অ্যা কিডন্যাপিং – ১৫

পনেরো

মুক্তিপণের টাকা হাতে পাওয়ার পর দুদিন কেটে গেছে। নোটগুলোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। হাত দিয়ে আলতো করে দেখেছি, না, অদ্ভুত কিছু হয়নি। তারমানে টাকার মধ্যে কোনোধরনের ফাঁদ পাতা হয়নি।

একটা গ্রোসারি ব্যাগে তিরিশ মিলিয়ন ইয়েন ভরে রেখে দিলাম। “এই যে, আমার অংশটা নিয়ে নিলাম। বাকি পুরোটা তোমার।”

জুরি টেবিলের নোটের স্তূপের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “বিশাল ঝামেলা মনে হচ্ছে। এর ওজনও অনেক হবে।”

“আমরা যে একটা বিশাল ম্যাচ খেলে এসেছি, এটা তারই প্রমাণ।”

তার দিকে একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোর পেপার ব্যাগ এগিয়ে দিলাম। সে টাকা ভেতরে ঢোকানো শুরু করলো। দুইশ সত্তর মিলিয়ন ইয়েন। জানা কথা অনেক ভারী হবে।

“এই টাকা দিয়ে আমি কী করব?”

“তোমার যা মনে চায় তুমি করতে পারবে। এটা সম্পূর্ণই তোমার। কিন্তু টাকা না ছড়ানোই বরং ভালো হবে।”

জুরি জোরে মাথা ঝাঁকালো। “আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি তো আর এই টাকার বস্তা নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবো না। এটা কি কয়েন লকারে ঢুকিয়ে রেখে দেবো? পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে সেটা বের করে আনলাম?”

“কয়েন লকার ব্যবহার করাটা কিন্তু বিপজ্জনক। যদি কোনোভাবে তারা চাবিটা খুঁজে পায়, তবেই হয়েছে। আর পরিস্থিতি ঠান্ডা হতে হতে কত সময় লেগে যাবে তা তো আমরা কেউই জানি না। অথচ নির্দিষ্ট সময় পরেই কিন্তু স্টোরেজের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। মেয়াদ শেষ হলে লকারটা খোলা হবে। গেম ওভার।”

“তাহলে আমার কী করা উচিত?”

“তোমার চেনাজানা কোনো আশ্রয়স্থল আছে? এমন কোনো জায়গা যেটার কথা কেবল তোমারই জানা আছে? যদি থাকে, তবে সেখানে কিছুদিনের জন্য রেখে আসতে পারো।”

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর সে মুচকি হাসলো। “একটা জায়গার কথা মনে পড়েছে। খুবই ভালো জায়গা।”

“কোথায়?” প্রশ্নটা করার সাথে সাথে সে কোন জায়গার কথা বলতে চাইছে, তা ধরতে পারলাম। মুখ কালো হয়ে গেল। “আমি জানি তুমি এ বাসার কথা বলবে, কিন্তু সেটা করা যাবে না। তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার পর তোমার-আমার মধ্যকার সব সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে। আমরা শুরুতেই কিন্তু সেটা ঠিক করে রেখেছি, মনে নেই?”

“কিন্তু আর কোনো ভালো জায়গার কথা তো মনে আসছে না।”

তার হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম, সে আসলেই আমার ঘরে টাকাগুলো রাখতে চেয়েছিল। “আচ্ছা, চলো বের হই।”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“আমার সাথে চলো আগে। তাহলেই টের পাবে।” উঠে দাঁড়ালাম। “ওহ হ্যাঁ, দুইশ সত্তর মিলিয়ন ইয়েনের প্যাকেটটা সাথে নিতে ভুলো না কিন্তু।”

ঘর থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটে চলে গেলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।

“অ্যাই, বলো না আমরা কোথায় যাচ্ছি? এখন তো আমাকে বলতে পারো, তাই না?”

“ইয়োকোসুকা।”

“আবার ইয়োকোসুকা?”

“তুমি বলেছিলে যে তোমার এক বান্ধবী আমেরিকায় গেছে, ঠিক না? ইউকি না কী যেন নাম? আমরা যার আন্সারিং মেশিন মুছে দিয়ে এলাম।”

আচ্ছা, সে অবশেষে আমার পরিকল্পনাটা আঁচ করতে পারলো। “তাহলে আমরা ওটা ইউকির ঘরে লুকিয়ে রাখবো।”

“সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তো ওটাই, তাই না?”

আন্সারিং মেশিনের ঘটনাটা অনেক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘরটা আছে বলেই স্বস্তি লাগছে। আমি নিজেও টাকা লুকোনোর জন্য ভালো জায়গা মনে মনে খুঁজছিলাম।

এমআর-এস এ ঢুকে সেটার ছাদটা তুলে দিয়ে ড্রাইভ করা শুরু করলাম। জুরি টাকার প্যাকেটটা হাঁটুর ওপর রেখে সেটাকে জড়িয়ে রেখেছে। এখন থেকে এটাই তার জীবন চলার পথে সাহায্য করবে।

“অ্যাই, তোমার কি মনে হয় পুলিশের তদন্ত শুরু হয়ে গেছে?” সে জিজ্ঞেস করলো।

“অবশ্যই। আমরা ফ্যাক্স পাঠানোর পর থেকেই সেটা শুরু হয়ে গেছে।”

“তারা আবার কোনো সূত্র-টুত্র খুঁজে পাবে না তো?”

“কোনোভাবেই না।” ঠোঁটটা কুঁচকে ফেললাম, “কিছু খুঁজে পেলেও সেটা ভুয়া হবে। ঐ যে, দূর থেকে আসা হুইসলের শব্দের মতো ছোটোখাটো ভুয়া সূত্র আরকি।”

ইমেইল বা মোবাইল দিয়ে আমাদের ওরা ট্রেস করতে পারবে না। একমাত্র সাক্ষী হিসেবে নাকামুরার কথা বলা যায়। কিন্তু জুরির কথা যদি সত্যি বলে ধরে নিই, তবে মানুষটা পুলিশকে কোনো তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবে না।

“কিন্তু একটা সত্যিকারের সূত্র তো রয়েছেই।” জুরি বলে উঠল।

“কোনটা?”

“কালপ্রিট ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। তাও আবার ব্রিটিশদের মতো করে।”

কথাটা শোনার সাথে সাথে চমকে গিয়ে স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরে গিয়েছিল। গাড়িটা আরেকটু হলেই রাস্তার মাঝখান থেকে বামদিকে সরে যাচ্ছিল। দ্রুত সেটাকে আগের মতো করলাম।

“তোমার ইংরেজি কেমন? ভালো?” নিজেকে শান্ত করতে করতে ওকে জিজ্ঞাস করলাম।

“মোটেই না। আমি অবশ্য এসব ব্রিটিশ টান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। তবে শুনে ব্রিটিশ স্টাইলের ইংরেজি বলেই মনে হচ্ছিল। ভুল বললাম?”

“হয়তো।” টের পেলাম, ঘেমে গেছি।

সে ঠিকই ধরেছিল। আমি লন্ডনে প্রায় একবছর থেকে এসেছি। সেসময়ে ইংরেজিতে দক্ষ হয়েছি বলা যায়। অনেকেই সেটা ধরতে পারে।

এক্সপ্রেসওয়ে পার হয়ে ইয়োকোসুকাতে হাজির হলাম। এর আগে যে রেঁস্তোরাতে নেমেছিলাম সেটা চোখে পড়লো। মনে পড়লো, ওখানে কেউ একজন আমার এমআর- এস গাড়িটাকে স্প্রে পেইন্ট করে নষ্ট করে দিয়েছিল।

“তুমি আগেরবারের মতো আবার ওখানে অপেক্ষা করতে পারবে?” জুরি জিজ্ঞেস করলো।

“না, জায়গাটা আমার জন্য কুফা। তাই কাছাকাছি কোথাও পার্ক করবো।”

“কাছাকাছি বলতে…”

“ইউকির বাসার কাছে। অত বড়ো ব্যাগ বহন করাটা তোমার জন্য কষ্টকর হবে, তাই না?”

“সমস্যা নেই। বরং তুমি এই টাইপ গাড়ি নিয়ে দাঁড়ালে আশেপাশের লোকজনের চোখে পড়ে যাবে।”

“তুমিই বরং লোকজনের চোখে পড়ে যাবে বলে আমার ভয় হচ্ছ। তুমি তো খালি প্যাকেজটা রুমে রেখে চলে আসবে, এই তো? তাই খানিকটা সময়ের জন্য পার্ক করলে কেউ কিছু মনে করবে না। রাস্তাটা দেখিয়ে দাও।”

“আচ্ছা, উম, সামনের ডানদিকের গলিটাতে ঢোকো।”

“ডানদিকে?” ব্লিংকার চালু করে ডানের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম।

কিন্তু এরপর থেকে বাকিটা পথ অসহনীয় ছিল। জুরির দিকনির্দেশনা অনেক বাজে ছিল। কোনদিকে মোড় নিতে হবে সেটাও সে মাঝেমাঝে ভুলে যেতে লাগল। অবশেষে তিরিশ মিনিট ঘোরাঘুরির পর আমরা বাসার সামনে পৌঁছালাম। জুরি অযুহাত দেখাতে লাগল সে নাকি কখনো ওখানে গাড়িতে করে যায়নি।

“তা সত্ত্বেও, অভিজ্ঞতাটা খুব বাজে ছিল। যাকগে, ওটাই তো সেই বাসাটা?” ডানদিকে তাকালাম। সাদারঙের একটা চারতলা বিল্ডিং চোখে পড়ছে। তবে বেশি ইউনিট চোখে পড়ছে না। মধ্যরাত হয়ে গেছে, তাই কেবল অর্ধেক সংখ্যক ঘরে বাতি জ্বলছিল।

“তাহলে আমি গেলাম।”

“সাবধানে যেও।”

গাড়ির ভেতর থেকে জুরির কাঁধটা দেখতে থাকলাম। সে টাকার ভারি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। সৌভাগ্যক্রমে রাস্তায় খুব বেশি লোকজন ছিল না। এত রাতে মানুষজন না থাকাটাই স্বাভাবিক। যাক, আমাদের কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়টা

আর করতে হচ্ছে না।

বিল্ডিংটার দিকে তাকালাম। রুম নম্বরটা ওকে জিজ্ঞেস করিনি, তাই জুরি কয়তলায় যাবে সেটা নিশ্চিত ছিলাম না। চারতলা বিল্ডিং তো, তাই হয়তো লিফটও নেই। অতবড়ো প্যাকেজটা ওঠাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হবে।

পাঁচমিনিট অপেক্ষার পর একটা জিনিস খটকা লাগলো। ব্যাপারটা কী? কোনো জানালাতে নতুন করে বাতি জ্বলতে দেখছি না। ইউকির রুম অন্ধকার থাকার কথা, তাই জুরি ঢোকার সাথে সাথে তাকে বাতি জ্বালাতে হবে।

নাকি অন্যপাশ থেকে দেখছি বলে সেটা চোখে পড়ছে না?

আরো পাঁচমিনিট পর জুরি বেরিয়ে এলো। সে জগিংয়ের গতিতে রাস্তা পার করে গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো।

“অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত,” সে প্যাসেঞ্জার সিটে বসতে বসতে বলল। লক্ষ করলাম, সে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে।

“ভালোমতো লুকিয়েছ তো?” গাড়িটা চালু করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম।

একদম নিখুঁতভাবে।”

““ইউকির বাবা-মা কিংবা অন্যকেউ সেটা খুঁজে বের করতে পারবে না তো?”

“সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। সে আমাকে বলেছে কখনো ওরকম হবে না। আর তাছাড়া কেউ ঢুকলেও সেটা সহজে খুঁজে বের করতে পারবে না।”

“ইউকির রুম কি অনেক বড়ো নাকি?”

“না। তবে সেখানে প্রচুর ফার্নিচার এলোমেলো করে সাজিয়ে রাখা।”

“আর ফ্লোর প্ল্যানটা কীরকম?”

“অ্যাঁ?”

“ইউকির রুমটা কী ধাঁচের সেটা জিজ্ঞেস করছি। স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট নাকি?”

“উম, হ্যাঁ হ্যাঁ। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“না, এখানকার অল্পবয়স্করা কীরকম রুমে থাকে জানতে মন চাইলো।”

যদি স্টুডিয়ো অ্যাপার্টমেন্ট হয়েই থাকে, তাহলে বাতি জ্বালালে বাইরে থেকে টের পাওয়ার কথা, ভাবলাম।

কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর জুরি বলে উঠলো, “অ্যাই, ঐ জায়গাটায় যাবে?”

“কোথায়?” ব্রেকে চাপ দিলাম।

“আরে, ঐ জায়গাটায়। মনে নেই? আমরা শেষবার যখন এখানে এসেছিলাম, ‘ঐ’ জায়গাটায় গিয়েছিলাম।”

“ওহ…” না, সেটার কথা ভুলিনি। “হঠাৎ এখানে কেন?”

“কারণ আজকের রাতটাই আমাদের একসাথে কাটানো সর্বশেষ রাত। এরপরে আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না।”

আমি চুপ করে রইলাম। সে ঠিকই বলছে। মনে মনে ভাবছিলাম তাকে কোথাও রেখে এসে তারপর কাতসুরাগিকে ফোন দেবো। এর মাধ্যমেই গোটা খেলাটার সমাপ্তি ঘটবে।

“ঐ স্মৃতিময় জায়গাটায় যেতে মন চাইছে।” সে কিছুটা লজ্জার সুরে বলল।

আমি ব্রেক প্যাডাল থেকে পা উঠিয়ে নিলাম। ইয়োকোসুকা এলাকাটাকে আমরা পুলিশকে ফাঁদে ফেলার জন্য ব্যবহার করছি, তাই এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, কিছুক্ষণের জন্য থাকলে সমস্যা হবে না। সে যা বলেছে তা একদম সত্যি। আজকের রাতটা আসলেই আমাদের একসাথে কাটানো সর্বশেষ রাত।

আধাঘণ্টা পর আমরা পৌঁছে গেলাম মিউরা পেনিনসুলার সেই অগ্রভাগে। সে রাতের মতো আজকেও গাড়ির ছাদটা খুলে দিলাম। ঘাসের সোঁদা গন্ধটা নাক দিয়ে টেনে নিলাম। পাশে থাকা জুরিও তাই করছিল।

দুর্ভাগ্যক্রমে আজকের আকাশটা মেঘে ঢাকা ছিল। তাই তারা দেখার সুযোগ মিলল না।

“অল্প সময় আমরা একসাথে কাটিয়েছি, কিন্তু প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার আনন্দে কেটেছে।” জুরি আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

“দুর্দান্ত একটা খেলা খেলেছি আমরা।”

“আমার মনে হয় আগামীকালের পর থেকে প্রত্যেকটা দিন আমার বিরক্তিকর কাটবে।”

“না, বিরক্তিকর কাটবে না। বারবার তোমাকে একই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমার কিন্তু আরো অনেক কাজ বাকি।”

“সেটা কিছুই না। এতদিন যা যা করে এসেছি, তার সাথে তুলনা করলে কিছুই মনে হচ্ছে না।”

“যাক, শুনে আশান্বিত হলাম।” হেসে ফেললাম।

“সাকুমা।” তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। “সবকিছুর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”

“ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমিও তো এই খেলায় অংশ নিয়ে প্রচুর মজা পেয়েছি। অনেকদিন হলো এরকম জীবন বাজি রেখে খেলায় অংশ নেই না।”

“তার ওপর তুমি খেলাটায় জিততেও পেরেছ।”

“তা তো অবশ্যই।”

আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম।

“না, সত্যিই কিন্তু, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।” জুরি বলল। “তোমার কারণেই আমি বেঁচে গেলাম।”

“কথাটা একটু বেশি বেশি হয়ে গেল।”

“কিন্তু আমি তো সত্যিই…অবশ্য আমার অবস্থা তুমি কীভাবেই বা বুঝবে।” জুরি ধীরে ধীরে বলল।

সে মুহূর্তে আমাদের চোখাচোখি হলো, আর আমরা চুম্বন করতে শুরু করলাম। তার ঠোঁটটা নরম তুলতুলে আর হালকা ভেজা ছিল। টের পেলাম, আমি শক্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার জামাকাপড় খোলার চেষ্টা করলাম না। কখন সীমা টানতে হয় তা বোঝাটা আমি অনেক জরুরি বলে মনে করি। আমাদের সম্পর্কটা এখানেই ছিন্ন করে ফেলতে হবে।

কিন্তু শেষবারের মতো জুরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এ কদিনে তার অনেকখানি ওজন কমে গেছে। “ধন্যবাদ,” সে আমার কানে ফিসফিস করলো।

.

ঐমিনামির উপকূলের রাস্তা ধরে শিনাগাওয়া স্টেশনের দিকে চললাম। কিন্তু সেখানে না থেমে গাড়ি থামালাম একটা বড়োসড়ো হোটেলের সামনে।

“আরেকবার সবকিছু বলো আমাকে,” তাকে বললাম।

“আবার? তুমি অনেক নাছোড়বান্দা একটা মানুষ।” জুরি কাষ্ঠহাসি হাসলো।

“এই সতর্কতাই আমাদেরকে বাঁচাবে। এ নিয়ে আর ঘ্যানঘ্যান কোরো না-যা জিজ্ঞেস করছি বলো।”

“যখন আমি চেতনা ফিরে পেলাম…” তার চোখ দূরের কোথায় যেন চলে গেল। “আমি একটা গাড়িতে শুয়ে ছিলাম। বোধহয় মার্সিডিজ ছিল ওটা। আমার হাত-পা তখন খোলা ছিল, আশেপাশে কেউ ছিল না। তাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল, কিন্তু এরকম সুযোগ আর পাবো না ভেবে জীবনরক্ষার তাগিদে দৌড়াতে শুরু করলাম। তাই গাড়ির প্লেট নম্বরটা দেখার সুযোগ মেলেনি। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, আমি একটা পার্কিং লটে অবস্থান করছি। সঠিক করে বলতে গেলে একটা হোটেলের বেসমেন্টের পার্কিং লটে। এলিভেটর ব্যবহার করে হোটেলটার লবিতে গেলাম, কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেছে বিধায় কেউ ওখানে ছিল না। তাই মূল গেট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি পিকআপের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার কাছে টাকা আছে কি নেই, সেসব নিয়ে একবারও ভাবিনি। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, বাড়ি ফিরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালো। “কি, কোনো ভুল করিনি তো?”

“নাহ, চমৎকার হয়েছে।” তাকে বাহবা দিলাম।

“চিঠিটা এনেছো তো?”

“হ্যাঁ আছে।”

তার দিকে একটা চিঠি বাড়িয়ে দিলাম। কম্পিউটারে টাইপ করে প্রিন্ট করিয়ে নিয়েছিলাম। চিঠিটাতে লেখা ছিল—

মিস্টার কাতসুতোশি কাতসুরাগি,

আমরা মুক্তিপণের টাকা বুঝে পেয়েছি। আমাদের ওয়াদাটাও রাখলাম। আপনার কন্যা জুরি কাতসুরাগিকে অক্ষত শরীরে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তার সাথে আমরা খারাপ আচরণ করেছি কিনা তা ওর মুখ থেকে শুনে নেবেন। পুরো ঘটনাটা একটা চমৎকার ব্যবসায়িক রীতিতে সম্পন্ন হয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে।

একটা চমৎকার খেলা ছিল এটা। খেলার অবশেষে সমাপ্তি ঘটেছে বলে ধরে নিচ্ছি। এরপর আমাদের পক্ষ থেকে আপনার সাথে আর যোগাযোগ করা হবে না। আপনার কাছে ওয়াদা করছি, আর কখনো আপনাকে এরকম খেলাতে অংশ নেবার জন্য বেছে নেবো না।

ইতি, কিডন্যাপাররা

“অবশেষে সময় হয়ে এসেছে,” আমি বললাম।

“হুম। ভালো থেকো।”

“তুমিও ভালো থেকো। শুভকামনা রইল।”

দুজনে করমর্দন করলাম। অনেকক্ষণ ধরে সে হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ি থেকে বের হলো। ধন্যবাদ, ভালো থাকবে বলে সে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি গাড়ি চালাতে শুরু করলাম।

চোখের সামনে রাতের শহরটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *