুলটা সরিয়ে নিল। “আমি চুল ভালো কাটতে পারি। মাঝেমধ্যে আমার বান্ধবীদের চুলও কেটে দিই। তাই আমার চেনাজানা একজন বিউটিশিয়ানের কাছ থেকে কাঁচিটা নিয়েছিলাম।”

“আচ্ছা। আর সেই কাঁচি বাথরুমে রাখা ছিল। যখন সে তোমাকে জিজ্ঞেস না করেই ক্রিমটা ব্যবহার করেছিল, তোমার সাথে তার ঝগড়া আরম্ভ হয়েছিল। শেষমেষ তুমি তাকে কাঁচিটা দিয়ে তাকে আঘাত করে হত্যা করেছিলে।”

“ঐ ক্রিমটা,” জুরি অন্যদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জবাব দিলো, “আমি ফ্রান্স থেকে এনেছিলাম। জাপানে ওটা কিনতে পাওয়া যায় না। আমি নিজে ও সেটা ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকতাম। আর সেই কুত্তিটা আমাকে না বলে…” সে আমার দিকে এবার সোজাসুজি তাকালো। “সেই প্রথম আঘাত করেছিল। সে আমার গালে একটা চড় দিয়েছিল।”

“কিন্তু তার বিনিময়ে তুমি যা করেছ সেটাকে আত্মরক্ষা বলা যায় না। তো, তুমি তাকে খুন করলে, তারপর ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে।”

সে আমার দিকে রাগী চোখে তাকালো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। “পিপাসা লেগেছে। কিছু নিয়ে আসবো?”

যাও, বলার আগেই সে রান্নাঘরে চলে গেল। বের হয়ে আসতেই তার হাতে একটা হোয়াইট ওয়াইনের বোতল দেখতে পেলাম। মাসক্যাডেই সার লি-এর ওয়াইন। খাবারের পূর্বে যে হালকা স্ন্যাকস দেওয়া হয়, তার সাথে এটা বেশ ভালো মানিয়ে যায়।

“আমি খেতে পারবো?”

“তোমার ইচ্ছা।’

“তুমিও নেবে তো?”

উত্তর দেবার আগেই সে আমার সামনের টেবিলে দুটো গ্লাস রেখে দিলো। কর্কস্কু আর বোতলটা সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“তুমি সে রাতে পালিয়ে কোথায় যেতে চেয়েছিলে? ঐ মুহূর্তে তুমি হোটেলে একটা রুম খুঁজছিলে। একরাত থাকার পর তোমার পরিকল্পনাটা কী ছিল?”

“বকবক না করে ওয়াইনের কর্কটা খোলো প্লিজ।”

কর্কটা খুলে দুটো গ্লাসেই ওয়াইন ভর্তি করে দিলাম। গ্লাস ঠোকাঠুকি করে আমরা মাসক্যাডেইতে চুমুক দিলাম একটা মনোরম অম্লতা ছিল তাতে, আর কচি আঙুরের একটা অপূর্ব গন্ধ আমাদের মুগ্ধ করে দিচ্ছিল।

“আমি আসলে তখন কিছুই ঠিক করিনি,” সে অবশেষে উত্তর দিলো।

“কী?”

“আমি বললাম যে, এরপর কী করব তা তখনো আমি ঠিক করিনি। কিন্তু যাই করি না কেন, ঐ বাসায় আর থাকতে চাচ্ছিলাম না। জানা ছিল, একটু পরেই পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ ধারণ করবে। আর কিছুক্ষণ পরে ওরা টের পাবে যে, আমিই কাজটা করেছি। হাজারটা মানুষ এসে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে; যেটা হবে খুবই বিরক্তিকর একটা বিষয়। তাই আশা করছিলাম যাতে পাপা কিংবা মা সব সমস্যা দূর করে দেয়। আমি ভেবেছিলাম সব সমস্যা দূর হবার পরেই বাড়ি ফিরে যাবো।”

“তার মানে তুমি ভেবেছিলে যে, ওরা মৃতদেহটা গোপনে গুম করে ফেলবে, যাতে করে তোমাকে খুনের দায়ে গ্রেফতার না করা হয়।” গ্লাসের বাকি ওয়াইনটা খালি করে আরেকবার ঢেলে নিলাম। “কী স্বার্থপরের মতো চিন্তাভাবনা।”

“আমি জানি ব্যাপারটা স্বার্থপরের মতো হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি পাপার মতো মানুষের পক্ষেও একটা খুন ধামাচাপা দেওয়া কষ্ট হবে—সেটাও আমার জানা ছিল। একটু আগে তোমাকে বললাম না, আমি তখন ‘বিশাল ঝামেলায় পড়েছিলাম?”

“আর তখনই আমি তোমার সামনে উদয় হলাম।”

“তোমার সাহায্য কিন্তু আমি চাইনি। তুমি নিজে থেকে আমার কাছে এসেছিলে।”

এর উত্তর দিতে পারলাম না। হ্যাঁ, আমি তার কাছে গিয়েছিলাম; কিন্তু সেটা কেবল কাতসুতোশি কাতসুরাগি সম্পর্কে নোংরা কিছু জানার জন্য। “কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কেন আমাকে অনুসরণ করতে রাজি হলে? ব্যাটাকে কাজে লাগানো যাক এটাই কি ভাবছিলে তখন?”

হাতে ওয়াইনের গ্লাসটা রেখেই সে মাথা নাড়লো। “সত্যি বলতে কী, তখন আসলে আমি কোনো কিছুর পরোয়া করছিলাম না। কাজটা করার পর থেকেই আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল। আর রাতে থাকার জন্য কোনো একটা জায়গার দরকার ছিল আমার; তবে সেটার জন্য আমি কোনোমতেই বাড়ি ফিরে যেতে রাজি ছিলাম না। সহজ কথায়, আমার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না।”

“আচ্ছা, যুক্তিটা মেনে নিলাম।” আবার ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিলাম। “তুমি জুরির নাম নিলে কেন?”

“কারণটা ছিল খুবই সোজা। আমি আমার আসল নাম একজন অচেনা মানুষের কাছে দিতে রাজি ছিলাম না। কারণ, আমি চাচ্ছিলাম না কেউ জানুক যে, চিহারু কাতসুরাগি এত রাতের বেলায় হোটেলে হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওটা ছিল হুট করে নেওয়া একটা সিদ্ধান্ত।”

মাথা দোলাতে দোলাতে বললাম, “হুট করে হলেও ওখান থেকে তুমি কিন্তু নিজেকে একেবারে নিখুঁতভাবেই জুরি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলে। তুমি কি জানো, তুমি একজন পাকা অভিনেত্রী?”

“মজা করে বলছো কিনা জানি না, তবে ধন্যবাদ।”

“এখন বলো।” গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলাম। “এসব কখন পরিকল্পনা করলে? স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিচ্ছি আমার গেম খেলার প্রস্তাবের পরপরই পরিকল্পনাটা করেছো। কিন্তু তার মানে তো এই না যে, ঠিক তখনোই তুমি হুট করে এই পরিকল্পনাটাও বানিয়ে ফেলেছ।”

“না, সেটা হুট করে বানানো হয়নি।” সে ওয়াইনের বোতলটা হাতে নিয়ে গ্লাসে ঢালার চেষ্টা করলো।

“শোনো, গ্লাসে ওয়াইন ঢালা একজন পুরুষের কাজ।” আমি তার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে তার গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে দিলাম।

“তোমার প্রস্তাব করা গেমটা ছিল সবকিছুর শুরু। ‘সে মনে করছে আমি জুরি। সে তাকে কিডন্যাপ করার ভান করতে চায়।’ আমার মনে হচ্ছিল, এই ব্যাপারটাকে কোনোভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাই ভাবলাম, আপাতত তোমার কথামতো আগানো যাক।”

“আমার গোটা পরিকল্পনাটা শোনার পর সেই উপলব্ধিটা আরো দৃঢ় হলো, তাই না?”

“আমার উপলব্ধিটা দৃঢ় হলো,” চিহারু মুচকি হাসলো, “যখন আমার পাপা আমাকে বাহবা দিলেন।

“বাহবা?”

“তোমার মুখে গোটা পরিকল্পনাটা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, পাপাকে ফোন করে সবকিছু খুলে বলব। আর হ্যাঁ, জুরির কথাও ভুলিনি।”

“তার মানে খেলার শুরু থেকেই তুমি উনার সাথে জড়িত ছিলে। হুম, কেনই বা থাকবে না। মিস্টার কাতসুরাগি বোধহয় তখন ভড়কে গিয়েছিলেন। তার এক মেয়েকে খুন করা হয়েছে, আর খুনি ছিল তার আরেক কন্যা। এরকম অবস্থায় তো আর পুলিশের কাছে যাওয়া যায় না।”

“পাপা কিন্তু তখনো সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার উপায় খুঁজছিলেন। ঠিক তখন আমি তাকে ফোন করেছিলাম। আমি আত্মহত্যা করে ফেললাম কিনা, পাপা তখন সে দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। তাই ফোনে আমার গলা শোনার পর তিনি অনেকখানি আশ্বস্ত হলেন। জুরিকে হত্যা করার জন্য তিনি আমাকে বকলেন না। তিনি আমাকে তার ওপর আস্থা রাখতে বলছিলেন। আমি যেন দ্রুত বাসায় ফিরে যাই, সে অনুরোধও করেছিলেন। তখন আমি তাকে তোমার পরিকল্পনা খুলে বলেছিলাম।”

“তারপর তিনি তোমাকে বাহবা দিলেন।”

“হ্যাঁ। তোমাকে যে কাজে লাগানো যেতে পারে, সেটা ভাবার জন্য তিনি আমাকে বাহবা দিলেন। পাপার কথা অনুযায়ী, এরকম অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটাই জয়ী আর পরাজিতের মধ্যে বিভাজন করে দেয়।”

এরকম কথা কেবল কাতসুতোশি কাতসুরাগিই বলতে পারে ভেবে মাথা নাড়লাম। “তারপর, তিনি তোমাকে কী কী নির্দেশনা দিলেন?”

“প্রথমে তিনি আমাকে বলে দিলেন, তুমি যা যা বলবে তা যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। তারপর যা যা ঘটছে সবই যেন তাকে রিপোর্ট করি। সবকিছুর পরিকল্পনা হয়ে গেলে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।”

“যোগাযোগ করবেন? কীভাবে?”

“তিনি আমার মোবাইলে ফোন করবেন,” সে এমন ভান করলো যেন আমি খুবই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছি।

“মোবাইল? কিন্তু তোমার কাছে তো মোবাইল ছিল না।”

“ছিল। তোমার কি মনে হয় আমি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিসের কথা ভুলে যাবো?” চিহারু আমাকে ব্যঙ্গ করে প্রাণখুলে হাসতে লাগল। “তোমার সাথে থাকার সময় আমি ফোনটা বন্ধ করে রাখতাম।”

“বোকা বনে গেলাম।” মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম। “তিনি তাহলে ফোন করে তোমাকে সব নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিলেন। ইয়োকোসুকাতে যাওয়ার ব্যাপারটাও তারই ঠিক করে দেওয়া, তাই না? আর ইউকি বলে তোমার কোনো বান্ধবী কখনোই ছিল না। কি ঠিক বলছি না?”

“না, ছিল। মিডল স্কুলে পড়ার সময় ইউকি নামের আমার এক বান্ধবী ছিল। তবে অনেকদিন ধরেই তার সাথে আমার দেখা-সাক্ষাৎ নেই।”

“তুমি আমাকে ইয়োকসুকায় যেতে বলেছিলে কারণ তুমি ওখানেই জুরির দেহাবশেষ পুঁতে রাখার পরিকল্পনা করেছিলে। কিন্তু আমাকে ওখানে শুধু গেলেই হবে না। আগে থেকেই ভাবনা-চিন্তা করে এমন সব ফন্দি এঁটে রাখলে, যাতে করে আমি ইয়োকোসুকাতে আমার চিহ্ন রেখে আসি।”

“হ্যাঁ, অনেকগুলো ফন্দি এঁটেছিলাম।” চিহারু হাঁটু ভাঁজ করে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। “কী কী ফন্দি, অনুমান করতে পারবে?”

“আমি একটা রেঁস্তোরায় বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন কে জানি পার্কিং লটে রাখা গাড়িটায় স্প্রে পেইন্ট করে মজা নিয়েছিল। স্টাফরা বোধহয় আমার চেহারাটা ভালোভাবেই মনে রাখবে। তাছাড়া আমি নিশ্চিত, এমআর-এস এর মতো বিরল গাড়িটা অনেকের মনে ছাপ ফেলে দিয়েছিল। যদি পুলিশ ওখানে গিয়ে আমার ছবি দেখায়, তবে ওখানকার স্টাফরা সাক্ষ্য দেবে বলে আমি নিশ্চিত। ঐ তামাশাটা কি মিস্টার কাতসুরাগির করা?”

“না, ওটা মা করেছিল।”

“তোমার মা? বাহ, তার মানে তোমার একের অধিক সহযোগী ছিল।”

“তুমি কিন্তু আরো অনেক চিহ্ন ফেলে এসেছিলে।”

“আমি জানি। কিন্তু সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।” আমি তার চোখ জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার ভাঁজ করা হাঁটুর দিকে তাকালাম। “শুধুমাত্র প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তুমি আমার সাথে শুয়েছিলে? শুধুমাত্র আমার বীর্য আর যৌনকেশের জন্য…তোমার বাবা-মা তোমাকে এতটা নিচে নামতে বলবেন—ব্যাপারটা কল্পনাও করতে পারছি না।”

পাপা আমাকে তোমার শরীরের লোম জোগাড় করতে বলেছিলেন। টিলার ওপর সেই মূর্তিটার কথা তোমার মনে আছে? তিনি আমাকে সেটা ওখানে লুকিয়ে রাখতে বলে দিয়েছিলেন। পাপা জানতেন, তোমার বীর্য থাকলে ব্যাপারটা আরো ভালো হতো। কিন্তু আমাকে তো আর এই কথাটা তিনি বলতে পারেন না। তাই লোম বলেই তিনি থেমে গিয়েছিলেন। সেটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক আমি সর্বোচ্চ প্রমাণটা জোগাড় করেই ছাড়বো।”

“তার জন্য তুমি পছন্দ করো না, এমন মানুষের সাথে শুতেও রাজি ছিলে।”

“কী, রাগ হচ্ছে?”

“না।”

“আমি কিন্তু তোমাকে পছন্দই করেছিলাম। তুমি নির্ভীক, আর প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। তোমার সাথে শোয়াতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। তুমি যদি বোকার হদ্দ হতে, মনে হয় না আমি অতদূর যেতে পারতাম।”

“তুমি কি আমার প্রশংসা করলে নাকি?”

“পাপাও তোমাকে বেশ সমীহের দৃষ্টিতে দেখেন। তোমার বুদ্ধিমান হওয়াটা আমাদের পরিকল্পনার জন্য অনেক জরুরি ছিল। যদি তুমি এমন মানুষ হতে, যে কিনা খুঁতওয়ালা কিডন্যাপিংয়ের পরিকল্পনা করে—তাহলে সবকিছু ভেস্তে যেত। পাপা হঠাৎ করে তোমার কোম্পানিতে গিয়েছিলেন, মনে আছে?”

