অ্যা কিডন্যাপিং – ১২

বারো

বাথরুম থেকে জুরি কালো কুচকুচে চুল নিয়ে বের হলো। আগের তুলনায় অবশ্য এটাকে বেশি চকচকে দেখাচ্ছে। তাতে সমস্যা নেই। অন্তত গতকালকের সেই সোনালি চুল থেকে এটা হাজারগুন ভালো।

“এটাই তোমার সাথে মানিয়ে যায়,” বলে উঠলাম। “জাপানিজদের আসলে সোনালি চুলে মানায় না।”

“বড়োরা সবসময় ও কথাই বলে।”

“তুমি বড়ো নও?”

“বড়ো, মানে বুড়োরা।”

“যেসব জাপানিজদের থ্যাবড়া মুখ আর সোনালি চুল নিয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে দেখি, তাদের দেখে লজ্জ্বা লাগে আমার। তাদের দেখলে মনে হয় তারা যেন একটা ওয়েস্টার্ন কমপ্লেক্সে ভুগছে।” সে রেগে যাচ্ছে টের পেয়ে তাড়াতাড়ি আরো কয়েকটা কথা যোগ করলাম, “আমি সব যুবক-যুবতিদের কথা বলছি না। আর তোমার মুখ কোনোভাবেই থ্যাবড়া নয়। তবে সেটা যে ককেশিয়ানদের মতোও নয়, সেটা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে।”

শেষের অংশটার জন্যই হয়তো তার মুখ থেকে রাগটা পুরোপুরি দূর হলো না। সে অভদ্রের মতো সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলো, “নতুন কোনো আইডিয়া পেলে?”

“এখনো চিন্তা করছি।”

“এখনো চিন্তা করছো? আমাদের হাতে চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময় রয়েছে।” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, “পোস্টটা সকাল ছটায় দেওয়া হয়েছে, তারমানে আমাদের হাতে আর কেবল সতেরো ঘণ্টা রয়েছে।”

“ওটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

“কিন্তু পাপা তো বলল, এর মধ্যে তার সাথে যোগাযোগ না করা হলে তিনি পুলিশদের কাছে যাবেন…”

এক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলাম। তারপর স্টেরিও রিমোটটা হাতে নিলাম। ‘ফ্যান্টম অব দি অপেরা’র মাঝামাঝি থেকে সিডি চলতে শুরু করলো। এর মিউজিক্যালটা আমার প্রচণ্ড ভালো লাগে। বেশ কয়েকবার সেটা দেখেছি। গল্পটা একজন কুৎসিত মানুষকে কেন্দ্র করে এগিয়েছিল, যে তার এই কুৎসিত চেহারাটা ঢেকে মানুষের থেকে আলাদা কিছু একটা হতে চেয়েছিল।

প্রত্যেকবার এটা দেখার সময় একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে যায়—সেই একমাত্র মুখোশধারী নয়

তবে আমি ‘তাদের’ সাথে যোগাযোগ করব বলে দিলাম। মানে? তিনি পুলিশদের সাথে যোগাযোগ করবেন? মজা নিচ্ছে নাকি—এখনো সে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেনি? এ কথাটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? এরকম হুমকি দেওয়ার কেবল একটাই মানে হতে পারে, তিনি কিডন্যাপারদের তেমন কিছুই মনে করছেন না।

তারপরেও কেন জানি নিশ্চিত হতে পারলাম না। হাকোজাকি জংশনের সেই অপারেশনের সময়েই লক্ষ করেছি, পুলিশের কোনো গাড়ি তাকে অনুসরণ করেনি। তারমানে…তিনি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেননি?

হয়তো।

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালাম। কোনোমতেই না। এটা একটা ফাঁদ। তারা আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যাতে আমরা, মানে কিডন্যাপাররা তাড়াহুড়ো করে বড়ো কোনো ভুল করে বসি।

“গতকালকে যখন পাপা কাজটা করছিলেন, তখনই তোমার টাকাটা সংগ্রহ করে ফেলা উচিত ছিল।” জুরি বলল।

“কোন কাজ?”

“ঐ যে, হাকোজাকি জংশনে চক্রাকারে ঘোরার সময়। তখনই তো দেখেছ যে, তার পেছনে কোনো ফেউ লাগেনি। তাকে ফোন করে ওখানেই কোথাও গাড়ি পার্ক

করে সেখান থেকে চলে যেতে বলতে। পাপা চলে যাওয়ার পর আমরা সেখান থেকে টাকাটা তুলে নিয়ে কিংবা গাড়িসুদ্ধই সেখান থেকে চম্পট দিতাম।”

“বোকার মতো কথাবার্তা। পুলিশ সাথে সাথে আমাদের অনুসরণ করা শুরু করতো।”

“পুলিশ কোথায়? আমার তো কোনো পুলিশ দেখিনি।”

“চর্মচক্ষে দেখতে পাওনি, তারমানে এই না যে, তারা একদমই ছিল না। কোথাও না কোথাও থেকে তারা মার্সিডিজের ওপর নজর রাখছিল—সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।”

ভেবে দেখেছিলাম, তারা হয়তো মেট্রোপলিটন এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন ইন্টারচেঞ্জে নজর রেখেছিল। সতর্কতার খাতিরে আমি এটাও ধরে নিয়েছিলাম যে, কাতসুরাগির সাথে আমাদের যে বাক্য বিনিময় হয়েছে, সেসময়েও তারা কোনো না কোনোভাবে আড়ি পেতে ছিল।

“ধরো, আমরা তাকে বললাম কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় মুক্তিপণের টাকা নিয়ে হাজির হতে।” তাকে বোঝানো শুরু করলাম। “তাকে টাকাটা রেখে দিয়ে ঝটপট বিদায় হতেও বলে দিলাম। কিন্তু উদ্বেগহীনভাবে যদি আমরা সেখান থেকে টানা তুলে আনতে যাই, আমরা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাবো। বলতে পারবে কেন?”

“কারণ পুলিশ ওঁত পেতে ছিল।”

“যাক, ধরতে পেরেছ। ডিটেকটিভরা কালপ্রিটকে হাতেনাতে ধরার জন্য বসে থাকবে। তাদের কথা অনুযায়ী, কিডন্যাপারকে ধরার সবচেয়ে মোক্ষম সময় হচ্ছে ওটা তাহলে আরেকটা প্রশ্ন রাখছি তোমার সামনে : পুলিশ কীভাবে জানতে পারলো জায়গাটার কথা?”

“এটা তো খুবই সহজ। কারণ ভিক্টিমের পরিবার তাদের জানিয়ে দিয়েছে।”

“একদম। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, কেন শেষ মুহূর্তে লোকেশন বলাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আবার এখানে একটা প্যাঁচ রয়েছে। যদি কিছুই না বলো তবে যে টাকা নিয়ে বের হয়েছে, সে কোথায় যাবে সে ব্যাপারে পুরো অন্ধ থাকে। দুটো দিকেই বিপদ আছে।”

“তাহলে মূল লোকেশনটা না বলে সেই এলাকায় আসতে বলবে। তারপর কাছাকাছি আসলে তাদের সঠিক লোকেশনটা বলে দেবে।”

“বলাটা সহজ, কিন্তু পরিস্থিতি কখনো এত সোজাভাবে আগায় না। তোমাকে সবসময় ধরে নিতেই হবে যে, পুলিশ তোমার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর কড়া নজর রাখছে। আর তারা তোমার প্রতিটা কাজ হওয়ার কয়েক মিনিটের মাঝেই প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাও ধরে নেবে। তাই সবকিছু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় সেরে নিতে হবে।”

“আর তুমি সেটা নিয়েই এখন ভাবছ?”

“হ্যাঁ। এতক্ষণে পরিকল্পনাটাকে একটা আবছা আকৃতি দিতে পেরেছি। যাক, এতদিনে পড়াশোনাটা কাজে লাগল।”

“পড়াশোনা?”

“একটু পরেই দেখতে পাবে।”

কম্পিউটার চালু করে কিবোর্ডে খটাখট করে নিচের মেসেজটা লিখলাম—

জনাব কাতসুতোশি কাতসুরাগি,

দুর্ভাগ্যবশত গতকাল আমরা পরিকল্পনা মোতাবেক আগাতে পারিনি। পুলিশ থাকার কারণেই আমরা শেষমুহূর্তে এভাবে সেটা বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আপনাকে পর্যবেক্ষণ করার সময়ে আমরা তাদের সূক্ষ্ম অস্তিত্ব টের পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। আপনি কি আসলেই তাদের সাথে কাজ করছেন কিনা সে বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত না। তবে যদি করে থাকেন এবং তারা ইনভেস্টিগেশন শুরু করে থাকে, তবে সেটা দুঃখের ব্যাপার হবে। সাথে সাথে আমরা আমাদের এই ডিল বন্ধ করে দেবো। জুরি কাতসুরাগি আর কখনোই আপনাদের কাছে ফিরে যাবে না।

আমরা আপনাকে আবার সতর্ক করে দিচ্ছি। পুলিশকে এর মধ্যে জড়াবেন না। যদি পরের বারেও আমরা কোনোভাবে তাদের অস্তিত্ব টের পাই, আমরা সাথে সাথে সেটাও বাতিল করে দেবো। আপনার সাথে আর

যোগাযোগ করা হবে না, নতুন করে সুযোগও দেওয়া হবে না।

সহজ ভাষায়, আমাদের দুপক্ষের জন্য এটাই সর্বশেষ সুযোগ। আপনাকে বেশ কয়েকটা নির্দেশনা দেবো। আশা করি কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই আপনি সেগুলো মেনে চলবেন।

১. পুরো টাকাটা যতটা ছোটো ব্যাগে পারেন, ভরে ফেলুন। একটা স্যুটকেস হলেই ভালো হবে বলে আমরা মনে করি। স্যুটকেস লক করতে হবে না, তবে হ্যাঁ, নোটগুলোকে একটা কালো প্লাস্টিকের মোড়কে আবৃত করে রাখবেন। তাহলে স্যুটকেস খুললেও যাতে সহজে ভেতরের জিনিস বোঝা না যায়। আর কোনোভাবে এর ভেতরে ট্রান্সমিটার ঢোকাবেন না। যদি কোনোভাবে আমাদের মনে হয় যে ভেতরে ট্রান্সমিটার দেওয়া হয়েছে, তবে সেটা আমাদের মধ্যকার চুক্তিটাকে ভঙ্গ করেছে বলে ধরে নেবো। ট্রান্সমিটার আছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করার জন্য আমরা একটা ব্যবস্থাও করে রেখেছি।

২. একটা নোটপ্যাড, লেখার সরঞ্জাম আর একটা সেলোফোন টেপ সাথে রাখবেন।

৩. এবার ব্যাগটা বহন করবেন আপনার স্ত্রী। আর তিনি তার বিএমডব্লিউ গাড়িটা চালাবেন। পূর্বের বলা কথাগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি : গাড়ি কিংবা স্ত্রী কারো কাছেই যেন ট্রান্সমিটার না থাকে। যদি ট্রান্সমিটার আছে বলে আঁচ করতে পারি, তবে ডিল ভেঙে দেওয়া হবে।

৪. স্ত্রীর জন্য আলাদা একটা ফোনের ব্যবস্থা করবেন। নম্বরটা আগের বারের মতোই ওয়েবসাইটে দেবেন।

আমরা আবার চব্বিশ ঘণ্টা পর আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবো। সেটার জন্য অপেক্ষা করবেন।

পুরো লেখাটা চারবার পড়ার পর নকল নাম ব্যবহার করে আরেকটা অ্যাকাউন্ট বানিয়ে মেইল আকারে পাঠিয়ে দিলাম। আর পিছিয়ে যাওয়া যাবে না।

“ট্রান্সমিটার আছে কিনা, সেটা কীভাবে পরীক্ষা করবে?”

“সেটা করার অনেকগুলো পদ্ধতি আছে। একটা মেটাল ডিটেক্টর দিয়েও সেটা করা যাবে। কিংবা একটা রেডিয়ো ওয়েভ ডিটেক্টর ব্যবহার করলেও হবে।”

“কিন্তু টাকাটা হাতে না আসা পর্যন্ত তো সেটা পরীক্ষা করা যাবে না।” মুচকি হাসলাম। “তা সত্য।’

“তাহলে এতগুলো নির্দেশনা দেবার মানে কী? অর্থহীন হয়ে গেল না পুরো ব্যাপারটা?”

“নির্দেশনাগুলো অনেকটা হুমকির মতো কাজ করবে। আমরা কী করব না করব, সেটা তারা জানে না। তাই তারা ওগুলো মেনে চলতে বাধ্য হবে।”

“তারা যে মানবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত তো?” জুরি একটু সন্দেহের সুরে বলল।

“আমার মনে হচ্ছে, টাকার ভেতর কোনো ধরনের ট্রান্সমিটার থাকবে না। টাকা অদলবদল হবার পর যদি কালপ্রিট ট্রান্সমিটার খুঁজে পেয়ে ক্ষেপে যায়, তবে তাদেরই ক্ষতি। তাই যদি তারা ট্রান্সমিটার লাগাতে চায়, তবে সেটা গাড়িতে কিংবা যে বহন করবে তার গায়ে লাগাবে বলে মনে হচ্ছে।”

“তারমানে মা কিংবা বিএমডব্লিউ।”

“সেজন্য আমাদের আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতোমধ্যে একটা পরিকল্পনা মাথায় এসেছে।”

“আমাকে বলো।”

“উঁহু, অপেক্ষা করো, ধীরে ধীরে বুঝে যাবে।”

“আবার একই কথা?” জুরি ক্লান্তমুখে বলল। “এরকম বারবার ঢং না ধরলে হয় না? ব্যাপারটাতে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। আমি কি তোমার পার্টনার নই?”

“তুমি আমার একমাত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পার্টনার। তোমাকে ছাড়া এই পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। না, ভুল বললাম, তোমাকে ছাড়া এই পরিকল্পনাটা চিন্তাও করা সম্ভব নয়। আগেই বলে রাখছি, এবারে তোমার কাজও কিন্তু অনেক বেশি।”

আমার কথায় সে একটু আশ্বস্ত হয়েছে বোঝা গেল। তার বড়ো বড়ো চোখদুটো চিকমিক করতে লাগল। তবে তার মধ্যে খানিকটা অস্থিরতাও টের পাওয়া যাচ্ছিল।

“আমাকে কী করতে হবে?”

“তোমাকে অভিনয় করতে হবে।” সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। “অনেক বড়ো একটা পার্টের অভিনয়। অনেক বড়ো।”

পরের দিন, মানে সোমবারে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস অনুযায়ী ব্যায়াম করা শুরু করলাম। তবে তার মানে এই না যে, গতরাতে আমার ভালো ঘুম হয়েছে। সারাটা রাত আমি আমার পরিকল্পনার শেষ পর্যায়ের বাস্তবায়নের খুশিতে উত্তেজিত ছিলাম। তাই ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলেও হঠাৎ করে জেগে গেছি। ফলে মাথাটা এখন ভারি ভারি লাগছে।

চোখমুখ ধুয়ে আমার রেগুলার ব্যায়াম করছি, এমন সময় বিছানা থেকে জুরি আমাকে ডাক দিলো।

“এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল?”

জুরিকে দেখে মনে হলো তারও ভালোমতো ঘুম হয়নি। চোখদুটো লাল হয়ে আছে।

“কাজে যেতে হবে যে।”

“কাজ? এরকম একটা দিনে?”

“এরকম বড়ো একটা দিন বলেই কাজে যেতে হবে। স্বাভাবিকের ব্যতিক্রম কোনোমতেই করা যাবে না। পরে কোনো কারণে তারা আমাকে সন্দেহ করলে যদি দেখে এদিনে ছুটি নিয়েছিলাম তবে ঝামেলায় পড়ে যাবো।”

“তোমাকে সন্দেহ করবে? সত্যি?”

“সেটা…” বুকডন দিতে দিতে বললাম, “সেটা করলেই খুবই অস্বাভাবিক হবে।”

“তাহলে…”

“সমস্যা নেই।” বললাম। “আজকে সোমবার, অন্যান্য দিনের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাই স্বাভাবিকের মতোই আমি কাজে যাবো, মিটিং করবো, বিভিন্ন প্রপোজাল সামলাবো। সামান্য একটা খেলার জন্য সেটা বন্ধ করা ঠিক হবে না।”

আমার কথা সে ধরতে পেরেছে কিনা, তা বুঝতে পারলাম না। তবে সে চুপ হয়ে গেল।

ব্রেকফাস্টের পর আমরা আমাদের পরিকল্পনাটা তৈরি করে ফেললাম। আমি কাজ থেকে ফেরার পরই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করবো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে ওভারটাইম করবো না।

অফিসে পৌঁছাতেই দেখলাম, টেবিলে কাজের পাহাড় জমে আছে। ঐ বুদ্ধিহীন আইডলের একটা প্রোমো বানানোর মিটিংয়ে যোগদান করতে হবে। আইডলের প্রত্যেকটা নাচগানের সময় তার পাশে তার গেমের চরিত্রটাও এসে যোগ দেবে—এই ছিল তাদের আইডিয়া। কিন্তু এই আইডিয়াটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলোও একই কাজ করছে, তাই কাজটায় কোনো নতুনত্ব নেই। যখন আমার মতামত জানতে চাওয়া হলো, আমি ঠিক তাই বললাম। যিনি মিটিংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি ফস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমার কোনো আইডিয়া আছে কিনা।

“কয়েকজন একইরকম দেখতে মেয়েকে জোগাড় করলে কেমন হয়?” আমি মাথায় যেটা এলো, সেটাই তাদের সামনে ছুঁড়ে দিলাম। “একইরকম শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আর একই রকম মুখায়ব বিশিষ্ট মেয়েদের জোগাড় করে তাদেরকে হালকা মেকআপ করালে তাদের সবার চেহারা একদম মিলে যাবে। আসলজনসহ দশজনকে লাইন করে দাঁড়িয়ে রাখা হবে। সবার মনে একই প্রশ্ন জাগবে—কোনটা আসল? শুরুর দিকে কিছুই বলা হবে না। ধীরে ধীরে সেটা বোঝা যাবে। এটা যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে আমি নিশ্চিত মিডিয়ায় হইচই পড়ে যাবে।”

হ্যাঁ, হইচই হবে ঠিক আছে, কিন্তু আইডলের আখেরে তেমন উন্নতি হবে না, একজন বলে উঠল। ওটাকে নিতান্ত একটা স্টান্টবাজি বলেই মনে রাখবে। তাই এটা বাস্তবায়িত করলে স্টান্টের বেশি কিছু হওয়া সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।

তর্কে গেলাম না। মানুষটা ভুল বলেনি। কিন্তু তার চিন্তাধারাতে খানিকটা ভুল আছে। তার মতামত অনুযায়ী আইডলরা কেবল স্টান্টবাজিই করে না, আরো অনেক কিছু করে। তারপরেও গোটা মিটিং চুপ থাকলাম। কারণ, এ কাজটায় আমার মতামতের তেমন একটা মূল্য নেই।

মিটিং শেষে চুপিসারে ইন্টারনেট চেক করলাম। সিপিটি মালিকদের ওয়েবসাইটের বুলেটিন বোর্ডে ‘জুলি’র নতুন পোস্ট দেখা যাচ্ছে। লক্ষ করলাম, এই ওয়েবসাইটে ঘন ঘন পোস্ট হবার কারণে দর্শকসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বোধহয় অনেকে জুলি নামধারী এই ইউজারের ওপর অনেকে সন্দেহ করা শুরু করেছে।

.

অবশেষে (ইউজারনেম জুলি)

হ্যালো। আমার কন্টাক্টের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তারা এবার গোটা চুক্তিটা সম্পন্ন করতে রাজি হয়েছে। তবে এবারে তারা নানান শর্ত জুড়ে দিয়েছে। অথচ আমি তাদের বারবার একই কথা বলে আসছি, যা ইচ্ছা শর্ত জুড়ে দিন, কেবল গাড়িটা হাতে পেলেই হলো। তারা আমাকে এতটা অপেক্ষা করিয়েছে যে, ইতোমধ্যে লাইসেন্স প্লেট নম্বরটা পালটে গেছে।

এখন সেটা 8xxx আর ৭xxx ।

আর তর সইছে না। কখন যে কাগজপত্রে সাক্ষর করে সবকিছু বুঝে নেবো!

.

ওখানে লেখা নম্বরটা টুকে নিলাম। ওটা বোধহয় কাতসুরাগির স্ত্রীর নম্বর। যাক, সব কিছু আমার হাতে চলে এসেছে।

ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেখলাম, কোজুকা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কম্পিউটারে নতুন করে একটা প্রোপোজালের উইন্ডো খুললাম।

“কী অবস্থা?” কোজুকা জোর করে হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলেন। এর মানে কেবল একটাই হতে পারে, আমার জন্য কোনো খারাপ খবর অপেক্ষা করছে।

“আমি বেশ সুখেই আছি। নতুন প্রজেক্টে বিপুল উদ্দমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।” যদি সে আমার ব্যঙ্গ করে বলা কথাগুলো ধরতে পারে, তবে প্রচণ্ড খুশি হবো। সেজন্যই কথাগুলো বলা।

কোজুকা আমার কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকালেন। “মনে হচ্ছে ঐ আইডল, মানে ইউমি কুরিহারার প্রোমোর কাজটাতে তুমি খুব একটা উৎসাহী নও।”

বোধহয় স্টাফ মিটিংয়ে আমার বলা কথাগুলো তার কানে গেছে। এই অপবাদটা কীভাবে তার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। “মোটেই নয়। কাজটাতে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিচ্ছি। নতুন নতুন আইডিয়া বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

“একই চেহারার দশজন থাকার আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়, স্বীকার করছি।”

একটা মেকি হাসি দিলাম। সে আমাকে করুণা করে উৎসাহ দিচ্ছে। এ কারণে রেগে গেলাম না, বরং নিজের জন্য কেমন জানি দুঃখবোধ হতে লাগল। আমি কবে অপদার্থদের কাতারে চলে গেলাম?

“তিনটার পর থেকে তুমি আমার সাথে থাকবে। এক জায়গায় যেতে হবে।”

“কোথায়?”

“নিসেই অটোমোবাইল-এর হেডকোয়াটারে।”

থতমত খেয়ে কোজুকার দিকে তাকালাম। সে আমার থেকে চোখ এড়িয়ে কথাগুলো বলছে। “ব্যাপারটা কি আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে না? আমাকে লাথি মেরে বের করে দিল, কিন্তু ঠিকই একটু পরপর আমাকে তাদের সামনে ডেকে পাঠাচ্ছে। তাদের সমস্যাটা কী?”

“সত্যি বলতে, ওরা এরকম কেন করছে সেটা আমারো জানা নেই। এটেন্ডেন্স লিস্টে তোমার নাম দেখলাম। তাই তোমাকে জানাতে এলাম।”

“কার মনের খেয়ালে আমার নাম এলো? মিস্টার কাতসুরাগি নাকি?”

“কে জানে। শুনেছি, তিনিও নাকি মিটিংয়ে যোগ দেবেন। তাই চাইলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”

“মিস্টার কাতসুরাগি মিটিংয়ে থাকবেন? আপনার কোনো ভুল হয়নিতো?”

“না, ভুল হয়নি। ফ্যাক্সটা মাত্র পেয়েছি।”

শোনার পরও কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। মানুষটা মনে মনে কী ভাবছে? তার কন্যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, টাকা অদলবদলের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে—আর তিনি কিনা চিন্তামুক্তভাবে মিটিংয়ে যোগ দেবেন? নাকি তিনি আগেই ধরে রেখেছেন, সেটা মিটিংয়ের আগেই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে? তারপরেও কেমন জানি ব্যাপারটা, মনে মনে ভাবলাম।

“কী করবে? যদি যোগ না দিতে চাও, আমি তোমাকে জোর করবো না। মানা করলেও সমস্যা নেই। তুমি অন্য একটা কাজে ব্যস্ত আছো অযুহাত দেখালেই চলবে। ওরাই তোমাকে টিম থেকে বের করে দিয়েছে। তাই মানা করে দিলে তোমাকে দোষ দিতে পারব না।”

“না, আমি যাবো,” বললাম। “মিস্টার কাতসুরাগির চাঁদবদনখানি দেখলে মন্দ হবে না।”

কথাগুলো কোজুকা কোন অর্থে নিলেন তা বুঝতে পারলাম না। তবে তিনি দাঁত বের করে হেসে আমার পিঠে চাপড় দিয়ে তার অফিসে ফিরে গেলেন।

ঘড়িতে তিনটা পার হতেই আমি, কোজুকা আর কয়েকজন অফিসকর্মী নিসেই অটোমোবাইল-এর হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সুগিমোতো আমাকে অগ্রাহ্য করছে। মনে মনে বোধহয় ভাবছে, এই ব্যাটা এখানে কেন?

ট্রাফিক কম থাকায় আমরা বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। সুগিমোতো আর বাকিরা সবাই মিটিং রুমে ঢুকে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমার কোনো কাজ ছিল না, তাই সেখান থেকে বের হয়ে নিকটবর্তী ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা ইন্সট্যান্ট কফি কিনে স্মোকিং জোনে চলে গেলাম। কতগুলো গাছপালা দিয়ে সেটাকে সাজানো হয়েছিল। দেখলাম, কোজুকা সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে।

“সুগিমোতো আর অন্যরা বলছিল যে, নিসেইতে কোনো ধরনের সমস্যা হয়েছে।” সে আমাকে দেখে বলে উঠল।

“মানে?”

“আমার মনে হয় নিসেই এখন চলার দিকটা হারিয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে তারা কাজের ফোকাসও হারিয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে, মন্দার প্রভাব প্রভাবশালী নিসেইকেও ছাড় দেয়নি।”

নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম। তবে আমার মনে হয়, শুধু মন্দার কারণেই নিসেই কাবু হয়ে যায়নি। কাতসুরাগির মনের অবস্থাও কাবু হয়ে গেছে।

যখন ভাবলাম তার কাছে আরো কিছু জিজ্ঞেস করবো, তখনই টের পেলাম তার মুখচোখ শক্ত হয়ে গেছে। চট করে বুঝে গেলাম আমার পেছনে কে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে দাঁড়ালাম। কাতসুতোশি কাতসুরাগি পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *