অস্পৃশ্যকে হরিজন বলায় গান্ধীর প্রবঞ্চনা ছিল না – হোসেনুর রহমান
যুগে যুগে রাষ্ট্র, ব্যক্তি, স্বাধীনতা, বুদ্ধিজীবী মহলে বিতর্কের বিষয় হয়েছে। ব্যক্তি ও শাস্ত্রী, ব্যক্তি ও প্রাধিকার (authority), ব্যক্তি ও নীতি পরায়ণতা এমন বিতর্কে প্রাধান্য পেয়েছে। আমাদের দেশে উনিশ শতকী বাংলায় এ সব প্রশ্ন বাঙালি তরুণদের যথেষ্ট পরিমাণে আক্রমণ করেছিল। নাটের গুরু ছিলেন ডিরোজিও। রাজা রামমোহন এই জীবন জিজ্ঞাসার প্রথম পুরোহিত। প্রথম সার্থক আধুনিক মানুষ। তিনি শাস্ত্র, সমাজ, ব্যক্তির, পরিবর্তন চাইলেন। উদ্দেশ্য আগামিকালের পৃথিবীতে ভারতীয়রা যেন মানুষের পরিচয় নিয়ে মানুষের গড়া শাস্ত্র ও সমাজের আমূল পরিবর্তন চাইতে পারে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এ কাজ আরম্ভ করলেন প্রবল বিক্রমে। বঙ্কিমচন্দ্র সূতীব্র এক ব্যক্তিত্ব — যিনি নিজেই এক অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠান। হিন্দু ধর্মের ও ব্যক্তির চূড়ান্ত সমালোচক। স্বাধীনতার প্রবল প্রবক্তা। রামকৃষ্ণ পরমহংস থেকে বিবেকানন্দ এ কাজ নতুন মাত্রা অর্জন করল। এখানে বলা সমীচীন যে রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দ শাস্ত্রী ও প্রচলিত সমাজকে আঘাত করলেন চুড়ান্ত। আজ অনেকেই মনে করেন যে রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দ গোঁড়া হিন্দুত্ববাদেরই আর এক নব প্রয়াস। এ ধারণা সর্বৈব ভ্রান্ত। জানি, যে কোন সাধু সম্প্রদায়কে কড়া নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গোঁড়া প্রকৃতির হতেই পারেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ—বিবেকানন্দ আন্দোলন বলতে আমি স্পষ্টত বুঝি সেবা, শিক্ষা এবং স্বাধীনতা। এবং সেবা বলতে বিবেকানন্দ মানবপ্রেম ও মানবসেবা বুঝতেন। গো—রক্ষা কিংবা গো—সেবা বুঝতেন না। জগতে যা যাঁরা প্রচলিত আনুষ্ঠানিক বিশ্বাস ও প্রাধিকারকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য চিরকাল চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকার মহাত্মা গান্ধী। তিনি স্পষ্টত আঘাত করেছেন শ্বেতাঙ্গ প্রাধিকারকে। আঘাত করেছেন আনুষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মকে, সমালোচনা করেছেন বর্ণ—হিন্দুর অস্পৃশ্যতাবোধকে! এবং সবকিছুই করেছেন আদর্শ হিন্দু, আদর্শ ভারতীয় হিসেবে। আমার কৈশোর—যৌবন যাদে নিয়ে কেটেছিল তাঁদের মধ্যে প্রথমে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ। এই সময় আর একজন মানুষ আমার কল্পনাকে পরাস্ত করেছিলেন, তিনি বাট্রান্ড রাসেল। এত বেশি করেছিলেন যে আশাভঙ্গের যন্ত্রণার মুহূর্তে রাসেল আমাকে নতুন করে আশাবীদ করেছেন। মুক্তি দিয়েছেন।
আজ রাসেল বেশি করে মনে পড়ছে। কারণ, আমি দেখতে পাচ্ছি, আজকের পৃথিবীতে রাসেলই একমাত্র পারফেক্ট। তিনি যথার্থ মহাপুরুষ আর সব সাধারণ। কেউ কেউ আবার কাপুরুষ। আজ দেশে গান্ধী—জিজ্ঞাসা প্রখর হচ্ছে। এতো ভালো কথা, প্রাণের লক্ষণ।
আমাদের দেশে বিশ্বাসপ্রবণতা এত বেশি যে যুক্তি—তর্ক শেষ পর্যন্ত শিথিল হয়ে আসে। আমরা বিগ্রহ পূজায় (বৃহত্তর অর্থে খৃশ্চান ও মুসলমান কিছু কম বিগ্রহবাদী নয়) গা ভাসিয়ে দিতে ভালবাসি। কারণ শান্তিপ্রিয় আমরা। কারণ, আমরা নিত্য জীবনের সুনিয়ন্ত্রিত নিরাপত্তা শৃঙ্খলমোচন করতে চাই না। বর্তমান অবস্থা ভাঙতে পারি না। আর পারি না বলেই মহাপুরুষের কিংবা ক্ষমতাবান, ঈশ্বরনামধারী সাধু বাবাজীদের প্রশ্ন করতে পারি না, সমালোচনা তো দূরের কথা। একটা দৃষ্টান্ত দিই। বাট্রান্ড রাসেল আজীবন গণতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। গণতন্ত্রে ব্যক্তি ও স্বাধীনতা যুক্তি ও বিজ্ঞান সার্থকরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত।
আবার সেই রাসেলই আমেরিকার সমালোচনা করেছেন অকপটে। বিশ্বাস করেছেন আমেরিকার গণতন্ত্র সর্বাঙ্গীণ সার্থক হতে পারেনি। সীমিত অর্থে সেখানে গণতন্ত্র আছে। ‘দ্য গ্রিপ অব কনফরমিটি’ শীর্ষক আলোচনা পঞ্চাশের দশকে ‘রাসেল বনাম আমেরিকায়’ পর্যবসিত হয়। রাসেল বার বার বলেছেন ‘দ্য বেস্ট আনসার টু ফ্যানাটিসিজম — লিবারালিজম’। তিনি ম্যাকার্থিবাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারণ ম্যাকার্থিবাদীরা ‘সিভিল লিবার্টিজ’কে আঘাত করেছে অহরহ। রাসেল এই বিতর্কে পরিষ্কার করে বললেন এ জীবনে সার্থকতার জন্যে ধর্মকর্ম চাই না, চাই স্পষ্ট কতগুলো নৈতিক সূত্র। এই সূত্রের প্রথম ও প্রধান হচ্ছে অন্যের অথরিটির প্রতি কোন শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও মৈত্রী রক্ষার জন্যে চাই বিভিন্ন বিশেষ স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকা। আর এই দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ সময় অযৌত্তিক শত্রুতা থেকে জন্ম নেয়। রাসেল সারা জীবন ব্যক্তিত্বেক বিকাশের জন্যে, ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানের অবসানের জন্যে, বিজ্ঞান ও দর্শনের জন্যে প্রাণপাত করেছিলেন।
এই স্বল্প রাসেল আলোচনার একটাই যুক্তি। সাম্প্রতিক কালে আমরা বড় বেশি পরিমাণে এক পথের মাহাত্ম্য গান করতে ভালবেসেছি। ‘বহুমত বহুপথ’ জীবনে ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করতে শিখিনি। আজ গান্ধী সমালোচনা হচ্ছে চারিদিকে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু আগে গান্ধী আলোচনা হলে পরে সমালোচনা যথার্থ গঠনমূলক হতে পারত। আর ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে সেটাই ছিল মঙ্গল। কারণ দুটো মতে সংঘর্ষ ভাল। দুটো মনের সংঘর্ষ ভাল নয়। আমি গান্ধী দর্শন পছন্দ করি, তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করি। বিশ্বাস করি তিনি অনেক ভুলত্রুটি এবং অসঙ্গতি পেরিয়ে তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তেমন আর কোন বিশ্ব ব্যক্তিত্ব পারেননি। রাসেলকে অনেক সময়ই গ্রেট ব্রিটেনের তথা সমগ্র পশ্চিমে ইউরোপের গান্ধী বলতে পারা যায়। তিনি অত্যন্ত বেশি পরিমাণে বুদ্ধি ও যুক্তির ওপর নির্ভর করেছেন। গান্ধী যুক্তিনিষ্ঠ মানুষ কিন্তু রাসেলের মত কট্টর বিজ্ঞানবাদী ও নিরীশ্বরবাদী ছিলেন না। যুক্তি ও বৃদ্ধির প্রয়োগের মাত্রাজ্ঞান নাকি রাসেলের থাকত না। তবু আমি রাসেলের একান্ত ভক্ত। আমার বিশ্বাস, ধর্ম ও রাষ্ট্রের সমালোচনায় কোন কোন সময় আপোষহীন, কাণ্ডহীন, ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতেই পারেন রাসেলের মত মানুষ। আর তাইতেই মানবজাতির কল্যাণ। কিন্তু আমি বহু ক্ষেত্রেই একম অদ্বিতীয়ম জ্ঞান করেছি। তিনি সারাজীবন গীতা অথবা তুলসীদাসের রামায়ণের দ্বারা চালিত হয়েছেন। ঈশ্বর বলতে সত্য ও ন্যায়পরাণতা (Righteousness) বুঝেছেন। যথার্থ ধর্ম ও যথার্থ নৈতিকতা এক ও অভিন্ন এই বিশ্বাস তাঁকে সারাজীবন সমৃদ্ধ করেছে। গান্ধীর ব্যক্তিগত মত, সমস্ত ধর্মই সত্য। সব ধর্মেই অল্পবিস্তর ভুল—ভ্রান্তি আছে। সব ধর্মই আমাদের কাছে ততটাই প্রিয়তটা আমার নিজের ধর্ম। তাই ধর্মান্তরণ আমার কল্পনা বহির্ভূত। হিন্দু ভাল হিন্দু হোক, মুসলমান ভাল মুসলমান হোক। এই হল গান্ধীর মত। এখানে রাসেল বলবেন দু’জনই ভাল মানুষ হোন। এবং আমি রাসেলের মত সমর্থন করি। ধর্ম সম্পর্কে গান্ধীর স্পর্শকাররতা আমি পছন্দ করিনি কোনদিন। এবং ধর্মকে উপযুক্ত শাস্ত্র জ্ঞান করে তা পৃথিবীতে বহু বড়মানুষই প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। গান্ধীও ব্যতিক্রম নন। এখানে গান্ধীর মর্মবেদনা বুঝি। কিন্তু তাঁকে সমর্থন করি না। এত কিছু বলার পরও গান্ধীপ্রেম আমার কমেনি। কারণ, ভারতবর্ষকে ভেতর থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতে সাম্প্রতিককালে আর কেউ তেমন করে চাননি যেমন করে তিনি চেয়েছেন। তিনি একটি শান্ত—বিপ্লব সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। হিংসা, রক্তপাত, প্রতিহিংসা— এ সব অস্ত্র তিনি পরিহার করেছেন মনে প্রাণে। গান্ধীর প্রাণে রসের ধারা ছিল অফুরন্ত। ঠাট্টা করে প্রায়ই বলতেন বিপ্লবে তিনি বিশ্বাস করেন না। কারণ, বড় বেশি খরচা। পড়তায় পোষাবে না। এমন বিপ্লবে জীবন, অর্থ ও মূল্যবোধ— এ সব কিছুর মূল্যহ্রাস এতই হয় যে মানুষই যায় হারিয়ে, বড় হয়ে ওঠে কোন একটা তন্ত্র। তা ধর্ম হতে পারে, রাষ্ট্র হতে পারে। এমনকি ব্যক্তিও হতে পারে। গান্ধী বিপ্লবের পথে না গিয়ে ক্রমিক, স্বাভাবিক, উদ্বোধন, উত্তরণের পথ বেছে নিলেন। আত্মশক্তিই হল মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়। সেই জাগরণের জন্য মানুষকে তিনি প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। মানুষের অখণ্ড চৈতন্যকে গান্ধী জ্যোতির্ময় পরম—শক্তি বলে জেনেছেন। মানুষের খণ্ডিত রূপ, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, বিচ্ছিন্ন সম্পর্ক তাঁকে বেদনার্ত করেছে। অস্পৃশ্য হিন্দু কিংবা দূরবর্তী মুসলমান তাঁকে সব সময় পীড়িত করেছে। তিনি বিচ্ছিন্ন মানবসমাজকে এক মানবজাতি রূপে দেখতে চেয়েছেন। এখানে তিনি নমস্য, অন্য কোন সর্বভারতীয় নেতা তাঁর সমগোত্রীয় নন। জিন্না বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন। সৎ, নির্ভীক, সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তিনি কেবলমাত্র ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বড় অংশের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন। এবং তিনি যতটা বাইরে থেকে আধুনিক ছিলেন ততটাই ভেতর থেকে মৌলবাদী ছিলেন। এবং তিনি যতটা বাইরে থেকে আধুনিক ছিলেন ততটাই ভেতর থেকে মৌলবাদী ছিলেন। কারণ ভারতবর্ষের ইতিহাসে ধর্ম ও সম্প্রদায়কে আর কেউ ইতিপূর্বে এমন করে ব্যবহার করতে পারেননি। কোন কোন হিন্দু নেতা সাম্প্রদায়িক দল তৈরি করে তা করতে চাননি তা বলা যাবে না। কিন্তু ওই গান্ধীকে, তিনি একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। গুজরাট থেকে বিহার, রাজস্থান থেকে উত্তরপ্রদেশ গান্ধী হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ঘন জমিন ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদ গান্ধীর জন্যে সর্বভারতীয় স্তরে দানা বাঁধতে পারল না। আজ গান্ধীহীন ভারতবর্ষে তা বেশ ভাল করে বোঝা যাচ্ছে। অতীতে অবিভক্ত বঙ্গদেশও আজ পশ্চিমবঙ্গের ছবি ভিন্ন। কারণ রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ। কারণ বাঙালির উনিশ শতকের ঐতিহ্য।
গান্ধীকে নৃবিজ্ঞানী নির্মলকুমার বসু প্রশ্ন করেছিলেন : কংগ্রেসের অস্পৃশ্যতা অবসানের কর্মসূচীতে অস্পৃশ্যদের সঙ্গে বসে বর্ণ—হিন্দুদের আহারাদির এবং তাদের সঙ্গে বিবাহদির কী কোন চিন্তা করা হয়েছে।
গান্ধীর উত্তর, আমি যতদূর কংগ্রেসিদের মনের কথা জানি তাতে আজ হরিজনদের সঙ্গে খানা খেতে তাদের কোন আপত্তি নেই। আমার নিজের কথা, আমি বলেছি আমাদের সবাইকে হরিজন হতে হবে, নইলে অস্পৃশ্যতার এ দাগ মুছে যাবার নয়। আমি বিবাহে ইচ্ছুক এমন ছেলে মেয়েদের বলেছি সেবাগ্রাম আশ্রমে তোমাদের বিবাহ তখনই সম্ভব যখন দু’জনের মধ্যে একজন হরিজন হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন বিবাহে তেমন সত্যকারের কোন বাধা নেই। আসলে যা দরকার তা হল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
অস্পৃশতা সম্বন্ধে গান্ধী সারাজীবন লিখেছেন, বলেছেন। হিন্দু ধর্ম অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদন করে পাপ করেছে। এই পাপ আমাদের অধঃপতিত করেছে, পারিয়ায় পরিণত করেছে। এমন কি মুসলমানরাও এই সংক্রামক ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গান্ধী একথাও বলেছেন ১৯৪৭ সালে : অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের কেবল অংশ বিশেষ নয়, তাকে প্লেগ বলতে হয়। প্রতিটি হিন্দুর নৈতিক কর্তব্য এই ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে তাকে দূর করা। অস্পৃশ্যতা লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। হিন্দু সমাজের মূল ব্যধি থেকে গান্ধী বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। পতিত, দূর্বল, নির্ধন নর—নারীকে সমাজে অর্থবান কী চোখে দেখেন তা গান্ধী স্বচক্ষে দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি বলেছেন অস্পৃশ্যতা অবসানের অর্থ হচ্ছে চারপাশের সকল মানুষের জন্যে ভালবাসা এবং সেরা। এবং তা সম্ভব হলেই অহিংসার সূচনা হবে। সেই অহিংসা সমস্ত জাতের মানুষের কল্যাণ করবে।
গান্ধীকে একথাও প্রশ্ন আকারে বলা হয়েছিল : বর্ণ—হিন্দু কী করে হরিজনদের দুঃখ মোচন করতে পারে। তারা কী করে হরিজনদের এই এতদিনের যন্ত্রণা, অত্যাচার, অপমান নিজেদের অভিজ্ঞতার অন্তর্গত করবে? সেক্ষেত্রে হরিজনদের দায়িত্ব দেওয়াই কি ভাল নয়— তারা নিজেরা নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তাদের উন্নতি কোন পথে আসবে তারা নিজেরাই ভাল বুঝবে।
এর উত্তরে গান্ধী বলেছিলেন : বর্ণ—হিন্দুদের একটা দায়িত্ব আছে— তথাকথিত অস্পৃশ্যদের প্রতি। বর্ণ—হিন্দুকে ভাঙ্গিতে পরিণত হতে হবে — কথা ও কাজে। এ কাজ যে দিন সম্ভব হবে সেদিন তথাকথিত অস্পৃশ্য এক মুহূর্তে সমাজে নিজের জায়গাটি পেয়ে যাবে এবং হিন্দুধর্ম পৃথিবীর কাছে একটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ওই এক কথা। মানুষের রূপান্তর চেয়েছেন গান্ধী। ছোটখাটো মেরামতিতে বিশ্বাস করেননি। মানুষ যা আছে তাতে পৃথিবীর মঙ্গল হচ্ছে না। এবং হবারও নয়। ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন সেখানে সত্যিকারের ভাঙ্গি হল engineers and sanitarians । ভারতবর্ষে তা সম্ভব নয় যতক্ষণ না সমাজের মৃতবৎ, অচলাবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে।
গান্ধীকে আমরা কোনদিন বুঝতে চেষ্টা করিনি। জাতির জনক বলে পুজো করেছি নিশ্চয়ই। কিন্তু তিনি কী চেয়েছেন আমাদের কাছে। এই জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছেন। মানুষের মনের পরিবর্তন চেয়েছেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে হিংসার নৈরাজ্যের প্রাণহীন প্রতিযোগিতার অবসান চেয়েছেন। ধনীর ধনের অহঙ্কারের অবসান চেয়েছেন। উৎপাদনের কথা উঠলেই সমবন্টনের প্রস্তাব করেছেন। ধর্মের প্রশ্ন উঠলে সত্য তাঁর একমাত্র ঈশ্বর বার বার ঘোষণা করেছেন। যে ধর্মে মানুষের কল্যাণ নেই সে ধর্ম তাঁর হতে পারে না। শিক্ষার কথা উঠলেই ‘জাতীয় শিক্ষা’ তিনি চেয়েছেন। বিদেশী—কালচার নির্ভর ইংরেজি শিক্ষা আমাদের কোন হিতসাধন করতে পারে না। এই ছিল গান্ধীর আজীবনের বিশ্বাস। সেই শিক্ষা সম্পূর্ণ শিক্ষা যে শিক্ষায় হাতের, হৃদয়ের এবং মস্তিষ্কের চর্চা হবে সমান পরিমাণ। যে শিক্ষা মানুষকেমানুষের কাছে নিয়ে যাবে, যে শিক্ষা পৃথিবীকে কাছে আনবে কিন্তু নিজেকে বিভ্রান্ত করবে না। গান্ধী ভাঙ্গি কুলোনিতে বাস করেছেন রাজনৈতিক মর্যাদা লাভের জন্যে নয়। আমাদের সকলের চিত্তশুদ্ধির জন্যে, চৈতন্যের জন্যে, মুক্তির জন্যে। এবং অস্পৃশ্য মানবসন্তানকে হরিজন বলে গান্ধী কাছে টেনে নিয়েছেন ভারতবর্ষ একদিন বৃহৎ মহাভারত হবে এই স্বপ্ন দেখেছেন বলে। গান্ধীর ঈশ্বর এই ‘হরিজন’ ভবিষ্যতে একদিন আমাদের সদগতি করবেন। এই বিশ্বাস গান্ধীর ছিল। এর মধ্যে আর অন্য কোন প্রবঞ্চনা ছিল না।