“হুম, তুমি বলার পর কথাটা মনে পড়লো…” তিনি সাইবারপ্ল্যানের বানানো গেমগুলো সম্পর্কে জানতে এসেছিলেন।

“তিনি তোমার বানানো গেমটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। দ্য মাস্ক অব ইয়ুথ, কি, ঠিক বলেছি না? গেমটা দেখার পরেই পাপা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তোমাকে বিশ্বাস করা যায়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লাম। দুর্বলভাবে হেসে বললাম, “তখন থেকে তিনি আমাকে মূল্যায়ন করা শুরু করলেন?”

“যখন লাভ হোটেল থেকে আমাকে দিয়ে তুমি ফোন করালে, তখন হুইসলের শব্দটা খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছিলে, মনে আছে? তিনি তোমার এই কাজটাতেও প্রচণ্ড মুগ্ধ হয়েছিলেন।”

“আর সেটা ছিল আমার জন্য পাতা আরেকটা ফাঁদ।” আমি কাতসুতোশি কাতসুরাগির বানানো পথ ধরেই সুখীমনে চলছিলাম।

“কিন্তু আসল খেলা তখনই শুরু হয়েছিল। পাপা জানতে চেয়েছিল তুমি কীভাবে মুক্তিপণের টাকাটা হাতবদল করবে। কিন্তু গোটা পরিকল্পনাটা তুমি আমাকেও খুলে বলোনি। আরেকটু হলেই আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যেত যে, কেউই পুলিশের কাছে যায়নি।”

“মিস্টার কাতসুরাগী নিশ্চয়ই হাকোজাকির ঐ ধাক্কাটাতে খুব রেগে গিয়েছিলেন।”

“তিনি মনে মনে ধরে নিয়েছিলেন তুমি টাকাটা নিয়ে নেবে। কিন্তু দিনশেষে তোমার কাজে তিনি মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি পরে স্বীকার করেছিলেন, পেছনে পুলিশের চর লেগেছে কিনা সেটা বের করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।”

“যখন সত্যি সত্যি টাকাটা হাতবদল হলো, সে ব্যাপারে তার কোনো মতামত ছিল?”

“অবশ্যই। তার কাছে পরিকল্পনাটা অসাধারণ লেগেছিল। ওভাবে আগানোর ফলে কালপ্রিটকে আলাদা করে চিহ্নিত করার মতো কিছুই পাওয়া যায়নি। তিনি মনে করেন যে, যদি পুলিশ জড়িত থাকতো, তারপরেও তারা তোমার টিকিটা পর্যন্ত ধরতে পারতো না।”

মাথা নাড়লাম। ব্যাপারটাতে খুশি হবার কিছু নেই। তবে এটুকু ভেবে ভালো লাগছে যে, কাতসুতোশি কাতসুরাগির মতো মানুষও পরিকল্পনাটাতে উপহাস করার মতো কিছু খুঁজে পাননি। “তোমার দুইশ সত্তর মিলিয়ন ইয়েন লুকানোর জন্য আমরা ইয়োকোসুকাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। টাকাটা তোমার বান্ধবী ইউকির ঘরে লুকানোর কথা, অথচ বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। তখন তুমি টাকাটা নিয়ে কী করলে?”

“আমি ঐ বিল্ডিংয়ের গুদাম ঘরের মতো একটা জায়গায় টাকাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর চট করে পাপাকে ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা ওখান থেকে চলে আসার পর তিনি তৎক্ষণাৎ টাকাটা উদ্ধার করেছিলেন।”

“বুঝতে পেরেছি। এর মাধ্যমে জুরি কাতসুরাগিকে কিডন্যাপ করাও হলো, আবার মুক্তিপণের দাবিও মেটানো হলো। কিন্তু বড়ো একটা সমস্যা রয়ে গেছে। অবশ্য উত্তরটা খানিকটা আঁচ করতে পারছি।”

“কী সমস্যা?”

“আমাকে নিয়ে তোমরা কী করতে চেয়েছিলে?”

চিহারু ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর দিলো, “প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে শক্ত হয়ে যাবে।”

“শক্ত হওয়াই স্বাভাবিক।”

“তুমি মাত্র বললে যে, তুমি খানিকটা আঁচ করতে পারছো। বলে ফেলতে পারো।”

“এত পরেও তুমি আমাকে সব বলতে রাজি নও? আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে জুরির হত্যাকাণ্ড, নকল কিডন্যাপিং সবই সফলভাবে বাস্তবায়িত হলো। কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা রয়ে গেছে। সমস্যা না বলে দুর্ভাবনা বললেই বরং ভালো হবে। সেটা হলো, তোমরা তো আমার চোখে ধূলা দিতে পারবে না। ধরো, কেসটা রিপোর্ট করার পর ধীরে ধীরে আমি লুকিয়ে থাকা সত্যটা বুঝে ফেললাম। আমি সর্বোচ্চ নিজে থেকে পুলিশের কাছে ধরা দিতে পারি। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।। কিন্তু তোমাদের সেটা নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। কারণ, এ কেসটাতে আমিই প্রধান আসামীরূপে গণ্য হচ্ছি। তাই আমি এখনো সেটা করার কথা ভাববো না। কিন্তু তোমরা এটাও জানো যে, আমি চুপ করে বসে থাকবো না। আর যদি কোনোভাবে আমি পুলিশের সন্দেহের নজরে পড়ে যাই, তাহলে হয়তো আমি তাদের কাছে সবকিছু খুলে বলব। প্রথম প্রথম তারা হয়তো আমাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তারা বিষয়টা তদন্ত করে দেখবে। প্রেসও সুযোগ পেয়ে লাফিয়ে উঠবে। এগুলোর একটাও কাতসুরাগিদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। গোটা ব্যাপারটাকে সমাধান করার জন্য কেবল একটা পথ রয়েছে।”

এটুকু বলার পরেই আমি টের পেলাম, আমার ভেতরে তীক্ষ্মসুরে একটা অ্যালার্ম বেজে উঠছে।

মাথাটা হঠাৎ করে টিপটিপ করে প্রচণ্ড ব্যথা করতে শুরু করেছে। গোটা মস্তিষ্কেই ধীরে ধীরে ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছিল। তারপর আস্তে আস্তে ব্যথাটা কমতে শুরু করলো। কিন্তু আমি তখন টের পেলাম, আমার ইন্দ্রিয়গুলো অবশ হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে চেতনা হারিয়ে ফেলছি।

আমি চিহারুর দিকে তীব্রদৃষ্টিতে তাকালাম। তারপর ওয়াইনের বোতলটার দিকে তাকালাম।

“উপহারটার জন্য ধন্যবাদ।”

“জিনিসটা কি অবশেষে কাজ করতে শুরু করেছে?” সে আমার মুখের কাছে মাথাটা এনে আমাকে ভালোভাবে দেখলো।

“ওয়াইনে কী মিশিয়েছ?”

“আমি জানি না। পাপা সেটা আমার হাতে দিয়েছে। আমি আগেই সিরিঞ্জ দিয়ে সেটা বোতলে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি।”

কোনো ধরনের চেতনানাশক মনে হচ্ছে, ঘোলাটে মাথায় কথাটা ভাবলাম।

“আমাকে কি শুরু থেকেই খুন করার পরিকল্পনা করেছিলে?”

“আমি জানি না। আমি কেবল পাপা যা বলে দেয়, তাই করি।”

“সে আমাকে আগে থেকেই খুন করার পরিকল্পনা করেছে। তাছাড়া গোটা পরিকল্পনাটা ভেস্তে যাবে। ঐ মানুষটার পক্ষে এরকম অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়।”

উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু শরীরটা আমাকে মানতেই চাইছিল না। হুড়মুড় করে সোফা থেকে পড়ে গেলাম। টেবিলের কোণাটায় আঘাত পেলাম, কিন্তু কোনো ব্যথা অনুভূত হলো না।

“আমাকে যা যা বলা হয়েছে, আমি শুধু তাই করেছি। এরপরে কী হবে তার কিছুই আমার জানা নেই। কারণ, পাপাই সবকিছু দেখভাল করবেন।”

চিহারু উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলাম, সে এতক্ষণ ওয়াইন খাওয়ার ভান করছিল।

আমি আস্তে আস্তে চেতনা হারাতে শুরু করেছিলাম। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল।

কোনোমতেই সম্পূর্ণভাবে চেতনা হারালে চলবে না। যদি তা করে ফেলি, তবে তারা তাদের পরিকল্পনা মতো আগানো শুরু করবে। সোজা কথায় তারা আমাকে খুন করে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবে। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে হয়তো তারা প্রচার করবে যে, আমি ঐ খুন আর কিডন্যাপিংয়ের দায়ভারটা সহ্য করতে পারিনি। কিংবা হয়তো আমি ভেবেছিলাম যে, আমাকে খুব শীঘ্রই পুলিশ গ্রেফতার করবে, তাই…”

“…থামো,” ঘড়ঘড়ে গলায় বললাম। “আমার কথা শোনো। কথাটা শোনা… তোমার জন্য ভালো হবে।”

চিহারু কোথায় তা দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমনকি আমার কথাটা সে শুনেছে কিনা তাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। তারপরেও আমার শরীরের সবটুকু শক্তি একত্র করে কথাটা বলতে চেষ্টা করলাম।

“কম্পিউটার। আমার অটোমোবাইল পার্কের…ফাইলটা…’”

আমার মুখটা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু মস্তিষ্ক থেকে সেখানে কোনো সংকেত আর পৌঁছাচ্ছিল না। টের পেলাম, আমার গলার স্বরও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কিংবা অন্যকিছু। যেটাই ক্ষমতা হারাক, এখন আর যায় আসে না। মনে হলো, ধীরে ধীরে অন্ধকার আমাকে চারদিক থেকে গ্রাস করে ফেলছে। গভীর একটা গর্তে পড়ে যাওয়ার অনুভূতির সাথে পরিচিত হলাম। এটাই বোধহয় আমার সর্বশেষ অনুভূত অনুভূতি হতে যাচ্ছে।

.

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার বুকে কিছু একটা উঠে বসে আছে। এতক্ষণ যা যা ঘটলো, তা কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল কিনা তাও ভাবলাম। আমার মুখটা উত্তপ্ত বোধ হচ্ছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার গলার নিচ থেকে বাকি শরীর কিন্তু ঠান্ডা লাগছিল। না, ভুল বললাম। ঠান্ডা নয়, বরং প্রচণ্ড ঠান্ডা বোধ হচ্ছিল। বুঝতে পারলাম, ঘামে ভিজে আমার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।

আমি তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। যাক, এটুকু বোঝার শক্তি আছে এখনো। তার মানে এখনো আমার মৃত্যু ঘটেনি। চোখ খুললাম। আশেপাশের সবকিছু ঘোলাটে দেখাতে লাগল। তবে আবছা আবছা হলেও টের পেলাম, সামনে কিছু একটা রয়েছে। যদিও সেটা এখনো খুবই অস্পষ্ট মনে হচ্ছে।

ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করলো। আমি আমার ঘরেই আছি এখনো। টের পেলাম, আমি আমার সোফায় শুয়ে রয়েছি। শরীরটা নড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাথে সাথে ব্যথায় কাতরে উঠলাম। বমি বমি ভাব আর প্রচণ্ড মাথাব্যথা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এতটা জোরে অনুভূতিগুলো ধাক্কা দিলো যে, আরেকটু হলেই আবার অজ্ঞান হয়ে যেতাম।

কিন্তু জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার পর সেগুলোর প্রভাব খানিকটা কমে গেল। আস্তে আস্তে নিজেকে কিছুটা ওঠাতে সক্ষম হলাম। কানের পেছনের শিরাগুলো তখনো কেঁপেই যাচ্ছে।

“অবশেষে ঘুম ভাঙলো তাহলে,” একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটা পুরুষ মানুষের গলা।

আমি শুধুমাত্র চোখ সরিয়ে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। গলাটা নাড়াতে তখনো অনেক কষ্ট হচ্ছিল।

অবশেষে মানুষটার অবয়ব আমার চোখের কোণায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মানুষটা ঠিক আমার সামনেই একটা চেয়ারে বসে আছে। সে আর কেউ না, স্বয়ং কাতসুতোশি কাতসুরাগি।

সোফাটাতে কোনোমতে ঠিকঠাক হয়ে বসলাম। আমার শরীরটা তখনো শান্ত হয়নি। এখন যদি সে আমাকে আক্রমণ করে বসে, তবে মনে হয় না আত্মরক্ষা করতে পারবো। কিন্তু কাতসুতোশি কাতসুরাগিকে দেখে সেসব কিছুই মনে হলো না। তিনি তখন চিন্তাহীনভাবে স্বাভাবিকের মতো হাঁটু ভাঁজ করে সিগারেট ধরিয়েছেন।

তিনি একটা ডাবল-ব্রেস্টেড স্যুট পরেছিলেন। জিনিসটা দেখে একটু শান্ত হলাম। যদি তিনি সত্যিই আমাকে খুন করতে চাইতেন, তবে আরো সাধারণ কোনো জামা পরে থাকতেন; যাতে তিনি কারো চোখে না পড়েন।

“অবশেষে মূল অভিনেতা মঞ্চে এসে হাজির হলো,” বললাম। আমার নিজের গলা নিজের কাছেই ফাঁপা ফাঁপা মনে হতে লাগল। “নাকি অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা মাস্টারমাইন্ড বলবো?”

“আমার মেয়ের দেখভাল করার জন্য ধন্যবাদ,” কাতসুতোশি কাতসুরাগি বললেন। তার গলার স্বর সম্পূর্ণ শান্ত ছিল।

আশেপাশে তাকালাম। “আপনার প্রাণপ্রিয় কন্যা কি বাড়ি ফিরে গেছে?”

“তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে আমার স্ত্রী কোনোরকমের দুঃশ্চিন্তা না করে।

“আপনার স্ত্রীও তো আপনার দুষ্কর্মের সাহায্যকারী।”

সেটার উত্তর না দিয়ে তিনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকালেন। “আমার মনে হয় আপনি আমার কন্যার কাছ থেকে গোটা পরিকল্পনাটার সারসংক্ষেপ শুনতে পেরেছেন। আমি চেয়েছিলাম আমিই আপনাকে সবকিছু খুলে বলব। কিন্তু সে বলল সে নাকি আপনাকে শেষবারের মতো দেখতে চায়।”

“তাকে দেখে আমারো ভালো লেগেছে। তবে সেটা শেষবারের মতো কিনা তা বলতে পারছি না।

“সবার আগে এত ঝামেলা পোহানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি কিন্তু মজা করছি না। আমার ধারণা ইতোমধ্যে আমার মেয়ে আপনাকে জানিয়েছে দিয়েছে যে, আপনি অনেক নিখুঁতভাবে সবকিছু সম্পন্ন করেছেন। মুক্তিপণের টাকা অদলবদলের পদ্ধতিটা কি আপনার নিজস্ব আইডিয়া ছিল? নাকি কোনো রহস্যপোন্যাস থেকে সেটা ধার করেছেন?”

“সম্পূর্ণটাই আমার বানানো ছিল।”

“আচ্ছা। সেটা অসাধারণ ছিল।” তিনি ধীরে ধীরে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগলেন। ধোঁয়ার আড়াল থেকেই তিনি বললেন, “তবে মাঝের দিকে কয়েকটা অংশে আমি ত্রুটি খুঁজে পেয়েছি। মাঝের অংশ থেকে আপনি আমাকে ইংরেজিতে নির্দেশনা দেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু একজন বা দুজন পুলিশকে কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা ইংরেজিতে দক্ষ। তাই নিখুঁত স্কোর দিতে পারছি না।”

“আমার জানা ছিল যে, আপনি ফরাসি ভাষাও জানেন। আমি নিজেও একটু- আধটু ফরাসি জানি। কিন্তু সেটা ব্যবহার করিনি কারণ তাতে কালপ্রিটের সংখ্যা অনেকখানি কমে আসবে। আজকালকার যুগে জাপানে প্রায় কোটিসংখ্যক মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। ফরাসি ভাষার ক্ষেত্রে কিন্তু সে কথাটা বলা যায় না। তাই আমি সবকিছু চিন্তা করেই ইংরেজি ব্যবহার করেছি।”

“আচ্ছা। তাহলে দুজনের মতের প্রতিই শ্রদ্ধা পোষণ করছি।” তাকে দেখে মনে হলো আমার কথাতে তিনি আপত্তি করেননি।

“আপনার পরিকল্পনাও কিন্তু অসাধারণ ছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, সবকিছু আপনার মেয়ের ওপর নির্ভর করছিল। কিন্তু এত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও আপনি নানান কাজ করে সেটাকে সফল করিয়েছেন।

“একটা ব্যাবসা চালাতে গেলে যা যা করতে হয়, তার কাছে এটা কিছুই না। এখানে শুধু তোমাকে বোকা বানানোর প্রয়োজন পড়েছিল,” তিনি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন, “কিন্তু একটা কোম্পানি চালাতে গেলে অসংখ্য মানুষকে বোকা বানাতে হয়—কাস্টমার, কর্মচারী সবাইকে,” এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন। সিগারেটে জোরে একটা টান দিলেন। “যাই হোক, শুনলাম তুমি নাকি আমার মেয়েকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলে।”

“হ্যাঁ। আপনি আমাকে নিয়ে কী করবেন?”

কাতসুতোশি কাতসুরাগি মুচকি হেসে সিগারেটের ছাই অ্যাশট্রেতে ঝাড়লেন। তারপর হাঁটু ঠিক করে নিয়ে তৃপ্ত মুখে বসলেন। মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন, “যদি গোটা পরিকল্পনাটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্নও হতো, তারপরেও আমার পরিবারের কেউ শান্তি পেত না। কারণ, এখনো একজন মানুষ আছে যে কিনা আমাদের সব গোপন কথা জানে। শুনসুকে সাকুমা—তাকে নিয়ে কী করা যায়। তাকে খুন করে আত্মহত্যার নাটক সাজানো যায়। তারপর পুলিশকে কোনোভাবে বিশ্বাস করাতে পারলেই হলো। তারা ধরে নেবে যে, সেই জুরি কাতসুরাগিকে কিডন্যাপ করেছিল। কফিনের শেষ পেরেকটাও মারা হয়ে যাবে। তুমি অনুমান করেছিলে যে, আমার পরিকল্পনার শেষে তোমার মৃত্যু লেখা রয়েছে।”

“আমি কি ভুল ভেবেছি?”

“তা অবশ্য বলতে পারছি না। একবারও যে কথাটা ভাবিনি, তা কিন্তু বলছি না। কিন্তু আমার প্রিয় সাকুমা, আমি তো এতটা সোজাসাপ্টা মানুষ নই। আমাকে এরকম ভাবায় খানিকটা রাগ করলাম। তোমার নিখুঁত পরিকল্পনাটাই তোমার জন্য পাতা ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম অবস্থায় যে কেউই নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবতে পারে। সেজন্য তুমি ভাবলে, তাহলে নিজেকে নিরাপদ রাখার একটা রাস্তা খুঁজে বের করা যাক। আমি তোমাকে নিয়ে যা যা ভেবেছিলাম, তার সবই সত্যি হয়েছে।” বলে তিনি আমার পেছনে তাকালেন। আমার কম্পিউটারটা ওখানে রাখা ছিল। সিপিউর ফ্যানের শব্দ কানে আসছিল, তারমানে সেটা চালু রয়েছে।

“আপনি কি ফাইলটা দেখেছেন?”

“অবশ্যই দেখেছি।”

তার মানে জ্ঞান হারানোর আগে চিহারুকে যে শব্দগুলো বলেছিলাম তা বৃথা যায়নি।

“যখন চিহারুর কাছে শুনতে পেলাম তুমি কোনো একটা ফাইলের কথা বলেছ, আমি সেটা নিয়ে তেমন কিছুই ভাবিনি। কোনো জরুরি কিছু তো আর হবে না বলে ভেবে নিয়েছিলাম। হয়তো একটা টেক্সট ডকুমেন্ট পাওয়া যাবে, যাতে গোটা ঘটনাটা স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে। আর হ্যাঁ, সাথে একটা সাবধানবাণী থাকবে যাতে লেখা থাকবে, তোমার মৃত্যুর পর সেসব তথ্য কোনো না কোনোভাবে পুলিশের কাছে পৌঁছে যাবে।”

“জিনিসটা কি আপনাকে এক মুহূর্তের জন্যও থমকে দেবে না?”

“কেন দেবে? এসবকে গালগপ্পো বলে অস্বীকার করলেই তো হবে। যদি আমরা তোমাকে খুন করার জন্য প্রস্তুত থাকতাম, তাহলে এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভেবেও দেখতাম না। আমি হয়তো বলতাম যে, কিডন্যাপারটা আত্মহত্যা করার আগে একটা গল্প বানিয়ে রেখে গেছে। এখন বলো তো, পুলিশ কাকে বিশ্বাস করবে?”

উত্তর দিলাম না। পরোক্ষভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, তার কথাটা আমি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। সন্তুষ্ট মুখে কাতসুতোশি কাতসুরাগি অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা চেপে নেভাতে লাগলেন।

“কিন্তু তুমি এতটা বোকা ছিলে না। হ্যাঁ, আমার অনুমান অনুযায়ী সেখানে একটা চিঠি ঠিকই ছিল, কিন্তু সাথে আরো একটা ফাইল ছিল। জিনিসটা আমিও মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিলাম। না, মুগ্ধ বললে ভুল হচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।”

“স্বীকার করছি, জিনিসটা হঠাৎ করে আমার মাথায় এসেছে,” আমি তার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার করলাম। “আমি আগে ভাবতেও পারিনি যে, জিনিসটা পরে এভাবে কাজে লেগে যাবে।”

“বুদ্ধিমান মানুষদের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়। তারা মনের অজান্তেই নিজেদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে থাকে। এরকম জিনিস কাউকে শেখানো যায় না।”

দুর্বলভাবে হাসলাম। এরকমভাবে লোকটার কাছ থেকে প্রশংসিত হবো, তা কখনো কল্পনাও করিনি।

“আমি তোমাকে খুন করতে চাইনি,” কাতসুতোশি কাতসুরাগি বললেন। “কারণ তোমাকে খুন করার কোনো প্রয়োজন নেই। পুলিশ তোমাকে না ধরা পর্যন্ত তুমি কারো কাছে মুখ খুলবে না। আর তুমি কখনো ধরা পড়বেও না। কারণ, আমরা তোমাকে সাহায্য করবো। ভিক্টিম হিসেবে আমরা ইচ্ছামতো অসংখ্য প্রমাণ প্রস্তুত করতে পারবো যাতে দেখা যাবে তুমি আসলে কালপ্রিট নও। অবশ্য সেটা আমাদের সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল। তুমি যদি গেমটা ভালোভাবে সম্পন্ন না করতে পারতে, তাহলে আমাদের ওটাই অনুসরণ করতে হতো। কিন্তু এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, তুমি খুব সফলভাবেই গেমটা শেষ করেছ।”

“যদি আমাকে কালপ্রিট না বানাতেই হতো, তবে ইয়োকোসুকায় কেন আমার চিহ্ন কেন রেখে আসা হলো?”

“প্রথমত, আমি তোমাকে দুর্বল বানাতে চেয়েছিলাম। এরকম অবস্থায় পড়লে তুমি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে যাবে বলে ধরে নিয়েছিলাম। আসলে তোমাকে নয়, বরং কোনো একজন কালপ্রিটের চিহ্ন হলেই চলত আমার। গোটা কিডন্যাপিংটাই যে একটা সাজানো নাটক ছিল, এই তথ্যটাকে কখনো আলোর মুখ দেখতে দেওয়া যাবে না। একজন কালপ্রিটের অস্তিত্ব দেখানোর জন্য আমার একজন ‘সত্যিকারের কালপ্রিট’ প্রয়োজন ছিল।”

“তাহলে একটু আগে আমাকে কেন ঘুম পাড়ালেন?”

কাতসুতোশি কাতসুরাগি আবার মুচকি হাসলেন। তার মুখটা দেখে বুঝতে পারলাম, তিনি এই প্রশ্নের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। “তোমার কি মনে হয়েছিল, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে মেরে ফেলা হবে?”

“সত্যি বলতে কি, হ্যাঁ, তাই মনে হয়েছিল।”

“হুম। তাই সেটা ঠেকানোর জন্য তুমি সর্বশক্তি ব্যবহার করে তোমার ট্রাম্প কার্ডটা বের করে আনলে। আমি মনে মনে ঠিক সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম। তোমার ব্যবহার করা সর্বশেষ কার্ড।”

আমি ঘোঁৎ করে উঠলাম। “আপনি অপেক্ষায় ছিলেন আমার হাতের সবগুলো কার্ড দেখার?”

“খেলা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো খেলায় জয়ী কে, তা বের করা সম্ভব হয়নি। তোমার হাতের কার্ডগুলো এখনো তোমার হাতেই রয়ে গেছে।”

কাতসুতোশি কাতসুরাগি আবার কম্পিউটারের দিকে তাকালেন। তার মতো আমিও পেছনে ফিরে তাকিয়ে মনিটরটার দিকে তাকালাম। মনিটরটাতে একটা ছবি দেখা যাচ্ছিল। ছবিটা যে এই ঘরেই তোলা তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

চিহারু যখন জুরি সেজে আমার বাসায় থাকছিল, ছবিটা সেই সময়কার। ছবিটায় সে আমার জন্য বানানো খাবার ট্রেতে করে বহন করছিল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *