অ্যাবসার্ড মানুষ

অ্যাবসার্ড মানুষ

‘যদি স্টবরোজিন বিশ্বাস করে, সে ভাবে না সে বিশ্বাস করে।
যদি সে বিশ্বাস করে না, সে ভাবে না সে বিশ্বাস করে না।’

-দ্য পোজেজভ

.

গ্যয়টে বলেন, ‘আমার ক্ষেত্র সময়।’ বাস্তবিকই তা অ্যাবসার্ড বক্তৃতা। সত্যিই এই অ্যাবসার্ড মানুষটি কি? একে অস্বীকার করা ছাড়া সে শাশ্বতের জন্য কিছুই করে না। এ কারণে নয় যে নস্টালজিয়া তার কাছে বাইরের। কিন্তু সাহস ও যুক্তির জন্য পছন্দ করে। আবেদন ছাড়াই তাকে বাঁচতে শেখায় প্রথম এবং তার যা আছে তা নিয়েই বাঁচে; দ্বিতীয় জানায় তাকে তার সীমা। তার সাময়িক সীমিত স্বাধীনতার আশ্বাস দেয়, ভবিষ্যৎ না ভেবে তার বিদ্রোহ এবং তার মরণশীল সচেতনতায়, তার জীবনকালের সময়সীমার ভেতরে তার দুঃসাহসিক অভিযানে সে থাকে না। সেটা তার ক্ষেত্র, সেটা তার প্রতিক্রিয়া, যার ভেতর সে যে কোনো বিচার থেকে আত্মরক্ষার জন্য ঢালরূপে ব্যবহার করে, অবশ্য সেটা তার নিজের। অধিকতর মহৎ জীবন তার কাছে অন্য জীবন বলে মনে হতে পারে না। সেটা অন্যায় হবে না। এমনকি আমি বলছি না যে, এখানে সেই তুচ্ছ চিরন্তনতা যাকে বলা হবে উত্তরপুরুষ বা উত্তরকালীন। ম্যাডাম রোলা তাঁর মন্তব্যকে উদ্ধৃতি দিয়ে খুশি হয় কিন্তু বিচার করতে ভুলে যায়। ম্যাডাম রোলা উত্তরপুরুষ সম্পর্কে উদাসীন 1

নীতিকে সামনে ধরে রাখার ওপর কোনো প্রশ্নই হতে পারে না। মহান আদর্শ নিয়ে লোকেদের খারাপ ব্যবহার করতে আমি দেখেছি এবং নোট রেখেছি যে, ঐক্যের কোনো রীতিনীতির প্রয়োজন নেই। থাকে কেবল একটি আদর্শরীতি (Code) যা অ্যাবসার্ড মানুষটি গ্রহণ করতে পারে, একজন যাকে ঈশ্বরের থেকে আলাদা করা যায় না : একজন যাকে নির্দেশ করা হয়। কিন্তু এ এতই ঘটে যে, সে সেই ঈশ্বরের থেকে বাইরেই থাকে। যেমন অন্যদের ক্ষেত্রে (আদর্শহীনতারও কথা বলতে চাইছি), তাদের মধ্যে অ্যাবসার্ড মানুষটি কিছুই দেখে না কেবল ন্যায় ব্যবস্থা এবং তাকে কোনোকিছুই বিচার করতে হয় না। তার সারল্যের আদর্শ থেকে এখানে শুরু করি।

সেই সরলতাকে ভীত হতে হয়। ‘সবকিছুই অনুমতি পায়’ ইভান কারামাজোভ বিস্ময় প্রকাশ করে। সেটাও অ্যাবসার্ডের আভাস। কিন্তু শর্ত থাকবে এই কুৎসিত অর্থে একে নেওয়া হবে না। যাই হোক, এ যথেষ্টরূপে দেখিয়ে দেয়, আমি জানি না যে, এ মুক্তি বা আনন্দের বিস্ফোরণ নয় বরং এ ঘটনার এক তিক্ত পরিচয়। অব্যাহতি নিয়ে খারাপভাবে আচরণ করার ক্ষমতার আকর্ষণতায়, বহুদূর অতিক্রম করে ঈশ্বরের নিশ্চয়তার জীবনকে এক অর্থ দেয়। পছন্দটা এ তৈরি করতে কঠিন হবে না। কিন্তু কোনো পছন্দ করার নেই এবং তা যেখানে তিক্ততা প্রবেশ করে। অ্যাবসার্ড স্বাধীন করে না, অ্যাবসার্ড বেঁধে রাখে। সব কাজেই কর্তৃত্ব করে না। অনুমতি দেয় সবকিছুকে—তার মানে এ নয় যে, কোনো কিছুই নিষিদ্ধ নয়। সেই সব কাজের ফলাফলের ওপরেই শুধু অ্যাবসার্ড এক সমত্বকে তুলনা করে। এ অপরাধকে সুপারিশ করে না, কারণ এ হয়ে উঠবে শিশুসুলভ; কিন্তু এর ব্যর্থতায় অনুশোচনা করে এবং পুনঃসঞ্চয় করে। একইভাবে যদি সব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে উদাসীন হয়, তবে কর্তব্য অন্যদের মতো আইনসম্মত। খেয়ালবশে একজন হতে পারে নির্দোষ, ধার্মিক।

আদর্শের সবরীতি ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, সব কাজের রয়েছে ফল যা হয় আইনসম্মত করে অথবা বাতিল করে। অনুপ্রাণিত হয় অ্যাবসার্ডের সঙ্গে মন, সেই মন শুধু বিচার করে যে, ঐসব ফল অবশ্যই শান্তভাবে বিবেচিত হবে। মূল্য দিতে প্রস্তুত। অন্যথায়, হতে পারে দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিন্তু একজনও অপরাধী নেই, এর মতের ভিত্তিতে। এরূপ বিশেষ ক্ষেত্রে এর ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার জন্য মন অতীত অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি হবে। সময় দীর্ঘায়িত করবে সময়কে এবং জীবন সেবা করবে জীবনকে। এই ক্ষেত্রে সেটি হবে উভয় ক্ষেত্রে সীমিত এবং সম্ভাবনার সঙ্গে প্রসারিত, তার নিজেরই ভেতর রয়েছে সবকিছু, স্বচ্ছতা ব্যতিরেকে, তার কাছে মনে হয় অচিন্তনীয়। তবে কোনো নিয়ম অযৌক্তিক আদেশ থেকে উদ্ভূত হতে পারে? যা প্রচলিত নয় কেবল সেই সত্যই হতে পারে তার কাছে উপদেশাত্বক : এ জীবনের কাছে আসে এবং মানুষের ভেতর খুলে দেয়। এর যুক্তিতর্কের শেষে অ্যাবসার্ড মন এতটা নৈতিক নিয়ম আশা করতে পারে না, বরং আশা করে মানব জীবনের চিত্র ও নিঃশ্বাসের মতো। কিছু অনুসরণকারী মূর্তি এ ধরনের। এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ ও তাদের উষ্ণতা দিয়ে তারা অ্যাবসার্ড যুক্তিকে দীর্ঘায়িত করে।

এ ধারণাটা উন্নত করার আমার প্রয়োজন কি, একটা উদাহরণ প্রয়োজনীয় রূপে উদাহরণ যা অনুসরণ করা হবে (এমনকি এত কম যদি অ্যাবসার্ড জগতে সম্ভব না) এবং ঐসব চিত্র যেহেতু মডেল নয়? এই ঘটনা ছাড়া এর জন্য এক নির্দিষ্ট সাফল্যের প্রয়োজন, একজন হয়ে ওঠে উপহাসের পাত্র, সব সুবিধে সত্ত্বেও, রুশোর থেকে এনে সিদ্ধান্ত টানে, একজন অবশ্যই চারপাশে হাঁটবে এবং নিৎসে থেকে একজন তার মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে। ‘এ অ্যাবসার্ড হয়ে ওঠা জরুরি,’ একজন আধুনিক লেখক লেখে, ‘একজন প্রতারিত ব্যক্তি হয়ে ওঠা জরুরি নয়।’ আমি যে দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যবহার করব তা তাদের অসঙ্গত বিবেচনার ভেতর দিয়ে তাদের সমগ্র অর্থকে ধারণা করতে পারবে। পোস্ট অফিসের একজন সাব-ক্লার্ক একজন বিজয়ীর সমান হয় যদি চেতনা তাদের কাছে সাধারণ হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সব অভিজ্ঞতা নিরাসক্ত। কিছু আছে যা সেবা হিসেবে বা সেবা নয় এমনই মানুষের কাছে কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। যদি সে সচেতন হয় তবে তারা তার জন্য কাজ করে। অন্যথা, তার কোনো গুরুত্ব নেই একজন মানুষের ব্যর্থতা সমার্থক হয়ে ওঠে বিচারের সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে নয়, তা নিজেরই সঙ্গে।

আমি সম্পূর্ণভাবে মানুষকে পছন্দ করছি যারা নিজেদেরই কেবল ব্যয় করার লক্ষ্য রাখে অথবা যাদের আমি দেখছি নিজেদের ভেতর ব্যয়িত হচ্ছে। তা আর বেশিদূর প্রয়োগ হয় না। মুহূর্তের জন্য আমি কেবল জগতের কথা বলতে চাই যাতে জীবনের মতো ভাবনা নাকচ করে ভবিষ্যৎকে। সবকিছু মানুষকে কাজের করে তোলে এবং আমাকে ব্যবহার করার জন্য উত্তেজিত করে তোলে। সম্পূর্ণ ভাবনাটা মিথ্যে নয়, যেহেতু ভাবনাটা বন্ধ্যা ভাবনা। অ্যাবসার্ড জগতে ধারণার মূল্য অথবা জীবন মাপা হয় এর বন্ধ্যাত্ব দিয়ে।

ডন জুয়ানবাদ

যদি ভালোবাসার ইচ্ছেটি যথেষ্ট হতো, বস্তু হয়ে যেত খুবই সহজ। অধিকতর শক্তিকে একজন আরো ভালোবাসে যার থেকে অ্যাবসার্ড বেড়ে যায়। ভালোবাসার খামতির ভেতর দিয়ে নয় যে, ডন জুয়ান একজন স্ত্রীলোকের থেকে আরেক স্ত্রীলোকের কাছে যায়। সমগ্র ভালোবাসার অনুসন্ধানে রহস্যময় হিসেবে তাকে উপস্থিত করে যা উপহাস্যাস্পদ। কিন্তু এ সত্যই কারণ একই কামনা দিয়ে তাদের সে ভালোবাসে এবং প্রতিবারেই তার সমগ্রসত্তা দিয়ে যা তার উপহার তার গভীর অনুসন্ধান দিয়ে অবশ্যই সে পুনরাবৃত্তি করে। যখন প্রতিটি রমণী তাকে দেবার জন্য আশা করে যা কেউই এ পর্যন্ত তাকে দেয়নি। প্রতিবারই তারা পুরোদস্তুর ভুল এবং কেবল সেই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজনকে কোনো রকমভাবে তাকে অনুভব করায়। ‘অবশেষে’, তাদের মধ্যে একজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়েছি।’ আমরা কি অবাক হতে পারি যে, ডন জুয়ান একে উপহাস করে? ‘অবশেষে? না,’ সে বলে, ‘কিন্তু আরো একবার।’ আরো বেশি ভালোবাসার উদ্দেশ্যে দুর্লভরূপে একে ভালোবাসা জরুরি রকম উচিত কেন?

ডন জুয়ান কি বিষণ্ন? সম্ভবত নয়। কেবল কিংবদন্তির দিকে প্রবহমানতা আমার থাকবে। সেই উপহাস ঔদ্ধত্যকে জয় করে, থিয়েটারের সেই অভিনয়ময়তা ও ভালোবাসা সবই পরিচ্ছন্ন ও আনন্দের। প্রতিটি স্বাস্থ্যবান প্রাণী নিজেকে বহুগুণে বাড়াতে মনোযোগী। সুতরাং এ রয়েছে ডন জুয়ানের সঙ্গে। কিন্তু আরো বেশি বিষণ্ণ মানুষের এরূপ সত্তার জন্য দুটো যুক্তি রয়েছে : তারা জানে না বা তারা আশা করে। ডন জুয়ান জানে এবং আশা করে না। স্মরণ করিয়ে দেয় সেই শিল্পীদের একজনকে যে জানে তাদের সীমা, তাদের বাইরে কখনো যায় না এবং সেই দৈবাধীন বিরতিতে যার ভেতর তারা তাদের আত্মিক স্থিতিকে গ্রহণ করে, সেই বিরতিতে উপভোগ করে কীর্তিমানদের বিস্ময়কর সহজতাকে এবং সেটাই প্রকৃত প্রতিভা : বৌদ্ধিক যা এর সম্মুখকে জানে। শারীরিক মৃত্যুর প্রান্ত পর্যন্ত ডন জুয়ান হচ্ছে বিষণ্নতার অজ্ঞতা। মুহূর্তটিকে সে জানে, ফেটে পড়ে সামনে তার হাসি, একজনকে করে তোলে এমনই যে, সবকিছুকে ক্ষমা করে। যে সময় সে আশা করেছিল তখনই সে হয়ে ওঠে বিষণ্ণ। আজ, সেই রমণীর মুখে বুঝতে পারে কেবল জ্ঞানের তিক্ত ও আরামপ্রদ স্বাদ। তিক্ততা? সবেমাত্র : সেই প্রয়োজনীয় অসম্পূর্ণতা সুখের প্রতীতি তৈরি করে।

ডন জুয়ানে দেখার চেষ্টা করাটা ভুল যে, একজন মানুষ বড় হয়ে ওঠে যাজকীয়তার (Ecclessiastes) ওপর। অন্য জীবনের আশা ছাড়া শুধু শুধু তার অহঙ্কারে। এটা সে প্রমাণ করে কারণ স্বর্গের বিরুদ্ধে যে জীবন নিজে তাকে নিয়ে অন্য জীবনের জন্য জুয়া খেলে। কামনায় বেঁচে তুষ্টির ফলে হত্যা করা হয়, অক্ষম মানুষটির সেই সাধারণ জায়গায় আর সে থাকে না। ফাউস্টের জন্য সব ঠিক আছে, ফাউস্টের ঈশ্বরের ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস আছে, সে নিজেকে শয়তানের কাছে বিক্রি করে। তবে ডন জুয়ান বস্তু হিসেবে অধিকতর সরল। মলিনার ‘বুরলেডোর’ নরকের শাসানিতে এ পর্যন্ত তার উত্তর : ‘তুমি কতটা দীর্ঘ অবসর আমায় দেবে।’

মৃত্যুর পর কী আসে, ব্যর্থতা এবং কত দীর্ঘদিনের পরম্পরায় কে জানবে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়। পার্থিব বস্তুকে প্রার্থনা করে ফাউস্ট, গরিব লোককে কেবল সরাসরি হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। যখন সে একে খুশি করতে অসমর্থ সে সময় ইতিমধ্যে তার আত্মাকে বিক্রি করাতে হিসেব করে। অপরদিকে সতীত্ব সম্পর্কে, তার ওপর ডন জুয়ান জোর দেয়। যদি সে কেবল তাকে কামনা করা বন্ধ করেছে। সুন্দরী রমণী সব সময়ই কামনীয়। কিন্তু সে অন্য একজনকে কামনা করে বা না করে, তা একই জিনিস নয়।

তার প্রতিটি ইচ্ছে এই জীবনকে খুশি করে এবং একে হারানো এর চেয়ে খারাপ কিছু হয় না। এই পাগল লোকটি একজন মহান জ্ঞানী ব্যক্তি। কিন্তু যে মানুষ আশায় বাঁচে, এই বিশ্বে তারা উন্নতি করে না, এই বিশ্ব যেখানে দয়া মেনে নেয় উদারতা, পৌরুষ নীরবতায় রয়েছে স্নেহ ভালোবাসা এবং একক সাহসের প্রতি বন্ধুত্ব এবং সবাই তাড়াতাড়ি বলে : ‘সে একজন দুর্বল, একজন আদর্শবাদী অথবা একজন সন্ত।’ একজন তার মহত্ত্বকে মর্যাদা দেয় না যার ফলে সে অসম্মানিত হয়।’

লোকেরা যথেষ্ট বিরক্ত (অথবা মৃদু হাসে যা জটিল মৃদু হাসি, এ হাসি যা তাকে প্রশংসা করে সেটা খারাপ করে) ডন জুয়ানের বক্তৃতায় এবং সেই একই মন্তব্য যা সে সব রমণীর ওপর ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো একজন যে তার আনন্দের পরিমাণ খোঁজে, কেবল একটা জিনিস যা বাস্তবায়িত হয় তা হলো অভীষ্ট। সংকেত শব্দের জটিল ব্যবহারটা কী যা পরীক্ষাকে দাঁড় করিয়েছে? কেউই নয়, না রমণী না পুরুষ কেউ তাদের শোনে না, বরং কণ্ঠস্বরটি শোনে যে তাদের উচ্চারণে করে। তারা হলো নিয়ম, রীতি ও সৌজন্য। তাদের বলা হলে তখনো সম্পাদন করাটা বাকি থাকে। ইতিমধ্যে এর জন্য ডন জুয়ান প্রস্তুত। আদর্শের ক্ষেত্রে সে নিজেকে কেন সমস্যায় জড়ায়? সে তো আর মিলোজের মানাবার মতো নয়, একজন সন্ত হওয়ার জন্য কামনার ভেতরে নিজেকে ঘৃণ্য বলে ঘোষণা করে। তার জন্য নরক, আর সেটা তাকে প্ররোচিত করে। দৈব ক্ষোভের প্রতি তার কিন্তু একটা উত্তর রয়েছে এবং তা হলো মানব সম্মান : ‘আমার সম্মান আছে,’ কমান্ডারের প্রতি সে বলে, ‘আর আমি আমার শপথ রেখেছি কারণ আমি একজন যোদ্ধা।’ কিন্তু এ শুধু হয়ে ওঠে এক মহান ভুল, তাকে আদর্শহীন করে তোলে। এক্ষেত্রে, সে ‘অন্য সবার মতো’ : পছন্দের ও অপছন্দের এক নৈতিক রীতি তার রয়েছে। ডন জুয়ানকে ঠিকমতো বুঝতে পারা যাবে কেবল অবিরাম উদাহরণের সাহায্যে যা সাধারণভাবে প্রতীকী করে তোলে : সাধারণ ধর্ষণকারী এবং যৌন ক্রীড়াবিদ। সে একজন সাধারণ ধর্ষণকারী।[১৬] আলাদা হওয়া ছাড়া সে সচেতন কেননা সে অ্যাবসার্ড। একজন ধর্ষণকারী পরিচ্ছন্ন হয়েছে বলে সে সবকিছুর জন্য পরিবর্তন করবে না। ধর্ষণ করাটা তার জীবনের শর্ত। কেবল উপন্যাসেই একটি অবস্থাকে বা শর্তকে পরিবর্তন করে অথবা ভালো করে। তবু বলতে পারা যাবে যে, একই সময়ে কোনো কিছু পরিবর্তন হবে না এবং সবকিছু রূপান্তরিত হয়। কাজের ভেতর ডন জুয়ান বোঝে তা হলো পরিমাণগত নান্দনিকতা, বিপরীতক্রমে সন্ত যেখানে গুণকে যত্ন করে, বস্তুর গভীর অর্থকে বিশ্বাস না করাটা অ্যাবসার্ড মানুষের অধিকার। ঐসব আন্তরিক অথবা বিস্ময়াভূত মুখাবয়বের বিষয়ে, সে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে, সংরক্ষণ করে তাদের এবং তাদের ওপর স্বল্প বিরতি দেয় না। তাদের সঙ্গে সময় তুলে রাখে। অ্যাবসার্ড মানুষটিই সে যাকে সময়ের থেকে আলাদা করা যায় না। ডন জুয়ান উপাসনারত রমণীদের কথা ভাবে না। তাদের সংখ্যা সে শেষ করে ফেলে এবং তার সঙ্গে জীবনের সুযোগও দুঃখকে সে বাতিল করে, বাতিল করে আশার অন্য রূপকে। পোর্ট্রেটের দিকে তাকাতে সে অক্ষম।

সবকিছুর জন্য সে কি স্বার্থপর? সম্ভবত তার পথে। কিন্তু এখানেও, একজন আরেকজনকে বোঝাটা জরুরি। তারা যারা বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্ট হয়েছে এবং তারা যারা ভালোবাসার জন্য। কমপক্ষে ডন জুয়ান এরূপ বলার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু কয়েকটি শব্দের ভেতর সে করত যেমন তার পছন্দ করার সামর্থ্য। কারণ ভালোবাসা যা আমরা এখানে বলেছি, একে চিরন্তনতার অধ্যায়ে আবরিত রাখা হয়। যেমন কামনায় সব বিশেষজ্ঞরা আমাদের শিক্ষা দেয় কোনো চিরন্তন ভালোবাসা বলে কিছু নেই, তবে কি আমাদের বাধা দেয়। সংগ্রাম ছাড়া কোনো কামনা দুর্লভ। চূড়ান্ত মৃত্যুর বিরোধিতায় এ রকম এক ভালোবাসা শীর্ষে উঠতে পারে। একজন অবশ্যই হবে ওয়েরদার (Werther) বা কিছুই নয়। তারপরও রয়েছে বহু ধরনের আত্মহত্যা, কোনো এক সামগ্রিক উপহার এবং আত্মবিস্মরণতা। ডন জুয়ান এবং কোনো একজন জানে যে, এটি আলোড়িত হতে পারে। তবে অন্তত কয়েকজনের মধ্যে সে একজন যে জানে এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। সে শুধু আরো ভালো জানে যে, এক মহান ভালোবাসার ভেতর দিয়ে সব ব্যক্তিগত জীবন থেকে তারা দূরে চলে যায়, সেই মহান ভালোবাসা তাদের নিজেদের ধনী করে সম্ভবত তবে নিশ্চিতরূপে তাদের মানিয়ে নেয়, তাদের ভালোবাসাকে পছন্দ করে নিয়েছে। মা অথবা স্ত্রীর প্রয়োজনীয় রূপে রয়েছে এক ঘনিষ্ঠ হৃদয়, কারণ জগৎ থেকে একে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ আলাদা এক ভালোবাসা ডন জুয়ানকে বিরক্ত করে এবং এটি স্বাধীন করছে। এ নিয়ে আসে জগতে সব মুখ এবং এর কম্পন সত্য থেকে আসা, এ নিজেই জানে মরণশীল হতে। ডন জুয়ান শূন্য হওয়াটাই পছন্দ করেছে।

তার জন্য এ হলো স্পষ্টভাবে দেখা। আমরা ভালোবাসা বলি যা বিশেষ প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের কেবল বেঁধে রাখে, দৃষ্টান্তস্বরূপ এ হলো যৌথভাবে দেখা। এ দেখার জন্য দায়ী বই ও কিংবদন্তি কাহিনী। কিন্তু ভালোবাসার আমি যা জানি তা হলো কামনা, স্নেহ এবং বুদ্ধির মিশ্রণ যা আমাদের সঙ্গে এই বা ঐ প্রাণীকে বেঁধে রাখে। অন্য ব্যক্তির জন্য সেই উপাদানই একই নয়। একই নামের সঙ্গে ঐসব অভিজ্ঞতাকে বলার অধিকার আমার নেই। একই অভিব্যক্তি নিয়ে তাদের সঙ্গে আচরণ করা থেকে একজনকে এ ছাড় দেয়। অ্যাবসার্ড মানুষ এখানে আবার বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় যা সে একত্রিত করতে পারে না। এভাবে সে সত্তার এক নতুন পথ আবিষ্কার করে, সেই পথ তাকে মুক্তি দেয় কমপক্ষে যারা তার কাছে আবেদন জানিয়েছিল ততটা এ তাদের মুক্ত করে। কোনো মহৎ ভালোবাসা নেই কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী ও ব্যতিক্রম উভয় ক্ষেত্রে নিজেকে চেনায়। ঐসব মৃত্যু এবং ঐসব পুনর্জন্ম একত্রে জমা হয় যেন এ এক আঁটি, ডন জুয়ানকে সাজায় তার জীবনের ফুল দিয়ে। এ হলো তার দেবার রীতি এবং স্পষ্ট করে তোলা। একে আমি সিদ্ধান্ত নিতে দিই, তা যাই হোক না কেন একজন স্বার্থপরতার কথা বলতে পারে।

এই বিষয়ে আমি মনে করি যারা সম্পূর্ণভাবে প্ররোচিত করে ডন জুয়ানকে শাস্তি দেওয়া হোক। কেবল অন্য জীবনেই নয়, এমনকি এই ক্ষেত্রেও। ঐসব গল্প, কিংবদন্তী উপাখ্যান এবং প্রহসন বয়স্ক ডন জুয়ান সম্পর্কে মনে করি। কিন্তু ডন জুয়ান ইতোমধ্যেই প্রস্তুত। একজন সচেতন মানুষের কাছে বুড়ো মানুষ এবং যা পূর্ব লক্ষণ দেখায় তা বিস্ময়কর নয়। বাস্তবিকই সে যতটা সচেতন নিজের ভেতরে ততটাই নিজের ভেতর থেকে এর আতঙ্ককে চাপা দিয়ে রাখে না। এথেন্সে এক মন্দির রয়েছে যা বৃদ্ধদের জন্য উৎসর্গিত। শিশুদের সেখানে নেওয়া হয়। ডন জুয়ানের ক্ষেত্রে, বহু মানুষ তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করে, আরো শারীরিক অবয়ব নিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। বাতিল করে একজনকে, তাকে ধার দেয় রোমান্টিকতা। সেই পীড়ন কেউই তাকে নিয়ে তামাশা বা বিদ্রূপ করে না, সমব্যথী হয়ে ওঠে ডন জুয়ান। তাকে সমবেদনা জানানো হয়; স্বর্গ নিজে তাকে পুনরুদ্ধার করবে কি? কিন্তু সেটা এ নয়। বিশ্বে ডন জুয়ানের রয়েছে এক ঝলক দেখা, উপহাসও এর ভেতর যোগ করা হয়। সংযমী হয়ে একে সে স্বাভাবিক বলে মনে করে। সেটাই খেলার নিয়ম এবং বাস্তবিক। খেলার এসব নিয়ম বলে মেনে নেওয়াটা এক ধরনের মহত্ত্ব। তবুও সে জানে, সে ঠিক এবং সে ক্ষেত্রে শাস্তির কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। নিয়তি কোনো শাস্তি নয়।

সেটা তার অপরাধ এবং কত সহজে এ বুঝতে হবে কেন ঈশ্বরের মানুষেরা তার মাথার ওপরে শাস্তি কামনা করে। অধ্যাস বা ভ্রম ছাড়া সে জ্ঞান আহরণ করে, অধ্যাস সে যা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে সবই বাতিল করে। ভালোবাসা, অর্জন, বিজয় এবং ভোগ—তা হলো তার জানার পথ (সেই প্রিয় শাস্ত্রীয় শব্দ যাকে বলে ‘জানা’র শারীরিক প্রক্রিয়া তার গুরুত্ব রয়েছে)। এলাকাতে সে তাদের পরম শত্রু, আর সে তাদের সম্পর্কে অজ্ঞ। ধারাবিবরণকারী লেখক জুড়ে দেয় সত্য ‘বারলেডর’ (Burlador) ফ্রান্সিসকেন কর্তৃক নিহত, সে চেয়েছিল ডন জুয়ানের অতিরিক্ত এবং ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের (blasphemies) ভেতর শেষ করতে। ডন জুয়ানের জন্ম তাকে শাস্তি থেকে অব্যাহতির আশ্বাস দিয়েছিল। তারপর তারা আঁকড়ে ধরে সে স্বর্গ তাকে আঘাত করে নিচে নামায়। কেউই প্রমাণ করেনি সেই অদ্ভুত সমাপ্তি অথবা কেউই প্রমাণ করেনি বিপরীতটিও। কিন্তু ঘোরাঘুরি না করে এ যদি সম্ভব হয়, আমি বলতে পারি যে এ যৌক্তিক। এই ক্ষেত্রে আমি কেবল চাই একটিমাত্র শব্দ ‘জন্ম’ এবং শব্দ নিয়ে খেলা চালাতে : এ ছিল জীবনের ঘটনা যে নিশ্চিত করে তার সরলতাকে। এ কেবল মৃত্যু থেকে সে বিশ্লেষণ করে এক অপরাধ, সেটা কিংবদন্তী হয়ে ওঠে।

কি করে যে পাথর নির্দেশক (Commander) চিহ্নিত করে বোঝায়; যা ভাবতে সাহস করেছিল সেই শীতল মূর্তি ডুবে যাওয়ার সময়ে দুর্জয়তাকে শাস্তি দিতে? চিরন্তন যুক্তির সব শক্তি, আদেশ, বৈশ্বিক আদর্শ, সব দেবতার বাইরের মহানত্ব ক্ষোভের দিকে খুলে যায়, আর সেইসব তার নিজের ভেতর অন্তঃসারিত করে। সেই দৈত্যকার এবং অন্তহীন প্রাণ কেবলই শক্তিগুলোকে প্রতীকী করে তোলে, যা চিরকালের জন্য ডন জুয়ান বাতিল করে। কিন্তু কমান্ডারের অভিযান সেখানে বন্ধ হয়। বজ্র ও বিদ্যুৎ নকল স্বর্গের দিকে ফিরতে পারে যখন তাদের নিয়োগ করা হয়। তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে প্রকৃত ট্র্যাজেডি জায়গা করে নেয়। না, এ পাথরের হাতের অধীনে নয় যে তার মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ডন জুয়ানের। এই কিংবদন্তী সাহসিকতায় বিশ্বাস করায় আমাকে আনত করে, সেই স্বাস্থ্যবান মানুষটির সেই পাগল অট্টহাসি প্ররোচিত করে এক অনাস্তিত্ব ঈশ্বর। কিন্তু, সর্বোপরি আমি বিশ্বাস করি যে, সেই সন্ধ্যায় যখন ডন জুয়ান আন্নার বাড়িতে অপেক্ষা করে, কমান্ডার তখনো আসেনি এবং মধ্য রাত্রির পর ব্লাসফেমার অবশ্যই অনুভব করেছে তাদের ভয়ঙ্কর তিক্ততা যারা ঠিক ছিল। এমনকি আমি আরো তৈরি হয়ে তার জীবনের হিসেবকে গ্রহণ করেছি যা আগেই সে নিজেকে মাঠের ভেতর সমাহিত করে। শুধু তাই নয়, গল্পের নির্মীয়মাণ দৃষ্টিকোণ সম্ভবত বিবেচিত হতে পারে। ঈশ্বরের কাছে জানতে চাইতে পারে কি সে কোন আশ্রয়ে যাবে? তবে এ জীবনের যৌক্তিক ফলকে বরং প্রতীকী করে তোলে। সম্পূর্ণভাবে এই জীবন অনুপ্রাণিত করে অ্যাবসার্ডের সঙ্গে, অস্তিত্বের ভয়ানক সমাপ্তি ক্ষণস্থায়ী আনন্দের দিকে ফেলে। এই ক্ষেত্রে সংবেদজ তৃপ্তি কঠোর তপস্যায় ভেসে যায়। এ বোঝাটা জরুরি, বলতে গেলে তারা হতে পারে একই নিঃসঙ্গতার দুটি দৃষ্টিকোণ। একজন মানুষের তার শরীরের বিশ্বাসঘাতকতার চেয়েও আরো ভয়ানক মূর্তিকে কতটা স্মরণ করতে পারে, এর কারণ সময়মতো সে মরেনি, কৌতুকের থেকে বেঁচেছে যখন সমাপ্তির জন্য অপেক্ষা করে, সেই ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়, ভক্তি করে না, সেবা করে যেমন সে জীবনকে সেবা করে, হাঁটু গেড়ে বসে এক শূন্যতার কাছে, নীরবে হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় স্বর্গের দিকে। এসব গভীরতা ছাড়া এই হয়ে ওঠাটা সে জানে?

আমি ডন জুয়ানকে দেখি পাহাড়ের চুড়োয় স্পেনীয় মঠগুলোর এক প্রকোষ্ঠে হারিয়ে যেতে। আর যদি সে আদৌ কিছু অবলোকন করে, এ অতীত ভালোবাসার প্রেতাত্মা, সম্ভবত, রোদে পোড়া দেয়ালের সরু ফালির ভেতর দিয়ে, কিছু স্পেনীয় সমতল, মহৎ আত্মাহীন ভূমির ভেতর সে নিজেকে চেনে। হ্যাঁ, এই বিষণ্ণতা, উজ্জ্বল মূর্তির যাতে অবশ্য যবনিকা নেমে আসে। চূড়ান্ত সমাপ্তি, অপেক্ষা করে কিন্তু কখনো কামনা করে না, চূড়ান্ত শেষটা নগণ্য।

নাটক

হ্যামলেট বলে, “নাটক এমনই এক জায়গা (thing) যে জায়গাতে আমি রাজার বিবেককে ধরব।’ ধরা বাস্তবিকই একটি শব্দ। কারণ বিবেক দ্রুত সরে যায় বা এ নিজের ভেতরই তুলে নেয়। উইংয়ের ওপর একে ধরতে হবে, সেই ধরার শূন্য মুহূর্তে যখন ঝলক দৃষ্টি ফেলে নিজে নিজে ক্ষণস্থায়ী রূপে। প্রতিদিনকার মানুষ গড়িমসিকে উপভোগ করে না। অপরদিকে সবকিছুই তার দিকে ব্যস্ত করে তোলে। কিন্তু একই সময়ে নিজেকে ছাড়া আর কোনো কিছুরই প্রতি তাকে উৎসাহিত করে না, বিশেষ করে তার সক্ষমতাগুলো। যখন থিয়েটারে প্রদর্শনীতে তার উৎসাহ, যেখানে এত বেশি ভাগ্য তার কাছে মেলে ধরে, বেদনা অনুভব ছাড়া সে ক্ষেত্রে সে কবিতাকে পছন্দ করতে পারে। নিদেনপক্ষে ভাবনাহীন মানুষকে চিনতে পারা যায় এবং সে কিছু আশা বা অন্য কিছুর দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়াটা থামায় না। একজন মানুষ যে জায়গায় ছেড়ে যায় সেখান থেকেই অ্যাবসার্ড মানুষটি শুরু করে, যেখানে নাটকের প্রশংসা বন্ধ করে দেয়, মন এর ভেতর প্রবেশ করতে চায়। এইসব জীবনে প্রবেশ করে, তাদের বিচ্ছিন্নতায় তাদেরই অভিজ্ঞ করে, হিসেব কষে অভিনয়ে প্রকাশ করে। আমি বলছি না যে, সাধারণভাবে অভিনেতারা সেই আবেগকে বা প্রেরণাকে মান্য করে, তারা অ্যাবসার্ড মানুষ, কিন্তু তাদের ভাগ্য হলো এক অ্যাবসার্ড ভাগ্য তা মোহিত করতে পারে এবং আকর্ষণ করতে পারে কোমল হৃদয়কে। ভুল বোঝাবুঝি যা অনুসরণ করবে তা আঁকড়ে ধরার উদ্দেশ্যে একে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি।

অভিনেতার রাজ্য তা হলো অল্পস্থায়ী। সব ধরনের খ্যাতি, এটা জানা; তারটি স্বল্পস্থায়ী। কমপক্ষে কথোপকথনে এ বলা হয়। কিন্তু সব ধরনের খ্যাতিই স্বল্পস্থায়ী। সিরিউসের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্যয়টের লেখা দশ হাজার বছরের মধ্যে সবই ধুলো হয়ে যাবে অথবা ভুলে যাবে। সম্ভবত খোঁজ করবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের একরাশ ‘প্রমাণের’ জন্য যেমন আমাদের যুগে হয়। সেই ধারণা সব সময় এক শিক্ষাকে ধারণ করে রেখেছে। অনুধাবন করা হয় দারুণভাবে, গভীর মহত্ত্বের দিকে আমাদের উদ্বিগ্নতা কমে যায়, দেখা যায় তার ভেতরে উদাসীনতা। সর্বোপরি, যার ভেতর নিশ্চয়তা রয়েছে তার দিকে আমাদের সমর্থনকে পরিচালিত করে, তা হলো এখনই যা রয়েছে তার দিকেই। সব রকম খ্যাতির কম প্রতারণার একটি হলো যার ভেতর একে বাঁচানো হয়।

অতঃপর অভিনেতাটি বহুগুণ খ্যাতি পছন্দ করেছে, সেই খ্যাতি মিথ্যা ও পরীক্ষিত। কোনো একদিন ঘটনা থেকে সব কিছুকেই মরতে হয়, তো সে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত সে টানে। একজন অভিনেতা সফল হোক বা না হোক। একজন লেখকের কিছু আশা থাকে এমনকি যদি সে সফল নাও হয়। সে ধরে নেয় যে, তার লেখা সে কী ছিল তার সাক্ষ্য বহন করবে। শ্রেষ্ঠ অভিনেতাটি আমাদের জন্য একটা ফটোগ্রাফ রেখে গেছে এবং সে নিজে কী ছিল তার কিছু অবশ্যই এ নয়। তার অভিব্যক্তি ও তার নীরবতা, তার আঁকড়ে ধরা ভালোবাসার সঙ্গে তার আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছোটা, সবই আমাদের কাছে নেমে আসা। তার জন্য, তাকে না জানানোটা অভিনয় করা নয় এবং অভিনয় না করা সব প্রাণী সমেত শতবার মরে যাচ্ছে না, নিয়ে আসবে সে জীবনে বা পুনরুজ্জীবিত করবে।

আমরা কেন এক ক্ষণস্থায়ী খ্যাতি দেখে অবাক হব যা সৃষ্টির স্বল্প সময়ের ওপর সৃষ্টি? অভিনেতার ইয়াগো বা আলয়েস্টে, ফেডার বা গ্রুপেস্টার হয়ে ওঠার জন্য রয়েছে তিনঘণ্টা সময়সীমা। সেই অল্প সময়সীমার ভেতর সে তাদের তৈরি করে জীবনে আসার এবং পঞ্চাশ বর্গফুটের ওপর মরতে। অ্যাবসার্ড কখনো এত সুন্দরভাবে চিত্রিত হয় না এবং এ রকম দৈর্ঘ্যতার ভেতরও নয়। স্টেজ সেটের ভেতরে ঐসব চমৎকার জীবন, ঐসব ব্যতিক্রমী ও সমগ্র নিয়তি কয়েক ঘণ্টার জন্য মেলে ধরা অপেক্ষা আর কত উন্মোচিত মর্মার্থ কল্পনা করা যেতে পারে? মঞ্চের বাইরে, সিগিসমুণ্ডো হিসেব বন্ধ করে দেয়। দু’ঘণ্টা পরে তাকে দেখা যাবে বাইরে কোথাও খেতে। তারপর সম্ভবত এ হয়ে যাবে সেই জীবন এক স্বপ্ন। কিন্তু পরে সিগিসমুণ্ডো অন্য হয়ে আসে। নিশ্চয়তা থেকে নায়কের কষ্ট প্রতিশোধের জন্য হয়ে ওঠে মানুষের গর্জন। শতাব্দী শতাব্দী এবং মনগুলো সাফসুফ করে এভাবে, যেমন সে হতে পারে মূকাভিনেতা এবং যেমন সে রয়েছে, অন্য অ্যাবসার্ড ব্যক্তির সঙ্গে অভিনেতার রয়েছে অনেক মিল, ভ্রমণকারী। তারই মত, কিছু সে নিষ্কাশিত করে এবং অবিরাম চলার ভেতর থাকে। কালক্রমে হয়ে ওঠে এক ভ্রমণকারী, কারণ সবচেয়ে ভালো, শিকারি ভ্রমণপিপাসু আত্মাদের দ্বারা অনুসারিত হয়। যদি এ পর্যন্ত পরিমাণগত নৈতিক সততার পুষ্টতা দেখতে পাওয়া যায়, বাস্তবিকই এ সেই অদ্ভুত মঞ্চ। কোন স্তরে অভিনেতাটি চরিত্রগুলো থেকে উপকার করে তা বলা শক্ত। তবে সেটা বড় কথা নয়। এ কেবল জানার ব্যাপার যে, কতটা ঐসব অরূপান্তরযোগ্য জীবনগুলোর সঙ্গে সে নিজেকে মেলাতে পারে। এ প্রায়ই ঘটে, তাদের সে তার সঙ্গে বহন করে, যেখানে তারা জন্মায় সে সময় ও স্থানকে তারা উপচে দেয় কিছু। তারা অভিনেতাকে সহযোগিতা করে, অভিনেতা যেখানে ছিল যে অবস্থায় রয়েছে তার থেকে নিজেকে সঙ্গে সঙ্গেই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। ঘটনাক্রমে তার আয়নার কাছে পৌঁছে তার পেয়ালাটি তুলে হ্যামলেটের অভিব্যক্তিকে পুনরায় রপ্ত করে। না, প্রাণীদের থেকে দূরত্ব তাকে আলাদা করে, এর ভেতরই সে জীবনকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, তবে তা ততটা মহান নয়। প্রতিমাসে সে প্রতিদিন সে অজস্র চিত্র আঁকে যা এত সংকেতপূর্ণ সত্য যে, একজন মানুষ যা হতে চায় এবং যা সে আছে তার মাঝখানে কোনো সীমান্ত নেই। সব সময়ে অধিকতর ভালো প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে যুক্ত, প্রদর্শন করে কোনো স্তরে উপস্থিত হয়ে সৃষ্টি করে সত্তা। কারণ সেটাই হলো তার শিল্প—সম্পূর্ণরূপে উদ্দীপ্ত করে, যতটা সম্ভব গভীরভাবে জীবনের ভেতরে নিজেকে মেলে ধরে যা তার নিজের জীবন নয়।[১৭] তার প্রয়াসের শেষে তার জীবনযাত্রা স্পষ্ট হয়ে ওঠে : নিজেই প্রয়োগ করে তার সম্পূর্ণ চিত্তে সত্তার শূন্যতা বা সত্তার বিভিন্নতা। সংকীর্ণতর সীমাগুলো বণ্টন করে তার চরিত্রকে সৃষ্টি করার জন্য, আরো বেশি প্রয়োজন তার প্রতিভার। মুখোশের নিচে তিনঘণ্টার মধ্যে সে মরে যাবে যা সে ধরে রেখেছে আজ। অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে অবশ্য এই তিনঘণ্টার মধ্যে এবং প্রকাশ করবে এক সমগ্র ব্যতিক্রমী জীবনকে। তাকে বলা হয় একজন নিজেকে হারায় অন্যজন নিজেকে দেখার জন্য। ঐ তিনঘণ্টার ভেতর মৃত্যুর শেষ পথটির সমগ্র চক্রটি সে ভ্রমণ করে যা লোকটি দর্শকদের ভেতরে আবরিত করতে এক জীবনকালকে গ্রহণ করে।

ক্ষণকালের মূকাভিনয়, অভিনেতার উপস্থিতিতে কেবল নিজেকে রপ্ত করে এবং মেঝে ঘষে নিজেকে সঠিক করে। থিয়েটারি ঐতিহ্য হলো অভিব্যক্তি এবং শারীরিক ক্রিয়াকলাপের ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা এবং কেবল তার সঙ্গে যোগ স্থাপন করা—অথবা কণ্ঠস্বরের ভেতর দিয়ে যা যতটা আত্মার ততটাই দেহের। ঐ শিল্পের নিয়ম প্ররোচিত করে সবকিছুকে বড় করার এবং রক্ত-মাংসের অনুবাদ। মানুষের বাস্তবে যেমন ভালোবাসা মঞ্চে তেমনই যদি মঞ্চ ফুটিয়ে তোলার জরুরি আকাঙ্ক্ষা হয়, নিয়োগ করে সেই রূপান্তর অযোগ্য হৃদয়ের কণ্ঠস্বর, যেমন লোকেরা জীবনে যা দেখতে পায় তেমনই দেখতে চায়, আমাদের কথা হয়ে উঠবে ইঙ্গিতে। কিন্তু এখানে নীরবতাগুলো তারা নিজেদেরই শুনিয়ে দেবে। আরো জোরে কথা বলে ভালোবাসা এবং নিশ্চলতা নিজেই সুবিন্যস্ত হয়ে ওঠে। শরীরটি রাজা। সবাই ‘থিয়েটারীয়’ হতে পারে না এবং এই অন্যায়রূপে ক্ষতিকর শব্দ সমগ্র নান্দনিকতাকে আবৃত করে এবং এক সমগ্র নৈতিকতাকেও। একজন মানুষের জীবন কাটে অর্ধেক সমার্থকতার ভেতরে, ফিরে যায়, এবং থাকে নীরবতা নিয়ে। এখানে অভিনেতা হলো অনুপ্রবেশকারী। ভেঙে দেয় শৃঙ্খলা সেই আত্মা এবং আবেগ কামনা তাদের মঞ্চের দিকে ছুটে যেতে পারে। তারা প্রত্যেকটি অভিব্যক্তির কথা বলে; চিৎকার ও কান্নার ভেতর তারা বাস করে। এইভাবে অভিনেতাটি প্রদর্শনের জন্য তার চরিত্রদের সৃষ্টি করে। সে তাদের রূপরেখা আঁকে এবং ভাস্কর্য তৈরি করে এবং তাদের কাল্পনিক আকারের ভেতর প্রবেশ করে, রক্ত চালিত করে সেই কাল্পনিক মূর্তির ভেতর। নিশ্চয়, আমি মহান নাটকের কথা বলছি, সেই ধরনের যা একজন অভিনেতাকে সুযোগ দেয় তার সমগ্র শারীরিক ভাগ্যকে পরিপূর্ণ করতে। উদাহরণস্বরূপ শেক্সপিয়রকে নাও। সেই প্রেরণাদায়ক নাটকে শারীরিক আবেগ কামনা চালিত করে নাচের দিকে। সবকিছুকে তারা ব্যাখ্যা করে। তাদের ছাড়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে। নিষ্ঠুর অভিব্যক্তি ছাড়া পাগলামো সরিয়ে রেখে কিং লিয়ার কখনোই কারো সঙ্গে সংযুক্তি রাখে না, সেই অভিব্যক্তিই নির্বাসিত করে কর্ডেলিয়াকে এবং অস্বীকার করে এডগারকে। এ কেবল সেই ট্র্যাজেডির মুক্তি যে তারপর থেকেই উন্মত্ততা দিয়ে শাসিত হওয়া উচিত। আত্মাদের দৈত্য এবং তাদের সারা ব্যান্ডের (এক ধরনের স্পেনীয় নৃত্য) কাছে অর্পণ করা হয়। চার পাগলের আর বেশি নেই : বাণিজ্য দিয়ে এক, ইচ্ছে দিয়ে আরেকটি এবং শেষ দুটো কষ্টের ভেতর দিয়ে—একটি শর্তের চারটি বিশৃঙ্খল দেহ, চার অনুচ্চারিত দৃষ্টিকোণ।

মানবদেহের বিশেষ তুলাদণ্ডটি যথেষ্ট নয়। মুখোশ ও জুতো, মেকাপ কমিয়ে দেয় ও উচ্চারণ করে মুখ যা এর প্রয়োজনীয় উপাদান, সাজপোশাক যা অতিরিক্ত বর্ণনা করে এবং সরলীকরণ করে–বিশ্ব সবকিছুকে উৎসর্গ করে উপস্থিত হয় এবং তৈরি হয় সম্পূর্ণরূপে চোখের জন্য। নিয়ে আসে অ্যাবসার্ড জাদুর ভেতর দিয়ে, এটি দেহ যা নিয়েও আসে জ্ঞান। আমার কখনো প্রকৃতরূপে ইয়াগোকে বোঝা উচিত নয় যে পর্যন্ত না তার ভূমিকা পাঠ করি। তাকে শোনাটাই যথেষ্ট নয়, কারণ যখন আমি তাকে দেখি সেই মুহূর্তে আমি তাকে আঁকড়ে ধরি। অ্যাবসার্ড চরিত্রের ফলস্বরূপ অভিনেতা রয়েছে একঘেয়েমিতে, তো একক, নির্যাতিত সিল্যুট, পাশাপাশি অদ্ভুত ও পরিচিত, যা সে এক নায়কের থেকে আরেক নায়কের কাছে বহন করে নিয়ে যায়। এখানেও মহান নাটকের কাজ দানস্বরূপ এই স্তরের ঐক্যের গভীরতা। এ ক্ষেত্রে আমি মলিয়ের আলসেস্টোর কথা ভাবছি। সবকিছু এত সরল, এত অবশ্যম্ভাবী, এত কর্কশ। আলসেস্টো ফিলিনাটের বিরুদ্ধে, সেলিসেনে এলিয়ানথের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির অ্যাবসার্ড ফলাফলে সমগ্র বিষয় এর চরমের দিকে নিয়ে যায়, এর পদ্য নিজেই, ‘মন্দ পদ্য’টি, চরিত্রের প্রকৃতির একঘেয়েমির মতো কেবলই উচ্চারিত হয়। যেখানে অভিনেতা নিজেই স্ববিরোধী; একই তথাপি এত বিভিন্ন, এত বেশি আত্মা একটি মাত্র শরীরের সারার্থ করে। তথাপি এই অ্যাবসার্ড, তা নিজেই বিরোধিতা করে, তো ব্যক্তি যে সবকিছু পেতে চায় এবং সবকিছুতে বাঁচতে চায়, সেই অর্থহীন প্রয়াস, সেই ব্যর্থ জেদে চালিয়ে যাওয়া। সব সময় কি নিজেই বিরোধিতা করে তৎসত্ত্বেও তার সঙ্গে যোগ দেয়। সে সেই বিন্দুতে থাকে যেখানে দেহ ও মন মিলিত হয়, যেখানে এর মন এর পরাজয়ে ক্লান্ত, মন ফেরে এর অত্যন্ত বিশ্বস্ত মৈত্রীর দিকে। হ্যামলেট বলে, ‘And blest are those whose blood and judgement are so well commingled that they are not a pipe for fortune’s finger to sound what stop she please.’

.

অভিনেতার ব্যাপারে এ রকম রীতি নিন্দে করতে চার্চ কেমন করে ব্যর্থ হয়েছিল? সেই শিল্পতে সে বর্জন করে যা আত্মার বিরুদ্ধে মতের বৃদ্ধিতে, আবেগতাড়িত লাম্পট্য, মনের কলঙ্কিত অযৌক্তিক রূপকে মেনে নেয়, সেই বস্তুগুলো জীবিত কিন্তু একটি জীবন এবং নিক্ষেপ করে উদ্বৃত্ত সব আকারের ভেতর। তাদের ভেতর সে নির্বাসিত করে, সেই পছন্দ বর্তমানের জন্য এবং প্রোটেউসের বিজয় যা সে শেখায় তা হলো সব কিছুরই নাকচ। চিরন্তনতা খেলা নয়। নির্বোধ মন চিরন্তনার দিকে কমেডিকে পছন্দ করাটা যথেষ্ট, তা দিব্যতাকে বা মুক্তিকে হারিয়েছে। ‘সর্বত্র’ ও ‘চিরকাল’ এর মাঝে কোনো সমঝোতা নেই। যখন সেই বহু ক্ষতিকর জীবিকা ভয়ঙ্কর আধ্যাত্মিক দ্বন্দ্ব জেগে উঠতে দিতে পারে। ‘কি ব্যাপার’, নীৎসে বলেন, ‘চিরন্তন জীবন নয় কিন্তু চিরন্তন প্রাণশক্তিতে ভরা।’ বস্তুত, সব নাটক এই পছন্দতে রয়েছে।

এড্রিয়েনে লেকুব্রুয়ের তার মৃত্যুশয্যায় স্বীকার করতে চেয়েছিলেন এবং যোগসূত্র পেতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু তাঁর বৃত্তিকে শপথপূর্বক পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। তার ফলে স্বীকারোক্তির যে সুবিধে তা সে আর পায়নি। ফলবশত তাঁর আচ্ছন্ন কামনা পছন্দ করাটাকে কি হিসেব করা হয় না ঈশ্বরের নির্বাচনে? এবং মৃত্যু যন্ত্রণায় সেই মহিলা যাকে সে শিল্প বলে তাকে বর্জন করতে অস্বীকার করে যা মহত্ত্বের প্রমাণ দেয়। তা কখনো পাদপ্রদীপের আলোয় আড়াল থেকে সংগ্রহ করেনি। এটিই তার শ্রেষ্ঠ ভূমিকা এবং কঠিনতম অভিনয়। স্বর্গ ও ভয়ানক বিশ্বস্ততার মাঝে পছন্দ করা, একজনের চিরন্তনতা বা ঈশ্বরের ভেতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলাটা পছন্দ করা হলো বয়োবৃদ্ধ ট্র্যাজেডি, এর ভেতরেই প্রত্যেকে তার ভূমিকা অবশ্যই অভিনয় করে।

যুগের অভিনেতারা জেনেছিল তারাই অতি যোগাযোগকারী এই বৃত্তিতে ঢুকে হিসেব করে নরককে বেছে নিয়েছিল এবং চার্চ উপলব্ধি করেছিল তার নিকৃষ্টতম শত্রুকে তাদের ভেতরে। কিছু শিক্ষিত লোক এর প্রতিবাদ করেছিল : ‘কী! মলিয়ের প্রতি শেষ আচরণ অনুষ্ঠানগুলোর অস্বীকার!’ কিন্তু সেটা ন্যায়, বিশেষ করে একজনের ক্ষেত্রে যিনি মঞ্চে মারা গেছেন এবং শেষ করেছেন অভিনেতার মেকাপে, একটা সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেছেন বিচ্ছুরণে। তাঁর ক্ষেত্রে প্রতিভা হলো মিনতি ভরা আন্তরিক প্রার্থনা, যা সবকিছুকে ক্ষমা করে। কিন্তু প্রতিভা কোনো কিছুকে ক্ষমা করে না, কারণ শুধু এ এরূপ করতে অস্বীকার করে।

সেই সময়ে অভিনেতাটি জানে কী শাস্তি তার জন্য মজুদ হয়ে আছে। কিন্তু এ রকম মিথ্যে শাসানির কি গুরুত্ব তা তুলনা করা হয়েছে চূড়ান্ত শাস্তির সঙ্গে যা জীবন নিজেই তার জন্য সংরক্ষিত করেছেন? এটি এক যা সে অগ্রিম অনুভব করেছিল এবং গ্রহণ করেছিল সম্পূর্ণরূপে। একজন অভিনেতার কাছে যেমন একজন অ্যাবসার্ড মানুষের কাছে অকালমৃত্যু অপূরণীয় ও অসাধ্য। কোনো কিছুই মুখগুলো ও শতাব্দীগুলোর অঙ্ককে পূরণ করতে পারে না, যা সে অন্যথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্রে একজনকে মরতে হবে। অভিনেতার জন্য সর্বত্রই সন্দেহহীন কিন্তু কাল তাকেও উড়িয়ে দেয় এবং তার সঙ্গে এর অভিব্যক্তিও তৈরি করে।

এর প্রয়োজন কিন্তু সামান্য কল্পনা অনুভব করে যাতে একজন অভিনেতার ভাগ্য বলতে কী বোঝায়। সময়মতো সে পূরণ করে এবং তার চরিত্রগুলোকে মূল্যায়ন করে। সময়মতো তেমনই সে তাদের নিয়ন্ত্রিত করতে শেখে। বহুসংখ্যক বিভিন্ন জীবনে সে থেকেছে, তাদের থেকে আরো দূরে থাকতে পারে। সময় আসে যখন মঞ্চে অবশ্যই সে মারা যাবে এবং জগতের জন্য। কিসে সে বেঁচে রয়েছে যার মুখোমুখি তাকে হতে হয়। স্পষ্টভাবে সে দেখে। অনুভব করে যে, দুঃসাহসিক অভিযানের যন্ত্রণাদায়ক ও স্থানান্তর অসাধ্য গুণকে। সে জানে এবং এখন সে মরতে পারে। বয়স্ক অভিনেতাদের রয়েছে আশ্ৰয়।

বিজয়

বিজয়ী বলে, “না, মনে করো না যে আমি যুদ্ধ ভালোবাসি, এর ফলে কীভাবে চিন্তা করতে হয় তা আমাকে ভুলতে হয়েছে। অপরদিকে, আমি যা বিশ্বাস করি তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নির্ণয় করতে পারি। কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং নিশ্চিতরূপে ও পরিষ্কারভাবে দেখি। যারা এসব সম্পর্কে সচেতন তারা বলে, “এ প্রকাশ করতে যে সমর্থ তা আমি ভালোভাবেই জানি।” কারণ যদি তারা এ রকম না করতে পারে, এর কারণ তারা জানে না অথবা কুঁড়েমির জন্য বাইরের কঠিন আবরণে বন্ধ করে দেয়।

‘বহুমত আমার নেই। জীবনের শেষে মানুষ দেখে একটিমাত্র সত্যে নিশ্চিত হতে গিয়ে অনেক বছর সে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একটি মাত্র সত্য, যদি তা অবশ্যম্ভাবী হয় সেই সত্য এক অস্তিত্বকে পরিচালনা করাই যথেষ্ট। আমার ব্যাপারে ব্যক্তি সম্পর্কে স্থিররূপে আমার কিছু বলার রয়েছে। তার সম্পর্কে একজন নির্বোধরূপে নিশ্চয় বলবে, যদি প্রয়োজন হয়, তা সঠিক অবজ্ঞায়।

‘একজন মানুষ বস্তুর ভেতর দিয়ে অনেক বেশি মানুষ, তার ভেতর দিয়ে যা সে বলে তার চেয়েও সে তার নিজের ভেতরই রাখে। অনেক কিছুই থাকে যা আমি নিজেই রাখব। কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যারা ব্যক্তিকে বিচার করে তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম অভিজ্ঞতার অনেক কিছু করে, যার ওপর ভিত্তি করেই তাদের বিচার। বুদ্ধি, আন্দোলিত বৌদ্ধিকরূপ সম্ভবত সামনে দেখে যা উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু যুগটিকে, এর ধ্বংস এবং আর রক্ত ঘটনার সঙ্গে আমাদের জয় করে। প্রাচীন জাতিগুলোর জন্য এ সম্ভব এবং এমনকি আরো সাম্প্রতিক একটি আমাদের যান্ত্রিকযুগে নিচে নামে, একজনকে ওজন করে অন্যদের বিরুদ্ধে সমাজের ও ব্যক্তির ভালোর জন্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যা অন্যকে সেবা করে। প্রথমেই, মানব সত্তার সৃষ্টি করা হয়েছে সেবা করার জন্য বা সেবিত হওয়ার জন্য, সেই অনুসারে মানুষের হৃদয়ের জেদি বিপথগমনের দরুন তা সম্ভব ছিল। দ্বিতীয় স্থান, এ সম্ভব ছিল কারণ সমাজও নয় বা ব্যক্তিও নয় তখনো তাদের সব ক্ষমতা উন্মোচিত হতে বাকি।

‘ফ্ল্যান্ডারের রক্তাক্ত যুদ্ধে চূড়ান্তরূপে এসে ডাচ শিল্পীদের সেরা ছবির জন্ম হয়, কিছু উজ্জ্বল মন এতে বিস্মিত হয়ে এ পালিত হয়েছিল। তাদের বিস্ময়কর দৃষ্টির সামনে চিরন্তন মূল্যগুলো ঈশ্বরে অবিশ্বাসকারীদের অস্থিরতায় রক্ষা পায়। কিন্তু তখন থেকেই উন্নতি হয়েছে। আজকের শিল্পীরা এরূপ শান্ত অবস্থা থেকে বঞ্চিত। এমনকি যদি তাদের প্রাথমিকভাবে হৃদয় রয়েছে যা স্রষ্টার প্রয়োজন, আমি বলতে চাই বন্ধ হৃদয়ের কথা, এর কোনো ব্যবহার নেই, প্রত্যেকের জন্য সন্তের জিনের জন্যও জমায়েত করা হয়। সম্ভবত এই যে যা আমি অত্যন্ত গভীরভাবে অনুভব করেছি। প্রতিটি ফর্মে তো ট্রেঞ্চের ভেতর বাহিত হয়েছে, প্রতিটি রূপরেখায়, রূপকে অথবা প্রার্থনা ইস্পাতের নিচে চূর্ণ হয়, চিরন্তনতা হারায় একটি ধাপ। সচেতনতা এমনই যার থেকে আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, এর সম্পূর্ণতার একটা অংশ হয়ে থাকাটা স্থির করেছি। কেন আমি ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করি কারণ সে ভয়ানক ও লাঞ্ছনার জন্য আমায় আঘাত করে। তা জেনে বিজয়ের কোনো কারণ এক্ষেত্রে নেই। হারানোর কারণের ওপর আমার একটা পছন্দ রয়েছে : তাদের প্রয়োজন রয়েছে এক পবিত্র আত্মার, এর সাময়িক বিজয়গুলোর মতো এর পরাজয়ও সমান। যে কোনো ব্যক্তির জন্য যে অনুভব করে এ জগতের ভাগ্যের সঙ্গে বাঁধা, সভ্যতার সংঘর্ষে রয়েছে কিছু জিনিস যা একে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। একই সময়ে তৈরি করেছি আমার ক্ষোভ যাতে আমি যোগ দিতে চেয়েছিলাম। ইতিহাস ও চিরন্তনতার মধ্যে ইতিহাসকে বেছেছি কারণ আমি নিশ্চয়তাকে পছন্দ করি। নিদেনপক্ষে এতে আমি নির্দিষ্ট, এবং কেমন করে এই শক্তিকে আমি অস্বীকার করি যে আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে?

‘সব সময় একটা সময় আসে যখন একজনকে অবশ্যই অবলোকন ও কাজের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়। একেই বলে একজনের মানুষ হয়ে ওঠা। এ রকম জোর করে টানগুলো ভয়ঙ্কর। কিন্তু গর্বিত হৃদয়ের জন্য সমঝোতা হতে পারে না। রয়েছে ঈশ্বর অথবা কাল, সেই ক্রশ অথবা এই তরবারি। এই জগতের রয়েছে উচ্চতর তাৎপর্য যা এর দুর্ভাবনাকে অতিক্রম করে অথবা কোনো কিছুই সত্য নয় শুধুই দুর্ভাবনা। কালের সঙ্গে সে বাঁচে এর সঙ্গেই সরে অথবা এক মহৎ জীবনের জন্য অন্যত্র পালায়। আমি জানি, যখন চিরন্তনতার ওপর বিশ্বাস থাকে একজন সমঝোতা করতে পারে এবং বাস করতে পারে জগতে। তাকে বলা হয় গ্রহণ। কিন্তু এই পরিভাষাকে আমি ঘৃণা করি এবং সব চাই অথবা কিছুই নয়। যদি আমি যুদ্ধ চাই, মনে করো না এই অবলোকন আমার কাছে অজানা দেশের মতো। কিন্তু এ আমাকে সবকিছু দিতে পারে না, চিরন্তনতা থেকে বঞ্চনা করে, সময়ের সঙ্গে নিজেই আমি মিত্রতা চাই। হয় নস্টালজিয়া অথবা তিক্ততায় আমার হিসাবে রাখতে চাই না এবং শুধু স্পষ্টভাবে দেখতে চাই। তোমাকে আমি বলি, আগামীকাল তোমার জমায়েত হবে। তোমার জন্য এবং আমার জন্য সেটাই হলো স্বাধীনতা। ব্যক্তি কিছুই করতে পারে না এবং তথাপি সে সবকিছু করতে পারে। সেই বিস্ময়কর অসংযুক্ত অবস্থায় তুমি বোঝ কেন আমি স্থাপন করি এবং তাকে চূর্ণ করি একটিতেও একই সময়ে। এই জগৎ যা তাকে ধ্বংস করে এবং আমি তাকে স্বাধীন করি। তার সব অধিকারসমেত আমি তাকে জোগান দিই।

‘বিজয়ীরা জানে যে যুদ্ধ তার ভেতর অর্থহীন। তবে একটা অর্থপূর্ণ কাজ রয়েছে তা হলো মানুষকে ও পৃথিবীকে পুনর্নির্মাণ। আমি কখনো মানুষকে পুনর্নির্মাণ করব না। তবে একজন মানুষ অবশ্য করবে ‘যেন’। কারণ সংগ্রামের পথ আমাকে জীবের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি পীড়ন, জীবই (জৈবই) আমার একমাত্র নিশ্চয়তা। এর ওপরই কেবল আমি বেঁচে থাকতে পারি। জীবই আমার জন্মভূমি। এই কারণেই আমি বেছেছি অ্যাবসার্ড এবং সম্পাদিত প্রয়াসকে। এই কারণে আমি সংগ্রামের দিকে রয়েছি। নতুন যুগের শুরু এর দিকে নিজে ধার দেয়, যেমন আমি বলেছি। এখান থেকেই বিজয়ীর মহত্ত্ব ছিল ভৌগোলিক। এ মাপা হয় বিজয়ীর সীমানা বাড়িয়ে। একটি কারণ আছে কেন শব্দটি অর্থগত ব্যাপারে পরিবর্তিত করেছে মহত্ত্ব। এ রয়েছে প্রতিবাদে এবং অন্ধগলির উৎসর্গে। এই ক্ষেত্রেও পরাজয় পছন্দের ভেতর এ নেই। বিজয়ই হবে আকাঙ্ক্ষিত। তবে এক্ষেত্রে রয়েছে একটি জয় এবং এটি চিরন্তন। সেটি এমন একটি যা আমি কখনো পাব না। সেই জায়গাটিতে হোঁচট খাব এবং লেগে থাকব। বিপ্লব সব সময় সংঘটিত হয় ঈশ্বরের বিরুদ্ধে, প্রমিথিউসের বিপ্লব শুরুতেই, প্রথম আধুনিক বিজয়ীরা। এটাই মানুষের দাবি যা তার অদৃষ্টের বিরুদ্ধে তৈরি করেছিল; হতভাগ্যদের চাহিদা হলো বরং এক মিথ্যে ওজর। তথাপি আমি ধরতে পারি কেবল সেই উদ্দীপনাকে এর ঐতিহাসিক কার্যের ভেতর এবং যেখানে এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। যাই হোক, মনে করো না যে এর ভেতর আমি তৃপ্ত : প্রয়োজনীয় বিরোধিতার বিরুদ্ধে। আমি আমার মানব বিরোধিতাকে রক্ষা করে ছিল। একে যা কিছুর ভেতর বাতিল করে আমি আমার স্বচ্ছতাকে তার ভেতরই প্রতিষ্ঠা করি। মানুষকে যা চূর্ণ করে তারই সামনে তাকে স্থাপন করি এবং আমার স্বাধীনতা, আমার বিদ্রোহ এবং আমার কামনা একত্রে আসে, তারপর সেই অস্থিরতায়, সেই স্বচ্ছতায় এবং সেই বিশাল পুনঃসম্পাদন।

‘হ্যাঁ, মানুষ তার নিজের সমাপ্তি এবং সে কেবলই তার সমাপ্তি। যদি সে কিছু হতে চায় তবে এই জীবনেই করতে হবে। এখন আমি কেবল এও ভালো জানি। বিজয়ীরা মাঝে মাঝে পরাজয়ের এবং বিজয়ের কথা বলে। কিন্তু এ সব সময় “নিজের জয়ে”র কথা যা বলে তারা বলে। তুমি ভালোই জান যা তারা বলতে চায়। একটা বিশেষ মুহূর্তে প্রতিটি মানুষ নিজেই অনুভব করে ঈশ্বরের সমান হতে। কমপক্ষে এই উপায় একে ব্যক্ত করা। কিন্তু এ আসে ঘটনা থেকে, এক ঝলকানিতে, অনুভব করে মানব মনের মহান বিস্ময়ময়তা। বিজয়ীর কেবল সেই সব মানুষ যারা তাদের শক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন, ঐসব শীর্ষের ওপর অবিরামভাবে বসবাসের নিশ্চয়তা এবং সেই মহানত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকা। অল্পবিস্তর, এ পাটীগণিতের প্রশ্ন। বিজয়ীরা আরো বেশি সমর্থ। কিন্তু মানুষ নিজে যখন চায় তার চেয়ে বেশি তারা সমর্থ নয়। কেন যে তারা কখনো মানবের কঠিন পরীক্ষায় ছেড়ে দেয় না, বিপ্লবের সিদ্ধ আত্মার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘সেখানে তারা দেখে প্রাণীরা অঙ্গচ্ছেদিত, কিন্তু কেবল যে মূল্য তারা পছন্দ করে ও প্রশংসা করে তারাও সেখানে লড়াই করে, মানুষ ও নীরবতা, এ উভয়ই তাদের নিঃসঙ্গতা ও তাদের সম্পদ। যা রয়েছে তাদের জন্য কিন্তু এক বিলাস—তা হলো মানব সম্পর্ক। একজন কেমন করে বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, এই মর্মাহত বিশ্বে সবকিছু তা হলো মানব এবং সম্পূর্ণরূপে মানব মনে করে আরো বেশি স্পষ্ট অর্থ? উত্তম মুখগুলো, ভ্রাতৃত্বকে বা সহকর্মীদের সতর্ক করে, মানুষের মধ্যে শক্তিশালী ও সততাপূর্ণ বন্ধুত্ব—এগুলো সত্যই ধনী কারণ তারা স্বল্পস্থায়ী। তাদের মাঝে মন শক্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল। সেটাই বলতে হয়, এর ফলস্বরূপ। কেউ কেউ প্রতিভার কথা বলেছে। কিন্তু প্রতিভা বলাটা সহজ; আমি বুদ্ধিকেই পছন্দ করি। এ অবশ্যই বলা হবে যে, তাহলে এ হয়ে উঠবে চমৎকার। এই মরুভূমিকে আলোকিত করে এবং একে শাসন করে। এর নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে এ জানে এবং তাদের আঁকে। এই দেহের মতো একই সময়ে এ মরবে। কিন্তু এ জেনে এর স্বাধীনতাকে গঠিত করে।

চার্চ যে আমাদের বিরুদ্ধে সেই তথ্য সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ নই। হৃদয় এই অস্থির এতই ভীত যে, চিরন্তনতাকে এড়িয়ে যায় এবং সব চার্চ, দৈব অথবা রাজনৈতিক, চিরন্তনতাকে দাবি করে। সুখ ও সাহস, প্রতিশোধ বা বিচার তাদের জন্য মুখ্য সমাপ্তি। এ এক যা তারা আনে একজন অবশ্য একে সম্মতি জানায়। কিন্তু ভাবনাগুলোর সঙ্গে যে চিরন্তনতার আমার কোনো যোগ নেই। আমার কেন্দ্রবিন্দুর ভেতর সত্যগুলো আছে যা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যেতে পারে। তাদের থেকে আমি আলাদা করতে পারি না। এই কারণে আমার ওপর কোনো কিছুর ভিত করতে পার না : বিজয়ীর কোনো কিছু স্থায়ী হয় না, এমনকি তার তত্ত্বগুলোও নয়।

‘সবকিছুর শেষে, সবকিছুকে তুচ্ছ করে, তা হলো মৃত্যু। আমরাও জানি, মৃত্যু সবকিছুকে শেষ করে। এই কারণে ঐসব কবরখানা সমস্ত ইউরোপ ব্যাপি রয়েছে, কবরখানাগুলো আমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে আবিষ্ট করে, সেগুলো কুৎসিত। যা লোকেরা ভালোবাসে তা মানুষেরা সুন্দরের মর্যাদা দেয় এবং মৃত্যু আমাদের তাড়া করে, আমাদের ধৈর্যকে ক্লান্ত করে। একেও জয় করতে হবে। শেষ কাররারা (Carrara), পাড়ুয়া (Padua) একজন বন্দি প্লেগে শূন্য হয়ে যায় এবং ভেনেটীয় দ্বারা বাধা পায়, পরিত্যক্ত প্রাসাদের হলগুলোর ভেতর দিয়ে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ায় : শয়তানকে সে ডাকতে থাকে এবং মৃত্যুর জন্য তাকে বলে। জয় করার এটাই পথ। পাশ্চাত্য সাহসের বৈশিষ্ট্যের চিহ্নের মতোই অনুরূপ ত্রুটি, জায়গাগুলো এতই কুৎসিত করা হয়েছে যেখানে মৃত্যু নিজেই ভাবে তাকে সম্মাননা করেছে। বিদ্রোহীর বিশ্বে, মৃত্যু স্থাপন করে অন্যায়। এই চূড়ান্ত অপব্যবহার বা বিকৃতি।

‘কোনো সমঝোতা ছাড়া অন্যরা চিরন্তনতাকেই পছন্দ করেছে এবং এই জগতের অধ্যাসকে ঘৃণা করেছে। তাদের সমাধিগুলো অসংখ্য ফুল ও পাখির মাঝে মৃদু হাসে। সেটা বিজয়ীকে মানিয়েছে এবং যা সে বাতিল করেছে সে সম্পর্কে তাকে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয়। অপরদিকে সে পছন্দ করেছে কালো লোহার বেড়া অথবা বেওয়ারিশদের সমাধি। ঘটনাক্রমে ঈশ্বরের মানুষদের মধ্যে সেরা ধরা পড়ে আতঙ্ক নিয়ে, বিবেচনার সঙ্গে মিশে যায় এবং মনের সমব্যথা এরূপ তাদের মৃত্যুর এক কল্পনা যার সঙ্গে বাস করতে পারে। তথাপি ঐসব মনের শক্তিকে এবং বিচারবোধকে এর থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের সামনে আমাদের ভাগ্য এবং আমরা তাকে প্ররোচিত করি। আমাদের নিষ্ফল শর্তের সচেতনতার বাইরের চেয়ে অহঙ্কার কম। আমরাও মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের সমবেদনা অনুভব করি। এ কেবল সমবেদনা যা মনে হয় আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য : এক অনুভব যা সম্ভবত তুমি বুঝতে পার না এবং তা তোমার এবং তা মনে হয় তোমার কাছে দুর্লভ পৌরুষ। তথাপি আমাদের মধ্যে অত্যন্ত সাহসী কয়েকজন যারা একে অনুভব করে। কিন্তু আমরা বলি পরিচ্ছন্ন পৌরুষ একটি এবং আমরা একটি শক্তি চাই না যা স্বচ্ছতা থেকে আলাদা।’

.

আমাকে পুনরায় বলতে দিন এইসব ধারণা আদর্শ রীতি প্রস্তাব করে না এবং কোনো বিচারের সঙ্গে যুক্ত নয় : এগুলো রূপরেখা। তারা কেবল জীবনের একটা রীতিকে উপস্থাপিত করে। প্রেমিক, অভিনেতা অথবা দুঃসাহসী অভিযাত্রী অ্যাবসার্ড অভিনয় করে। কিন্তু সমানভাবে ভালো, যদি সে ইচ্ছে করে, নম্র মানুষ, রাষ্ট্রকর্তৃক অথবা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। জানাটা যথেষ্ট তবে কোনো মুখোশ পরা নয়। মাঝে মাঝে ইতালীয় মিউজিয়ামে ছোট রং করা পর্দা দেখা যায় যা যাজক ও অপরাধী লোকেদের সামনে ধরা হয়, তাদের থেকে মঞ্চটা আড়াল করার জন্য। এর সব ফর্মে ঝাঁপটি, অলৌকিক অথবা চিরন্তনতায় ছুটে যায়, প্রতিদিনকার অধ্যাসে বা ধারণায় ছেড়ে দেয়—ঐসব পর্দা অ্যাবসার্ডকে লুকোয়। কিন্তু পর্দা ছেড়ে রয়েছে রাষ্ট্রকর্তৃকগণ এবং তাদের মধ্যে এক শ্রেণী যাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছি।

চূড়ান্তভাবে আমি একজনকে ভেবেছি। এই স্তরে অ্যাবসার্ড তাদের এক রাজকীয় ক্ষমতা দেয়। এ সত্য যে, ঐসব রাজকুমারেরা রাজ্যহীন। তবে অন্যদের ওপর তাদের সুযোগ-সুবিধে আছে : তারা জানে সব রাজকীয়তাই ভ্রম। তারা জানে সেটা তাদের সামগ্রিক মহত্ত্ব, লুক্কায়িত দুর্ভাগ্যের সম্পর্ক বিষয়ে তাদের কিছু বলা বৃথা অথবা মোহভঙ্গের ভষ্ম। আশায় বঞ্চিত হওয়া হতাশা নয়। পৃথিবীর অগ্নিশিখা নিশ্চিতরূপে মূল্যবান স্বর্গীয় সুবাস। আমিও নই বা অন্য কেউও নয় এখানে তাদের বিচার করে। অধিকতর ভালো হয়ে তারা লড়াই করে না, সঙ্গতিপূর্ণ হতে চেষ্টা করছে। মানুষের ক্ষেত্রে যদি পরিভাষা ‘জ্ঞানী ব্যক্তি’ ব্যবহার করা যেতে পারে, সেই মানুষ যা তার আছে তারই ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হিসাব না কষে যা তার কাছে আছে তারই ওপর বেঁচে থাকে, তাহলে তারা জ্ঞানী ব্যক্তি। তাদের মধ্যে একজন বিজয়ী তবে মনের রাজ্যে, একজন ডন জুয়ান, তবে জ্ঞান, অভিনেতা কিন্তু বুদ্ধিমত্তায়, যে কোনো একজনের চেয়ে বেশি জানে : তুমি এমন কেউ নও যে, পৃথিবীতে একটি সুবিধে উপযুক্ত মনে কর এবং সম্পূর্ণতা আনার জন্য স্বর্গে তোমার প্রিয় ছোট্ট শান্ত নিরীহ ভেড়াটি, তৎসত্ত্বেও তুমি বড়জোর শিং সমেত অদ্ভুত ছোট্ট ভেড়া হওয়াতে অব্যাহত থাক এবং এর বেশি নয়—এমনকি মনে কর যে, অহঙ্কারে ফেটে পড় না এবং কলঙ্ক সৃষ্টি কর না বিচারকের মতো ভঙ্গি করে।’

অ্যাবসার্ড যুক্তিতে আরো বেশি আন্তরিক উদাহরণ যে, কোনো ক্ষেত্রে এ ছিল পুনঃসঞ্চয় করা। কল্পনা অন্যান্য অনেক কিছু যোগ করতে পারে, সময় ও নির্বাসন থেকে অচ্ছেদ্য, অনুরূপ যে জানে ভবিষ্যৎ ছাড়া বিশ্বের সঙ্গে ঐক্য নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়। এই অ্যাবসার্ড, ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীতে তখন মানুষের সঙ্গে মিশে যায় যারা স্পষ্টরূপে ভাবে ও আশা ছেড়ে দেয় এবং এখনো আমি অত্যন্ত অ্যাবসার্ড চরিত্র নিয়ে কথা বলিনি, যারা স্রষ্টা।

***

নোট

১৬. সম্পূর্ণতম বোধ এবং তার অপরাধে। সুস্থ অভিপ্রায় ও অপরাধের সঙ্গে।

১৭. এই বিন্দুতে ভাবছি মলিয়ের অ্যালসেস্টো। সবকিছু এতই সরল, এতই অবশ্যম্ভাবী এবং এতই কর্কশ। অ্যালসেস্টো ফিলিন্টের বিরুদ্ধে, সেলিমেনে এলিয়ান্থের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির অ্যাবসার্ড ফলগুলোয় পুরো বিষয়টা এর চূড়ান্তের দিকে বহন করে এবং পদ্য নিজেই, ‘মন্দপদ্য’ চরিত্রের প্রকৃতির একঘেয়ের মতো শুধু উচ্চারণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *