অধ্যায় ৫০
পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। এখান থেকে বের হওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, পার্কিং এরিয়াতেও পাহারা বসানো হয়েছে। হোটেলের গেস্টদের কাছে ব্যাপারটা অনেকটা টি.ভি সিরিজের মত, পার্থক্য শুধু এইটুকুই যে এখন বাজে সকাল সাতটা। আর টি.ভি সিরিজে দেখা যেতো আরো রাতে। এমন পরিস্থিতির কারণে কিছু গেস্টকে বেশ উত্তেজিত দেখা গেল, তাদের ফ্লাইট ছুটে যাচ্ছে বলে। কিন্তু ক্যামিলের কড়া নির্দেশ কেউ বেরুতে পারবে না। আর এদিকে হোটেল মালিকের দফারফা অবস্থা, দুদিক থেকেই ঝড় সামলাতে হচ্ছে তাকে।
হোটেল মালিক দরজায় দাঁড়িয়ে ক্যামিল আর লুইসের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আসার পর কথা বলার জন্য লুইস এগিয়ে গেল। এমন পরিস্থিতে লুইস এমনটাই করে, কারন এতে অভ্যস্ত সে। আর তাছাড়া ক্যামিলকে কথা বলার সুযোগ দিলে, আধাঘন্টার মাঝে এখানে যে যুদ্ধ শুরু হবে, তা বেশ ভালোমতোই জানে সে।
হোটেল মালিককে এক পাশে নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করলো লুইস। এরমাঝে স্থানীয় থানার একজন অফিসার এসে ক্যামিলকে বলল, “আমি একনজর দেখেছি লাশটা। আপনাদের হারানো বিজ্ঞপ্তির ওই মেয়েটাই।”
একটা ধন্যবাদের জন্য অপেক্ষা করলেও, তা এলো না। কেননা সামনে দাঁড়ানো ছোটখাট মানুষটা মোটেও বন্ধুবৎসল না। আর এসব ধন্যবাদ দিয়ে অভ্যস্ত নয়। কথাটা শোনার পরপরই সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল সে। লিফট থাকলেও তা ব্যবহার করলো না।
“আমরা এখনো কাউকে ঢুকতে দেই নি। আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।” বিমর্ষ কণ্ঠে বলল সেই অফিসার।
রুমের সামনে চলে এলো সে। রুমটা ক্রাইম সিন হিসেবে টেপ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ফরেনসিক টিমের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এদিকে লুইস এখনো মালিকের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। সে রুমে এমনভাবে ঢুকলো যেন ভেতরে তার কোন আত্মীয় মারা গেছে। কিছুক্ষণের জন্য খুব একাকী বোধ করলো।
মৃত্যুর ব্যাপারটা মোটেও জাঁকজমকের কিছু নয়, বরং অসীম শূন্যতা ঘিরে থাকে তাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম কিছু দেখলো না। মেয়েটার শরীর চাদরে পেঁচিয়ে আছে, হয়তো খিচুনি হওয়ার সময় আরো শক্ত হয়ে পেঁচিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, লাশটা যেন মিশরের কোন ফারাওয়ের, আর তা মমি বানানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। একটা হাত ভূমির সমান্তরালে বেরিয়ে আছে। তার মুখটা থেঁতলে গেছে। চোখ দুটো খোলা, মৃত্যুর আগে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কিছু দেখছিলো হয়তো। মুখের এক কোণা দিয়ে একটু বমি বেরিয়ে এসেছে, বাকিটা হয়তো মুখের ভেতরেই আছে। পুরো দৃশ্যটাই যন্ত্রণাদায়ক।
লাশ দেখে প্রথমেই ক্যামিল নিজেকে বলল, আমি সবসময়ই দেরি করে পৌঁছাই। ঠিক এই কারণেই আইরিন মারা গিয়েছিলো। তার পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণেই, আইরিনকে বাঁচাতে পারেনি। আবার কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে? এমন প্রশ্নে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। কেননা তার স্ত্রী আইরিন ছিল ফুলের মত পবিত্র আর শিশুর মত নিষ্পাপ, কিন্তু সামনে পড়ে থাকা মেয়েটা মোটেও নিষ্পাপ না।
তবুও এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। কেন পারছে না, তা নিজেও জানে না।
সে ঠিকই বুঝতে পারলো, শুরু থেকে কিছু একটা মিস করেছে। কিছু একটা আছে যা সে এখনো ধরতে পারেনি। আর এই মেয়েটা সেই গোপন কিছু তার সাথে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। লাশটা ভালোমত দেখার জন্য আরো কাছে চলে গেল।
মেয়েটা যখন জীবিত ছিলো, তখন তাকে ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। এখন মেয়েটা তার সামনে পড়ে আছে। কিন্তু এখনো তার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। মেয়েটার আসল নাম কী? থাকে কোথায়? বয়স কত?
পাশেই একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে থাকতে দেখলো সে। ল্যাটেক্স গ্লোভ পড়ে নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটা খুললো। একটু খোঁজার পর পেয়ে গেল বহু আকাঙ্খিত জিনিস। আই.ডি কার্ড
মৃত মানুষ আর জীবিত মানুষের মাঝে বিস্তর ফারাক। একবার আই.ডি কার্ডের ছবি আরেকবার পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো ক্যামিল। কোন চেহারাই তার আঁকা ই-ফিটের সাথে মেলে না। আই.ডি কার্ডে থাকা ছবিটা হয়তো সদ্য বিশে পা দেয়া কোন তরুণীর
আই.ডি কার্ডে মেয়েটার নাম দেখলো।
অ্যালেক্স প্যিভো।
নামটা মনে মনে আরেকবার বলল।
অ্যালেক্স।
এর সাথে সাথে লরা, লি, নাটালিরও পরিসমাপ্তি ঘটলো।
আদতে তার নাম ছিল অ্যালেক্স।
নাকি এটাও…
অধ্যায় ৫১
ম্যাজিস্ট্রেট ভিডার্ড বেশ উল্লসিত। মেয়েটার আত্মহত্যা যেন তার বিচক্ষণতা, দক্ষতা আর একরোখা মনোভাবের ফসল। নিজের গূণ নিজেই গাইতে পছন্দ করে সে। এতোকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও, উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। ক্যামিল একদম নিশ্চুপ। ক্যামিলের নীরবতা তার বিজয়ের আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্জনের মাস্ক আর নীল ওভারবুট পড়া ভিডার্ডকে বেশ উদ্ভট দেখাচ্ছে।
করিডোর থেকেই ক্রাইম সিন দেখতে পারলেও নিচে নেমে এলো সে। ফরেনসিন টিম এসে কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এসিড ব্যবহার করে বিভৎসভাবে হত্যা করে যে খুনি, তার মুখ দেখার কৌতুহল সামলাতে পারলো না। তাকে দেখে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো। রোমান সম্রাটের মত রুমে ঢুকলো। প্রথমে রুমের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলো, এরপর লাশের দিকে ঝুঁকে কিছু একটা দেখলো। বের হওয়ার সময় তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো, এই কেসের এমন সমাপ্তি তাকে খুশি করে তুলেছে। যাওয়ার আগে ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেটরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি খুব দ্রুত এর রিপোর্ট চাই, বুঝলে?”
ম্যাজিস্ট্রেটের মতলব ধরে ফেললো ক্যামিল। একটু পরেই সংবাদ সম্মেলন করতে যাচ্ছে সে।
ক্যামিলও সম্মতি জানালো।
“অবশ্যই। আমরা এই কেসের শেষ দেখে ছাড়বো।”
“এই কেস এখানেই শেষ। এ নিয়ে আর কোন তদন্ত চাই না আমি। সবাই কথাটা মগজে ঢুকিয়ে নিন,” বলল ম্যাজিস্ট্রেট।
“আপনি কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন কথাটা?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“সত্যি বলতে, হ্যা, তোমার কথাই বলছি আমি।”
এই কথা বলতে বলতে গায়ে থাকা প্রটেকটিভ স্যুট খুলে ফেললো সে। এখনো মাথায় ক্যাপ আর পায়ে নীল বুট পড়ে আছে।
“এই কেসে তোমার দূরদর্শীতার অভাব সুস্পষ্ট, ভেরহোভেন। প্রতিটা ঘটনাই তোমার অবস্থানকে আরো নড়বড়ে করেছে। ঘটনার ধারে কাছেও যেতে পারোনি তুমি। এমনকি মেয়েটার পরিচয়ও তুমি বের করতে পারোনি, এর জন্য মেয়েটার কাছেই ঋণী আমরা। তোমার ভাগ্য ভাল যে শেষমেশ এমন একটা ঘটনা ঘটার কারণেই তার পরিচয় জানতে পেরেছি আমরা। জীবিত অবস্থায় মেয়েটা একের পর এক খুন করে গেছে, তার টিকিটারও নাগাল পাওনি। এই কেসে তোমার অবদান কী? আমার চোখে তো কিছু পড়ছে না। আমি এখনো নিশ্চিত না যে তুমি এই কেসে থাকবে কিনা। তবে আমার এখনও মনে হয় তুমি এই কেসের জন্য…”
“…যোগ্য না? বলে ফেলুন, স্যার, শব্দটা তো আপনার ঠোঁটের গোড়ায় এসে রয়েছে। এই তো আপনার আসল পরিচয়। যা ভাবেন তা বলার সাহস নেই, আর যা বলেন তা ভাবার মত সততাও নেই।”
“ওহ, তাই নাকি। শুনতে চাও আমি কী ভাবছি…
“ভয়ে আমার পা কাঁপছে, স্যার!!”
“তুমি এমন জটিল কেস পরিচালনা করার উপযুক্ত না।”
এই কথা বলে কিছু সময় চুপ করে রইলো ভিডার্ড। ক্যামিলকে এমন আঘাত করে বেশ খুশি মনে হলো তাকে। কিছুক্ষণ ভেবে আবারো বলল, “তুমি ফিরে আসার পর উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারো নি। আমার মনে হয় তোমার সরে দাঁড়ানোর সময় চলে এসেছে।”
অধ্যায় ৫২
প্রথমে সবকিছুই ফরেনসিক বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হলে ক্যামিলের অফিসে পাঠিয়ে দেয়। দেখতে কম মনে হলেও, বেশ জায়গা লাগলো ওগুলো রাখতে। টেবিল, ক্যাবিনেট, সোফা, হ্যাট-স্ট্যান্ড সবকিছু সরিয়ে কিছু জায়গা খালি করলো আরম্যান্ড। এরপর জিনিসপত্র রেখে, চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো। কিন্তু ত্রিশ বছর বয়সি একজনের এমন সংগ্রহ কিছুটা অবাক করলো তাকে। কেননা সবকিছুই শিশুসুলভ জিনিসপত্র। দেখলে মনে হবে মানসিকভাবে হয়তো কখনোই বেড়ে ওঠেনি এই জিনিসগুলোর মালিক। নইলে সস্তা দরের গোলাপী চুলের ক্লিপ, ছেঁড়া টিকেট কে রেখে দেয়?
সব কিছুই হোটেল থেকে আরো চারদিন আগে আনা হয়।
হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নামলো ক্যামিল, ওখানে আরম্যান্ড রিসিপশনিস্টকে জেরা করছে। যথার্থ কারণেই আরম্যান্ড ডাইনিং রুমে জেরা করছে, যেখানে হোটেলের গেস্টরা সকালের নাস্তা করছে।
কথা বলতে বলতে এক কাপ কফি, চারটা ক্রয়স্যান্ট, এক বাটি সিরিয়েল, একটা সিদ্ধ ডিম, দুই স্লাইস হ্যাম আর কয়েকটুকরা পনির তুলে নিলো। মুখভর্তি খাবার নিয়েও মনোযোগ দিতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তার।
“একটু আগে আপনি আমাকে বলেছেন তখন রাত সাড়ে আটটা বাজে।”
“হ্যা। তবে পাঁচ মিনিট এদিক সেদিক হতে পারে।” রোগা একজন মানুষের এমন খাওয়া দেখে কিছুটা বিস্মিত কণ্ঠে জবাব দিলো রিসিপশনিস্ট। ।
আরম্যান্ড এমনভাবে মাথা নাড়লো যেন সব বুঝতে পেরেছে। “আপনার কাছে কার্ডবোর্ড বক্স হবে নাকি?” জিজ্ঞেস করলো সে। এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই কয়েকটা ব্রেড আর ক্রয়স্যান্ট টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে নিলো। চিন্তিত রিসিপশনিস্টের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেই সকাল থেকে কাজ করছি, এখনো নাস্তাই করা হয় নি ভালোমতো…”
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে।
ক্যামিল কনফারেন্স রুমে চলে গেল, ওখানে লুইস প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলছে। অ্যালেক্সের মৃতদেহ প্রথমে দেখেছে হোটেলের এক পরিচারিকা, বয়স পঞ্চাশের কোঠা পার করেছে, মুখটা ফ্যাকাশে আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সাধারণত তার ডিউটি শুরু হয় সন্ধ্যায়, ডিনারের পর সবকিছু পরিস্কার করে, বাসায় চলে যায়। তবে মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম ঘটে। অন্য কেউ অনুপস্থিত থাকলে, সকালেও ডিউটি করতে হয়। মহিলা বেশ মোটাসোটা আর কোমরের ব্যথায় ভুগছে অনেকদিন ধরে।
ঘটনার দিনও তাকে সকালের শিফটে ডিউটি করতে হয়। তার কাজ হলো বেডরুম পরিস্কার করা। কিন্তু ঘটনার দিন সকালেই একটা ভুল হয় তার। তার কাজের লিস্টে তিনশ সতেরো নাম্বার রুমও ছিলো, আর ওই রুমের লোকজন চেক আউট করায় ঝামেলা আরো কমে যায় তার।
“লেখাটা একটু অস্পষ্ট ছিলো। আমি মনে করেছিলাম ওটা তিনশ চৌদ্দ লেখা।”
তাকে বেশ আবেগাপ্লুত মনে হলো। এই খুনের ঝামেলার মাঝে নিজেকে জড়াতে চায় না। এতে তার কোন দোষ নেই ।
“রুম নাম্বার যদি ঠিকমতো লেখা থাকতো, তাহলে এসব কিছুই ঘটতো না।”
মহিলাকে আশ্বস্ত করার জন্য তার কাঁধে হাত রাখলো লুইস।
ভুলে ওই রুমে ঢুকেই বুঝতে পারে, বিছানায় পড়ে থাকা ত্রিশ বছর বয়সি তরুণী আত্মহত্যা করেছে।
“মেয়েটাকে একনজর দেখেই বুঝতে পেরেছি সে মারা গেছে।”
এই বলে নিশ্চুপ হয়ে গেল পরিচারকা, কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। এর আগেও অনেক মৃতদেহ দেখেছে তার জীবনে। কিন্তু প্রতিটা মৃত্যুই তাকে নতুন করে নাড়া দেয়, নিজের সময় সম্পর্কে আবারো মনে করিয়ে দেয়।
“ঘটনাটা আমাকে হতবিহ্বল করে দেয়।”
লুইস আবারো সমবেদনা জানালো। ক্যামিল এখনো নিশ্চুপ, সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে।
“মেয়েটাকে এতো সুন্দর আর এতো জীবন্ত দেখাচ্ছিলো যে…”
“মেয়েটাকে জীবন্ত মনে হচ্ছিলো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
এতোক্ষণে মুখ খুললো ক্যামিল
“আমি আসলে এটা বোঝাতে চাইনি। এর আগের দিনেও আমি মেয়েটাকে দেখেছিলাম, তখন এতো উচ্ছল আর প্রাণবন্ত লাগছিলো। মেয়েটার মাঝে কেমন একটা ভয়ডরহীন ভাব ছিলো। আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না।”
“আগের দিন রাতে কোথায় দেখেছিলেন মেয়েটাকে?” শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো লুইস।
“হোটেলের পাশের রাস্তায়। হাতে তিনটা বিন ব্যাগ নিয়ে…”
বাক্যটা শেষ করার সুযোগ পেলো না সে, এরইমাঝে সামনে থাকা দুজন গায়েব হয়ে গিয়েছে। হোটেল থেকে বের হওয়ার দরজার দিকে ছুটেছে দুইজন।
যাওয়ার পথে আরম্যান্ডকেও সাথে নিয়ে গেল ক্যামিল। পঞ্চাশ মিটার দূরে একটা ট্রাক, বিন থেকে ময়লা উঠিয়ে নিচ্ছে। তাকে থামানোর জন্য সবাই চিৎকার শুরু করলেও, কোন লাভ হলো না। কেননা এতো দূর থেকে শব্দ ট্রাকে থাকা লোকটার কানে যাচ্ছে না। ক্যামিল আর আরম্যান্ড একদিকে দৌড়ানো শুরু করলো, আর লুইস বিপরীত দিকে। কাছাকাছি যাওয়ার পর তিনজনই তাদের ওয়ারেন্ট কার্ড দেখালো। হুইসেল বাজিয়ে ময়লার ট্রাকে থাকা ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হলো। নিজের দিকে পুলিশের লোকজন এমন হতদন্ত হয়ে ছুটে আসছে দেখে, কিছুটা ভয় গেল সে।
পরিচারিকাকে বাইরে বের করে আনা হলো। ওইদিন রাতে মেয়েটাকে কোথায় দেখেছিলো তা আঙুল দিয়ে দেখালো।
“মেয়েটা এর আশেপাশেই কোথাও ছিলো। আমি ঠিক বলতে পারবো না, তবে এদিকেই হবে।”
হোটেলের আশেপাশে প্রায় বিশটা ডাস্টবিন আছে। ক্যামিলের মুখভঙ্গি দেখেই ভয় পেয়ে গেল হোটেলের ম্যানেজার।
“কিন্তু, তাই বলে আপনি এমন করতে…”
“আমরা কী করতে পারবো না?” বাঁধা দিয়ে বলল ক্যামিল।
ম্যানেজার বুঝতে পারলো প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। কার পার্কিংয়ে সব ডাস্টবিন খুলে চেক করা হলো। ম্যানেজার মনে মনে বলল, “হোটেলের দুর্নাম করার জন্য আত্মহত্যাই কি যথেষ্ট ছিল না?”
আরম্যান্ড তিনটা বিন লাইনার খুঁজে পেলো।
এসব কাজে তার অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা সবচেয়ে বেশি।
অধ্যায় ৫৩
রবিবার সকাল সকাল উঠে দুদুশের জন্য ঘরের জানালা খুলে দিলো ক্যামিল, কেননা জানালায় বসে বাজার দেখতে পছন্দ করে দুদুশে। নাস্তা করার সময় ঘড়ি দেখলো, এখনো আটটাও বাজেনি। গত রাতে একফোঁটা ঘুম হয়নি তার। সারারাত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে, এক সমাধান বের করলে তো আরেক সমাধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উভয়ই বাতিল হয়ে যায়। কী করবে আর কী না করবে, কিছুই ঠিক করতে পারছে না। এই অনিশ্চয়তা ঘেরা সময়গুলোর সবচেয়ে জটিল দিক হলো, ভিতর থেকে সে নিজেও জানে না কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
আজ তার মায়ের ছবির নিলামে উঠছে। ওখানে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।
দশটার দিকে দুদুশেকে বাসায় রেখে বেরিয়ে পড়লো ক্যামিল। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটা বেশ উপভোগ করছে। গন্তব্য তার অফিস।
*
রবিবার হওয়া স্বত্বেও, একটার দিকে অফিসে আসবে বলে জানালো লুইস।
অফিসে আসার পর থেকেই টেবিলে পড়ে থাকা জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে। জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বিক্রির জন্য সাজিয়ে রেখেছে।
অ্যালেক্সের লাশ খুঁজে পাওয়ার পরের দিন তার ভাই এবং মাকে ডাকা হয়েছিলো সনাক্ত করার জন্য। মিসেস প্যিভোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কাউকে সন্দেহ হয় কিনা।
মিসেস প্যিভো দেখতে বেশ ছোটখাটো, মাথার চুল কমে এসেছে, গায়ে জীর্ণ পোষাক। তবে আচার আচরণে বেশ বিনয়ী। এখানে আসার পরেও নিজের কোট খুলে রাখেনি, এমনকি হ্যান্ডব্যাগটাও হাতছাড়া করেনি। কোথাও যেন যাওয়ার তাড়া আছে তার।
“এখন আপনাকে যে কথা বলবো, তাতে বিশাল ধাক্কা লাগতে পারে আপনার। নিজেকে একটু শক্ত করুন। আপনার মেয়ে গতরাতে আত্মহত্যা করেছে, আর মারার আগে কমপক্ষে ছয়জনকে হত্যা করেছে। সংখ্যাটা আরো বাড়তে পারে, তবে আমরা এই কয়েকটার খবর পেয়েছি,” বলল আরম্যান্ড।
সামনের কঠোর পরীক্ষার জন্য মিসেস প্যিভোকে প্রস্তুত হতে বলল ক্যামিল। কেননা সামনে অনেক প্রশ্ন মোকাবেলা করতে হবে। ছোট বেলায় কিংবা বড় হওয়ার পর কী কী বিষয়ে অ্যালেক্সের আগ্রহ ছিল তা জানতে চাইলো সে। এরপর টেবিলে থাকা তার মেয়ের জিনিসপত্র দেখাতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো মিসেস প্যিভো। নিজেকে সামলাতে না পেরে চেয়ারে বসে পড়লো। নিজের মেয়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে, পুরোনো স্মৃতি জেগে উঠলো। তবে কিছু জিনিস চিনতে না পারার কারণে কিছুটা বিহ্বল মনে হলো।
“কী কারণে আপনার মেয়ে এইসব জঞ্জাল যত্ন করে রেখেছিলো। আর এগুলো কি আদৌ তার?”
“এই যে এটা আমার মেয়ের,” একটা কালো চুলের ক্লিপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে।
“আমার মেয়ে খুব বইপড়ুয়া ছিলো। প্রচুর বই পড়তো।” সামনে থাকা পেপারপব্যাক বইগুলো দেখিয়ে বলল।
*
লুইস দুইটার দিকে আসার পর দু’জনে মিলে লাঞ্চ করতে বেরিয়ে পড়ে। এমন সময় ক্যামিলের মায়ের বন্ধু ফোন করে সকালের নিলামের ব্যাপারে। ক্যামিল তাকে বারবার ধন্যবাদ দিতে লাগলো, কিন্তু এরপরে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে সরাসরি টাকার কথা চলে গেল। কিন্তু লুইস জানে ফোনের ওপ্রান্তে থাকা লোকটা ভদ্রতাবশত টাকার ব্যাপারে এখন কথা বলবে না, আর তাই করলো সে, কাজটা সে নিজের প্রয়াত বান্ধবীর জন্য করেছে বলে জানালো। নিলাম থেকে ক্যামিলের আশার চেয়েও বেশি টাকা উঠেছে- দুই লাখ আশি হাজার ইউরো। ছোট একটা পোট্রেটই বিক্রি হয়েছে আঠারো হাজার ইউরোতে।
লুইস মোটেও বিস্মিত হলো না। ভাল কাজের দাম কেমন হয় তা বেশ ভালোই জানা আছে তার। এসব ব্যাপারে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে।
ক্যামিলের যেন বিশ্বাসই হতে চাইলো না। তার কয় বছরের বেতল হবে এই টাকা দিয়ে, তাই হিসাব শুরু করল। এখন তার কাছে অনেক টাকা। হুট করেই এই টাকাকে কাঁধের বোঝা মনে হলো।
“কেমন বোকার মত সব বিক্রি করে দিলাম। কাজটা ঠিক হয়নি, তাই না?”
“না। মোটেও না।” বেশ সাবধানে জবার দিলো লুইস।
তবুও বিস্ময়ের ঘোর কাটলো না ক্যামিলের।
অধ্যায় ৫৪
ক্লিন শেভড, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, দ্যুতিময় চোখ আর পুরু ঠোঁট। বেল্ট পড়ার পর ভুড়িটা যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দেখতে মনে হয় বয়স চল্লিশেরও বেশি হবে। আসলে তা সায়ত্রিশ। সে প্রায় ছয় ফিট লম্বা, আর তার কাঁধ বেশ চওড়া। লুইসও ছয় ফিট লম্বা, কিন্তু তার পাশে লুইসকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।
ক্যামিল এর আগেও তাকে মর্গে দেখেছে। খুবই সাধারণ ভঙ্গিমায় অটোপসি টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে লাশটা দেখেছিলো। মুখে কিছু না বললেও, লাশ ঠিকই সনাক্ত করেছে।
করিডোর ধরে পাশাপাশি হাঁটছে লুইস আর ক্যামিল, “আগের চেয়ে আরো কৌশলী মনে হচ্ছে তাকে,” বলল লুইস।
লোকটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো প্যাসকেল ট্র্যারিক্সের হত্যা রহস্য নিয়ে তদন্ত করার সময়।
সোমবার বিকাল পাঁচটার সময়, ক্রিমিনাল ব্রিগেড এর হেডকোয়ার্টারে মিলিত হয়েছে সবাই।
লুইস নিজের ডেস্কে বসে আছে। আরম্যান্ড ঠিক তার পাশেই। তবেই ক্যামিল সবার থেকে একটু দূরে, রুমের এক কোণায় বসে স্কেচ করছে।
“লাশ কবে হস্তান্তর করা হবে?”
“খুব শীঘ্রই,” বলল লুইস।
“চারদিন তো পার হয়ে গেছে।”
“তা আমি জানি, কিন্তু এইসব কাজে সময় একটু বেশিই লাগে।”
সত্যি বলতে, এই ধরনের বিষয়, লুইসের মত দক্ষতার সাথে কেউ পরিচালনা করতে পারে না। ক্যামিলও বিনাবাক্যে লুইসের এই গুণের কথা স্বীকার করে। এই গুণ সে বংশানুক্রমে পেয়েছে।
নিজের নোটবুক আর কেস ফাইল হাতে তুলে নিলো লুইস।
“তো, টমাস ভ্যাসো, জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর।”
“এটা তো ফাইলেই লেখা আছে।”
একটু বিরক্তি সহকারে বলল টমাস ভ্যাসো।
“হ্যা, তা আছে। তবুও একবার চেক করতে দোষ কী? আর আমরা যতদূর জানি, আপনার বোন পাঁচ জন পুরুষ আর একজন মহিলাসহ মোট ছয়জনকে খুন করেছে। ওদের ফ্যামিলিকেও তো কিছু বলতে হবে। তাই ঘটনাগুলো একটু সাজিয়ে নিচ্ছি আর কী। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন।”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো টমাস।
“তো, জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর”
“হ্যা।”
“আর আপনি একটা কোম্পানির সেলস ডিরেক্টর।”
“ঠিকই বলছেন।”
“স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে থাকেন আপনি।”
“জ্বি। আপনি তো সবই জানেন।”
“তো আপনি অ্যালেক্সের চেয়ে সাত বছরের বড় ছিলেন?”
শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো টমাস।
“নিজের বাবা কখনো দেখেনি অ্যালেক্স,” বলল লুইস।
“আমার বাবা মারা যায় আমি ছোট থাকতেই। এরপর আমার মা আরেকজনের সাথে জড়িয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই লোক মাকে ছেড়ে চলে যায়, আর অ্যালেক্স আমাদের সাথেই বড় হয়।”
“তার মানে, আপনিই ওর কাছে বাবার মত ছিলেন?”
“আমি ওর দেখাশোনা করেছি। আর এটা ওর দরকার ছিলো।” লুইস কিছুই বলল না। আর এদিকে ভ্যাসো বলে চললো।
“এমনকি ও যখন মানসিকভাবে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো, তখনও ওর হাত ছাড়িনি।”
“ওহ হ্যা, আপনার মা বলেছিলো এই কথা।” জবাবে বলল লুইস।
“কিন্তু তাকে ডাক্তার দেখানোর কিংবা হাসপাতালে ভর্তি করানোর কোন তথ্য নেই।”
“অ্যালেক্স পাগল ছিল না, শুধু একটু অন্যরকম ছিলো।”
“কারণ ওর কোনো বাবা ছিল না…
“আসলে ওর পারসোনালিটিতে একটু সমস্যা ছিলো। ছোটবেলায় কারো সাথে কথা বলতো না। ওর কোন বন্ধুও ছিল না। সারাদিন একা একা ঘরে বসে থাকতো।”
লুইস কিছু না বলে মাথা নাড়ালো যেন বলতে চাইছে, বলে যান আপনি।
“আদতে ওর একটু বেশি যত্নের দরকার…
“ঠিক এই কথাটাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আপনার মা যথেষ্ট ছিল না!!” প্রায় চিৎকার করে বলল লুইস।
“তা করতো, কিন্তু বাবার বিকল্প তো আর কেউ হতে পারে না।”
এমনিতে অ্যালেক্স নিজের বাবার কথা বলতো না? কিছু জিজ্ঞেস করতো না? দেখতে চাইতো না?”
“না। ওর প্রয়োজনীয় সবকিছুই বাসায় ছিলো।”
“আপনি আর আপনার মা?”
“হ্যা। আমি আর আমার মা।”
“ভালোবাসা আর নিয়মানুবর্তিতা।”
“আপনি যদি এভাবে বলে খুশি হন, তাহলে তাই।”
*
যে কোন ব্যাপারে এখন লা গুয়েন ম্যাজিস্ট্রেট ভিডার্ড এর সাথে যোগাযোগ করে। ক্যামিল আর ম্যাজিস্ট্রেট এর মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই কাজ করছে সে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট যত বাজেভাবেই বলুক না কেন, এই মুহূর্তে ক্যামিল তাদের কাছে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষও একই কথা বলছে। ক্যামিল ভেরহোভেন আর আগের মত নেই, এতো বড় কেস পরিচালনা করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। ছয় ছয়টা খুন হওয়ার পরেও খুনিকে ধরতে পারেনি। এ ধরনের কেসে তাকে রাখার দরকার কী। এমন আরো নানা ধরনের মন্তব্য এসেছে নানা দিক থেকে।
ক্যামিলের করা রিপোর্ট আরেকবার পড়লো লা গুয়েন। এক ঘণ্টা আগে তাদের মিটিং শুরু হয়েছে।
“এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত, ক্যামিল?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন। “অবশ্যই। আর আপনি যদি চান, তাহলে আমি…”
“না। না। তা লাগবে না। ব্যাপারটা আমি দেখছি। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে দেখা করে, তাকে বুঝিয়ে বলবো।”
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুললো ক্যামিল।
“কী সমস্যা, ক্যামিল? আমি একদম শুরু থেকেই দেখছি, তুমি তাকে সহ্যই করতে পারছো না।”
*
“তো যাই হোক, প্যাসকেল ট্র্যারিক্সকে আপনি স্কুল থেকে চিনতেন?
“হ্যা।”
“কিন্তু আমি প্রথমবার যখন আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি তখন আপনি বলেছিলেন; ‘প্যাসকেল সারাক্ষণ নিজের গার্লফ্রেণ্ড নাটালির কথা বলতো। যদিও আমরা জানতাম এই মেয়েই তার জীবনের প্রথম আর শেষ মেয়ে’।”
“হ্যা, বলেছিলাম। কিন্তু এতে সমস্যা কই?”
“কারণ আমরা জানতে পেরেছি, এই নাটালিই আপনার বোন অ্যালেক্স।”
“হয়তো আপনারা এখন জানেন, কিন্তু আমি সেই সময় কিছুই জানতাম না।” কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দিলো টমাস।
লুইস চুপ করে রইলো। ব্যাপারটা ভেঙে বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো টমাস।
“আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, প্যাসকেল আমাদের মত স্বাভাবিক ছিল না। আদতে ওর কোনো গার্লফ্রেণ্ডই ছিল না। ও যখন নিজের গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতো, আমি ভাবতাম চাপাবাজি করছে। কেননা, ওর মুখে শুধু নাটালির কথাই শুনেছি, কখনো দেখিনি। তাই, ওর কথাকে এতোটা গুরুত্বও দেইনি।
“কিন্তু অ্যালেক্সের সাথে আপনার বন্ধু প্যাসকেলকে তো আপনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।”
“না, আমি তা করিনি। আর তা ছাড়া ও আমার বন্ধুও না।”
“ওহ, তাই নাকি? তাহলে প্যাসকেলের সাথে আপনার সম্পর্ক কী?”
“দেখুন, আপনাকে আমি একদম পরিস্কার করে বলছি। প্যাসকেল ছিল একটা বোকাচোদা, বুদ্ধি বলতে কিছুই ছিল না। স্কুল জীবনে ওর সাথে আমার পরিচয়। তবে ‘ঘনিষ্ঠ’ বলতে যা বোঝায়, তা মোটেও ছিল না।”
একটু উত্তেজিত কণ্ঠে জবাব দিলো টমাস ভ্যাসো।
“শান্ত হয়ে বসুন।” অনেকক্ষণ সহ্য করার পর কথা বলল ক্যামিল,
“আমরা প্রশ্ন করবো, আপনি জবাব দিবেন।”
যেদিক থেকে এই কথাগুলো এলো, সেদিকে তাকালো টমাস। ক্যামিল আবারো স্কেচ করায় মনোযোগ দিলো।
“এখানের নিয়ম এটাই।” যোগ করলো সে।
শেষমেশ স্কেচ আঁকা শেষ হলো তার। মাথা উঠিয়ে আবারো বলল, “আপনি যদি আরেকবার তেড়িবেড়ি করেন, তাহলে তদন্ত কাজে অসহযোগিতার অভিযোগে আপনার নামে মামলা করা হবে। আশা করি, এই কথা দ্বিতীয়বার বলতে হবে না।”
এই কথা শোনার পর ভ্যাসোর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আর তা দেখে মুচকি হেসে উঠল লুইস।
“তো?” বলল লুইস।
“তো কী?” বলল হতভম্ব টমাস।
“তাহলে, অ্যালেক্সের সাথে প্যাসকেলের পরিচয় হলো কীভাবে?”
“আমি জানি না।”
পুরো রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো।
“তার মানে কী এদের মাঝে ভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছে…”
“আমার তাই মনে হয়।”
“আর সে নিজের নাম বলল নাটালি। এরপর শাবল দিয়ে মাথায় আঘাত করে প্যাসকেলকে খুন করলো। আর আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি কিছুই জানেন না?”
“আপনি কী চান? অ্যালেক্স খুন করেছে, আমি তো না!”
একটু উত্তেজিত হয়ে বলল টমাস। কিন্তু একটু গলার স্বর নরম হয়ে এলো। নিচু স্বরে বলল, “আমাকেই কেন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন? আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পেয়েছেন আপনারা?”
“না। কিন্তু, ব্যাপারটা আপনাকে বুঝতে হবে, ছেলের মৃত্যুর পর তার বাবা জ্যঁ পিয়েরে ট্র্যারিক্স, আপনার বোনকে খুঁজতে বের হয়। একসময় সে খুঁজেও পায়, আর বাসা থেকে তাকে অপহরণ করে। অনেকদিন আটকে রেখে অত্যাচার করে। এরপর একদিন মেয়েটা সুযোগ বুঝে পালায়। কিন্তু অবাক করার মত বিষয় হলো, নিজের নাম কেন লুকাতে গেল অ্যালেক্স? আর ট্র্যারিক্সের বাবাই বা কীভাবে তার ঠিকানা খুঁজে পেলো?”
“সেটা তো আমার জানার কথা না।”
“আচ্ছা। তবে আমাদের ছোট একটা থিয়োরি আছে এই ব্যাপারে।”
এই কথাটা ক্যামিল বললে অভিযোগ কিংবা হুমকির মত শোনাতো। তবে লুইসের মুখে আর দশটা কথার মতই লাগলো। লুইস আর ক্যামিলের মাঝে এটাই পার্থক্য ।
“আমাকে কি বলা যাবে?”
“নিজের সন্তানের খোঁজ পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবার কাছেই গিয়েছিলো জ্যঁ পিয়েরে ট্র্যারিক্স। আর একটা অস্পষ্ট ছবি সবাইকে দেখিয়ে বেড়িয়েছে, যেখানে প্যাসকেল আর নাটালি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। আর এই নাটালিই কিন্তু অ্যালেক্স, আশা করে ভুলে যাননি। তো যাই হোক, আপনাকে দেখানো মাত্র আপনি নিজের বোনকে চিনে ফেলেন। আমাদের ধারণা, আপনিই তাকে অ্যালেক্সের ঠিকানা দিয়েছিলেন।”
কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না টমাস। লুইস বলে চললো।
“আর ছেলে হারানোর শোকে মি. ট্র্যারিক্স ছিলেন পাগলপ্রায়। অ্যালেক্সের প্রতি তার যে ক্ষোভ ছিল তা আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন এবং ঠিকানা পেলে যে সে ওর ক্ষতি করবে তাও জানতেন।”
“আমি এমন কাজ কেন করতে যাবো?” কৌতুহলী দৃষ্টি তার চোখেমুখে।
“ঠিক এই কথাটাই তো আমরা জানতে চাই, মসিয়ে ভ্যাসো। ছেলে হারানো বাবা সন্তানকে ফিরে পাবার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত থাকে। আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা একটা লোকের সামনে যেই থাকুক না কেন, পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে। আমি শুধু বলতে চাইছি এটা তো আপনার বোনকে মার দেয়ার সমতুল্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কোনটা ভেবে ঠিকানা দিয়েছিলেন? অ্যালেক্সকে একদম হত্যা করার জন্য?
“আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে?”
“আহা!”
বলে উঠলো ক্যামিল। বিজয়ের চিৎকার দিয়ে শুরু করে, শেষমেশ হাসি দিয়ে শেষ করলো সে।
“হা! হা! হা! আমি ঠিক এটাই চাইছিলাম।”
ভ্যাসো তার দিকে ঘুরে গেল।
কোন সাক্ষী যদি প্রমাণ চায়, তার মানে বুঝতে হবে সে আমাদের থিয়োরিকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। সে শুধু চায় ব্যাপারটাকে কোন মতে পাশ কাটাতে।”
“আচ্ছা, মানলাম। কেউ কি বলবে এখানে আমাকে কেন আনা হয়েছে?”
“আপনি যখন ধর্ষণ শুরু করেছেন, তখন অ্যালেক্সের বয়স কত ছিলো?”
এই কথা শোনার পর যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ভ্যাসোর।
“আচ্ছা। আমার মনে হয় যাওয়া…”
“আরে, বলে ফেলুন…”
*
ছোটবেলা থেকেই ডায়েরিতে লেখার অভ্যাস ছিল অ্যালেক্সের। নিজের কথা, জীবনের কথাসহ নানা বিষয় নিয়ে লিখেছে ডায়েরির পাতায়। বেশ কয়েকটা নোটবুক ছিল তার। ডাস্টবিন থেকে সব তুলে আনা হয়েছে আরো আগেই।
হাতের লেখাও অনেকটা বাচ্চাদের মত।
ক্যামিল শুধু একটা বাক্য পড়লোঃ ‘টমাস আমার বেডরুমে ঢুকলো। প্রায় প্রতিদিনই আসে। মামুনিও জানে।”
*
ভ্যাসো উঠে দাঁড়ালো।
“মাফ করবেন, আমার এখন যেতে…”
“আমার মনে হয় না এভাবে আপনি পার পেয়ে যাবেন।”
“ওহ, তাই নাকি!! তা আমার কী করতে হবে?”
“আমার মতে, এখানে বসে প্রশ্নের জবাব দেয়াটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
“কোন প্রশ্নের উত্তর দিবো?”
“নিজের বোনকে ধর্ষণের ব্যাপারে।”
“তাই নাকি? কেন? ও কী আমার নামে কেস করবে নাকি করেছে?” ক্যামিল পুরোপুরি অবাক হয়ে গেল।
“আপনারা সবগুলো অকর্মণ্য। আমি কোন কথাই বলবো না এই ব্যাপারে। আমি আপনাদের শান্তিতে থাকতে দিবো না।”
এই কথা বলে টমাসকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো। এরপর নিজের মাথা এমনভাবে কাত করলো যেন কিছু একটা খুঁজছে, নাটকীয় ভঙ্গিতে আবারো বলল, “সত্যি বলতে কী, অ্যালেক্সকে আমি খুব পছন্দ করতাম। ছোট অ্যালেক্সকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করতো। তুলতুলে গাল, রসালো ঠোঁট আর মসৃণ ত্বক ছিল ওর। তবে, একটাই সমস্যা ছিল ওর। আর এ জন্যেই একটু আলাদা যত্ন নিতে হয়েছে ওর। বুঝেনই তো, একটু ভালবাসাও দিতে হয়েছে তখন।”
এতোক্ষণ শ্রোতা হিসেবে থাকা লুইস, বক্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো।
“আপনি না একটু আগেই বললেন, ওর বাবার অভাব আপনিই পূরণ করতেন।”
“আচ্ছা, এবার বলুন, অ্যালেক্স আমার নামে কোন মামলা করেছে? আমাকে একটা কপি দেখাতে পারবেন?”