অ্যালেক্স – ২৫

অধ্যায় ২৫ 

বুধবার সকালেই পোস্ট-মর্টেম সম্পন্ন হলো। ক্যামিল আর লুইসও উপস্থিত সেখানে। 

লা গুয়েন বরাবরেই মত আজকেও দেরি করে এসেছে, এরইমাঝে যা জানার তা জেনে গেছে বাকিরা। লাশটা প্যাসকেল ট্র্যারিক্সের, যা সবাই আগেই অনুমান করেছিলো। বয়স, উচ্চতা, চুলের রং, মৃত্যুর সময় সবই মিলে গেছে প্যাসকেলের সাথে। আর স্যানড্রিন তো আগেই লাশটাকে সনাক্ত করেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য এখন শুধু ডি.এন.এ টেস্ট করা বাকি, তবে লাশটা যে প্যাসকেলের, আর নাটালি গ্রেঞ্জার তাকে খুন করেছে এটা ধরে সামনে আগানোর সিদ্ধান্ত নিলো তারা। খুনি প্রথমে কুড়াল দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করে, এরপর বেলচা দিয়ে মাথাকে থেঁতলে দেয়, এইটুকু নিশ্চিত করেছে ফরেনসিক বিভাগ। 

“এতেই প্রমাণ হয় ছেলেটার সাথে কোন হিসাব চুকিয়েছে নাটালি,” বলল ক্যামিল। 

“হ্যা, তা ঠিক। কমপক্ষে ত্রিশটা আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। তবে বাদবাকি পরীক্ষা সম্পন্ন করার পর আপনাকে সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারবো। আর বেলচার একপাশ দিয়ে আঘাতের ফলে মনে হচ্ছে ভোতা একটা কুড়াল দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো।” ল্যাবের প্যাথলজিস্ট বলল। 

ক্যামিল বেশ সন্তুষ্ট। সে খুশি না, তবে সন্তুষ্ট কেননা তার ধারণার সাথে ঘটনাটা পুরোপুরি মিলে গেছে। শালার ম্যাজিস্ট্রেটটা এখন থাকলো ব্যঙ্গাত্মক কিছু বলতো, নিজের পুরোনো বন্ধু লা গুয়েনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বলেছিলাম না মেয়েটার মাঝে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে… 

“আমাদের পরীক্ষা করতে হবে, কিন্তু এটা যে এসিড এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই,” বলল প্যাথলজিস্ট । 

ছেলেটার মাথায় একের পর এক আঘাত করা হয়েছে, এরপর খুনি নাটালি গ্রেঞ্জার প্রায় এক লিটার সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিয়েছে গলা দিয়ে। ক্ষতির পরিমাণ দেখে প্যাথলজিস্টের ধারণা এটা ঘন সালফিউরিক এসিডই হবে। 

“বেশ ঘন সালফিউরিক এসিড।” 

ঘন সালফিউরিক এসিড মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। মাংসকে একদম গলিয়ে দেয়, তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে ঘনত্বের উপর। 

একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে ক্যামিলের মাথায়। 

“এই কাজ যখন করা হয়, তখন কি ছেলেটা জীবিত নাকি মৃত?” 

ক্যামিল জানে এই ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে উত্তরটা হবে ‘পরীক্ষা করার আগে আমরা কিছুই বলতে পারছি না’। কিন্তু এইক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলো, প্যাথলজিস্ট এখনই মুখ খুললো। 

“হাতে পায়ে দাগ দেখে এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিলো।”

গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সবাই। 

“আমার মতামত জানতে চাও?” 

কেউ কোনো কথা বলল না। 

“আমার ধারণা, আগে মাথায় বেলচা দিয়ে আঘাত করে ছেলেটাকে অজ্ঞান করা হয়েছে। এরপর শক্ত করে বেঁধে গলায় এসিড ঢেলে দিয়েছে খুনি। তবে তার মানে এই না যে এরপরে তাকে আর আঘাত করা হয়নি…যাই হোক, আমার মতে, ছেলেটা কষ্ট পেয়েই মরেছে।” 

এমন ঘটনা যা কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু এসিড আগে না পরে ঢালা হয়েছে এই নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামালো না। তদন্তের কাজে এটা কোন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। 

“এটা বিচারকের কাজে লাগবে,” বলল ক্যামিল। 

*

ক্যামিলের একটা সমস্যা হলো, সে কখনো পিছু হটে না। যত যাই হোক, নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না। একদিন লা গুয়েন বলছিলো, “ক্যামিল, তুমি আসলেই অত্যধিক একরোখা। শিয়াল ধরা কুকুরগুলোও তো একসময় পিছু হটে, কিন্তু তুমি…” 

“তুলনাটা কম হয়ে গেল না? এরচেয়ে আমাকে একটা বাসেট হাউন্ডের সাথে তুলনা করতে পারতেন, অথবা পুডল ডগের সাথে?” 

অন্য কেউ হলে এই কথা শোনার পর ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বেঁধে যেতো। 

এখন, ক্যামিল তার সেই পিছু না হটার সুনাম ধরে রেখেছে। লা গুয়েনের ধারণা ক্যামিল একটু উদ্বিগ্ন। করিডোরে দেখা হওয়ার পরও, না দেখার ভান করে সেখান থেকে চলে যায় সে। একটু পর আবারো লা গুয়েনের অফিসে আসে, মুখ দেখে মনে হয় কিছু বলবে, কিন্তু কিছু না বলেই আবারো সেখান থেকে চলে যায়। লা গুয়েন বেশ ধৈর্যশীল মানুষ। ওয়াশরুমে দেখা হলে সে বলে, “কখন তুমি বলার জন্য প্রস্তুত,” আদতে বলতে চেয়েছিলো, “আমি তোমার এমন ব্যবহারে অভ্যস্ত।” 

লাঞ্চের একটু আগে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ক্যামিল তার ফোন অফ করে রাখলো, সবাইকে একটা অলিখিত বার্তাও দিয়ে দিলো যে সবার অখণ্ড মনোযোগ তার প্রয়োজন। চারজনের সবাই উপস্থিত এখন : লা গুয়েন, ক্যামিল, লুইস, আরম্যান্ড। ঝড় যেহেতু শেষ, তাই পরিস্থিতি আবারো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আরম্যান্ড এক ঢোকেই তার বিয়ার শেষ করে ফেললো। 

“মেয়েটা একটা খুনি,” ক্যামিল বলল। 

“হয়তোবা মেয়েটা খুনি। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে, নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। তাই, এখন তুমিও যেমন জানো আমিও তেমন জানি, এটা সম্পূর্ণ আমাদের ধারণা।” লা গুয়েন বলল। 

“ধারণা হোক আর যাই হোক, আমরা সত্যের খুব কাছাকাছি।” 

“আচ্ছা, মানলাম তুমিই ঠিক। কিন্তু এতে কি পরিবর্তন হয়?” 

সমর্থনের জন্য লুইসের দিকে তাকালো ক্যামিল। কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল লুইস, ভদ্র ঘরের সন্তান সে। ভাল স্কুলে পড়াশোনা করেছে; তার এক চাচা আর্চবিশপ, আরেক চাচা পার্লামেন্ট মেম্বার, তাই অনেক আগে থেকেই নৈতিকতা আর বাস্তবতার মাঝে পার্থক্য করতে শিখেছে। এছাড়াও, জেসুইট পাদ্রীদের দ্বারাও সে শিক্ষা পেয়েছে। 

“উনার প্রশ্ন আমার কাছেও বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। এতে কি পরিবর্তন হয়?” 

“লুইস, আমি ভাবতাম তুমি বেশ স্মার্ট। এটা তো পুরো কেসটার দিকই পরিবর্তন করে দেয়।” 

এই কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। আরেকজনকে পটিয়ে কেবলই একটা সিগারেট বাগাচ্ছিলো আরম্যান্ড, বিস্ময়ে সে ঘুরে গেল। 

“কেসের দিক? কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলছো, ক্যামিল?” 

“তোমরা কেউই আমার কথা বুঝতে পারো নি,” বলল ক্যামিল। অন্য সময় হলে, তার এই কথা নিয়ে ঠাট্টা করতো সবাই। কিন্তু এখন এই কথায় অন্য কিছু খুঁজে পেলো তারা। 

“আসলেই কেউ আমার কথা বুঝতে পারোনি। 

স্কেচ করার নোটবুকটা বের করলো। একটা পেজের উল্টোপাশে কিছু আঁকছে সে। সাধারণত সে কিছু লিখে না, কেননা নিজের স্মৃতিশক্তির উপর তার প্রবল বিশ্বাস আছে। লুইস উঁকি দিয়ে দেখলো একটা ইঁদুরের ছবি আঁকছে। 

“মেয়েটাকে বেশ কৌতুহলোদ্দিপক মনে হচ্ছে আমার কাছে। আর সালফিউরিক এসিডের ব্যাপারটাও বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। তাই না?” 

কেউ কোন কথা বলল না। 

“আমি এই নিয়ে অল্পবিস্তর গবেষণা করেছি। কিছু সংশোধনের দরকার আছে, তবে কাজ চলার মত তথ্য পেয়ে গেছি।” 

“আরে দেরি করছো কেন? বলে ফেলো।” 

গ্লাস ভরা বিয়ারের পুরোটা গলায় ঢেলে দিলো ক্যামিল। ওয়েটারকে আরেক গ্লাসের অর্ডার দিলো। আর এই সুযোগে আরম্যান্ডও নিজের জন্য আরেকটা আনতে বলল। 

“গত বছর মার্চের তেরো তারিখ, বার্নাড গ্যাটেনগো নামে একজন, বয়স তেপান্নো, টেমসের পাশের এক মোটেলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। সালফিউরিক এসিডের কারণেই মৃত্যু হয়, যার ঘনমাত্রা ছিল আশি শতাংশ।” 

“ওহ, শিট…” আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল লা গুয়েন। 

“বৈবাহিক অবস্থা সুখকর না হওয়ার কারণে এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।”

“বাদ দাও, ক্যামিল।”

“না, আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। এই ঘটনার আটমাস পর, নভেম্বরের আটাশ তারিখ, স্টেফান ম্যাকিয়াক, ক্যাফের মালিক, তাকে হত্যা করা হয়। ক্যাফের ভেতরে তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে তার কর্মীরা। পোস্ট মর্টেম থেকে জানা গেছে, হত্যা করার আগে তাকে বেদম প্রহার এর সাথে একই ঘনমাত্রার সালফিউরিক এসিড তার গলায়ও ঢালা হয়। আর ক্যাশ বাক্স থেকে দুইহাজার ইউরোও চুরি যায়। 

“তোমার মনে হয় একটা মেয়ে এমন কিছু করতে পারে?” লা গুয়েন জিজ্ঞেস করলো। 

“আর তোমার কীভাবে মনে হয় একটা মানুষ সালফিউরিক এসিড খেয়ে আত্মহত্যা করবে?” 

“কিন্তু আমাদের কেসের সাথে এর কী সম্পর্ক?” উত্তেজিত হয়ে বলল  গুয়েন। 

হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলো ক্যামিল। 

“আচ্ছা…ঠিক আছে লা গুয়েন।” 

এরইমাঝে ওয়েটার বিয়ার নিয়ে ফিরে এলো। যে যার মত বিয়ার নিয়ে নিলো। এরপরে কী ঘটবে লুইস তা ভালমতোই জানে। কেউ চাইলে সে লিখেও দিতে পারবে পরবর্তী ঘটনা কী হবে। এরপরেই ক্যামিল প্রতিআক্রমণ করবে। 

“একটা কথা ছিল…লা গুয়েন,” 

লা গুয়েন চোখ বন্ধ করে ফেললো। লুইস মুচকি হাসলো, লা গুয়েনের সামনে সে এভাবেই হাসে। আর ওদিকে আরম্যান্ড তার স্বভাবচারিত ভঙ্গিমায় ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে বত্রিশটা দাত বের করে দিলো 

“তুমি যদি একটু কষ্ট করে আমাকে একটা জিনিস বলতে…মনে করে দেখো তো সর্বশেষ কবে আমরা সালফিউরিক এসিড দিয়ে হত্যা করার কেস নিয়ে কাজ করেছি? ভেবে বলো…” বলল ক্যামিল। 

এখন এইসব ভাবার মুড নেই লা গুয়েনের। 

“এগারো বছর- আমি অমীমাংসিত কেসগুলোর কথা বলছি। এরমাঝে আমরা অনেক অপরাধী পেয়েছি, যারা অপরাধের জন্য এসিড ব্যবহার করেছে। তবে, আমরা ওদেরকে ধরেছি, শাস্তিরও ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু, গত এগার বছরে অপরাধের জন্য সালফিউরিক এসিড ব্যবহার করে কেউ পার পায়নি, পুলিশ ওদের ক্ষেত্রে ছিল আপসহীন এবং শতভাগ সফল।” 

“তুমি কী তা জানো? তুমি আসলেই গোদের উপর একটা বিষফোঁড়া।”

“একদম ঠিক বলেছো। এরজন্যেই তো ডান্টন বলে গেছে, ‘সত্য সবসময়ই তিক্ত’।” 

“লেনিন,” লুইস বলল। 

বিরক্তি সহকারে ঘুরে দাঁড়ালো ক্যামিল। 

“লেনিন আবার কী করলো?” 

“ওই যে আপনি বললেন ‘সত্য সবসময়ই তিক্ত’ এটা ডান্টন নয়, লেনিন বলেছিলো জন অ্যাডামসের একটা উক্তি ব্যবহার করে।” 

“তাতে কী?” 

লজ্জায় লাল হয়ে গেল লুইস, কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু এর আগেই লা গুয়েন বলল, “তাতে কী, ক্যামিল? গত দশ বছরে এসিড সংক্রান্ত কোন কেস আমরা পাইনি, এতে সমস্য কী?” 

“দশ না এগারো বছর।” 

“কিন্তু এখন, আমাদের হাতে আট মাসের ব্যবধানের দুটি ঘটনা। আর যদি প্যাসকেলের কেস ধরি তাহলে মোট তিনটা,” বলতে থাকলো সে। 

“কিন্তু…” 

এইবারের মত লা গুয়েন ছাড় পেয়ে গেল, মনে মনে বলল লুইস। “কিন্তু মেয়েটার সাথে এর কী সম্পর্ক?” জিজ্ঞেস করলো আরম্যান্ড। মুচকি হাসলো ক্যামিল। 

“যাক, শেষমেশ একটা বুদ্ধিমানের মত প্রশ্ন করেছো।” 

“…আসলেই একটা বিষফোঁড়া,” বিড়বিড় করে বলল লা গুয়েন। 

এই ব্যাপারে বেশ নিরুৎসাহিত মনে হলো তাকে। নিজের মনোভাব প্রকাশের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বিচিত্র এক ভঙ্গিমা করলো, যেন বলতে চাইছে, ‘হয়তোবা তুমি ঠিক, কিন্তু এই ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলবো’। যারা তাকে চেনে না, তারা ভাববে হতাশা থেকে এই কথাগুলো বলছে সে। টেবিলের উপর একটা কয়েন ছুঁড়ে দিয়েই অফিস ত্যাগ করলো। 

দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো ক্যামিল। মাঝে মাঝে সত্য কথা বলাও ভুল। নিজের নাক চুলকাতে শুরু করলো, যেন লুইস আর আরম্যান্ডকে বোঝাতে চাইছে নাক নামক জিনিসটা তারও আছে। আসলে, তার বলার সময়টা ভুল। কেননা, এখনও মেয়েটা শুধুই একজন ভিক্টিম, যে বাক্সে বন্দী অবস্থায় আছে। এই মেয়েকে উদ্ধার করাটাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু তাকেই এখন খুনি বানিয়ে ফেলা, খুব একটা যুক্তিযুক্ত হবে না। 

“টিমের সবাই রেডি আছে। প্রথম টিম…” লুইস বলল। 

ক্যামিল নিজের কপালে এমনভাবে হাত রাখলো, যেন একটা কোবরা দেখলো পায়ের কাছে। লুইস আর আরম্যান্ড, দুজনেই সতর্ক হয়ে উঠলো। তিনজন পুরুষ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে, হুট করেই পায়ের নিচের মাটি যেন কাঁপতে শুরু করল। সবাই ঘুরে দাঁড়ালো। বিশ মিটার দূর থেকে যেন রাগান্বিত হাল্ক ছুটে আসছে ভয়াবহ গতিতে। বিদ্যুতের গতিতে আসছে লা গুয়েন, জ্যাকেটটা বাতাসে উড়ছে, হাতে মোবাইল ফোন। এই দেখে ক্যামিল নিজের ফোনের জন্য পকেটে হাত বাড়ালো, মনে পড়লো ফোনটা যে বন্ধ। তার গতিপথ থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো সে। এখনও দম আছে তার। 

“মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন প্যান্টিনে। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠো।”

*

তীব্র গতিতে গাড়ি ছোটালো লুইস। কয়েক মিনিটের মাঝেই পৌঁছে গেল তারা। 

নদীর ধারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে গুদামঘর, কাঠের তৈরি কোন এক শিল্পকারখানা। অর্ধেক মালামাল রাখার জন্য, আর বাকি অর্ধেক ফ্যাক্টরি। বর্গাকৃতির বিল্ডিং এখন অনেকটা হলদেটে হয়ে গেছে। ১৯৩০ সালের মাস্টারপিসগুলোর একটা। স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে এখনও টিকে আছে একটা নামফলক ‘ফন্ডেরিস রালেস’। 

আশেপাশের সবকিছু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। শুধু এই বিল্ডিংটাই এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো কিছু দিনের মাঝেই এটাকেও সংস্কার করা হবে। দেয়ালের উপর থেকে নিচে সাদা, নীল, কমলা রঙ দিয়ে গ্রাফিটি করা। গতকাল কয়েকটা ছেলে দেয়াল বেয়ে বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলায় ওঠে। এখন যা কিছুটা অসম্ভব মনে হচ্ছে, তবে গতরাতে গ্রাফিটি করার শেষ মুহূর্তে ওদেরই একজন একটা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পায়, একটা বাক্স ঝুলানো, আর সেটার ভেতরে মানুষও আছে। পুলিশকে জানাবে কিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ভোর বেলায় অজ্ঞাত পরিচয় দিয়ে ফোন করে। দু-ঘণ্টার মাঝেই পুলিশ তাদেরকে খুঁজে বের করে, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। 

ফায়ার ব্রিগেড আর ক্রিমিনাল ব্রিগেডও চলে এসেছে। কয়েক বছর ধরে এই অবস্থায় পড়ে আছে এই বিল্ডিং। সবগুলো দরজা জানালা ইট দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। ফায়ার ব্রিগেডের কিছু সদস্য মই দিয়ে উপরে উঠছে, আর বাকিরা হ্যামার দিয়ে ভাঙছে দরজা। 

ক্যামিল দ্রুতগতিতে গাড়ি থেকে নেমে বিল্ডিংয়ে ঢুকলো, কেউ তার কার্ড দেখতে চাওয়ার সাহস করলো না। একটা ভাঙ্গা ইটে পা আটকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো, নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে ফায়ার বিগ্রেডের সদস্যদের বলল, “থামো।” 

সামনে এগিয়ে গেল সে। কেউ এসে তাকে বাঁধা দেয়ার আগেই দেয়ালে তৈরি হওয়া ছোট ছিদ্র গলিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। শুধুমাত্র সে ছাড়া, আর কারো পক্ষে এই ছিদ্র দিয়ে ঢোকা সম্ভব না। 

*

ভিতরটা পুরোপুরি ফাঁকা, কোথাও কোন জিনিসপত্র নেই। জানালার ভাঙ্গা অংশ দিয়ে আলো প্রবেশ করছে। টিপ টিপ করে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেলো। তার পায়ের কাছ দিয়ে পানির সরু রেখা সাপের মত আঁকাবাঁকা পথে চলছে। দূর থেকে প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। জায়গাটা দেখতে অনেকটা পরিত্যক্ত ক্যাথেড্রালের মত, বিল্ডিংটা যেন শিল্পায়নের শেষ সময়টাকে করুণভাবে উপস্থাপন করছে। এই রুমের আলো আর ব্যাকগ্রাউণ্ড দুটোই ছবির সাথে মিলে যায়। ওদিকে স্লেজহ্যামার দিয়ে এখনো দেয়ালে আঘাতের পর আঘাত চলছে। 

“কেউ কি আছেন?” চিৎকার করে বলল ক্যামিল। 

কিছু সময় অপেক্ষা করে দৌড়ানো শুরু করলো। রুমটা পনেরো-বিশ মিটার লম্বা, আর সিলিং চার পাঁচ মিটার উঁচু। মেঝেটা স্যাতসেতে, দেয়াল গড়িয়ে পানি পড়ছে, পুরো রুমের বাতাস কেমন জানি ভেজাভেজা আর ঠাণ্ডা। আরো সামনে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেউ কি আছেন?” 

এক রুম থেকে আরেক রুমে ঢুকলো। পেছনে দ্রুতগতিতে কিছু ছুটে আসার শব্দ শোনা গেল। আদতে তার সহকর্মীরা ছুটে আসছে। রুমটা জুড়ে পচা মাংস, প্রসাব আর পায়খানার তীব্র দূর্গন্ধ। 

লুইস পিছনে এসে দাঁড়ালো। ক্যামিলের মুখ থেকে বের হওয়া প্রথম কথাটাই শুনলো, “ফাকিং হেল…” 

কাঠের বাক্সটা মেঝেতে পড়ে আছে, একপাশের কিছু টুকরা ভেঙ্গে গেছে। মেঝেতে পড়ার সময় হয়তো ভেঙ্গে গেছে, মেয়েটা পালিয়ে গেছে। তিনটা ইঁদুর মেঝেতে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, ওখান থেকে পচা গন্ধ আসছে। একটু দূরেই মলমূত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ক্যামিল আর লুইস উপরের দিকে তাকালো। রশিটার এক প্রান্ত ছিঁড়ে গেছে, আরেকপ্রান্ত এখনও পুলিতে ঝুলে আছে। 

সবখানে রক্ত ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোথাও মেয়েটার কোন চিহ্ন নেই।

মেয়েটা যেন ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেছে। 

এমন অবস্থায় মেয়েটা পালালো কী করে? কীভাবে পালালো? কোন দিক দিয়ে পালালো? ফরেনসিক বিভাগ হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। তবে মেয়েটাকে আর উদ্ধার করতে হবে না, নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। 

মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছে, কিন্তু অন্যান্য ভিক্টিমের মত সরাসরি পুলিশ স্টেশনে যায়নি। এই ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুললো ক্যামিল আর লুইসকে। 

কয়েকমাস আগে সে একজন পুরুষকে হত্যা করে। প্রথমে বেলচা দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়, এরপর মুখের প্রায় অর্ধেক সালফিউরিক এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ভাগ্যচক্রে তার লাশ আবিষ্কার করে পুলিশ। 

আরো দুটি হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে যা একই উপায়ে করা হয়েছে। আরো যে হত্যা করা হয়নি, তাই বা কে জানে। তাদের লাশই বা কোথায় আছে। 

এমন অবস্থা থেকে পালিয়ে যেতে পারে যে মেয়ে, সে অবশ্যই সাধারণ কেউ নয়। 

মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। 

কিন্তু মেয়েটা কোথায় যেতে পারে, সে ব্যাপারে কেউ জানে না। 

অধ্যায় ২৬ 

আধো ঘুম থেকে জেগে উঠলো অ্যালেক্স। এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারছে না। 

নিজের শক্তির শেষবিন্দু ব্যবহার করে বাক্সটাকে জোরে জোরে দোলাতে লাগলো। এই দুলুনিতে ইঁদুরগুলোও ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না, বাক্সের গায়ে আরো জোরে আঁচড় কাটছে। ব্যথায় তীব্র চিৎকার করে উঠলো। রশির শেষপ্রান্তে বিপদজনকভাবে ঝুলছে বাক্সটা, আর সারা ঘর জুড়ে বয়ে যাচ্ছে বরফশীতল বাতাস। 

বাক্সটা যখন নিচের দিকে ঝুলে যায়, তখনি যেন ভাগ্যদেবী তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। বাক্সটা নিচু হতেই একপ্রান্তের রশি ছিড়তে শুরু করে। অ্যালেক্স তাকিয়ে পুরো প্রক্রিয়া দেখে। রশির প্রতিটি সুতো ছেড়ার সময় যেন ব্যথায় চিৎকার করছিলো। হুট করেই বিদ্যুৎ গতিতে বাক্সটা নিচে পড়ে যায়, সময়ের ভগ্নাংশে ঘটনাটা ঘটায় কোন প্রস্তুতিই নিতে পারেনি সে। বাক্সটা মেঝেতে পড়ার ফলে তীব্র ঝাঁকুনিতে ভিতর থেকে গোঙানি বের হয়ে এলো তার। তবে এই গোঙানি তার মুক্তির, তার স্বস্তির। দুটি কাঠের টুকরা হালকা ভেঙ্গে গেছে, তবে পুরোপুরি না। সে উপরের দিকে চাপ দিলো একটু ফাঁকা করার জন্য। 

হুট করে পড়ার ফলে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো সে। পুরোপুরি নিজেকে ফিরে পেতে কিছুটা সময় লাগলো। কিন্তু তার পরিকল্পনা যে কাজে লেগেছে, তা ঠিকই খেয়াল করেছে। একটা কাঠের টুকরা পুরোপুরি দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে, তবে বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু হাইপারট্রপিতে আক্রান্ত সে, বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি পাবে কিনা সে ব্যাপারে নিজেই সন্দিহান। তবুও সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে আস্তে আস্তে বের হলো। প্রথমে পা দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করে, হাত দিয়ে কাঠের টুকরা সরিয়ে বের হবার জায়গা তৈরি করে। বের হওয়ার পর তার মনে হলো যেন কবর থেকে মুক্তি পেলো। 

জীবন বাঁচানোর এই বাজিতে জিতে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল সে। এতোদিন দুঃখ, কষ্টে ভুগে ভুগে নিজের উপর সব আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, এরপর পাগলামিতে ভরা একটা প্ল্যান করে মুক্তি পাওয়া, সব মিলিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। মাটিতে বসে পড়লো। 

হুট করে কে যেন তাকে সতর্ক করে দিলো। তার মনে পড়লো এখনি মুক্তি আসেনি। আবার যদি ট্র্যারিক্স ফিরে আসে? গত কয়েকদিন আসেনি–কিন্তু এখন যদি আসে? 

যে কোন মূল্যে এখান থেকে বের হতে হবে। নিজের কাপড়ও যোগাড় করতে হবে। 

নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে দুইমিনিটেরও বেশি সময় লাগলো তার। অনেকদিন ধরে হাত পা না নাড়ানোর ফলে হাত পা কেমন জানি অবশ হয়ে গেছে। হাত পা একটু নাড়াচাড়া করতে গেলেই, তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। ব্যথায় অসহায় আর্তনাদ করে উঠলো সে। হাতে ভর দিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যায়। শরীরে আর একবিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। 

আবারো উঠে দাঁড়ানোর জন্য দরকার অকল্পনীয় ইচ্ছাশক্তি, অদম্য সাহস আর সর্বোচ্চ চেষ্টা। এ সবকিছু জড়ো করে একটু একটু করে হাত পা নাড়ানো শুরু করলো। মরণাপন্ন অ্যালেক্স আর জীবিত অ্যালেক্সের মাঝে অলিখিত যুদ্ধ চলছে। কিন্তু এই সময়ে এসে কিছুতেই হার মানতে চায় না সে। এক ইঞ্চি, এক ইঞ্চি করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আবারো ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল। মেঝেতে বাড়ি লেগে মুখে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। 

কিছু সময় পর, হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগুলো, একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা ঘাড়ে পেঁচিয়ে নিলো। সামনের পড়ে থাকা পানির বোতল হাতে নিয়ে, এক ঢোকে সম্পূর্ণ পানি খেয়ে নিলো। উপুড় হয়ে শুয়ে চিন্তা করলো- কতদিন পর এমন মুক্ত স্বাধীন হলো? কতদিন পর হাত পা নাড়াতে পারলো? কতদিন পর আবারো বাঁচার ইচ্ছে জেগে উঠলো? যেদিন ওই মরণবাক্সে বন্দী হয়, সেদিন থেকেই এমন দিনের দেখা পাবার একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল তার মনে। কিন্তু, আজকে সেইদিন উপস্থিত, নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হলো না তার। ধীরে ধীরে মাংসপেশীগুলো যেন জীবন ফিরে পেলো, সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিলো। ফ্রস্টবাইটে আক্রান্ত মানুষগুলোর জীবন ফিরে পাবার পর কেমন অনুভূতি হয়, আজ তা বুঝতে পারলো। 

ভেতর থেকে কেউ যেন আবারো সতর্কবার্তা পাঠালো, যদি সে চলে আসে? এক্ষুণি এখান থেকে পালাও। 

তাড়াতাড়ি নিজের আশেপাশে কিছু একটা খুঁজলো অ্যালেক্স। তার জামাকাপড়, হ্যান্ডব্যাগ, টাকা পয়সা, অপহরণের দিন পড়ে থাকা উইগসহ সবকিছুই পড়ে আছে ওখানে। ট্র্যারিক্স কিছুই নিয়ে যায়নি, কেননা তার একমাত্র চাওয়া ছিল অ্যালেক্সের মরণ। এইসব নিয়ে না ভেবে দ্রুত নিজের জামাকাপড় পড়ে নিলো। যদি লোকটা চলে আসে, তাই লড়াই করার জন্য কিছু খুঁজছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যন্ত্রপাতির মাঝে কাজে লাগার মত কিছুই খুঁজে পেলো না, তাই একটা শাবল তুলে নিলো। এটা সে কখন ব্যবহার করতো? আমাকে হত্যা করার পর? আমাকে মাটিচাপা দেয়ার সময়? এইসব ভেবে আরেকদফা ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। আর এটা উঠানোর মত শক্তিও যে তার নেই, সেই কথাটাও ভুলে গেল। 

জামাকাপড় পড়ার পর খেয়াল করলো তার গা থেকে প্রসাব, পায়খানা, বমির দুর্গন্ধ আসছে। কয়েকটা টুকরো কাপড় খুঁজে বের করে নিজের শরীরে পানি ঢাললো, নিজেকে পরিস্কার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। গা থেকে দুর্গন্ধ মোটেও কমছে না। আরো জোরে জোরে ঘষতে শুরু করলো। এখানে কোন আয়নাও নেই যে নিজেকে একনজর দেখবে। আয়নার কথা মনে করতেই হ্যান্ডব্যাগে থাকা আয়নার কথা মনে পড়লো। কিন্তু আবারো সে সতর্ক বার্তাঃ এখনো এখানে তুমি? তাড়াতাড়ি বের হও এখান থেকে!!! 

কাপড় পড়ার কারণে এখন কিছুটা উষ্ণতা অনুভব করছে। দুইবারের চেষ্টায় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে পালানোর জন্য তৈরি হলো। শাবল ওখানেই ফেলে গেল, কেননা এটা তার গতি আরো কমিয়ে দিবে। মাথা উঁচু করে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো, যা কিছুক্ষণ আগেও তার কল্পনার বাইরে ছিলো। তার চলার ধরণ অনেকটা বৃদ্ধা মহিলার মত। 

ট্র্যারিক্সের রেখে যাওয়া পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগুতে লাগলো। কেননা এতোদিনে ভালোমতোই বুঝে গেছে, এখান থেকে বের হবার পথ একটাই। আর প্রথমদিন যেখানে এসে ইটের দেয়াল দেখে থেমে গিয়েছিলো, ঠিক তার নিচেই মেঝেতে একটা ট্র্যাপডোর আছে, যা ওইদিন চোখে পড়েনি। হাতলের জায়গায় জট বেঁধে রয়েছে কিছু তার, ট্র্যাপডোর উঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। আরো কয়েকবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না, ভেতর থেকে একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এলো। এখন সে বুঝতে পারছে, ওইদিন পালানোর সময় ট্র্যারিক্স কেন তাকে তাড়া করেনি। কেননা সে ভালোমতোই জানতো, এই ট্র্যাপডোর খোলা তার সাধ্যের বাইরে। 

নিজের ভেতরে এক চাপা আক্রোশ, তীব্র ক্রোধ আর পাশবিক শক্তি অবুভব করলো সে। জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে, আর দৌড়ানো শুরু করলো। পায়ে পুরোপুরি বল ফিরে না পাওয়ায়, একটু খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে। শাবল আর কয়েকটা কাঠের টুকরা নিয়ে আবারো ট্র্যাপডোরের কাছে চলে এলো। এই শক্তি তার মাঝে কোথা থেকে এলো, তা নিজেই জানে না। এখন শুধু একটা জিনিসই তার মাথায় খেলছে, ‘এখন আমাকে যে করেই হোক বাঁচতে হবে।’ কোন কিছুই তাকে থামাতে পারবে না, প্রয়োজন হলে এখান থেকে বের হওয়ার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিবে। শাবলের এক প্রান্ত ট্র্যাপডোর আর মেঝের মাঝখানে দিয়ে, অন্যপ্রান্তে নিজের পুরো ভর দিলো। এতে যতটুকু ফাঁকা হলো, সেখানে পা দিয়ে একটা কাঠের টুকরা ঠেলে দিলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পর পনেরো ইঞ্চির মত ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো, যা মোটেও তার বের হবার জন্য যথেষ্ট না। আর একটু উলটাপালটা হয়ে পুরোটাই ধসে পড়লে, তাকে ছাতু হয়ে যেতে হবে। 

একটু থেমে আবারো নিজের পরিকল্পনা ঠিক করে নিলো। একটু দ্বিধার কারণে যদি হালকা পিছিয়ে যায়, তাহলে এখানেই আটকে থাকতে হবে। তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে প্রথমে ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে নিজের ব্যাগ ছুঁড়ে মারলো। মাটিতে পড়ার শব্দ শুনে অনুমান করলো খুব বেশি নিচে পড়েনি, তাই একটু আশ্বস্ত হলো। এবার তার পালা। উপুড় হয়ে শুয়ে প্রথমে নিজের পা ফাঁকা জায়গা দিয়ে গলিয়ে দিলো, আস্তে আস্তে পুরো শরীর। কিন্তু সমস্যা হলো, মাথাটা যখন ঘুরালো, তখনি হাতের কনুইয়ের গুতা লাগলো শাবলে। আর ওমনি সরে গেল শাবলটা। ন্যানোসেকেণ্ডের জন্য তার দম বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু রিফ্লেক্স এর কারণে বেঁচে গেল যাত্রা। সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ট্র্যাপডোর অতিক্রম করলো। অন্ধকার থেকে হুট করে আলোতে আসায় তার চোখ ধাধিয়ে গেল। চোখে আলো সওয়ার পর, নিজের হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে রওনা হলো। আর নিজেকে বারবার একই কথা বলছিলো, ‘আমি এখান থেকে বের হবো। আমি মুক্তি পাবো। আমি আবারো খোলা হাওয়ায় মুক্ত স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবো।’ কিছুদূর সামনে যাওয়ার পর একটা স্টিলের দরজা দেখতো পায়, কিন্তু এই দরজা খুলতে গেলে তার এক যুগ লেগে যাবে। তাই ভিন্ন পথ খুঁজতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটা করিডোরে আবিষ্কার করলো, যেখানে প্রসাবের তীব্র গন্ধ। ওখানেই একটা সিঁড়ি দেখতে পেলো, মনে পড়েছে এখানে আনার সময় এই সিঁড়িতেই তার মাথা ঠুকে গিয়েছিলো। কয়েকটা সিঁড়ি পেরোনোর পর একটা ধাতব দরজা দেখতে পায় সে। সেই দরজা সরিয়ে বের হতেই অনেকদিন পর পৃথিবীর মুক্ত বাতাস তাকে আলিঙ্গন করে গেল। 

অ্যালেক্স এখন মুক্ত। 

বাতাসের এই ঝাপটা তার খুব ভাল লাগলো। আবারো তার জীবন ফিরে পেয়েছে, আবারো সে নতুন করে স্বপ্ন বাঁধতে পারবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এখন তার কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। 

ত্রিশ মিটার দূরে একটা পরিত্যক্ত জাহাজ ঘাট দেখতে পেলো। আরেকটু দূরে কিছু ছোট ছোট বাসা, ওখান থেকে মৃদু আলো আসছে। 

অ্যালেক্স হাঁটা শুরু করলো। 

এতো রাতে কোন যানবাহন খুঁজে পাওয়াও দুস্কর। কিন্তু, একটু সামনেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিটাকে ডাকবে কিনা তাই নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো। এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। 

কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথও খোলা নেই। 

অধ্যায় ২৭ 

যখন একসাথে অনেকগুলো কাজ জমে যায়, তখন কোনটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ সেটা বের করাটাও কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে ক্যামিলের মতামত, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কিছুই না করা।” এমন কেস এ পড়লে তার একটা নিজস্ব টেকনিক আছে, যা সে ব্যবহার করে। পুলিশ একাডেমীতে পড়ানোর সময় এই টেকনিকের নাম দিয়েছিলো, ‘এরিয়াল টেকনিক’। চার ফুট এগারো ইঞ্চির একটা মানুষের মুখ থেকে এই কথা শুনে যে কেউ হেসে উঠবে, তাকে নিয়ে মজা লুটবে। কিন্তু একটা টু শব্দ করার সাহসও কেউ পায় না। 

সকাল ছয়টা বাজে। এরইমাঝে ক্যামিল তার গোসল আর নাস্তা সেরে নিয়েছে। তার ব্রিফকেসও রেডি। নিজের বিড়ালটাকে একটু আদর করে দিলো। 

এমন সময় সামনে পড়ে থাকা চিঠির দিকে নজর গেল তার। নিলামকারীরা কয়েকদিন আগে চিঠি পাঠিয়েছে তার বাবার সম্পত্তির ব্যাপারে। কিন্ত খোলার সাহস হয়নি। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলো, কিছুদিন শোক পালন করেছে, কিন্তু একদম ভেঙ্গে পড়েনি। তার সীমিত ক্ষতি হয়েছে। তার বাবার ব্যাপারে সব কিছুই অনুমেয় ছিলো; যেমন ছিল এই মৃত্যুটাও। কিন্তু গতকাল অবধি এই চিঠি খোলার সাহস পায়নি, কেননা এই চিঠি তার প্রজন্মের সমাপ্তি ঘোষণা করবে। কিছুদিন পরেই বয়স হবে পঞ্চাশ। পরিবারের কেউ বেঁচে নেই-প্রথমে তার মা, এরপর তার স্ত্রী, আর সবশেষে তার বাবা। সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার কোন সন্তান নেই কিংবা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বংশধারা বহন করার মত কেউ নেই। এটাই খারাপ লাগে তার, বাবার মৃত্যুর পর পুরোপুরি একা সে। জীবন নামের এই ছবিতে যখন একমাত্র চরিত্র হিসেবে বেঁচে থাকতে হয়, তখন আর তা আনন্দদায়ক থাকে না। কোন পিছুটান নেই। 

বাবার অ্যাপার্টমেন্ট আরো আগেই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। মায়ের কিছু ছবি তার বাবা অনেকদিন ধরে রেখে দিয়েছিলো, ওই ছবিগুলোই এখন নিলামে উঠবে। 

আর স্টুডিওর কথা বলাই হয়নি। ওখানে পা দিতেও সাহস পায় না সে- কেননা স্টুডিও জুড়ে আছে মাকে জড়ানো হাজারো স্মৃতি। ওখানের সিঁড়িতে চড়ে, দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা তার পক্ষে সম্ভব না। কখনোই না… 

নিজের সমস্ত শক্তি জড় করে, মায়ের এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে নিলামের ব্যাপারে তার কাছে সাহায্য চায়। ওই লোকই সব কিছুর ব্যবস্থা করে। নিলামের দিন তারিখও ঠিক করা হয়েছে, অক্টোবরের সাত তারিখে। সারা সন্ধ্যা তার মাকে উৎসর্গ করা হবে ওইদিন। মায়ের স্মরণে স্মৃতিসভা আর নানা আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলো মায়ের সমস্ত চিত্রকর্মই নিলামে তুলবে। কোন ছবিই কাছে রাখবে না। এর পিছনে নানা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছে। পরম শ্রদ্ধা আর সন্তুষ্টির ভাব নিয়ে বলল, ‘যদি কখনো মায়ের ছবি দেখার ইচ্ছা হয়, তাহলে গ্যালারিতে যেতে হবে।’ আদতে এটা যে খোঁড়া যুক্তি তা সে নিজেই জানে। আসলে মাকে সবসময় সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে সে, সবসময় মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, হিংসা, তিক্ততা আর অসন্তোষ মিশ্রিত এক বিচিত্র অনুভূতি কাজ করেছে, এক অদ্ভুত দোটানায় ভুগেছে সারা জীবন। পেইন্টিং তার মায়ের জীবনের একমাত্র চাওয়া ছিলো- আর এ জন্য নিজের জীবনের সাথে সাথে ক্যামিলের জীবনটাও উৎসর্গ করেছে। নিজের জীবনের যে অংশটুকু উৎসর্গ করেছে তার মা, সেইটুকুই অভিশাপ হয়ে নেমেছে তার জীবনে। 

তার মায়ের জীবনের শেষ সময়ে আঁকা আটটি ছবি বিক্রি করা হবে। বেশিরভাগই বিমূর্ত প্রকৃতির। ক্যামিল মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে, রংগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, মার্ক রথকোর ছবির দিকে তাকিয়েও এমন অনুভূতি হয় তার। ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকাকালীন সময়ে আঁকা দুটি ছবি ইতিমধ্যে জাদুঘরে পাঠানো হয়েছে, ছবিগুলোতে শেষ জীবনের কষ্ট গুলোই যেন ফুটে উঠেছে। ত্রিশ বছর বয়সে আঁকা পোট্রেট সে রেখে দিতে চেয়েছিলো। ছবির মধ্যে কিছু একটা আছে যা তাকে আকৃষ্ট করে। ছবির মুখটায় আছে এক অদ্ভুত শূন্যতা যা দর্শককে ছুঁয়ে যায়, আর আছে পরিপূর্ণ নারীস্বত্তা এবং তার সাথে শিশুসুলভ নিষ্পাপতার এক নিপুণ যুগলবন্দী, যেমনটা দেখা যায় মদের প্রভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কোন যুবতীর মুখে। এই পেইন্টিং আইরিনেরও খুব পছন্দ ছিলো। এর একটা ছবিও তুলে ফ্রেমে বেঁধে দিয়েছিলো। সেটা এখনও তার ডেস্কে রয়েছে। এই ছবিটা আরম্যান্ডেরও বেশ পছন্দ, এটাই কিছুটা বুঝতে পারে সে। ক্যামিল কয়েকবার ভেবেছে ছবিটা আরম্যান্ডকে দিয়ে দিবে। কিন্তু এখনো দেয়া হয়ে ওঠেনি। হয়তোবা আর হবেও না। মায়ের আঁকা এই পেইন্টিংটাও নিলামে তুলেছে। কোন পিছুটান রাখতে চায় না। সব পিছুটান দূর হলে হয়তো কিছুটা মানসিক শান্তি আসবে তার মনে। আর শেষ সুতো হিসেবে টিকে থাকা স্টুডিও মন্টফোর্টও বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। 

*

অবশেষে তার ঘুম আসার সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন কিছু ছবিও ভেসে উঠলো। বন্দী অবস্থায় থাকা এক তরুণী পালিয়ে যাচ্ছে। কিছু মৃত্যুর ছবি ভেসে উঠছে, কিন্তু সবগুলোই ভবিষ্যতের। সে নিজেও জানে না কেন তার এমন মনে হচ্ছে, কিন্তু ভাঙ্গা বাক্সটা আর তার সাথে মৃত ইঁদুর দেখে তার মনে হচ্ছে আরো খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে সামনে। অপেক্ষা করছে আরো মৃত্যু। 

নিচে এখনও মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। অবশ্য এতে খুব একটা সমস্যা হয় না তার। তবে এমন অবস্থায় আইরিন একটুও ঘুমাতে পারতো না। আর দুদুশে তো এমন সব কিছুতে মজা পায়, এখনও জানালার পাশে বসে আছে বিড়ালটা। 

মাথার ভেতরে পাকানো জট না খুলে বের হয় না সে। এখন তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। 

প্যান্টিনের ওই গুদামঘর ট্র্যারিক্স কীভাবে খুঁজে পেলো? এটা চিন্তা করা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এমন নানা প্রশ্নের জালে বন্দী ক্যামিল। এতোদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, গৃহহীন মানুষগুলোও দখল নেবার চেষ্টা করেনি। এর পিছনে দুটি কারণ। প্রথমত, জায়গাটা বসবাসের উপযুক্ত না। দ্বিতীয়ত, এখানে প্রবেশের জন্য মাটির উপরে একটা সরু টানেল ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসা যায় না। এর জন্যেই হয়তো ট্র্যারিক্সের তৈরি কাঠের বাক্সটা এতো ছোট ছিলো। এর চেয়ে বেশি আনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর মেয়েটাকে আনা তো আরোও কষ্টসাধ্য, লোকটা যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল তা বোঝা যাচ্ছে। যতক্ষণ না মেয়েটা স্বীকার করতো তার ছেলেকে কোথায় পুঁতে রেখেছে, ততক্ষণ আটকে রাখার পরিকল্পনা ছিল তার। 

নাটালি গ্রেঞ্জার। তারা জানে এটা আসল নাম না, তবুও এই নামেই ডাকে সবাই। ক্যামিল ভেবেছিলো ‘মেয়েটা’ বলে ডাকবে, কিন্তু মাঝে মাঝে নাটালি বলেই ডেকে ফেলে। কোন নামই নেই আর একটা ছদ্মনাম-এর মাঝে কোনটা বেশি ভালো? 

অপরাধীকে খোঁজার জন্য অনুমতি দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু যে মেয়েটা প্যাসকেলকে মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করার পর সালফিউরিক এসিড দিয়ে মুখ গলিয়ে দেয়, তাকে শুধুমাত্র সাক্ষী হিসেবেই রাখা হয়েছে। অথচ মেয়েটার রুমমেট ই-ফিট দেখে তাকে শনাক্ত করেছে, কিন্তু আদালত আরো শক্ত প্রমাণ চায়। 

প্যান্টিনের ওই গুদামঘর থেমে পাওয়া রক্ত আর চুলের নমুনার সাথে ট্র্যারিক্সের ভ্যান থেকে পাওয়া নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে। এতে করে তদন্ত কিছুটা হলেও এগুবে। কিন্তু, সে বেশ ভালোমতোই জানে এতোটুকু যথেষ্ট নয়। 

তার এই সন্দেহ প্রমাণ করার একমাত্র উপায় হলো সালফিউরিক এসিড সম্পর্কিত ওই দুটো কেস আবারো চালু করা এবং দেখা সবগুলো একই খুনির কাজ কিনা। লা গুয়েন বিশ্বাস না করলেও ক্যামিল নিশ্চিত-তিনটা খুনই একজন করেছে- তিনটা খুনই একই নারীর কাজ। স্থানীয় থানার কাছে ফাইলগুলো চেয়ে পাঠিয়েছে, সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ফাইল চলে আসবে। 

এক মুহূর্তের জন্য নাটালি গ্রেঞ্জার আর প্যাসকেল ট্র্যারিক্স এর কথা ভাবলো সে। ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে খুন? কিন্তু এক্ষেত্রে তার ধারণার উল্টো ঘটনা ঘটেছে; যদি এই কারণেই হতো তাহলে হয়তো আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে প্যাসকেল নাটালিকে খুন করতো। কিন্তু এর উল্টোটা…? কোন দুর্ঘটনা? ক্যামিল ভেবে কোন সমাধান পাচ্ছে না কী কারণে ছেলেটা খুন হতে পারে। নিজের চিন্তাভাবনাগুলো ঠিক পথে এগুচ্ছে না। এমন সময় দুদুশে তার কোর্টের আস্তিন ধরে উপরে উঠার চেষ্টা করছে, এভাবেই কি মেয়েটা পালিয়েছে? 

ক্যামিল পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার মুভিতে একটা দৃশ্য অনুপস্থিত। 

তারা জানে মেয়েটা নিজের জামা কাপড় উদ্ধার করেছে, রেখে গেছে তার জুতার ছাপ। মেয়েটাকে অপহরণ করার সময় হয়তো এই জুতোই পড়ে ছিলো, কেননা অপহরণকারী অবশ্যই এক জোড়া নতুন জুতো কিনে দিবে না। ট্র্যারিক্স মেয়েটাকে অমানুষের মত মেরেছে, এরপর ভ্যানে তুলেছে। মেয়েটার কাপড়ের কী অবস্থা হওয়া উচিৎ? কুচকানো, ময়লা, ছেড়া? আর যাই হোক জামা যে পরিস্কার থাকবে না এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আর এমন জামা পড়ে যে মেয়ে বাইরে ঘুরবে তাকে অবশ্যই চোখে পড়বে অনেকের, তাই না? 

“মেয়েটা একদম বিধ্বস্ত আর নোংরা,” উচ্চস্বরে বলে উঠলো ক্যামিল।

দুদুশে শব্দ শুনে তার মনিবের দিকে তাকালো। 

মেঝেতে পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো, আর পানির বোতলেও হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বের হওয়ার আগে মেয়েটা নিজের শরীর ধুয়ে নিয়েছে। 

“তবুও…তিন সপ্তাহ ধরে জমা হওয়া প্রসাব পায়খানার মাঝে থেকে, মাত্র তিন লিটার পানিতে কতটুকুই বা পরিস্কার হওয়া সম্ভব?” 

গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আবারো তার মনে উঁকি মারলো, “লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে কীভাবে নিজের বাসায় গেল?” 

*

“কে বলল কেউ তাকে দেখে নি?” আরম্যান্ড বলল। 

সকাল ৭:৪৫। ক্রিমিনাল ব্রিগেডের সদস্যরা উপস্থিত। সবাই না থাকলেও, পাশাপাশি বসে থাকা লুইস আর আরম্যান্ডকে দেখে যে কেউ মজা পাবে। লুইসের পরণে ধূসর রঙের কিটন স্যুট, স্টেফানো রিকির টাই, আর ওয়েস্টনের জুতা। ঠিক পাশেই বসে থাকা আরম্যান্ডের পড়নে ক্লিয়ারেন্স সেল এ কেনা সস্তা জামাকাপড়। ক্যামিলের মনে হয় আরম্যান্ড ইচ্ছে করেই ছোট জামাকাপড় কেনে যাতে খরচ কম হয়। 

“ব্যাপারটাতে আরেকটু মনোযোগ দিতে হবে,” বলল ক্যামিল । 

কেউ মেয়েটাকে খেয়াল করলো না, হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। না। এটা সম্ভব না। 

“কেউ হয়তো লিফট দিয়েছে?” বলল লুইস, কিন্তু তার নিজেরই বিশ্বাস হলো না এই কথা। রাত দুইটা বাজে কে ওখানে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? আর তা ছাড়া বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তিও মেয়েটার নেই। 

“কোনো বাস…” 

এটা সম্ভব। তবে রাতে ওই পথে বাস খুব একটা চলে না। যদি ভাগ্য মেয়েটার সহায় হয় তাহলে পেতে পারে, নইলে ছেঁড়া জামাকাপড় পড়া অবস্থায় আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বাসের জন্য। কিন্তু মেয়েটার যা অবস্থা, এতোক্ষণ টিকতে পারবে না। 

“ট্যাক্সি…” 

সর্বশেষ এই তথ্য যোগ করলো লুইস, কিন্তু…ভাড়া কি ছিল তার কাছে? আর এই অবস্থায় কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভার কি তাকে নিয়ে যেতো? একা একা হাঁটার পথে কেউ কি দেখেছে তাকে? 

একটা ব্যাপারে তারা নিশ্চিত যে মেয়েটা প্যারিসের দিকে গিয়েছে। কিন্তু কিসের মাধ্যমে পৌঁছালো সেটা জানা সম্ভব হয়নি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যাবে। 

অধ্যায় ২৮ 

ধীরে ধীরে সতর্ক পায়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলো অ্যালেক্স। ট্র্যারিক্স কি অপেক্ষা করছে তার জন্য? পালানোর খবর কি পেয়ে গেছে? প্রথমে লবি চেক করলো, কেউ নেই সেখানে। সিঁড়িতেও কেউ নেই; ব্যাপারটা পুরো স্বপ্নের মত মনে হলো তার কাছে। 

অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। 

আসলেই স্বপ্নের মত লাগছে। 

নিজের ঘর। এখন সে নিরাপদ। অথচ দুইঘণ্টা আগেও নিজের মৃত্যুর প্রহর গুণছিলো। তার জীবন ছিল ইঁদুরগুলোর হাতে। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে যেতে দেয়াল ধরে ভারসাম্য রক্ষা করলো। 

এক্ষুণি কিছু খাওয়া দরকার। 

কিন্তু তার আগে একবার নিজেকে দেখতে হবে। 

আয়নার নিজের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল অ্যালেক্স। বয়স যেন পনেরো বছর বেড়ে গেছে, দেখতেও কুৎসিত আর নোংরা লাগছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখেও হলদেটে একটা ভাব। 

পনির, ব্রেড, মাখন, কলা- ফ্রিজে যা পেলো সবকিছুই বের করলো। তাড়াহুড়ো করে খেয়েই গোসলের জন্য দৌড় লাগালো। কিন্তু গোসলখানায় পৌঁছানোর আগেই বমি করে দিলো। 

একটু জিরিয়ে এক লিটার দুধ খেয়ে নিলো।

হাত, পা, গোড়ালি, বুক আর মুখে তৈরি হওয়া ক্ষতগুলো ভাল মত পরিস্কার করে গোসলে গেল। গোসল শেষে সেখানে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে নিলো। ক্ষতগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাত আর পায়ের দুটি ক্ষতে ইনফেকশন হওয়ায় কিছুটা চিন্তিত মনে হলো তাকে। ল্যাবরেটরীতে কাজ করার সময় কিছু ঔষুধ সবসময় বাসায় রেখে দিতো। ক্যাবিনেট এ পেনিসিলিয়াম, বার্বিচুরেটস, ট্রাংকুলাইজার, অ্যান্টি-বায়োটিক সহ আরো বেশ কিছু ওষুধ খুঁজে পেলো। 

*

সবশেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো 

শোয়ার সাথে সাথেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

টানা তেরো ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙ্গলো অ্যালেক্সের। 

যেন কোমা থেকে জেগে উঠলো। 

আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগলো নিজের অবস্থান আবিষ্কার করতে। এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করলো না, তাই আবারো ঘুমানোর চেষ্টা করল। বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। 

আরো পাঁচ ঘণ্টা পর ঘুম শেষ হলো। সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। রেডিও থেকে জানতে পারলো আজকে বৃহস্পতিবার। 

ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসলো সে। সারা শরীরে এখনও বেশ ব্যথা আছে। হাত পা নাড়াতেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো। আস্তে আস্তে হালকা ব্যায়াম করে হাত পা টান করলো। বেশ দ্রুতই উন্নতি করছে, বিছানা থেকে উঠতেই মাথা ঘুরতে শুরু করলো, দেয়াল ধরে আবারো ভারসাম্য বজায় রাখলো। পড়ে গিয়ে আরেকটা ক্ষত বানানোর ইচ্ছে নেই। খুব সাবধানে হাঁটছে। এরইমাঝে পেটে ছুঁচোর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার আগে আরেকবার নিজেকে আয়নায় দেখলো, ক্ষতগুলো ব্যাণ্ডেজ করতে হবে। হুট করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠলো। সব কিছুর আগে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাকে। 

টারিক্স আবারো আসতে পারে আমাকে ধরতে। সে অবশ্যই আমার বাসার কথা জানে, কেননা বাড়ি ফেরার পথেই আমাকে অপহরণ করেছিলো, মনে মনে বলল অ্যালেক্স। এতক্ষণে হয়তো পালানোর খবর সে জেনে গেছে। জানালা দিয়ে সামনের রাস্তার দিকে নজর রাখলো অ্যালেক্স। 

ল্যাপটপ হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো অ্যালেক্স। ‘ট্র্যারিক্স লিখে গুগলে সার্চ দিলো। লোকটার পুরো নামও সে জানে না। জানে তার ছেলের নাম, প্যাসকেল। কিন্তু তার দরকার বাবার নাম। কেননা একমাত্র সেই জানে প্যাসকেলের সাথে কী করেছে আর কোথায় তাকে পুঁতে রেখেছে। 

সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফলে জ্যঁ পিয়েরে ট্র্যারিক্স সম্পর্কে একটা আর্টিকেল তার চোখে পড়লো। ওখানে ক্লিক করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো, 

‘পুলিশের তাড়া খেয়ে সন্দেহভাজন এক আসামীর আত্মহত্যা’

পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গত রাতে জ্যঁ পিয়েরে ট্র্যারিক্স নামে পঞ্চাশ বছর বয়সি এক লোককে পুলিশ তাড়া করে। ফ্লাইওভারের উপর উঠে লোকটা হঠাৎ করে গাড়ি থামিয়ে ওখান থেকে লাফ দেয়। নিচে পড়ার পর একটা আর্টিকুলেটেড লরির নিচে চাপা পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই মারা যায়। 

অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে প্যারিসের এক রাস্তা থেকে একটা মেয়ে অপহৃত হয়। পুলিশ এই কেসে লোকটাকে সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে খুঁজছিলো। তদন্তের স্বার্থে এই ব্যাপারে আরো তথ্য দিতে রাজি হয়নি যথাযথ কর্তৃপক্ষ। তবে মেয়েটার অপহরণের কারণ না জানা গেলেও, পুলিশ তার অবস্থান শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। পুরো ব্যাপারটা পুলিশকে হতবাক করে দেয়। তবে ভিক্টিমের অনুপস্থিতিতে সন্দেহভাজন আসামীর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চিহ্নিত করায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপারটা ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট ভিডার্ড এই কেসের রহস্য সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ আশ্বাস দিয়েছেন, আর কেসের দায়িত্ব পড়েছে ক্রিমিনাল ব্রিগেডের তুখোড় অফিসার ক্যামিল ভেরহোভেনের হাতে। 

নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হলো না অ্যালেক্সের। 

এরজন্যেই অমানুষটা আসতে পারেনি। লরির নিচে চাপা পড়ে! অবশ্যই সে আমাকে দেখতে আসবে না কিংবা ইঁদুরের খাবার দিতে আসবে না। বাস্টার্ড ট্র্যারিক্স নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে, তবুও পুলিশকে আমার কথা বলেনি, যাতে করে আমি মুক্ত হতে পারি। ভাল হয়েছে। এবার তোর নরকের কীট ছেলের সাথে নরকে গিয়ে মর তুই। 

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পুলিশ এখনো জানে না আমি কে। আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। অন্ততপক্ষে রিপোর্ট করার সময় কিছুই জানতো না। 

ব্রাউজারের সার্চ বক্সে নিজের নাম লিখে সার্চ দিলো। বেশ কয়েকটা সাজেশন আসলো, কিন্তু নিজের সম্পর্কে কোন তথ্যই দেখতে পেলো না। 

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অ্যালেক্স। 

ফোন চেক করে দেখলো-আটটা মিসকল উঠে রয়েছে। কিন্তু চার্জ প্রায় শেষের দিকে। চার্জে লাগানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়েই সোফায় পড়ে গেল। অভিকর্ষজ টান যেন এখন একটু বেশি তার জন্য। মাথার সামনে সবকিছু যেন ঘুরছে। একটু তন্দ্রাচ্ছন্নতা অনুভব করলো। কিছু সময় বসে থাকার পর এই ভাব কেটে গেল। এরপর আস্তে আস্তে গিয়ে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে মিসকলগুলো চেক করলো। সবগুলোই তার কাজ সম্পর্কিত। কেউ কেউ দুইবারও কল করেছে। ভয়েস মেইল শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না। 

“আচ্ছা। তুমি…অনেকদিন ধরে তোমার কোন খবর নেই যে?” 

সেই কণ্ঠস্বর…তার মা আর তার সমালোচনা। মায়ের সমালোচনা শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে সে। যখনি এইসব কথা শোনে, গলায় কিছু একটা পিণ্ড পাকিয়ে ওঠে তার। নানা ধরনের অজুহাত তৈরি করে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। সন্তানের কোন কাজের ব্যাপারে, তার মা বেশ সন্দিহান। 

“অস্থায়ী চাকরি? ওখান থেকেই ফোন করেছো?” 

মায়ের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর। 

“হ্যা, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না,” বলল অ্যালেক্স।

“কল করে তাহলে কী লাভ?” 

তার মা কখনোই ফোন করে না। যখন অ্যালেক্সে করে, তখন এইধরনের কথাবার্তাই শুনতে হয়। তার মা যেন রাজত্ব করে চলতে পছন্দ করে। মায়ের কাছে ফোন করা যেন তার কাছে কোন পরীক্ষা দেয়া- প্রস্তুতি নিতে হবে, মুখস্থ করতে হবে, আর মনোযোগ লাগবে সবটুকু। 

“আমি কিছুদিন শহরের বাইরে থাকবো। এটাও অস্থায়ী চাকরি। মানে আরেকটা অস্থায়ী…” 

“ওহ, তাই নাকি? এবার কোথায় যাচ্ছো?” 

“খুব অল্প সময়ের চুক্তি,” আবারো বলল অ্যালেক্স। 

“তার মানে শহরের বাইরে অল্প সময়ের কাজ, এটা বুঝলাম। কিন্তু যে জায়গায় যাবে, তার কোনো নাম নেই?” 

“একটা এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছি। বিস্তারিত এখনো জানি না। আর কাজ শুরু করার আগে কিছুই জানানো হবে না।”

“ওহ।” 

একটা কথাও বিশ্বাস করেনি তার মা। একটু দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, “তার মানে তোমার কাজ কোথাও তা জানো না। আর কার জন্য কাজ করছো তাও জানো না। তাই তো?” 

এই আলাপচারিতার মাঝে অস্বাভাবিক কিছুই নেই- আদতে এটাই তাদের স্বাভাবিক কথাবার্তা। আজকে পার্থক্য বলতে একটাই- সে আজকে বেশ দুর্বল আর রোগা। 

“না। আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন না…” 

“তাই, তাহলে কেমন?” 

“শোনো, আমার ফোনের চার্জ প্রায় শেষের দিকে……” 

“আসলেই…আমার ধারণা তুমি এটাও জানো না যে এই চুক্তি কতদিনের। একদিন হুট করে কাজ শেষ হবে, আর তারা তোমাকে ছুটি দিয়ে দিবে, তাই না?” 

উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে তার মা। কিছু সময় পর সে বলল, “আমাকে এখন যেতেই হবে।” 

“আচ্ছা। আর অ্যালেক্স…”

“হ্যা, বলো।” 

“আমি ভালই আছি। জিজ্ঞেস করার জন্য ধন্যবাদ।” 

এই বলে ফোন রেখে দিলো তার মা। 

মা সম্পর্কিত যাবতীয় চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো সে। ট্র্যারিক্স, এখন মৃত। পুলিশ, বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মার সাথে ও কথা বলা শেষ। এখন একটা কাজ বাকি, ভাইকে মেসেজ পাঠাতে হবে। 

চোখ বন্ধ করে, বুক ভরে শ্বাস নিলো অ্যালেক্স। পরবর্তী কাজের ব্যাপারে সবকিছু মনে মনে গুছিয়ে নিলো। কাজের কথা মনে করতেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল তার। 

ক্ষতগুলোর ব্যাজে আরেকদফা পরিবর্তন করলো। পেটে আবারো ছুঁচোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। আয়নার নিজেকে দেখলো। এখনো নিজের বয়স দশ বছর বেশি মনে হচ্ছে। 

গোসল সেরে কয়েক মিনিট নিজের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পা থেকে মাথা অবধি তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে শুরু করলো- বেঁচে থাকা আসলেই আনন্দদায়ক। নিজের জীবন আবারো ফিরে পেয়ে বেশ খুশি। গা মোছা শেষ হলে উলের সোয়েটার গায়ে দিয়ে হালকা সুড়সুড়ি অনুভব করলো। শরীরের সাথে মনও আনন্দে নেচে উঠলো। বেখাপ্পা সাইজের লিলেনের একটা ট্রাউজার পড়ে, চাবি আর এটিএম কার্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার পথে প্রতিবেশী মিস গুনাডের সাথে দেখা হলো তার। 

“কবে আসলে তুমি, অ্যালেক্স?” 

“এইতো গতকালকেই।” 

“ওখানের আবহাওয়া কেমন?” 

“অসাধারণ।” 

“ক্লান্ত নাকি?” 

“আসলে কাজের জন্য কয়েক রাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি, তাই এমন দেখাচ্ছে।” 

“তোমার ঘাড়ে কী হয়েছে?” 

“ওহ। তেমন কিছু না। একটু আঁচড় লেগেছে।” 

“আর কপালে?” 

“আর বলবেন না, ওইদিন বোকার মত পড়ে গিয়ে কেটে গেছে।” 

“ওহ আচ্ছা। একটু সাবধানে চলাফেরা করবে।” 

“আপনিও ভাল থাকবেন।” 

রাস্তায় বের হয়েই গোধূলির নীলাভ আলো মন কেড়ে নিলো তার। এই মুহূর্তে জীবন সার্থক আর সুন্দর মনে হলো। আরব দোকানীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিলো। সবকিছুই আজকে কেমন জানি অন্যরকম মনে হচ্ছে। প্রাণখুলে হাসছে, বুকভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। প্রতিটি জিনিসের মাহাত্ম আজকে নতুন করে অনুভব করছে। নিজের প্রয়োজনীয় কেনাকাটাগুলো আজকে পুরষ্কারের মত মনে হচ্ছে। কেনাকাটা শেষ করে নিজের বাসায় ফিরে এলো। জিনিসপত্র বেশি হওয়ার কারণে আজকে লিফট ব্যবহার করল। জীবনের প্রেমে পড়ে গেছে সে। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কেন আজকের মত না তাই ভাবতে লাগলো। 

*

প্রায় নগ্ন অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেক্স, নিচের দিকে একটা তোয়ালে পেচানো। আয়নায় দেখে মনে হলো, এখনো তাকে পাঁচ-ছয় বছর বেশি বয়স্ক দেখা যাচ্ছে। আর কিছুদিন শরীরের যত্ন নিলেই আবার আগের অবস্থায় চলে আসবে, তা নিজেই বুঝতে পারছে। শরীরের নানা জায়গার কাটাছেড়া, চোখের নিচের কালো দাগ, মুখের হলদেটে ভাব আর শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধ কিছুই থাকবে না। নিচের দিকে জড়ানো তোয়ালে ফেলে দিলো, এখন সম্পূর্ণ নগ্ন সে। নিজের ব্রেস্ট, নিজের পেট…এগুলোর দিকে তাকিয়ে গুমরে কেঁদে উঠলো। 

নিজের কান্নার শব্দ শুনে নিজেই আবার হেসে উঠলো, কেননা এখনও সে বুঝতে পারছে বেঁচে আছে বলে খুশি হবে নাকি আগের সেই অ্যালেক্সই আছে বলে মন খারাপ করবে। 

তবে সব কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে। জীবনে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তার। কিন্তু কখনোই দমে যায় নি। সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে সামনে এগিয়ে গেছে। 

এইসব ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো। 

অধ্যায় ২৯ 

তেল, গ্রিজ, কালি, পেট্রোল সহ আরো বেশ কয়েকটা জিনিসের গন্ধ একসাথে আসছে- মিসেস গ্যাটেনগোর কথা না হয় বাদই রইলো, তার শরীর দিয়ে আসছে ভ্যানিলার গন্ধ। গ্যারেজে পুলিশের গাড়ি দেখেই, কাচ দিয়ে ঘেরা অফিস থেকে প্রায় দৌড়ে চলে এসেছে সে, অনেকটা মনিবের আগমনে কুকুরের ছুটে আসার মত। 

“আপনার স্বামী সম্পর্কে কথা বলতে এসেছি।” 

“কিসের স্বামী?” 

“বার্নাড গ্যাটেনগো।” 

এই কথা শোনার পর যেন আকাশ থেকে পড়লো সে। মুখ হা হয়ে গেল। এই স্বামীর কথা ভাবেনি সে। আদতে, গতবছর আবারো বিয়ে করেছে মিসেস গ্যাটেনগো। তার বর্তমান স্বামী একটা ব্যাণ্ডের লিড সিংগার, আর একই সাথে এই গ্যারেজের মালিক। এখন সে মিসেস জরিস নামে পরিচিত। যে মুহূর্তে তাদের বিয়ে হয়েছিলো, সেই সময়ই যেন বার্নাড গ্যাটেনগো প্রতিজ্ঞা করেছিলো বাকি জীবন বারে কাটাবে। আগের স্বামীর কথা মনে পড়তেই বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তার মন। 

“দেখুন, কাজটা আমার নিজের ভবিষ্যতের জন্য করেছি। নিজস্ব গ্যারেজ পাওয়ার স্বপ্নে…” 

ক্যামিল বুঝতে পারলো। এতো বড় গ্যারেজ, চার পাঁচ জন মেকানিক, বেশ কয়েকটা গাড়িও আছে। এর মাঝে একটার বনেট খোলা, একজন মেকানিক কিছু একটা খুলে দেখছে। পেশীবহুল এক মেকানিক ময়লা কাপড়ে হাত মুছে ক্যামিলের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?” লোকটাকে দেখেই ক্যামিলের মনে হলো, কোন কারণে যদি মি. জরিস মারাও যায়, তাহলে অনায়াসে তার জায়গা দখন করতে পারবে এই তরুণ মেকানিক। বাইসেপস গুলো যেন চিৎকার করে বলছে, পুলিশ দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার মত পুরুষ আমি নই। 

“আমার বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যেও…” 

নিজের দ্বিতীয় বিয়ের পক্ষে সাফাই গেয়েই চললো মিস. জরিস। শুরু থেকেই নিজের দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ক্যামিলকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। 

লুইসের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, একটু ঘুরে দেখতে শুরু করলো ক্যামিল। তিন চারটা পুরাতন গাড়ি পড়ে আছে, উইন্ডশিল্ডে দামও লেখা আছে। এরপর অফিসের দিকে পা বাড়ালো। কাঁচে ঘেরা অফিস, মেকানিকরা কী কী করছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিজের পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ আস্থা আছে তার। একজন জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাবে, আর আরেকজন ঘুরে ঘুরে দেখবে। সবসময়ই কাজে দেয় এই পদ্ধতি। 

“কিছু খুঁজছেন আপনি?” 

উচ্চস্বরে কথা বলা মানুষটার দিকে ঘুরলো ক্যামিল। বাইসেপ সমৃদ্ধ সেই মেকানিক দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অবস্থান থেকে একচুলও না নড়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার চোখে মুখে। বেশ লম্বা এক মেকানিক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। হাতের ট্যাটুগুলো বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। 

“কোথা থেকে করিয়েছো ওগুলো?” 

বলেই হাতের ট্যাটুগুলোর দিকে আঙুল তাক করলো। 

“এইগুলো তো নব্বইয়ের দিকে দেখা যেতো। কতদিন ছিলে জেলে?” এই কথায় হতবাক হয়ে গেল তরুণ মেকানিক। বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বলল, “আমার ডিউটি শেষ। আমি এখন বাড়ি যাবো।” 

অ্যালেক্সের স্কেচ মিস. জরিসকে দেখাচ্ছে লুইস। ক্যামিলও চলে এলো সেখানে। ছবি দেখে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লো মিস. জরিস, চোখগুলো বড় বড় করে তাকালো, নিজের সাবেক স্বামীর প্রেমিকাকে দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। লি। “নামটার মাঝে একটা বেশ্যা ভাব আছে, তাই না?” প্রশ্ন শুনে দ্বিধায় পড়ে গেল ক্যামিল, লুইসও নিশ্চুপ। নাম শুধুই লি, এর আগে পিছে কিছু আছে কিনা তা বলতে পারলো না মিস. জরিস। মেয়েটার সাথে মাত্র দু’বার দেখা হয়েছে, কিন্তু ঘটনাগুলো এমনভাবে বলছে যেন কালকে ঘটেছে সবকিছু। “মেয়েটা বেশ মোটা ছিলো।” মেয়েটাকে দেখতে দুধে ধোয়া তুলসি পাতা মনে হলেও, আদতে ও একটা কুত্তী, যদিও ব্রেস্টগুলো বেশ বড় ছিলো।” আপাতত এই শব্দটা কিছুটা আপেক্ষিক মনে হচ্ছে ক্যামিলের কাছে। কেননা মিস. জরিসের ব্রেস্ট এতোটাই ছোট যে তা নেই বললেই চলে। তাই নিজের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনে এই মেয়ের ব্রেস্টকে দায়ী মনে করাটা তার জন্য স্বাভাবিক 

টুকরো ঘটনা দিয়ে পুরো গল্পটা সাজানোর চেষ্টায় ব্যস্ত ক্যামিল, কিন্তু হাতে তথ্য খুবই অপ্রতুল। নাটালি গ্রেঞ্জারের সাথে গ্যাটেনগোর দেখা হলো কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। গত দুই বছর ধরে কাজ করা মেকানিকও কিছু বলতে পারলো না এই ব্যাপারে। একজন বলল, একদিন মেয়েটা গাড়ি নিয়ে এসেছিলো এখানে। গাড়ির এক কোণায় বসে ছিলো। স্কেচ এর ছবিটা দেখালে, নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলো না ওই মেকানিক। তবে গাড়ির নাম্বার, কত সালের গাড়ি তা ঠিকমতো বলে দিলো। কিন্তু এখন এইসব তথ্য কোন কাজেই আসবে না। “মেয়েটার চোখ ছিল বাদামী,” বলে উঠলো আরেক মেকানিক। বয়স দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তার অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মেয়েদের বুক কিংবা পাছা দেখার বয়স নেই তার, তাই হয়তো চোখ খেয়াল করেছে। স্কেচ এ নাটালির চোখ দেখে, কিছুই বলতে পারলো না। এই লোকও কোনো কাজে আসলো না। ঠিকমতো বলতে না পারলে দেখে কী লাভ। “এমন বালের স্মৃতিশক্তি নিয়ে জীবনে কী করবে এরা?” মনে মনে বলল ক্যামিল। 

না। কেউই সঠিক জানে না কীভাবে তাদের দেখা হয়েছিলো। তবে, এই ভালোবাসা যে ঘূর্ণিঝড়ের মতই ছিলো, সবাই তা একবাক্যে স্বীকার করলো। হুট করেই একদিন মেয়েটার আগমন, আর পরেরদিন থেকেই গ্যাটেনগো যেন ভিন্ন এক মানুষ। 

প্রায়ই গ্যারেজ থেকে উধাও হয়ে যেতে লাগলো গ্যাটেনগো। একদিন মিস. জরিস তাকে অনুসরণ করে অনেকদূর যায়। কিন্তু নিজের সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে, এই ব্যাপার নিয়ে বেশি ঘাটায়নি। একরাতে তার স্বামী বাসায় ফিরে না, পরেরদিন সকালে বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে ঢুকলে ঝগড়া হয় তাদের মাঝে। তবুও লি এর সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ হয় না গ্যাটেনগোর। “ওই মাগীটা একদিন বাসায় আসে, আমার স্বামীর খোঁজ করতে,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল মিস. জরিস। দুই বছর পরেও তার চোখ ভিজে উঠলো। প্রায়ই লি’কে নিজের বাসার সামনে দেখতো মিস. জরিস। একদিকে নিজের স্ত্রী, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে ওই “সেক্স বম্ব” (নাটালি গ্রেঞ্জার কিংবা লি) এর শরীরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। দ্বিধায় ভুগতো তার স্বামী। কিন্তু একদিন সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নিজের মানিব্যাগ আর জ্যাকেট নিয়ে বাসা থেকে চলে যায়। এরপরের সোমবারে এক হোটেলে নিজের স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর শুনতে পায়। হোটেলের এক কর্মচারী লাশ রুমে লাশ আবিষ্কার করে। কিন্তু ওই হোটেলে না আছে কোন লবি, না আছে কোন রিসিপসনিস্ট। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পে করলেই রুমের চাবি পাওয়া যায়। তার স্বামীর কার্ড দিয়েই পেমেন্ট করা হয়েছিলো। কিন্তু কোথাও মেয়েটার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি। স্বামীর লাশটাও পুরোপুরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার, কেননা মুখের নিচ থেকে বীভৎস অবস্থা ছিল লাশের। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুসারে, হত্যার আগে কোন জোরজবরদস্তি করা হয়নি, জামাকাপড় যেমন থাকার কথা তেমনই ছিলো, প্রায় হাফ লিটার এসিড গিলেছে; গাড়ির ব্যাটারিতে যেটা ব্যবহার করা হয়। 

অফিসে ফিরে এসেই রিপোর্ট লিখতে শুরু করলো লুইস, দ্রুতগতিতে লিখছে যেন পিয়ানো বাজানোর অনুশীলন করছে। ক্যামিল ফরেনসিক রিপোর্ট আরেকবার চেক করলো। কিন্তু এসিডের ঘনমাত্রা সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। লোকটা স্বেচ্ছায় এসিড পান করে আত্মহত্যা করেছে। আর চার হাজার ইউরো খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা হত্যাকাণ্ডের আগের দিন তোলা হয়েছিলো। 

এই ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ রইলো না যে গ্যাটেনগো আর প্যাসকেল একই খুনির শিকার, সেটা নাটালি নামে হোক কিংবা লি নামে হোক। আর হত্যাকাণ্ডের পর চুরি যাওয়া টাকার পরিমাণ থেকে ধারণা করা যায়, খুনগুলো টাকার কারণে ছিল না। তাই প্যাসকেল ট্র্যারিক্স আর গ্যাটেনগোর অতীত ঘাটতে শুরু করলো তারা, যদি কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *