আঠারো
আমার গলা ভেজানোর দরকার, কিন্তু তা না করে সোজা বাসায় ফিরে গেলাম। যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাই, তবে হয়তো মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে যেতে পারে। মাতাল অবস্থায় নিজেকে সামলানোর মতো শক্তি আর পাচ্ছি না।
বাসায় ফিরে বারবনের একটা বোতল খুলে বরফ না মিশিয়েই সেটা পান করা শুরু করলাম। বুকের খাঁচার ভেতর তখনো হৃৎপিণ্ড পাগলের মতো লাফালাফি করছে। বোধহয় এটাকেই ‘পূর্বাশংকা’ বলে। মানে, শীঘ্রই খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যদি সেটা তাই-ই হয়ে থাকে, তবে হাজার বোতল মদ পান করলেও লাভ নেই। টিভির পর্দায় দেখা ছবিটা আমার মাথায় খোদাই হয়ে গেছে। চেষ্টা করলেও সেটা ভুলতে পারছি না।
ওটা কে ছিল? তার নাম ব্যবহার করে টিভিতে এটা কাকে দেখানো হচ্ছে?
কিন্তু সব চ্যানেলেই সে ছবিটা দেখানো হচ্ছে। যদি তারা ভুল দেখিয়েই থাকে, তবে এতক্ষণে ভুলটা ঠিক করে ফেলার কথা।
তারমানে, ওটাই ‘আসল’ জুরি কাতসুরাগি।
তাহলে আমি যার সাথে এতদিন কাটালাম, সে আসল জুরি নয়? ও তাহলে কে? সে কেন নিজেকে ‘জুরি’ বলে পরিচয় দিয়েছিল?
সেই যে সত্যিকারের জুরি কাতসুরাগি ছিল, সে বিষয়ে আমি কীভাবে নিশ্চিত হতে পারবো? একসময় মনে পড়লো : তার গলার স্বর।
পুলিশের গতিবিধি সম্পর্কে জানার জন্য আমরা হাকোজাকি স্টেশন ব্যবহার করেছিলাম। ঐ সময়ে জুরিকে ব্যবহার করে কাতসুরাগিকে নাচিয়েছিলাম। টাকা তুলে নেওয়ার সময়েও তাকে ব্যবহার করেছিলাম। জুরি মিস্টার কাতসুরাগির সাথে সরাসরি কথা বলেছিল। অথচ কাতসুরাগি একবারও সেই গলার স্বরকে সন্দেহ করেনি। দুজন মহিলার একই রকম গলার স্বর থাকতে পারে, কিন্তু একজন বাবা তার মেয়ের গলার আওয়াজ তার মধ্যেও আলাদা করে নিতে পারবেন। সে ব্যাপারে তার অন্তত ভুল হবে না। একেবারে হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যেও কাতসুতোশি কাতসুরাগি তার চরিত্রের এই দিকটা হারাবেন না, এটুকু অন্তত মানি। একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি তার গলার স্বরের নির্দেশনাগুলো একেবারে কাটায় কাটায় মেনে গেছেন।
তাহলে টিভিতে যে ছবিটা দেখানো হচ্ছে, সেটা কি ভুল? কাতসুরাগি কি ইচ্ছা করেই একটা নকল ছবি প্রচার করতে দিয়েছেন? তিনি এরকম কেন করতে যাবেন?
না, সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না। কেবল আমিই তো শুধু টিভি দেখছি না, জুরির সঙ্গীসাথীরাও সেটা দেখছে। যদি ছবিটা অন্য কারো হতো, তবে এতক্ষণে কেউ স্টেশনে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিত।
জুরি। গাছপালা (জুমোকু), আর বিজ্ঞান (রিকা) এর প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে ‘জুরি’।
তার নামটা সে কীভাবে বলেছিল, তা মনে পড়লো। আমি একদম নিশ্চিত সে এটাই বলেছিল। সেটাও কি মিথ্যা ছিল? একেবারে শুরু থেকেই সে মিথ্যা বলে আসছে?
তাহলে ও আসলে কে?
অসংখ্য গ্লাস বারবন গলায় ঢালার পরেও টের পেলাম, এতটুকু মাতাল হতে পারিনি। বরং পালসের গতি বেড়ে গেছে, সেই সাথে আরো অস্থিরবোধ করতে শুরু করেছি।
তার সাথে কাটানো ঘণ্টাগুলো, দিনগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। খুব বেশি সময় সে আমার সাথে ছিল না, কিন্তু তার মধ্যে অনেককিছু ঘটে গেছে। আমরা একটা বিশাল খেলা একসাথে শুরু করেছি, একটা নকল কিডন্যাপিংকে মঞ্চে উপস্থাপন করে সেই খেলার সমাপ্তি ঘটিয়েছি। এতকিছুর পরেও আমি আমার সঙ্গিনীর আসল পরিচয় জানি না–এর মানে কী হতে পারে?
না, কেবল ওটাই যে শুধু জানি না তা কিন্তু নয়। মনে হচ্ছে যে রাতে আমার সাথে ‘নকল’ জুরি কাতসুরাগির দেখা হয়েছিল, সে রাতেই ‘আসল’ জুরি কাতসুরাগি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। আসল জুরি তাহলে এখন কোথায়? ‘নকল’ জুরির ঘর পালিয়ে যাওয়া কি কাকতালীয় ব্যাপার ছিল, নাকি অবশ্যম্ভাবী ছিল?
আমার মাথা আর কাজ করছিল না। একটা যৌক্তিক সমাধানও মাথায় এলো না। কতটুকু মদ গিলেছি তার হিসেব রাখতে পারিনি। চেতনা ফিরতে টের পেলাম সোফায় শুয়ে আছি। ঘরের বাতি এখনো জ্বালানো। বারবনের খালি বোতলটা পাশেই কাঁত হয়ে পড়ে রয়েছে। পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকে পড়েছে। দেওয়ালঘড়িটার দিকে তাকালাম। আগের মতো নির্দিষ্ট সময়েই ঘুম ভেঙে গেছে। দশমিনিট আগপিছও হয়নি। আমার শরীরে খোদাই হয়ে যাওয়া অভ্যাসগুলো এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও নিয়ম মেনে চলছে।
ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। গলা শুকিয়ে একদম শুকনো খটখটে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে এভিয়ানের বোতল বের করে নিলাম। তারপর সোজা বোতল থেকে পানি পান করতে শুরু করলাম। মাথা ঘুরতে শুরু করায় ফ্রিজে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম।
মাইক্রোওয়েভের ওপর রাখা বড়ো পাত্রটার ওপর চোখ পড়লো। মনে পড়ে গেল, জুরি ওটা ব্যবহার করেই স্ট্যু বানিয়েছিল। সে কী কী নিয়ে কথা বলেছিল তা একে একে মনে পড়তে লাগল। সে যা যা বলেছিল, তার কতটুকু মিথ্যা আর কতটুকু সত্য ছিল? নাকি সবকিছুই বানোয়াট? এখনো সেটা ধরতে পারছি না।
সোফায় ফিরে গিয়ে টিভিটা চালু করলাম। এত সকালে প্রত্যেকটা চ্যানেলে ঘুরেফিরে কেবল একই টাইপের নিউজ দেখায়। অবচেতন মনে টিভির পর্দায় তাকিয়ে থাকলাম। একসময় জুরির খবরটাও পর্দাতে ভেসে উঠলো। নিসেই অটোর ইভিপির কন্যা নিখোঁজ—এবার কথাটার শেষে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তার নিচেই লেখা : বাড়ি থেকে পালিয়েছে কি?
আবার পর্দায় সেই অচেনা মেয়েটার ছবি দেখাতে লাগল। নিখোঁজ হওয়া জুরি কাতসুরাগি, নিচে ক্যাপশন আকারে লেখা ছিল। খবরে নতুন করে কিছু যোগ করা হয়নি। তার মানে এখনো সাংবাদিকদের কেউ কাতসুরাগি পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। বোধহয় তারা বিশাল কোনো স্পন্সর হারানোর ভয়ে এখনো কাতসুরাগি পরিবারের কারো সাক্ষাৎকার নেওয়ার সাহস পায়নি। খবর দেখে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, প্রেসও এ ব্যাপারে খুব আশাহত হয়ে আছে।
বোধহয় এটা যে একটা কিডন্যাপিং ছিল, সেটা প্রেসকে এখনো জানানো হয়নি। কারণটা ধরতে পারলাম। পুলিশ নিশ্চয়ই মুক্তিপণের টাকা খোয়ানোর ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে। তারা হয়তো ভাবছে, কিডন্যাপারদের গ্রেফতার করার পর এসব তথ্য প্রকাশ করলেই চলবে। কিন্তু এরকম খোলাখুলিভাবে তদন্ত করার জন্য তাদের মিডিয়ার সাহায্য লাগবেই। সেজন্যই তারা গোটা ব্যাপারটাকে কেবল ‘নিখোঁজ’ বলেই প্রচার করছে।
এখন প্রেস গোটা ব্যাপারটাকে কীভাবে সামলাবে, সেটা নিয়ে ভাবা যাক। টিভি দিয়েই না হয় শুরু করি। তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে—এ বিষয়টা তারা খুব সহজে মেনে নিতে পারবে না। এতক্ষণে বোধহয় তারা টের পেয়েছে যে, এটা কোনো সাধারণ মিসিং পার্সনস কেস নয়। তাই সবার আগে তারা কাতসুরাগিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করবে। অল্প সময়ের মধ্যেই কাতসুরাগির মেয়েঘেঁষা স্বভাবটা সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে। তারপর তারা যখন জানতে পারবে, জুরি তার বর্তমান স্ত্রীর আপন মেয়ে নয়—তাহলেই হয়েছে। গোটা মিডিয়ায় হইচই পড়ে যাবে। স্টেশনগুলো তাদের স্পন্সরকে না ক্ষেপিয়ে যতটা সম্ভব একের পর এক গালগপ্পো প্রচার করতে থাকবে…
না—সৎ মেয়ের গল্পটা কি আদৌ সত্য? যে মানুষটা আমার কাছে গল্পটা ফেঁদে বসেছিল তার নিজের গোটা অস্তিত্বটাই তো মিথ্যা ছিল। মিথ্যাটা কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সে ভালো করেই উপস্থাপন করেছিল।
অবৈধ রক্তের সম্পর্ক, একটা জটিল মনুষ্য গাঁথা…
ঠিক তখনই একটা হাইপোথেসিস আমার মাথায় এলো।