অহিংসা – পান্নালাল দাশগুপ্ত

অহিংসা – পান্নালাল দাশগুপ্ত

গান্ধীজি বলেছেন ছোটোবেলা থেকেই সত্যের প্রতি তাঁর সহজাত আকর্ষণ ছিল—কিন্তু অহিংসা তাঁর সহজাত ধর্ম নয়। সত্যের সন্ধান করতে করতেই তিনি অহিংসা আবিষ্কার করেন। আত্মজীবনীতে দেখা যায় তিনি ছোটবেলা লুকিয়ে লুকিয়ে মাংস খেতেন। কেন না তাঁর সহপাঠিরা তাঁকে বুঝিয়েছিল মাংস না খেলে গায়ের শক্তি হয় না এবং ইংরেজের সঙ্গে পারাও যায় না। কিন্তু মাংস খাওয়া একদিন ছেড়ে দিলেন, মাংস খাওয়াতে দোষ, এ বুঝে নয়—লুকিয়ে খেতে হয় বলে, মিথ্যেকথা বলতে হয় বলে—সেই লজ্জায়। অহিংসার প্রতি দৃষ্টি তাঁর জীবনের গভীরতম সংকট ও সংগ্রামের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল।

কি এই অহিংসা? গান্ধীজি বলেছেন, ”তত্ত্ব হিসেবে অহিংসা কি তা কেউ জানে না? ভগবানকে যেমন ব্যাখ্যা করা যায় না, অহিংসাকে তেমনি বোঝানো শক্ত। কিন্তু এর বাস্তব ব্যবহারের সময় আমরা তার চকিতদর্শন পাই—যেমন চকিত দর্শন পাই ভগবানের—তাঁর কাজের মধ্যে, আমাদেরই মারফৎ।” Ahimsa in theory, no one knows. It is as indefinable as God. But in its working we get glimpses of the Almighty in His working, amongst us and through us.—(Mahatma by Tendulkar Vol V-p. 307)

মহাত্মা নিজেই অহিংসার সংজ্ঞা পরিষ্কার করে দিতে পারছেন না, আমরাই বা কোন সাহসে তাঁর definition তৈরি করতে যাবো। তবে আমরা তাঁর কার্য ও লেখা থেকে যথাসম্ভব একটা চেহারা তৈরী করবার চেষ্টা করবো। সোজাসুজি অহিংসার ব্যাখ্যা না করে অহিংসার বিকাশ ও ব্যবহারের নমুনা থেকে তার ছবিটা ঘুরিয়ে ধরবার চেষ্টা করবো। হিংসার উল্টো অহিংসা একথা বললেও অর্থ সম্পূর্ণ হবে না। গায়ের জোর নয়, মনের জোর বললেও কোন অর্থ হবে না—কেন না এই দুই জোরের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। যারা সশস্ত্র সংগ্রাম করে, তারা সবাই হিংসুক এমন কথা বলা অন্যায়—কারণ ইতিহাসে সশস্ত্র সংগ্রামে মানুষের মহান চরিত্রের ও আত্মোৎসর্গের অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আবার সত্যাগ্রহীমাত্রেই হিংসাশূন্য—একথা দাবি করা যায় না। তাদের মধ্যেও গোপন হিংসা ও ঈর্ষা ও নানান দুর্বলতা, এমন কি ভয়ও লক্ষ্য করা গেছে—অন্ততঃ গান্ধীজি নিজেই তা স্বীকার করেছেন। কাজেই অহিংসা কথাটার চট করে সংজ্ঞা দেওয়া সত্যিই সহজ নয়। অথচ কঠিন বলেই ধরে নিতে হবে না, অহিংসা বলে বুঝি তবে কিছু নেই—সেটা একটা কাল্পনিক শক্তি মাত্র, একথা আর বলার জো নেই।

ভালোবাসাও বা প্রেমই অহিংস নয়—এ যেন বীর্যবান ভালোবাসা বা ভালোবাসার শক্তি—অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজের সর্বস্ব জীবন—ধন সব কিছু উৎসর্গ করে এক লড়াই—অথচ এতে শত্রুতা নেই। অনেক গুণ ও বাণীর কথা আমরা অতীতের মহামানবদের কাছ থেকে বা তাঁদের জীবনে পেয়ে থাকি—নীতির কথা, আদর্শের উদারতা, প্রেমের মহিমা, অত্মোৎসর্গের পরাকাষ্ঠা তাঁদের জীবনে ছিল বলে ধরা হয়—বুদ্ধের করুণা, খৃষ্টের প্রেম ও ক্ষমা ইত্যাদি আমরা শুনি। কিন্তু এগুলো কোন বাস্তব বলে বিশ্বাস করি না। গান্ধীজি সেগুলো বিশ্বাস করতেন এবং এইসব মহান গুণসমূহকে বর্তমানের পৃথিবীতেও ঘোরতর সংকট থেকে মানুষের মুক্তির কাজে লাগাতে পারেন কিনা, তার বাস্তব গবেষণা বা experiment প্রথমে নিজের উপরে, তারপর নিজের আশু পরিবেশের উপরে, পরিশেষে সমগ্র দেশের উপর প্রয়োগ করেন এবং দেখতে পান, তার কার্যকারিতা আছে। কাজেই তিনি বলেন, অহিংসাকে আমি পুনরুদ্ধার করেছি, নতুন কিছু আবিষ্কার করিনি। Ahimsa is as old as hills এই তাঁর মত। তিনি কেবল তার প্রয়োগ যতদূর সম্ভব mass scale বা large scale-এ করেছেন—তাঁর সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে সত্যাগ্রহের হাতিয়ারটি অংহিসা—ধর্মের দ্বারা সঞ্জীবিত। ইনি এই অস্ত্রটিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর সুঠাম ও অমোঘ করার জন্য লেগে যান। তিনি বলেছেন, ‘‘Thousands, indeed tens of thousands, depend upon their eixtence of families disappear before the exercise of this force. Hundreds of nations live in peace. History does not and cannot take note of this fact. History is really a record of very interruption of the even working of the force of love on the soul…soul force, being natural, is not noted in history’’ (Satagraha. pp 10 & 11) অর্থাৎ ”হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নরনারী এই শক্তির উপরই প্রতিদিন নির্ভরশীল) লক্ষ—কোটি লোকের প্রতিদিনকার সাংসারিক ছোট ছোট কলহ—বিবাদ—বিসম্বাদ তারা এই শক্তির সাহায্যেই মিটিয়ে নেয়। শত শত জাতি শান্তিতে বাস করে কিন্তু ইতিহাস তাদের শান্তির খবর লেখে না বা লিখতে পারে না। বাস্তবে দেখি যে এই ভালোবাসার শক্তি বা আত্মার শক্তির সহজ শান্তিতে যখন বিঘ্ন ঘটে তখনই ইতিহাস রচনার প্রয়োজন হয়।…আত্মার শক্তি অতি স্বাভাবিক জিনিস বলেই ইতিহাসে তার ঠাঁই হয়নি।” গান্ধীজি বলতে চান, অস্বাভাবিক খবর, যুদ্ধের খবর, অশান্তির খবর, গৃহযুদ্ধ ও শ্রেণিযুদ্ধের খবরেই ইতিহাসের সৃষ্টি—কিন্তু মানুষ যেখানে শান্তিতে আছে সেখানে ইতিহাসের আদর নেই—অর্থাৎ ইতিহাস শান্তির বর্ণনা করে না বলেই পৃথিবীতে, সমাজে, সংসারে শান্তির ও ভালোবাসার ক্ষেত্র নেই, এমন কথা বলা যায় না। বরং মানুষেরা, নিজেরা নিজেদের কলহ বিনা যুদ্ধেই অহরহ মিটিয়ে থাকে—এবং তা অহিংসার শক্তি ও প্রয়োগ দিয়ে—যেখানে অস্ত্রের সাহায্য নেই, আছে ভালোবাসা, আত্মদান, আত্মোৎসর্গ ইত্যাদি শক্তিগুলি। এই শক্তিকেই পরিমার্জিত করে গান্ধীজি অহিংসা ও সত্যাগ্রহের একটা পূর্ণরূপ দিতে চেষ্টা করেছেন।

অহিংসা ও হিংসা কথাটা ইংরাজি non-violence ও violence-এর অর্থে ব্যবহার করেছি। হিংসুটেপনা ও ঈর্ষা ও নোংরামীর কথা এখানে আনা হচ্ছে না। দৈহিক শক্তি বা গায়ের জোর প্রয়োগ করে শত্রুতা করা বা না করার কথাটাই এখানে প্রধান বিবেচ্য।

প্রথমেই বলতে হবে অহিংসা হিংসাকে এড়িয়ে চলে না। অহিংসার সাথে অহিংসার লড়াই হতে পারে না। ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে এবং হিংসার সঙ্গেই অহিংসার লড়াই। অতএব যে অহিংস সে হিংসাকে এড়ায় না—হিংসাকে চ্যালেঞ্জ করাতেই অহিংসার বাহাদুরী ও কার্যকারিতা। তার অর্থ এই যে, যারা ঝঞ্ঝাট এড়াতে চায়, যারা যুদ্ধবিগ্রহকে এড়াতে চায়, যারা অত্যাচারীকে এড়াতে চায়, যারা ‘শান্তিবাদী’ তারা যদি মনে করে যে তারা অহিংস, তবে গান্ধীজির কাছে তারা অতি হাস্যকর জীব। আর যারা ভয়ে শান্তির পথ, স্বোয়াস্তির পথ অন্বেষণ করে অহিংসার আশ্রয় নিতে চায়, তারা গান্ধীজির কাছে করুণার পাত্র। গান্ধীজি বলেছেন, দুর্বলের অহিংসার কোন অর্থই হয় না। একটি মূষিক বেড়ালের কাছে কখনও অহিংস হতে পারে না—আসলে মূষিক কোনো কালেও অহিংস হতে পারবে না—কারণ সাহসের অভাবই তার মস্ত কথা। যারা সহিংস বিরোধিতা করতে পারে তারা বরং অহিংস হতে পারে—কিন্তু দূর্বল ও ভীরুরা অহিংস হতে পারে না। দুর্বলের অহিংসা বলে কোনো জিনিস নেই। আর অহিংসা হিংসার বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্যই ব্যবহার হতে পারে ও জন্ম হতে পারে। বনে জঙ্গলে তপোবনে মানুষের সঙ্গে মানুষের যেখানে কোনো সংগ্রাম নেই—সেখানে অহিংস হবার কোন অর্থ নেই। সৎলোকের সঙ্গে সৎব্যবহারেও কোন অহিংসা নেই, ভালো লোকের সঙ্গে ভালোব্যবহার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক—কিন্তু মন্দলোকের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করার মধ্যেই সত্যিকার ভালোর পরিচয় হতে পারে। যেখানেই হিংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যেখানে অত্যাচার উদ্ধত মূতির্তে এসে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে, যেখানে কপটতা, হীন ষড়যন্ত্র করে চলেছে—সেখানেই অহিংস সত্যাগ্রহীর স্থান—অহিংস সৈনিক কখনো কোনো স্থিতিতেই হিংসার মূর্তি দেখে পলায়ন করবে না—বরং হিংসাই অহিংসার আকর্ষণ। গান্ধীজির ভাষায়, ‘‘Marching right into the jaws of himsa means (that-and) nothing else, nothing else. (Tendulkar’s Mahatama, Vol-V, P-115) হিংসার করাল মুখ্যব্যাদনের মধ্যে নির্ভয়ে অগ্রসর হয়ে যাবার নামই অহিংসা—অন্য কিছু নয়। দুর্বলের নিষ্ক্রিয়তা বা Passivity of the weak-ও অহিংসা নয়। অহিংসা একটা প্রচণ্ড সক্রিয় শক্তি। এখন আমরা তাঁর কথা দিয়ে এই উপরোক্ত কথাগুলোকে প্রমাণ করবো।

যারা মনে করে মৃত্যুকে এড়াবার জন্য বুঝি অহিংসার প্রয়োজন—যারা মনে করে দেশের স্বাধীনতা আনতে চাই কিন্তু মরতে চাই না—তাদের সুবিধাবাদ ও ভয়কে আশ্রয় দেবার জন্য গান্ধীজি অহিংসা আবিষ্কার করেছেন—তারা অতি মূর্খ। আর যাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী, তাঁরা যদি মনে করেন, গান্ধী মৃত্যুকে ভয় করতেন বা দেশে রক্তারক্তি এড়াবার জন্য একটা নরম পথ আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁরাও অতিশয় ভ্রান্ত। গান্ধীজি ১৯৩১ সালে বোম্বের আজাদ ময়দানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘‘I would not finch from sacrificing even a million lives for India’s liberty. I told so to the English people in England’’ (Tendulkar-Mahatma, Vol-III, P. 186) অর্থাৎ ”স্বাধীনতার জন্য আমি ১০ লক্ষ ভারতীয় প্রাণ বলিদান দিতে প্রস্তুত। আমি একথা ইংল্যান্ডে ইংরেজদেরও বলে এসেছি।” আমরা জানি গান্ধী—আন্দোলনে কত হাজার হাজার লোক শহীদ হয়ে গেছেন—কত লক্ষ লক্ষ লোক কত নির্যাতন সহ্য করেছেন।

গান্ধীজি তাঁর হিন্দস্বরাজ নামক বইতে লিখেছেন—‘‘That nation is great which rests its head upon death as pillow. Those who defy death are free from all fear’’.

অর্থাৎ ”সেই জাতিই মহান যে জাতি মৃত্যুর বালিস মাথায় দিয়ে বিশ্রাম করে। যারা মৃত্যুর ভয় ত্যাগ করতে পেরেছে তারা সব কিছুর ভয় থেকেই মুক্ত।” তিনি বলেছেন—‘‘People committed the mistake of thinking all that did not involve killing was non-violence. Sometime killing is the cleanest part of violence.’’ (Tenulkar-Mahatma, Vol-VII p. 30). মেদিনীপুরে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ”লোকের ভুল হয় এই যে বুঝি হত্যা না করাটাই অহিংস। কখনো কখনো হিংসা—আন্দোলনের মধ্যে হত্যাটাই শুদ্ধতম কাজ, এমন দেখা যায়।” ১৯২৪ সালে গান্ধীজি বলেছেন, ‘‘I like to die for India’s freedom and would die for it. because it is a part of truth, only a free India can worship the true God.’’ অর্থাৎ ”আমি ভারতের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে চাই এবং তারজন্য প্রাণ দেবোও, কে না ভারতের মুক্তি সত্যেরই অংশ। একমাত্র মুক্ত ভারতই সত্যিকার ভগবানের আরাধনা করতে পারে।” আবার শুনুন—”Man does not live but to escape death. If he does so, he is advised not to do so. Man is adviced to learn to love death, as well as life, if not more so. Indeed, a hard saying, harder too act up to, one may say. Every worthy act is difficult. Ascent is always difficult. Decent is easy, and often slippery. Life becomes livable, only to the extent death is treated as friend, never as as enemy. To conquer life’s temptations, summon death to your aid. In order to postpone death, a coward surrenders his honour, his life, his daughter and all. A courageous man prefers death to the surrender of sell-respect. When the time comes, as it conceivably can, I would not leave my advice to be reffered, but it will be given in precise language. That, today, my advice might be followed only by one or none, does not detract from its value, A Begginning is always made by few, even one’’. (Mahatma–Vol. VII, page 249) অর্থাৎ মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার জন্যই মানুষ বেঁচে নেই। যদি কেউ তা করে তবে আমার উপদেশ এই যে, সে যেন তা না করে। জীবনকে যত ভালোবাস, সেরকম, এমন কি, তারও চেয়ে বেশি, মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখো, এই হল আমার কথা। কেউ হয়তো বলবে এ বড় কঠিন উপদেশ, পালন করা আরও কঠিন। প্রত্যেক মহৎ কাজই শক্ত। উপরে ওঠা সর্বদা কষ্টকর। নীচে নামা সহজ ও প্রায়ই পিচ্ছিল। জীবন উপভোগ্য তখনই হয় যখন মৃত্যুকে বন্ধুর মতো দেখা সম্ভব হয়, শত্রুর মতো নয়। জীবনের নানা প্রলোভনকে জয় করতে হলে মৃত্যুর সাহায্য নিতে হবে। মৃত্যুকে স্থগিত রাখার জন্য ভীরু তার নিজের সম্মান, স্ত্রী, কন্যা, সমস্ত কিছু বিসর্জন দেয়। কিন্তু সাহসী লোক জীবন দেয় তো তো ইজ্জত দেয় না। যখন সময় আসবে, এবং সে সময় হয়তো আসছে, তখন আমার এই উপদেশ কিভাবে পালন করতে হবে অনুমান করতে হবে না। আমি স্পষ্ট ভাষায়ই তা জানিয়ে দেব। আজ আমার কথা শোনবার জন্য কত জনা আছে, কি একজনই আছে, এতে আমার বক্তব্যের মূল্যামূল্য বিচার হবে না। আরম্ভ চিরকালই মুষ্টিমেয় লোকের, এমন কি একজনের হাত দিয়েও শুরু হয়।” এই উদাত্ত বাণীর মধ্যে যে বজ্রনির্ঘোষ ইঙ্গিত রয়েছে, তা ছিল মহাত্মার non-violence of the brave বা বীরের অহিংসা কি, তার অনুসন্ধান ও বাস্তব ব্যবহারে। তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন এই তত্ত্বেরই নির্ভেজাল রূপ আবিষ্কারের উদ্বেগময় সাধনায় কেটেছে। এর কিছুকালের মধ্যে তাঁর জীবন নাথুরাম গডসের হাতে অন্ত হয়। কাজেই উপরোক্ত কথার মর্যাদা তিনি নিজের জীবন দিয়েই দেখিয়ে গেলেন। এই মৃত্যুর সাধনা গান্ধীজির জীবনে একটা পরম আকর্ষণীয় দিক। তিনি বারে বারে নিজের জীবন বিপন্ন করে যে সমস্ত অনশন করেছেন, অথবা যেসব বিপদসঙ্কুল পথে বিচরণ করছেন, তার দৃষ্টান্ত দেখাবার কোন দরকার করে না। সেগুলি ভারতের ইতিহাস রচনা করে গেছে। কাজেই অহিংসার সঙ্গে মৃত্যুবরণ কথাটা অঙ্গাঙ্গীভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে, মৃত্যু বা বিপ্লব এড়াবার কোনও ইঙ্গিত তাতে নেই। আবার শুনুন তিনি কেমন করে তাঁর এই নির্ভীকতাকে শক্তিমান করার জন্য ভগবানের তত্ত্ব দিয়েও জোর দিয়েছেন। ‘‘Nations have progressed both by evolution and revolution. The one is as necessary as the other. Death, which is an eternal perity, is revolution at birth and afterwards it is slow and steady evolution. Death is as necessary for man’s growth as life itself. God is the greatest revolutionist the world have ever known or will know. He sends deluges. He sends storms where a moment ago there was calm. He levels down mountain which he builds with exquistie care and infinite patience.

”প্রত্যেক জাতি ক্রমবিকাশ ও বিপ্লব—এই উভয় শক্তির দ্বারাই উন্নত হয়ে থাকে। উভয়েরই সমান প্রয়োজন হয়। মৃত্যুও একটা চিরন্তন সত্য এবং জন্মের মতো মৃত্যুও একটা বিপ্লব, যেমন জন্মের পর আবার ধীরে ধীরে চলে তার ক্রমবিকাশ। মানুষে বিকাশের জন্য মৃত্যু জীবনের মতো সমান প্রয়োজনীয় ঘটনা। ভগবান হলে শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। তাঁর চেয়ে বড় বিপ্লবীকে কেউ জানে না ও কোন কালেই জানবে না। তিনি দরকার মতো তাঁর সৃষ্টিতে প্রলয় ঘটিয়ে দেন। এক মুহূর্ত পূর্বে যেখানে সমস্ত কিছু শান্ত ছিল, সেখানে পর মুহূর্তেই প্রবল ঝঞ্ঝা পাঠিয়ে দেন। কত দীর্ঘকাল ধরে যে পর্বত তিনি কত যত্ন ও ধৈর্যের সাথে সৃষ্টি করেছেন, তা তিনি গুঁড়িয়ে সমতল করে ছেড়েছেন।” এইভাবে তিনি তাঁর ভগবানকে বিপ্লবী ভগবান বানাতে ছাড়ে নি।

এই সঙ্গে আরও একদল লোক সম্বন্ধে একটা কথা বলে যাওয়া দরকার। যাঁরা constitutionalist তাঁরা গান্ধী আন্দোলনকে একটা constitutional আন্দোলন বলে এখন চালাতে চাইছেন। গণআন্দোলন বা গণবিপ্লবের যে সব মৃত্যুঞ্জয়ী দিক গান্ধীজির উপরোক্ত কথা ও কাজের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, সেগুলি তারা এখন লুকোতে চাইছেন। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে তাঁদের কোন মিল ছিল না। তিনি ১৯৩২ সালে এক অনশনকালে বলেছেন, ‘‘Those who have to bring about radical change in human condtions and surroundings cannot do it except by raising a ferment in society. There are only two methods of doing this–violent and non-violent’’. অর্থাৎ যাঁরা সমাজের অবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে চান, তাঁদের পক্ষে সমাজের জনমনে বিরাট বিক্ষোভ সৃষ্টি না করে তা কখনোই করা সম্ভব নয়। তা করতে হলে দুটি মাত্র পথ আছে—এক সহিংস, অপরটি অহিংস। অর্থাৎ তিনি বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অহিংস বিপ্লবে তিনি বিশ্বাস করতেন। অতএব বিপ্লব যে করতে হবে এ বিষয়ে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতই সমান উৎসাহী ছিলেন কিন্তু তাঁর পথ ও উপায় ভিন্ন। তিনি একবার বলেছেন, ‘‘Constitutionalism, legality and such other things are good enough wthin their respective spheres, but they become a drag upon the human progress immediately the human mind has broken these artificial bonds and flies higher.’’ (Mahatma Vol. V, page–31.)

”নিয়মতান্ত্রিকতা, আইনানুগত্য এবং এই জাতীয় কার্যকলাপ তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রের মধ্যে কার্যকরী সন্দেহ নেই—কিন্তু মানুষের মন যখন তার সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উচ্চতম স্তরে অগ্রসর হতে চায়, তখন সেগুলি বিরক্তিকর কিছু টান বা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।” প্রত্যেক গণআন্দোলনের সামনে তিনি যখন এগিয়ে যাবার জন্য নির্ভীক ডাক দিতেন—বলতেন, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’—যখন বলতেন কোন কিছুর ভয় করো না—সেই উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক যে আইনভঙ্গ করতে এগিয়ে আসতো তাকে কি আমরা নিয়মিতান্ত্রিকতা বলে চালাতে পারি? অথচ আশ্চর্য এই, আজকাল অনেক গান্ধীভক্ত গান্ধীজীকে একজন নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা বলেই চালাতে চান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রাজদূত শ্রীজি. এল. মেহতা সেদিন ওয়াশিংটনে গান্ধীজীকে আমেরিকান ধনীদের কাছে কি সাজে সাজিয়ে দিতে চাইছেন দেখুন—‘‘Our national movement has been described as non-violent. And constitutionalism is but non-biolence translated in political terms.’’

আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনকে বলা হয় অহিংসা আন্দোলন। আর অহিংসা হচ্ছে তাই যার রাজনৈতিক রূপ হলো (আপনাদের ভাষায়) নিয়মতান্ত্রিকতা।” ভারতের রাজদূত বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের খুশী করার জন্য হোক অথবা নিজের তান্ত্রিকতা ছাড়া আর কিছু বলে ভারতে পারেন না। আর এই সংবাদ ভারতে পরিবেশন হচ্ছে কার মারফত? ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুক্ত পত্র A. I. C. C.-র পত্রিকা ‘Economic Review’—15th Aug. 1954 মারফৎ। তার মানে শুধু জি. এল. মেহতারই এই মত নয়—এ. আই. সি.—এর মুখপত্রও সেই মত পোষণ করেন নিশ্চয়, তা নাহলে তাঁরা তা ছাপাতেন না। গান্ধীবাদীদের এই জাতীয় ব্যাখ্যাকারীরা গান্ধীজীর কম ক্ষতি করছেন না। এই জাতীয় লোকেরাই গান্ধীজীকে বিপ্লবীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

এখন দেখা যাক গান্ধীজি সহিংস সংগ্রামীদের কি চোখে দেখতেন? পূর্বে বলেছি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাঁরা সশস্ত্র বিপ্লবের পথে চলতে, তাঁদের তিনি শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন—যদিও তাঁরা ভুল করছেন, একথা বলতে ও বোঝাতে তাঁর কোন সংকোচ ছিল না। তিনি তাঁদের বিষ চোখে দেখতেন বা ঘৃণা করতে বা জব্দ করতে চাইতেন, একথা এতটুকু ঠিক নয়। কত ফেরারী বিপ্লবী তাঁর কাছে গিয়ে নির্ভয়ে কথাবার্তা, তর্কাতর্কি করতেন। বিপ্লবীদের ফাঁসী থেকে বাঁচাবার জন্য তিনি কম চেষ্টা করেন নি। হরিদাস মিত্র ভগৎ সিংদের ফাঁসী থেকে বাঁচাতে পারেননি বলে তাঁর মনে বিশেষ দুঃখ ছিল। গান্ধী—আরউইন প্যাকটের সময় ভগৎ সিংদের ফাঁসী রদ করার দাবিকে কেন তিনি একটি শর্ত হিসেবে রাখেন নি, এ নিয়ে প্রবল বিক্ষোভ গান্ধীজীর বিরুদ্ধে হয়েছে এবং একদিন লাহোর স্টেশনে বিক্ষোভকারীদের কালো পতাকা ও জুতোর মালা নিজ হাতে নিয়ে তিনি গলায় পরেছিলেন এবং সেখানে বলেছিলেন যে ভগৎ সিং—এর ফাঁসী রদ করার দাবি তিনি সর্ত হিসেবে রাখতে পারেন নি কারণ সে সর্ত রাখতে গেলে প্যাকট হতো না। ”কিন্তু আমি প্যাকটটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করাতে দুঃখের সঙ্গে সেই সর্ত তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে ভগৎ সিং—এর জীবনকে আমি রক্ষা করতে পারি নি। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে, তাঁর জীবন রক্ষা না করতে পারার জন্য যে অপরাধ, তাতে জুতোর মালা আমার প্রাপ্য হতে পারে। আমি তোমাদের জুতোর মালা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করছি।” কিন্তু হয়তো এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, গান্ধী—আরউইন প্যাকটের প্রয়োজন কি ছিল? গান্ধী—আরউইন প্যাকটের কোন মর্যাদা তো ইংরেজ শেষ পর্যন্ত দেয় নি। এই জাতীয় সমালোচনা নিশ্চয়ই চলতে পারে এবং তৎকালীন বিপ্লবীরা ও চরমপন্থীরা সেদিন এ যুক্তি দিয়েছিলেন। আপোষের পথে পা না দিয়ে যদি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যেতো তবেই ছিল ভালো। প্যাকট করে নিজেরে আন্দোলনকে খর্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছিল মাত্র—এই জাতীয় সমালোচনা চলতে পারে। কিন্তু গান্ধীজী বলতে পারেন যে, ঘটনা ঘটে গেলে পরে সবাই বিজ্ঞ হতে পারে কিন্তু আগে থেকে সবকিছুর পরিণাম বোঝা সম্ভব না—ও হতে পারে। তাছাড়া গান্ধী—আরউইন প্যাকটের ফলে কংগ্রেসের মর্যাদা ও জনসাধারণের আত্মশক্তিতে বিশ্বাস অসাধারণ রকম বেড়ে গিয়েছিল এবং জনসাধারণের এই আত্মপ্রত্যয় হয়েছিল যে ভারতবর্ষ তাহলে সত্যি সত্যিই স্বাধীনতা হতে পারে। জগত সভায় ভারতের দাবিও এই প্যাকটের ফলে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আরও একটা কথা ভুললে চলবে না। যাঁরা সহিংস ও সশস্ত্র বিপ্লব করতে চান—তাঁরা অহিংস সত্যাগ্রহী নেতা গান্ধীজীর ভরসায় আন্দোলন করবেন কেন? কেন তারা আশা করবেন যে গান্ধীজী শেষপর্যন্ত তাঁদের— বিপ্লবীদের— ফাঁসির মঞ্চ থেকে বাঁচিয়ে দেবেন? তাহলেও একথা সত্যি গান্ধীজী অহিংস হয়ে বিপ্লবীদের কারামুক্তকরার জন্য এই ফাঁসীর আসামীদের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ও মামলায় উকিল ব্যারিষ্টার লাগাবার জন্য অনেক কিছু করতেন—যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। কেন না গান্ধীজী বলতেন, ”কংগ্রেসকে সমস্ত দেশের প্রতিনিধি হতে হবে। যারা কংগ্রেসে বিশ্বাস করে না এবং এমন কি যারা সম্ভব হলে কংগ্রেসকে চূর্ণ করে দিতে চায় তাদের স্বার্থও কংগ্রেস অবহেলা করতে পারে না।” বিরোধী—অবিরোধী সকলেরই মঙ্গল তিনি চাইতেন বলে তাঁকে সত্যি সত্যি ‘জাতির পিতা’ বলা যায়। পিতা যেমন সকল সন্তানকেই ভালোবাসেন, যে ছেলেটা অবাধ্য হয়ে গেছে, তার প্রতি কর্তব্য পালনেও অবহেলা করেন না—তিনি তেমনি জাতির সকলের মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করতেন। Father of the nation-এর এই সত্যিকার পরিচয়।

গান্ধীজি হিংসার মধ্যেও পার্থক্য বিচার করতেন। সব সহিংস—আন্দোলনকেই তিনি এক চোখে দেখতেন না। আত্মরক্ষার জন্য সহিংস প্রতিরোধকে তিনি ন্যায্য অধিকারী বলেই মনে করতেন। আক্রমণকারীর হিংসা বা প্রবলপক্ষের হিংসাকে তিনি কখনো ক্ষমা করতেন না। তিনি বলেছেন, ‘‘If a man fights with with his sword single-handed against a horde of dacoits armed to the teeth, I should say that he is fighting almost non-violently. Have I not said to our women that if in defence of their honour they used their nails and teeth and even a dagger, I should regard their conduct non-violent ?……..In the same way, for the Poles to satnd violently against the German hordes, vastly superior in number, millitary equipment and strength, was almost non-violence. (Mahatma Vol-V. P. 388-9)

অর্থাৎ, একদল সশস্ত্র ডাকাতের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যদি কোন ব্যক্তি একা একখানা তলোয়ার নিয়েও লড়াই করে তবে তাকে আমি প্রায় অহিংসা সংগ্রাম বলবো। নারীরা তাদের আত্মরক্ষার জন্য যদি তাদের নখ, দাঁত, এমন কি একখানা ছোরাও ব্যবহার করে তবে তাদের সেই প্রতিরোধকেও আমি প্রায় অহিংস সংগ্রাম বলবো।………এইভাবে বহুগুণে শক্তিশালী আক্রমণকারী হিটলারের দোর্দণ্ড দলের বিরুদ্ধে পোল্যাণ্ডের স্বাধীনতা কামীরা যে সশস্ত্র প্রতিরোধ করেছেন তাকেও আমি প্রায় অহিংসার মধ্যেই ধরি।” এই থেকে বোঝা যায় গান্ধীজির চিন্তাধারা কত সংস্কারমুক্ত ছিল। ন্যায্য সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামকে, আত্মরক্ষার সংগ্রামকে তিনি এতটা মর্যাদা দিতেন যে, তাদেরকে তিনি অহিংসার গৌরবই দিতে প্রস্তুত ছিলেন। জাপানের বিরুদ্ধে চীনের সশস্ত্র প্রতিরোধকেও তাঁর নৈতিক সমর্থন দিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নি। তিনি কখনো কট্টর, গোঁড়া বা Fanatic ছিলেন না, কোন একটা মন্ত্র বা formula-কে আঁকড়ে থাকতেন না, মানুষের উন্নতি ও মুক্তির মানদণ্ড দিয়ে তাঁর আদর্শের বিচার চলতো। কাজেই তিনি সত্যের জন্য সংগ্রামী হিংসাবাদীদেরও ভালোবাসতেন। তিনি একদিন বিপ্লবীদের বলেছিলেন, ‘‘If you can reach your goal by any other way, do so by all means. You will deserve my congratulations. For, I cannot in any case stand cowardice. Let none say when I am gone that I taught the people to be cowards. If you think my ahimsa amounts to that or leads you to that, you should reject it without hesitation. I would rather think that you died in abject terror. (Mahatma Vol. V. Page 141.)

”যদি তোমরা তোমাদের লক্ষ্যে অন্য কোন উপায়ে পৌঁছাতে পারো, নির্ভয়ে সেই পথে চলো। তোমরা আমার অভিনন্দন পাবে। কেন না, আমি কোন অবস্থায়ই কাপুরুষতা সহ্য করতে পারি না। আমার মৃত্যুর পরে কেউ যেন এই অভিযোগ না করে যে আমি কাপুরুষতার শিক্ষা বা প্রশ্রয় দিয়ে গেছি। যদি তোমরা মনে করো যে আমার শিক্ষা সেদিকেই নিয়ে যায়, তবে তোমরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করো না আমাকে বর্জন করতে। আমি বরং চাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমার ঘুষির বদলে ঘুষি খেয়ে মরো—কিন্তু কখনো ভয়ে ভীত হয়ে মরো না।” অতি পরিষ্কার কথা। কোন ব্যাখ্যার দরকার করে না।

নোয়াখালিতে থাকা কালে পুরোনো বিপ্লবীদের সাথে তাঁর এক বৈঠক হয়, কি করে আত্মরক্ষা করা যায়, নারীদের ইজ্জত রক্ষা করা যায়, হিন্দুদের মনে বল ফিরিয়ে আনা যায়, বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল এই। ‘‘You will note, added Gandhiji, that for purpose of our present discussion I have not asked you to discard the use of arms. It is not for me to provide arms for the Chittagong Armoury Raid men. The most tragic thing about the armoury Raid people, is the they could not even multiply themselves, their bravery was lop-sided. It did not infect others.’’ ‘‘No wonder, it could not’’ exlcaimed a worker. ‘‘The Armoury Raid people were comdemned.’’

‘‘By whom ?’’ he asked. ‘‘I may have–that is a different thing.’’

‘‘The people did so. I am myself an Armoury Raid man.’’

‘‘They did not, you are no armoury raid man or you should not have been here to tell these things. That so many of them should have remained living witness of the things that have happened is in my eyes a tragedy of first order. If they had shown the same fearlessness and courage to face death in the present crisis, as they did when they made that raid, they would have gone down in history as heroes. As it is, they have only inscribed a samll footnote in the page of history. You will see I am not, as I have already said, asking you just how to unlearn the use of arms, or ot follow my type of heroism. I have not made it good, even in my own case. I have here to test it in East Bengal. I want you to take up the conventional type of heroism. You should be able ot inject others both men and women—with courage and fearlessness to face death when the alternative is dishonour and humiliation. Then the Hindus can stay in East Bengal, noto otherwise. After all Muslims are blood of our blood and done of our bone. (Mahatma, Vol. VII Page. 301.) গান্ধী বললেন, ”তোমরা দেখছো আমাদের বর্তমান আলোচনার বিষয়বস্তুতে আমি অস্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা করছি না। অস্ত্র তোমাদের সংগ্রহ করে দেওয়া আমার কাজ হতে পারে না। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনকারী বিপ্লবীদের অস্ত্র আমাকে যোগাড় করে দিতে কেউ নিশ্চয়ই বলবে না। অস্ত্রাগার লুন্ঠনকারী বিপ্লবীদের সম্বন্ধে সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, তারা তাদের দল বাড়াতে পারলো না। তাদের বীরত্ব বড্ড একপেশে ছিল। তাদের বীরত্ব সংক্রামক হতে পারে নি।

একজন কর্মী বলে উঠলেন, ”তাতে আর আশ্চর্য কি? অস্ত্রাগার লুন্ঠনকারীদের নিন্দা করা হয়েছিল।”

গান্ধীজী জিজ্ঞাসা করলেন, ”কে নিন্দা করেছিল? হয়তো আমি করেছিলাম কিন্তু সে কথার অর্থ ভিন্ন রকমের।”

”জনসাধারণও নিন্দা করেছিল। আমি নিজেই অস্ত্রাগার লুন্ঠনকারীদের একজন।

”না, দেশ কখনো তাঁদের নিন্দা করে নি। তাছাড়া তুমি সেই বিপ্লবীদের মধ্যে একজন নও। তা যদি হতে তাহলে তোমার পক্ষে আজ আমার কাছে এইসব মর্মন্তুদ ঘটনার সংবাদ নিয়ে আসার অবসর হতো না। তোমাদের মধ্যে আজও সেই দলের এত লোক জীবিত আছে নোয়াখালির এই কলংকের চাক্ষুষ সাক্ষ্য দেবার জন্য—এ আমার কাছে অতি শোচনীয় ঘটনা বলে মনে হয়। তাঁরা অস্ত্রাগার লুন্ঠন করার সময় যে সাহস দেখিয়েছিলেন, আজ যদি তাঁরা নোয়াখালির হিন্দুদের এই সংকটে তেমনি নির্ভীকতা দেখাতে পারতেন, তবে তাঁরা ইতিহাসের পাতায় বীর হিসেবে স্থান পেয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁরা যা করেছেন তাতে তাঁদের নাম ইতিহাসের কোন পাদটীকার মত একটু সামান্য স্থান অধিকার করে আছে মাত্র। তোমরা লক্ষ করেছ, আমি আগেও বলেছি যে অস্ত্রের শিক্ষা তোমরা ত্যাগ করে আমার ধরনের বীরত্বের পথ অনুসরণ কর—এ আমি তোমাদের বলছি না। আমার ধনের বীরত্ব পথকে আমি এখনও স্পষ্ট করে তুলতে পারিনি, আমার নিজের জন্য তা নির্ভুল করে উঠতে পারি নি। পূর্ববঙ্গে আমি আমার পথের পরীক্ষা করতে এসেছি। আমি তোদের প্রচলিত ও চিরাচরিত বীরত্বের পথ গ্রহণ করতেই বলেছি। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার আশা এই যে, তোমরা অন্যদের—নারী ও পুরুষ—সবারই প্রাণে তোমাদের সাহসের সংক্রমণ করাতে পারবে, যাতে তারা নিজেদের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা করার জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস পায়। তাহলেই হিন্দুরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পারবে, নইলে নয়। কেন না শেষ পর্যন্ত মুসলমানেরা আমাদেরই রক্তের রক্ত। আমাদের হাড়ের হাড়।”

একটা ভুল ধারণা যাতে না হয় তার জন্য এখানেই গোটা কয়েক কথা বলে রাখা ভালো—যদিও বারান্তরে তার বিশদ আলোচনার দরকার হবে। অন্যান্য দেশে যেরকম রক্তাক্ত বিপ্লব হয়েছে এবং যেভাবে সেসব দেশের জনতা নিজেদের রাজ কায়েম করেছে—ভারতবর্ষে সেরকম বিপ্লব হতে পারতো, কিনা, এর বিচার একটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কেন না এখানে আমরা সে জাতীয় আলোচনা উত্থাপন করতে চাইনি—আমরা কেবল আমাদের নজর গান্ধীজীর ভূমিকায় ইতিহাসের সার্থকতাকত দূর এবং কেন হয়েছে, তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো। এছাড়া এদেশের সশস্ত্র বিপ্লব হতে পারতো কিনা—এ একটা academic ও hypothetical তর্ক। যদি সত্যি সত্যি একদল বিপ্লবী সর্বভারতে সশস্ত্র বিপ্লব করতে বহু আগে থেকেই লেগে যেতেন, যদি তাঁরা গণআন্দোলনের দায়িত্ব গান্ধীজির হাতে সঁপে দিয়ে নিজেরা কেবল অস্ত্রের কথাটা না ভাবতেন, যদি তাঁরা সমগ্রভাবে ভারতীয় জাতীয়তার দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করতেন, যদি তাঁরা প্রথম, থেকেই জনতাকে হাত করার জন্য লেগে যেতেন এবং মুষ্টিমেয় বিপ্লবীদের মধ্যেই বিপ্লব সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস না করতেন, যদি তাঁরা গান্ধীজীর সাহায্যেই শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র বিপ্লবের পটভূমিকা তৈরি করার মিছে স্বপ্ন না দেখে শুরু থেকেই কংগ্রেসের বাইরেই নিজেদের গণসংগ্রাম গড়তে চেষ্টা করতেন—তবে ভারতের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো বৈকি। কিন্তু আজ এসব কথা সম্পূর্ণ কেতাবী বা academic তর্কমাত্র—যার সঙ্গে বাস্তবের কোন সম্পর্ক নেই। গান্ধীজীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পথ ও লড়াইয়ের কায়দা নিশ্চয়ই সশস্ত্র সংগ্রামের চেয়ে ভিন্ন—অতএব সশস্ত্র সংগ্রামকারীরা, কেন গান্ধীজী তাঁদের মতো সংগ্রাম চালাচ্ছেন না—এই অনুযোগ করতে পারেন না। অথবা তাঁরা যে মনে করতেন গান্ধীজী শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েই সশস্ত্র সংগ্রামের আদেশ দেবেন—এই ভুল ধারণা করতে গান্ধীজী কখনো সুযোগ দেন নি। অতএব যা তাঁর কাছ থেকে পাবার নয়—তার আশা করে থাকা নিশ্চয়ই ভুল। অথবা জনসাধারণ একদিন গান্ধীজীর নেতৃত্বকে দূর করে দেবে—যে জনসাধারণ গান্ধীজীর প্রভাবেই বর্ধিত ও চেতনাপ্রাপ্ত হচ্ছে—এমন সহজ স্বপ্ন দেখাও ভুল হয়েছে। গান্ধীজীর প্রকৃত শক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি না করার জন্যই তাঁর কাজটাকে লঘু করে দেখার জন্যই এ জাতীয় ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অতবে গান্ধীজী কেন বেপরোয়া রক্তাবিপ্লবের ডাক দিলেন, এজাতীয় অভিযোগ ও অনুযোগ হাস্যকর। কাজেই গান্ধীজীর সংগ্রাম পদ্ধতি, আপোষ করার নীতি, সংগ্রাম কৌশল ও সংগ্রামের বিরতি, গঠনমূলক ভঙ্গী, শত্রুর সঙ্গে ঠিক শত্রুর মতো ব্যবহার না করা ইত্যাদি যে সমস্ত কৌশল আমরা পছন্দ করি নি বা বুঝতে পারি নি—সেগুলি তাঁর অহিংসা সম্বন্ধে ধারণা থেকেই একমাত্র বোঝা সম্ভব, হিংসার নীতি থেকে বোঝা শক্ত বৈকি। যেমন হরজন পত্রিকার উপর সরকার ১৯৪০ সালে যখন censor বসাতে চাইলেন, গান্ধীজী তখন হরিজন পত্রিকা সোজা বন্ধ করে দিলেন, সরকারী নিয়ন্ত্রণ মানলেন না এবং সরকার এই কাগজকে নিয়ন্ত্রিত করতে যতটা আশা করেছিলেন তার চেয়ে বেশি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করে দিলেন, অর্থাৎ কাগজটা বন্ধ করেই দিলেন। সরকার হয়তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, অথবা অন্যদিক দিয়ে বিব্রত হয়ে পড়লেন। তিনি তখন লিখলেন, ‘‘If my life were regulated by violence in the last resort, I would refuse to give an inch lest an ell might be asked for. But if my life is regulted by non-violence, I should be prepared to and actually give an ell when an inch is asked for. By so doing I produce on the usurper a strange and pleasurable sensation. He would also be confounded and would not know what to do with me.’’ (Harijan 10.11.40)

অর্থাৎ ”আমার জীবন যদি শেষ পর্যন্ত হিংসার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তবে আমার বিপক্ষ যদি আমার কাছে এক ইঞ্চি পরিমাণ কিছুও চায় আমি তা—ও দিতে রাজী হবো না, পাছে সে শেষ পর্যন্ত পুরো গজ পরিমাণটাই চেয়ে বসে। আবার যদি আমার জীবন অহিংসা—নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে বিপক্ষ যদি এক ইঞ্চি চায়, আমি তাকে নির্বিবাদে এক গজ দিয়ে দেবো। কেন না ইঞ্চির বদলে পুরোগজ পেয়ে দখলকারীর মনে এক অদ্ভূত ও সুখকর অনুভূতি আসতে বাধ্য। তাছাড়া সে তখন বিমূঢ় হয়ে পড়তেও পারে এবং আমাকে নিয়ে কি করা যায় সেই ভাবনায় পড়ে যাবে।” অতএব আমার দেখছি অহিংস—সংগ্রামের কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গী ও দার্শনিক ভিত্তি সম্পূর্ণ অন্যরকম বলে গান্ধীজি বরাবরই বলে আসছেন ও দেখিয়ে আসছেন। সত্যাগ্রহ সম্বন্ধে যখন আলোচনা করা যাবে তখন এর আরো বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে।

এখন আমরা আমাদের আলোচনার ধারায় ফিরে যাই। সময়ে সময়ে বেশ স্পষ্ট দেখা যায় যে গান্ধীজি dogmatic non-violence পছন্দ করেন নি। জীবহত্যা অন্যায়, কিন্তু মানুষ জীবহত্যা না করে পারে না। নির্ভেজাল অহিংস হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর মতে একমাত্র ভগবান ছাড়া আর কেউ সত্যি সত্যি অহিংস হতে পারে না। যুদ্ধের সময় অন্নকষ্ট দূর করার উপায় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনবার ব্যবস্থ করতে সরকারকে বলেছিলেন। একজন ভক্ত তাঁকে বলেন, বাঙালিরা মাছ খায় এবং বাস্তবতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অহিংস হবার কারোরই সাধ্য নেই। তিনি আর এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘To allow crops to be eaten up by the animals in the name of ahimsa, while there is famine in the land, is certainly a sin. Evil and good are relative ferms. Whatis good under certain condition can become an evil……….sin under different set of condition.’’ (Mahatma Vol. VII, page. 153)

অর্থাৎ ”দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলেছে তখন অহিংসার নামে জন্তু জানোয়ারদের শস্য নষ্ট করতে দেওয়া, খাইয়ে দেওয়া, নিশ্চয়ই পাপ। ভালো ও মন্দ উভই আপেক্ষিক সত্য। কোনও একটি অবস্থায় যা ভালো, ভিন্ন অবস্থায় তা মন্দ হয়ে দাঁড়াতে পারে।” বিপ্লবী স্পষ্ট। Absolute Truth মানুষের পক্ষে ধরা অসম্ভব—যদিও তিনি Absoulte Truth বা ভগবানকে পাবার জন্য সাধনা করে চলেছেন। তবে তাঁকে Relative Truth নিয়ে চলতে হচ্ছে, সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। তাঁর আত্মজীবনীতেও তিনি লিখছেন—‘‘So long as I have not realised the absolute truth, so long must I hold by my relative truth as I have conceived it.’’ অর্থাৎ ”যতদিন পর্যন্ত না আমি পরম সত্যকে দেখতে পাচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে আপেক্ষিক সত্যকেই ধরে চলতে হবে।” এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি relative truth বা খণ্ড সত্য বা আপেক্ষিত সত্যকেই নিয়ে তাঁর চলতে হয় তবে পরম সত্য বলে একটা কিছু আছে, এই ধারণা রাখার সার্থকতা কি? কেন এই Abstract Truth বা Abstract Ideal-এর পিছনে ছোটো? তিনি উত্তর বলেছেন, ধ্রুব তারা নাবিকের কাছে যেমন পরসত্য, আমার কাছে তেমনি। ধ্রুব তারা সুদূর আকাশের মানুষের হাতের নাগালের বহুদূরে চিরকালই থাকবে, কিন্তু নাবিকের ধ্রুব তারা দিয়ে তাদের দিগনির্ণয় করে থাকে—সে দূর বলে কম প্রয়োজনীয় নয়। তেমনি, পরম সত্য, পরম আদর্শ যতই মানুষের অসাদ্য হোক—তবু মানুষের জীবনসমুদ্র তারা ধ্রুব তারার মতোই কাজ করে যাবে। এই আদর্শ ও পরমসত্যের পিছনে না ছুটলে মানুষের কোন ভবিষ্যতই নেই। এবং কোনকালেও থাকেব না। তিনি বলেছেন, আমি হলেম ‘Practical Idealist বা বাস্তব আদর্শবাদী। তাই একদিকে তাঁকে আমরা দেখি নিষ্ঠবান অহিংসার পূজারী রূপে, অপরদিকে অবস্থার সীমাটাও তার লক্ষ্যে স্পষ্ট, তাই মাত্র ছাড়িয়ে যাওয়াকে তিনি অন্যায় বলতেন। এই মাত্রা হলো মানুষের নিজের দুর্বলতা, অবস্থায় গণ্ডী। যারা কেবল আদর্শের পূজারী, তার স্বপ্নবিলাসী ও Utopian হয়ে যেতে বাধ্য। আর যারা কেবল বাস্তববাদী practicalism ও pragmatism-কেই সম্বল করে চলে যারা, তারা কখনো দূর সৃষ্টিসম্পন্ন হয় না। তারা সুবিধাবাদী হতে বাধ্য হয়, নীতিহীনতা এসে যায়। কাজেই এই দুই ভিন্ন প্রেরণাকে যাঁরা সংযুক্ত করতে পারেন, তাঁরাই বাস্তবেও সার্থক হন—আবার ক্রমশঃ আদর্শের দিকেই তাঁরা এগিয়ে যেতে পারেন। বিজ্ঞানী এবং নীতিধর্ম সম্পর্কে তাঁর ধারণা এইপ্রকারের। বিজ্ঞানের কোন নীতিবোধ বা moral নেই। বিজ্ঞান বলতে পারে, মানুষের কচি শিশুদের মাংস, মুরগীর মাংসের মতোই উপাদেয় ও উপকারী হওয়া সম্ভব—কিন্তু মানুষের নীতি ও ধর্মবোধ এই কথা শুনে আঁতকে উঠবে। অতএব বিজ্ঞানকে আদর্শ ও নীতির উপদেশ ও পাহারা মেনে চলতে হবে, আবার আদর্শ ও নীতিকে বিজ্ঞানসম্মত করে তুলতে হবে, তা বিজ্ঞানবিরোধী হলে চলবে না।

যাই হোক, আমার অহিংসার কথা ফিরে যাই। তিনি পরম অহিংস হবার জন্যই সর্বদা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করতে পারেন নি। তিনি বুঝতেন, যদি একটি দুর্বলচিত্ত লোক একখানা লাঠি হাতে পেলে সবলতা ফিরে পায় এবং অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পায়, তবে তিনি লাঠি বা অস্ত্রকে অস্বীকার করবেন কি করে? যদি অহিংস উপায়েই বিনা লাঠি, বিনা বন্দুকেই সে রুখে দাঁড়াতে পারে, বাহবা, বেশ—এর মতো চমৎকার আর হয় না। তিনি লোকেদের জন্য এই কথাই, এই শিক্ষাই, এই আদর্শই প্রচার ও প্রয়োগ করে গেছেন। কিন্তু তিনি মেনে নিয়েছেন, বারে বারে যদি কেউ তার পথে সাহস না পায়, যদি অস্ত্র ছেড়ে দিলে তার মনের বল ভেঙে যায়, যদি সে অহিংসার মতো আদর্শকে গ্রহণ না করতে না পারে—তবে অস্ত্র তার হাতে থাকুক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াক, তাতে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি মনে করতেন ধীরে ধীরে তাঁর আদর্শের বাস্তবশক্তি মানুষ বুঝতে পারবে। একদিনেই সমগ্র জগত তাঁর কথার মর্ম ও সক্রিয়তা বুঝতে পারবে না—কেন না ইতিহাসের হাজার হাজার বছর ধরে লড়াইয়ের যে সংস্কারের তার এসেছে তার এসেছে তা সহসা ত্যাগ করা সম্ভব নয়। এই ছিল তাঁর Practical Idealism. এই সূত্র থেকেই বুঝতে হবে কেন গান্ধীজী বিপ্লবীদের নোয়াখালিতে অস্ত্রত্যাগ করতে আদেশ দেন নি, কেন চীনের সংগ্রামকে, পোল্যাণ্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি প্রায় অহিংস বলে আশীর্বাদ করেছিলেন এবং কেন শেষপর্যন্ত পণ্ডিত নেহরুকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে কাশ্মীরকে রক্ষা করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে পাঠাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সমস্ত অনুমতি দিলেও তিনি কখনও অহিংসার জন্য অভিযানকে ব্যর্থ মনে করেন নি। তিনি বলে গেছেন, অহিংসার পথে যেতেই হবে। মানুষের অন্য গতি নেই—অবস্থার চাপে পড়েও নেই। পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর অহিংস যুদ্ধবিগ্রহ একপ্রকার অচল হয়ে গিয়েছে। যদি সাধারণ মানুষ, অত্যাচারিত মানুষ পারমাণবিক বোমার জন্য আজ লড়াই, চিরাচরিত সশস্ত্র লড়াই করা অসম্ভব মনে করে—তবে তাকে কি করতে হবে? সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের প্রয়োজন তো আজও রয়েছে—তাদেব অন্য পথ আবিষ্কার করতেই হবে। সে পথ সত্যাগ্রহের পথ—অহিংসার পথ। এই পথ শক্ত হতে পারে, কঠিন হতে পারে—কিন্তু অন্য পথ, পারমাণবিক বোমার পথ, শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব এবং রুদ্ধই বলা চলে।

আজকাল অনেকেই দাবি করে থাকেন যে ভারত একমাত্র অহিংসার সাহায্যেই স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু গান্ধীজী সে দাবি কখনও করেন নি। তিনি বলেছেন, অহিংসার দান রয়েছে, তার প্রভাব হয়তো খুব বেশি ছিল, কিন্তু সত্যিকার অহিংসা বা বীরের অহিংসা খুব বেশি দেখানো হয় নি। পলে ভারতে এতো অনাচার। এতো দাঙ্গা এতো বীভৎস কাণ্ড ঘটছে স্বাধীনতা পাবার সময়। দুর্বলের অহিংসা বলে কোনো জিনিস নেই—সকলের হিংসা কি, ভারত তা আজও ব্যাপকভাবে বুঝতে পারে নি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে নানা সন্দেহ ও উদ্বেগে ভুগতে হয়েছে। জীবনের শেষ বছরটি তাঁর গভীর বেদনা ও বিক্ষোভের মধ্যে কেটেছে। তিনি আকুল হয়ে দিনরাত্রি প্রশ্ন করে চলেছেন—তবে কি তিনি কংগ্রেসের দ্বারা প্রসারিত হয়েছেন, তবে কি দেশবাসী কখনোই অহিংসা বুঝতে পারে নি, তাদের অহিংসা, হিংসার সম্মুখে দাঁড়াতে পারছে না কেন? কেন তাঁর নিকটতম শিষ্যমণ্ডলীও অহিংসা ত্যাগ করে অস্ত্র ধরবার জন্য এতো ব্যাপাক হয়ে উঠেছে। কেন তাদের বিশ্বাস অগ্নিপরীক্ষার সামনে এসে গলে যাচ্ছে। দাঙ্গার মধ্য দিয়ে মানুষের যে কুৎসিত কাপুরুষতা, নৃশংসতা, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার আগুন দেখা দিয়েছিল—এই আগুন কি করে নেভানো যায়? গভীর রাত্রিতে পাগলের মতো ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন, আলো চাই—আর বলেছেন—ম্যায় ক্যাঁ করুঁ, ম্যায় ক্যা করুঁ। (Vide, My Days with Gandhi—by N. K. Bose)

‘‘The world thought that India had won her independence through non-violence, and, if it is so it was a unique thing in history. How he wished it was really so. But he had alrdeay declared that it was not. The cowardly or the weak or the lame of the heart colud never practice non-violence. The physically disabled could always practice non-violence, if they had the grace of God. He had blindly thought that India’s fight was non-violent. But the event that had taken place lately, had opened his eyes to the fact that theirs was the passive resistance of the weak. If the Indian had really been bravely non-violent, they could never have iudulged in the acts of which they are guilty. (Mahatma Vol. VIII, page—368)

”জগতের লোকের ধারণা ভারতবর্ষ অহিংসার সাহায্যে স্বাধীন হয়েছে এবং যদি তাই হয়ে থাকি তাহলে ইতিহাসের পাতার একটা নতুন কিছু ঘটলো বটে। গান্ধীজী বলেন, আরে, যদি তাই হতো। কিন্তু তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তা অহিংসার বলেই ঘটে নি। যারা ভীতু, দুর্বল ও ক্ষীণচিত্তের লোক, তারা কখনোই অহিংসার প্রয়োগ করতে পারে না। শরীরে যারা অক্ষম তারাও ভগবানের কৃপা থাকলে অহিংসা দেখাতে পারে। তিনি অন্ধের মতো ভেবেছিলেন যে ভারতের সংগ্রাম বুঝি অহিংসার পথেই চলেছে। কিন্তু ইদানীং যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তাতে তাঁর চোখ খুলে গিয়েছে এবং তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তাদের সংগ্রামটা দুর্বলের পরোক্ষ প্রতিরোধ মাত্র। যদি ভারতীয়েরা সক্রিয় বীরের অহিংসা পালন করতো, তবে কখনোই তার এসব হীন কাজ করতে পারত না। আজ তারা দোষী।”

আবার শুনুন, ‘‘Let me make one thing clear. I have frankly and freely admitted that what we have practised during the past thirty years was not non-violent resistance, but passive resistance, which only the weak offer because they were unable, not willing, to offer an armed resistance. If we know the use of non-violent resistance which only the hearts of oak can offer, we can present to the world a different picture of free India, instead of an India cut into twain, one part hightly suspicious of the other and the two too much engaged in internal strife to be able to think cogently of the food and clothing of the hungry and naked millions, who know no religion, that know of one and only God, who appears to them in the guise of necessaries of life. ‘‘Mahatma Vol. VIII, page—57)

”একটা জিনিস স্পষ্ট করে দিতে চাই। গত ত্রিশবছর ধরে আমরা যে প্রতিরোধ আন্দোলন করে এসেছি তা সত্যিকারের অহিংস আন্দোলন ছিল না—তাক্সিচদ্ভ্রল পরোক্ষ প্রতিরোধ মাত্র—যা দুর্বলেরাই করে থাকে। কেননা সশস্ত্র সংগ্রাম গ্রহণ করবার সাহস, ইচ্ছা ও ঝুঁকি নিতে তারা পারে না। যদি আমরা অহিংস প্রতিরোধ করতে পারতাম অন্তর যাদের ওক গাছের মতো শক্ত, একমাত্র তারাই সেই অহিংসা দেখাতে পারে—তবে পৃথিবী আজ স্বাধীন ভারতের একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি দেখতে পেতো এবং আজকের দ্বিখণ্ডিত ভারতে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ ও আত্মকলহ—বিড়ম্বিত ছবির বদলে দেখতে পেতো যে আমরা ক্ষুধিত ও নগ্ন লক্ষকোটি জনতার অন্নবস্ত্র সংগ্রহে সত্যি সত্যি ব্যস্ত—যে জনতার কাছে অন্নবস্ত্রাদি অতি প্রয়োজনীয় চাহিদা—যে ভগবান সেটা মেটাতে পারে, সেই ভগবান ছাড়া আজ তাদের অন্য কোনো ভগবান নেই, থাকতে পারে না।”

শুধু কি জনসাধারণের অধঃপতনেই গান্ধীজী ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন? তিনি কংগ্রেসের ভিতরকার গলদ, কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডল ও সভাসদদেরও ত্রুটি, অধঃপতন ও সুবিধাবাদ দেখাতেও কম কঠিন কথা ব্যবহার করেন নি। হরিজন কাগজে দক্ষিণ—ভারতে এক কংগ্রেস নেতার পত্র তিনি নিজের মন্তব্য ও বেদনাসহ প্রকাশ করে দিলেন।

‘‘I intensely hate to point out the shortcomings of the individuals, but to shut one’s eyes to the terrible consequences of the rot set in the the individuals an organisation like the Congress of noble in its origin and admirable in its achievements, would be heinous. The root in the Congress is that of the people’s represenation in the legislative bodies of the provinces, who are the prototype of the rank and file. They are vociferous about stopping the widespread corruption, but they themselves resort of worse corruption. They accept money from the people to secure licences of every description, indulge in black-marketing of the worst type, trade on the ignorances of the masses, and corrupt the sources of justice, and force the administrative machinery to get transfers for the administrative personnel. The people are crushed between these set of people. Two hundred and fifty of these legislators let loose on the people in a province without opposition, are, in my opinion, the worst plague. Is it after all for the replacing rapacity of the while by the Black that so many noble souls, who are no more with us, suffered and sacrificed everything worth living for in their lives ? There must be an escape from this morass.’’ (Tendulakr, Mahatma Vol. VIII, page—292)

”লোকের দোষদ্রুটি দেখতে আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি কিন্তু কংগ্রেসের মত গৌরবময় প্রতিষ্ঠান, যার জন্ম ও জীবন নানা কীর্তিতে ভরা—সেই কংগ্রেসের মধ্যে ব্যক্তি চরিত্রে যে ভয়াবহ পচন দেখা দিয়েছে, তা দেখতে না চাওয়া আজ ঘোরতর অপরাধ হবে আমার পক্ষে। প্রাদেশিক আইন সভাগুলিতে যে সমস্ত সভ্য আজ নির্বাচিত হয়েছে, তাঁরা সাধারণ কংগ্রেসকর্মীদের প্রতিবিম্ব মাত্র। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা খুব মুখর কিন্তু নিজেরা অধিকতর দূর্নীতিতে দৃষ্ট। নানারকম লাইসেন্স সংগ্রহ করিয়ে দিতে এঁরা ঘুষ খান, নানারকমের কালোবাজারের অংশীদার হয়ে পড়েছেন, এঁরা, জনসাধারণের অজ্ঞতার সম্পূর্ণ সুযোগ নেন নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্য, বিচারালয়গুলিকেও এঁরা দূর্নীতিদুষ্ট করে তুলেছেন, কর্মচারীদের বদলির উপর এঁরা অসম্ভব প্রভাব খাটিয়ে থাকেন—নিজেদের স্বার্থে। জনসাধারণ এই দুই দলের লোকের চাপে আজ পিষ্ট। দুইশত পঞ্চাশ জন এই জাতীয় আইন সভাসদেরা, যাদের বাধা দেবার মত কোন বিরোধীদল নেই—আজ তাঁরা জনতাকে লুন্ঠন করতে ব্যস্ত—এই জিনিসটা আমার কাছে প্লেগের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে হয়। সাদাদের শোষণ ও লুন্ঠনের পরিবর্তে কালোদের লুন্ঠন ও শোষণ কায়েম করার জন্যই কি এতো প্রাণ বলিদান করা হয়েছে? যাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নেই তাঁরা ধন প্রাণ যা কিছুর জন্য মানুষ জীবন উপভোগ করে থাকে, সেসব উৎসর্গ করেছেন কি এরই জন্য? এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ চাইই চাই।”

গান্ধীজী মনে করতেন এই পঙ্কিলতার জন্ম কখনো অহিংসা থেকে হতে পারে না। এ যখন দেখা দিয়েছে তখন বুঝতে হবে আমাদের অহিংসার আড়ালে গোপন হিংসা, গুপ্ত লোভ, নির্লজ্জ সুবিধাবাদ বাসা বেঁধে ছিল। গান্ধীজী তাঁর শেষ জীবনে এসেই এই দুর্বলতার পূর্ণ রূপটা দেখতে পেলেন। কেন আগে দেখতে পান নি বা complacent ছিলেন, এই অভিযোগ নিশ্চয়ই করা যায়। তিনি নিজেও এইজন্য ক্রমশঃ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন এবং এমন কি তিনি আর ১২৫ বছর বেঁচে থাকতে চান না, তিনি হয় এই হিংসা ও পচনের পঙ্ক দূর করবেন নইলে প্রাণ বিসর্জন করবেন, এমন ধরনের ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও। তবে দুর্বলের ভীরু অহিংসা বলে যে কিছু নেই একতা অবশ্য তিনি বহুপূর্ব থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু এসব বলা সত্ত্বেও তিনি কঠিন পরীক্ষা দ্বারা দেখেন নি, যারা কংগ্রেসে ঢুকছে তাদের সত্যিকার নিষ্ঠা কতটুকু। ১৫.১০.২৫ তারিখের Young India-তে তিনি লিখেছেন, ‘‘Retreat of our fear was cowardice and cowardice would not hasten a settelment or the advent of non-violence. Cowardice was a species of violence which it was the most difficult to ovrecome. One would hope to persuade a violently inclined person to shed his violence but since cowardice is the negation of all force, it was impossible to teach a mouse non-violence in respect of a cat. He would simply not understand what non-violence could be, because he had not the capacity for violence against the cat. Would it not be a mockery to ask a blind man not to look at ugly things ? Moulana Shaukat Ali and I were at Bettia in 1921. The people of a village near Bettia told me that they had run away whilst the police were looting their houses and molesting their womenfolk. When they said they had run away because I had told them to be non-violent, I hung my head in shame. I assured them such was not the meaning of my non-violence. I expected them to intercept the mightiest power that might be in the act of harming those who were under their protection, and draw without retaliation, all harm upon their own heads even to the point of death, but never to run from the storm-centre. It was manly engough to defend one’s property, honour or religion at the point of sword. It was manlier and nobler to defend them without seeking to injure the wrong-doers. But it was unmanly, unnatural and dishonnourable to forsake they post of duty, and in order to save one’s own skin to leave property, honour and religion to the mercy of wrong-doer. I could see my way of sucessfully delivering the message of Ahimsa to those who know how to die, not to those who are afraid of death.’’ (Communal Unity-page—117)

”ভয়ে পালিয়ে আসার নাম কাপুরুষতা। কাপুরুষতার সাহায্যে কোন মীমাংসা বা অহিংসা আনা সম্ভব নয়। কাপুরুষতাও এরকমের হিংসা, যা দূর করা খুব শক্ত। একজন হিংস্রতা প্রবণ লোককে বরং অহিংস করে তোলা সম্ভব—কিন্তু ভীরুতা যেহেতু সকল শক্তির নেতি, সেইহেতু মূষিককে বিড়াল সম্পর্কে অহিংসা কোন কালেই শেখানো সম্ভব নয়। মূষিক অহিংসা কি তা কখনো বুঝতে পারবে না; যেহেতু বিড়ালের বিরুদ্ধে সহিংস হবার মতো ক্ষমতাও তার কোন কালেই ছিল না। একজন অন্ধকে যদি বলা যায় সে কুৎসিৎ জিনিস দেখো না, তবে কি তা ঠাট্টার মতো শোনায় না? মৌলানা সৌকত আলি ও আমি ১৯২১ সালে বেটিয়াতে যাই। বেটিয়ার নিকট এক গ্রামের লোকেরা আমাকে জানায় যে যখন পুলিশেরা তাদের ঘরদোর লুঠ করতে লাগলো ও মেয়েদের উপর অত্যাচার করতে লাগলো, তখন পুরুষেরা গ্রাম থেকে পালিয়ে গেলো। যখন তারা বললো যে, তারা আমার শিক্ষানুসারে অর্থাৎ অহিংস থাকার জন্যই পালিয়ে গিয়েছিল, তখন আমার মাথা লজ্জায় নুয়ে পড়লো। আমি তাদের বোঝাই যে অহিংসার অর্থ তা নয়। আমি তাদের কাছ থেকে এই আশা করি যে যেন তারা জগতের সবচেয়ে শক্তিমান শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পায়—যখন তারা দেখবে সে শক্তি অন্যায় করতে উদ্যত, এবং কোন প্রতিশোধ না নিয়ে নিজেদের মাথার উপর সেই উদ্ধত শক্তির সমস্ত আঘাত স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করবে—কিন্তু কোন অবস্থাই রণক্ষেত্র থেকে পালাবে না। নিজেদের সম্পত্তি, মান সম্মান ও ধর্মকে তরবারির সাহায্যে রক্ষা করাতে কোন লজ্জা বা অধর্ম নেই। তা সম্পূর্ণ মানবোচিত ও বীরোচিত ব্যাপার। কিন্তু তারও চেয়ে উন্নততর ও গৌরবময় হবে সেই প্রতিরোধ, যাতে প্রতি—হিংসা নেই, অথবা শত্রুর প্রতি কোন অশুভ কামনা নেই। কিন্তু কর্তব্যের স্থান থেকে পালিয়ে আসা, নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে সম্পত্তি, মান—ইজ্জত ও ধর্ম অনিষ্টকারীর হাতে সঁপে দেওয়া অমানবিক, অস্বাভাবিক ও কলঙ্কময়। যারা মরতে পারে তাদেরকেই আমার অহিংসা বোঝানো সহজ—যারা মরতে ভয় পায়, তাদের অহিংসা শেখানো কঠিন।”

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মেটাবার উপায়ও যে সাহস সৃষ্টি করা, সে সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘The question here, therefore, is not now to teach one of the two communicties a lesson or how to humanize it, but how to tech a coward to be brave.’’ (Harijan 11.10.1928)

”সুতরাং প্রশ্নটা এই নয় যে দুয়ের মধ্যে কোন একটি সম্প্রদায়কে কেমন করে একটা শিক্ষা দেওয়া যায় বা কেমন করে তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগানো যায়, এখানে প্রশ্নটা হলো কেমন করে ভীরুকে সাহসী হতে শিক্ষা দেওয়া যায়।”

তিনি আবার বলেছেন, ‘‘I have, therefore, not hesistated to say that it is better to be violent, if there is violence in our breasts, than to to put on th cloak of non-violent ot cover impotence. There is hope for a violent man to become non-violent, there is no such hope for the imporent.’’ (Harijan 21.10.39)

”তাই আমি দ্বিধাহীনভাবে বলেছি, বারবার বলেছি যে, যদি আমাদের বুকের ভিতর হিংসাই থেকে থাকে তবে বরং সহিংস লড়াই—ই ভাল—কিন্তু কাপুরুষতাকে ঢেকে রাখবার জন্য অহিংসার মুখোশ পরা অন্যায়। হিংসা নপুংসক ভীরুতার চেয়ে চিরকালই শ্রেয়। হিংস্রাপরায়ণ লোককে বরং অহিংস করা সম্ভব, কিন্তু ভীরুর কোন গতি নেই।”

এখন আমরা দেখবো কংগ্রেস শাসন হাতে নিয়ে কিভাবে অহিংসকে ত্যাগ করেছে এবং গান্ধীজী তাতে কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। কংগ্রেস, আগেই বলেছিল, অহিংসাকে কখনো একটা শাশ্বত নীতি বা principle হিসেবে গ্রহণ করে নি—কৌশল বা tactics হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। ফলে যখন গত যুদ্ধের সময় ইংরেজের সাথে স্বাধীনতা দাবি দাওয়া নিয়ে কংগ্রেস একটা আপোষ করতে যাচ্ছিল, তখন স্বাধীনতা যদি ইংরেজ স্বীকার করে নেয় এবং প্রত্যক্ষভাবে দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্ত দায়িত্ব কংগ্রেসের হাতে তক্ষুণি দেয়, তবে তারা জাপান ও জার্মানীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নিযুক্ত হবে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অর্থাৎ অস্ত্র গ্রহণ করতে কংগ্রেস রাজি হলো ও অহিংসা পরিত্যাগ করতে রাজি হলো। এই সময় গান্ধীজী বলেছেন, ‘‘The tragedy of the situation is that if Congress is to throw in its lot with those who believe in the necessity of armed defence of India, the past twenty years will have been years of gross neglect of the primary duty of the Congraesmen to learn the science of armed warfare. And I fear that history will hold me responsible for the tragedy. The futre historian will say that I should have perceived that the nation was learning not the non-violence of the strong, but merely the passivity of the weak and that I shoud have, therefore, provided for the Congressmen’s military training.’’ (Mahatma Vol. V, page 21)

”অবস্থার শোচনীয় পরিণাম এই যে কংগ্রেস আজ অন্যান্য সবার সাথে দেশরক্ষার ব্যাপারে অস্ত্রধারণ করারই দরকার মনে করে, তাহলে গত বিশ বছর ধরে কেন কংগ্রেস—কর্মীদের সশস্ত্র—লড়াইতে শিক্ষিত করা হলো না এবং কেন এই দায়িত্ব অবহেলা করা হলো? আমার মনে হয়, ইতিহাস এই ত্রুটির জন্য আমাকে দায়ী করবে। ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক বলবে যে, আমার বোঝা উচিত ছিল যে দেশ বলিষ্ঠের অহিংসায় দিনকে দিন শিক্ষিত হয়ে উঠছে না বরং দুর্বলের পরোক্ষ প্রতিরোধই গড়ে উঠেছে এবং আমার কংগ্রেস কর্মীদের জন্য সামরিক শিক্ষারই ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।” এখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার, জাপানের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করার দায়িত্ব গান্ধীজী স্বীকার করতেন। দেশ ইংরেজদের কাছে পরাধীন বলে জাপানের আক্রমণ থেকে রক্ষার কোন চেষ্টার প্রয়োজন নেই—এমন ধরনের উদাসীনতা বা নিষ্ক্রিয়তা তাঁর নীতি বহির্ভূত। জাপান যদি উড়িষ্যার উপকূলে নামে—যার সম্ভাবনা খুব দেখা দিয়েছিল এক সময়ে—সেই আশংকা করে করে গান্ধীজী উড়িষ্যাতে বেসরকারী প্রতিরোধ সৃষ্টি করার জন্য বাছা বাছা কয়েকজন সহকর্মীকে উড়িষ্যার উপকূল প্রদেশে কাজে লাগিয়ে দেন। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই অহিংস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অতি সামান্য মনে করেন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর প্রতিরোধ বলে মনে করেন, কেন না দেশে সেই জাতীয় অহিংসার শক্তি বিদ্যামান ছিল না এবং ইংরেজের প্রতি বিদ্বেষটা এতো বেশি দেশে ছিল, দেশ পরাধীন বলে, যে জাপানের আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশবাসী অন্তর দিয়ে প্রতিরোধ করতে লাগতো না। গান্ধীজিও একথা বুঝতেন এবং বুঝতেন বলেই শেষ পর্যন্ত ১৯৪২ সালের আন্দোলন বা আগস্ট বিপ্লবের আয়োজন করেন। কেন না তিনি বুঝিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন না হলে স্বাধীনতার জন্য জাপানের বিরুদ্ধে দেশবাসী লড়বে না।

এখানে আরো একটা প্রসঙ্গ একটু ছুঁয়ে যাওয়া দরকার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লাগার সাথে সাথে বা তার পূর্বেই দেশে সংগ্রাম চেতনা খুব প্রবল হয়ে ওঠে। সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি এবং কংগ্রেসের চরমপন্থী লোকেরা গান্ধীজীর উপরে ক্রমবর্ধমান চাপ দিতে থাকেন যে যথাসম্ভব শীঘ্র সংগ্রাম ঘোষণা করুন। গান্ধীজী এড়াতে থাকেন। প্রথমতঃ আন্তর্জাতিক জটিল পরিস্থিতি থেকে তাঁর সংগ্রামের আদর্শকে স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল করে ধরে দেওয়া তাঁর অহিংসা নীতির পক্ষে একটি অত্যন্ত জটিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কেননা তিনি জগত সভায় একথা বুঝাতে চান যে, ইংরেজের দুর্দিনকে তিনি নিজের সুদিন মনে করলে তাঁর অহিংসা কলঙ্কিত হবে, আর দ্বিতীয়তঃ মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লেগে যাওয়াতে একথা যেন প্রচারিত না হয় যে কংগ্রেস ফ্যাসিস্ট হিটলারে সহায়ক। কিন্তু তৃতীয়তঃ, আর একটি বিশেষ কারণে তিনি আরও বেশি দ্বিধা করে চলেছিলেন. তিনি বুঝেছিলেন যে, দেশে এমন অগ্নিময় ও বিশৃঙ্খলার শক্তি ঘনিয়ে উঠেছে যে যদি তিনি অহিংস সংগ্রামের হুকুম দেন তবে অচিরে তা সহিংস সংগ্রাম ও বিশৃঙ্খলায় পরিণত হবে। তাই তিনি বলতেন দেশ তাঁর মতে প্রস্তুত নয়।* অপ্রস্তুত এই অর্থে নয় যে দেশে আগুন জ্বলবে না, অপ্রস্তুত এই অর্থে যে তা অহিংস সত্যাগ্রহের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না। এজন্য দেশে যতই সংগ্রামের চাহিদা বেড়ে যেতে লাগলো, তিনি ততই অহিংসার উপর দিতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, গঠনমূলক কাজের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জনতাকে অহিংসার শিক্ষা দিয়ে তৈরি করো, নচেৎ আমি সংগ্রামের ডাক দেবো না। বামপন্থীরা বিরক্ত হয়ে উঠলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র অস্থির হয়ে উঠলেন এবং দেশে কিছু হবে না জেনে হতাশ হয়ে বিদেশে ইংরেজবিরোধী শক্তিসমূহের সহিত সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু গান্ধীজী নড়ছেন না। কেন না তাঁর ১৯২২ সালে চৌরিচৌরায় হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলন বন্ধ করে দেবার কথা মনে আছে। হিংসা ফেটে পড়েছিল বলে তিন সেদিন সংগ্রাম বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তার জন্য কম কৈফিয়ৎ ও ক্ষতিপূরণ দিতে হয় নি। এবং আজ যখন তিনি প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পারছেন যে ভারতবর্ষ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, তখন তো তা হিংসায় ফেটে পড়বেই। অথচ লড়াই করা যে প্রয়োজন, লড়াই না করলে যে সেদিনের অসহায় অবস্থা থেকে ভারতকে রক্ষা করার আর উপায় নেই, একথা তিনি যত অনুভব করতে লাগলেন ততই অস্থির হয়ে উঠতে লাগলেন। তিনি বিনোভা ভাবেকে ও কংগ্রেস নেতাদের শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে নামিয়ে দিলেন। জাতির যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের সাথে সাথে দেশে সুশৃঙ্খল সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়, তারই পটভূমিকা সৃষ্টি করা সেই ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেই সদ্যাগ্রহ বিশেষ কার্যকরী জিনিস হলো না—ইংরেজের পক্ষে আপোষের জন্য একটা চাপ সৃষ্টি হলো মাত্র। কিন্তু ইংরেজের সঙ্গে আপোষ আলোচনা ও ক্রিপস—মিশন ব্যর্থ হলো। ওদিকে যুদ্ধের জন্য নানারকম অরজাকতা ও দুনীতিতে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে—জাপানী আক্রমণ ক্রমশই ঘনিয়ে আসছে। তখন গান্ধীজীর এরকম চরম পরীক্ষার দিন। তখন তিনি ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। তিনি অন্তর থেকে চীৎকার করে উঠলেন আর নয়, যদি হিংসা আসে আসুক তার ঝুঁকি আমাকে নিতে হবে, আমি অহিংসার সংগ্রামই শুরু করবো—হিংসা আসবে বলে ভয় পেলে চলবে না। Dogmatic Ahimsa তাঁকে ছাড়তে হলো। বলতে হলো, ‘‘Leave us to God or anarchy but quit.’’ বলতে হলো, অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠছে, এর চেয়ে যে কেন অবস্থা ঢের ভালো, ‘Anarchy is better than this!’ তারপরেই আগস্ট আন্দোলনের ডাক, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আহ্বান, ‘Do or die-এর order। সংগ্রামের কৌশল ও দিনক্ষণ ঘোষণা করার আগেই সরকার গান্ধীজী ও কংগ্রেসের উপর আক্রমণ চালিয়ে দিলেন রাত্রির অন্ধকারে। দেশ বিক্ষোভে, হিংসায়, অহিংসায় মেতে উঠলো—যার নাম ‘আগস্ট বিদ্রোহ’। গান্ধীজী জেল থেকে বেরিয়ে বললেন, আমাকে সংগ্রাম করতে দেওয়া হয় নি। আমাকে আমার মতো করে সংগ্রাম বা অহিংস উপায়ে সংগ্রাম চালাবার সুযোগ সরকারই দেয় নি। কাজেই দেশে যে হিংসা দেখা দিয়েছিল কংগ্রেসের দায়িত্ব তাতে কিছু নেই—দায়িত্ব সরকারের, ইত্যাদি। পণ্ডিত নেহরু সেদিন প্রতিবাদ করলেন, বললেন, জনতা যা কিছু করেছে ভালো হোক, মন্দ হোক তার দায়িত্ব কংগ্রেসের নিতে কোন কুণ্ঠা বা লজ্জা বোধ করার কারণ নেই। কারণ পণ্ডিত নেহরুর অহিংসা বোধটা অতো নৈতিকতা দুরন্ত নয়। এবং কোন কংগ্রেস কর্মীরই নয়। কেন না তাঁরা অহিংসাকে কৌশল হিসেবেই প্রধানতঃ গ্রহণ করেছিলেন—নীতি বা Creed হিসেবে নয়। যা হোক, ঐতিহাসিক জওহরলাল নীতিবাগীশ গান্ধীর সংকোচ অনুভব করলেন—কংগ্রেস আগস্ট আন্দোলনের সমস্ত গৌরব বুক ফুলিয়ে গ্রহণ করে নিল। গান্ধীজী চুপ করে গেলেন—জওহরলালের দাবি বোধহয় অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন। এবং ১৯৪২ সালের আগস্ট বিদ্রোহেও শুদ্ধ অহিংসার কোন স্থান হয়নি।

তারপর কংগ্রেস সরকার দখল করে অহিংসনীতির কোন প্রয়োগ করেননি। তাঁরা প্রচলিত প্রথা মতো রাষ্ট্রযন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা এখনো ফাঁসী দেবার প্রথাটা পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে পারলেন না। জনতার উপর গুলি, গ্যাস চালনোর প্রথায় তাঁরা অহিংস আদর্শের প্রতিবিশেষ কোন শ্রদ্ধা দেখান নি। এবং এখনও হয়তো মনে করেন যে সরকারী আসনে বসে কারো অহিংস থাকবার উপায় নেই অথবা প্রয়োজন নেই। দেশের অশান্তি, দাঙ্গা, ধর্মঘট, বিক্ষোভ ইত্যাদির প্রতি তাঁদের আচরণ ইংরেজ আমলের মতোই আমলাতান্ত্রিকতা, যান্ত্রিকতা ও Law and order এর চিরাচরিত প্রথাসম্মত। রাষ্ট্রযন্ত্র চালনায় অহিংসার কোন স্থান অছে বলে তাঁরা স্বীকারই করতে চান না। অথচ গান্ধীজির মত তা ছিল না। গান্ধীজি অনেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, অহিংসার ক্ষেত্র রাষ্ট্রকেও দেখাতে হবে। সামাজিক অনেক প্রকার বিশৃঙ্খলা, এমন কি জেলের কয়েদী গুণ্ডা—বদমায়েসদের সংশোধন করাতেও অহিংসার একটি নিজস্ব নীতি থাকা চাই। দেশ স্বাধীন করার জন্যই অহিংসা দরকার—উপায় হিসেবে মাত্র—কিন্তু স্বাধীন হলে অহিংসার কোন প্রয়োজন নেই—তাহলে অহিংসার কোন সময়ই দদরকার নেই। মনে রাখতে হবে, গান্ধীজির কাছে অহিংসা মাত্র একটা উপায়ই নয়, লক্ষ্যও বটে—both means an end. পথ ও লক্ষ্য তাঁর কাছে আলাদা জিনিস নয়। তিনি শুধু সংগ্রামেই হিংসা চান তা নয়—তিনি এমন সমাজ চান যা অহিংস। ভবিষ্যত সমাজ সমাজতান্ত্রিক হবে, কি সর্বোদয় হবে, এ নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে কিছু লিখেছেন বা বলেছেন বটে—কিন্তু অহিংস সমাজ হবে, একথা তাঁর প্রত্যেক কথা ও কাজের মধ্যে ছিল। তাঁর ধারণা ছিল যে, যদি সমাজ অহিংস হয় তবে সত্যিকার সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও সর্বোদয় সম্ভব। আদর্শ—সাম্যবাদী সমাজও আসলে অহিংস সমাজ। অতএব যে মুহূর্তে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল তখন আর অহিংসার প্রয়োজন নেই, এই যাঁরা ভাবেন, তাঁরা গান্ধীজীর কিছুই বুঝতে পারেন নি। কাজেই গান্ধীজি যখন দেখতেন কংগ্রেস মন্ত্রীরাও পুরোনো আমলাতান্ত্রিক ও জবরদস্তি ঢঙে আইন ও পুলিশের সাহায্যেই রাজ্য চালাতে চাইছেন, তখন তিনি ভীষণ দুঃখ পেতেন। তিনি বলছেন, ‘‘I am ashamed that our ministers had to call to their aid the police and and the military. I am ashamed that they had to use the language that they did in reply to the opposition speeches I feell as if the congress had lost and the British had won. Why does our non-violence fail on such occasions ? It it the non-violence of the weak ? Even the goondas should not move us away from our faith and make us say, ‘We will send them to gallows or shoot them down.’ They too are our countrymen. If they will kill us, we will allow them to do so. You cannot pit against organized violence the non-violence of the weak, but the non-violence which the bravest alone can exercise. We have, you will say, been sufficiently non-violent. We are non-violent during the civil disobedience campaign, we received lathi blows and worse. My reply is this : We did, but not sufficiently. We could not get independence at the end of the Dandi March, as ours was not the unadulterated non-violence of the bravest.’’ (Non-violence in Peace and War—page 543)

”আমাদের কংগ্রেস মন্ত্রীরাও যখন শাসনকার্য চালাতে পুলিশ ও সৈন্যের সাহায্য নেন তখন আমি লজ্জা পাই। আমি শুনে লজ্জা পাই যে মন্ত্রীরা ঠিক সেই জাতীয় ভাষাই ব্যাবহার করেন বিরোধীদের বিরুদ্ধে, যা তাঁরা চিরকাল ইংরেজ আমলাতান্ত্রিক কাছে শুনে এনেছেন। আমি অনুভব করি যেন কংগ্রেস হেরে গিয়েছে—ইংরেজরাই আসলে জিতে গেছে। কেন এসব অবস্থায় আমাদের অহিংসা ব্যর্থ হচ্ছে? গুন্ডারা যেন আমাদের বিশ্বাস ও ধর্ম থেকে আমাদের হটাতে না পারে এবং আমাদের মুখ থেকে বলাতে না পারে যে আমরা গুন্ডাদের ফাঁসীতে লটকাবো বা গুলি করে মারবো। ওরা আমাদের স্বদেশবাসী। ওরা যদি আমাদের হত্যাও করেও করে করুক, তবুও আমরা আমাদের নীতি বদলাবো না। আমাদের অহিংসা কি দুর্বলের অহিংসা? সঙ্ঘবদ্ধ হিংসার বিরুদ্ধে দুর্বলের অহিংসা কার্যকরী হতে পারে না—একমাত্র বলিষ্ঠের অহিংসাই দাঁড়াতে পারে। তোমরা বলবে আমরা অতীতে অনেক অহিংসা দেখিয়েছি, আমরা আইন অমান্য আন্দোলনের সময় অহিংস ছিলাম। আমরা লাঠির আঘাত নীরবে সহ্য করেছি, আরো কতো কি নির্যাতন ভোগ করেছি। আমার উত্তর এই, আমরা করেছি বটে কিন্তু যথেষ্ট করি নি। ডান্ডি অভিযানের পর আমরা স্বাধীনতা পাই নি, তার কারণ আমাদের অহিংসা বীরশ্রেষ্ঠদের নির্ভেজাল অহিংসা ছিল না।”

তবু যাই হোক, আন্দোলনের সময় অনেকটা অহিংসার প্রভাব ছিল কংগ্রেসের উপর। ক্ষমতা পাবার পর সেই প্রভাব চলে যাচ্ছে কেন? ক্ষমতায় আসীন হলে কি বিরোধীদের প্রতি অহিংস থাকবার কোন উপায় থাকে না? তিনি কংগ্রেসের শাসন সংক্রান্ত দায়িত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘It should seek to meet the violence of the individuals not with the organised violence called punishment, but with non-violence in the shape of friendly approach to earring individuals and through the cultivation of sound public opinion agaist any form of violence. In other words, the Congress will rule not through the police backed by the military but through its moral authority based upon the greatest goodwill of the people. It will rule not in virtue of authority derived from a superior armed power but its virtue of the service of the people whom it seeks to represent in everyone of its action….the Ministers, who may find violence, hatred or obscentity in their provinces will look to the Congress organisations and ultimately to the Working Committee from active and efficient help before they resort to the process of criminal law and allietd means. Indeed the triumph of the Congress will be measured by the success in achieves in rendering the police and the military idle. (Mahatma Vol.—IV, page 226)

কংগ্রেস সরকার কখনো ব্যক্তি বিশেষের হিংস্র কাজের বিরুদ্ধে সাজা নামক সংগঠিত দলবদ্ধ রাষ্ট্রীয় হিংসার প্রয়োগ করবে না। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের দ্বারা ও অহিংস ব্যবহারের দ্বারা সুস্থ জনমত সৃষ্টি করে অন্যায়কারীদের এবং ভ্রান্তবুদ্ধির লোকেদের সংশোধন করবে। অথাৎ ও পুলিশের জোরে কংগ্রেস রাজ্য চালাবে না, চালাবে তার নৈতিক সমর্থন দিয়ে—যে সমর্থন আসবে অধিকাংশ লোকের শুভকামনা থেকে। কোন সশস্ত্র শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে কংগ্রেস ক্ষমতা পায়ও নি এবং তার ক্ষমতা সশস্ত্র শক্তির মাধ্যমে প্রকাশও করবে না—জনগণকে সেবার জন্য প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের প্রতি গণসমর্থন ফুটে বেরোবে।….মন্ত্রীরা যখন দেখবেন যে তাঁদের প্রবেশে মারামারি, হিংসা, দূর্নীতি বেড়ে চলেছে তখন তাঁরা কংগ্রেস সংগঠন ও কর্মীদের সাহায্য চাইবেন—শেষ পর্যন্ত ওয়ার্কিং কমিটির সক্রিয় সাহায্য চাইবেন। তাঁদের সাহায্য পাওয়ার পরেও যদি দরকার হয়, তখন তাঁরা ফৌজদারী আইন ও তৎসংক্রান্ত ব্যবস্থাদির সহায়তা নিতে পারেন—তার পূর্বে নয়। (অর্থাৎ কংগ্রেস একমাত্র তার সরকারী শক্তি দিয়ে চলবে না, তার বেসরকারী জনসেবার ও গণআন্দোলনের ঐতিহ্যটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং তারই সাহায্যে অনেক কাজ করতে হবে কেবল মন্ত্রীত্বের ক্ষমতা দিয়ে নয়। (লেখক) পুলিশ ও সৈন্যের প্রয়োজন যত কমিয়ে দিতে পারবে, ততই কংগ্রেস সার্থক হলো বলতে হবে।” কিন্তু আমরা আজকাল কি দেখি? পুলিশ ও সৈন্যখাতে ব্যয়টা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। স্বাধীন ভারতে পুলিশের সংখ্যা বোধহয় দশগুণ বেড়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, গান্ধীজির অহিংসা রাষ্ট্রকার্যে আজ থোড়াই ব্যবহৃত হয়।

আর কংগ্রেসের ভিতরকার হিংসা সম্বন্ধেও গান্ধীজি কম সচেতন ছিলেন না। এখানে দলাদলি, হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিযোগিতার যে চিত্র তিনি দেখতেন, তাও তাঁকে শংকিত করে তুলতো। তিনি বলেছেন, ‘‘Moreover one finds today violence resorted to by rival Congressmen at Congress meeting. The gross indiscipline and fraud practiced at Congres elections are illustration of Congress violence.’’ (Harijan, 21.10.39) ”তাছাড়া কংগ্রেসকর্মীদের সভাগুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে আজকাল হিংসা ও মারামারি করতেও দেখা যায়। কংগ্রেস নির্বাচনের সময় অনেক রকমের দুরাচার ও বিশৃঙ্খলা দেখি, যেগুলি কংগ্রেসের ভিতরকার হিংসার পরিচায়ক।”

যাক, এতক্ষণে আমরা গান্ধীজীর নিজের ভাষ্য থেকেই দেখতে পেলাম যে সত্যিকারে শুদ্ধ অহিংসা কোনদিনই তেমনভাবে দেখা দেয় নি, দেশ একমাত্র অহিংসার সাহায্যেই স্বাধীন হয় নি এবং অহিংসাই দেশ স্বাধীনতার প্রধান কারণও হয়তো ছিল না। অন্যান্য শিষ্যরা যে দাবিই করে থাকুন, গান্ধীজী নিজে অহিংসার এতটা দাবি কর্মক্ষেত্রে সমর্থন করতে রাজি দিতে নারাজ। দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য এবং সে স্বাধীনতার জন্য একমাত্র অহিংসাই সমস্ত বাহাদূরী নিতে পারে না। যাঁরা সোজাসুজি ও প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁদেরও একটা অংশ এর মধ্যে আছে। সুভাষবাবুর মতো যোদ্ধাদের দানও কিছু সামান্য নয়। বামপন্থীদের দান নেই একথাও বলা যায় না। তাছাড়া বিশ্বপরিস্থিতির অনুকূলতাও ভারতের স্বাধীনতা পাওয়াতে সাহায্য করেছে। রুশ বিপ্লব, চীনবিপ্লব, এশিয়ার জাগরণ, ফ্যাসীবাদের ধ্বংস, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের অর্থনৈতিক দুবলতা, তাদের রাজনৈতিক দুর্বলতা—এগুলিও ভারতকে স্বাধীন হবার পথে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আর সবার উপর রয়েছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, যে সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। অন্যান্য অনেক শক্তি এই স্বাধীনতার ব্যাপারে নিযুক্ত থাকলেও, একা গান্ধীজীর দান সবার যোগফলের চেয়েও বোধহয় বেশী—নেতৃত্বের দিক থেকে। কিন্তু এটা কি অন্যান্য দাবি নয়? একেবারেই নয়। যদিও আমরা দেখেছি গান্ধীজীর শুদ্ধ অহিংসাই সবটা ছিল, তথাপি একথা বললে সমস্ত ভুল হবে যে অহিংসা হলো গান্ধীজীর একমাত্র দান। গান্ধীজী সমগ্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিলেন—হিংসা—অহিংসা, গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক, গঠনতান্ত্রিক যতরকমের জাগরণ আমরা দেখেছি তার প্রত্যেকটি শক্তি আলাদা আলাদাভাবে এবং সমগ্রভাবে গান্ধীজীর নেতৃত্বের মধ্যে কমবেশী সীমাবদ্ধ ছিল। এমন কি সুভাষবাবুর আনুগত্যও গান্ধীজীর প্রতি কম ছিল না। আজাদহিন্দবাহিনীও ভারতের পিতা গান্ধীজীর নাম করেই সংগ্রামী অভিনন্দন করতে দ্বিধা করতো না—এবং গান্ধীজীও বিপ্লবীদের কখনো ত্যাগ করতে পারে নি।* মডারেটরাও তাঁর কথা না শুনে পারতেন না। ভারতের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান, সে জনসেবাই হোক, রাজনীতিই হোক, নারী আন্দোলনই হোক, হরিজন আন্দোলনই হোক, কুটিরশিল্পের রক্ষাই হোক—যা কিছু হোক, সবটার মধ্যে গান্ধীজীর হাত ছিল। জাতীয় জাগরণের প্রত্যেকটি ব্যাপারে তাঁর হাত ছিল। সমগ্রভাবে জনতার বৃহৎ ছবিটা, এক প্রাণ এক জাতির বাস্তব মূর্তিটা কাঠামোটা তিনিই তৈরি করে যান। গান্ধীজিই যে ভারতবর্ষ—একথা বিদেশীরাও জানতেন। এ দেশের শ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ধর্মপ্রচারক—কেউ তাঁর সাহায্যে থেকে বঞ্চিত হন নি। তিনি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কাজই শুরু করে দিয়ে গেছেন। কেবল রাজনৈতিক দিকে নয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর দান স্পষ্ট। যারা তাঁকে দেখতে পারতো না, তাদেরও স্বার্থ তিনি অবহেলা, করতেন না, যারা তাঁকে বিদ্রূপ করতো, তিনি তাদেরও অবহেলা করেন নি। সত্যিকার অর্থেই বলা যায় He was the father of the nation। কেবলমাত্র অহিংসাই তাঁর দান, এই জাতীয় যুক্তি এবং যেহেতু ভারতীয় জীবনে আজ অহিংসা কোথাও কায়েম নেই কাজেই গান্ধীজির কোন দানই নেই—এই জাতীয় যুক্তি হাস্যকর। গান্ধীজিকে একটা sect সম্প্রদায়ের স্রষ্টা মনে করলে মস্ত ভুল হবে। তিনি ছিলেন ভারত ইতিহাসের এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণে ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতীক—যার ভিতর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেছে। গান্ধীজি নিজেও জানতেন অহিংসা তাঁর জীবনের একটা মূলমন্ত্র হলেও ওটাই তাঁর একমাত্র দায়িত্ব নয়। যদি অহিংসাকে সবচেয়ে বড় কথা ও শেষ কথা বলে তিনি ধরে রাখতেন তবে গান্ধীজি তাঁর পরবর্তী নেতার পদে জওহরলালকে নিযুক্ত না করে হয়তো কোন বিশিষ্ট ও গোঁড়া গান্ধীবাদীকেই নিযুক্ত করে যেতেন।** Jawaharlal is my successor বলার মধ্যে গান্ধীজির ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতাগুলিই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ জওহরলাল কোনোকালেই অহিংসবাদী নন—ভগবানভক্ত তো একেবারেই নন। গান্ধীজি রাজাগোপালাচারী বা বিনোবা বা রাজেন্দ্রপ্রসাদকে পরবর্তী নেতা নিযুক্ত করে যান নি, যদিও অন্যান্য দিক দিয়ে তাঁরা গান্ধীজির আরও নিকটে ছিলেন। গান্ধীজির ঐতিহাসিক দায়িত্ব তাঁকে বোঝার মত অর্ন্তদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি দিয়েছিল যে এটা ভারতের ইতিহাসকে অগ্রগামী করার বাহন আজ জওহরলালের মধ্যে যতটা আছে, অন্যদের মধ্যে ততটা নেই। অবশ্য জওহরলালকে নেতৃত্বে আসীন করে দিয়ে গান্ধীজির অহিংসা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, এমন মনে করার কারণ নেই। অহিংসা পৃথিবীতে ব্যর্থ হয়েছে, এধরনের উক্তিও হাস্যকর। Practical idealist হিসাবে গান্ধীজিকে হয়তো কোন কোন বিষয়ে compromise বা আপোষ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি খেয়াল করে দেখি তবে বুঝতে পারবো গান্ধীজির অহিংসা মুছে যায় নি বা মুছে যাবার কোনো লক্ষণ নেই। হিংসার ও প্রতিহিংসার ও কদর্যতার যত ছবিই দেখি না কেন—ভারতের সম্মুখে আজ আদর্শের এমন উজ্জ্বল এলো কোথা থেকে। ভারতীয় বৈদেশিক নীতিতে পঞ্চশীলের ও শান্তির আবেদন এলো কোথা থেকে? এর বীজ গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন থেকে এসেছে—জওহরলাল তার ধারক মাত্র, সৃষ্টিকর্তা নন। আজকাল ভারতীয় রাজনীতিতে জনসাধারণের দাবি সর্বাগ্রগণ্য—এই কথা এলো কোথা থেকে, কার জোরে এটা এতো সহজে স্বীকৃত হলো? নীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র এত সহজে ভারতে কি করে স্বীকৃতি পেয়েছে? এ সমস্তের গোড়ায় গান্ধীজির যে দান আছে তাকে ভুললে চলবে না। গান্ধীজি আমাদের চরিত্রের ছাপ ও আদর্শ তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আমাদের জীবনের মোড় গণমুখী করে দিয়ে গেছেন। অহিংসার মধ্যকার spirit বা causeটার গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে হবে। কি spirit কাজ চলছে? এই spirit of modern India কোথা থেকে এতো ঔজ্জ্বল্য এবং মহিমা অর্জন করেছে? এই spirit-এর বাস্তব realisation অবশ্য অনেক দূরে—কিন্তু We have been possessed by the spirit.

হিংসার সাহায্যে যারা বিপ্লব করতে চায় তাদেরও একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এঙ্গেলসের কথা থেকে বলছি—Engles German Idelogy বইখানার ভূমিকায় লিখেছেন….‘‘Let us have no illusion about it ; a real victory over the military in the street fighting, a victory as between two armies, is one of rarest exceptions. But insurgents also counted on it juts rarely. For them it was solely a question of making the troops yield to normal influences. Hence the passive defence is the prevailing form of fight. The attack will rise here and there, but only by way of exception. অর্থাৎ আমাদের এ বিষয়ে কোন ভ্রান্ত ধারণা থাকা উচিত নয়ঃ বিপ্লবী জনতার পক্ষে রস্তার লড়াইতে সামরিক শক্তিকে পরাজিত করে দেওয়া, যেমন একদল সৈন্য অপরকে পরাজিত করে—এমনি ধরনের জয়ে বিপ্লবীরাও খুব বেশি ভরসা করে না। তাদের কাছে সৈন্যদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে যে নৈতিক আবেদন ও জাগরণ আছে, যাতে সৈন্যরাও মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়, সেইটাই তার বৈপ্লবিক তাৎপর্য। আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধটাই বিপ্লবে সাধারণ ঘটনা—কদাচিৎ কখনো তা আক্রমণের স্তরে উঠতে পারে এখানে সেখানে—কিন্তু তা কেবল ব্যতিক্রম হিসেবেই ধর্তব্য।

তিনি আরও বলেছেন, ‘‘Even in the classic time of street fighting, therefore, barricade produced more of a moral than of a material effect. It was a means of shaking the steadfastness of the military. If it held out until this was attained, then victory was won ; if not, there was defeat. This is the main point, which must be kept in view, likewise, when the chances of contingent future street fights are examined. Engels—‘‘Introduction to Class Struggle in France.’’

এর সহজ ও সরল অর্থ এই, যখন কোনো বিদ্রোহী জনতা সৈন্য ও পুলিশের প্রসঙ্গে সংঘর্ষে এসে যায় বা রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে লড়াই করতে চায় তখন তারা যে শক্তি বলে’ সৈন্য ও পুলিশকে হারিয়ে দিতে পারে তা নয়। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ একটা অপূর্ব মনোবল সৃষ্টি করে এবং শত্রুর মাথা নত করিয়ে দিতে সাহায্য করে। এর নৈতিক দানটাই বা psychological ferment-টাই বড় কথা, physical strength-টা নয়। দেখা যায় জনতা যখন সংগ্রামে অস্ত্র হাতে নিয়েও এগিয়ে আসে তখন দক্ষতা ও কৌশলের দিক থেকে তারা কত কাঁচা, কত সহজেই না শিক্ষিত সৈন্যদল তাদের কতলোককে ঘায়েল করে ফেলে। কিন্তু তথাপি এই জাতীয় সংগ্রাম বৈপ্লবিক চেতনা ও আদর্শের ঔজ্জ্বল সৃষ্টি করে, যার ছোঁয়াচ সৈন্য ও পুলিশের উপরে পড়তে বাধ্য হয়। এর অর্থ, এই সশস্ত্র বিপ্লবেও অস্ত্রবলটা বড় কথা নয়—নৈতিক বল ও আদর্শ বা sprit of cause কত শক্তিশালী হলো তারই উপর বিপ্লবের ভাগ্য নির্ভর করে—হাতাহাতি বা গায়ের জোরের হিসেব নিকেশ দিয়ে নয়। এঙ্গেলস এইজন্যই গায়ের জোরের শক্তি সম্বন্ধে কোনো illusion না রাখতে বলেছেন।

গান্ধীজির অহিংসাও সেই নৈতিক শক্তি জাগাতে সমর্থ হয়েছিল। দেশের আপামর জনসাধারণ ভীরু, দুর্বল, নারী ও শিশু—রাজকর্মচারী, পুলিশ, সৈন্য সকলের বুকে তাঁর অহিংসা অপূর্ব জাগরণের পরশকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছিল। যারা সহিংস পন্থায় বিশ্বাসী, তাদের বুকেও তিনি সাহস এনে দিয়েছিলেন। ঐ ব্যাপক জাগরণ তাঁর অহিংস আন্দোলনে সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তার বিকাশ সর্বত্র অহিংস ছিল না। তাছাড়া ভারতের cause-টাকে তিনি অহিংসার সাহায্যে এমন সুন্দরভাবে পৃথিবীর দরবারে উপস্থিত করে দিয়েছিলেন—ভারতের প্রতি অত্যাচারকে সকলের চক্ষে ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে ইংরেজরা পর্যন্ত দিনকে দিন বিচলিত ও লজ্জিত হয়ে উঠেছিল, যার ফলে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সময় বিলেতে বিশেষ কোনই বাধা ঘটে নি। হিংসার পথে গেলে এত সহজ সমর্থন পাওয়া সম্ভব হতো না। অতএব অহিংসার কোন দান ছিল না একথা বলা ভুল। তাছাড়া একথাও মনে রাখতে হবে দেশবাসীর কার্যতঃ অহিংসা দেখাতে না পারলেও গান্ধীজি নিয়েই তা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত জাতীয় জীবনে অনেকদিন পর্যন্ত একটা প্রভাব রেখে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। গান্ধীজির জীবন ও চরিত্র অহিংসার দ্বারা তৈরি, একথা বলা যেতে পারে এবং জীবন, জাতীয় জীবন ও জাতীয় চরিত্র সৃষ্টি করতে কতটা সাহায্য করেছে তার সত্যিকার হিসেবনিকেশ আজও চলেছে।

এখানে একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। সহিংস সংগ্রামের সাহস বড় না অহিংসার সাহস? এ—জাতীয় তর্ক উঠতে পারে, কেন না সাহস দুয়েরই উপাদান। কাদের সাহসটা বেশি effective সেটাই বড় প্রশ্ন—সাহসের বড়াইটা নয়। ফলাফল দিয়ে বিচার হবে এদের গুণাগুণ। গান্ধীজি বলতে চান, অহিংসার সাহস বেশি ফলবান ও দীর্ঘস্থায়ী। কেন না অহিংসার সাহস যে অহিংস, তাকেও যেমন মহান করে, যে বিপক্ষ, অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে অহিংসা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাকেও সংশোধিত হতে বিবেকবুদ্ধি ফিরিয়ে পেতে ও মহান হতে সাহায্য করে। সহিংস সাহস শত্রুর মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়, অহিংসা শত্রুকে ধ্বংস করতেত চায় না, ভয় পাইয়ে দিতে চায় না—অহিংসা সকল মানুষ যে মূলতঃ এক—এই সূত্রটাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায়। অহিংসা তাই শত্রুকে শত্রু বলে মনে করেন। সত্য, প্রেম ইত্যাদি overriding qualities of heart বা চিত্তের মহান গুণগুলি দিয়ে অহিংসার সাহস নৈতিক শক্তি অর্জন করে। কিন্তু যারা বিপ্লবী, তাদের চরিত্রেও যে এসব নৈতিক সমর্থনের প্রয়োজন, একথাও কেউ অস্বীকার করবেনা। কিন্তু যেভাবে অহিংসার সংগ্রামকে যোজনা করা হয় তাতে অহিংসা সংগ্রামীর উদ্দেশ্যকে শত্রু—মিত্র কারো পক্ষে সহসা ভুল বুঝবা আশংকা কম। হিংসার সংগ্রামে মানুষের মত্ততা ও তিক্ততা এতো বেড়ে যায় যে বিপ্লবীর উজ্জ্বল আদর্শের মহিমা শত্রুপক্ষের লোক বুঝতে পারে না, বা বুঝতে চায় না। এজন্য বিপ্লবীদের কম বেগ পেতে হয় না। অথচ justness of their cause বা তাদের আদর্শের যুক্তি—যুক্ততা ও ন্যায্যতা যদি শত্রুপক্ষের উপর না পড়ে, তবে শত্রু পক্ষের বিরোধিতার জোর কমে না। এইজন্য বিপ্লবীবাদীদেরও fraternisation-এর এত লক্ষ্য রাখতে হয়। সংগ্রামের ন্যায্যতা সংগ্রামকে জয়ী করে থাকে শেষপর্যন্ত—কিন্তু সংগ্রামের শক্তি দুর্বল হতে থাকে যদি তার পিছনে ন্যায্যতার বা নৈতিক বলের সমর্থন কম পড়ে যায়। গান্ধীজি সংগ্রামে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তার মানে তাঁর সংগ্রামের ন্যায্যতা দেখাতে চান, কাজেই তিনি এমন তিক্ততাশূন্য উপায়ে তাঁর দাবি ও বক্তব্য উপস্থাপিত করেন এবং সংগ্রামটাকে এমনভাবে এবং এমন কায়দায় চালু করতে চান, যাতে সংগ্রামের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি না হয়, কাজেই তাঁকে অহিংসার পথ নিতে হয়েছে। শত্রুর গায়ের জোরটা তাঁর লক্ষ্য নয়, শত্রুর অন্তরটাই তাঁর লক্ষ্যস্থল। ফলে তিনি মনে করেন, অহিংস সংগ্রামের যে সাহস তা বেশি ফলপ্রসূ—এবং তা শত্রুর গায়ের জোরকে পরাজিত করার উপর যেহেতু নির্ভর করে না, সেহেতু তা দীর্ঘস্থায়ী। কেন না শত্রুর গায়ের জোরটা আজ হয়তো জব্দ করা গেলো, কিন্তু কাল সে প্রতিশোধ নেবার জন্য তেমনি বর্বরতার সাথে পুনরাক্রমণ করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেমন জার্মানীকে বরাবার পরাজিত করা হলো, কিন্তু জার্মানী প্রতিশোধ নেবার জন্য বারে বারেই চেষ্টা করে চলেছে—এর শেষ কোথায়? কাজেই গান্ধীজির যুক্তি হলো, এই অহিংস সংগ্রাম নিজের ও শত্রুদের—উভয়েরই মহান পরিবর্তন ঘটিয়ে এক সত্যিকার সমানাধিকারের উপর মিলিত করবে এবং দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবে।

কিন্তু এখানে একটা মস্ত কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। বিপ্লবীরা ও গান্ধীবাদীরা উভয়েই সাহসের কারবার করেছেন—ভীরুতার কোনো দরকার কারোরই নেই। কিন্তু ভীরু লোকেরসংখ্যাই তো বেশি। অতএব ভীরু লোকেদের যদি বাদ দেওয়া যায় তবে কি সহিংস কি অহিংস, কারো দলই তেমন কিছু করাতে পারবে না। অতএব কার সাহস কত বড়, এবং কার সাহস কত কার্যকরী এ প্রশ্নের জবাবও নির্ভর করছে কার সাহস কত বেশি ভীরুলোকেদের মনোবল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে তার উপর। অহিংসা যদি ভীরুদেরও একদিন সাহসী করতে না পারে তবে অহিংসা ব্যর্থ হলো আবার অস্ত্রবলে বিশ্বাসী বিপ্লবীর সাহস যদি ভীরুদের সাহসী করতে না পারে তবে তাদের সাহসও ব্যর্থ হলো। কথাতো এই নয় যে সমাজে অনেক সাহসী লোক আছে, তাদের বেছে নিতে হবে। সমস্যা এই যে, সমাজে সাহসী লোক অতি বিরল—অর্থাৎ একটা পরাধীন, পতিত সমাজে সাহসের বড়ই অভাব। কাজে সবাইকে, ভীরুদেরও, সাহসী করে তুলতে হবে—এই হলো সমাধান। বিপ্লবীরা যদি মনে করে যে নিরস্ত্র লোকেদের অস্ত্র যোগান করে দিতে পারলেই সাহস হয়, তবে সেটা ভুল। অস্ত্র ধরতে পারে এমন সাহস জনতার আসে তখনই, যখন তারা তাদের উদ্দেশ্য বা দাবির ন্যায্যতা বুঝতে পারে, যখন তারা সত্যি সত্যি সাহসী ও সচেতন (conscious) হতে পারে। অবশ্য এই বুঝবার, এই নৈতিক সমর্থন পাবার সাহায্য হয়তো অস্ত্র হাতে পেলে ত্বরান্বিত হয়, কিন্তু শুধু অস্ত্রবলই বিপ্লবের বল নয়—বরং সেটা গৌণ, আসল হচ্ছে আদর্শ, সচেতনতা, মনোবল, চেতনা ও নৈতিক শক্তি। তবে তারা মনে করে এই চেতনা ও নৈতিকশক্তি শারীরিক শক্তির সাহাস্যেও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। কাজেই তারা অস্ত্রকে সাহস সঞ্চারের কাজে লাগাতে চায় এবং একথা অস্বীকার করা যায় না যে অস্ত্র হাতে পেলে অনেকেই সাহস অনুভব করে, এবং অস্ত্রহীন হয়ে পড়লে অনেকেই দুর্বল হয়ে যায়। কাজেই পৃথিবীর বিপ্লবীরা অস্ত্রের প্রয়োজন স্বীকার করেছিলেন, সাধারণের সাহস সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু গান্ধীজী মানুষকে অস্ত্র ছাড়াও সাহসী করা যায়, এমন ধরনের বিশ্বাস করতেন। অহিংসার একটা training বা শিক্ষানবিশী আছে। গঠনমূলক কাজ ও সত্যাগ্রহের মধ্য দিয়ে মানুষকে অহিংসার সাহস দেওয়া যায়, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস এবং সেভাবেই তিনি অহিংসার সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন এবং একথাও ঠিক, গান্ধীজী ভারতের আপামর জনসাধারণকে যতটা সাহসী হাতে শিখিয়ে গেছেন ততটা অন্যরা পারেনি। কিন্তু গান্ধীজীর এই দান শুধু অহিংসার সাহায্যেই একথা আমরা পূর্বেই দেখেছি, ঠিক নয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় জাগরণের নেতা হিসেবে তিনি সাহসের সৃষ্টি করেছিলেন—তবে তার মধ্যে একথাট ও স্বীকার করতে হবে যে ভারতীয় সংগ্রাম অহিংসার দ্বারা গঠিত না হলেও বিশেষভাবে প্রভাববাম্বিত।

এতক্ষণ এতো ভাবে সাহস কথাটার উপর এতো জোর দেওয়াতে কেউ যেন মনে না করেন, শুধু সাহসই বুঝি অহিংসা, এবং হিংসা ও অহিংসা যেহেতু উভয়েই সাহসের সাধনা করে তবে বুঝি তারা এক। তা কিন্তু নয়। হিংসার সাহস ও অহিংসার সাহসে পার্থক্য আছে—পার্থক্য আছে অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জীবন সম্বন্ধে ধারণা ও ব্যবহারের ভিন্নতা থেকে। অহিংসার মধ্যে সত্য, প্রেম ইত্যাদি যেসব মানসিক গুণ আছে, তাদের মোটেই তুচ্ছ করলে চলবে না। কিন্তু তাই বলে প্রেমই অহিংসার একমাত্র শক্তি, একথা মনে করলেও ভুল হবে। যেমন কেউ কেউ মনে করেন গান্ধীজীর বহু পূর্বে এই বাংলাদেশে অহিংসার ব্যবহার করে গেছেন শ্রীচৈতন্য। তিনি বিরুদ্ধবাদীদের প্রেমের সাহায্যে জয় করেছিলেন। কিন্তু চৈতন্য ও গান্ধীর প্রেমে ঢের পার্থক্য। গান্ধীজী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে লড়াই করেছিলেন—সেট ঠিক প্রেম বিতরণ নয়। রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রতিরোধ এনেছিলেন তিনি দেশে—লক্ষ লক্ষ সাধারণ, ম্রিয়মাণ জনতার বুকে সাহস ও আত্মসম্মানবোধ জাগিয়েছিলেন। গান্ধীজী ছিলেন একজন সেনাপতি—প্রেমপাগল বৈরাগী নন। যদিও গান্ধীজীর মধ্যে বৈষ্ণবসুলভ প্রেমের প্রভাব খুবই ছিল, যদিও গান্ধীজী একজন ভক্ত ছিলেন, কিন্তু তিনি শুধু তাই ছিলেন না। তিনি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠা যোদ্ধা বলে ইতিহাসে ঠাঁই পাবেন বা পেয়ে গেছেন। গান্ধীজীর প্রতিদিনকার জীবনের সাথে যাঁরাই সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরাই জানেন যে তিনি কত মধুর ব্যবহার করতেন, কত আন্তরিকতা ও সহৃদয়তা ছিল তাঁর প্রতি কাজে, শিশুর মতো সরলতা ছিল ও অফুরন্ত উৎসাহ দেবার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু এতদসত্ত্বেও মানুষ কখনো ভুল করতে পারতো না যে এই মৃদুভাষী, সুন্দর হৃদয়ের লোকটির ভিতর ভিসুভিয়াসের শক্তি পুঞ্জীভূত হয়ে আছে—mighty passions যাকে বলে, তা তাঁর বিশাল হৃদয়ে উত্তাল সমুদ্রের মতো নিঃশব্দ বিক্ষোভ সৃষ্টি করে চলেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই অনুভূতি নিয়ে সবাইকে ফিরতে হয়েছে। সকলেই বুঝতো যত হাসাহাসি, তামাসাই তিনি করুন, এই লোকটির মধ্যে অহরহ বিরাট এক শক্তি খেলা করে চলেছে। তাঁর কাছে বসলে মনে হতো যেন এক শান্ত সমুদ্রের কূলে বসা গেছে। অন্য কোন রকম হওয়াই সম্ভব নয়—কেন না সমস্ত ভারতের অপমানিত আত্মা তাঁর ভিতরে প্রকাশিত হয়েছে, অগণিত লোকের দুঃখ—বেদনা, আশা—আকাঙ্ক্ষা ঐ বক্ষে আলোচনা করে চলেছে। গান্ধীজী একজন ব্যক্তি ছিলেন না—তিনি ছিলেন ভারতবর্ষ। বহু বছরের সাধনা ও সেবার দ্বারা তিনি নিজেকে ভারতের আত্মার সাথে একাত্ম করতে পেরেছিলেন। কাজের ভারতের নির্যাতিত মানুষের প্রত্যেকটি অপমান, প্রতিটি দুঃখ, প্রতিটা আঘাত তাঁকে বিক্ষুব্ধ, বিচলিত করে তুলতো। এতো সিরিয়াস লোক কমই দেখা যায়। কেন না তাঁর দায়িত্বটাও সবার চেয়ে ছিল বেশি। দেশশুদ্ধ লোক তাঁকে মহাত্মা বলে জয়জয় করছে, লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর দর্শন পাবার জন্য ব্যাকুল—এসব তিনি মজার জিনিস বলে মনে করতেন। তিনি বুঝতেন, এর দায়িত্ব কত কঠিন, কত সাংঘাতিক। কাজের কত রাত্রি তাঁর বিনিদ্র কেটে গেছে, তার হিসেব নেই। উত্তেজনা, উদ্বেগে তাঁকে খুব ভুগতে হয়েছে, যদি তিনি গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ লোক হবার জন্য প্রতিদিন সাধনা করে এসেছিলেন। লোকের ধারণা হয়তো তাঁর রাগ ছিল না—কিন্তু তিনি ভয়ংকর রাগী ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর মনোবিক্ষোভ ফেটে পড়তে চাইতো, কিন্তু সাধারণ লোকের মতো তা চীৎকার, মুখবিকৃতি বা epileptic fit-এ শেষ হয়ে যেতে না। তিনি মহতী ভাবাবেগগুলিকে (mighty passions) সংযমের বাঁধনে বেঁধে উচ্চতম পথে নিয়ে যেতেন, যাকে শোধন বা sublimation বলা হয়। ক্ষণিকের বিস্ফোরণে বা দুর্ব্যবহারের মধ্যে ক্ষোভ ফুটে বোরোতে দিতেন না। যখন কোন কিছু করার নেই, যখন তাঁর মনে হয়েছে কোনও পথ পাছেন না, সংগ্রামের জন্য—তখন তিনি প্রায়ই অনশনের আশ্রয় নিতেন। তাঁর দুরন্ত বিক্ষোভে অনশনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে শান্ত সমাহিত রূপ গ্রহণ করতো। অতএব এই জাতীয় লোককে চৈতন্য, যীশু বা টলষ্টয়ের সাথে এক গোত্রের লোক বললে ভুল হবে—যদিও তাঁদের কোনো কোনো গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি একবার বলেছেন—‘‘But in life’s battle, there is such a thing as mute submission to many a wrong. If it is deliberate, in generates strength which, if the submission is well-conceived, may well become irresistible.’’ (Mahatma, Vol. V, page–375.) অর্থাৎ ”জীবন সংগ্রামে নানা রকমের সমস্যা মুখ বুঁজে অনেক ক্ষেত্রে সহ্য করতে যেতে হয়। কিন্তু যদি সে সহ্য করাটা স্বেচ্ছাকৃত ও সুনিশ্চিত হয় তবে তা একদিন দুর্দমনীয় শক্তিতে পরিণত হতে পারে।” একথা বলা যায় যে গান্ধীজীর সংযম তাঁকে অপরিসীম শক্তি যুগিয়েছিল। তিনি আর এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘Violence is exhibition of anger and any such exhibition is dissipation of valuable energy. Subduing one’s anger was storing up of national energy, which, when set free in an organised manner would produce astounding results.’’ (Young India—4.8.20—p. 126) ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হলো হিংসা এবং এই জাতীয় বহিঃপ্রকাশ মূল্যবান শক্তির অবচয় মাত্র। ক্রোধকে সংযত করা মানে জাতীয় শক্তি সঞ্চয় করা—এদিন সুশৃঙ্খল উপায়ে তার মুক্তি দিলে বিস্ময়কর ফল পাওয়া যাবে।” এইভাবে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি সঞ্চয় ও ব্যবহার করেছেন। তিনি ক্ষীণজীবী, স্বল্পজীবী লোক ছিলেন না। যেদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় এক শ্বেতাঙ্গ তাঁর ঘাড় ধরে রেলের কামরা থেকে বের করে দিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই তাঁর এই সংযমের শক্তি সঞ্চয় হতে থাকে যার শেষ পরিণাম দেখি ভারত থেকে সাম্রাজ্যবাদের প্রস্থানে। সেই ইংরেজ সেদিন গান্ধীজীকে প্রত্যক্ষভাবে অপমান করে সাম্রাজ্যবাদের পতনের বীজ পুঁতে দিয়েছিল, একথাও হয়তো ঐতিহাসিকরা বলতে পারেন। গান্ধীজীর জীবনে আবেগের স্থান যে কতো ছিল, নির্মলবাবুর বইতে (My Dasys with Gandhi) তার একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। তাঁর নীরবতাও যে কত ভয়ংকর ছিল, তা তাঁর সহকর্মীরা ও সরকার উভয়েই জানতেন। কিন্তু তাঁর এই সাহসিকতা ও বিদ্রোহী মনটাকে আরও একটা শক্তি নিয়ন্ত্রিত করতো—সে হলো তাঁর overriding love for mankind। মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম ভালবাসা—ফলে তাঁর নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য অহরহ সাধনা ছিল, ফলে তাঁর ক্রোধ কুৎসিৎ ও বীভৎস রূপ নিত না, তার শক্তি সুন্দর হয়ে ফুটে উঠতো।

তিনি বলেছেন, জীবনে তিনি অনেক বিষয়ে অনেকবার ভুল করেছেন, ভুল করেই তিনি শুব্ধ থেকে শুদ্ধতর পথে আসতে পেরেছেন, এখনও তিনি জানে না শুদ্ধতম পথ কী? অহিংসার মতো অদ্ভুত লড়াই—যা সম্পূর্ণ এক নতুন গবেষণা বা experiment–তাতেও ভুল হয়েছে অনেকবার—যেমন রাজকোটের জায়গীরদার ঠাকুরসাহেবের বিরুদ্ধে অনশন বেলায়। ঠাকুরসাহেবের প্রজাদের দাবি মানাবার জন্য তিনি বড়লাটের সাহায্য নিয়েছিলেন করে—একথার দুর্বলতা তিনি ছাড়া আর কেই বুঝতেই পারতেন না। তিনি বুঝলেন, অনশন—যা তাঁর শেষ অস্ত্র, তাকে এক্ষেত্রে তিনি কলুষিত করেছেন, যেন না ঠাকুরসাহেবকে জব্দ করতে তিনি বড়লাটের সাহায্য নিয়েছেন। নিজের ভুল বুঝে তক্ষণি প্রায়শ্চিত্তের জন্য বেশ কয়েকদিন আবার আত্মশুদ্ধির অনশন করেছিলেন। নিজের অপরাধকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করতেন না। যাই হোক, অহিংসা এভাবে নানা ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন হচ্ছে, এই ছিল তাঁর ধারণা। ভারতবর্ষ ও কংগ্রেস অহিংস হয়েছে, মোটামুটিভাবে এই ভ্রান্তিও তাঁর হয়েছিল। কিন্তু জীবনের শেষ কটি দিন তিনি দিনরাত শুধু এই আক্ষেপই করে গেছেন যে লোকেরা অহিংসার আড়ালে কাপুরুষতা বা নোংরা হিংসা পোষণ করতো। তিনি বুঝে গেছেন যাবার আগে, যে তাঁর আরও বেশি কড়া নজর রাখা উচিত ছিল, আরও কঠিন পরীক্ষা ও ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। সুবিধাবাদীদের সম্বন্ধে আরও বেশি হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিল। মৃত্যুর সময়ে তিনি মোটেই সুখী ছিলেন না—অনেক সময় আত্মবিশ্বাসও সন্দেহযুক্ত হয়ে উঠেছিল যে বুঝি বা অহিংসার কিছুই রইলো না। অতটা নৈরাশ্যবাদী হবার অবশ্য কোন কারণ ছিল না, কেন না অহিংসার শেষ দান তাঁর নিজের জীবন দানের ফলে অবস্থায় মোড় যে ঘুরে গিয়েছিল—সেকথা তো আর তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

ভুল হিসাবে আরও কয়েকটা উদাহরণ দিতে পারা যায়। তবে সেসব ভুল তিনি নিজেই স্বীকার করে গেছেন, আর পুনরাবৃত্তি করার দরকার নেই। আবার এমন ভুলও আছে যা তাঁর লক্ষ্যে পড়ে নি বা কেউ দেখিয়ে দেয় নি। আমরা একটা লেখার এমনি একটি ভুল দেখাতে চাই। হিটলারের আক্রমণের সামনে ফ্রান্স, পেঁতার নেতৃত্বে বিনা যুদ্ধেই হার মেনে নিল—পেতাঁর সেই বিশ্বাসঘাতকতাকে গান্ধীজী বুঝতে পারেন নি এবং অহিংসার উপর অতিরিক্ত আসক্তি থেকে অথবা হিংসাকে এড়াবার আগ্রহ থেকে তিনি ফ্রান্সকে এই গর্হিত কাজের জন্য প্রশংসা করে বসলেন। তিনি লিখলেন, The fall of France is enogh to my argument. I think the French statesman have shown rare courage in bowing to the inevitable and refusing to be a party to senseless mutual slaughter. There can be no sense in France coming out victorious, if the state in truth is lost. The cause of liberty becomes a mockery, if the price to be paid is wholesale destruction of those who are to enjoy liberty. It then becomes an intolerable situtation of ambition. The bravery of the French soldier is world-known. But the world knows also the quieter bravery of the French statesmen in suing for peace. I have assumed that the French statesmen have taken the step in a pefectly honourable manner, as behoves a true soldier. Let me hope that Herr Hitler will impose no humiliating terms but show that, though he can’t fight with mercy, he can at least conclude peace not without mercy.’’ (Mahatma, Vol. V, page 353)

”আমার যুক্তির সপক্ষে ফ্রান্সের পতন একটি দৃষ্টান্ত। আমার মতে ফ্রান্সের রাজনৈতিক নেতারা যা অবশ্যম্ভাবী তাকে স্বীকার করে নিয়ে ও বৃথা রক্তক্ষয় হতে না দিয়ে যে পরাজয় স্বীকার করেছেন, তাতে তাঁদের দুর্লভ সাহসেরই পরিচয় পাওয়া যায়। যদি সবই ধ্বংস হয়ে যায় তবে এই যুদ্ধে ফ্রান্সের জয়ী হয়ে আসার কোন অর্থ হয় না। মুক্তির কোন মানেই হয় না যদি মুক্তির জন্য লড়াইতে যারা মুক্তিকামী তাদের সকলেই ধ্বংস হয়ে যায়। তাহলে সেটা হবে গৌরবহীন দাম্ভিকতা মাত্র। ফরাসী সৈন্যদের বীরত্ব পৃথিবী বিখ্যাত। কিন্তু জগত জানুক যে ফরাসী নেতাদের শান্তির সাহস আর বীরত্বপূর্ণ। আমি অবশ্য এক্ষেত্রে ধরে নিয়েছি যে ফরাসী নেতারা সম্পূর্ণ সম্মানজনক সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই সন্ধি করেছেন—যা সকল খাঁটি সৈনিকেরাই করে থাকে। আমি আশাকরি হের হিটলার যুদ্ধের সময় করুণা দেখাতে না পারলেও, সন্ধির সময়ে সম্মানজনক শর্ত আরোপ করবেন না এবং তাঁর সন্ধি—সর্তে করুণার অভাব হবে না।” ১৭ই জুন, ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের পতন হয়, আর ১ই জুন তারিখের ‘হরিজনে’ তিনি না বুঝে—সুঝে এই জাতীয় একটা বিবৃতি দিয়ে বললেন। আমরা জানি, কোনও সম্মানজক সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পেতাঁ পরাজয় স্বীকার করেন নি। ভিশি সরকার একটি বিশ্বাসঘাতক সরকার ভিন্ন আর কিছুই নয় এবং কত কলংকময় তার ইতিহাস। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তো তারা করেই ছিল, সমগ্র গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। এই জাতীয় পতনকে প্রশংসা করার মধ্যে কোন কিছু যুক্তি ছিল না। এটা গান্ধীজীর একটা বিবেচনারহিত বিবৃতি বলে মানতে হবে। এই জাতীয় কথায় তাঁর অহিংসা ক্ষুণ্ণ হয় এবং অনেক রকমের সুবিধাবাদ এই জাতীয় বিবৃতির মধ্য দিয়ে গান্ধীবাদে প্রবেশ করে। যদি তিনি বলতেন, ফরাসীদেশ অস্ত্র ত্যাগ করেছে করুক, এখন তারা নিরস্ত্র অহিংসার লড়াইয়ের পথে আসুক, তবেই গান্ধীজীর মতো কথা হতো। নাহলে ওটা নেহাৎই impotent pacifism বা ক্লীব শান্তিবাদ হয় যা উনি চিরকাল ঘৃণা করে এসেছেন। গান্ধীজী অবশ্য ইংল্যান্ডকেও হিটলারের বিরুদ্ধে অস্ত্রের যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়ে জার্মান সৈন্যদের ইংল্যান্ডের বুকে ডেকে নিতে বলেছিলেন এবং তিনি নিজে সে সংগ্রামে অংশ নেবার প্রস্তাবনাও করেছিলেন, সেটা যতই অবাস্তব ও Utopian হোক, অন্ততঃ তার ভিতরে লজ্জাজনক নতিস্বীকারের বা সুবিদাবাদের ক্ষেত্র নেই। যে গান্ধীজী মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন বা do or die-এর মন্ত্রদাতা, তিনি ফরাসীদের জীবনের মায়ার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মোটেই যুক্তিযুক্তকাজ করেন নি। কাজেই দেখতে পাই, অহিংসার লড়াই যদি বিন্দুমাত্র ভুল হয় তবে তার ভিতর প্রচুর সুবিধাবাদ ঢুকে যেতে পারে। একমাত্র সহিংস সংগ্রামেই গলদ ঢোকে তা নয়, অহিংস সংগ্রামেও এইভাবেই নানা গলদ ও সুবিধাবাদ, এমন কি কাপুরুষতাও ঢুকে যেতে পারে—যার পরিণতরূপ গান্ধীজী শেষ জীবনে নিজেই লক্ষ্য করেছিলেন এবং অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

অহিংসা ও সত্যাগ্রহের নীতি বাস্তব সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের সমস্যা সম্মুখীন হয়। সর্বভারতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই সত্যাগ্রহ ও অহিংসানীতির প্রয়াস প্রচেষ্টা বলতে ১৯২০—২১ সাল, ১৯৩০—৩১—৩২ সাল ও ১৯৪২ সাল এই তিনটি কালকেই বোঝায়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত গান্ধীজীকে অহিংসা ও সত্যাগ্রহের অনেক ছোটখাট প্রয়োগ করতে দেখা যায়। তার মধ্যে কতগুলো আন্দোলনকে মোটামুটিভাবে বড়ই বলা যায়। তাছাড়া ব্যক্তিগত ব্যাপারেও এই সহকর্মীদের সংশোধনের ক্ষেত্রেও তাঁকে অহরহ ছোটখাট অনশন জাতীয় সত্যাগ্রহ করতে দেখা যায়। এগুলির সামরিক আলোচনা এবং বিশ্লেষণ প্রত্যেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা করে করা দরকার। এবং এইসব ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে সত্যাগ্রহ ও অহিংসার নির্ভুল প্রয়োগ সম্পর্কে গান্ধীজীকে অনেক রকম সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং কখনও কখনও তিনি ভুলও করেছেন এবং নিজের ভুলের জন্য আবার অনশন করে প্রায়শ্চিত্তও করেছেন। মোট কথা অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতির প্রয়োগ প্রত্যেক্ষ ক্ষেত্রে খুব সহজ হয়নি, এবং এই পথ আবিষ্কার করতে গান্ধীজীকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নানা আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে দেশ ভাগ করে ভারত স্বাধীন হবার সময়ে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তাতে কংগ্রেস অথবা অন্যান্য অহিংসা বিশ্বাসী ব্যক্তি ও সংগঠন যেভাবে সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজীর শেষপর্যন্ত এই প্রত্যয় হয় যে দেশে যে ধরনের অহিংসার প্রয়োগ হয়েছে এবং যে ধরনের লোক এই অহিংসা নীতি প্রয়োগ করতে গান্ধীজীকে অনুসরণ করেছিলেন, তাতে অনেক দূর্বলতা ছিল। তিনি সবলের অহিংসায় কি হতে পারে তারই অনুসন্ধানে নোয়াখালিতে নিজেকে বারে বারে প্রশ্ন করেন। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সবলের অহিংসা দিয়ে দেশকে শক্তিমান করতে পারেনি। এই হতাশা নিয়েই তাঁর একশত পঁচিশ বছর বাঁচবার ইচ্ছা তিনি ত্যাগ করেন। বলাবাহুল্য নাথুরাম গডসে তাঁর ইচ্ছাপূরণ করেছিলেন।

___

* এই কঠিন পরিস্থিতি অধিকতর পরিষ্কার করার চেষ্টা গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্র নামক অধ্যারে করা হয়েছে, যেখানে গান্ধীজি পথ এবং সুভাষচন্দ্রের পথের তুলনামূলক বিচারের প্রচেষ্টা আছে।

* ‘গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্র’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

** জওহরলালকে পরবর্তী নেতা বলে বলে দেওয়াটা গান্ধীজির অহিংসা বর্জন হলো, এমন বলা যায় না। হয়তো গান্ধীজির জীবনদর্শন ও সভ্যতা সম্বন্ধে ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, কিন্তু হিংসাবাসীদের সমর্থন করা হলো না। নেহেরুর নেতৃত্বে পঞ্চশীল, সহাবস্থান ও শান্তিনীতির প্রচেষ্টা দেখা যায়, যদিও আজ সেই পঞ্চশীল ও সহাবস্থাননীতি বিপন্ন তথাপি অহিংসা ও শান্তি ছাড়া যে মানুষের মুক্তি নেই সেই প্রত্যয়ও অনেক বেশি। কিন্তু যে ধরনের সভ্যতা অর্থাৎ বিকেন্দ্রিত স্বাবলম্বী অর্থনীতি ও সংযত জীবনচর্যা ভিন্ন ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে, রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকতে পারেন না, সেই বিশ্বব্যাপী প্রশ্ন আজ উপস্থিত আমাদের জন্যও এবং সকলের জন্যও। ”গান্ধী—গবেষণা” যখন ৩০ বছর পূর্বে সমাপ্ত করি, জেলখানায় তখন এসব বৃহত্তর ও গভীরতর সমস্যাগুলি পরিষ্কার হয়নি। ফলে জহরলাল সম্বন্ধে আমার সেদিনকার সমস্ত চিন্তা চেতনা ও বিচার আজকের কার্যক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সমর্থিত হননি। এ সম্বন্ধে ‘গান্ধী ও ইতিহাস’ অধ্যায়টি দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *