ষোলো
অনেকদিন পর এই শনিবারে ডেটিং করতে বের হলাম। সঙ্গিনী হিসেবে ছিল চব্বিশ বছর বয়সের একজন ইভেন্ট কম্প্যানিয়ন। ইটালিয়ান খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে হোটেল বারে বেশ কয়েকটা ককটেল হাতে নিয়ে সময় পার করলাম। তবে আজকে রাতের সমাপ্তিটা হোটেলের রুমে ঘটল না। অবশ্য চাইলেও এখন একটা রুম পাওয়া সম্ভব হবে না। আমি যদি মনে করি ডেট ভালোমতোই আগাবে, তখন আগে থেকেই একটা রুম রিজার্ভ করে রাখি। কিন্তু সে রাতে কোনো রিজার্ভেশন নিয়ে রাখিনি। না, আত্মবিশ্বাস ছিল না বলে নয়। বরং গোটা ব্যাপারটা চিন্তা করতেও বিরক্তি লাগছিল।
সত্যি বলতে কী, সঙ্গিনীর প্রতি আমার কোনোপ্রকার অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছিল না। যে কেউ চাইলেই আজকে আমার ডেট হতে পারতো।
এরকম মানসিক বিক্ষিপ্ততার কারণে সুস্বাদু খাবার খেয়েও স্বাদ পাচ্ছিলাম না, তার কথায় মনোযোগ দেওয়া তো দূরের কথা। হয়তো ডেটের শেষ পর্যায়ে তার মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, ‘তাহলে আমাকে সে ফোন দিলই বা কেন?’
জুরিকে মাথা থেকে বিদায় করতেই পারছিলাম না। জুরি চলে যাওয়ার পর কী কী ঘটেছিল? অদ্ভুত ব্যাপার, ওর ব্যাপারে কোনো ধরনের রিপোর্ট বা কেস আমার চোখে পড়েনি। এতক্ষণে তো সাংবাদিকদের মচ্ছব লেগে যাবার কথা, প্রেসে পার্টি হবার কথা। বিখ্যাত নিসেই অটোমোবাইল-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের কন্যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, আর তার মুক্তিপণের টাকাটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। জিম্মিতে থাকা কন্যা অক্ষত দেহে বাবা-মায়ের কোলে ফিরে গেছে। এখন পুলিশ চাইলেই প্রকাশ্যে তদন্ত শুরু করতে পারে। এ সময়ে তাদের তো প্রেসকে কাজে লাগানোর কথা, তাই না?
সঙ্গিনীকে বিদায় জানিয়ে রুমে ফিরে এলাম। কম্পিউটারের সামনে বসে সেটা চালু করে ইন্টারনেটের সংযোগ স্থাপন করলাম। খেলার সমাপ্তির পর ‘সিপিটি মালিকদের ক্লাব’ ওয়েবসাইটটাতে অনেকদিন হলো ঢু মারি না।
বুলেটিন বোর্ড পেজটা খুললাম। অসংখ্য মন্তব্য বোর্ডটা ছয়লাব হয়ে গেছে। অবশ্য সেগুলো জুরিকে নিয়ে নয়। সেগুলো আসলেই সিপিটির সম্পর্কে জানতে চাওয়া পোস্ট।
কিন্তু একটা পোস্ট দেখে আমি জমে গেলাম।
.
প্লিজ (ইউজারনেম-জুলি)
আমার গাড়িটার যে কী হলো কে জানে। টাকাটা মিটিয়ে দেবার পরেও ওরা আমার সাথে আর যোগাযোগ করেনি। কী হলো কিছুই বুঝতে পারছি না।
গাড়ির মালিক, আপনি যদি এ পোস্ট দেখে থাকেন, তবে প্লিজ আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
প্লিজ।
.
এর মানে কী?
গত পরশু পোস্টটা দেওয়া হয়েছে। পোস্টটার ভেতরের অর্থ হচ্ছে—আর দেরি না করে জুরিকে দ্রুত তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা তো হওয়ার কথা নয়। তার তো নিরাপদেই বাসায় ফিরে যাবার কথা।
এটা আমার জন্য পাতা কোনো ফাঁদ নয়তো?
হতে পারে—জুরি বাসায় পৌঁছায়নি ভান করে কিডন্যাপারদের বিভ্রান্ত করে তাদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া।
কিন্তু, আমি ভাবলাম। জুরি বাসায় পৌঁছালো নাকি পৌঁছালো না, তাতে তো কিডন্যাপারদের যায়-আসে না। তারা কি সত্যিই কিডন্যাপারদের এতটাই বোকা ভাবছে যে, এই ফাঁদে কিডন্যাপাররা পা ফেলবে? কোনোকিছু না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম।
কিন্তু সে যদি সত্যি সত্যিই বাসায় না ফিরে থাকে?
এটাই আমার কাছে সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। তাকে শিনাগাওয়ার একটা হোটেলের কাছে রেখে চলে এসেছিলাম। সে তো ট্যাক্সিতে নাও উঠে থাকতে পারে। এমনকি সে যে বাসায় গেছে—সেটার প্রমাণই বা কোথায়? সে কাতসুরাগিদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তার হাতে এখন অনেক টাকাপয়সা এসেছে। তাই হয়তো সবার চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে বিশাল বিপদ। যে জিম্মিকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল, তাকে ছেড়ে দেবার পর তার নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাবার কথা। অন্তত একজন জিম্মির মনের অবস্থা এরকমই থাকে। কাতসুরাগিদের প্রাসাদটা হয়তো খুব আনন্দদায়ক জায়গা নয়, তারপরেও গোটা দুনিয়ায় তার কেবল এই একটাই আশ্ৰয় আছে।
জুরি যদি সবার আড়ালে থাকতে পারে, তবে কোনো সমস্যা নেই। সত্যটাও আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু সেটা কি অনেক কঠিন একটা ব্যাপার নয়? বিশের ঘরে এখনো পা দেয়নি, এরকম একটা ছোট্ট মেয়ের পক্ষে কি তার পরিচয় গোপন রেখে জীবন কাটানো সম্ভব? প্রচুর টাকা থাকলেও একটা বাড়ির ঠিকানা কিংবা ফ্যামিলি রেজিস্টার ছাড়া সে কীভাবে থাকবে?
এভাবে চলতে থাকলে পুলিশ তাদের তদন্ত আরো জোরদার করবে। গোটা জাপানের সবজায়গা তার ছবিতে ছেয়ে যাবে। টিভি স্টেশনগুলোও এই সুবর্ণ সুযোগ ছেড়ে দেবে না। জুরি যতটাই নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, তাকে একসময় না একসময় বের হতেই হবে। তাকে মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কেউ না কেউ ওকে চিনতে পারবেই।
তাকে পুলিশের কাস্টোডিতে নেওয়া হলে সে কীরকম অভিনয় করবে? আমি তাকে যেসব লাইন শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেগুলো উগড়ে দেবে? তখন সেসব বলা অর্থহীন হয়ে যাবে। পুলিশ একসময় বুঝতে পারবে, গোটা কিডন্যাপিংটাই সাজানো একটা নাটক ছিল। আমার মনে হয় না জুরি একটানা পুলিশের সেই অসহনীয় জিজ্ঞাসাবাদ সহ্য করতে পারবে। একসময় না একসময় সে মুখ খুলতে বাধ্য হবে। আমার নামটাও তখন বেরিয়ে আসবে।
বসে থাকতে না পেরে হাতে কোটটা নিয়ে রুম থেকে ছুটে বের হলাম। মদের নেশা একদম কেটে গেছে।
গাড়িতে উঠে সোজা ইয়োকোসুকার পথ ধরলাম। জুরি যদি সত্যি লুকিয়ে থাকার চিন্তা করে থাকে, তবে ওর বান্ধবীর বাসা বাদে আর কোনো জায়গার কথা মাথায় আসছে না। টাকাটাও ওখানে লুকানো।
এক্সপ্রেসওয়েতে গতি বাড়িয়ে চলতে চলতে নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে গোছানোর চেষ্টা করলাম। সবার আগে জুরিকে খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে পাওয়ার পর কী করব? যেভাবেই হোক তাকে তার বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য করব। যদি গায়ে হাত তুলতে হয়, তাও করতে আমি রাজি আছি। এতদিন পর তাকে ফিরিয়ে দেওয়াটাকে কালপ্রিটদের ‘সন্দেহবাতিকতা’ বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
তবে জুরি যদি কারো সাথে যোগাযোগ করে ফেলে, তবে সব আশা চুরমার হয়ে যাবে। অবশ্য আমার কাছে ওকে এতটা বোকা বলে মনে হয়নি। তবে আমি ওর জায়গায় থাকলে কী করতাম? আমার ব্রেন সর্বোচ্চ গতিতে কাজ করতে লাগল, কিন্তু সেটা সামলানোর মতো কোনো ধরনের পরিকল্পনা মাথায় এলো না। প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে সে ইতোমধ্যে কারো সাথে যোগাযোগ না করে থাকে।
ইউকির বাসার কাছাকাছি উপস্থিত হলাম। ওখান থেকে একটু দূরে গাড়িটা পার্ক করে হেঁটে হেঁটে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এরকম জায়গায় ঘোরাঘুরি করাটা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু জুরিকে এভাবে ছেড়ে রাখাটা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেভাবেই হোক, তাকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
কেউ আমাকে লক্ষ করছে কিনা তা দেখে নিলাম। তারপর বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে পড়লাম। রাত হয়েছে, তাই বোধহয় সুপারিন্টেন্ডেন্ট সেখানে নেই। এখন সমস্যা হলো, আমি ইউকির বাসার নম্বরটা জানি না। কেবল ওর নাম যে ‘ইউকি’, সেটাই জানি।
কাচের সদর দরজাটা খোলাই ছিল। কোনো ধরনের অটো লকের ব্যবস্থাও তাতে ছিল না। যা ভেবেছিলাম, সুপার নেই। দরজার পাশেই ডানদিকে মেইলবক্সগুলো সারিসারিভাবে সাজানো। কয়েকটা নেইমট্যাগ আছে, কয়েকটাতে নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলোর নামগুলোও এত সংক্ষিপ্তভাবে দেওয়া যে, সেটা আমার খুব একটা কাজে লাগল না।
আশপাশের দিকে সতর্ক নজর রেখে প্রত্যেকটা মেইলবক্সের ভেতরে হাতড়াতে লাগলাম। প্রথমটাতে কিছু পেলাম না। আজ শনিবার রাত। হয়তো ইতোমধ্যে চিঠিপত্র সবাই যে যার মতো তুলে নিয়ে গেছে।
পরের মেইলবক্সে হাত ঢুকালাম। এবার কিছু একটার অস্তিত্ব টের পেলাম। আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে সেটাকে বের করে আনলাম। জিনিসটা একটা পোস্টকার্ড ছিল। কার্ডে লেখা ঠিকানার দিকে তাকালাম। প্রাপকের নাম কাওরু ইয়ামামোতো। না, এটা ইউকি হবে না।
এবার পরের মেইলবক্সে নজর দিলাম। হাতড়াতে হাতড়াতে আমার মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ভর করলো। এভাবে কি আদৌ কিছু খুঁজে বের করতে পারব? কিন্তু এটা বাদে তো আমার আর কোনো উপায় জানা নেই।
মেইলবক্সটাতে কিছু একটা আছে মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেটা বের করে আনলাম। এবার একটা খাম পেয়েছি।
তেতসুইয়া মাতসুমোতো….
এটাও কোনো কাজে লাগল না ভেবে আবার সেটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম। অকস্মাৎ একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল।
তোমার সেখানে না যাওয়াই ভালো। শুধুমাত্র মেয়েরা থাকে সেখানে….
জুরি তো আমাকে এই কথাটাই বলেছিল।