অ্যারিস্টটল কিংবা শেক্সপীয়র
প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার সময় প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করি ভোরের পৃথিবী। পুব আকাশে রাঙিয়ে ওঠার আগের মুহূর্তগুলি যেন এক স্বপ্নলোকের। আঁধারের খোলস ছিঁড়ে একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে সাদা ধোঁয়ারং দিনের প্রথম মুহূর্ত। বাতাস কলুষহীন। নিশ্বাস নিতেও আরাম। ফুসফুস ধুয়ে মুছে বিশোধিত।
পুব আকাশ লাল হয়ে ওঠার সঙ্গে দিনের রঙেরও বদল। বাজারের মোড়ে অজস্র দোকানপাট, বাজারের ভিতরে প্রচুর সবজির দোকান। বাসস্ট্যান্ডে সারি সারি বাস অপেক্ষায়। গোটা ফুটপাথ জুড়ে চায়ের দোকানের সারি, জ্বলছে স্টোভ বা উনুন। কোনও কোনওটা থেকে গন্ধ বেরচ্ছে ঘুগনির বা আলুর দমের।
এসব নৈমিত্তিক দৃশ্য দেখতে দেখতে পার হয়ে যাই বাজারের ভিতর দিয়ে বড়ো রাস্তায়। সেখান থেকে আরও কিছুটা হেঁটে মস্ত সবুজ মাঠ। ঘণ্টাখানেক সবুজ হাওয়া বুকে ভরে আবার বাড়ির পথে। ফেরার পথে দেখি দৃশ্যপট বদলে গেছে অনেকখানি। সবজিওয়ালা-ফলওয়ালাদের চারপাশে উপচে পড়ছে ব্যাগ-হাতে বাবুদের ভিড়। চলছে দামাদামির পর ঝপাঝপ পাল্লায় ওজন। ভরে উঠছে বাজারের ব্যাগগুলি।
সেরকম আজও হাঁটছে নতুন দিনের পর্যটক হয়ে। রোজকার মতোই আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি নতুন কিছু। হঠাৎ চোখে পড়ল সেই মানুষটাকে যাকে প্রায়ই দেখি এক দার্শনিকের ভূমিকায়। তার কৌতূহলী দুটি বড়ো বড়ো চোখ দেখে মনে হয় আমার চেয়েও আবিষ্কারে ব্যস্ত। মুখে এলোমেলো দাড়ির রাজ্য। মাথায় কতদিন-না-কাটা একমাথা ঝাঁকড়া রুক্ষ সুক্ষ চুল। পরনের ছেঁড়া জামাপ্যান্টে কতদিনের ময়লা! বগলে একতাড়া সাদা কাগজ নিয়ে হেঁটে চলেছে আনমনে। দু-চোখ নিবদ্ধ ভোরের রং ছড়াতে থাকা চারপাশের পৃথিবীর দিকে। কখনও আকাশের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে বলছে কিছু। যেন এ-যুগের এক দার্শনিক আনমনে খুঁজে চলেছে জীবনের অপার রহস্য।
তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি পৃথিবীর। সুপার মার্কেটের কাছে এসে লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তখন সবে এসে পৌঁছেছে সবজিওয়ালারা। খুলছে তাদের কাল রাতে ঢেকে রেখে যাওয়া আলু-পেঁয়াজ-আদা কিংবা ঝিঙে-পটল-কুমড়ো-টম্যাটো-ঢ্যাঁড়শের পশরা। আসতে শুরু করেছে ফলওয়ালা, কেউ হাই তুলতে তুলতে সরাচ্ছে প্লাস্টিকের আবরণ, কেউ কেউ প্লাস্টিক সরিয়ে মুছতে শুরু করেছে প্রতিটি ফল যাতে খদ্দেরের কাছে চকচকে দেখায় তার পণ্য।
সারি সারি চায়ের দোকানগুলো অবশ্য খুবই ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ডের ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের চা-পিপাসা মেটাতে। ধোঁয়া-ওঠা চা-ভর্তি মাটির খুলিগুলো আমন্ত্রণ জানাচ্ছে যাত্রীদেরও।
লোকটিকে আমি প্রায় রোজই দেখি, কিন্তু চিনি না, যাওয়া-আসার পথে লোকটিকে দেখতে পাই নানা ভঙ্গিমায়। বসে থাকে সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে। হেলান দিয়ে বসে থাকা লোকটি তখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে নিবিষ্ট তার পাশে জড়ো করা কাগজের ডাঁইয়ের উপর। সাদা কাগজ খুলে বসে খুব দ্রুত লিখে চলেছে অজস্র আঁকাবাঁকা অক্ষর! পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। অন্যপাশে ডাঁই করে রাখা লেখা কাগজের স্তূপ।
কী লেখে তা নিয়ে ছিল আমার অনন্ত কৌতূহল। কখনও তাকে দেখি বড়ো বড়ো পায়ে হাঁটছে ফুটপাথ দিয়ে। আকাশের দিকে মুখ। কী যেন বলছে বিড়বিড় করে। বগলে সর্বক্ষণই একগুচ্ছ সাদা কাগজ।
কখনও বিকেলে এদিকে এলেও দেখেছি হয় চুপচাপ বসে আছে সিঁড়িতে, নয়তো লিখে চলেছে ঝুঁকে পড়ে। কখনও কোনও চাওয়ালা দয়া করে তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে এক-খুলি গরম চা, সেই চায়ে ঠোঁট ডুবিয়ে পরম তৃপ্তিতে হাসছে নিজের মনে। তার পাশে জড়ো করে রাখা সেই অক্ষরভর্তি কাগজের ডাঁই।
কখনও কাজের অবকাশে লোকটির মুখ ভেসে ওঠে মগজে। লোকটি সারাদিনে কী খায়, তার কি আদৌ কোনও বাড়ি আছে, নাকি রাতেও শোয় এখানকার ফুটপাথে— এরকম সাত-দশ ভাবনাও ভেবে ফেলি কী জানি কেন!
এরকম দেখে আসছি অনেক অনেক দিন।
আজ হঠাৎ মনে হল এই অচেনা লোকটিকে আবিষ্কার করি।
লোকটির হাঁটাচলা, তাকানো— সবই খুব নির্বিকার ভঙ্গিতে। আজ তার পিছু নিই। সুপারমার্কেট পেরিয়ে লোকটি হাঁটছে ফুটপাথ ধরে। আমিও হাঁটতে থাকি। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল একটা মরা সজনে গাছের সামনে। ভালো করে দেখল তার শুকিয়ে আসা ডালপালা, কাণ্ড। কী দেখল সে-ই জানে! আবার একটু এগোল, লম্বা লম্বা পায়ে, তাকাল রাস্তার এদিক-ওদিক, পার হয়ে গেল চওড়া রাস্তাটা।
ওপারে গিয়ে দাঁড়াল বাসশেডের নীচে, যেন পরবর্তী বাস এলে তাতে উঠে বসবে। পর পর তিনটে বাস এল, কিন্তু একটুও চাঞ্চল্য নেই তার ভঙ্গিমায়। দেখল মানুষজন। তারপর আবার পার হল রাস্তাটা যেখান থেকে এসেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসল সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে। এই জায়গাটাই তার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস। যাতায়াতের পথে এখানেই বেশি দেখা যায় তাকে। নীচে থেকে তিন নম্বর সিঁড়িতে বসে হেলান দিয়ে পিঠ ঠেকাল চার নম্বরে। বগলে চেপে ধরা কাগজগুচ্ছ। কী যেন ভাবছে নিবিষ্ট হয়ে।
তখন লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এ-যুগের এক অ্যারিস্টটল।
আমিও লোকটিকে তখন পড়ছি। তার তাকানো, আলসেমি, কৌতূহল— সব কিছু। কিছুক্ষণ পরে বগল থেকে বার করে পাশে নামিয়ে রাখল সেই কাগজগুচ্ছ। এতক্ষণে দেখলাম তার এক পিঠে টাইপ করা, অন্যপিঠ সাদা। কোনও অফিসের বাতিল কাগজই হবে হয়তো।
লোকটি ভাবছে আর বিড়বিড় করছে। কী ভাবছে তা সেই জানে। একটু পরেই বুক পকেট থেকেবার করল একটা গোলাপি ডটপেন। তারপর ঝুঁকে পড়ল কাগজের উপর।
সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে দু-ধাপ উঠে আমি তার অজান্তেই গিয়ে দাঁড়াই তার পাশে। লোকটি তার লেখায় এত নিবিষ্ট যে, খেয়ালই করল না আমার অস্তিত্ব।
দেখছি ঘসঘস করে লিখে চলেছে আঁকাবাঁকা অক্ষর। কিছু অক্ষর চেনা, অধিকাংশই অচেনা। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেকখানি লেখা হয়ে গেছে তার। টাইপ করা কাগজগুলোর সাদা দিকটা মেলে ধরে লিখে চলেছে একের পর এক লাইন। কিছুক্ষণ পর পর লিখে ফেলা পৃষ্ঠাগুলো উল্টে রাখছে পাশের কাগজগুলের স্তূপে।
তার এই লেখক ভূমিকা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছিল লোকটার নাম দিই শেক্সপীয়র।
তা এই নব্যযুগের শেক্সপীয়র কী লিখছেন তা জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। লোকটি কি পাগল, না কি অনির্দিষ্ট সময় কর্মহীন থেকে হারিয়ে ফেলেছে নিজের বাস্তব অস্তিত্ব!
কিছুক্ষণ লেখার মধ্যে হঠাৎ দেখি সামনের এক চায়ের স্টল থেকে একটি ছেলে এসে তার পাশে রেখে গেল একটা বড়ো খুরি ভর্তি চা। লোকটি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, সেও। তার কাছে কোনও পয়সাও চাইল না। যেন তাদের পরম বন্ধু।
লোকটি মুখ তুলে হাতে তুলে নিল খুরিটা, কয়েক মুহূর্ত দেখল গরম চায়ের লোভনীয় রূপ, তারপর ঠোঁটের কাছে ধরে একটা চুমুক দিল খুব আরাম করে।
লোকটির দাড়িগোঁফভর্তি মুখের অভিব্যক্তিতে পরম প্রসন্নতা। হয়তো দুপুরের খাওয়াও আসে এভাবে।
চা পানের এই সামান্য অবসরে তার মুখোমুখি হই, যেন একজন ভিআইপি-র সাক্ষাৎকার নিচ্ছি এমন শরীরী ভঙ্গিমা আমার। বললাম, কিছু মনে না করলে দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করব?
লোকটি একটু অবাক, মুখ তুলে বলল, কী কথা?
আপনাকে রোজ-রোজ বহু কিছু লিখতে দেখি। রাশি রাশি কাগজ ভরে তোলেন অক্ষরে অক্ষরে। কী লেখেন রোজ এত!
লোকটি অদ্ভুতভাবে হাসল। যেন ভারী বালখিল্যের মতো প্রশ্নটা করেছি। বলল, কত কিছু লিখি। লেখার কত অজস্র বিষয়।
ঠিকই বলেছেন। তবু জানতে ইচ্ছে করে কী লেখেন রোজ?
লোকটির মুখে নিষ্পাপ, সরলসুন্দর হাসি, বলল, ওই আর কী, খসড়া করি।
খসড়া? কীসের খসড়া?
নিজেকে নিয়ে! রাশি রাশি অক্ষরের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখি, নিজেকে আবিষ্কার করি।
উত্তর শুনে বেশ ধন্দে পড়ি। নিজেকে আবিষ্কার করা তো এক দুরূহ কর্ম! বলি, কী আবিষ্কার করেন? নিজেকে আবিষ্কার করার কীই বা আছে!
লোকটি আবার হাসল। ভারী তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে রোজ অসংখ্য ঘটনা ঘটে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তার কোনও মূল্য নেই। কিন্তু আমার মনে হয়— আছে। প্রত্যেকটি ঘটনা মিলিয়ে আমাদের জীবনের ভাঙাগড়া। প্রতিটি ঘটনা থেকেই আমাদের শিক্ষা। প্রতিটি ঘটনা থেকে এরকম তিল তিল করে গ্রহণ করা শিক্ষাই তো গড়ে তোলে একজন মানুষের জীবনবোধ, সমৃদ্ধ করে তার চেতনা।
বিস্মিত হয়ে তাকাই লোকটির শ্মশ্রূপূর্ণ মুখের দিকে। লোকটিকে দেখে মনে হয় পাগল! কিন্তু আসলে কি পাগল!
আমার বিভ্রান্ত মুখভঙ্গি পড়ে লোকটি হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি লিপিবদ্ধ করে রাখি খাতার পৃষ্ঠায়। সন্ধের পর সেগুলো পড়তে বসি। প্রতিটি ঘটনাই এক এক পৃষ্ঠা শিক্ষা। সারা সন্ধে সেই শিক্ষা নিতে থাকি হৃদয়ের মধ্যে। এই কাগজগুলিই আমার শিক্ষক।
লোকটির পাশে ডাঁই করে রাখা কাগজের মধ্যে বিদ্ধ করি বিস্মিত দৃষ্টি। অজস্র আঁকাবাঁকা অক্ষরের মধ্যে তন্নতন্ন খুঁজতে থাকি তার শিক্ষককে।
তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি ঘরে। লোকটির মুখ থেকে যায় মগজে, থেকে যায় তার অস্তিত্ব, তার অক্ষরগলো। তার ভাবনাগুলি নিয়ে আমি একা-একা জাবর কাটি। যে-দিনটা পার হয়ে এলাম তার মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতে থাকি। ভাবতেই থাকি।
আজকাল আমিও যখন বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটি, ব্যস্ত থাকি দৈনন্দিন কাজকর্মে, প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হয়ে খুঁজতে থাকি আমার সেই শিক্ষককে।