অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স
একটা প্রশ্ন এখানে উঠতেই পারে— ঠিক কবে থেকে ইহুদিরা নিজেদের আত্মরক্ষার কথা ভাবতে শুরু করল? ১৯২৯ সালে ওয়েলিং ওয়ালের সামনে আক্রমণের ঘটনার আগে আত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই কি তারা করেনি?
উনবিংশ শতকের সিকি ভাগ বাকি থাকতে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে দলবদ্ধ ভাবে চাষবাস শুরু করে। তাদের ফসল ও ঘরবাড়ি রক্ষা করবার জন্য আরবদের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বাঁচতে হত। জলের জন্যও লড়তে হত অনেক সময়। তাদের সামনে মাত্র দুটো রাস্তাই খোলা ছিল। এক, লড়াই করো; দুই, প্রতিবেশীর দয়ার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকো। ইহুদিরা প্রথম রাস্তাটাই বেছে নিয়েছিল। এই সময় কিছু প্রহরী নিয়োগ করা হয় ইহুদিদের রক্ষার জন্য। প্রথম দিকে স্থানীয় আরবদেরই এই কাজে নেওয়া হত। তরুণরা সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ইহুদিরাই নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় এই দায়িত্ব। কারণ আরবরা আক্রমণ করলে আরব প্রহরীরা কতটা সাহায্য করবে সেটা নিয়ে ইহুদিদের মনে একটা ধন্দ ছিল।
১৯০৭ সালে ইসরায়েল সোহাতের উদ্যোগে য়িত্জাক বেন জভি, জভি বেকার, ইসরায়েল গিলাডি, য়েহেজকিয়েল হানকিন, য়েহেজকিয়েল নিসানভ, আলেকজান্ডার জিদ জাফাতে এক গুপ্ত সংস্থা তৈরি করেন, যার নাম দেওয়া হয় বার-গিওরা।
কিন্তু এমন নাম কেন?
৬৬-৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইহুদিদের সেনাদলের নেতা ছিলেন সিমন বার-গিওরা। তাঁর নামেই এই নামকরণ। বার-গিওরার কাজ ছিল ইহুদিদের বাসস্থানগুলোকে রক্ষা করা। তাদের পতাকায় লেখা থাকত— ‘রক্ত আর আগুনের মধ্যে দিয়ে ইহুদির পতন হয়েছিল, রক্ত আর আগুন থেকেই ইহুদির উত্থান হবে!’
প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আসছিল। দিনে দিনে লোক বাড়ায় প্রয়োজন হচ্ছিল আরও শক্তিশালী একটা সংগঠনের। ১৯০৯ সালে বার-গিওরা থেকে তৈরি হল ‘হাসোমার’, যা মূলত বার-গিওরারই এক পরিবর্ধিত রূপ। সেজেরা, লোয়ার গ্যালিলি ও অন্যান্য ইহুদি গ্রামগুলোতে সশস্ত্র পাহারা মোতায়েন করে হাসোমার। এর জন্য বার্ষিক খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। জেজরিল উপত্যকায় যখন জিউস ন্যাশনাল ফান্ডের সাহায্যে জমি কেনা হয়, তখন আরব আক্রমণ ঠেকাতে হাসোমারের সদস্যদের পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় হাসোমারের সদস্য সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট কম। এবার একটা পুরোদস্তুর সৈন্যদল গঠন করা খুব দরকারি হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে ‘হেগানা’ গঠন হওয়ার পর হাসোমারের অস্তিত্ব লোপ পায়। হেগানার কথা যদিও আগেই বলা হয়েছে, তবুও এই সূত্রে আরও কিছু জিনিস ছুঁয়ে যেতেই হয়।
১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে আরব-দাঙ্গার পর ইহুদিরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য ব্রিটিশদের ওপর ভরসা করা পুরোপুরি ভাবে ছেড়ে দেয়। জেরুসালেমের এই দাঙ্গায় নিহত হয় ৫ জন ইহুদি ও ৪ জন আরব। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২০ সালের জুন মাসে তৈরি করা হয় আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিটারি অর্গানাইজেশন–হেগানা, যা স্বাধীন ইসরায়েল গঠনের পরে পরিণত হয় আইডিএফ-এ। প্রথম ন’ বছর হেগানার সংগঠন ছিল নড়বড়ে। ১৯২৯ সালের আরব-দাঙ্গার পর হেগানাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়—
সমস্ত যুবক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের হেগানার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার ফলে প্রতিটি শহরে কয়েক হাজার করে হেগানার সদস্য তৈরি হয়।
সদস্যদের জন্য ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।
কয়েকটা অস্ত্রাগার তৈরি করা হয় যেখানে ইউরোপ থেকে আনা অস্ত্রাদি মজুত করা হয়।
আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্র তৈরির কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে হেগানা রীতিমতো এক সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়। যদিও ব্রিটিশদের কাছে হেগানা সরকারিভাবে স্বীকৃত কোনো সংস্থা ছিল না। কিন্তু হেগানার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন তাদের ছিল।
দাঙ্গার সময় প্রায় ৫০টি ইহুদি-অধ্যুষিত গ্রামকে সুরক্ষা দিয়েছিল হেগানার সদস্যরা।
১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকার এক হোয়াইট পেপার বা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে পার্টিশনের প্রস্তাব খারিজ করে দেওয়া হয়। আরব ও ইহুদিদের সম্মিলিত সরকার গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইহুদি জনসংখ্যা প্যালেস্টাইনের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয় এবং তার বেশি সংখ্যক ইহুদিদের জায়গা দিতে হলে তা হবে আরবদের অনুমতি সাপেক্ষ।
এতে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জায়গা কেনার ক্ষেত্রেও রাশ টানার কথা বলা হয়।
বলা বাহুল্য, এটা ইহুদিদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না এবং তারা হতাশ হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের হোয়াইট পেপার সামনে আসার পর হেগানা ইহুদিদের অবৈধ অনুপ্রবেশে সাহায্য করা শুরু করে। কারণ, তাদের লক্ষ্য ছিল ইহুদি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে তারা জায়গায় জায়গায় প্রদর্শন শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হেগানার সদস্যরা ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করে। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি কম্যান্ডো মিশনে তারা অংশ নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হেগানা নিজেকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তরুণদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৪১ সালে হেগানার আন্ডারগ্রাউন্ড এলিট ইউনিট ‘পালমাখ’ গঠন করা হয়। পালমাখের সদস্যদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাদের সাহস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিরা আশা করেছিল যে, এবার হয়তো তাদের আশা পূরণ হবে। ব্রিটিশরা নিশ্চয়ই এবার ইহুদি-রাষ্ট্রের ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি মিলল। ব্রিটিশরা এ ব্যাপারে েেকানা আগ্রহই দেখাচ্ছিল না। এবার হেগানার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তারা সরাসরি ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু করে দিল।
হেগানা প্যালেস্টাইনের বাইরেও তাদের জাল বিস্তার করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, মরক্কো প্রভৃতি দেশে তাদের শাখা খোলা হয়েছিল। এদের মধ্যে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা অনেক সদস্যও ছিল।
হেগানার শাখা মোসাদ লালিয়াহ েেবটর দায়িত্ব ছিল অবৈধ অনুপ্রবেশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। পালমাখের শাখা ‘পালয়ম’-এর দায়িত্ব ছিল জলপথে অনুপ্রবেশকারীদের প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসা। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে ৬৬টা জাহাজে করে গোপনে ৭০,০০০ ইহুদিকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসা হয়।
হেগানার সক্রিয় সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপ চেকোস্লোভাকিয়া থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র কিনে প্যালেস্টাইনে পাঠায়। এরা অস্ত্র তৈরির কারখানাও চালু করে যার হিব্রু নাম ‘তা’স’ যার মানে, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি। ইসরায়েল যখন স্বাধীন হয়, তখন তা’স-এর কাছে ছিল মোট ৪৬টি অস্ত্র কারখানা। সেখানে তৈরি হত সাব মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড, বুলেট ও বিস্ফোরক।
এখানে বিশ্ব ইতিহাসের একটা তুলনামূলক অনালোচিত অধ্যায়ের কথা না বললে পাঠকদের সঙ্গে বঞ্চনা করা হবে। এত বোরিং ইতিহাস বর্ণনার মধ্যে এটুকুই তো অক্সিজেন।
কী সেই কথা?
ক্লিমেন্টিসের নাম পড়েছেন বন্ধু? মানে, ভ্লাদিমির ক্লিমেন্টিস? বিগত শতাব্দীর বহুলচর্চিত চেকোস্লোভাকিয়ান নেতা, ক্লিমেন্টিস ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ক্লিমা গোটবাল্ডের দক্ষিণ হস্ত।
ভদ্রলোকের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল— ওঁর মাথায় সবসময় একটা ইউরোপিয়ান ফার-ক্যাপ থাকত। অল দ্য টাইম! আর এই ক্যাপটাই হয়ে ওঠে ওঁর পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, অনেকটা চার্চিলের টুপির মতো, ইয়াসের আরাফাতের কাফিয়ার মতো। ঊনবিংশ শতকের চারের দশকে চেকোস্লোভাকিয়াতে কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লব চলছিল। তা সফলও হল। গোটা দেশ ক্লিমা গোটবাল্ডকে নেতা হিসাবে বেছে নিল।
গোটবাল্ড হলেন নতুন সরকারের মুখ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পথের জুলুসের দিকে মুখ করে গোটবাল্ড জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। ওঁর সঙ্গে ছিলেন পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং ছিলেন ভ্লাদিমির ক্লিমেন্টিস।
হঠাৎ বরফ পড়তে শুরু করল। গোটবাল্ডের মাথায় কোনো টুপি ছিল না। ব্যাপারটা দেখে ক্লিমেন্টিসের ভালো লাগেনি— ‘আরে, আমাদের নেতা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সেটা যে আমাদেরই অসম্মান!’
নিজের মাথা থেকে ফার-ক্যাপটা খুলে গোটবাল্ডের মাথায় সসম্মানে পরিয়ে দিলেন ক্লিমেন্টিস। ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানিতে চিরদিনের মতো কয়েদ হয়ে গেল সেই মুহূর্ত।
বন্ধুরা ধৈর্য হারাচ্ছেন কি? ভাবছেন ইসরায়েলের ডিফেন্সের কথা বলতে গিয়ে কোথাকার কোন ভ্লাদ ক্লিমেন্টিস নামক বুড়োর গল্প ফাঁদল রে বাবা! বলি, একটু সবুর করুন।
১৯৪৮ সাল। ইসরায়েল তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। ইসরায়েলের স্বাধীনতা পাওয়ার পরদিনই ইসরায়েলের ওপর আরব দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর এই আক্রমণের কথা আগে থেকেই আঁচ করে নিয়ে ইসরায়েলিরা লড়াই করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে রেখে দিয়েছিল। আর সেই মোক্ষম সময়পর্বে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছিলেন এই ক্লিমেন্টিস। ১৯৪৮ সালের ৩১মার্চ থেকে আরম্ভ করে আগস্ট মাসের ১২ তারিখ অবধি চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ইসরায়েলে অস্ত্র পাচার চলে। এই অপারেশনের নাম ছিল ‘অপারেশন বালাক’। কিন্তু পরবর্তী কালে আমেরিকান গভর্নমেন্টের চাপের মুখে পড়ে চেকোস্লোভাকিয়া এই মদত বন্ধ করে দেয়। আর এরপরই ক্লিমেন্টিস পড়েন গোটবাল্ডের কোপে। কমিউনিস্ট পার্টি ওঁর বিপক্ষে চলে যায়। ফাঁসি দেওয়া হয় ভ্লাদিমির ক্লিমেন্টিসকে।
ক্লিমেন্টিসের ফাঁসির পর অদ্ভুত ভাবেই ইতিহাস থেকে তাঁর উপস্থিতির যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ মুছে দিতে শুরু করেন কমিউনিস্টরা। প্রায় সব নথি থেকে মুছে যায় তাঁর নাম। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই মোছা গেল না। বিপ্লবের সাফল্যের পরপরই গোটবাল্ডের মাথায় টুপি পরানোর ঐতিহাসিক চিত্র থেকে ক্লিমেন্টিসকে মুছে ফেলা গেলেও লুকোনো গেল না গোটবাল্ডের মাথার ফার- ক্যাপ। শাশ্বত রয়ে গেল তাঁর টুপি!
১৯৪৭ সালে ডেভিড বেন গুরিয়নের নেতৃত্বে হেগানার এক সাধারণ নীতি তৈরি করা হয়। আরব আক্রমণ ঠেকানোর জন্যই ছিল মূলত এই নীতি। ১৯৪৮ সালের ২৬ মে হেগানাকে দেশের সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ‘জিভা হেগানা লে-য়িসরায়েল’ বা ‘ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস’, যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘আইডিএফ’।
১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত হেগানার ৫,১৫১ জন সদস্য নিহত হয়েছে যার মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধেই নিহত হয়েছে ৩,৯৫২ জন।
একটা অবৈধ আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র সংগঠনের একটা দেশের সেনাবাহিনী হয়ে ওঠা এক বিরল ঘটনা। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পথে এবং ইহুদিদের অস্তিত্ব রক্ষার চরম সংকটে হেগানা এক অসামান্য অবদান রেখেছে।
ইসরায়েল এবং ইহুদিরা চিরদিন হেগানার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
কিন্তু আরও কিছু কথা বাকি রয়ে যায় যে!
১৯৩১ সালে হেগানার কয়েক জন কমান্ডার মতবিরোধের জেরে হেগানা পরিত্যাগ করে ‘ইরগুন’ প্রতিষ্ঠা করে। হেগানার যে নীতি অনুসরণ করত তা ছিল রক্ষণাত্মক, যার নাম ছিল ‘হভলাগাহ’। আক্রমণ হওয়ার পরে ইহুদিদের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল হেগানার যোদ্ধাদের। কিন্তু কোনো আক্রমণের আগাম খবর পেলেও কোনো কিছু করার অধিকার তাদের ছিল না। এদিকে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ওপর আক্রমণ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছিল।
এই সময় হেগানার রক্ষণাত্মক নীতির যথেষ্ট সমালোচনা হয়। ইরগুন প্রতিষ্ঠার নেতা ছিলেন ভ্লাদিমির জবোটিনস্কি। হিংসাকে একমাত্র হিংসার মাধ্যমেই আটকানো যায়— এই ছিল তাঁর মূল বক্তব্য। ধীরে ধীরে হেগানার সদস্যরা তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। এরাই ১৯৩১ সালে হেগানা থেকে আলাদা হয়ে গঠন করে ইরগুন। আক্রান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে শত্রুকে আক্রমণ করাই ছিল তাদের নীতি। এই দলের প্রথম দিকে নাম ছিল ‘হেগানা বেট’ এবং পরে এর নাম হয় ‘ইরগুন’। ইরগুনের আরেকটা নামও ছিল— ‘এটজাল’। জবোটিনস্কিই ছিলেন এই দলের সুপ্রিম কমান্ডার। ১৯৪০ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
ইরগুনের সদস্যরা আরবদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র হামলা চালায়। অনেককে গ্রেফতার করে ব্রিটিশরা। একটা আরব বাসে গুলি চালানোর অপরাধে শ্লোমো বেন যোসেফ নামে এক সদস্যকে ফাঁসিতে ঝোলায় ব্রিটিশরা। ১৯৩৯ সালের মে মাসে ইহুদিদের স্বার্থবিরোধী হোয়াইট পেপার পাবলিশ হওয়ার পর ইরগুন ব্রিটিশদের তাদের শত্রুর তালিকায় যোগ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ইরগুনের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। বেশ কিছু সদস্য ব্রিটিশ আর্মির প্যালেস্টাইন ইউনিটে ও পরে জিউস ব্রিগেডে যোগ দেয়।
১৯৪৩ সালে ইরগুনের প্রধান হলেন মেনাকেম বিগিন যিনি পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরগুন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা সরকারি দপ্তর, মিলিটারি ইনস্টলেশন ও পুলিশ স্টেশনগুলোয় হানা দিয়ে সেগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া শুরু করল। হেগানা ইরগুনের এই কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট ছিল এবং তারা এর বিরুদ্ধে প্রচার চালায় যার চলতি নাম ছিল ‘সেজোন’।
ব্রিটিশরা বহু ইরগুন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ও জেলে পাঠায়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে ইরগুনের ৪ জনকে আকোর জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। এ বছরেরই মে মাসে ইরগুন আকোর জেলে হামলা চালিয়ে ৪১ জন বন্দিকে মুক্ত করে। জুলাই মাসে আরো ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল স্বাধীন হওয়ার পর আগস্ট মাসে ইসরায়েলের ক্যাবিনেট ইরগুনের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে, ইরগুনের সদস্যরা আইডিএফে যোগ দিক আর তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে সেনা নামানো হবে। ক্যাবিনেটের এই সিদ্ধান্তে সাড়া দিয়ে ইরগুনের সদস্যরা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোটা ইরগুন আইডিএফে মিশে যায়। আর এভাবেই ইরগুনের অস্তিত্ব লোপ পায়।
ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ফার বাহাইন্ড? এই অমোঘ সত্যের মতো বার-গিওরা বা ইরগুনের কথা তুললে এসে যায় ‘লেহি’র আলাপও।
কী ব্যাপার দেখে নেওয়া যাক।
ইরগুন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি হিংসার রাস্তা বেছে নিয়েছিল। এদের থেকেও বেশি চরমপন্থী আরেকটা দল গড়ে উঠেছিল। ইরগুনের কিছু সদস্য মিলে ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে তৈরি করেছিল ‘লেহি’। এই দলের নেতা ছিলেন আব্রাহাম স্টার্ন। ভদ্রলোক নিজে একজন প্রতিভাবান লেখকও ছিলেন। এক সময়ে তিনি ভেবেছিলেন ইতালিতে গিয়ে ডক্টরেট করবেন, গবেষণা নিয়ে সময় কাটাবেন। কিন্তু তিনি অনুভব করেন যে, ব্রিটিশদের হাত থেকে প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট প্রতিরোধ কেউ গড়ে তুলতে পারছে না। তাই তিনি তাঁর জীবনের লক্ষ্য ত্যাগ করে এক উগ্রপন্থী দল গড়ে তোলেন। লেহির বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরা এর নাম দিয়েছিল ‘স্টার্ন গ্যাং’।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ব্রিটিশরা লড়ছিল নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে। ইহুদিদের ওপর করা নাৎসিদের নারকীয় অত্যাচারের স্মৃতি তখন দগদগে। ইরগুন তাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কারণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধ লড়াই করা মানে পরোক্ষভাবে নাৎসিদেরই সাহায্য করা। কিন্তু লেহির সদস্যরা নাৎসিদের থেকেও বড় শত্রু ভাবত ব্রিটিশদের। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। তাদের টার্গেট ছিল ব্রিটিশ মিলিটারি ও সরকারি আধিকারিকরা।
লেহির স্বপ্ন ছিল প্যালেস্টাইন থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করে ইউফ্রেটিস ও নীল নদের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু লেহির লোকবল ও অস্ত্রবল ছিল যথেষ্ট সীমিত। লেহির এই কার্যকলাপ সাধারণ ইহুদি জনগণের সমর্থন পায়নি। কারণ সাধারণ মানুষের চোখে তারা ছিল কেবল একটা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ফলে তারা একটা বিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হয়। ব্রিটিশ পুলিশের কাছে লেহির সদস্যরা ছিল মোস্ট ওয়ান্টেড। ১৯৪২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি স্টার্ন ব্রিটিশ সেনার হাতে নিহত হন। লেহির বাকি সদস্যরা কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুেদ্ধ আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, একদিন ঠিক তারা ব্রিটিশদের তাড়াতে সক্ষম হবে।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর এলিয়াহু বেট-জুরি এবং এলিয়াহু হাকিম নামে দুই লেহির সদস্য মধ্য-প্রাচ্যের ব্রিটিশ মিনিস্টার লর্ড ময়েনকে কায়রোতে তাঁর বাড়ির সামনে হত্যা করে। অপরাধীরা ধরা পড়ে। মিলিটারি কোর্টে তাদের বিচার হয় ও ১৯৪৫ সালের ২৩ মার্চ তাদের ফাঁসি হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন ইহুদি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছিল না, তখন বেন-গুরিয়ন সম্মিলিত সংগ্রামের ডাক দেন। হেগানা, ইরগুন ও লেহি গড়ে তোলে ইউনাইটেড রেসিস্টেন্স মুভমেন্ট, যার অগ্রভাগে থাকবেন বেন-গুরিয়ন। ঠিক করা হয় যে, তারা একত্রে ব্রিটিশদের ওপর হামলা চালাবে। হেগানার হাতে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাদের সবচেয়ে সফল আক্রমণ ছিল হাইফাতে রেল সেতু উড়িয়ে দেওয়া ও গোটা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ করে দেওয়া। ১৯৪৬ সালের জুন মাসের ১৬ ও ১৭ তারিখ এই আক্রমণ করা হয়েছিল।
১৯৪৮ সালের ৩১ মে যখন আইডিএফ সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন লেহির অস্তিত্ব বিলোপ করা হয়, আর লেহির সদস্যরা আইডিএফে নাম লেখায়। কেবল জেরুসালেমে লেহির সদস্যরা স্বতন্ত্রভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। তাদের দাবি ছিল যে, এখনও জেরুসালেমের ভাগ্য নির্ধারণ বাকি কারণ এখনও কেউ জানে না, জেরুসালেম কার দিকে থাকবে।
১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইউএন মিডিয়েটর ফোক বার্নাডোট জেরুসালেমে খুন হয়ে যান। অভিযোগের আঙুল ওঠে লেহির সদস্যদের দিকে। সরকার লেহিকে নিষিদ্ধ সংগঠন বলে ঘোষণা করে এবং এর মুখপত্র হামিভরাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। নাটান য়েলিন-মোর, মাটিটয়াহু শমুয়েলভিট্জ নামের লেহি নেতাদের জেলে পোরা হয়। অবশ্য পরে তারা মুক্তি পায়।