অ্যালফ্রেড ওয়াডহ্যামের ফাঁসি
ফাদার ডেনিসকে আমি কয়েকদিন আগের একটা আশ্চর্য সেঁয়াসের কথা বলছিলাম। আমি নিজেও সেখানে হাজির ছিলাম। যে ভদ্রমহিলা মিডিয়াম হয়েছিলেন, তিনি ভরের মধ্যে বলেছিলেন আমার এক পরলোকগত বন্ধুর আত্মা ওখানে উপস্থিত হয়েছে, সে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার বন্ধু বেঁচে থাকার সময় তার গলার স্বর যেমন ছিল, ঠিক সেই স্বরে তিনি কথা বলছিলেন। আমার মনে বিশ্বাস জন্মাবার জন্য ভদ্রমহিলা এমন কতগুলো ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন যা আমি আর আমার সেই বন্ধু ছাড়া তৃতীয় কারো জানবার কথা নয়। ‘মরণের ওপার থেকে ইহজগতের সঙ্গে একটা যোগাযোগের চেষ্টা চলছে এটা বোধ হয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না,’ আমি বলেছিলাম ফাদার ডেনিসকে।
ঘরের ভেতরটা বেশ গরম, তবু আমার মনে হল ফাদার ডেনিসের শরীর একটু কেঁপে উঠল। তিনি আগুন চুল্লির দিকে চেয়ারটা আরেকটু এগিয়ে নিলেন, দু-হাত মেলে ধরলেন সেই আগুনের দিকে।
—মৃতের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার, তাদের সঙ্গে তেমন কিছু করতে গেলে শয়তানের কবলে পড়াও অসম্ভব নয়, সে বন্ধু কিংবা আপনজনের ছদ্ম পরিচয়ে আপনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে। —মাঝা ঝাঁকিয়ে বললেন ফাদার।
—কিন্তু এটা তো আপনার অনুমান মাত্র। আমি বললাম, বরং বলা যেতে পারে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃত ব্যক্তিরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, এর মধ্যে আবার শয়তানকে টেনে আনছেন কেন?
উনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন।
—এখনও বেশি রাত হয়নি, তিনি বললেন, আপনার যদি তাড়া না থাকে তবে একটা ঘটনা আপনাকে বলি।
—আপনি বোধ হয় জানেন, ফাদার ডেনিস শুরু করলেন, পাদরির কাছে অপরাধ স্বীকার করা ক্যাথলিক ধর্মের একটা প্রচলিত রীতি। এর পবিত্রতা কোনোমতেই লঙ্ঘন করা যায় না। একজন পাপী যখন তার ধর্মগুরুর কাছে কনফেশনের জন্য আসে, সে তার এই বিশ্বাস নিয়েই আসে যে পাদরি ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তার অপরাধের কথা শুনে তাকে ক্ষমা করার অধিকার সেই পাদরির আছে। সেইসঙ্গে তার স্বীকারোক্তি পাদরির বুকে সিলমোহর হয়ে থাকবে, কোনো সংগত কারণেও প্রকাশ পাবে না। যদি সেই স্বীকারোক্তি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির কানে যাবার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকত, তবে কেউ পাদরির কাছে কনফেশনের জন্য আসত না। সেক্ষেত্রে ধর্মভীরু মানুষের মনের ওপর সবচেয়ে যে বড়ো নিয়ন্ত্রণ তা হারাতে হত চার্চকে, আর মানুষের চিরন্তন বিশ্বাস, তার কৃতকর্মের জন্য ভগবানের ক্ষমা লাভ করেছে, তাও নষ্ট হয়ে যেত।
অবশ্য পাদরি যদি নিঃসন্দেহ না হন যে কনফেশন করতে এসেছে সে তার অপরাধের জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত তবে তিনি তাকে ক্ষমা নাও করতে পারেন। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে অপরাধই সে করে থাকুক না কেন, পাদরিকে নীরবতা পালন করতেই হবে। তিনি যদি তা প্রকাশ করে একটা ঘোর অন্যায় বা অবিচার এড়াতে পারেন তবু তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। যা তিনি শুনেছেন তা কনফেশনের পবিত্র গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে হবে, এই হল ধর্মীয় কানুন।
—এর ফল খুব মারাত্মক হতে পারে, আমি বললাম, কিন্তু এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমি একমত।
—অনেক ক্ষেত্রেই এই নিয়মের জন্য মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। ফাদার ডেনিস বললেন, আজ আমি আপনাকে এমন একটা স্বীকারোক্তির কথা বলব যেটা আমার কাছেই করা হয়েছিল।
—কিন্তু আপনি তো তা পারেন না, আমি বললাম, স্বীকারোক্তি যখন বলছেন।
—সেই গোপনীয়তা রক্ষার দায় থেকে আমি এখন মুক্ত। ফাদার ডেনিস তাঁর কাহিনি শুরু করলেন।
বছরখানেক আগে একটা খুনের ঘটনা আপনার হয়তো মনে নেই। জেরাল্ড সেলফি নামে এক ভদ্রলোক ওই খুনের শিকার হয়েছিলেন। এই ঘটনায় কোনো রহস্য ছিল না, কোনো প্রেমের ব্যাপারও নয়, তাই জনসাধারণের মনে ওই খবর কোনো রেখাপাত করেনি। সেলফি কিছুটা অসংযত চরিত্রের মানুষ ছিলেন, কিন্তু সমাজে তাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। তাঁর কিছু ব্যক্তিগত দুর্বলতা ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে, কোনো এক বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা ফাঁস করে দেবার হুমকি দেখিয়ে, কেউ তাঁর কাছে টাকা দাবি করছিল। ভদ্রলোক ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। সেলফি যেদিন মারা যান সেদিন সি আই ডি-র এক অফিসার তাঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন দিনরাত কাজ করার লোকটিকেই এ ব্যাপারে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেই লোকটির নাম অ্যালফ্রেড ওয়াডহ্যাম। বয়সে ছোকরা। বেশিদিন সে কাজে ঢোকেনি, তার অতীতও কেমন যেন ধোঁয়াটে। পুলিশ তাকে হাতেনাতে ধরবার জন্য ফাঁদ পাততে চেয়েছিল, সে ব্যাপারে সেলফিকে কী করতে হবে তার খুঁটিনাটি ছিল সেই চিঠিতে। সেলফির মৃত্যুর পর তাঁর লেখার টেবিলের একটা দেরাজে তালা ভাঙা ছিল। ওই ফ্ল্যাটে সেলফি আর ওয়াডহ্যামই শুধু থাকত। একজন ঠিকে কাজের মেয়ে সকালে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি আর টুকিটাকি ঘরের কাজ করে চলে যেত। দুপুর আর রাত্রের খাওয়া সেলফি ক্লাবেই সারতেন। ওই বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায় একটা রেস্তরাঁ ছিল। সেখানেও মাঝে মাঝে খেতেন সেলফি। সেই রাত্রে ওখানেই তিনি ডিনার সেরেছিলেন। পরদিন সকালে ঠিকে মেয়েটি কাজ করতে এসে ফ্ল্যাটের বাইরের দরজা খোলা দেখতে পায়, সেলফি গলা কাটা অবস্থায় বসবার ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিলেন। ওয়াডহ্যামকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিন্তু তার শোবার ঘরে নোংরা ফেলার বালতিতে জলের মধ্যে মানুষের রক্ত পাওয়া গিয়েছিল। দু-দিন পরে সে ধরা পড়ে।
পুলিশের কাছে সে বলেছিল, তার জন্য যে ফাঁদ পাতা হয়েছে সেটা সে সন্দেহ করেছিল। মি সেলফি যখন নীচের রেস্তরাঁয় রাতের খাবারের জন্য গিয়েছিলেন, সে তখন মনিবের দেরাজ খুলে চিঠিটা দেখতে পেয়েছিল। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে সে ঠিক করে পালাবে, মনিব ফিরে আসার আগেই সে সরে পড়েছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জেরার মুখে কিছু উলটোপালটা কথা সে বলেছিল। তার শোবার ঘরে যে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, আর সেলফিকে খুন করার পেছনে তার যে মোটিভ, এই দুই বিবেচনা করে জুরিরা মত দিয়েছিলেন সে দোষী। মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল তার। এই আদেশের বিরুদ্ধে সে আপিল করেছিল কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি।
ওয়াডহ্যাম ছিল ক্যাথলিক। একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক হিসাবে আমার কর্তব্য ছিল জেলখানার যে কুঠুরিতে সে মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষা করছিল, সেখানে গিয়ে তাকে ধর্মের কথা শোনানো। আমার সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিল। আমি তাকে বার বার অনুরোধ করেছিলাম, তার আত্মার শান্তির জন্য সে যেন আমার কাছে তার অপরাধ স্বীকার করে। কিন্তু তার অন্য সব অপরাধের স্বীকারোক্তি করতে ইচ্ছুক হলেও, যে অপরাধে তার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল সে-ঘটনায় নিজেকে সে নির্দোষ বলেছিল বার বার। একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু নিশ্চিত। ওই ঘটনা ছাড়া অন্য সব দুষ্কর্মের জন্য সে সত্যিই অনুতপ্ত হয়েছিল। আমাকে সে বলেছিল, আদালতে পরস্পরবিরোধী কিছু কথা বলেছে কিন্তু তার মূল বক্তব্য ছিল নির্ভেজাল সত্য— সে খুন করেনি। এবং তার যদি ফাঁসি হয় তবে অন্যায়ভাবে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। এমনকী ফাঁসির আগের দিন সন্ধেবেলা দু-ঘণ্টা আমি তার সঙ্গে ছিলাম, তার জন্য প্রার্থনা করেছিলাম, তাকে আবার অনুরোধ করেছিলাম কনফেস করতে। কিন্তু সে তার বক্তব্য থেকে এক চুলও সরেনি। তখনই আমার কেমন সন্দেহ জেগেছিল— সত্যিই কি সে নিরপরাধ?
আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। লোকটির আগামীকাল সকালে ফাঁসি হবে, ভোর ছ-টার আগে জেলখানায় হাজির হতে হবে আমাকে। আমি তাকে ঈশ্বরের করুণালাভের জন্য ধর্মীয় নিয়মে অভিষিক্ত করব কি না বুঝতে পারছিলাম না। যদি সে সত্যিই খুনের অপরাধে অপরাধী হয় কিন্তু আমার কাছে স্বীকারোক্তি না করে তবে মৃত্যুর আগে আমি তাকে অভিষিক্ত করতে পারি না। কিন্তু যদি সে নির্দোষ হয় আর আমি তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করি তবে সেটাও হবে ঘোর অবিচার। ফেরার পথে ওয়ার্ডারের সঙ্গে আমি কথা বললাম।
—ওই কয়েদির সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে একটু সরে গিয়ে একজনকে যাবার রাস্তা করে দিল। তার মুখ আমার অচেনা নয়, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসমিদের সে ফাঁসি দেয়। ওখানকার জল্লাদ।
—আমিও কিছু বুঝতে পারছি না, ওয়ার্ডার জবাব দিল, আমি জানি ওর দোষ প্রমাণ হয়েছে, আপিলও খারিজ হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলব, না, আমি বিশ্বাস করি না।
রাত দশটার সময় আমি শুতে যাব এমন সময় আমার পরিচারিকা এসে খবর দিল হোরাস কেনিয়ন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য নীচে অপেক্ষা করছে। সেও একজন ক্যাথলিক। একসময় আমি তাকে বন্ধু বলেই মনে করতাম। কিন্তু তার সম্বন্ধে পরে এমন কতগুলো কথা আমার কানে এসেছিল যে তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখিনি। আমি স্পষ্টই সেকথা বলেওছিলাম। লোকটি ছিল খারাপ প্রকৃতির। আমরা সকলেই কোনো-না-কোনো সময় অন্যায় কাজ করি, কিন্তু ওই লোকটা মন্দের জন্যই যেন মন্দ কাজ করত। আমি বলে পাঠালাম দেখা করতে পারব না। কিন্তু লোকটা সোজা ওপরে আমার ঘরে চলে এল। বলল তার প্রয়োজন খুব জরুরি। ওইরাতেই সে কনফেস করতে চায়। একজন ধর্মযাজক হিসাবে তাকে সে-সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে আমি পারি না।
তার স্বীকারোক্তি হল, জেরান্ড সেলফিকে সে খুন করেছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল লোকটা বোধ হয় আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। কিন্তু সে শপথ করে বলল তার কথা মিথ্যে নয়। ওই ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সে আমাকে দিল। সেরাতে সেলফির সঙ্গে সে ওই রেস্তরাঁয় খেয়েছিল। তারপর তার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল তাস খেলতে। সেলফি তাকে বলেছিল পরদিন বাড়ির চাকরটিকে ব্ল্যাকমেলের জন্য পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ‘আজ সে চালাকচতুর ছোকরা,’ সেলফি বলেছিল, ‘আগামীকাল এই সময় সে হয়তো নিজেকে আর অত চালাক ভাববে না।’ তার চাকর এসে তাস খেলার টেবিল পেতে দেবে বলে সে ঘণ্টা বাজিয়েছিল। তারপরই দেখল টেবিল পাতাই আছে। তার ঘণ্টা শুনে চাকর যে এল না, সেটা সে আর খেয়াল করেনি। তার দু-জন বেশি পয়সার বাজিতে খেলছিল, সেলফি বাজির পর বাজি হারছিল, কেনিয়নকে সে বলেছিল জোচ্চোর। এই নিয়ে দু-জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়, তা থেকে ঘুসোঘুসি। রাগের মাথায় কেনিয়ন টেবিল থেকে একটা ছুরি নিয়ে সেলফির গলায় বসিয়ে দিয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রক্তপাতে মৃত্যু হয়েছিল সেলফির…। কেনিয়নের মনে পড়ে যায় ঘণ্টায় সাড়া দিয়ে চাকরটি ঘরে আসেনি। সে পা টিপে টিপে ওয়াডহ্যামের ঘরে গিয়েছিল। শূন্য ঘর। ওই ফ্ল্যাটের অন্য কোনো ঘরেও কেউ নেই। সে তখন ওয়াডহ্যামের ঘরে গিয়ে হাতের রক্ত ধুয়েছিল, ময়লা ফেলার বালতিতে সেই হাত-ধোয়া জল ফেলেছিল। তারপর ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা রেখে সে নীচে নেমে গিয়েছিল।
তার কাহিনি শেষ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে হাসল।
—শ্রদ্ধেয় যাজক মশাই, এখন কী করবেন? বেশ যেন উপভোগ করছে এমনভাবে সে কথাগুলো বলল।
—ভগবান রক্ষা করেছেন, তুমি তোমার অপরাধ স্বীকার করেছ। আমি জবাব দিলাম। একজন নির্দোষ মানুষকে বাঁচাবার সময় এখনও আমাদের হাতে আছে। তুমি এখুনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করো।
সে উঠে দাঁড়াল, হাঁটু গেড়ে সে কনফেস করছিল, প্যান্টের ওই জায়গার ময়লা ঝেড়ে সে বলল, কী অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি, আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই।
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।
—আমি নিজেই তবে পুলিশের কাছে যাব, আমি বললাম।
লোকটা হা হা করে হেসে উঠল।
—না, যাজক মশাই, আপনি তা পারেন না, ধূর্ত হাসি হেসে সে বলল, কনফেশনের যে পবিত্র গোপনীয়তা তার কী হবে? বরং একজন ধর্মযাজকের সেকথা মনে আনাও পাপ। প্রিয় ডেনিস, আমার কিন্তু সত্যিই আপনার জন্য করুণা হচ্ছে। তবে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে রসিকতা করছিলেন, ভেবে বলেননি।
—আমি ভেবেই বলছি, আমি বললাম, এখুনি দেখবে আমি ভেবে বলছি কি না। কথাটা আমি বললাম বটে কিন্তু আমার গলায় তেমন দৃঢ়তা ছিল না। একজন নির্দোষ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সব কিছু করা যায়।
—ক্ষমা করবেন, আপনার কথাটা সত্যি নয়, সে বলল, আমাদের ধর্মে মৃত্যুর চাইতেও ভয়ানক একটা জিনিস আছে, তা হল আত্মার নরকভোগ। আমার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে আপনার নিশ্চয়ই তেমন পাপভোগ করার ইচ্ছে নেই। আমি সব কিছু ভেবে চিন্তেই আপনার কাছে স্বীকারোক্তি করেছি, কোনো ঝুঁকি নিইনি।
কিন্তু তুমি ওই লোকটিকে না বাঁচালে সেটা খুনই করা হবে।
—ও সেকথা, কিন্তু আমি তো খুন আগেই করেছি, কেনিয়ন জবাব দিল, এ ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে আরেকটা খুন কোনো ব্যাপারই নয়। বেচারা ওয়াডহ্যাম, আগামীকালই তো ওর ফাঁসির দিন, তাই না? তবে ওর শাস্তিটা বেশি কঠিন হয়ে গেল বলে আমি মনে করি না, ব্ল্যাকমেলিং একটা জঘন্য অপরাধ।
আমি টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে ধরলাম।
—বাঃ, ভারি মজার ব্যাপার তো! কেনিয়ন বলল, সবচেয়ে কাছের থানা হল ওয়ালটন স্ট্রিট। আপনার নম্বর চাইবার দরকার নেই, শুধু বলুন ওয়ালটন স্ট্রিট পুলিশ স্টেশন! কিন্তু আপনি তা পারবেন না, আমার এখানে হোরাস কেনিয়ন নামে একজন লোক এসেছে, সে স্বীকার করেছে যে সে-ই সেলফিকে খুন করেছে— একথা কি আপনি বলতে পারবেন? কেন মিথ্যে ভড়ং করছেন পাদরি মশাই! তা ছাড়া আপনি যদি তা বলেন, আমি বলব আমি তেমন কিছুই স্বীকার করিনি। একজন ধর্মযাজক, যিনি তাঁর ধর্মের পবিত্র অঙ্গীকার ভাঙতে পারেন, তাঁর মুখের কথার দাম কী? ছেলেমানুষি করবেন না।
—কেনিয়ন, আমি বললাম, ভগবানের নামে আর নরকযন্ত্রণার কথা মনে করে তুমি ধরা দাও। আমি কিংবা তুমি কয়েকটা বছর যদি কম বাঁচি তাতে কী এসে যায়, বরং আমাদের পাপ কাজের জন্য আমরা যদি অনুতপ্ত হই, সেকথা স্বীকার করি এবং তার জন্য ঈশ্বরের ক্ষমা লাভ করি, তবে সেটাই হবে পরম পাওয়া। আমি কথা দিচ্ছি দিনরাত আমি তোমার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করব।
—আপনার অশেষ দয়া, সে বলল, তবে আপনি নিশ্চয়ই ঈশ্বরের করুণা লাভের জন্য ওয়াডহ্যামকে ধর্মীয় আচারে অভিষিক্ত করতে এখন আর আপত্তি করবেন না। তাহলে আগামীকাল সকালে সে যদি পরপারে যাত্রা করে তাতে কী এসে যায়?
—ওকে বাঁচাবার কোনো ইচ্ছেই যদি তোমার না থাকে, প্রায়শ্চিত্তের কথাও যখন তুমি ভাবছ না, তবে আমার কাছে স্বীকারোক্তি করতে কেন এসেছিলে তুমি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
—ভালো প্রশ্ন করেছেন, কেনিয়ন বলল, কিছুদিন আগে আপনি আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। আপনি বলেছিলেন কোনো ভদ্রলোক আমার সঙ্গে মেলামেশা করবে না। হঠাৎ আজই আমার মাথায় এল, আপনাকে এই সংকটে ফেলতে পারলে বেশ মজা হবে।
যাবার জন্য পা বাড়িয়ে সে বলল, ‘আমি রাস্তায় ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আজ রাত্রে আপনাকে নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। আপনি কোথাও যেতে চান তো আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। সে চলে গেল।
আমি যে মানসিকভাবে কী নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলাম তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না, আমার ভেতরটা যেন পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম কনফেশনের পবিত্র রীতি না ভেঙে আমি কি কিছু করতে পারি? জানালা দিয়ে আমার চোখে পড়ল ওয়েস্টমিনস্টারের ক্লক টাওয়ারে তখনও আলো জ্বলছে পার্লামেন্টের অধিবেশন তবে চলছে। ধর্মীয় রীতি লঙ্ঘন না করে হোম সেক্রেটারিকে আমি বলতে পারি একটা কনফেশন থেকে আমি জানতে পেরেছি ওয়াডহ্যাম নির্দোষ। তিনি আমার কাছে বিস্তারিত কিছু জানতে চাইলে আমি তাঁকে জানাব— তারপরই আমি বুঝতে পারলাম তাঁকে আমি কিছুই জানাতে পারব না, তাঁকে বলতে পারব না যে খুনি সেই রাত্রে সেলফির সঙ্গে তাঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। সেই খবরের সূত্র ধরে এটা হয়তো বেরিয়ে পড়বে যে কেনিয়ন সেই রাত্রে তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেয়েছিল। কিন্তু আমি যা-ই করি না কেন, আমাকে কারো পরামর্শ নিতে হবে।
আমি তখুনি প্রধান ধর্মযাজকের কাছে ছুটে গেলাম। মাঝরাত তখন পেরিয়েছে, তিনি শুয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু আমার জরুরি অনুরোধে নীচে নেমে এলেন। আমি তাঁকে নামধাম গোপন করে ঘটনা খুলে বললাম। আমি যা ভেবেছিলাম তিনিও তাই বললেন। হোম সেক্রেটারির সঙ্গে অবশ্যই আমি দেখা করতে পারি এবং তাঁকে একথা বলতেও বাধা নেই যে, এমন একটা স্বীকারোক্তি আমার কাছে করা হয়েছে, কিন্তু আমি এমন কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি না যাতে কাউকে শনাক্ত করা যায় কিংবা ধর্মীয় রীতি লঙ্ঘিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন অমন ভাসা ভাসা খবরে ফাঁসির হুকুম বোধ হয় রদ করা যাবে না।
—তোমার মনে যত যন্ত্রণাই হোক, তিনি বললেন, এটা তোমাকে অবিশ্যিই দেখতে হবে যে, অন্যায় করার জন্য সে-যন্ত্রণা তুমি ভোগ করছ না, করছ যা উচিত তাই করার জন্য। ধর্মের পবিত্র নিয়ম ভেঙে কেজন মানুষকে বাঁচাবার তাগিদ তোমার আসছে শয়তানের প্রলোভন থেকে, তার ইচ্ছে বশীভূত না হবার জন্য তোমাকে যে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে সেটার উৎসও কিন্তু সেই এক— শয়তানের খেলা।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হোম সেক্রেটারির আপিস কামরায় আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে নির্দিষ্ট কোনো সূত্র না দিলে এ ব্যাপারে তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়, একথাই তিনি বললেন। তিনি অবিশ্যি বুঝলেন আমার পক্ষে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
—বিচারে সে দোষী প্রমাণিত হয়েছিল, তিনি বললেন, তার ক্ষমা ভিক্ষার আবেদনও গ্রাহ্য হয়নি। নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ না পেলে আমি কিছুই করতে পারি না।
একটু চিন্তা করে তিনি বললেন, এটা একটা মর্মান্তিক ঘটনা! আপনার কাছে কেউ এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি করেছে এটা আমি অবিশ্বাস করছি না, কিন্তু তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। আপনি লোকটির সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে পারেন না? তার মনে ভগবানের ভয় ঢোকাতে পারেন না? কাল ওর ফাঁসি হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি যদি যুক্তিসংগত কোনো তথ্য আমাকে দিতে পারেন, তবে আমি কথা দিচ্ছি সঙ্গেসঙ্গে ফাঁসির হুকুম স্থগিত রাখার নির্দেশ আমি দেব। আপনি এখানে কিংবা আমার বাড়িতে কোনো সময় ফোন করবেন।
আমি হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।
পরদিন সকাল ছ-টার আগেই আমি জেলখানায় গেলাম। ওয়াডহ্যামকে আমি বললাম সে যে নিরপরাধ তা আমি বিশ্বাস করেছি, আমি তাকে ঈশ্বরের করুণা লাভের যোগ্য হিসাবে ধর্মীয় নিয়মে অভিষিক্ত করলাম। সে ওই পবিত্র অনুষ্ঠান এবং আশীর্বাদ শান্তভাবে গ্রহণ করল, তারপর নির্ভয়ে মৃত্যুবরণ করল।
ফাদার ডেনিস একটু থামলেন।
আপনি যে সেঁয়াসের কথা বলছিলেন, তিনি আবার বললেন, আমাদের সেই মূল আলোচনায় আসার আগে অনেক সময় লেগে গেল, কিন্তু আমি এখন যা বলব তা বুঝতে হলে পুরো ঘটনা আপনার জানা দরকার ছিল। আমি বলেছিলাম মৃতের আত্মার কাছ থেকে যে বার্তা আসে, তারা যে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, তা আসলে সত্যি নয়, কোনো অশুভ শক্তি তাদের রূপ ধারণ করে ওই কাজ করে। আপনি বলেছিলেন, শয়তানকে কেন এর মধ্যে টেনে আনা। আমি সেই কথাই এখন আপনাকে বলব।
ফাঁসির পর আমি বাড়ি ফিরে এলাম। ওটা ছিল শীতের ভোরবেলা, তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। ওই শোচনীয় ঘটনার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী, তবু কিন্তু আমার মন স্থির আর শান্ত ছিল। কেনিয়নের কথা আমি একবারও ভাবিনি, শুধু ওয়াডহ্যামের কথাই চিন্তা করছিলাম— অন্যায়ভাবে তাকে শাস্তি পেতে হল, একটা দুঃখজনক ঘটনা। আমি মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম, আমি ঠিক পথে চলতে পেরেছি। কেনিয়ন যদি আমার অভিযোগের ভিত্তিতে এখন পুলিশের হেপাজতে থাকত, কিংবা সেই কারণে ওয়াডহ্যামের ফাঁসি না হত, তবে একজন যাজক হিসাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ভঙ্গের ঘোর অপরাধে আমি অপরাধী হতাম।
সারারাত আমার ঘুম হয়নি, বাড়ি ফিরে রোজকার পুজো-আর্চা সেরে আমি একটু ঘুমিয়ে নেবার জন্য একটা সোফায় শুয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম জেলখানায় ওয়াডহ্যামের সঙ্গে আমি আছি, আর সে জানে তার নির্দোষিতার প্রমাণ আমার হাতে আছে। ফাঁসির ঠিক আগের ঘটনা। পাথুরে ঢাকা বারান্দায় প্রহরীদের জুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছে, শব্দটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওয়াডহ্যামও শুনতে পেল সেই শব্দ, সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে আঙুল মেলে দিল।
—আপনি একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিতে মরতে দিচ্ছেন, অথচ আপনি তাকে বাঁচাতে পারতেন, অভিযোগের কণ্ঠে সে বলে উঠল, আপনি তা করতে পারেন না, ফাদার ডেনিস। ফাদার ডেনিস। ক্রমাগত সে চিৎকার করতে লাগল, ওর কুঠুরির দরাজ না খোলা পর্যন্ত ওর চিৎকার থামল না।
আমার ঘুম ভেঙে গেল, খুব কাছ থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকছিল বলেই ঘুমটা ভাঙল, কার গলা সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আমি আমার শান্ত, নির্জন ঘরে একা, দিনের অস্পষ্ট আলো জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। ঘুমের মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, ওই মুহূর্তে আমার ঘুমের ঘোর কেটে গিয়েছিল, আমার খুব কাছে অদৃশ্য এক মানুষের আত্মার উপস্থিতি আমি অনুভব করছিলাম— যে মানুষটিকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলাম তার আত্মা আমার নাম ধরে ডাকছে।
একটু ধাতস্থ হবার পর আমি সমস্ত ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিলাম। গতকাল রাত থেকে যেভাবে আমার কেটেছে, একটা দুঃস্বপ্ন দেখা খুবই স্বাভাবিক। কয়েকটা দিন নিরুপদ্রবেই কেটে গেল। তারপর একদিন রোদ ঝলমলে জনবহুল একটা রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা অশুভ পরিবর্তন আমি অনুভব করলাম, একটা যেন ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হল। আমার অত্মরাত্মা অশুভ কল্পনায় কেঁপে উঠল। তারপরই ওয়াডহ্যামকে দেখলাম। ফুটপাথ ধরে আমার দিকেই ও এগিয়ে আসছিল, যেন খুশি, ভদ্র এক মানুষ। ও আমার দিকে তাকাল, সঙ্গেসঙ্গে ঘৃণায় বিকৃত হল ওর মুখ। আশা করি প্রায়ই আমাদের দেখা হবে ফাদার ডেনিস, আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় এই কথাটা ও বলল। আরেকদিন গোধূলি বেলায় আমি বাড়ি ফিরে সবে ঘরে ঢুকেছি, হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ শুনতে পেলাম, তারপরই দেখলাম জানলার ওপাশে ওয়াডহ্যামের শরীরটা ঝুলছে, ফাঁসির আগে তার মুখ যে কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, সেইভাবে ঢাকা মুখ।
কখনো কখনো আমি যখন পড়াশোনা করছি, দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেত এবং বন্ধ হত, আমি বুঝতাম ও এসেছে। ওই প্রেতাত্মার আবির্ভাব কিন্তু ঘন ঘন হত না, হয়তো তাহলে আমি সাবধান হতাম, আমার প্রতিরোধ শক্ত হয়ে উঠত। কিন্তু বেশ কিছুদিন বিরতির পর যখন আমি অসতর্ক থাকতাম, ভাবতাম ওকে আমি পরাস্ত করেছি, তখনই ও দেখা দিত। মাঝে মাঝে আমি নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছিলাম। তবে সবসময় ওর দেখা পাবার আগে একটা অশুভ শক্তির উপস্থিতি আমি অনুভব করেছি। এই তো গত রবিবার—
ফাদার ডেনিস হঠাৎ থেমে গেলেন, দু-হাত দিয়ে চোখ ঢাকলেন যেন কোনো আতঙ্কজনক দৃশ্য দেখতে না হয়।
গির্জায় আমি ধর্মের কথা বলছিলাম। তিনি আবার শুরু করলেন, উপাসনার মস্ত ঘরটা ভক্ত মানুষে ভরে গিয়েছিল। ধর্মের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করা ছাড়া দ্বিতীয় চিন্তা আমার মাথায় ছিল না। ওটা ছিল প্রভাতকালীন উপাসনা, জানলার রঙিন কাচের ভেতর দিয়ে এক ঝলক আলো এসে পড়েছিল, রামধনু রঙের আলো। আমার বর্ক্তৃতা যখন মাঝপথে, হঠাৎ ভেসে এল একখণ্ড কালো মেঘ, সঙ্গেসঙ্গে আমি অনুভব করলাম সেই অশুভ শক্তি আসছে। হল ঘরটা এত অন্ধকার হয়ে গেল যে সব আলো জ্বালিয়ে দিত হল। বেদির ওপর একটা ডেস্কে একটা বাতিদান ছিল, ওখানে আমি আমার কাগজপত্তর রেখেছিলাম। সেই আলোটা জ্বলে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে বেদির ঠিক নীচে সংরক্ষিত আসন আলোকিত হয়ে উঠল, আর সেখানে চোখ পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। দেখলাম সেই আসনে আমার দিকে মুখ তুলে বসে আছে ওয়াডহ্যাম। তার মুখ রক্তবর্ণ, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, আর গলায় ফাঁসির দড়ির ফাঁস।
মুহূর্তের জন্য আমার গলা কেঁপে গেল, আমি বেদির রেলিং দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম। সে যেমন আমার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, আমিও ঠিক তেমনভাবেই তাকিয়েছিলাম তার মুখের দিকে। একটা আত্মার চরম ঘৃণা গাঢ় অন্ধকারের মতো আমাকে যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল। একজন নিরপরাধকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি, এ শাস্তি আমার প্রাপ্য।
;;; তারপরই রাতের আকাশে হঠাৎ কালো মেঘ সরে গেলে উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন জ্বলজ্বল করে, আমার মনে সেই বিশ্বাস ফিরে এল একজন ধর্মযাজক হিসাবে ও ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না। সঙ্গেসঙ্গে আমার মনে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মাল ওই প্রেতাত্মা শয়তানের দূত এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটাকে প্রতিহত করতে হবে। আমি যাকে দেখেছি সে কোনো মানুষের আত্মা নয়, আসল মানুষের নকল আত্মা, শয়তান প্রেরিত এক অশুভ শক্তি। অমি তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার কাগজপত্তর তুলে আবার বর্ক্তৃতা শুরু করলাম। ওই ক্ষণিকের বিরতি আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল, কিন্তু পরে আমি জেনেছিলাম ওটা ছিল মুহূর্তকাল, কারো নজরে আসেনি। আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করলাম কোনো নৈতিক শাস্তি আমি ভোগ করছি না, আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল;;;।
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। তাঁর দু-চোখের স্থির দৃষ্টি দরজার দিকে, সেই দৃষ্টিতে ভয়ের লেশমাত্র চিহ্ন নেই, আছে তীব্র বিদ্বেষের ভাব।
ওটা আসছে, তিনি বললেন, আপনি যদি কিছু শোনেন কিংবা দেখেন, ভয় পাবেন না, ওটাকে অবজ্ঞা করবেন, ঘৃণা করবেন, কারণ ওটা অশুভ।
দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, তারপর আবার বন্ধ হল। কাউকে ঢুকতে না দেখলেও আমি বুঝতে পারছিলাম ফাদার ডেনিস এবং আমি ছাড়াও ঘরে অশরীরী কিছু একটার প্রবেশ ঘটেছে এবং আমার মনে তার অস্তিত্বের একটা প্রতিক্রিয়া ঘটছে— একটা গলিত শবের দুর্গন্ধ যেমন একজনকে শারীরিকভাবে অসুস্থ করে, আমার মনও তেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তখনও আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু এটা অনুভব করছিলাম আগুন চুল্লির উত্তাপে যে ঘরটা এতক্ষণ উষ্ণ আর আরামদায়ক মনে হচ্ছিল, তা ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে, একটা কিছুর প্রভাবে স্তিমিত হয়ে আসছে আলো। আমার খুব কাছে টেবিলের ওপর একটা বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছিল, ওটা থেকে যে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল হঠাৎ সেটার ঔজ্জ্বল্য কমে গেল, আগুন নিভে এলে কয়লা যেমন নিষ্প্রভ লাল হয়ে ওঠে ঠিক তেমন একটা লালচে আভা দেখা দিল সেখানে।
ফাদার ডেনিস তাঁর চেয়ারে ঋজু হয়ে বসে ছিলেন, আমার চোখে অদৃশ্য এমন কিছুর ওপর তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছিল, মৃদু স্তব করছিলেন তিনি, তাঁর গলায় যে ত্রুশবিদ্ধ যিশুমূর্তি ঝুলছিল সেটা তিনি হাতের মুঠোয় চেপে ধরেছিলেন। তারপরই আমি দেখতে পেলাম। শূন্যে তাঁর সামনে আকার নিচ্ছে একটা মুখ। ফোলা ফোলা রক্তবর্ণ, একটা মুখ, জিভটা একপাশে বেরিয়ে আছে, শূন্যে ওটা ঝুলছে আর সামনে পেছনে দুলছে। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল সেই মুখ, এখন আর আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে, ওটা ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে। যদিও একটা প্রেতাত্মা, আমার মনে হচ্ছিল ওটা জীবন্ত আর প্রাণবন্ত। মানুষের আত্মা ওটা নয়, নারকীয় কিছু একটা।
ফাদার ডেনিস হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, সেই ঝুলন্ত ঘৃণ্য বস্তু আর তাঁর মধ্যে দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি। তিনি সেই পবিত্র ত্রুশ তুলে ধরলেন। শান্ত, অবিচলিত কণ্ঠে তিনি বললেন ঈশ্বরের করুণা যতদিন না তোমাকে অনন্ত মৃত্যুর বরদান করছে, ততদিন তোমাকে এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে— যাও, চলে যাও।
বাতাসে একটা বিলাপের সুর ভেসে উঠল, একটা প্রবল ঝঞ্ঝয় কেঁপে উঠল ঘর, তারপরই ঘরের আলো উজ্জ্বল হল, আবার ফিরে এল উষ্ণতা। ঘরে আমরা দু-জন ছাড়া আর কেউ নেই। ফাদার ডেনিসের দু-চোখ যেন বসে গেছে, একটা প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বে তাঁর কপাল থেকে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, কিন্তু তবু তাঁর মুখ থেকে এমন একটা দীপ্তি বেরুচ্ছে যা আগে কখনো কোনো মানুষের মুখে আমি দেখিনি।
আর ও আসবে না, তিনি বললেন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক ওই ক্রুশের সামনে আমি ওকে কুঁকড়ে যেতে দেখেছি…আপনার দু-চোখ আমাকে বলে দিচ্ছে আপনি এখন বুঝতে পেরেছেন মানুষের চেহারায় যা দেখা দিয়েছিল তা পুরোপুরি অশুভ।
আমরা আরও কিছুক্ষণ কথা বললাম।
ভালো কথা, ফাদার ডেনিস বললেন, আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার কাছে একজনের স্বীকারোক্তি আমি কেমন করে আপনাকে বলব। আজ সকালে হোরাস কেনিয়ন আত্মহত্যা করেছে। উকিলের কাছে সে একটা প্যাকেট রেখে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর পর ওটা খুলে যেন সব কাগজে ছাপা হয়। আজ সন্ধ্যায় এক কাগজে আমি সেটা দেখেছি, তাতে সে কীভাবে সেলফিকে খুন করেছিল তার পূর্ণ বিবরণ আছে। ও চেয়েছিল ঘটনাটা যেন সারা দেশে প্রচার পায়।
—কিন্তু কেন? আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।
ফাদার ডেনিস একটু চুপ করে রইলেন।
—মন্দ কাজেই তার ছিল আনন্দ, তিনি বললেন, আগেই বলেছি, মন্দের জন্যই সে মন্দ কাজ করত, ওটা ছিল তার কাছে একটা তামাশা। আইনের শাসনের যখন সে ধরাছোঁয়ার বাইরে, তখনই সত্যি ঘটনা সবাই জানুক এই ছিল তার নির্দেশ। বিকৃতরুচির মানুষ ছিল কেনিয়ন।
ই এফ বেনসনের গল্প অবলম্বনে