অ্যালোন ইন নাইট

অ্যালোন ইন নাইট

রাস্তাটির নাম চার্চ রোড। লন্ডন শহরের উপকণ্ঠে রয়েছে এই রাস্তাটি। আমরা তখন থাকতাম ঐ রাস্তায়। রাস্তাটি বেশ খোলামেলা এবং সেখানে কোনো শহরের ভীড় নেই। আনন্দেই ছিলাম আমরা এখানে।

তবুও আমাদের ছাড়তে হল এই রাস্তাটি, ঐ সুন্দর এলাকাটা আমরা দুঃখের সঙ্গে ছাড়লাম। এই বিশ্রী বাড়িটার জন্য আমাদের সেখানটা ছাড়তে হল। তখনও এই বাড়িটা ছিলনা, যখন আমরা এ পাড়ায় এলাম। এই জায়গাটা ফাঁকাই ছিল।

আমাদের বাড়িটা আর্ল স্ত্রীটের মোড়ে চার্চ রোডের একেবারে শেষ মাথায়। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের ফাঁকা জায়গায় একখানা চৌকোনো বাড়ি উঠল, বাড়িটি চোখ দুটিকে পীড়িত করে। কারণ বাড়ির গড়নে কোনো শিল্প সুষমা নেই, এটি অত্যন্ত কুদর্শন। এমন বিশ্রী বাড়ি কে তৈরী করল এত টাকা খরচ করে?

কয়েকজন ঝি-চাকর নিয়ে মিস স্পেনসার নামে এক ভদ্রমহিলা সেই বাড়িতে থাকতে এলেন। আপনজন কেউ ছিল না ভদ্রমহিলার। অনেক কিছুই জানলাম ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে কারণ এই নতুন প্রতিবেশিনীকে লক্ষ্য করার অনেক সুযোগ ছিল আমার।

বাড়ির পাশের একটি দরজা দিয়ে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসতেন রোজ সকালে। মিশ স্পেনসারের চেহারা লম্বা, দোহারা, চেহারায় একটা আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে যা তার হাঁটাচলার মধ্যে ফুটে উঠত এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল বেশ সুরুচিপূর্ণ এবং তিনি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চার্চ রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন।

তিনি যখন চলতেন রাস্তার পাশের গাছের ছায়ায়, তখন আমার বেশ ভাল লাগত। ভদ্রমহিলার আর কোনো পরিচয় জানতাম না কেবল নামটুকু ছাড়া। সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে তিনি অভিজাত পরিবারের সন্তান। গাড়িখানা বেশ দামী ভদ্রমহিলার। তাঁর যে অর্থের অভাব নেই তা বেশ বোঝা যেত। তিনি গাড়ি করে বেরোতেন রোজ সকালে। তার জীবন ছিল একক নিঃসঙ্গ কারণ তিনি সকালে যখন হেঁটে যেতেন বা বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেরোতেন তখন একাই থাকতেন।

আমার মনে হত যে তার কি কোনো আপনজন নেই। তাকে দেখে আমার সমবেদনা হত।

আমি একদিন বললাম চায়ের টেবিলে বসে, ওরকম একলা থাকাটা খুব একঘেয়ে এবং অত বড় বাড়িতে মিস্ স্পেনসারের নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়। খুবই একঘেয়ে ব্যাপার ঐ একলা থাকাটা।

আমার স্বামী খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন তুমি ঠিকই বলেছ, এই ভদ্রমহিলার জীবনে কোনো বৈচিত্র নেই বেশ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং সুন্দরী এই মহিলা, দেখলেই অভিজাত বংশের বলে উনি মনে হয়।

আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না? স্বামী একটু থেমে বললেন।

আমি বলে উঠলাম, কি কাজ।

 স্বামী বললেন, আমি বলছিলাম যে তুমি গিয়ে ঐ ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপকর, অবশ্য যদিও এক সুন্দরী আরেক সুন্দরীকে সহ্য করতে পারে না।

আমার মনের বাসনা পূর্ণ হত না, যদি না সেইদিন একটা সামান্য ছোট্ট ঘটনা হত।

চার্চ রোডে আমি বেড়াতে বেরিয়ে ছিলাম আমাদের পোষা কুকুর কালোকে নিয়ে। মিশ স্পেনসারকে দূরে দেখলাম কারণ তিনি এদিকেই আসছে। কার্লোর গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল আনন্দের ডাক। সে আমার চারপাশে ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ তার কি হল, মিস্ স্পেনসারের দিকে দাঁত বের করে হিংস্র ভাবে তীব্র বেগে ছুটে এল এবং এমন জোরে ধাক্কা দিল যে তিনি পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলেন। ওঁর দিকে আমি ছুটে গেলাম এবং বারবার ভদ্রমহিলার কাছে ক্ষমা চাইলাম কুকুরটার আচরণের জন্য।

সামলে নিয়েছেন ততক্ষণে ভদ্রমহিলা। তিনি কোমল গলায় আমাকে বললেন, আপনি এত অপ্রস্তুত হবেন না, আমি নিজে কুকুর ভালবাসি, আমি কিছু মনে করিনি।

আমার পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল কালো, কারণ সেবুঝতে পেরেছে যে সে অন্যায় করেছে। মিস্ স্পেনসার আদর করবার জন্য তার দিকে হাত বাড়ালেন। কিন্তু সে পিছিয়ে গেল। ওর এরকম আচরণের কারণ বুঝতে না পারলেও, এটা বুঝলাম যে ও ভীষণ রেগে গিয়েছে।

মিস্ স্পেনসার কালোর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, আপনার কুকুরটা খুব সুন্দর।

কার্লোর গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে উঠল এবং সে হিংস্রভাবে গর্জন করতে লাগল যেটা খুবই অবাক ব্যাপার।

বিষণ্ণ গলায় মিস্ স্পেনসার বলে উঠলেন, আমাকে মোটেই পছন্দ করছে না দেখছি আপনার এই কুকুরটি।

আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী। ওঁর আপনার প্রতি এই আচরণের অর্থ আমি বুঝতে পারছি না।

মিস্ স্পেনসার বলে উঠলেন, প্রতিবেশী!

–আপনার বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িতে আমি থাকি।

 –ঠিক।

 তার বাড়িতে আমি যেতাম, এই বলে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। ভদ্রমহিলার মুখ খুশিতে ভরে গেল, তিনি বলে উঠলেন–খুবই আনন্দের কথা। আমার বাড়িতে আপনি কালকেই আসুন না।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

এই বলে আমি তখনকার মত বিদায় নিলাম।

মিস্ স্পেনসারের বাড়িতে গেলাম এবং আমার তাকে খুব পছন্দ হল। আমাকেও ভাল লাগল এই ভদ্রমহিলার। ভদ্রমহিলা বিদুষী এবং সুরুচি সম্পন্না, তাই আলাপের পর প্রায়ই তার বাড়িতে যেতাম। তার একটা প্রচণ্ড আকর্ষণী শক্তি আছে। তাই তিনি সঙ্গী হিসাবে চমৎকার। তার এই আকর্ষণী শক্তিই আমাকে অভিভূত করত। সেই শক্তি আমায় টানত, যখন আমি তার কাছে থাকতাম না। আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না যে আমার সম্বন্ধে তার প্রকৃত মনোভাব কি? আমার মনের এক কোণে একটি ক্ষীণ বিরূপ ভাব ছিল যদিও আমি তাকে ভালবাসতাম এবং শ্রদ্ধা করতাম।

আমার এটি যে কেন হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। এই বিরূপতা সৃষ্টির জন্য কিন্তু  ভদ্রমহিলার আচার-আচরণে এমন কিছু দেখা যায় নি। এসব জটিল মনস্তত্ত্বের কথা এখন থাক। ভদ্রমহিলার প্রতি আমার মনোভাব আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না।

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে যারা তার কাছাকাছি আসতেন, তাদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার ছিল, কারণ তার বয়স চল্লিশের কম নয়। তাঁর এই রূপের কাছে অভিজাত সমাজের সুন্দরীর পছন্দ ম্লান হয়ে যাবে, কিন্তু তিনি এড়িয়ে যেতেন সমাজকে, নিঃসঙ্গ জীবনই ছিল তার কাম্য। কেবলমাত্র আমার সঙ্গেই তাঁর কিছুটা অন্তরঙ্গতা হয়েছিল।

আমি তার বাড়ি গেছি অনেকবার কিন্তু তাকে আমার বাড়ি আসবার কথা বললেই তিনি এড়িয়ে যেতেন। তবে তিনি আমার বাড়ি এলেই অস্বস্তি বোধ করতেন। নিজের বাড়ির মত সহজ হতে পারতেন না। কার্লোর এই আচরণই হয়তো তার অস্বাভাবিকতার কারণ থাকতে পারে। কুকুরটা ওঁকে দেখলে যে কেন এরকম করত, তা আমি বুঝতে পারতাম না। আমাদের ঘরে উনি এলেই কালো সোফার তলায় ঢুকে পড়ত এবং এমন অস্বাভাবিক আচরণ করত যে ভদ্রমহিলা বিব্রত হয়ে পড়তেন। ভদ্রমহিলার অজ্ঞান হবার অবস্থা। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

কি অস্বস্তিকর ব্যাপার সেটি।

মিস্ স্পেনসার জোর করে তার মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনলেন। আমার যে কি হয় মাঝে মাঝে, দেখুন কি কাণ্ড। সামান্য ঘটনাতেই ভয় পেয়ে যাই, নিজের বাড়ি ছাড়া সহজ হতে পারি না এবং স্বস্তিও পাই না। এই কথা তিনি ম্লান হেসে বললেন।

আমি ভদ্রমহিলার অপ্রস্তুত ভাব কাটানোর জন্য বললাম, তাতে কি হয়েছে। হঠাৎ অসুস্থ মানুষ মাত্রেই হতে পারে।

মিস্ স্পেনসার বললেন, কোনো লৌকিকতার দরকার নেই। আপনি আমার বাড়ি চলে আসবেন, যখনই আপনার সুবিধা হবে। আপনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট, তাই আপনিই বেশী আসবেন।

এই বলে তিনি হাসলেন।

 সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাসলাম।

আমি প্রায়ই যেতাম তার বাড়িতে, আমার মনে এক অদম্য কৌতূহল ছিল তার সম্বন্ধে। একটা রহস্যের আবরণ ছিল ভদ্রমহিলার মধ্যে। দুর্ভেদ্য আবরণ ছিল তার মধ্যে। তিনি কখনই তার বাবা, মা, ভাই, বোন, প্রেমিক বা বন্ধুবান্ধবের কথা তুলতেন না। আলাপ করবার সময় তার এই কারণটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। তার জীবন, বিশেষ করে অতীতের কথা তিনি কিছু বলতেন না। আমাদের মধ্যে কেবল সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং রাজনীতি নিয়ে আলোচিত হত। অতীতের স্মৃতির রোমন্থন কোনোদিন মিস্ স্পেনসারকে করতে দেখিনি। আমি একবার সোজাসুজি প্রশ্ন করতে তিনি বলেছিলেন যে তার বাবা মা কেউ নেই। আমি তাকে ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করিনি কারণ আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে যে নিষেধের ভাব ফুটে উঠেছিল তার মুখে সেটা দেখেই।

টাকার কোনো অভাব ছিল না মিস্ স্পেনসারের। তিনি যে প্রচুর অর্থের অধিকারিনী তা তার দামী পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবনযাত্রার ধরণ দেখে মনে হত। তাদের ঝি চাকরদের মাইনেপত্তর দেখে মনে হয় খুব ভাল এবং তারা বেশ খানদানী প্রকৃতির। ইংরেজ ঝি এবং রাঁধুনী ছিল তার এবং ফরাসী ছিল খানসামা লুই। লুই তার সঙ্গে থাকত যখন মিস্ স্পেনসার গাড়ি নিয়ে বেরোতেন। মিশ স্পেনসারের চিঠি নিয়ে মাঝে মাঝে লুই আমার কাছে আসত। তার সঙ্গে বেড়াতে যাবারও আমন্ত্রণ থাকত চিঠিতে। আমি খুব খুশি মনেই সেই বেড়াবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতাম, কারণ আমাদের কোনো গাড়ি ছিল না, তাই গাড়ি করে বেড়াবার লোভে।

আমাকে মিস্ স্পেনসারের আমন্ত্রণপত্র একবার এক সপ্তাহে দু-দুবার প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছিল। পরে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, হয়তো উনি অভদ্র ভাবছেন একথা ভেবেই। ভাবলাম ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বলব কেন দু-দিন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। উনি নিশ্চয় ভালো করে বললে ব্যাপারটা বুঝবেন। সেই ঘটনারও অবসান হবে যদি তার মনে আমার সম্বন্ধে কোনো বিরূপ ধারণা থাকে।

কিন্তু ভদ্রমহিলাকে খুব বিচলিত দেখলাম। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন একটি চাপা উত্তেজনায়।

সেকথা তাকে বুঝিয়ে বলতে গেলাম যে কেন দু-দিন তার সঙ্গে বেড়াতে যাইনি। তিনি কোনো কাহিনীনা শুনেই বললেন, একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন আমার বাড়িতে, বলুন দেখি তিনি কে?

–মিঃ মার্শাল যিনি গীর্জার যাজক, তিনি এসেছিলেন বোধ হয়।

–কথাটা ঠিকই, গীর্জার এলাকায় পড়ে এমন সব বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যাজক মশায় দেখা করতে যান। এটা তিনি নিয়মিত করেন, আমার মনে হয় কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে আর দেখা করতে আসবেন না।

এই বলে মিস্ স্পেনসার হাসলেন মৃদু।

আমার যে ধর্মের ব্যাপারে একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে এবং সেটাই যে আমার মনের কথা তা আমি স্পষ্ট ভাবেই বলেছি। আমি কোনোদিন কোনো গীর্জায় যাইনি।

–কি বললেন, যাজক মশাই? আমার যাজক মশায়ের আতঙ্কে ভরে যাওয়া মুখখানি মনে পড়ে বেশ মজাই লাগছিল।

আমার মনে হল উনি অনেক কথাই ভাবলেন কিন্তু তেমন খুব একটা কিছু বললেন না। পুরুষ মানুষের পক্ষে ধর্মের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত মতের বিরুদ্ধে চিন্তাভাবনা করা বিরাট অপরাধ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এর কোনো ক্ষমা নেই।

আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে যে আমি একাধিক বার মিস্ স্পেনসারকে গীর্জায় যেতে দেখেছি। তাই বলে উঠলাম, কিন্তু আপনি তো ধর্মায়তনের প্রতিষ্ঠিত মতের বিরুদ্ধে নন। একথা যদি তিনি অস্বীকার করেন তো কিছুই করার নেই, কারণ এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি বলতেও চাই না।

তারপর একদিন মিস্ স্পেনসারের বাড়ি গিয়ে দেখলাম যে উনি ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বাইবেল পড়ছেন। আমাকে তিনি স্বাগত জানালেন, আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম, মিস্ স্পেনসার আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, কেইন আর অ্যাবেল-এর কাহিনী আপনি নিশ্চয় বাইবেলে পড়েছেন।

তিনি যেন সদ্য প্রকাশিত কোনো উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন, এই ভেবেই যেন প্রশ্নটা করলেন।

বাইবেলের এ গল্প তো সকলকার জানা যে আদিম মানব মানবী আদম আর ইভের পুত্ৰ কেইন তার ভাই অ্যাবেলকে হত্যা করে।

মিস্ স্পেনসারের প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ, পড়েছি।

–পৃথিবীর প্রথম খুনীর মুখে যেকলঙ্ক ফুটে উঠেছিল, তার কথা কি আপনি কখনও ভেবেছেন।

আমি বললাম–মাঝে মাঝে ভেবেছি এই কথা। মিস্ স্পেনসার তার কালো চোখের দৃষ্টিতে অতলান্ত গভীরতা এবং অনির্দেশ্য রহস্যময়তা নিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, আপনার এই বিষয়ে মত কি?

–খুবই শক্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা। এ ব্যাপারে অনুমান ছাড়া অন্য কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় কারণ আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত।

–কৌতূহলের ফলে আসতে পারে শুধুই অপমান। এটা আপনি ঠিকই বলেছেন, এবং এটা খুবই কৌতূহলজনক।

মিস্ স্পেনসার বললেন–এই কলঙ্ক চিহ্ন কি সবসময়েই থাকত। এই অবস্থায় বিশেষ বিশেষ পরিবেশে ফুটে উঠত এই চিহ্নগুলো।

আমি এটা বলতে পারব না, কারণ আমি এ সম্বন্ধে কোনো দিন ভাবিনি। এটা সত্যিই যে এই ধরনের চিন্তা ভাবনাই একেবারে নতুন আমার কাছে।

মিস্ স্পেনসারের কণ্ঠে শোনা গেল বিষণ্ণতার সুর।

কেইনের কি দরকার, কলঙ্ক চিহ্ন আছে কি নেই। এই ধরনের চিন্তা ভাবনাই আমার কাছে নতুন এটাই সত্যি কথা। কেইনের কৃত কর্মের জন্য অনুতাপে ভরে গিয়েছিল তার মন। সে। নিজে তো জানত যে কি প্রচণ্ড অন্যায় সে করেছে এবং কি মহাপাপ সে করেছে। আকুল ভাবে পাপ স্বলনের জন্য সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ কি নিদারুণ কলঙ্ক চিহ্ন তাকে বহন করতে হয়েছে তার নিজের শরীরে এটা সে জানত এবং এটাই তার খুবই দুর্ভাগ্য। এটাই তার শাস্তি।

মিস্ স্পেনসার মানসিক যন্ত্রণায় হাত কচলাতে লাগলেন। কেইনের মত একজন নৃশংস হত্যাকারীর উপর মিস্ স্পেনসারের সহানুভূতি দেখে আমি বললাম, কিন্তু কেইন তার নিজের ভাইকে হত্যা করে মহাপাপ করেছিল। যে মহাপাপ সে করেছে তার জন্য তার ওরকম শাস্তিই পাওয়া উচিত। ওর উপর আমার কোনো সহানুভূতি নেই।

মিস্ স্পেনসার আর্তনাদের সুরে বলে উঠলেন, না আপনি ওইরকম বলবেন না।

আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেঁপে উঠল, তার চোখের দিকে চোখ পড়তেই।

আমি তার চোখে কি দেখলাম তা বলতে পারব না। এটা একটা ভাবান্তর। তার আগেকার শান্তভাব ফিরে এল মুহূর্তের মধ্যেই। ক্ষণিকের জন্য একটা মুখোশ খুলে পড়েছিল।

হিংসা হচ্ছে মানুষের প্রথম অপরাধ, হিংসা প্রবৃত্তিই মানুষের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছে তাকে বিভিন্ন অপরাধের মধ্য দিয়ে। মহা অমঙ্গল হচ্ছে হিংসা। মানুষের উপর একটি শয়তানের প্রভাবের ফল হিংসা। শয়তান ঈশ্বরের সৃষ্টিকে নষ্ট করে দিতে চায়। মানুষকে প্রলুব্ধ করে নানাভাবে সে তার এই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি দিয়ে। এই বলে মিস্ স্পেনসার থামলেন।

— খারাপ খুবই ব্যাপারটা। এরকম কথা ভাবতেই ভাল লাগেনা যে, মানুষ হিংসাকে তুচ্ছ অজুহাত হিসাবে দেখে তার ভালবাসার পাত্রপাত্রীকে খুন করবে।

–একথা কি বিশ্বাসযোগ্য যে একজন মানুষ তার ভালবাসার পাত্রীকে খুন করতে পারে।

–আমি বিশ্বাস করি না একথা।

–মিস্ স্পেনসার ব্যগ্রভাবে এই প্রশ্ন করলেন।

ভালবাসার হত্যা কখনো হয় না। অন্য প্রবৃত্তি মানুষের অশুভ কামনাকে জাগিয়ে তোলে। অপরাধ করে মানুষ অন্ধ আবেগের তাড়নায়, আত্মত্যাগ শেখায় ভালবাসা, দুঃখ, বেদনা নিয়ে আসে হিংসা আর ভালবাসা? প্রিয়জনের সুখের জন্য যে নিজেকে নিঃশেষে, সম্পূর্ণভাবে বিলিয়ে দিতে পারে, সেই মানুষকে ভালবাসে। প্রেমের পাত্রকে সর্বসময়ই সুখী করতে চায় ভালবাসা।

মিস্ স্পেনসার আমার দিকে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে বললেন।

আপনি জানেন না যে প্রলোভনের শক্তি কি প্রচণ্ড। আপনি জানেন না যে, প্রলোভনের শিকার হয়ে মানুষ অনেক খারাপ কাজ করতে পারে। আমার ধারনার বাইরে, যে মানুষ কত নীচেনামতে পারে। মিসেস থোপ, আপনি খুব ভালোমানুষ এবং সরল। সত্যি বলছি আমি খুব আনন্দ পাই আপনি এলে।

ওখানেই শেষ হল সেদিনকার কথাবার্তা। খানসামা লুই আমার কাছে এল কয়েকদিন পর মিস্ স্পেনসারের চিঠি নিয়ে। আমি সেদিন তার সঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে যেতে পারব কিনা, তা মিস স্পেনসার জানতে চেয়েছেন। মিস স্পেনসার আরো জানতে চেয়েছেন যে দুপুরের খাওয়াটা আমি ওখানে সারতে পারব কিনা।

আমার খেতে বা বেড়াতে যে কোনো অসুবিধা নেই তা আমি লুইয়ের মারফৎ জানিয়ে দিলাম।

 মিস্ স্পেনসারের গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বেলা প্রায় বারটায়। আমি তৈরী হয়েছিলাম তাই গাড়ি আসতে বেরিয়ে পড়লাম।

গাড়ি করে বেরোলাম দুপুরের খাওয়া সেরে। খানসামা লুই আমার সঙ্গে ছিল যথারীতি।

ঘোরার ঘণ্টা দুই পর এল আমাদের ঘরে ফেরবার পালা। আমরা ফিরছিলাম বড় রাস্তা ধরে। একটা টুপির দোকানে এসে আমরা দাঁড়ালাম, বাড়ি তখনও দুই মাইল দূরে। এ দোকানে নানারকম মেয়েদের টুপি পাওয়া যায়, একটা ফোটো তোলবার স্টুডিও রয়েছে পাশে।

গাড়ি থামাবার নির্দেশ দিলেন মিস স্পেনসার। টুপির দোকানের সামনে গাড়িটা থামল। ভদ্রমহিলা হয়তো টুপি কিনবেন, এই কথা ভাবলাম। স্টুডিওর সামনে গাড়িটা থামল।

দরজা খুলবার জন্যনামল খানসামা লুই। হাত রেখে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দরজানা খুলেই। দুশ্চিন্তার ছাপ দেখলাম ওঁর চোখে মুখে এবং খুবই অবাক হলাম এটা দেখে।

লুই মাদাম বলে ডেকে উঠল এবং ঐ একটা শব্দেই ঝরে পড়ল একরাশ মিনতি, নিষেধের রেখা ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। মিস্ স্পেনসারের দুটি চোখ যেন ঝলসে উঠল বিদ্যুতের মত, দরজা খোল এই বলে তিনি কুম দিলেন।

আদেশ অমান্য করা অসম্ভব, এই শীতল অথচ দৃঢ়কণ্ঠের।

নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পেলাম লুই-এর। করুণ দৃষ্টিতে সে তাকাল আমার দিকে। লুই যেন কিছু বলতে চায়, ওর ভাব দেখে আমার মনে হল। সাহস নেই কথা বলবার ওর। এর কথার অর্থ কী বুঝতে পারলাম না কিছুই।

গাড়ি থেমেছে স্মিথের স্টুডিওর সামনে। স্মিথের খুব নাম–ডাক আমাদের এ শহরতলীতে ভালো ফটোগ্রাফার হিসাবে। এখান থেকে কয়েকবার ফোটো তুলেছি আমি এবং আমার স্বামী। স্মিথ ছবি তুলেছে খুব যত্ন করে। খুব সুন্দর হয়েছে ছবি।

আমাদের ঢুকতে দেখে অল্পবয়সী একটি মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।

–আপনারা কি ছবি তুলবেন?

মিস্ স্পেনসার বললেন, নিশ্চয়।

–আসবার কথা ছিল কি আপনাদের?

–আসবার কথা ছিল আমাদের দুটোর সময়, নিজের নাম বললেন মিস্ স্পেনসার।

–ছবি তুলবার জায়গায় মেয়েটি আমাদের নিয়ে গেল, আসুন ভেতরে আসুন–এই বলে। ডার্ক চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন স্মিথ।

কি রকম ছবি তুলবেন মিসেস থোপ– একটু হেসে আমাকে দেখে বললেন স্মিথ।

জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্পেনসার।

–ছবি আমি তুলবনা, তুলবে আমার বান্ধবী। এই বলে আমি জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই মিস্ স্পেনসার আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালেন, ফটোগ্রাফার স্মিথ চমকে উঠলেন তাঁর দিকে তাকিয়ে।

চমকাবারই কথা সত্যি ভদ্রমহিলার মুখে কি অদ্ভুত পরিবর্তন, এই মহিলার সঙ্গে কতই না গল্প গুজব, হাসি ঠাট্টা করছিলাম মাত্র দশমিনিট আগে। চোখ দুটো বসে গিয়েছেমিস্ স্পেনসারের। এক বিন্দু রক্ত নেই, সেই পাণ্ডুর মুখে। কেমন যেন লম্বাটে হয়ে গিয়েছে সুন্দর গোল মুখখানা। এক অসহনীয় যন্ত্রণার নির্ভুল ইঙ্গিত ফুঠে উঠছেতার মুখের রেখায়। অমানুষিক যন্ত্রণায় ভদ্রমহিলা কষ্ট পাচ্ছেন।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, আপনি কি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। একটু জল আনুন না কেউ। 

মিস্ স্পেনসার অদ্ভুত গলায় বললেন, না জলের কোনো প্রয়োজন নেই, তারপর ছবি তোলবার জন্য স্মিথকে ইঙ্গিত করলেন। কালো পর্দার কোণায় গিয়ে ঢুকল স্মিথ তাড়াতাড়ি। স্মিথ মিস্ স্পেনসারের বসার ভঙ্গী ঠিক করে দেয়নি। এমন কি একটা কথাও বলেনি এর সম্পর্কে যা আমার পরে মনে হয়েছিল।

ছবি তোলার কি দরকার–বরফের মত ঠাণ্ডা হাত দুখানা ঘষতে ঘষতে মিস্ স্পেনসারের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আমি বললাম এবং আরো বললাম, আপনার শরীরের অবস্থা এখন ফোটো তোলার মত নয়। আপনি অসুস্থ, ছবিতে উঠবেনা আপনার আসল চেহারা, মৃত মানুষের ছবি বলে এটা দেখে মনে হবে।

এক অমানুষিক দুঃসহ আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা চিরে। ঐ তীব্র তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা ধরা পড়ল। দাঁতে দাঁত আটকে গেল, চেয়ারের হাতলটা ধরল তার ডান হাতখানা। কপালে বড় বড় ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠছে। তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে একটা প্রচণ্ড ভয়। সেই মহাভয়ের সঙ্গে তিনি যুঝে চলছেন প্রবল ইচ্ছা শক্তি দিয়ে।

আমার দারুণ ভয় হল–আমি কাঁপতে লাগলাম ভদ্রমহিলার এই অবস্থা দেখে।

আমি চীৎকার করে উঠলাম, ভদ্রমহিলাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আসুন–আপনি চলে আসুন।

বাধা দিলেন মিস্ স্পেনসার। ফ্যাস ফ্যাস করে তিনি বললেন ভাঙা গলায়, আপনি আমার কাছে থাকুন। আমাকে একটু সাহায্য করুন।

নিজের মুখ দু–হাত দিয়ে ঢেকে আমি স্পেনসারের পাশে বসলাম। আমি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকাবার। আমি যেন বিয়োগান্তক নাটকের কোনো একটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিবলে আমার মনে হল। আমার ভয় যেন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল, এটি কিসের জন্য তা না জানায়।

কেটে যাচ্ছে সময়। অভিভুতের মতো বসে রইলাম, সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, ফটোগ্রাফার স্মিথের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি কালো কাপড়ে ঘেরা এই জায়গাটার মধ্যে।

খুবই দুঃখিত ম্যাডাম, আপনার ফোটো ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়–স্মিথের এই কথায় আমি চমকে উঠলাম।

চেয়ার থেকে উঠে মিস্ স্পেনসার নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, একটাও কথা না বলে। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, তার মুখে নিদারুণ হতাশার ছাপ।

দুজনে কোন কথা হল না। তিনি আমাকে এই প্রথম জড়িয়ে ধরে চুম্বন করে বললেন, বিদায়–চির বিদায় মিসেস থোপ। যখন আমাদের বাড়ির সামনে তার গাড়ি এসে দাঁড়াল। তার কথাও খুবই বিষণ্ণ শোনাচ্ছিল।

দু-চোখ জলে ভরে এসেছিল আমার। কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিল গলার ভিতর থেকে। তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না কোনো কথা কান্নাভরা গলায়। ভাবলাম তিনি নিশ্চয় আমাকে যথাসময়ে খুলে বলবেন সব কথা।

সন্ধ্যাবেলায় স্বামী ফিরলে স্টুডিওর ভিতর যা ঘটেছিল, তা তাকে সব বললাম। বাদ দিলাম না কোনো কথা। ব্যাপারটা হালকা ভাবেই নিলেন আমার স্বামী। তিনি বললেন, এটি একপ্রকার স্নায়ু দোষ, একে খেয়ালী মনের উৎকট বিলাসও বলা যেতে পারে। সেই কারণেই এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।

আমি তাকে প্রতিবাদের সুরে বললাম, এটা কখনই নয়, মিস্ স্পেনসারের পাল্টে যাওয়া মুখ যদি তুমি দেখতে, তাহলে তুমি কখনই একথা বলতে পারতে না।

পরিচারক কথা শেষ করার আগেই বলে উঠল, গিন্নীমার সঙ্গে দেখা করতে চান ফটোগ্রাফার স্মিথ।

আমি বললাম, নিয়ে এস ওনাকে।

আমার স্বামী মিঃ স্মিথ ঘরে এলে বললেন, কি সব রহস্যময় অদ্ভুত ব্যাপার আপনার স্টুডিওতে ঘটছে মিঃ স্মিথ। একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন আমার স্ত্রী আপনার স্টুডিওতে গিয়ে।

আমি নিজেই ঘাবড়ে গেছি, সুতরাং এতে অবাক হবার কিছু নেই। তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা, যে ভদ্রমহিলা মিসেস থোপের সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা, মিসেস থোপের বন্ধু হলেও তিনি স্বাভাবিক নন। ওর জীবনের সঙ্গে কোনো একটি অদ্ভুত ব্যাপার জড়িয়ে পড়েছে। অলৌকিক এবং অপ্রাকৃতিক ব্যাপার এটি।

এরকম ধারণার কারণ কি আপনার?

সম্ভব নয় এই ভদ্রমহিলার ছবি তোলা।

 আমার স্বামী অবজ্ঞার সুরে বললেন–শুধু এই কারণেই আপনার এই ধারণা হল।

–শুধু আজ নয়, মিস্ স্পেনসারকে আমি আগেও দেখেছি। একটি বিখ্যাত কোম্পানীর ফটোগ্রাফার ছিলাম আমি বছর পাঁচেক আগে। সেখানে গিয়েছিলেন উনি ফোটো তুলতে। আমি ওঁর ফটো তুলতে পারিনি অনেক চেষ্টা করেও। আমি ওকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমার পক্ষে ওঁর ছবি তোলা সম্ভব নয়।

আমার স্বামী জিজ্ঞেস করলেন, এটি অসম্ভব কেন?

-এর নেগেটিভ গুলি অসংখ্য দাগে ভরা। আমি প্রথমে ওনার মুখ দেখতে পাইনি কারণ উনি জানলার দিকে মুখ করে ছিলেন। আমার দিকে ঘুরতেই ওঁর শঙ্কা–বিহ্বল মুখ দেখেছিলাম। তখনই ওনাকে চিনতে পারলাম। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম ওঁর ফটো তোলবার জন্য কিন্তু সে চেষ্টা বৃথা।

উত্তেজনায় থরথর গলায় আমি প্রশ্ন করলাম–কেন?

–একইরকম ফল। দু–খানা নেগেটিভআমি প্রিন্ট করেছি আপনাদের দেখাবার জন্য। দেখুন এর কি ফল। আপনি আগে দেখুন মিঃ থোপ।

দু–খানা ফটো ব্যাগের ভিতর থেকে বের করে আমার স্বামীর হাতে মিঃ স্মিথ দিলেন। আমার স্বামীর মুখের চেহারা পাল্টে গেল এই ফটো দেখে। আমার তর সইছিল না, আমি কৌতূহল আর উৎকণ্ঠায় ফটো চাইলাম। আমি তাকালাম ফটোগুলোর দিকে।

হায়, এ কি দৃশ্য। আমার থর থর করে সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। দাগে ভরে গিয়েছে সমস্ত ছবি। একটি করে মুখের ছাপ প্রতিটি দাগে, একদম পরিষ্কার এবং নিখুঁত।

মৃত মানুষের মুখের ছাপ।

শিউরে উঠলাম দারুণ আতঙ্কে। অন্ধকার, চারপাশে শুধুই অন্ধকার, অন্ধকারের সমুদ্র আমায় গ্রাস করবার জন্য ছুটে আসছে।

জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে, আর আমার কিছু মনে নেই।

 ও বাড়ি থেকে পরদিন আমার স্বামী আমায় অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন।

পনের দিন পরে বেরিয়ে দেখলাম সামনের বাড়িটা খালি। মিস্ স্পেনসারের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, তিনি চলে গিয়েছেন। ভবিষ্যতেও দেখা হবে না। তিনি যতবড় অপরাধই করে থাকুন না কেন তাকে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে।

তার মনে অহরহ অনুতাপ ও অনুশোচনা হচ্ছে কারণ তিনি মহাপাপ করেছেন। এ পাপের কোনদিনই মুক্তি নেই।

আমার সমস্ত মন দিয়ে তার উদ্দেশ্যে জানাই সহানুভূতি। তার জন্যে আমি সমবেদনা বোধ করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *