অ্যাবসার্ড যুক্তি

অ্যাবসার্ড যুক্তি

পৃষ্ঠাগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাতে বলা হয়েছে অ্যাবসার্ড সংবেদনশীলতা সম্পর্কে, দেখা যাবে দীর্ঘকাল ও বহুবিস্তৃত হয়েছে, অ্যাবসার্ড দর্শনে এসব নেই, আমাদের সময়ে ঠিকমতো বলাও হয়নি, জানাও হয়নি সেসব। তাই সহজ-সরলভাবে বলা হয়েছে, শুরুতেই এসব পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে বিশিষ্ট সমসাময়িক চিন্তাবিদরা। আমার লুকোবার অভিপ্রায় থেকে এ এতদূরে যে তাদের বলা ও মন্তব্য করতে দেখা যাবে এ লেখার ভেতর দিয়ে।

কিন্তু একই সময়ে রেখে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় তথ্য, এযাবৎ যা নেওয়া হয়েছে উপসংহার হিসেবে, প্রারম্ভিক সূত্র হিসেবে এ প্রবন্ধে বিবেচিত করা হয়েছে অ্যাবসার্ডকে। এই হিসেবে এ বলা হতে পারে আমার ভাষ্যে রয়েছে কিছু উদ্দেশ্য : এখানে যা অচ্ছেদ্যরূপে রয়েছে তাকে কেউ আগে থেকে বিচার করতে পারে না। এখানে কেবল দেখা, পবিত্র অবস্থায় (রাষ্ট্রে), বুদ্ধিজীবীদের দুর্বল ব্যাধির বর্ণনা। এক মুহূর্তের জন্যও এতে জড়িত নেই কোনো অধিবিদ্যা, কোনো বিশ্বাস। এগুলোই সীমাবদ্ধতা, এ বইয়ের এটাই কেবল বিশেষ পক্ষপাত। বিশেষ ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতাগুলো স্বচ্ছ করে দিতে আমাকে আগ্রহী করে তোলে।

অ্যাবসার্ডতা ও আত্মহত্যা

সত্যিই এক গুরুতর দার্শনিক সমস্যা রয়েছে সেটা হলো আত্মহত্যা। যাই হোক বেঁচে থাকা বা বেঁচে না থাকার মূল্যায়ন করে দর্শনের মৌলিক জিজ্ঞাসায় উন্নীত হয়ে উঠতে পারে। আর বাকি সব জগতে থাকুক বা না থাকুক তাতে রয়েছে তিনটি মাত্রা, আর মনের রয়েছে নয়টি বা বারোটি প্রকারভেদ-আসে পরপর। এ হলো খেলা, অবশ্য এ প্রথমে উত্তর দেবে। আর এ যদি সত্য হয়, যেমন নিৎসে দাবি করেন তিনি একজন দার্শনিক, যোগ্যতর ব্যক্তি হিসেবেই তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয়, আলোচনা করবেন উদাহরণ সহযোগে, আপনি প্রশংসা করতে পারেন সেই উত্তরের গুরুত্বকে, এগিয়ে যাবে নির্দিষ্ট কর্মের দিকে। এই ঘটনাগুলোকে হৃদয় অনুভব করে; তবুও বুদ্ধির কাছে স্বচ্ছ হয়ে ওঠার আগে তারা যত্নের সঙ্গে পড়াশোনা করে থাকেন। নিজেকে যদি প্রশ্ন করি কীভাবে বিচার করব, এর চেয়ে আরো বেশি জরুরি হয়ে ওঠে এ প্রশ্ন, এর সঙ্গে যা কিছু অচ্ছেদ্যভাবে রয়েছে তা কাজের মাধ্যমে বিচার করে একজন, তারই উত্তর দিই। তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়ে আমি কখনো কাউকে মরতে দেখিনি। গ্যালিলিও মহান গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সত্যকে আঁকড়ে ছিলেন। ত্যাগ করেছিলেন তা সহজেই, কারণ তা তাঁকে বিপদগ্রস্ত করেছিল। এক হিসেবে তা ঠিকই করেছিলেন।[১] সেই সত্যের মূল্য ছিল না বিপদের কাছে। যাই হোক, পৃথিবী বা সূর্য একে অন্যের চারপাশে ঘোরে, এ হলো গভীর এক পার্থক্য।

সত্যি বলতে কী এ হলো অবান্তর প্রশ্ন। অপরদিকে, আমি বহু লোককে মরতে দেখেছি; তারা মনে করেছে বেঁচে থাকাটার কোনো মূল্য নেই। অন্যদের ধারণা বা মায়াগুলোকে কূটাভাস রূপে হত্যা করে যা তাদের বেঁচে থাকার এক কারণ হিসেবে গণ্য করে (যাকে বেঁচে থাকার যুক্তি বলা হয় সেটা এক চমৎকার মৃত্যুর যুক্তিও)। সুতরাং প্রশ্নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো জীবনের অর্থ একটা উপসংহার টানি। কীভাবে উত্তর দেব? সব মূল সমস্যার (আমি মনে করি, তার ফলে ঝুঁকি নিয়ে তার দিকে ছুটে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে বা প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে জীবনের প্রতি) সম্ভবত রয়েছে দু’ধরনের চিন্তার পদ্ধতি : লা পলিসে (La Palisse) ও ডন কিহোটো পদ্ধতি। সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ ও ব্যক্তিগত আবেগ বা লিরিকবাদের মধ্যে ভারসাম্য, আবেগ ও স্বচ্ছতাকে একই সঙ্গে আমাদের অনুমোদন করতে পারে। তৎক্ষণাৎ বিষয় আবেগের সঙ্গে বিনীত এত নম্র ও এত ভারি, শিক্ষা ও ধ্রুপদী ভাষাগত বিরোধিতা অবশ্য স্বীকার করে নেয়, একজন দেখতে পায়, মনের আরো নম্র প্রবণতা যা সাধারণ প্রজ্ঞা ও বোধ থেকে এক বা একই সময়ে আহরণ করে।

সামাজিক রূপ ছাড়া আত্মহত্যা কখনো বিবেচিত হয় না। এর বিপরীতে ব্যক্তিগত ভাবনা ও আত্মহত্যার মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে আমরা শুরুতেই ওয়াকিবহাল। কোনো এক কাজের মতো এও হৃদয়ের ভেতর নীরবে তৈরি হতে থাকে, যেমন মহান শিল্পকর্ম হয়ে থাকে। মানুষ নিজেই এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে। এক সন্ধ্যেয় সে ট্রিগার টেনে দেয় অথবা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অ্যাপার্টম্যান্ট বিল্ডিং ম্যানেজার আত্মহত্যা করে, পাঁচ বছর আগে সে তার মেয়েকে হারিয়েছে, আমায় বলা হয়েছিল। তারপর থেকেই সে বড় রকমের বদলে গিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতাই তাকে ‘ধ্বংস’ করেছে। এর বেশি সঠিক কথা কল্পনা করতে পারা যায়নি। ভাবনার শুরুটাই হলো ধ্বংসের শুরু। সমাজের এ রকম শুরুর সঙ্গে যোগ খুবই কম রয়েছে। পোকাটি থাকে মানুষের হৃদয়ের ভেতর। কোথায় খোঁজা হবে সেটিকে। একজন অবশ্য লক্ষ্য করবে এবং বুঝবে এই সর্বনাশা খেলাটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখিতে এ খেলাটি পরিচালিত করে স্বচ্ছতা থেকে এই আলো থেকে পলায়ন।

আত্মহত্যার বহু কারণ আছে, সাধারণত কোনো একটি বিশেষ কারণ নিশ্চয়ই প্রধান নয়। খুব কম প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে আত্মহত্যা ঘটে (তথাপি প্রকল্পটি বর্জিত হয় না)। কিসের থেকে সংকটের সূত্রপাত হয় তা সব সময়ই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধরা থাকে। সংবাদপত্র প্রায়ই ‘ব্যক্তিগত দুঃখ’ বা ‘দুরারোগ্য অসুস্থতা’র কথা বলে। এসব ব্যাখ্যা আপাতভাবে ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু একজনকে জানতে হবে কোনো বিশেষ বন্ধু বিশেষ সেই দিনটিতে এ বেপরোয়া লোকটির সঙ্গে উদাসীনভাবে কথা বলেছিল কিনা। অপরাধীদের মধ্যে সেও একজন। এ কারণে সব রকম সঞ্চিত ঘৃণা-বিদ্বেষ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করাটাই ঠিক এবং সব রকম একঘেয়েমিকে তখন স্থগিত রাখে সাময়িক।[২]

কিন্তু দ্রুত সঠিক যদি স্থির করতে কঠিন হয়ে পড়ে, মন যখন বেছে নিয়েছে মৃত্যু সূক্ষ্ম গতিতে, কাজটি নিজেই পরিণতিতে প্রকাশ করে, তার থেকে এ কমানো সহজতর। জ্ঞানত এবং নাটকীয়তায়, তোমার স্বীকৃতি উন্নীত বা মূল্যায়ন হয়ে থাকে তোমার নিজেকে হত্যা করা। স্বীকার করা হচ্ছে যে, তোমার জন্য জীবন বেশি বা তুমি এটা বুঝছ না। এরূপ উপমায় আমাদের বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই বরং প্রতিদিনকার কথায় ফিরে যাওয়াটা ঠিক। এ কেবল স্বীকার করা ঐ ‘কষ্টকে মূল্য দেয় না’। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাটা কখনো সহজ নয়। অনেক কারণে অস্তিত্বের নির্দেশের প্রকাশভঙ্গি তৈরি করে, তাদের মধ্যে প্রথমটি হলো স্বভাব। স্বতঃপ্রবৃত্ত মৃত্যু নিহিত থাকে তোমার জানার-চেনার ভেতর, এমনকি স্বভাবগতভাবে সেই স্বভাবের ভয়ঙ্কর চরিত্রে, বেঁচে থাকার যে কোনো যুক্তির অনুপস্থিতিতে, সেই নিত্য ক্ষোভ-বিদ্রোহের উন্মত্ত চরিত্রে এবং কষ্টের অনর্থতায়।

তাহলে সেই অনুভবটি কী যা জীবনের ঘুমের প্রয়োজন মন বঞ্চিত করে? এমন কী খারাপ কারণগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে জগৎকে, যে জগৎ অতি পরিচিত। কিন্তু অপরদিকে, বিশ্বে হঠাৎই মায়া ও আলো থেকে বঞ্চিত করে, নিঃসঙ্গ ও অচেনা বোধ করে মানুষ। তার হারানো ঘরের স্মৃতি থেকে ও আকাঙ্ক্ষিত দেশের আশা থেকে যেদিন সে বঞ্চিত হয়, কোনো সমাধান থাকে না তার নির্বাসনের। মানুষ ও তার জীবনের বিচ্ছেদের মধ্যে, অভিনেতা ও তার সেটিং, হয়ে ওঠে প্রকৃতই উদ্ভটতার (absurdity) অনুভব। সব স্বাস্থ্যবান লোকের থাকে আত্মহত্যার ভাবনা, এ দেখতে পাওয়া যায়, কোনোরূপ অধিক ব্যাখ্যা ছাড়াই, এই অনুভব ও মৃত্যুর জন্য বাস করার মধ্যে থাকে সরাসরি এক যোগাযোগ।

এই প্রবন্ধের বিষয় হলো স্পষ্টরূপে অ্যাবসার্ড ও আত্মহত্যার মধ্যে সম্পর্ক, ঠিক ডিগ্রিটি রয়েছে অ্যাবসার্ডে, তাতে আত্মহত্যাই হলো সমাধান। নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, একজন মানুষের পক্ষে যে ঠকায় না, সে তার কাজকে ঠিক করতে পারে যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে। অস্তিত্বের উদ্ভটতায় বিশ্বাস অবশ্য তার আচরণকে পরিচালিত করে। এ বৈধ বিস্ময় স্পষ্টত, মিথ্যা প্যাথোজ ছাড়াই, যাই হোক যত দ্রুত জটিল বোধ বা অবোধ্য অবস্থাকে পরিত্যাগ করার দাবি করে। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, অবশ্যই মানুষদের কথা বলছি, যারা তাদের নিজেদের সঙ্গে ঐক্য সংযুক্ত করে।[৩]

পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত, সরল ও অসমাধানযোগ্যতা এই সমস্যাটিকে মনে হতে পারে। কিন্তু এ ভুলভাবে মনে করা হয় যে, সহজ জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তরের সঙ্গে যুক্ত যা মোটেই সহজ নয় এবং সেই প্রমাণ নিহিত রয়েছে প্রমাণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। প্রাকসিদ্ধ এবং সমস্যার অবস্থার বিপরীত, একজন কেবল নিজেকে হত্যা করুক বা না করুক, মনে হয় কেবল দুটোই দার্শনিক সমাধান হতে পারে হ্যাঁ বা না। এটা বেশ সহজ। কিন্তু তাদের কাছে প্রশ্রয় পেয়ে থাকে যারা কোনো সমাপ্তি ছাড়াই অনবরত প্রশ্ন করে যায়। এখানে আমি কেবল পরিহাসে সামান্যরূপে আস্কারা দিচ্ছি: এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি এও লক্ষ্য করি যারা ‘না’ বলে উত্তর করে তারা এমন করে যেন ভাবছে ‘হ্যাঁ’। বস্তুত, আমি যদি নিৎসে নীতি বা পদ্ধতি গ্রহণ করি, তাহলে একভাবে বা অন্যান্যরূপে তারা মনে করে ‘হ্যাঁ’। অপরদিকে, এ প্রায়ই ঘটে যারা আত্মহত্যা করে তারা হিসেব করে জীবনের অর্থ। এসব বিরুদ্ধতা অনবরত থাকে। এমনকি এও বলা হতে পারে, বিপরীতরূপে যুক্তি যেখানে কাম্য মনে হয়। তারা কখনো এসব ক্ষেত্রে এত সূক্ষ্ম প্রগাঢ় হয়ে ওঠে না। এটা হলো সাধারণ জায়গা দার্শনিক তত্ত্বগুলো এবং আচরণকে তুলনা করা হয়, তারা সেগুলো দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে। কিন্তু এও অবশ্য বলা হয় চিন্তাবিদরা জীবনের অর্থকে অস্বীকার করে, কিরিলভ ছাড়া কেউই একে মানেন না, কিরিলভ সাহিত্যের, পেরেগিনোস যাঁর জন্ম এক উপকথা,৪ এবং প্রকল্পে রয়েছেন জুলেস লেকুইয়ার (Julse Lequier), তাঁরা জীবনের অর্থকে অস্বীকারের যুক্তিকে মেনে নিয়েছেন। সোফেনহাওয়ার প্রায়ই বলে থাকেন, এ কৌতুকের মানানসই বিষয়, কারণ তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত টেবিলে বসে থেকে আত্মহত্যাকে প্রশংসা করেন। এটা ঠাট্টার বিষয় নয়। ওভাবে ট্র্যাজিককে গভীরভাবে নেওয়া নয়, তা এত দুঃখদায়ক নয়, কিন্তু একজনকে বিচার করতে এ সাহায্য করে।

আমরা কি অবশ্য সমাপ্তি টানব এরূপ বিরোধিতা ও জটিলতার মুখোমুখি হয়ে, যে জীবনের প্রতি এবং যে জীবনের ওপর আস্থা ছেড়ে দেয় সেই অভিমতের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে? এদিকে অতিরিক্ত কিছু করার প্রয়োজন নেই। এই জগতে জীবনের প্রতি মানুষের সংসক্তিতে সব অসুস্থতা থেকে কিছু জিনিস শক্তিশালী রয়েছে। শরীরের বিচার হলো সেই রকমই যেমন মনেরটি হবে এবং সংকুচিত হয় পীড়ন থেকে। ভাবনার অভ্যেস আয়ত্ত করার আগে বেঁচে থাকার অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। সেই প্রতিযোগিতায় আমরা মৃত্যুর দিকে দ্রুত প্রতিদিন এগিয়ে যাই, শরীর এই অসাধ্য এগিয়ে যাওয়াকে রক্ষণাবেক্ষণ করে। সংক্ষেপে, সেই বিরোধিতায় নির্যাস রয়েছে যাকে আমি কৌশলে এড়ানো বলব কারণ পাস্কেলিয় জ্ঞান থেকে বিভাজন থেকে উভয়ই কম-বেশি। কৌশলে এড়ানো বা পলায়ন এক অপরিহার্যের খেলা। কৌশলে এড়ানো অদ্ভুত কর্মটি, সর্বনাশা পলায়ন যা এই প্রবন্ধের তৃতীয় থিম রূপে গঠিত, তা হলো আশা। ভিন্ন জীবনের আশায় একজন অবশ্য উপযুক্ত হবে বা যারা বেঁচে থাকবে বা বেঁচে থাকবে না নিজেরা তাদের উপযুক্ত বা ছলনা করবে, কিন্তু তাদের মহৎ ধারণার জন্য সীমা ছাড়বে, মসৃণ করবে, একে এক মূল্য দেবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবে।

এভাবে ধাঁধা ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে সবকিছুর অবদান রয়েছে। এযাবৎ, এ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে না, লোকেরা কথা নিয়ে খেলা করে এবং বিশ্বাস করার ভান করে যে জীবনের অর্থকে অনুমোদন করতে অস্বীকার করে, প্রয়োজনীয় রূপে ঘোষণা করতে এগোয় যে এ জীবনের কোনো অর্থ নেই। সত্যই দুই বিচারের মধ্যে কোনো সাধারণ পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার নেই। একজনকে কেবলই দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ ও অসামঞ্জস্যের দ্বারা ভুল পথে চালিত করতে একজনকে কেবলই অস্বীকার করতে হয়, যা পূর্বেই দেখানো হয়েছে। সবকিছুকে মুছে একপাশে অবশ্য রেখে দেবে এবং প্রকৃত সমস্যার দিকে এগিয়ে যাবে। একজন নিজেকে হত্যা করে কারণ বেঁচে থাকাটায় কোনো মূল্য নেই, তা নিশ্চয়ই সত্য—তবু এক অসফল সত্য কারণ এ এক সত্যবাদ (truism)। কিন্তু অস্তিত্বকে অসম্মান করে কি, সরাসরি অস্বীকার যার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই অস্বীকার আসে ঘটনা থেকে, যার কোনো অর্থ নেই? আশা বা আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে পলায়ন কি এর অ্যাবসার্ডতার প্রয়োজন—একে ব্যাখ্যা করা অবশ্য প্রয়োজন, অনুসন্ধান করে বের করা দরকার, কৌশলে এড়ানো যখন বাকি সবকিছু সরিয়ে একপাশে রাখে। অ্যাবসার্ড কি মৃত্যুকে পরিচালিত করে? অন্যান্য সমস্যা অপেক্ষা এই সমস্যাটিকে অধিক প্রাধান্য অবশ্য দেওয়া হয়, বাইরে চিন্তার সব পদ্ধতি এবং নিরুৎসুক মনের সব অভ্যেস অপেক্ষাও। অর্থের আচ্ছাদন, বিরোধিতা, মনস্তত্ত্বের বহুনিষ্ঠ মনটি সব সময় সব সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। সাধারণভাবে একে বলা হয় অন্যায়, অন্যভাবে যৌক্তিক, ভাবনা। এ সহজ নয়। এ সব সময় যৌক্তিক হওয়াতে সহজ। তিক্ত সমাপ্তিতে এ প্রায় যৌক্তিক হওয়ার অসম্ভব। যারা নিজের হাতে মারা গেছে পরিণতিতে তারা অবসান করে আবেগতাড়িত অনুরাগ, অবশ্য তা অনুসরণ করেই। আত্মহত্যার প্রতিফলন আমাকে কেবলমাত্র সমস্যা তুলতে এক সুযোগ করে দেয় যাতে আমার রয়েছে উৎসাহ : মৃত্যুর ব্যাপারে কি কোনো যুক্তি আছে? আমি যদি অন্বেষণ না করি তবে আমি জানতে পারি না, বেপরোয়া আবেগ ছাড়াই, প্রমাণের অদ্বিতীয় এক আলো, যার কার্যকারণ থেকেই উৎস আমি বাতলে দিই। যাকে আমি বলি অ্যাবসার্ডের কার্যকারণ। অনেকেই এর থেকে শুরু করেছে। যাই ঘটুক না কেন আমি জানি না এটা তারা রাখে কিনা।

যখন কার্ল জেসপারস ঐক্যকে জগতে রূপ দেওয়া অসম্ভব বলে উন্মোচিত করে, তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন : ‘এই সীমাবদ্ধতা আমাকে স্বয়ং আমার নিজের কাছে নিয়ে যায় যেখানে আমি যে বস্তুগত দৃষ্টিকোণ নিছক বিবৃতি করছি তেমন কোনো অবস্থানের অন্তরালে আর পিছিয়ে যায় না, যেখানে স্বয়ং আমি অথবা অন্যদের অস্তিত্ব আর আমার কাছে কোনো বস্তু হতে পারে না,’ আরো অনেকের অনুসরণে তিনি জাগিয়ে তুলছেন সেইসব জলশূন্য মরুভূমি যেখানে চিন্তা পৌঁছায় তার সীমান্ত রেখায়। অন্যান্য অনেক কিছুর পর, বস্তুত তারা সেগুলোকে তাড়িয়ে দিতে কতটা আগ্রহী। শেষ চৌমাথায়, যেখানে ভাবনা ইতস্তত করে, উপস্থিত হয় বহু মানুষ এবং এমনকি কিছু অত্যন্ত অনুগত। তারপর তাদের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু, তাদের জীবন, সেটি দিয়ে দেয়। অন্যান্য, মনের রাজকুমারদের, সে রকমভবে ছেড়ে দেয়, কিন্তু পবিত্রতম বিদ্রোহে তাদের ভাবনা আত্মহত্যায় মুখ্য ভূমিকা নেয়। প্রকৃত প্রয়াসকে সেখানে থাকতে হয়, বরং যতদূর তা সম্ভব, সেইসব দূরবর্তী অঞ্চলের উদ্ভট গাছপালা বেড়ে যাওয়া খুবই কাছ থেকে পরখ করে। সংসক্ত ও সূক্ষ্ম বুদ্ধি এই অমানবিক প্রদর্শনের দর্শকেরা সুবিধে পেয়ে থাকে যাতে উদ্ভটতা, আশা ও মৃত্যু তাদের সংলাপ বহন করে। তারপর মন সেই উপাদানের সংখ্যাকে বিশ্লেষণ করতে পারে, তবুও সেগুলোকে দেখানো ও মুক্ত করার আগে থাকে সুচারু নৃত্য।

অ্যাবসার্ড দেয়াল

মহান কাজের মতো, বলার ব্যাপারে তারা যতটা সচেতন তারচেয়ে গভীর অনুভবকে অনেক বেশি করে অর্থ প্রকাশ করে। আত্মার ভেতর ঘৃণার নিয়মিত রূপ বা আবেগ আবার এনে দেয় দ্বন্দ্বের মুখোমুখি, করা বা ভাবার অভ্যাসে। পুনরায় তৈরি হয়, ফলে তার ভেতর আত্মা নিজেই তার কিছু জানে না। মহান অনুভবগুলো তাদের নিজেদের বিশ্বে, চমৎকারিত্বে বা দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় কী বলতে চায় তা বুঝিয়ে দেয়। অন্তরঙ্গ জগতে তাদের আবেগ উত্তেজনার সঙ্গে আলোকিত করে যেখানে তাদের পরিস্থিতিকে চেনে। সেখানে রয়েছে এক ঈর্ষার, আকাঙ্ক্ষার, স্বার্থপরতার বা উদারতার বিশ্ব। অন্যভাবে বলতে এ এক অধিবিদ্যার এবং মনের এক আচরণের বিশ্ব। ইতিমধ্যে যাকে সত্যি, বিশেষ অনুভব মনে করা হচ্ছে, এমনকি আবেগ হয়ে উঠবে আরো বেশি, সেসব প্রাথমিকভাবে যেমন মাঝারি, আবার একই সঙ্গে মিথ্যে এবং ‘নির্দিষ্ট’, দূরের ও বর্তমান তেমন সাজানো হয় সেগুলো আমাদের সৌন্দর্য দিয়ে বা জাগিয়ে দেয়া অ্যাবসার্ডতা দিয়ে।

যে কোনো পথের বাঁকে অ্যাবসার্ড তার অনুভব যে কোনো মানুষের মুখে আঘাত করতে পারে। এ যেমন এর যন্ত্রণা নগ্নতার ভেতর, উজ্জ্বলতা ছাড়া এর আলো, এ ছলনাময়। কিন্তু সেই বিশেষ কাঠিন্য সম্মান করে প্রতিফলনকে। সম্ভবত এ সত্য আমাদের কাছে একজন চিরকালের জন্য অপরিচিত থাকে এবং তার মধ্যে অপরিবর্তনীয় থাকে কিছু, যেসব আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে লোকেদের আমি জানি এবং তাদের আচরণ, তাদের কাজের সমগ্রতা, তাদের উপস্থিতিতে জীবনে কার্যকারণবশত যা কিছু হয়ে থাকে তা দিয়ে আমি চিনি। অনুরূপভাবে, ঐ সব অযৌক্তিক অনুভব কোনো তথ্য সংগ্রহের সুযোগ দেয় না। বাস্তবিকভাবে বুদ্ধিদীপ্তির প্রভাবে তাদের ফলগুলোকে হিসেব করে উভয়কে একত্রিত করে, তাদের সব দৃষ্টিভঙ্গিকে লিখে ও ধরে নিয়ে, তাদের রূপরেখা দিয়ে তাদের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে পারি, প্রশংসা করতে পারি। এ ঠিকই, আপাতভাবে আমি যদিও একশবার দেখেছি একই অভিনেতাকে, আর ঠিক সেই কারণে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশি ভালো জানব তার কোনো মানে নেই। তবু নায়করা যেসব ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করেছে তার ভিত্তি করে সব যোগ করে যদি বলি আমি তাকে একটু বেশি জানি শততম চরিত্র হিসেবে, এই হিসেবটা থামিয়ে দিই, সত্যের এক উপাদান রাখাটা তাহলে অনুভূত হবে। এ কারণে আপাত কূটাভাসটিও হলো এক নীতি কাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে এক নীতি। এ শেখায় মানুষ নিরূপিত করে তার ভান ও আন্তরিক আবেগ দিয়ে। এভাবে অনুভবের এক নিম্নতর চাবিটি, হৃদয়ের ভেতরটি অগম্য কিন্তু অংশত প্রকাশিত হয় প্রতিক্রিয়াতে, তারা প্রকাশ করে, এবং কল্পনা করে মনের মনোভাব। এ স্পষ্ট এভাবে আমি ঠিক করি একটি পদ্ধতি। কিন্তু এও এক সাক্ষ্য ঐটি বিশ্লেষণের একটি পদ্ধতি এবং তা জ্ঞান নয়। পদ্ধতির কারণে নিহিত রয়েছে অধিবিদ্যা, সচেতনহীনভাবে উপসংহার প্রকাশ করে, তবু তারা প্রায়ই জানতে দাবি করে না। একইভাবে বইটির শেষপাতায় রয়েছে ইতিমধ্যেই সেটা প্রথম পাতায় রয়েছে। এই যোগসূত্রটি অপরিহার্য। এখানে পদ্ধতিটি নিরূপিত করে অনুভবের সত্যতাকে, যা সব সত্যের জ্ঞান অসম্ভব। সম্পূর্ণভাবে উপস্থিতি বারবার উল্লেখিত হতে পারে এবং পরিস্থিতি নিজেই একে অনুভব করায়।

সম্ভবত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অ্যাবসার্ডতার সেই ছলনাময় অনুভবকে অতিক্রম করতে আমরা সমর্থ হব কিন্তু বুদ্ধিদীপ্তির জগৎ, জীবনযাপনের প্রক্রিয়া বা শিল্পসত্তার সঙ্গে এর থাকে ঘনিষ্ঠরূপে সম্পর্ক। শুরু থেকেই রয়েছে অ্যাবসার্ডতার পরিবেশ। শেষে রয়েছে অ্যাবসার্ড বিশ্ব এবং মনের দৃষ্টিবোধ যা জগৎকে আলোকিত করে এর প্রকৃত রং দিয়েই ও স্পষ্ট করে তোলে সুবিধেপ্রাপ্ত ও অশান্ত মুখ যার সেই মনোভাব এর ভেতর দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে।

সব মহান কাজ ও সব মহান চিন্তারই রয়েছে এক অদ্ভুত শুরু। মহান কাজগুলো প্রায়ই জন্ম নেয় রাস্তার মোড়ে অথবা রেস্তোরাঁয় ঘোরানো দরজায়। তাই এতে থাকে অ্যাবসার্ডতা। সেই ভয়ঙ্কর জন্ম থেকে এর মহত্ত্বকে অন্যদের অপেক্ষা আরো বেশি অ্যাবসার্ড জগৎকে বিশ্লেষণ করে। সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, যখন জিজ্ঞাসা করে একজন চিন্তা করতে থাকে একজন মানুষের ভেতর কিসের ভান হতে পারে, তার উত্তর ‘নেই’। তারা যারা ভালোবাসা পায়, এই বিশেষ ভালোবাসা সম্পর্কে সচেতন থাকে। যদি তার উত্তর আন্তরিক হয়, যদি তা প্রতীকী হয় তবে সেই অদ্ভুত আত্মার অবস্থা যা বাকিটা হয়ে ওঠে কথাসর্বস্ব, নিত্যদিনকার অভিব্যক্তির ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়, খুঁজে বেড়ায় যোগসূত্র ব্যর্থভাবে, সেটি আবার যোগ করবে, বলতে গেলে তখন এ হয়ে ওঠে অ্যাবসার্ডতার প্রথম সংকেত।

স্টেজ-সেটের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এ ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে। জাগা, ট্রাম, অফিস বা ফ্যাক্টরিতে চার ঘণ্টা, খাওয়া, ট্রাম, চার ঘণ্টা কাজ, খাওয়া, ঘুম এবং সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এবং শনিবার, একই ছন্দ অনুসারে—অধিকাংশ সময় এই পথটি সহজভাবে অনুসরণ করে। কিন্তু একদিন ‘কেন’ কথাটা ওঠে এবং সবকিছুই শুরু হয় সেই শ্রান্তিতে, বিস্ময়ে ঈষৎ রঙিন হয়ে ওঠে। ‘শুরু’—শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। যান্ত্ৰিক জীবনের কাজের শেষে শান্তি আসে, কিন্তু একই সঙ্গে খুলে দেয় সচেতনতার প্রেরণা। জাগিয়ে দেয় সচেতনতা এবং কী অনুসরণ করবে তাও প্রলুব্ধ করে। সময়মতো জাগরণের শেষে আসে ফল : আত্মহত্যা অথবা আরোগ্য। শ্রান্তির নিজেরই এ সম্পর্কে রুগ্নতা থাকে। অবশ্যই এখানে উপসংহার টেনে দিই এটা ভালো। সচেতনতার সঙ্গে শুরু হয় সবকিছু এবং এর ভেতর দিয়ে ছাড়া কোনো কিছুরই মৌলিকত্ব নেই। কিন্তু তারা অবশ্যই; একেবারের জন্য একটা যথেষ্ট অ্যাবসার্ডের মৌলিকতা প্রদর্শনের সময়ে। যেমন হাইডেগার বলেন, কেবল ‘দুশ্চিন্তা’ সবকিছুর সূত্রে রয়েছে।

অনুরূপভাবে, অনুল্লেখ জীবনের প্রতিদিনে, সময় বহন করে আমাদের। কিন্তু যে সময় একে বহন করতে হয় আমাদের, সব সময়ই একটি মুহূর্ত আসে। আমরা বাস করি ভবিষ্যতের ওপরে : ‘আগামীকাল’, ‘পরে’, ‘যখন তুমি তোমার পথ তৈরি করেছ,’ ‘তুমি যখন যথেষ্ট বুড়ো হবে সে সময় বুঝবে’। এসব অপ্রাসঙ্গিকতা বিস্ময়কর, কারণ, সর্বোপরি এ হলো মৃত্যুর ব্যাপার। তবু একটা সময় আসে যখন একজন মানুষ দেখে এবং তার বয়স তিরিশ। এভাবে জাহির করে সে তরুণ। কিন্তু একই সঙ্গে সে নিজেকে সময়ের সঙ্গে স্থাপন করে। জায়গা করে নেয় এর ভেতরই। মেনে নেয় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বাঁকের নির্দিষ্ট বিন্দুতে, সে স্বীকার করে নেয় এর শেষ পর্যন্ত ভ্রমণ করতে হয় তাকে। সময়ের মালিক সে, আর আতঙ্ক দিয়ে তাকে ধরে যেখানে তার ভেতর সবকিছু বর্জন করা উচিত। শারীরিক বিদ্রোহ হলো অ্যাবসার্ড।[৫]

তুলনামূলক এক ধাপ নিচে এবং বিস্ময়করতা গড়িয়ে চলে : উপলব্ধি করে জগৎ হলো গভীর; জ্ঞানার্জন করে কোনো ডিগ্রিতে একটি পাথর বাইরের এবং আমাদের কাছে পরিবর্তনীয়, কোনো প্রগাঢ়তায় প্রকৃতি ও ভূদৃশ্যাবলি আমাদের বাতিল করতে পারে। সব সৌন্দর্য হৃদয়ের ভেতর কিছু অমানবিক হয়ে থাকে এবং এই সব পাহাড়, আকাশের কোমলতা, এই সব গাছপালার রূপরেখা এই বিশেষ মুহূর্তে সংবেদনার অর্থকে হারায় যার সঙ্গে আমরা তাদের পোশাকে ঢেকে রেখেছিলাম, অতঃপর এক হারানো স্বর্গ অপেক্ষা আরো বেশি দূরে। জগতের আদিম হিংস্রতা জেগে আমাদের মুখোমুখি হয় বহু বহু শতাব্দী অতিক্রম করে। এক মুহূর্তের জন্য আমরা এই বোঝাপড়া থেকে বিরত হই কারণ বহু শতাব্দীর জন্য আমরা এ বুঝেছিলাম এককভাবে, এর ভেতর যে মূর্তি ও নকশা আগেই এতে আমরা আরোপ করেছিলাম, কারণ অতঃপর সেই শিল্পায়নে যা কিছু ব্যবহার করা হয়েছে তার শক্তির খামতি রয়েছে আমাদের। জগৎ পরিহার করে আমাদের কারণ এই জগৎ হয়ে ওঠে নিজের সত্তা পুনরায়। অভ্যাসবশত মঞ্চ-দৃশ্য পরে নেয় আবরণ, আগে যা ছিল তাই হয়ে ওঠে আবার। আমাদের থেকে দূরত্বটা তুলে নেয়। একজন স্ত্রীলোকের পরিচিত মুখের নিচে যেমন দিনগুলোয় আমরা তাকে আগন্তুকের মতো দেখি, কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে তাকে ভালো বেসেছিলাম, সম্ভবত আমরা কামনা করে আসব, আর আমাদের ছেড়ে চলে যায় আকস্মিকভাবে নিতান্তই নিঃসঙ্গরূপে। অথচ তার কিন্তু এখনো সময় হয়নি। কেবল একটাই জিনিস : জগতের সেই গভীরতা ও বিস্ময়করতাই হলো অ্যাবসার্ড।

মানুষেরা অমানবিকতাকেও লুকিয়ে রাখে। স্বচ্ছতার নির্দিষ্ট মুহূর্তগুলোয় তাদের অভিব্যক্তির যান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ, তাদের অর্থহীন মূকাভিনয় যা তাদের ঘিরে রেখে সবকিছুকেই নির্বোধ করে। কাচের বিভাজনের আড়ালে একজন মানুষ কথা বলে চলে টেলিফোনে; তুমি তার কথা শুনতে পার না কিন্তু দেখতে পাও তার অবোধ্য মূক-প্রদর্শনী: তুমি বিস্মিত সে কেন জীবিত। আমরা যা সেই মূর্তির সামনে এই অগণনীয় উল্টেপড়া, মানুষের নিজের অমানবিকতায় অস্বস্তি, আজকের লেখক হিসেবে বলবে এই “বিবমিষা’, এই বিবমিষাকেও বলবে অ্যাবসার্ড। অনুরূপভাবে এই আগন্তুক আয়নার ভেতর আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে বিশেষ সেকেন্ডে, আমরা আমাদের ফটোগ্রাফগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব করি, পরিচিত এবং এযাবৎ আশঙ্কিত ভয়ও অ্যাবসার্ড।

অবশেষে আমি মৃত্যুতে আসি এবং মনোভাবের দিক দিয়ে আমরা রয়েছি এর দিকে। এ ক্ষেত্রে সবকিছুই বলা হয়েছে এবং করুণতাকে কেবল এড়িয়ে চলাই ঠিক। তথাপি একজন কখনোই যথেষ্ট রূপে বিস্মিত হয় না যেন কারুর ‘জানা’ নেই এভাবে সবাই বেঁচে আছে। এর কারণ বাস্তবে মৃত্যুর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ঠিকভাবে বললে, কোনো কিছুরই অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু কিসে বাস করছে এবং সচেতন করছে। এখানে, অন্যান্য মৃত্যুর অভিজ্ঞতাগুলো বলা সম্ভব। এ হলো বিকল্প, এক অধ্যায়, এ আমাদের সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করে না। এই বিষয়ের গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবে আতঙ্ক আসে। যদি সময় আমাদের ভয় পাওয়ায়, তার কারণ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করে এবং এর পরই আসে সমাধান। আত্মাবিষয়ক সুন্দর বক্তৃতামালা তাদের বিপরীত প্রতীতিরূপে প্রমাণিত করবে, অন্তত একবারের জন্য। এই জড়দেহের ওপর আত্মার কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকবে না, এই আত্মা অদৃশ্য হয়েছে। এই দুঃসাহসিক অভিযানের প্রাথমিক ও সুনির্দিষ্ট মনোভাব গঠিত হয় এই অ্যাবাসার্ড অনুভব দিয়ে। সেই নিয়তির ভয়ঙ্কর আলোর ঝলকানির নিচে, এর অব্যবহার্যতা সাক্ষ্য হয়ে ওঠে। নিষ্ঠুর গণিতের সামনে পূর্ববর্তী কোনো নীতিবিদ্যার সংকেত ও কোনো প্রয়াসেরই বিচারগ্রাহ্যতা নেই, যা আমাদের অবস্থাকে আদেশ দেয়।

আমাকে পুনরায় বলতে দিন : এসব বারবার বলা হয়েছে। দ্রুত শ্ৰেণী বিভাজন করার ক্ষেত্রে এবং এসব অবশ্যম্ভাবী থিম আমি এখানে নিজেই সীমিত করছি। তারা সব সাহিত্য ও দর্শন পড়েছে। প্রতিদিন সেইসব কথাবার্তা মন ভরিয়েছে। তাদের পুনঃ আবিষ্কারের প্রশ্ন নেই। কিন্তু এসব ঘটনার সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে যাতে আদিম প্রশ্নের ওপর একজন নিজেই পরবর্তীরূপে প্রশ্ন তুলতে সমর্থ হয় তারই উদ্দেশ্যে। আমি আগ্রহী—আমাকে আবার ঐকথা বলতে দিন—সেটা ততটা অ্যাবসার্ড আবিষ্কার নয়, যতটা তাদের ফলের ব্যাপার। এসব ঘটনা যদি কাউকে সুনিশ্চিত করায়, তবে তাকে কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাকে কতটা যেতে হবে যাতে কোনো কিছু থেকে পালাতে না হয়? স্বেচ্ছায় কি একজনকে মরতে হবে অথবা সবকিছুর পরিবর্তে আশা করতে হবে? আগে বৌদ্ধিক স্তরের ওপর একই দ্রুতপাঠ্য সারণি নেওয়ার প্রয়োজন।

মনের প্রথম পদক্ষেপ হলো কোনটা মিথ্যে থেকে কোনটা সত্য তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে। যাই হোক, শিগগিরই চিন্তার ভেতর তা প্রতিফলিত হয়, প্রথম যা আবিষ্কার হয় তা হলো বিরোধিতা। এই ব্যাপারে প্রভাবিত করতে অকারণ লড়াই। স্পষ্টতর রূপে কয়েক শতাব্দী ধরে এবং অ্যারিস্টটলের চেয়ে সুরুচিকর উদাহরণ কেউই পরিবেশিত করেনি : ‘প্রায়ই এই সব মতের বিদ্রূপাত্মক পরিমাণ হলো তারা নিজেরাই তাদের ধ্বংস করে। কারণ জাহির করা থেকে যা সব সত্য তাই আমরা প্রমাণ করি, বিপরীত ক্ষেত্রে জাহির করা এবং ফলত আমাদের নিজেদের তত্ত্বের মিথ্যাবাদিতা (কারণ বিপরীতে প্রমাণ মেনে নেওয়া হয় না যা সত্য হতে পারে।) এবং যদি একজন বলে যে, সবই মিথ্যা, সেই প্রমাণ করে নিজেই মিথ্যা। যদি আমরা ঘোষণা করি যে, এককরূপে জাহির করাটা আমাদের বিরোধিতা করেছিল তা মিথ্যে বা অন্য কিছু, সম্পূর্ণতই আমাদের সেটা মিথ্যে নয়, তৎসত্ত্বেও সত্য ও মিথ্যের বিচারে অসীম সংখ্যাকে মেনে নিতে বাধ্য করে। কারণ একজন যে সত্য প্রমাণকে ব্যক্ত করে তা একই সঙ্গে আঁকড়ে ধরে এই সত্য এবং এ রকম চলে অনন্তকাল।

এই দুষ্ট বৃত্তটি কিন্তু সিরিজের প্রথম, মন নিজেই পাঠ করে নেয়, মাথা ঝিমঝিম করে এমন ঘূর্ণায়মান জায়গায় থাকে যাতে এই মনটি নিজেকে হারায়। এসব কূটাভাসের বিশেষ সরলতা তাদের অসাধ্য করে তোলে। যাই হোক না কেন, শব্দের ওপর খেলা এবং যুক্তির ওঠানামার কসরত, সর্বোপরি বোঝাটা একত্রিত করতে হয়। মনের এই গভীর ইচ্ছা, এমনকি এর সবচেয়ে বেশি বিশদ কর্মধারা সমান্তরাল করে মানুষের অসচেতন অনুভব, তার বিশ্বের মুখোমুখি হয়ে : এ এক পরিচিতির ওপর, স্পষ্টতার জন্যকে ক্ষুধার ওপর আরোপ। একজন মানুষের জন্য জগৎকে বোঝা, মানুষের প্রতি ক্রমশ ক্ষীয়মান, সিলমোহর দিয়ে ছাপ মারা। বিড়ালের বিশ্ব উইয়ের ঢিবির জগৎ নয়। সত্যবাদের ‘সব ভাবনা হলো মনুষ্যত্ব আরোপ’ এর অন্য কোনো অর্থ নেই। অনুরূপভাবে মনের লক্ষ্য হলো বাস্তবতাকে বোঝা, সেই মন নিজেই বিবেচনা করতে পারে, ভাবনার শর্তগুলো এর ভেতর হ্রাস পেয়ে খুশি করে কেবল। মানুষ যদি বোঝে যে বিশ্ব তার মতো, তবে ভালোবাসতে এবং কষ্ট করতে পারে, সে পুনরায় মিলিত হবে। অভ্যাসের ঝকমকে আয়নায় যদি আবিষ্কার করে ভাবনা, তাদের যোগ করতে সমর্থ হয় চিরন্তন সম্পর্ক ও সেগুলো যদি একটিমাত্র আদর্শের ওপর যুক্ত করে, তাহলে দেখা যাবে এক বৌদ্ধিক আনন্দ, এই আনন্দে আশীর্বাদের মিথ হয়ে উঠবে কিন্তু এ অনুকরণটি অসম্ভব ও হাস্যকর। ঐক্যের জন্য সেই নস্টালজিয়া, সঠিকের জন্য খিদে এঁকে দেয় মানুষের নাটকের জন্য অপরিহার্য প্রেরণা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো সেই নস্টালজিয়ার অস্তিত্ব থাকে না যা সঙ্গে সঙ্গেই তৃপ্ত করে। কারণ যদি উপসাগরটিকে সেতু করে, কামনাকে বিচ্ছিন্ন করে জয়ের আকাঙ্ক্ষা, আমরা ঈশ্বরের (যা কিছু হতে পারে) বাস্তবতাকে পারমেনিডেজের (Permenides) সঙ্গে তুলনা করি, আমরা এই মনের হাস্যকর বিরোধিতার মাঝে পড়ি, তুলনা করি—সমগ্র ঐক্য, এর নিজের পার্থক্য এর বিশেষ জাহিরত্ব দিয়ে প্রমাণ করে এবং দাবি করে বৈচিত্র্য ভেঙে যায়। এই অন্য অসৎ বৃত্তটি আমাদের আশাগুলোকে শ্বাসরুদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট।

এগুলো আবার সত্যবাদ। আবার আমি একই কথা বলব, ওরা নিজেরা উৎসাহী নয় কিন্তু ফলাফল থেকে অনুমান করতে পারে। আমি অন্য এক সত্যবাদকে জানি : আমায় বলে মানুষ মরণশীল। তৎসত্ত্বে একজন মনকে হিসেব করতে পারে, এর থেকে চূড়ান্ত উপসংহার অনুমান করেছে। এই প্রবন্ধে সাহায্যকারী এক অবিরত বিন্দু হিসেবে একে অচ্ছেদ্য বিবেচনা করতে হয়, নিয়মিত বিচ্ছেদের মাঝে আমরা কল্পনা করি আমরা জানি এবং যা প্রকৃতই জানি, বাস্তবিক সম্মতি ভানকারীর অজ্ঞতা যা আমাদের ধারণার সঙ্গে বেঁচে থাকাটা মেনে নেয়, সেই ধারণা যদি আমরা পরীক্ষার জন্য সত্যি তাদের রাখি, তাহলে আমাদের সারা জীবন উলটপালট হওয়া উচিত। মনের যে জট ছাড়ানো যায় সেই বিরোধিতার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে, আমাদের নিজেদের সৃষ্টি থেকে যা আমাদের আলাদা করে, সেই বিচ্ছেদকে আমরা সম্পূর্ণ আঁকড়ে ধরব। এই শর্তে স্থবির জগতে আমরা আশাগুলো সম্পর্কে মন নীরব থাকে, প্রতিফলিত হয় সব কিছু, এর নস্টালজিয়ার ঐক্যে ব্যবস্থা করে। কিন্তু এর প্রথম চলাটার সঙ্গে এই জগতে ভেঙে যায় ও উল্টে যায় : বোঝাপড়ার জন্য সামনে এগিয়ে দেয় এক অসীম সংখ্যক চকমকে বিচ্ছিন্নতা। সব সময় পরিচিত শান্ত সমতলে পুনর্নির্মাণে আমরা অবশ্যই হতাশ হব এই শান্ত সমতলে হৃদয়ের শান্তি আমাদের দেয়। বহু শতাব্দীর অনুসন্ধানের পর, চিন্তাবিদদের মধ্যে এত অধিকার ছেড়ে দেওয়া, আমরা ভালোভাবে ওয়াকিবহাল যে, আমাদের সব জ্ঞানের কারণে এ সত্য। যুক্তিবাদীরা ছাড়া, আজকের লোকেরা সত্য জ্ঞান সম্পর্কে হতাশ। যদি শুধু মানব চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে যাতে থাকবে পুনরোত্তর দুঃখ ও এর অক্ষমতার ইতিহাস।

কার এবং বস্তুত কিসের কথা আমি বলতে পারি : ‘আমি সেটা জানি!’ এই যে হৃদয় আমার সঙ্গে আছে আমি অনুভব করতে পারি এবং আমি বিচার করি এ রয়েছে। এই জগৎ স্পর্শ করতে পারি এবং অনুরূপভাবে আমি বিচার করি এ রয়েছে। এখানে আমার জ্ঞান হচ্ছে আর বাকিটা তৈরি করা হয়েছে। কারণ আমি যদি ধরার চেষ্টা করি এরই ভেতর যা আমি নিশ্চতরূপে অনুভব করি, যদি চেষ্টা করি সংজ্ঞা নিরূপণের এবং সারমর্ম করি, এ আঙুলের ফাঁক দিয়ে জল গলা ছাড়া আর কিছু নয়। এক এক করে সব মুখাবয়বের রূপরেখা আঁকতে পারি, এ অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হয়, অনুরূপভাবে ঐসবের অবদান রয়েছে, এই লালন, এই উৎস, এই প্রচণ্ড আবেগ বা এই সব নীরবতা, এই মহত্ত্ব বা এই নিচতা। কিন্তু দৃষ্টিকোণগুলো যুক্ত হতে পারে না। এই বিশেষ হৃদয় যা আমার, তা আমার কাছে চিরকালই অধরা থাকে। আমার অস্তিত্বে রয়েছে নিশ্চয়তা এবং বিষয়টি যা আমি সেই আশ্বাস দিতে চেষ্টা করি, এই শূন্যতা কখনো পূরণ হয় না। চিরকালের জন্য আমার কাছে আমি এক অচেনা, এক আগন্তুক। মনস্তত্ত্বে যেমন যুক্তিশাস্ত্রে সত্য রয়েছে কিন্তু সেটা সত্য নয়। সক্রেটিসের রয়েছে “নিজেকে জানো’ ততটা মূল্যই যতটা আমাদের স্বীকারের মতো ‘নিষ্পাপ হও’। তারা এক নস্টালজিয়ার উন্মোচন করে আবার একই সঙ্গে এক অজ্ঞতাও তাঁরা মহান বিষয়ের ওপর নিষ্ফল প্রয়াস চালায়। তারা যতটা কাছাকাছি করে তার সংক্ষিপ্তরূপে আইনসঙ্গত।

আর এখানকার গাছপালা, তাদের গাঁটসর্বস্ব তল, জল আমি জানি এবং এর স্বাদ অনুভব করি। ঘাসের এসব ঘ্রাণ ও রাতের নক্ষত্র, নির্দিষ্ট সন্ধ্যেগুলো যখন হৃদয় অবসর উপভোগ করে—যার ক্ষমতা ও শক্তিকে অনুভব করি সেই জগৎকে আমি কীভাবে বাতিল করি? তবুও পৃথিবীর ওপর যেসব জ্ঞান আমাকে কোনো কিছুই আশ্বাস দেয় না, যে এই জগৎ আমার। আমার কাছে বর্ণনা করো এবং একে শেখাও শ্রেণী বিশ্লেষণ। এর সূত্রগুলো উল্লেখ করো এবং আমার জ্ঞানের তৃষ্ণার কারণে আমি মেনে নিই এগুলো সত্য। এর যান্ত্রিকতা তুমি আলাদা করে রাখো আর আমার আশাগুলো বেড়ে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাকে শেখাও এই বিস্ময়কর ও বহুবর্ণের বিশ্ব ক্রমশ কমে গিয়ে হতে পারে পরমাণু, এই পরমাণু নিজেই কম হতে পারে ইলেকট্রন। এই সব ভালো এবং একে অবিরাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তোমার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু আমাকে এক অদৃশ্য গ্রহ পদ্ধতি সম্পর্কে বলো, যাতে এক নিউক্লিয়াসের চারপাশে মাধ্যাকর্ষণ করে ইলেকট্রনগুলো। এক প্রতিমূর্তি দিয়ে আমাকে তুমি এ জগৎকে ব্যাখ্যা করো। আমি বুঝি তারপর তুমি কবিতায় রূপান্তরিত হও : আমি কখনো জানব না। ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধী হওয়ার সময় কি আমার আছে? তুমি ইতিমধ্যে তত্ত্বগুলো বদলে নিয়েছ। সুতরাং বিজ্ঞানকে আমায় সবকিছু শেখাতে হয়। এই বিজ্ঞানের সমাপ্তি ঘটে একটি প্রকল্পে, রূপকের ভেতর ঐ স্বচ্ছ স্থপয়িতারা, ঐ অনিশ্চয়তা শিল্পকর্মে মিশে যায়। এত সব প্রয়াসের কি প্রয়োজন ছিল? এই সব পাহাড়ের নরম রেখায় এবং এই কষ্টকাতর হৃদয়ের উপর সন্ধের হাত আমাকে শেখায় আরো বেশি। আমার শুরুতে আমি ফিরেছি। আমি বুঝি যদি বিজ্ঞানের ভেতর দিয়ে আমি অভ্যাসকে ধরতে পারি এবং তাদের প্রকাশ করতে পারি। তার জন্য আমি জগতের সবকিছু ধরতে পারি না। আমার আঙুল দিয়ে সমগ্র সাময়িক মুক্তিকে যদি চিহ্নিত করতাম, এর বেশি আর জানা উচিত নয়। আর তুমি আমাকে পছন্দ করার সুযোগ দিয়েছ, এ এক বর্ণনা যা নিশ্চিত কিন্তু তা আমাকে কিছুই শেখায় না এবং এ প্রকল্পগুলো যা আমাকে শেখাতে দাবি করে কিন্তু সেটাও নিশ্চিত নয়, এরই মাঝে। আমার ভেতর অচেনা এবং জগতে সম্পূর্ণভাবে একা, ভাবনার অস্ত্রে সজ্জিত, নিজেই বাতিল করে, তুলনা করে দ্রুতই, এই অবস্থাটা এমনই যাতে জানতে ও বাঁচতে অস্বীকার করে কেবল শান্তি পেতে পারি, যার ভেতরে জয়ের খিদে দেয়ালে ধাক্কা খায় এবং অস্বীকার করে অসম্মানকে? ইচ্ছেকে নিয়ে যেতে হয় কূটাভাসে। এভাবে সবকিছু আদেশেই পালিত হয়, সত্তার ভেতরে আনতে হয়, এই সত্তার শান্তি বিষাক্ত করে চিন্তাহীনতা, হৃদয়ের অভাব অথবা ভয়ানক আত্মোৎসর্গে উৎপন্ন করে সেটা।

অতঃপর বুদ্ধিমত্তা ও এর প্রক্রিয়া আমাকে বলে এই জগৎ হলো অ্যাবসার্ড। এর বিপরীত, অন্ধ কারণ ভালোভাবে দাবি করতে পারে সবকিছুই পরিষ্কার। প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম এবং এ ঠিক হয়ে উঠবে তার জন্য ছিলাম। কিন্তু বহু ভণ্ড শতাব্দীর পরিবর্তে, এত বেশি বাকপটু ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরা মাথার ওপরে আমি জানি এ মিথ্যে। কমপক্ষে এই সমতলের ওপরে আমি যদি না জানতে পারি তবে কোথাও সুখ নেই। সেই চিরন্তন কারণ, বাস্তব বা নৈতিক, সেই নির্ণয়বাদ, সেই সব স্তরভেদে ব্যাখ্যা করে একজন ভালো মানুষকে হাসাবার পক্ষে সবকিছুই যথেষ্ট। মন নিয়ে তাদের কিছু করার নেই। তারা বাতিল করে গভীর সত্যকে যাকে বন্দি হতে হয়। এই দুর্বোধ্য ও সীমিত বিশ্বে অতঃপর মানুষের ভাগ্য অন্তর্ভুক্ত করে এর তাৎপর্যকে। লাফিয়ে ওঠে অযৌক্তিক বড় দল এবং তাকে ঘিরে ধরে যে পর্যন্ত না চূড়ান্তরূপে শেষ হচ্ছে। তার আরোগ্যতায় এবং স্বচ্ছ পাঠে, হয়ে ওঠে অ্যাবসার্ডের অনুভূতি পরিষ্কার ও নির্দিষ্ট। আমি বলি এই জগৎ হলো অ্যাবসার্ড কিন্তু আমিও হঠকারী ছিলাম। এ জগৎটা নিজেও যুক্তিগ্রাহ্য নয়, সেটাই সব এ বলা যেতে পারে। কিন্তু অ্যাবসার্ড কী, অযৌক্তিক লড়াই ও স্পষ্টতার জন্য বন্যরূপে থাকে, যার ডাক প্রতিধ্বনিত হয় মানব হৃদয়ের ভেতরে। অ্যাবসার্ড যতটা মানুষের ওপর নির্ভর করে ততটাই জগতের ওপর। সেই মুহূর্তে সব তাদের সঙ্গে একত্রে যোগসূত্র স্থাপন করে। তাদের একটার সঙ্গে অন্যকে বাঁধে যেমন ঘৃণা দুটো প্রাণীকে একত্রে প্রবল চাপে সংযুক্ত করে। এই সব যা পরিষ্কাররূপে আলাদা করতে পারি, এই অপরিমিত বিশ্বকে যেখানে আমার অভিযান অনুষ্ঠিত হয়। আসুন এখানে আমরা একটু থামি। যদি সত্য হয়ে আমি ধরি অ্যাবসার্ডতা জীবনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্ণয় করে, সেই স্পর্শকাতরতার সঙ্গে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠি যা আমাকে তুলে ধরে জগতের দৃশ্যগুলোর সামনে, বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে স্বচ্ছতা দিয়ে আরোপিত করে আমাকে, এই সব নিশ্চয়তায় আমার সবকিছু অবশ্য উৎসর্গ করব আমি এবং অবশ্য দেখব তাদের, তারা সমর্থ হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণে চৌকসরূপে। সর্বোপরি, তাদের ওপর আমার আচরণ অবশ্যই গ্রহণ করব এবং তাদের সব পরিণাম অনুসরণ করব। এখানে আমি সৌন্দর্যের কথা বলছি। যদি চিন্তা সেই সব মরুভূমিতে বাস করতে পারে তবে আমি কিন্তু আগেই জেনে নিতে চাই।

আমি ইতোমধ্যেই জেনেছি এই সব মরুভূমিতে কমপক্ষে চিন্তা প্ৰবেশ করেছে। দেখা গেছে এর রুচিতে। বোঝা গেছে দুঃস্বপ্নে আগেই একে খাওয়ানো হয়েছে। জরুরি থিমগুলো তাদের মধ্যে অধিকাংশ মানব প্রতিফলনে বিচার করা হয়।

যেই মুহূর্ত থেকে অ্যাবসার্ডতা চেনা গেল, এ হয়ে ওঠে আবেগ, সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু একজনের আবেগের সঙ্গে থাকতে পারুক বা না পারুক, তাদের নীতিকে গ্রহণ করতে পারুক বা না পারুক, যা হৃদয়কে পোড়াতে হয় আবার একই সঙ্গে তারা প্রতিষ্ঠিতও করে, সেটাই হলো সম্পূর্ণ জিজ্ঞাসা। যাই হোক এটাই একটা নয়, আমরা কেবল জিজ্ঞেস করব। দাঁড়িয়ে থাকে অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এর দিকে ফিরে আসার সময়ও হয়ে যাবে। বরং আসুন আমরা ঐসব থিম ও ঐসব প্রেরণা যা মরুভূমিতে জন্মায় সেগুলো চিনি। তাদের যথাযোগ্য রূপেই উল্লেখ করবে, আজ সেগুলোও সবার জানা হবে। অযৌক্তিক অধিকারকে রক্ষার জন্য লোক সব সময় থেকে যাবে। ঐতিহ্য সম্পর্কে যা খুশি বলা যেতে পারে, পীড়নকারী চিন্তা থাকবে তা কখনো বন্ধ করা যায় না। প্রায়ই যুক্তিবাদের সমালোচনা তৈরি হয়ে থাকে যেন মনে হয় এ আবার শুরু হয়েছে অকারণ। এযাবৎ আমাদের সময় চিহ্নিত হয় সেই সব কূটাভাসতার রীতির পুনর্জন্মের দ্বারা, সেই রীতি যুক্তির কাছে ফিরে আসার ক্ষেত্রে বিরোধিতা যেন সত্যি এ সব সময় পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। কিন্তু যুক্তির ফলপ্রদ প্রমাণের পক্ষে সেটা যথেষ্ট নয় যেমন এর আশায় ঐকান্তিক প্রয়াসের ক্ষেত্রে। ইতিহাসের সমতলের ওপর, এরূপ দুটি মনোভাবের স্থিরতা মানুষের অচ্ছেদ্য আবেগকে এঁকে দেয়, ঐক্যের দিকে তার আগ্রহ এবং স্বচ্ছ দৃষ্টির মাঝে বিদীর্ণ করে, থাকতে পারে তার দেয়াল যা তাকে ঘিরে রাখে।

কিন্তু, কখনোই নয়, সম্ভবত যে কোনো সময় যুক্তির ওপর আক্রমণ হলেও আমাদের চেয়ে বেশি হিংস্র নয়। জরাথুস্ট্রর মহান প্রতিবাদ থেকে : ‘আকস্মিক জগতে এ হলো মহানুভবতা। তুলনা করি সবকিছুর সঙ্গে যখন তাদের ওপর কোনো চিরন্তন ইচ্ছেকে চর্চা করা হয়েছিল তারই ব্যাপক প্রচার করি’, কিয়ের্কেগার্দের নিয়তিসূচক অসুস্থতা থেকে : ‘সেই ব্যাধি তার সঙ্গে কোনো কিছুই অনুসরণ না করে মৃত্যুর দিকে চালিত করে’, অ্যাবসার্ড ভাবনার থিমের গুরুত্বপূর্ণতা ও যন্ত্রণা একে অন্যকে অনুসরণ করেছে। অথবা, কমপক্ষে, এই অনুবিধি হলো প্রধান গুরুত্বপূর্ণ, যৌক্তিক থিম এবং ধর্মীয় ভাবনা। জাসপারস থেকে হেইডেগার থেকে, কিয়ের্কেগার্দ থেকে চেস্টভ, রূপতত্ত্ববিদ থেকে শেলার, যৌক্তিক সমতলের ওপরে, আদর্শের সমতলে তাদের নস্টালজিয়ার সঙ্গে একটি পুরো পরিবারের মনের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু তাদের পদ্ধতি অথবা তাদের লক্ষ্য দিয়ে বিরোধিতা করে, যুক্তির রাজকীয় পথ অবরোধের দ্বারা নাছোড় হয়ে রয়েছে এবং আয়ত্ত করে সত্যের সরাসরি পথকে। এখানে আমি মনে করি, এসব ভাবনা জ্ঞাত হবে এবং থাকবে। যা কিছু হতে পারে বা যা কিছুতে তাদের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, সবকিছু শুরু হয়েছিল সেই অবর্ণনীয় বিশ্ব থেকে যেখানে বিরোধিতা, অ্যান্টিনোমি, ক্ষোভ বা অক্ষমতা রাজত্ব করে। আর তারা থাকে সাধারণত্বে যা হলো সংক্ষিপ্তরূপে থিম, তা যতটা সম্ভব প্রকাশ করে দেয়। তাদের জন্যও এ অবশ্যই বলা হয়ে থাকে, সেই সব আবিষ্কার থেকে তারা নজর কাড়ার ব্যবস্থা করেছে সর্বোপরি ব্যাপারগুলো হলো উপসংহার। সেই ব্যাপারগুলো এত বেশি যে আলাদাভাবে সেগুলো অবশ্যই পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাদের আবিষ্কারগুলো ও তাদের প্রাথমিক পরীক্ষাগুলোর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল। আমরা সম্পূর্ণভাবে উল্লেখিত তাদের চুক্তির সঙ্গে ওয়াকিবহাল। যদি বিনা বিচারেই সাময়িকভাবে তাদের দর্শনকে প্রয়োগ করতে চেষ্টা হয়ে থাকে, যে কোনো ক্ষেত্রে এ সম্ভব এবং যথেষ্ট পরিস্থিতিকে স্পষ্ট ব্যক্ত করা, সেটা তাদের কাছে সাধারণ।

শীতলভাবে হেইডেগার মানব অবস্থাকে বিবেচনা করেন এবং ঘোষণা করেন সেই অস্তিত্বকে পীড়ন করা হয়। সত্তার পুরো আবর্তে বাস্তবতা হলো কেবল ‘দুশ্চিন্তা’। মানুষের কাছে জগৎ হারিয়ে যায় এবং এর বিভেদগামিতার এই দুশ্চিন্তা এক সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী ভয়। কিন্তু যদি সেই ভয় নিজেই সচেতন হয়ে ওঠে, তবে হয়ে ওঠে ক্ষোভ, স্বচ্ছ মানুষটির স্থায়ী পরিবেশে ‘যার অস্তিত্ব কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়’। নির্দ্বিধায় দর্শনের এই অধ্যাপক লেখেন এবং জগতে সবচেয়ে বেশি বিমূর্ত ভাষায় যে ‘মানব অস্তিত্বের নির্দিষ্ট ও সীমিত চরিত্র মানব সত্তার চেয়েও অনেক বেশি আদিম।’ তাঁর কান্টের উপর আগ্রহ, তার ‘পবিত্র যুক্তি’র গণ্ডি বেঁধে দেওয়া চরিত্রকে চেনার ঔৎসুক্যকে কেবল বাড়িয়ে দেয়। তার বিশ্লেষণের শেষে এই উপসংহার টানতে হয়, ‘যে মানুষ ক্ষোভে পূর্ণ, জগৎ সেই লোককে আর বেশি কিছু সাধতে পারে না।’ জগতের সব রকমভেদের চেয়ে মনে হয় এই দুশ্চিন্তা তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এ সম্পর্কে তা বলেছে। এর বোধকে সে বেশি ব্যক্ত করে : একঘেয়েমিকে যখন একজন সাধারণ মানুষ তার ভেতর বিরোধিতা করে বাতিল করে এবং একে অকেজো করে দেয়; আতঙ্ক মন যখন মৃত্যুকে অবলোকন করে। সেও আলাদা করে না অ্যাবসার্ড থেকে সচেতনতাকে। মৃত্যুর সচেতনতাকে বলা হয় দুশ্চিন্তার ডাক এবং ‘অস্তিত্ব তারপর এ নিজেই সচেতনতার মধ্যবর্তীর ভেতর দিয়ে এর নিজের সমন বিলি করে দেয়।’ এ হলো ক্ষোভের বিশেষ কণ্ঠস্বর এবং বাধ্য করে ভয় দেখিয়ে অস্তিত্বকে ‘অজ্ঞাতনামা ‘তাহারা’র ভেতর হারানোর থেকে ফিরে আসে’। ‘তার জন্য এ একজন অবশ্য ঘুমোয় না কিন্তু যতক্ষণ না সম্পূর্ণতা দেয় ততক্ষণ সজাগ থাকে। এই অ্যাবসার্ড জগতে সে দাঁড়ায় এবং দেখায় স্বল্পজীবী চরিত্রকে। এই সব ধ্বংসের ভেতর তার পথ খোঁজে।

জাসপারস যে কোনো তত্ত্ববিদ্যার ওপর হতাশ কারণ তিনি দাবি করেন আমরা সরলতা হারিয়েছি। তিনি জানেন আমরা কিছুই অর্জন করতে পারিনি যে উপস্থিতির সর্বনাশা খেলায় শ্রেষ্ঠ হবে। তিনি জানেন মনের শেষ হলো ব্যর্থতা। আধ্যাত্মিক অভিযানগুলো যা ইতিহাস প্রকাশ করেছে তা নিয়ে তিনি গড়িমসি করেন এবং নির্দয়ভাবে প্রতিটি পদ্ধতির মধ্যে ত্রুটিকে প্রকাশ করে দেন, কোনো কিছুই আর লুকিয়ে রাখেন না। এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জগতে যাতে জ্ঞানের অসম্ভাব্যতা প্রতিষ্ঠিত, যাতে চিরন্তন শূন্যতা মনে হয় একমাত্র বাস্তব এবং সমাধান নয় এমন হতাশা, মনে হয় এ কেবল মাত্র মনোভাব, তিনি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেন ‘এরিয়াডনের সুতো’ যা ঐশ্বরিক রহস্যতার দিকে চালিত করে।

চেস্টভ, তাঁর ভাগে, এক বিস্ময়কর ক্লান্তিকর কাজের ভেতর দিয়ে, একই সত্যের দিকে অবিরামভাবে বিস্তৃত করে দৃঢ়ভাবে, ক্লান্তিহীনভাবে প্রদর্শন করে দৃঢ়রীতি, সবচেয়ে চিরন্তন যুক্তিবাদ সমসময় চরমভাবে মানব ভাবনায় যুক্তির ওপর হোঁচট খায়। পরিহাস ভরা ঘটনাসমূহ অথবা অদ্ভুত বিরোধিতা যুক্তিতে মূল্য দেয় না, যা তাকে বাঁচায়। কেবল একটা জিনিসই তাকে আগ্রহী করে এবং তা হলো ব্যতিক্রম তা নিয়ন্ত্রণে থাকুক হৃদয় বা মনের। দস্তয়েভস্কির অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির, হ্যামলেটের আহ্বান বা ইবসেনের তিক্ত আভিজাত্য, খুঁজে বের করে, বিভ্রান্ত করে অপ্রতিকার্যের বিরুদ্ধে মানব বিদ্রোহকে। এ কারণকে অস্বীকার করে, এর ঋতুগুলোকে এবং সেই বর্ণহীন মরুভূমির মাঝে কেবল কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলতে শুরু করে, এখানে সব নিশ্চয়তা পাথর হয়েছে।

সম্ভবত সবচেয়ে বেশি যুক্ত, কিয়ের্কেগার্দ কমপক্ষে তার অস্তিত্বের ভাগে অ্যাবসার্ড আবিষ্কারের চেয়ে আরো বেশি করেন, তিনি এতেই বেঁচে আছেন। যে মানুষটি লেখেন : জেদী নীরবতার নিশ্চিততমকে একজনের জিদ ধরতে হয় না বরং কথাকে শুরুতেই নিশ্চিত করে কোনো সত্যই সম্পূর্ণ নয় বা প্রতিদিন হিসাবে দিতে পারে অস্তিত্বের সন্তুষ্টি যা এরই সত্তার ভেতর অসম্ভব। ডন জুয়ানের বোঝাপড়া, বাড়িয়ে দেয় ছদ্মনাম এবং বিরোধিতা, লেখেন তাঁর ‘ডিসকোর্সেস অব এডিফিকেশন’ এবং একই সঙ্গে নিন্দিত অধ্যাত্মবাদের নীতিশাস্ত্র, ‘দ্য ডায়েরি অব দ্য সিডুসার’। তিনি অস্বীকার করেন সান্ত্বনা, নীতি, বিশ্বাসযোগ্য আদর্শ। সেই কণ্টক বিষয়ে তাঁর হৃদয়ে তিনি অনুভব করেন, এর শান্ত বেদনা সম্পর্কে যত্নবান ছিলেন না। অপরদিকে, জাগিয়ে দেয় মানুষের বেপরোয়া আনন্দ ক্রুশবিদ্ধ ও সুখী হয়ে ওঠে এই রকম, টুকরো টুকরো করে নির্মাণ করে—স্বচ্ছতা, অস্বীকার, ভান—এক ধরনের মানুষের অধিগত। মেনে নেওয়া ও অবজ্ঞা উভয়ই থাকে সেই মুখে, সেই সব আঙুলের ওপর ভর দিয়ে পাক খাওয়া উদ্দাম চান হৃদয়ের থেকে এক চিৎকার অনুসরণ করে যা আত্মা নিজেই আঁকড়ে ধরে বাস্তবতার সঙ্গে, যার পেছনে রয়েছে উপলব্ধি। আর আধ্যাত্মিক দুঃসাহসিক অভিযান যা চারিত করে কিয়ের্কেগার্দকে তাঁর ভালোবাসার দুর্ণামগুলোতে, শুরু করে অনুরূপভাবে এক অভিজ্ঞতার বিশৃঙ্খলায় একে স্থির হওয়া থেকে বঞ্চিত করে এবং মূল অসংলগ্নতায় নির্বাসিত করে একে।

সম্পূর্ণ এক আলাদা সমতলে, সেই পদ্ধতিতে হুসার্ল ও রূপতত্ত্ববিদরা তাদের বিশেষ সীমা পেরোনো দিয়ে এর বিচ্ছিন্নতায় জগৎকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং যুক্তির সর্বশক্তিকে অস্বীকার করে। তাদের ভেতর দিয়ে আধ্যাত্মিক বিশ্ব অপরিমেয় জ্ঞান লাভ করে। ভালোবাসা, কামনা বা মাধ্যাকর্ষণের সূত্রের যেমন গুরুত্ব তেমনই গোলাপের পাপড়ি, মাইলস্টোন বা মানুষের হাতের গুরুত্ব। বড় তত্ত্বের ছদ্মবেশে একত্রিত বা তৈরি করে এক অনুরূপ জনপ্রিয়তা যা বন্ধ করে ভাবনা। ভাবনা আবার শেখাচ্ছে পুনরায় দেখতে, মনোযোগী হতে, সচেতনতার ওপর আলোকপাত করে; প্রুস্তের মনোভাবে প্রতিটি ধারণা, প্রতিটি মূর্তি ঘোরে, এক সুবিধেপ্রাপ্ত মুহূর্তে। কোনো যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তাই হলো এর চূড়ান্ত সচেতনতা। শুরুতেই কিয়ের্কেগার্দ বা চেস্টাভ, হুসার্লের এগিয়ে যাওয়ার আচরণ যদিও অনেক বেশি, অধিকন্তু যুক্তি ধ্রুপদী রীতিকে বাতিল করে, হতাশ করে আশা, খুলে দেয় স্বজ্ঞার কাছে ও হৃদয়ের কাছে, অবভাসের এক সামগ্রিক বেড়ে যাওয়া, সম্পদ যাতে অমানবিক কিছু থাকে। এই পথ গেছে সব বিজ্ঞানের দিকে অথবা কারো কাছে নয়। এই ক্ষেত্রে বলবার এই পরিমাণ সমাপ্তি অপেক্ষা উপায়গুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবই জড়িত তা হলো ‘এক বোঝার মনোভাব’ এবং নেই সান্ত্বনা। আমাকে আবার বলতে দিন : শুরুতে, কমপক্ষে।

এই সব মনের প্রাথমিক সম্পর্কগুলো অনুভব করতে কীভাবে একজন ব্যর্থ হয়! তার কীভাবে দেখতে ব্যর্থ হয় তারা যারা সুযোগপ্রাপ্ত ও তিক্ত মুহূর্ত ঘিরে থাকে, পক্ষ নিয়ে থাকে যাতে আশার আর কোনো জায়গা নেই? আমি চাই আমার কাছে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হোক অথবা কোনোকিছুই নয়। আর যুক্তি অক্ষম যখন হৃদয় থেকে এই আর্তনাদ শোনে। এই চাপানো অনুসন্ধানের ফলে মন জেগে ওঠে এবং কিছুই দেখতে পায় না, কিন্তু দেখে বিরোধিতা এবং অজ্ঞানতা। আমি যা বুঝতে ব্যর্থ হই তাই হলো অজ্ঞানতা। এরূপ অযুক্তি দিয়ে জগৎ ভরে আছে মানুষে। যার একটি অর্থ আমি বুঝি না সেই জগৎ বরং এক বিশাল অসঙ্গতি। যদি একজন একবারের জন্য কেবল বলতে পারে : ‘এ পরিষ্কার’, সবই রক্ষা পাবে। কিন্তু এই সব মানুষ একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, ব্যাপক প্রচার করে যার কোনোকিছুই পরিষ্কার নয়, সবকিছুই ডামাডোলে, সবার যা আছে তা হলো স্বচ্ছতা এবং দেয়ালের নির্দিষ্ট জ্ঞান যা তাকে ঘিরে আছে।

এই সব অভিজ্ঞতা রাজি হয়ে এবং একজন আরেকজন সুনিশ্চিত করে। মন যখন সীমানায় পৌঁছায়, মন অবশ্যই এক রায় তৈরি করে এবং বেছে নেয় সিদ্ধান্ত। এই সেই জায়গা যেখানে আত্মহত্যা ও উত্তর দাঁড়িয়ে। কিন্তু অনুসন্ধানের আদেশটি বিপরীত করার ইচ্ছে পোষণ করি এবং বৌদ্ধিক অভিযানের প্রয়াস করি ও ফিরে আসি প্রতিদিনের কর্মধারায়। এখানে মনের ভেতর অভিজ্ঞতার ডাক এসেছিল তা এই নির্জনতায় জন্ম নিয়েছিল, আমরা অবশ্য পেছনে ফেলে যাইনি। তারা কতটা গিয়েছিল কমপক্ষে তা জানা দরকার। তার প্রয়াসের এই ক্ষেত্রে মানুষ অযৌক্তিকতার সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার সঙ্গে সে অনুভব সুখের জন্য যুক্তির জন্য তার বেঁচে থাকা। জগতের মানব প্রয়োজন ও অযৌক্তিক নীরবতার মাঝে এই বিরোধিতায় জন্ম নেয় অ্যাবসার্ড। এ অবশ্য ভোলা যায় না। এতে অবশ্য অনুরক্ত হতে হয় কারণ জীবনের সব পরিণাম এর ওপর নির্ভর করে। অযৌক্তিক, মানব নস্টালজিয়া এবং অ্যাবসার্ড থেকে জন্ম নেয় সংঘর্ষ-নাটকের এই তিনটিই হলো চরিত্র, আর প্রয়োজনীয়ভাবে নিষ্পত্তি হওয়া দরকার যুক্তির মাধ্যমে যাতে অস্তিত্ব সমর্থ হয়।

দার্শনিক আত্মহত্যা

অ্যাবসার্ড অনুভূতি সব সত্ত্বেও কিন্তু অ্যাবসার্ড ধারণা নয়। ভিতগুলো এরই জন্য, সেগুলোই সব। বিশ্বের ওপর যখন বিচার শেষ হয়ে যায় সেই অল্প সময় ছাড়া এই ধারণা সীমিত থাকে না। পরবর্তী পর্যায়ে এর সুযোগ রয়েছে আরো দূরে অগ্রসর হওয়ার। এ হলো জীবন্ত, অন্যথা হয় এ মরবে নয় প্রতিহত করবে। তাই যা সব আমরা একত্রিত করেছি, সেই থিমগুলো এর সঙ্গেই থাকে। আবার যা আমাকে উৎসাহিত করে তা কিন্তু কথা বা মন নয়, সমালোচনা যাদের অন্য ফর্মে ও অন্যত্র তাদের দাবি মেটায়, তবে তাদের সিদ্ধান্তের আবিষ্কারে রয়েছে কিছু সাধারণ সাদৃশ্য। সম্ভবত কখনোই মনগুলো এত আলাদা নয়। তবু আমরা চিনতে পারি পরিচিত আধ্যাত্মিক ভূদৃশ্যাবলি যাতে তারা গতিপথকে প্রতিহত করে। অনুরূপ, ঘৃণা এমনই বিসদৃশ জ্ঞানের পরিধি, তাদের ভ্রমণশীলতা শেষ সীমায় নিয়ে যায়, একইভাবে আর্তনাদ ঘোষণা করে জোরে। সাক্ষ্যরূপে যাদের আমরা পুণরায় স্মরণ করি সেইসব চিন্তাবিদদের রয়েছে একই রকম পরিবেশ। বলতে গেলে সেই পরিবেশ ভয়ঙ্কররূপে শব্দের খেলায় কোনোরকম পরিমাপ করা। সেই শ্বাসরুদ্ধ আকাশের নিচে একজনকে বাধ্য করে, হয় পালাতে নয় থাকতে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কীভাবে লোকেরা প্রথম ক্ষেত্রে পালায় এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে লোকেরা থাকে। কেমনভাবে আমি আত্মহত্যার সমস্যা ও অস্তিত্ববাদী দর্শনের উপসংহারের সম্ভাব্য উৎসাহের সংজ্ঞা নিরূপণ করি।

কিন্তু প্রথমেই সরাসরি পথ থেকে আমি ঘোরাতে চাই। এ পর্যন্ত আমরা বাইরে থেকে অ্যাবসার্ডকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছি। যাই হোক একজন বিস্মিত হতে পারে সেই ধারণাটা কতটা পরিচ্ছন্ন এবং অন্যদিকে সরাসরি বিশ্লেষণ করে, এর অর্থ আবিষ্কারের চেষ্টা করে আবার অন্যদিকে ফলাফল এরই ভেতর জড়িত।

আমি যদি একজন সরল নিরপরাধ ব্যক্তিকে ভয়ঙ্কর অপরাধে অভিযুক্ত করি, যদি একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিকে বলি যে, তার নিজের বোনের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত, তবে সে উত্তর দেবে এ অ্যাবসার্ড। তার ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধে রয়েছে এর কৌতুকের দিক। কিন্তু এরও রয়েছে মৌলিক কারণ। সেই উত্তরে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি প্রমাণ করে যে, কাজের ভেতর থেকে তাকে গুণী বলে মনে করি এবং তার জীবনভর আদর্শের মাঝখানে তার সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিনোমি অস্তিত্ব। ‘এই অ্যাবসার্ড’-এর অর্থ হলো ‘এ অসম্ভব’ কিন্তু এও এক বিরোধিতা’। আমি যদি দেখি একদল লোক মেশিনগান নিয়ে একজনকে আক্রমণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তি একটা তরবারি অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে, তার এই কাজকে আমি অ্যাবসার্ড হিসেবে বিবেচনা করব। কিন্তু তার ইচ্ছে ও বাস্তবের মাঝে যা নিয়ে লড়াই করবে তা অসামঞ্জস্যের কারণে এতই নিঃসঙ্গ সম্পূর্ণ একক, বিরোধিতায়ও লক্ষ্য করি তার প্রকৃত শক্তি ও উদ্দেশ্যের মাঝে তার রয়েছে এক অবলোকন। অনুরূপ আমরা রায় দিই অ্যাবসার্ড যখন এর সঙ্গে রায়ের তুলনা করি, যে রায় যে ঘটনা আপাতভাবে বলা হয়েছে। এবং একইভাবে অ্যাবসার্ডের সাহায্যে দেখানো হয় যৌক্তিক বাস্তবতার সঙ্গে ফলের এরূপ এক যুক্তি দিয়ে পাওয়া যায়, যাকে একজন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই সব ক্ষেত্রে, সহজতম থেকে জটিলতমের দিকে, আমার তুলনায় দুটি স্তরের মাঝখানের দূরত্বে অ্যাবসার্ডতার বিস্তার হয়ে ওঠে সরাসরি অনুপাত। এতে রয়েছে অ্যাবসার্ড বন্ধন, প্রতিবাদ, ঈর্ষা, হিংসা, নীরবতা, যুদ্ধ এমনকি শান্তিচুক্তি। তাদের প্রত্যেকের জন্য এক তুলনা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ্যাবসার্ডতা। এভাবে আমাকে যাচাই করা হয় এই বলে যে, কেবল একটি ঘটনার সমীক্ষা বা অভিব্যক্তি থেকে অ্যাবসার্ডতা লাফিয়ে পড়ে না বরং এক উন্মুক্ত ঘটনা এবং এক নির্দিষ্ট বাস্তবতার তুলনা মাঝখান থেকে এ বিস্ফোরিত হয়, এক প্রতিক্রিয়া ও জগতের মাঝে এ সর্বোৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। অ্যাবসার্ড হলো মুখ্যত এক বিচ্ছেদ। অ্যাবসার্ড উপাদানগুলোর তুলনায় কখনোই এ থাকে না, এ জন্ম নেয় তাদের সংগ্রামের থেকে।

এই বিশেষ ক্ষেত্রে এবং বৌদ্ধিক সমতলে, আমি তাই বলতে পারি অ্যাবসার্ড একজন মানুষের ভেতর নেই (যদি এ রকম রূপকের কোনো অর্থ থেকে থাকে), নেই জগতে, কিন্তু তাদের যৌথ উপস্থিতিতে রয়েছে। মুহূর্তের জন্য তাদের একত্রিত রাখার জন্য এ হলো বণ্ড। আমি যদি নিজেকে সীমিত রাখতে ইচ্ছে করি, ঘটনারাজিতে আমি জানি মানুষ কী চায়, জানি জগৎ তাকে কী দিতে চায় এবং এখন আমি বলতে পারি আমি এও জানি তাদের যোগসূত্র কী। গভীরতর রূপে একে খনন করা আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অনুসন্ধানকারীর পক্ষে কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্টতাই যথেষ্ট। এর থেকে তাকে সহজভাবে সব ফলাফলকে বের করতে হবে।

তৎক্ষণাৎ ফলও হলো এক রীতির নিয়ম। এই অস্বাভাবিক ত্রয়ী এভাবে আলোর দিকে নিয়ে আসে তা কিন্তু নিশ্চিতরূপে চমকপ্রদ আবিষ্কার নয়। কিন্তু তার ভেতর অভিজ্ঞতার তথ্য একই রূপ, সেই ক্ষেত্রে উভয়ই অসীম রূপে সরল এবং অসীম রূপে জটিল। এই ক্ষেত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এ কখনো বিভাজিত হতে পারে না। এর শর্তাবলির একটিকে ধ্বংস করা মানে সবকেই ধ্বংস করা।

মানব মনের বাইরের দিকে কোনো অ্যাবসার্ড নেই। এভাবে, সব কিছুর বেলায় মৃত্যুর সঙ্গে সব অ্যাবসার্ড শেষ হয় এবং এ হলো প্রাথমিক নীতি যা দিয়ে আমি অ্যাবসার্ড ধারণাকে মুখ্য হিসেবে বিচার করি, বিবেচনা করি, আমার সত্যগুলোকে প্রথম হিসেবে এ দাঁড় করাতে পারে। উপরে যা পরোক্ষরূপে উল্লেখ করে তার পদ্ধতির নিয়ম এখানে উপস্থিত হয়। আমি যদি একটি জিনিসকে সত্য বলে বিচার করি, আমি অবশ্য তাকে রক্ষা করব। যদি আমি একটি সমস্যাকে সমাধান করি, কমপক্ষে সেই বিশেষ সমাধান দিয়ে আমি অবশ্যই সমস্যার একটি শর্তকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করব না। সম্পূর্ণ উপাত্তটি আমার কাছে অ্যাবসার্ড। সর্বোপরি আমার প্রথম ও আমার অনুসন্ধানের কেবল শর্ত হলো বিশেষ জিনিসটিকে রক্ষা করা বা আমাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফলে এক্ষেত্রে একে আমি মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করি। আমি একে কেবল দ্বন্দ্ব ও অবিরাম সংগ্রাম হিসেবে নির্ণয় করেছি।

এবং এর উপসংহারের দিকে এই অ্যাবসার্ড যুক্তি বহন করে, আমি অবশ্য তাকে মেনে নিই যে, আমার সমগ্র অনুপস্থিতির (যার হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই) সঙ্গে নিহিত থাকে সংগ্রাম, এক অবিরাম বাতিল (যা আত্মত্যাগের সঙ্গে অবশ্যই বিভ্রান্ত হবে না) এবং এক সচেতন অসন্তুষ্টি (যা অবশ্যই তুলনা করা হবে না এর অকাল অস্থিরতার সঙ্গে)। সবকিছু নষ্ট হয়, সবকিছু কৌশলে দূরে সরে থাকে বা ঐসব বস্তু অনুশীলিত হয় (এবং প্রথমত সম্মতিকে যা বিচ্ছেদ দূরে ঠেলে দেয়), ঐসব বস্তু ধ্বংস করে অ্যাবসার্ডকে এবং দৃষ্টিকোণকে অবমূল্যায়ন করে পরে যা প্রস্তাবিত হতে পারে। যতক্ষণ এ একমত না হয় কেবল ততক্ষণ পর্যন্ত অ্যাবসার্ডের অর্থ থাকে।

এক অনিবার্য সত্য রয়েছে যাকে মনে হয় আক্ষরিক অর্থে আদর্শ : যেমন একজন মানুষ সব সময় তার সত্যগুলোর কাছে এক শিকার। একবার সেগুলো যদি মেনে নেয়, তার থেকে সে নিজেকে আর মুক্ত করতে পারে না। একজনকে কিছু মূল্য দিতেই হয়। একজন মানুষ যে অ্যাবসার্ড সম্পর্কে সচেতন, সে চিরদিনের জন্য এর কাছে বাধ্য হয়ে ওঠে। আশাহীন ও সচেতন সত্তার মানুষ ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবে না। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ কেবল স্বাভাবিক যে, তার উচিত তার সৃষ্ট জগৎ থেকে পালানোর জন্য সংগ্রাম করা। সব রকম অগ্রগমনের গুরুত্ব রয়েছে কেবল এই কূটাভাসের কারণে। যুক্তিবাদের সমালোচক থেকে শুরু করে, নির্দিষ্ট মানুষেরা মেনে নেয় অ্যাবসার্ডের সেই অবস্থা। পথটির সমীক্ষা এই অবস্থায় কোনো কিছুই বেশি উপদেশাত্মক নয়, সেই পথটিতে তারা তাদের ফলাফল বিস্তারিত করেছে।

এখন, অস্তিত্ববাদী দর্শনে নিজেকে সীমিত রেখে দেখি ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই তাদের পালানোর উপদেশ দেয়। এক বাজে যুক্তির ভেতর দিয়ে, মুক্তির ধ্বংসের ওপর অ্যাবসার্ড থেকে বেরিয়ে; বন্ধ জগতের ভেতর মানবতায় সীমিত করে, এরা তাকে ঐশ্বরিক বলে মনে করে, চূর্ণবিচূর্ণ করে তাদের এবং দেখতে পায় আশার যুক্তি। তার ভেতর তাদের বোঝাপড়ার সাহায্যে উন্নত করে, মনোযোগ দাবি করে।

উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে কেবল বিশ্লেষণ করব কিছু থিম যা চেস্টভ ও কিয়ের্কেগার্দের কাছে প্রিয়। কিন্তু এক উপহাসের ঢঙে বা একটু বাড়িয়ে বলে, জেসপার আমাদের এই দৃষ্টিকোণের এক অদ্ভুত উদাহরণ সরবরাহ করেন। ফলে বাকিটুকু হয়ে ওঠে আরো স্পষ্ট। ক্ষমতাহীন অবস্থায় সর্বোৎকৃষ্টতাকে যাচাই করার জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, অভিজ্ঞতার যে গভীরতা তাকে প্রোথিত করতে অপারগ এবং ব্যর্থতার ফলে উলট-পালট হয়ে যায় জগৎ। সেই ব্যর্থতা থেকে সে কি এগিয়ে যাবে নাকি নিদেনপক্ষে সিদ্ধান্ত টানবে? তার কোনো নতুন অবদান নেই। অভিজ্ঞতার ভেতর কোনো কিছু সে দেখে না কিন্তু তার নিজের অক্ষমতার স্বীকারোক্তি দেখে এবং কোনো ক্ষেত্রেই কোনো সন্তোষজনক আদর্শ বা নীতির সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবু যুক্তি ছাড়াই যেমন সে নিজেকে বলে, হঠাৎ সে তখনি সব কিছুকে বর্ণনা করে সর্বোৎকৃষ্ট বলে, জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস ও জীবনের অতিমানবতার গুরুত্বকে যখন লেখে : ‘ব্যর্থতা কি প্রকাশ করে না, কোনো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের আড়ালে, অনুপস্থিতিতে নয় কিন্তু সর্বোৎকৃষ্টের অস্তিত্বে?’ সেই অস্তিত্ব যা হঠাৎ এবং মানব আত্মবিশ্বাসের অন্ধ প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করে, নিরূপণ করে সংজ্ঞা যেমন ‘সাধারণ ও বিশেষ অচিন্ত্যনীয় ঐক্য’। এভাবে অ্যাবসার্ড হয়ে ওঠে ঈশ্বর (এই শব্দ ব্যাপক অর্থে) এবং বোঝার যে অক্ষমতা তা হয়ে ওঠে অস্তিত্ব, সেই অস্তিত্ব ভ্রম সৃষ্টি করে। এই যুক্তি কোনোকিছু যৌক্তিকভাবে তৈরি হয় না। একে আমি বলতে পারি এক লাফ। আর কূটাভাসরূপে বুঝতে পারা যাবে জেসপারের দৃঢ়তাকে, তাঁর অসীম ধৈর্য যে সর্বোৎকৃষ্ট অসম্ভবের অভিজ্ঞতাকে বোঝার জন্য তিনি নিজেকে কীভাবে আন্তরিকভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। আরো দ্রুতগামিতার জন্য যা সম্ভাব্য তা হলো, আরো শূন্য যা হয়ে ওঠার বর্ণনা করার জগতে সে আন্তরিকভাবে অযৌক্তিকতার মাঝখানের শূন্যতায় সরাসরি সমানুপাত। এভাবেই উপস্থিত হয়, আর একে আরো তিক্তভাবে জেসপার চূর্ণবিচূর্ণ করে পূর্ব ধারণার যুক্তিকে, আরো সম্পূর্ণভাবে বদলে সে জগৎকে ব্যাখ্যা করে। নিপীড়নের ভাবনার প্রচারক নিপীড়নের শেষে দেখবে যে পুনরুত্থিত সত্তা এর বিশেষ গভীরতার দিকে।

রহস্যময় ভাবনা এরূপ পরিকল্পনাগুলো বা কৌশলগুলোর সুপরিচিত করে। কোনো মনের অভিপ্রায় যেমন আইনমাফিক সেগুলো তেমনই। ঠিক মুহূর্তের জন্য আন্তরিকরূপে কোনো সমস্যাকে যেমন আমি নিয়েছি সেরূপ অভিনয় করছি। পূর্ব বিচার ছাড়াই এক অভিপ্রায়ের সাধারণ মূল্য বা এর শিক্ষার শক্তি, আমি সহজভাবে বিবেচনা করার কথা বলছি যেখানে শর্তগুলোকে সাড়া দেয়, যা আমি নিজে স্থাপন করেছি, আর এ হলো সংগ্রামের মূল্য যা আমার সঙ্গে লিপ্ত। এভাবে আমি চেস্টভে ফিরে যাই। তাঁর মন্তব্য ধারাভাষ্যকার যোগসূত্র স্থাপন করে যা সমান করে আগ্রহকে : সে বলে, ‘কেবল সত্য সমাধানের কি প্রয়োজন? অসম্ভবকে পাওয়ার জন্য আমরা ঈশ্বরের দিকে ফিরি। সম্ভব সম্পর্কে মানুষেরা সমান হয়ে ওঠে।’ চেস্টভীয় দর্শন অনুসারে আমি বলতে পারি এভাবে এ একত্রে সারমর্ম করে। কারণ, আবেগিত বিশ্লেষণের উপসংহারে যখন চেস্টভ আবিষ্কার করেন সব অস্তিত্বের মৌলিক অ্যাবসার্ডতা, তিনি বলেন না : ‘এ অ্যাবসার্ড’, বরং ‘এ ঈশ্বর : আমরা অবশ্যই তার ওপর নির্ভর করব এমনকি যদি তিনি আমাদের যৌক্তিক রূপগুলোর সঙ্গে কোনো একটির সঙ্গেও যোগাযোগ না করেন।’ সুতরাং দ্বিধার কোনো সম্ভাবনা নেই, রুশ দার্শনিক এমন ইঙ্গিত দেন সম্ভবত এই ঈশ্বর সম্পূর্ণ ঘৃণ্য ক্রোধে ও ঘৃণায় পূর্ণ, ধারণার অতীত ও স্ব-বিরোধী; কিন্তু আরো ভয়ঙ্কর তার মুখ, আরো কথা বলে শক্তি সম্পর্কে। তার মহত্ত্ব হলো তার অসংলগ্নতা বা অবান্তরতা। তার প্রমাণ হলো তার অমানবিকতা। একজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং এই ঝাঁপ দিয়ে যৌক্তিক অধ্যায় থেকে একজন নিজেকে মুক্ত করে। এভাবে, চেস্টভের জন্য, অ্যাবসার্ডকে মেনে নেওয়াটা হলো অ্যাবসার্ডের নিজেরই সঙ্গে সমসাময়িকতা। সচেতন হয়ে একে গ্রহণ করেই এ পরিমিত করে এবং তার চিন্তার সমগ্র যৌক্তিক প্রয়াসকে ব্যক্ত করতে হয়। সুতরাং একই সময়ে ভয়ঙ্কর আশা যা এরই সঙ্গে যুক্ত তা সামনেই ফেটে পড়তে পারে। আমাকে পুনরায় বলতে দাও এই অভিপ্রায় হলো আইনসঙ্গত কিন্তু আমি একটি মাত্র সমস্যাকে বিবেচনা করে এবং এর সব ফলাফলকে নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক চিন্তার আবেগ অথবা এর বিশ্বস্ত এক কাজকে নিয়ে আমাকে পরীক্ষা করতে হয় না। সেটা করার জন্য আমার সমগ্র এক জীবন পড়ে আছে। আমি জানি যে, যুক্তিবাদীরা চেস্টভের দৃষ্টিভঙ্গিকে একটু অবজ্ঞা নিয়েই দেখে। কিন্তু অনুভবও করি যুক্তিবাদীদের অপেক্ষা চেস্টভ ঠিক এবং কেবল জানতে চাই যদি অ্যাবসার্ডের নির্দেশের প্রতি যদি সে বিশ্বস্ত থাকে।

এখন, এ যদি মেনে নিতে হয় অ্যাবসার্ড হলো আশার বিপরীত, দেখা যাবে চেস্টভের কারণে অস্তিত্ববাদী ভাবনা পূর্ব-ধারণা অনুযায়ী এ হলো অ্যাবসার্ড কিন্তু একে দূরীভূত করতে হলে একে কেবল প্রমাণ করতে হবে। এই এইরূপ চিন্তার সূক্ষ্মতা বা অস্পষ্টতা হলো ঐন্দ্রজালিক আবেগিত কৌশল। অন্যত্র যখন চেস্টভ বর্তমান আদর্শ ও যুক্তিতে বিরোধীদের ভেতরে অ্যাবসার্ড স্থাপন করেন, তিনি একে সত্য ও পুনঃপ্রাপ্তি বলেন। অতঃপর প্রাথমিকভাবে সেই ক্ষেত্রে অ্যাবসার্ডের সংজ্ঞায় এক অনুমোদন রয়েছে যা চেস্টভ মেনে নিয়েছেন। যদি এ মেনে নেওয়া হয় সেই ধারণার সব শক্তি পথের মাঝে থাকে, তা যদি থাকার জন্য অনুভূত হয়, প্রয়োজন নেই অ্যাবসার্ডের অনুমতি, তাহলে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যাবে প্রকৃত উদ্দেশ্য এ হারিয়েছে, প্রবেশ করে এর মানবিক ও আপেক্ষিক চরিত্র এক চিরন্তনতার দিকে, এই লক্ষ্যে উভয়ই উপলব্ধিজাত ও সন্তোষজনক। যদি অ্যাবসার্ড থেকে থাকে, তা হলো মানুষের বিশ্ব। মুহূর্তের ধারণাটি রূপান্তরিত হয় নিজেই এক চিরন্তন স্প্রিংবোর্ডে, মানবিক স্বচ্ছতার যোগসূত্রটি হতে এ বন্ধ করে দেয়। শিগগিরই অ্যাবসার্ডকে এবং সেই অবস্থায় এর মুখ্য চরিত্রের অদৃশ্য হওয়ার কারণ, সেই চরিত্র হয়ে ওঠে বিপরীত, ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন। এই লাফটি হলো পলায়ন। চেস্টভ যিনি হ্যামলেটের মন্তব্য উদ্ধৃতি দিতে ভালোবাসেন, ‘সময় সন্ধিস্থল হতে বাইরে’ এ যখন লেখেন হিংস্র আশার সঙ্গে যা মনে হয় বিশেষ ক্ষেত্রে এ তিনি নিজের ভেতরই পেয়েছেন। এই জ্ঞানে এই জন্য এ নয় যে, এ হ্যামলেট বলেন বা শেক্সপিয়র বলেন। অযৌক্তিকতার মাদকতায় ও ভাবাবেগের পেশা অ্যাবসার্ড থেকে স্বচ্ছ মনকে সরিয়ে দেয়। চেস্টভের যুক্তিকে অকেজো কিন্তু যুক্তির পেছনে কিছু রয়েছে। অ্যাবসার্ড মনের যুক্তি অকেজো এবং এই যুক্তির পেছনে কিছুই নেই।

কমপক্ষে এই ঝাঁপ আরো কিছুটা আলোকিত করতে পারে যেমন অ্যাবসার্ডের সত্য প্রকৃতির দিকে যা করে থাকে। আমরা জানি, ভারসাম্যের ভেতর ছাড়া এ অর্থহীন, সর্বোপরি এ রয়েছে তুলনার ভেতর এবং সেই তুলনা শর্ত হিসেবে নয়। কিন্তু এ এতই ঘটে যে, এই শর্তগুলোর একটির ওপর চেস্টভ জোর দেন এবং ভারসাম্যটি নষ্ট করেন। বোঝার জন্য আমাদের যে খিদে, সম্পূর্ণতার জন্য আমাদের নস্টালজিয়া যতদূর প্রকাশ করা যায়, স্পষ্টত আমরা যেমন বুঝতে পারি এবং ব্যাখ্যা করতে পারি অনেক কিছু। যুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার কোনো মানে নেই। এর নিয়মনীতি ফল দিতে সক্ষম। সঠিকভাবে এ হলো মানব অভিজ্ঞতা। আমরা যেখানে সবকিছুকে চেয়েছিলাম স্পষ্ট করতে। আমরা যদি এ রকম না পারি, সেই ক্ষেত্রে জন্ম নেয় অ্যাবসার্ড, সাক্ষাৎ-বিন্দুতে স্পষ্টত জন্ম নেয় সেই ফলাফল কিন্তু চিরন্তন পুনরুত্থানরত অবস্থার সঙ্গে যুক্তির কারণে তা সীমিত। এবার, যখন চেস্টভের উত্থান ঘটে এক হেগেলীয় প্রাক-অবস্থার বিরুদ্ধে যেমন ‘সৌর নিয়মের গতি অনুসারে পরিবর্তনীয় সূত্র এবং সেইসব সূত্র এর কারণ’, যখন স্পিনোজার বুদ্ধিবাদকে পাল্টাতে এর ভেতর তার সব প্রয়াস ও আবেগকে নিয়োজিত করেন, শেষ করেন প্রতিক্রিয়াতে, সব প্রকার গরিমার পক্ষেই থাকে। যখন স্বাভাবিক ও অবৈধ পশ্চাদগমনের সাহায্যে, অযৌক্তিক প্রাক-মহানতায়।[৬] বিশেষ করে ব্যতিক্রমের ধারণা প্রসঙ্গে এবং অ্যারিস্টটলের বিরুদ্ধে। কিন্তু অতিক্রমণ কখনো স্পষ্ট নয়। কারণ এখানে ধারণার সীমা বা স্তরের সীমার মাঝে হস্তক্ষেপ করতে পারে। প্রকৃতির সূত্রগুলো নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পরিচালিত হতে পারে, যা তাদের ধরা- ছোঁয়ার বাইরে তাতে তারা নিজেরাই অ্যাবসার্ড জন্ম দেওয়ার বিরুদ্ধে। অন্যথায় সত্য হয়ে ওঠে ব্যাখ্যার স্তরে, তা বর্ণনার স্তরে সেই কারণ ছাড়া নিজেদের ভেতর তারা যৌক্তিক হয়ে উঠতে পারে। সবকিছুই এখানে যৌক্তিকতার উৎসর্গিত, স্পষ্টতার দাবি দূরে চলে যায় ভোজবাজির মতো, এর তুলনায় শর্তগুলোর একটির সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায় অ্যাবসার্ড। অপরদিকে অ্যাবসার্ড মানুষ এরকম স্তরের পদ্ধতি গ্রহণ করে না। সংগ্রামকে সে চিনতে পারে, অবজ্ঞাও করে না সম্পূর্ণভাবে যুক্তিকে এবং মেনে নেয় অযৌক্তিককে। এভাবে আবার সে অভিজ্ঞতার সব তথ্য একটি পলকেই জড়িয়ে ধরে এবং জানার আগেই লাফাবার জন্য অল্প-স্বল্প ঝুঁকে পড়ে। সহজভাবে সে জানে যে, সেই সতর্কতার সচেতনতার আর কোনো আশার জায়গা নেই।

লিও চেস্টভের যা কিছু গ্রহণযোগ্য রয়েছে সম্ভবত তা রয়েছে আরো বেশি কিয়ের্কেগার্দের ভেতর। নিশ্চিত যে, প্রস্তাবগুলোর রূপরেখা স্পষ্ট করা কঠিন ফলে একজন কৌশলে এড়িয়ে বা পালিয়ে যায়। কিন্তু আপাতভাবে ঘৃণায় বিরোধিতা করে লেখাকে, ছদ্মনামের আড়ালে, কৌশল ও মৃদুভাবে অনুভূত হতে পারে সেই কাজের মধ্যে দিয়ে, বলতে গেলে সত্যের পূর্বাভাস (একই সময়ে যেমন আশঙ্কা) যা পরিণামস্বরূপ শেষ কর্মগুলোর ভেতরে ফেটে পড়ে; অনুরূপভাবে কিয়ের্কেগার্দ ঝাঁপটিকে গ্রহণ করে। তার কারণেও অ্যান্টিমোনি ও কূটাভাস হয়ে ওঠে ধর্মের বিচার বা নীতি। এভাবে এই জিনিসটি হতাশার অর্থের দিকে চালিত করে এবং এখন এই জীবনের গভীরতা দেয় এর সত্যতা ও স্পষ্টতা। খ্রিস্টানতা কলঙ্কজনক, কিয়ের্কেগার্দ ঠিক সরলভাবে দাবি করে তা হলো তৃতীয় উৎসর্গ, একে চায় ইগনেসিয়াস লোয়াল, ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি স্ফূর্তি করে : ‘বৌদ্ধিক উৎসর্গ’।[৭] এ ভাবা হতে পারে আমি এখানে মুখ্য সমস্যাকে অবজ্ঞা করছি, তা হলো বিশ্বাস…। কিন্তু কিয়ের্কেগার্দ বা চেস্টভ বা পরবর্তী হুসার্লের দর্শন আমি পরীক্ষা করছি না (এ দাবি করবে বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন অভিপ্রায়) : সহজভাবে তাদের থেকে আমি থিম ধার করছি ও পরীক্ষা করছি যেখানে এর ফলাফল খাপ খেয়ে যায়, ইতোমধ্যে যা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম আছে। এ কেবল জেদের ব্যাপার। ‘ঝাঁপটি’র এই প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত তবে বেশিক্ষণ আমাদের বিস্মিত করে না অন্য জগতের নীতিটি সে তৈরি করে অ্যাবসার্ড যেখানে সহজরূপে এ হলো এই জগতের অভিজ্ঞতার এক বাড়তি পাওয়া। কিয়ের্কেগার্দ বলেন, “তার ব্যর্থতায় বিশ্বাসকারী দেখে বিজয়।’

প্রচারে আলোড়িত যা আমাদের কাছে সেটা বিস্ময়ের নয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্ত করা হয়েছে। আমাকে কেবল বিস্মিত করে যদি অ্যাবসার্ডের প্রদর্শন এবং নিজের চরিত্র একে বিচার করে। এক্ষেত্রে আমি এমন নয়। আবার অ্যাবসার্ডের বিষয়কে বিবেচনা করে এই পদ্ধতিটিকে একজন বেশি ভালো বোঝে এবং এ কিয়ের্কেগার্দকে উৎসাহিত করেছে। জগতের অযৌক্তিকতা অ্যাবসার্ডের নস্টালজিয়া বেড়ে যাওয়ার মাঝে সে আর ভারসাম্যকে রক্ষা করে না। সে আর সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করে না যা সঠিকরূপে অ্যাবসার্ডতার অনুভবের কথাকে সংগঠিত করে। নিশ্চিত হয়ে যায় অযৌক্তিকতার থেকে বাঁচাতে অক্ষম, নিদেনপক্ষে দুঃসাহসিক নস্টালজিয়া থেকে নিজে বাঁচার জন্য রক্ষা করতে চায়, তার কাছে মনে হয় এর প্রয়োগ নিষ্ফল ও প্রয়োজনহীন। তবে যদি এইক্ষেত্রে তার বিচারে সে ঠিক হয়ে থাকে তাহলে তার বাতিলে সঠিক সে হতে পারে না। যদি বিদ্রোহে তার আর্তনাদ বদল করে এক চরম লিপ্ততা, তৎক্ষণাৎ অ্যাবসার্ডের দিকে নিজেকে অন্ধের মতো অগ্রসর করে, এই লিপ্ততা এখান থেকেই তাকে আলোকিত করে, অলৌকিক করে নিশ্চয়তা, অতঃপর যা সে অধিকৃত করে তা হলো অযৌক্তিকতা। গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সেরে উঠবে না, যেমন আবেব গ্যালিয়ানি ম্যাডাম ডি’ইপিনেকে বলেন, কিন্তু যন্ত্রণা নিয়ে বাস করে। কিয়ের্কেগার্দ আরোগ্য লাভ করতে চায়। আরোগ্য লাভ তার উন্মত্ত ইচ্ছে এবং এ তার সমগ্র জার্নালের ভেতর দিয়ে ছুটে চলে। তার বৌদ্ধিক সমগ্র প্রয়াসকে পালাতে হয় মানবিক অবস্থার অ্যান্টিনোমি থেকে। আরো এক দুঃসাহসিক প্রয়াস থেকে সে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে অহঙ্কারকে উপলব্ধি করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে, যেন ঈশ্বর বা ধর্ম থেকে তার ভয় নেই, সেসব তাকে শান্তিতে নিয়ে যেতে সক্ষম। এভাবে চাপের ভেতর দিয়ে সে দেয় অযৌক্তিক উপস্থিতি এবং অ্যাবসার্ডের ঈশ্বরের অবদান, অবিচার বিচ্ছিন্নতা এবং সাধ্যাতীত মানব চাহিদাগুলো নিচে নামিয়ে রাখে, যাতে বুদ্ধি শুধু সংগ্রাম করে এবং শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে। এখান থেকে কিছুই প্রমাণিত হয় না, তবে সবকিছু প্রমাণিত হতে পারে।

বস্তুত, কিয়ের্কগার্দ নিজেই আমাদের গ্রহণীয় পথ দেখায়। আমি এখানে কিন্তু বাতলাতে চাই না, কিন্তু একজন কীভাবে তার লেখাকে পড়াতে ব্যর্থ হয় যা প্রায় এক আত্মার ইচ্ছের অঙ্গচ্ছেদের সংকেত, সেই সংকেতগুলোর অঙ্গচ্ছেদের ভারসাম্য গ্রহণ করে অ্যাবসার্ডের উদ্দেশ্যে? এ হলো জার্নালের আগাগোড়া প্রতিধ্বনি। ‘আমার যা খামতি সেটা হলো পশু, এই পশু আবার মানব নিয়তিও বটে… আমাকে তাহলে একটা শরীর দাও।’ এবং আরো : ‘ওহ! বিশেষ করে আমার প্রথম যৌবনে মানুষ হয়ে আমাকে কী দেওয়া উচিত নয়, এমন কী ছ’মাসের জন্য… প্রাথমিকভাবে আমার যা খামতি তা হলো শরীর, অস্তিত্বের শারীরিক অবস্থা।’ অন্যত্র, একই মানুষ যেহেতু আশার মহান চিৎকার গ্রহণ করে, সেই আশা বহু শতাব্দীর ভেতর দিয়ে নেমে আসে, বহু হৃদয়কে পুনরায় শক্তিশালী করে তোলে, কেবল অ্যাবসার্ড মানুষটি ছাড়া।’ এর জন্য খ্রিস্টনীয় মৃত্যু সবকিছু শেষ নয় এবং আবাদের সঙ্গে জড়িয়ে সে জীবন তার চেয়েও যুক্ত রয়েছে অসীম জীবন, এমনকি যখন জীবন ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বাস্থ্য ও পৌরুষের সঙ্গে।’ কলঙ্কের ভেতর দিয়ে যে বন্ধুত্বতা এখনো বন্ধু হয়ে থাকে। এ একজনকে মেনে নেয়, সম্ভবত যেমন তাকে দেখতে পাওয়া যায়, অনুমতি দেয় আশাকে এর বিরোধিতাকে বের করতে যা হলো মৃত্যু। কিন্তু এমন যদি হয় সে সমবেদনা সেই অভিপ্রায়ের দিকে অনুরক্ত, তবু অবশ্য বলা হবে যে, কিছু বেশি ন্যায়বিচার হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে সেই অতিক্রমণ যা চলতে থাকে তুলাদণ্ডে, সুতরাং তা হয়ে উঠবে অতিমানব। কিন্তু এই ‘সুতরাং’ হলো অপর্যাপ্ত। এখানে কোনো যৌক্তিক নিশ্চয়তা নেই। কোনো নিরীক্ষামূলক সম্ভাব্যতা নেই। সত্য হলো, আমি যা বলতে পারি তা হলো আমার মানকাঠিকে অতিক্রমণ করে। যদি এর থেকে আমি কোনো বাতিলকে না টানি, নিদেনপক্ষে অসাধ্যের ওপরে আমি কোনো কিছুই দেখতে চাই না। আমি জানতে চাই, যেখানে আমি থাকতে পারি যেখানটা আমি জানি এবং একা। আমাকে আবার বলা হয়েছে এখানে বুদ্ধিকে অবশ্যই এর অহংকারে বলি দিতে হবে এবং যুক্তিকে আনতে হবে। আমি যদি যুক্তির সীমানাগুলো চিনি তাহলে একে আমি বাতিল করি না, এর আপেক্ষিক শক্তিগুলো চিনে আমি কেবল এই মাঝপথে থাকতে চাই; যেখানে বুদ্ধি পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে। যদি এ অহঙ্কারে, একে পরিত্যাগ করার যথেষ্ট যুক্তি আমি দেখি না। উদাহরণস্বরূপ কিয়ের্কেগার্দের দৃষ্টিকোণ অপেক্ষা কোনো কিছু বেশি গভীর নয়, সেই অনুসারে সেই হতাশা সত্যও নয় কিন্তু এ এক অবস্থা : পাপের বিশেষ অবস্থা। পাপের কারণে ঈশ্বরের থেকে এলিয়েনেশন হয়ে যায়। অ্যাবসার্ড সচেতন মানুষের আধ্যাত্মিক অবস্থা, অ্যাবসার্ড ঈশ্বরের দিকে চালিত হয় না। সম্ভবত এই ধারণা অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠবে যদি আমি দুঃখদায়ক মন্তব্যে ঝুঁকি নিই; ঈশ্বর ছাড়া অ্যাবসার্ড হলো পাপ।

অ্যাবসার্ডের সেই অবস্থায় বেঁচে থাকাটা। এ কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা আমি জানি, একজন আরেকজনকে আলিঙ্গন করার সামর্থ্য ব্যতীত এই মন ও এই জগৎ প্রত্যেক প্রত্যেকের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করে। সেই অবস্থার জীবনের নিয়মকে খোঁজ করি এবং যা এর ভিত্তিকে অবজ্ঞা করে সেটা আমাকে পছন্দ করতে বলা হয়, বেদনাদায়ক বিরোধিতার শর্তগুলোর একটিকে বাতিল করে, দাবি করে পদত্যাগ। আমি যা নিজের মতো করে চিনি সেই অবস্থায় যা জড়িত তাকে আমি চাই। আমি জানি, জটিলতা ও অজ্ঞতার সঙ্গে এ জড়িত, আমি আস্থাশীল যে, এই অজ্ঞতা সবকিছুকে ব্যাখ্যা করে এবং সেই অন্ধকারত্বই হলো আমার আলো। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষার এখানে কোনো উত্তর নেই এবং এই সক্রিয়তার লিরিকবাদ আমার থেকে এই কূটাভাস কিছু লুকোতে পারবে না। সুতরাং অবশ্যই একজন দূরে চলে যায়। সতর্ক তাতে চিৎকার করতে পারে কিয়ের্কেগার্দ : ‘মানুষের যদি চিরন্তন সচেতনতা না থাকে, সব কিছুর নিচে শুধু বন্যতা, সিদ্ধ শক্তি উৎপাদন করে সবকিছু, উভয়ই বৃহৎ ও তুচ্ছ, অন্ধ আবেগের ঝড়েতে, যদি তলহীন শূন্য যা কোনো কিছু পূর্ণ করতে পারে না, সব জিনিসই ঠেকনা হিসেবে রয়েছে, তাহলে জীবন হতাশা ছাড়া কি হবে? এই চিৎকার অ্যাবসার্ড মানুষকে থামাবার সম্ভাবনা নেই। যা সত্য তার অন্বেষণ কিন্তু যা কাম্য তার অন্বেষণ নয়। যদি পালাবার উদ্দেশ্যে দুশ্চিন্তাপূর্ণ প্রশ্ন : “জীবন কী হবে?’ গাধীর মতো একজন অবশ্য ভ্রমের গোলাপ খেয়ে পেট ভরায়, তারপর অ্যাবসার্ড মন মিথ্যেতে নিজে ছেড়ে যাওয়া অপেক্ষা নির্ভীকরূপে কিয়ের্কেগার্দের উত্তরকে গ্রহণ করতে পছন্দ করে : ‘হতাশা’। সবকিছুই বিবেচনা করে, মনস্থ আত্মা সব সময় গুছিয়ে নেয়।

অস্তিত্ববাদ অভিপ্রায়কে দার্শনিক আত্মহত্যা বলাটাকে আমি স্বাধীনতা নিচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গে বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই। এ হলো আন্দোলনের সংকেতের একটা সুবিধেজনক পথ, এই পথ দিয়েই ভাবনা নিজেই বাতিল করে একে, আর এই বিশেষ বাতিলতার ভেতর দিয়ে নিজেই অতিক্রমণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অস্তিত্বগুলোর কারণ বাতিল হলো তাঁদেরই ঈশ্বর। যথাযথরূপে মানব যুক্তি[৮] বাতিলের মধ্য দিয়ে কেবল ঈশ্বরকে রক্ষা করে। কিন্তু আত্মহত্যার মতো, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরেরা বদলায়। বহু রকমের ঝাঁপ দেবার পথ রয়েছে, মুখ্য সত্তার ঝাঁপ। ঐসব বাতিল ঐসব স্ববিরোধিতা যা বাঁধাকে অস্বীকার করে, সেই বাঁধাকে এখনো অতিক্রম করে, এক নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রেরণা থেকে লাফাতে পারে (এ কূটাভাস যাতে এই যুক্তির অবতারণা লক্ষ্য করে) যেমন পারে যৌক্তিক শৃঙ্খলা থেকে। সব সময় তারা দাবি করে চিরন্তনতাকে এবং সম্পূর্ণরূপে এরই ভেতর থাকে, তার থেকে ওরা ঝাঁপটিকে গ্রহণ করে।

অবশ্যই এ আবার হবে, এই প্রবন্ধে যুক্তির উন্নতি ঘটে, আমাদের জ্ঞানদীপ্ত যুগের সবচেয়ে বেশি প্রসারিত আত্মিক মনোভাব একত্রে ত্যাগ করে; নীতির ওপর ভিত্তি করে এ হয়ে ওঠে যুক্তি, যার উদ্দেশ্য হলো জগৎকে ব্যাখ্যা করা। প্রত্যয়নকে গ্রহণ করার পর জগতের একটা স্বচ্ছ ধারণা দেওয়াটাই এর পক্ষে স্বাভাবিক। এ অবশ্যই স্বচ্ছ হবে। এমনকি এ আইনসঙ্গত কিন্তু এখানে আমরা অনুসরণ করছি সেই সম্পর্ককে যা এ যুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সত্য এই, যখন জগতের দর্শনের অর্থের খামতি থেকে শুরু করে, এর ভেতর এক অর্থ ও গভীরতা দেখে শেষ করে মন সেইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার ওপর আলোকপাত করাই আমাদের লক্ষ্য, সেইসব পদক্ষেপের সবচেয়ে স্পর্শীয় রূপের যার অর্থ হলো ধর্মীয় রূপ, এ অবশ্যই হয়ে ওঠে অযৌক্তিক থিমে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কূটাভাসতায় এবং গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই একটি রূপ যা জগতে যৌক্তিক কারণ হিসেবে আরোপ করে, যেমন কোনোরূপ নীতির ধারণা বেড়ে মৌলিকরূপে এ কল্পনা করে। নস্টালজিয়ার প্রেরণার নতুন সাফল্যের কোনো ধারণা না দিয়ে যা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সেই সব ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ফলাফল বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অসম্ভব।

আমি কেবল পরীক্ষা করব। ইচ্ছেটির থিমটিকে, যা হুসার্ল ও রূপতত্ত্ববিদগণ ফ্যাশনরূপে তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে পরোক্ষভাবে আমি তা উল্লেখ করেছি। বাতিল করেছে মূলত যুক্তির ধ্রুপদীয় প্রক্রিয়াকে হুসার্লের পদ্ধতি। আমাকে বলতে দেওয়া হোক আবার। এক মহান বা আদর্শ আভাসের ভেতর পরিচিত উপস্থিতি চিন্তাভাবনায় একত্রিত (গঠিত) হয় না। ভাবনা কীভাবে আবার সামগ্রিকরূপে তা শেখায়, পরিচালিত করে একজনের চেতনাকে, তৈরি করে প্রত্যেক রূপকে একটি সুবিধেজনক জায়গায়। অন্যভাবে, রূপতত্ত্ব জগৎকে ব্যাখ্যা করতে অস্বীকার করে, হতে চায় কেবল এক প্রকৃত অভিজ্ঞতার বিবরণ। এর প্রাথমিক প্রমাণের ভেতর সুনিশ্চিত করে অ্যাবসার্ড ভাবনা, এর ভেতর কোনো সত্য নেই, অথচ এ শুধুই সত্য। আমার কাঁধের ওপর সন্ধের বাতাস থেকে এই হাতের মাঝে, সত্য রয়েছে সবকিছুতে। এর দিকে মনোনিবেশ করে চেতনা ভ্রম তৈরি করে। এর বোঝাপড়ার উদ্দেশ্য হতে চেতনা গঠিত হয় না, কেবল আলোকপাত করে, এ হলো মনোযোগের লক্ষ্য ও কাজ এবং ‘বার্গসোঁ’র ধারণা থেকে ধার করা, এ সমান ভাবে পরিকল্পনাকারী বা আলোকপাতকারীকে দেখে যা হঠাৎই এক মূর্তির ওপর আলোকপাত করে। পার্থক্যটা হলো এই যে, কোনো চিত্রাবলি বা দৃশ্যাবলি থাকে না কিন্তু থাকে পরম্পরা ও অসংলগ্ন উদাহরণ। সুযোগ পায় সেই ম্যাজিক লণ্ঠনের ভেতর সব ছবিই। এর মনোযোগের লক্ষ্যের ভেতর সচেতনতা সাময়িক স্থগিত রাখে অভিজ্ঞতাকে। বিস্ময়করতার মধ্য দিয়ে এ তাদের বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ করে তোলে। এরপর চলে যায় সব বিচারের বাইরে। এটাই হলো ‘ইচ্ছে’ যা চরিত্রায়ন করে চেতনা। তবে শব্দ কোনো চূড়ান্ত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, নেওয়া হয় এর ‘নির্দেশিত’ জ্ঞানের ভেতর : এর কেবল অভিহিত মূল্য (face value) হলো সংস্থানিক (topographical)।

প্রথম দর্শনে, এ নিশ্চয়ই মনে হয় এভাবে কোনো কিছুই অ্যাবসার্ড প্রেরণার সঙ্গে বিরোধিতা করে না। ভাবনার সেই আপাত বিনয় যা সীমিত করে রাখে নিজেরই বিবরণ, এড়িয়ে যায় ব্যাখ্যা, সেই ঐচ্ছিক শৃঙ্খলা যখন কূটভাসতায় ফলাফল বা পরিণাম এক গভীর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে থাকে এবং তারই ক্লান্তির জগতের পুনর্জন্ম, এ অ্যাবসার্ড অগ্রগতির রীতিই বলা যায়। নিদেনপক্ষে প্রথম দর্শন। ভাবনার পদ্ধতিগুলোর জন্য, অন্যত্র যেমন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত, ধরা হয় সব সময় দুটো দৃষ্টিভঙ্গিকে, একটি হলো মনস্তত্ত্ব এবং অন্যটি পরাতাত্ত্বিক।[৯] (এমনকি সবচেয়ে বেশি কঠিন জ্ঞানতত্ত্বগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এবং এতটাই এর স্তর যে, বহু সমসাময়িক চিন্তাবিদের অধিবিদ্যায় জ্ঞানতত্ত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়।) সেখানে তারা দুটো সত্যের আশ্রয় নেয়। যদি ইচ্ছের থিম কেবল এক মনঃস্তাত্ত্বিক অভিপ্রায় দাবি করে, যার দ্বারা ব্যাখ্যা হওয়ার পরিবর্তে বাস্তবতা নিষ্কাশিত হয়, প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছু অ্যাবসার্ড প্রেরণার থেকে আলাদা করে না। যা একে অতিক্রমণ করতে পারে না তাকেই বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। এ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করে যে, কোনো ঐক্যবদ্ধ নীতিসূচক ভাবনা ছাড়াই প্রত্যেক অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণকে বর্ণনা করে এবং বুঝে আনন্দকে গ্রহণ করতে পারে। সেই সব দৃষ্টিকোণের প্রত্যেকটির অভিপ্রায়ের জন্য তখন সত্য জড়িত থাকে, প্রকৃতিতে সেটাই হলো মনস্তাত্ত্বিক। এ ‘ঔৎসুক্য’র দিকে সহজভাবেই পরীক্ষা করা হয় যা বাস্তব সাধতে পারে। এ ঘুমন্ত জগৎ থেকে জাগরণের একটি উপায় এবং মনের অন্তর্মুখের দিকে গঠন করে এক স্পষ্টরূপ। কিন্তু কেউ যদি বাড়াবাড়ির জন্য সচেষ্ট হয় এবং সেই সত্যের দিকে এক যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করে, যদি একজন এভাবে জ্ঞানের প্রতিটি বস্তুর ‘সারধর্ম’ (essence) আবিষ্কার করার দাবি করে, অভিজ্ঞতার প্রতি এর গভীরতা পুনঃসঞ্চয় করে। অ্যাবসার্ড মনের জন্য তা হলো ধারণার বাইরে। বিনয় ও আশ্বাসের মাঝে এখন এই দোলা হলো যা ঐচ্ছিক অভিপ্রায়ের ভেতর দৃশ্যমান এবং রূপতত্ত্বীয় ভাবনার এই দীপ্তি অন্য কিছু অপেক্ষা অনেক বেশি ভালো আঁকবে অ্যাবসার্ড যুক্তিতর্ক।

কারণ হুসার্ল ‘অতিরিক্ত সাময়িক সারধর্ম’-এর অনুরূপ ইচ্ছে আলোতে নিয়ে আসে এবং প্ল্যাটোর মতো ধ্বনি হয়। একটা জিনিস দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা হয় না কিন্তু হয় সব জিনিস দিয়ে। আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। ঐসব ধারণা বা ঐসব সারধর্ম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সব বর্ণনার শেষে চেতনা ‘সম্পাদন করে’ তবুও সঠিক মডেল হিসেবে সেইসব বিবেচিত হয় না। কিন্তু বলা হয় যে, তারা সরাসরি রূপে প্রতিটি প্রত্যক্ষণের উপাত্ততে উপস্থিত হয়। শিগগিরই একটি মাত্র ধারণা সব কিছুকে ব্যাখ্যা করে কিন্তু সারধর্মের এক অনির্দিষ্ট সংখ্যা বস্তুর এক অনির্দিষ্ট সংখ্যার অর্থ করে দেয়। জগৎ এক থামবার জায়গায় আসে আবার তেমন আলোকিত করে। হয়ে দাঁড়ায় প্ল্যাটোনিক বাস্তবতার স্বজ্ঞা কিন্তু তখনো এ বাস্তবতা। তাঁর ঈশ্বরের ভেতর কিয়ের্কেগার্দকে গেলানো হয়; একজন ঈশ্বরের মাঝে ভাবনাকে পারমেনিডেস ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এখানে এক বিমূর্ত বহু ঈশ্বরবাদের ভেতরে ভাবনা নিজেই সজোরে নিক্ষেপ করে। কিন্তু এটাই সব নয় : দুঃস্বপ্ন (অমূল প্রত্যক্ষণ) ও কল্পকাহিনী সমভাবেই ‘অতিরিক্ত সাময়িক সারধর্ম’-এর অধিকারী। ধারণার নতুন জগতে, অশ্বমানুষের (centaur) প্রজাতির সঙ্গে আরো বেশি বিনয়ী নাগরিক মনের (Metropolitan) মানুষের প্রজাতি সহযোগীরূপে কাজ করে।

অ্যাবসার্ড মানুষের জন্য সেই শুদ্ধরূপে মনস্তাত্ত্বিক অভিমতে রয়েছে সত্য ও তিক্ততা তাতে জগতের সব দৃষ্টিকোণে সুযোগ সুবিধে পেয়ে থাকে। বলতে গেলে সবকিছুকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাকে বলা যায় সমপরিমাণ যা সবকিছুই সমান। কিন্তু সেই সত্যের আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ এতই দূর-ছোঁয়া যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সম্ভবত সে প্লুটোকে আরো বেশি কাছে অনুভব করে। বস্তুত, তাকে শেখানো হয় প্রতিটি মূর্তিই পূর্ব ধারণায় যা সমানভাবে সুবিধেপ্রাপ্ত সারধর্ম। যাজকহীন এই আদর্শজগতে, নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর সেনাপতিদের দ্বারা সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতি রয়েছে। নিশ্চিত হয়ে, অতিক্রমণীয়তাকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ভাবনার এক হঠাৎ পরিবর্তন ফিরিয়ে আনে জগতে যাতে রয়েছে এক ধরনের আংশিক অন্তনির্হিত রূপ, যা বিশ্বে পুনঃসঞ্চিত হয় এর গভীরতা।

সৃষ্টিকর্তা বৃহত্তর সতর্কতা দিয়ে একটা থিমকে চালনা করে ফলে আমাকে বহন করে নিয়ে যায়, এজন্য আমাকে ভীত হতে হবে? আমি শুধু হুসার্লের সেই বিবৃতিগুলো পড়ি, আপাতভাবে কূটভাসতায় তবু ভয়ঙ্কররূপে যৌক্তিক যদি তা পূর্ববর্তী হয়ে থাকে তাকে গ্রহণ করা হয় : ‘যা সত্য তা হলো সম্পূর্ণরূপে সত্য, তার নিজেরই ভেতর, সত্য এক, নিজেই পরিচিত, যাই হোক নানা ধরনের প্রাণী যারা উপলব্ধি করে জড় পদার্থ মানুষ, দৈত্য, দেবদূত বা দেবতা।’ যুক্তির জয় এবং সেই কণ্ঠস্বরের বিজয়, আমি অস্বীকার করতে পারি না। অ্যাবসার্ড জগতে এর বিবৃতিগুলোর কি অর্থ করা যেতে পারে? দেবদূত বা দেবতার প্রত্যক্ষণ আমার কাছে এর কোনো অর্থ নেই। সেই জ্যামিতিক স্থান যেখানে দিব্যি যুক্তি আমাকে সমর্থন করে তা আমার কাছে সব সময় হয়ে উঠবে অসাধ্য, ধারণার বাইরে। সেখানেও আমি উপলব্ধি করি ঝাঁপকে, যদিও বিমূর্তর ভেতর সম্পাদন করেছিল, তৎসত্ত্বেও এ আমার কাছে অর্থ করে আমি ভুলে গেছি যা আমি ভুলতে চাই না। যখন আরো বেশি বিস্ময় প্রকাশ করে হুসার্ল : ‘যদি আকর্ষণ করার সব জনগণের বিষয় অদৃশ্য হয়ে যায়, আকর্ষণের সূত্র ধ্বংস হবে না কিন্তু কোনোরূপ সম্ভাব্য আবেদন ছাড়া সহজভাবে থাকবে’, আমি জানি সান্ত্বনার পরাতত্ত্বটির সঙ্গে আমাকে মুখোমুখি হতে হবে। আর যদি আবিষ্কার করতে চাই বিন্দুটিকে যেখানে ভাবনা প্রামাণ্যের পথটিকে ছেড়ে দেয়। আমাকে কেবল সমান্তরাল যুক্তিটিকে পুনর্পাঠ করতে হয় যা মন সম্পর্কে হুসার্ল বলে থাকেন : ‘আমরা যদি পরিষ্কারভাবে অবলোকন করতে পারি সঠিক শারীরিক প্রক্রিয়ার নিয়মগুলো, চিরন্তন ও অভেদ্য স্বরূপ হয়ে সমানভাবে তাদের দেখানো হবে তাত্ত্বিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্রগুলো। অতঃপর সেগুলো হয়ে উঠবে সিদ্ধ এমনকি যদি সেখানে কোনো শারীরিক প্রক্রিয়া নাও থাকে।’ এমনকি মন যদি নাও হয়, তাহলেও হয়ে উঠবে এর সূত্রগুলো। আমি তখন দেখি সেই মনস্তাত্ত্বিক সত্য যৌক্তিক নিয়ম তৈরি করে তোলাটা হুসার্লের লক্ষ্য; মানবযুক্তির ঐক্য শক্তিকে অস্বীকার করার পর এই বাঁধা দূর করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিরন্তন যুক্তির দিকে।

হুসার্লের ‘স্বচ্ছ বিশ্ব’-এর থিমটি আমাকে অবাক করতে পারে না। আমাকে যদি বলা হয় যে সব সারধর্ম স্বাভাবিক নয় তবে তাতে রয়েছে কিছুটা বস্তুনিষ্ঠ, তাতে প্রথমটি হলো যৌক্তিক উদ্দেশ্য এবং দ্বিতীয়টি হলো বিজ্ঞান, এ শুধু এক সংজ্ঞার ই প্রশ্ন। আমাকে বলা হয়েছে, বিমূর্ততা নির্দেশ করে তবে পরম্পরা ব্যতীত একটা অংশ, এক স্বচ্ছ বিশ্বের। কিন্তু ইতিমধ্যেই আন্দোলন যা উল্লেখ করা হয়েছে, এই শর্তগুলোয় দ্বিধায় আলো জ্বালাবার অনুমতি প্রদান করে। কারণ তা অর্থ করতে পারে আমার আকাঙ্ক্ষার স্বচ্ছ উদ্দেশ্য, এই আকাশ, এই কোটের ওপর সেই জলের প্রতিফলন একা প্রকৃতি সম্মানকে সংরক্ষণ করে যা আমার উৎসাহকে জগতে বিচ্ছিন্ন একাকী করে তোলে এবং একে আমি অস্বীকার করব না। এর মানে এও হতে পারে—এই কোটটি নিজেই চিরন্তন, এর রয়েছে বিশেষ এবং যথেষ্ট সারধর্ম, গঠনের আকৃতির জগতের স্বত্বাধিকারী। তারপর আমি বুঝি শুধু মিছিলের শৃঙ্খলা পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চতর বিশ্বে জগৎ তার প্রতিফলন বন্ধ করেছে কিন্তু স্বর্গের গঠনগুলো মূর্তির অবয়বিত। এই পরিবর্তনগুলো আমার কাছে কিছুই নয়। বরং দ্বন্দ্বে এক স্বচ্ছতার পরখ, মানব শর্তের তাৎপর্য, যথেষ্টরূপে আমি দেখি, নাছোড়বান্দা এক বৌদ্ধিকবাদ যা নিজেই স্বচ্ছতায় সাধারণীকরণ করে।

আপাত কূটাভাস দিয়ে বিমোহিত করতে ব্যর্থ, সেই ব্যর্থতা পীড়নের মুক্তি ও বিজয়ের যুক্তির বিপরীত পথ দিয়ে এর নিজের অস্বীকারের দিকে ভাবনাকে চালনা করে। হুসার্লের বিমূর্ত ঈশ্বর থেকে কিয়ের্কেগার্দের তীব্র ধাঁধানো ঈশ্বরের দূরত্ব বেশি নেই। যুক্তি ও অযৌক্তিকতা অগ্রসর হয় একই আলোচনার দিকে। সত্যের ভেতর বাস্তবায়িত হয় দিশা তবে তা সামান্য; হাজির হয় ইচ্ছেটি যথোপযুক্ত রূপে। বিমূর্ত দার্শনিক ও ধর্মীয় দার্শনিক এক বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে এবং একই দুর্ভাবনায় পরস্পরকে সমর্থন করে। তবে ব্যাখ্যা করতে হয় প্রয়োজনীয়তাকে। এখানে জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী নস্টালজিয়া। এ গুরুত্বপূর্ণ কারণ নতুন যুগের শুরুর ভাবনা তখনি হয়ে ওঠে জগতের অগুরুত্বপূর্ণ দর্শনের সঙ্গে গভীররূপে অনুপ্রাণিতের একটি এবং এর সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অত্যন্ত বিভাজিত একটি। বাস্তবের চূড়ান্ত যৌক্তিকতার মাঝে অনবরত দুলতে থাকে যা তার ওপর মুক্ত হয়, উপযুক্ত যুক্তিগুলোর ভেতর ভাবনা এবং এর চরম অযৌক্তিকতায় যা একে দৈবিক বলে লালন করে। তবে এ বিচ্ছেদ কেবল সাময়িক। এ হলো এক বন্ধুত্বের ব্যাপার এবং উভয়ক্ষেত্রে ঝাঁপটি যোগ্যতা অর্জন করে। সব সময় ভুলভাবে ভাবা হয় যে, যুক্তির ধারণাটা একমুখী। সত্যি বলতে কি যতই ভয়ঙ্কর হোক, হতেই পারে এ আকাঙ্ক্ষা, এই প্রত্যয় সত্ত্বেও অন্যদের মতো অস্থায়ী। যুক্তি সম্পূর্ণ বহন করে মানব দৃষ্টিকোণ থেকে, দেবত্বের দিকেও ঘুরে যেতে পারে। প্লাটিনাস যাকে চিরন্তন জলবায়ুর সঙ্গে প্রথম সখ্যতা করতে হয়, এর সেইসব নীতি অতি যত্নে লালনের থেকে দূরে সরে যাওয়া শিখেছে, যার রয়েছে বিরোধিতা, পরম্পরায় সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ময়তাকে একত্রিত করে, এরই ভেতর অংশগ্রহণের একটি হলো পূর্ণাঙ্গ জাদু।[১০] এ হলো এক চিন্তার যন্ত্র, তবে এর নিজেরই চিন্তা নয়। সর্বোপরি, মানুষের চিন্তা হলো তার নিজেরই নস্টালজিয়া।

শুধু যেমন যুক্তিকে প্লাটিনাসের বিষাদ হিসেবেই প্রবোধ দিতে সমর্থ হয়, সমর্থ হয় আধুনিক ক্ষোভকে নিজেই চিরন্তন পরিচিত স্থাপনার ভেতর শান্ত করে তোলায় উপায় অন্বেষণ করতে। অ্যাবসার্ড মনের রয়েছে ভাগ্যের অভাব। এ কারণে জগৎ এত যৌক্তিকও নয়, আবার এত অযৌক্তিক নয়। এ কেবল অযৌক্তিক হয়ে ওঠে, কেবল তাই। পরিণামস্বরূপ হুসার্লের সঙ্গে যুক্তির আদৌ কোনো সীমা নেই। এর ক্ষোভকে শান্ত করতে অক্ষম তার থেকে অপরদিকে অ্যাবসার্ড নিজেই এর সীমাবদ্ধতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনভাবে কিয়ের্কেগার্দ বলেন, সেই ক্ষোভকে নাকচ করতে একটি সীমাই যথেষ্ট। তবে অ্যাবসার্ড ততদূর যায় না। এই কারণে সীমাকে সম্পূর্ণভাবে যুক্তির আকাঙ্ক্ষার দিকে পরিচালিত করা হয়। যেমন অস্তিত্ববাদীরা অযৌক্তিক থিমকে গ্রহণ করে, সেই থিম হয়ে ওঠে যুক্তি। নিজেরই নাকচে তা হয়ে ওঠে দ্বিধাগ্রস্ত ও পলায়নমুখী। সীমাকে উল্লেখ করে অ্যাবসার্ড হয় স্বচ্ছ যুক্তি।

কেবল এই কঠিন পথটির শেষে অ্যাবসার্ড মানুষ তার সত্যকে চেনে। তার অভ্যন্তরীণ জরুরি ব্যাপার তুলনার ভিত্তিতে এবং তারপর যা তাকে পছন্দ করার সুযোগ দেয়, হঠাৎই অনুভব করে সে অস্বীকার করতে চলেছে। হুসার্লের বিশ্বে জগৎ পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে, ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের হৃদয়ে নোঙর করে সেসব হয়ে যায় অর্থহীন। যদি এ সন্তুষ্ট হতে চায় তবে কিয়ের্কেগার্দের রহস্য উন্মোচেনের ভেতর অবশ্য ছেড়ে দিতে হবে তার আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতার জন্য। পাপকে এতটা জানা হয় না (যদি চায়, সবাই অজ্ঞ হয়ে থাকে) যতটা জানতে চায়। বস্তুত, এ শুধু পাপ যাতে অ্যাবসার্ড মানুষ অনুভব করতে পারে যে এ গঠিত হয় তার অপরাধ ও সরলতা উভয় নিয়েই। তাকে এক সমাধান পছন্দ করতে বলা হয় যাতে সব বিরোধিতা কেবল বিতর্কিত খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। তবে তাদের সাহায্যে সে যেমন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে সেটা কোনো পথ নয়। তাদের সত্য অবশ্যই রক্ষিত হবে, এ যা দিয়ে গঠিত তাতে সন্তুষ্ট নয়। সে প্রচার করতে চায় না।

আমার যুক্তি প্রামাণ্য তথ্যাদির ওপর বিশ্বস্ত থাকতে চায় যা একে সক্রিয় করে রাখে। সেই তথ্যাদি হলো অ্যাবসার্ড। এ হলো সেই বিচ্ছেদ যা মন কামনা করে এবং জগৎ যা হতাশ হয় তারই মাঝখানে, ঐক্যের জন্য আমরা নস্টালজিয়া, এই টুকরো করা বিশ্বেও বিরোধিতা যা তাদের একত্রে বাঁধে। আমার নস্টালজিয়াকে দাবিয়ে রাখে কিয়ের্কেগার্দ এবং সেই বিশ্বকে একত্রে সংগ্রহ করে হুসার্ল। যা আমি আশা করেছিলাম এটা তা নয়। ঐ সব স্থানচ্যুতির সঙ্গে বেঁচে থাকা এবং ভাবার ব্যাপার, এ জেনে একজনকে হয় তা গ্রহণ করতে বা অস্বীকার করতে হয়েছিল। প্রামাণ্যে কোনো মুখোশ পরার প্রশ্ন থাকতে পারে না, সমাধানের শর্তগুলো দিয়ে অস্বীকার করে একজনের অ্যাবসার্ডকে চাপা দেওয়ার থাকতে পারে না। জানাটা প্রয়োজন যেখানে একজন এর সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারে বা যেখানে অপরদিকে যুক্তি আদেশ করে একজনকে এর ভেতর মরতে পারে। আমি দার্শনিক আত্মহত্যাতে উৎসাহী নই বরং সাধারণ আত্মহত্যাতে কৌতূহলী। আমি কেবল এর আবেগিত বিষয়, এর যুক্তি ও এর ঐক্য জেনে বিশোধিত করতে পছন্দ করি। অ্যাবসার্ড মনের বর্জন ও মনের পশ্চাদপসরণের আগে মন নিজেই প্রকাশ্যে এনেছে তার সঙ্গে অন্য অবস্থা সংযুক্ত। ‘জীবনযাপনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অভ্যেসের এবং অস্তিত্বের সুনির্দিষ্ট সুপরিচিত ও সুবিধেজনক শর্তগুলোর ভাবনাকে’ পলায়নের কামনা হিসেবে মেনে নিতে দাবি করেন হুসার্ল, কিন্তু চূড়ান্ত ঝাঁপটি নিজেরই ভেতর সঞ্চিত হয় চিরন্তন ও এর সুবিধেজনক স্থিতিতে। ঝাঁপটি যেমন কিয়ের্কেগার্দ পছন্দ করে থাকে সেইরূপ চরম বিপদরূপে উপস্থাপিত করে না। অপরদিকে, বিপদটি সূক্ষ্ম তাৎক্ষণিকের ভেতর থাকে যা ঝাঁপটির দিকে এগোয়। সেই হতবুদ্ধির শীর্ষে থাকতে সমর্থ হয়—তা হলো ঐক্য এবং বাকিটা হলো এড়ানোর কৌশল। আমিও জানি যে, কিয়ের্কেগার্দের ক্ষেত্রে যেমন এক্ষেত্রে কখনো অসহায়ত্ব সেভাবে এরূপ আকর্ষণীয় ঐক্যকে উৎসাহিত করে না। কিন্তু যদি অসহায়ত্বের ইতিহাসের উদাসীন ভূদৃশ্যাবলি থাকে, তবে এর যুক্তিতে কিছু নেই, এই যুক্তির জরুরি প্রয়োজনগুলো এখন জানা গেছে।

অ্যাবসার্ড স্বাধীনতা

এখন প্রধান জিনিসটি করা হলো, যা থেকে আলাদা করতে পারি না তার থেকেই সেইসব নির্দিষ্ট তথ্য ধরে রাখি। যা আমি জানি যা নির্দিষ্ট, যা আমি অস্বীকার করতে পারি না, যা আমি বাতিল করতে পারি না, এসবই হিসেব করে। যার ভেতরে বেঁচে রয়েছে মিথ্যে নস্টালজিয়া, ঐক্যের তাগিদে এই কামনা, সমাধানের জন্য অপেক্ষা, স্পষ্টতা ও অবসানের প্রয়োজন ছাড়া আমার সেই অংশ থেকে সব বাতিল করতে পারি। এই জগতে আমাকে যা কিছু ঘিরে রয়েছে তা আমায় আক্রমণ করে বা পরম আনন্দ দেয় তার সবকিছু আমি খণ্ডন করতে পারি, কেবল এই হৈ চৈ, এই সাৰ্বভৌম সুযোগ এবং স্বর্গীয় সাম্যতা ছাড়া যা নৈরাজ্য থেকে লাফিয়ে পড়ে। আমি জানি না এই জগতের কোনো অর্থ রয়েছে কিনা যা একে অতিক্রমণ করে। কিন্তু আমি জানি আমি যে সেই অর্থ জানি না এবং তবে আমার পক্ষে কেবল এ জানা এখন অসম্ভব। আমার কাছে এর অর্থ যা আমার অবস্থার বাইরে তার কি অর্থ করতে পারে? মানবিক শর্ততেই আমি কেবল বুঝতে পারি। যা আমি স্পর্শ করি, যা আমাকে প্রতিরোধ করে সেইটা আমি বুঝি এবং এই দুটি নিশ্চয়তা–সম্পূর্ণতার জন্য এবং ঐক্যের জন্য আমার খিদে এবং এই জগতের কমে যাওয়ার অসম্ভাব্য যৌক্তিক ও কার্যকারণের আদর্শতে—এও জানি আমি পুনরায় তাদের মেলাতে পারব না। মিথ্যে ছাড়া আমি কোনো অন্য সত্য মেনে নিতে পারি, আশার কথা না শুনিয়ে আমি কী করে অভাব বোধ করি, আমার শর্তের সীমাবদ্ধতার ভেতরে কোনো কিছুই অর্থ প্রকাশ করে না?

গাছেদের মধ্যে আমি যদি গাছ হতাম, জন্তুদের মধ্যে বিড়াল, এই জীবনের একটা অর্থ থাকত অথবা বরং এই সমস্যা উঠত না, কারণ এই জগতের একজন মালিক হওয়া উচিত। এই জগৎ হয়ে ওঠা আমার উচিত যাতে আমার সমগ্র সচেতনতা এবং আমার সমগ্র দৃঢ়তার পরিচিতি দিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করা হয়। এই অদ্ভুত যুক্তি যা সব সৃষ্টিতে আমাকে বিরোধী অবস্থায় স্থাপন করে। আমি এক কলমের খোঁচায় একে কেটে দিতে পারি না। সত্য বলে আমি যা বিশ্বাস করি তাকে অবশ্য আমি রক্ষা করব। আমার কাছে যা এতই নিশ্চিত মনে হয়, এমনকি তা আমার বিরুদ্ধেও হয়ে থাকে, আমি তাকে অবশ্যই সমর্থন করি। আর সেই দ্বন্দ্বের ভিত্তি কিসের ওপর গঠিত হয়, জগতের ও আমার মনের ফাটলে, নাকি এর স্বজাগত্বে? যদি তাই হয় তবে আমি একে রক্ষা করতে চাই। এক অবিরাম সচেতনতার মধ্য দিয়ে আবার চির জাগরণের ভেতর দিয়ে, চির সতর্কতার মধ্য দিয়ে আমি পারি। মুহূর্তের জন্য এ আমি অবশ্য স্মরণ করব। সেই মুহূর্তেও মন উষ্ণতা ছেড়ে দিতে পারে, শুকিয়ে নিতে পারে পরিচ্ছন্ন প্রয়াসে। এখন সেই পথটি মিশে যায় রোজকার পথে। এর সংঘর্ষ ঘটে অজ্ঞাত নৈর্ব্যক্তিক সর্বনাম ‘একজন’ এর সঙ্গে, কিন্তু অতঃপর মানুষ প্রবেশ করে তার বিদ্রোহ এবং তার স্বচ্ছতা নিয়ে, সে ভুলে যায় কীভাবে তা আয়ত্ত করবে। বর্তমানের এই নরকটি অবশেষে তার সাম্রাজ্য। সব সমস্যা তাদের ধারালো প্রান্তে পুনরুদ্ধার করে। ফর্ম ও রঙের কবিতাবলির সামনে পিছিয়ে যায় বিমূর্ত প্রমাণাদিতে। আত্মিক সংঘর্ষ হয়ে ওঠে শরীরী এবং ফিরে যায় মানুষের হৃদয়ের দুর্দশায় ও আশ্চর্যজনক আশ্রয়ে, তাদের মধ্যে কেউই প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু সবাই রূপান্তরিত হয়ে যায়। একজন কি মরতে যাচ্ছিল, ঝাঁপিয়ে বেঁচেছে, ভাবনার এক সৌধ পুনঃনির্মাণ করে এবং গঠন করে একজনের নিজের মাপযন্ত্র? অপরদিকে একজন কি অ্যাবসার্ডের হৃদয়বিদারী ও চমৎকার বাজি ধরতে চলেছে? এই বিষয়ে আসুন আমরা এক চূড়ান্ত প্রয়াস নিই এবং আমাদের সব উপসংহার টানি। শরীর, স্নেহ, সৃষ্টি, ক্রিয়া, মানব মহত্ত্ব তাহলে এই উন্মত্ত জগতে তাদের জায়গায় পুনরায় শুরু করবে। অবশেষে মানুষ আবার সেখানে দেখবে অ্যাবসার্ডের মদিরা এবং উদাসীনতার রুটি যার ওপর সে তার মহানতাকে পুষ্টিলাভ করায়।

আমাদের এই রীতিটিকে প্ররোচিত করতে আমাদের দেওয়া হোক : এ হলো দৃঢ়তার ব্যাপার। তার পথের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে অ্যাবসার্ড মানুষটিকে প্রলুব্ধ করা হয়। ইতিহাস হয় ধর্ম বা ভবিষ্যৎ বক্তা, এমনকি ঈশ্বর ছাড়া নিষ্প্রয়োজন নয়। তাকে ঝাঁপাতে বলা হয়। সবই সে উত্তর দিতে পারে সেইসব সে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারে না, তা সম্ভব নয়। কার্যত সে কিছু করতে চায় না যা সে সম্পূর্ণভাবে বোঝে। সে আস্থাশীল হয় এ হলো অহঙ্কারের পাপ কিন্তু সে বোঝে না পাপের ধারণা; সম্ভবত মজুতখানায় নরক রয়েছে কিন্তু সেই অদ্ভুত ভবিষ্যৎকে দেখার ব্যাপার যথেষ্ট কল্পনা তার নেই, অমর জীবন সে হারাতে থাকে, কিন্তু তা তার কাছে মনে হয় এক আদর্শ বিবেচনা তাকে পাবার জন্য একটা প্রয়াস হয় যে তার অপরাধকে মেনে নিতে সারল্য অনুভব করে সে। সত্য বলতে কী, যেসব সে অনুভব করে তা হলো—তার অপূরণীয় সরলতা। এটা হলো তাই যা সে সবকিছু মেনে নেয়। ধরা যাক যা সে নিজেই দাবি করে, তাকে বাস করতে হয় সম্পূর্ণরূপে একা যা সে জানে, সে নিজেই ব্যবস্থা করে নেয় যা রয়েছে এবং শূন্যতার ভেতর আনে যা নিশ্চিত বা নির্দিষ্ট নয়। তাকে বলা হয় তা কিছুই নয়। কিন্তু নিদেনপক্ষে এ হলো এক নির্দিষ্টতা এবং এ এর সঙ্গে রয়েছে যা তাকে সংযুক্তি করেছে : সে খুঁজে বের করতে চায় যদি আবেদন ছাড়াই বাস করা সম্ভব হয়।

এখন আমি আত্মহত্যার ধারণাকে শুরু করতে পারি। ইতিমধ্যে এ অনুভব করেছে কোনো সমাধান দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে সমস্যাটি করা হয় উল্টো, আগের মতো এ এক খুঁজে বের করার প্রশ্ন যেখানে হোক বা না হোক জীবনে বেঁচে থাকার একটা অর্থ থাকতে হবে। অপরদিকে এখন এ পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, এ বেঁচে থাকা হবে সবই অধিকতর ভালো যদি এর কোনো মানে না থাকে। এক অভিজ্ঞতায় বাস করে, এ বিশেষ ভাগ্য, একে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেছে। এখন, কেউই এই ভাগ্যে বাস করবে না, অ্যাবসার্ড হয়ে একে জেনে যদি বা তার সামনে সবকিছু রাখে যে সচেতনতা দিয়ে অ্যাবসার্ডকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। বিরোধীর শর্তগুলোর একটিকে বাতিল করে যার ওপর একে এড়িয়ে মূল্যবান করে বাস করে। চেতনার বিদ্রোহকে করা হলো সমস্যা থেকে কৌশলে পালানো। স্থায়ী বিপ্লবের থিমটি এভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভেতরে বাহিত হয়। বাস করাটা অ্যাবসার্ডকে রাখছে জীবন্ত। একে জীবন্ত রাখাটা সর্বোপরি অবলোকন। ইউরিডাইসের মতো নয়, অ্যাবসার্ড কেবল মারা যায় যখন আমরা এর থেকে পালাই। সংলগ্ন দার্শনিক অবস্থাগুলোর মধ্যে কেবল একটি এভাবে বিদ্রোহ করে। মানুষ ও তার নিজের অস্পষ্টতার মধ্যে এ এক অনবরত লড়াই। এক অসম্ভব স্বচ্ছতার ওপর এ এক দৃঢ়তা। প্রতিটি সেকেন্ডে নতুনরূপে এ জগৎকে বিরোধিতা করে। সচেতনতাকে আয়ত্ত করার চমৎকার সুযোগ নিয়ে কেবল বিপদ জোগান দেয় মানুষকে, এতই আধ্যাত্মিক বিদ্রোহ সমগ্র অভিজ্ঞতার দিকে বিস্তৃত করে। এ হলো মানুষের নিজের চোখের অবিরাম উপস্থিতি। এ আকাঙ্ক্ষা নয়, এ হলো আশাকে ছেড়ে দেওয়া। সেই বিদ্রোহ বিচূর্ণ ভাগ্যের নিশ্চয়তা, পদত্যাগ ছাড়াই একে সঙ্গ দেওয়াটা তার উচিত।

যেই স্তরে অ্যাবসার্ড অভিজ্ঞতাকে দেখা গেছে সেখানে সেটা আত্মহত্যা থেকে অনেক দূরে। ভাবা হতে পারে আত্মহত্যা অনুসরণ করে বিদ্রোহকে—কিন্তু তা ভুলভাবে। কারণ এ বিদ্রোহের যৌক্তিক ফল হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে না। অপরদিকে এ শুধু প্রাক ধারণাকে অনুমোদন করে। ঝাঁপের মতো, আত্মহত্যা একে চূড়ান্ত করে গ্রহণ করে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে এবং মানুষকে ফিরিয়ে দেয় তার প্রয়োজনীয় ইতিহাসে। তার ভবিষ্যৎ, তার চমৎকার ও ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ—দেখে তার দিকে ছুটে যায়। এরই পথে, আত্মহত্যা অ্যাবসার্ডকে মেনে নেয়। একই মৃত্যু অ্যাবসার্ডকে গ্রাস করে। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে আমি জানি, অ্যাবসার্ডকে মেনে নিতে পারে না। আরো বিস্তার করে আত্মহত্যা থেকে এ বেঁচে যায়; একই সঙ্গে মৃত্যু সম্পর্কে সচেতন হয় এবং বাতিল করে। অভিযুক্ত ব্যক্তির শেষ ভাবনার সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ে এ হলো তাই যা সেই জুতোর ফিতেয় যা কিছু ঘৃণ্য কিছুটা দূরে থেকে সবকিছু দেখতে পায়; একদম শেষপ্রান্তে এ হলো ম্রিয়মাণ পতন। আত্মহত্যার বিপরীতে মানুষ মৃত্যুকে অস্বীকার করে।

সেই বিদ্রোহ জীবনকে এর মূল্য দেয়। এক জীবনের সমগ্র দৈর্ঘ্যতার ওপর বিছিয়ে দেয়, সেই জীবনের দিকে এ পুনরায় সঞ্চিত করে এর মহিমা। সেই বৌদ্ধিক অপেক্ষা আর কোনো অধিকতর সূক্ষ্ম দৃষ্টি নেই যা একে অতিক্রমণ করে। মানব গর্বের দৃষ্টিটি অসমান। কোনো অসম্মান বা অবজ্ঞা কোনো কাজে লাগে না। ঐ শৃঙ্খলা যা নিজেই মনের ওপর আরোপ করে, কোনো কিছুর জন্য বশ করবে না, তাদের ব্যাপারে মুখোমুখি সংগ্রাম কিছুটা ব্যতিক্রম রয়েছে। সেই বাস্তবতাকে উন্নতি করে বা মানিয়ে নিয়ে; সেই বাস্তবতায় যাদের অমানবিকতা গঠন করে মানুষের মহিমা, তা তার নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সমান। তাই আমি বুঝি কেন আমার কাছে তত্ত্বগুলো সবকিছু ব্যাখ্যা করে, একই সময়ে আমাকে সাহসী করে তোলে আমার নিজের জীবনের ভার থেকে ওরা সাময়িক মুক্তি দেয় এবং তবুও আমি একে একাই অবশ্য বহন করব। এই সংযোগস্থলে ধারণ করতে পারি না এক নাস্তিক্যপূর্ণ অধ্যাত্ম যা যুক্ত হতে পারে এক আত্মোৎসর্গের নৈতিকতার দিকে।

সচেতনতা ও বিদ্রোহ, এসব বর্জন আত্মোৎসর্গের বিরুদ্ধাচরণ। সবকিছুই অদম্য এবং মানব হৃদয়ের আবেগতাড়িত যা তাদের ত্বরান্বিত করে। অপরদিকে এর নিজের জীবনের সঙ্গে থাকে। মরে যাওয়াটা প্রয়োজনীয় বিচ্ছেদ এবং একজন নিজের মুক্ত ইচ্ছে নয়। আত্মহত্যা এক বিচ্ছিন্নতা। অ্যাবসার্ড মানুষ তিক্ত পরিসমাপ্তিতে সবকিছু কেবল নষ্ট করতে পারে এবং নিজেকে শূন্য করতে পারে। অ্যাবসার্ড তার চূড়ান্ত উত্তেজনা যা সে একক প্রয়াসে অনবরত রক্ষা করে চলে, কারণ সে জানে সেই চেতনায় এবং দিনের পর দিন বিদ্রোহ সে কেবল সত্যকে প্রমাণ দেয়, সেই সত্য ঘৃণায় ভরা বিরোধিতা এই প্ৰথম ফল।

.

যদি আমি প্রাক-ব্যবস্থিত অবস্থায় থাকি যা সব সিদ্ধান্তকে আকর্ষণ করতে সংগঠিত করে (এবং আর কিছুই নয়), নতুনভাবে, প্রত্যয় আবিষ্কার করাতেই যুক্ত হয়, তাহলে আমাকে মুখোমুখি হতে হয় দ্বিতীয় কূটাভাসে। সেই পদ্ধতিতে বিশ্বস্ত থাকার উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার সমস্যা নিয়ে আমার কিছুই করার থাকে না। মানুষ স্বাধীন হোক বা না হোক জানাটা আমাকে কৌতূহলী করে না। আমার স্বাধীনতায় আমি কেবল অভিজ্ঞ হতে পারি। এ অনুযায়ী আমার কোনো সাধারণ ধারণা থাকতে পারে না, তবে কেবল অল্প কয়েকটি স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি থাকতে পারে। ‘স্বাধীনতা এ রকম’ এর সমস্যার কোনো অর্থ নেই। কারণ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ঈশ্বরের সমস্যার সঙ্গে এ যুক্ত। মানুষ হয় স্বাধীন অথবা নয় জেনে যুক্ত হয় যে তার একজন মাস্টার রয়েছে জানাটা, এই সমস্যার অ্যাবসার্ডতার অদ্ভুত ঘটনা থেকে আসে যে সেই বিশেষ প্রত্যয় যা তৈরি করে স্বাধীনতার সম্ভাবনার সমস্যাও, সেই ধারণার সব অর্থকে দূরে নিয়ে যায়। কারণ ঈশ্বরের উপস্থিতিতে শয়তানের সমস্যা অপেক্ষা অনেক কম স্বাধীনতার সমস্যায় রয়েছে। বিকল্প তুমি জান : হয় আমরা স্বাধীন নই এবং সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরই শয়তানের জন্য দায়ী। অথবা আমরা স্বাধীন এবং দায়ী কিন্তু ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নয় সব পণ্ডিতীয় সূক্ষ্মতার কোনোকিছু যোগ করার নেই অথবা এই কূটাভাসে সঠিকতা থেকে কোনোকিছুই বাদ দেবার নেই।

যা গৌরবান্বিত হয়েছে তার ভেতর কেন আমি পেতে পারি না অথবা প্রত্যয়ের শুধু সংজ্ঞা পাই না যা আমাকে কৌশলে দূরে সরিয়ে দেয় এবং হারিয়ে ফেলে এর অর্থ শিগগিরই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়গত কাঠামোর ভেতর তা চলে যায়। আমি বুঝতে পারি না কী ধরনের স্বাধীনতা উচ্চতর সত্তায় আমাকে দেওয়া হবে। যাজক জ্ঞান আমি হারিয়েছি। আমি কেবল স্বাধীনতা ধারণা পেতে পারি যা রাষ্ট্রের মাঝেতে বন্দি অথবা ব্যক্তিগত স্তরে। কেবল একটাই জানি তা হলো ভাবনা ও কর্মের স্বাধীনতা। এখন যদি চিরন্তন স্বাধীনতায় আমার সব সুযোগ নাকচ করে দেয়, অপরদিকে আমার স্বাধীনতায় পুনঃসঞ্চয় করে এবং বড় করে তোলে আশার ও ভবিষ্যতের সেই অভাব এবং বঞ্চনার অর্থ মানুষের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি।

অ্যাবসার্ডের সঙ্গে সংঘর্ষের আগে, মানুষ প্রতিদিন বাস করে লক্ষ্য নিয়ে, ভবিষ্যতের জন্য বা যুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে (কার উদ্দেশ্যে বা কী প্রশ্ন নয়)। তার সুযোগগুলো মাপে, ‘কোনোদিন’ এর জন্য সে হিসেব কষে, হিসেব করে তার অবসর বা তার পুত্রদের পরিশ্রম। সত্যের ভেতরে, সে এমন আচরণ করে যেন সে মুক্ত, এমনকি যদি সব ঘটনা সেই স্বাধীতার বিরোধিতায় কেন্দ্রভূমি তৈরি করে। কিন্তু অ্যাবসার্ডের পরে, সবকিছুই উলট-পালট হয়ে যায়। সেই ধারণা যে ‘আমি’, আমার কার্যকলাপের ধারায় সবকিছুই যেন একটা অর্থ আছে (এমনকি যদি, কোনো উপলক্ষে আমি বলেছি যার কিছু নেই)—মৃত্যুর অ্যাবসার্ডতা দিয়ে সব যা কিছু মিথ্যা দেওয়া হয় ঝিমঝিম করা ফ্যাশানে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবে, একজন নিজেরই জন্য উদ্দেশ্যকে প্রতিষ্ঠিত করে, সুযোগ দিয়ে—স্বাধীনতায় এসব পূর্ব নির্ধারিত এক বিশ্বাস, এমনকি যদি উপলক্ষত একজন বলে যে একজন এ অনুভব করেন কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি ভালো রকম ওয়াকিবহাল যে সেই উচ্চতর স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতায় অস্তিত্বশীল হয়ে যা একাই সত্যের জন্য ভিত্তি হিসেবে রক্ষা করে, তার অস্তিত্ব থাকে না। মৃত্যুই সেখানে একমাত্র বাস্তব। মৃত্যুর পর আঘাতগুলোতে নেমে যায়। যদিও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি নিজেই, তবুও আমি মুক্ত নই। তবে এক ক্রীতদাস এবং সর্বোপরি এক শাশ্বত বিপ্লবের আশা ব্যতীত এক ক্রীতদাস কোনো দায়িত্ব নেই এমনভাবেই ঘৃণা করে। আর বিপ্লব ছাড়া এবং ঘৃণা ছাড়া কোনো ক্রীতদাস থাকতে পারে? শাশ্বতের আশ্বাস ছাড়া পূর্ণরূপে কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে?

কিন্তু একই সময়ে অ্যাবসার্ড মানুষটা বোঝে যে, এ যাবৎ সেই ভ্রমের ওপর সেই স্বাধীনতার দাবিতে বাধ্য থাকে যাতে সে বাস করছে। তাকে ক্ষতি করেছিল এক নির্দিষ্ট বোঝাপড়ায়। বিস্তৃত করে যার ওপর তার জীবনে এক উদ্দেশ্যে কল্পনা করেছিল, সে নিজেই কতকগুলো ফলরূপে পেতে চাহিদার উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করেছিল এবং তার স্বাধীনতার ক্রীতদাস হয়ে উঠেছিল। এভাবে বাবা যেভাবে করে (বা ইঞ্জিনিয়ার বা জাতির নেতা বা পোস্ট অফিসের সাব-ক্লার্ক) তার চেয়ে অন্যরূপে আমি কাজ করতে পারি না যা আমি হয়ে ওঠার প্রস্তুত হচ্ছি। মনে করি অন্য কিছু হয়ে ওঠার চেয়ে আমি হয়ে ওঠাটা বেছে নিতে পারি। নিশ্চিত হয়ে এসব আমি অসচেতন হয়েই ভাবি। কিন্তু একই সময়ে আমার চারপাশে যেসব বিশ্বাস রয়েছে, আমার মানব পরিবেশকে বিনাবিচারে মেনে নেওয়ার সঙ্গে আমার দাবিকে শক্তিশালী করে (অন্যরা মুক্ত হওয়াতে এত নিশ্চিত এবং সেই স্বতঃস্ফূর্ত মেজাজ এতই সংক্রামক!)। যতদূরেই হোক একজন কোনো বাছবিচার না করেই, আদর্শ বা সামাজিকতা থেকে তাদের দ্বারা একজনকে অংশত প্রভাবিত করে এবং এমনকি, তাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ তার জন্য (ভালো বা মন্দ বিনাবিচারে মেনে), তাদের প্রতি আস্থায় একজনের জীবন একজন গ্রহণ করে। এভাবে অ্যাবসার্ড মানুষটি বোঝে যে, সে প্রকৃত অর্থে মুক্ত নয়। স্পষ্টরূপে বললে, বিস্তৃত করে যা আমি আশা করি সে ক্ষেত্রে, যাতে আমি সত্য সম্পর্কে অস্থির থাকি, তা আমার কাছে ব্যক্তিগত হতে পারে, সত্তার বা সৃষ্টির পথে, বিস্তৃতির দিকে যাতে আমার জীবনকে ব্যবস্থা করে তার ফলে প্রমাণ করি একে গ্রহণ করি যেহেতু এর একটা অর্থ আছে। যার ভেতর আমার জীবনকে সীমিত করি তার মাঝে আমি নিজেই সৃষ্টি করি বেড়া। মনের ও হৃদয়ের বহু আমলা যেমন তৈরি করি তেমনই তারা আমাকে ভরে দেয় বিরক্তিতে এবং তারা কেবল একটা অপরাধ করে, এখন আমি পরিষ্কার দেখি, মানুষের স্বাধীনতাকে আন্তরিকভাবে নিতে হবে।

এই ক্ষেত্রে অ্যাবসার্ড আমাকে আলোকিত করে : এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অতঃপর আমার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতার জন্য এটাই কারণ। আমি এখানে দুটো তুলনা করে ব্যবহার করব। প্রথমেই, অতীন্দ্রিয় রূপগুলো তাদের নিজেদের ছেড়ে দেওয়ার ভেতর স্বাধীনতাকে দেখে। তাদের ঈশ্বরের ভেতর তারা হারিয়ে, গ্রহণ করে তার নিয়মনীতি, তারা স্বাধীন হয়ে ওঠে গোপনভাবে। ক্রমাগতভাবে ক্রীতদাসত্ব গ্রহণে তারা এক গভীরতর স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার কি মানে? সর্বোপরি এ বলা হতে পারে তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে মুক্ত অনুভব করা এবং স্বাধীনতার মতটা মুক্ত নয়। অনুরূপ সম্পূর্ণভাবে ঘুরে যায় মৃত্যুর দিকে (এখানে গ্রহণ করা হয় সবচেয়ে নিশ্চিত অ্যাবসার্ডতা), বাইরের সবকিছু থেকে সে মুক্ত মনে করে, যা সেই আবেগতাড়িত মনোযোগ স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তার ভেতর। সাধারণ নিয়মকানুনের উদ্দেশ্যে সে স্বাধীনতা উপভোগ করে। এই ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যাবে সে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রাথমিক থিমগুলো তাদের সম্পূর্ণ মূল্যকে রেখে দেয়। সচেতনতার দিকে ফিরে, প্রতিদিনকার ঘুম থেকে পালিয়ে অ্যাবসার্ড স্বাধীনতার প্রথম ধাপগুলোকে পুনরায় উপস্থিত করে। কিন্তু এ হলো অস্তিত্ববাদের প্রচার যা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে এবং এর সঙ্গে সেই আধ্যাত্মিক ঝাঁপ যা প্রাথমিকভাবে চেতনার থেকে পালায়। একইভাবে (এটি আমার দ্বিতীয় তুলনা) প্রাচীনকালীয় ক্রীতদাসেরা তাদের মধ্যে বাস করে না। কিন্তু তারা জানে যে স্বাধীনতা গঠিত হয় তার কোনো দায়িত্বশীল অনুভব নেই[১১]। মৃত্যুরও রয়েছে অভিজাত সম্প্রদায়ের হাত, সেই হাত চূর্ণবিচূর্ণ করে, করে স্বাধীন।

সেই তলহীন নিশ্চয়তার একজন নিজেকে হারিয়ে, একজনের নিজের জীবন থেকে অতঃপর যথেষ্টভাবে দূর অনুভব করে, একে বাড়ায় এবং গ্রহণ করে খোলাখুলি মত—সংসক্ত হয়ে পড়ে স্বাধীনতার আদর্শে। এরূপ নতুন স্বাধীনতার নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে, যে কোনো স্বাধীনতার কার্যধারার মতো। অমরতার জন্য কোনো চেক লিখে দেয় না। কিন্তু স্বাধীনতার অধ্যাসের জন্য জায়গা করে নেয়, এই ব্যাপারটা মৃত্যুর সঙ্গে সব শেষ হয়ে যায়। অভিযুক্ত মানুষের দিব্যপ্রাপ্তির পূর্বে যার জেলখানার দরজাগুলো অতি প্রত্যুষে খুলে যায়, সবকিছুর ব্যাপারে সেই অবিশ্বাস্য উদাসীনতা, একমাত্র জীবনের শুদ্ধ শিখা ব্যতীত এ পরিষ্কার যে, মৃত্যু ও অ্যাবসার্ড এখানে কেবল স্বাধীনতার যুক্তিযুক্ত নীতি : যার ভেতর মানব হৃদয় অভিজ্ঞ ও বাস করতে পারে। এটি হলো দ্বিতীয় ফল। অ্যাবসার্ড মানুষটি এভাবেই জ্বলন্ত ও স্থির দৃষ্টিকে ধরে, স্বচ্ছ ও সীমিত বিশ্ব যার ভেতর কোনোকিছুই সম্ভব নয় কিন্তু সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং যার আড়ালে সবই স্তব্ধ এবং শূন্য। তাহলে সে এরূপ বিশ্বকে গ্রহণ করতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং এর থেকে তার শক্তি, আশাকে অস্বীকার ব্যাপারটা টানতে পারে এবং সান্ত্বনা ছাড়া জীবনের নাছোড় জোরালো প্রমাণপত্রও

কিন্তু এ রকম বিশ্বে জীবনের কী অর্থ? মুহূর্তের জন্য কিছুই নয় কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য উদাসীনতা এবং সবকিছু ব্যবহার করার আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুই দেওয়া হলো। সব সময়ই জীবনের অর্থের বিশ্বাস জড়িত। জড়িত মূল্যায়ন, পছন্দ, আমাদের অগ্রাধিকারের মাপকাঠি। আমাদের সংজ্ঞানুযায়ী অ্যাবসার্ডের বিশ্বাস লেখায় বিরোধিতা। তবে এ সুষ্ঠু পরীক্ষা।

আবেদন ছাড়াই একজন বাস করতে পারে তা জেনেই হোক বা না জেনেই হোক, সেইসব সম্পর্কিত বিষয়ে আমাকে উৎসাহী করে। আমার গভীরতা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাই না। জীবনের দৃষ্টিকোণ যা আমাকে দেওয়া হয়েছে আমি নিজে কি তা গ্রহণ করতে পারি? এখন, এই বিশেষ সম্পর্কের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে, অ্যাবসার্ডের বিশ্বাস উৎকৃষ্টতার জন্য অভিজ্ঞতার পরিমাণ বদলের সমান হয়ে ওঠে। যদি আমি অনুভব করি আমার সমগ্র ভারসাম্য আমার সচেতন বিদ্রোহ ও অন্ধকারত্বের মাঝে সেই শাশ্বত বিরোধিতা নির্ভর করে যার ভেতর এ সংগ্রাম করে। যদি আমি মেনে নিই এর সীমিত ভাগ্যের সম্পর্ক ছাড়া আমার আর কোনো অর্থ নেই, তাহলে আমি অবশ্য বলব যা হিসেব করা হয় সেটাই শ্রেষ্ঠ বাঁচা নয় কিন্তু অধিকাংশ বাঁচা। বিস্মিত হওয়া আমার ওপর নির্ভর করে না যদি এ অশ্লীল বা বিদ্রোহী, চমৎকার ও দুঃখদায়ক। একবার এবং সবার জন্য, মূল্য বিচার তথ্যাদি বিচারের পক্ষে নাকচ করা হয়। যা আমি দেখতে পাই তার থেকে আমাকে কেবল সিদ্ধান্ত টানতে হয় এবং ঝুঁকি নিতে পারি না যা প্রকল্পিত। এভাবে সেই বেঁচে থাকাকে গ্রহণ করা সম্মানজনক নয়, তবে প্রকৃত মালিকানা আমাকে অসম্মানিত হতে আদেশ করে।

ব্যাপকতর অর্থে অধিকাংশ জীবন, সেই জীবনের নিয়ম কোনোকিছুর অর্থ প্রকাশ করে না। সংজ্ঞা নিরূপিত করতে আহ্বান করে। মনে হয় প্রথমে ঘটনা যা পরিমাণগত ধারণা দিয়ে যথেষ্টভাবে উন্মোচিত করা হয় না। কারণ মানব অভিজ্ঞতার এক বৃহৎ অংশকে এ হিসেব করতে পারে। কেবল অভিজ্ঞতার পরিমাণ ও প্রকারভেদের ভেতর ছাড়া একজন মানুষের আচরণবিধি ও তার মূল্য পরিমাপের কোনো অর্থ নেই, তার ভেতরই সঞ্চয় করার মতো অবস্থায় রয়েছে। এখন আধুনিক জীবনের অবস্থাগুলোকে মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর আরোপ করে, আরোপ করে তাদের অভিজ্ঞতাগুলোর পরিমাণ ও ফলবশত একই গভীর অভিজ্ঞতায়। নিশ্চিত হয়ে ব্যক্তির অনবরত অবদানের বিবেচনার ভেতর অবশ্য নেওয়া হয়েছে, তার ভেতর যেসব উপাদান ‘দেওয়া হয়েছে’। আমি তার বিচার করতে পারি না, আমাকে আবার বলতে দেওয়া হোক এখানে আমার নিয়ম তাৎক্ষণিক প্রামাণ্যের সঙ্গে একমত হতে হবে। তখন আমি দেখি নীতির সাধারণ রীতির ব্যক্তির চরিত্র এত বেশি থাকে না যাতে অভিজ্ঞতার রীতির ভেতরে এর প্রাথমিক নৈতিক প্রকৃত গুরুত্ব যা মাপাটা সম্ভব। অল্পবিস্তর একটা বিন্দুতে টেনে এনে, গ্রিকদের অবসরের রীতি ছিল যেমন আমাদের রয়েছে দিনে আট ঘণ্টা। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের ট্র্যাজিকের কারণের মধ্যে বহু মানুষ আগেই দেখে যে এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বদলে দেয় এই আলোচনার মূল্য। তারা আমাদের কল্পনা করতে সাহায্য করে প্রতিদিনকার দুঃসাহসী যেসব রেকর্ড ভেঙে দেবে কেবল অভিজ্ঞতার পরিমাণের ভেতর দিয়ে (উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমি এই খেলোয়াড়সুলভ অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করছি), এবং এভাবে জয় করবে তার নিজের নীতির নিয়মনীতিকে।[১২] তথাপি আসুন আমরা রোমান্টিকতাকে এড়াই এবং আমাদের নিজেদের শুধু জিজ্ঞেস করি কেবল কী রকম এক দৃষ্টিকোণ একজন মানুষের কাছে অর্থ হতে পারে। তার মন তার বাজি ধরায় মনস্থির করে, সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে কীভাবে খেলার নিয়মরীতিকে গ্রহণ করে।

যতটা সম্ভব জগতের মুখোমুখি হয়ে সব রেকর্ড ভাঙাটা প্রাথমিক কাজ। বিরোধিতা ও শব্দ নিয়ে খেলা ব্যতীত কীভাবে এ করা যেতে পারে? কারণ অ্যাবসার্ড শেখায় সব অভিজ্ঞতা যা গুরুত্বহীন এবং অপরদিকে অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বেশি পরিমাণের প্রতি চালিত করে। তাহলে আমি যাদের কথা আগেই বলছিলাম বহু মানুষ যারা করেছিল সেই রকম একজন মানুষ কীভাবে ব্যর্থ হতে পারে—সেই মানুষেরা পছন্দ করে জীবনের গঠন যা আমাদের কাছে নিয়ে আসে অত্যন্ত সম্ভাব্য মানবিক ব্যাপার, তার ফলে মূল্যের মাপযন্ত্রকে পরিচয় করে যাতে অপরদিকে একজন বাতিল করার দাবি করে।

কিন্তু আবার অ্যাবসার্ডও আমাদের শিক্ষা দেয় এর বিরোধী—জীবন। কারণ ভুলটা ভাবা হচ্ছে যে, সেই অভিজ্ঞতার পরিমাণ আমাদের জীবনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে যখন আমাদের ওপর পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এখানে আমাদের অতিরিক্ত সরল হতে হয়। একই সংখ্যার বছরগুলোয় দু’জন মানুষের বাস করায়, জগৎ সব সময় একই সংখ্যক অভিজ্ঞতায় সরবরাহ করে। আমাদের ওপর নির্ভর করে তাদের সচেতন হয়ে ওঠা। একজনের জীবনে সজাগ হয়ে, একজনের বিদ্রোহ, একজনের স্বাধীনতা, সর্বোচ্চ অবস্থায়, বাস করছে, সর্বোচ্চ স্তরে। যেখানে স্বচ্ছতা নিয়ন্ত্রণ করে, মূল্যায়নের মাপযন্ত্র হয়ে ওঠে অব্যবহার্য। এমনকি আমরা আরো বেশি সরল হই। আমাদের বলতে দাও পুরো প্রতিবন্ধক। পুরো ঘাটতি ভার হয়ে ওঠে, অকালমৃত্যু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। এভাবে কোনো গভীরতা নয়, কোনো আবেগ নয়, কোনো কামনা নয় এবং কোনো আত্মত্যাগ অ্যাবসার্ড মানুষের চোখে সমানরূপে পরিণত করতে পারে না (এমনকি যদি সে ইচ্ছে করে), পারে না চল্লিশ বছরের সচেতন এক জীবন এবং পরিচ্ছন্নরূপে ষাট বছরে বিস্তৃত[১৩] করতে। উন্মত্ততা ও মৃত্যু তার কাছে অপ্রতিরোধ্য। মানুষ পছন্দ করে না। অ্যাবসার্ড ও অতিরিক্ত জীবন যা সংসক্ত হয়, সুতরাং মানুষের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না তবে এর বিরুদ্ধে তা হলো মৃত্যু।[১৪] শব্দ সাবধানে মেপে, একত্রে এক ভাগ্যের প্রশ্ন। কেবল একজন এতে রাজি হয়ে সমর্থ হতে হবে। কুড়ি বছরের জীবনে ও অভিজ্ঞতায় কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু এরূপ সজাগ প্রতিযোগিতায় এক অগোছালো অস্বস্তির সঙ্গে গ্রিকেরা দাবি করে যারা কম বয়সে মারা গেছে তারা তাদের ঈশ্বরের স্নেহধন্য এবং তা কেবল সত্য যদি তুমি বিশ্বাস করতে ইচ্ছুক থাকো যে ঈশ্বরের ভয়ঙ্কর জগতে প্রবেশ করে চিরকালের জন্য পবিত্রতম আনন্দগুলো অনুভব করছে তা হারায় এবং পৃথিবীতে যা অনুভব করছে। বর্তমান ও বর্তমানের পরম্পরায় অনবরত সচেতন আত্মার আগে থাকে অ্যাবসার্ড মানুষের আদর্শ। কিন্তু শব্দের আদর্শ ডাক এই ক্ষেত্রে মিথ্যে। এমনকি এ তার মোক্ষলাভের আহ্বান নয় তবে কেবল তার যুক্তির তৃতীয় ফল। অমানবিক এক ক্ষুব্ধ সচেতনতা থেকে যাত্রা শুরু করে, অ্যাবসার্ডের ওপর ধ্যান ফিরে যায় ভ্রমণের শেষে যেখানে মানব বিদ্রোহের কামনার আগুনের বিশেষ হৃদয়টির দিকে।[১৫]

এভাবে আমি অ্যাবসার্ড থেকে তিনটি ফল টানি তা হলো আমার বিদ্রোহ, আমার স্বাধীনতা ও আমার কামনা। সচেতনতার কেবল কার্যধারা দিয়ে আমি জীবনের নিয়মে রূপান্তরিত করি যা মৃত্যুকেই আমন্ত্রণ—আর আমি আত্মহত্যাকে অস্বীকার করি। আমি জানি, নিশ্চিত হয়ে, নিরুত্তেজ প্রতিধ্বনি এইসব দিনের মধ্য দিয়ে কম্পিত হয়। তবু আস্থার বরং বলার আছে : তো এটা প্রয়োজনীয়। যখন নিৎসে বলেন : স্পষ্টভাবে মনে হয় স্বর্গে ও পৃথিবীর ওপর প্রধান জিনিসটি পূর্ণরূপে মানতে হবে এবং একটি মাত্র লক্ষ্যে : পরিশেষে কিছু ফলাফল রয়েছে যার ভেতরে এই পৃথিবীর ওপর বেঁচে থাকার কষ্টটার মূল্য রয়েছে যেমন উদাহরণস্বরূপ, পুণ্য, শিল্প, সঙ্গীত, নৃত্য, যুক্তি, মন–কিছু যার রূপান্তর ঘটে। কিছু যা জটিল, উন্মত্ত বা ঐশ্বরিক’, প্রকৃত উল্লেখযোগ্য নৈতিক রীতির নিয়মকে তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু তিনি আরো অ্যাবসার্ড মানুষের পথটিকে চিহ্নিত করেন। ক্রোধ বা আবেগকে মেনে সহজতম ও কঠিনতম উভয়ই করতে হবে। যাই হোক নিজেকে বিচার করা কাজের সুযোগ মানুষের পক্ষে এ রকম করতে সে একাই সমর্থ হয়ে ওঠে।

‘প্রার্থনা’, এলেইন বলেন, ‘প্রার্থনা হলো যখন রাত্রি নেমে আসে চিন্তার ওপর। কিন্তু অবশ্যই রাত্রির সঙ্গে মেলে,’ উত্তর দেয় রহস্য ও অস্তিত্ব। হ্যাঁ, কার্যত, তবে সে রাতটি নয় যা বন্ধ চোখের পাতার নিচে জন্ম নেয় এবং শুধু মানুষের ইচ্ছের ভেতর দিয়ে—অন্ধকার, স্পর্শকাতর যোগ্য অন্ধকার যা মন স্মরণ করে এর ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে। অবশ্য এক রাতের সঙ্গে লড়াই বরং একে হতে দাও সেই হতাশা যা সরল থাকে—সৌররাত্রি, মনের জাগরণ যখন সম্ভবত জাগবে সে সাদা এবং কুমারীসুলভ উজ্জ্বলতা যা বৌদ্ধিক আলোতে প্রত্যেকে উদ্দেশ্যের রূপরেখা আঁকে। সেই স্তরে, সমপরিমাণ লড়াই করে কামনা ভরে বোঝাপড়ার সঙ্গে। তাহলে শিগগিরই এমনকি বিচারের প্রশ্নে এ হলো অস্তিত্বের ঝাঁপ। মান মনোভাবের বয়োবৃদ্ধ ফেস্কোর মাঝে পুনরায় এক জায়গা অনুসন্ধান করে। দর্শকদের জন্য যদি সে সচেতন হয়, সেই ঝাঁপ এখনো অ্যাবসার্ড। যতটা ভাবা হয় এ কূটাভাসকে সমাধান করে, সম্পূর্ণটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। এই হিসাবে, এ চালনা করছে। এই হিসাবে, সবকিছুই এর জায়গায় পুনরায় শুরু করে, এবং অ্যাবসার্ড জগৎ পুনরায় জন্ম নেয় এর সব উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্য।

কিন্তু বন্ধ করাটা খারাপ, একটি মাত্র দেখবার পথে সন্তুষ্ট হওয়াটা কঠিন, কোনো বিরোধিতা ছাড়া যাওয়া, সম্ভবত সব আধ্যাত্মিক শক্তি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। কেবল ভাবনার পথকে আগেই সংজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে ভাবনাটা হলো বেঁচে থাকা।

***

নোট

১. ‘absurd’ শব্দটির জুতসই বা পছন্দমতো প্রতিশব্দ পাইনি। এজন্য বাংলায় ‘অ্যাবসার্ড’ কথাটা ব্যবহার করলাম। অবশ্য কোথাও উদ্ভট বা উদ্ভটতা ব্যবহার করেছি। যদিও অ্যাবসার্ড দর্শনের ক্ষেত্রে এ ব্যবহার ঠিক নয়, আমার মনমতো নয়, ‘কিমিতি’ শব্দটি আমার পছন্দ নয়। একঘেয়ে কাটানোর জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছি। কোনো সহৃদয় পাঠকের যদি কোনো প্রতিশব্দ জানা থাকে, বসিয়ে নেবেন।

২. আসুন আমরা এই প্রবন্ধের আপেক্ষিক চরিত্রকে দেখানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করব না। বস্তুত, আত্মহত্যা অনেক বেশি সম্মানজনক বিবেচনার সঙ্গে সম্পর্ক-উদারণস্বরূপ, চীন বিপ্লবের সময়ে, যেমন : তারা বলে থাকে রাজনৈতিক আত্মহত্যা হলো প্ৰতিবাদ।

৩. সত্যের আপেক্ষিক মূল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। অপরদিকে পৌরুষোচিত আচরণের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই মনীষীর ভঙ্গুরতা আমাদের ভালোভাবে হাসি আনতে পারে।

৪. সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রয়াসী পেরোগ্রিনোসের কথা আমি শুনেছি, যুদ্ধ পরবর্তীকালের এক লেখক। তাঁর প্রথম বইটি লেখা শেষ করার পর, তাঁর লেখার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য আত্মহত্যা করেন। মনোযোগ আকর্ষণ হয় সত্যি কিন্তু বইটির বিচার সফল হয়নি।

৫. কিন্তু প্রকৃত অর্থে নয়। এটি সংজ্ঞা নয়, বরং অনুভবের বর্ণনা যা মেনে নিতে পারে অ্যাবসার্ডকে। শেষ হয়েছে এখন হিসেবপত্তর। তৎসত্ত্বেও অ্যাবসার্ড শেষ হয়ে যায়নি।

৬. বিশেষভাবে ব্যতিক্রমের ধারণার প্রসঙ্গ ও অ্যারিস্টটলের বিরুদ্ধে।

৭. ভাবতে পারে এখানে আমি প্রধান সমস্যাগুলো অবহেলা করছি তা বিশ্বাসের। কিন্তু কিয়ের্কেগার্দের বা চেস্টভের বা পরবর্তীকালের দার্শনিকদের, হুসার্লের (এ মনে করে বিভিন্ন জায়গায় এবং মনের বিভিন্ন মনোভাব) : ওদের থেকে সাধারণভাবে একটি থিমকে ধার করি এবং পরখ করি যেখানে এর ফলাফল ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত নিয়ত মানতে পারে; এ কেবল একটা জেদের ব্যাপার।

৮. বহিষ্কৃত ‘ঈশ্বর’, আমি বলিনি, ঈশ্বর এখনও প্রমাণসাপেক্ষ।

আমাকে আবার ব্যক্ত করতে দিন : এই ঈশ্বরের স্বীকৃতি নয় যা এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, বরং যুক্তিকে স্বীকৃতির দিকে চালিত করা হয়েছে।

৯. এমনকি সবচেয়ে তীব্র কঠিন জ্ঞানতত্ত্ব যুক্ত রূপতত্ত্বে। আর এরূপ স্তরে বহু সমসাময়িক চিন্তাবিদের অধিবিদ্যা কোনো কিছুই গঠনের ভেতর নেই। তবে রয়েছে এক জ্ঞানতত্ত্ব।

১০. ক: সময়মতো যুক্তিকে নিজেই একে গ্রহণ করতে বা মরতে হয়। এ কেবল নিজেই গ্রহণ করে। প্লাটিনাসের সঙ্গে, যুক্তিবাদী হওয়ার পর এ হয়ে ওঠে নান্দনিক। রূপক সহানুমানের জায়গা নিয়ে নেয়।

খ: অধিকন্তু রূপবিদ্যায় কেবল প্লাটিনাসের অবদানই নয়। সম্প্রত্যয়ে ইতিমধ্যেই এসব অভিপ্রায়ের ভেতর রয়েছে তা এতই প্রিয় আলেকজান্দ্রীয় চিন্তাবিদের কাছে বা শুধু একজন মানুষের প্রত্যয়ও হলো সক্রেটিসের এক প্রত্যয়।

১১. এখানে আমি তথ্যের তুলনার সঙ্গে যুক্ত, অবমাননার সঙ্গে নয়। অ্যাবসার্ড মানুষ বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষের বিরোধী।

১২. মাঝে মাঝে পরিমাণ তৈরি করে গুণমান। আমি যদি বিশ্বাস করতে পারি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাম্প্রতিকতম বক্তব্য। শক্তির কেন্দ্র দিয়ে সব ব্যাপার গঠিত হয়েছে। তাদের বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর সংখ্যা এর বিশেষত্ব অল্পবিস্তর তৈরি করে উল্লেখযোগ্য রূপে। লক্ষ লক্ষ আয়ন (ion = স্থূলাণু) এবং একটি আয়নের মধ্যে শুধু পরিমাণগত পার্থক্য নয়, রয়েছে গুণগত পার্থক্যও। মানব অভিজ্ঞতাকে এক সাদৃশ্য দেখাটা সহজ।

১৩. একই প্রতিফলন একটি ধারণার ওপর শাশ্বত শূন্যতার ধারণার মতোই পার্থক্য। বাস্তব থেকে কিছু যোগও করা হয় না আবার বাদও দেওয়া হয় না। শূন্যতার মনস্তাত্ত্বিকতার অভিজ্ঞতায়, বিবেচনায় ২০০০ বছরে যা ঘটবে তা আমাদের নিজেদের শূন্যতা সত্যি সত্যি অর্থ গ্রহণ করে। এর দৃষ্টিকোণগুলোর মধ্যে একটি, শাশ্বত শূন্যতা জীবনের সমষ্টিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূরণ করা হয়, তাতে যা আসে তা আমাদের হয়ে ওঠে না।

১৪. ইচ্ছেটা কেবল এখানে প্রতিনিধি : সচেতনতা রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। সরবরাহ করে জীবনের শৃঙ্খলা এবং তা প্রশংসার যোগ্য।

১৫. কোন ব্যাপারগুলো সুসঙ্গত। জগতের গ্রাহ্যতা থেকে আমরা এখানে শুরু করি। কিন্তু প্রাচ্য চিন্তাধারা শিক্ষা দেয় জগতের বিরুদ্ধে পছন্দ দিয়ে যুক্তির একই প্রয়াসে একজন প্রশ্রয় দিতে পারে। সেটা কেবল আইনগত, জানায় এই রচনারই দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমা। কিন্তু জগৎ‍ কর্তৃক যা কিছু বাতিল করা হয় তাকে অনুসন্ধান করা হয় যা শুধু তীব্র রূপে একজন প্রায়ই সম্পাদন করে (নির্দিষ্ট বেদান্তিক স্কুলগুলোয়) একই ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ কাজের নিরপেক্ষতা বিষয়ে। বইটির বড় গুরুত্ব, Le Choix, জাঁ গ্রেনিয়ার (Jean Grenier) এভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘নিরপেক্ষতার দর্শন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *