অ্যা কিডন্যাপিং – ১১

এগারো

স্ক্রিনে হাকোজাকি জংশনটা দেখতে পেলাম। বেশ কয়েকবার ঘুরতে দেখলাম মার্সিডিজ গাড়িটাকে। আরো কয়েকটা গাড়িও ক্যামেরার সামনে পার হয়ে গেল। তবে ক্যামেরাতে একমাত্র কাতসুরাগির গাড়িটাই দেখা গেল একের অধিকবার।

“অদ্ভুত তো। কেবল মার্সিডিজ গাড়িটাই দেখতে পাচ্ছি।”

হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় ফিরে এলাম। পরদিন সকালে চেক-আউট, তাই সকালে গিয়েই চেক-আউট করে আসবো। সন্ধ্যাতেই করে ফেললে সেটা হোটেলের লোকজনের কাছে সন্দেহজনক মনে হবে।

জুরি সময়ের সাথে সাথে আরো বেশি হতাশ হয়ে যাচ্ছিল। “কী অদ্ভুত? এবার তো আমাকে খুলে বলো।”

“ঐ চক্রাকার লেনে কেবল মার্সিডিজটাই ঘুরছে। সেটাই তো আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আরো তো গাড়ি থাকার কথা।”

“কই, করছে তো। অনেকগুলো ট্যাক্সি, এমনকি ট্রাকও তো রয়েছে সেখানে। অনেকগুলো।”

“সেগুলো তো কেবল একবার ঘুরেই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। একটা গাড়িই কেবল লেনটাতে চরকির মতো ঘুরছে, আর সেটা হলো তোমার পাপার মার্সিডিজ। আর কোনো গাড়ি সেটা করেনি।”

“সেটাই কি স্বাভাবিক না? একমাত্র পাপাকেই তো সেই নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল।”

“কিন্তু সেটাকে তো পেছন থেকে পুলিশদের অনুসরণ করার কথা।”

জুরির মুখ হা হয়ে গেল। অবশেষে সে আমার কথার মানে বুঝতে পেরেছে।

“যদি এরকম পরিস্থিতিতে দুটা কিংবা তিনটা পুলিশের গাড়ি মার্সিডিজের ঠিক পেছনে না থাকে কিংবা দূর থেকে অনুসরণ না করে—জিনিসটা তোমার অদ্ভুত লাগবে না? যদি কাছাকাছি না থাকে, তবে তারা কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারবে? কিন্তু ভিডিয়ো দেখে তো এরকম একটা গাড়িও চোখে পড়ছে না। সমস্যাটা কী?”

জুরি উত্তর না দিয়ে ওই অবস্থাতেই মাথা হেলালো। এখনো সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হয় না এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে রয়েছে।

“এখান থেকে কয়েকটা জিনিস অবশ্য আঁচ করে নিতে পারি,” বললাম। “এক হচ্ছে, যে-কোনো কারণেই হোক তাদের পেছনে কোনো ফেউ ছিল না। তারমানে ট্র্যাকিংয়ের জন্য আরো ভালো পদ্ধতি তাদের হাতে রয়েছে। ধরো, মার্সিডিজটার ভেতর হয়তো একজন গোয়েন্দা লুকিয়ে ছিল।”

“কে জানে লুকিয়ে ছিল কিনা।” জুরি আবার স্ক্রিনের দিকে তাকালো।

“পরীক্ষা করে দেখা যাক।”

ভিডিয়োর দৃশ্য থেকে একটা ছবি বেছে নিলাম। সেটাতে মার্সিডিজটা খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। যদিও কিছুটা ফাটা ফাটা লাগছিল ছবিটা, তবে এটাতেই গাড়িটাকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল।

“কাউকে তো ব্যাকসিটে দেখছি না।” বললাম।

“ট্রাঙ্কে লুকিয়ে নেই তো?”

“সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনশ মিলিয়ন ইয়েনের নোটভর্তি একটা ক্যাডি ব্যাগ আর আরেকটা ব্যাগ সেখানে রাখা হয়েছে। একজন মানুষ সেখানে চাপাচাপি করে বসে থাকলেও কাজের সময় সে ওখান থেকে বের হতেই পারবে না। সেজন্যই আমি ট্রাংকে দুটো ব্যাগই ভরতে বলেছিলাম।”

জুরি বুঝতে পেরে মাথা নাড়লো। সে আমার যুক্তিগুলো মেনে নিয়েছে। আস্তে আস্তে আমার প্রতি তার মনোভাব পাল্টাতে শুরু করেছে।

“আচ্ছা, গল্পের বই আর সিনেমায় পুলিশরা টাকার ভেতর একটা ট্রান্সমিটার ঢুকিয়ে দেয়। ওরাও হয়তো একই কাজ করছে।”

“হুম, ট্রান্সমিটারের ব্যাপারটা মাথায় রয়েছে।” তার সাথে একমত হলাম। “কিন্তু শুধু ট্রান্সমিটার দিয়েই এত বড়ো কাজ তাদের সারার কথা না। সাধারণত এইরকম পরিস্থিতিতে পেছনে পুলিশের ফেউও থাকার কথা। আবার এটাও হতে পারে যে, দূর থেকে গাড়িটাকে তারা নজরে রাখছিল।

“হয়তো রাখছিল।”

“অসম্ভব। আমরা তাকে শুরুতে মুকোজিমা ইন্টারচেঞ্জে চলে যেতে বলেছিলাম। তাহলে হাকোজাকি জংশনে কীভাবে তারা নজরদারি রাখবে?”

“আমিও তোমার সাথে একমত…তাহলে…তোমার কী মনে হচ্ছে?”

“আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। সেজন্য একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। পুলিশগুলো তাহলে কোথায় লুকিয়ে ছিল?” ধপ করে সোফাতে বসে পড়লাম।

অবশ্য আরেকটা কারণও মাথায় এসেছে। সেটা এতটাই অসম্ভব ছিল যে, বলতেও সাহস পাচ্ছিলাম না। সেটা হলো, পুলিশ এসবের কিছুই জানে না। সহজ ভাষায়, কাতসুতোশি কাতসুরাগি ঘটনার পর কারো সাথেই যোগাযোগ করেননি। তাহলে তিনি একলা একলা মার্সিডিজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কেন? সেটাই তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো রহস্য বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু যা ভাবছি তা কি হওয়া সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। কোনোমতেই সে সম্ভাবনাটা ফেলে দেওয়া যায় না। হাজার হোক, কাতসুতোশি কাতসুরাগিও একজন বাবা। বোধহয় তার কন্যার জীবনটা বাঁচানোর জন্যই তিনি কিডন্যাপারদের কথামতো পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেননি। তার কাছে জুরির জীবনের মূল্যটাই সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে।

কিন্তু, মাথা চুলকালাম। তিনি তো ওরকম মানুষ নন। সামান্য একটা হুমকিতে তার কোনোমতেই ভয় পাবার কথা নয়। বরং যেভাবেই হোক কিডন্যাপারদের ঘোল খাইয়ে কন্যাকে উদ্ধার করার মতো মানুষ তিনি। আর সেটা করার জন্য তার পুলিশের সাহায্য লাগবেই। পুলিশ কোনো না কোনোভাবে তাকে সাহায্য করছে—সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। যখন কাতসুতোশি কাতসুরাগি চরকির মতো লেনে ঘুরেই যাচ্ছিল, তারা নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও বিরক্ত মুখে বসে বসে সব লক্ষ করছিল।

“তাহলে কখন পাবো ওটা?”

“কখন কী পাবে?”

“কখন টাকাটা আমরা সত্যি সত্যি হাতে পেতে যাচ্ছি? আর কিই বা জিজ্ঞেস করব আমি! নাকি সবাইকে আরো কয়েকবার নাকানি-চুবানি খাওয়াবে?” তার কথা শুনে বুঝতে পারলাম, আমার পদ্ধতিগুলো তার কাছে ভালো লাগছে না।

“আসলে আমি সবকিছু নিখুঁতভাবে করতে চাই। এসব কিন্তু তোমার জন্যও করছি। টাকাটা তো তোমার দরকার, তাই না? তুমি কাতসুরাগিদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাও—এ কথাটাও তো সত্য?”

“সবই সত্য। কিন্তু এভাবে ঢিলেঢালাভাবে কাজ করতে ভালো লাগছে না।”

“আমরা ঢিলেঢালা ভাবে কাজ করছি না। আমরা সতর্ক থাকছি। কারণ আমাদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে কাতসুতোশি কাতসুরাগির মতো একজন মানুষ।”

“তাহলে কখন পাবো টাকা?”

“এতটা অধৈর্য হচ্ছো কেন? তাড়াহুড়ো করে তো কোনো লাভ নেই। ট্রাম্প কার্ড এখনো আমাদের হাতেই রয়েছে। আমরা সঠিক সময় বেছে নিরাপদে সেটা হাতে নেবার ব্যবস্থা করবো।”

জুরি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো। তার ছোটো করে কাটা চুলগুলোও উদ্দাম হয়ে নেচে উঠলো। “তুমি হয়তো এটাকে খেলা ভেবে মজা নিতে পারছো, কিন্তু আমার কথাটাও তো একবার ভাবো। আমি আর এরকম অস্থিরতার মধ্যে থাকতে পারছি না। শান্তি ফিরে পেতে চাই আমি!”

কথাগুলো চিৎকার করে বলে সে হনহন করে বেডরুমে চলে গেল। এরকম প্রতিক্রিয়া যে তার কাছ থেকে পাবো, সেটা কিন্তু আশা করিনি। তার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এখন হঠাৎ করে এই চিৎকার-চেঁচামেচি করার কারণটা বোধগম্য হলো না।

বেডরুমে যেতেই দেখলাম, সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার পাশে বসে তার ডাই করা চুলগুলোতে হাত দিয়ে বিলি কাটতে লাগলাম। সে ইতোমধ্যে তার সাহসী দিকটা দেখিয়ে দিয়েছে, তাহলে হঠাৎ করে এই পরিবর্তন কেন?

জুরি দুহাত দিয়ে আমার গলাটা আঁকড়ে ধরলো। আমি নিঃশব্দে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। তারপর তার পুরো শরীরটা জড়িয়ে ধরলাম।

“আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো,” ফিসফিস করে বলল। “আমরা কেবল এই মুহূর্তের জন্যই একত্রে থাকতে পারবো।”

.

এভাবে মিলন করে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমার হাতটাকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে থাকা এই মেয়েটার প্রতি কেন আমি মনের অজান্তেই স্নেহার্দ্র হয়ে পড়ছি?

আমরা কেবল এই মুহূর্তের জন্যই একত্রে থাকতে পারবো, কথাটা সত্যি। খেলার সমাপ্তি ঘটলে হয়তো একে অপরের সাথে আমাদের আর দেখা হবে না। ওরকম বিপজ্জনক কিছু করা যাবে না। শুরু থেকেই সেটা ভেবে রেখেছি।

কিন্তু কিছুক্ষণ ধরেই একটা জিনিস আমার মনে খচখচ করছে। তার সাথে আমি আরো সময় কাটাতে চাই। শুধু সেটাই না। এই খেলা শেষেও যাতে আমি তার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি—এরকম চিন্তাও মাথার ভেতর ঘোরাফেরা করছিল।

এ তোমার কী হলো শুনসুকে সাকুমা? তুমি তো এরকম মানুষ নও।

পরবর্তী সকালে ঘুম থেকে উঠার পর জুরিকে পাশে দেখতে পেলাম না। বরং রান্নাঘর থেকে কফির সুমিষ্ট একটা গন্ধ ভেসে এলো।

বেডরুমের দোরগোড়া থেকে উঁকি মেরে দেখলাম, জুরি ডাইনিং টেবিল আর রান্নাঘরে ছোটাছুটি করে কাজ করছে। টেবিলে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা পদ সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

ক্যাবিনেটের ওপর রাখা ডিজিটাল ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে দোরগোড়া থেকেই তার দিকে ক্যামেরাটার লেন্স তাক করলাম। সে যখন ট্রে হাতে টেবিলে যাচ্ছিল, তখনই শাটারে ক্লিক করলাম। ফ্ল্যাশটা আগেই বন্ধ করে রেখেছিলাম বলে সে টের পায়নি। ক্যামেরার ডিসপ্লেতে ছবিটা দেখলাম। অস্পষ্ট হলেও জুরিকে অপরূপ দেখাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই কভার খুলে মেমোরি কার্ডটা বের করে নিলাম।

“ঘুম ভেঙেছে?”

জুরি আমার পায়ের শব্দ পেয়ে রান্নাঘর থেকে বলে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি করে ক্যামেরাটা ক্যাবিনেটে রেখে দিলাম। মেমোরি কার্ডটা এখনো আমার হাতের মুঠোয় রয়ে গেছে।

দরজা খুলে সে ভেতরে প্রবেশ করলো। আমি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম দেখে সে একটু অবাক হলো।

“কখন ঘুম থেকে উঠেছো?”

“এই তো, মাত্র উঠলাম। গন্ধ শুঁকেই টের পেয়েছি, তুমি আমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়েছো।”

“ঘরে বেকার হয়ে বসে আছি। তাই কিছুটা হলেও তো তোমাকে সাহায্য করতে চাই। তাছাড়া ক্রিম স্ট্যু খেতে খেতে বিরক্তি ধরে গেছে।”

জুরি ঘাড় ঘোরাতেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মেমোরি কার্ডটাকে একটা জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।

মেন্যুতে হ্যাম, ডিম, ভেজিটেবল স্যুপ, টোস্ট আর কফি দেখা যাচ্ছে। এটাকে অবশ্য রান্নাবান্না বলা চলে না, তবে ফ্রিজের যা অবস্থা তাতে এটাই রাজকীয় ভোজ বলে মনে হচ্ছে।

“মনে হচ্ছে আমি যেন একজন বিবাহিত পুরুষ।” টোস্টে কামড় দেবার পর বিড়বিড় করে বললাম।

“তুমি বিয়ে করোনি কেন?”

“আসলে, আমি জানতে চাই মানুষ কেন বিয়ে করে। যে মানুষটার প্রতি একসময় না একসময় বিরক্ত হবোই, সেই মানুষটার সাথে কীভাবে আমি সারাজীবন কাটাবো?”

“তারপরেও সেই মানুষটা অন্তত তোমাকে সারাজীবন সঙ্গ দেবে। তুমি যতই কুৎসিত একটা বুড়ো হও না কেন, তোমাকে একা থাকতে হবে না।”

“তার বিনিময়ে সে যতই কুৎসিত বুড়ি হোক না কেন, তার পাশে আমাকে থাকতে হবে। আর একসময় না একসময় সে চলে যাবে। তখন আমি আবার একা হয়ে যাবো। তাই বিয়ে করা বা না করা—সবই আমার কাছে এক মনে হয়।”

“কিন্তু তোমার বাচ্চাকাচ্চা থাকবে না? তোমার স্ত্রী মারা গেলেও তারা তো তোমার পাশে থাকবে।”

“সেটা কি বাস্তবে হয়? আমার কথাই ধরো।” হাতের কাঁটাচামচটা নিজের বুকে তাক করলাম। “আমার বাবা-মা আছেন। তা সত্ত্বেও আমি এভাবে একলা বাসা নিয়ে থাকছি। শেষবার তাদের সাথে বোধহয় বছরখানেক আগে কথা হয়েছে।”

“তুমি তাদের কাছে না থাকলেও ভালো আছো— হয়তো এটুকু জেনেই তোমার বাবা-মা সন্তুষ্ট থাকেন। হয়তো তুমি কীরকম জীবনযাপন করছো, সেটা কল্পনা করেই তারা নিজেদের সময়টা উপভোগ করেন।”

জুরির কথা শুনে বিষম খেয়ে গেলাম। কফির কাপটা মুখ থেকে সরিয়ে নিলাম। সে আমার দিকে এতে হাসার কী হলো ভঙ্গি করে তাকালো।

“তোমার মুখ থেকে ‘পরিবারের প্রয়োজনীয়তা’ শব্দটা মানায় না।”

জুরি চোখ নামিয়ে ফেলল। তার কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়া ঠিক হলো না।

ডিম ফাটিয়ে সেটার কুসুমটা হ্যামের ওপর ঢেলে মিক্স করে মুখে পুরলাম।

“তুমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলো না কেন?” সে ওভাবে চোখ নামিয়ে রেখেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

“তাদের সাথে আমার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। সোজা কথায় এই হচ্ছে কারণ। তাদেরকে আমার উপদ্রব বলেই মনে হয়। মাঝেমধ্যে টাকাপয়সার ব্যাপারে তাদের সাথে ফোনে আলাপ হয়। আর সেটার পালা চুকালে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার মতো কোনো টপিক খুঁজে পাই না।”

“তোমার বাড়ি কোথায়?”

“ইয়োকোহামাতে। মোতোমাচির কাছাকাছি একটা এলাকায় আমার বাড়ি।”

“এলাকাটা শুনেছি অনেক সুন্দর।”

“মেয়েরা ও কথা বলেই। বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে ওখানে ঘুরে বেড়ানো আর ওখানে বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জিনিস।”

“তারা কি ওখানে কোনো দোকানপাট চালান?”

“বাবা একজন সাধারণ চাকুরীজীবী ছিলেন। মোতোমাচির শপিং স্ট্রিটের সাথে কোনোভাবেই তিনি জড়িত ছিলেন না।”

“তোমার বাবা কি এখনো বেঁচে আছেন?”

আমি মাথা নাড়লাম। “তিনি আর বেঁচে নেই। আমি যখন এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ি, তখনই তিনি মারা গেছেন।”

“আচ্ছা…তাই।”

“বাবা-মা দুজনের মধ্যেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। বাবাই আমার দায়িত্ব নেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর আমি আবার মায়ের কাছে ফিরে যাই। সে সময়ে মা তার বাবার বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। তাই আমিও ওখানে গিয়ে তাদের সাথে থাকা শুরু করেছিলাম।

সেই পরিবার একটা ফার্নিচারের দোকান চালাতো। স্থানীয়দের মধ্যে দোকানটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। আমার নানা-নানীর শরীর স্বাস্থ্য ভালোই ছিল। তারা তাদের জেষ্ঠ্য পুত্রের সাথে থাকতেন। আমরাও, মানে আমি আর আমার মা সেই পরিবারে যোগ দিলাম। মা দোকানের কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি ঘরদোরও সামলাতেন। আমার মা যেখানে বড়ো হয়েছেন, সে বাড়িতে নিজেকে কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়নি। আমার নানা-নানী আমাকে ভালোবাসতেন, এমনকি বড়ো মামা আর মামীও আমাকে পছন্দ করতেন। তাদের এক ছেলে আর মেয়ে ছিল, যাদের কেউই আমাকে কখনো ‘আপদ’ মনে করেনি।

কিন্তু ধীরে ধীরে একদিন টের পেলাম, সবই ছিল কৃত্রিমভাবে তৈরি শান্তি।”

“মানে?”

“দিনশেষে আমি আর আমার মা দুজনেই তাদের কাছে আপদের মতো ছিলাম। অবশ্য তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যে-কোনো পরিবারে একজন সন্তানসহ ডিভোর্সি নারী সবসময় আপদের মতোই মনে হয়। মামীর সাথে আমার কোনো ধরনের রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাই তিনি আমাদের ওপর বেশ বিরক্ত ছিলেন। বাইরে থেকে কিন্তু সেটা বোঝা যেত না। তার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই সেটা পরোক্ষভাবে টের পাওয়া যেত। তাকে যখন আমি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম তখন একটা জিনিস টের পেয়েছিলাম। তার এই দুমুখো স্বভাবের শিকার শুধু আমরা নই, আরো অনেকেই এ তালিকায় রয়েছে। মামী ছিলেন একজন কঠোর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ। ব্যাবসাটা তিনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতেন। দোকানটা আমার মামা নয়, বরং মামীই পেছন থেকে চালাতেন। সেখানকার কর্মচারীরাও তাকেই বেশি বিশ্বাস করতো, তার ওপর আস্থা রাখতো। এ কারণে তার আত্মবিশ্বাসটা আরো বেড়ে যেত। ধীরে ধীরে আড়ালে থেকে ব্যবসায় সাহায্য করা বন্ধ করে সোজাসুজি সবার সামনে মামা আর আর নানুর ওপর সর্দারি করা শুরু করলেন। নানা-নানীর কাছে বিষয়টা ভালো ঠেকছিল না। তারা তাদের পুত্রের হাতে পুনরায় ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু মামা খুবই অপদার্থ একটা মানুষ ছিলেন। কোনোধরনের বাধাবিপত্তির শিকার হলেই তিনি তার স্ত্রীর আঁচলের তলায় লুকোতেন। জিনিসটা নানা-নানীর কাছে খুবই আপত্তিকর একটা বিষয় ছিল। তবে একসময় তারা হাল ছেড়ে দিলেন। যদি তাদের পুত্রবধূ তাদের অনিচ্ছাতেও দোকানটা চালায়, সেটাকে প্রচণ্ড অপছন্দ করলেও বাইরের কারো কাছে সেটা প্ৰকাশ করা চলবে না। সেজন্য আমাদের পরিবারে সবসময় একটা থমথমে আবহাওয়া বজায় থাকতো।”

বিশাল উত্তরটা দেবার পর শেষে যোগ করলাম। “বিরক্তিকর সব ব্যাপারস্যাপার।”

“না, বিরক্তিকর নয়। তখন তুমি কী করলে? আমি নিশ্চিত, ওরকম বড়ো মানুষদের সাথে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছিল।”

“ততটা কষ্ট কিন্তু মনে হয়নি। শুরুতে আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে সব কীভাবে চলছে তা বের করে ফেললাম। খুবই সোজা। সহজ করে বললে—আমি টের পেয়েছিলাম, এরকম পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য বেশ কয়েকটা নিয়ম মান্য করতে হয়। ওগুলো মানতে পারলেই আর কোনো সমস্যা হয় না।”

“নিয়ম?”

“পরিস্থিতি বুঝে সবাইকে একটা মুখোশ পরতে হতো। এমন কিছু করা যাবে না যাতে কারো সামনে সেই মুখোশটা খুলে যায়। কারো কাজে শক্তভাবে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানো যাবে না। সামান্য একটা মুখোশই তো, ভেবেছিলাম তখন। তাই আমিও সেরকম মুখোশ পরা শুরু করলাম।”

“কী ধরনের মুখোশ?”

“পরিস্থিতি অনুযায়ী মুখোশ পরতে হতো। ছোটোবেলায় সেটা ছিল বড়োদের প্রত্যাশা পূরণ করা। তবে শুধু ভালো ছেলে সেজে থাকলে কিন্তু চলবে না। ছোটোবেলায় আমি দুরন্ত, ডানপিটে ছেলের মুখোশ ধারণ করেছিলাম। কিছুদিন যাবার পর প্রতিবাদী, একগুঁয়ে কিশোরের মুখোশ। তারপর একে একে প্রাপ্তবয়স্ক হবার মুখোশ, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা যুবকের মুখোশ। যেটাই পরি না কেন, সেটাকে বড়োদের পরিচিত থাকতে হবে।”

“অবিশ্বাস্য…”

“না, তেমন বড়ো কোনো ব্যাপার ছিল না। আর ওভাবে মুখোশ পরে থাকাটাই আমার কাছে সোজা মনে হতো। যে যাই বলুক, সে তো আমাকে কথাগুলো বলছিল না; বলছিল আমার মুখোশকে। ভেতরে ভেতরে তাকে ব্যঙ্গ করতে পারি; সেই সাথে তাকে খুশি করার জন্য কীরকম মুখোশ ধারণ করতে হবে সেটাও ভাবা শুরু করে দিই। মানুষের সাথে মানুষের এই যে সম্পর্ক গড়ে তোলা, সেটা খুবই কষ্টকর একটা প্রক্রিয়া। তবে আমার পদ্ধতিটা অনুসরণ করলে সে কষ্টটা একদম শূন্যের ঘরে চলে যায়।

“তারপর থেকেই তুমি এরকম করে আসছো?”

“তারপর থেকেই আমি এরকম করে আসছি।”“

জুরি হাতের কাঁটাচামচটা প্লেটে রেখে হাত দুটো টেবিলের নিচে লুকালো। “শুনে খুব নিঃসঙ্গ বোধ হচ্ছে।”

“তাই? আমার তো সেটা কখনোই মনে হয়নি। ভালো করে ভেবে দেখো, প্রত্যেকটা মানুষকেই জীবনের কোনো না কোনো মুহূর্তে মুখোশ পরতে হয়। তোমার ক্ষেত্রেও তো ব্যাপারটা সত্য, তাই না?”

“আসলে…”

“নাহলে এ জগতে টিকে থাকা অসম্ভব। যদি তুমি তোমার আসল চেহারা সবার কাছে প্রকাশ করে দাও, তবে একদিন না একদিন তোমার অজান্তে সে মুখের ওপর আঘাত পড়বেই। গোটা দুনিয়াটা একটা খেলার ময়দান। এই খেলার ময়দানে খেলা বুঝে তোমাকে মুখোশ পরতে হবে।”

“দ্য মাস্ক অব ইয়ুথ’–তাই না?”

“কী বললে?” কফি কাপ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। “এইমাত্র কী বললে তুমি?”

“কিছু না।”

“না, আমি শুনতে পেরেছি কথাটা। ‘দ্য মাস্ক অব ইয়ুথ’– এই গেমটার কথা তুমি কীভাবে জানো? এখনো তো সেটা বাজারে মুক্তি পায়নি।”

আমি তার দিকে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ চোখ সরিয়ে রাখার পর সে ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকালো। তার ছোটো গোলাপি জিহ্বাটা সে তার ঠোঁটের মধ্য দিয়ে বের করে দিল।

“মাফ করো। আমি যখন ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম, তখন দেখে ফেলেছি।’

“কী ঘাঁটাঘাঁটি করছিলে?”

“ঘরের সবকিছু। এমনকি তোমার কম্পিউটারও।”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কফির কাপটা আবার হাতে নিয়ে ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিলাম। “তোমাকে না বলেছি আমার জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি না করতে?”

“সেজন্যই তো ক্ষমা চাচ্ছি। কিন্তু তোমাকে তো বুঝতে হবে যে, আমি তোমার ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। তুমি কীরকম টাইপের মানুষ, কীভাবে তুমি বড়ো হয়েছ ইত্যাদি।”

“আমার সম্পর্কে যা যা জানার, সবই আমি মাত্র বলে দিয়েছি। আমি খুব ভালোও ছিলাম না, আবার খুব কষ্টেও ছিলাম না।”

“তোমার মা এখন কোথায়?”

“আমি হাইস্কুলে থাকতেই তিনি আবার বিয়ে করে ফেলেন। তার নতুন স্বামী একটা কন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল কোম্পানিতে কাজ করতেন। খুবই চুপচাপ মানুষ ছিলেন তিনি, আমার সাথে ভালো ব্যবহারও করতেন…” মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটা ঠিক করলাম। “তিনি স্নেহার্দ্র মানুষের মুখোশ পরে থাকতেন আরকী। এখনো বোধহয় সে মুখোশটা তিনি খোলেননি। আমার সম্পর্কে এটুকু জানলেই হবে।” আমি কথার ইতি টানলাম।

জুরি আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাওয়ায় এখন কেন জানি অনুতাপ বোধ হচ্ছে।

ব্রেকফাস্ট সেরে সিপিটি মালিকদের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। নতুন পোস্ট হয়েছে।

.

২৪ ঘণ্টা (ইউজারনেম-জুলি)

শুভ সকাল। আমি টাকা জোগাড় করা সত্ত্বেও হঠাৎ করে চুক্তিটা পিছিয়ে গেছে। ধ্যাত! আমার কিন্তু অনেক রাগ হচ্ছে। তাই আমি আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে ওরা যদি আমার সাথে যোগাযোগ না করে, তবে আমি

‘তাদের’ সাথে যোগাযোগ করব বলে দিলাম।

এত সকাল সকাল ঘ্যানঘ্যান করার জন্য দুঃখিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *